এ টেল ট্যু সিটীজ – ১

. গোড়ার কথা

খৃস্ট জন্মের ১৭৭৫ বৎসর পরে।

নভেম্বর মাসের এক সন্ধ্যা। গড় গড় করে একখানা ঘোড়ার গাড়ি ছুটছিল ডোভারের রাস্তা ধরে। মস্ত লম্বা গাড়ি, অনেক লোক তাতে যেতে পারত, কেউ ভিতরে, কেউ ছাদে। তখন রেলগাড়ি ছিল না, ডাক চলাচল করত এই রকম সব ঘোড়ার গাড়িতে। এ গাড়িটাও সেই ডাকগাড়ি।

মাত্র সাতাশ মাইল চওড়া সমুদ্রের খড়ি। নাম তার ইংলিশ চ্যানেল। তার এপারে ইংলন্ড, ওপারে ফ্রান্স। দুই দেশের ভিতর অনবরত লোকের আনাগোনা। এই ডাকগাড়ি ছাড়া সে সব লোকের চলাচলের আর কোন উপায় ছিল না সেকালে। এপারে ওপারে সারা পথটাই চলতে হত ডাকগাড়িতে; মাঝখানে শুধু খাড়িটুকু পার হওয়ার জন্য ছিল জাহাজ।

সেই সন্ধ্যাবেলা।

.

গাড়িখানা একটা ছোট পাহাড়ের নিচে দিয়ে চলেছে। হঠাৎ একজন লোককে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে দেখা গেল সেই গাড়ির দিকে। সে গাড়ির কাছাকাছি এসেই চিৎকার করে উঠলল–”গাড়ি থামাও!”

ডাকগাড়ির চালক গাড়ি থামিয়ে দিলো। অশ্বারোহী তখন গাড়ির কাছে এসে পড়েছে। সে তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো–টেলসন ব্যাঙ্কের মিঃ লরী এই গাড়িতে আছেন কি?

গাড়ির ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে একটি ভদ্রলোক বললেন–আমিই মিঃ লরী। কি দরকার আপনার বলুন।

লোকটা তখন তার পকেট থেকে একখানা খাম বের করলো। খামের মুখ আঁটা। সেটা মিঃ লরীর দিকে এগিয়ে ধরে বললো–আপনার চিঠি।

–আমার চিঠি!

–হ্যাঁ, ব্যাঙ্ক থেকে দেওয়া হয়েছে, খুব জরুরি চিঠি।

মিঃ লরী লোকটার হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে তাড়াতাড়ি খুলে পড়লেন। চিঠিখানা খুবই ছোট। তাতে লেখা ছিল–

“মিঃ লরী,

ডোভারের রয়্যাল জর্জ হোটেলে দেরি করবেন একটু। সেখানে আসবেন সেই ভদ্রমহিলা। আপনার সঙ্গে তার দেখা হওয়া দরকার!”

এ টেস্ অব টু সিটীজ চিঠিখানা পড়া হয়ে গেলে মিঃ লরী সেখানাকে আবার খামে বন্ধ করলেন; পকেটে রাখতে রাখতে বললেন–আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পারো।

অশ্বারোহী নমস্কার করে চলে গেল। তার ঘোড়ার খুরের আওয়াজ একটু একটু করে ঢিমিয়ে এল। দূর থেকে দূরে সরে যেতে যেতে একসময়ে তা একেবারে মিলিয়ে গেল।

ডাকগাড়িখানা আবার ছুটতে লাগলো হাওয়ার বেগে।

পরদিন সকালে ডাকগাড়িখানা এসে দাঁড়ালো রয়্যাল জর্জ হোটেলের দরজার সামনে।

গাড়ি থামতেই হোটেলের সর্দার খানসামা এগিয়ে এসে মিঃ লরীকে খাতির করে উপরে নিয়ে গেল।

টেলসন ব্যাঙ্ক খুব বড় ব্যাঙ্ক। লন্ডন আর প্যারী–এই দুই রাজধানীতেই তার বিশাল কারবার। বিখ্যাত ব্যাঙ্কের সমস্ত কাজ দেখাশোনার ভার মিঃ লরীর উপরে। কাজেই লোক তিনি সামান্য নন। তাঁকে খাতির করবার জন্য যে হোটেলের লোকেরা ছুটে আসবে, একথা না বললেও চলে।

মিঃ লরী হোটেলের ম্যানেজারকে তার জন্য দু’খানা ভাল ঘর ব্যবস্থা করে। দিতে বললেন। তিনি আরও বললেন যে, ঘর দু’খানির একখানিতে থাকবেন একজন তরুণী। তিনিও আজই আসবেন।

তখনই ঘর ঠিক হয়ে গেল।

.

ঘরে গিয়ে পোশাক বদল করবার সঙ্গে সঙ্গেই সকাল বেলার খাবার নিয়ে এলো একজন খানসামা।

মিঃ লরী তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়লেন, তার ইচ্ছে সমুদ্রের ধারে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আসা।

ডোভার শহরটা ঠিক সমুদ্রের উপরে নয়; একটু দূরে, পাহাড়ের গায়ে। সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে যদি কেউ শহরের দিকে তাকায়, তার হঠাৎ মনে হবে শহরটা সমুদ্রের ভয়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছিল। বেশি দূরে যেতে পারেনি; মাঝপথে পাহাড়কে পেয়ে তারই বুকে মুখ লুকিয়ে রয়েছে। সমুদ্র কিন্তু অত সহজে তাকে ছেড়ে দিতে রাজী নয়। সে পেয়াদার পর পেয়াদা পাঠাচ্ছে শহরটাকে ধরে আনবার জন্য। সে

পেয়াদা হল পাহাড় সমান বড় বড় ঢেউ। সে সব ঢেউ কিন্তু শহরের নাগাল পাচ্ছে না; শহর পাহাড়ের গায়ে অনেক উঁচুতে বসে ঢেউ-পেয়াদাকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। ঢেউয়েরা রেগে যাচ্ছে তাতে, লাফিয়ে উঠছে কূলের উপর। তাতে শহরের কিছু ক্ষতি হচ্ছে না; মাঝখান থেকে ভেঙে পড়ছে কূলের মাটি। বেড়াবার পক্ষে খুব যে মনোরম জায়গা এটা, তা নয়। একটা সোঁদা আঁশটে গন্ধ ডাঙায়; আর একটা গোলমেলে আওয়াজ জলের দিক্টাতে, সে-আওয়াজ শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে যায় মানুষের।

ডোভারে তখন ব্যবসা-বাণিজ্য খুব কমই হত। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য না করেও হঠাৎ বড়লোক হতে দেখা যেতো দু’চার জনকে। কী করে হত? জাহাজ তো মাঝে মাঝে ডোবে সমুদ্রে! সে সব জাহাজের অনেক মালপত্রই ভাসতে ভাসতে কূলে গিয়ে লাগে। তার ভিতর সোনা-দানা হীরে-জহরতের বাক্সও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। ডোভারের উপকূলটা এরকম ভাবে বাঁকানো যে ওখানে এসে লাগলে সে জিনিস আর ভেসে বাহির সমুদ্রে যেতে পারে না। এখন যেমন সরকারী লোক নিযুক্ত হয়েছে ঐ সব ভেসে-আসা মাল টেনে তুলবার জন্য, তখন তা ছিল না। কাজেই যার সম্মুখে পড়ত, সেই নিয়ে যেত। কেউ কেউ বড়লোক হয়ে যেত এই ভাবেই। তাই লোভে লোভে ডোভারবাসী সবাই সমুদ্রের ধারে ধারে ঘুরে বেড়াত অবসর পেলেই।

সেদিনও ঐ রকম কয়েকজন লোক ঘুরে বেড়াচ্ছিল সমুদ্রের তীরে। মিঃ লরীর ভাল লাগল না তাদের ঐ রকম ঘোরাফেরা। অনেকক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি হোটেলে ফিরে গেলেন।

বিকেলের দিকে কুয়াশায় আবছা হয়ে এলো চারিদিক। ওপারের ফরাসী-উপকূল ভাল দেখা যায় না আর। সেইদিকে চেয়ে মিঃ লরীর মনে নানা চিন্তার উদয় হতে লাগল। দুঃখেরই চিন্তা। পনেরো বছর আগে একটি দু’বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে ফরাসী-দেশ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেই দু’বছরের শিশু আজ সতেরো বছরের তরুণী। তাকেই আজ আবার ফরাসীদেশে নিয়ে যাবার দরকার হয়েছে। রয়্যাল জর্জ হোটেলে এসে তারই পথ চেয়ে বসে রয়েছেন মিঃ লরী। অবশ্য আজকের দিনটা এমনিতেই তাকে অপেক্ষা করে থাকতে হত, কারণ কালকের আগে আর জাহাজ নেই ওপারে যাবার।

তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে। খাওয়ার ঘরে লোকের ভিড় দেখে মিঃ লরী তার খাবার আলাদা জায়গায় দিতে বললেন। নির্জনে বসে চিন্তা করতে চান তিনি। এই যে তরুণীটি আসছেন, কী ভাবে এঁর সঙ্গে আলাপ করবেন তিনি, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না এখনও। কিন্তু বুঝে পড়ে ঠিক হয়ে থাকা দরকার; তা নইলে বিপদ হবে দু’জনেরই; তাঁরও, তরুণীরও! নিজের মনকে তিনি আরও সময় দিতে চান তৈরি হওয়ার জন্য।

খাওয়া শেষ হবার আগেই সদরে একখানা ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শোনা গেল। দু’মিনিট পরেই একজন খানসামা এসে মিঃ লরীকে জানালো যে, একজন তরুণী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।

খানসামা আরও বললো যে, যে ঘরখানা মহিলাটির জন্য আগে থেকে বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছিল, সেইখানেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তিনি সেই ঘরেই অপেক্ষা করছেন। মিঃ লরী তখন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে সেইদিকে চললেন। ঘরের ভিতর আলো অতি কম, সহসা তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না, কিন্তু একটি মিষ্টি কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পেলেন; কে যেন তাকে আসন গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ করে উঠলো। মিঃ লরী এইবার ঠাহর করে দেখলেন–সামনেই একটি তরুণী আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, টুপি হাতে করে। মেয়েটির বয়স বছর সতের। ছিপছিপে লম্বা চেহারা, বেশ সুন্দরী। মাথায় একরাশ সোনালী চুল।

মিঃ লরী নমস্কার করলেন। অপরিচিত বৃদ্ধ ভদ্রলোকের যেরকম নমস্কার করা উচিত এক তরুণীকে, সেই ভাবেরই এ নমস্কার। কারণ, পরিচয় যেটুকু হয়েছিল একদিন, তা এ-মেয়েটির মনে থাকবার কথা নয়। পনেরো বছর আগে এই লুসী ম্যানেটকে তিনিই ফরাসীদেশ থেকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন অবশ্য, কিন্তু এই দীর্ঘ পনেরো বছর একে আর দেখবার সুযোগ হয়নি তার। তিনি যখন টেলসন ব্যাঙ্কের লন্ডন-অফিসের খাতাপত্রের তদারকে ব্যস্ত, তখন লুসী ম্যানেটের তদারক করছিলেন পল্লী-অঞ্চলের এক বিদ্যালয়ের পরিচালক। অবশ্য, ব্যাঙ্ক থেকেই যোগানো হয়েছে লুসীর সমস্ত খরচা।

মেয়েটিই কথা বালো প্রথমে। ব্যাঙ্ক থেকে কাল একখানা চিঠি পেয়েছি, আমার বাবার টাকাকড়ি বিষয়-আশয়ের সম্বন্ধে। শুধু টাকাকড়িই নয়, বাবার নিজের কথাও কিছু আছে চিঠিতে। এতদিন পরে এ-রকম চিঠি এল–এতে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি। বাবাকে আমি চোখেও দেখিনি । শুনেছি যে আমার জন্মের কয়েকমাস আগেই–

মিঃ লরী নীরবে শুনে যান মেয়েটির কথা।

মেয়েটি বলে চলে–ব্যাঙ্কের চিঠিতে আমাকে বলা হয়েছে–এই হোটেলে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আপনি আমায় নিয়ে যাবেন প্যারী-নগরে…আমার। পিতার সেই বিষয়-আশয়ের সম্বন্ধে যেমন দরকার হবে, তেমনি ব্যবস্থা করবার জন্য।

মিঃ লরী বললেন–হ্যাঁ, সেই রকমই কথা আছে বটে!

মেয়েটির কথা তখনও শেষ হয়নি! সে বললো–চিঠিতে এ-কথাও লেখা ছিল–এ ব্যাপার সম্বন্ধে সব-কিছু আপনার কাছেই জানতে পাবো আমি।

মিঃ লরী কিভাবে তার কথাটা শুরু করবেন, তা ভেবে ঠিক করবার আগেই মেয়েটি আবার প্রশ্ন করলো–আচ্ছা, আপনি কি একেবারেই অপরিচিত আমার?

এ প্রশ্নের সোজা উত্তর না দিয়ে মিঃ লরী পাল্টা প্রশ্ন করলেন–অপরিচিত নই কি?

দারুণ দোনা-মনায় পড়লে মানুষের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। মেয়েটির কপালেও দেখা দিল সেই রেখা। খুবই চিন্তিত ভাবে সে ধীরে-ধীরে বসে পড়লো চেয়ারে। এতক্ষণ সে দাঁড়িয়েই ছিল।

আগের কথা একেবারেই চাপা দিলেন মিঃ লরী। এই যেন নূতন পরিচয় হচ্ছে তাদের, সেই ভাবে বলতে শুরু করলেন, কুমারী ম্যানেট! আমি ব্যবসায়ী লোক।’ ব্যবসার কথাই আপনার সঙ্গে বলতে এসেছি। ব্যবসার ব্যাপারেই আমাদের এক মক্কেলের জীবনের কোন কোন ঘটনার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছি আমরা, সে সব কথাই বলতে চাই আপনাকে।

–মক্কেলের কথা!

–হ্যাঁ, মক্কেলের কথা। যারা আমাদের ব্যাঙ্কের সঙ্গে লেনদেন করেন, তাদেরই আমরা বলি মক্কেল। ভদ্রলোক ছিলেন ফরাসী বৈজ্ঞানিক, উঁচুদরের পণ্ডিত চিকিৎসক।

–তাঁর বাড়ি কি বোভেয়াতে?

-হ্যাঁ, আপনার পিতা মঁসিয়ে ম্যানেটের মত, এ ভদ্রলোকও ছিলেন বোভেয়াবাসী। মঁসিয়ে ম্যানেটের মত, এঁর খ্যাতি ছিল দেশে। প্যারীতে তার সঙ্গে আলাপ হয় আমার। বৈষয়িক লেনদেন নিয়েই আলাপ অবশ্য, তবে একটু গোপনীয় ব্যাপার ছিল এর ভিতর। আমি তখন আমাদের প্যারীর অফিসে। সে আজ কুড়ি বছর আগের কথা।

-কি বললেন? কুড়ি বছর আগের কথা?

–হ্যাঁ, কুড়ি বছর আগের কথা। তিনি বিবাহ করেন একটি ইংরেজ-মহিলাকে। তার সম্পত্তির ভার ছিল আমার উপর। ও-রকম অনেক ফরাসী-ভদ্রলোকেরই সম্পত্তির ভার আমায় নিতে হয়েছিল তখন ব্যাঙ্কের তরফ থেকে।–নিছক ব্যবসায়ের দিক দিয়েই সম্পর্ক, ওতে বন্ধুত্ব নেই, দরদ তো নেই-ই। সারাদিন ব্যাঙ্কে বসে মক্কেলের পর মক্কেলের হিসাব যেমন পরীক্ষা করি, ঠিকই তেমনই, মক্কেলের পর মক্কেলের বৈষয়িক সুবিধা কিসে হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখি আমি। ও আমার কর্তব্য। কর্তব্য করে যাওয়ার একটা কল আমি, আর কিছু নই। হ্যাঁ, যা বলছিলাম! সেই বোভেয়াবাসী ভদ্রলোক মারা গেলেন। যদি না যেতেন–ওকি! চমকে উঠছেন কেন?

লুসী সত্যিই চমকে উঠে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মিঃ লরীর হাত, নিজের দু’হাত দিয়ে। মিঃ লরী বুঝতে পারলেন, লুসীর মনে ভয় হয়েছে, যদিও কিসের ভয় তা সে জানে না। তাই তাকে সাহস দেবার জন্যে বাপ যেমন মেয়ের হাত ধরে তেমনি ভাবে তার হাত চেপে ধরে শান্তভাবেই বলতে থাকেন–

–হ্যাঁ, যা বলছিলাম! ঐ ভদ্রলোক যদি মারা না যেতেন! মিস্ ম্যানেট, আপনি মনে মনে একটা ধারণা গড়ে তুলবার চেষ্টা করুন। ধারণা করুন যে ভদ্রলোকটি মারা যাননি, মারা যাওয়ার বদলে তিনি হঠাৎ হারিয়ে গেছেন, অসাধারণ শক্তিমান কোন শত্রু তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে অতি গোপন জায়গায় এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছে যে তার কোন খোঁজ তার আত্মীয়-বন্ধুরা শত চেষ্টাতেও পাচ্ছে না! ধারণা করতে পারছেন? তাহলে এখন বুঝে দেখুন যে সেই অভাগা ভদ্রলোকটির কী অবস্থা!

এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন লরী, বোধ হয় মিস্ ম্যানেটকে তৈরি হবার সময় দেওয়ার জন্য। তারপর আগের চেয়ে নিচু গলায় বললেন–ঐ বোভেয়াবাসী ডাক্তারটির যে অবস্থা আপনি ধারণা করতে পেরেছেন, ঠিক সেই অবস্থাই ঘটেছিল ডাক্তার ম্যানেটের, আপনার শিত।

লুসী ম্যানেট তাকিয়ে আছে। তার চোখের চাউনিতে ভয় আর সংশয় মাখামাখি। সে-অসহায় দৃষ্টি দেখে দুঃখ হল মিঃ লরীর। কিন্তু দুঃখ পেয়ে কথা চেপে গেলে তো চলবে না। তিনি আবার বলতে লাগলেন–হ্যাঁ, এ-রকম ব্যাপার ঘটে ফরাসীদেশে…প্রচুরই ঘটে! ফ্রান্সের যাঁরা ধনী মানী প্রবল জমিদার–তারা ইচ্ছে। করলেই, যে-কোন ব্যক্তিকে ব্যাস্টিল কারাগারে আবদ্ধ করতে পারতেন, যা এখনও পারেন–সারা জীবনের মত। এক-রকম সরকারী ফর্ম, ছাপানো কাগজ আছে। সেই ফর্ম পূরণ করে দিলেই হল। যার নাম লিখে দেওয়া হবে, সে অন্তর্ধান করবে সঙ্গে সঙ্গে। তার স্ত্রী-কন্যা গিয়ে রাজা-রানীর পায়ে নিজের কলিজা ছিঁড়ে উপড়ে দিলেও কিছু হবে না। আর আত্মীয়-স্বজনেরা সংবাদটি পর্যন্ত পাবে না যে, সে অভাগা বেঁচে আছে না মরে গেছে। এ-রকম ঘটনা ঘটে থাকে ফরাসীদেশে। যে ভাগ্যহীন বোভেয়াবাসী ডাক্তারের কথা আমি বলছিলাম আপনাকে, তার স্ত্রীর ভাগ্যে এমনি ঘটনাই ঘটেছিল। যদিও তার সাহস ছিল অসীম, ধৈর্যের তুলনা ছিল না। তা হলেও স্বামীর এ রকম অদ্ভুত ভাবে হারিয়ে যাওয়ার ব্যথা তিনি বেশিদিন সহ্য করতে পারলেন না। একটি সন্তানের জননী তিনি। সন্তানটি যখন জন্মগ্রহণ করল, তখন তার স্বামী অন্তর্ধান করেছেন…

বাধা দিয়ে নিচু গলায় লুসী বললো–সন্তানটি, বোধ হয় মেয়ে?

মিঃ লরী উত্তর করলেন–হ্যাঁ, মেয়েই বটে। মেয়েটি দু’বছরের হতে-না-হতেই তার মাকেও সে হারালো। বুদ্ধিমতী জননী একটি কৌশল করে গিয়েছিলেন মরবার আগে। মেয়েকে জানিয়েছিলেন যে তার বাবা মৃত।

লুসীর সারা দেহ থেকে-থেকে কেঁপে উঠতে লাগলো। মিঃ লরী বললেন–স্বামী বেঁচে আছেন, অথচ তার কাছে যাবার উপায় নেই, তার সংবাদ নেবার উপায় নেই, এমনকি, কোথায় কতদূরে কীভাবে যে তাকে আটক করে রেখেছে দুশমনেরা, তা জানবারও কোন উপায় নেই!–এ-রকম অসহায় অবস্থায় পড়লে মানুষের মনে কি যে নিদারুণ যাতনা হয়, তা তিনি সেই দু’বছরে ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। মেয়েও যাতে বাপের জন্য ঐ-রকম যাতনা ভোগ করতে বাধ্য না হয়, তাই এ কৌশল তিনি করেছিলেন। কন্যা যাতে কোনদিন জানতে না পারে যে, তার পিতা জীবিত-ওকি! আপনি হাঁটু গেড়ে বসছেন কেন?

–আমায় দয়া করুন! সত্যি কথা বলুন আমায়! নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছি আপনার কাছে–আপনি আমায় সত্য কথা বলুন–সকাতরে বলে উঠলো লুসী।

এ অবস্থায় কি যে করা যায়–বুঝতে না পেরে মিঃ লরী বললেন–বিপদে ফেললেন আপনি! আপনার অবস্থা দেখে আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথা গুলিয়ে গেলে কথা কইবো কি করে?…নয় পেন্সকে নয় গুণ করলে কত হয় বলুন তো চট করে? কুড়ি গিনিতে কত শিলিং হয়, হিসাব করে বলুন তো? এঃ!–আপনি গুলিয়ে দিলেন সব!

বলতে-বলতে মিঃ লরী লুসীকে তুলে সযত্নে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। লুসীর অস্থিরভাবটা ধীরে-ধীরে কমে আসতে লাগলো। মিঃ লরীও মাথা ঠিক করে নিজের গল্প শুরু করলেন আবার।

–শুনুন তাহলে, কুমারী ম্যানেট। আপনার মা ঠিক এই ব্যবস্থাই করেছিলেন আপনার সম্বন্ধে। তারপর তিনি স্বর্গে গেলেন। ভগ্নহৃদয়ে মারা গেলেন বলেই আমার বিশ্বাস। আপনার পিতার জন্য সন্ধানের তার বিরাম ছিল না–জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। যাই হোক, তিনি মারা গেলেন। আপনি বড় হয়ে উঠলেন দিনে-দিনে…সুন্দরী, লাবণ্যময়ী, সুখী। আপনার পিতা বেঁচে আছেন, বেঁচেও মরার সামিল হয়েই আছেন, এ-কথা আপনি জানতে পারেননি কোনদিন। তা যদি পারতেন, তা হলে আপনার মায়ের মত আপনারও জীবন কাটত সংশয় আর যাতনার মাঝে। সে-যাতনার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন আপনি এতদিন–মায়ের আশীর্বাদে।

লুসীর সোনালী চুলের দিকে নতনেত্রে তাকিয়ে ছিলেন মিঃ লরী। তার চোখের চাহনির ভিতর দিয়ে গভীর স্নেহ ঝরে পড়ছিল যেন। হঠাৎ তার মনে হল–পিতার দুর্ভাগ্যের কথা গোড়া থেকে জানতে পারলে এই সতেরো বছরের মেয়েরই চুল হয়তো আজ সাদা হয়ে যেতো, যাতনার আগুনে পুড়ে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মিঃ লরী বললেন–না, সম্পত্তির কোন কথা নয়, ও-সম্বন্ধে নতুন কোন খবর নেই। কিন্তু…

তাঁর একখানা হাত লুসীর হাতের ভিতরে বন্দী রয়েছে বহুক্ষণ, তার উপর যেন বড় বেশি চাপ পড়তে লাগলো এইবার। ওদিকে লুসীর দুই ভ্রর মাঝখানের যে চিন্তারেখা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন তা যেন স্থায়ী আসন গেড়ে বসেই রইলো সেখানে। শুধু সেই রেখাঁটির দিকে তাকিয়েই মিঃ লরী বুঝতে পারলেন–কী ভয়ানক বেদনা আর বিভীষিকায় ভরে গেছে কোমলা কুমারীর অন্তর। লুসীর চেতনাই যেন আধা আধি লোপ পেয়েছে; মিঃ লরীর কথাগুলো সে শুনছে বটে, কিন্তু তার কোন অর্থ সে বুঝতে পারছে না।

মিঃ লরী বললেন–হাঁ, পাওয়া গেছে…তাকে পাওয়া গেছে…বেঁচে আছেন তিনি। খুবই বদলেছেন–অবশ্য। শরীর-মন একেবারেই ভেঙে গেছে বলে মনে হয়। অবশ্য, আশা করছি তিনি হয়তো ভালোই আছেন। অন্তত বেঁচে যে আছেন, এটাও তো কম কথা নয়! ব্যাস্টিল থেকে বেরুবার পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, তারই এক পুরাতন কর্মচারীর বাড়িতে। আমরা সেখানেই যাবো এখন। আমি যাচ্ছি–দেখি তাকে চিনতে পারি কি না, অর্থাৎ ইনিই সত্যি সত্যি আপনার পিতা কি না, সেটা সনাক্ত করবার ভার আমার। আর, আপনার ভার–আপনার স্নেহে ও সেবায় ওঁকে আবার বাঁচিয়ে ভোলা, জীবনের আনন্দ আর আশা ওঁকে আবার ফিরিয়ে দেওয়া…

সারা দেহে একটা শিহরন খেলে গেল লুসীর। সে যেন স্বপ্নের ঘোরেই বলে উঠলো–বাবা! আমার বাবা বেঁচে আছেন। তাকে আমি দেখতে পাবো?

সে-কথার উত্তর না দিয়ে মিঃ লরী বললেন–আর একটা জিনিস মনে রাখা দরকার কুমারী ম্যানেট! প্যারীতে রাজার যে কারাগার আছে ব্যাস্টিল,–নামে এ টেস্ অব টু সিটী কারাগার মাত্র হলেও সবদিক দিয়ে একটা দুর্গের মতই যা মজবুত–সেইখানেই আপনার পিতাকে আটক রেখেছিল শত্রুরা। কে সে শত্ৰু, কেন সে আটক রেখেছিল তাকে–এ-সব বিষয়ে সন্ধান নিতে যাওয়া বিপজ্জনক হবে এখন। আমাদের কাজ হবে—ওঁকে যত শীঘ্র সম্ভব ফ্রান্স থেকে সরিয়ে আনা। দেখুন, আমি ইংরেজ। ইংলক্সে রাজার প্রজা আমি, তার উপর টেলসন ব্যাঙ্কের পদস্থ কর্মচারী হিসেবে ফরাসীদেশে আমার কিছুটা সম্মানও আছে, কিন্তু ব্যাস্টিলের কথা মুখে উচ্চারণ করতে ভয় পাই আমি।–কিন্তু! একি! মিস ম্যানেট।…লুসী।

লুসী স্থির হয়েই বসেছিল–কিন্তু মিঃ লরীর কথা শুনতে-শুনতে কখন চেতনা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল ভাগ্যহীনা বালিকার। চক্ষু দুটি বিস্ফারিত হয়ে শরীর মুখের দিকে তাকিয়েই আছে, দুই জ্বর মাঝখানটা তখনো আগের মতই কুঁচকে রয়েছে। সবই আগের মত আছে, নেই কেবল জ্ঞান। এমন শক্ত করে লুসী মিঃ লরীর হাত দু’খানা ধরেছিল যে, তার নড়বার উপায় ছিল না। নড়লেই লুসী মাটিতে পড়ে যাবে। সুতরাং সেইভাবে বসে বসেই মিঃ লরী হোটেলের দাসীদের ডাকতে লাগলেন-সাহায্যের জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *