৫
বিকেল সওয়া পাঁচটায় বি-বা-দী বাগের একদিকে মিনিবাসগুলোর সামনে লম্বা লম্বা লাইন পড়েছে। আজ আকাশে বেশ ভারি ধরনের মেঘ। কদিন ধরেই মেঘলা আকাশ খুব খেলা দেখাচ্ছে। বৃষ্টি নামবে নামবে করেও নামছে না। গরমে একেবারে অতিষ্ঠ হবার মতন অবস্থা। রাস্তার সবাই মাঝে মাঝে আকাশের দিকে চাইছে। আর কয়েকদিন পর এইসব লোকই বলবে, ওঃ বৃষ্টির জ্বালায় আর পারা যাচ্ছে না! কলকাতায় এত বৃষ্টির কী দরকার, কলকাতায় কি ধান চাষ হয়?
মিশন রো-র একপাশে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে লালুদা আমাকে নিয়ে হেঁটে এলো স্টিফেন হাউসের সামনে।
একটা ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে লালুদা বলল, এই তো, এসে গেছে! তুমি বাঁ দিক থেকে মিনিবাসগুলো দ্যাখো, এক-দুই-তিন-চার, চার নম্বর মিনিবাসটার সামনে যে লাইনটা পড়েছে, তাতে তুমি প্রথম থেকে লোকগুলোকে গুণে যাও, এক-দুই-তিন…চোদ্দ-পনেরো-সতেরো, হ্যাঁ, ঐ সতেরো নম্বরের লম্বামতন, আকাশী রঙের শাড়ি পরা মেয়েটি, দ্যাট ইজ দা গার্ল!
আমি বললুম, মেয়েটি তো এক্ষুনি বাসে উঠে যাবে, তখন আমি কী করব?
—তুমিও ঐ বাসে উঠবে।
—তারপর?
—তারপর তুমি যা ভালো বুঝবে, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা, সব কি আর বলে দেওয়া যায়? তুমি যদি ওর সঙ্গে ভাব জমাতে পার, মানে বেশ একটা মাখো মাখো ভাব, বেশ তোমার সঙ্গে ভিক্টোরিয়ায় বেড়াতে যাবে, ব্যাস—তা হলেই কাজ হয়ে যাবে। আমার ক্যামেরায় একখানা ছবি তুলে নেব, তারপর সেটা পাঠিয়ে দেব চন্দনের কাছে।
—আর আমি যদি মার খাই?
—মার খাবে? কে মারবে?
—মেয়েটার পাড়ার ছেলেরা মারতে পারে। চন্দনদা মারতে পারে।
—চন্দন মারবে? তুমি চন্দনকে চেনো না? ওর মধ্যে ভায়োলেন্স একদম নেই। ও মনের দুঃখে কয়েকদিন কাঁদবে, তারপর নীপার কাছে এসে ক্ষমা চাইবে।—লালুদা, আমি পারব বলে মনে হচ্ছে না। মেয়েটি আমাকে পাত্তা দেবে কেন?
—আরে, নীলমাধব, তুমি একটা ইয়াংম্যান, বেকার, তুমি একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে পারবে না! বেকারদের পক্ষে প্রেম করাই তো সবচেয়ে সহজ কাজ। যাও, আর দেরি করো না, বাস ছেড়ে দেবে।
—মেয়েটির নাম কী?
-ওর নাম, ওর নাম, ইয়ে, হ্যাঁ, বেনু।
—নামটা ঠিক বলছেন তো?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেনুই তো। বেনু দাশগুপ্ত। দাঁড়াও-দাঁড়াও, নামটা ঠিক যেন শোনাচ্ছে না। স্যরি, বেনু নয়, রেণু।
–এই রে, আপনি আমাকে ভুল নাম শেখাচ্ছিলেন।
—বেনু আর রেণু। মাত্র একটা ফুটকির তো মোটে তফাৎ, ঐটুকু মোটে ভুলে গেসলুম।
—একটা ফুটকির জন্য অনেক মানে বদলে যায়। যার নাম রেণু, সে কখনো বেনু নামটা পছন্দ করবে না।
—একটা ফুটকি নিয়ে এরকম বাড়াবাড়ি করা কি ভালো? বাংলাভাষাটা কি যাচ্ছেতাই বলো তো! আর হ্যাঁ, দাশগুপ্ত না, সেনগুপ্ত।
—আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, লালুদা, আমার বদলে আপনি ঐ মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করবার চেষ্টা করছেন না কেন? আমার চেয়ে আপনি অনেক ভালো পারবেন। আপনার সব বাড়িতে অবারিত গতি।
-আমার একটু অসুবিধে আছে, বুঝলে নীলকান্ত। মেয়েটি আমাকে চেনে।—তার মানে আপনিও মেয়েটিকে চেনেন? সেটা আবার অসুবিধে হবে কেন? ওকে চেনেন যখন, অনায়াসে ওর বাড়িতে আপনি যেতে পারবেন। আমার তো সে স্কোপ নেই।
—চন্দনের সঙ্গে ঐ বেনুর আমিই আলাপ করিয়ে দিয়েছি।
—বেনু না রেণু, ঠিক করে বলুন!
–না, না, রেণু, ডেফিনিটলি রেণু, ইনফ্যাকট, ও আমার ভাগ্নী হয়। আপন নয় যদিও, একটু দূর সম্পর্কের, তবু আমার ভাগ্নী তো বটে!
—আপনার ভাগ্নী? তা হলে আপনি সোজাসুজি ওর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেই তো পারেন।
—তোমার সঙ্গে একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক আলাপ করানোটা, বুঝলে, তা হলে আমাকে দোষের ভাগী হতে হয়। ধরো, তোমার সঙ্গে যদি ওর প্রেম হয়েই যায়, তুমি ওকে নিয়ে, মানে, তখন আমার দিদি বলবে, হ্যাঁরে, লালু, তুই জেনেশুনে একটা বেকার বাউণ্ডুলে ছেলের সঙ্গে আমার মেয়েটাকে ভেড়ালি? অলরেডি চন্দনের ব্যাপারে দিদি আমার ওপর বিরক্ত হয়ে আছে।
—লালুদা, আমার সম্পর্কে আপনার ধারণা খুব একটা উঁচু নয়, তা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনার ভাগ্নীই বা চন্দনদার বদলে আমাকে পাত্তা দেবে কেন?—ট্রাই করো, ট্রাই করো, বেশি দূর এগোতে না পারলেও, যদি কোনোক্রমে একদিন ভিক্টোরিয়ায় নিয়ে গিয়ে ছবিটা তুলিয়ে ফেলতে পারো, ঐ দ্যাখো বাসের ড্রাইভার উঠে পড়েছে, আর দেরি করো না। আমাকেও সিনেমায় যেতে হবে, টাইম হয়ে গেল।
—আপনি এখন একা একা সিনেমা দেখবেন?
—একা নয়। একা সিনেমা আমি জীবনে দেখিনি। নীপাকে নিয়ে যাচ্ছি, বেচারা মনমরা হয়ে থাকে দিনের পর দিন, তাই ওকে একটু সঙ্গ দেওয়া।
লালুদা পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে একটা একশো টাকার নোট তুলে বলল, এটা তোমার কাছে রাখো, খরচ-খর্চা আছে। যাও-যাও, দৌড়ে যাও।
লালুদা প্রায় আমাকে ঠেলেই রাস্তায় নামিয়ে দিল।
আমি দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালুম চতুর্থ মিনিবাসটির লাইনে।
বাসটি গজরাতে শুরু করেছে। এখন আর মিনিবাসে মাথা গুণে লোক তোলে না, ভেতরটা ঠাসাঠাসি হবার পর ড্রাইভার বাসটিকে একটা ঝাঁকুনি দেয়, যাতে আরও দু’চারজনের দাঁড়াবার জায়গা হতে পারে।
আমাকেও দাঁড়াতেই হলো। তার ফলে একটা সুবিধে হলো এই যে আমি মেয়েটির কাছাকাছি চলে আসতে পারলুম অন্যদের ঠেলেঠুলে। মেয়েটির চেহারায় সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হলো তার সাজসজ্জায় উদাসীনতা। একটা লাল রঙের ব্লাউজ আর হালকা নীল রঙের শাড়ি পরেছে, এ ছাড়া তার কানে দুল নেই, হাত দুটি একেবারে যাকে বলে নগ্ন নির্জন, গলায় কিছু নেই। টিপ নেই, লিপস্টিক মাখেনি, কিচ্ছু না। চুল খোলা। মুখখানি নিমগ্ন ধরনের। সে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, অথচ কিছুই দেখছে না মনে হয়।
এই মিনিবাসটা যাবে বেহালার দিকে। মেয়েটি জানলার ধারে সীট পায়নি, পাশের দিকে বসেছে। কিছু লোক এইসব জায়গায় বাধ্য হয়েই মেয়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, মেয়েটি সরে যাবার চেষ্টাও করছে না, কোনো লোকের দিকে তাকিয়ে ভূভঙ্গিও করছে না। তার এই স্বাভাবিক ব্যবহারটা আমার ভালো লাগল। মেয়েটি কতদূর যাবে, একেবারে বেহালা পর্যন্ত?
কণ্ডাক্টর এসে টিকিট চাইতে মেয়েটি একটি দু টাকার নোট বার করে বলল, দেড় টাকা। আমি দেখলুম, তার আঙুলগুলো লম্বা ধরনের, ঝকঝকে, তার গলার আওয়াজটিও জড়তাহীন। এর নাম রেণু সেনগুপ্ত না হলেও আশ্চর্য কিছু নেই। লালুদাকে বিশ্বাস করা যায় না।
মেয়েটির মুখখানার দিকে তাকাতে তাকাতে কেন যেন মনে হচ্ছে, একে আমি আগে কোথাও দেখেছি। কোথায়? না, এর সঙ্গে আমার কখনো আলাপ হয়নি। চন্দনদাদের বাড়িতেও দেখিনি। তবে? এর ছবি দেখেছি কোথাও? সিনেমার অভিনেত্রী হতে পারে না, তাহলে লাইনে দাঁড়িয়ে মিনিবাসে উঠবে কেন? মুখখানা পরিচিত অন্য কারুর মতন?
আমি টিকিট কাটলুম আশি পয়সার।
রেণু তার হ্যাণ্ডব্যাগ খুলে একটা বই বার করল। আমি সিটের পেছন থেকে উঁকি মেরে বইয়ের নামটা দেখে নিলুম। উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘মণিমহেশ’।
বাসটা কার্জন পার্ক পার হয়ে ছুটছে রেড রোড ধরে। বেশ জোরে একবার বিদ্যুৎ চমকালো, তারপর দিগন্ত কাঁপিয়ে বাজের আওয়াজ। আজ বেশ সমারোহ করেই বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। আমার মনটা এত ফুরফুরে লাগছে কেন? কিসের জন্য মন ভালো হয়ে গেল?
রেড রোড থেকে মিনিবাসটা যেখানে বাঁক নেবে, সেখানে একবার লোক তোলার জন্য থামতেই আমি জোরজার করে নেমে পড়লুম।
আমার যা দেখার ছিল দেখা হয়ে গেছে। আমি একটি অচেনা মেয়েকে ফলো করে বেহালা পর্যন্ত যাব, পাগল নাকি? বেপাড়ায় গিয়ে প্রেম! বেহালার ছেলেরা আমার পিঠের চামড়া তুলে নেবে না? একটা সুন্দর চেহারার অহংকারী মেয়ের পেছন পেছন গেলুম, অমনি তার সঙ্গে প্রেম হয়ে গেল, তারপর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ঝোপের আড়ালে গলা জড়িয়ে নাচ আর গান, আড়াল থেকে লালুদা ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলবে, এ কী হিন্দি সিনেমা নাকি? দৃশ্যটা ভাবতেই আমার গা গুলিয়ে উঠছে।
বুক পকেটটা দুবার চাপড়ালুম। একটা একশো টাকার নোট পাওয়া গেছে, এটাই লাভ! বর্বরস্য ধনং ক্ষয়ম! লালুদার গ্যাস সিলিণ্ডারের ব্যবসা। পকেট থেকে ফটাফট একশো টাকার নোট বার করতে পারে। গ্যাসের টাকা।
লালুদা নীপাবৌদিকে নিয়ে সিনেমায় যায় কেন, সেটাই বরং ভেবে দেখা দরকার। না, কোনো বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে এক-আধবার সিনেমা দেখতে যাওয়া দোষের কিছু নয়, কিন্তু লালুদা কি চন্দনদার বন্ধু? লালুদা নীপাবৌদির বাপের বাড়ির সম্পর্কে চেনা।
একটা বিকট আওয়াজ হলো খানিকটা দূরে, না বজ্রপতন নয়। অন্যরকম। বেশ বড় ধরনের অ্যাকসিডেন্ট। মিনিবাসটা বাঁক নিয়েই একটা মিলিটারি ট্রাকের মুখোমুখি পড়ে গেছে। হেড অন কলিশান না হয়ে দুটোই শেষ মুহূর্তে ঘুরে গেছে দু’ দিকে। মিনিবাসটা ধাক্কা মেরেছে একটা গাছ, আর ট্রাকটা ঢুকেছে একটা ট্রামের ঠিক মাঝখানে গেল।
সেদিকে এক ঝলক তাকাতেই আমার মনে পরপর দুটো চিন্তা ঢেউ খেলে
আমি কী করে বেঁচে গেলাম? লালুদার কথামতন সত্যি সত্যি বেহালা যাবার চেষ্টা করলে ঐ বাসে আমিও এতক্ষণে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে…
ঐ মেয়েটি মরে গেছে? তা হলেই তো সব সমস্যার মীমাংসা হয়ে যায়। তৃতীয়জন সরে গেলেই চন্দনদা আর নীপাবৌদি কাছাকাছি চলে আসতে পারে….
দ্বিতীয় চিন্তার মাঝপথে থমকে গিয়ে আমার নিজের নাকে একটা ঘঁষি কষাতে ইচ্ছে হলো। অ্যাঁ, আমি ঐ মেয়েটির মৃত্যু কামনা করছি? ছিঃ, নীললোহিত ছিঃ, তোমার থুতু ফেলে তাতে ডুবে মরা উচিত। ঐ ছিমছাম, ব্যক্তিত্বময়ী যুবতীটি কী দোষ করেছে? সে যদি চন্দনদার সঙ্গে প্রেম করেও থাকে, প্রেম কি একটা সাঙ্ঘাতিক অপরাধ? বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে পৃথিবীতে আগে কি কেউ কখনো প্রেম করেনি? প্রেম কি হিসেব করে, মেপেজুপে হয়? তা ছাড়া সত্যি সত্যি সেরকম কিছু হলে, তাতে চন্দনদারও দায়িত্ব কম নয়। ঐ মেয়েটি কেন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে?
রাস্তায় বিরাট একটা হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে, বহু লোক ছুটে যাচ্ছে দুর্ঘটনাস্থলে। আমি কোনোদিন এইসব হুজুগে যাই না, রাস্তায় যে-কোনো ছোটোখাটো দুর্ঘটনা চোখে পড়ে গেলেও তক্ষুনি মুখ ফিরিয়ে নিই, সেদিকে হাঁটি না পর্যন্ত। আজ একটা দৌড় লাগালুম মিনিবাসটার দিকে।
একে বলা যেতে পারে বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া!
মিনিবাস ও মিলিটারি ট্রাকের প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষার শব্দ, তারপর দু জায়গায় দুখানা ধাক্কা ও লোকজনের আর্তরব, সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল একটা প্রলয়ংকারী ব্যাপার ঘটে গেল বুঝি। আসলে দুটি ড্রাইভারই খুব দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের বাঁচিয়েছে। মিনিবাসটি একটা জারুল গাছে ধাক্কা খেয়ে নাক ভেঙেছে বটে, কিন্তু ভেতরের লোকজন সব অক্ষত। মাথায় একটু গুঁতো-ছুঁতো লেগেছে হয়তো। ড্রাইভারটি লাফিয়ে নেমে এসেছে নীচে।
মিনিবাসটার খানিকটা ক্ষতি হয়েছে। ফুটো হয়ে গেছে রেডিয়েটার, ইঞ্জিন স্টার্ট নিচ্ছে না। বাস খালি করে মাটিতে দাঁড়িয়ে গুঞ্জন করছে যাত্রী—যাত্রিণীরা। সেই দীর্ঘকায়া মেয়েটি সরে দাঁড়িয়েছে একটু দূরে, পাহাড়ের ভ্রমণ কাহিনীটির মধ্যে আঙুল গোঁজা, যেন এক্ষুনি আবার সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বইটা পড়তে শুরু করবে।
এই মুখ আগে কোথায় দেখেছি? কোথায় দেখেছি? টিভিতে? খবরের কাগজে? কোনো ট্রেনের কামরায় অনেকক্ষণ একসঙ্গে গেছি?
আমি তার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও সে আমাকে লক্ষ করল না।
কোনো মানুষের মৃত্যুচিন্তা করলেই সে মরে না। হয়তো তাতে আরও আয়ু বেড়ে যায়। আমি একটা সাধারণ, এলেবেলে মানুষ। আমার শুভেচ্ছারও বিশেষ দাম নেই। তবু আমি মনে মনে বললুম, হে তরুণী, তুমি আগামী শতাব্দীর মধ্যকাল পর্যন্ত অন্তত এই পৃথিবীতে থাকো। তুমি একটা পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িও!
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। এবার কি এতগুলো লোক মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিজবে? ওদিকে মিলিটারি লরিটা একটুও ঘায়েল হয়নি, ট্রামটিই তুবড়ে গেছে কিছুটা, দুটোই দিব্যি আবার চলতে শুরু করল। একটিও হতাহত নেই। এই দুর্ঘটনার কথা কালকের কাগজেও বেরুবে না।
আর একটি মিনিবাস এসে পড়তেই এ বাসের যাত্রীরা হৈ হৈ করে দাঁড়িয়ে পড়ল মাঝরাস্তায়। সে বাসটাও ভর্তি, তবু এই যাত্রীরা কুমড়ো গাদা করে উঠে পড়ল। সেই গম্ভীর, বই-হাতে তরুণীটি উঠল সকলের শেষে।
আমি মনে মনে বললুম, আবার দেখা হবে!
যদি নীপাবৌদি লালুদার সঙ্গে এবং চন্দনদা এই তরুণীটির সঙ্গে আলাদাভাবে ভাব-ভালোবাসা করে থাকে, তাহলে আমাকে বলতেই হবে যে চন্দনদার রুচি অনেক উন্নত।
লাল গাড়ি চেপে ঘুরে বেড়ালেও লালুদাটা আসলে একটা রাঙালু।
বৃষ্টিতে না ভিজে আমি টেনে এক দৌড় মারলুম। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গেট এখনো বন্ধ হয়নি, ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়লুম একটা ঝুপসি গাছের নীচে।
বিভিন্ন শেড ও গাছের নীচে আরও অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে। বাচ্চাটাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে কয়েকটি পরিবার আছে, আর অধিকাংশই জোড়া জোড়া ছেলেমেয়ে। আমার গাছটার পেছনদিকেই দাঁড়িয়েছে একটি যুগল। ওরা ফিসফিস করে কী যেন বলছে আর হাসছে। বিয়ের আগে চন্দনদা আর নীপাবৌদি কি হাত ধরাধরি করে এখানে ঘোরেনি, এরকমভাবে অকারণ হাসিতে পরস্পরের গালে গাল ঠেকায়নি?
দূর ছাই, আমার অত নীপাবৌদি আর চন্দনদাকে নিয়ে মাথা ঘামাবার কী দরকার? ওরা যদি ঝগড়া করে সংসার ভাঙতে চায়, সেটা ওদের নিজস্ব ব্যাপার, ওরা বুঝবে! আমার আপাতত লাভ একশোটা টাকা। সেইজন্যই মনটা চাঙ্গা লাগছে। লালুদার কাছ থেকে এরকম আরও কয়েকখানা নোট বাগানো যাবে না?
দু’তিনদিন আর ওমুখো হলুম না।
ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে একদিন দু’ তিন বছরের পুরোনো খবরের কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করলুম অনেকক্ষণ ধরে। মনের মধ্যে একটা সন্দেহ খচখচ করছিল, এবার সেটা মিলে গেল। আশ্চর্য, তিন বছরে মানুষ কত কী ভুলে যায়! বি-বা-দি বাগে যে সব অফিসফেরত যাত্রীরা মিনিবাসের জন্য লাইন দেয়, তারা কেউ ঐ যুবতীটিকে চিনতে পারে না? সব বড় কাগজে অন্তত চার-পাঁচবার ওর ছবি ছাপা হয়েছে।
বেনুও নয়, রেণুও নয়, ওর নাম রোহিণী সেনগুপ্ত। লালুদা নিজের ভাগ্নীর নামটাও ঠিকমতন মনে রাখতে পারে না? অবশ্য ওর একটা ডাকনাম থাকতে পারে ঐ ধরনের।
নীপাবৌদি-চন্দনদার ঝগড়া মেটাবার কোনো আগ্রহ নেই আমার, কিন্তু মুমুর জন্য আমার একটু চিন্তা হতে লাগল। নীপাবৌদি সেদিন ওরকম একটা চড় মেরেছিলেন! মুমু খুব জেদি হয়ে গেছে ঠিকই, বাবা আর মা দুজনের ওপরেই অভিমানে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলে, কিন্তু আসলে সে তো একটা বাচ্চা মেয়ে! তার সরল মনোজগতটা ওরা তছনছ করে দিয়েছে!
যাদবপুরে এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ফেরবার পথে মনে হলো, একবার সুইন হো স্ট্রিটে গিয়ে মুমুর সঙ্গে দেখা করলে মন্দ হয় না।
নীপাবৌদি একটা ব্যাঙ্কে কাজ করে, এখনো ফেরেনি। লীনা নামে তার সেই মাসিও নেই, ফ্ল্যাটে মুমু একা। দারুণ জোরে একটা বিলিতি বাজনা বাজছে রেকর্ড প্লেয়ারে। দরজা খুলে দিল মুমু, তার গায়ে একটা বয়স্ক পুরুষমানুষের কোট, মুখে একটা জ্বলন্ত চুরুট!
তাকে দেখে আমার মুখ দিয়ে কথাই বেরুল না প্রথমে।
মুমু চুরুটটা দাঁতে চেপে বলল, কী চাই আপনার?
খপ করে তার মুখ থেকে চুরুটটা কেড়ে নিয়ে আমি বললুম, এই মুমু, এসব কী করছিস তুই?
মুমু পাগলাটে গলায় বলল, দাও, আমার চুরুট দাও! আমার যা খুশি আমি তাই করব!
আমি ধমক দিয়ে বললুম, যা খুশি করা মানে কি চুরুট টানা? এই বয়েসে? এক চাঁটি মারব!
মুমু চোখ পাকিয়ে বলল, অ্যাই ব্লু, তুমি আমায় মারবার কে? তোমাকে এখানে কে আসতে বলেছে?
—এই গরমে তুই একটা কোট পরে রয়েছিস?
—বেশ করেছি!
কোটটা চন্দনদার, খাবার টেবিলের ওপর চন্দনদার চুরুটের বাক্সটা খোলা। চন্দনদা কি এ-বাড়ি থেকে একবস্ত্রে বিদায় নিয়েছিলেন?
বারান্দায় একটি বুড়ি বসে আছে পা ছড়িয়ে। এ বাড়ির রাঁধুনি মাসি, আগেরদিন একে দেখিনি। চন্দনদা ও নীপাবৌদি দুজনেই চাকরি করে, তাই সংসারের রান্নাবান্না ও মুমুকে স্কুল থেকে ফেরার পর খেতে-টেতে দেবার জন্য চন্দনদা তার দেশের বাড়ি থেকে এই বুড়িকে আনিয়েছিল। তবে বড্ডই খুনখুনে বুড়ি, প্রায় আশির কাছাকাছি বয়েস হবে।
সেই মাসির কাছ থেকে জানা গেল যে নীপাবৌদির ব্যাঙ্কের এক সহকর্মীর বিয়ে উপলক্ষে আজ পার্টি, নীপাবৌদি একেবারে সেখান থেকে ঘুরে বাড়িতে আসবে, ফিরতে ফিরতে সাড়ে নটা-দশটা হবে। মুমুর লীনামাসি এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরবে বলে কোথাও বেরিয়েছে। তা এক ঘণ্টার বেশি তো হয়ে গেল।
মুমু যে চুরুট ধরিয়ে টানছে, তাতে বাধা দেবার সাধ্য নেই এই বুড়িমাসির। মুমুর মা ফিরলে তাকে নালিশ করবে!
একজন পুরুষমানুষ নেই, তাই বাড়ির চেহারাটা একদম অন্যরকম হয়ে গেছে। আমি বললুম, চল মুমু, আমার সঙ্গে একটু বেড়াতে যাবি?
এবার লক্ষ করলুম, মুমুর ঠোটে গাঢ় করে আঁকা লিপস্টিক। ভুরুটা মোটা করে আঁকা। চোখের পাতায় কী যেন রঙ মেখেছে। গায়ে ভুর ভুর করছে কোনো বিদেশী পারফিউমের গন্ধ। অর্থাৎ সে তার মায়ের ড্রেসিং টেবিলের যাবতীয় প্রসাধনের জিনিস একসঙ্গে মেখেছে। এই অবস্থায় নীপাবৌদি দেখে ফেললে আজও তার কপালে নির্ঘাৎ মার আছে।
মুমু তার লাল ঠোট উলটে বলল, কেন, তোমার সঙ্গে বেড়াতে যাব কেন?
—চল না, খুব ভালো জায়গায় নিয়ে যাব!
—কোথায়?
—ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে? কিংবা গঙ্গার ধারে রেস্টুরেন্টের দোতলায় বসে আইসক্রিম খেতে পারিস। সেখান থেকে জাহাজ দেখা যায়।
—জানি। সে রেস্টুরেন্টটা আমি দেখেছি। কিন্তু সেখানে তোমার সঙ্গে যাব কেন?
–কেন, আমার সঙ্গে যেতে আপত্তি কিসের? আমি কি খারাপ লোক?—হ্যাঁ, তুমি খারাপ লোক। তুমি গঙ্গার ধারে নিয়ে গিয়ে আমাকে চুমু খাবে।—অ্যা? কী বললি? এইবার কিন্তু কানটা মুলে দেব, মুমু! বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে। এইসব কথা কে শিখিয়েছে?
—আমি দেখেছি। গঙ্গার ধারে লোকেরা চুমু খায়। আমি যখন ছোট ছিলুম, ক্লাস টু-তে পড়ি, আমার বাবাটাও আমার মাকে অন্ধকারে চুমু খেয়েছিল ওখানে। ভেবেছে, আমি দেখতে পাইনি। আমার সব মনে আছে!
–তোকে সেদিন বলেছি না, আঠেরো বছর বয়েস হবার আগে এইসব কথা বলতে নেই। তুই যে চুরুট ধরিয়েছিলি, জানিস, ছোট মেয়েরা সিগারেট-চুরুট মুখে দিলেই পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। আমি যদি এখন পুলিশকে গিয়ে বলি যে তুই—
–যাও না, বলো গিয়ে, বলো! আমার বড়মামা আছে, সে তোমার পেছনেই হুড়কো দেবে!
—আবার এইসব খারাপ কথা? ছি ছি ছি ছি!
—পেছনে হুড়কো দেবে-টা খারাপ কথা? ঐ যে লালুটা বলে যখন তখন!—বড়রা তবু বলতে পারে। তা হলেও আমি লালুদাকে বলে দেব, যেন তোর সামনে এসব কথা কখনো উচ্চারণ না করে।
—আমার সামনে না বললে কী হয়। পাশের ঘরে বলে, আমি শুনতে পাই। আমি আরও অনেক খারাপ কথা জানি!
—মুমু শোন, তুই এখনো বড় হসনি। বড়দের মতন কথা বলা, বড়দের মতন ব্যবহার করা, এইসব একটুও ভালো দেখায় না। আমি তোকে এত করে বারণ করছি…
—তুমি বারণ করবার কে হে? তুমি কি আমার আপন কাকা? জানো, আমাদের পাড়ায় যে বস্তি আছে, সেখানে একটা ছেলে তার কাকার সঙ্গে ঝগড়া করে বলছিল, শালা। দূর শালা! এই নীলকাকা শালা। হি-হি-হি-হি!
নাঃ, এ মেয়েকে শোধরানো আমার সাধ্য নয়। এবারে রণে ভঙ্গ দিতে হলো। এ বাড়িতে আর আসা যাবে না।
কোনো কথা না বলে সোজা উঠে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পায়ে স্ট্র্যাপ শু গলাতে যেতেই মুমু ছুটে এসে দু’ হাত মেলে বাধা দিয়ে বলল, অ্যাই, শুধু শুধু চলে যাচ্ছ যে? এই যে বললে আইসক্রিম খাওয়াবে?
—তুই তো বললি আমার মতন খারাপ লোকের সঙ্গে যাবি না?—পয়সা দাও, দোকান থেকে কিনে আনব।
—উহুঁ! পয়সা-টয়সা হবে না।
—তবে তোমার সঙ্গে যেতে পারি, যদি তুমি ভ্যানিলা কিংবা স্ট্রবেরি খাওয়াও!
—তা খাওয়াব। কিন্তু আমার সঙ্গে গেলে একটাও খারাপ কথা বলা চলবে না! আর এই কোট খুলতে হবে। লিপস্টিক ফিপস্টিক সব মুছে ফেলতে হবে। যা, সব ঠিক করে আয়!
বুড়ি মাসিকে বললুম, আমি মুমুকে একটু নিয়ে যাচ্ছি। নটার মধ্যে ফিরব, কেমন!