এ টেল ট্যু সিটীজ – ৪

০৪. দণ্ডমুণ্ডের মালিক

প্যারী নগরে বিরাট এক রাজপ্রাসাদ।

রাজপ্রাসাদ বটে কিন্তু এই প্রাসাদের মালিক ঠিক রাজা নন। রাজার ঠিক নিচেই। যাঁদের স্থান, রাজার অসীম প্রতাপ আর ক্ষমতা পরিচালিত হয় যাঁদের হাত দিয়ে ইনি তাদেরই একজন।

এঁর দরবারে সেদিন সকাল বেলায় অতি লোকের আমদানি হয়েছে। সবাই প্রভুর দর্শনের অভিলাষে এসেছে। প্রভু যেন ভুলে না যান, এইজন্যই হাজিরা দেওয়া। আর হাজিরা দিতে যারা এসেছে তারাই কি বড় নগণ্য? দু’চারটে মাকুইস মার্শালও আছে ঐ দলে–যারা নিজের নিজের এলাকায় প্রত্যেকেই হাজার হাজার লোকের দণ্ডমুণ্ডের মালিক।

সারি-সারি ঘর। এক ঘরের ভিতর দিয়ে অন্য ঘরের দরজা। বহুমূল্য আসবাবে, রাজকীয় আড়ম্বরে সাজানো সব ঘর। সব ঘরেই অভ্যাগতের ভিড়। প্রভু আছেন এই সারিবদ্ধ ঘরের শেষ ঘরখানিতে। দরজা বন্ধ করে চকোলেট পান করছেন তিনি। চারজন সুদক্ষ চাকরের সাহায্য দরকার হয় প্রভুর চকোলেট খাবার সময়।

চারজনের জায়গায় তিনজন হলে চলে না। অচল তো হয়ই, প্রভু নিজেকে অবহেলিত, অপমানিত মনে করেন। এ-রকম অঘটন ঘটেনি কোনদিন, ঘটতে যদি–ফরাসী দেশকে রসাতলে দিতেন প্রভু! চারজন ভৃত্যের কমে চকোলেট খাওয়া? কী করে হতে পারে? একজন নিয়ে আসবে চকোলেটের স্বর্ণপাত্র, একজন নাড়বে সেই চকোলেট সোনার কাঠি দিয়ে, আর একজন সোনার তারে গাঁথা চীনদেশের রেশমী কাপড় দিয়ে ঢাকা দেবে প্রভুর অঙ্গ, যাতে চকোলেটের ছিটেফোঁটা

পড়ে যায় সে দেবদেহে, আর, চতুর্থ ব্যক্তি–এ হলো স্বয়ং সর্দার-খানসামা এর জামার দুই পকেটে দুটো সোনার ঘড়ি বাজে টিটি করে–যেন তারা বলছে–টিক্ টিক্‌, ঠিক ঠিক, এইভাবেই চলছে চিরদিন, এইভাবেই চলবে ঠিক! ঠিক্ ঠি! টিক্ টিক্‌!

হ্যাঁ, কী বলছিলাম, এই ডবল সোনার-ঘড়িওয়ালা সর্দার-খানসামা চকোলেট ঢেলে দেবে সোনার পেয়ালায়, তবে তা প্রভুর পানযোগ্য হবে! কারণ ইনি প্রভু, প্রভুদেরও প্রভু! এঁর উপরেও আর-এক প্রভু আছেন বটে, তিনি স্বয়ং রাজা। কিন্তু রাজার সঙ্গে সরাসরি ধরা-ছোঁয়ার ভিতর কম লোকই আসে। রাজশক্তির উত্তাপ নিজেদের অঙ্গে ধারণ করে এই প্রভুর দলই জনসাধারণকে পুড়িয়ে মারেন। সূর্যের তেজে গরম হয়ে ওঠে মরুভূমির বালুকা। রৌদ্রের চেয়ে সেই তপ্ত বালুকাই বেশি অসহ্য লাগে মরুপথের পথিকের কাছে।

চকোলেট পানপর্ব অবশেষে সাঙ্গ হল। রুদ্ধদ্বার খুলে গেল। প্রভুর উদয় হল তাদের সমুখে, যারা দলে দলে বাইরে বসে আছে একটিবার তাঁর দর্শন পাবার জন্য। ডাইনে-বাঁয়ে মাথা সব নুয়ে পড়তে লাগলো কর্তিত শস্যের মত। কাউকে একটি কথা, কারুর উপর একটুখানি হাসি, কারুর পানে চোখের কোণের এতটুকুন দৃষ্টি বর্ষণ করতে-করতে প্রভু চলেছেন কক্ষের পর কক্ষ অতিক্রম করে। শেষপ্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি, ইনিও প্রভুজাতীয়। গৃহস্বামী-প্রভুর মত অতবড় প্রভু না হলেও ইনিও বড় কম যান না। দেয়ালে কোন ইতালীয়ান ওস্তাদ শিল্পীর আঁকা ম্যাডোনা চিত্র। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হয়তো তিনি সেই মাতৃমূর্তির সৌন্দর্যই দেখছিলেন, যদিও নিজের জীবনে মায়েদের সম্মান কমই রক্ষা করা অভ্যাস তার। মাতৃজাতি তত তার খেলার বস্তু! অর্থাৎ ওঁর একার নয়, সেই সময়কার প্রভু জাতিরই খেলার বস্তু।

গৃহস্বামীকে সামনে দেখে অন্য সবাইয়ের মত তটস্থভাব মোটেই দেখালেন না ইনি। অনেকটা সমকক্ষের মতই অভিবাদন করলেন তাঁকে। ভাবটা এই আজ তুমি রাজার কৃপালাভ করে খানিকটা উঁচুতে উঠে গেছ বটে, কিন্তু কাল পাশা উলটে যেতে পারে। তখন তোমার পদে আমি বসবো হয়তো, আর আমার বাড়িতে তুমি হাজিরা দেবে স্বার্থের খাতিরে।

আগন্তুক-প্রভুর মনের ভাব গৃহস্বামী-প্রভুর অজানা থাকবার কথা নয়, কারণ, এসব ব্যাপারে প্রভুরা পরস্পরের মনের ভাব ঠিকই বুঝতে পারেন। তিনি গম্ভীর ভাবে ঠিক সেইটুকুন সৌজন্যই দেখালেন–যা না দেখালে শিষ্টাচার বজায় থাকে না। যে চমৎকার কায়দায় আগন্তুকের নমস্কার তিনি ফিরিয়ে দিলেন, তাতে স্পষ্টই ফুটে উঠলো তার মনের কথা–অত আশা করো না বন্ধু! রাজার কৃপা তোমার বরাতে নেই, আর আমি গিয়ে তোমার বাড়িতে হাজিরা দেবো কোনদিন–এ আশা মগজে স্থান না দেওয়াই তোমার ভালো।

গৃহস্বামী পিছন ফিরলেন, দুশো লোককে খুশি করে বিদায় করার ঝামেলা মিটিয়ে দিলেন পাঁচ মিনিটের ভিতর। তিনিও নিজের খাসকামরায় গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন, অভ্যাগত প্রভুটিও রুক্ষ মেজাজে মুখটি কালো করে ত্যাগ করলেন সে গৃহ। আসবার তার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু না এলেও সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবার সম্ভাবনা। যতক্ষণ যার হাতে ক্ষমতা রাছে, তাকে তোয়াজ করতে হবে বইকি, তা সে যতই দাম্ভিক হোক!

অভ্যাগত প্রভুর চার ঘোড়ার গাড়ি সিঁড়ির নিচেই অপেক্ষা করে আছে। প্রভু উঠে পড়লেন, ইশারা পেয়ে বায়ুবেগে গাড়ি চালিয়ে দিলো কোচোয়ান। জনাকীর্ণ নগরীর রাজপথ; তাও যে আবার সব জায়গায় তা সমান প্রশস্ত, তা নয়। তার উপর দিয়ে এ-রকম বেগে গাড়ি চালানো নিরাপদ নয় জেনেও কোচোয়ান চাবুকের পর চাবুক মারতে লাগলো ঘোড়ার গায়ে। তেজী ঘোড়া ছুটলো ঝড়ের মত ।

এ ১ অব টু সিটীজ পথচরেরা চাপা পড়তে-পড়তে ছুটে পালাতে লাগলো। তাণে প্রাণ বাঁচানো তাদেরই। কাজ। ঘোড়ার পায়ের তলায় পড়ে মরে যদি তারা, ঘোড়ার কোন দোষ হবে না, কোচোয়ানের তো নয়ই। আরোহী? আরোহী যদি নেমে এসে মৃতের আত্মীয়দের ধরে চাবুক না মারেন, তবে তার নাম রটে যাবে দয়ালু বলে।

ঘড়-ঘড় ঝন্ঝন্ ঘটাং-ঘটাং শব্দ করে ছুটে চলেছে গাড়ি। ঝড়ের বেগে ছুটেছে, মোড়ের পর মোড় ঘুরে যাচ্ছে সেই ঝড়ের বেগে। নারীরা চিৎকার করে পালাচ্ছে পথ ছেড়ে, পুরুষেরা টানাটানি করছে শিশুদের। হৈ-হৈ ব্যাপার! রৈরৈ কাণ্ড! মাকুইসের গাড়ি! সামা!

পথের ধারে একটা ফোয়ারা। অনেক নারী ও শিশু সেখানে। নারীরা জল ভরছে, শিশুরা কাদা মাখছে। ঝড়ের বেগে এসে পড়লো মার্কুইসের গাড়ি। একটা রব উঠলোপালাও! পালাও!

একখানা চাকা ধাক্কা খেয়েছে কিসের সঙ্গে যেন। একটা আর্ত কোলাহল চারিদিকে। ঘোড়ারা পা তুলে লাফিয়ে উঠলো।

ঘোড়ারা লাফিয়ে উঠলো বলেই গাড়ি থামলো। তা নইলে থামবে কেন? গাড়ির। তলায় মানুষ চাপা পড়ে থাকে অমন, তা বলে প্রভুদের গাড়ি থেমে পড়বে রাস্তার। মাঝখানে, অমন আশা করে না গরীবেরা। কিন্তু এ-যাত্ৰা ঘোড়ারা লাফিয়ে উঠেছে, গাড়ি থামাতেই হল। মাকুইস মুখ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলেন–হল কি?

লম্বা একটা লোক, ঘোড়ার পায়ের তলা থেকে টেনে বার করেছে একটা মাংসপিণ্ড, আর কাদার উপর সেইটেকে রেখে, তার উপরে পড়ে চিৎকার করছে হাউহাউ করে।

ছেঁড়া কাপড় পরা একটা লোক বিনীত স্বরে বললে–মহান্ মার্কুইস! ক্ষমা করুন প্রভু!–একটা বাচ্চা চাপা পড়েছে!

–ও লোকটা অমন জানোয়ারের মত চেঁচায় কেন? ওরই বাচ্চা বুঝি?

–তাই বটে হুজুর। ওরই ছেলে বটে!

লম্বা লোকটা হঠাৎ রক্তমাখা মাংসপিণ্ডের উপর থেকে লাফিয়ে উঠলো, ছুটে এলো গাড়ির দিকে। দুই হাত মাথার উপর তুলে চিৎকার করে বললো–মেরে ফেলেছে! মরে গেছে আমার ছেলেটা? সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো মার্কুইসের দিকে চোখে তার যেন বিজলীর ঝলক!

বহু লোক গাড়ির চারিপাশে। সবাই তাকিয়ে মাকুইসের দিকে কী তিনি। বলেন–শুনবার জন্য কান খাড়া করে আছে তারা; কী তিনি করেন–দেখবার। জন্য চোখে তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কিন্তু সে দৃষ্টিতে ক্রোধ নেই, মুখেও তাদের ভাষা নেই। মহান্ মাকুইস একবার সবাইয়ের দিকে একনজর দেখে নিলেন, নিছক তাচ্ছিল্য তার সে নজরে। অপরিসীম তাচ্ছিল্য–যেন গর্ত থেকে একপাল ইঁদুর বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে তার সমুখে! টাকার থলে বার করলেন মার্কুইস! তারপর তার মুখ থেকে ধীরে ধীরে বেরুলো :

–আমি দেখে অবাক হয়ে যাই যে, তোদের নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার, বা ছেলেগুলোকে সাবধানে রাখার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই। একটা-না-একটা সর্বদাই এসে। পড়ছে গাড়ির সমুখে! কী জানি আমার ঘোড়ার পা খোঁড়া হয়ে গেল কি না! নে, এইটে দে ওকে!

একটা মোহর থলে থেকে নিয়ে তিনি ভিড়ের ভিতর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। সমস্তগুলো ঘাড় সেইদিকে ফিরলো, সমস্তগুলো চোখ দেখতে লাগলো–মোহরটা কী-রকম ঘুরপাক খেয়ে উপরে উঠে আবার ঘুরপাক খেয়ে নিচে নামতে লাগলো। শুধু লম্বা লোকটা আবার দু’হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলো–মেরে ফেলেছে! মরে গেছে। ছেলেটা!

অনেকবার সে এইভাবে চিৎকার করেছে, আরও কতবার যে এইভাবে চিৎকার করতো–কে জানে! কিন্তু এই সময়ে আর একটি লোক জোর-পায়ে এসে হাজির। হল সেখানে। তাকে দেখে অন্য সবাই পথ ছেড়ে সরে গেল। লম্বা লোকটা এই আগন্তুকের কাঁধের উপর মাথা রেখে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলো এইবার। একটা আঙুল তুলে কেবল সে ফোয়ারার দিকে দেখাতে লাগলো–যেখানে এক রক্তমাখা মাংসপিণ্ড ঘিরে পাড়ার মেয়েরা ঘুরছে আর ফিরছে–নীরবে, মাথা নিচু করে।

আগন্তুক বললো–সব শুনেছি, সব জানি ভাই গ্যাসপার্ড। ভালোই হলো, বাচ্চাটার পক্ষে এ ভালোই হলো। যে-ভাবে মানুষ বাঁচে এ-দেশে, সে-ভাবে বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো গ্যাসপার্ড! বুক বাঁধো ভাই! বুক বাঁধো!

মাকুইসের বাঁকা-অধরে খেলে গেল মৃদু হাসি। সে হাসি নিছক অবজ্ঞার। বাঃ! তুমি তো জ্ঞানী লোক দেখছি! নাম কি তোমার?

–ডিফার্জ।

–কী করো?

–মহান্ মার্কুইস! আমি মদের দোকানী।

–জ্ঞানী ও মদের দোকানী! এই তোমার বকশিশ!–বলে মার্কুইস আর-একটা মোহর ছুঁড়ে মারলেন ডিফার্জের দিকে। তারপর হুকুম দিলেন–চালাও গাড়ি!

জনতার দিকে আর দ্বিতীয়বার দৃষ্টি না দিয়ে মহান্ মাকুইস গদীতে ঠেসান দিয়ে বসলেন। চলতে চলতে পায়ের গুঁতোয় একখানা মেটে বাসন ভেঙে ফেলেছেন যেন! দাম চুকিয়ে দিয়েছেন–আবার কী?–চালাও!

গাড়ি সবে চলতে শুরু করেছে, এমন সময়ে ঠং করে তারই ছুঁড়ে দেওয়া মোহর উড়ে এসে পড়লো গাড়ির পাটাতনের উপরে। চমকে উঠলেন প্রভু।

–রোখো! রোখো!–কে ছুঁড়লো মোহর?

মার্কুইস তাকিয়ে দেখলেন। মদের দোকানী জ্ঞানী ডিফার্জ আর সেখানে নেই। আছে আর একটি কালো শক্ত নারী, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বুনে চলেছে ছবির পর ছবি, সাদা কাপড়ে।

গলার স্বর এক পর্দাও না চড়িয়ে মার্কুইস বললেন–কুত্তা সব। কে ঐ ঢিল ছুঁড়েছে গাড়ির ভিতর, জানতে যদি পারতাম! তাকে গাড়ির চাকার নিচে ফেলে গুঁড়ো করে ফেলতাম আমি!

গাড়ি গড়গড় করে চলে গেল, ফোয়ারার জল তরতর করে বয়ে চললো। থরথর করে কাঁপতে-কাঁপতে ইঁদুরের দল ঢুকলো-যে যার গর্তে। একটা ছেলে মরে গেছে, সেটা বড় কথা নয়; বড় কথা এই যে মার্কুইস রেগেছেন! কাজেই কাঁপছে ইঁদুরেরা।

সেই রাত্রে।

নিজের প্রাসাদে নৈশ-ভোজনে বসেছেন মহান্ মার্কুইস। টেবিলে দু’জনের খাবার! খাচ্ছেন কিন্তু মার্কুইস একাই। ইংলন্ড থেকে তার ভ্রাতুস্পুত্রের আজ আসবার কথা। এখনও পৌঁছোননি তিনি! একাই খেতে বসেছেন মার্কুইস! রাজভোেগ! পরম পরিতোষের সঙ্গে ভোজন চলেছে প্রভুর!

পথে একটা ব্যাপার ঘটেছে যা মার্কুইস ঠিক বুঝতে পারেননি! গাড়ির তলা: লোহার কাঠামো ধরে ঝুলতে ঝুলতে একটা লম্বা লোক না-কি এসেছিল বহুদূর! সইস-কোচোয়ানেরা দেখতে পায়নি তাকে, কিন্তু পথচরেরা দেখেছিল। তাদেরই কানাকানি থেকে কথাটা প্রচার হয়ে পড়ে। মাকুইসের কানে যখন এলো এ-খবর, তখন আর গাড়ির তলার লম্বা লোকটাকে কোথাও পাওয়া গেল না; সে কোন্ ফাঁকে পালিয়ে গেছে!

অবশ্য, কোন ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার পাত্র মার্কুইস নন–তা সে ব্যাপার যত দুর্বোধ্যই হোক না কেন! তবে হ্যাঁ, খেতে-খেতে দু’তিনবার তিনি ভৃত্যদের বললেন জানলা খুলে দেখতে–বাইরে কোন অচেনা লোককে দেখা যায় কি না। নাঃ, সন্দেহজনক কিছু কোথাও নেই।

গাড়ির শব্দ!–ঐ বোধ হয় এলো তার ভ্রাতুস্পুত্র! আসবামাত্রই ভৃত্যেরা তাকে। জানালো যে মাকুইসের ঘরে তার খাবার দেওয়া হয়েছে। তিনি এলেন। কে তিনি? তাকে আমরা দেখেছি লন্ডনে। ওল্ড বেইলীর বিচারকক্ষে। তার নাম ছিল তখন, চার্লস্ ডার্নে।

খুবই ভদ্রভাবে ভাইপোকে ডেকে পাশে বসালেন মার্কুইস। কিন্তু সভ্যসমাজের যা রীতি, আপনজনের সঙ্গে দেখা হলে করমর্দন করা, কিন্তু তার জন্য হাত বাড়ালেন না কেউ।

ডার্নে বললেন–আপনি এই এলেন প্যারী থেকে?

–হ্যাঁ। আর তুমি?

–সোজা লন্ডন থেকে!

–অনেক দিন থেকেই আসবার কথা শুনছিলাম তোমার।

–একটু দেরি হয়ে গেল! কাজ ছিল–

–তা তো বটেই!

ভৃত্যেরা যতক্ষণ কক্ষে রইলো, এইরকমই মামুলী আলাপ চললো দু’জনের ভিতর। তারপর ভোজন শেষ হয়ে গেল, কফি পরিবেশন করে ভৃত্যেরা চলে গেল ঘর থেকে। তখন ডার্নে বললেন :

যে-কাজের জন্য ঘুরছি কিছুদিন থেকে আপনি তা জানেন। তারই দরুন আসতে হল আবার! এ-রকম যাতায়াত খুবই বিপজ্জনক। এর জন্য বৃটিশ সরকারের সন্দেহভাজন হয়ে পড়েছি আমি। মাঝখানে রাজদ্রোহের মামলায় পড়েছিলাম। অতি কষ্টে প্রাণে বেঁচেছি! অবশ্য, প্রাণ গেলেও দুঃখ ছিল না। যে পবিত্র কাজ মাথায় তুলে নিয়েছি, তার জন্য হাসিমুখে মরতেও পারি আমি।

পিতৃব্য একটুও ব্যস্ত না হয়ে বললেন–আরে না, না, মরতে হবে কেন?

ভ্রাতুস্পুত্র উত্তর করলেন–অবশ্য, আমি মরতে বসলেও যে আপনি আমার রক্ষার জন্য কোন চেষ্টা করতেন না, তা আমি বিলক্ষণ জানি।

পিতৃব্য হাত নেড়ে একটা প্রতিবাদেরই ভঙ্গি করলেন অবশ্য, কিন্তু সে-প্রতিবাদ যে আন্তরিক নয়, তা বুঝতে কষ্ট হল না ডার্নের। তিনি যেন স্পষ্ট কথা শোনাবার জন্যই এসেছেন আজ; পিতৃব্যকে সোজা শুনিয়ে দিলেন–আপনার ক্ষমতা থাকলে আপনি বরং আমার বিপক্ষেই দুচারটা জোরালো প্রমাণ যুগিয়ে দিতেন, তা আমি বুঝি।

আশ্চর্য মানুষ এই মাকুইস! একটুও বিরক্ত বা ক্রুদ্ধ না হয়ে মিষ্টস্বরে বললেন– আরে, না–না! বলো কি?

ডার্নে সে-কথায় কান না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–আমার কাজে বাধা দেবার শক্তি থাকলে আপনি কি তা দিতেন না?

মাকুইসের অধরে চকিতের জন্য ক্ষীণ হাসি দেখা দিয়ে তা মিলিয়ে গেল। তিনি উত্তর করলেন–তা যে দিতাম, সে কথা তো আগেই বলেছি!

–সম্ভব হলে আপনি আমাকে ব্যাস্টিলে আবদ্ধ করতেন। বলুন, এ কথা সত্য কিনা!

–খুবই সত্য! ব্যাস্টিলে কিছুদিন রাখতে পারলে তোমার উপকার হতো। নির্জন কারাবাসে চিন্তার সময় পাওয়া যায়। আর চিন্তাতেই মানুষের স্বভাব শোধরায়।

ডানে হেসে বললেন–তাহলে বলতে হয় যে, এ-দেশের বর্তমান শাসক যাঁরা, তাদের সঙ্গে আপনার সদ্ভাব নেই বলেই আমি এখনো স্বাধীন আছি?

তিক্তকণ্ঠে মাকুইস বললেন–কী যে হল দেশটার! অল্পদিন আগেও আমরা যা খুশি তাই করেছি। যাকে দরকার ব্যাস্টিলে পাঠিয়েছি, যাকে ইচ্ছে ফাঁসিতে লটকেছি! কিন্তু সেভাবে চলতে গেলে এখন যেন সুবিধে হবে না বলে মনে হয় মাঝে-মাঝে! এ টেস্ অব সিটীজ একটা নতুন কথা শুনতে পাই এখন। জনগণের স্বাধীনতা! হাঃ হাঃ- কী গেরো বল দেখি! হতাশভাবে মার্কুইস এক টিপ নস্য নাকে খুঁজে দিলেন।

ডানে উত্তর করলেন–সেইভাবে চলে-চলে যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে–ছিঃ ছিঃ! আমাদের এই বংশকে যতটা অভিশাপ দেয় এ-দেশের লোক, এমন আর বোধ হয় কাউকে নয়!

মার্কুইস যেন খুশি হয়ে বললেন–তাই তো চাই! যে অভিশাপ দেয়, বুঝতে হবে যে প্রতিহিংসা নেবার শক্তি তার নেই!

এ-কথার উত্তরে ডার্নে নতমুখে তাকিয়ে রইলেন টেবিলের দিকে। উদ্বেগ আর নৈরাশ্য তার বসার ভঙ্গি থেকেই ফুটে বেরুচ্ছিলো যেন। আর মাকুইস? তিনি যখন কথা কইলেন আবার, তা থেকে ফুটে বেরুলো শুধু অসহ্য দম্ভ। বলে চললেন– যত দিন এই প্রাসাদের উপর ছাদ বজায় থাকবে, ততদিন চাবুকের চোটে কুকুরের দলকে ঠাণ্ডা রাখবো বৎস! নিজেকে বড় করে রাখার সহজ পথ দুনিয়ায় চিরদিনই একটি মাত্র–সে হচ্ছে, অত্যাচার!

ডার্নে বললেন–অন্যায় করলেই সাজা পেতে হয় তার জন্য। আমরা অন্যায় করেছি, তারই সাজা আসছে কিস্তিতে কিস্তিতে। প্রথম কিস্তি এই অভিশাপ।

–আমরা অন্যায় করেছি?–মার্কুইস জিজ্ঞাসা করলেন–আমরা কারা?

–আমরা অভিজাতেরা! সে অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্তের জন্যই আমার ইংলন্ডে থাকা। মা আমায় আদেশ করে গিয়েছেন মৃত্যুকালে–এ জমিদারীর সঙ্গে সংস্রব না-রাখতে! অত্যাচারিত প্রজাদের মাথায় নতুন অত্যাচারের বোঝ আমি যেন কোনদিন না চাপাই, মা আমায় মিনতি করে গিয়েছেন বারবার।

মার্কুইস ব্যঙ্গের সুরে বললেন–জমিদারী আগে পাও তো, তারপর সে-কথা। আমি তো আজই মরছি না!

ডার্নে বললেন–না, সে কামনা আমি করি না। আপনি আরও দীর্ঘ দিন বাঁচুন!–তবে আপনার দেহান্ত ঘটলে এ-সম্পত্তি যদি আমার হয়, হবেই অবশ্য, আমি এর পরিচালনার নতুন ব্যবস্থা করবো। গরীব প্রজার দুর্গতি যাতে দূর হয়, তারা যাতে পেট ভরে খেতে পায়, পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে পায় সত্যিকার মানুষের মত, তা আমি করবো সেদিন।

–এবং তুমি নিজে উপবাস করবে–প্রজাদের ভরপেট খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে–এই তো?–বিদ্রূপ করে উঠলেন মার্কুইস।

উত্তেজিত হয়ে ডানে বললেন,”উপবাস? উপবাস কেন করবো? এখন কি আমি উপবাস করে আছি? যে খেটে খেতে পারে, তাকে কখনো উপবাস করতে হয় না। শুধু আমি কেন, বহু ফরাসী-ভদ্রলোকই এই অভিশপ্ত দেশ ত্যাগ করে ইংলন্ডে গিয়েছেন–নিজের চেষ্টায় নিজের জীবিকা অর্জন করবার জন্য।

আবার বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলো মার্কুইসের মুখে। বহু ফরাসী-ভদ্রলোক? তার ভিতর বোভেয়াবাসী এক ডাক্তার আছেন বোধ হয়? চেনো সে ডাক্তারকে? ডাক্তার ম্যানেট?

মাকুইসের হাসির কারণ বুঝতে না পেরে বিস্মিত ডার্নে সংক্ষেপে বললেন– চিনি।

-বেশ, বেশ। ম্যানেটের এক মেয়ে আছে না? তোমার এ নতুন মতবাদের মূলে কি সেই ম্যানেটের মেয়ে? যাকগে, ঘুম পাচ্ছে আমার! কাল আবার কথা হবে বৎস। শুভরাত্রি!

এই বলে মার্কুইস ঘণ্টা বাজালেন। ভৃত্যেরা আলো নিয়ে এলো ডার্নেকে তার শয়নকক্ষে নিয়ে যাবার জন্য। মার্কুইসও নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন গিয়ে। কিন্তু আজ কেন চোখে ঘুম আসে না?

সুকোমল সুগন্ধি রাজশয্যায় শুয়ে মাকুইসের নয়নে তবু নিদ্রা নেই। চোখের সামনে ছবির পর ছবি ভেসে ওঠে। ঘরের ভিতর অন্ধকার; কিন্তু সে অন্ধকারের বুক থেকে ফুটে ওঠে রক্তরাঙা সব ছবি। প্যারীর রাজপথ, রাজপথের কোণে ফোয়ারা, গাড়ির চাকার নিচে দলিত মাংসপিণ্ড…মুমূর্ষ চিৎকার করছে…অন্ধকারে রক্তবিন্দু ঝরে পড়ছে শিশিরের মতন।

এমন সময় অকস্মাৎ একটা ঘ-ঘস্ শব্দ ঘরের ভিতর! মাকুইস চকিত হয়ে ওঠেন, কিন্তু ভৃত্যদের ডাকবার আগেই একখানা ছোরা আমূল বিঁধে যায় তার হৃদয়ে। প্রায়শ্চিত্তের পালা শুরু হয়েছে এবার।

***

সেই গ্যাসপার্ড! যে একদিন লাল মদ দিয়ে দেওয়ালের গায়ে লিখেছিল–”রক্ত? রক্ত!” যে একদিন কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল পুত্রকে মাকুইসের গাড়ির তলায় চাপা পড়তে দেখে! সেই গাড়ির নিচেকার লৌহদণ্ড ধরে ঝুলতে-ঝুলতে মাকুইসের অনুসরণ করেছিল।

গ্যাসপার্ড কিন্তু ধরা পড়লো! পালাতে পারলো না। মাকুইসের প্রাসাদের পায়ের তলায় মাথা গুঁজে পড়ে আছে যে গরীবদের গ্রাম, সেইখানে হলো তাঁর ফাঁসি। চল্লিশ ফুট উঁচুতে তুলে ফাঁসি দেওয়া হল তাকে। সেই চল্লিশ ফুট উঁচুতে ঝুলতে থাকলে তার দেহ, যতদিন না পচে গলে খসে পড়লো তার হাত-পাগুলো–চল্লিশ ফুট নিচের গ্রামের ভিতর। জমিদার খুন? এ-পাপের এমনি চরম দণ্ড না দিলে দেশে শান্তি রক্ষা হবে কি করে?

দিন যায়। অত বড় দাপট যে মাকুইসের, তিনি আর নেই! যিনি চাবুকের চোটে শায়েস্তা রাখতে চেয়েছিলেন দেশের লোককে, তিনি হঠাৎ-ই, দেশকে অভিভাবকশূন্য করে চলে গেলেন পরলোকে। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র–যিনি বিশ বৎসরের ভিতর জমিদারী হাতে পাবার প্রত্যাশা করেননি, তিনি হঠাৎ প্রভাতে শয্যাত্যাগ করেই দেখতে পেলেন–জমিদারী পেয়ে গেছেন তিনি। গ্যাবেলকে ডেকে পাঠালেন।

এ টেস্ অব দ্যু সিটীজ গ্যাবেল হল মাকুইসের তহশীলদার। খাজনাপত্র সেই আদায় করে। এখন থেকে আর কোন খাজনা আদায় হবে না প্রজাদের কাছে, বরং উলটে সকল রকমে তাদের সাহায্য করা হবে জমিদারীর সঞ্চিত অর্থ থেকে, এই সোজা আদেশ দিয়ে ডার্নে প্রস্থান করলেন লন্ডনে। এই অভিশপ্ত জমিদারীতে বাস করবেন না তিনি, পাছে সংক্রামক ব্যাধির মত তার মনেও ক্ষমতার মোহ সঞ্চারিত হয়।

ডার্নে চলে গেলেন, গ্যাবেল নতুন নিয়মে জমিদারী চালাবার জন্য প্রস্তুত হল। কিন্তু সে প্রস্তুত হবার আগেই একদিন মাকুইসের প্রাসাদে আগুন লাগলো! গ্রামের লোকে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো সেই আগুন। এ ওকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো–আগুনটা চল্লিশ ফুট উঁচুতে উঠেছে কি না!

সেই একই রাত্রে ও-অঞ্চলের প্রত্যেক জমিদারবাড়িই আগুনে ছাই হয়ে গেল! প্রায়শ্চিত্তের দ্বিতীয় কিস্তি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *