আমি মুজিব বলছি – ৮

সকলের সহযোগিতাই আওয়ামী লীগের কামনা

আগে পশ্চিম পাকিস্তানে দলীয় সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করিয়া পরে ঢাকা আসিয়া আবার আলোচনা শুরু করিবেন এই অজুহাত তুলিয়া পিপ্লস পার্টিই ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তারিত আলোচনা মুলতুবি রাখিয়া যায়। এদিকে আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার ওয়াদার পুনরাবৃত্তির পাশাপাশি দেশকে একটি স্থায়ী শাসনতন্ত্র প্রদানের জন্য সকল মহলের সহযোগিতা কামনা করেন। এই উদ্দেশ্যেই আমরা মারকেজী জমিয়তে ওলেমায়ে ইসলামের মৌলানা নুরানী, নওয়াব আকবর খান বুগতি, মৌলানা গোলাম গাউস হাজারভী ও মৌলানা মুফতি মাহমুদ (জমিয়তে ওলেমায়ে ইসলাম) ও অন্যান্য পশ্চিমাঞ্চলীয় নেতার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হই। একই সঙ্গে আমরা অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের বৈঠক ডাকার জন্য চাপ দিতে থাকি। পরিষদের অধিবেশন ডাকিতে বিলম্ব হইয়াছে এবং শেষ পর্যন্ত ইহা ডাকার আগেই দুইটি মাস অতিক্রম হইয়া গিয়াছে। শেষ পর্যন্ত যখন ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহুত হইয়াছে তখন মূহুর্তের জন্য হইলেও মনে হইয়াছে, যে কুচক্রী শক্তি প্রতিবার গণতান্ত্রিক পন্থায় জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সক্রিয় হইয়া উঠিত তাহাদের উপর যুক্তিবাদী শক্তির বিজয় সূচিত হইয়াছে। এই গণবিরোধী শক্তি ১৯৫৮ সালে পূর্ব-বাংলায় একটি নির্বাচিত সরকারকে বাতিল করিয়াছে, ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করিয়াছে এবং তারপর প্রতিটি গণ আন্দোলন বানচালের অশুভ প্রচেষ্টায় লিপ্ত হইয়াছে।

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহুত হইবার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহই সাক্ষ্য দেয় যে, এই ষড়যন্ত্রকারী শক্তি আরেকবার ছোবল হানার প্রস্তুতি নিতেছে। জনাব ভুট্টো এবং পিপিপি আকস্মিকভাবে এমন সব ভাবভঙ্গি ও কথাবার্তা চালাইতেছেন যার উদ্দেশ্য মনে হয় জাতীয় পরিষদের স্বাভাবিক কর্মধারা বিঘ্নিত করিয়া শাসনতান্ত্রিক ধারাকে বানচাল করা। আর এইভাবেই তাহারা জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রতিহত করিতে চান।

পিপল্স পাটির সেক্রেটারী জেনারেল জনাব জে এ রহিম এক বিবৃতিতে বলিয়াছিলেনঃ “আমরা দেখিয়াছি পূর্ব-পাকিস্তান যে আসলেই একটি কলোনী ইহা অতৃপ্ত মানসিকতার কথা নয়–কঠিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তব।” [আউটলাইন অব এ ফেডারেল কনষ্টিটিউশন ফর্ পাকিস্তান–জে এ রহিম, পৃষ্ঠা ৭১] কিন্তু তা সত্ত্বেও ৬ দফার বিরুদ্ধে উত্থাপিত কতিপয় মৌলিক আপত্তি সাবধানতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করিলেই দেখা যাইবে যে, ইহা বাংলাদেশকে কলোনী হিসাবেই বজায় রাখার সুপরিকল্পিত কার্যক্রম ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রধানত কেন্দ্র কর্তৃক বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক সাহায্য ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই দেশের অপরাংশের কায়েমী স্বার্থবাদীদের তরক্কির জন্য বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের উপর ঔপনিবেশিক শোষণ চলিয়াছে, বাংলার সম্পদ পাচার করা হইয়াছে। এইভাবেই প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশী পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদীদের কল্যাণে ব্যয়িত হইয়াছে। গত ২৩ বছরের মোট আমদানীর দুই-তৃতীয়াংশ আসিয়াছে পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ৫ শত কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ করা হইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় মুনাফাশিকারী শিল্পপতির স্বার্থে বাংলাদেশকে সাত কোটি লোকের ‘সংরক্ষিত বাজার’ হিসাবে ব্যবহার করা হইয়াছে। আর এই নির্মম শোষণের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনিবার্য বিপর্যয়ের দ্বারপান্তে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। দিকে দিকে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া, অর্থ নাই সংগতি নাই। বাংলাদেশের মানুষ আজ ভয়াবহ আকালের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে। যা কিছুই ঘটুক না কেন আমরা আর এ অবস্থা চলিতে দিতে পারি না।

বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য কেন্দ্রের হাতে না থাকিলে এহেন নির্মম শোষণ চলিতে পারিত না। এই পটভূমিতে কেন্দ্রের হাতে বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য বহাল রাখার জেদ নগ্নভাবে এই সত্যই প্রকট করিয়া তোলে যে, ইহার উদ্দেশ্য জাতীয় সংহতি অর্জন নয়, বরং বাংলা দেশের উপর ঔপনিবেশিক শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য প্রধান হাতিয়ারগুলি কেন্দ্রের হাতে রাখা।

পিপ্‌স্ পার্টির অন্য একটি উক্তিতে এই সত্যের যথার্থতা প্রমাণিত হয়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পরিষদ গঠনের দাবীর সমর্থনে খাঁটি ফেডারেশনের (উহার অর্থ যাহাই হউক না কেন, কারণ কোন দুইটি ফেডারেশনই যখন একে অন্যের সহিত সাদৃশ্যপূর্ণ নহে) নীতি গ্রহণের প্রস্তাব করা হইয়াছে। যাহার দ্বিতীয় কক্ষে সকল ইউনিটের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকিতে হইবে বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। অপর কথায়, ধরুন, দ্বিতীয় কক্ষের সদস্য সংখ্যা একশত হইলে উহাতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হইবেন মাত্র ২০ জন। এইভাবে বৃহত্তর জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বহীন সংখ্যালঘু ইউনিটে পরিণত করার প্রস্তাব দেওয়া হইয়াছে। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ইতিপূর্বে কখনও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব শতকরা ২০ ভাগে হ্রাস করার প্রস্তাব উত্থাপন করিতে সাহস পায় নাই। কিন্তু সংখ্যাসাম্যের জিগির তুলিয়া নিজেরা আত্মতুষ্টি লাভ করিয়াছে। দ্বিতীয় কক্ষে সংখ্যা সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের বর্তমান প্রস্তাব গৃহীত হইলে বাংলাদেশ অন্য পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব থাকা সত্ত্বেও অসহায় সংখ্যালঘু ইউনিটে পরিণত হইবে। এই পদ্ধতিতে অপর অঞ্চলের সংখ্যালঘুরা কেন্দ্রের উপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখিবে। এভাবে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হইলে যে সরকার বৈদেশিক সাহায্য ও বাণিজ্যের ক্ষমতাবলে ঔপনিবেশিক শোষণের পুরাতন পদ্ধতি স্বচ্ছন্দে চিরস্থায়ীভাবে কায়েম করিবে। এইসব প্রস্তাব কেন্দ্রীয় আমলাদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃষ্ট প্রমাণ বহণ করিতেছে। তাহারা এভাবে তাহাদের প্রভূ পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীদের মনোরঞ্জন অব্যাহত রাখিতে পারিবে–গত ২৩ বৎসর যাবতই তাহারা বিশ্বস্ততার সহিত তাহাদের ঐসব প্রভুর সেবা করিয়া আসিতেছে।

সেইজন্য সমান প্রাতনিধিত্বের ভিত্তিতে একটি কার্যকরী দ্বিতীয় কক্ষ গঠনের প্রস্তাব অন্তত পাকিস্তানের আদর্শে খাঁটি ফেডারেশনের জন্য মোটেই কার্যকরী নমুনা নহে, বরং উহা বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শোষণ চিরস্থায়ী করার অশুভ পাঁয়তারা মাত্র।

৬ দফা কর্মসূচির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অন্যান্য আপত্তি চিরাচরিতভাবে বিকৃত তথ্য পরিবেশনেরই সামিল এবং বাংলাদেশের মানুষ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতিত জনগণের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করাই উহার মূল উদ্দেশ্য। ৬ দফা কর্মসূচিতে ফেডারেশন সরকারকে ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কৃপার উপর নির্ভরশীল হইতে হইবে বলিয়া যে পরোক্ষ ইঙ্গিত করা হইয়াছে আসলে তাহা নহে। বরং উহাতে ফেডারেল সরকার কর্তৃক সাক্ষাৎ শাসনতান্ত্রিক বিধানমতে পর্যাপ্তভাবে রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা বিলি-বণ্টনের স্পষ্ট বিধান রহিয়াছে। যাহার ফলে ফেডারেল আইন পরিষদ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যর উপর ফেডারেল কর আরোপের ক্ষমতা লাভ করিবে।

ফেডারেশনের বিভিন্ন ইউনিটের সম্পদ হইতে প্রথম ব্যয় বরাদ্দ বাবদ উক্ত কর আদায় করা যাইবে।

অনুরূপভাবে বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের উপর ছাড়িয়া দিলে ফেডারেল সরকারের পক্ষে বৈদেশিক নীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে অলঙ্ঘনীয় অসুবিধা দেখা দিবে বলিয়া যে আপত্তি তোলা হইয়াছে, তাহাও ঠিক নহে। কারণ যুগে যুগে একথা পুনরনুমোদিত হইয়াছে যে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্যের ক্ষেত্রে যে ক্ষমতার অধিকারী হইবে তা দেশের বৈদেশিক নীতির কাঠামোর মধ্যে ব্যবহার করা হইবে।

বাংলাদেশের লোক ও পশ্চিমাঞ্চলের নির্যাতিত জনগণের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টির যে প্রচেষ্টা চালানো হইতেছে তাহা চরম অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছিয়াছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় বাঙালীদের প্রকৃত ‘শত্রু’ বলিয়া চিত্রায়িত করা হইয়াছে, যাহাদের নিকট গেলে পশ্চিম পাকিস্তানী প্রতিনিধিরা নাকি ‘হোস্টেজ’ হিসাবে আটকা পড়িয়া যাইবে। জাতীয় পরিষদকে ‘কসাইখানা’ আখ্যা দিয়া পরিষদের বাঙালী সদস্যদের প্রতি অযাচিত মন্তব্য করা হইয়াছে।

এই সব বাজে অভিযোগ উত্থাপনের একমাত্র কারণ এই যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহ্বান করা হইয়াছে। দেশের সকল প্রধান কেন্দ্রীয় সংস্থা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত বলিয়া বাঙালীরা যখন বিগত ২৩ বৎসর সকল সময়ই তথায় যাতায়াত করিতেছে, বিশেষত সেক্ষেত্রে অনুরূপ প্রতিক্রিয়া শুধু অশোভনই নহে বরং অযৌক্তিকও। এভাবে আবহাওয়া বিষাক্ত করিয়া তুলিলে বাঙালীরা কি ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রশ্ন করিতে পারেনা যে, তাহাদিগকে পশ্চিম পাকিস্তানে গমনের জন্য আহ্বান জানানো হইবে কি না? আরও কতিপয় উক্তি এ ব্যাপারে আলোকপাত করিয়াছে যাহার মধ্য হইতে উপরোক্ত মনোভাব টের পাওয়া যায়।

পিপলস পার্টির জনৈক সদস্য গত ২০ শে ফেব্রুয়ারী “পাকিস্তান টাইমস” পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে দাবী করেন যে. . . . জনগণ . . . (অবশ্যই)…… দেশের অখণ্ডতার প্রশ্নে তাহাদের সঠিক মনোভাব ব্যক্ত করিবে এবং মৌলিক ব্যাপারে যে কোন প্রকারের আপোস মীমাংসা প্রত্যাখ্যান করিবে। এবং আসন্ন ও মারাত্মক বিপর্যয়ের হাত হইতে সমগ্ৰ দেশকে রক্ষা করার কোন ক্ষমতা যখন তাহাদের থাকিবে না, তখন অন্তত যেটুকু পারা যায়, দেশের সে অংশটুকু রক্ষার জন্যও চেষ্টা করিবে। সঠিক রাজনৈতিক পন্থা হইতেই যেটুকু পারা যায় সেটুকু রক্ষা করা এবং দেশের অখণ্ডতা ভঙ্গের প্রচেষ্টা বা প্রস্তাব না করা। আমরা অবশ্যই আওয়ামী লীগকে তাহার ৬ দফা হইতে সরিয়া দাঁড়াইতে বলিব এবং তাহারা উহা না করিলে আমরা অবশ্যই যে কোন মূল্যে পশ্চিম পাকিস্তানে ৬ দফা প্রবর্তনের প্রচেষ্টাকে ঠেকাব।”

এখানে দুইটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করা হইয়াছে। উহার একটি হইতেছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। উহাতে অভিযোগ করা হইয়াছে যে, আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের উপর ৬ দফা চাপাইয়া দেওয়ার চেষ্টা করিতেছে। ৬ দফা কর্মসূচি আসলে ফেডারেশনভুক্ত ইউনিটগুলির স্বশাসনের নিরাপত্তাবিধানেরই কর্মসূচি। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ফেডারেশনভুক্ত ইউনিটগুলি একেবারে একই হারে বাংলাদেশের মত স্বায়ত্তশাসন না চায় অথবা যদি তাহারা কেন্দ্রের হাতে কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা ছাড়িয়া দিতে চায় কিংবা কতিপয় আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে আগ্রহী হয় তবে ৬ দফা ফর্মূলা তাদের পক্ষে অন্তরায় হইবে না। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগও কোন সময়েই এমন কোন ভূমিকা গ্রহণ করে নাই যে, ৬ দফা ফেডারেশনভুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইউনিটগুলির উপর চাপাইয়া দেওয়া হইবে। অপর যে বিষয়টি লক্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হইয়াছে তাহা হইতেছে এই যে যদি বাংলাদেশকে অতীতের শর্তের মধ্যে আবদ্ধ না রাখা যায় অথবা দেশের উপর অংশের সংখ্যালঘুদের নির্দেশিত শর্তে ধরিয়া না রাখা যায়, অর্থাৎ যদি উহাকে কলোনী হিসাবে বজায় না রাখা যায় এবং তাহার পরিবর্তে যদি বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রদেশ হিসাবে উহার ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা পালন করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘বাঁচাইতে’ হইবে। কিন্তু প্রশ্ন হইতেছে ‘কাহার নিকট হইতে’ এবং ‘কাহার জন্য’ বাঁচাইতে হইবে? স্পষ্টত নিবন্ধকার ইহাই দেখিতে চান যে পশ্চিম পাকিস্তানকে সেই বাঙালীদেরই হাত হইতে বাঁচানো হইয়াছে যাহারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ওয়াদা পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং তিনি ইহাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেই স্বার্থান্বেষী মহলেরই জন্য বাঁচাইতে চাহেন। যাঁহারা এইরূপ গণতান্ত্রিক পরিবেশে টিকিয়া থাকিবেন না এবং যাঁহাদের পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত অবহেলিত জনগণকে শোষণের অধিকার নিশ্চিত হইবে। এমন কি নিবন্ধকার বাংলাদেশের ব্যাপারে উক্ত স্বার্থান্বেষী মহলের ‘অধিকার’ হারাইতে হইলেও পশ্চিম পাকিস্তানে তাহাদের এই শোষণের অধিকারকে নিশ্চিত করিতে চান বলিয়া মনে হয়। পাকিস্তানের জাগ্রত জনগণের মনে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই থাকা উচিত নয় যে, ষড়যন্ত্রকারী এবং স্বার্থান্বেষী মহল এবং তাহাদের তোষামোদকারীরা নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা প্রণীত একটি শাসনতন্ত্র গ্রহণ ও তাহাদের হস্তেই ক্ষমতা হস্তান্তরকে বানচাল করার শেষ বেপরোয়া অপচেষ্টায় মাতিয়া উঠিয়াছে। তাহাদের এই বেপরোয়া মনোভাব এতই চরম আকার ধারণ করিয়াছে যে তাহারা জাতীয় অখণ্ডতার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার ভান করিয়া পাকিস্তানের অস্তিত্ব লইয়াও জুয়া খেলিতে ইচ্ছুক। তাহারাই পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে একত্রে বাস করার ভিত্তি তৈরীর শেষ সুযোগ বানচাল করিয়া পাকিস্তানের অখণ্ডতার উপর একটি চরম আঘাত হানিতে উদ্যত হইয়াছে।

পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে শাসনতন্ত্র গৃহীত হইবে তাহার লক্ষ্যই হইবে উক্ত মিলনের ভিত্তি রচনা করা। আমরা এখনও এই ফোরামে সার্থক প্রচেষ্টা চালাইতে প্রস্তুত রহিয়াছি এবং ইহাই আমাদের এই দেশকে একটি স্থায়ী শাসনতন্ত্র প্রদানে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য একমাত্র উপযুক্ত ফোরাম। এই দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে আমরা পাকিস্তানে প্রত্যেক অংশের প্রত্যেক জাতীয় পরিষদ সদস্যকে সহযোগিতা করিতে আমন্ত্রণ জানাই।

ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে

পাকিস্তানের নির্যাতিত জনগণ ও বাংলাদেশের জাগ্রত জনতা কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র জনগণের বিজয় বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। যাঁহারা ‘অনভিপ্রেত সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ব ও নির্বাচিতের স্বেচ্ছাচার সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তাঁহাদের প্রতি আমাদের জবাব হইতেছে পাকিস্তানের জনগণ ‘সংখ্যালঘুর একনায়কত্ব’ সহ্য করিবে না এবং এমনকি ক্ষমতার দ্বারা সমর্থনপুষ্ট হইলেও কোন স্বৈরাচারই তাহাদের ভীত করিতে পারিবেনা।

আমরা যে ক্ষমতাকে স্বীকার করি তাহা হইতেছে জনগণের ক্ষমতা। জনগণ সকল স্বৈরাচারীকেই নতি স্বীকার করিতে বাধ্য করিয়াছে; কারণ স্বৈরাচারীর ক্ষমতার দণ্ড জাগ্রত জনগণের সংঙ্কল্পের আঘাতের কাছে টিকিয়া থাকিতে পারে না।

যে কোন ভবিষ্যৎ স্বৈরাচারীর ইতিহাস হইতে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। আমরা ষড়যন্ত্রের অশুভ শক্তির প্রতি কোনপ্রকার বিবেকবর্জিত পাঁয়তারা না করার অথবা ১২ কোটি মানুষের ভাগ্য লইয়া খেলা না করার জন্য সতর্কবাণী উচ্চারণ করিতেছি। যদি কেহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাপ্রদান বা বানচাল করার চেষ্টা করে তবে বাংলাদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে জাগ্রত জনগণের পবিত্র দায়িত্ব হইবে তাহা প্রতিরোধ করা। আমি বাংলাদেশের জাগ্রত জনগণকে আমাদের মাটি হইতে গণবিরোধী শক্তিকে যে কোন উপায়ে নির্মূল করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানাইব।

আমরা আজ প্রয়োজন হইলে জীবন বিসর্জন দিব–যাহাতে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের একটি কলোনীতে বাস করিতে না হয়, যাহাতে তাহারা স্বধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে সন্মানের সহিত মুক্ত জীবন যাপন করিতে পারে, সেই প্রচেষ্টাই আমরা চালাইব।

এইদিন ২৪শে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁহার মতে ‘পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন কিনা’ প্ৰশ্ন করা হইলে আওয়ামী লীগ-প্রধান বিরক্তির সঙ্গে বলিলেন, এসব কথা শুনিতে শুনিতে আমরা ক্লান্ত। যখনই বাংলার মানুষ তাহাদের ন্যয্য দাবী-দাওয়া উত্থাপন করিয়াছে, তখনই শোষককুল ইসলাম ও সংহতি বিপন্নের ধুয়া তুলিয়াছে। ১৯৫২ সলের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী বিজয় বানচাল এবং ১৯৫৮ সালের সাধারণ নির্বাচন ঠেকাইয়া সামরিক আইন জারী–বিভিন্ন সময় বারবার এইসব বাজে ধুয়া তোলা হইয়াছে। তিনি বলেন, আমরা এসব ভুয়া সংহতিবাজের চাইতে অনেক বেশী ভালো পাকিস্তানী। এইসব ন্যুইসেনস আমরা আর সহ্য করিতে রাজী নই। তিনি বলেন, বাংলার উপকূলে মহাপ্রলয়ে যখন ১০ লক্ষ লোক প্ৰাণ হারাইয়াছে, লক্ষ লক্ষ লোক অন্তহীন দুর্দশার মধ্যে, তখন এই সব সংহতিবাজের অনেকেই বাংলায় আসিয়া তাহাদের দেখিতে পারেন নাই। জাতীয় নেতা হইয়াও তিনি কেন পশ্চিম পাকিস্তান সফর করিতেছেন না প্রশ্ন করা হইলে শেখ সাহেব বলেন, নির্বাচনের আগে আমি পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গিয়াছি, আমার দল বিভিন্ন প্রদেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়াছে। অথচ যারা আজ সংহতির ডঙ্কা বাজাইতেছে তাদের অনেকেরই বাংলাদেশে কোন অফিস নাই–দুর্দিনে তারা এখানে আসে না। শেখ সাহেব বলেন, জাতীয় সংহতি এখনও বিপন্ন হয় নাই। তবে কেহ যদি তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তার জন্য আমাদের কোন দায়-দায়িত্ব নাই।

সেদিন ১৯শে মার্চ। দৈনিক ইত্তেফাক কাগজে প্রথম পৃষ্ঠায় আট কলাম হেডিং-এ লেখা হলঃ আমি শেখ মুজিব বলছি, এ গণ-বিষ্ফোরণ মেসিনগানেও স্তব্ধ করা যাইবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের ধানমণ্ডির বাসভবন এখন মুক্তিকামী জনতার তীর্থক্ষেত্র। ১৮ই মার্চ বৃহস্পতিবার বিদেশী সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বললেন, বিদেশী বন্ধুরা, দেখুন আমার দেশের মানুষ আজ প্রতিজ্ঞা ও সংগ্রামের দৃঢ়তায় উজ্জীবিত। কার সাধ্য ইহাদের রোখে? আমার দেশ জাগিয়াছে। জনগণ জাগিয়াছে। তাহারা জীবন দিতে শিখিয়াছে। স্বাধীনতার জন্য জীবন দানের অগ্নিশপথে দীপ্ত জাগ্রত জনতার এ জীবন জোয়ারকে, প্রচণ্ড এ গণ-বিস্ফোরণকে স্তব্ধ করে দিতে পারে এমন শক্তি মেসিনগানেরও আজ আর নেই। [২৫শে ফেব্রুয়ারী ইত্তেফাক থেকে]

সেই মেসিনগানই নেমে এলো জাগ্ৰত জনমতকে স্তব্ধ করতে, স্বাধিকার দাবীতে সোচ্চার জনমতকে স্তব্ধ করতে। সেই মেসিনগান গুঁড়িয়ে দিল শহর, নগর, গ্রাম, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মন্দির, মসজিদ, গীর্জা সব। কিন্তু গণ-বিস্ফোরণ স্তব্ধ করা গেল না মেসিনগানে। সে ইতিহাস লিখবেন ভাবীকালের ঐতিহাসিকেরা। এখন শুধু মেসিনগানের গুলীতে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা ঘটল তার অতি সামান্য বিবরণ তুলে ধরছি। এই বিবরণ অতি সামান্য। প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে এই বিবরণের দ্বারা কোন পরিমাপ সম্ভব নয়।

“টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলো
আমার সূর্যের মত হৃৎপিণ্ড যেমন কোনো
পেশওয়ারী ফলওয়ালা তার ধারালো
ছুরির হিংস্রতায় ফালি ফালি করে কেটে
ফেলে তারা,
লাল টকটকে একটি আপেল।
কিন্তু শোনো, এক ফোঁটা রক্তও যেন
পড়ে না মাটিতে, কেননা, আমার
 রক্তের কণায় কণায় উজ্জ্বল স্রোতের
মত বয়ে চলেছে মনসুরের বিদ্রোহী
রক্তের অভিজ্ঞান। তোমরা কুটি কুটি
করে ছিঁড়ে ফেলো আমার হৃৎপিণ্ড,
যে হৃৎপিণ্ডে ঘন ঘন স্পন্দিত হয়
আমার দেশের গাঢ় ভালবাসা,
যে হৃদয়–
মায়ের পবিত্র আশীর্বাদের মতো,
বোনের স্নিগ্ধ প্রশান্ত দৃষ্টির মতো,
প্রিয়ার হৃদয়ের শব্দহীন গানের মতো,
শান্তির জ্যোৎস্না চেয়েছিল
পৃথিবীর আকাশের নীচে,
চৈত্রের তীব্রতায় শ্রাবণের পূর্ণিমায়। –

—শামসুর রাহমান

হৃদয়কে টুকরো টুকরো করে কাটার ইতিহাসই শুরু হয় এর পর। ২৫শে মার্চ ১৯৭০ সালে রাত থেকে পূর্ববাংলায় যে ইতিহাস রচনা শুরু হয় এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশী সাংবাদিকদের ঢাকা থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয় তাঁদেরই একজনের কাহিনী ‘আনন্দবাজার পত্রিকায়’ প্রকাশিত হয়। তারই বিবরণ এখানে তুলে ধরছিঃ

“ঢাকা ২৫ মার্চ,বৃহস্পতিবার। রাত ১১টা। সেনাবাহিনী জনসাধারণের বিরুদ্ধে যে হামলা চালাচ্ছে তার পরিণতি গুরুতর হবে বলে শেখ মুজিবুর রহমান যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেটার রিপোর্ট তৈরী করে ফেললাম। নীচের লবিতে চলে গেলাম। এবার একটি ট্যাক্সি ডেকে চলে যাব ‘তার’ অফিসে। কিন্তু লবিতে কী দেখছি! যুদ্ধসাজে সজ্জিত সৈন্যরা, তাদের মাথায় শিরস্ত্রাণ, হাতে অস্ত্র, তারা ঘুর ঘুর করে বেড়াচ্ছে। দরজার সামনে ব্ল্যাক বোর্ডের ওপর হোটেল কর্মীরা চক দিয়ে লিখে রেখেছেন: ‘অনুগ্রহ করে এখন বাইরে যাবেন না।’ অন্য কেউ বা শনিবারের সাধারণ হরতাল পালনের জন্য শেখ মুজিবুরের আহ্বান সংবলিত আবেদনপত্রটি ওই ব্ল্যাক বোর্ডের উপরই সেঁটে দিয়ে গিয়েছেন। অন্য সাংবাদিক বন্ধুরা জানালেন, সৈন্যরা তাঁদের ঘরের ভেতর থাকতে হুকুম দিয়ে গিয়েছেন। ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ব্যাপার কী?” জবাব দিলেন,”বাইরে বের হতে গেলেই গুলী। রাত ১১ টায় হেটেল তালাবন্ধ করে দিতে হবে এটাই আমার উপর হুকুম, আর কিছু জানিনা।”

রাত ১টা। শহরের পুরনো মহল্লা থেকে পূর্ব-পাকিস্তানী ভদ্রলোকটি ফোন করলেন। বললেন, তিনি মেশিনগানের গুলি শুনতে পাচ্ছেন। তিনি নিজের ঘরেই দোর বন্ধ করে বসে আছেন। একটু পরেই টেলিফোন নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হল। অটোমেটিক অস্ত্রের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, মাঝে মাঝে বড় রকমের বিস্ফোরণের শব্দও। রাস্তায় সামরিক জীপে ‘রিকয়েললেস রাইফেল’ বসানো হয়েছে।

রাত ৩টা। হোটেলের কাছেই সংবাদপত্র ‘পিপ্‌ল’-এর অফিস। সৈন্যরা মশাল হাতে নিয়ে সেদিকে এগোচ্ছে। কিছুটা চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। গুলী-গোলারও শব্দ শুনতে পাচ্ছি। অফিসে ওরা আগুন লাগিয়ে দিল। ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত এই সংবাদপত্র গভর্নমেন্টের অতি কড়া সমালোচক। এরপর হোটেলের অতি কাছেই আরও গুলীগোলার শব্দ। চীৎকার ও উল্লাস ধ্বনিও যেন শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না অপর দিক থেকেও প্রচণ্ড গুলীগোলার শব্দ আসছে।

সূর্যোদয় কাল। গুলিগোলার শব্দ এখন শোনা যাচ্ছেনা। পথঘাট সম্পূর্ণ জনহীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে এক বিরাট ধুম্রপুঞ্জ আকাশের দিকে উঠতে দেখতে পাচ্ছি। সৈন্যরা যদি ভারী অস্ত্র দিয়ে সেখানে আক্রমণ চালিয়ে থাকে, তবে নিশ্চয়ই বিপুল প্রানহানি ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দুটি ঘরে রাত্রে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকেন এবং প্রতি ঘরে প্রায় চারশো জন।

সকাল সাতটা। আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ১২ তলায় গেলাম, সেখানে ভুট্টো রয়েছেন, ভুট্টোর দু’জন দেহরক্ষী রাইফেল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভুট্টের দলের একজন হলঘরে এলেন। জিজ্ঞাসা করায় বললেন, রাত্রে যে কী ঘটেছে তার বিন্দুবিসর্গও তারা জানেন না। ভুট্টো ঘুমিয়ে আছেন। ৭-৩০ মিনিটে তাঁকে জাগিয়ে দেওয়ার হুকুম রয়েছে।

সকাল ৮টা। এক বেতার ঘোষণায় করাচী থেকে জানানো হল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেছেন এবং আজ রাত ৮টায় জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দেবেন। অতএব অভ্যুত্থানের ফলে ইয়াহিয়ার ক্ষমতাচ্যুতির গুজবটি মিথ্যা হয়ে গেল। টেলিফোন এখনও নিষ্ক্রিয়।

৮-৩০ মিঃ, কথায় কথায় জানা গেল ভুট্টো চলে যাচ্ছেন। নীচের লবিতে ছুটে গেলাম। ছদ্ম আবরণে ঢাকা মিলিটারী বাস ও একখানা মোটরকার লবির সামনে এসে দাঁড়াল। সৈন্যরা এসে লবি দখল করে ফেলল। ভুট্টো এলেন ধুসর রঙের ট্রাউজার ও নীল রঙের টাই গলায়। কিছু বললেন না তিনি। ‘আমার কিছুই বলার নেই।’ তিনি গাড়ীতে উঠে বসলেন। দুই দেহরক্ষী দুইপাশে বসলেন এবং তাঁদের রাইফেলের নল জানলার বাইরে বাড়িয়ে রাখলেন। তাঁরা যেভাবে ট্রিগারের ওপর আঙুল রেখে প্রস্তুত রয়েছেন তাতে আমরা সবাই যেন ঘাবড়ে গেলাম। ভুট্টোর একজন একান্ত সচিব বললেন, আগের দিন বেলা ৫টায় ভুট্টোর উপদেষ্টা যখন প্রেসিডেন্ট ভবনে বৈঠক সেরে ফিরে এলেন, তখনই তাঁরা জানতেন রাজনৈতিক মীমাংসার সকল সম্ভাবনা শেষ হয়ে গিয়েছে। এটার কারণ এই যে, মুজিব ইয়াহিয়া মীমাংসার শর্ত ভুট্টো মেনে নিতে পারলেন না অথবা সেনাবাহিনীর চাপে পড়েই ইয়াহিয়া মীমাংসা করলেন না। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ভুট্টোর সাঙ্গ পাঙ্গরা হয়ত এ ধারণাই সৃষ্টি করতে চাইছেন যে তাঁদের মনিব রাজী হলেন না বলেই মীমাংসা হল না। ভুট্টো চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বারান্দায় গেলাম। সৈন্যরা হুকুম হাঁকল, ‘ভেতরে যাও,’ একজন লেঃ কর্নেল হুকুম দিলেন, হোটেল ছেড়ে কেউ বাইরে যেতে পারবে না। বিদেশী বলে কেউ বাইরে যেতে পারবে না। বিদেশী বলে কেউ রেহাই পাবে না। আমরা ভেতরে না গেলে তিনি গুলী করবেন।

অগত্যা চলে গেলাম ভেতরে। ক্যাপ্টেন হোটেলের পাকিস্তানী অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে হুকুম দিলেন, ‘পনোরো মিনিটের মধ্যে যদি হোটেলের মাথায় পাকিস্তানী পতাকা তুলতে না পারো, তবে তোমাকে গুলী করে মারব।’ এই কথা বলে তিনি চলে গেলেন। হোটেলের কর্মচারীরা একখানা পাকিস্তানী পতাকা নিয়ে এলেন এবং সেটি তুলতে যাবেন এমন সময় অন্য সৈন্যরা হুকুম দিলেন, বাইরে যেতে পারবে না, গলা বাড়াইলেই গুলী।’দেখা যাচ্ছে সর্বত্রই সেনাবহিনীর মনমেজাজ একই ধরণের।

সকাল ৯টা। বেতার ঘোষণায় জানা গেল, ২৪ ঘণ্টার কারফিউ চলছে এবং যে কেউ রাস্তায় বের হবে, তাকেই দেখা মাত্র গুলি করা হবে। বেলা ১০ টায় একটি বিশেষ ঘোষণা করা হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হল। হোটেলের ম্যানেজার কোথাও থেকে একজন পাচক সংগ্রহ করলেন এবং তাকে দিয়েই প্রাতরাশ ও কফির ব্যবস্থা করলেন।

বেলা ১০টা। হোটেলের মাথায় পতাকা তোলা হল। হোটেলের ম্যানেজার বললেন, ‘সব রকম পতাকাই আমরা হাতের কাছে রেখে থাকি।’ বিশেষ ঘোষণা আসলে সামরিক আইনের অন্তর্ভুক্ত নির্দেশের একটি ফিরিস্তি, কিন্ত কারফিউর কথা এবার উল্লেখ করা হল না।

মধ্যাহ্ন। ওপরে উঠবার সিঁড়ির জানালা পথে দেখলাম, জনহীন রাজপথে জীপ ও ট্যাঙ্কগুলি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা যথেষ্ট গুলি গোলা ছুঁড়ছে বলেই মনে হল। তারা যেপথে চলে গেল, সে পথের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আরও বিরাট দুটি ধূম্রকুণ্ডলী আকাশের দিকে উঠছে। একটি যেন শহরের পুরনো মহল্লায়। সেদিকেই, যেদিকে আওয়ামী লীগের অফিস রয়েছে। এ এক অভিশপ্ত সাংবাদিক জীবন। এত কিছু দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু বাইরের পৃথিবীকে কিছুই জানাতে পারছি না শর্টওয়েভে পৃথিবীর যে সকল সংবাদ শুনেছি তাতে বুঝতে পারছি এই জঙ্গী প্রচণ্ডতার একটি কথাও এযাবৎ বাইরের পৃথিবীতে পৌঁছেনি। নিদারুণ অসহায়তায় নিজের আঙ্গুল কামড়াতে ইচ্ছে করে।

শুক্রবার বেলা ১২-৩০ মিঃ–সামরিক বাহিনীর যে লেঃ কর্নেলটি আগে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তিনি আবার ফিরে এলেন এবং মেহেরবাণী করে জানানেল যে, সময় কাটাবার জন্যে আমরা ইচ্ছে করলে সুইমিংপুল ব্যবহার করতে পারি। তিনি এই মর্মেও হুকুম জারী করে বলেন যে, কেবলমাত্র বিদেশীরাই সুইমিং পুল ব্যবহার করবে এবং পাকিস্তানীরা হোটেলের ভেতর আটক থাকবে। শহর বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা সম্পর্কে জবাব দিতে তিনি অস্বীকার করলেন এবং বললেন, “অত কথায় কাজ কি? সুইমিং পুলে নেমে শরীর ঠাণ্ডা করে নিন।’ বিকালটা শান্তিতেই কাটল। মাঝে মাঝে অবশ্য বন্দুক ও মেশিনগানের শব্দ শুনলাম। শহরের দক্ষিণ প্রান্তের আকাশে আবার ধুম্রকুণ্ডলী। সূর্য নেমে যাচ্ছে, আরও ধোঁয়া উঠছে আকাশের দিক।

রাত্রি ৮-১৫মিঃ–ইয়াহিয়ার বেতার বক্তৃতা শুনলাম। তিনি মুজিবুরের অসহযোগ আন্দোলনকে “রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ বলে মনে করেন এবং মুজিবুরের আওয়ামী লীগকে তিনি ‘বেআইনী-প্রতিষ্ঠান’ ঘোষণা করলেন। লবিতে নেমে গেলাম, সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। ইয়াহিয়ার বেতার বক্তৃতা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই সাংবাদিকদের পাকিস্তান ছেড়ে চলে যেতে বলা হল এবং এই বলার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সবাইকে একসঙ্গে ট্রাকে তুলে নিয়ে বিমান বন্দরের দিকে চালান করে দেওয়া হয়েছে। যেভাবেই হোক, আমাকে তুলে নিতে ওরা ভুলে গিয়েছিলেন। আমাকে দেখতে পেয়েই হোটেলের জঙ্গীরা আমাকে জীপে তুলে নিয়ে বিমান বন্দরে পৌঁছে দিয়ে আসতে চললেন। প্রথম মহাযুদ্ধে সৈন্যরা যে ধরণের শিরস্ত্রাণ পরতেন, তেমনই শিরস্ত্রাণ পরিহিত এক ছোকরা বয়সী লেফটেন্যান্ট হলেন আমার ড্রাইভার। তাঁরা আমার সুটকেশটি এনে সৈন্যবোঝাই সাঁজোয়া গাড়ীতে তুলে দিলেন। লেফটেন্যান্ট তাঁর রেডিও অপারেটরকে জীপে পেছনের আসনে বসতে বললেন। রেডিও অপারেটরের পাশেই আমাকে বসতে বলা হল। বসলাম। সূচীভেদ্য অন্ধকারের মধ্য দিয়ে জীপ ছুটে চলল। প্রত্যেকটি বাড়ীর দরজা জানালা বন্ধ, হেডলাইটের আলোতে সেগুলির দিকে চোখ পড়তেই আমার শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে যেতে লাগল। কোথাও জীবনের চিহ্নমাত্র নেই। আগের রাত্রে লোকেরা ইঁটপাথর ও গাছের গুঁড়ি দিয়ে যে সকল ব্যারিকেড করেছিল, সেগুলি উড়িয়ে দিয়ে সামরিক ট্রাক চলাচলের উপযোগী চওড়া রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। জীপ বিমানবন্দরের দিকে ছুটছে। লেফটেন্যান্টের সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি কোন প্রশ্নেরই জবাব দিতে ইচ্ছুক নন, বিশেষ করে লড়াই বা হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে তিনি একেবারেই চুপ করে গেলেন। কতদিন এই ব্যবস্থা চলবে বলে তিনি মনে করছেন,’ ‘আমি শুধু হুকুম তামিল করি, ওসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো কাজ নয়।’ একটু পরে অকস্মাৎ আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে হাসিহাসি মুখে বললেন, ‘দেখবেন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। ওদের গরম মাথা আমরা ঠাণ্ডা করে দেব।’ রেললাইনের লেভেল ক্রসিংএ দু’সারি কুঁড়েঘরে আগুন জ্বলছে। যাঁরা এখানে এতদিন বাস করতেন এবং যাঁদের পথের পাশে বসে চব্বিশঘণ্টা আড্ডা দিতে আমিও দেখেছি–তাঁদের চিহ্নমাত্রও আজ নেই। লেফটেন্যান্টকে জিজ্ঞসা করলাম, “ওরা গেল কোথায়?’ মাথা নেড়ে তিনি জবাব দেন, “আমি জানি না।’

রাত ১১-৩০ মিঃ।– এত তাড়াহুড়ো করে আমাদের বিমান-বন্দরে নিয়ে আসা হল যদিও — কিন্তু করাচীগামী বিমানের কোন পাত্তা নেই। সেটি এখনও এসে পৌঁছায়নি। আমরা একদলে ২৫ জন সাংবাদিক। এক এক জন করে সাংবাদিকদের জিনিসপত্র তল্লাসী করে দেখতে সময় লাগল মোট ৩ ঘণ্টা। এমনি একটি গুজব কানে এল যে, বাংলাদেশের পতাকা কেউ বাইরে নিয়ে যাচ্ছে কিনা, সেটা দেখার জন্য বিশেষ করে তল্লাসী করা হচ্ছে। একপোড্ ফিল্ম দেখা মাত্রই বাজেয়াপ্ত করা হল। কয়েকজন সাংবাদিক ইতিমধ্যে লাউনজে বসে তাঁদের রিপোর্ট টাইপ করছিলেন দেখে সেগুলি কেড়ে নেওয়া হল পোর্টেবল টাইপরাইটারগুলিও বাজেয়াপ্ত করা হল। বলা হল করাচীতে নেমে এগুলি ফেরৎ পাবেন।

বিমান বহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট এসে বললেন–এতগুলি লোককে নিয়ে যাবে, অথচ বিমান এসে পৌঁছল না।

রাত ৩টা। ‘এ-৭০৭’ যাত্রিবাহী জেট বিমান এল। আমরা চড়ে বসলাম। আমাদেরই সহযাত্রী একজন পাকিস্তানী যাত্রী বললেন, সৈন্য বোঝাই হয়ে বিমানখানা একটু আগেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছে। এই বিমান বন্দরেরই কোন একস্থানে সৈন্যদের নামিয়ে দিয়ে অতঃপর আমাদের তুলে নিতে এসেছে।

শনিবার মধ্যাহ্ন। অতঃপর করাচী বিমান বন্দর। ভারতের দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে এবং সিংহলে থেমে এই বিমানপর্যটন অত্যন্ত ক্লান্তিকর। কিন্ত মাটিতে পা দেবার আগেই শোনা গেল, শুল্ক অফিসাররা এখানে আর একদফা তল্লাসী করবেন। সেনসর না করিয়ে যাতে রিপোর্ট পাঠানো যায়, সেজন্যে আমাদের কেউ কেউ বোম্বাইগামী বিমান ধরার চেষ্টা করছেন। তল্লাসীর নতুন ঝামেলার ফলে সে বিমান ধরার চেষ্টা হয়তো নিস্ফল হয়ে যাবে।

কিন্তু বিমানবন্দরের কর্মীরা সাফ জানিয়ে দিলেন, তল্লাসী চলবেই, এজন্য যদি বোম্বাইগামী বিমানকে খানিকটা বিলম্ব করাতে হয়, তাও করাব।

বেলা ১টা। ইন্সপেক্টার আমার জিনিসপত্র তল্লাসী করতে এলে বললাম ‘একবার ঢাকা বিমানবন্দরে তল্লাসী হয়েছে, আবার কেন? ইন্সপেক্টর কড়া জবাবে বললেন, ‘বিশেষ হুকুম আছে।’ তিনি আমার নোটবই, ঢাকা থেকে পাঠানো আমার তারবার্তার কপি, সংবাদপত্রের ক্লিপিং এবং এমনকি আমার স্ত্রীর লেখা একখানা চিঠিও বাজেয়াপ্ত করলেন। এখানেই শেষ হল না। আমার ক্যামেরাব্যাগে যে ১৪ রোল আন এক্সপোজড্ ফিল্ম ছিল সেগুলিও কেড়ে নিলেন। এগুলি ফেরৎ চাইলে তিনি বললেন, ‘ডাকযোগে পরে এগুলি ফেরৎ পাবেন।’

১টা ৪৫ মিঃ। বোম্বাইগামী বিমানে উঠে বসলাম, এটা আমার সৌভাগ্যই বলতে হবে যে ওরা আমার নোটবইসহ সবকিছু কেড়ে নিয়ে গেলেও এই ডায়েরী এবং ঢাকায় বসে লেখা আর একটি বার্তা যে আমার হিপ পকেটে লুকানো ছিল তারা তা জানতে পারেনি। এই বিমানেই আমার সহযাত্রী অপর এক সাংবাদিকের দেহ তল্লাসী করা হয়েছিল এবং তাঁর জামার আস্তিনে লুকিয়ে রাখা ঢাকার অবস্থার রিপোর্ট তারা কেড়ে নিয়েছিল।

দিনাজপুরে অস্থায়ী সরকারের দেশে দুই দিন

২৩ শে মার্চ বড়খানার জন্য ডেকেছিল ইপিআরের বাঙ্গালী ফৌজী ভাইদের। জনতা যেমন আগেই বিপদ বুঝে প্রস্তুতি নেবার জন্য তৈরী হচ্ছিলেন তেমনি ইপি আর বাহিনীও একটা বিপদের আশঙ্কা করেছিলেন। পিণ্ডির কর্তাদের একটা সিক্রেট খবর ওয়ারলেসে পেয়ে ইপিআর ধরে ফেলে। বোঝে, পিণ্ডির পাক সৈন্যরা ওদের মেরে ফেলবে। ২৩ মার্চ যখন ইপি আর-এর বাঙালী সৈন্যদের নিরস্ত্র হয়ে খানাপিনায় আসতে হুকুম দেয় পাঞ্জাবী বড় কর্তা তখন এরা জানায়, সবাই নিরস্ত্র না হলে আমরাও হবো না। ২৫ মার্চ আবার খানাপিনার ডাক পড়ে। আর এদিকে ইপি আর বাহিনীর বাঙ্গালীদের অন্যত্র বদলীর আদেশ দিতে থাকে। পাক ফৌজ আসতে থাকে বাইরে থেকে। পাঞ্জাবী সৈন্যরা মেসিনগান, মর্টার প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নিজেদের এলাকাগুলি সজ্জিত করতে থাকে।

এদিকে মুজিবুর-ইয়াহিয়া ব্যর্থ বৈঠক, জনতার মিছিল সব খবরই দ্রুত দাবানলের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ই পি আর খবর পায় পাঞ্জাবী সৈন্যরা মেজরের নির্দেশে রবিবার রাত ৮ টায় আক্রমণ করবে। ই পি আর প্রস্তুত হতে থাকে ই পিআরের বিভিন্ন সদস্যরা গ্রাম এবং শহরের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলে দেয় আক্রমণ হলেই। পাল্টা আক্রমণ হবে এবং জনতা যেন কার্য্য ভঙ্গ করে ইপিআরের সঙ্গে যোগ দেয়।

ইপিআরের জনৈক বড়কর্তাকে মেজর আগের দিন রাতে ডেকে পাঠায় এবং কার্য্য জারী হয়েছে এটা প্রচার করার দায়িত্ব দেয়। সেই বড়কর্তা বর্তমানে দিনাজপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান। মেজরের সঙ্গে আলাপ আলোচনার সময়ে নিজের কোমরে গুলী ভর্তি রিভলবার নিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, ‘ভেবেছিলাম আমায় যদি গুলী করে তার আগে অন্তত দুইজনকে মেরে যাব।’ বললাম কিন্তু আপনারা এই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন কেন? বললেন, বাঁচার জন্য। আর চারিদিকে চেয়ে বুঝেছি দেশপ্রেম কি? গণ জাগরণ কি? শত্রুপক্ষ আক্রমণ করার আগেই তাদের আক্রমণ করা হবে বলে ই পি আর স্থির করে। ঠিক হয় ২৮ তারিখে সন্ধা ৬ টায় আক্রমণ হবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত জনৈক বাঙ্গালী ই পি আরই শত্রুপক্ষের কাছে পৌঁছে দেয়। এই বিশ্বাসঘাতকতার খবর জানতে পেরে ঐ বিশেষ মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে ই পি আর বাহিনী বেলা আড়াইটায় আক্রমণ শুরু করে। সার্কিট হাউস থেকে পাঞ্জাবী সৈন্যরা মেসিনগানের গুলী চালাতে আরম্ভ করে। এদিকে জনতা, ন্যাপ-এর উভয় অংশের নেতৃত্বে কার্য্য অমান্য করে বেরিয়ে পড়ে। দুইদিন ধরে দারুণ যুদ্ধের পর পাঞ্জাবী সৈন্য পরাজিত হয় এবং রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়। শত্রুপক্ষের হাতে ই পি আর এবং জনতার প্রায় এক হাজার নরনারী নিহত হয়েছেন।

কুষ্টিয়া শহরের মুক্তি সংগ্রামের আলেখ্য

শেখ মুজিবুরের সঙ্গে ইয়াহিয়ার আলোচনার সময় থেকেই কুষ্টিয়ার তরুণরা অস্ত্রচালনায় ট্রেনিং নিচ্ছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের শ’খানেক সক্রিয় কর্মী। এঁদের কাছে ছিল ৩৫টি রাইফেল ও হাজারখানেক গুলী।

২৫ মার্চ রাত্রি থেকে সারা দেশে শুরু হল সামরিক নিপীড়ন। সর্বত্র জারী হল ৩০ ঘণ্টা ব্যাপী সন্ধ্য আইন। জনৈক তরুণ প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষায়: “ভোর চারটে নাগাদ যাচ্ছিলাম থানাপাড়ার আমবাগানের দিকে। ওখানে ঐসময়ে ট্রেনিং হত আমাদের। হাইড রোডে হঠাৎ মিলিটারী পথরোধ করল। উর্দুতে প্রশ্ন করল কে? কি নাম? কোথায় যাবে?একজন বাঙ্গালী অফিসার এগিয়ে এসে বাংলায় তর্জমা করে দিলেন কথাগুলো। জানালাম মা’র অসুখ, থানাপাড়ায় যাচ্ছি মা’র সঙ্গে দেখা করবার জন্য, যেহেতু সারা রাত মার জন্য চিন্তায় উদ্বেগে ঘুম আসছিল না। ওরা যেতে দিল না। সকালবেলা রেললাইন ধরে থানাপাড়ার দিকে এগুলাম। মিউনিসিপ্যালিটি বাজারের কাছে আমার সামনেই এক তরুণকে ওরা গুলী করে হত্যা করল। ঘটনাটা দেখামাত্র আমি এগিয়ে গেলাম কে পড়ে গেছে ভাল করে বোঝার জন্য। ইঁটের টুকরোর সঙ্গে আমার রবারের চটির সংঘাতে হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম।

আর তখনই দেখলাম মিলিটারী বন্দুক উঁচিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে’ কোনমতে প্রাণভয়ে উঠে চোঁ-চোঁ-দৌড়ালাম থানাপাড়ার দিকে।”

সেদিন অর্থাৎ শুক্রবার, ২৬ মার্চ সকালে কুষ্টিয়ার সংগ্রাম পরিষদ সারা শহরে ব্যারিকেড তৈরীর সিদ্ধান্ত নিল, শুরু হল ইয়াহিয়ার সৈন্যদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হলেন ঘটনাস্থলেই।

এ রাত্রেই কুষ্টিয়ার তরুণরা ভারতীয় রেডিও শুনে জানতে পারলেন সমগ্র ‘বাংলাদেশ’-এ জনগণের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইস্ট-পাকিস্তান রাইফেলস মিলিটারীর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। এই সংবাদ তাঁদের মধ্যে বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি করল। সেদিন (২৬শে মার্চ) রাত্রেই অধিকাংশ তরুণ গ্রামে চলে গিয়ে ই পি আর ও সশস্ত্র জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন।

সান্ধ্য আইন বলবৎ করার পরেই পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করল-কারো কাছে কোন অস্ত্র থাকলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা জমা দিতে হবে সেনাবাহিনীর কাছে। কুষ্টিয়া শহরের বিত্তবানরা এই ঘোষণায় ত্রস্ত হয়ে প্রচুর বন্দুক জমা দিয়ে এসেছেন। জমা পড়ল মোট ৩৫০ টি বন্দুক ও টোটা ভরা রাইফেল এবং কিছু পিস্তল।

যে সকল তরুণ গ্রামাঞ্চলে গিয়ে ই পি আর ও সশস্ত্র জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন তারা রবিবারের মধ্যে শহরে ফিরে জানালেন সোমবার ২৯ মার্চ রাত্রে কুষ্টিয়া শহর ঘিরে ফেলে শহর-মুক্তির যুদ্ধ শুরু হবে।

এদিকে সোমবার (২৯শে মার্চ ) সান্ধ্য আইনের কড়াকড়ি কিছুটা হ্রাস করা হল, নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারী ছাড়া উঁচুতলার কর্মচারী অর্থাৎ মোট কর্মচারীর ২৫ শতাংশ অফিসেও যোগ দিলেন।

কিন্তু প্রত্যাশিত সম্ভাবনা রূপায়িত হল না। সোমবার রাত্রের মধ্যে ই পি আর ও সশস্ত্র জনগণ এসে পৌঁছতে পারলেন না কুষ্টিয়া শহর পর্যন্ত অশপাশের গ্রামসমূহে– কুমলাপুর, বারাদি, বারখাদ, বিন্তিপাড়া, পোড়াদহ প্রভৃতি অঞ্চলেই ঘাঁটি গেড়ে তারা সোমবার (২৯শে মার্চ) রাত্রি কাটালেন।

মঙ্গলবার ৩০শে মার্চ ই পি আর -এর জনৈক মেজর বেসামরিক পোশাকে এসে কুষ্টিয়া শহর পরিদর্শন করে গেলেন। আর তারপর রাত্রেই মুক্তিবাহিনীর (শ’খানেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী যারা সশস্ত্র লড়াইয়ের ট্রেনিং নিয়েছিলেন, তারা এবং শহরের পুলিশও মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিলেন) চারদিক দিয়ে কুষ্টিয়া শহর আক্রমণ করল। একদিকে পূর্ণাঙ্গ সামরিক শিক্ষণপ্রাপ্ত, চীনা ও মার্কিন অস্ত্র চালনায় সুদক্ষ ২৫০ জন পাক সৈন্য, অন্যদিকে ইপিআর পুলিশ ও সশস্ত্র জনগণের মিলিত মুক্তিবাহিনীর হাতে শুধু বন্দুক, তাও সীমিত সংখ্যক। আর ইয়াহিয়া সৈন্যদের কাছে আধুনিক অস্ত্র ছাড়াও চীনদেশে তৈরী হাল্কা স্বয়ংক্রিয় বন্দুক এবং লাইট মেসিনগান এ হেন সময় বিশেষ উপযোগী।

স্থির ছিল–বারাদি, বারখাদা থেকে মুক্তিবাহিনীর একাংশ পুলিশ লাইন আক্রমণ করা মাত্র পুলিশেরা সক্রিয়ভাবে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেবে। মুক্তিবাহিনীর অপরাপর অংশগুলি যুগপৎ পোড়াদহ থেকে জেলা স্কুল ও থানা (জেলা স্কুলে সামরিক শিবির স্থাপন করেছিল ইয়াহিয়া বাহিনী), বিণ্ডিপাড়া থেকে জেলা স্কুল এবং কুমিলাপুর থেকে বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র (ওয়ারলেস স্টেশন) আক্রমণ করে শত্রুকে অতর্কিতে পরাস্ত করবে।

ইতিমধ্যে একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। ই পি আর-এর উপরিউল্লিখিত মেজর জেলা প্রশাসকের কাছে সোমবার রাত্রেই একটি বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে রেখেছিলেন– পুলিশদের ব্যবহারের জন্য যে সকল অস্ত্র মজুত করা আছে সেগুলি পুলিশের হাতে দিয়ে দিন। জেলা প্রশাসক পুলিশ সুপারকে (এস পি) সেই মত নির্দেশ দিলেন। আর তারপরেই দেখা গেল, অস্ত্রদান তো দূরের কথা এস পি পুলিশদের সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করলেন। নতুন আদেশ দিলেন তিনি- ‘হাউসিং এস্টেট’-এ দাঙ্গা বাধার উপক্রম, ওখানে লাঠি সড়কি নিয়ে গিয়ে দাঙ্গা রোখো। আসলে ও ধরনের কোন অবস্থা ‘হাউসিং এস্টেট’-এ ঘটেনি। এস পি-র আদেশের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল– পুলিশদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সকল সংযোগ ছিন্ন করা। কিন্তু পুলিশেরা এস পি-র আদেশ লঙ্ঘন করে মঙ্গলবার রাত্রে মজুত অস্ত্র ছিনিয়ে নিলেন। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক পুলিশ লাইন আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশবাহিনী মুক্তিবাহিনীর পাশে এসে দাঁড়ায়। বারাদি, বারখাদা থেকে পুলিশ লাইন আক্রমণ শুরু হল বুধবার ভোর চারটা নাগাদ। লাল ও সবুজ আলো বিচ্ছুরিত করে দুটো বোমার বিস্ফোরণ আক্রমণ শুরুর নির্দেশ পৌঁছে দিল শহরের সকল প্রান্তে। তুমুল যুদ্ধের পর বুধবার রাত্রের মধ্যেই পুলিশ লাইন ও জেলা স্কুল চলে এল মুক্তিবাহিনীর বশে। বৃহস্পতিবার ১ লা এপ্রিল সকালের মধ্যে ওয়ারলেস স্টেশনও দখল করে নিল মুক্তিফৌজ।

জেলা স্কুলে যখন পাক সৈন্যরা প্রায় সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত সে সময় মুক্তি বাহিনীর সামনে এসে দাঁড়ালেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (যুদ্ধ হওয়া মাত্র তিনি জেলা প্রশাসকের সমগ্র ক্ষমতা করায়ত্ত করেন)। পায়ে তাঁর গুলি লেগেছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তরুণ এক ছাত্রের সামনে এসে বললেন, “কোরাণ শরীফের শপথ নিয়ে বলছি আমি কোন অপরাধ করিনি। তোমায় ১,১০০ টাকা দেব–আমায় জানে মেরোনা। আর ১৫০০০ হাজার টাকা দিচ্ছি আমার পায়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দাও।” আগুন জ্বলে উঠল তরুণের চোখে। ঘুষ দিয়ে প্রাণ ভিক্ষা? মুক্তিফৌজের সামনে এর চেয়ে বড় অপরাধ নেই। বন্দুক উঁচিয়ে তৎক্ষণৎ পাঞ্জাবী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে হত্যা করলেন ১৯ বছরের যুবা।

বৃহস্পতিবার ১লা এপ্রিল সকাল দশটার মধ্যে সমগ্র কুষ্টিয়া শহর মুক্ত হল। বহু অস্ত্র– মূলতঃ চীনা ও মার্কিন–মুক্তিফৌজের হাতে এসে গেল। বন্দী হল ইয়াহিয়া বাহিনীর ১৩ জন সৈন্য আর শ’ দেড়েক সক্ষম হল পালাতে। পলাতকদের অধিকাংশই পরে গ্রামবাসী তথা শসস্ত্রবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নিহত হয়।

কিছু পরেই কুষ্টিয়ার আকাশে দেখা গেল জেট ফাইটার বিমান। আমবাগানের মধ্যে জেলা স্কুল। তার পাশেই সার্কিট হাউসের বড় দালান। বিমান থেকে সৈন্যরা ঐ সার্কিট হাউসকেই জেলা স্কুল বলে ভুল করল তাই বোমা পড়ল জনশূন্য সার্কিট হাউসের উপরেই।

ততক্ষণে প্রকৃত জেলা স্কুলের ছাদে বেশ কিছুসংখ্যক মেশিনগান লাগানো হয়েছে। জেট বিমান লক্ষ্য করে নীচ থেকে গুলী ছোঁড়াও হল। বিমান হানা শেষ হতে লাগল কয়েক মিনিট।

পাবনার মুক্তিসংগ্রামের দিনপঞ্জী ২৫ থেকে ২৮ মার্চ

২৬ মার্চ

সেদিন শুক্রবার, বাজার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সামরিক বাহিনীর অতর্কিত হস্তক্ষেপে সন্ত্রস্ত মানুষ সেদিন আর বাজারে যেতে পারেন নি–বাজার বসেও নি। সারাদিন শহরে সন্ত্রাস ও কবরের নীরবতা বিরাজ করতে থাকে।

ইতিপূর্বে তারা পাবনার টেলিফোন এক্সেঞ্জ ভবন, প্রধান ডাকঘর প্রভৃতিতে পজিশন নিয়ে ফেলে– বেসামরিক লোকজনকে হটিয়ে দেয়।

চলতে থাকে সারা শহরে মুক্তিবাহিনীর গোপন তৎপরতা। তারা আক্রমণ চালাবার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

শুক্রবার রাতে কতিপয় বিশ্বাসঘাতক লোকজনের সহায়তায় সামরিক বাহিনী স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দের বাড়ীতে হানা দেয়। কিন্তু বেশীর ভাগকেই তারা পায় না–তাঁরা পূর্বাহ্নেই সরে গিয়েছিলেন। শুধুমাত্র সদর মহকুমা আওয়ামী লীগ সম্পাদক এবং এমপিএ জনাব আমিনুদ্দীন আহমেদ ভাসানীপন্থী ন্যাপের ডাঃ অমলেন্দু দীক্ষিত, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু সাঈদ তালুকদার, একজন রাস্তার পাগল (রাজেন পাগল) ও জনৈক পৌর কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। রাস্তা থেকে আরও বেশী সাধারণ লোককে গ্রেপ্তার করেছিল কিন্তু ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে মাররধর করে পরে তাদের মুক্তি দেয়। শুক্রবার তারা পুলিশ লাইনে গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র সামরিক বাহিনীকে দিয়ে দিতে বলে– কিন্তু তারা পুলিশ সুপারের নির্দেশ না পেলে দেবেনা বলে জানিয়ে দেয়।

২৭ মার্চ

শনিবার সারাদিন কাৰ্য্য বলবৎ থাকে। হাট বাজার বন্ধ–কিন্তু মুক্তি বাহিনীর গোপন প্রস্তুতি অব্যাহত থাকে এই দিন সামরিক বাহিনীও সারা শহরে টহল চালু রাখে। সকালে গণসংযোগ অফিসারকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় বন্দুকের নলের ডগায় তাকে বিভিন্ন নির্দেশ প্রচার করতে বাধ্য করে।

সন্ধায় তারা গিয়ে পুলিশ লাইন ও ম্যাগজিন আক্রমণ করলে তারা প্রতিহত হয়। ফিরে যায় তখনকার মতো। কিন্ত অজস্র গুলীগোলা চালায়। ফাঁকা আওয়াজও করে শহরের সকল প্রান্তে সন্ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করে।

শেষরাতে আবার সামরিক বাহিনী এসে পুলিশ লাইন ও ম্যাগজিন আক্রমণ করে। পুলিশবাহিনীও সারারাত প্রস্তুত ছিল, তারা বীরত্বের সাথে এ আক্রমণ প্রতিরোধ করে। সামরিক বাহিনীর কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে, বাঙ্গালী পুলিশের গুলীতে নাস্তানাবুদ সামরিক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ইতিমধ্যে জনৈক বিশ্বাসঘাতক পুলিশেকেও মুক্তিবাহিনীর পুলিশেরা গুলি করে হত্যা করে সে গোপনে সামরিক বাহিনীকে খবরাখবর দিচ্ছিল।

রবিবারে রক্ত সূর্যোদয় ইতিমধ্যে সকাল হয়ে যায়–রবিবার সকাল। পাবনার ইতিহাসে গণ-বিপ্লবের সূচনা হয় সেদিনের ভোরের রক্ত সূর্যের উদয়ের সাথে সাথে।

পুলিশ বাহিনীর এই বিজয়ের সাথে সারা শহর সংগ্রামী রূপ নেয়। রাতের মধ্যেই সামরিক তৎপরতা সত্ত্বেও তৈরী হয়েছে অসংখ্য ব্যরিকেড – যেন এক অবরুদ্ধ নগরী।

এ ছাড়াও চলে সাধারণ মানুষের প্রস্তুতি। প্রস্তুতি মেহনতি মজুর ও কিষাণের। তারা ভোর হতে না হতেই হাজার হাজার লাঠি, ঢাল, সড়কি, তীর-ধনুক ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সহ শহরের বিপ্লবীদের মনে জোগায় অভূতপুর্ব উদ্দীপনা, সাহস ও প্রেরণা।

পুলিশ লাইনের বিজয়ের অব্যবহিত পরেই বেলা ন’টার মধ্যেই টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকে আক্রমণ করা হয়। তিন থেকে চার ঘণ্টা লড়াই এর পর ৩০ জন পাঞ্জাবী সেনা নিহত হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে। সূচিত হয় প্রথম গণবিজয়।

ইতিমধ্যে কিছু সংখ্যক সৈন্য শহরের পূর্বপ্রান্তে একটি ছোট্ট বিস্কুট কারখানার ঘরে গিয়ে ঢোকে। খবর চলে আসে শহরে। মুক্তিবাহিনী ছুটে যায় সেখানে। হাজারে হাজারে মানুষ তাঁদের সাথে। অবরুদ্ধ হয় ফাঁকা মাঠের মধ্যে বিস্কুট কারখানা।

মুক্তিবাহিনীর গুলীতে নিহত হয় দু’জন সৈন্য। দরজা-জানলা বন্ধ করে সৈন্যরা তখন ছোট্ট ফুকরির মধ্যে দিয়া রাইফেল উঁচিয়ে বসে থাকে। নেমে আসে সন্ধ্যার অন্ধকার। এই ভীত সন্ত্রস্ত সৈন্যরা তখন কারখানার শ্রমিকদের লুঙ্গি পরে সাধারণ মানুষের বেশে পালিয়ে গিয়ে একটি গ্রামে আশ্রয় নিলে সেখানকার লোকজন বীরবিক্রমে তাদের আক্রমণ করে। মৃত্যু ঘটে সৈন্যদের।

সৈন্যদের সঙ্গে গ্রামের মানুষের হাতে হাতে লড়াই

এই দিনই অপরাহ্নে বিজয়মত্ত সংগ্রামী মুক্তিবাহিনী ও তাঁর বিশ্বস্ত দোসর সাহায্যকারী হাজার হাজার শ্রমিক কৃষক গিয়ে ঘেরাও করে পাবনার সামরিক বাহিনীর মূল ক্যাম্পটিকে। প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়। দু’জন টাওয়ার গার্ড মুক্তিবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। ক্যাম্পের সামরিক বাহিনীর লোকেরা আর কাউকে তখন আর টাওয়ারে না পাঠিয়ে নিজেরা কাপুরুষের মতো ক্যাম্পের দালানের দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকে। গোলাগুলীও চালনার সাহস তারা হারিয়ে ফেলে পুরোদস্তুর। মুক্তিবাহিনী ও হাজার হাজার মানুষ ঘিরে রাখে শত্রুর এই শেষ শিবিরটিকে। রাত শেষ হয়ে গেল। এলো সোমবারের সকাল। ভীরু সশস্ত্র বাহিনী ওয়ারলেসে ঢাকা ও অন্যত্র যোগাযোগ করে তাদের পালোনোর গোপন পরিকল্পনা আঁটে। এই খবরটি মুক্তিবাহিনীর জানা ছিল না।

বোমারু বিমানের সঙ্গে রাইফেলের গুলী

যাই হোক, সকাল ন’টায় আসে দু’খানি জঙ্গী বিমান। তারা নীচে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর বন্দুক ও রাইফেলের গুলীর সম্মুখীন হয়। ওপর থেকে তখন তারা ভারী মেসিনগানের গুলী নিক্ষেপ করে সামরিক শিবির ঘিরে রাখা মুক্তিবাহিনীকে সরে যেতে বাধ্য করে। ইতিমধ্যে রাজশাহী থেকে সামরিক বাহিনীর ৪০ জন লোক সুসজ্জিত হয়ে জীপে ও ট্রাকে বহুদিনের পুরাতন রাস্তা দিয়ে পাবনার সামরিক বাহিনীর অবরুদ্ধ লোকজনকে নিয়ে পালিয়ে যায়। যাবার সময় তারা সদর মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও এম পি এ জনাব অমিনুদ্দীন আহমেদ অ্যাডভোকেট, ভাসানীপন্থী ন্যাপ নেতা অমলেন্দু দীক্ষিত, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু সৈয়দ তালুকদার ও রাজেন পালকে গুলী করে হত্যা করে। পথিমধ্যে গ্রামের হাজার হাজার কৃষক তাদের ঘিরে ফেললে প্রচণ্ড লড়াই চলে। উভয় পক্ষেই হতাহত হয় অনেক। তখন সৈন্যরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পালিয়ে যায়। এক ভাগের গাড়ীগুলি মুক্তিবাহিনীর গুলীতে অচল হয়ে যায়। তখন আবার প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়। সৈন্যরা গ্রামের কিছু বাড়ীঘর জ্বলিয়ে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন সৈন্যের সবাই সেখানে নিহত। পলায়নরত অপর দলটিও কিছু দূরে গিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণের সন্মুখীন হয় এবং দীর্ঘ সময় লড়াইয়ের পর অধিকাংশ মৃত্যু বরণ করে। মোট প্রায় ১৫০ জন সৈন্য নিহত হয়। এর মধ্যে এদিক ওদিক নানান গ্রামে ছিটকে পালিয়ে যাওয়া সৈন্যও রয়েছে। গ্রমের কৃষকেরাই তাদের মেরে ফেলেছে।

সেই অবধি–অর্থাৎ আজ ১১ দিন যাবৎ সারা পাবনা জেলা মুক্তিবাহিনীর দখলে। মুক্তিবাহিনী এই বিপ্লব-লব্ধ স্বাধীনতা রক্ষা করে চলেছে–নতুন নতুন বিজয়ের পরিকল্পনা করছে গ্রাম থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে কৃষক জনতা এই মুক্তিবাহিনীর আহারের জন্য ভাত, রুটি, মাছ ইত্যদি প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে রান্না করে পাঠাচ্ছে।

পাক সেনাবাহিনীর গণহত্যা। দিকে দিকে প্রতিরোধ

বাংলার রাজধানী ঢাকায় যখন একে একে পাকিস্তানের সকল প্রদেশের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুরের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আরম্ভ করার অচলাবস্থা দূরীকরণের বিষয়সমূহ আলোচনা হয় এবং তখনকার বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের বিবৃতি ও অবস্থা দৃষ্টে বাংলার গণমানসে যখন সমস্ত প্রাপ্তির আশা আন্দোলিত হচ্ছিল, যখন বাংলার নবরূপকে কি ভাবে গ্রহণ করা হবে তার প্রস্তুতি চলছিল, সেই সময় কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন বর্তমান বাংলার এই রূপ হবে? সারা বাংলার জনগণ ভেবেছিলেন ২৬শে মার্চ দেশ থেকে সামরিক আইন উঠে যাচ্ছে। মুজিবুরের দল ক্ষমতা বুঝে নিচ্ছে। কিন্তু না, বাংলা মায়ের সে প্রাপ্তি আর হল না। গভীর রাতের অন্ধকারে গোপন নির্দেশ দিয়ে গোপনে পালিয়ে গেলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেঃ ইয়াহিয়া খান এবং ভুট্টো। ২৫শে মার্চ গভীর রাতে যখন ঢাকা নগরে মানুষ নতুন স্বপ্নে বিভোর তখন ঢাকার চারপাশ অকস্মাৎ মেসিনগান কামানের গর্জনে ভরে উঠল। ভীত বিহ্বল জনগণের স্বপ্ন খান খান হয়ে ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে? গভীর আর্তস্বর–একি হোল?

চারদিকে গোলাগুলীর গর্জন আর গর্জন। দেখা গেল অনেক স্থানেই আগুন জ্বলছে। মানুষজন অসহায় ভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে একটু সাহায্য পাবার আশায়।

সেনাবাহিনীর হামলার লক্ষ্য

ঐ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বপ্রথম আক্রমণের লক্ষ ছিল বাংলার পুলিশ বাহিনীর হেড-কোয়ার্টার রাজারবাগ, পিলখানার পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্-এর হেড কোয়ার্টার। ঢাকা ছাত্র আন্দোলনের হেড কোয়ার্টার ইকবাল হল, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ শহর এলাকার বিভিন্ন থানা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঘর বাড়ী। পুলিশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে এসে সৈন্যবাহিনী পুলিশ বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। পুলিশবাহিনী তাতে অস্বীকৃতি জানালে সৈন্যবাহিনী প্রথম মেসিনগান চালাতে শুরু করে। এর পর পুলিশ বাহিনীও পালটা গুলী বর্ষন করতে শুরু করে। শেষ রাতের দিকে যখন সৈন্যবাহিনীর অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে ঠিক সেই সময়েই সৈন্যবাহিনীর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে ট্যাংক বাহিনী। পুলিশ বাহিনী তখন প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। পলায়নপর পুলিশ বাহিনীকে খুঁজে বের করার জন্যে সৈন্যবাহিনী সার্চলাইট ব্যবহার করে যাকে তাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। শুধু মাত্র ২-১ জন কোন ভাবে আহত অবস্থায় প্রাণ নিয়ে বাঁচে। পিলখানার ই পি আর ক্যাম্পের ঊর্ধ্বতন অফিসাররা অবাঙালী–তারা আগে থেকেই এই দিনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। যার ফলে এই ক্যাম্প আক্রমণ করার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সকল ই পি আর জোয়ান নিহত হন। এদের অতি অল্প সংখ্যকই প্রাণ নিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন।

নির্বিচারে হত্যালীলা

ছাত্র আন্দোলনের দুর্ভেদ্য দূর্গ ইকবাল হলের চারপাশ প্রথমে সৈন্যবাহিনী ঘিরে ফেলে এবং বেপরোয়া গুলীবর্ষণ করতে শুরু করে। সাথে সাথে ছাত্ররাও পাল্টা গুলবির্ষণ করতে শুরু করলে আক্রমণকারী সৈন্যবাহিনী আগুনে বোমা নিক্ষেপ করে। হলে ডিনামাইট চার্জ করে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ট্যাংকবাহিনী এসে হলের অক্ষত ঘরগুলির প্রতি গুলীবর্ষণ করে। হলে অবস্থানকারী বিভিন্ন দলের ছাত্র কর্মীবৃন্দ প্রায় সবই এই আক্রমণে নিহত হয়। এই আক্রমণে হলের হাউস টিউটর তাঁর পরিবার পরিজন সহ নিখোঁজ হন। একই সময় সৈন্য বাহিনী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারও ডিনামাইটের চার্জে উড়িয়ে দেয়। এই শহীদ মিনার উড়িয়ে দেবার ` শব্দ আশেপাশের এলাকা কাঁপিয়ে তোলে। এই আক্রমণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দরুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে বহু রোগী, ডাক্তার, নার্সও মারা যায়। শহরের বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্মচারীরাও তাদের থানা আক্রমণের সময় বেশ কিছুক্ষণ পালটা গুলীগোলা চালানোতে একদম স্তব্ধ হয়ে যায়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বাড়ীর মধ্যে শেখ মুজিবের বাড়ীই সৈন্যবাহিনীর প্রথম আক্রমণের লক্ষ্য হয়। ঐ বাড়ীর রক্ষকরা বেশ কিছুক্ষণ লড়াই করে সবাই মারা যান। শেখ মুজিবের বাড়ী মেসিনগান এবং ডিনামাইট চার্জে উড়িয়ে দেওয়া হয়।

গণহত্যা শুরু

এরপর শুরু হয় গণনির্যাতন। বিভিন্ন পুরনো এলাকা অসংখ্য সৈন্যে ছেয়ে ফেলে এবং বাড়ী বাড়ী ঢুকে হাজার হাজার নিরীহ লোকজনকে ব্যাপকভাবে হত্যা করতে শুরু করে। লোকজন যে যেদিকে পারলো প্রাণ নিয়ে ছুটে পালালো। সৈন্যরা আগুনে বোমা নিক্ষেপ করলে যখন লোকজন প্রাণভয়ে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে আরম্ভ করতো, তখনই সৈন্যরা বর্বরভাবে মেসিনগান চালিয়ে ঐ সব লোকজনকে হত্যা করতে শুরু করে। সৈন্যরা বাড়ী ঘর দোকানপাট নির্বিবাদে লুঠ করতে থাকে। অসংখ্য মহিলার শ্লীলতাহানি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র মহিলা আবাসিক ছাত্রী আবাস রোকেয়া হলে প্রায় দেড় হাজার ছাত্রী থাকতো। পরিস্থিতির ক্রমাবনতি হওয়ায় বিভিন্ন দলের প্রায় ৩৫০ জন কর্মী ছাত্রী ঐ হলে তখনো থাকতে। বর্বর সৈন্যরা ঐ ছাত্রীদের জোর করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নিয়ে যায়। ঐ সকল অসহায় মেয়েরা এখনও কেউ আর বাড়ী ফেরেনি। বর্বর সৈন্যরা প্রাণভয়ে পলায়নপর যুবতী মেয়েদের জোর করে ধরে বলাৎকার করে। লজ্জায় বাংলার বহু মেয়ে নারীত্বের অবমাননায় তখন আত্মহত্যা করে। প্রথম রাতে বর্বর সৈন্যরা ঢাকা সদরঘাট টারমিনালে ঘুমন্ত কয়েক হাজার ভিখারীকে মেসিনগান দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঢাকা শহর ২ দিনেই এক মৃতের এলাকায় পরিণত হয়। লাখ লাখ লোকজন অসহায় ভাবে ঢাকার নেয়। অনাহারে, অর্ধাহারে ওদের চারপাশের বিভিন্ন গ্রাম এলাকায় এক বস্ত্রে আশ্রয় অনেকেই আজ মৃতবৎ। ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক হলগুলি ধ্বংস করা হয়। বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে আসা বহু প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকার বহু জ্ঞানী, গুণী, অধ্যাপক, শিক্ষক এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নৃশংস ভবে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করার কাহিনী বিবৃত করেন।

তাঁরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পুরনো ঢাকা আজ প্রাগৈতিহাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। চেনার উপায় নেই, অনেক স্থানে দুদিন পর্যন্ত আগুন জ্বলতে দেখা গিয়েছে।

বিভীষিকাময় পরিস্থিতি

বিভিন্ন গ্রামে অবস্থানকারী হাজার হাজার অসহায় ছিন্নমূল শরণার্থীদের গ্রাম বাংলার লোকজন নারী পুরুষ নির্বিশেষে তাঁবু খাঁটিয়ে চিঁড়া মুড়ি দিয়ে সাহায্য করছে, বাচ্চাদের দুধ সরবরাহ করছে। জিঞ্জিারার আশ্রয় শিবিরে প্রত্যহ হাজার হাজার প্রাণ ভয়ে ভীত লোকজন আসছে। অনেকই শুধু পায়ে হেঁটে ৫০-৬০ মাইল দূর গ্রামে নিরাপত্তার জন্য চলে যাচ্ছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে অসংখ্য লাশ ভাসছে। মানুষ পচার গন্ধে চারিদিক বিভীষিকাময় করে তুলেছে। ঢাকার মীরপুর এলাকার সমস্থ বাড়ী ঘর আগুনে গুলীতে ধ্বংস হয়ে যায়। সৈন্যরা কালো পোশাকে বিভিন্ন অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্র পাক সৈন্যদের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে বললেন–বাংলা দেশের অন্যান্য এলাকায় এই স্বাধীনতা যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার বেশ আগে থেকেই চট্টগ্রামে পাক সৈন্য ও জনসাধারণের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ চলছিল। তিনি ২৫ তারিখ বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। পথে ব্যারিকেড ও লাইন তুলে ফেলার জন্য অনেক স্থানে পায়ে হেঁটে, কোন স্থানে রিকসায়, কোন স্থানে স্কুটারে করে শনিবার সকালের দিকে ঢাকা পৌঁছান। মিরপুরে যখন নিজের ভাইয়ের বাসা খুঁজে ওখানে পৌঁছান তখন দেখেন–ওখানে আগুন জ্বলছে আর রাস্তাঘাট মৃতদেহে ভরে আছে, কুকুর শকুনে খাচ্ছে। পুতিগন্ধে ঢাকার আবহাওয়া বিষাক্ত। শহর ছেড়ে হাজার ছাত্র জনতা গ্রামের পথে ছুটছে। গ্রামে গ্রামে ছেলেমেয়েরা চেয়ে চেয়ে ভিক্ষা করে খাবার খাচ্ছে।

দিকে দিকে প্রতিরোধ

ঐ সময় গ্রামের যুবকরা লাঠি সোঁটা নিয়ে যে যার মতো গ্রামের রাস্তাঘাট পাহারা দিচ্ছিলেন আর যে যার মতো শরনার্থীদের খাবারের সাহায্যের ব্যবস্থা করছিলেন। পথে পথে গ্রামবাসীরা অসংখ্য ব্যারিকেড রচনা করে শত্রুর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

পথের বিভিন্ন স্থানে গ্রাম বাংলার সর্বস্তরের মানুষ যে ভাবে পারছে শত্রুর মোকাবিলায় প্রস্তুত হচ্ছিল। সর্বত্রই বাংলার পুলিশ, আনসার, মোজাহিদ বাহিনী রাস্তার ধারে এবং সম্ভাব্য আক্রমণের পথের ধারে ওৎ পেতে বসেছিল। ঐ সকল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের কারো হাতে সড়কি, লাঠি প্রভৃতি পথের ধারে দেখা যাচ্ছে, আজ এক সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ বাংলার স্বাধীনতার জন্য এক রাস্তায় দাঁড়িয়ে গিয়েছে।

মানিকগঞ্জে সকল ঘর বাড়ী গাড়ীতে, সরকারী বেসরকারী অফিসের গৃহে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে দেখা গিয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবক পুলিশ সবাই একযোগে এলাকা টহল দিচ্ছে।

আরিচা ফেরী ঘাটে কয়েক হাজার অসহায় মানুষের ভীড় সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঁচ- ছয় বৎসরের একটি ফুটফুটে মেয়ে, ওর সাথে প্রায় ওরই সামান একটি মেয়ে। বাচ্চা মেয়েটির সাথে যে মেয়েটি ছিল ওর ডানহাত অর্ধেক কাটা। সে-ই ফুটফুটে মেয়েটির একমাত্র সঙ্গী। ওদের সাথের ভৃত্যের সঙ্গে কথা বলার পর জানা গিয়েছে, ২৫ তারিখের শেষ রাতে হানাদার শত্রুরা মেয়েটির বাবাকে বেয়নেটের আঘাতে হত্যা করে। মেয়ের মায়ের কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি। ঐ সময় এক ফাঁকে গৃহভৃত্যটি মেয়েটিকে নিয়ে কোনভাবে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এরা দূরে কোন এক স্থানে একটু নিরাপত্তার জন্য ছুটে চলেছে। শত্রুর হামলায় হাতকাটা মেয়েটির হাত কেটে যায়। এবং এখন সে ফুটফুটে মেয়েটির একমাত্র সঙ্গী। কত লোক কোলে নিয়ে আদর করতে গিয়ে হতাশ হয়েছে। বাচ্চাটি আজ জানে– ঐ ভৃত্য এবং তার বোনই আজ এ বিশ্বে ওর সব কিছু।

রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড

গোয়ালন্দ থেকে ফরিদপুর শহরে যেতে ব্যারিকেড তৈরি হয়েছে অসংখ্য। প্রতি ব্যারিকেডের পাশেই ওৎ পেতে বসে আছে গ্রামীন মানুষ তাদের লাঠি, সড়কি নিয়ে। ফরিদপুর শহরের সর্বত্রই স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। ফরিদপুর শেখ মুজিবুরের দেশ পূর্ণ স্বাধীন। সর্বত্রই স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। ছাত্র যুবকরা গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে।

ফরিদপুরের নাড়ারটেকের লঞ্চ ঘাটেও সকল সময় ৪-৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক, পুলিশ অফিসার আর মুজাহিদ দিবারাত্র প্রতীক্ষায় আছে কখন শত্রু আসবে। কামারখালি ঘাটে ওৎ পেতে আছে আর ও ৪ হাজার মুক্তিসেনা। সবাই সশস্ত্র। বহু লোক প্রতিদিন ঢাকা হতে পায়ে হেঁটে ৫২ মাইল দূরের শহর ফরিদপুরে আশ্রয় নিচ্ছে। কামারখালি ঘাট পার হয়ে যশোহর জেলার মাগুরা শহরের রাস্তায় তৈরী করা হয়েছে ব্যারিকেড। ব্যারিকেড তৈরী করা হয়েছে রাস্তায় বিরাট বিরাট গাছ ফেলে। একস্থানে এক বিরাট কাঠের পুল লোকজন জ্বালিয়ে দিয়েছে যাতে শত্রুরা চলাচল করতে না পারে। আশপাশ থেকে পার হবার ডিঙ্গি নৌকাগুলোকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ঝিনাইদহ শহরে আসতে প্রায় আরো ৫০টি ব্যারিকেড পার হতে হয়েছে। রাস্তায় ই পি আর, আনসার, স্বেচ্ছাসেবক, মুজাহিদরা পাহারা দিচ্ছেন। বহু ই পি আর কুষ্টিয়া চলেছেন ওখানকার পাক সৈন্য ক্যাম্প দখল করতে। ঝিনাইদহ হতে যশোহরের কালিগঞ্জে আসার পথে তৈরী করা হয়েছে ৭৯টি ব্যারিকেড। রাস্তা কেটে দেওয়া হয়েছে বহু জায়গায়। পুরনো বিরাট বিরাট গাছগুলিকে কেটে ফেলে রাখা হয়েছে রাস্তার মাঝখানে। কালিগঞ্জ থানায় করা হয়েছে মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প। ওখান থেকে মুক্তি-বাহিনী ঝাঁকে ঝাঁকে গিয়ে যশোহর মিলিটারী ক্যাম্প আক্রমণ করছে। ই পি আর, আনসার এরা সবসময় শত্রু সৈন্যদের ক্যান্টনমেন্ট এলাকার চার পাশ থেকে গুলী চালাচ্ছে। ওখানে আলাপ হল ১০ জন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যের সাথে। তাদের নিকট থেকে জানা গিয়েছে যে ৩০ শে মার্চ তারা যখন খেতে বসেছিলেন তখন হঠাৎ পাক সৈন্যরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর গুলীবর্ষণ শুরু করে। পাকসৈন্যদের হঠাৎ আক্রমণে বহু বাঙ্গালী সৈন্য নিহত হয়। যে যেভাবে পারে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে এবং সাধ্যমত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়।

[“গণশক্তি”-৬ই এপ্রিল, ১৯৭১]

চট্টগ্রাম রণাঙ্গণে এগারো দিন

আগরতলা ৭ই এপ্রিল–আমরা সম্প্রতি চট্টগ্রাম যাই। আমরা চট্টগ্রামের রণাঙ্গনে এগারো দিন অবস্থান করি। চট্টগ্রামের লড়াইয়ের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি প্রত্যক্ষ করি। আমাদের এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার একটি বিবরণ নিচে দিচ্ছিঃ-

২৪শে মার্চ বিকেল ৬টায় আমরা চট্টগ্রামে পৌঁছালাম। সারা শহরে তখন উড়ছে কালো পতাকা। অফিস আদালত ছাড়া আর সব খোলা।

২৪শে মার্চ রাত তখন বারোটা।

চট্টগ্রাম জেটি। পাক সৈন্যবাহিনীর অস্ত্র ভর্তি একটি সামরিক জাহাজ তখন বন্দরে। জনতার কাছে খবর পৌঁছুল সৈন্য-সামন্ত অস্ত্র খালাসের চেষ্টা করছে। ২০ হাজার মানুষ ঘিরে ফেলে জেটি। বেসামাল সৈন্যরা কোন হুঁশিয়ারী না দিয়েই গুলী চালাল। বীরের মৃত্য বরণ করলেন ৮জন। কিন্তু জনতার অবরোধ ভাঙেনি। সারারাত চলল তাতের প্রতিরোধ। মিলিটারী অস্ত্র নামাতে ব্যর্থ হল। এই প্রথম চট্টগ্রামে জনতা বনাম সশস্ত্রবাহিনীর লড়াইয়ের সূত্রপাত। এ পক্ষে হাত লাঠি, তলোয়ার, রড, পাথর কাটার অস্ত্রাদি, আর হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের দু’হাজার স্বেচ্চাসেবীর হাতে বন্দুকও ছিল।

আর ওপক্ষ অর্থাৎ ইয়াহিয়ার বাহিনী সর্বাাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। সারা রাত সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছিল ২০ তে। আর আহত শতাধিক। রাত আড়াইটার সময় হাজার ২৫ মানুষ গোটা শহর পরিক্রমা করে। তাদের স্লোগানে নিস্তব্ধ চট্টগ্রামের রাত্রিকালীন নৈঃশব্দ ভেঙে খান খান হচ্ছিল।

২৫শে মার্চ–ভোর থেকে

ভোর থেকেই শহরের সর্বত্র মিছিল বেরুলো। সব মিছিলই সশস্ত্র। মামুলি অস্ত্রের সঙ্গে বিপ্লবী জনতার হাতে বেশ কিছু বন্দুকও ছিল। বিকেলে ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির স্বেচ্ছাবাহিনীর প্যারেড অনুষ্ঠিত হলো। দুই পার্টির স্বেচ্ছাসৈন্যের পোশাক ভিন্ন। এই সশস্ত্র কুচকাওয়াজকে গগনভেদী অভিনন্দন ধ্বনিতে জনতা বার বার স্বাগত জানিয়েছে। দুই পার্টি মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসৈন্য কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে মহিলারাও ছিলেন। জাহাজঘাটের অবরোধ এইদিনও চলেছে। শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়ার বীর পুঙ্গব বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হলো। অস্ত্র নামানো হলো না।

২৬শ মার্চ–জনতার হাতে অস্ত্র

ভোরবেলা বেতারে ঘোষিত হলো সামরিক শাসন। ইয়াহিয়ার বিশ্বাস ঘাতকতায় ক্রুদ্ধ চট্টলাবাসী জমা হতে লাগলেন রাস্তায়। আবাল বৃদ্ধ বনিতার ভেদ নেই। বেলা বাড়তে না বাড়তে রেস্ট হাউস হয়ে উঠলো বিপ্লবী জনতার অস্ত্রাগার। আওয়ামী লীগের ঝাণ্ডা টাঙানো ট্রাক, জীপ ঐসব অস্ত্র রেস্ট হাউসে পৌঁছে দিতে লাগল। আমার আন্দাজ রাইফেলের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০। বেশ কিছু গাদা বন্দুক আর সামান্য সংখ্যক হালকা মেসিনগান ও দেখেছি। কার্টিজ সংগ্রহ হয়েছিল প্রচুর। অস্ত্র বোঝাই গাড়িগুলো দেখে জনতার সে কি উল্লাস। দল নির্বিশেষে, বাছবিচার না করে প্রতিরোধকামী জনতার হাতে তুলে দেওয়া হল অস্ত্র। সশস্ত্র স্বেচ্ছাবাহিনী ট্রাকে ক্যান্টনমেন্ট দখলে অগ্রসর হলো।

রেস্ট হাউস তখন আওয়ামী লীগের কার্যালয়। ইতিমধ্যে সারা শহরের সঙ্গে হেড কোয়ার্টারের টেলিফোন যোগাযোগ সম্পন্ন। এ সময়ে ঘটনার গতি খুব দ্রুত। ই পি আর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, মুজিব বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো দখল করতে রওনা হলো। কোর্ট বিল্ডিং, সিটি কলেজ, কোতোয়ালী মুক্তি ফৌজ দ্রুত দখল করে নেয়। কিন্তু ডি সি বাংলো তখনো হানাদারদের কবলে। মহল্লার জনগণ অস্ত্র হাতে প্রহরারত। সন্ধাবেলায় বেতারে ঘোষিত হলো আওয়ামী লীগ বে-আইনী। ক্ষুদ্ধ জনতা তখন ক্রোধে ফেটে পড়েছেন। মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর থেকে নির্দেশ এলোঃ সারারাত শহর নিষ্প্রদীপ থাকবে। ঐ দিনই চট্টগ্রাম বেতার-কেন্দ্র মুক্তিফৌজ দখল করে নিল। তা থেকে নির্দেশ দেওয়া হতে লাগল।

বাবর বনাম জাহাঙ্গীর

২৭শে ও ২৮শের ঘটনা প্রায় একরকম। যে জাহাজটি অস্ত্র খালাস করতে না পেরে গভীর সমুদ্রে চলে গিয়েছিল, তার নাম ‘বাবর’। ‘বাবর’ আবার ফিরে আসার চেষ্টা করে। সে সময় নৌবাহিনীর আর একটি জাহাজ ‘জাহাঙ্গীর’ ‘বাবরকে’ বাধা দেয়। জাহাঙ্গীরে যারা ছিলেন তারা বাঙালী। এই দু’দিনে হানাদার সৈন্যরা বেতারকেন্দ্র দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তবে বিমান বন্দরটি তাদের দখলে থাকায় হেলিকপ্টার দিয়ে ওরা রসদ সরবরাহ অব্যহত রাখে। ২৮ শে খবর এলো ক্যান্টনমেন্টে জোর লড়াই চলছে।

২৯শে মার্চ–প্রতিরোধ চলেছে

বেতারকেন্দ্র দখলের জন্য হানাদাররা মরিয়া হয়ে ওঠে। মুক্তিবাহিনী মাটি কামড়ে লড়াই চালান। গোলাগুলি সমানে চলতে থাকে। সারাদিন বেতারসূচি বন্ধ থাকে। হানাদাররা ব্যর্থ হয় শেষ পর্যন্ত। শত্রুকে বিপর্যস্ত করে দিতে আওয়ামী লীগের নির্দেশে জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমি যে জায়গায় সেদিন আস্তানা গেড়েছিলাম, সেখান থেকে সারাদিন গুলীগোলার আওয়াজ ভেসে আসে। রাতে দেখলাম জেটি দাউ দাউ জ্বলছে। ২৫শে মার্চ রাত্রি থেকে আরম্ভ হয়েছে বাংলা দেশের মানুষের উপর ইয়াহিয়ার ফৌজী আক্রমণ। ২৫শে মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত কত লক্ষ মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারেন এই মুহূর্তে অনুমানসাপেক্ষ। সারা বাংলাদেশ জুড়ে যেভাবে আক্রমণ চলছে এবং যে তীব্র উন্মাদনার সঙ্গে কোটি কোটি মানুষ বিজয় অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সামরিক বাহিনীর গতিরোধ করে, সেই ক্ষেত্রে ৫-৭ লক্ষ মানুষের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আদৌ অবাস্তব এবং অবিশ্বাস্য নয়। ৩১শে মার্চ রাত্রিতে কলকাতায় বিভিন্ন সূত্র থেকে যে সংবাদ এসেছে, তাতে জানা যায় ৭ লক্ষ মানুষ মাত্র ৭ দিনের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

এই ৭ লক্ষ মানুষের মৃত্যুসংবাদের পরে আরও যে সংবাদ সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানুষের সামনে বিভীষিকার চিত্র তুলে ধরেছে, তা হল প্রায় সারা বাংলা দেশ জুড়ে ইয়াহিয়ার বিমান এখন অবিরাম বোমা বর্ষণ করে চলেছে। এই বোমার আক্রমণে কত মানুষ নিহত হয়েছেন, তার কোন সংবাদ নেই। বাংলাদেশের বিদ্রোহী মানুষের বিশ্বাস এ সংখ্যা অগন্য, অপরিমিত।

প্রায় ৩০মে মার্চ নাগাদ ইয়াহিয়ার বিমানবাহিনী বোমা বর্ষণ শুরু করেছে। এই বোমার সঙ্গে আছে শত শত নাপাম বোমার বীভৎস অভিযান। মানবিকতার সমস্ত আবেদন পদদলিত করে পাক প্রেসিডেন্ট ফৌজী নায়ক ইয়াহিয়া খান তাঁর মার্কিন মহাপ্রভুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করছে নাপাম বোমার আগুনে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে নাপাম বোমা দিয়ে ভিয়েতনামের লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর বীভৎস আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে–সেই নাপাম বোমাই আজ ইয়াহিয়ার হাতের অস্ত্র।

সুতরাং ৩১শে মার্চ পর্যন্তই যদি ৭ লক্ষ মানুষ নিহত হয়ে থাকেন তবে আর কত প্ৰাণ পরের দিনগুলিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? এ সংখ্যা গণনাতীত।

শুধু হত্যাভিযানের মধ্যেই ইয়াহিয়ার ফৌজ নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি। নারকীয়তার শেষ পর্যায় শুরু করেছে ইয়াহিয়ার ফৌজ। রাশি রাশি রিপোর্ট আসছে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে–যেখানেই ইয়াহিয়ার ফৌজ আক্রমণ চালানোর সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই করছে নারী অপহরণ বলাৎকার এবং সর্বশেষে তাদের ঘৃণ্য কাজের সাক্ষ্য প্রমাণ লোপ অর্থাৎ নিপীড়িতনারীদের নৃশংসভাবে হত্যা। ২৫শে মার্চ সেই তমসাঘন রাত্রিতে নৃশংস অভিযানের কথা কেউ ভুলতে পারে না। ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হেস্টোল আক্রমণ করে ৪০০ ছাত্রীকে তারা অপহরণ করে নিয়ে চলে গেল। কত বয়স সেইসব ছাত্রীদের? উনিশ, কুড়ি একুশ কিংবা বাইশ। সেই ছাত্রীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াই করার জন্যে অস্ত্র শিক্ষাও গ্রহণ করে ছিল। ইয়াহিয়া ফৌজের বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব তারা লড়েও ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারল না। ইয়হিয়ার ফৌজ পৈশাচিক উল্লাস ঘোষণা করে তাদের নিয়ে গেল নিজেদের শিবিরে এবং পরবর্তী ঘটনা তমসাঘন রাত্রির থেকে কালিমাময় কলঙ্কিত। সেই ৪০০ ছাত্রীকে নিয়ে চলল জানোয়ারদের নৃশংস নারকীয় উল্লাস। ঐ ছাত্রীদের তারা বলাৎকার করল সেইদিন, তারপর দিন তারও পরের দিন। তারপর দেশাত্মবোধে উৎসর্গীকৃত যে ছাত্রীরা শত্রুপ্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইয়াহিয়ার বুলেটে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল আক্রান্ত স্বাধীন বাংলার মাটি থেকে। ৪০০ তরুণী ছাত্রীর জীবন নিঃশেষ হয়ে গেল সত্য কিন্তু সেই নির্যাতিতা ছাত্রীদের বেদনাগাথা ফৌজী নায়ক ইয়াহিয়া খানকে আর একবার ঘৃণিত খুনী হিসাবে চিহ্নিত করে দিল।

নারী লাঞ্ছনা, নারী ধর্ষণের ঘটনা কেবলমাত্র ঢাকার ছাত্রী হোস্টেলেই সীমাবদ্ধ থাকল না। আক্রমণকারী ফৌজদের এই পৈশাচিক অত্যাচারের বিবরণ এলো রংপুর থেকে; খুলনা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, শ্রীহট্ট এবং বাংলাদেশের শহরাঞ্চলগুলির এক প্রান্ত থেকে আর এক প্ৰান্ত পর্যন্ত।

মানুষ ভুলতে পারেনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ইয়াহিয়ার গোলাবর্ষণের কথা। ২৫শে রাত্রিতে ইয়াহিয়ার গোলন্দাজ বাহিনী কামানের গোলাবর্ষণ করল বহু গৌরবের স্মৃতি বিজড়িত ইকবাল হল আর জগন্নাথ হলের উপর। প্রায় ৮০০ ছাত্র ইয়াহিয়ার সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আত্মাহুতি দিল। ২৭শে মার্চ-এর মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার সংগ্রামী যোদ্ধা নিহত হল ঢাকার রাজপথে।

ঢাকার ওপর দিয়ে উড়ে আসা কয়েকটি বৈদেশিক বিমানের কাছে জানা গেল ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহের স্তূপ জমে আছে। পরবর্তী সংবাদে জানা গেল ২৬-২৭শে মার্চ পাক-ফৌজ বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীকে হত্যা করে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দিল।

কুমিল্লা, রংপুর, শ্রীহট্ট, রাজশাহী কুষ্টিয়া ইত্যদি শহরের অধিবাসীদের উপর চলল অকথ্য অত্যাচার।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বানবতাবর্জিত সিদ্ধান্তের ফলে হিরোসিমায় আনবিক বোমার আঘাতে নিহত হয়েছেন প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ।

কিন্তু আজ? একথা অবধারিত সত্য যে, আক্রমণ আরম্ভের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশে যতো মানুষ নিহত হয়েছেন সে সংখ্যা হয়তো হিরোশিমার হত্যাকাণ্ডের চেয়েও বেশি। নাগাসাকিতেও নিহত হয়েছিলেন অনুরূপ সংখ্যক মানুষ। এখনো পর্যন্ত যে আক্রমণ বাংলাদেশের মানুষের উপর চলছে হয়তো হিরোসিমা ও নাগাসাকির হত্যাকাণ্ডের মিলিত সংখ্যার চেয়েও ইয়াহিয়ার আক্রমণে নিহত মানুষের সংখ্যা ছাপিয়ে যাবে আক্রান্ত স্বাধীন বাংলাদেশে।

[দেশহিতৈষী–৯ই এপ্রিল, ১৯৭১]

পত্রিকায় প্রকাশিত “মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশ” নিবন্ধের একটি অংশ তুলে ধরছিঃ “বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন বিল্ডিং জ্বলছে দাউ-দাউ করে। ধোঁয়া আর আগুন ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। শত্রুর মর্টারের গোলায় ধ্বসে গেছে মেইন বিল্ডিং, উড়ে গেছে মধুর ঐতিহাসিক ক্যান্টিন। ঐ মধুর ক্যান্টিনে বসেই মুজিবুর রহমান, গাজীউল হক, অলি আহাদ তোয়াহারা একদিন ভাষা আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিলেন। ওখানেই জন্ম নিয়েছিল ‘৬২, ‘৬৬ এবং ‘৬৯ সালের গণ-আন্দোলন। ওই ক্যান্টিনের সঙ্গে মতিয়া চৌধুরী রাশেদ খান মেনন, তোফায়েল আহম্মদ, সাইফুদ্দিন মানিক, জামাল হায়দার, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আরও অনেক অনেক বাংলা মায়ের বীর ছেলেমেয়ের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে শেখ মুজিব থেকে শুরু করে অসংখ্য নেতার আমাদের অনেক সকাল, দুপুর,সন্ধার স্মৃতি জড়ানো ঐ ক্যান্টিন আর নেই। বর্বর দস্যুর গোলায় নিশ্চহ্ন হয়ে গেছে সেটি। রকেট ছুঁড়ে অগুন লাগিয়ে দেওয়া হল সর্বত্র। সৈন্যরা বেশ কিছুক্ষণ লড়াই-এর পর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন ছাত্রাবাসে ঢুকে পড়ল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা ঘেঁসে রাস্তার কাছেই মধুর ক্যান্টিন। ওই ক্যান্টিন গুঁড়িয়ে দিয়ে ট্যাংক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ট্যাংক থেকে গোলা ছুটছে রাত্রির অন্ধকারের বুক চিরে। বিশ্ববিদ্যায়ের আটশো ছেলে লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিল। দিন কয়েক থেকে ওখানেই থাকত। তাদের সঙ্গে থাকত তাদের প্রিয় অধ্যাপকরাও।

যারা তখনও বেঁচে ছিল, সৈন্যরা ভিতরে ঢুকে নির্বিচারে গুলি করে মেরেছে তাদের। অধ্যাপকদের আবাস স্থানে ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে ডঃ জি সি দেব, ডঃ জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর, ডঃ এম. মনিরুজ্জমান মিয়া, এবং আরো কয়েকজনকে। এঁরা অনেকেই বিভাগীয় প্রধান। সার্জেন্ট জহিরুল হক হলের (সাবেক ইকবাল হল) একজন সেই রাত্রে কোনমতে পাকিস্তানী সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে পালিয়ে এসেছে জীবন নিয়ে। অধ্যাপকদের সার করে দাঁড় করিয়ে স্টেনগানের গুলীতে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে। অধ্যাপকদের পরিবারের লোকেরাও রেহাই পান নি। ঘুমন্ত শিশুদের বিছানায় মেরে রেখে চলে গেছে। এমন অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে আছে বলে মনে হয় না। জনৈকা বিদেশিনী এক পাক-অফিসারকে জিজ্ঞাসা করেছিল তোমরা নিষ্পাপ শিশুদের মারছ কেন? সৈনিকটি জবাব দিয়েছেঃ না হলে যে – ওরাই একদিন তাদের মায়ের, ভাইয়ের, বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে।

সৈন্যবাহিনী সেরা সেরা অধ্যাপকদের হত্যা করেছে। ইয়াহিয়ার অভিমতঃ মুজিবকে মদত দিচ্ছে অধ্যাপক ও ছাত্ররা, তারাই হলেন পুর্ব বাংলার সমস্ত গণ-আন্দোলনের অগ্রপথিক। তাদের নিশ্চিহ্ন করতে পারলে ভবিষ্যতে পূর্ব-বাংলায় আর গণ-আন্দোলন দেখা দেবে না। দর্শন বিভাগের প্রধান ডঃ গোবিন্দ দেবকেও ওরা হত্যা করেছে। হায়, বাংলাদেশের কতো মনীষী শেষ হয়ে গেল বর্বর দস্যুর বুলেটের আঘাতে।

এখানে Blitz পত্রিকায় প্রকাশিত Mr. A Sanders -এর একটি বিবরণীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে বর্বর ইয়াহিয়া দস্যুদের যে নির্মম, যে নিষ্ঠুর অত্যাচারের চিত্র ধরা পড়েছে তা হুবহু তুলে ধরা হলঃ

I am one of the British businessman who left East Pakistan on April 2, 1971, enroute to the U. k. I thought it my duty to convey to Blitz this eye-witness account of the sandistic, sex-driven and brutal torture of the girl students living at Rockeya Hall of Dhaka University.

RAPES

It was around 5 p.m. when about 350 to 400 Pakistan troops attacked the hall. They entered all the rooms lodging the girls and dragged them out, tearing off their clothing one by one as they were being pulled and manhandled.

There was panic, and shrieks could be heard. Saris, skirts, salwars were ripped one and flung aside. Next blouses, khameezes and brassieres were torn of, and the girls were physically lifted off by their breast or hair…some held upside down,

As they tried to cover their shame with their hands, the troops kicked them on their private parts with their heavy boots, punched them with their fists, some even bayoneted the delicate puble porttions, blood trickline therefrom.

SUICIDES

Next come the raping. The girls were pinned down to the floor face upwards, legs mercilessly pulled apart and fully stretched. . . then finally the brutal act of raping.

:

The girls cried, shrieked and struggled, but the beastly soldiers went on raping. Blood ran as one after another, each girl was raped successively by 10 to 12 beasts. Most of them fell unconscious as the troops departed after satisfying their devilish lust.

The girls were in such a condition that they could not even cover up their bodies.

They were so badly mutilated–breasts bitten off, private parts torn by the forceful thrust of the fist and kicking with boots. throats throttled when where was some resistance.

It was at this juncture that 50 brave girls jumped to their death from the hall instead of falling into the hands of the barbarians.

Particularly pathetic was the fate of a 12 year old girl who had come to see one of the students in the college, This juvenile breathed her last as a brutal Pathan sepoy assaulted her. The girls gave a pitiful shriek and never came to her senses, but the brute went on mating her till he reached his climax, and when he finished gave a brutal kick with his boot on her puble region, By then, the girl had died. Blood was flowing as if from a lap.

SODOMY

The worst came when some of the Pathans resorted to sodomy with the grown up girls. They simply swooned due to pain. Most of their rectums got torn and were bleding profusely. Still the devils did not leave them.

The assault upon the Rockey Hall happens to be one of a dozen similar brutalities known to have comitted on woman and children by the Punjabi and Pathah troops in Dacca.

I happend to get all the details because an associate’s daughter was involved in this vulger and violent attack. He happens to be a Muslim and a law-abiding subject of Pakistan. but after her has sworn to avenge her on every Punjabi or Pathen he can lay hands on.

SADISTIC

Why have president Yahya Khan and his Government brought this calamity on their heads? Neither I nor my colleagues can guess the answer.

I am sure, you,as a brave Editor, will publish this account of the horrid scene. I have tried to minimise the horror. In fact, I never expected that the Pakistani troops were so sex-crazy, sadistic, barbaric and brutal.

“পূবের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে
আলোকে আলোকময়
জয় জয় জয় বাংলা–
ঘুম পাড়ানী মাসি পিসি
বেরিয়ে এস সবে,
বর্গী যদি আসেই তাদের
তাড়িয়ে দিতে হবে।
বুলবুলিকে ধান দেবো
আদর সোহাগ করে,

যে যখন যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁদের কাছে গেছি, শুনেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত, শুনেছি মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব-কাহিনী, আর শুনেছি যাঁর আহ্বানে সাত কোটি বাঙ্গালী সর্বস্ব পণ করে স্বাধিকারের লড়াইয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সেই মহান নায়ক মুজিবের কাহিনী।

বাংলাদেশে যা ঘটেছে সেটা বিগত চব্বিশ বৎসরের ইতিহাসের ধারা যে গতিপথে এগিয়ে এসেছে, বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ হলো সফল পরিণতি। ধর্মের ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না। এই বিজ্ঞানকে অস্বীকার করেই পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু বিজ্ঞানের স্বাভাবিক গতি কোন যুক্তি, মানবতাবোধ অথবা কোন উচ্ছ্বাসে রুদ্ধ হতে পারেনা। অবৈজ্ঞানিক কোন ঘটনা সাময়িকভাবে ঘটলেও সেটা চিরস্থায়ী হয়না। পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল এমনি অবৈজ্ঞানিক মানবিকতা ও আবেগের মধ্যে দিয়ে, তাই আজ ধর্মের নামে গঠিত যে পাকিস্তান রাষ্ট্র সেই রাষ্ট্র থেকে ধর্মীয় আবরণ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে তার মধ্যে দিয়ে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় অবশ্যম্ভাবী। তাই ভুট্টো, ইয়াহিয়া খাঁ, টিক্কা খাঁ অথবা এদের চেয়ে আরো বড় কোন অস্ত্রের শক্তিতে বিশ্বাসী ব্যক্তি যদি শুধুমাত্র বন্দুক, বেয়নেট দিয়ে ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে চান সে চেষ্টায় তাঁরা ব্যর্থ হবেন।

ব্যর্থ যে হবেনই তার নজির অনেক দিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধে সেটা আরও প্রকট ভাবে ধরা পড়ল। ইয়াহিয়া খাঁ বা তার সাংঙরা ভালভাবেই সেটা বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেই কারণেই বাংলাদেশের মানুষকে নির্মম ও নিষ্ঠুর ভাবে হত্যায় তাঁরা এত বেশী আগ্রহী। এই ধ্বংসলীলার ব্যাপকতা কতটা আজ পর্যস্ত নির্ণয় হয়নি; তবে ইতিমধ্যে এই সত্য প্রমাণিত হয়ে গেছে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দমনে ইয়াহিয়া খাঁ যে অমানবিক পথ গ্রহণ করেছে তা বিগত বিশ্বযুদ্ধে নাগাসাকি-হিরোসিমাতে অ্যাটম বোমা বর্ষণের নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছে এবং ভিয়েতনামে মাইলাই এর কলঙ্কজনক ঘটনার ইতিবৃত্তিকে ম্লান করে দিয়েছে। নাগাসাকি-হিরোসিমাতে বোমা বর্ষণে পাঁচ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খাঁ চক্র তার চেয়ে অনেক বেশী মানুষকে খুন করেছে। মাইলাই-এর কলঙ্কজনক ঘটনায় মাত্র একটি গ্রামের কিছু মহিলা কিছু সংখ্যক মার্কিন দস্যুদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খাঁর বর্বরতা চমুরা শত শত মাইলাই-এর নজির স্থাপন করেছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচারের হাত থেকে বাংলাদেশকে কি রক্ষা করা যেতো না? আমাকে প্রশ্ন করেন ইয়াহিয়া খাঁর সঙ্গে মুজিব আলোচনায় বসে এত সময় দিলেন কেন? আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, এই ভাবে নিরস্ত্র মানুষদের যুদ্ধবাজ নেকড়ের থাবায় ফেলে দেওয়া অদূরদর্শিতার কাজ হয়েছে। এই কথাগুলির জবাব আছে। প্রথম কথা হলো শেখ মুজিবুর রহমান পরিষদীয় রাজনীতির প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়মনিষ্ঠার সাথে মেনে চললেন। কিন্তু ভুট্টো-ইয়াহিয়া খাঁ চক্র যখন তাদের নির্দেশিত ফর্মান তাঁরা নিজেরা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন (যেমন নির্বাচনের পর জাতীয় পরিষদ গঠিত হবে। জাতীয় পরিষদ একশত ২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনা করবেন। নির্বাচনে যাঁরা সংখ্যাধিক্য লাভ করবেন তাঁরা সরকার গঠনের সুযোগ পাবেন–এই সব নিয়ম নীতি, পুর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেন ইয়াহিয়া ও ভুট্টো চক্র।) তখন শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে কোন পথ খোলা ছিল না। তিনি কি কেন্দ্রে ভুট্টোকে সরকার গঠন করতে দেবেন, না তিনি কি পূর্ব পাকিস্তানে নুরুল আমিনকে সরকার গঠন করতে দেবেন। সেটা সম্ভব ছিল না। তাই শেখ মুজিব ডাক দিলেন অসহযোগ আন্দোলন। নির্বাচনের মাধ্যমে একবার প্রমাণিত হলো দেশের মনুষ শতকরা একশত জনই মুজিবুর রহমানের পক্ষে এবং ইয়াহিয়া খাঁ নিজের বিশ্বস্ত জন ভেবে তাদের হাতে বন্দুক তুলে গিয়েছেন তাঁরাও পর্যন্ত কেউ ইয়াহিয়া খাঁর পক্ষে নয়। তাই তো অনেক আগে থাকতেই ইয়াহিয়া খাঁ চক্র বাঙ্গালী সশস্ত্র বাহিনীকে নিরস্ত্র করবার প্রচেষ্টায় তৎপর হয়েছিল। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলনে যা হলো তার কোন নজির নাই, তার কোন তুলনা নেই; ভারতবর্ষে গান্ধীজীর নেতৃত্বে সংগঠিত অসহযোগ আন্দোলন মুজিবের নেতৃত্বে আন্দোলনের কাছে, শুনতে খারাপ শোনালেও, খুবই নগণ্য মনে হয়। একজন চাপরাশী থেকে আরম্ভ করে সর্বোচ্চ বিচারপতি পর্যন্ত অথবা একজন চৌকিদার থেকে আরম্ভ করে পুলিশ প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর সর্বপ্রধান আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। এমন অসহযোগ আন্দোলন কখনো হয় নি, কখনো কেউ দেখে নি, যার কোন নজির অতীতে কোথাও নেই।

জনমতকে যদি সামরিক শক্তি দিয়ে পর্যুদস্ত করবার পথ বেছে নেওয়া হয় তবে নিরস্ত্র জনগণের সাময়িক পরাজয় অথবা পশ্চাদপসারণ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই সঙ্গে শুধু লোকসানই হয় না, লাভও কিছু হয়। সেই লাভ হলো দুঃখের অন্ধকারে বন্ধুকে চেনা যায়, আর সেই সঙ্গে স্বাভাবিক সময়ে নানা উচ্চমার্গের বাতচিতের স্বরূপ ধরা পড়ে। ভারত-বিদ্বেষ ও দ্বিজাতিতত্ত্বের অন্ধ-উন্মাদনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক দর্শনে পাকিস্তান কখনই একটি রাষ্ট্রের রূপ গ্রহণ করতে পারে না; অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে কখনো কোন রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে না। আবার শুধুমাত্র বিদ্বেষ ভিত্তি করেও কোন রাষ্ট্রের পক্ষে স্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়। কাজেই পাকিস্তান বলে কোন রাষ্ট্র যে ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে ও বর্তমানে অছে, তা কখনো চিরস্থায়ী হয়না। তার অর্থ এই নয় পাকিস্তান রাষ্ট্রটি রাতারাতি ভারতের সঙ্গে মিলে যাবে। তার অর্থ হলো এই যে বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের দর্শন ও কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবেই। বাংলাদেশে শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে যে অভ্যুত্থান ঘটল সেটা হলো এই রাষ্ট্র-কাঠামোর পরিবর্তনের বহিঃপ্রকাশ। তাই দেখা গেল ইয়াহিয়া বাহিনী যখন বিশ্বের ইতিহাসে অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করে নৃশংস হত্যালীলা চালিয়ে পাকিস্তানের মানুষের স্বাভাবিক দাবীকে দাবিয়ে দিতে চাইল তখন কিন্তু গত পঁচিশ বছর ধরে যে ভারত-বিদ্বেষের হিষ্টিরিয়া সৃষ্টি করেছিল তা উবে গেল। বাংলাদেশের মানুষ আশ্রয়ের জন্য, নিরাপত্তার জন্য ভারতবর্ষে চলে এলো। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ভারতে এসে যখন দাঁড়াল তখন কিন্তু ভিন্ন রাষ্ট্রে বা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিচারে শত্রুরাষ্ট্রে এলো–সে কথা ভাবল না।

শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে, তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও দর্শন সম্পর্কে আমি আমার নিজের কোনো ভাষ্য এই বইতে উপস্থাপনের চেষ্টা করিনি। আমি শুধু পাকিস্তান সৃষ্টি ও তৎপরবর্তীকালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মধারার বিবরণ তুলে ধরেছি। একটি প্রশ্ন এই গ্রন্থ লিখবার সময় বারে বারে উঠেছে নানা মহল থেকে। সে প্রশ্ন হলো মুজিবুর রহমান কেন পঁচিশ বা ছাব্বিশ মার্চ ইয়াহিয়া বাহিনীর কাছে ধরা দিলেন বা পড়লেন কেন? তার জবাব হলো এই কাজও মুজিবুর করেছেন দেশবাশীর প্রতি তাঁর প্রবল প্রেম ও মানবতাবোধ থেকেই। মুজিবুর চাননি তিনি নিরাপদ দূরত্বে বেঁচে থাকবেন। তাঁর স্ত্রী- পুত্র নিরাপদে থাকবে আর ঢাকা বা বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইয়াহিয়া বাহিনীর কাছে চরম নির্যাতন ভোগ করবে। তাই তাঁর বক্তব্য ছিল সকলের ভাগ্যে যা ঘটবে তাঁর ভাগ্যেও তাই ঘটবে। তাই তিনি পলায়নের পথ গ্রহণে স্বীকৃত হননি। সেখানেও তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল তাঁকে না পেলে ইয়াহিয়া বাহিনী মানুষকে অরো বেশী নির্যাতন করবে। তাঁকে খুঁজে পেতে ও দিতে আরো মানুষের মৃত্যু ঘটাবে। এছাড়া মুজিবুর একটি কথা ১৯৬৬ সাল থেকে বলে এসেছেন, “আমি থাকি বা না থাকি, আমি বেঁচে থাকি বা মরে যাই, তাতে আন্দোলনের কোন পরিবর্তন হবে না।” এছাড়া আরো একটা কথা আছে। শেখ মুজিবুর যদি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসতেন তাহলে ভারতের বিরুদ্ধে প্রচারে পাকিস্তানের হাতই শক্ত হতো। লোকে বলতো লক্ষ লক্ষ লোককে মৃত্যুর মুখে ফেলে মুজিবুর পালিয়ে গেছে। স্ট্রাটেজির দিক থেকে মুজিবুরের আত্মগোপন যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন ভবিষ্যৎ আন্দোলনের পক্ষে সেটা কোন মহৎ নজির হতো না। মুজিবুরের রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে দর্পণ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধ তুলে ধরছি। শুধু এই নিবন্ধ নয়, অন্য আরো বহু ঘটনা ও নজিরে দেখা যায় শেখ মুজিবুর রহমান হলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সার্থক উত্তরাধিকারী ও জীবনদর্শন অনুসরণকারী।

“ছাত্রাবস্থায় শেখ মুজিবুরের রাজনীতিতে হাতেখড়ি কলকাতায় নেতাজী সুভাষচন্দ্ৰ বোসের কাছে। তাঁর বয়স তখন মাত্র সতের। তখন থেকে মুজিবুর কলকাতার বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন এবং নেতাজী এবং শ্রদ্ধেয় শরৎ বসু মহাশয়ের অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠেন। তখন ত্রিশ দশকের মাঝামাঝি এবং নেতাজী তখন স্বদেশ ও বিদেশের ছাত্র সংঘঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য।

মুজিব নেতাজীর এই সাংগঠনিক প্রস্তুতির অবস্থায় তাঁর সান্নিধ্যে আসেন। উনিশ’শ তেত্রিশ সালে নেতাজী তাঁর মৌলিক রাজনৈতিক দর্শন উপস্থাপিত করেন লণ্ডনে এক ছাত্রসভায়। বক্তৃতার বিষয় ছিল, “সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম এবং সাম্যবাদ।” এই বক্তৃতায় ভারতের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক হওয়া সত্ত্বেও আপসমুখী নেতৃত্বের জন্য কিভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে তার এক বিরাট ইতিবৃত্ত নেতাজী তুলে ধরেন।

মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত অহিংসা ও অসহযোগ আন্দোলনের অবশ্য বিরোধী তিনি ছিলেন না। কিন্তু নেতাজী আন্দোলনের স্তর উন্নয়ন সম্পর্কে এক সুচিন্তিত পরিকল্পনা সভায় উপস্থাপিত করেন। তিনি আন্দোলনে সাফল্যের জন্য ৪টি প্রাথমিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।

১। সরকারের কর এবং অন্যান্য রাজস্ব আদায় সম্পূর্ণ বানচাল করার ব্যবস্থা।

২। সরকারী প্রশাসন, পুলিশ এবং সম্ভব হলে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে জাতীয় আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি সৃষ্টির প্রচেষ্টা করা–যাতে আন্দোলন দমন করার সরকারী নির্দেশ কার্যকরী না হয়।

৩। আন্দোলন চলাকালীন সরকারের সংকটময় মুহূর্তে সমস্ত সরকারী সরবরাহ-খাদ্য, অর্থ, অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য সব কিছু বিচ্ছিন্ন করার জন্যে সুসংগঠিত ব্যবস্থা। এবং (৪) পর্যাপ্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সশস্ত্র প্রচেষ্টা।

নেতাজী তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, প্রথম তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে সরকারী প্রশাসন যন্ত্র ছন্নছাড়া হয়ে যাবে আর সরবরাহ ব্যবস্থা বানচাল হওয়ার ফলে আন্দোলন জয়ের পথে এগিয়ে যাবে। এই বক্তৃতায় নেতাজী ঠিক কোন স্তরে বিপ্লব সশস্ত্র আকার নেবে তার কোন উল্লেখ করেননি। শুধু তিনি বলেছেন, গান্ধীজীর নেতৃত্বে বিপ্লব ঠিক পূর্বোক্ত পথে এগোয়নি, তা ব্যর্থ হয়েছে।

মুজিবুর রহমানের কাছে নেতাজীর এই বক্তৃতা প্রথম রাজনেতিক জ্ঞান উদয়ে সাহায্য করেছিল এবং এবারের পূর্ব বাংলার মুক্তি আন্দোলন সংগঠনে তার প্রথম রাজনৈতিক দীক্ষার ছাপ সুস্পষ্ট। প্রথমেই মুজিব আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থির হয় সরকার তাঁর ৬ দফা দাবী মেনে নিক, অন্যথায় তাঁর সংগ্রাম আপোসহীন। আন্দোলনের কৌশল অবশ্যই অহিংস–অসহযোগ, কিন্তু হিংস্র আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি তাঁর বক্তৃতায় অনেকদিন থেকেই বলে আসছেন। আক্রমণ হিংস্র এবং বিভৎস পর্যায়ে যেতে পারে এ ধারণা তাঁর এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ছিল। এবং সেই অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সাংগঠনিক প্রস্তুতিও করেছেন লীগ নেতারা।

মার্চ মাসের দু’তারিখ হতে অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম পর্যায় চলে মার্চ মাসের চৌদ্দ তারিখ পর্যন্ত। তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায় এবং শেখ মুজিবুর ঘোষণা করেন তাঁর ৩৫ দফা নির্দেশ। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ

“বীরত্বপূর্ণ গণ-সংগ্রাম এগিয়ে চলেছে। পৃথিবীর অন্যান্য জাতি যারা স্বাধীনতার জন্যে জীবনপণ সংগ্রাম করেছেন তারা যেন আমাদের সংগ্রামকে বিশ্ব-জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসাবে মনে করেন। বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রমাণ করেছে কিভাবে তাঁদের সংগ্রামী ঐক্য ও দৃঢ়তা পাশবিক শক্তির দ্বারা স্বাধীনতাকে যারা নিস্পিষ্ট করতে চায় সেই ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের শক্তিশালী দুর্গে পরিণত করতে পারে। আজ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ–পুরুষ মহিলা এবং এমন কি শিশুরা পর্যন্ত উন্নত শির। নগ্ন হিংসা দিয়ে যারা মানুষকে অবদমিত করতে চেয়েছে তারা আজ পর্যুদস্ত। সরকারী ও অফিস কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক-কৃষক ও ছাত্র, বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ নিশ্চিতভাবে ঘোষণা করেছে যে তারা আত্মসমর্পণের পরিবর্তে আত্মদানে প্রস্তুত।”

“বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করা যাবে না। আমরা অজেয়, কারণ প্রয়োজন হলে আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত–যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা স্বাধীনতা ও সম্মানের সঙ্গে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে বাঁচতে পারে। তাই আমাদের সংগ্রাম নতুন উদ্যমে উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত এগিয়ে যাবে। যে কোন আত্মত্যাগের জন্য আমি মানুষকে প্ৰস্তুত থাকতে আবেদন জানাই এবং আন্দোলনকে হিংসার দ্বারা দমন করার সমস্ত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।”

শেখ মুজিবুর পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রীরূপে একবার জাপান পরিদর্শনে যান। জাপানে গিয়ে মুজিবুর দেখলেন অনেক কিছু, কিন্তু সেই সঙ্গে দেখতে গেলেন জাপানের উপকণ্ঠে রেনকোজী মন্দির। যেখানে রয়েছে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের তথাকথিত চিতাভষ্ম। রেনকোজী মন্দিরে একখানা মন্তব্য লিখবার খাতাও রয়েছে যে খাতায় দেশ বিদেশের সুধিজনেরা তাঁদের মন্তব্য লিখে রেখে আসেন। সেই মন্তব্য খাতায়, স্বর্গত পণ্ডিত জহওরলাল নেহরুরও মন্তব্য লেখা রয়েছে। নেহরুজী লিখেছেন “বুদ্ধের ভাবমূর্তি সর্বজনে বিরাজ করুক।” নেতাজীর চিতাভষ্ম দেখতে গিয়ে পণ্ডিত নেহরুর কিন্তু একবারও নেতাজীর কথা মনে পড়লো না। তিনি লিখলেন বুদ্ধের কথা। আর-সেই খাতায় শেখ মুজিবুর লিখলেন “নেতাজী হলেন অখণ্ড ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা যার নেতৃত্বে কোন গলদ ছিল না এবং একমাত্র তাঁর দ্বারাই সম্ভব হত অখণ্ড ভারতের মুক্তিসাধনা। হে নেতাজী লহ প্রণাম।” নেতাজীর চিতাভষ্ম সমীপে উপস্থিত হয়ে মুজিবুরের বারে বারে মনে পড়েছে অখণ্ড ভারতের কথা, মনে পড়েছে নেতাজী থাকলে ভারত বিভাগ হয়ত হত না। মুজিব বুঝি নেতাজীর অসমাপ্ত কার্যই করতে চেয়েছিলেন, তাই নিজের জীবন দর্শন প্রবাহিত করেছিলেন নেতাজীরই ভাবাদর্শে। নেতাজী আর মুজিবের চোখে বাংলাদেশের রূপ ছিল অভিন্ন।

বিশ্বকবির সোনার বাংলা
নজরুলের এই বাংলাদেশ
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা
নেইকো তার রূপের শেষ।
জয় হিন্দ–জয় বাংলা–

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *