৪
চন্দনদার কাছ থেকে ফেরার ভাড়াটা চাইতেই আমার সবচেয়ে গ্লানি বোধ হয়েছিল।
মুমু এত উৎসাহ করে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে এল, দেখা হবার পর কিন্তু সে আর একবেলাও সেখানে থাকতে চাইল না, চন্দনদাও রাখবার জন্য জোর করলেন না একটুও। মুমুর স্কুল খোলা, তবু সে কলকাতা থেকে চলে এসে দারুণ অন্যায় করেছে। আজকাল এমনই পড়াশুনো ব্যবস্থা যে শখ করে দু’-একদিন স্কুলে না যাওয়াটা যেন একটা বিরাট পাপ!
রাত্তিরে আমরা সাপের খপ্পরে পড়েছিলুম শুনেও চন্দনদা আমার ওপর খুব রাগারাগি করলেন, যেন সব দোষ আমারই। দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতন একটা আধা—খ্যাঁচড়া বাংলোয় আমি উঠেছি কেন? আগে থেকে ঠিকঠাক খবর না দিয়ে কি কেউ এইরকম ছোট জায়গায় আসে?
এর ফলে হলো কি, রেল স্টেশনে যে আমি মুমুকে জেলে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছি, সে ঘটনাটা চন্দনদাকে বলাই হলো না। শুনলেই আরও বকাবকি করবেন নিশ্চয়ই। মুমুও বাবার ওপর অভিমান করে চুপ করে ছিল।
চন্দনদার কাছ থেকে আমি কখনো এরকম খারাপ ব্যবহার পাইনি।
চন্দনদা মুমুর ফেরার ভাড়া, ট্রেনে যাওয়ার খরচ ইত্যাদি হিসেব করে আশি টাকা দিয়েছিলেন আমাকে। উনি ভেবেছিলেন, আমি নিজের শখে বেড়াতে এসেছি, সুতরাং ভাড়া-টাড়ার দায়িত্বও আমার নিজের। তখন বাধ্য হয়ে আমাকে মুখ ফুটে বলতে হলো, চন্দনদা, আমারও গোটা পঞ্চাশেক টাকা লাগবে! চন্দনদা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিলেন, যেন আমি একটা রক্তচোষা ছারপোকা
হায়, এমন দিন কি কখনো আসবে, যখন প্রতিদিনই পয়সা গুনে গুনে হিসেব করতে হবে না?
মেয়ের ওপর রাগ এবং আমার প্রতি বিরক্তির কারণটাও চন্দনদা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন। চন্দনদা নীপাবৌদির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সেইজন্যই তাঁর ছোটপাহাড়ীতে চলে আসা। কলকাতায় গিয়েও তিনি নিজেদের ফ্ল্যাটে যাননি, মুমুর সঙ্গে শুধু একবার দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন তার স্কুলে। মুমু যে স্কুল পালিয়ে ছোটপাহাড়ীতে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, এর সবটা দোষই নীপাবৌদি মুমুর বাবার ওপর চাপাবে, এটাই চন্দনদার ধারণা। মুমুর লেখাপড়ায় বিন্দুমাত্র ক্ষতি হোক, এটা চন্দনদা নিজেও চান না অবশ্য। মুমুর পড়ার খরচ তিনিই চালাবেন।
যে-কয়েকটি দম্পতির সঙ্গে আমার চেনাশুনো আছে, তাদের মধ্যে চন্দনদা আর নীপাবৌদিকেই আমার সবচেয়ে আদর্শ এবং হাসিখুশি মনে হতো। ছোট্ট পরিবার, শ্বশুর-শাশুড়ির ঝামেলা নেই, স্বামী এবং স্ত্রী দু’জনেই ভালো চাকরি করেন, একটি মাত্র সন্তান, সে-ও লেখাপড়ায় ভালো। চন্দনদাদের ফ্ল্যাটে ওঁদের প্রচুর বন্ধুবান্ধবীদের আড্ডা দিতে দেখেছি, ওঁরা দু’জনেই অতিথিবৎসল। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে গেল?
কেন যে এমন হলো, সেই ব্যাপারে প্রশ্ন করা যায় না।
চন্দনদাকে বেশ কঠোর মনে হলো, নীপাবৌদি সম্পর্কে যেন সব ভালোবাসা তাঁর চলে গেছে, এমনকি মুমুকে তিনি দু’-একটা ভালো কথা বললেন না। উনি কি বউ-মেয়েকে ত্যাগ করে এই ছোটপাহাড়ীর মতন গড ফরসেকেন প্লেসে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান? চন্দনদার মেজাজ দেখে সেসব কথাও জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না আমার।
ট্রেনের জানলার ধারে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে মুমু। তার মুখখানা যেন মূর্তিমতী অভিমান।
মেয়েরা সাধারণত মায়ের চেয়ে বাবার বেশি ভক্ত হয়। খুব ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মুমু একেবারে বাবা-অন্ত প্রাণ। প্রায়ই ও বলত, আমার বাবার মতন হ্যাণ্ডসাম কেউ না! মুমুর মতে তার বাবা সকলের চেয়ে জ্ঞানী, আমরা যেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না, তা সবই তার বাবা জানে। তার বাবা অন্য সব বাবার চেয়ে ভালো।
চন্দনদাকেও মেয়েকে নিয়ে খুব আদিখ্যেতা করতে দেখেছি। অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই প্রথমে জিজ্ঞেস করতেন, মামণি কোথায়? প্রত্যেকদিন মুমুর জন্য চকলেট কিংবা কিছু না কিছু কিনে আনবেনই। মুমু কোনো জিনিসপত্র ভাঙুক কিংবা যত দোষই করুক, চন্দনদার কাছে সব কিছু মাফ, এ জন্য নীপাবৌদিই মাঝে মাঝে বকতেন চন্দনদাকে। সেই চন্দনদা মুমুকে ছেড়ে থাকতে পারছেন?
মুমু ওর ক্লাসে ফার্স্ট সেকেণ্ড হয়। আজকাল বাবা-মায়ের তাড়না লাগে না, ভালো ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই গরজ করে প্রত্যেকদিন স্কুলে যায়, তবু মুমু স্কুল নষ্ট করে বাবাকে দেখতে এসেছিল। দু’মাস সে বাবাকে দেখেনি। সে হয়তো আশা করেছিল যে বাবা তাকে দেখলেই আনন্দে এমন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে যে পুরোনো সব ঝগড়াঝাঁটি ভুলে যাবে।
মুমুর ক্ষুদ্র হৃদয়ে এখন যে কী আলোড়ন চলছে, তা আমি বুঝব কী করে!
একবার এক ঠোঙা বাদাম কিনে জিজ্ঞেস করলুম, মুমু, বাদাম খাবি? মুমু কোনো উত্তরই দিল না। আমি ওর একটা হাত নিয়ে, মুঠোর মধ্যে কয়েকটা বাদাম দিয়ে দিলুম, হাতটা সেইরকম মুঠো করাই রইল।
আমার ক্ষমতা থাকলে আমি চন্দনদাকে জেলে দিতুম! কেন সে একটা বাচ্চা মেয়েকে এরকম কষ্ট দেবে? নীপাবৌদি যা-ই দোষ করে থাকুক, চন্দনদা তা মানিয়ে নিতে পারলেন না? আমি তো নিজের চোখেই দেখে এলুম, বউয়ের ওপর রাগ করে চনদা মেয়েকেও শাস্তি দিচ্ছেন।
খড়্গপুর স্টেশন পেরিয়ে যাবার পর মুমু হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বলল, নীলকাকা, আমার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না!
এই রে, এ যে বিপজ্জনক চিন্তা! মেয়েটার মাথায় যদি এসব ঢোকে, তা হলে হঠাৎ একটা কিছু যা-তা করে বসতে পারে। এই বয়েসি একটা মেয়ের জন্য পথেঘাটে বিপদ ওঁৎ পেতে আছে।
আমি যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক মুখ করে, একটু হেসে জিজ্ঞেস করলুম, বাড়ি ফিরবি না, তা হলে কোথায় যাবি?
মুমু বলল, তা জানি না। কিন্তু বাড়িতে আমি আর যাব না। আমার ভালো লাগছে না।
—মুমু, তুই তোর মাকে বলে এসেছিলি তো?
—না।
—বলিসনি? কী সাঙ্ঘাতিক কথা রে! নীপাবৌদি এতক্ষণে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। ছিঃ, মুমু, মাকে কি কষ্ট দিতে হয়?—মা আমাকে ভালোবাসে না। আমাকে কেউ ভালোবাসে না!
—আরে নাঃ! শোন, মুমু, তুই তো এখন বড় হচ্ছিস, তোকে কয়েকটা জিনিস বুঝতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এরকম ঝগড়া মাঝে মাঝে হয়, আবার মিটে যায়। কিংবা ধর, যদি বা নাও মেটে, ডিভোর্স কাকে বলে জানিস তো? স্বামী আর স্ত্রী আলাদা আলাদা থাকবে, কিন্তু ছেলেমেয়েরা বাবার কাছেও যাবে, মায়ের কাছেও যাবে।
—তুমি এসব কী করে জানলে? তোমার কি বউ আছে?—না থাকলেই বা। চারপাশে এরকম দেখছি তো অনেক।—আমার বাবা আর বাবা থাকবে না?
—আহা, তা কেন? বাবা সব সময়েই বাবা থাকবে।
—চাই না আমার ওরকম বাবা! আমার মাও চাই না। আমি বাড়ি যাব না।
—তা হলে কোথায় যেতে চাস?
—আমি পরের স্টেশনে নেমে পড়ব!
—ধ্যাৎ! পাগলের মতন কথা। যে কোনো জায়গায় নেমে পড়লেই কি সেখানে থাকা যায়? ওসব ভাবতে নেই, আগে তোর পড়াশুনো শেষ করতে হবে না? তুই খুব ভালো রেজাল্ট করবি। নিজের পায়ে দাঁড়াবি, তখন দেখবি, সবাই তোকে কত খাতির করছে!
উপদেশ-টুপদেশ আমার মুখে একদম আসে না। কিন্তু এইটুকু একটা মেয়েকে শুধু কথা দিয়ে ভোলানো ছাড়া আর উপায় কী? এই কথাগুলো আমি উচ্চারণ করতে লাগলুম অভিনয়ের মতন, বেশ দরদ দিয়ে।
দূরপাল্লার ট্রেন হলেও আমাদের কামরায় ভিড় খুব কম। সবেমাত্র সন্ধে হচ্ছে। গতকাল এই সময় আমরা বাসে ছোটপাহাড়ী যাচ্ছিলুম, তখন মুমুর মনে কত আশা ছিল, সে ভেবেছিল বাস ডিপোতেই তার বাবা তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরবে। কাল মুমু সর্বক্ষণই প্রায় আমার সঙ্গে রেগে কথা বলছিল, আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিল, আজ সে সুর বদলে গেছে। বিপদের একটা রাত্রি আমাদের কাছাকাছি এনে দিয়েছে অনেকখানি।
মুমু আবার বলল, আমি যদি যে-কোনো স্টেশনে নেমে পড়ি, তারপর আমার যাইই হোক, আমি যদি মরেই যাই, তাতে কার কী ক্ষতি! বেশ করব, আমার যা খুশি করব।
—তুই মরতেও পারবি না। তার আগেই তোকে পুলিশে ধরবে। যেসব ছেলেমেয়েরা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, পুলিশ তাদের ঠিক খুঁজে আনে।
—পুলিশ আমাকে ধরতেই পারবে না। আমি যদি এক্ষুনি ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ি, পুলিশ কী করে ধরবে?
—সেটাও তুই পারবি না। আমি বাধা দেব। আমি তোকে আটকে রাখব।
—কেন তুমি আমাকে আটকে রাখবে?
—কারণ আমি তোকে ভালোবাসি। তুই আমাদের মুমু।
—অ্যাই ব্লু, তুমি খবর্দার ভালোবাসা-টালোবাসার কথা বলবে না! তুমি না কথা দিয়েছিলে, আমাকে বিয়ে করতে চাইবে না?
—বিয়ে না করলে বুঝি ভালোবাসা যায় না? তুই এত পাকা হলি কী করে রে?
—আমি বাবাকে অনেকবার বলতে শুনেছি, মাকে বলেছে, আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। ওরা সবাই মিথ্যে কথা বলে!
—ভালোবাসা কি একরকম হয় রে? ভালোবাসা অনেক রকম!
—আমি ওসব কিছু চাই না। আমি কারুকেই চাই না।
—তা বললে তো হবে না। তোর এখন এগারো বছর মোটে বয়েস! আঠেরো বছর বয়েস হবার আগে পর্যন্ত তুই নিজের ইচ্ছে মতন কিচ্ছু করতে পারবি না। সেইজন্যই তো বলছি, তুই লেখাপড়া শিখে আগে বড় হয়ে নে, তারপর স্বাধীনভাবে যা খুশি করবি। হয়তো লণ্ডন কিংবা আমেরিকা চলে যাবি!
—না যাব না। আমি আর পড়াশুনো করবই না!
–তোর মার সঙ্গে তোর বাবার কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে তা জানিস?
—তোমাকে বলব কেন? তুমি বাইরের লোক! তোমার সঙ্গে আমার ঐ রেল স্টেশনে দেখা না হলে তুমি কিছু জানতেই পারতে না!
–এক সময় ঠিকই জেনে যেতুম।
মুমু একটুক্ষণ আবার চুপ করে গেল। তার সেই মন খারাপের ভাবটা কেটে গেছে, তবু চোখে মুখে বেশ চাঞ্চল্য। একবার উঠে বাথরুমে গেল, আমি সরে এসে দরজার কাছে দাঁড়ালুম। বলা যায় না, হঠাৎ ঝাঁপিয়ে-টাপিয়ে পড়তে পারে। আজকাল স্কুলের ছেলেমেয়েরাও আত্মহত্যা করে।
মুমু বাথরুম থেকে বেরুতেই আমি ওকে আগের জায়গায় বসিয়ে দিলুম টেনে এনে।
এবারে ও পা থেকে সুন্দর নীল রঙের এক পার্টি জুতো খুলে হঠাৎ ছুঁড়ে ফেলে দিল জানলা দিয়ে।
আমি চমকে বললুম। একি, একি করলি?
মুমু বলল, ঐ লোকটা কিনে দিয়েছিল। এটা আমি আর পরব না।
—ঐ লোকটা মানে? মুমু, এভাবে কথা বলতে নেই।
—তুমি চুপ করো! তুমি আমার কে? তুমি আমার নিজের কাকা নও!
—তা বলে একটা ভালো জুতো ফেলে দিলি?
অন্য পার্টিটা তুলে মুমু বলল, এটা রেখে আর কী হবে? এটা তুমি ফেলবে?
আমি দুদিকে মাথা নাড়তেই মুমু সেই জুতোটাও নিরুদ্দেশে পাঠাল। হঠাৎ হি হি করে হেসে উঠল খুব জোরে। কামরার কয়েকজন এদিকে ফিরে তাকাল।
হাওড়ায় পৌঁছলুম রাত প্রায় দশটায়। মুমু তার ব্যাগ খুলে একজোড়া হাওয়াই চটি বার করল। মিশনারি স্কুলে পড়া মেয়ে খালি পায়ে কলকাতার রাস্তা দিয়ে কিছুতেই হাঁটবে, চটি আছে বলেই জুতো জোড়া ফেলতে পেরেছে।
আমি মুমুর হাত ধরে রইলুম। এই ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ যদি দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করে, তাহলে ধরা মুশকিল হবে।
হিসেব করে দেখলুম, আমার কাছে আর যে কটা টাকা বাকি আছে, তাতে ট্যাক্সি ভাড়া কুলিয়ে যাবে।
সুইন হো স্ট্রিটে চন্দনদার ফ্ল্যাট। চন্দনদা মুমুর জন্য আশি টাকা দিলেন কেন, পুরো একশো টাকা দিতে পারতেন না? বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে চন্দনদা এমন কৃপণ হয়ে গেছেন?
ট্যাক্সিটা মুমুদের বাড়ির কাছে এসে থামল, সেখানে লাল রঙের একটা ছোট গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাড়িটার দিকে এক পলক তাকিয়ে মুমু বলল, তুমি এই ট্যাক্সিটা নিয়ে বাড়ি চলে যাও।
আমি ভাড়া মেটাতে মেটাতে বললুম, আমার অত তাড়া নেই। নীপাবৌদির সঙ্গে দেখা করে যাব না?
মুমু গম্ভীর ভাবে বলল, তুমি এখন বাড়ির মধ্যে এসো না। আমার মায়ের কাছে তার বয়ফ্রেণ্ড রয়েছে।
—কী বাজে কথা বলছিস!
—এই যে গাড়িটা রয়েছে দেখছ না? এটা মায়ের বয়ফ্রেণ্ডের গাড়ি। মা এখন তোমাকে দেখলে ভালো করে কথা বলবে না!
এখন ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের মুখে কিছু আটকায় না। মায়ের বয়ফ্রেণ্ড! মুমু মাকে কিছু না বলে ছোটপাহাড়ী চলে গিয়েছিল, নীপাবৌদি কিছু জানেন না, সেই অবস্থায় তিনি এত রাত্রে বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে বসে গল্প করবেন? তা হতে পারে না। তবু ব্যাপারটা আমাকে দেখতেই হবে।
সদর দরজা খোলা, মুমুদের ফ্ল্যাট দোতলায়। আমি মুমুর হাত ছাড়িনি। ওর ভাবভঙ্গি ভালো নয়। বেল দিতেই দরজা খুলে দিল একটি অপরিচিতা মেয়ে, এক মুহূর্তে সে যেন ভূত দেখার ভয় পেল, পরের মুহূর্তেই তার মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল।
সে চেঁচিয়ে বলল, মুমু! এই দিদি, মুমু ফিরে এসেছে! মুমু এসেছে!
দরজা খোলার পরেই প্রথমে একটা বসবার ঘর, তার ওপাশে খাবারের জায়গা, তারপর দুদিকে দুটো বেডরুম। খাবারের জায়গা থেকে ছুটে এলো নীপাবৌদি আর একজন ভদ্রলোক, তাকে আমি চিনি। সবাই তাকে লালুদা বলে, ভালো নামটা কী আমার মনে নেই।
একসঙ্গে সেই তিনজন বলতে লাগল, মুমু, কোথায় গিয়েছিলি? মুমু তুই ইস্কুল থেকে বাড়ি না ফিরে…। মুমু, তোর জন্য সব জায়গা খুঁজে খুঁজে…। মুমু, তুই বাড়িতে কারুকে কিছু না বলে…।
মুমু খানিকটা অবজ্ঞার ভঙ্গিতে হাতের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে, ফটাশ ফটাশ করে চটি জুতো খুলল, তারপর সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, বাবার কাছে গিয়েছিলুম।
নীপাবৌদি এগিয়ে এসে মুমুর হাত ধরল। যেন মুমুর কথাটা বুঝতেই পারেনি, এইভাবে আবার জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলি?
মুমু তেড়িয়াভাবে বলল, বাবার কাছে।
নীপাবৌদি বলল, সেখানে কেন গিয়েছিলি?
মুমু বলল, বেশ করেছি!
নীপাবৌদি মেয়েকে ফিরে পেয়ে নিশ্চিত খুব খুশি হয়েছে, তবু মুমুর এই কথা শুনে ঠাস করে এক চড় কষাল।
লালুদা বলল, আরে, আরে কী করছ, নীপা! পাগল হয়ে গেলে নাকি? ওকে মারছ কেন?
অপরিচিতা মেয়েটি টেনে নিল মুমুকে, লালুদা নীপাবৌদিকে সরিয়ে এনে বলল, নীপা, মাথা ঠাণ্ডা করো, মুমু ফিরে এসেছে।
নীপাবৌদি বলল, কেন ও যাবে? যে লোক দু’ মাস ধরে একটি বারের জন্যও মেয়ের খোঁজ নেয়নি, তার কাছে ও হ্যাংলার মতন ছুটে যাবে কেন? সে ভাববে, আমিই বুঝি মুমুকে পাঠিয়েছি?
নীপাবৌদি এবার আমার দিকে তাকাল জ্বলন্ত চোখে। যেন আমিই ভুলিয়ে ভালিয়ে মুমুকে নিয়ে গিয়েছিলুম ছোটপাহাড়ীতে।
লালুদা বলল, আরে নীলকণ্ঠ, তুমি মুমুকে কোথায় পেলে?
আমি বললুম, আমার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল বালুঘাই স্টেশনে।—হঠাৎ দেখা হলো, মানে, তুমি বালুরঘাট গিয়েছিলে?
–বালুরঘাট না, বালুঘাই। সেখানেই দেখা হলো।
–না, মানে, তুমি এমনি এমনি বালুঘাই গিয়েছিলে?
-এমনি এমনি না, নিজস্ব একটা কাজে।
লালুদা বা নীপাবৌদি যে আমার কথা বিশ্বাস করছে না, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। খাঁটি সত্যি কথা সহজ সরলভাবে বলে দিলে অনেকেই সন্দেহ করে। আর হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সবাই ভাবে বানানো। গল্প-উপন্যাসে এরকম হয়।
অপরিচিতা মেয়েটি মুমুকে জিজ্ঞেস করলো, মুমু, তুই একা একা ট্রেনে করে চলে গেলি?
মুমু উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা ঝোঁকাল।
লালুদা আমাকে জিজ্ঞেস করল, মুমুর সঙ্গে তোমার নীলুরঘাট স্টেশনে যাওয়ার সময় দেখা হয়েছিল, না আসবার সময়?
—দু’বারই হয়েছে। আর একটা কথা, আমার নাম নীলকণ্ঠ নয়।
—ও হ্যাঁ, তোমার নাম, তোমার নাম কী যেন, নীলাদ্রিশেখর?
—আজ্ঞে না।
—তবে? নীলোৎপল? উৎপলেন্দু? ইন্দুশেখর?
মুমু আমার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে একটু হাসল। আমি যে নিজে থেকে নামটা বলতে চাইছি না এতেও ও কিছুটা মজা পেয়েছে। এর মধ্যে যেন একটা প্রতিবাদের ভাব আছে।
নীপাবৌদি বিরক্ত হয়ে বলল, কী সব বলছ লালুদা, ওর নাম তো নীললোহিত। ওকে এ বাড়িতে আগে দেখোনি?
লালুদা বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আনকমন নাম। সেইজন্য ঠিক মনে থাকে না। তুমি তো মুমুকে নিয়ে চলে গেলে, এদিকে আমাদের কী চিন্তা। নীপা একেবারে পাগলের মতন।
—আমি মুমুকে নিয়ে যাইনি। আপনি ভুল করছেন, আমার সঙ্গে ওর বালুঘাই স্টেশনে দেখা হয়েছিল আপনাকে বলেছি।
—তারপর শোনো, আমি নীপাকে বললুম, কোনো চিন্তা নেই, ঠিক পাওয়া যাবেই। মুমু ব্রাইট মেয়ে, সে আজেবাজে কারুর পাল্লায় পড়বে না, আমি সব হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে তারপর থানায়, খবরের কাগজে, তারপর রেডিও আর টিভিতে অ্যানাউন্সমেন্ট হয়েছে, মুমু, আজই টিভিতে তোর ছবি দেখিয়েছে।
অচেনা মেয়েটি বলল, তোর লাল ফ্রক পরা ছবি। ইস, তুই দেখতে পেলি না। কালকেও বোধহয় দেখাবে, তাই না লালুদা?
মুমু এসব অগ্রাহ্য করে খাবার জায়গার দিকে চলে গেল। ফ্রিজ খুলে একটা ঠাণ্ডা জলের বোতল এনে নিজে ঢক ঢক করে খানিকটা খেল, তারপর আমার কাছে এসে বলল, নীলকাকা, জল খাবে?
এখন এ বাড়িতে আমি আর মুমু যেন এক দলে, বাকি তিনজন অন্য দলে। এখানে বেশিক্ষণ থাকার আমার মোটেই ইচ্ছে নেই, কিন্তু নীপাবৌদি হঠাৎ মুমুকে চড় মারলেন কেন, এটা খুবই অন্যায়। যতই দুঃখ উদ্বেগ আর রাগ থাকুক, বাড়ি ফেরামাত্র মেয়েকে এরকম চড় মারা ঠিক হয়নি। মুমুকে আমি এ বাড়িতে কখনো মার খেতে দেখিনি। বাবা অনুপস্থিত বলে মেয়েটা চড়চাপড় খাবে, এটা সহ্য করা যায় না।
চড়টা খেয়ে মুমু কিন্তু একটুও বিচলিত হয়নি। যেন চড় মারার ফলে তার মা-ই হেরে গেছে।
আমাদের দুজনকে জল খেতে দেখে লালুদা ব্যস্ত হয়ে বলল, আরে, ওদের খাবার দাও, চা দাও, কত দূর থেকে এসেছে। নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে, মুমুকে দুধ দাও, কদিন দুধ খায়নি, আর নীলোৎপল, তুমি কী খাবে?
আরও কুড়ি-পঁচিশ মিনিট সেখানে বসতে হলো নানারকম জেরার জবাব দেবার জন্য। অবশ্য আসল আসল ঘটনাগুলোই ওরা শুনতে পেল না। রেল স্টেশনের কাহিনী আর সাপের কাহিনী একদম বাদ।
তার কারণ, লালুদা যত না শুনতে চায়, তার চেয়ে নিজে বেশি কথা বলে। মুমুর নিরুদ্দেশ হওয়া উপলক্ষে সে যে কত লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, পুলিশের ডি সি সাউথ থেকে শুরু করে হাসপাতালের সুপারিনটেণ্ডেণ্ট আর খবরের কাগজের রিপোর্টার এইরকম কত লোকের সঙ্গে তার চেনা, সেই কথা শোনাতেই সে ব্যস্ত, আর নীপাবৌদি ঠারেঠারে শুধু জানতে চায়, চন্দনদার সঙ্গে কী কী কথা হলো। আমি বললুম, চন্দনদা মুমুকে কী বলেছে তা আমি জানি না। মুমু সর্বক্ষণ ঘাড় হেঁট করে টেবিলে আঁকিবুকি কেটে গেল, হ্যাঁ কিংবা না ছাড়া সে আর কিছু বলে না।
অচেনা মেয়েটির নাম লীনা, সে মুমুর মাসি হয়, আপন নয়, খুড়তুতো মাসি, সে কয়েকদিন ধরে এখানে আছে। তার কৌতুহল, আমি বালুঘাই স্টেশনে কী করতে গিয়েছিলুম। আমি যে সেখানে একটা চাকরির ব্যর্থ ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলুম, সে কথা কারুকে জানাতে চাই না। সুতরাং বারবার বলেছি, নিজের কাজে। আমার যে কী কাজ, তা বুঝতে না পেরে লীনা আরও বেশি কৌতূহলী হয়ে উঠল, যেন আমার পুরো পরিচয়টা না জানতে পারলে তার ভাত হজম হবে না।
লালুদাকে মুমু যে তার মায়ের বয়ফ্রেণ্ড বলেছিল, সেটা নিশ্চয়ই রাগের কথা। এই লালুদাকে আমি আরও দু’-একটা বাড়িতে দেখেছি, সর্বঘটে কাঁঠালি কলা জাতীয় মানুষ।
সকলের সঙ্গেই মেশে, সকলের সঙ্গেই হৈ হৈ করে, কারুর জন্য ফ্ল্যাট খুঁজে দেয়, কারুর ট্রেনের টিকিট দরকার হলে হাত তুলে অভয় দিয়ে বলে, ব্যবস্থা হয়ে যাবে, শস্তায় কোথায় স্টিলের আলমারি পাওয়া যায়, তাও লালুদা জানে। এইসব লোক বেশ উপকারী হয়, কিন্তু ‘এরা কি প্রেমিক হতে পারে?
লালুদার চেহারা খারাপ নয়, বছর চল্লিশেক বয়েস, পৌনে ছ’ফুট লম্বা, গায়ের রং মাজা মাজা, স্বাস্থ্য ভালো, সবই ঠিক আছে, কিন্তু মুখখানা অতি চালাক অথচ বোকা ধরনের। ঠোটে সবসময় কাঁঠালি কলা মার্কা হাসি। এই ঠোঁটে নীপাবৌদির মতন মেয়ে কখনো চুমু খাবে, এ আমি বিশ্বাসই করতে পারি না। চন্দনদা যদি এই লালুদা সম্পর্কে কিছু ভেবে নিয়ে নীপাবৌদিকে ছেড়ে গিয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে যে চন্দনদার মাথা খারাপ হয়েছে।
জেরার শেষে লালুদা হঠাৎ একবার নিজের কবজির সোনালি হাতঘড়ি দেখে বলে উঠল, ওরের্ বাস, সোওয়া এগারোটা বাজে? এবার উঠি। মুমুকে ভালো করে ঘুমোতে দাও। নীলকমল, তুমি কোনদিকে থাক? আমি তোমায় নামিয়ে দিয়ে যেতে পারি।
লালুদা যে আমার নামটা বারবার ভুল বলে, তাতে আমার কিছু মনে করা উচিত না। কারণ, লালুদার ভালো নামটা যে আমারও মনে নেই।
লালুদার গাড়ির রংটাও লাল, নিশ্চয়ই তিনি ইচ্ছে করেই লাল কেনেননি। গাড়ির কাচ ছাই রঙের অর্থাৎ বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যাবে না। ভেতরে মিষ্টি গন্ধ, আর ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা। আমার সারাদিনের ঘেমো শরীর, ময়লা জামা—প্যান্ট নিয়ে এই রকম গাড়িতে উঠতে লজ্জা হলো।
স্টার্ট দেবার পর লালুদা বললেন, ঐ যে প্যাকেট রাখা আছে, তুমি সিগারেট খেতে পারো, আমি স্মোক করি না। আমি ড্রিংকও করি না, কিন্তু তুমি যদি চাও, বাঁ দিকের খোপটায় ব্র্যাণ্ডির বোতল রাখা আছে, ইচ্ছে করলে দু’ ঢোঁক মেরে দিতে পারো।
একেই বলে সত্যিকারের পরোপকারী!
একটুখানি যাবার পর লালুদা বলল, চন্দনটা কী করল বলো তো? নীপার মতন মেয়ে, একেবারে হীরের টুকরো, সবাই তাকে ভালোবাসে, সেই নীপাকে এমন কষ্ট দিল চন্দন!
তারপর লালুদা তার মুখটা অনেকখানি ঝুঁকিয়ে দিল আমার দিকে।
রাস্তায় কোনো লোক নেই, এত রাত, চলন্ত গাড়ি, তারও কাচ বন্ধ, তবু লালুদা ফিসফিস করে বলল, একটা সত্যি কথা বলো তো, নীলাঞ্জন? ছোটপাহাড়ীতে সেই মেয়েটাকে দেখলে?
আমি আকাশ থেকে পড়ে বললুম, মেয়েটা মানে? কোন মেয়েটা?
লালুদা বলল, তাও জানো না! কারুকে বলো না যেন, একটা মেয়ের জন্যই তো চন্দন কলকাতা ছেড়ে চলে গেল!