আমি মুজিব বলছি – ৭

জুলুম প্রতিরোধ দিবসে চট্টগ্রামে পুলিশের গুলী চালনা

প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের হুঁশিয়ারী এবং সরকার পক্ষের সবরকম প্রস্ততি ও তৎপরতা সত্ত্বেও ১৩ই ডিসেম্বর’ ৬৮ সারা পূর্ব পাকিস্তান সাফল্যজনক ভাবে জুলুম বিরোধী দিবস পালন করে। যদিও আমরা পূর্ব পাকিস্তানের নিকটতম প্রতিবেশী এবং সীমান্তের এপার থেকে ঢিল ছুঁড়লে ওপারে পড়ে, তবুও সংবাদ আদান-প্রদানের এত কড়া ব্যবস্থা রয়েছে যে সঠিক সংবাদ সংগ্রহ করা খুবই কষ্টসাধ্য। দ্রুত সংবাদ সংগ্রহের আমাদের একমাত্র উৎস রেডিও পাকিস্তান। এবং রেডিও পাকিস্তানের স্বরূপ কারোরই অজানা নয়। আয়ুব সরকারের গুণগান তোষণই তার একমাত্র কাজ। সেই রেডিও পাকিস্তান যে সংবাদ পরিবেশন করে তা প্রতিরোধে জনসাধারণের দৃঢ়তা সহজেই অনুমান করা যায়।

দুদিন গুলী

আয়ুব খানের ঢাকায় অবস্থানের কয়েক দিনের মধ্যে জনসাধারণের বিক্ষোভ দমনে পুলিশকে দুদিন গুলী চালাতে হয়েছে। এর আগে ঢাকায় গুলীবর্ষণে অন্তত পক্ষে দুজন নিহত হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত শহরের সর্বত্র সামরিক বাহিনী সঙ্গিন উঁচিয়ে শান্তিরক্ষা করছে। তৎসত্ত্বে ও সাতটি বিরোধী দিবস পালনে সামরিক বাহিনীর সঙ্গিন উপেক্ষা করে সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন। সংবাদে প্রকাশ সরকার সামরিক বাহিনীর সহায়তায় যানবাহন চালু রাখার চেষ্টা করলে–জনতা শহরের বিভিন্ন স্থানে ১২ খানার বেশী গাড়ি পুড়িয়ে দেয় বা নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ঢাকায় সংলগ্ন শ্রমিক এলাকা নারায়ণগঞ্জ থেকেও জনতা পুলিশের নানা ধরনের সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রামে গুলী চালনা

এইদিন সবচেয়ে গুরুতর ঘটনার সংবাদ আসে চট্টগ্রাম থেকে। এখানে পুলিশ কর্তৃক জনতার উপর দু’বার গুলি চালনার ফলে অন্ততপক্ষে ১৫ জন ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়েছেন। অন্যত্র জনতা ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ কাঁদানো গ্যাস প্রয়োগ করে। সকালের দিকে জনতা যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরী করতে পুলিশ লাঠি চালনা করে জনতা ছত্রভঙ্গ করে এবং বাস্তব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে। রেডিও পাকিস্তানের সংবাদ অনুসারে জনতা একটা ট্রেন আক্রমণ করলে পুলিশ গুলী চালনা করে।

গভর্নর মোনেম খানের হুঁশিয়ারী

আগের দিন সন্ধ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জনাব আবদুল মোনেম খান ঢাকা রেডিও থেকে জনসাধারণকে হুঁশিয়ার করে দেন যে, সরকার এদেশে বিশৃঙ্খলা দমনে বদ্ধপরিকর তিনি আরো বলেন, সরকার জনসাধারণকে যে বাক্যের স্বাধীনতা দিয়েছেন কোন কোন নেতা তার অসদ্ব্যবহার করছেন। সরকার তা বরদাস্ত করবে না।

এক হাজারের বেশী গ্রেপ্তার

এই বক্তৃতার অভ্যবহিত পর থেকে সারা পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গ্রেপ্তার শুরু হয়। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তারের সংখ্যা হাজারেরও বেশী হয়ে গিয়েছে। প্রতিবাদ দিবসের দিন যেসব ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার মধ্যে আছেন কর্ণেল মুক্তার হোসেন, এয়ার মার্শাল আসগর খানের প্রাইভেট সেক্রেটারী। কর্ণেলকে একটা মসজিদের বাইরে গ্রেপ্তার করা হয়। এখানে এয়ার মার্শাল ও কর্ণেল সংবাদপত্র রিপোর্টারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। এয়ার মার্শাল এই গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশকে বলেন।

মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী

এবারে আয়ুবের ঢাকা আগমন পুলিশী জুলুম ও রক্তের দাগে চিহ্নিত হয়ে রইল। একদিকে মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী তাঁকে ঘিরে ভিড় করেছে, অপর দিকে জনতার বিক্ষোভে তিনি পর্যুদস্ত। আয়ুব আমলের অনেক কথাই এতদিন অজ্ঞাত ছিল। শাসকগোষ্ঠীর অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে তা আজ জনসমক্ষে উদঘাটিত হচ্ছে। নিত্য নতুন নেতার আবির্ভাব হচ্ছে, পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক অগ্রগমনের জেহাদ চলছে।

জনতার কাতারে নেমে আসতে হবে

এ জেহাদের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করছে নবাগত নেতাদের ভবিষ্যত কার্য-কলাপের উপর। এ সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহম্মদ সম্প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে গনতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করতে হলে জনতার কাতারে নেমে আসতে হবে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, সাধারণ মানুষের দাবী-দাওয়া নিয়ে সংগ্রাম করতে হবে এবং জনগণের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মুজিবুর যখন বন্দী, বন্দী রাজ্যের অন্যান্য সমস্ত রাজনৈতিক নেতা, তখন রাজ্যের নেতৃত্ব গ্রহণ করল পুর্ব বাংলার ছাত্র সংগ্রামী পরিষদ। ছাত্র সংগ্রামী পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচি, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি এবং শেখ মুজিবুরের ৬ দফা কর্মসূচি সম্মিলিত রূপ নিল ছাত্রদের আন্দোলনে। শুরু হল প্রচণ্ড গণ-আন্দোলন, যে আন্দোলন পরবর্তী পর্যায়ে গণ-বিস্ফোরণে পরিণত হলো, যে বিস্ফোরণে পতন ঘটল আয়ুব খাঁর। কিন্তু তার আগেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়ে গেছে। শেখ মুজিবুরের বিরুদ্ধে প্রচার করা হলো তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী, ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চান। ষড়যন্ত্র মামলার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হল। মুজিবুর মুক্তি পেলেন আর আয়ুব খাঁকে মাথা নীচু করে সেই মুজিবুরকেই আহ্বান করতে হলো গোলটেবিল বৈঠকে। কিন্তু এক নাগাড়ে নির্যাতন দমন-পীড়ন মুজিবুরের কোন পরিবর্তনই করতে পারে নি। গোলটেবিল বৈঠকে বসেও মুজিবুর বললেন,”ছয় দফা দাবী হলো পূর্ব বাংলার জনগনের দাবী, সে দাবী থেকে এক পা সরে আসতে তিনি রাজী নন।”

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ব্যর্থ হলে কবি দিলওয়ার লিখলেনঃ

ষড়যন্ত্র মামলা আর নেই
যেন প্রবল এক ফুৎকারে
উড়ে গেলো আকাশছোঁয়া এক
তাসের ঘর,
উড়ে গেলো গ্রহ থেকে গ্রহান্তর
প্রবল ঝড়ের মুখে তুষারকণা যেন,
আর তার ‘উটপাখী’ কারিগরের দল
এখন দেখো কেমন আধ্যাত্মিক যন্ত্রণায়
দুঃসময়ের বালুচরে মুখ গুঁজে
কুটিল বিবেকের শুনছে আৰ্তনাদ
জনগণের মিলিত নিঃশ্বাসে
ছন্দায়িত ঐতিহাসিক ঝড়;
কম্বু কন্ঠে সতত স্পান্দিত
অক্ষুন্ন বিচারকের রায়ঃ
যে আগুন মহাহৃদয়ের উৎস,
যে আগুন পথ পায়
মহা শপথের ঘর্ষণে ঘর্ষণে,
কে আছে তেমন শক্তিমান
যে হবে তার ঘৃণ্য হন্তারক?

আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, তিনজন সি এস পি অফিসার ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্দুস, খান এম শামসুর রহমান, একজন মেজর ও তিনজন ক্যাপ্টেন সহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে সরকারী পক্ষ থেকে অভিযোগ আনা হয়েছে যে তাঁরা ‘কমাণ্ডো স্টাইলে’ হঠাৎ করে কেন্দ্রীয় অস্ত্রগারগুলে দখলে এনে পূর্ব পাকিস্তানেকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘোষণার চেষ্টায় ছিলেন। এমনকি তাঁরা ভারতের সঙ্গে এক ভদ্রলোকের চুক্তিও করেছিলেন যে জলপথ বা আকাশ-পথে ভারত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য পাঠাতে বাধা দেবে এবং তাদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করবে। তাঁরা আরও ঠিক করেছিলেনযে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারী পূর্ব পাকিস্তানীদের ফেরৎ না দিলে পশ্চিম পাকিস্তানীদের পুর্ব পাকিস্তানে ‘জিম্মি’ হিসাবে আটক রাখবেন। এই অভিযোগের সাক্ষী দিবার জন্য, ২৩২ জনকে নির্যাতন করে, ভয় দেখিয়ে, চাকরী, প্রমোশন প্রভৃতি লোভ দেখিয়ে দাঁড় করিয়েছেন। অমানুষিক নির্যাতন করে সাক্ষী হিসবে দাঁড় করিয়েছেন কামালউদ্দিন আহম্মদকে। অত্যাচারে জর্জরিত কামালউদ্দিন শেষে রাজী হয়েছিলেন সাক্ষী দিতে। কিন্ত সরকারপক্ষের প্রধান কৌসুলী মঞ্জুর কাদের স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি যে কামালউদ্দিন এইভাবে মামলাটা কেঁচে দেবেন। স্টেটমেন্টে যা বলেছিলেন, কোর্টে এসে ঠিক তার উল্টো বললেন। সনাক্ত করতে পারলেন না তাঁদের যাঁদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।

২৮ জানুয়ারী। সিগন্যাল সেস।

তখন দশটা বেজে পনেরো মিনিট। শেখ মুজিবুর এসে দাঁড়ালেন আসামীর ডাকে। চোখে পুরো ফ্রেমের চশমা। বলিষ্ঠ চেহারায় দৃঢ়তা আর আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ স্পষ্ট। আদালত কক্ষে একবার চোখ বুলিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন,”আগেও বলেছি, এখনও বলছি, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আমি চাই। পুর্ব পাকিস্তানকে শোষন করার বিরুদ্ধে আমৃত্যু আমার আন্দোলন চলবে। কোন বুলেট বেয়নেটের সাধ্য নেই যে সেই আন্দোলনকে রোখে। ৬ দফা দাবী আদায়ের জন্য আমি লড়াই চালিয়ে যাব। প্রতিরক্ষার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ করার দাবী জানিয়েছি। দেশের কল্যাণের জন্যই তা করেছি। পুর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য করিনি। আমি বিশ্বভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী। তাই তাসখন্দ ঘোষণা সমর্থন করছি আমাকে আমার পার্টিকে, পুর্ববাংলার সাড়ে ছয় কোটি মানুষকে হেয় করার জন্য কায়েমী শাসক আর শোষকের এই মামলা সাজিয়েছে। এক মুজিব যাবে, লক্ষ লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে পূর্ববাংলায়। স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে এগিয়ে যাবে রাইফেলের মুখে।

শেখ মুজিবুরের গম্ভীর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে শিরায় শিরায় আগুন ধরাল। মুজিবুর সাহেব। এবার সরাসরি ট্রাইবুনালে বিচারপতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পূর্ববাংলা শোষিত হচ্ছে, চাকরী-বাকরী, উন্নয়ণ সর্বক্ষেত্রেই পূর্ব-পাকিস্তানীদের প্রতি যে বৈষম্য চলছে তা বলা কি দেশদ্রোহিতা? ডিকটেটরের কাছে তা হতে পারে–কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে নয়। গণ- আদালতে আমি নির্দোষ। আমার আর কিছু নেই।’ বলে নেমে এলেন আসামীর ডক থেকে।

এবার ২ নং আসামী লেফটেনান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন,‘গ্রেপ্তারের পর আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এই মর্মে একটি বিবৃতি দিতে বলে যে, আমি শেখ মুজিবুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, এস এম মোর্শেদ, সি এস পি অফিসার এ এফ রহমান, শামসুর রহমান এবং আরো অনেকের নাম বলে গেল, তাঁদের চিনি এবং বলি, তাঁদের সকলে স্বাধীন পুর্ব বাংলার আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। বিবৃতিতে যেন আরো উল্লেখ করি কমাণ্ডো স্টাইলে বিপ্লব করার জন্যে শেখ মুজিবুর রহমান সৈনিকদের সংঘবদ্ধ করতে বলেন আমাকে। বলি, ভারত আমাদের অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে মিস্টার ওঝার মারফৎ।

আমি এই মিথ্যা বিবৃতি দিতে অস্বীকার করায় কর্ণেল আমির ঘুসি মেরে আমার দাঁত ভেঙ্গে দেন।’ লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন একটি ভাঙ্গা দাঁত দাখিল করলেন এবং বললেন, ‘তাঁরা আমায় বললেন যদি আমি তাঁদের কথানুযায়ী বিবৃতি দিই তাহলে আমার অবসর গ্রহণের আবেদন মঞ্জুর করা হবে এবং পেনসন দেওয়া হবে। অন্যথায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমাকেও ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠাবে। কর্নেল আমির বললেন, তুমি সহযোগিতা না করলেও অনেকেই করবে। বেসামরিক আদালতে যদি শেখ মুজিব রেহাং পান, সামরিক আদালতে তাঁর মুক্তিলাভের চান্স নেই। মুজিবকে আমরা শেষ করব। আমাদের প্রেসিডেন্টের বড়ো শত্রু সে।

প্রলোভন ও ভীতি প্রদর্শন সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিতে রাজী হলাম না। শেখ মুজিবুর কখনও দেশদ্রোহী হতে পারেন না। তিনি দেশপ্রেমিক। পুর্ব বাংলার সাড়ে ছয় কোটি মানুষের নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিলে আল্লা আমায় ক্ষমা করবেন না। বিবৃতি দিতে রাজী হইনি বলে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়েছেন সরকার।’ কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইশ পৃষ্ঠার একটি লিখিত বিবৃতিও দাখিল করলেন তিনি।

লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেনের পর আসামীর ডকে দাঁড়িয়ে স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমানের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁর উপর যে নৃশংস নির্যাতন হয়েছে মর্মস্পর্শী ভাষায় তার বিবরণ দিতে থাকেন। তিনি বললেন, ‘১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে রাজারবাগ, পরে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যায়।

১১ ডিসেম্বর রাজারবাগে নিয়ে গেল। আমি একটা কক্ষে বসে আছি। একটু বাদে কয়েক সীট টাইপ করা কাগজ হাতে দিলেন লেফটেন্যান্ট শরীফ। তিনি কাছে এসে টাইপ করা সীটগুলো পড়ে গেলেন। তাতে বহু আর্মি অফিসার, সি এস পি অফিসার এবং রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর নাম উল্লেখ ছিল। উল্লেখ ছিল তাঁরা কিভাবে স্বাধীন পূর্ববাংলা গঠন করবার চেষ্টা করছেন। লেফটেন্যান্ট শরীফ আমাকে ঐ তৈরী স্টেটমেণ্ট অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ একটি বিবৃতি দিতে বললেন। বলতে বললেন, আমি তাদের চিনি এবং ওই দলে ছিলাম।

এই মিথ্যা বিবৃতি দিতে অস্বীকার করলাম আমি। তখন আমায় একটা নির্জন কক্ষে নিয়ে গেল। তারপর শুরু হলো নির্যাতন। নখের ভিতর পিন ঢুকিয়ে দিল। রুল দিয়ে পেটাতে লাগল একটা লোক। কাপড় জামা রক্তে সপসপে হয়ে উঠল। নাক মুখ মাথা দিয়ে রক্ত গড়াল আমার। জ্ঞান হারালাম। বিকাল চারটায় সময় জ্ঞান ফিরলে দেখলাম মেজর নাসের ঘরে ঢুকছেন। তিনি আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট মিথ্যা জবানবন্দী দিতে বললেন। আমি পারব না বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রচণ্ড চড় কষালেন আমার গালে। মারপিটে আমার অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। শেষে ডাক্তারের পরামর্শে কয়েকটা দিন মারপিট বন্ধ রাখল।

১৮ই ডিসেম্বর আবার শুরু হলো অত্যাচার। ন্যাংটো করে শুইয়ে রাখল বরফের মধ্যে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় দশ মিনিটে শরীর জমে গেল। তখন কম্বলে জড়িয়ে অন্য ঘরে নিয়ে গেল।”

পনেরো-ষোল বারেরও বেশী মেজর নাসের, কর্নেল শরীফ আমাকে মিথ্যা বিবৃতি দিতে চাপ দেন। আমি অস্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গেই বার বার আমার উপর অমনি নৃশংস নির্যাতন চালানো হয়। বিবৃতি দিতে অস্বীকার করার জন্যই আমার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

এই সময় বাইরে স্লোগান ওঠেঃ ‘শেখ মুজিবুরের মুক্তি চাই, “মিথ্যা মামলা তুলে নাও, আয়ুবশাহী ধ্বংস হোক।” গ্যালারীর ভিতর থেকেও একদল ছাত্র ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’ বলতে বলতে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে এসে দেখি মিলিটারির প্রহরায় শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্ট জেলে। জনতা স্লোগান দিচ্ছে তখনো। মিলিটারীরা রাইফেলের কুঁদো দিয়ে চার্জ শুরু করে। জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে মিলিটারীরা চলে গেল।

সেদিনকার মতো অধিবেশন মুলতুবী রইল।

২০শে ফেব্রুয়ারী

কয়েকদিন থেকে ২৪ ঘণ্টা কারফিউ চলছে। মাঝে দু-এক ঘণ্টা বিরতি অবশ্য ছিল। কয়েক দিনের মধ্যে আজই যা একটু বেশি সময়ের বিরতি ছিল। সকাল সাতটা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিরতি। হঠাৎ বারোটার দিকে দেখা গেল দোকানপাট ঝটাপট বন্ধ হতে শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলছে গৃহে। বরোটার থেকে নাকি কারফিউ জারী হয়েছে। প্রেসক্লাব থেকে ডি সি-র কন্ট্রোল রুমে ফোন করে জানা গেল ওটা গুজব। পাঁচটা থেকে কারফিউ শুরু হবে। এদিকে রিক্সায় মাইক বসিয়ে পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় ছাত্ররা সন্ধ্যের সময় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মশাল নিয়ে উপস্থিত থাকার ডাক দিচ্ছে। কথার ফুলকিতে আগুনের জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে শিরায় শিরায়।

বিকাল চারটে থেকে মশাল আর প্ল্যাকার্ড হাতে বেরিয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। কমলাপুর, খিলগাঁও, মালিবাগ, তেজগাঁ, সারা ঢাকা শহরের লেন-বাই লেন থেকে বেরিয়ে আসছে খণ্ড খণ্ড মিছিল। কণ্ঠে স্লোগান। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার, অসংখ্য পোস্টার। প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মিছিলের পর মিছিল। মনে হচ্ছে-

এখন একটাই রঙ–লাল।
একটাই সঙ্গীত–স্লোগান।
একটাই হাত–মিছিল।
একটাই কাগজ–পোস্টার।

যখন এদেশের মানুষের হাসিগুলো শুকিয়ে কান্নায়, বিবর্তিত, যখন এদেশের মানুষের সুরেলা কণ্ঠগুলো আর্ত চীৎকারে রূপান্তরিত-

তখন একটা রঙিন ল্যাণ্ডস্কেপ থেকে বিক্ষুব্ধ মানুষেরা বলে, ‘অন্ন চাই, বস্ত্ৰ চাই’;

বলে–এদেশ আমার

এ মাটি আমার–এর প্রতিটি ধূলিকণা

তাই

আমার রক্তের সাথে জড়িত।

‘এ-রূপময়ী দেশের মানুষের কণ্ঠে আজ অধিকারের দাবীঃ
লড়াইয়ের মাঠে হারজিত আছে
থামবো কে তা’ বলে?
পোস্টার, পোস্টার, পোস্টার
মিছিল, মিছিল, মিছিল,
জনতা, জনতা জনতা।’

ইউনিভারসিটির কাছে দেখা গেল শুধু মানুষ আর মানুষ, প্লাকার্ড আর প্লাকার্ড। মশাল তখনও জ্বলেনি। লক্ষ লক্ষ মশাল জ্বলে উঠলে রমনার বুকে আজ এক বিচিত্র দৃশ্যের সৃষ্টি হবে। শহীদ মিনারের কাছে লক্ষ মানুষের ভিড়। শীতের সন্ধ্যা ছায়া ছায়া হয়ে এসেছে পাঁচটার মধ্যেই। শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে প্রথম মশাল জ্বালাল তোফায়েল। তারপর একে একে জ্বালাল দীপা দাস, সাইফুদ্দিন, জামাল হায়দার, মাহবুল্লাহ, আনোয়ার হায়দার–সকলে। জ্বলে উঠল একটার পর একটা মশাল। অ্যসেম্বলি হাউসের শেষ মাথা থেকে ইউনিভারসিটি ছাড়িয়ে যতদূর দৃষ্টি যায় দেখা গেল আলোর ফুলকিগুলো ক্রমশ শিখা হ’ল লক্ষ মশালের তলায় দূর হয়ে গেল অমানিশা। লালে লাল হয়ে উঠল রমনা। সকলের চোখে মুখে আগুনের শিখাগুলো তির তির করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে রক্ত ফেটে পড়ছে লক্ষ মানুষের মুখ থেকে। হিমের শীতল বাতাস বইছে, কিন্তু বাতাসটা আর ঠাণ্ডা লাগছে না। মশালের আগুনে তেতে উঠেছে শরীর। এমন সময় খবর ছড়িয়ে পড়ল কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে। মুজিবুর রহমানকেও নাকি ছেড়ে দেবে। ছাত্রনেতারা মাইকে ঘোষণা করল সে কথা। উল্লাসে ফেটে পড়ল জনতা। স্লোগান উঠলঃ

‘শেখ মুজিবকে এনেছি
জেলের তালা ভেঙেছি।’
‘জেলের তালা ভাঙব,
মণি সিংকে আনব!’
‘জেলের তালা ভাঙব,
মতিয়া চৌধুরীকে আনব।’
রাজবন্দীদের আনব
জেলের তালা ভাঙব।’
‘কৃষক শ্রমিক ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ-জিন্দাবাদ।’

শহীদ বেদী থেকে মাইকে তোফায়েলের কণ্ঠ ভেসে এলোঃ ‘এ জয় আপনার, আমার,সকলের জয়। ঝিলাম চেনার রাভী নদীর দেশ থেকে কর্ণফুলি পদ্মা মেঘনা বুড়িগঙ্গার দেশের সাড়ে এগারো কোটি মানুষ আজ জেগে উঠেছে, বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে, কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে জয়ের গান। আয়ুব–মোমেন-মুসার সাধ্য নেই জনতার সেই কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়। ওদের বেয়নেট ভোঁতা হয়ে গেছে, বুলেট ছুঁড়তে হাত কেঁপে উঠেছে। ওরা আজ কোটি কোটি জনতার ক্রুদ্ধ গর্জনে ভীত, সচকিত। জয় আমাদের হবেই। পথ আমাদের রুখবে কে? এগিয়ে চলুন-এগিয়ে চলুন-এগিয়ে চলার ডাক এসেছে।

এগিয়ে চলল লাখো মশালবাহী ছাত্র জনতার মিছিল নিউ মার্কেটের দিকে। কণ্ঠে স্লোগান। শাহাবাগ হোটেল বাঁয়ে ফেলে ঢাকা ক্লাবের পাশ দিয়ে মিছিল এগিয়ে চলল। সামনে বড়ো ফোয়ারার জল লাল হয়ে গেছে। রেসকোর্সের পাশের সদা ছায়াচ্ছন্ন রাস্তাটা আগুনের আলোয় আলোকিত করে এগিয়ে চলল মিছিল।

৩রা মার্চ-

সন্ধ্যের সময় এক বিশেষ বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট আয়ুব ঘোষণা করলেন, তিনি আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।

পরদিন দুপুরের সংবাদে হঠাৎ ঘোষণা করা হলোঃ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য অভিযুক্তরা কুর্মিটোলা সামরিক হেফাজত থেকে মুক্তি পেয়ে নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেছেন। মুক্তি পেয়েছে অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী আর রাশেদ খান মেনন। সন্ধ্যার পর মণি সিংকে মুক্তি দেওয়া হবে। মুক্তি দেওয়া হবে অন্যান্য রাজবন্দীদের। বিদ্যুৎবেগে খবর ছড়িয়ে পড়ল দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। উল্লাসে ফেটে পড়ল সারা দেশের মানুষ। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় বাজী পুড়ল, আকাশে লাল, নীল, সবুজ নানা রঙের বেলুন উড়ল। জনতার স্রোত চলেছে শেখ মুজিবের ধানমণ্ডীর বাসায়, এগিয়ে চলেছে রেসকোর্সের ময়দানে। সংবর্ধনা সভায় একক-দশক -শতক নয় অযুত লক্ষ জনতা এসে হাজির হয়েছে। মুখে নতুন ফাগুয়ার নতুন গান।

জেলের তালা ভেঙেছি,
শেখ মুজিবকে এনেছি,
জেলের তালা ভেঙেছি,
রাজবন্দীদের এনেছি,
মতিয়া রাশেদ এনেছি,
জেলের তালা ভেঙেছি,
জেলের তালা ভাঙব,
মণি সিংকে আনব।

রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনার উত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, আপনারা আমায় ভালবাসেন, আমি যেন সব সময় আপনাদের ভালবাসার মর্যাদা রাখতে পারি এই একমাত্র কামনা। গোলটেবিলে যাচ্ছি ১১ দফা প্রশ্নের দাবী নিয়ে। ১১ দফা প্রশ্নের কোন আপোস নেই। মুহুর্মুহু করতালির ভিতর দিয়ে উঠে দাঁড়াল মতিয়া এবং অন্যান্য মুক্তিপ্রাপ্ত রাজবন্দীরা। সভা শেষে বিরাট জনতা চলল জেলগেটের দিকে। কন্ঠে তাদের সাত সাগর তের নদীর গর্জনঃ জেলের তালা ভেঙেছি, রাজবন্দীদের এনেছি, জেলের তালা ভাঙব রাজবন্দীদের আনব।’

রাত আটটায় বেরিয়ে এলেন মণি সিং। মতিয়া প্রথম ফুলের মালা পরিয়ে দিল তাঁর কণ্ঠে। উল্লাসে ফেটে পড়ছে জনতা। রাতের তারাভরা আকাশে উড়ল রঙবেরঙের হাউই।

[বিক্ষুব্ধ পাকিস্তান-কল্‌হন]

আগরতলা মামলার বিশেষ ট্রাইবুনালে মুজিবুর রহমানের লিখিত জবানবন্দী

স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতীয় ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে আমার বিদ্যালয় জীবনের সূচনা হইতেই আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করিয়াছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে আমাকে আমার লেখাপড়া পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হইয়াছে।

স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ পাকিস্তানে জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। এর ফলে ১৯৪৯ সালে আমরা মরহুম জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠন করি। আওয়ামী লীগ পূর্বেও ছিল এবং এখনও সেইরূপ একটি নিয়মতান্ত্রিকতার প্রথানুসারী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিদ্যমান।

১৯৫৪ সালে আমি প্রথমে প্রাদেশিক পরিষদে এবং জাতীয় বিধানসভায় সদস্য নির্বাচিত হই। আমি দুইবার পূর্ব পাকিস্তান জনসাধারণের কল্যাণার্থে একটি নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দল গঠন করার জন্য আমাকে ইতিমধ্যেই কয়েক বৎসর কারা নির্যাতন ভোগ করিতে হয়। সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর হইতেই বর্তমান সরকার আমার উপর নির্যাতন চালাইতে থাকে।

১৯৫৮ সালের ১২ ই অক্টোবর তাহারা পূর্ব পাকিস্তান জন নিরপত্তা অর্ডিন্যান্সে আমাকে গ্রেপ্তার করে এবং দেড় বৎসর কাল বিনা বিচারে আটক রাখে। আমাকে এই ভাবে আটক রাখা কালে তাহারা আমার রিরুদ্ধে ছয়টি ফৌজদারী মামলা দায়ের করে, কিন্তু আমি ঐ সকল অভিযোগ হইতে সসম্মানে অব্যাহতি লাভ করি। ১৯৫৯-এর ডিসেম্বর কিংবা ১৯৬০-এর জানুয়ারীতে আমাকে উক্ত আটকাবস্থা হইতে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তিলাভ কালে আমার উপর কিছু কিছু বিধিনিষেধ জারী করা হয়। যেমনঃ ঢাকা ত্যাগ করিলে আমাকে গন্তব্যস্থলের সম্বন্ধে লিখিতভাবে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাইতে হইবে এবং প্রত্যাবর্তনের পরও একই ভাবে সেই বিষয় তাহাদিগকে অবগত করাইতে হইবে। গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা এই সময় সর্বদা ছায়ার মত আমার পিছু লাগিয়া থাকিত। অতপর ১৯৬২ সালে বর্তমান শাসনতন্ত্র জারীর প্রাক্কালে যখন আমার নেতা মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হয় তখন আমাকেও জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স বলে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয় এবং ছয়মাস বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। জনাব সোহারাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে দেশের উভয় অংশে আওয়ামী লীগকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুনর্জীবিত করা হয় এবং আমরা সম্মিলিত বিরোধী দলের অঙ্গ দল হিসাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সম্মিলিত বিরোধী দল এই সময় প্রেসিডেন্ট পদে জনাব আয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মোহাতারেমা ফাতেমা জিন্নাকে মনোনয়ন দান করে। আমরা নির্বাচনী অভিযান শুরু করি। সরকারী কর্তৃপক্ষও আমার বক্তৃতা সম্পর্কে কয়েকটি মামলা দায়ের করিয়া আমাকে মিথ্যা বিরক্ত ও লাঞ্ছিত করিতে থাকে।

১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ চলাকালে যে সকল রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন আমি তাহাদের অন্যতম। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পূর্ণভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার দল ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য প্রদান করার জন্যও আমরা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ইহার সকল অঙ্গের নিকট নির্দেশ প্রেরণ করি।

যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সর্বদলের সম্মেলনে আমি প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করি এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও সাহায্য করিবার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানাই। যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আয়ুবের প্রদেশ ভ্রমণ কালে আমি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করি। সেই সময় আমি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও যুদ্ধকালে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রদেশকে সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিবার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ, যুদ্ধকালে পুর্ব পাকিস্তান দেশের অন্য অংশ সহ সকল বিশ্ব হইতে সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। আমি তাসখন্দ ঘোষণাকেও সমর্থন করিয়াছিলাম কারণ আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান অগ্রগতির জন্য বিশ্বশান্তিতে আস্থাবান–আমরা বিশ্বাস করি যে সকল আন্তর্জাতিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা হওয়া উচিত।

১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সম্মিলনীর বিষয় নিবার্চনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলীর নিয়মতান্ত্রিক সমাধান– ছয় দফা কর্মসূচিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উভয় অংশের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবী করি। অতঃপর আমার প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং দেশের উভয় অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্য দূরীকরণের অনুকূলে জনমত যাচাই ও গঠনের জন্য ছয় দফার পক্ষে জনসভা অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়।

ইহাতে প্রেসিডেন্ট সহ অন্যান্য সরকারী নেতৃবৃন্দ ও সরকারী প্রশাসন যন্ত্র আমাকে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি হুমকী প্রদান করেও একযোগে আধ ডজনের অধিক মামলা দায়ের করিয়া আমাকে হয়রানি করিতে শুরু করে। ১৯৬১ সালের এপ্রিলে আমি খুলনার একটি জনসভা করিয়া যশোহর হইয়া ঢাকায় ফিরিতেছিলাম,তখন তাহারা যশোহরে আমার পথরোথ করে এবং আপত্তিকর বক্তৃতা প্রদানের অভিযোগে ঢাকা হইতে এক গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বলে এই বারের মত প্রথম গ্রেপ্তার করে।

আমাকে যশোহর মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে উপস্থিত করা হইলে তিনি আমার অন্তবর্তীকালীন জামীন প্রদান করেন। আমি ঢাকার সদর দক্ষিণ মহকুমা প্রশাসকের সন্মুখে উপস্থিত হইলে তিনি আমার জামিনে অসম্মত হয়। কিন্তু মাননীয় দায়রা জজ প্রদত্ত জামীন বলে আমি সেইদিনই মুক্তি পাই এবং সন্ধ্যা সাতটায় নিজ গৃহে গমন করি। সেই সন্ধ্যায় আটটায় পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত এক বক্তৃতার উপর সিলেট হইতে প্রেরিত এক গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বলে আমার বাসগৃহ হইতে আমাকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ সেই রাত্রেই আমাকে সিলেট লইয়া যায়। পরদিন প্রাতে আমাকে আদালতে উপস্থিত করা হইলে সিলেটের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমার জামিনের আবেদন বাতিল করিয়া আমাকে কারাগারে প্রেরণ করে। পরদিবন সিলেটের মাননীয় দায়রা জজ আমার জামীন প্রদান করেন কিন্ত আমি মুক্ত হইবার পূর্বেই পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত বক্তৃতা প্রদানের অভিযোগে কারা-দরজায়ই গ্রেপ্তার করে। এবারের গ্রেপ্তারী পরোয়ানা মোমেনশাহী হইতে প্রেরিত হইয়াছিল। সেই রাত্রে আমাকে পুলিশ পাহারাধীনে মোমেনশাহী লইয়া যাওয়া হয় এবং একই ভাবে মোমেনশাহীর মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমার জামীন প্রদানে অস্বীকৃত হন এবং পরে মাননীয় দায়রা জজ প্রদত্ত জামিনে মুক্তিলাভ করিয়া ঢাকা প্রত্যাবর্তন করি। উপরিউক্ত সকল ধারাবাহিক গ্রেপ্তারী প্রহসন ও হয়রানী ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে সংঘটিত হয়।

১৯৬৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে, সম্ভবত আটই মে, নারায়ণগঞ্জে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করি এবং রাত্রে ঢাকায় নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন করি। রাত একটার সময় পুলিশ “ডিফেন্স অফ পাকিস্তান রুল”–এর ৩২ ধারায় আমাকে গ্রেপ্তার করে। একই সঙ্গে আমার প্রতিষ্ঠানের বহু সংখ্যক নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইহাদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোন্দকার মুশতাক আহম্মদ, প্রাক্তন সহ-সভাপতি জনাব মুজিবুর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা আওয়মী লীগ সম্পাদক জনাব আজিজ, পূর্ব পশ্চিম আওয়ামী লীগের প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ জনাব নরুল ইসলাম চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জনাব জহুর আহাম্মদ চৌধুরী সহ বহু অন্যান্য।

ইহার অল্প কয়েকদিন পরে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মীজানুর রহমান চৌধুরী এম এন এ, প্রচার সম্পাদক জনাব মোমেন অ্যাডভোকেট, সমাজকল্যাণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব হাফিজ মোহাম্মদ মুন্না, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য মোল্লা জালালুদ্দিন আহম্মেদ অ্যাডভোকেট, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি ও প্রাক্তন মন্ত্রী ক্যাপটেন মনসুর আলী, প্রাক্তন এম এন এ জনাব আমজাদ হোসেন, অ্যাডভোকেট জনাব আমিনুদ্দিন আহম্মদ, পাবনার অ্যাডভোকেট জনাব আমজাদ হোসেন, নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব মুস্তফা সারওয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব মহীউদ্দিন আহম্মেদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব মোহাম্মদুল্লাহ, অ্যাডভোকেট ও সংগ্রামী নেতা শাহ মোয়াজ্জম হোসেন, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব সিরাজউদ্দীন আহম্মদ, রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব হারুনুর রশীদ; তেজগাও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব শাহাবুদ্দীন চৌধুরী ঢাকা সদর উত্তর আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব আবদুল হাকিম, ধানমণ্ডি আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি জনাব রশীদ মোশারফ, শহর আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব সুলতান আহম্মদ, অন্যতম আওয়ামী লীগ কর্মী নুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ অস্থায়ী সম্পাদক জনাব আবদুল মান্নান, পাবনার অ্যাডভোকেট জনাব হাসনাইন, মোমেনশাহীর অন্যতম আওয়ামী লীগ কর্মী, ছাত্র নেতা ও শ্রমিক নেতাকে পাকিস্তান রক্ষা বিধি ৩২ ধারার (নিষ্ঠুর অত্যাচার) বলে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয়। আমার দুই ভ্রাতুষ্পুত্র পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ শহিদুল ইসলামকেও কারারুদ্ধ করা হয়। অধিকন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক ‘ইত্তেফাককেও’ বৰ্তমান শাসকগোষ্ঠী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ইহার একমাত্র কারণ হইল যে ‘ইত্তেফাক’ মাঝে মাঝে আমার নীতিসমূহ সমর্থন করিত। সরকার ইহার ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে এবং ইহার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সম্পাদক জনাব তোফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়াকে দীর্ঘকালের জন্য কারারুদ্ধ করিয়া তাহার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ফৌজদারী মামলা দায়ের করে। যুগপৎ চট্টগ্রাম মুসলিম চেম্বার অব কমার্সের প্রাক্তন সভাপতি, চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের প্রাক্তন সহ-সভাপতি ও অন্যতম আওয়ামী লীগ নেতা জনাব ইদ্রিসকেও পাকিস্তান রক্ষা বিধি বলে অন্ধ কারাকক্ষে নিক্ষেপ করা হয়।

আমাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আমার প্রতিষ্ঠান ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। প্রদেশব্যাপী এই হরতালের দিন পুলিশের গুলীতে ঢাকা নারায়ণগঞ্জের এগারো জন ব্যক্তি নিহত হয়। পুলিশ প্রায় আটশ’ লোক গ্রেপ্তার করে ও অসংখ্য লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জনাব মোমেন খান প্রায়শই তাঁহার লোকজন এবং সরকারী কর্মচারী সমক্ষে উন্মুখভবে বলিয়া থাকেন যে যতদিন তিনি গদীতে আসীন থাকবেন ততদিন শেখ মুজিবকে শৃঙ্খলিত থাকিতে হইবে। ইহা অনেকই অবগত আছেন। আটক অবস্থায় কারাকক্ষেই আমাকে বেশ কয়েকবার বিচারালয়ের সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। প্রায় ১১ মাস আটক থাকার পর ১৯৬৮ সালের ১৭।১৮ তারিখে রাত ১টার সময় আমাকে তথাকথিত মুক্তি দেওয়া এবং হয় কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক হইতে কতিপয় সামরিক ব্যক্তি দৈহিক বল-প্রয়োগ করিয়া আমাকে ঢাকা সেনানিবাসে লইয়া আসে এবং একটি রুদ্ধকক্ষে আটক রাখে ও আমাকে বহির্জগত হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া নির্জনে রাখা হয়। কাহারও সহিত সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা হয়। আমাকে আমার খবরের কাগজ পর্যন্ত পড়িতে দেওয়া হইত না। বিশ্ব ইহতে সকল যোগাযোগ বীহীন অসস্থায় এই ভাবে আমাকে দীর্ঘ পাঁচমাস কাল আটক থাকিতে হয়। এই সময় আমাকে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় এবং আমাকে সকল প্রকার দৈহিক সুযোগ সুবিধা হইতে বঞ্চিত রাখা হয়। এই মানসিক অত্যাচার সন্বন্ধে যত অল্প প্ৰকাশ করিতে হয় ততই উত্তম।

এই বিচারকার্য শুরু হইবার মাত্র একদিন পূর্বে, ১৯৬৮ সালের ১৮ই জুন আমি প্রথম অ্যাডভোকেট জনাব আবদুস সালাম খানের সহিত সাক্ষৎ করি এবং তাঁহাকে আমার অন্যতম কৌসুলী নিয়োগ করি। কেবলমাত্র আমার উপর নির্যাতন চালাইবার জন্য এবং আমার দলকে লাঞ্ছিত অপমানিত ও আমাদিগকে কুখ্যাত করিবার জঘন্য মনোবৃত্তি লইয়া আমাকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলায় মিথ্যা জড়িত করা হইয়াছে। এই ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী সহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চাকুরীর সংখ্যা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সততার ন্যায়সঙ্গত দাবী আদায়ের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা ও নিষ্পেষণ করাই ইহার মূল উদ্দেশ্য।

এই আদালতে আসিবার পূর্বে আমি লেঃ কেঃ মোয়াজ্জম হোসেন, এক্সপোরাল আমির হোসেন, এল এস সুলতানউদ্দিন আহমেদ, মুজিবুর রহমান ফ্লাইট সার্জেন্ট মহফুজ উল্লাহ ও এই মামলায় জড়িত অন্যান্য স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী কর্মচারীদের কখনও দেখি নাই। জনাব আহাম্মদ ফজলুর রহমান, জনাব রহুল কদ্দুস ও জনাব খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান এই তিনজন সি এস পি অফিসারকে আমি জানি। আমি মন্ত্রী হিসাবে সরকারী কার্য সম্পাদনকালে তাহাদিগকে জানিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম এবং তাহারাও তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমি তাহাদিগকে কখনও রাজনীতিক বিষয়ে আলোচনায় লিপ্ত করি নাই কিংবা ষড়যন্ত্রেও ব্যাপৃত হই নাই। আমি কোনদিন লেঃ কঃ মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসগৃহ অথবা করাচীতে জনাব কামালুদ্দিনের বাসগৃহে গমন করি নাই কিংবা আমরা অথবা লেঃ কঃ মোয়াজ্জেম হোসেনের অথবা করাচীতে জনাব কামালউদ্দিনের বাসগৃহে কোন সভাও অনুষ্ঠিত হয় নাই। কিংবা এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোন ব্যক্তির সহিত কোন আলোচনা আমার অথবা জনাব তাজুদ্দিনের বাসায় সংঘটিত হয় নাই। এই সকল ব্যক্তি কোনদিন আমার বাসগৃহে গমন করে নাই এবং আমিও ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত কাহাকেও টাকা দেই নাই। আমি কখনও ডাঃ সাঈদুর রহমান কিংবা মানিক চৌধুরীকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রে সাহায্য করিতে বলি নাই। তাহারা চট্টগ্রামের অন্যান্য শত শত কর্মীদের ন্যায় মাত্র। আমার প্রতিষ্ঠানের তিনজন সহ-সভাপতি, ৪৪ জন নির্দেশনা পরিষদ সদস্য, একজন সাধারণ সম্পাদক এবং আটজন সম্পাদক রহিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের অনেকেই প্রাক্তন মন্ত্রী, এম এন এ ও এম পি এ। বর্তমান কেন্দ্রীয় পরিষদের পাঁচজন ও প্রাদেশিক পরিষদের দশজন সদস্য, আমার প্রতিষ্ঠানভুক্ত। চট্টগ্রামেও আমার প্রতিষ্ঠানের জেলা ও শহর সভাপতি ও সম্পাদকগণ প্রাক্তন এম এন এ, এম পি এ, অনেক বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ বিদ্যমান। আমি তাহাদের কাহারও নিকট কোন প্রকার সাহায্যের কথা উল্লেখ করি নাই। ইহা অসম্ভব যে আমি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী মানিক চৌধুরী একজন সাধারণ এল এম এফ ডাক্তার সাঈদুর রহমানকে কোন সাহায্যের জন্য অনুরোধ করিতে পারি। ১৯৬৫ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জনাব জহুর আহম্মদ চৌধুরীর বিরোধিতা করিবার জন্য ডাঃ সাঈদুর রহমানকে বরং আওয়ামী লীগ হইতে বহিষ্কার করা হইয়াছিল। আমি ডাঃ সাঈদুর রহমানের গৃহে কদাপি গমন করি নাই। আমি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, ইহা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যাহার একটি সুনির্দিষ্ট, সুসংগঠিত নীতি ও কর্মসূচি রহিয়াছে। আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কদাপি আস্থাশীল নই। আমি দেশের উভয় অংশের জন্য ন্যায় বিচার চাহিয়াছিলাম–ছয় দফা কর্মসূচিতে ইহাই বিধৃত হইয়াছে। দেশের জন্য আমি যাহাই মঙ্গলকর ভাবিয়াছি আমি সর্বদাই তাহা নিয়মতান্ত্রিক গণ্ডীর ভিতরে জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়াছি। এবং এই নিমিত্ত আমাকে সর্বদাই শাসক গোষ্ঠী ও স্বার্থবাদীদের হাতে নিগৃহীত হইতে হইয়াছে। তাহারা আমাকে ও আমার প্রতিষ্ঠানকে দমন করিয়া পাকিস্তানের জনগণের বিশেষত পূর্ব পকিস্তানীদের উপর শোষণ ও নিষ্পেষণ অব্যাহত রাখিতে চায়।

আমার উক্তির সমর্থনে আমি মহামান্য আদালতে আরো নিবেদন করিতে চাই যে আমাকে প্রতিহিংসাবশত এই মিথ্যা মামলায় জড়িত করা হইয়াছে। পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগ কর্তৃক ১৯৬৮ সালের ৬ই জানুয়ারী প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে অভিযুক্ত বলিয়া কথিত ১৮ ব্যক্তির কথা লিপিবদ্ধ ছিল এবং ইহার মধ্যে আমার নাম ছিল না। উক্ত প্রচারপত্রে ইহাও উল্লেখ করা হইয়াছিল যে সকল অভিযুক্তই অভিযোগ স্বীকার করিয়াছে, তদন্ত প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে এবং শীঘ্র বিষয়টির বিচারার্থে আদালতে প্রেরণ করা হইবে। একজন প্রাক্তন মন্ত্রী হিসাবে অর্জিত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি স্বরাষ্ট্র বিভাগের উক্ত প্রচারপত্র সম্বদ্ধে এ কথা জানাইতে চাই যে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সেক্রেটারী কর্তৃক ব্যক্তিগতভাবে দলিল পত্র পরীক্ষিত ও অনুমোদিত হওয়া ব্যতিরেকে কোন বিভাগ হইতে কোন প্রকার প্রচারপত্র প্রকাশ করা যায়না। এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে কোন প্রচারপত্র প্রকাশ করিতে হইলে প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রেসিডেন্টের অনুমোদন লাভ আবশ্যক।

বর্তমান মামলাও উল্লিখিত নিষ্পেষণ ও নির্যাতন নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। অধিকন্তু স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক শোষণ অব্যাহত রাখার যে ষড়যন্ত্রজাল বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিস্তার করিয়াছে এই মামলা তাহারই বিষময় প্রতিক্রিয়া। আমি কখনও এমন কিছু করি নাই কিংবা কোনদিনও এই উদ্দেশ্যে কোন স্থল, নেভী বা বিমান বাহিনীর কোন কর্মচারীর সংস্পর্শে কোন ষড়যন্ত্রমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করি নাই। আমি নির্দোষ এবং এ ব্যাপারে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।”

মুক্তির পর শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকায় এক অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা জানানো হয়। দশ লক্ষ লোকের এক জনতা তাকে সংবর্ধনা জানায়। এমন বিরাট সমাবেশ নাকি ঢাকায় স্মরণাতীত কালের মধ্যে দেখা যায় নি। এই সমাবেশে তাঁকে বঙ্গবন্ধু আখ্যা দেওয়া হয়। এই দিন থেকে মুজিবুর হলেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবুরকে রাওয়ালপিণ্ডিতে প্রেসিডেন্ট আয়ুবের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিতে রাজী করাতে প্রেসিডেন্ট আয়ুব তাঁর ব্যক্তিগত দূত হিসাবে কেন্দ্ৰীয় মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীনকে ঢাকায় পাঠান

দেশের শত্রু বলে বর্ণিত শেখ মুজিবুরের ভাষণ ঢাকা বেতারে প্রচারিত করে জনগণকে শান্ত থাকার আবেদন করা হয়েছিল। সেই দিন ৪৯ বৎসর বয়স্ক শেখ মুজিবুরের কাছে পাকিস্তানের লৌহমানব ৬২ বছরের প্রেসিডেণ্ট আয়ুব খাঁকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল।

১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ বিদায় নিলেন আয়ুব।

কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যে ফাটল দেখা দেয় এবং পরিণতিতে নারায়ণগঞ্জের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে দু-টুকরা হয়ে যায় এবং মৌলানা ভাসানী, তোহা প্রমুখকে নিয়ে যে আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়, সেই পর্টিতেও ভাঙ্গন দেখা দিল।

প্রথমে পার্টিতে থেকে তোহা মৌলানা ভাসানীর সমালোচনা শুরু করলেন, পরে ‘গণশক্তি’ নামে একটি পত্রিকা বের করে ভাসানীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে জেহাদ ঘোষণা করলেন। লড়াই শুরু হলো তোহার ‘গণশক্তি’ ও ভাসানীর ‘স্বাধিকার’ পত্রিকার মাধ্যমে। অবস্থা এমন এক স্তরে এলো যে ভাসানীর দল থেকে তোহাকে বের করে দেওয়া হল। কিন্তু তোহা আগে ভাগেই দল থেকে পদত্যাগ করে ভাসানীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের শর নিক্ষেপ করলেন। ভাসানীও চুপ করে থাকলেন না, তিনিও তোহার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের ফিরিস্তি প্রচার করলেন।

এই প্রসঙ্গে পূর্ব-পাকস্তানের ‘গণশক্তি’ ও ‘স্বাধিকার’ পত্রিকার তিনটি রিপোর্ট তুলে ধরছি। এই তিনটি রিপোর্টে দেখা যাবে এক দিকে যখন মুজিবুর রহমান তাঁর ছয় দফা দাবীতে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন পণ লড়াইয়ে নেমেছেন, তখন মৌলানা ভাসানী ও তোহা চীন- রাশিয়া মার্কসবাদ-লেলিনবাদ ও মাও সে তুং নিয়ে চুলচেরা বিতর্কে পূর্ব-পাকিস্তানের সহজ রাজনীতিকে জটিল আবর্তে নিয়ে ফেলেছেন।

আয়ুবের বিদায়ের পর ইয়াহিয়া খাঁ ক্ষমতায় এলেন। ক্ষমতায় এসে ইয়াহিয়া খাঁ ‘এক ইউনিট’ প্রথা বাতিল করে দিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন যত শীঘ্র সম্ভব জনপ্রতিনিধিদের হাতে তিনি ক্ষমতা তুলে দিবেন। কিন্তু মাঝের কয়েকটি বছরে বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। মুজিবুর জেলে থাকতেই আয়ুবশাহী শেষ চেষ্টা করেছিল শুধু মুজিবুরকে নয়, মুজিবুরের ছয় দফা দাবীকে নয়–পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে, তাদের রাজনৈতিক জীবন তিলে তিলে ধ্বংস করে দিতে। রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক জীবনেও আঘাত হেনেছিলেন আয়ুব খাঁ ও তাঁর অনুচরেরা। রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ হয়েছিল। নজরুল হয়েছিলেন নিন্দিত। সুকান্ত, জীবনানন্দ দাশ হয়েছিলেন পরিত্যক্ত। কিন্তু পূর্ববাংলার মানুষ যেমন বিদ্রোহ করেছিল রাজনৈতিক বন্দীজীবনের বিরুদ্ধে, একই ভাবে বিদ্রোহ করেছিল সাংস্কৃতিক জীবনের বিরুদ্ধে। তাই তারা আয়ুবশাহীর শত লাঞ্ছনা কটুক্তি অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথের ছবিকে পত্রপুষ্পে সাজিয়ে স্থাপিত করেছিল জনমানসে।

১৯৫৯ সালের ২৫শে মার্চ আয়ুব বিদায় নিলেন। এলেন ইয়াহিয়া খাঁ। যেভাবে ইস্কান্দার মীর্জার বিদায়ের পর আয়ুব এসেছিলেন ঠিক সেইভাবেই আয়ূবের পর এলেন ইয়াহিয়া খাঁ। অনেক টাল বাহানার পর ইয়াহিয়া খাঁ নির্বাচনের দিন ঘোষণা করলেন। আওয়ামী লীগ ঠিক করল অন্য কোন দলের সাথে জোট না বেঁধে নিজের শক্তির উপরই নির্ভর করে নির্বাচনে লড়বে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মুজিবুর নিজের শক্তিতে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, তাছাড়া ১৯৫৪ সালে হক সাহেব সোহরাওয়ার্দী ছিলেন, মৌলানা ভাসানীও ছিলেন এই দলে। কিন্ত আজ অনেকেই যেমন নেই তেমনি যাঁরা আছেন তাঁদের কাছে ৬ দফা দাবীর চেয়ে নানা মতবাদের সূক্ষ্ম তর্ক বিচারই বড় কথা। নির্বাচনী জয়লাভের জন্য যুক্তফ্রণ্টের প্রয়োজনীয়তা যথেষ্ট থাকলেও নির্বাচনের পরে সরকার গঠন করতে ও চালাতে দলাদলির রাজনীতি প্রকট হয়ে ওঠে।

তাই মুজিব নিজের দলকে শক্তিশালী করে তুলবার কাজে ব্রতী হন’। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী গ্রুপ ) অবশ্য যুক্তফ্রন্ট গঠনের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। ওয়ালী গ্রুপের ধারণা ছিল কোন দলই নিজের শক্তির উপর ভিত্তি করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারবে না। তাই একদিকে ধর্মীয় রাজনীতি অপর দিকে অতি-বিপ্লবীর হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন হওয়া প্রয়োজন। কিন্ত মুজিবুর নিজের বিশ্বাসে অটল থাকলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার প্রতি যে অন্যায় অবিচার করে এসেছে তার বিরুদ্ধে জনমতের রায় গ্রহণই হল মুজিবুরের নির্বাচনী প্রচারের মূল কথা।

মুজিব ও আওয়ামী লীগের কথা হল পূর্ব বাংলার পাট বিক্রয় করে পাকিস্তান যে বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে তার বেশীর ভাগই পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ করা হয়। সামরিক কাজে বাঙালী উপযুক্ত নয়, এই অজুহাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে বাঙালীকে বিশেষ নিয়োগ করা হয় নি। পাকিস্তানের রাজধানী পশ্চিম খণ্ডে অবস্থিত থাকায় চাকুরীর ব্যাপারে বাঙালীরা বিশেষ কোন সুযোগ পায় নি। পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে কাজ করতে যাওয়া অনেক লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। পশ্চিমখণ্ডে কেন্দ্রীয় অফিসারের অফিস থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে লাইসেন্স এবং অন্যান্য সুযোগ- সুবিধা থেকেও বঙালীরা বঞ্চিত হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু পূর্ববাংলা রয়েছে এখনো সেই আগের মত। কেন্দ্ৰীয় সরকার পূর্ববাংলার উন্নয়নমূলক কাজে উদাসীনতা দেখিয়ে যাচ্ছেন। বন্যা ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে পূর্ব বাংলাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করার জন্য বহুবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার সে বিষয়ে উদাসীন।

সরকারের অজুহাত হল যে, ভারতবর্ষের সহযোগিতা ভিন্ন পূর্ব বাংলার নদীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু কাশ্মীরের সমস্যা সমাধান না হলে ভারতবর্ষের সাথে এ সব বিষয়ে আলোচনা করা যাচ্ছে না। মুজিবুরের কথা হল যে, কাশ্মীর সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সিন্ধুনদী নিয়ে যদি ভারতের সাথে চুক্তি করা চলে তবে পূর্ববাংলার নদীগুলোর সমস্যা নিয়ে কি ভারতের সাথে আলোচনা করা সম্ভব নয়? কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে মুজিবুরের বক্তব্য হল ইসলামাবাদে আধুনিক কায়দায় নতুন রাজধানী গঠনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে কিন্তু পূর্ববাংলার সর্বনাশা বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার সময় সরকারের অর্থ থাকে না। পূর্ববাংলার এই সকল সমস্যা দূর করার জন্য মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ ৬ দফা উত্থাপন করলেন।

এই ৬ দফা দাবীকে বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ নানাভাবে সমালোচনা করেন। অনেক আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ এনেছেন। এই অভিযোগের উত্তরে মুজিবুর রহমান বলেন, “বাঙালীরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অতএব বাঙালীদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ কি ভাবে আসে? সংখ্যগরিষ্ঠরা কি নিজেদের দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়?” অনেকে অভিযোগ করে বলেন যে আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিতর দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এত কম ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে যে পৃথিবীর কোন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারেরই সেই রকম ব্যবস্থা নেই। কিন্ত তাঁরা ভুলে যান যে পাকিস্তানের মত এই রকম দুই খণ্ডে বিভক্ত কোন রাষ্ট্রও পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অভিনবত্ব যদি থাকে তবে সেটাই তো স্বাভাবিক।

পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জেগে উঠলো। “জাগো জাগো, বাঙালী জাগো”, “জয় বাংলা”, “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা”- ইত্যাদি স্লোগান সেই জাগরণের সাক্ষ্য বহন করছে। অনেকে এই সব স্লোগানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনেন। জামাতে ইসলামীর পূর্ববঙ্গের নেতা অধ্যাপক গোলাম আজম বলেন, পাকিস্তান শুধু মুসলমানদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।

বাঙালী মানেই যারা বাংলাদেশে বাস করে অর্থাৎ সকল জাতিই। কিন্ত হিন্দু মুসলমান মিলে যদি এক জাতি হোত তবে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করা হল কেন? অর্থাৎ অধ্যাপক গোলাম আজম মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ সকলে মিলে একটি জাতির সৃষ্টি করতে পারে তা মানেন না। কিন্ত কেবল মাত্র ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গড়ে ওঠে একথা আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে না। অন্য অনেক দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এটাই হল মূল তফাৎ।

ইসলামের নাম করে পাকিস্তানে এতদিন যে রাজনীতি চলেছে তার আসল চেহারা পুর্ববাংলার অধিবাসীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইসলামের নাম করে পূর্ববাংলাকে তার ন্যায্য দাবী থেকে এতদিন বঞ্চিত করা হয়েছে।

বাংলার বিখ্যাত চিন্তানায়ক আবুল ফজল ‘ইত্তেফাকে’ লিখলেন, “আমাদের দেশের যে কয়েকটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ধর্মের সেবা করছে বলে দাবী করছে, আদতে ধর্মের খেদমত বা ধর্মপ্রচার এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা দখল সহজ হবে মনে করেই এসব প্রতিষ্ঠান ধর্ম বা ইসলামকে করেছে একমাত্র মূলধন। কারণ এ মূলধনের সাহায্যে ধর্মপ্রাণ জনগণকে সহজেই উত্তেজিত করে তোলা যায়, যায় বিভ্রান্ত করা।” অপর এক জায়গায় আবুল ফজল বলেন: “আমার বিশ্বাস ধর্ম আর রাজনীতি কখনো একসঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশতে পারে না।” শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বক্তৃতাতে বারবার উল্লেখ করেছেন যে বাংলার দাবী যখনই উত্থাপন করা হয় তখনই একদল লোক ইসলামের নাম দিয়ে সে দাবী অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে।

শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনের সময় প্রকাশিত এক ইস্তাহারে বলেন যে, প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, ঔষধপত্র এবং ন্যায্য বেতনে চাকুরী দেওয়ার ব্যবস্থা করা সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। কিন্ত অর্থনৈতক অবিচার দূর করে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির ব্যবস্থা এবং সেই উন্নতির ফলে উৎপাদিত ধন যাতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খণ্ডে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে বণ্টন করা হয় তার ব্যবস্থা করাই আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য। কিন্ত নতুন সমাজে যে জনসাধারণের কঠোর পরিশ্রম এবং ত্যাগ স্বীকার ব্যতীত গঠন করা সম্ভব নয় একথাও বলা হয়।

রাষ্ট্রের বিভিন্ন খণ্ড এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোক সকলেই যাতে অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকারে রাজী হয়, ও সকলেই যাতে উন্নতির ফল ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করাও দলের অন্যতম উদ্দেশ্য।নিজের দলের নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শেখ, মুজিবুর রহমান ২৪শে অক্টোবর বেতার ও টেলিভিশন যোগে যে ভাষণ প্রদান করেন তাতে তিনি বলেন :

“বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষণ ও অবিচারের যে অসহনীয় কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে অবশ্যই তার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। জাতীয় শিল্প সম্পদের শতকারা ৬০ ভাগের অধিক আজ মাত্র দু-ডজন পরিবার করায়ত্ত করেছে। ব্যাঙ্কিং সম্পদের ৮০ ভাগ এবং বীমা সম্পদের শতকরা ৭৫ ভাগ এই দু’ডজন পরিবারের কুক্ষিগত।” দলের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন :

“জাতীয়করণের মাধ্যমে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলি সহ অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলোকে জনগণের মলিকানায় আনা অত্যাবশ্যক বলে আমরা বিশ্বাস করি। অর্থনীতির এসব ক্ষেত্রে ভবিষ্যত উন্নয়ন সাধিত হবে সরকারী অর্থাৎ জনগনের মালিকানায়। নতুন ব্যবস্থায় শ্রমিকগণ শিল্প ব্যবস্থাপনায় ও মূলধন পর্যায়ে অংশীদার হবেন। বে-সরকারী পর্যায়ে এর নিজস্ব ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে।

একচেটিয়াবাদ ও কার্টেল প্রথার সম্পুর্ণরূপে বিলোপ সাধন করতে হবে। কর-ব্যবস্থাকে সত্যিকার গণমুখী করতে হবে। সৌখিন দ্রব্যাদির ব্যাপারে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করে তাদেরকে উৎসাহ দিতে হবে। এ সমর্থনের জন্যে কুটিরশিল্পের ক্ষেত্রে কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।…সমবায়ের মাধ্যম ক্ষুদ্রাকৃতির শিল্প গড়ে তুলতে হবে।” পাট, তুলা ব্যবসায় জাতীয়করণের উপর তিনি উক্ত ভাষণে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। ভূমি বণ্টন ও কৃষি উন্নয়ন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেনঃ “প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গোটা কৃষি ব্যবস্থাতে বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম পাকিস্তানে জমিদারী জায়গীরদারী সর্দারী প্রথার অবশ্যই বিলোপ সাধন করতে হবে। প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গোটা ভূমি-ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস সাধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভূমি দখলের সর্বোচ্চ সীমা অবশ্যই নির্ধারণ করে দিতে হবে। নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত জমি এবং সরকারী খাস জমি ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।”

আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। যে সমাজতন্ত্র বিশেষ পার্টির ডিক্টেটরশিপের সাথে জড়িত আওয়ামী লীগ তার ঘোরতর বিরোধী। আওয়ামী লীগ মনে করে যে সমাজতন্ত্রের নামে কোন বিশেষ নীতি, সমস্ত দেশের বিশেষ সমস্যাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতেই সেই দেশের সমাজতন্ত্রের রূপ নির্ধারিত হয়। তাই তাঁরা বলেন যে তাঁদের সমাজতন্ত্র বিদেশ থেকে আমদানী করা কোন সমাজতন্ত্র নয়, বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানের জন্যই এই সমাজতন্ত্র গণতন্ত্র ও মানবতাবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। আওয়ামী লীগের সমাজতান্ত্রিক নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এম আনিসুজ্জামান বলেনঃ “আপনাদের গভীর মানবতাবোধে উদ্ধুদ্ধ হয়ে উঠতে হবে। রোজা লুকসেমবার্গের সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ রাখবেনঃ দৃঢ়নিষ্ঠ বৈপ্লবিক কার্যকলাপের সঙ্গে গভীর মানবতাবোধের সংযোগই সমাজতন্ত্রে মূল কথা।”

[১৯৬৯ সালের ১৪ই আগস্টে ‘জনতা’ থেকে উদ্ধৃত।]

অনেকে মনে করেন যে আওয়ামী লীগের নীতি পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী। কিন্ত শেখ মুজিবুর বার বার ঘোষণা করেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের বিরুদ্ধে তাঁর কোন অভিযোগ নেই। যে দু-ডজন পরিবার পাকিস্তানের অর্থনীতিকে নিজেদের স্বার্থে কুক্ষিগত করে রেখেছে তারা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের লোক। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এই কয়েকটি পরিবারের স্বার্থ দ্বারাই চালিত হচ্ছে। অতএব আওয়ামী লীগের সংগ্রাম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এবং সেই দু-ডজন পরিবারের নীতির বিরুদ্ধে। এই সংগ্রামের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থের কোনই বিরোধ নেই। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের উভয় খণ্ডের জনসাধারণের মঙ্গল কামনা করে। মুজিবুর রহমান যখন আয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানে যান তখন “পাকিস্তান টাইমস্” এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লেখে, “গোলটেবিল বৈঠকে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য কে কথা বলবে?” তার উত্তরে মুজিবুর রহমান বলেছিলেন “কেন? পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আমি কথা বলব। পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধি ও মঙ্গল কামনা করেন বলেই দ্বিধাহীনভাবে তিনি একথা বলতে পেরেছিলেন। আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবী কেবল বাংলাদেশের জন্য রচিত হয় নি, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলির স্বার্থও এই নীতি দ্বারা সুরক্ষিত হবে। সিন্ধু যুক্ত ফ্রন্টের প্রেসিডেন্ট জনাব জি এম সৈয়দ তাঁর বেতার ভাষনে বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফার ভিত্তিতে আমরা প্রদেশসমূহের জন্য সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন দাবী করি।’

[১৯৭০ সালের ২১শে নভেম্বরের দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ থেকে। ]

দুই বাংলার মধ্যে সহজ সম্পর্ক চাই

মুজিবুর রহমান তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বেতার ভাষণে বলেনঃ “কারুর প্রতি বিদ্বেষ নয়, সকল রাষ্ট্রের সাথে, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে আমরা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানে বিশ্বাসী। আমরা মনে করি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া উচিত। এর মধ্যে আমাদের জনগণের বৃহত্তম স্বার্থ নিহিত রয়েছে। সেজন্য প্রতিবেশীদের মধ্যে বর্তমান বিরোধসমূহের নিষ্পত্তির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করি।” আলোচনার মাধ্যমে সমস্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বলে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।

দুই বাংলার মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের উপর আওয়ামী লীগ ও পূর্ববাংলার শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। দুই বাংলার মধ্যে স্বাভাবিক বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন যাতায়াতের সুযোগ সুবিধা এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ব্যবস্থা, সৃষ্টি করার দাবী পূর্ববঙ্গে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সেখানকার কয়েকটি সংবাদপত্র পাকিস্তান ও ভারতের বাণিজ্যিক লেন-দেন শুরু করার জন্য বহুবার সেখানকার সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন। গত ২৫শে অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমীর ৫ম বার্ষিক সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে একাডেমীর সভাপতি সৈয়দ মুর্তাজা আলী পশ্চিমবঙ্গ থেকে বইপত্র আমদানি ও পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত বই বাংলার ওপারে রপ্তানীর ব্যপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়াটিক সোসাইটির বার্ষিক সাধারণ সভায় সোসাইটির সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যক্ষ ডক্টর এ. বি. এম হাবিবউল্লাহও পশ্চিমবঙ্গ থেকে বইপত্র আমদানীর উপর যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা তুলে দেবার জন্য পাক সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

রাজনীতির রথও যদি প্রকৃতির বিধান ও ভৌগোলিক পরিবেশকে অগ্রাহ্য করে নিজের খেয়াল খুশীমত এগিয়ে চলতে আরম্ভ করে তবে তার ফলে মানুষের কল্যাণ সাধন তো দূরের কথা নানা প্রকার অনাসৃষ্টি ও দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এপার ও ওপার বাংলার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক যোগ-সূত্র বর্তমান তা অস্বীকার করে কোন বাংলার রাজনীতিক সার্থক হয়ে উঠতে পারে না। বিজ্ঞান সম্মত রাজনীতি, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে; তাদের অস্বীকার করে নয়।

দুই বাংলার অর্থনীতি পরষ্পরের উপর নির্ভরশীল। এ সম্পর্ককে অস্বীকার করার ফলে দুই বাংলার অর্থনীতিই আজ পঙ্গু। পূর্ব বাংলার মাছ যদি ওপারের বাজারেও বিক্রি করা সম্ভব হয় তবে পশ্চিমবঙ্গের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ও পূর্ববঙ্গের অস্বাভাবিক মূল্য হ্রাস এই দুই সমস্যারই সমাধান হতে পারে। পূর্ব বাংলার পাট চাষীরা এখানে বিক্রি করার স্বাধীনতা পেলে তাঁরা যেমন সহজেই পাটের ন্যায্যমূল্য পেতে পারবেন তেমনই পশ্চিমবঙ্গে ধানের বদলে পাট চাষের প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে এবং তার ফলে এ বাংলার খাদ্য-সমস্যা সমাধানের পথ অনেকাংশে সহজতর হয়ে উঠবে। এই ধরণের অর্থনৈতিক সহযোগিতার উপরই উভয় বাংলার সমৃদ্ধি নির্ভর করছে। পূর্ব বাংলার চাষীর ক্রয়ক্ষমতা যদি বৃদ্ধি না পায় তবে সেদেশে শিল্পের অগ্রগতি কি করে সম্ভব? সেই ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবার সহজ স্বাভাবিক উপায়কে যে অস্বীকার করে, তা আত্মঘাতী। অর্থনীতির সহজ নিয়মকে অস্বীকার করার ফলে সীমান্তে ক্রমশ চোরাকারবারের প্রসার বেড়ে চলেছে। এই তথাকথিত চোরাকারবারকে দমন করার চেষ্টা বৃথা; ব্যবসায়-বাণিজ্যের রাজপথকে উন্মুক্ত রাখাই চোরাকারবার বন্ধের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায়। পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্য দেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে যখন দ্রুত এগিয়ে চলেছে তখন কোন যুক্তিতে আমরা দুই বাংলার মধ্যে সমস্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সমস্যায় জর্জরিত হয়ে নিজেদের রুদ্ধ কক্ষে বাস করে দিন যাপন করব? প্রত্যেক দেশের রাজনীতি জাতীয় স্বার্থ দ্বারাই নির্ধারিত হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় তার পথ অবরোধ কেন? বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের ফলে কোন রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা তো কোনদিন কোন প্রকারে ক্ষুন্ন হয়নি। ভারত ও পাকিস্তান দুইটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাদের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যা মতবিরোধও প্রচুর, কিন্ত সেই অজুহাতে অর্থনৈতিক অবরোধের নীতি গ্রহণ করার কোন যৌক্তিকতা নেই। এ পথ বাঁচবার পথ নয়– এ পথ আত্মহত্যার পথ।

উভয় বাংলার জনকল্যাণের স্বার্থেই পরস্পরের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। দুই বাংলাতেই আজ এই দাবী সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কোন রাজনীতিই এ দাবীকে বেশী দিন প্রতিরোধ করতে পারবে না। গঠনমূলক দৃষ্টিতে এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে বাঙালী জাতিকে নূতনভাবে গড়ে তোলার দিন আজ সমাগত।

মুজিবুর রহমান রাজ্যব্যাপী প্রচার অভিযানে যে কয়েক হাজার বক্তৃতা দেন তার দুটি বক্তৃতা এখানে তুলে ধরছি। শেখ মুজিব রাজ্যব্যাপী প্রচার অভিযান শেষ করলেন। নির্বাচনী কর্মসূচী প্রকাশ উপলক্ষে ও নির্বাচনী প্রস্তুতিতে কেন্দ্রীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হল ঢাকায়। সভা শুরু হওয়ার মুখে এল আকাশ ভেঙ্গে ঝড় বৃষ্টি। ঝড়ের বেগে মঞ্চ দুলতে লাগল মাঝদরিয়ায় ঢেউয়ের নৌকার মত। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা। শুধু ঝড় নয়, নেমে এলো ঝড়ের ধারা। সারা ময়দানে একহাঁটু জল হয়ে গেল কিন্তু একজন মানুষও ময়দান ছেড়ে গেল না। এই দুর্যোগ বুঝি মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলের ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে এনে দিল। প্রথম দিন সভায় ঝড় জল যেমন নির্বাচনের অনেক আগে নেমে এসেছিল, নির্বাচনের পরে সেই ঝড় জল বুঝি নেমে এল অন্য রূপে। নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন বাকী, পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল পূর্ববঙ্গে। বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর কখনও ঘটে নি। খৃষ্টের জন্মের পুর্ববর্তী কালে বিষুবিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত এবং চীনের দুর্ভিক্ষে যে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল তার সাথে একমাত্র তুলনা করা যেতে পারে পূর্ব-পাকিস্তানের এই ঘুর্ণিঝড় ও বিপর্যয়কে। ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে চীন দেশের পীত নদীতে বন্যায় অথবা ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে টেকসাস হ্যারিকেনে, ১৯৫৩ খ্রীষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডে ঝটিকা জলোচ্ছ্বাসে, ১৯৫৯ খ্রষ্টাব্দে মেক্সিকোতে বন্যায় যে সব ক্ষতির বিবরণ আছে পূর্ব পাকিস্তানের ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সেই সব রেকর্ডকে ম্লান করে দিল। পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে পশ্চিম-পাকিস্তান তথা কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরূপ আর একবার চিনে নেবার সুযোগ পেল। ১৯৬০ সালে থেকে এই ভাবে বারবার প্রকৃতির নিষ্ঠুর আক্রমণে পুর্ব পাকিস্তানে কম করে ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫ শত কোটি টাকা। কিন্তু কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার পূর্ব-বাংলার দিকে ফিরে তাকাবার প্রয়োজন অনুভব করেননি। পরবর্তীকালে মুজিব বার বার এই কথা বলেছেন। কোথায় পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি রক্ষার কর্ণধাররা, কোথায় ইয়াহিয়া খাঁ, ভুট্টো সাহেব, কেউ একবার আমাদের দেখতে পর্যন্ত এলেন না! মহাপ্রলয়ের দেড় মাস পরে” এই শিরোনামে পূর্ব-পাকিস্তানের এক দৈনিক পত্রিকায় ভোলা ও পটুয়াখালির বন্যা-বিধ্বস্ত এলাকার এক চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। তা এই-

“১২ই নভেম্বর মহাপ্রলয়ে বিধ্বস্ত বরিশাল জেলার ভোলা মহকুমার ভোলা, দৌলতখান, লালমোহন, তজুমদ্দিন, চরফেসন; পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা, খেপুপাড়া, বরগুণা থানার অঞ্চল ও চরাঞ্চলে এখনও যাহারা কোনমতে বাঁচিয়া আছে, তাহাদের অধিকাংশই ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর দারুণ শীতে একরকম বিনা বস্ত্রেই উন্মুক্ত আকাশের নীচে কালযাপন করিতেছে। বেতার সরকারী ও বৈদেশিক সাহায্য বিতরণের যে ফিরিস্তি প্রকাশ করিতেছেন, সরেজমিনে তদন্ত করিলেই কেবলমাত্র তাহার সত্যতা প্রমাণিত হইবে। বরিশাল পটুয়াখালি জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখনও হাজার হাজার লোক খাদ্যের অভাবে গাছের পাতা, কচু গাছ ও অখাদ্য- কুখাদ্য খাইয়া নামমাত্র বাঁচিয়া আছে। পৌষের এ তীব্র শীতের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের নীচে এখনও বিনা বস্ত্রে হাজার হাজার লোক মৃত্যুপথ যাত্রী। বিভিন্ন এলাকায় কয়েকজন শিশুর শীতে মৃত্যুবরণের খবর পাওয়া গিয়াছে। মহাপ্রলয়ের পর দীর্ঘ ৫০ দিন অতিবাহিত হইলেও সরকার আজও বিধ্বস্ত এলাকায় পরিবার পিছু একটি শীতের কাপড়ও দিতে পারেন নাই। দুর্গতদের ভাসিয়া যাওয়া কুঁড়েঘর নূতন করিয়া গড়িবার জন্য একখণ্ড বাঁশ, গোলপাতা বা অন্য কোনরকম সামগ্রী যোগাড় করিতে পারেন নাই। অথচ বিভিন্ন সরবরাহ ডিপোতে বিপুল পরিমাণ সাহায্য এবং গৃহনির্মাণ সরঞ্জাম পড়িয়া আছে। .. কয়েকটি ডিপোতে চাল, আটা ও অনেক রিলিফ পচিয়া যাইতেছে বলিয়া খবর পাওয়া গিয়াছে। . . . . . ছেলে-মেয়েদের পরণে কোন কাপড় নাই, শিশুরা ন্যাংটা এবং বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা ও পুরুষেরা খেজুর গাছের পাতার বেষ্টনীর মধ্যে থাকিয়া কোন রকমে ইজ্জত রক্ষা করিবার বৃথা চেষ্টা করিতেছে।… আমি ব্যক্তিগতভাবে এখনও উপদ্রুত এলাকায় বহু গলিত মথিত মানুষ ও পশুর লাশ পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াছি। চরফেশন থানার বেতুয়া স্লইস গেটের মধ্যে ও তাহার আশেপাশে এখনও বহু লাশ পড়িয়া আছে। …একজন গ্রামবাসী আমাকে জানান যে তাঁহারা মাথাপিছু সপ্তাহে মাত্র আধসের চাউল ও আটা পাইয়াছেন।” [মহাপ্রলয়ের দেড় মাস পরেঃ ভোলা ও পটুয়াখালী। নিজামউদ্দিন আহমদ প্রদত্ত। দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা ২২শে পৌষ, ১৩৭৭]

একজন সাংবাদিক লিখেছেন—”কয়েক আউন্স তুলো আর তার ভিতরে বেশ কয়েকটি ন্যাপথলিন পুরে একটি মুখোশ তৈরি করে নাকমুখ তা দিয়ে বেঁধে আমরা কয়েকজন এগুচ্ছিলাম। এগুচ্ছিলাম দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের দানবীয় আক্রমণে লক্ষ লক্ষ লোকের বধ্যভূমি স্ট্যালিনগ্রাদের দিকে নয়, সত্তরের স্টালিনগ্রাদ চরজব্বারের দিকে।”

তারপর তিনি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিভিন্ন শ্রেণীর বিপর্যস্ত মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাৎ করেছেন সেই বৃদ্ধটির সঙ্গে যিনি রিলিফ নিতে চান নি, কেননা আজীবন তিনিই সবাইকে রিলিফ দিয়েছেন। যে হাতে তিনি সবাইকে দিয়েছেন, সেই হাতে তিনি নেবেন কি করে?

দেখে এসেছেন আঠারো ঊনিশ বছরের বলিষ্ঠ গড়নের যুবককে। সে একটি কলেজের প্রথম বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র। সে তার বন্ধুদের সাথে এসেছিল রিলিফের কাজে! কিন্ত ধ্বংসলীলার ভয়াবহ দৃশ্য দেখে সে পাগল হয়ে গিয়েছে। তাকে একটি বাড়ীর উঠানে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে সে ইকবালের শেকোয়া কাব্য আবৃত্তি করছে—”হে খোদা তুমিই আসামী। এত নিষ্ঠুর কেন হলে তুমি?

আর দেখেছেন পাশাপাশি দুটি লাশ। মৃত্যুও যাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারে নি। নববিবাহিত এক দম্পতি। একটি দামী সূতির শাড়ীর দুই প্রান্তে দু’জনের কোমর বাঁধা। দু’জনের হাতেই মেহেদির রং মাখানো। হয়তো সেই মহা দুর্যোগের রাতে তাদের ফুলশয্যা হয়েছিল। বিয়ের সময় মোল্লা পুরুত যে মন্ত্র পড়েন, এক হও, থেকো একসঙ্গে, কেউ কাউকে পরিত্যাগ করো না–তা তাঁরা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন। মৃত্যুও কিন্তু এখানে হার মানল না? [‘দেখিয়া এলেম আমি আবার হাহাকার ভরা।’ সলিমুল্লা। পূর্বদেশ, সোমবার,১৪ই অগ্রহায়ণ]

‘পূর্বদেশ’ সম্পাদকীয় লিখেছেন–

“শাওয়ালের চাঁদে এবার বক্র ইশারায় তাই নতুন জীবন-জিজ্ঞাসা চিহ্নিত। আমরা জীবস্মৃত জাতি হিসাবে চরম ধ্বংসের দিকে এগুবো, না জীবনের নতুন সূর্যকে তমসার আড়াল থেকে ছিনিয়ে আনব। এবারের ঈদে অভিনন্দন নয়, শপথ গ্রহণ। খণ্ডচাঁদে জীবনের যে প্রতিভাস, হোক সে আজ ক্ষীণ, তাকে কয়েকজনের জীবনে নয় সকলের জীবনে পরিপূর্ণ করে তোলার সাধনাই আমাদের এবারের ঈদ।”

আর কবি-সাহিত্যিকদের কাছে এ বেদনায় রক্তিম নতুন এক চেতনা। গভীর বেদনার বিলাপে এবং কঠিন সংগ্রামের শপথে একই সঙ্গে উদ্বেলিত এবং সংহত তাদের চেতনা। এমনি কবিতাঃ

আর কান্দিসনে মা/হাসনা আরা

“একদা শান্ত ঝিলের স্বচ্ছ জলে
মুখ দেখত আমার রূপসী মা
সে জলে এখন ভাসমান তার ছেলে —
আমার মা।………
কান্দে আমার মা,মৃতবৎসা
অঝোর ধারে সে কান্দনে কাঁদে আকাশ
হায়রে ভাগ্যবতী
বুকে উপুড় হয়ে পড়া কেশ,
মরণেও তোরে আঁকড়ে ধরে
অবোধ সন্তান। …..
ফুরিয়ে গেছে অশ্রুজল
তার চেয়ে বুকে পাষাণ বাঁধ
রুদ্ররোষে জ্বালাও ওদের
তোমায় যারা করল অপমান,
দুঃখের গরল আকণ্ঠ পানে নীলকন্ঠীহ
জননী আমার
বঙ্গ আমার, স্বর্গ আমার,
কান্দিস নে মা আর।”

এমনি অসংখ্য কবিতা পুর্ব পাকিস্তানের রবিবারের সংবাদ সাময়িকীতে, বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার সবগুলি সংকলন করলে বাংলা সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ হবে। যেমন হয়েছে পঞ্চাশের মন্বন্তরের উপর লেখা কবিতা সংকলন।

আর এক কবি জাহিদুল হক, তার এক অপূর্ব কবিতায় অপরুপ শোকগাথা রচনা করেছেন। তার খানিকটা তুলে দিচ্ছিঃ

“ভাঁড়ার এখানে শূন্য; আমাদের চারিদিক
আজ লাশে একাকার
অপহৃত শম্যের মাঠে, বাঁশ ঝাড়ে নিকানো উঠানে।
হাতিয়ায়, সন্দ্বীপে, খুলনায়, বরিশালে
হৃদয়ের আনাচে কানাচে,
স্বপ্নে সবুজ এত লাশ,-হে পৃথিবী আমরা
কোথায় যাবো,
আমাদের চাদ্দিকে ক্ষুধা, বিভীষিকা
মৃত্যুর শরীর,
আমাদের রান্নাঘর ভেঙ্গে গেছে গত রাতে
ভীষণ তুফানে,
স্বপ্ন সাধ, হৃৎপিণ্ড, আমাদের সভ্যতার
পাঁচলক্ষ কারিগর,
গত রাতে বিনাশী তিমিরে ডুবে হাহাকার
লাশ হয়ে গেছে।
আমরা কোথায় যাবো, ডানা ভাঙ্গা সেই
পাখীটার মতো
কোথাও সংসার নেইঃ চারপাশে অপহৃত
ফসলের মাঠ–আমরা কোথায় যাবো?
ভাঁড়ার এখনো শূন্যঃ নীল চোখ গলে গেছে
তাই – সমগ্র শরীর
আমাদের সারা বুকে নিদারুণ জেগে আছে
স্বজনের নষ্ট কবর।

[নষ্ট কবর–জাহিদুল হক]

দুর্যোগ কেটে গেল। বহু প্রত্যাশিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এই প্রথম নির্বাচন। নির্বাচনে অসাধারণ সাফল্য ঘটল আওয়ামী লীগের। যে ঝড়ের অগ্নিরথে আওয়ামী লীগের অভিযান শুরু হয়েছিল ৭ই জুন ১৯৭০ সালে, সেই ঝড়ই বুঝি নিশ্চিহ্ন করে দিল নির্বাচনী প্রতিপক্ষকে। কোথায় গেল মুসলিম লীগ, কোথায় গেল কনভেনসান মুসলিম লীগ, কোথায় গেল অন্যান্য দলছুটেরা। মুজিবুর ও আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচি সামনে নিয়ে জাতীয় পরিষদের তিনশটি আসনের মধ্যে ১৬০ টি আসন লাভ করল। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্দ্দিষ্ট ১৬২ টি আসনের মধ্যে ১৬০ টি আসনই পেল আওয়ামী লীগ। প্রাদেশিক বিধানসভায় ৩০০ টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন পেল আওয়ামী লীগ।

৩রা জানুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে সভা। একখানা ৩০০ ফুট লম্বা সুবৃহৎ নৌকার অবয়বে তৈরী হল মঞ্চ, মঞ্চের উপর দাঁড়ালেন আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা। মাঝে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ সভা ছিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সভা। শপথ নিলেন মুজিবুর রহমান, শপথ নিলেন আওয়ামী লীগের সদস্যরা। ৬ দফা কর্মসূচি রূপায়ণ আমাদের লক্ষ্য, আমাদের ব্রত। তারপর ১২ই জানুয়ারী ঢাকায় এলেন ইয়াহিয়া খাঁ, তারপর এলেন ভুট্টো সাহেব, জাতীয় পরিষদের বৈঠক দু’বার মুলতুবি হয়ে গেল, ইতিহাসের চাকা ঘুরতে আরম্ভ করল। এল ফিরে ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ সাল। সংগ্রামে আত্মত্যাগের প্রেরণা গ্রহণের মিনার তৈরি হয়েছে এই ২১ শে ফেব্রুয়ারী। শেখ মুজিবুর ১৯৫২ সালের পর অনেকবার এসেছেন এই ২১ শে দিনটিতে, আজ ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী আবার এলেন সেই শহীদ-বেদীর পাদদেশে।

২১ শে ফেব্রুয়ারী – ১৯৭১ সাল

একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারীর কাকডাকা ভোরে শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর শপথবাণী উচ্চারণ করে বললেন, ‘বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী নস্যাৎ করে দেবার জন্যে শক্তি প্রয়োগ করা হলে তা বরদাস্ত করা হবে না। প্রয়োজনে বাঙালী আরও রক্ত দেবে, কিন্তু স্বাধিকারের দাবীর প্রশ্নে কোন আপোস করবে না।’ শেখ মুজিবুর রহমান যখন কথাগুলি বলছিলেন তখনো ভালো করে ভোরের আলো ফোটেনি। পূর্ব আকাশে লালের ছোপ ধরেছে সবে, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়ে খালি পায়ে সমবেত হয়েছে শহীদ বেদীর সামনে নতুন দিনের নতুন শপথ নিতে। তিনি বলে চলেছেন, ‘বাংলার মানুষ যাতে রাং নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে বরকত – সালাম-রফিক-শফিকরা নিজেদের জীবন দিয়ে সেই পদ দেখিয়ে গেছেন। ৫২ সালের সেই রক্তদানের পর, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯-এ বার বার বাঙালীকে রক্ত দিতে হয়েছে। কিন্ত আজও সেই স্বাধিকার আদায় হয়নি। আজও আমাদের স্বাধিকারের দাবী বানচাল করে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য বাংলার ঘরে ঘরে প্রস্তুত হতে হবে–এবার চূড়ান্ত সংগ্রাম। চরম ত্যাগের এবং প্রস্তুতির বাণী নিয়ে আপনারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুন, বাংলার প্রতিটি ঘরকে স্বাধিকারের এক-একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে দেখিয়ে দিন, বঙালীকে পায়ের নীচে দাবিয়ে রাখার শক্তি পৃথিবীতে কারুর নেই।’ একটু থেমে তিনি আবার বলেছিলেন, ‘ষড়যন্ত্রকারী শোষকগণ দুশমনের দল বার বার বাঙালীর রক্তে বাংলার মাটি রঞ্জিত করেছে। যারা নির্মম শোষনে লুণ্ঠনে বাংলার মানুষকে ভিখারিতে পরিণত করেছে, তারা আজও নিজেদের কুমতলব হাসিল করার চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে।’

শেখ মুজিব কারুর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বজ্রকণ্ঠে বললেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা জেনে রাখুন ১৯৫২ সাল আর ৭১ সাল এক নয়। ষড়যন্ত্রকারীদের বিষদাঁত কি করে ভাঙতে হয় তা আমরা জানি। কারু প্রতি আমাদের বিদ্বেষ নেই, আক্রোশ নেই, আমরা চাই স্বাধিকার, আমরা চাই আমাদের মতো পাঞ্জাবী, সিন্ধু, বালুচ এবং পাঠানরাও নিজ নিজ অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে কেউ আমাদের উপর প্রভূত্ব করবে। ভ্রাতৃত্বের অর্থ দাসত্ব নয়। সম্প্রীতি আর সংহতির নামে বাংলাদেশকে আর কলোনী বা বাজার হিসাবে ব্যবহার করতে দেব না। যারা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বাধিকারের দাবী বানচালের জন্য বাঙালীকে ভিখারী বানিয়ে ক্রীতদাস করে রাখছে তাদের উদ্দেশ্য যে কোন মূল্যে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে। একটু থেমে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে শেখ মুজিব ফের বললেন,–‘ভাইরা আমার–বোনেরা আমার– সামনে আমাদের কঠিন দিন। আমি হয়ত আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে মরতেই হয়। জানি না, আবার কবে আপনাদের সামনে এসে দঁড়াতে পারব। তাই আজ আমি আপনাদের এবং বাংলার সকল মানুষকে ডেকে বলছি–চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হোন– বাংলার মানুষ যেন শোষিত না হয়, বঞ্চিত না হয়, লাঞ্চিত অপমানিত না হয়। দেখবেন শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। যতদিন বাংলার আকাশ, বাতাস, মাঠ,নদী থাকবে, ততদিন শহীদরা অমর হয়ে থাকবে। বীর শহীদদের অতৃপ্ত আত্মা আজ দুয়ারে দুয়ারে ফিরছে : বাঙালী তোমরা কাপুরুষ হইওনা, চরম ত্যাগের বিনিময়ে হইলেও স্বাধিকার আদায় করো। বাংলার মানুষের প্রতি আমারও আহ্বান–প্রস্তুত হোন। স্বাধিকার আমরা আদায় করবই।’

“তুমি আজ জাগো, তুমি আজ জাগো
একুশে ফেব্রুয়ারী
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে
বীর নারী
আমার শহীদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে
দারুণ ক্রোধের আগুনে জ্বালবো ফেব্রুয়ারী
একুশে ফেব্রুয়ারী, একুশে ফেব্রুয়ারী

কেটে গেছে ২১শে ফেব্রুয়ারী। মুজিবের মনে কিন্তু নানা সন্দেহ দানা বাঁধলেও ধরে নিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। তাই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ঘোষণা করলেন মুজিব।

২৮শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় শিল্প ও বণিক সংঘের সম্বর্ধনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করিবে।

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান রবিবার (২৮শে ফেব্রুয়ারী) বিকালে প্রাদেশিক পরিষদ ভবন প্রাঙ্গণে আয়োজিত ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির সংবর্ধনা-সভায় প্রধান অতিথির ভাষণ দান কালে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, তাঁহার দল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তবে সেই সমাজতন্ত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে নয়, বরং নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পন্থায় আস্তে আস্তে বিবর্তনের মাধ্যমে সেই লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যাইবে বলিয়া তাঁহার দল বিশ্বাস করে।

আওয়ামী লীগ প্রধান ঘোষণা করেন যে, ৬ দফার মাধ্যমে স্বাধিকার অর্জিত হইলে এদেশের ব্যবসায়ীদের বৈদেশিক মুদ্রার অভাব হইবে না সত্য। কিন্তু তাই বলিয়া একচেটিয়া পুঁজি ও কার্টেল প্রথা সৃষ্টি করিতে দেওয়া হইবে না। সমাগত শিল্পপতি ও বণিকদের উদ্দেশ্য করিয়া তিনি দৃপ্তকণ্ঠে আরও ঘোষণা করেন যে, ৭ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন আদায়ের পর এদেশে নতুন ২২ পরিবারের সৃষ্টি হইতে দেওয়া হইবে না।

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণের প্রারম্ভে ২৩ বৎসরে যাঁরা শহীদ হায়েছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাংলাদেশের বিশেষ করে গ্রাম বাংলার দুঃখ- দুর্দশা এবং সমস্যার কথা উল্লেখ করে শেখ সাহেব বলেন, স্বাধিকারের জন্য যারা বৎসরের পর বৎসর কারাবরণ করিতেছেন, আন্দামানে নির্বাসিত জীবন যাপন করিতিছেন, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়াছেন, তাঁহারা কি এই স্বাধীনতা চাহিয়াছিলেন। কায়েদে আজম যদি আজ বাঁচিয়া থাকিতেন তিনি বলিতেন, আমি জনগণের জন্য পাকিস্তান চাহিয়াছিলাম। এই পাকিস্তান চাই না। তিনি আরো বলেন, আজ যদি দেশের দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন না হয়, তবে শহীদানের আত্মা শান্তি পাইবে না। তিনি বলেন যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়া মানুষকে বাঁচানো যাইবে না।

তিনি ২৩ বৎসরের শোষণ ও বঞ্চনার খতিয়ান তুলে ধরে বলেন যে, স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশ শতকরা ৭০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করিতেন। কিন্তু বর্তমানে তাহা কমিয়া ৪৫ ভাগে নামিয়াছে। আর পশ্চিম পাকিস্তান শতকরা ৩৩ ভাগের স্থলে ৫৫ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করিতেছে। বাংলার পাট, তামাক, চায়ের বিনিময়ে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় পশ্চিম পাকিস্তানে কলকারখানা স্থাপন করিয়া সেই কলকারখানায় প্রস্তুত দ্রব্যই বাংলার বাজারে বিক্রয় করিতেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের কাপড়ের একচেটিয়া বাজার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বাংলার তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করা হইয়াছে। তিনি আরো বলেন যে, দেশের ব্যাঙ্ক ইনসিওরেন্সের মালিক আজ পশ্চিম পাকিস্তানের ২২ পরিবার। তাই বাঙালী ব্যবসায়ীদের এল. সি. মার্জিন দিতে হয় শতকরা ৪০ ভাগ। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীগণ টেলিফোন মারফত এল. সি. খুলিয়া ফেলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মাত্র ৬ হাজার হাসপাতালে বেডিং রহিয়াছে অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে ২৬ হাজার স্থাপন করা হইয়াছে। বাংলাদেশের বন্যা সমস্যাকে অগ্রাধিকার না দিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের তারবেলা, মঙ্গলা বাঁধ নির্মাণ করা হইয়াছে। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার কেন বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান করেন নাই। কেন্দ্রীয় সরকারে কি আমাদের অংশ ছিল না? শতকরা ৮০ ভাগ বৈদেশিক সাহায্য পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হইয়াছে। তিনি বলেন, দেশের ৫৬ জন বাঙ্গালী হইলেও কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরীতে শতকরা ৮৫ জনই পশ্চিম পাকিস্তানী এবং দেশরক্ষা বিভাগের শতকরা ৯০ টি চাকুরিতে পশ্চিম পাকিস্তানের লোক নিযুক্ত করা হইয়াছে। আর আমরা বাংলার ৭০ লক্ষ বেকার আজ চাকুরীর সন্ধানে পথে পথে ঘুরিতেছি। ২৩ বৎসরে বাংলার অর্থনীতিকে ভাঙ্গিয়া চুরমার করা হইয়াছে। আইন-শৃঙ্খলার নামে শ্রমিকদের হয়রানি করা হইতেছে। তিনি আরও বলেন, এই শোষণ চলিতে দেওয়া যাইতে পারে না। ইতিহাস শিক্ষা দেয় যে, অত্যাচার নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ একদিন না একদিন বিদ্রোহ ঘোষণা করিবেই। তিনি বলেন, বাস্তহারার ভিড়ে রাস্তা চলা যায় না। আমরা এই অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। দেশের মানুষকে আত্মনির্ভরশীল ভাবে গড়িয়া তুলিতে ব্যাঙ্ক, ইনসিওরেন্স জাতীয়করণ করিতে হইবে। তিনি শিল্পপতিদের উদ্দেশ্য বলেন, তাঁহারা যদি স্বাধিকারের আন্দোলনে দেশের মানুষের পাশে আসিয়া না দাঁড়ান তাহলে দেশের মানুষ তাঁহাদের ক্ষমা করিবে না।

জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান (বুধবার ২৪শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭১) ঢাকায় গণবিরোধী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়া ঘোষণা করেনঃ পাকিস্তানের জাগ্রত জনগণের মনে আজ আর কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নাই যে ষড়যন্ত্রকারী কায়েমী স্বার্থবাদী আর তাদের ফর্মাবরদাররা আজ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও জনগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের কার্যক্রম বানচাল করিবার জন্য শেষবারের মত উন্মত্ত প্রয়াসে মাতিয়াছে।

বারো কোটি মানুষের ভাগ্য এতই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে ইহা লইয়া ছিনিমিনি খেলার অবকাশ নাই। গত এক সপ্তাহ ধরিয়া জাতিকে যে সন্ন্যাসরোগীসুলভ ও রাজনৈতিক খ্যাপামী দেখিতে হইতেছে উহার অবসানের সময় আসিয়াছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা একটি শাসনতন্ত্র রচনা ও তাহাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালের জন্য সুপরিকল্পিতভাবে একটি কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা হইতেছে।

জনগণের প্রতি স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন মেজরিটি পার্টি আওয়ামী লীগ তিক্ত বিতর্কের দ্বারা পরিবেশ বিষাক্ত করিতে আগ্রহী না হওয়ার দরুণ এতদিন ইচ্ছাকৃতভাবেই নীরব থাকিয়াছে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী বলিয়াই আওয়ামী লীগ মনে করে যে একমাত্র জাতীয় পরিষদে আলাপ আলোচনার মাধ্যামেই গুরুত্বপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নের সুরাহা হইতে পারে এবং হওয়া উচিত। এই লক্ষ্য সামনে রাখিয়াই আওয়ামী লীগ অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের দাবী জানাইয়া আসিতেছিল। এই দল বরাবরই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় সম্মত থাকিয়াছে।

৬ দফা জনগণের সম্পদ

দলীয় নেতৃবৃন্দকে লইয়া আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মিলিত হই এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নির্বাচনী রায়প্রাপ্ত ৬ দফা শাসনতান্ত্রিক ফর্মূলার প্রতিপাদ্য ব্যাখ্যা করি। ইহার পর পিলস্ পার্টির চেয়ারম্যান জেড এ ভুট্টোর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। আমার সহকর্মীরা তাঁহার সহকর্মীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন। আমরা তাঁদের বুঝাইতে চাহিয়াছি যে, ৬ দফা ভিত্তিক ফেডারেল স্কীমের স্বপক্ষে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার ঐতিহাসিক রায় ঘেষিত হওয়ার পর ইহা এখন জনগণের সম্পদ। জনগণ আওয়ামী লীগকে ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ম্যান্ডেট দিয়েছে এবং আওয়ামী লীগ এই ম্যাণ্ডেটটি বাস্তবায়নের অবিচল প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ। তবে ৬ দফা বাস্তবায়িত হইলে পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত বা বেলুচিস্তানের ন্যায্য স্বার্থ বা ফেডারেল সরকারের কার্যকারিতা ক্ষুন্ন হইবে বলিয়া কাহারও মনে ভ্রান্ত ধারণা থাকিলে তাহা নিরসনের জন্য আমরা ৬ দফার প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিতে রাজী আছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *