০৫. ভালো ও মন্দ
শত্রুরা ম্যানেটকে ব্যাস্টিল কারাগারে আটক করবার আগে চিকিৎসক হিসাবে তার খুব নাম ছিল। আঠারো বছর নির্জন কারায় বাস করে তিনি যখন স্বাধীনতা ফিরে পেলেন আবার, তখন তিনি পাগল বললেই হয়। ওঁর অবস্থা দেখে মেয়ে লুসী, বা বন্ধু লরী, কেউই আশা করতে পারেননি যে, এই পাগলের মাথা আবার ঠিক হয়ে আসবে, তিনি আবার আগের মতই ভালো চিকিৎসক হয়ে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে চমৎকার চিকিৎসা করতে পারবেন।
কিন্তু যা আশা করা যায়নি, সেই ব্যাপারও সত্যই ঘটলো। সেই জড়তার আবরণ–ম্যানেটের দেহ-মন যার নিচে একেবারেই চাপা পড়ে গিয়েছিল, ভালোবাসার পরশ পেয়ে ধীরে ধীরে তা সরে যেতে লাগলো, যেন রৌদ্রের তাপে বরফ গলে যাচ্ছে। ম্যানেটের মনুষ্যত্ব লোপ পেয়েছিল একেবারে, তার প্রতিভা পড়েছিল ঘুমিয়ে। লুসী আর লরী–দু’জন দু’ভাবে তাদের জাগিয়ে তুললেন আবার। পাঁচ বৎসরের ভিতর লন্ডন-নগরের বড়লোক-মহলে ডাক্তার ম্যানেট সুবিজ্ঞ চিকিৎসক বলে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। তাঁর জ্ঞানও অসাধারণ, আবার রোগীর জন্য তিনি খাটেনও খুব বেশি; কাজেই তার উপার্জনও হয় প্রচুর।
একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন, চার্লস ডার্নে। লন্ডনে ইনি ফরাসী ভাষা শিক্ষা দেন, ইংরেজ তরুণ-তরুণীদের। এঁরও আয় ভালো। মাঝে মাঝে কেমব্রিজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নিজেও পড়াশুনা করেন।
ম্যানেট-পরিবারের সঙ্গে তিনি এখন খুবই মেলামেশা করেন। সেই মামলার পর থেকেই ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আর একজনও ম্যানেট-পরিবারের বাড়িতে আনাগোনা করে থাকেন–ঐ একই সময় থেকে। ইনি অবশ্য ঘনিষ্ঠ হতে পারেননি, কিন্তু এঁকে দেখলেও বাড়ির লোকেরা খুশি হন, আদর করেই এঁকে গ্রহণ করেন। ইনি সেই মক্কেলশূন্য উকিল সিডনী কার্টন–কোর্টে গিয়ে যিনি তাকিয়ে থাকেন ছাদের দিকে, ডার্নের সঙ্গে যাঁর চেহারার মিল একদা ডানের প্রাণটাই বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
সে-কথা যা। আমরা বলছিলাম–ডার্নে যে দিন ম্যানেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন সেই দিনের কথা। ডাঃ ম্যানেট তখন অধ্যয়ন করছিলেন। ডার্নেকে দেখে বই রেখে দিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–এসো ডার্নে! তিন চারদিন থেকেই ভাবছি তুমি এইবার আসবে, কারণ, কেমব্রিজে একটানা বেশিদিন থাকা তো তোমার অভ্যেস নয়! তুমি বসো! লুসী কী-সব কেনা-কাটা করতে গেছে। আসবে এখনই!
ডাক্তার ম্যানেট! আপনার কন্যা যে এখন বাড়িতে নেই, তা জেনেই আমি এসেছি। তিনি ফিরে আসবার আগেই দু-একটা কথা বলতে চাই আমি আপনাকে।
–কি বলবে, বলো! কীভাবে কথা শুরু করবেন, তা ঠিক করতেই যেন ডানের কিছু সময় কেটে গেল। তারপর তিনি বললেন কিছুদিন থেকে আপনার এখানে যে-রকম ঘনিষ্ঠভাবে মিশবার সুযোগ পেয়েছি আমি, তাতে আমার আশা হয়–যে-বিষয়ে আমি কথা কইবো আজ
ডাক্তার যেন হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিতে চাইলেন ডার্নেকে। তারপর হাত গুটিয়ে এনে ধীরে ধীরে নিচুগলায় বললেন :
–কথাটা কি, লুসী-সম্পর্কে?
–আজ্ঞে, হ্যাঁ।
–বলো!
–কী আমি বলবো, তা বোধ হয় বুঝতে পারছেন আপনি। আপনার কন্যাকে আমি ভালোবাসি! সারা হৃদয় দিয়ে! নিঃস্বার্থভাবে! ভক্ত যে-ভাবে পূজা করে উপাস্য দেবীকে, সেইরকম পূজা করি আমি তাকে! এই কথাই বলতে এসেছি আমি আপনাকে।
ডাক্তার বসে রইলেন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে, মাথা নিচু করে। লুসীকে বিয়ে দিয়ে পর করে দেবেন, এ কথা ভাবতেই তার কষ্ট হয়। লুসী ছাড়া জগতে তার কে আছে আর? লুসীই তাকে কবর থেকে তুলে এনেছে। লুসীরই সেবা আর যত্নে তিনি নিজের মনুষ্যত্ব আর প্রতিভা ফিরে পেয়েছেন; সমাজে আবার দশজনের একজন হতে পেরেছেন। লুসীকে হারালে এ-সবই আবার হারিয়ে ফেলা অসম্ভব নয় তার!
বহুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকবার পর ডাক্তার বললেন–তুমি কি লুসীকে বলেছো এ কথা?
–না।
–চিঠিতেও লেখোনি?
–কখনো না।
–বলোনি, বা লেখোনি যে, তা আমি বুঝি! আমি ধন্যবাদ দিই তোমায়। ডার্নে বলতে লাগলেন–ডাক্তার ম্যানেট। আমি জানি, আপনার পক্ষে লুসী এবং লুসীর পক্ষে আপনি কত বেশি প্রয়োজনীয়। শৈশবে লুসী পিতামাতার স্নেহ পাননি, আপনাকে তিনি পেয়েছেন রীতিমত বড় হয়ে। যেন পরলোক থেকে ফিরে পেয়েছেন তিনি আপনাকে। তার অন্তরের স্নেহভক্তি–যা জীবনের প্রথম সতেরোটি বৎসরের ভিতর ফুটে উঠবার কোন পথই পায়নি, তা অকস্মাৎ আপনাকে পেয়ে একান্ত নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো–এক নিশ্বাসে আপনার উপর উজাড় করে দিল ভক্তি, ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, নারীর অন্তরে যত কিছু পবিত্র ভাব থাকে সবই। আবার আপনিও আঠারো বৎসর এমন জায়গায় আটক ছিলেন, যার তুলনা করা যায় শুধু কবরের সঙ্গে। সেখান থেকে ভগবানের দয়ায় বেরুবার পরে ঐ মেয়েকে অবলম্বন করেই ফিরে পেলেন জীবন, স্বাস্থ্য, প্রতিভা, কর্মশক্তি, আশা ও আনন্দ। দেশের বে-আইনী অত্যাচারে, আঠারো বৎসর পূর্বে যে মহীয়সী পত্নীর কাছ থেকে চিরদিনের জন্য আপনাকে দূরে সরে যেতে হয়েছিল, তারই ছায়া যেন আপনি দেখতে পেলেন লুসীর মাঝে! ঐ মেয়েই আপনার জীবনের সম্বল, ওঁকে কেন্দ্র করেই আপনার সংসার, উনিই আপনার চোখের আলো– তা সবই বুঝি আমি। এ অবস্থায় বিয়ে দিয়ে ঐ মেয়েকে পর করে দেওয়া আপনার পক্ষে কতখানি শক্ত, তাও আমি বুঝি! আর বুঝি বলেই, এ বিয়ের প্রস্তাবই আমি উত্থাপন করতাম না, যদি-না এমন একটা উপায় আমি আবিষ্কার করতে সক্ষম হতাম, যাতে আপনাকে দুঃখ পেতে না হয়। আমার প্রস্তাব এই যে, লুসীকে আমি আপনার কাছ থেকে নিয়ে যাবো না, আমিই এসে আপনার কাছে আশ্রয় নেবো লুসীর পাশে! একটি সন্তানের জায়গায় দু’টি হবে আপনার!
এতক্ষণ নীরব নিস্পন্দ থাকবার পর, ডাক্তার এইবার ডার্নের হাতের উপর একটুখানি মৃদু চাপ দিলেন। তারপর, এতক্ষণ পরে তিনি মুখ তুলে চাইলেন একবার। তার মুখ দেখেই ডানে বুঝলেন যে অন্তরে তার লড়াই চলেছে একটা; মেয়ের ভালো কিসে হবে সেই চিন্তা একদিকে, আর নিজের সুখ-সুবিধা কিসে বজায় থাকবে–সেই চিন্তা অন্য দিকে। লড়াইয়ে যে নিজের সুখের চিন্তা পরাজিত হতে বাধ্য, তা আগে থাকতেই বুঝতে পেরেছেন তিনি। বুঝতে পেরে ভয়ও পেয়েছেন; সে-ভয়ের ছায়া তার মুখেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এইবার তিনি ধীরে ধীরে বললেন–ডার্নে, এমন আন্তরিকতার সুর, এতখানি উদারতার পরিচয় তোমার কথার ভিতর দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে বৎস, যে, তোমায় ধন্যবাদ না দিয়ে আমি পারি না। লুসী তোমায় ভালোবাসে বলে কি তোমার মনে হয়?
–এখন পর্যন্ত, কই, সে-রকম কিছু মনে করবার কোন কারণ দেখতে পাইনি আমি।
–আমার অনুমতি পেলে, তুমি কি এখনই লুসীর কাছে কথা তুলতে চাও?
–না, তাও না। কবে যে সাহস করে তাকে এ-কথা বলতে পারবো, তা। আমি জানি না! হয়তো কয়েক সপ্তাহের ভিতরও সে সাহস আমি সঞ্চয় করে উঠতে পারবো না।
–তুমি কি আমার কাছে পরামর্শ চাও?
–যদি দয়া করে দেন—
–কোন প্রতিশ্রুতি চাও আমার কাছে?
–চাই। আর বেশি কিছু নয়, লুসী নিজে যদি কখনো আপনার কাছে পরামর্শের জন্য আসেন এই ব্যাপারটি নিয়ে, তাহলে আপনি আমার বিপক্ষে কিছু বলবেন না, এইটুকু ভিক্ষা আমি চাই আপনার কাছে।
–সে অনুরোধ আমি রক্ষা করবো তোমার! তোমার বিরুদ্ধে আমি কখনো কিছু বলবো না–যদি বুঝি যে লুসীর সুখের জন্য তোমার সঙ্গে তার বিবাহ দেওয়া একান্ত আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি জানি না তোমার প্রকৃত মা, তোমার পারিবারিক ইতিহাস–না, না, এখন সে-সব বলবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ কথা আমি তোমায় বলছি–তোমার নাম বা পারিবারিক ইতিহাস শুনে তোমার উপর যদি আমার দারুণ বিরাগও জন্মে কোনদিন, তাহলে সে বিরাগও আমি দমন করবো লুসীর মুখ চেয়ে। আমার নিজের আপত্তির জন্য লুসীর সুখের পথে বাধা হবো না আমি।
*
পরের দিন।
একা ঘরে বসে সেলাই করছিলেন লুসী ম্যানেট।
ঘরে এসে ঢুকলো সিডনী কার্টন। মক্কেলশূন্য উকিল সিডনী, যার কাজ হলো অন্য উকিলদের কাগজ ঠিক করে দেওয়া, আর কোর্টে গিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকা।
উপার্জন কিছু আছে। অন্য উকিলদের সাহায্য করে বেশকিছু পায় সে। তার বারো-আনা খরচ হয় মদে। সংসারে সে একা। আপনার জন্য কোথাও কেউ নেই। প্রতিভা ছিল, নষ্ট হয়েছে মদে। কর্মশক্তি ছিল, লোপ পেয়েছে মদে। মনুষ্যত্ব ছিল, প্রায় ধ্বংস হয়েছে মদে। প্রায়’ বলছি এইজন্য–মাঝে-মাঝে তার আচরণে নিবন্ত মনুষ্যত্বের ছাই-চাপা পাঁশুটে আলো এখনো এক-আধবার দেখা দেয় বইকি!
সিডনী কার্টন এসে ঘরে ঢুকলো। লুসী অভ্যর্থনা করে বসতে বললেন তাকে। একটু বিব্রত বোধ করলেন বইকি লুসী! সিডনীকে ঠিক সুস্থ মনে হচ্ছিল না। লুসীর মনে হল, হয়তো অতিরিক্ত পান করে এসেছে সে। কিন্তু এ কী?–সিডনীর। মুখে তো এ-রকম বিষণ্ণ ভাব কখনো দেখা যায় না! যা দেখা যায় সর্বদা, সে । হল ছোট-বড় কতকগুলো রেখা–যাদের দিকে তাকালেই লোকের বুঝতে বাকি থাকে না যে সিডনী কার্টন কত বড় উচ্ছঙ্খল, অসংযমী আর চরিত্রহীন পুরুষ। আজকের এ মলিন মনমরা ভাব তো সিডনীর মুখে বড় কেউ দেখেনি কোনদিন।
লুসী প্রশ্ন করলেন–আপনার কি অসুখ করেছে মিস্টার কার্টন?
–না। তবে আমি যে-জীবনযাপন করি, তাতে স্বাস্থ্য তো ভালো থাকবার কথা নয়! দুশ্চরিত্র লোকের মুখে লাবণ্যের আলো দেখবার আশা করবেন না।
–এর চাইতে ভালো জীবনযাপন করায় তো বাধা নেই, মিস্টার কার্টন।
–বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আর উঠবার আশা নেই, এখন ক্রমেই নামছি, নামতে থাকবো!
টেবিলের উপর দুই কনুই রেখে, দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে রইলো সিডনী। অন্তরের আবেগে সারা শরীর কাঁপছিল তার, টেবিলখানাও কাঁপতে লাগলো তার কনুইয়ের ভারে।
সিডনীর এ-রকম কাতরতা কখনো দেখেননি লুসী। তিনিও বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। সিডনী মুখ না তুলেই বলতে লাগলো–আমায় ক্ষমা করতে হবে কুমারী ম্যানেট! একটা কথা বলতে এসেছি। কিন্তু বলতে এসে এখন ভয়ে কাঁপছি, এমন গুরুতর কথা সেটা। আপনি শুনবেন আমার কথাগুলি?
–শুনলে যদি আপনার কোন উপকার হয়, তবে সানন্দে শুনবো।
–এত দয়া আপনার? ভগবান ভালো করুন আপনার!
মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ধীরভাবে বলতে লাগলো সিডনী–ভয় পাবেন না, শুনুন। যা বলবো, তাতে শিউরে উঠবেন না। লোকে বলে না–আহা! ছেলেটা মরে গেল, নইলে খুব বড় হতে পারতো? আমিও সেইরকম। মরে গেছি। তা নইলে বড় হতে পারতাম!
লুসী বললেন–কেন একথা বলছেন? আমার তো মনে হয় এখনো সময় আছে আপনার, ইচ্ছে করলে আপনি এখনো একটা যোগ্য নোক হয়ে উঠতে পারেন।
–আপনার যোগ্য? একবার কথাটা বলুন মুখ দিয়ে, মিস্ ম্যানেট! বিশ্বাস করবার মত কথা না হলেও সে কথাটা আমি সারাজীবন মনে রাখবো…সারা জীবন!
লুসীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল, তিনি কাঁপতে লাগলেন।
সিডনী বলে চললো–এই দেখুন আমাকে। নিজেকে নিজে নষ্ট করেছি, শরীরটাকে করেছি ধ্বংস!…মাতাল। প্রতিভার অপচয় করে-করে অন্তর আজ শূন্য! এই অপদার্থ জীবের ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়া যদি আপনার পক্ষে সম্ভবও হত, তাহলেও আমি খুশি হতাম না তাতে। আমি জানি আমার দ্বারা একটা জিনিসই ঘটতে পারত সে ক্ষেত্রে, আপনাকে কলঙ্কে ডুবিয়ে, অনুতাপে মনস্তাপে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিজের সাথে-সাথে নরকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া আপনাকে! তাছাড়া অন্য কিছু করবার শক্তি ছিল না আমার! কিন্তু সে সব কথা অবান্তর! আমি জানি আমার জন্য কোন করুণা আপনার অন্তরে থাকতে পারে না। পারে না যে–এতে আমি খুশি, মিস্ ম্যানেট!
–সে করুণা না-ই যদি থাকে, তবুও কি আপনার কোন উপকারে আসতে পারি না আমি? মহত্ত্বের পথে কি আবার তুলে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি না আমি আপনাকে? আপনি যে বিশ্বাস করে আপনার হৃদয়ের গোপন ব্যথার কথা আমায় জানিয়েছেন, তার প্রতিদানে আপনার কি কোন উপকারই করতে পারি না আমি?
লুসীর চোখ জলে ভরে এল। তিনি সকাতরে বললেন–আপনার কোন উপকারে কি আসতে পারি না আমি?
সিডনী মাথা নেড়ে বললো–না। কিছু না! তবে আর দু’একটা কথা বলবার আছে। তা যদি শোনেন ধৈর্য ধরে, তাহলেই যথেষ্ট উপকার করা হবে। আমি আপনাকে জানাতে চাই যে, আমার জীবনে এই অল্প কিছুদিন আগে থেকে একটিমাত্র সুখস্বপ্নের উদয় হয়েছিল, সে-স্বপ্ন-আপনি। এই গৃহের সুখ-নীড়ের মাঝখানে আপনাকে দেখবার পর থেকেই প্রত্যহ অন্তত একবার আমার মনে হয়েছে আমার শৈশবের গৃহের কথা–যার কথা তার আগে এতদিন আমার একবারও কখনো মনে হত না। সেখানে এমনি নির্মল আবহাওয়া চিরদিন বিরাজ করত, আমার দেবীর মত মায়ের আশেপাশে। আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার পর থেকেই মাঝে মাঝে মনস্তাপ দেখা দিয়েছে আমার নিঃসাড় প্রাণে-হায়, এ আমি কোথায় নামিয়ে এনেছি আমাকে! আপনার কাছে আসবার পর থেকেই মাঝে-মাঝে শুনতে পেয়েছি কাদের যেন বিস্মৃত কিন্তু পরিচিত কণ্ঠস্বর–ওঠো, এই পাঁকের ভিতর পড়ে থেকো
আর, উঠে চলো আলোর রাজ্যে!–মনে জেগেছে আধ-গড়া সংকল্প-হা, আমি উঠবো, আবার উঠবো, এই আলস্য আর লালসার দাসত্ব ঝেড়ে ফেলে আবার। নতুন করে শুরু করব সেই জীবন-সংগ্রাম–যা থেকে ভীরুর মত পালিয়ে এসে সকলের পেছনে মুখ লুকিয়েছি আমি! কিন্তু সে সংকল্প আধ-গড়াই রয়ে গেছে চিরদিন, পুরোপুরি গড়ে উঠতে আর পারেনি, কুমারী ম্যানেট! শেষ পর্যন্ত সে একটা স্বপ্ন মাত্রই রয়ে গেল…সুখস্বপ্ন! স্বপ্নই বটে, কুমারী ম্যানেট…কিন্তু আমার জীবনে স্বপ্নও আজকাল কদাচিৎ আসে। তাই এর মূল্য আছে আমার কাছে, আর তাই আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ–আমার জীবনে এ স্বপ্নের উদয় আপনার জন্যই সম্ভব হয়েছিল বলে।
লুসী ব্যথিত-কণ্ঠে বলে উঠলেন–স্বপ্ন কি নিছক স্বপ্নই রয়ে যাবে, মিস্টার কার্টন? ওর এক তিলও কি সত্য হয়ে বজায় থাকবে না আপনার জীবনে?
–না, সে আশা নেই। এ হৃদয় ছাইয়ের গাদা, এক কণা আগুনও যদি থাকতো। এতে, তারই আলোতে পথ দেখতে পেতাম হয়তো উপরে উঠবার। কিন্তু এ ছাইয়ের গাদা অন্তত এক লহমার জন্যেও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেছিল আপনাকে দেখে, এ আমি ভুলতে পারবো না। ভুলতে পারবো না, কিন্তু উঠতেও পারবো না আমি। আগুন জ্বলে উঠে আবার তখনই নিবে গেছে, সে স্বর্গীয় আগুনকে জ্বালিয়ে রাখবে, এমন কাঠখড় তো আমার এ ছাইয়ের গাদায় ছিল না! প্রেরণা আপনি দিয়েছিলেন, কিন্তু আমার অন্তরে সৎ বৃত্তি কোথায় যে সে-প্রেরণাতে কাজ হবে?
–আপনার দুঃখকে আরও বাড়িয়ে দিলাম তাহলে আমি! দুর্ভাগ্য আমার! সকাতরে বললেন লুসী।
–না, না, এমন কথা বলবেন না। কেউ যদি আমায় উদ্ধার করতে পারতো তাহলে সে আপনি। কিন্তু উদ্ধার হবার মত শক্তিই নেই আমার, সে আমি হারিয়ে ফেলেছি! দীর্ঘদিনের অনাচারের নিচে সে কোথায় চাপা পড়ে হারিয়ে গেছে। তাকে আজ আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়!
–আপনার কোন উপকারেই কি তাহলে আসতে পারি না আমি?
–আপনি ধৈর্য ধারণ করে, সমবেদনার সঙ্গে এই অপদার্থ জীবের দুঃখের কথা শুনেছেন, এইতেই অপরিসীম উপকার করা হল আমার। বিশ্বাস করুন মিস্ ম্যানেট, এই যে একান্ত নিরিবিলি আপনার কাছে আমার মনের গোপন ব্যথা জানাতে পেরেছি, এ সৌভাগ্যের কথা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি মনে রাখব, চিরদিন এর স্মৃতি আমায় গভীর আনন্দ দেবে।…হ্যাঁ, এ আলাপন আপনি গোপনই রাখবেন তো? আপনার কাছে ঐ আমার একটিমাত্র ভিক্ষা!
-~-অবশ্য।
–আপনার অতি প্রিয় ব্যক্তির…প্রিয়তমের কাছেও কোনদিন প্রকাশ করবেন না তো এ-কথা?
লুসী একটু ইতস্তত করে তারপর বললেন–আপনার গোপন কথা প্রকাশ করবার অধিকার আমার কি আছে? আপনি চিন্তা করবেন না। এ-কথা কেউ জানবে না।
–ধন্যবাদ! ভগবানের আশিস বর্ষিত হোক আপনার উপর।
বিদায় নিয়ে দ্বার পর্যন্ত গিয়ে আবারও ফিরে দাঁড়ালো সিডনী।–আপনার ভয় নেই মিস্ ম্যানেট, এ-প্রসঙ্গের আলোচনা আর কখনো শুনতে পাবেন না আমার মুখে। আজও যে একথা শুনতে পেলেন, সে শুধু আমি একটা প্রলোভন দমন করতে পারিনি বলে। কী প্রলোভন, বলব? আমি সারা জীবন মনে মনে অনুভব করতে চাই যে, আমার গোপন-কথা আমারই অন্তরে শুধু নিবদ্ধ নেই, আমার গোপন-ব্যথা গোপনে বহন করবার জন্য আর-এক অংশীদার আছে আমার। আমার নাম, আমার অকীর্তি, আমার বিফল ভালোবাসার কাহিনী যে আপনার কোমল হৃদয়ের এক কোণে চিরদিনের জন্য একটুখানিও স্থান লাভ করল, এ আমার পরম সৌভাগ্য কুমারী ম্যানেট, এ আমার আশাতীত আনন্দ!
কার্টনের যে মূর্তি এতদিন চোখে পড়েছে লুসীর, তার চেয়ে এতটাই আলাদা, এতখানি উঁচু তার আজকের এই মূর্তি, যে, তাকে বিদায় দেবার কালে একটা সান্ত্বনার কথাও বলবার পথ না পেয়ে লুসী ব্যথিত-হৃদয়ে অশ্রুবর্ষণ করতে লাগলেন। সিডনী দেখলো সে অশ্রু, দেখে বললো-কাঁদবেন না কুমারী ম্যানেট! কার জন্য কাঁদছেন? একটা অপদার্থ! একটা পশু! এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েই যে আবার তার অভ্যস্ত পাঁকের রাজ্যে নেমে যাবে! কার জন্য দুঃখ করছেন আপনি?–তবে হ্যাঁ, যতই নেমে যাই-না কেন, যে-নরকেই বাস করি না আমি, আপনার সেবার সুযোগ যদি কখনো পাই, প্রাণ দিয়েও আমি তা করব–এ-কথা বিশ্বাস করুন কুমারী ম্যানেট! প্রাণ দিয়েও তা করব আমি! আপনি সুখী হোন। আর, সর্বসুখের মাঝে যেন আপনার স্মরণ থাকে যে, আপনার সুখের পথের কাটা দূর করবার জন্য প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত একটা জীব ধরায় আছে, নাম তার–সিডনী কার্টন।