প্ৰথম খণ্ড - আদি পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পর্ব

কীর্তিহাটের কড়চা – ২.৫

পশ্চিম দিকে সেকালের কলকাতায় ময়দানে উলুখাগড়ার জঙ্গল, দু-চারটে জলা, গঙ্গার ধারে বড় বড় অশ্বত্থের গাছ। জাহাজ বজরার মাস্তুল দেখা যাচ্ছে। চৌরঙ্গীর পূব পাশে সেকেলে বাড়ী। তখন হোয়াইটওয়ে লেডল তৈরী হয়নি, গ্র্যান্ড ফিরপোর বাড়ী তৈরী হয়নি। বাতাওয়ালা ছোট বাড়ী, গোল থাম, কাঠের রেলিং।

ব্রুহাম গাড়ী চলছে, সহিসেরা সামনে ছুটছে, পাল্কি চলছে। তালপাতার ছাতা মাথায় দিয়ে রাহী চলছে। ঘোড়ায় চলছে সওয়ার। গরুর গাড়ী চলছে।

ওই দেখ, পাল্কিতে কাত্যায়নী।

ব্রুহামে সোমেশ্বর। চোগা চাপকান পরেন নি, পরেছেন পাটের কাপড়-চাদর। কাত্যায়নীর পরনে বালুচরের বুটীদার রেশমী শাড়ী।

* * *

সোমেশ্বর রায় আশ্চর্য হয়ে গেল তান্ত্রিককে দেখে। আরে!

—কি? জিজ্ঞাসা করলেন মামাতো ভাই হরিহর।

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোমেশ্বর তান্ত্রিককে বললেন, কি বাবা চিনতে পারছেন আমাকে?

তান্ত্রিক হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, হাহা-হা। রায়বাবু? হাহা-হা। পারি বৈকি চিনতে। কেন পারব নি! হাহা-হা!

—এ পথে কত দিন বাবা?

—তা তিন জন্ম হল গো। এ জন্মে বছর পাঁচেক হয়ে গেল গো। হাহা হা। আমি ভাবছিলাম গো তোমার কথা। হাহা-হা!

অবাক হয়ে গেলেন সোমেশ্বর। তাঁর কথাই ভাবছিলেন? তবু জিজ্ঞাসা করলেন, কে বললে আমি আসব?

—হাহা-হা। আমার মন বললে গো। তোমাকে আমার দরকার আছে যে! হাহা-হা! আশ্চর্য! এ লোককে তিনি চেনেন। শ্যামনগরের ভটচাজবাড়ীর জামাই, পেশাদার কুলীনের ছেলে। ওর শ্বশুর খুব নামজাদা গৃহীতান্ত্রিক ছিলেন। শ্মশানে কালীপূজা করতেন। শ্মশানে জপতপ করতেন। তন্ত্রমতে স্বস্ত্যয়ন করতেন। কুলীনের ছেলে শ্যামাকান্ত চাটুজ্জে ভটচাজের কন্যাকে বিয়ে করে ঘরজামাই ছিলেন। প্রথম প্রথম বেড়াতেন গান-বাজনা করে। গান-বাজনার শিষ্য ছিল। নিজেও বড় বড় বাড়ীতে খেরুয়ার খোলে পোরা তানপুরা কাঁধে নিয়ে গান শোনাতে আসতেন। অসাধারণ গাইয়ে বলেছে মামাতো ভাই, তা এক বিন্দু বাড়িয়ে বলে নি। যেমন সঙ্গীতে জ্ঞান তেমনি কণ্ঠস্বর। তন্ত্রের ঝোঁকও ছিল। পাঁচ টাকা পার্বণী করে দিয়েছিলেন, কালীপুজোর পর এসে গান শুনিয়ে নিয়ে যেতেন। আজ বছর পাঁচেকই হবে আর আসেন নি। পাঁচ বছরে শ্যামাকান্ত একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছেন। ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপা কথা, হাহা হা, হাহা হা, যেন একটা উল্লাস উথলে উঠছে ওই শব্দের গমক মেরে। চাউনিও বদলেছে, চোখ দুটো বড়, সে চোখ লাল হয়ে আছে। চোখের তারা কখনও স্থির, কখনও অস্থির। কিন্তু যেন জ্বলছে জ্বলন্ত আঙরার মত।

তিনি বললেন—তা আমার বাঞ্ছা যে পূর্ণ করতে হবে।

—হাহা-হা। তোমার আবার বাঞ্ছা কিগো বাবু, জমিদারী, বাড়ী-টাকাকড়ি, হাতী-ঘোড়া, লোক-লস্কর,—আবার বাঞ্ছা? বলে হা-হা করে হেসে উঠলেন।

—আমার সন্তান নাই বাবা! সন্তান হয়, সব মরা সন্তান। অনেক প্রার্থনা করেছি—মায়ের কাছে—

—কার কাছে? ওই ন্যাংটা মাগীর কাছে। শ্মশানে ওটা ন্যাংটা হাহা হা! সংসারে ওটা ভিখিরী! হাহা-হা। ওই দেখ না কালীমন্দিরের আশে-পাশে ওই টেনা-পড়া দুম্বো দুম্বো কুমারী মেয়ে একটা পয়সা দাও, একটা পয়সা দাও বলে বেড়াচ্ছে, ওর মধ্যে সেটাও আছে। চোখ থাকলেই দেখবে। সেদিন আবার ঢং করে ভেসে এসেছিল মড়া হয়ে। হাহা হা। ফেলে দিলে। তা ও-ই করবে তোমার বাঞ্ছাপূরণ? ধুর ধুর ধুর! মন্দিরে যেটা আছে সেটার মুখ চোখ জিভ সব তো তৈরী করা! হাহা-হা!

লোক জমে গিয়েছিল অনেক। জনকতক লোক কালীর নিন্দে করার জন্যে রেগে উঠেছিল। তান্ত্রিক হাহা-হা করে হেসেছিলেন। সে হাসি আর থামে না। সোমেশ্বরের রোমাঞ্চ হয়েছিল সে হাসিতে। তিনি তাঁর হাত চেপে ধরেছিলেন।—বাবা!

উঠে দাঁড়িয়েছিলেন তান্ত্রিক। তিনিও হাত চেপে ধরেছিলেন সোমেশ্বরের। সোমেশ্বর শিউরে উঠেছিলেন।

তান্ত্রিকের হাতে যেন আগুনের মতো উত্তাপ। চোখ দুটো ঝকমক করে উঠেছিল। তান্ত্রিক বলেছিলেন, হবে। হবে। বাঁচবে ছেলে হেহে-হে! নিশ্চয় বাঁচবে। কিন্তু যজ্ঞ করতে হবে। করব আমি। আর ওষুধ দোব। খেতে হবে। হ্যাঁ।

—তাই করুন।

—হেহে-হে। সে এখানে নয়। বুঝেছ। এখান থেকে আমার ঘাড়ধাকা হয়ে গিয়েছে হেহে-হে। আমি তাতেই মনে মনে তোমাকে ডাকছিলাম, হেহে-হে! কীর্তিহাটে যেতে হবে। বুঝেছ। ওখানে সিদ্ধেশ্বরীর আসন আছে। ওখানে বসে সাধন করব। হেহে-হে। হবে।

—তার সঙ্গে আমার স্ত্রীর মাথার দোষ হয় মধ্যে মধ্যে, তা-ও ভাল করে দিতে হবে।

—সব হবে, সব হবে, হেহে-হে! কি মজা, হেহে-হে। দেখ দেখ, যোগটা দেখ—হেহে-হে!

তারপর হঠাৎ একেবারে যেন উম্মাদ হয়ে গেলেন—জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মন্দিরের দিকে তাকিয়ে গালাগাল শুরু করলেন—হারামজাদী বেহায়া ন্যাংটা মাগী! এবার তোর একদিন কি আমার একদিন!

সোমেশ্বর তাঁর দৃষ্টি দেখে শিউরে উঠেছিলেন। কাত্যায়নীর মাথার ঘোমটা খুলে গিয়েছিল।

.

সুলতা, অলৌকিক শক্তিটক্তির কথা আমি তোমার মনে বা কারুর মনেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছিনে—চাইও না। কিন্তু পাগলের মত মানুষ যখন কিছু খোঁজে, ক্ষ্যাপা যখন পরশপাথর খুঁজে খুঁজে ফেরে, তখন এমনি দৃষ্টি চোখে ফোটে। আয়নায় আমিও মধ্যে মধ্যে আমার চোখে এমনি দৃষ্টি দেখেছি।

সুলতা কিছু বলতে চাচ্ছিল। এবং সে কিছু যে ব্যঙ্গ শ্লেষাত্মক, তার আভাসও ফুটে উঠেছিল তার দৃষ্টিতে এবং ঠোঁট দুটির ভঙ্গিমার মধ্যে চাপা হাসিতে।

বাধা দিয়ে সুরেশ্বর বললে, থামো সুলতা, ব্যঙ্গ-শ্লেষ আমাকে আজ বিধতে পারবে না। আমার মনে একটি বিশ্বাসের দুর্ভেদ বর্ম আমাকে ঢেকে রেখেছে। বহু সন্ধানে যা আমি পেয়েছি, তাই আমি বলছি। এই মুহূর্তে আমার চোখের দিকে—ঠিক ওইরকম না হলেও, অনেকটা ওইরকম দৃষ্টি দেখতে পাবে। ওতে আমি বিশ্বাস করেছি। কারণ, সোমেশ্বরের স্ত্রীর এর পরের সন্তানটিই জীবন্ত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এবং বেঁচেও ছিল। সেটি কন্যা। তার তিন বছর পর হয়েছিল পুত্র। এবং কাত্যায়নী দেবীর মাথার গোলমাল ভাল হয়ে গিয়েছিল। তান্ত্রিক যজ্ঞ করেছিলেন, ওষুধও খাইয়েছিলেন। এবং এখনও আমাদের ওখানে বায়েনরা আছে, যারা ওই তান্ত্রিককে যথাসর্বস্ব দিয়ে সেবা করেছিল, তাদের তিনি বন্ধ্যাত্বের ওষুধ দিয়ে গিয়েছিলেন। আরও দুটি ওষুধ দিয়েছিলেন—একটি দু’দিন অন্তর পালাজ্বরের ওষুধ। একটি পয়সা একটি সুপুরী নিয়ে তারা ওষুধ আজও দেয়, শিকড় এবং কোন উদ্ভিদের পাতা, তারা দলে পিষে দেয়, লোকে চিনতে পারে না, তাতে লোকে সারে। আমি দেখেছি। তোমরা বিশ্বাস কর বা না কর, রাসপুটিনের ইতিহাস রাশিয়ার কম্যুনিস্ট ইতিহাস থেকেও মোছেনি!

সুলতা তাকিয়েছিল ছবিটার দিকে।

সোমেশ্বরের হাত ধরে তান্ত্রিক দাঁড়িয়ে আছেন। দীর্ঘকায় সোমেশ্বরের হাত ধরে একটি সোজা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, মাথায় তাকে সুরেশ্বর সোমেশ্বরের থেকেও উঁচু করে এঁকেছে। বুকের মোটাসোটা হাড়গুলি প্রকট হয়ে উঠেছে।

আশ্চর্য রকমে সজীব হয়ে উঠেছে এই তান্ত্রিকটি। তার চোখ দুটো ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে। বড় বড় চোখের সাদা ক্ষেতে লালের আভা ফুটিয়েছে; প্রকট পঞ্জরাস্থিগুলির অন্তরালে রুক্ষ কঠোর বা ক্ষুধার্ত হৃদয়ের স্পন্দনের পর্যাপ্ত আভাস মিলছে। একটা রহস্যময় হাসি তার মুখে, ধূসর কালো গোঁফ-দাঁড়ির মধ্যে সাদা সুগঠিত দাঁতের সারি। বিদ্রুপ ব্যঙ্গের বাঁকা রেখার সে হাসি ধারালো তীক্ষ্ণ। হয়তো খানিকটা হিংস্র কিম্বা সেটার অর্থ ক্রুদ্ধ প্রভুত্ব! গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পরনে গেরুয়া কাপড়, পায়ে খড়ম।

সুলতাকে ছবিটা আকর্ষণ করলে। সে উঠে কাছে গিয়ে দেখতে লাগল। সুরেশ্বর বললে—ব্যাকরণ নির্দেশ লঙ্ঘন করলে রূপ হয়তো থাকবে কিন্তু রূপের অন্তরালের রূপসী বা মোহিনী যিনি, তিনি মুখ ফেরাবেন নতুন বউয়ের মত। লজ্জা না বলি, সরম যাকে বলি, তা যার মধ্যে বেশী আছে, তিনি হয়তো এই মডার্ন যুগেও চোখ বুজে ফেলবেন। ছবি একটু দূর থেকেই দেখো, তাতে রূপসী অসঙ্কোচে রূপের রঙ-রেখার বাতায়নে মুখ রেখে চেয়ে থাকবেন। ছবিটার বৈশিষ্ট্য আছে। আশেপাশে যে বনচ্ছায়ার আভাস তার মাঝখানে তান্ত্রিক—কাছ থেকে একরকম দুর থেকে দেখলে মনে হবে আঁধার ভেদ করে বেরুচ্ছে।

সুলতা হেসে পিছিয়ে এসে ছবিখানাকে দেখতে দেখতে বললে—সত্যিই ছবিটা বড় ভাল হয়েছে, সুরেশ্বর। তান্ত্রিক যেন কাছে টেনে নিয়ে যায়।

সুরেশ্বর জানালা দিয়ে বাইরে রাত্রির আকাশের সন্ধানে চোখ ফিরিয়ে বললে—ছবিটাকে বারকয়েক আমি এঁকেছি। বাস্তবের সত্যকে ফোটাতে চেয়েছি। রায়বাড়ীর কুলজী আর কীর্তিহাটের কড়চার উপকরণ খুঁজতে খুঁজতে একটা সত্য আমি আবিষ্কার করেছি, সেটা হল এই যে, একটা দুর্নিবার আকর্ষণে কিছু যেন টানে। আমি ওখানে গিয়ে তারই টানে যেন পড়ে গিয়েছিলাম। যত হাতড়াই, যত ভাবি এই পেয়েছি, ততই দেখি আরও গাঢ়তর অন্ধকারের মধ্যে গিয়ে পড়েছি। আর যত অন্ধকার গাঢ় হল, ততই মনে হল, এর চেয়ে সত্য আর কিছু নেই।

বিচিত্র হেসে সুরেশ্বর বললে—গল্প শুনে ভেবেছিলাম, এর পর নিশ্চয় তান্ত্রিক ধরা পড়বে বুজরুক বলে। ক্রনোলজি ভেঙ্গে একটা গল্প বলি—সেটা ঘটেছিল আমার পিতামহের অর্থাৎ রায়বংশের বিদগ্ধ শিরোমণি দেবেশ্বর রায়ের আমলে। এক তান্ত্রিক এসেছিলেন, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মানুষ, দাড়ি-গোঁফে-চুলে বেশ ঘোরালো চেহারার মানুষ। এসে রায়বাড়ীতে ওঠেননি, বসেছিলেন রায়বাড়ীর বিমলদীঘির বাঁধা ঘাটে। তারপর পথচারীদের অতি পরিচিতের মত নাম ধরে ডেকে কাছে এনে কিছু কিছু গোপন কথা বলে বিমূঢ় করে দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রটে গেল—ত্রিকালদর্শী পুরুষ এসেছেন। সব থেকে বিস্ময়কর কথা কিছু কানে কানে বলেছিলেন দেবেশ্বরকে। চমকে উঠেছিলেন তিনি। মেজঠাকুরদা শিবেশ্বর তখন প্রচুর খেয়ে খেয়ে ডিসপেপসিয়া ধরিয়েছিলেন, তাঁকে বলেছিলেন–বাবা, আপনার পাকস্থলীতে তিনটি অপাচ্য অন্ন রয়েছে। একটির বর্ণ লাল, একটির কালো, আর একটি নীলাভ। কোন বন্ধুরূপী শত্রুর বাড়ীতে সমাদরের নিমন্ত্রণের মধ্যে আপনাকে খাইয়েছে তারা। তার থেকেই এর সৃষ্টি। এবং এই অন্নই হয়তো—। অন্তত আপনার জীবনে সকল অন্নকেই বিষাক্ত করে দেবে। আর তার ছেলে ধনেশ্বরকে দেখে বলেছিলেন—এর সাংঘাতিক ফাঁড়া আছে। রায়বাহাদুর তখন বেঁচে কিন্তু তিনি তখন তীর্থে। অবশ্য তিনি থাকলেও প্রভাবমুক্ত রাখতে পারতেন না নিজেকে। সে-কথা যাক। এর পর প্রতিকারের জন্য শ্মশানে কালীপূজার ব্যবস্থা হল। কৃষ্ণবর্ণ ছাগ থেকে শুরু করে আয়োজন উপকরণ অনেক

লোকটা বুজরুক। খেলাটা শেষ পর্যন্ত গুটিয়ে তুলতে পারেননি। মহানিশার শ্মশানে কালীকে একাকিনী অবস্থায় ফেলে দিয়ে মূল্যবান দ্রব্যগুলি পোঁটলা বেঁধে নিয়ে পালিয়ে ছিলেন। মুল্যবান দ্রব্যের মধ্যে সব থেকে মূল্যবান ছিল একটি নীলা আর একটি পান্না। শনি এবং রাহুর দশা বলে নীলা ধারণের ব্যবস্থা করেছিলেন। কলকাতা থেকে নীলা এসেছিল, সে আমলে দুটি রত্নের দাম নিয়েছিল সাতশো টাকা। দেবোত্তরের খাতায় খরচ পড়ে আছে।

এঁদের আপসোস হয়নি। এঁরা নিশ্চিত হয়েছিলেন এই কারণে যে, লোকটা যেহেতু বুজরুক ভণ্ড, সেইহেতু তার সব কথাই মিথ্যা হতে বাধ্য।

এসব গল্প মুখরোচক। ওই গুণে শুধু বেঁচেই নেই, হাত পা ছড়িয়ে বেঁচে আছে। আমারও শোনা ছিল। সুতরাং সোমেশ্বর তান্ত্রিককে নিয়ে এসে কীর্তিহাটে যজ্ঞ করিয়েছিলেন শুনে ভেবেছিলাম এমনি কিছু একটা সত্য প্রকাশ পাবে; যেটা কীর্তিহাটের বক্তাদের কাছে দুর্বোধ্য এবং দুর্ভেদ্য হলেও আমার মত বিদগ্ধ শ্রোতার কাছে ধরা পড়বে। কিন্তু বিস্ময়ের কথা তা পড়েনি। শুধু তাই নয়—আরও সেই তান্ত্রিকের ওষুধ ওখানে অনেক জনের মধ্যে সফল হচ্ছে। আমার দু’দিন অন্তর জ্বর হয়েছিল, ডাক্তারি ওষুধে, কুইনিন-ইনজেকশনে বন্ধ হয়নি। আমি ভাল হয়েছি ওই ওষুধে। খেতেও হয়নি। একটা পয়সা আর একটা সুপুরী নিয়ে ওখানকার বায়েনরা একটা জলজ উদ্ভিদ দলে পিষে হলুদমাখা ন্যাকড়ায় বেঁধে শুঁকতে দিয়েছিল। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত শুঁকে জলে ফেলে দিতে হয়। এও সেই তান্ত্রিকের ওষুধ।

সেই তান্ত্রিকের ওষুধে আর যজ্ঞের ফলে রায়বাড়ীর বধু রাজকুমারী কাত্যায়নী দেবী বৎসর খানেক পরেই জীবন্ত-কন্যা প্রসব করলেন। এ প্রত্যাশা সকলেই করেছিলেন, কারণ অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তিনি আগে দু’মাস থেকেই বিষণ্ণ হতেন, তিন-চার মাসে ঘরে ঢুকতেন, বোবার মত হয়ে যেতেন। পাঁচ-ছ’ মাস থেকে আগুনের মত উগ্র হয়ে উঠে সমস্ত সংসারটাকে দাহন করতেন। এবার তার কিছুই হয়নি।

তান্ত্রিক বলেছিলেন-পুত্র হোক, কন্যা হোক—ব অক্ষর আদিতে রেখে নামকরণ করো।

তান্ত্রিক তখন গত হয়েছেন। কংসাবতীর জলে নৌকোডুবিতে ভেসে গেছেন। সোমেশ্বরের আর আপশোশের সীমা ছিল না। তিনি তান্ত্রিককে কীর্তিহাটে এনে এখানেই বাস করিয়েছিলেন। তান্ত্রিকের প্রায় ক্রীতদাস হয়ে পড়েছিলেন। উগ্র তান্ত্রিক উপদ্রবের শেষ রাখতেন না। কালীমায়ের পূজক তাঁর ভয়ে পালিয়েছিল। পূজা করতেন তান্ত্রিক নিজেই। বিচিত্র লোক। তাঁর নিজের কাছে ছিল এক শালগ্রাম শিলা—তাঁর পূজা আর কালীর পূজা করতেন একসঙ্গে। শিউরে উঠত সকলে। কিন্তু কেউ কিছু বলতে সাহস করত না। কারণ কাত্যায়নী তখন অন্তঃসত্ত্বা হয়েও সুস্থ স্বাভাবিক আছেন। ওদিকে কলকাতায় একটা প্রকাণ্ড মামলায় জয়ী হয়েছেন সোমেশ্বর।

তান্ত্রিক খবর শুনে হেসে বলেছিলেন, হাহাহাঃ। হাহাহাঃ। হবে না। হাহাহাঃ- সৌভাগ্য-শিলা রাজরাজেশ্বর—হাহা-হাঃ!

এরই কিছুদিন পর।

তান্ত্রিক তখন যেন অতি অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। কাঁসাইয়ের ওপারে যে জঙ্গলটার কথা এবং যে শিমুলগাছটার কথা আমি বার বার বলেছি, যেখানটাকে তান্ত্রিক চিনেছিলেন এক সিদ্ধাসন বলে, লোক যেটাকে বলত সিদ্ধেশ্বরীতলা, সেখানে তিনি পঞ্চপর্বের রাত্রে যেতেন সাধনা করতে। রাত্রে যেতেন নৌকো করে, সঙ্গে যেতেন সোমেশ্বর, তাঁকে উত্তর সাধক হবার প্রতিশ্রুতি তিনি করিয়ে নিয়েছিলেন। আর বায়েনদের একজন খুঁজে খুঁজে তাঁকে শব এনে দিত। সেদিন ছিল চতুর্দশীর রাত্রি।

ভাদ্র মাস। কাঁসাই তখন দুকুলপ্লাবিনী। সোমেশ্বর, তান্ত্রিক আর সোমেশ্বরের অতি অনুগত দুজন—তারা হাড়ি এবং শিবে বাগ্দী, এরা যেত নৌকো নিয়ে। তারা হাড়ি আর শিবে বাগ্দীকে বলা চলে তাল আর বেতাল, যদি সোমেশ্বরকে বলা যায় বিক্রমাদিত্য। উৎসবে ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে ছাড়াও এরা বন্যায়, অগ্নিদাহে, শত্রুহননে সর্ববিধ কর্মেই সোমেশ্বরের সঙ্গী। এদের হাতে নৌকাখানা কংসাবতীর প্রলয়ঙ্করী উন্মাদনাকে মথিত করে ঠিক ওই জঙ্গলে গাছের গোড়ায় গিয়ে লাগত। এঁরা দুজনে সব উপকরণ নিয়ে গিয়ে উঠতেন শিমুলতলায়। উপকরণ সব সাজিয়ে নিয়ে তান্ত্রিক বলতেন সোমেশ্বরকে—যাঃ।

চলে আসতেন সোমেশ্বর। ফিরে এসে নৌকায় বসতেন। যতক্ষণ না সাড়া দিতেন তান্ত্রিক ততক্ষণ যাবার হুকুম ছিল না। এদিকে জঙ্গলে থাকত ভরু বায়েন। তার কর্ম ছিল ওই শবটিকে বেশ ভাল করে তালপাতার চাটাইয়ে জড়িয়ে গাছের উপরে বেঁধে রাখা। ভোরবেলা উঠে আসতেন তান্ত্রিক। ধরে নিয়ে আসত ভরু, তারপর ধরতেন সোমেশ্বর। এনে নৌকায় চাপাতেন। এপারে এসে সেই শেষরাত্রির অন্ধকারের মধ্যে তারা এবং শিবে তাঁকে ধরাধরি করে এনে শুইয়ে দিত তাঁর ঘরে। সোমেশ্বর স্থান করে চলে যেতেন অন্দরে।

এরই মধ্যে সেদিন ওপার থেকে ফিরবার সময় হঠাৎ নৌকোখানা গেল উল্টে। ভরা কাঁসাই। তার উপর আকাশে ছিল মেঘ-ঝড়। সমুদ্র খুব দূরে নয়। তুফান এখানে বেশী হয়। নৌকা উল্টে সকলে ডুবল জলে। সোমেশ্বর, শিবে, তারা তিনজনে কোনক্রমে সাঁতার দিয়ে পাড়ে উঠলেন কিন্তু সারারাত্রির সাধনার পর মদ্যপান এবং সাধন-ক্লান্তিতে বিবশচৈতন্য এবং অবশদেহ তান্ত্রিক গেল ভেসে। এঁরা কাদা মেখে ঘরে ফিরলেন। তান্ত্রিকের আর সন্ধান মিলল না। হয়তো এখানে তাঁর সাধনা সিদ্ধ হবার নয়, সিদ্ধি অপেক্ষা করছিল গঙ্গাসাগর সঙ্গমে। কাঁসাই হয়ে হলদী। হলদী হয়ে। ভাগীরথী। তারপর হিজলীর পাশ দিয়ে ওপাশে কাকদ্বীপকে রেখে রসুলপুরের মোহনা পার হয়ে সাগরদ্বীপে সাগরসঙ্গমের আবর্তের মধ্যে সিদ্ধি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল।

সোমেশ্বর লজ্জায় ভয়ে মুহ্যমান হয়ে গেলেন। খোঁজ তিনি করালেন অনেক। কিন্তু পেলেন না। লজ্জা এই জন্যে যে, নিজে বাঁচলেন অথচ তান্ত্রিক শ্যামাকান্তকে বাঁচাতে পারলেন না। ভয়, এরপর যদি বিঘ্ন ঘটে, যদি কাত্যায়নীর উন্মত্ততা দেখা দেয়। কিন্তু তা দেয়নি। তবু তিনি আতঙ্কিত হয়ে বজরায় অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে কাত্যায়নীকে নিয়ে চলে গেলেন কলকাতায়। কীর্তিহাটে যেন আতঙ্ক দেখছিলেন। কলকাতায় জন্ম হল তাঁর প্রথম জীবিত সন্তান—কন্যার। নাম হল বিমলা।

বিমলার অন্নপ্রাশন হল কীর্তিহাটে। শুধু অন্নপ্রাশন নয়—সঙ্গে সঙ্গে তান্ত্রিকের শালগ্রাম, সৌভাগ্য-শিলা রাজরাজেশ্বরের প্রতিষ্ঠা হল।

খরচ হয়েছিল কুড়ি হাজার টাকা।

রাজরাজেশ্বরের স্বতন্ত্র চত্বর এবং মন্দির—দশ হাজার টাকা। রাজরাজেশ্বরের এক মুকুট তৈরি হয়েছিল সাহেব জুয়েলারদের বাড়ীতে। হীরে বসানো ছিল পাঁচখানা। মিহি মুক্তোর ঝালর ছিল। দাম এক হাজার টাকা।

বাকীটা উৎসব, ভোজন, দান।

যে মামলাটায় জিতেছিলেন, তাতে সোমেশ্বর পেয়েছিলেন এক লক্ষ টাকার ডিক্রি। বাকী আশী হাজার টাকায় কিনেছিলেন নতুন জমিদারী। সেরেস্তা বড় হল। ম্যানেজার বহাল হল নায়েবের বদলে। বরকন্দাজ বহাল হল পশ্চিমদেশী; ভোজপুরী জোয়ান। শিবে-তারার মধ্যে তারা থাকত কলকাতায় সোমেশ্বরের কাছে। শিবে মরেছে বাঘের হাতে। হলদীর মোহনার কাছে গিয়ে আর ফেরেনি।

নতুন ম্যানেজার পাকা লোক ছিলেন, মহিষাদলের রাজা গর্গবাহাদুরদের স্টেটের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। দেওয়ানদের নতুন নাম হয়েছে ম্যানেজার। গিরীন্দ্র আচার্য। গর্গবাহাদুরদের কুনজরে পড়েছিলেন। তাঁকে আশ্রয় দিলেন সোমেশ্বর, বসবাস করালেন।

আর আনলেন নবদ্বীপ থেকে রামব্রহ্ম স্মৃতিতীর্থকে। কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্য দীক্ষা নিয়েছিলেন নবদ্বীপে, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের এক বংশধরের কাছে। তিনি গত হয়েছেন, আছেন গুরু-মা! সোমেশ্বর দীক্ষা নিয়েছেন গুরু-মার কাছে। সেই গুরু-মাই দিলেন এই তরুণ ছেলেটিকে, বাইশ তেইশ বৎসর বয়স, নিষ্ঠাবান ধার্মিক এবং পণ্ডিত ছেলে, ওঁদেরই জ্ঞাতি। মায়ের পুজায় বা প্রভু রাজরাজেশ্বরের সেবার কোন ত্রুটি হবে না, হতে পারে না।

এ ব্যবস্থা সোমেশ্বরের নয়, এ-ব্যবস্থা কাত্যায়নী দেবীর। তাঁর মস্তিষ্ক এখন সুস্থ। কন্যাকে কোলে নিয়ে বর্ষার পৃথিবীর মত শান্ত শীতলা। তবে মধ্যে মধ্যে ঝড় উঠলে সেটা ছোটখাটো সাইক্লোন হয়ে দাঁড়ায়। দেবসেবায় ত্রুটি হলে তাঁর কন্যার অমঙ্গল হবে। সুতরাং সে ব্যবস্থা তিনি করলেন। শুধু এখানের নয়, তাঁর পিত্রালয়েরও। এরপর থেকে রায়বংশে কাত্যায়নী দেবী এক দীপ্তিময়ী দেবী।

সমস্ত রায়বংশ, কীর্তিহাট কাত্যায়নী দেবীর ভয়ে কাঁপত।

তিন বছর পর ভূমিষ্ঠ হল পুত্র।

ব দিয়ে নাম। নাম হল বীরেশ্বর রায়। বীরেশ্বরের জন্ম কলকাতা। সোমেশ্বর রায় তখন কলকাতায় খুব কর্মব্যস্ত। তাঁর অভ্যুদয় হচ্ছে, অপ্রত্যাশিত অভ্যুদয়। ইংরেজ অ্যাটর্নীর কাছে টন্ডির কাজ করে আইনে তাঁর খ্যাতি হয়েছে। অনেক বড়ঘরের ল-এজেন্ট হয়েছেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর তখন এদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁর কাছে যান। তিনি পছন্দ করেন। দ্বারকানাথ তখন নুনের দেওয়ানের চাকরী ছেড়ে স্বাধীনভাবে নানান ব্যবসা করছেন। তার মধ্যে আইনের পরামর্শদাতা হিসেবে নাম তাঁর খুব। তিনি ল্যান্ড হোল্ডারস সোসাইটি স্থাপন করেছেন, প্রসন্নকুমার ঠাকুর তাঁর সহকারী; সোমেশ্বর প্রসন্নকুমারের সহকারী বা সহযোগী। এই সময়টা তখন জমিদারদের একটা দুঃসময়। কোম্পানী নতুন আইন করে লাখেরাজ ব্রহ্মত্র নানকার প্রভৃতির উপর কর ধার্য করতে চেষ্টা করছেন। ওদিকে লিমিটেশন এ্যাক্ট করে লর্ড ওয়েলেসলী জমিদারদের একটা বড় ঘা দিয়ে গেছেন। প্রজার চার বছর খাজনা বাকী হলেই বৎসারান্তে শেষ বছরের খাজনা তামাদি বলে গণ্য হবে। অবশ্য চার বছর খাজনা বাকী হলে শতকরা ২৫ টাকা সুদ জমিদার পাবে। এদেশে সুদ ছিল মহাজনীতে, খাজনায় জমিদার সুদও নিতেন না এবং প্রজার খাজনা যত কালেরই বাকী থাক, দিতে সে অস্বীকার করত না। ছ আইন সাত আইন উঠে গেছে। প্রজাকে বেঁধে রেখে খাজনা আদায় করা যায় না। জমিতে গাছ ধান ক্রোক করে টাকা আদায় নিষিদ্ধ হয়েছে। এর উপর এই লাখেরাজ বাজেয়াপ্ত বা তার উপর খাজনা ধার্য হলে জমিদার এবং তার সঙ্গে বাংলার মধ্যবিত্ত গৃহস্থের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছেন রাণী কাত্যায়নী, পাইকপাড়ার রাণী, কান্দির রাণী। দ্বারকানাথ তাঁর এস্টেটে আইনের পরামর্শদাতা। সোমেশ্বর তাঁর সহকারী। এ-বাড়ী রায়বংশের স্থাপয়িতা কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্যের মনিব-বংশ বলতে গেলে। তারপর লালাবাবু এ-বংশের সব অপরাধ মুছে দিয়ে পুণ্যবংশে পরিণত করেছেন। এ-সব লাখেরাজ রাজস্বমুক্ত সম্পত্তি, কোম্পানী সরকারের প্রকাশ্য নীলামে লাখেরাজ বলে সরকারই নীলেম করিয়েছেন, কিনেছিলেন লালবাবু দেবত্র হিসাবে। বিহারে এবং অযোধ্যা অঞ্চলে বৃন্দাবনের কাছে সে সম্পত্তি অনেক সম্পত্তি।

এখন কোম্পানীই দাবি করেছেন, খাজনা দিতে হবে। নতুন কালে খবরের কাগজ হয়েছে। ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া, ক্যালকাটা কুরিয়ার, ইংলিশম্যান। বাংলা কাগজও হয়েছে।

এসবের মধ্যে সোমেশ্বর জড়িয়ে পড়েছেন। তাতে তাঁর প্রতিষ্ঠাও হয়েছে। তবে তিনি হিসেবী লোক, সব কাজেই হিসেব করে নামেন। রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা বন্ধ করবার মত আন্দোলনের বাইরে থেকেছেন। সে-সব ক্ষেত্রে তিনি রাধাকান্ত দেবের দলের লোক। দ্বারকানাথের একখানা মজার পত্র আছে তাতে। তিনি সোমেশ্বরকে লিখেছেন, “আমি জানিয়া আশ্চর্য ইলাম যে, স্ত্রীর কথায় তুমি সতীদাহ ও বিধবাবিবাহ সমর্থন হইতে পশ্চাদপদ হইতেছে। ইহা লজ্জার কথা। অতীব লজ্জার কথা।” কাত্যায়নী দেবীর ভয়ে সোমেশ্বর রাধাকান্ত দেবের দলে যোগ দিয়েছিলেন।

এ-সবের নজির থাকে থাকে সাজানো ছিল এই জানবাজারের বাড়ীতে। এ-সব আমি অনেক পরে-পরে আবিষ্কার করেছি। আগেরটা পেয়েছি পরে, পরেরটা পেয়েছি আগে। তোমাকে বলবার সময় গুছিয়ে বলছি। আর কিছু শুনেছি গল্প, তার বেশীর ভাগ মেজঠাকুমার কাছে।

***

সুলতা, মেজঠাকুমা আমার মধ্যে মধ্যে দুঃখ করে বলতেন, সুরেশ্বর, ওরে আমার ভয় হয় কি জানিস? ভয় হয় আমার না রাবণের মা নিকষার দশা হয়! রায়বংশের পুরী আগলে আমাকে না বসে থাকতে হয়, সেই পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত।

সুরেশ্বর বললে-আমি সেদিন সকালে যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছি সুলতা। আমি সেই মডার্ন আর্টিস্ট, বিদ্রোহী আধ-পাগলা সুরেশ্বর নই; একটা ভাবের ঘোরের মধ্যে চলে গেছি ১৮৩৭-৩৮ সালে। মধ্যে মধ্যে সোমেশ্বর রায় হতে চেষ্টা করছিলাম। ওই তান্ত্রিক সন্ন্যাসীকে কল্পনা করেছি, মনে হয়েছে চোখে তাঁকে দেখছি। তোমাকে কাত্যায়নী ভাবতে চেষ্টা করেছি, এমন কি ব্রজদার সেই শেফালি মেয়েটিকে ভাবতে চেষ্টা করেছি, সোমেশ্বরের প্রেয়সী বাঈজী। ওই যাদের হাতে টাকা দিয়ে সেদিন ঘরে যেতে বলে এসেছিলাম, তাদের ভাবতে চেষ্টা করেছি, সোমেশ্বর রায়ের সেবাদাসী ঝি।

সুলতা হেসে ফেললে। বললে—মনে মনে পরম তৃপ্তি নিশ্চয় পেয়েছিলে। কিন্তু আমার নামটা টানছ কেন? যদি-বা সেদিন তোমার তা মনে হয়ে থাকেই তবে ওটা বাদ দিয়েই বল! ওর জন্যে তোমাকে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মত অশ্বত্থামা হত ইতি গজ বলার জন্য নরকদর্শন করতে হবে না, বা তোমার রথখানি মাটির উপরে বাতাসলোকে চলে না যে ধপ করে মাটিতে আছড়ে পড়বে।

হেসে সুরেশ্বর বললে—এত আছাড় খেয়েছি সুলতা যে, তা খেয়ে আছাড়-প্রুফ হয়ে গেছি। পাহাড়ের শিখর থেকে সমতলে পড়েছি, স্বর্গ থেকে নরকে পড়েছি; তা নইলে আজ তোমার এই কথাটিতেই আছড়ে পড়ে হাত-পা ভাঙ্গতাম। ঝগড়া করব না, ধরে নাও কাত্যায়নী তোমাকে ভাবি নি! তবে কথাটা এই যে আমি সেদিন সকালে যেন মৃত্যুপুরী বা অতীত কালের যবনিকা ঠেলে বর্তমানের দিকে পিছন ফিরে অভিভূতের মত হাতড়ে হাতড়ে চলেছিলাম, হঠাৎ পথ হারিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম। এই সময়ে বেলা তখন দশটা, মেজঠাকুমা এলেন, আমাকে চরণোদক দিয়ে নির্মাল্য মাথায় ঠেকিয়ে ওই কথাগুলি বললেন।

.

অভিভূত সুরেশ্বর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসু হয়ে মেজঠাকুমার দিকে তাকালে।

মেজঠাকুমা অত্যন্ত ম্লান হেসে বললেন—ধনেশ্বর গাল দিচ্ছে রে! ওই কথা বলে গাল দিচ্ছে। বলছে, আজ ওই বিশ্বাসঘাতিনীই সুরেশ্বরকে সব লাগাচ্ছে। ধ্বংস করছে মেজতরফকে। নিকষার মত হবে তুমি।

সুরেশ্বর বললে—না ঠাকুমা, পুরাণের কোন দুঃখিনীর সঙ্গে যদি তোমাকে তুলনাই করতে হয়, তবে তুমি গান্ধারী। গান্ধারীর স্বামী অন্ধ ছিলেন বলে সারাজীবন চোখে কাপড় বেঁধে ছিলেন, আলো দেখেন নি। তুমি বিয়ে করেছিলে ষোল বছর বয়সে ষাট বছরের শিবেশ্বর রায়কে। কুশণ্ডিকার হোমের আগুনে তুমি তোমার ষোল থেকে পঞ্চাশ, এই যৌবন কালটিকে আহুতি দিয়ে একেবারে একান্ন বছরের প্রৌঢ়া হয়েছিলে। তুমিই তো দুর্যোধন, দুঃশাসনকে উপেক্ষা করে সত্য কথা বলবে। নইলে কে বলবে বল!

মেজঠাকমা বললেন—মনটা জুড়িয়ে দিলি ভাই। আমি এখন যাই রে। একবার বাপের বাড়ি যাব, ওপাড়ায়, আমার বিধবা ভাজ খালাস পাচ্ছে। ভুগছে অনেক দিন থেকে। ডাক্তার বলেছে, আজ আর পার হবে না, একবার দেখে আসি।

সুরেশ্বর চমকে উঠে বললে—আর কোন বড় ডাক্তার দেখালে না?

—ডাক্তার? কি হবে?

—মানে?

—মানে বিয়ের এক বছরের মধ্যে বিধবা হয়েছে। ছেলে নেই, পুলে নেই। লোকের বাড়ী বলতে গেলে খেটে খায়। প্রথম যৌবনে লোকে এত মিথ্যে কলঙ্ক দিয়েছে যে, বেঁচে ছিল শরশয্যেতে ভীষ্মের মত! আমার থেকেও বছর চারেকের ছোট। কি করবে বেঁচে?

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল সুরেশ্বর।

মেজঠাকুমা একটু হাসলেন, যে হাসিতে অন্যের চোখে জল আসে। পা বাড়িয়ে আবার ফিরলেন, বললেন—হ্যাঁরে, চায়ের আগে দুখানা বাতাসা দিয়েছিল রঘু? খেয়েছিস?

—বাতাসা?

—হ্যাঁ, রাজরাজেশ্বরের শয্যাভোগ?

—শয্যাভোগ?

—হ্যাঁ। এখানে শয্যাভোগ হয় ঠাকুরের। আমি বাড়ীতে বলে রেখেছিলাম, তারা ভোর বেলাতেই দিয়ে গেছে। আমাকে বললে তারা?

রঘু বললে—হ্যাঁ, উতো দিয়ে গিয়েসে।

—তা দিসনি কেন?

—উ!

—ওরে বড়লোকের চাকর বড়লোক! উ! মানে উ! কি খাবে আমার বাবু! দে এনে দে। খা ভাই। আমি দেখে যাই। খা।

দুখানি ছোট বাতাসা। মেজঠাকুমাই মুখে ফেলে দিলেন। খেতে হল সুরেশ্বরকে। তবে গুড়ের বাতাসা, খারাপ লাগল না।

মেজঠাকুমা বললেন, আগে বরাদ্দ ছিল কাঁচা মিষ্টির। দুটি করে কাঁচা মিষ্টি, ঠাকুরের শয়নের সময় পাশে রেকাবীতে করে রাখা থাকত। আর জল। বরাদ্দ করেছিলেন রাজকুমারী বউ কাত্যায়নী! ফোমেশ্বর রায়ের স্ত্রী। লোকে বলত, বাঘিনী ঠাকরুণ। সুরেশ্বর হেসে বললে, সোমেশ্বর রায়কে মেজঠাকুমা বলেন, ফোমেশ্বর রায়। শ্বশুর-স্বামীর নাম তো করতে ছিল না সেকালে। তারপর সুরেশ্বর জের টেনে বললে—মেজঠাকুমা বললেন—তাঁর মেয়ে বিমলা যখন দু’বছরের তখন শেষরাত্রে উঠে সে ক্ষিদে পেয়ে কাঁদত। উপরি উপরি দিন কয়েক পর একদিন ঝিকে বললেন—মাথার গোড়ায় দুটো করে মিষ্টি রেখে দিস, আর এক গ্লাস জল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল কীর্তিহাটেও তো খুকী-খোকা আছে, মা মুক্তকেশী খুকী আর রাজ রাজেশ্বর গোপাল। তাহলে তো তাঁদের। ও তো ক্ষিদে পায়! এই পরদিন উঠেই হুকুম হল, বজরা সাজাও, আমি কীর্তিহাট যাব। এসেই সেই দিন থেকেই এই ব্যবস্থা হল। সেকালে মিষ্টান্ন তৈরী হত বাড়ীতে। বড় বড় গাই ছিল, মোষ ছিল। ঠাকুরবাড়ীতে হালুইকর বামুন ছিল। তারা ক্ষীর করে, ক্ষীরের নাড়ু তৈরী করে দিত। তারপর তোমার ঠাকুরদাদাদের আমলে চাকরান জমি দেওয়া হয়েছিল ময়রাদের। তারা কাঁচা মিষ্টি দিয়ে যেত। তারপর তোমাদের সেরেস্তা থেকে ময়রার নিজের খাজনার জোতের উপর যখন বাকী খাজনার নালিশ হল, তখন ওই মিষ্টির জমিটা সমেত ভুক্তান করে নালিশ হল। নালিশের ডিক্রীর দায়ে জোত নীলেম হয়ে গেল। কিনলে ধনেশ্বর। তারপর ময়রা মিষ্টি বন্ধ করলে। তখন থেকে দুখানা বাতাসা ব্যবস্থা হল।

হাসলেন মেজঠাকুমা। বললেন—ওবেলা আসব ভাই, এবেলা যাই। ছুঁড়িটাকে বড় ভালবাসতাম। শেষ দেখাটা করে আসি!

—চলও আমি যাই!

—তুই যাবি?

—যাব না? তুমি যাচ্ছ, আমি যাব না কেন?

—আয়। তার ভাগ্য! যাচ্ছিস যদি তবে তার অস্থিটা অন্ততঃ যাতে গঙ্গা পায় তার ব্যবস্থা করে দে ভাই। দেহ নিয়ে আর কেউ যায় না; আর তাতে বাড়াও হয়ে যায়। অস্থিটা পাঠিয়ে দো

—সে তুমি দেবে। তুমি হুকুম করবে, আমি তামিল করব।

বিহ্বল হয়ে গেল মেজঠাকুমা। নীরবেই পথ চলতে লাগল। সদর রাস্তায় না গিয়ে রায়বাড়ীর পাশ দিয়ে স্নানের পুকুর, দুধপুকুরের বাগানের মধ্য দিয়ে চলছিল মেজঠাকুমা। হঠাৎ এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে বললে—এইখানটায় গোপেশ্বর সুখেশ্বরকে মেরে ফেলেছিল।

সুরেশ্বর বললে—চল। দুঃখ আর কত করবে?

মেজঠাকুমা বললেন—তা ঠিক বলেছিস ভাই। দুঃখ আর কত করব। তাই তো এত বড় ঘেন্নার কথার কলঙ্ক দিয়ে সেদিন যখন গুজব রটালে তখন প্রথমটা বুকে যেন শেল বিঁধেছিল। কি দুঃখ যে হয়েছিল কি বলব! কিন্তু ওই বলেই বুঝিয়েছি, দুঃখ আর কত করব!

হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন—আঃ হায় হায় হায়! এ্যাঁ! এ গাছটাও কেটে ফেলেছে! সামনে একটা প্রকাণ্ড খালের মত গর্ত। কোন বড় গাছ সমুলে কাটার চিহ্ন!

—হ্যাঁ, কোন বড় গাছ ছিল এখানে।

—বাগানের সব থেকে বড় আমগাছ ছিল এখানে। গাছটা দুধপুকুরে বাগান করবার সময় কুড়ারাম মশায় রাজকুমারী পুত্রবধূকে দিয়ে পুঁতিয়েছিলেন। মালদা’র আমের গাছ। আঁটির গাছ, গুড়িটা ছিল এত মোটা যে, দুটো মানুষে হাত বাড়িয়েও জড়িয়ে ধরতে পারত না। হুঁঃ! বলে একটি আক্ষেপসূচক ধ্বনি তাঁর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল। তারপর বললেন-এ সুখেশ্বরের ছেলেদের কাজ! ওই যে কল্যাণেশ্বর, ওর মত কুটিল আমি দেখিনি। ওর বাপ বাইরে যত ভদ্র ছিল, ভেতরে তেমনি ছিল কুটিল। ও-ই তো তোর মেজঠাকুরদাকে ঠাকুরদের গয়না বিক্ৰী করে বিঘে-কতক ভাঙ্গা কেনা হল এই জমাখরচ দেখিয়ে টাকাটা মারবার ফন্দী দিয়েছিল। ঠিকেদারী করে কল্যাণেশ্বর গাছ থেকে তক্তা তৈরী করিয়েছে।

—চল ঠাকুমা। বড় বাজে বকছ।

—বাজে বকছি?

—বকছ না?

—তুই ছোঁড়া বুঝবি নে রে। এর বেদনা তুই বুঝবি নে! কলকাতার মানুষ তুই, এখানকার তো নস! জানিস, এ গাছের একটা গল্প আছে। গাছটা তখন বেশ বড় হয়ে উঠেছে। কাত্যায়নী ঠাকরুণ পুকুরে চান করছেন, তখন বয়স পঁয়তাল্লিশের পার। এই গাছে এক ছোঁড়া ডোম উঠেছিল আম পাড়তে। ঠাকরুণ এসে ঘাটে বসেছেন, গায়ের কাপড় খুলে দাসীতে তেল মাখাচ্ছে। ছোঁড়ার কপালে দৈবাঘাত, সে ওই রঙ দেখে হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছিল। আর পড়বি-তো-পড় ঠাকরুণের নজরেই পড়ল। ঠাকরুণ হেঁকেছিলেন, কে রে শুয়ারের বাচ্চা! ছোঁড়াটা ভয়ে হুড়মুড় করে ডালে-ডালে পাঁচিলে নেমে লাফিয়ে পড়ে পালিয়েছিল। পাঁচিলের বাইরে এই যে ঢিবিটার উপর দিয়ে যাচ্ছি, এইটেই ছিল তখন ডোমপাড়া। কত্তারাই বসিয়েছিলেন। বাড়ীতে তারা জমাদারের কাজ করত। ঠাকরুণ তৎক্ষণাৎ উঠে দাসীকে বলেছিলেন, মাহুতকে বল জংবাহাদুরকে পাঁচিলের ওপাশে নিয়ে আসবে। পিঠে সাজটাজের দরকার নেই। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। হারামজাদী, হেলে-দুলে আস্তে-আস্তে যাবি নি, দৌড়ে যাবি। বুঝলি -আমি একশো গুনব। তার মধ্যে না এলে ঝাঁটা-পেটা করব। যা। একশোর মধ্যেই সে এসেছিল। তারপর বোধ হয় দুশো-তিনশো গুনতে গুনতে হাতী এল। হুকুম হল, ডোমরা সব জিনিসপত্র বের করে নাও ঘর থেকে। পাঁচশো গুনব আমি। তারপর হাতী ঘর ভেঙে দেবে। কাত্যায়নী ঠাকরুণ বাঘিনী ঠাকরুণ। ডোমরা বাদ-প্রতিবাদ করেনি, বেরিয়ে এসে সরে দাঁড়িয়েছিল। ঠাকরুণ মাহুতকে বলেছিলেন, সমশের, জংবাহাদুরকে বল-পাড়াটা ভেঙে মাঠ করে দেবে। তারপর অবিশ্যি ডোমদের জায়গা দেওয়া হয়েছিল, ঘর করবার জন্যে, টাকা, খড়, বাঁশ, তালগাছ দেওয়া হয়েছিল, তা হয়েছিল। কিন্তু ওই ছোঁড়াটাকে গাছে বেঁধে দশকোড়া লাগিয়েছিল চাপরাসীরা! এ গাছটা সেই গাছ রে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *