এ টেল ট্যু সিটীজ – ৭

০৭. প্রলয়দোলা

মিস্টার লরী ইংরেজ, সুতরাং ফরাসীদেশের প্রলয়-দোলার মাঝখানেও তিনি খানিকটা নিরাপদ। গৃহবিবাদের সময় বিদেশী লোকের উপর অত্যাচার পারতপক্ষে কেউ করে না। আইনে ওটা নিষেধ আছে। লরী প্যারীর অফিসে বসে নিজের কাজ করে যেতে লাগলেন, কেউ তার উপর উৎপাত করতে এলো না। টাকা পয়সা আগে থাকতেই লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল–যতটা সম্ভব! কাগজপত্র কতক মাটির তলায় পুঁতে ফেললেন লরী, কতক বা ফেললেন পুড়িয়ে। সীমান্তে পাহারার যা কড়াকড়ি, তাতে এক টুকরো হিসাবের কাগজও যে ফ্রান্স থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া যাবে, সে-ভরসা তিনি করতে পারলেন না।

ব্যাঙ্কেরই একাংশে বাস করছেন মিস্টার লরী। বাড়ির ভিতরটা নির্জন। বাসিন্দা যারা ছিল, তারা পালিয়েছে। প্যারীর অনেক মহল্লাই এখন এমনি নির্জন। একটা প্রকাণ্ড শান-যন্ত্র বসানো রয়েছে বাড়ির উঠানে। সেখানে অবিরত অন্ত্রে শান দেওয়া চলেছে। শত-শত লোক আসছে আর যাচ্ছে। সকলেরই হাতে কোন-না-কোন অস্ত্র। মানুষ কেটে-কেটে ভোতা হয়ে যাচ্ছে অস্ত্র, আর অমনি ছুটে আসছে তারা শান। দেওয়ার জন্য। তরোয়াল, কোদাল, কুড়াল, ছুরি, ছোরা! যারা আসছে, তাদের হাতে রক্ত, কাপড়ে রক্ত, হাতিয়ারে রক্ত…

রাত্রে লরী ঘরের ভিতর বসে ভগবানের নাম স্মরণ করছেন। উঃ! সবরক্ষা যে, এই মহা-নরকে আমার কোন প্রিয়জন আজ নেই! ভগবানকে ধন্যবাদ! হঠাৎ তার অফিস-ঘরের কড়া নড়ে উঠলো। সাবধানে দ্বার খুললেন লরী। হয়তো কোন দুর্ভাগ্য মক্কেল। রাত্রির অন্ধকারে টাকা নিতে এসেছে। পালাবার কোন উপায় করতে পেরেছে হয়তো। এখন টাকাটা পেলেই ত্যাগ করতে পারে এই অভিশপ্ত পুরী। লরী এমন অনেককেই দিয়েছেন টাকা গভীর রাত্রে। ব্যাঙ্কেরই টাকা অবশ্য। ব্যাঙ্কে টাকা কতদূর কী জমা আছে অভাগা মক্কেলের, তা না দেখেই টাকা দিতে হয়েছে তাকে।

কিন্তু এ কারা? মক্কেল তো নয়! লরীর চোখের সমুখে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। লুসী? ডাক্তার ম্যানেট? লুসীর মেয়ে?–এইমাত্র না তিনি ভগবানকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন যে, তাঁর কোনও প্রিয়জন–হ্যাঁ ঈশ্বর! এমন নিষ্ঠুর পরিহাস কি করতে আছে কারো সঙ্গে?

ওরা ছুটে ঘরে ঢুকলো এসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো নিজেদের কাহিনী! লরী যেদিন চলে এলেন, তার পরদিন ডার্নেও কী একটা চিঠি পেয়েছিলেন নাকি ডার্নে; ফ্রান্স থেকে! কার নাকি জীবন রক্ষার জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিল ডার্নের ফ্রান্সে আসবার। কাউকে কিছু বলেননি ডার্নে। লুসীর নামে একখানা পত্র লিখে রেখে, “বেড়াতে যাচ্চি একটু”–বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। চিঠি পেয়েই ডাক্তার ম্যানেট ছুটে এসেছেন। তিনি জানেন ডানের প্রকৃত পরিচয়। বিদ্রোহী ফরাসী, রক্ত-পাগল ফরাসী-জনসাধারণের হাতে পড়লে চিরদিনের অত্যাচারী এভরিমন্ডি জমিদারের যে নিশ্চয়ই প্রাণ যাবে, তা বুঝতে পেরে সঙ্গে-সঙ্গেই তাকে বাঁচাবার জন্য ছুটে এসেছেন ডাক্তার ম্যানেট! ডাক্তার ম্যানেট লুসীকে আনতে চাননি কোনমতেই, কিন্তু সে কি পড়ে থাকতে চায়? স্বামী যেখানে শত্রুর হাতে মরতে বসেছে, পতিব্রতা পত্নী কি সেখানে দূরে বসে থাকতে পারে, নিজের জীবনটাকে নিরাপদ রাখবার জন্য?

সব শুনে লরী কপালে করাঘাত করে হতাশভাবে বললেন–কিন্তু তুমি যে ছুটে এলে ম্যানেট, কী করতে পারবে তুমি? ডার্নেকে বাঁচাবার কতটুকু শক্তি আছে তোমার?

–তা আছে। একটু গর্বের সঙ্গেই ম্যানেট বললেন–তা কিছু আছে! কারণ, আমি আঠারো বৎসর বন্দী ছিলাম ব্যাস্টিলে। আমার নাম সবাই জানে–আজকের এই বিদ্রোহীরা। আমার খাতির এরা করবে। ইতিমধ্যেই খাতির পেয়েছি। ডার্নের খবর আমি সীমান্তের অফিসে বসেই সংগ্রহ করতে পেরেছি। অন্য কেউ সে খবরটাই যোগাড় করতে পারত না।

লরী বললেন–কী খবর? কী খবর পেয়েছে?

–ডার্নেকে বন্দী করে রাখা হয়েছে লা-ফোর্সের কারাগারে।

লরী শিউরে উঠলেন–লা-ফোর্সের কারাগারে? সেখান থেকে তো জীবন্ত বেরিয়ে আসতে কাউকে দেখলাম না এ-কয় দিনে। তোমার যদি কিছু করতে হয় তো–এক্ষুণি, ডাক্তার! হয়তো এখনও সময় থাকতেও পারে! যদি কিছু উপায় তুমি করতে পারো, তবে তা এক্ষুণি করো ডাক্তার! কাল হয়তো দেখবে যে, সব ফুরিয়ে গেছে। বিদ্রোহীরা বেশি সময় নেয় না। কেউ একজন অভিযোগ করলেই হল যে, এ-লোকের দ্বারা জনসাধারণের উপর অত্যাচার হয়েছে। জজ আর জুরী বসেই আছে মৃত্যুদণ্ড দেবার জন্য। গিলোটিন পাতাই আছে! যাও, যাও ডাক্তার! লুসী এখানেই থাকুক, তুমি দেখ কি করতে পারো!

বাইরের উঠানে কয়েক শত লোক অস্ত্রে শান দিচ্ছিলো তখনো, রক্তরাঙা অস্ত্র… রক্তরাঙা মানুষ! সেই কয়েক শত লোকের ভিড়ের ভিতর ঢুকে পড়লেন শুক্লকেশ ম্যানেট! অফিস-ঘরের দরজা একটুখানি খুলে লরী দেখতে লাগলেন– ম্যানেট কি-যেন-কি কথা কইছেন সেই ভিড়ে দাঁড়িয়ে! সহসা সেই ভিড় চিৎকার করে উঠলোব্যাস্টিলের বন্দী ম্যানেট, দীর্ঘজীবী হোন! ব্যাস্টিল-বন্দীর আত্মীয় এভরিমন্ডিকে চাই আমরা। মুক্ত করো ব্যাস্টিল-বন্দীর আত্মীয়কে। চলো সবাই লা ফোর্সে! চলো সবাই লা-ফোর্সে!

সেই কয়েক শত লোক ডাক্তার ম্যানেটকে কাঁধে করে নিয়ে ছুটে চললো লা ফোর্সে। লুসী আশায় উৎফুল্ল হয়ে ভূতলে জানু পেতে বসে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন ভগবানকে। লরীরও আশা না হল তা নয়, কিন্তু তিনি জানেন–বন্দীকে খালাস করে আনা কত কঠিন আজকের দিনে! বেশি আশা করতে সাহস হল না তার।

চার দিন পরে ফিরে এলেন ম্যানেট। লরীর সঙ্গে গোপনে আলাপ হল তাঁর। জনতা তাকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়েছিল লা-ফোর্সে। সারা দীর্ঘপথ রক্তে পিছল..মড়ার গাদা চারিদিকে। জনসাধারণ হত্যা করেছে জনসাধারণের শত্রুদের। কারার ভিতরেও চলেছে হত্যাকাণ্ড। বিচারসভা বসেছে কারার ভিতর। বিচারকেরা গায়ের জোরেই বিচারক হয়ে বসেছে। তাদের সম্মুখে বন্দীরা আনীত হচ্ছে একটি একটি করে। বেশির ভাগ বন্দীকে সঙ্গে-সঙ্গেই সঁপে দেওয়া হচ্ছে জনতার হাতে, তারা সঙ্গে-সঙ্গেই টুকরো করে কেটে ফেলছে তাদের। দু’চার জন মুক্তি পাচ্ছে। দু’একজনকে আবার ফেরত পাঠানো হচ্ছে কারাগারে। ম্যানেট এই বিচারসভার সমুখে গিয়ে পরিচয় দিলেন নিজের। তাঁকে জানে সবাই। জুরীর ভিতর বসেছিল তার সেকালের এক ভৃত্য, নাম তার ডিফার্জ।

তিনি শুনতে পেলেন–ডার্নে তখনও জীবিত। সেই স্বয়ং-নিযুক্ত আদালতের সমুখে তিনি জামাতার স্বপক্ষে অনেক কিছুই বললেন–প্রাণের সমস্ত দরদ ঢেলে! ম্যানেটের আঠারো-বৎসর ব্যাস্টিল-বাসের কাহিনী যে শুনেছে, সেই বলেছে– ডার্নের মুক্তি পাওয়া উচিত। ডাক্তার আশা করছেন প্রতি মুহূর্তে যে, এইবার সে মুক্তির আদেশ দেওয়া হবে, এমন সময়ে কেমন করে যেন হাওয়া বদলে গেল একেবারে। জুরীদের ভিতর কানাঘুষা চললো কিছুক্ষণ, তারপর আদেশ হলো– মুক্তি এখন হতে পারে না এভরিমন্ডির, তবে তাকে কারাগারে নিরাপদে রক্ষা করা হবে, জনতার হাতে তুলে দেওয়া হবে না তাকে। ডার্নেকে সঙ্গে সঙ্গে আবার কারাগারের ভিতরে চালান করে দেওয়া হলো। ডাক্তার তখন সকাতরে প্রার্থনা করলেন–তাকে সেইখানে থাকতে দেওয়া হোক, যতক্ষণ-না উন্মত্ত জনতা কারাগার ছেড়ে চলে যায়। তারা গেল চার দিন পরে। এই চার দিন ডাক্তারকে লা-ফোর্সে থেকে পাহারা দিতে হয়েছে–যাতে কারাগারের ভিতর থেকে ডার্নেকে টেনে বের করে হত্যা না করে রক্তপাগল জনতা।

এই চার দিনের ভিতর লরী একটা বাসা ঠিক করেছেন লুসীদের জন্য। লুসী ও ম্যানেট সেইখানেই বাস করতে লাগলেন। ডানে কবে মুক্তি পাবেন, স্থির নেই। মুক্তি পেলে ফ্রান্স ত্যাগ করে যাওয়া এখন কখনোই সম্ভব হবে না ডার্নের পক্ষে। কাজেই দীর্ঘদিন সকলের প্যারীতে থাকতে হবে হয়তো।

দেখতে দেখতে ডাক্তার ম্যানেটের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো চিকিৎসক হিসাবে। বিদ্রোহী নেতারা তাঁকে লা-ফোর্সে ও অন্য তিনটে কারাগারের পরিদর্শক নিযুক্ত করল। শুধু চিকিৎসক বলে নয়, আগের দিনের ব্যাস্টিল-বন্দী বলে তিনি এই কাজ পেলেন। তার ফলে ডার্নের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে লাগলো তার মাঝে-মাঝে। লুসীকে পত্র দেবার সুযোগও পেলেন ডার্নে, ম্যানেটের হাত দিয়ে। দীর্ঘ এক বৎসর কেটে গেল এইভাবে। না হল ডার্নের মুক্তি, না হল তার বিচার। ম্যানেট এখন আর লুসী বা লরীর সাহায্যের উপর নির্ভরশীল নন, বরং তার উপর নির্ভর করেই এঁরা সবাই বাস করছেন প্যারীতে। আজ ম্যানেটের যেমন সম্মান, তেমনি তার কাজের শক্তি, আর তেমনি তার মনের জোর। এক বৎসর কেটে গেল। ডার্নের মুক্তির জন্য ম্যানেটের চেষ্টার বিরাম নেই। কিন্তু মুক্তির কথা তো পরে, বিচারের ব্যবস্থা পর্যন্ত হল না অভাগা বন্দীর। ও-রকম তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কই নতুন শাসকদের? নতুন যুগের ঢেউ এসেছে দেশে। রাজার বিচার করা হয়েছে, রাজার উপর মৃত্যুদণ্ড প্রচার হয়েছে, রাজশির ছিন্ন হয়েছে ঘাতকের আঘাতে। সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফরাসীদেশে, সে-তন্ত্রের মূল নীতি হলো, “সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, আর তার অভাবে মৃত্যু।” সারা পৃথিবী ভয় পেয়ে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়েছে এই নতুন সাধারণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই সাধারণতন্ত্র, কারও ভয়ে ভীত নয়, কারও কুটি দেখে নিরস্ত হবার পাত্র নয়। “হয় জয়, নয় মৃত্যু”–তার পণ! নোতরদামের গির্জার আকাশচুম্বী চুড়ায় দিবানিশি উঠছে কৃষ্ণপতাকা! পৃথিবীতে যে যেখানে অত্যাচারী আছে, তাদের সমূলে বিনাশ করবার জন্য তিন লক্ষ ক্ষুধার্ত, চিরদিন পদদলিত লোক লাফিয়ে উঠেছে ফরাসীদেশের প্রতি গ্রাম ও নগর থেকে। যেন দৈত্যের পাল গর্জন করে বেরিয়ে পড়েছে পাহাড় ও সমতল, পাথর ও বালুকা, লোকালয় ও অরণ্য থেকে। দক্ষিণের রৌদ্র-ঝলমল আকাশের নিচে, আর মেঘ-ঢাকা উত্তর-ফ্রান্সের আকাশের নিচে দ্রাক্ষা ও জলপাইয়ের আবাদে, আর শস্যহীন ক্ষেত্রের নাড়াবনে, নদীতীরে আর সাগর উপকূলে–সর্বত্র জেগেছে পালে-পালে দৈত্য-রক্ত-পিপাসায় লকলক জিহ্বা মেলে দিকে দিকে ছুটেছে তারা। সারা দেশে ছুটেছে ধ্বংসের বন্যা। তুচ্ছ ডার্নের কথা ভেসে গেল সে-প্লাবনের মুখে!

ও কী ও? রাজার ছিন্ন মুণ্ড! ও কী আবার? রানীর ছিন্ন শির! তরুণী রানীর শিরে সাদা চুল এলো কোথা থেকে? সেই সুন্দরী লাবণ্যময়ী যৌবনবতী নারীর শিরে? হাঃ হাঃ, কেশ শুরু হতে কি বেশি সময় লাগে? রাজার মৃত্যুর পরে নয় মাস বেঁচে ছিলেন রানী। সেই নয় মাসের প্রতি মুহূর্তে তাকে সইতে হয়েছে দারুণ অপমান, চরম অপমানের আশঙ্কা–যুবতীর কালো চুল সেই আশঙ্কাতেই অকালে সাদা হয়ে গিয়েছে।

এ টেস্ ট্যু সিটীজ সব ভেঙে চুরে যাচ্ছে! ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে সব! সব কিছু ধেয়ে চলেছে। ধ্বংসের মুখে। গোটা দেশটার উপর ঘন হয়ে নেমে এসেছে মরণের কালো ছায়া! সে ছায়া গিলোটিনের। আগে লোকে শপথ করবার জন্য ক্রশের চিহ্ন করতে, এখন করে, গিলোটিনের। গিলোটিনের ছবি সকল ঘরে, গিলোটিনের ক্ষুদে ছবি সকলের জামার বুকে! এক-একটা মুণ্ড কেটে ফ্যালে এক-এক মিনিটে…অত দ্রুত হাত চালাতে কোন জল্লাদ কোনদিন পারেনি।

নদীতে ডুবিয়ে মারা, লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা–এ-সবও কি নেই? তাও আছে…সর্বত্র মৃত্যু! মৃত্যুর তাণ্ডব চলেছে এক বছরের উপর। ডার্নে পড়ে আছেন কারাগারে, লুসী পড়ে আছেন শিশুকন্যা নিয়ে লরীর তত্ত্বাবধানে, আর ম্যানেট ঘুরছেন বন্দীদের তদারক করে।

অবশেষে ডাক্তার একদিন সংবাদ নিয়ে এলেন–দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান, কাল হবে ডানের বিচার।

***

মুক্তি! মুক্তি! দীর্ঘ প্রত্যাশার পরে, দীর্ঘদিন সংশয়-দোলায় দোলবার পরে, ডার্নে পেয়েছেন মুক্তি! ডাক্তার ম্যানেটের করুণ ইতিহাস, অষ্টাদশবর্ষ ব্যাস্টিল-বাসের শোকাবহ কাহিনী, এ সব শুনে জনসাধারণের মনে জেগেছে গভীর সহানুভূতি। তাই জজ আর জুরীর মুখ থেকে প্রচারিত হয়েছে জনসাধারণের ইচ্ছা…ডার্নে মুক্ত।

সেদিন কী আনন্দ ডাক্তার ম্যানেটের গৃহে! মৃত্যুর গ্রাস থেকে ফিরে এসেছেন প্রিয়তম; লুসী চোখে জল, অধরে হাসি নিয়ে, নতজানু হয়ে বসেছেন ভগবানকে ধন্যবাদ জানাতে। বহুদিন অদর্শনের পর পিতার দর্শন পেয়ে শিশু লুসী মুখরা হয়ে উঠেছে কলকাকলি তুলে। ম্যানেটের মুখে স্নিগ্ধ হাসি, আত্মপ্রসাদে তার চিত্ত উঠেছে ভরে। লরীর আনন্দের সীমা নেই, লুসীর স্বামীকে নিরাপদ দেখে। নিঃসন্তান বৃদ্ধ লরীর জীবনে এখন যা কিছু আনন্দ, তা যে ঐ লুসীকে নিয়েই।

এদিকে এই আনন্দের বান ডেকেছে, অন্যত্র কিন্তু ডার্নের প্রসঙ্গ নিয়ে ক্রোধ আর উত্তেজনার সীমা নেই। ডিফার্জের ঘরে সেই উত্তেজনার প্রবল ঢেউ! ডিফার্জের চাইতেও মাদাম ডিফার্জের বেশি ক্রোধ এভরিমন্ডি-বংশের উপর। বিপ্লব আজ নারীর অন্তরের সমস্ত স্নেহ-মায়া-ক্ষমাকে নিঃশেষে মুছে ফেলে দিয়েছে। তাছাড়া, আরো গভীর কারণ আছে। মাদামের প্রতিজ্ঞা–এভরিমন্ডি-বংশকে ঝাড়েমূলে নির্মূল করতে হবে। এভরিমন্ডি-বংশের ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ-প্রত্যেকেরই নাম মাদাম ডিফার্জের সেলাইয়ের ভিতর বুনোট করা রয়েছে। সে দুর্বোধ্য ভাষায় রেজিস্ট্রী হয়ে গেছে যার নাম, তার আর নিস্তার নেই…কিছুতেই নেই!

ঐ এভরিমন্ডি-পরিবারের এক ভূতপূর্ব মার্কুইস–গ্যাসপার্ড যাঁর বুকে ছুরি বিঁধিয়ে দিয়ে নিজে চল্লিশ ফুট উঁচু ফাঁসিকাঠে ঝুলেছিল–সেই ভূতপূর্ব মাকুইসের প্রথম যৌবনের এক বীভৎস কুকীতির কথা বলতে হল এবার। দরিদ্র প্রজাদের ঘরে সুন্দরী রমণী দেখলে তার কামনা আগুনের মত লক লক করে উঠত। ছলে বলে-কৌশলে সে-নারীর সর্বনাশ করতেন তিনি। এক বালিকা এইভাবে চরম লাঞ্ছনায় লাঞ্ছিতা হলো তার হাতে। মনোবেদনায় দারুণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়লো সে, ঐ মাকুইসেরই গৃহে। বালিকার পিতা ক্ষীণ প্রতিবাদ করেছিল একটু। সেই ধৃষ্টতার শাস্তিস্বরূপে তাকেও মরতে হল ছুরিকাঘাতে। বালিকার ভ্রাতা দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছিল মার্কুইসকে। শিক্ষিত তলোয়ারবাজ মাকুইসের সঙ্গে সে এঁটে উঠতে পারবে কেন? অস্ত্রবিদ্যায় অশিক্ষিত কৃষক-বালক–সে-ও মরলো তরবারির আঘাতে।

দরিদ্র সেই কৃষক-পরিবারের একমাত্র অবশিষ্ট প্রাণী, একটি শিশুকন্যা, ধর্ষিতা যুবতীর কনিষ্ঠা ভগ্নী–তাকে আত্মীয়েরা পাঠিয়ে দিলো দূরে, সমুদ্রতীরে এক ধীবর পল্লীতে। সেইখানে সে মানুষ হল, আপন মনে প্রতিদিন এই মন্ত্র জপ করতে করতে মানুষ হল যে প্রতিহিংসা নিতে হবে–প্রতিহিংসা নিতে হবে–প্রতিহিংসা! সেই মেয়েই আজ এই মাদাম ডিফার্জ।

এমন যে মাদাম ডিফার্জ সে কখনো এভরিমন্ডি-বংশের বর্তমান মার্কুইস ডার্নেকে মুক্ত দেখে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে? যেভাবে হোক, মাদাম ডিফার্জ প্রতিহিংসার ব্রত উদ্যাপন করবেই, ধর্ষণকারী মাকুইসের বংশ নির্মূল করে। আর, ডার্নে কিন্তু সেই ধর্ষকের দূর আত্মীয়ও নয়, আপন ভ্রাতুস্পুত্র! ওর মৃত্যু চাই-ই!

মাদাম ডিফার্জ জ্যা-সঙেঘর নেতৃস্থানীয় কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলো গোপনে। স্বামীকেও সে এ-পরামর্শের ভিতর ডাকেনি, কারণ, ডিফার্জ একদা ডাক্তার ম্যানেটের অনুরক্ত ভৃত্য ছিল, সদাশয় প্রভুর কাছে সেদিনে যে স্নেহ সে লাভ করেছিল, তার কথা সে এখনো ভোলেনি। ডাক্তার ম্যানেটের জামাতাকে হত্যা করার পরামর্শে সে খুশি হয়ে সম্মতি দেবে না কখনো। তাই স্বামীকে গোপন করে, মাদাম ডিফার্জ চক্রান্ত করতে বসলো অন্য লোকের সঙ্গে! জ্যাকসঙ্ঘের ভিতর রক্তপিপাসু লোকের তো অভাব ছিল না! গোটা সঙঘটাই তো গড়ে উঠেছে, ফরাসীদেশের যাবতীয় নর-রাক্ষসদের (অবশ্য অত্যাচারেই রাক্ষস হয়ে দাঁড়িয়েছে এ-সব মানুষ) একত্র করে!

এই গোপন চক্রান্তের ফল ফলতে বিলম্ব হল না।

ডার্নের মুক্তির উপলক্ষে সেদিন সন্ধ্যায় পারিবারিক উৎসবে মেতেছেন ডাক্তার ম্যানেট–এমন সময়ে অস্ত্রধারী নাগরিকেরা গিয়ে সাধারণতন্ত্রের নামে দ্বিতীয়বার বন্দী করলো ডার্নেকে! অপরাধ, দেশদ্রোহ…জনসাধারণের উপর অত্যাচার! অপরাধ নিজের হোক বা পূর্বপুরুষের হোক, কথা একই।

এই আচমকা বিপদ সবাইয়ের মাথায় এসে পড়লো যেন নীল আকাশ থেকে বজ্রের মত।

ডার্নে আবার কারারুদ্ধ!

পরদিনই বিচার। প্রশ্ন উঠলো, আগের দিন যাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, আজ আবার তাকে পুনরায় অভিযুক্ত করা হল কেন? তার উত্তরে একখানা কাগজ দাখিল হল আদালতে।

ব্যাস্টিল অধিকারের দিনে ডাক্তার ম্যানেটের ১০৫নং কারাগহুর থেকে যে কাগজখানা উদ্ধার করেছিল ডিফার্জ, এটা সেই কাগজ। ম্যানেট তার কারাবাসের দিনে নিজের হাতে লিখে রেখেছিলেন–অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ! কে সেই অত্যাচারী? অত্যাচারী–মার্কুইস এভরিমন্ডি! এভরিমন্ডি-মাকুইসের আবেদনেই ম্যানেট বিনা বিচারে আঠারো বছর বন্দী ছিলেন ব্যাস্টিলের নির্জন কারায়।

হায় দুর্ভাগা ম্যানেট!

এই কাগজের কথা তার একেবারেই স্মরণ ছিল না!

হ্যাঁ, এভরিমন্ডি-বংশ যে তার কারাবাসের কারণ, তা তিনি জানতেন। মাকুইসের আহ্বানে একদা তাকে যেতে হয়েছিল এক পীড়িতা নারীর চিকিৎসার জন্য। সেখানে গিয়ে বিকারগ্রস্ত রোগিণীর প্রলাপ থেকে এক ভয়াবহ কাহিনী শুনতে পান তিনি। রোগিণীর ভাইকেও দেখতে পান ঐ গৃহে, সে তখন মরতে বসেছে। তার বুকে তরোয়াল বিদ্ধ হয়েছে! রোগিণীর পিতাও নিহত হয়েছেন ঐ গৃহেই, এ-বৃত্তান্তও ম্যানেটের কানে আসে!

ম্যানেট ফিরে এলেন। কিন্তু মাকুইসের ভয় রইলো–তার এ অনাচারের ইতিহাস হয়তো ম্যানেট একদিন প্রকাশ করে দেবেন। দণ্ডের ভয় না থাক, কলঙ্কের ভয় মার্কুইসের ছিল। তাই তিনি ব্যবস্থা করলেন ম্যানেটকে সরিয়ে ফেলবার। আচমকা তাকে ধরে ব্যাস্টিলে বন্দী করা হল।

রাগে দুঃখে প্রতিহিংসার কামনায় ম্যানেট বুকের রক্তে লিখেছিলেন– এভরিমন্ডির বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের বিবরণ। সেদিন প্রতিহিংসায় অন্ধ ম্যানেট স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে ঐ বিবরণ থেকেই আজ তার প্রাণাধিকা কন্যার প্রিয়তম স্বামীর জীবনান্ত ঘটবে। এর চেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস নিয়তির ভাণ্ডারে তো কিছু থাকতে পারে না!

এভরিমন্ডি! ম্যানেটের শত্রু ওরা। কিন্তু কন্যার মুখ চেয়ে এভরিমন্ডি-বংশধরকে তিনি হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন। তখন কি জানতেন যে, তিনি এভরিমন্ডিকে ক্ষমা করলেও, আর-একজন কেউ দুনিয়ায় আছে–যার কাছে এভরিমন্ডি-বংশের ক্ষমা লাভের কোন আশাই নেই?

হ্যাঁ, এমন একজন আছে দুনিয়ায়। সে হল মাদাম ডিফার্জ।

জামাতার স্বপক্ষে তবুও ম্যানেট কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আদালত আর সে-কথায় কর্ণপাত করলো না। এভরিমন্ডি-বংশের যে পৈশাচিক অত্যাচারের বিবরণ ম্যানেটের লিখিত অভিযোগে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে স্বয়ং ম্যানেটের কোন কথাও। কেউ আর শুনতে চাইলো না, অপরাধীর স্বপক্ষে।

মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রচারিত হল।

ম্যানেট লুটিয়ে পড়লেন ডার্নের পায়ের কাছে। তিনিই ঠেলে দিয়েছেন প্রিয় জামাতাকে, মৃত্যুর মুখে। তিনিই নিজের হাতে প্রিয় কন্যাকে সাজিয়ে দিয়েছেন বিধবার বেশে! তিনিই নয়ন-মণি দৌহিত্রীকে করে দিয়েছেন পিতৃহীনা! হায় ভাগ্য!

ডার্নে স্থির, গভীর, অবিচলিত। লুসীও তাকে বিদায় দিলেন কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে। যাও প্রিয়তম! আমার জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না তোমায়। আমিও এলাম বলে!–এই হল লুসীর বিদায়-বাণী।

জানা গেল–অভিশপ্ত এভরিমন্ডি-বংশের শেষ সন্তানকে পরদিন বেলা তিনটেয় গিলোটিনে নিক্ষেপ করা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *