প্ৰথম খণ্ড - আদি পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পর্ব

কীর্তিহাটের কড়চা – ১.৯

সুরেশ্বরের জীবনকে কিন্তু এতে আর বিষণ্ণ বা বিমর্ষ করতে পারেনি। পাগলামি কিছুটা তারও আছে। সেটাই যেন বেড়ে গেল। পাগলামি বটে কিনা সেটা পাগল-বিশেষজ্ঞ বলতে পারেন। সুরেশ্বর তা ভাবে না, কারণ মধ্যে মধ্যে নিজেরই যে মনে হয় সে একটু পাগল। পাগল সে ততক্ষণ হতেই পারে না, যতক্ষণ পাগলামিকে পাগলামি বলে নিজের সন্দেহ হয়। সে সন্দেহ তার হতো। শুধু সন্দেহ নয়—ভয়ও হতো। তাদের রক্তে যে পাগলামির মত একটা দুরন্ত ব্যাধির মত কিছু আছে তাতে তার সন্দেহ ছিল না। সেগুলো মধ্যে মধ্যে প্রকাশ পেত নিজের অজ্ঞাতসারেই। এবার তাতে জোর ধরল। সব থেকে বেশী প্রকাশ পেতে লাগল সেটা তার বেশভূষা এবং স্টাইলের মধ্যে। হঠাৎ চুল-দাড়ি দুই রেখে ফেললে সে।

একেবারে প্রথমে সে তখন পাঁচ-ছ’দিন কামায়নি। মা তাকে দেখে বললেন,–ও কি, কামাসনি কেন?

দাড়ির খোঁচায় হাত বুলিয়ে বললেও একটা ঝঞ্ঝাট।

—ঝঞ্ঝাটি? কামানো?

—হ্যাঁ।

—তাই বলে কামাবিনে?

—দাড়ি রাখলে ভাল লাগবে না?

—বাপের মতো?

—না। ফ্রেঞ্চকাট-টাট নয়। আদি ও অকৃত্রিম ইন্ডিয়ান স্টাইল।

—না। দাড়ি রাখতে হবে না!

সুরেশ্বর বলেছিল—আমার সেলফ-পোর্ট্রেট আমি দাড়ি-গোঁফ এঁকে দেখেছি আমাকে খুব ভাল মানাবে মা!

মা তবুও বলেছিলেন—না না! কামিয়ে ফেল!

—দোহাই মা। এই তো কিছুদিন হল সাবালক হয়েছি বলে একগাদা কাগজপত্রে সই করলাম। কিন্তু বিষয়কর্ম তোমার হাতে রয়েছে, থাকবে। ওখানে আমি নাবালকই থাকব। এই একটা জায়গায় আমাকে সাবালক হতে দাও।

—এ উদ্ভট খেয়াল তোর হল কেন বল তো?

—ওই যে মা, অশৌচ পালন করতে ক’দিন কামাইনি, দাড়ি-গোঁফ বেরিয়েছিল, তা থেকেই বুঝলাম, খুব ভাল মানাবে আমাকে দাড়ি-গোঁফে। তারপর পোর্ট্রেট এঁকে দেখলাম। আর বিশ্বসুদ্ধ লোক দাড়ি কামাচ্ছে যখন, তখন এটা একটা অসাধারণ কিছু হবে।

মা কিছু আর বলেননি। ছেলের সম্পর্কে রায়বংশের বংশধর বলে তাঁর মনে একটা আশঙ্কা আছে। ছেলে যা কিছু উদ্ভট-উৎকট করে, তাই দেখে তিনি শঙ্কিত হন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সে ভয়ঙ্কর পথে পা বাড়ায়, ততক্ষণ তিনি বলতে গিয়েও বলতে পারেন না।

তিনি শুধু একটা জায়গায় সতর্ক হয়ে আছেন এবং শেষ পর্যন্ত থাকতে চান। সেটা বিষয় ও অর্থের অধিকার। এটাই সব তা তিনি স্বীকার করেন না। তবে এটা যে অনেকখানি, তা তিনি উকিলের ভাগ্নী এবং জমিদারের বধু হয়ে স্পষ্ট বোঝেন, তাঁর জীবন তাঁকে মর্মে মর্মে বুঝিয়েছে। একটা কথা যোগেশ্বর বলতেন তাঁকে। হেমলতা যখন তাঁকে কাগজ বের করতে বলেন, তখন বলেছিলেন; তারপরও বলতেন। বলতেন—দেখ, কাগজ শুধু কাগজ নয়, ব্যবসায়ও বটে। তাই বা কেন, আগে ওটা ব্যবসা, পরে ওটা কাগজ বা কাগজের মতবাদ—দেশের কল্যাণ। ব্যবসা করে টাকা আসে। এবং সেইটেই বড় হয়ে দাঁড়ায় ক্রমে। তখন বাজনার তালে গায়কদের নিয়ে যাওয়া যায় না, গায়করা বেতালা গাইলেও তার সঙ্গেই তাল মানিয়ে চলতে হয়! তা টাকার তো প্রয়োজন নেই আমার। টাকা তো রয়েছে। অর্থ পুঞ্জীভূত হলেই অনর্থ এবং বিষয় বিপুল হলেই বিষ।

তাই বিষয় অর্থ ধরে রেখেছেন এই রোগশয্যায় শুয়েও। মধ্যে মধ্যে ভাবেন—ওই তিন লক্ষ টাকা সেদিন যদি যোগেশ্বরের নিজের হাতে না থাকত। একখানা চেক কেটে যদি ফরেন এক্সচেঞ্জে পরিণত করতে না পারতেন, তবে কি তিনি তিন-চারদিনের মধ্যে চন্দ্রিকাকে নিয়ে জাহাজে চড়তে পারতেন? তবে পাগলের মত দেশেই পালিয়ে বেড়ানো অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তাতে কি চন্দ্রিকাই রাজী হত? হত না বলেই তাঁর ধারণা।

তাই ছেলে ছবি আর গান-বাজনা নিয়ে ঘরের মধ্যে মেতে আছে, তাতে তিনি নিশ্চিন্ত আছেন। এবং ছেলে দাড়ি-গোঁফ রাখছে—তা রাখুক। আপত্তি করেননি।

সুরেশ্বর বাড়ী থেকে বের হত না। ওই আর্ট এক্‌জিবিশন দেখতে যাওয়া, কখনও যামিনী রায়ের বাড়ী, কখনও হঠাৎ শান্তিনিকেতন যাওয়া, যাওয়ার গণ্ডীটা এর মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দূর থেকে দেখেছে। কাছে যায়নি। একান্তভাবে যাত্রীর মতই যেত—চলে আসত। নিজেকে আর্টিস্ট বলেও কোথাও জাহির করত না। মধ্যে মধ্যে পায়ে হেঁটে বেড়াত গঙ্গার ধার থেকে চৌরঙ্গী পর্যন্ত। আর যেত সে সাহিত্য-সম্মেলনে, যেখানে আধুনিক সাহিত্যিকরা সমবেত হতেন। পরিচয় গ্রুপের সুধীন দত্ত, নীরেন রায় এঁদের দেখেছে। অতুল গুপ্তকে দেখেছে। শরৎচন্দ্রের বাড়ী দেখে এসেছে। কখনও কখনও নব্যপন্থী কাগজের আপিসের সামনে দিয়ে ঘুরেও আসত। আর যেত ভাদুড়ীমশায়ের থিয়েটারে নাটক দেখতে। আর্ট থিয়েটার তখন উঠে গেছে। রঙমহল হয়েছে, নাট্যনিকেতন হয়েছে, সেখানেও যেত। দক্ষিণ কলকাতায় আশুতোষ কলেজে কিছুদিন আগে প্রগ্রেসিভ রাইটার্স কনফারেন্সে সে সামনের সারিতে আসন সংগ্রহ করে সব বক্তৃতা মন দিয়ে শুনে এসেছে। বিবাহের চেয়ে বড় এবং প্রাচীর ও প্রান্তর বইখানার নাম তার খুব ভাল লেগেছে। এমনি মন তখন তার। হয়তো এর কারণ এই যুগের ছেলে, এই যুগের নিঃশ্বাস নেয়—তাও বটে; গণবিপ্লবের ভূমিকা উনিশশো তিরিশে—তার জেলের অভিজ্ঞতা ও তার কৃতকর্মও বটে। তাছাড়াও হয়তো গভীর অন্তস্তলে আরও কিছু আছে। নিজের বংশের ধারাকে সমর্থনও বটে আবার তার প্রতি বিদ্বেষও বটে। কারণ যাই হোক, ব্যাপারটা বলতে গেলে এককালের ল্যাংড়া গাছের মিষ্টি আম, স্বাদে টক হয়ে যাওয়ার মত ব্যাপার। কথাটা সুরেশ্বরের নিজের কথা। সে বলেছিল তার মামাতো ভাইবোনেদের। অর্থাৎ হেমলতার মামাতো ভাই ব্যারিস্টার প্রবীর চ্যাটার্জির ছেলেমেয়েদের। মেলামেশা অর্থাৎ পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতাসূচক মেলামেশা এদের সঙ্গেই ছিল তার।

বাইরের অনেকে তাকে চিনত, সে-ও তাদের চিনত—সে শুধু চেনা-জানাই। সকলের দৃষ্টিই তার প্রতি নিবন্ধ হত তার চেহারার জন্যে। সুপুরুষ দীর্ঘাকৃতি যুবক—চলায়-ফেরায়, কথায়-বার্তায়, দৃঢ়তা এবং শীলতা, তার উপর বেশভূষার বৈচিত্র্য—এসব দেখে তাকে লোকে চিনতে চাইত এবং চিনে রাখতও। কিন্তু আলাপ সে ঘনিষ্ঠভাবে করতে চাইত না। তার কারণ ছিল- কীর্তিহাটের রায়বংশের নাম, আধুনিকদের কাছে খুব পরিচিত না হলেও, যোগেশ্বরের নাম অনেকে জানত এবং দেশদ্রোহিতার অপবাদে সে-নাম খুব প্রীতিপদ ছিল না। সে যখন জেল থেকে বন্ড দিয়ে চলে আসতে চেয়েছিল, তখন সকলেই বলেছিল—জে রায়ের ছেলে যে! তাছাড়া তার বাপের চন্দ্রিকাকে নিয়ে ইয়োরোপ চলে যাওয়ার কথাটাও গোপন নেই। সুতরাং ঘনিষ্ঠ হতে সে চাইত না। তাতে সুবিধে এই যে, ভদ্রতার ঢালের আড়াল দিয়ে চলা যায় এবং তাতেও যদি কেউ ভদ্রনীতি উপেক্ষা করে আঘাত করে, তবে সেখানে তীরের বদলে ভগ্ন নিক্ষেপে বাধা হয় না। সে-ক্ষমতা সে রাখে।

মেলামেশা তাই অতি নিকট-আত্মীয়তার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। মামাতো বোন দুটি—একটির বয়স সতেরো, অন্যটি পনেরো, ভাইটি ছোট। সীমা-অসীমা-প্রদীপ। সীমা তাকে বলেছিল—তুমি কি হচ্ছ সুরোদা?

—আমি আমি হচ্ছি! যেমন তুমি তুমি হচ্ছ।

—হেঁয়ালি করছ!

—খেয়ালি মানুষের খেয়াল অনেক সময় হেঁয়ালি বলে সন্দেহ হয়।

—কথার প্যাঁচ কযো না। দিন দিন কুনো হয়ে যাচ্ছ না?

—বন থেকে কোন নিরাপদ স্থান, আরামদায়কও বটে। আমি বন্য নই তো!

.

—বাবার কাছে একজন মক্কেল এসেছিল তোমার জাঠতুতো দাদাদের নামে নালিশ করতে। তারা বলছিল-রায়েরা আগাগোড়া হাড়ে হাড়ে টক হয়ে গেছে। তোমার নামও করছিল। আমিও তা সমর্থন করছি-কি বলার আছে তোমার?

সুরেশ্বর বলেছিল ওই কথা-ল্যাংড়া আম কালে স্বাদ বদলে টক হয়ে যায় নজীর আছে। হয়তো হয়েছি। কিন্তু তার উপায় কি? ওই লোকটি এসেছিল, আমার জ্যাঠামশায়ের শ্যালক। জ্যাঠাইমার সহোদর, এক মাড়োয়াড়ীর সঙ্গে কয়লার ব্যবসা করেন। তিনি দুবার এর আগে ইনসলভেন্সী নিয়েছেন। তাতে বেশ পোস্টাই হয়েছে। এবার জ্যাঠামশাই ইনসলভেন্সী নিয়েছেন। তাঁর টাকা ডুবেছে। তাই তিনি আমাদের কীর্তিহাটের ভদ্রাসন ক্রোক করেছিলেন। কিন্তু আমার মা-র তা সয়নি। তিনি বাড়ীটায় জ্যাঠামশাইয়ের অংশ কিনে বাঁচিয়েছেন। আমার কাছেও তিনি এসেছিলেন। সুতরাং আমাদের অম্লত্বের স্বাদ তিনি প্রত্যক্ষভাবে আস্বাদন করেছেন। তবে কি জান সীমা, স্বাদের ব্যাপারটা জিহ্বার উপর নির্ভর করে। কেউ বলে হাড়টক। কেউ বলে অম্লমধুর।

—ওরে, বাপরে! আত্মপ্রশংসায় পঞ্চমুখ! তা ঘরে বসে আমার সামনে করলে কি হবে? বাইরে বেরিয়ে কর! তবে তো বুঝি! ছবি আঁকবে কাউকে দেখাবে না। গান গাইবে, বাজারে কাউকে শোনাবে না! এত অহংকার কেন তোমার?

—সে তো তোমার কাছে নেই। চলো নতুন ছবি দেখাই। তারপর গান শোনাব। তবে বাইরের লোকের কাছে অহংকার আমার বেঁচে থাক—তাতে তোমার সঙ্গে কোঁদল করবার পথটা দিন দিন প্রশস্ত হবে।

সীমা আবদার করে তার হাত ধরে বলত—না, তোমার কথা কিছুতেই শুনব না। আমাদের বাড়ীতে, না আমাদের বাড়ীতে হলে তোমার ছবি দেখানো হবে না, এই বাড়ীতেই আমার বন্ধুদের একদিন নিমন্ত্রণ করব। তোমাকে ছবি দেখাতে হবে, গান শোনাতে হবে। হবেই হবে। আমার এক নাকউঁচু বান্ধবী আছে, সুলতা ঘোষ, তাকে একবার সব দেখাতে চাই।

—সুবিধে হবে না। আমি বৃক্ষটি ঠিক যাকে সহকার বলে তা নই। বলতে পারো শাম্মী বৃক্ষ। অর্থাৎ শিমুল গাছ।

—ওঃ, সুলতা নাম শুনেই ধরে নিলে আমি তোমাকে তার সহকার করে, তাকে কাঁধে চড়িয়ে দিতে চাই?—সে লতা হলে যাকে বলে কণ্টকলতা, তাই। বেতসলতা মশাই, তারও কাঁটা আছে। এবং তা দিয়ে যে আঘাত তাকে বলে বেত্রাঘাত!

—অথবা নিতান্ত মাঠে যে কুমড়ো খেঁড়োর লতা হয় তাই!

—বাবাঃ! হার মানলাম।

—আমি খুশী হলাম। চল আগে বাজনা শোন।

এইভাবেই সে গড়ে উঠছিল আপনার আবেষ্টনীর মধ্যে—সে লোহার জাফরীঘেরা গাছের মতই হোক আর একান্তে একেবারে উন্মুক্ত প্রান্তরে একক একটি গাছের মতই হোক, মোটামুটি সোজাসিধে হয়েই উঠে চলেছিল।

এরই বছরখানেকের মধ্যে অর্থাৎ উনিশশো চৌত্রিশ সালে হঠাৎ হেমলতার হার্টের অসুখ বেড়ে উঠে শক্ত হয়ে দাঁড়াল।

একটা কারণ ঘটেছিল। সুরেশ্বর বাড়ী ছিল না, সে গিয়েছিল একজন জাপানী আর্টিস্ট এসেছেন তাকে দেখতে। ইতিমধ্যে এসেছিল একটি মহিলা, সে সটান এসে বাড়ীর ভিতর অতি পরিচিতের মত একেবারে হেমলতার কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। হেমলতা তাকে দেখে চমকে উঠেছিলেন ভূত দেখার মত। যে এসেছিল সে চন্দ্রিকা। সে ভারতবর্ষে ফিরেছে। সে ক্ষমা চাইতে এসেছিল হেমলতার কাছে। তার কাছে সে বিশ্বাসঘাতিনী। হেমলতাই সমাদর করে তাকে নিমন্ত্রণ দিয়ে বাড়িতে এনে যোগেশ্বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। সে যোগেশ্বরকে প্রলুব্ধ করে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। কথা এইটুকু। তার মূল্য চন্দ্রিকার গ্লানি থেকে মুক্তি কিন্তু হেমলতার কাছে তার মূল্য আরও অনেক। তার জন্য তার জীবন দিতেও আক্ষেপ হয়নি। চন্দ্রিকা বলে গেছে—দেখ, তোমাকে সিস্টারই যদি বলি, তবে ঘৃণা করে না বোলো না। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করেছি তাকে সুখী করতে। বিলিভ মী। কিন্তু সে সুখী হয়নি। একদিনের জন্যও না। সে বলত কি জানো? বলত-হেমলতা was my life, and you চন্দ্রিকা তুমি আত্মহত্যার মৃত্যু, তুমি অতি সুন্দরী, তুমি মনোহারিণী, আত্মহত্যার মত মনোহারিণী। মৃত্যুতে মানুষ শান্তি পায়, আত্মহত্যার মৃত্যুতে পায় না। If there is a life after death তবে, আত্মহত্যার মৃত্যুতে শান্তি পায় না—এটা শাস্ত্রের সত্য নয়, লজিকের সত্য। বেশী মদ খেলে কাঁদত। আমাকে মারত। আমি বলতে এসেছি—আমি তাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারিনি। ডাকাতি করেও পারিনি। শাস্তি আমি পেয়েছি। কিন্তু তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

এবং দিয়ে গিয়েছে কিছু কাগজপত্র। যেটা যোগেশ্বরের মৃত্যুর পর তার হাতে পড়েছিল। তাই সে দিয়ে গেছে। হেমলতা শুনেছিলেন আর কেঁদেছিলেন। চন্দ্রিকা চলে যাবার পরও পড়ে পড়ে কাঁদছিলেন, এরই মধ্যে উঠেছিল হার্টের রোগ।

রোগের এই আক্রমণেই হেমলতার মৃত্যু হল। পনের দিন অতি নিষ্ঠুর যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন। দিনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকটা সময় কিছুটা সুস্থ থাকতেন, তাও একনাগাড় একটানা অর্ধেক দিন নয়। কিছুক্ষণ একটু ভাল, তারপরই আবার বুকের যন্ত্রণা উঠত।

চিকিৎসার ব্যবস্থার ত্রুটি তো ছিলই না—আতিশয্যই হয়েছিল বলতে হবে। ডাক্তার-নার্স বলতে গেলে মোতায়েন ছিল। বড় কনসাল্টিং ফিজিসিয়ান দিনে একবার নিয়মিত আসতেন। একজন অল্পবয়সী ডাক্তার প্রায় অর্ধেক দিনেরও বেশী থাকতেন। দিনে আসতেন দুবার। এবং রাত্রে নটার পর এসে এখানেই শুতেন। নার্স দুবেলা দুজন। রাত্রে একজন, দিনে একজন। সুরেশ্বর মায়ের পাশের ঘরেই শুতো। সে এসে বসে থাকত জানালার ধারে একটা চেয়ারে।

মা মধ্যে মধ্যে কাছে ডেকে বলতেন—যা, শুগে যা। এখন ভাল বোধ করছি।

বললেই সে চলে যেত। কিন্তু আধঘণ্টা বা একঘণ্টা পরই সামান্য শব্দ শুনলেই নিঃশব্দে মাঝের দরজাটি খুলে সেখানে দাঁড়াত। বিশেষ কিছু না হলে ফিরে যেত, না হলে ধীরে ধীরে এসে ওই চেয়ারখানিতে বসত।

এরই মধ্যে পনের দিনের দিন হেমলতা চলে গেলেন। বুঝতে তিনি পেরেছিলেন। ছেলেকে ডেকে কাছে বসিয়ে বলেছিলেন-আমাকে যেতে হবে রে। ভেঙে পড়িসনে যেন!

সুরেশ্বর আত্মসম্বরণ করেও করতে পারেনি। কথা না বলে ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিল—না, তা সে ভেঙে পড়বে না। কিন্তু চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছিল দুটি ধারায়।

হেমলতা বলেছিলেন—কাঁদছিস?

সে মাটির মূর্তির মত স্থির হয়ে বসেছিল। হেমলতা বলেছিলেন—চোখ মোছ।

একবার সে মুছেছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার ধারা নেমে এসেছিল; চোখ-মুখ মুছেও তো আর উৎসমুখ বন্ধ করা যায় না!

হেমলতা আর বলেছিলেন- তোকে না বলে একটা কাজ করেছি, বলে যাই তোকে। আমাকে উনি যা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা থেকে আমি কীর্তিহাটে তোর জ্যাঠামশাইয়ের সবই কিনেছি। দেবোত্তর পত্তনী নিয়েছি, বাড়ী কিনেছি। ওখানকার খরচ যেন কমাসনে। আর মেজতরফ যেমন খেতে পায় তেমনি যেন পায়। মেজখুড়ীমাকে পঞ্চাশ টাকা করে পাঠানো হয়। বন্ধ করিসনে। আমি জানি দেবতায় তোর বিশ্বাস নেই। কিন্তু ওটা পূর্বপুরুষের কীর্তি

মৃত্যুর একদিন আগের কথা। পরের দিন সকাল নটায় তিনি আধবসা হয়ে বসে থাকতে থাকতেই প্রায় নিঃশব্দে চলে গেলেন। কেউ বুঝতেও পারলে না।

সুরেশ্বর দুবার শুধু ডাকলে—মা! মা!

মা স্থির নিথর। সে গায়ে হাত দিলে। নার্স ডাক্তারকে ডাকলে। সে পাশের ঘরেই ছিল- ইনজেকশন তৈরী করছিল। সে এসে দেখে বললে—একস্পায়ার্ড!

সুরেশ্বর সেই চুপ করে মায়ের গায়ে হাত দিয়ে মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

সেইদিন সন্ধ্যায় যখন সে ফিরল, তখন সে ভাঙ্গা মানুষ। মায়ের শবদেহ যতক্ষণ ছিল তখনও পর্যন্ত সে যেন ব্যাপারটা ঠিক বোঝে নি। মায়ের দেহ চিতায় চাপাতেই সে কল্পনায় কি হবে তা বুঝে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল। সংকারে এসেছিল ব্যারিস্টার মামা এবং তার দুই জেঠতুতো ভাই। আর তাদের কাছে সংবাদ পেয়ে এসেছিল ধনেশ্বরের বড় ছেলে ব্রজেশ্বর। সে নাকি এখন এক কোটিপতি শেঠের বাড়ী চাকরি করে।

ব্যারিস্টার মামা প্রবীর চ্যাটার্জী রুমালে চোখ মুছে তাকে ধরে বললেন–এ কি, এ কি, তুমি এমন করে কাঁদবে! না-না-না! আমি তো তোমাকে খুব স্ট্রং নার্ভ শক্ত মানুষ বলে জানতাম। ও নো। ডোনট ক্রিয়েট এ সিন! লোকে বলবে কি? দেখ রবীন্দ্রনাথের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ যখন মারা যান। তখন তাঁর কথা তুমি জান। মা কি কারুর চিরকাল থাকে! ছি! চল এখন সরে গিয়ে দূরে বসবে চল!

—না। চোখ মুছে সে প্রায় নিষ্পলক দৃষ্টিতে মায়ের দেহ পুড়ে ছাই হতে দেখেছিল শেষ পর্যন্ত!

পাশে এসে বসেছিল খুড়তুতো ভাই ব্রজেশ্বর। ব্রজেশ্বর তার থেকে বয়সে বছর তিনেকের বড়। ধনেশ্বর যোগেশ্বরের থেকে বয়সে বছর দুয়েকের ছোট হলেও বিবাহ করেছিল প্রায় পাঁচ বছর আগে।

ব্রজেশ্বর প্রিয়দর্শন। কিন্তু দেহে দুর্বল। সম্ভবতঃ অভাব তার কারণ। বেশ ছিমছাম ফিটফাট। সে এসে সুরেশ্বরের পাশে চুপ করে বসেছিল। প্রগল্ভতা করেনি। তাকে বোঝাতে চায় নি। শুধু বসেই ছিল। মধ্যে মধ্যে সিগারেট খাচ্ছিল।

হঠাৎ সে এক সময় গুন গুন করে সুর ভেঁজে ক্রমে ক্রমে কণ্ঠস্বর উচ্চ করে গান গেয়ে উঠেছিল—“ছাড়িয়ে সংসার কোথা চলে যাও দীনহীন বেশ ধরিয়ে—।”

কণ্ঠস্বর তার সত্যকারের সুস্বর। গানটিও এই ক্ষেত্রের উপযোগী। “তখনকার কালে এ গানটির চল ছিল। সংসারের সব পিছনে ফেলে দীনহীনের বেশে কপালে তিলক নিয়ে কোথায় চলেছ তুমি? একবার পিছন ফিরে তাকাও। বলে যাও, কোথায় যাবে আপনার ব’লে যাদের বুকে ধরেছিলে এতদিন তাদের ফেলে!”

শ্মশানে গান সহজবুদ্ধি যাদের তারা হয় তো গায় না কিন্তু কীর্তিহাটের ধনেশ্বর রায়ের ছেলে ব্রজেশ্বর রায়ের পক্ষে সে কথা খাটে না। তাছাড়া গানটি এমন কালোপযোগী এবং এমন বেদনা দিয়ে সে গাইলে যে আবার সুরেশ্বরের স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আবেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। আবার তার চোখ দিয়ে দরদর ধারে জল গড়াতে লাগল।

বাড়ী ফিরতে সন্ধ্যে উত্তরে গিয়েছিল; নিম মুখে দিয়ে মিষ্টিজল খেয়ে সকলে চলে গেল; জ্যেঠতুতো ভাইরা চলে গেল, ব্রজেশ্বর শুধু বললে—বল তো আমি রাত্রিটা থেকে যাই ভাই সুরেশ্বর। একলা থাকবে?

সে বলেছিল—বেশ তো! থাকুন! বলেই উপরে চলে গিয়ে সে মায়ের ঘরের মেঝেতেই শুয়ে পড়েছিল কম্বল পেড়ে।

নায়ের ম্যানেজার হরচন্দ্র প্রাচীন, বহুদর্শী কর্মক্ষম বিশ্বস্ত লোক, সে যথাবিধি ব্যবস্থার খুঁত থাকতে দেয়নি। সুরেশ্বর বলেছিল—দেখবেন, যেন মায়ের অশৌচে শ্রাদ্ধে কোন খুঁত বা ত্রুটি আমার না হয়।

হরচন্দ্র বলেছিল—সে তুমি ভেবো না। সে কোন খুঁতই হবে না। ভাবছি হবিষ্যির জন্যে। কে রান্না করে দেবে?

—আমি নিজেই করে নেব। না-পারার মত কিছু নেই।

পরদিন সকালে উঠে চা-ও সে খায় নি। অপেক্ষা করেছিল পুরোহিতের জন্য, যার কাছে সব জেনে নেবে। এই সময় উপরে উঠেছিল ব্রজেশ্বর। বললে-তা হলে আমি চলি ভাইরাজা!

সুরেশ্বর সবিস্ময়ে মুখ তুলে তাকালে। ভাইরাজা সম্বোধন শুনে সে বিস্মিত হয়েছে।

ব্রজেশ্বর হেসে বললে—খোসামোদ করে বলিনি ভাই। ওটা রপ্ত হয় নি। তবে কাল তোমার যা মায়ের উপর টান ভক্তি দেখলাম—মনটির পরিচয় পেলাম—তাতে তুমি রাজা। তা ছাড়া চেহারাতেও তাই। পয়সার কথা বলব না, জ্ঞাতিতে বললে হিংসে হয়। অন্যে বললে ভিক্ষে চাইবে মনে হয়। রাজা তুমি রূপে-গুণে মনে মেজাজে। তা ছাড়া ছোট তুমি, আশীর্বাদও করছি।

ব্রজেশ্বরের জিহ্বা এবং কণ্ঠস্বরে মধু আছে। ভাল লাগল সুরেশ্বরের। সে বললে—আসবেন আবার।

—নিশ্চয় আসব রাজা! বলতে গেলে কাল সব বুঝে তো বিনা খাজনার প্রজা হয়ে গিয়েছি। সেলাম দিতে নিশ্চয় আসব। এত দিন আছি আসি নি। পরিচয়টা ঠিক হয় নি, তোমাকে ঠিক বুঝি নি, তাই আসি নি। ভেবেছিলাম কি জানি কাঁটায় ছড়ে যাবে কাছে গেলে। এ যে জুড়িয়ে গেল রাজা। শ্রাদ্ধ এখানেই করবে? না যোগেশ্বর জ্যাঠার শ্রাদ্ধের মতো কীর্তিহাটে যাবে?

—না। এখানেই হবে!

—সেই ভাল। অনর্থক রাশি রাশি টাকা খরচ করে কতকগুলো লোভী বামুন খাইয়ে আর—। এইখানেই কর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *