মুজিবুরের আহবান
৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দেশব্যাপী আন্দোলনের আহবান জানালে সারা দেশব্যাপী আন্দোলনকে সার্থক করে তুলবার জন্য জনগণ সচেষ্ট হন।
(গণশক্তি–৬ই এপ্রিল)
উত্তাল উদ্দাম জলধিতরঙ্গ
৭ই মার্চ একটি অবিস্মরণীয় দিন। অনন্যসাধারণ ওই দিনের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান। অবিস্মরণীয় এই অনন্য দিনে রেসকোর্সে বাংলার স্বাধীকার আন্দোলনের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর নির্দেশকামী স্বাধিকার সৈনিকদের সংগ্রামী সম্মেলন।
“সংগ্রামী বাংলা দুর্জয় দুর্বিনীত। কাহারও অন্যায় প্রভুত্ব মানিয়া নেওয়ার জন্য, কাহারও কলোনী হইয়া, কাহারও বাজার হইয়াও থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয় নাই।” বঙ্গবন্ধুর এই তেজোদৃপ্ত ঘোষণারই পুনরাবৃত্তি করিয়া বাংলার অপরাজেয় গণশক্তি গতকাল (রবিবার) রেসকোর্স ময়দানে সার্বিক মুক্তিআদায়ের ইস্পাত কঠিন শপথের দীপ্তিতে প্রিয় নেতাকে যেন দুর্লঙ্ঘ্য নির্দেশ প্রদান করে, ‘বঙ্গবন্ধু আগাইয়া চলো, আমরা আছি পিছনে। আর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে আবহমান বাংলার বাসন্তী সূর্য আর উদার আকাশকে সাক্ষী রাখিয়া গতকাল নির্ভীক নেতা এবং বীর জনতার কন্ঠস্বর একই সুরে ধ্বনিত হইয়া উঠে যুগ যুগান্তর, দেশ-দেশান্তরের সকল মুক্তি পিপাসু সভ্য জাতির হৃদয়-বাসনার অমোঘ মন্ত্র ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ ধ্বনিত হইয়া উঠে লক্ষ লক্ষ কন্ঠে দিগন্ত কাঁপাইয়া ‘জয় বাংলা’। ৭ই মার্চ তাই বাংলার সার্বিক স্বাধিকার আন্দোলনের দুর্গম, দুস্তর পথের প্রান্তে একটি অতুলনীয় স্মৃতি ফলক।
গতকাল (রবিবার) রেসকোর্স ময়দানে স্বাধিকারকামী বাঙালীর ঢল নামিয়াছিল। আকারের বিশালতা, অভিনবত্বের অনন্য মহিমা, আর সংগ্রামী চেতনার অতুল বৈভবে এই জনসমুদ্র ছিল নজিরবিহীন। আর সেই বিশাল জনসমুদ্রের আর একটি লক্ষণীয় দিক ছিল হাতে বাঁশের লাঠি–কন্ঠে প্রলয় রাত্রির বিদ্রোহী বঙ্গোপসাগরের সঘন গর্জন। শতাব্দীর ইতিহাসের বক্ষে বিলীন স্বাধীনতা সংগ্রামী তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা দেখি নাই, কিন্তু গতকাল রেসকোর্সে বাংলার স্বাধিকারকামী জনতার হাতে দেখিয়াছি বাঁশের লাঠি আর সেই লাঠির সমবেত গর্জন যেন কামানের গর্জনের জবাব হইয়া গতকাল ঢাকার আকাশে বাতাসে ভাসিয়া বেড়াইয়াছে বহুক্ষণ। একের লাঠি অন্যের লাঠিতে ঠোকাঠুকি করিয়া আর সেই সঙ্গে বজ্রের নিকট হইতে ধ্বনি কাড়িয়া স্লোগান দিয়া বাংলার মানুষ যেন একে অপরকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে চাহিয়াছে-
“বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ/সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত/বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি/চিনে নিক দুর্বৃত্ত।”
গতকাল রেসকোর্সে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটিয়াছিল সার্বিক স্বাধিকার আন্দোলনে পরবর্তী কর্মসূচী সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর পথনির্দ্দেশ লাভের জন্য। আসিয়াছিল পুরুষ নারী, অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কবি, কিশোর, তরুণ যুবক, পরিণত শ্রমিক জনতা। তাদের চোখে মুখে ছিল প্রতিরোধের অগ্নিশিখা, বুকে বুকে মুক্তি পিপাসার জ্বলন্ত চিতা, কিন্তু তবু তারা শান্ত ছিল, সংযত ছিল–ছিল বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা। নিরীহ, অথচ সেই জনতাই আবার সংগ্রামী শপথ ঘোষণায় উচ্চকিত হইয়া উঠিয়াছে মহা প্রলয়ের জলধির মত। তাইতো আশ্চর্য এই দেশ, আশ্চর্য বাঙালীর মন ও মানস। বেলা দুটোয় শেখ মুজিবুরের সভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তিনি মঞ্চে আসেন ৩টা ১৫ মিনিটে, কিন্তু তবু জনতার মধ্যে কোন অধৈর্য অসহিষ্ণতার লক্ষণ দেখা যায় নাই। নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে জনতার স্রোত আসিয়া উপচাইয়া পড়িতে থাকে রেসকোর্সের উপলখন্ডে। আর তা জনস্রোতে সয়লাব হইয়া যায় অচিরেই। বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, পোশাক-পরিচ্ছদে যতই অমিল থাকুক, সে জনতার মধ্যে আশ্চর্য মিল হাতের বাঁশের লাঠি, কন্ঠের স্লোগান আর অন্তরের অন্তরতম প্রকোষ্ঠে স্বাধিকারের লক্ষ্যে। বেলা ঠিক সোয়া তিনটায় সাদা পাজামা পাঞ্জাবির উপর হাতকাটা কোট (মুজিবকোট) পরিহিত বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসিয়া দাঁড়াইলে বাংলার বীর জনতা বজ্র নির্ঘোষে করতালি ও স্লোগানের মধ্যে তাঁকে অভিনন্দন জানায়। নেতা মৃদু হস্ত আন্দোলনের দ্বারা জনতাকে অভিনন্দন জানান। তাঁর চোখেমুখে সুযোগ্য সিপাহ সালারের দুর্লভ তেজোদৃপ্ত আর সংগ্রামী শপথের দীপ্তি খেলা করিতে থাকে। রেসকোর্স বাংলার মানুষকে প্রাণের টানে ডাকে। সে ডাকে সাড়া দিয়া ১৯৬৯ এর ফেব্রুয়ারীতে রেসকোর্সে বাংলার মানুষ শুনিয়াছে এক ইউনিট আর প্যারিটির মৃত্যুঘন্টা; ১৯৭০ সালের ৭ই জুন শুনিয়াছে ৬ দফার জয়নাদ; ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারী শুনিয়াছে ৬ দফা, ১১ দফা বাস্তবায়নের দ্ব্যর্থহীন শপথ; আর গতকালও রেসকোর্স ময়দান বাংলার মানুষকে নিরাশ করে নাই। গতকাল রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়াইয়া শেখ মুজিবুর বাংলার মানুষকে ডাকিয়া বলিয়াছেন : পরিষদে যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করিতে পারি, যদি-(ক) অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয়; (খ) সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া লওয়া হয়; (গ) নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত হয়; (ঘ) নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরিত করা হয়।
বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রবিবার ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে সমবেত লক্ষ লক্ষ মুক্তি সেনানীর বজ্র-নির্ঘোষ সংগ্রামী ধ্বনির তুর্যনাদের মধ্যে জলদগম্ভীর স্বরে উপরোক্ত ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে শেখ সাহেব বলেন, আপনি ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকিয়াছেন। আগে আমার এই সব দাবী মানিতে হইবে তারপর বিবেচনা করিব অধিবেশনে যোগদান করিব কিনা। এই দাবী পূরণ ছাড়া পরিষদে যাওয়ার অধিকার বাংলার জনগণ আমাকে দেয় নাই। বাংলার সার্বিক মুক্তি-আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণাকল্পে ইতিপূর্বেই শেখ সাহেব ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিবেন বলিয়া জানা গিয়াছে। সেই অনুযায়ী স্বাধীকারকামী লক্ষ লক্ষ লোক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ লাভের জন্য এই সমাবেশে যোগদান করেন। স্লোগানমুখর সেই স্বাধিকারকামী জনসমুদ্র লক্ষ্য করিয়া শেখ মুজিবুর শপথদৃপ্ত কন্ঠে বলেন–ভাইয়েরা আমার, পস্তুত হও। এবারের সংগ্রাম বাঙালীর মুক্তি-সংগ্রাম। রক্ত দিতে আমি প্রস্তুত। যদি আমি ও আমার সহকর্মীরা ডাক দিতে না ও পারে মুক্তি সংগ্রামের পতাকা হাতে তোমরাই আগাইয়া যাও। এবারের সংগ্রামে ঘরে ঘরে সংগ্রামের দুর্গ, সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়িয়া তোল, মুক্তি আসিবেই। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ সম্পর্কিত প্রেসিডেন্টের ঘোষণার উল্লেখ প্রসঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে সৃষ্ট সংগ্রামের জন্য জনাব ভূট্টো ও প্রেসিডেন্টকেই দায়ী করেন। তিনি অভিযোগ করেন, “গোলমালের সৃষ্টি করিলেন ভূট্টো, গুলী চালাল বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র জনতার উপর। যখনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অর্থাৎ বাংলার মানুষ আত্মপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হইয়াছে, যখনি তাহাদের হাতে নিজেদের সমগ্র পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার অর্পিত হওয়ার উপক্রম হইয়াছে, তখনি তাহাদের উপর শক্তি লইয়া ঝাপাইয়া পড়া হইয়াছে। কিন্তু কেন? কতকাল এই নির্যাতন চলিবে? ভাইয়েরা আমার, দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আজ আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত হইয়াছি। আপনারা সবই জানেন, সবই বোঝেন। বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, মানুষের মত বাঁচিতে চায়, আত্মপ্রতিষ্ঠার অধিকার চায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে বাংলার মাটি সয়লাব করিয়া দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু কেন? কি অন্যায় আমরা করিয়াছিলাম? কত আশা লইয়া এদেশের মানুষ আমাকে আমার দলকে ভোট দিয়াছে। তাহারা আশা করিয়াছিল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসিবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈয়ারী করিব, দেশকে সুষ্ঠুভাবে গড়িয়া তুলিব, মানুষ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্বাধিকার পাইবে। সে আশা পূরণের জন্য আমার ত্রুটি ছিল না। ত্রুটি নাই। কিন্তু আবার ষড়যন্ত্র। গত তেইশ বছরের ইতিহাস ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। বাংলার মানুষের বঞ্চনা, আত্মদান, রক্তদান, আর মুমূর্ষুর আর্তনাদের ইতিহাস। বাঙালীর রক্তাক্ত আন্দোলন, ‘৫৪ সালের নির্বাচন বিজয় নস্যাতের ষড়যন্ত্র,’৫৮ সালের সামরিক শাসন জারী, ‘৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ‘৬৯ সালের গণ-আন্দোলন এবং এবার স্বাধিকারের আন্দোলন।
আয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান শাসনতন্ত্র, গণতন্ত্র প্রবর্তনের ওয়াদা করিয়াছিলেন, কিন্তু তারপর কি হইয়াছে? মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে আমি ১৫ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার সুপারিশ করি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর কথামত ৩রা মার্চ পরিষদের অধিবেশন ডাকিলেন। আমি বলিলাম, ঠিক আছে জাতীয় পরিষদে আলাপ-আলোচনা হইবে। এমনও বলিয়াছি যে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে ১ জন সদস্যও যদি যুক্তিসম্মত প্রস্তাব লইয়া আসেন উহা গ্রহণ করা হইবে, তবু তাঁদের মন ভরে নাই। ভুট্টো ঢাকায় আলোচনার শেষে বলিয়া গিয়াছিল, দরজা বন্ধ হয় নাই, আরও আলোচনা হইবে। তারপর আমি মৌলানা নূরানী, মৌলানা মুফতী মাহমুদ প্রমুখের সহিত আলোচনা করিয়াছি। তাঁদের আমি বলিয়া দিয়াছি বাংলার জনগণ ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে ভোট দিয়াছে, উহা পরিবর্তনের ক্ষমতা আমার নাই। এদিকে ভুট্টো বাংলার মানুষকে চরমভাবে অপমান করিয়া জাতীয় পরিষদকে কসাইখানা বলিয়া আখ্যায়িত করিলেন। বাংলায় আসিলে ‘ডবল জিম্মি’হওয়ার মত মন্তব্য করিলেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসিলে পেশোয়ার হইতে করাচী পর্যন্ত হরতালের ভয় দেখাইলেন। শুধু তাই নয় তিনি হুমকী দিলেন কোন পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য ঢাকায় গেলে তাহার মুন্ডুপাত করা হইবে। ৩৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে আসিলেন, কিন্তু তবু ভুট্টোর জেদের দাম দিতে গিয়া অধিবেশন মুলতবী করা হইল। দোষী ভুট্টো, অথচ দোষারোপ করা হইল আমার উপর, বাংলার মানুষের উপর। আমি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ডাক দিলাম। সংগ্রাম শুরু হইল। শান্তিপূর্ণ সংগ্রামে কি পাইলাম? পাইলাম গুলী, নির্যাতন, মৃত্যুর পরোয়ানা। বাংলার শোষিত বঞ্চিত মানুষ অনাহারে থাকিয়া দেশরক্ষার অস্ত্র কেনার জন্য যে পয়সা দিয়াছে সেই পয়সায় কেনা অস্ত্র প্রয়োগ করা হইতেছে সেই বাংলার মানুষেরই বিরুদ্ধে তাদের নির্বিচারে পাখি শিকারে মত হত্যা করার জন্য। সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্য ও দায়িত্ব দেশরক্ষা ও শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করা। বাংলার মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাইবার কোন অধিকার আপনাদের নাই। আপনারা ব্যারাকে থাকুন, প্রয়োজনবোধে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবেন, বাংলার মানুষের বুকে আর একটিও গুলী চালাইবেন না। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে আমি তাঁকে ঢাকায় আসিতে বলি। আমি বলিয়াছিলাম, আপনি প্রেসিডেন্ট, আপনি আসুন, আপনি দেখুন কিভাবে মানুষের রক্ত লইয়া হোলি খেলা চলিতেছে। দেখিয়া বিচার করুন।
গোল টেবিল বৈঠকের উল্লেখ করিয়া তিনি বলিলেন, “কিসের গোলটেবিল, কার সঙ্গে বসিব? যারা বাংলার মানুষের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে গোলটেবিলে বসিব? কিন্তু কেন?”
শেখ মুজিব বলেন, “আমি প্রেসিডেন্টকে বলিয়া দিয়াছি শহীদের রক্তের দাগ রাজপথ হইতে এখনও শুকায় নাই। সেই রক্তের উপর দিয়া হাঁটিয়া আমি গোলটেবিলে যাইতে পারি না। বাংলার মুক্তি-আন্দোলনে যারা জীবন দিয়াছে, যারা রক্ত দিয়া আমাকে মুক্ত করিয়াছে, তাদের সঙ্গে আমি বেঈমানী করিতে পারি না, বেঈমানী করিব না, রক্ত দিয়াই আমি রক্তের ঋন শোধ করিব। যদি আঘাত আসে, যদি আমি নির্দেশ নাও দিতে পারি, যদি আমার সহকর্মীদের পথ-নির্দেশ দেওয়া সম্ভব নাও হয়, বাংলার মানুষ তোমরা নিজেরাই নিজের কর্মপন্থা ঠিক করিয়া লইও। হাতের কাছে যা পাও তাই লইয়া শত্রুর মোকাবিলা করিও। রাস্তাঘাট বন্ধ করিয়া দিও, ঢাকা বন্ধ করিয়া দিও। বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়িয়া মুক্তি সৈনিক হইয়া সর্বশক্তি লইয়া দুষমনের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াও।
সভা শুরু হওয়ার আগে মঞ্চ হইতে সংগ্রামী স্লোগান দান করেন ছাত্র লীগ নেতা নূরে- আলম সিদ্দিকী, শেখ শহীদুল ইসলাম, আ.স.ম. আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন। শেখসাহেব মঞ্চে আসিয়া পৌঁছিলে তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা জনাব তোফায়েল আহমদ মঞ্চ হইতে স্লোগান পরিচালনা করেন। সভার শুরুতে কোরান পাঠ করেন মৌলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ।
[ইত্তেফাক্-৮ই মার্চ,১০ই মহরম, ১৩৯১হিঃ]
রক্তের ঋণ শোধ করবো
“ভাইয়েরা, আমার উপর বিশ্বাস আছে?” লাখো লোকের জনতা হাত উঠিয়ে হ্যাঁ বলে। “আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারে নি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে আমাকে নিতে পারে নি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব। মনে আছে? আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।
রবিবার রমনা রেসকোর্স ময়দানের উদ্বেলিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে জন-নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ দানের আগে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা ও বর্তমানে নির্বাচিত এম এল এ জনাব তোফায়েল আহমদ, পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র লীগের সভাপতি নুরে-আলম সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদের (ডাকসু) সহ সভাপতি আ.স.ম. আবদুর রব,-সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন মঞ্চ থেকে স্লোগানের নেতৃত্ব দান করেন। সভা শুরুর বহু পূর্ব থেকেই লাঠি, বল্লম, তলোয়ার, তীর-ধনুক, লোহার রড নিয়ে ছোট বড় অসংখ্য শোভাযাত্রা রমনার জনসমুদ্রে এসে মিশে। বহু সংখ্যক মহিলাও লাঠি হাতে মিছিল করে ফাল্গুনের মধ্যাহ্নের খরতাপ উপেক্ষা করে সভায় যোগদান করেন। বোরখা পরা ও সন্তান কোলে কয়েকজন মহিলাও সভায় আসেন। কিন্তু তাঁদের হাতেও বাঁশের লাঠি ছিল। উদ্বেলিত জনসমুদ্র বক্তৃতা শুরুর আগে সমগ্র এলাকা কাঁপিয়ে স্লোগান তোলেন -২৫ তারিখের পরিষদে জাতির পিতা যাবেন না; ষড়যন্ত্রের পরিষদে শেখ মুজিব যাবেন না; ইয়াহিয়ার ঘোষণা-মানি না মানি না; পরিষদ না রাজপথ-রাজপথ-রাজপথ; গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়ো, বাংলাদেশ মুক্ত করো; রক্তরাঙা পরিষদে-বাঙালী যাবে না। সংহতি পরিষদে-বাংলাদেশ যাবে না; আপোষ না স্বাধীনতা-স্বাধীনতা-স্বাধীনতা, নতুন মাটি নতুন দেশ-বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। মা-বোনেরা ধ্বনি তোলেন : -প্রীতিলতার পথ ধরো-সালোয়ার কামিজ ছুঁড়ে ফেলো; আমাদের সন্তানের রক্ত-বৃথা যেতে দেব না। সভায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত শত শত পতাকা উত্তোলন করা হয়। মৌলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সভায় কোরান পাঠ করেন এবং শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করেন। রবিবার জনসভায় প্রায় ৪ জন বিদেশী সাংবাদিকও ছিলেন। বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁরা সংগ্রামী বাংলার খবর সংগ্রহে এসেছিলেন।
[ পূর্বদেশ-৮ই এপ্রিল ]
আজ থেকে আমার নির্দেশ
(১) বাংলার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ রাখুন।
(২) সমগ্র বাংলাদেশের সেক্রেটারিয়েট, সরকারী ও আধা-সরকারী অফিস, সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্টে হরতাল করুন। (কোথাও শিথিল করা হইলে জানানো হইবে। )
(৩) রিকসা, বেবী, বাস-ট্যাক্সী প্রভৃতি এবং রেলগাড়ী ও বন্দরসমূহ চালু রাখুন; কিন্তু জনগণের উপর জুলুম চালাইবার উদ্দেশ্যে শসস্ত্রবাহিনীর চলাচলের কাজে রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারীগণ সহযোগিতা করিবেন না এবং সেক্ষেত্রে তাহাদের চলাচলের ব্যাপারে কোন কিছু ঘটিলে আমি দায়ী হইব না।
(৪) বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসেবীরা আমাদের বিবৃতি-বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ প্রদান করিবেন এবং গণ-আন্দোলনের কোন খবর গায়েব করিবেন না। যদি তাহাতে বাধা দেওয়া হয় তাহা হইলে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালীরা কাজে যোগ দিবেন না।
(৫) শুধু লোকাল এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক-টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন।
(৬) স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখুন।
(৭) সকল গৃহশীর্ষে কালো পতাকা উড্ডীন রাখুন।
(৮) ব্যাঙ্কসমূহ প্রতিদিন ২ ঘন্টা খোলা রাখুন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও যেন পাচার না হয়।
(৯) অন্যান্য ক্ষেত্রে আজ হইতে হরতাল প্রত্যাহৃত হইল। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে যে কোন সময় আবার আংশিক বা সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা করা হইতে পারে, তজ্জন্য প্রস্তুত থাকুন।
(১০) স্থানীয় আওয়ামী লীগ শাখার নেতৃত্বে অবিলম্বে বাংলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করুন।
রবিবার রমনা রেসকোর্সের উত্তাল জনসমুদ্রকে সাক্ষী রাখিয়া তুমুল করতালির মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবাসীর উদ্দেশ্যে উপরোক্ত ঘোষণা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের আহ্বান প্রসঙ্গে শনিবার প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রদত্ত বেতার ভাষণের জবাবে আওয়ামী লীগ প্রধান রবিবারে আরও একটি লিখিত বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের জবাবে বিস্তারিতভাবে নিজ দলের বক্তব্য পেশ করেন।
প্রেসিডেন্টের-বেতার ভাষণের জবাবে শেখ মুজিবুর
১লা মার্চ তারিখে আকস্মিক ভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সেই দিন হইতে ৬ই মার্চ বাংলাদেশের জনসাধরণ সামরিক মোকাবিলার অধীনে রহিয়াছে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আকস্মিক ও অবাঞ্ছিতভাবে স্থগিত ঘোষণা করার বিরুেদ্ধে প্রতিবাদে নিরস্ত্র বেসামরিক অধিবাসীদের (শ্রমিক কৃষক ও ছাত্র) উপর ব্যাপকভাবে গুলী চালানো হইয়াছে। যাহারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁহারা শহীদ হইয়াছেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন খামখেয়ালীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ করিতে যাইয়া তাঁহারা মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। এই শহীদদের ‘ধ্বংসকারী শক্তি’ আখ্যা দান নিঃসন্দেহে সত্যের অপলাপ। প্রকৃতপক্ষে তাহারাই সত্যিকার ধ্বংসকারী শক্তি যাহারা বাংলাদেশের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির জন্য দায়ী। ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, যে বিভীষিকা সৃষ্টি করা হইয়াছে তাহা দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট ঢাকায় আসার সময় করিতে পারিলেন না।
প্রেসিডেণ্ট যাহাকে সর্বনিম্ন শক্তি প্রয়োগ বলিয়াছেন তাহাতেই যদি হাজার হাজার লোক হতাহত হইতে পারে, তাহা হইলে তাঁহার পর্যাপ্ত শক্তি প্রয়োগের অর্থ কি আমরা সম্পূর্ণ নির্মূল করাই বুঝিব? আমি বাংলাদেশের নিরস্ত্র অধিবাসীদের প্রতি এই ধরণের নগ্ন হুমকী দানের নিন্দা করিতেছি। বিদেশী হানাদারদের প্রতিহত করার জন্যই জাতি বিপুল অর্থব্যয়ে সেনাবাহিনীকে অস্ত্রসজ্জিত করিয়াছে। বেসামরিক জনসাধারণকে কচুকাটা করার জন্য তাঁহাদের অস্ত্রসজ্জিত করা হয় নাই। অপর অংশের উর্দিধারী ব্যক্তিদের বাড়াবাড়ি হইতে আজ বাংলার জনসাধারণের নিরাপত্তা প্রয়োজন। তাহারা খিলজীর বাহিনীর মতই আচরণ করিতেছে। বলা হইয়াছে যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখাকে “ভুল বুঝা হইয়াছে। আমি প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসা করিতে চাই, শুধুমাত্র একটি দলের কারসাজিতে সাড়া দিয়াই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয় নাই কি? এই দলটি পরিষদে সংখ্যালঘিষ্ঠ। অথচ ইহা করা হইয়াছে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের এবং পশ্চিমাঞ্চলেরও বহু সদস্যের ঘোষিত ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আমরা প্রথম অধিবেশনের তারিখ হিসাবে ১৫ই ফেব্রুয়ারী সুপারিশ করিয়াছিলাম। অপরদিকে উক্ত সংখ্যালঘু দলটি মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন অনুষ্ঠানের পক্ষপাতী বলিয়া জানাইয়াছিলেন। সংখ্যালঘু দলের মতামতই গ্রহণ করা হইল এবং ৩রা মার্চ তারিখে অধিবেশন ডাকা হইল। কিন্তু ইহার পরও সেই সংখ্যালঘু দলই আবার জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানে আপত্তি জানাইল। প্রথমে এই দলটি অত্যন্ত আপত্তিকর মনোভাব প্রদর্শন করে। তাঁহারা বলেন যে ঢাকায় গেলে তাঁহাদের সদস্যরা বিপদাপন্ন হইবেন এবং তাঁহারা ‘ডবল জিম্মি’ হইয়া পড়িবেন। ইহার পর এই দল এই মনোভাব গ্রহণ করে যে তাঁহারা শুধু নিজেদের শর্তেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করিবেন। ইহার পর এই দলের সদস্যরা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত করিয়া অপর একটি ভেল্কি প্রদর্শন করেন। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হইল এই যে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আইনগত কাঠামো আদেশ সংশোধন করিয়া তাঁহাদের অধিবেশনে বসার পূর্বেই পদত্যাগের সুযোগ করিয়া দেওয়া হয়। কিন্তু ইহার পর তাঁহারা পদত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নেন। ২৭শে ফেব্রুয়ারী তারিখে তাঁহাদের এই আপোসহীন মনোভাব চরমে উঠে। দলের পক্ষ হইতে ঘোষণা করা হয় যে, উক্ত দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইলে তাঁহারা গণ-আন্দোলন শুরু করিবেন। তাঁহারা এতদূর পর্যন্ত বলেন যে, তাঁহারা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করিলে জনসাধারণ তাঁহাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করিবে। আরও বলা হয় যে জনসাধারণ প্রতিশোধ গ্রহণে ব্যর্থ হইলে পার্টি তাঁহাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে। ইহার পরও হুমকী দেওয়া হয় যে উক্ত দলের কোন সদস্য অধিবেশনে উপস্থিত হইলে, ‘দলীয় কর্মীরা তাঁহাকে নিশ্চিহ্ন করিয়া দিবে।’ এই সময়ে আমাদের পার্লামেন্টারী পার্টি ঢাকায় মিলিত হন। পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন প্রদেশ হইতেও সদস্যরা আসিতে থাকেন। প্রধান নির্বাচনী কমিশনার ঢাকায় উপনীত হন এবং ২রা মার্চ মহিলা সদস্যের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে বলিয়া ঘোষণা করেন। উদ্বোধনী অধিবেশনের জন্য প্রেসিডেন্ট নিজেই ১লা মার্চ ঢাকা আসিবেন বলিয়া আশা করা হইতেছিল। ২৪শে ফেব্রুয়ারী তারিখে সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃতিতে আমরা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে আমাদের ভূমিকা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করিয়াছি। এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে আমাদের সহিত সহযোগিতা পালনের জন্য আমরা পাকিস্তানের সকল অংশের প্রতিটি সদস্যকে পুনরায় আমন্ত্রণ জানাই।
২৭শে ফেব্রুয়ারী আমরা এতদূর পর্যন্ত বলি যে কোন সদস্য পরিষদে ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত কিছু পেশ করিলে আমরা তাহা গ্রহণ করিব। কিন্তু এমনকি ইহাও উপেক্ষা করা হয় সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবে ও একটা উদ্দেশ্য নিয়া। ১লা মার্চ বেতারে এক বিবৃতির মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আকস্মিক ও অবাঞ্ছিতভাবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখা হয়। এজন্য যে কারণ দেখানো হয়, তাহাতে বলা হয় যে ইহার ফলে ‘সমঝোতা’ প্রতিষ্ঠার জন্য আরও সময় পাওয়া যাইবে। উক্ত বিবৃতিতে বলা হয় যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক ‘মোকাবিলা’ চলিতেছে। বাংলাদেশের জনগণের কি একথা মনে করার মত যথেষ্ট কারণ নাই যে, এক অগণতান্ত্রিক সংখ্যালঘু দলের আঙ্গুলি হেলনেই তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করা হইতেছে? তাদের কি একথা মনে করার মত যথেষ্ট কারণ নাই যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে বাধাসৃষ্টি এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীকে অধিকার হইতে বঞ্চিত করার জন্য এক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে জোট পাকাইয়াছে? ক্রমান্বয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের এই আশঙ্কা বরং বদ্ধমূল হয়। ইহার ফলে বোঝা যায় যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী, সংখ্যালঘিষ্ঠ গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত না করিলে ‘রাজনৈতিক মোকাবিলার’ পরবর্তী পর্যায়ে ‘সামরিক মোকাবিলা’ চালানো হইবে। গত ২৪শে ফেব্রুয়ারী তারিখে প্রদত্ত আমাদের বিবৃতিতে এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছিলাম যে যখনই জনসাধারণ গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণ করিতে গিয়াছে, তখনই অশুভ ও কুচক্রী শক্তি সর্বদা হস্তক্ষেপ করিয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের প্রতিভূ এক অতি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী গণতন্ত্র বানচাল করিয়া দিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতিত সাধারণ মানুষের সাথে সাথে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি অধিবাসীকেও মৌলিক অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া আসিয়াছে। পাঞ্জাবী ক্ষমতাসীন চক্রের চক্রান্তের দরুণ ১৯৫৩ সালে বাঙ্গালী প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত হন। একই চক্র ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং খোদ গণপরিষদ ভাঙ্গিয়া দেয়। ১৯৫৯ সালে গোড়ার দিকে দেশব্যাপী যখন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ঠিক সেই সময়ে পাঞ্জাবী কায়েমী স্বার্থবাদী মহল আর একবার আঘাত হানে এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। আজ পাঞ্জাবী ক্ষমতাসীন চক্র ন্যাক্কারজনক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু তাদের জানা উচিত যে, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মত বাংলাদেশের জাগ্রত জনসাধারণও সকল সম্ভবপর উপায়ে তাদের এই হীন চক্রান্ত প্রতিরোধ করিবে।
কখনও গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেই নাই
আমি সুস্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিতে চাই যে আমি কখনও গোল টেবিল বৈঠক ধরনের কোন সম্মেলন অনুষ্ঠানের পক্ষে আভাস বা ইঙ্গিত দেই নাই। আমি শুধু প্রেসিডেণ্টকে জানাইয়াছিলাম যে, বাংলাদেশের গুরুতর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং বেপরোয়াভাবে নিরপরাধ নিরস্ত্র লোকজনকে হত্যা করা বন্ধের জন্য তাঁর ঢাকা আসা উচিত। প্রেসিডেন্ট ইতিপূর্বে যে বৈঠকের প্রস্তাব করেন সে সম্পর্কে আমরা জানাই যে, কয়েক সপ্তাহ আগে ভাগেই আমাদের দলের কার্য নির্বাহক কমিটি এবং পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠক অনুষ্ঠানের তারিখ ধার্য করা হইয়াছে। কাজেই এ ব্যাপারে আমাদের ব্যস্ত থাকিতে হইবে বলিয়া ঐ সময় রাওয়ালপিণ্ডি যাওয়া সম্ভব হইবে না। উপরন্তু আমরা জানাই যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বিষয়াদি গোপন আলাপ-আলোচনার পরিবর্তে জাতীয় পরিষদের অভ্যন্তরে বা কমিটি পর্যায়ে মীমাংশা করাই উত্তম। তাছাড়া জাতীয় পরিষদ যখন গঠিত হইয়াছে তখন কোন গোলটেবিল অনুষ্ঠান বা গোপন শলাপরামর্শের মানে হয় না।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধাসৃষ্টি করিয়াছে বলিয়া যে দোষারোপ করা হইয়াছে উহা খণ্ডনের জন্যই আমি এইসব বাস্তব ঘটনা তুলিয়া ধরিয়াছি। এই ধরণের বাধাসৃষ্টিতে যদি কোন দল লাভবান হয় তাহা হইলে সে অন্য দল, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নিশ্চয়ই নয়। দেশবাসী তথা গোটা বিশ্ববাসীর কাছে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে যে পশ্চিম পাকিস্তানের এক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর হুকুমের নিকট নতি স্বীকার করা তাঁর নৈতিক কর্তব্য’ বলিয়া প্রেসিডেন্ট মনে করিতেছেন। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বানচাল করার জন্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠী কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের সঙ্গে চক্রান্ত করিতে থাকিলে গণতন্ত্র কখনও প্রতিষ্ঠিত হয় না বা শাসনক্ষমতাও জনসাধারণের নিকট হস্তান্তরিত হইতে পারে না। গণতন্ত্র যদি চরম শিকারে পরিণত হয় এবং প্রস্তাবিত ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যর্থ হয় তাহা হইলে এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং যারা এদের সঙ্গে যোগসাজস করিতেছে তারা দায়িত্ব এড়াইতে পারিবে না। এই ‘মুষ্টিমেয় ব্যক্তিই’ কি তারা নয়-যাদের কার্যকলাপ একসাথে বসবাসের একটি ভিত্তি উদ্ভাবনের ব্যাপারে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রচেষ্টায় চরম আঘাত হানিয়াছে? আজ বিবেকবান প্রতিটি মানুষ এই প্রশ্ন করিবে :-বাংলাদেশের সর্বত্র নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষকে গুলী করিয়া হত্যা করিয়া সশস্ত্র বাহিনী ‘পাকিস্তানের সংহতি, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা’ রক্ষার কোন্ দায়িত্ব পালন করিতেছে? এইরূপ কার্যকলাপের মাধ্যমে তারা কি বিচ্ছিন্নতার প্রধান শক্তি হিসাবেই কাজ করিতেছে না? নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর দেশে আজ জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই ক্ষমতার একমাত্র আইনানুগ উৎস। অন্য কোন ব্যক্তিই এই নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের চাইতে অধিক ক্ষমতা দাবী করিতে পারেন না।
আমরা, বাংলাদেশের জনসাধরণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ মনে করি যে, আমরাই বাংলাদেশের ক্ষমতার একমাত্র আইনানুগ উৎস। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়া আমরা সমগ্র দেশের ক্ষমতার আইনানুগ উৎসও বটে। সাত দিনের ঘটনাবলীতে দেখা গিয়াছে যে, সমগ্র বাংলাদেশে কার্যরত সরকারী প্রশাসন যন্ত্রের শাখাসমূহ আমাদিগকে আইনানুগ কর্তৃত্বের উৎস হিসাবে মানিয়া লইয়াছে এবং আমাদের নির্দেশসমূহ পালন করিয়া চলিয়াছে।
আজ ইসলামাবাদস্থ সরকার এবং প্রেসিডেন্টকে এই মূল সত্যটি স্বীকার করিয়া লইতে হইবে এবং বাংলাদেশের জনসাধারণের ঘোষিত ইচ্ছার সহিত ইহাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ হইতে হইবে। -বাংলার জনসাধারণের ইচ্ছা এই যে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রয়োগের ব্যাপারে কেহ হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে না।
এ ব্যাপারে আমাদের সামনে ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান সংক্রান্ত ঘোষণার প্রশ্নটি আসিয়া পড়ে। তাড়াতাড়ি পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে জরুরী প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা বারে বারে উল্লেখ করিয়াছি। কিন্তু আজ মারাত্মক ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হইয়াছে। বাংলাদেশের অসামরিক জনসাধারণের সহিত সামরিক মোকাবিলা নীতি অনুসরণ করিতে গিয়া কার্যত সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হইয়াছে। হাজার হাজার লোক নিহত ও আহত হইয়াছে বলিয়া খবর আসিয়া পৌঁছিতেছে। এবং চতুর্দিকে, তৎসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কণ্ঠে এবং সমগ্র বিশ্বের সঠিক চিন্তাধারার অধিকারীদের নিকট হইতে রব উঠিয়াছে গণহত্যা বন্ধ কর। সন্ত্রাসমূলক পরিবেশের মধ্যে জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ তাঁহাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত এই মোকাবিলা-নীতি অব্যাহত থাকিবে এবং পশ্চিমাঞ্চল হইতে সামরিক বাহিনীর লোকজন এবং অস্ত্রপাতি আনয়ন করা হইবে, যতক্ষণ পর্যন্ত দমননীতি চলিতে থাকিবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান হইতে বেসামরিক লোকজনের উপর সামরিক বাহিনীর গুলীবর্ষণের খবর আসিতে থাকিবে ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের সদস্যগণ বন্দুকের নলের মুখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের কথা চিন্তাও করিতে পারেন না।
প্রেসিডেন্ট যদি আন্তরিকভাবে মনে করেন যে, জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সার্বভৌম সংস্থা হিসাবে জাতীয় পরিষদকে কার্যকর করা উচিত তাহা হইলে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাসমূহ অবিলম্বে প্রতিপালিত হইতে হইবে :-
(ক) সামরিক বাহিনীর সকল লোককে অবিলম্বে তাহাদের স্ব স্ব ছাউনিতে ফিরাইয়া লইতে হইবে।
(খ) বেসামরিক জনসাধারণের উপর অবিলম্বে গুলীবর্ষণ বন্ধ করিতে হইবে এবং এই মুহূর্তে একটি বুলেটও যাহাতে তাহাদের প্রতি বর্ষিত না হয় তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
(গ) সামরিক সমাবেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিপুল সংখ্যায় সামরিক বাহিনীর লোককে এখানে আনয়ন করা বন্ধ করিতে হইবে।
(ঘ) বাংলাদেশে সরকারী যন্ত্রের বিভিন্ন শাখাসমূহের কাজে সামরিক কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ করা চলিবে না এবং সরকারী অফিসার ও কর্মচারীদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ হইতে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে হইবে।
(ঙ) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ভার সম্পূর্ণভাবে পুলিশ এবং বাঙালী ই পি আর-এর উপর ন্যস্ত করিতে হইবে এবং যেখানে প্রয়োজন হইবে সেখানে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তাহাদিগকে সাহায্য করিবে।
সামরিক মোকাবিলা-নীতি যদি অব্যাহত থাকে এবং নিরস্ত্র জনসাধারণ যদি বুলেটের আঘাতে মাটিতে লুটাইয়া পড়িতে থাকে তাহা হইলে জাতীয় পরিষদ যে আর কখনই কাজ করিতে পারিবে না ইহাতে আর সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
আমাদের জনসাধারণ ইতিমধ্যেই বিশ্বসমক্ষে ঘোষণা করিয়া দিয়াছে যে, তাহারা আর কলোনী অথবা বাজার হিসাবে শোষিত হইতে রাজী নহে। তাহারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাঁচিতে বদ্ধপরিকর, একথাও জানাইয়া দিয়াছে। ধ্বংসের হাত হইতে আমাদের অর্থনীতিকে অবশ্যই রক্ষা করিতে হইবে। আমাদের মেহনতী জনতাকে রক্ষা করিতে হইবে অনাহার ও বুভুক্ষা হইতে। রোগ মহামারী হইতে এবং বেকারত্ব হইতে। ঘুর্ণি-দুর্গত অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এখনও করা হয় নাই। শাসকচক্র যদি জনসাধারণের এই আশা-আকাঙ্ক্ষা বানচাল করিয়া দিতে চায় তাহা হইলে জনসাধারণ তাহাদের মুক্তির উদ্দেশ্যে দীর্ঘ ও অবিরাম সংগ্রাম পরিচালনার জন্যও প্রস্তুত। এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার এবং জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি হাসিল করার জন্য যে বিপুল সংখ্যক শহীদ তাঁহাদের রক্ত দিয়াছেন তাঁহাদের রক্ত বৃথা যাইতে পারে না।
আমাদের সংগ্রামের প্রথম পর্যায় শুরু হইয়াছে। আমাদের বীর জনসাধারণ অদম্য সাহস ও সংকল্পের পরিচয় দিয়াছেন। সুপরিকল্পিতভাবে তাঁরা কারফিউ ভঙ্গ ও বুলেটের মোকাবিলা করিয়াছেন। আমি জনসাধারণ ও আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদেরও অভিনন্দন জানাই।
ভাড়াটিয়া উসকানিদাতা ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী গ্রুপের মধ্যে এবং বাঙালী ও তথাকথিত অবাঙালীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির যে মতলব আঁটিয়াছিল, তাঁহারাই উহা বানচাল করিয়া দিয়াছেন। আমি আরও একবার জানাইয়া দিতে চাই যে, বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষই বাঙালী এবং তাঁর জান-মাল ও মান-মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। যে কোন মূল্যেই হোক তাহা অবশ্যই রক্ষা করিতে হইবে। আমরা গর্বের সঙ্গে বলিতে চাই যে, আমাদের সেচ্ছাসেবকরা সতর্কতা ও প্রহরার দায়িত্ব গ্রহণের পর কোন অবাঞ্ছিতক ঘটনা ঘটে নাই।
‘আমাদের সংগ্রাম চলিতেছে ও চলিবে।’ সংগ্রামের বর্তমান লক্ষ্য হইল : -অবিলম্বে সামরিক শাসনের অবসান এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর। এই লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন চলিতে থাকিবে।
ঢাকা বেতার বন্ধ
ঢাকা বেতারে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা রীলে না করার প্রতিবাদে এবং বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রচণ্ড দাবীর মুখে ঢাকা বেতারের কর্মরত সকল বাঙালী কর্মচারী সহযোগিতা না করার দরুণ রবিবার (৭ই মার্চ) বিকাল হইতে ঢাকা কেন্দ্ৰ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ঢাকা বেতার কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার ৩ ঘণ্টা পর অর্থাৎ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বেতার ভবনের আঙ্গিনায় একটি হাতবোমা নিক্ষিপ্ত হয়। একটি চলমান জীপ হইতে উক্ত হাতবোমা নিক্ষিপ্ত হয়। বোমা বিস্ফোরণের ফলে কোন জান-মালের ক্ষতি হয় নাই বলিয়া সংশ্লিষ্ট মহল হইতে জানা গিয়াছে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ রীলে করার জন্য কয়েকদিন যাবৎ বিভিন্ন মহল হইতে জোর দাবী ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষ তাঁহার এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রীলে করার সিদ্ধান্ত বেতার মারফত ঘোষণা করিলেও শেষ মুহূর্তে উহা করা হয় নাই। ঢাকা বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের রমনা রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ রীলে করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর প্রদেশব্যাপী শ্রোতাগণ অধীর আগ্রহে রেডিও সেট লইয়া অপেক্ষা করিতে থাকেন। বেলা ২টা ১০ মিনিট হইতে ৩টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা বেতারে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ রীলে শুরু করার পূর্বক্ষণে বিশেষ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ পরিবেশন ব্যতীতই আকস্মিকভাবে ঢাকা বেতারে ৩য় অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। বিশেষ কর্তৃপক্ষের উক্ত নির্দেশের প্রতিবাদে ও শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ রীলে করিতে না দেওয়ায় ঢাকা বেতারের কর্মচারীগণ সহযোগিতা করিতে অস্বীকার করায় রবিবার বৈকাল হইতে ঢাকা বেতার কেন্দ্রটি অচল হইয়া পড়িয়াছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ঢাকা বেতারের শিল্পীগণ ২রা মার্চ হইতে ঢাকা বেতারের সহিত অসযোগিতা করিয়া জনতার সংগ্রামের সহিত একাত্মতা ঘোষণা করিয়াছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতার কর্মচারীদের কাজে যোগদানের জন্য আলাপ-আলোচনা চালাইয়াও অধিক রাত্রি পর্যন্ত কোন বেতার কর্মচারী কাজে যোগদান করেন নাই এবং বেতার-কেন্দ্র চালু করা সম্ভব হয় নাই। শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ণ ভাষণ ঢাকা বেতারে প্রচার করা না হইলে তাঁহারা কাজে যোগদান করিতে সম্মত নন বলিয়া জানা গিয়াছে।
টিক্কা খাঁ ঢাকায় এলেন ৭ই মার্চ অপরাহ্নে। বিমান-বন্দরে সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেঃ সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারগণ টিক্কা খাঁকে অভ্যর্থনা করলেন। ৭ই মার্চ রবিবার সন্ধ্যায় অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং অনতিবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানান। আসগর খান বলেন যে, ‘যখনই দেশে জনসাধারণ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সুযোগ উদ্ধার করেন তখনই কায়েমী স্বার্থবাদীরা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ব্যর্থ করিয়া দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রে তৎপর হয়।’ তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসন করিবার অধিকার আছে। আমি বুঝিতে পারি না কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিকট ক্ষমতা দেওয়া হইবে না।’
এইদিন গভীর রাত্রিতে এক সরকারী প্রেসনোট প্রকাশ করে জানানো হয় গত কয়েকদিন প্রদেশব্যাপী হাঙ্গামায় ১৭২ জন নিহত ও ৩৫৮ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম পাহারতলী ফিরোজ শাহ কলোনী ও ওয়ারলেস কলোনীতে ৭৮ জন নিহত ও ২০৫ জন আহত হয়েছে।
[ইত্তেফাক-৮ই মার্চ]
৮ই মার্চ সোমবার অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেল ঢাকায়। লেঃ জেঃ টিক্কা খানকে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আনুগত্যের শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করলেন। শুধু বিচারপতিরা নয়, গভর্নমেন্ট হাউস থেকে বাবুর্চি বেয়ারাও চলে গেছেন। রান্না-বান্নার কাজ করতে হচ্ছে সিপাইসান্ত্রীদের। পূর্ববাংলায় বা বাংলাদেশে সামরিক প্রশাসন ঝড়ের মুখে পড়ে কদলী বৃক্ষের মত দুলছে। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের অস্তিত্ব নিঃশেষিত। হাজার মাইল দূরে ‘রাওয়ালপিণ্ডি’ অথবা ‘ইসলামাবাদে’র কোন নির্দেশই আজ বাংলাদেশে কার্যকর নয়। প্রাদেশিক সরকারের সমস্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নিজেদের হাতে গ্রহণ করেছে। সরকারের পদস্থ কর্মচারীরা নির্দেশ নিচ্ছেন মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলের কর্মীদের কাছ থেকে। দুই পাকিস্তানের মধ্যে ডাক, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ অচল। প্রদেশের সর্বত্র সকল ভবনের শীর্ষে উড়ছে কালো পতাকা, সর্বত্র তৈরী হয়েছে নিহত বাঙালীদের জন্য শহীদ বেদী।
ঢাকায় এলেন মৌলানা ভাসানী
মঙ্গলবার ঢাকার পল্টন ময়দানে ভাষন দিলেন মৌলানা। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন আতাউর রহমান খান। এর পরে বৈঠক বসল মুজিবুর ও ভাসানীর মধ্যে। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খাঁকে গদীচ্যূত করার আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন মৌলানা ভাসানী, পাশে ছিলেন মুজিবুর রহমান। এবার পুরোভাব মুজিবুর আর পাশে আছেন মৌলানা ভাসানী। ইতিমধ্যে পাকিস্তান রেডিও সংবাদ দিল, প্রেসিডেণ্ট ঢাকায় আসছেন। সোমবার থেকেই রাজ্যব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে। এইদিন ঢাকা রেডিও থেকে মুজিবুরের বক্তৃতা রীলে করা হয়।
মুজিবুর তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, “আর যদি একটি গুলী চলে, যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তাহলে আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন। যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।
আমরা ওদের ভাতে মারব, পানিতে মারব। সৈন্যদের বলি, তোমরা আমাদের ভাই, তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও। তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আমাদের উপর গুলী চালাবার চেষ্টা করলে ভাল হবে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমরা মরতে শিখেছি; কেউ আমাদের রুখতে পারবে না। মালিকদের কাছে আমার অনুরোধ রইল এই হরতালে যেসব শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন তাঁদের যেন বেতন পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়। সব কর্মচারী যেন ২৮ তারিখে বেতন নিয়ে আসেন।
(জনতার হর্ষধ্বনি)
সরকারী কর্মচারীদের বলি-আমি যা বলি তা মানতে হবে। আন্দোলন কিভাবে করতে হয় তাও আমরা জানি। মুক্তি না আসা পর্যন্ত ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হল। হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী-অবাঙালী সবাই আমার ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের সকলের। দেখবেন আমাদের যেন বদনাম না হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আমি বলে দিতে চাই-দেশকে একেবারে জাহান্নামে নিয়ে যাবেন না। যদি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারি তবে জানবেন যে বাঁচার সম্ভাবনা আছে। এই জন্য অনুরোধ–মিলিটারী শাসন চালাবার আর চেষ্টা করবেন না।
এখন প্রোগ্রামটা বলছি শুনুন :-
যদি রেডিও আমাদের কথা না শোনে তবে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবেন না। টেলিভিশনে যাবেন না। (জনতার হাততালি)।
কেউ যদি আমাদের নিউজ না দেয় তবে ওদের কাছে যাবেন না। ব্যাঙ্ক খোলা থাকবে ২ ঘণ্টা যাতে মানুষ মাহিনাপত্র নিতে পারে। আর পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও যাবে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রত্যেক মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন।
আমরা রক্ত দিয়েছি, আরও রক্ত দেব। এই সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এই সংগ্ৰাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রস্তুত থাকুন ডিসিপ্লিন রাখুন। মনে রাখবেন আমি কোনদিন বেঈমানী করি নাই। আমি রক্ত দিবার জন্য প্রস্তুত। জয় বাংলা।” (জনতার চিৎকার- জয় বাংলা)
ভাসানী জনসভার প্রস্তাবাবলী
৯ই মার্চ মঙ্গলবার বিকালে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত মৌলানা ভাসানীর জনসভায় গৃহীত প্রস্তাবে পশ্চিমা শোষকগোষ্ঠীর আজ্ঞাসহ সামরিক সরকার কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামী বাঙালীর উপর সৈন্যদের গুলীবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ এবং গুলীবর্ষণে নিহত ও আহত স্বাধীনতা সৈনিকদের প্রতি গভীর সংগ্রামী সমবেদনা জ্ঞাপন এবং ক্ষতিপূরণ দাবী ও প্রদেশের সর্বত্র গায়েবানা জানাজার আয়োজন করিবার আহ্বান জানানো হয়।
এক প্রস্তাবে ৯ই জানুয়ারী সন্তোষ সম্মেলনে গৃহীত এবং ১০ই জানুয়ারী পল্টনের জনসভায় ঘোষিত স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার দাবীর সহিত পুনরায় দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানানো হয়। এক প্রস্তাবে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার সামাজিকীকরণ ও সুষম বণ্টন এবং সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবিরোধী কৃষক শ্রমিক রাজ কায়েম এবং ধর্ম বর্ণ ভাষা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্ৰাম ঘোষণা করা হয়।
এক প্রস্তাবে পূর্ব বাংলায় উৎপাদিত পণ্যের সকল বিদেশী বিকল্প বর্জনের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
এক প্রস্তাবে উপরোক্ত লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের সর্বদলীয় সংগ্রাম গঠনের জন্য দলমত নির্বিশেষে সাত কোটি বাঙালীর প্রতি সংগ্রামী পরিষদ আহ্বান জানানো হয়। এক প্রস্তাবে শেখ মুজিবুর রহমান খাজনা, ট্যাক্স বন্ধের যে আহ্বান জানাইয়াছেন তাহা যাহাতে সুষ্ঠুভাবে পালিত হয় তজ্জন্য সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে লবন ট্যাক্স, নগরশুল্ক, হাট বাজারের তোলা, খাজনা, ইনকাম ট্যাক্স, এগ্রিকালচারাল ট্যাক্স সহ সমুদয় ট্যাক্স সংগঠিত ভাবে বন্ধ করিবার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এক প্রস্তাবে নিরস্ত্র, নিরপরাধ জনগণকে গুলী করিয়া হত্যা করিবার অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল সামরিক কর্মচারী ও সরকারী কর্মচারীদের নিকট নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী (চাল ইত্যাদি) বিক্রি বন্ধ করিবার জন্য সংগ্রামী জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
এক প্রস্তাবে দেশের বর্তমান খাদ্য ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে যাহাতে কোন দ্রব্য সীমান্তের অপর পারে চোরাচালান না হয় তজ্জন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখিবার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানানো হয়।
দেশের ৩০ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণ করিবার নিমিত্ত স্বেচ্ছায় উৎপাদন বৃদ্ধি করিবার জন্য জনগণ, বিশেষ করিয়া কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতি আহবান জানাইয়া এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। উক্ত প্রস্তাবে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে পতিত জমি বিলি করার জন্য সংগ্রাম পরিষদের প্রতি আহবান জানানো হয়। এক প্রস্তাবে পূর্ব বাংলায় অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যাঙ্ক ও বীমা কোম্পানীসমূহের শাখায় কোন টাকা জমা না করার আহবান জানানো হয়। কালোবাজারী ও আড়তদারদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুত করিবার মাধ্যমে দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্ব গতির ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করিবার জন্য এক প্রস্তাবে সকলের প্রতি আহবান জানানো হয়।
সভায় বাঙালী-অবাঙালী হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধানোর মাধ্যমে গণসংগ্রামকে বিপথে পরিচালিত করিবার জন্য কোন কোন মহল হইতে যে প্রচেষ্টা চালানো হইয়াছিল এবং হইতেছে, তাহা প্রতিরোধ করিবার জন্য সাত কোটি বাঙালীর প্রতি আহবান জানানো হয়।
এক প্রস্তাবে বাঙালী জাতির মুক্তি আন্দোলনের নামে এক শ্রেনীর টাউট, প্রবঞ্চক সর্বত্র যে চাঁদা তুলিয়া বেড়াইতেছে তাহা প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।
এক প্রস্তাবে বিদেশী সৈন্য, বিশেষ করিয়া পাকিস্তানী ও মার্কিন সৈন্য যাহাতে পূর্ব বাংলায় অবতরণ করিতে না পারে তজ্জন্য চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখিবার আহবান জানানো হয়।
সভায় গণবিরোধী শাসন আমলের তমঘা, খেতাব সহ বিভিন্ন উপঢৌকন বর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি নির্দেশ দান করা হয়।
সর্বশেষ প্রস্তাবে বলা হয় যে, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের এই কর্মসূচী প্রয়োজন মত সংশোধন, পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যাইবে।
পল্টনের জনসভায় মৌলানা ভাসানীর ঘোষণা
মঙ্গলবার পল্টনের এক বিরাট জনসভায় তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে অশীতিপর বৃদ্ধ ন্যাপ নেতা মৌলানা ভাসানী ঘোষণা করেন :–
“শেখ মুজিবরের নির্দেশিত ২৫শে মার্চের মধ্যে কোন কিছু না করা হইলে আমি শেখ মুজিবুরের সহিত মিলিয়া ১৯৫২ সালের ন্যায় তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু করিব।”
ন্যাপ নেতা মৌলনা ভাসানী দেশের সর্বশেষ অবস্থার পটভূমিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহবান জানাইয়া বলেন : একদিন ভারতের বুকে নির্বিচারে গণহত্যা করিয়া, জালিয়ানওয়ালাবাগের মর্মান্তিক ইতিহাস রচনা করিয়া, অত্যাচার অবিচারের বন্যা বহাইয়া দিয়াও প্রবল পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সরকার শেষ রক্ষায় সক্ষম হয় নাই। শেষ পর্যন্ত তাহাদের শুভবুদ্ধির উদয় হইয়াছে। পাক-ভারত উপমহাদেশকে শত্রুতে পরিণত না করিয়া সম্প্রীতি ও সৌহার্দের মধ্যে সরিয়া যাওয়াই তাঁহারা মঙ্গলকর মনে করিয়াছেন। যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যাইত না, রূঢ় বাস্তবের কষাঘাতে সে সাম্রাজ্যেরও সূর্য আজ অন্তমিত। …..প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকেও তাই বলিঃ অনেক হইয়াছে, আর নয়। তিক্ততা বাড়াইয়া আর লাভ নাই। লা- কুম-দ্বীনুকুম অলইয়া দ্বীন’ এর (তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার) নিয়মে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া লও।”
দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির পটভূমিতে স্বাধীন বাংলা আন্দোলন সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই সভায় মৌলানা ভাসানীর বক্তব্য শ্রবণের জন্য প্রচুর লোক সমাগম হয়। সভায় মৌলানা সাহেব ছাড়া আর কেবল জনাব আতাউর রহমান খান বক্তৃতা করেন বক্তৃতা-মঞ্চে অন্যদের মধ্যে জনাব শাহ আজিজুর রহমানকেও দেখা যায়। সভার পক্ষ হইতে প্রস্তাব পাঠ করেন ন্যাপ নেতা জনাব মশিহুর রহমান। সভার স্থলে মৌলানা ভাসানীর স্বাক্ষর যুক্ত একটি প্রচারপত্র পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত জনসাধারণের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের আজাদী রক্ষা ও মুক্তি- সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ার আহবান জানানো হয়। মৌলানা সাহেবের ভাষণের বিভিন্ন পর্যায়ে লাল টুপি পরিহিত ন্যাপ কর্মীগণ ‘স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা–মৌলানা ভাসানী’ ‘স্বাধীন বাংলার নয়ন মণি–মৌলানা ভাসানী ‘ প্রভৃতি ধ্বনি তোলেন।
ন্যাপ-প্রধান মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মঙ্গবার পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দানকালে অবিলম্বে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান।
এক পর্যায়ে তুমুল করতালির মধ্যে তিনি ঘোষণা করেন “মুজিবের নির্দেশ মত ২৫ তারিখের মধ্যে কোন কিছু করা না হইলে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত মিলিয়া ১৯৫২ সালের ন্যায় তুমুল আন্দোলন শুরু করিব।” ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান যে ঘোষণা করিয়াছেন সে ব্যাপারে শেখ সাহেব আপোস করিতে পারেন বলিয়া কেহ কেহ সন্দেহ প্রকাশ করিতেছেন বলিয়া উল্লেখ করিয়া মৌলানা সাহেব বলেন; “খামকা কেহ মুজিবুরকে অবিশ্বাস করিবেন না। মুজিবকে আমি ভাল করিয়া চিনি, তাঁহাকে আমি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়াছি।’
মৌলানা সাহেব মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে আরও বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানকে আমার তিন পুত্রের চেয়েও ভালবাসি। আমার রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সভাপতি হিসাবে আমি ৩১ জন সেক্রেটারীর সহিত কাজ করিয়াছি। তাঁহাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান শ্রেষ্ঠ সেক্রেটারী ছিল। “মৌলানা সাহেব বলেন,” সেদিন এত লালটুপি ছিল না। সেদিন আমার হাতে এক টাকা বা বার আনা পয়সাও সম্বল ছিল না। সেই বিপদের দিনে আমরা একত্রে কাজ করিয়াছি।
স্বভাবসুলভ কণ্ঠে গর্জিয়া মৌলানা সাহেব বলেন, “আপোস? আপোস করিলে মুজিব বল, ভাসানী বল, কাহারও আর নিস্তার থাকিবেনা।” মৌলানা সাহেব তেজোদৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন, “পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হইবে। পাকিস্তান অখন্ড থাকিবে না। অখন্ড রাখিব না। ইয়াহিয়ার বাপেরও ক্ষমতা নাই ইহা ঠেকায়। কামানের গুলীকে বাঙালী ভয় করে না। বাঙালীর হাতে তীর ধনুক, খন্তা,কুড়াল, বল্লম আছে।” মৌলানা বলেন, “অহিংসায় আমি বিশ্বাস করি না, আল্লাহ এবং রসুল (দঃ) ও এই শিক্ষা দেয় নাই। যে জুলুম করে সে যেমন পাপী যে তাহা সহ্য করে সেও তেমন পাপী। জালিমের সাথে কোন সহযোগিতা নাই।” মৌলানা সাহেব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্যে আরও বলেন, “যদি পশ্চিম পাকিস্তানের পৌণে পাঁচ কোটি মানুষের ভাল চান তবে কালই বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া লউন। ইংরাজের গোলাম ছিলেন, ইংরাজের আদর্শ নিশ্চয় জানা আছে। ইংরাজও যেদিন বুঝিয়াছিল যে,ভারত সাম্রাজ্য আর টিকিবে না তখন শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়া দুই বৎসর আগেই ভারত ত্যাগ করিয়াছিল।” তিনি আরও বলেন, “ব্রিটিশ ভারতে নির্যাতন চালাইয়া জালিয়ানওয়ালাবাগে গুলী করিয়া নিজেরই পতন ডাকিয়া আনিয়াছিল। গুলী চালাইয়া কোন দেশকে যে দাবাইয়া রাখা যায় না এ তাহারই প্রমাণ।” তিনি বলেন, “ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, ব্যবসায়িক সম্পর্ক যাতে তিক্ত না হয় তার জন্য ব্রিটিশ সরকার আগেভাগেই ভারতকে স্বাধীনতা দিয়া পালাইয়া বাঁচিয়াছিল।” তিনি বলেন, আপনি দৌলতানা, ভুট্টো, খুরোর সহিত আলোচনা করিয়া দুই তিন দিন পরে আসুন। তাড়াহুড়ায় কাম নাই। তারপর এখানে আসিয়া বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া লউন।” মৌলানা ভাসানী বাংলার নিরস্ত্রমানুষকে হত্যার তীব্র প্রতিবাদ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া বলেন, “২৩ বৎসর ব্যাপী বাঙালীকে পশ্চিমা শাসক শোষকগোষ্ঠীর শোষণের কোন সুবিচার না করিয়া নিরস্ত্র নিরপরাধ বাঙালীকে হত্যা করা হইয়াছে।”
প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করিয়া তিনি বলেন, “বাহাদুর সৈন্য কাশ্মীর দখল করিতে পারে না। ভারত যখন দুনিয়ার রীতি বর্জন করিয়া কাশ্মীর দখল করিল, তখন তোমরা সৈন্য পাঠাইতে পার না। আর আইন-শৃঙ্খলার নামে বাংলাদেশে মানুষ খুন কর!
মৌলানা সাহেব তেজোদৃপ্ত কন্ঠে আরও বলেন, “ল অ্যান্ড অর্ডার আপনি ভঙ্গ করিয়াছেন। আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকিয়া তাহা বাতিল করিয়াছেন। আপনি যে কারণ দেখাইয়াছেন তাহা পানওয়ালারাও বিশ্বাস করে না।”
তিনি প্রকারান্তরে ভুট্টোকে লক্ষ্য করিয়া বলেন, “গণতন্ত্রের অর্থই আপনি জানেন না। পার্লামেন্ট বর্জনের এ ধরণের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নাই। বাংলার নাই। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠদলকে ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব যুক্তি দিয়া বুঝাইয়া সম্মত করাইতে হয়। “তিনি বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষক শ্রমিকের গ্রাস কাড়িতে চাহিত; তাহা হইলে বাংলার মানুষ, দুনিয়ার মানুষ তোমাদিগকে সমর্থন করিত।”
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে উদ্দেশ করিয়া মৌলানা সাহেব বলেন, “আপনার হাতে লিগ্যাল ফ্রেম’ আছে। ইহার নাম কি গণতন্ত্র? কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি এই নিয়ম আছে? আমেরিকা, বৃটেন, দুনিয়ার কোথাও এই নিয়ম নাই। গণতন্ত্র সম্বন্ধে আপনার কোন আইডিয়া নাই। “ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গার্নারের উদ্ধৃতি দিয়া মৌলানা সাহেব বলেন,”গণতন্ত্র যদি সত্যিকার গণতন্ত্র না হয়, তাহা হইলে গণতন্ত্রের চেয়ে একনায়কত্ব ভাল। বৃটেনে পার্লামেন্টে কি হয় রাণী তাহার খবর রাখেন, কিন্তু বাধা দেন না। আপনার ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা গালগল্প ছাড়া কিছুই নয়।” নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার তীব্র সমালোচনা করিয়া মৌলানা সাহেব বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে দুনিয়ার ইতিহাস না জানিলে আন্তত পাক-ভারতের অতীত ইতিহাস পাঠ করিতে অনুরোধ করি। অত্যাচার,নিপীড়ন চালাইয়া বৃটিশ সাম্রাজ্যেরও সূর্য অস্ত গিয়াছে। মুসলিম লীগ, আইয়ুব সরকারেরও পতন ঘটিয়াছে। অত্যাচার নিপীড়ন চালাইয়া আজ যদি আপনার, সন্তান বাংলায় গুলী খাইয়া মরিত তাহা হইলে আপনার স্ত্রী পাগলিনী হইয়া যাইত। মায়ের অভিশাপ আপনার উপর ঘনাইয়া আসিতেছে।” তিনি বলেন, “নতুন করিয়া অর্ডার দিয়া বলেন, নতুন হায়দরাবাদের নরম মানুষ ভদ্রলোক আহসানকে বিদায় দিয়া টিক্কা খানকে আনা হইয়াছে বাঙালীকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু সাত কোটি বাঙালীকে হত্যা করা যাইবে না। হত্যা করিয়া বাঙালীর দাবী দাবাইয়া রাখা যাইবে না। এখনও সময় আছে। যাহাতে দুই অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যের সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক রক্ষা করার মত পরিবেশ থাকে, যাহাতে রাষ্ট্রদূত বিনিময় করা যায় এবং যাহাতে একে অপরের শত্রু না হই, এজন্য আগে ভাগাভাগি করিয়া ফেলুন। মেজরটি মাইনরিটি খেল যাহা দেখাইতে চান তাহা পশ্চিম-পাকিস্তানেই দেখান, আমাদের আপত্তি নাই।”
মৌলানা সাহেব বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ টন খাদ্য উৎপাদনের কথা উল্লেখ করিয়া কৃষকগণকে খাদ্য উৎপাদনের উপদেশ দেওয়ার জন্য কর্মীগণকে আহবান জানান। তিনি কর্মীগণকে চরিত্রবান হওয়ার জন্য আহবান জানাইয়া বলেন, “চরিত্রবান না হইলে স্বাধীন বাংলা রক্ষা করা যাইবে না।” তিনি বলেন, “দোকানপাট, লুঠতরাজ বন্ধ কর, জ্বালানো পোড়ানো বন্ধ কর। এইগুলি আমাদের জাতীয় সম্পদ। স্বাধীন বাংলায় হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টানকে সমান অধিকার দিতে হইবে। তবে লক্ষ্য রাখিতে হইবে যেন বাংলাদেশ হইতে সম্পদ পাচার না হয়।
আতাউর রহমান খান
জনসভায় ভাষণদান কালে জাতীয় লীগ প্রধান জনাব আতাউর রহমান খান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্দেশে বলেন “এই মুহূর্তে আপনি স্বাধীন বাংলার জাতীয় সরকার ঘোষণা করুন। বাংলার মানুষ আজ কাতারে কাতারে সারিবদ্ধ হইয়াছে। এই ক্রান্তিকাল আর আসিবে না। বাংলার সকলেই জাতিয় সরকারের হুকুম মানিয়া চলিবেন। আমাদের আর কোনো দাবী নাই।” জনাব আতাউর রহমান খান বলেন যে, “লাহোর প্রস্তাবে স্বাধীনতার ওয়াদা ছিল। কিন্ত তাহা আজও পূরণ হয় নাই। গত ২৩ বৎসর যাবৎ বাঙালীরা রক্ত দিতেছে। এবার স্বাধীনতার জন্য রক্তদান শুরু হইয়াছে।”
জাতীয় লীগ প্রধান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদ্দেশে বলেন, “বাঙালী স্বাধীন হইয়া গিয়াছে, তাহা স্বীকার করিয়া নিন। আড়াই ডিভিশন সৈন্য আছে এখানে, সৈন্য সরাইয়া নিন। বাঙালী ইহাদের মোকাবিলা করিতে পারিবে। কিন্তু অনর্থক জীবন নষ্ট করিতে চাই না।”
সাম্প্রতিক আন্দোলনে গণহত্যার উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন, “গত কয়েক দিনে পাঁচ শত লোক হত্যা করা হইয়াছে। যাহারা বাংলার মানুষকে হত্যা করিয়াছে সেই কসাইদের কাছে হত্যার বিচার চাই না।” জনাব আতাউর রহমান খান বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, তাঁহার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র চলিতেছে।” ১৯৫৪সালে এবং ‘৫৮ সালেও এই ষড়যন্ত্র করা হইয়াছিল বলিয়া উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন, “এইবারও একবার পরিষদ ডাকিয়া আবার বাতিল করা হইয়াছে।” তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ করিয়া বলেন, “পরিষদে কাজ হইবে না। পরিষদের কথা ভুলিয়া যান। সিপাহীরাজ এল এফ ও-এর মাধ্যমে কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থ রক্ষার জাল বিস্তার করিতেছে। সিপাহীরাজ,স্বাধীন বাংলার ঘোষণা কর। তোমাদের এলাকায় স্বাধীন পরাধীন যাহা কিছু কর আমাদের আপত্তি নাই।”
ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক জনাব মশিয়ুর রহমান সভায় প্রস্তাব পেশ করেন।
ছাত্র লীগ কেন্দ্রীয় সংসদের জরুরী সভায়
“স্বাধীন বাংলা দেশ”
ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন–
মঙ্গলবার ৯ই মার্চ সার্জেন্ট জহুর (ইকবাল) হল ক্যানটিনে ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরী সভা সংগঠনের সভাপতি নূরে-আলম-সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় গৃহীত এক শোক প্রস্তাবে বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনে উপনিবেশবাদী পাকিস্তান সেনা কর্তৃক নিহত ছাত্র লীগ কর্মী, শহীদদের জন্য গভীর শোক প্রকাশ, তাঁহাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং শহীদদের শোকসন্তপ্ত পরিবার বর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। সভায় গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে গত ২রা মার্চ বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্র লীগ এবং ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ” ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
অপর এক প্রস্তাবে বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে বাংলাদেশে জাতীয় সরকার গঠনের জন্যে অনুরোধ করা হয়। সভায় বাংলা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ছাত্র লীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহ সভাপতি আঃ সঃ মঃ আবদুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনকে লইয়া গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের’ উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সভায় ছাত্র লীগের প্রত্যেক জেলা এবং শহর হইতে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শাখায় ছাত্র সভাপতিকে আহবায়ক, সাধারণ সম্পাদককে সম্পাদক করিয়া এবং ৯জন সদস্য লইয়া সর্ব মোট ১১জনের সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করার নির্দেশ দান করা হয়। প্রস্তাবে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ব্যাপারে স্থানীয় কলেজ ছাত্র সংসদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের জন্যও নির্দেশ প্রদান করা হয়। ইহা ছাড়া, প্রত্যেক শাখাকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদ গঠনেরও নির্দেশ দান করা হয়।
সাংগঠনিক প্রস্তাবে কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের পরিবর্তে শুধু ছাত্র লীগ নাম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
অপর এক প্রস্তাবে প্রত্যেক জেলা শাখাকে জরুরী কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করিয়া ছাত্র লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় সংসদকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য দায়িত্ব পালনের অনুমতি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়।
[ইত্তেফাক–১০ই মার্চ ]
পূর্ব বাংলার বে-আইনী কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রচারপত্র
পাকিস্তানী শাসক চক্র পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিকে দীর্ঘদিন যাবত বে-আইনী ঘোষণা করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি তাই গোপন অবস্থায় থেকেই সেখানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গত ৯ই মার্চ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব বাংলায় এক প্রচারপত্র বিলি করে। তখন সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে ইয়াহিয়া চক্রের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। দেরীতে হলেও এই প্রচারপত্রের হুবহু আমরা ছেপে দিলাম। ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া চক্র বাংলাদেশের মানুষের সমস্ত দাবীকে অস্ত্রের জোরে বন্ধ করার চেস্টা করছে। পূর্ব বাংলার মানুষ তাই অস্ত্র নিয়েই ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছেন। “স্বাধীন বাংলাদেশ” ঘোষণা করেছেন। মুক্তি বাহিনী গঠিত হয়েছে।
“ভাইসব,
বাংলাদেশের জনগণ আজ গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এখানে একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন ও এই জন্য এক গৌরবময় সংগ্রাম চালাইতেছেন। এই সংগ্রামে জনগণ অসীম সাহসিকতার সহিত সশস্ত্র সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করিতেছেন এবং নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য বুকের রক্ত ঢালিতেও দ্বিধা করিতেছেন না। কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব বাংলার সংগ্রামী বীর জনগণের আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছেন। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টরা দীর্ঘকাল হইতেই বাঙালী সহ পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী জাতির বিচ্ছিন্ন হইয়া স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবী করিয়া আসিতেছে। পূর্ব বাংলার জনগণ আজ অনেক ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতের ভিতর দিয়া পূর্ব বাংলায় একটি পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের যে দাবী উত্থাপন করিয়াছেন আমরা ইহাকে ন্যায্য মনে করি। তাই পূর্ব বাংলার জনগণের বর্তমান সংগ্রামে আমরা সর্বশক্তি লইয়া শরিক হইয়াছি।
জনগণের দুশমন কাহারা?
বাংলাদেশে পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের এই সংগ্রামে জনগণের দুশমন হইল পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক গোষ্ঠী ও বর্তমান সামরিক সরকার। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ–বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, বড় বড় জোতদার জায়গীরদার মহাজন ও একচেটিয়া পুঁজির মালিক ২২টি পরিবারের কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্য গত ২৩ বৎসর যাবৎ বাংলাদেশের শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত ছাত্র প্রভৃতি জনগণকে শোষণ এবং নিপীড়ন করিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে শাসক গোষ্ঠী পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণকে জাতীয় অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার হইতে আগাগোড়া বঞ্চিত করিয়াছে। আজও উহাদের স্বার্থেই ইয়াহিয়া সরকার প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীসমূহের নয়া নেতা ভুট্টোর সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন নস্যাৎ করে ও গণতন্ত্র জাতীয় অধিকার এবং শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে এই প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের বর্তমান সংগ্রামকে দমনের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রহিয়াছে এবং সেনাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে নিয়োগ করিয়াছে। সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় ইতিমধ্যেই গণহত্যা ঘটাইয়াছে ও রক্তের বন্যায় পূর্ব বাংলায় জনতার সংগ্রাম স্তব্ধ করিবার জন্যে সেনাবাহিনী প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে।
তাই বাংলাদেশের জনগণের দুশমন হইল সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ, ও একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী সরকার ও উহার সেনাবাহিনী। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঠান-বেলুচ-সিন্ধি-পাঞ্জাবী জাতিসমূহের মেহনতী জনতা পূর্ব বাংলার শত্রু নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের গণতন্ত্র ও বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর জাতীয় অধিকারকেও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী শোষণ নিপীড়ন করিতেছে। তাই ঐ দুশমনদের জব্ধ করার জন্য আজ এখানে গড়িয়া তুলিতে হইবে বাঙালীঅবাঙালী, হিন্দু-মুসলমান জনগণের দুর্ভেদ্য একতা। ঐ দুশমনদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণকে বেলুচ পাঠান-সিন্ধি-পাঞ্জাবী মেহনতী জনগণকে মিত্র বলিয়া মনে করিতে হইবে এবং পূর্ব বাংলার সংগ্রামে তাঁহাদের সাহায্য পাইতে সর্বদাই সচেষ্ট থাকিতে হইবে।
এই সংগ্রামে এখানকার জনগণের সুদৃঢ় ঐক্য ও বেলুচ-পাঠান প্রভৃতির সমর্থন যত বেশী গড়িয়া উঠিবে গণ-দুশমনদের পরাজয়ও ততই নিশ্চিত হইবে।
প্রকৃত মুক্তির লক্ষ্যে অবিচল থাকুন
ঐক্যবদ্ধ গণশক্তি ও জনতার সংগ্রামের জোরে গণ-দুশমনদের ও উহাদের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করিয়া এখানে জনগণের দাবী মতে ‘স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলা’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অগ্রসর করিয়া লইতে হইবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলা যাহাতে সাম্রাজ্যবাদীদের শৃঙ্খলে বাঁধা না পড়ে, স্বাধীন বাংলায় কৃষক সমাজের উপর যাহাতে জোতদার মহাজনের শোষণ না থাকে, স্বাধীন বাংলায় যাহাতে শ্রমিক ও জনসাধারণকে পুনরায় পুঁজিপতিদের শোষণ ও নিপীড়নে ধুঁকিয়া মরিতে না হয়, সেজন্যও সংগ্রামকে দৃঢ়ভাবে আগাইয়া লওয়ার জন্য আহবান জানাইতেছে।
কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশে এখন একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের আহবান জানাইয়াছে যেখানে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ উৎখাত করিয়া ও পুঁজিবাদ বিকাশের পথ পরিহার করিয়া জনগণের স্বার্থে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করা ও সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হইবার বিপ্লবী পথ উম্মুক্ত হইতে পারে।
বিভ্রান্ত হইবেন না
কতকগুলি তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টি জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার জন্য “ধর্মঘট, অসহযোগ আন্দোলনের প্রয়োজন নাই”, “গ্রামে গ্রামে কৃষি বিপ্লব শুরু করুন”, “জোতদারদের গলা কাট” প্রভৃতি আওয়াজ তুলিতেছে। কোন কোন নেতা “স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা হইয়া গিয়াছে” বলিয়া ধ্বনি তুলিয়া আজকাল গণসংগ্রামের উদ্দীপনা, সংকল্প ও প্রস্তুতিতে ভাঁটা আনিয়া দিতে চাহিয়াছেন। মার্কিনী এজেন্টরা এই সংগ্রামে অনুপ্রবেশ করিয়া সংগ্রামকে
বিপথগামী করার প্রচেষ্টা করিতে পারে। শাসকগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের উসকানিতে সমাজবিরোধী দুষ্কৃতকারীরা দাঙ্গা-হাঙ্গামা লুঠতরাজ প্রভৃতি বাধাইয়া সংগ্রামকে বিনষ্ট করিতে তৎপর হইতে পারে। এই সকল বিষয়ে হুঁশিয়ার ও সজাগ থাকার জন্য আমরা জনগণের প্রতি আহবান জানাইতেছি।
দৃঢ় সংকল্প বজায় রাখুন
বাংলাদেশের জনগণ আজ অভূতপূর্ব দৃঢ়তা ও একতার সঙ্গে অফিস-আদালতে হরতাল, খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ প্রভৃতির যে সংগ্রাম চালাইতেছেন, সে সংগ্রাম ইতিমধ্যে ইতিহাসে এক নূতন নজির স্থাপন করিয়াছে। সামরিক সরকারের হুমকী, দমননীতি, অভাব অনটন প্রভৃতির মধ্যেও যে সংগ্রাম শিথিল বা দমিত হইবে না এবং শত্রুর নিকট আমরা কখনও নতি স্বীকার করিব না এই বজ্রদৃঢ় সংকল্প আজ বাংলার ঘরে ঘরে জাগিয়া উঠুক।
ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করুন
নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা প্রদান, সামরিক শাসন প্রত্যাহার প্রভৃতি যে দাবীগুলি আওয়ামী লীগ প্রধান উত্থাপন করিয়াছেন সেগুলি আদায় করিতে পারিলে ‘স্বাধীন বাংলা কায়েমের সংগ্রামের অগতির সুবিধা হইবে–ইহা উপলদ্ধি করিয়া ওই দাবীগুলির পিছনে কোটি কোটি জনগণকে সমবেত করা এবং ওই দাবীগুলি পূরণে ইয়াহিয়া সরকারকে বাধ্য করাই হইল এই মুহূর্তে জরুরী কর্তব্য।
সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করুন
বস্তুত হরতাল, লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশ, মিছিল, সরকারী অফিস-আদালত ও সামরিক বাহিনীর সহিত অসহযোগ প্রভৃতি শান্তিপূর্ণ পন্থায় বর্তমান পর্যায়ে জনগণের আকাঙ্খিত স্বতন্ত্ৰ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালাইতে হইবে।
কিন্তু জনগণকে আজ সংগ্রাম করিতে হইতেছে প্রত্যক্ষভাবে সশস্ত্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তাই শান্তিপূর্ণ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত জনগণের সংগ্রাম বিজয়ী হইবে এইরূপ মনে করিবার কারণ নাই। প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর আজ্ঞাবাহী সেনাবাহিনী জনগণের উপর সশস্ত্র হামলা শুরু করিতে পারে। তাই আত্মসন্তুষ্টির কোন কারণ নাই। সংগ্রাম যে কোন সময়ে সুতীব্র রূপ ধারণ করিতে পারে। এই অবস্থায় স্বতঃস্ফুর্ততার উপর নির্ভর না করিয়া সুশৃঙ্খল ভাবে সংগ্রামের সর্বাত্বক প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার। সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবেলা ও উহা প্রতিরোধ করার জন্য শহর গ্রাম সর্বত্র জনগণকে সংগঠিত ভাবে প্রস্তুত হইবার জন্য আমরা জনগণের প্রতি আহবান জানাইতেছি। এই জন্য পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে, কলকারখানায় সর্বত্ৰ দলমত নির্বিশেষে সমস্ত শক্তি দিয়া গড়িয়া তুলুন স্থানীয় সংগ্রাম কমিটি ও গণবাহিনী। সেনাবাহিনী আক্রমণ করিলে ইহা প্রতিরোধের জন্য ব্যারিকেড গঠন করুন, যার যাহা আছে তাহা দিয়াই শত্রুকে প্রতিহত করুন।
শ্ৰমিক-কৃষক ভাইরা এগিয়ে আসুন
আজিকার সংগ্রাম জনগণের ন্যায্য সংগ্রাম। পশুশক্তির বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম বিজয়ের বজ্রকঠিন শপথ ও সংকল্প নিয়া আগুয়ান হওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি আজ নারী-পুরুষ,জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের সমস্ত জনগণকে, বিশেষত শ্রমিক, শহরের গরীব বস্তিবাসী, কৃষক ও ছাত্র সমাজের প্রতি আহবান জানাইতেছে। সাহসের সহিত শত্রুর বিরুদ্ধে সঠিকভাবে সংগ্রাম চালাইতে পারিলে আমাদের জনগণের বিজয় সুনিশ্চিত।
কেন্দ্রীয় কমিটি
পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি -ঢাকা
৯.৩.৭১
“স্বদেশ অন্ততঃ এখনো আমি আছি
স্পর্ধিত নদী-নক্ষত্রের
যৌবন নিয়ে বাঁচি।
সূর্যকে ভেঙ্গে খান্ খান্ করে
কাঁকন পরেছি হাতে
আকাশের ঐ তারা গলিয়ে
কাজল এঁকেছি চোখে।”
প্রতিটি দেশবাসীর মনে আজ এ-কথা উচ্চারিত। প্রতিটি মানুষ আজ এক অনাগত লড়াইয়ের মুখে এমনি দুঃসাহস আর চেতনা বুকে রেখে ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। আজ দাবী-দাওয়া আদায়ের ব্যাপারে সাত কোটি বাঙালী এক দেহ, একপ্রাণ। গুটিকয় আপন গণশত্রু ব্যতীত সমস্ত জাতি ঐক্যের পতাকাতলে সমবেত হয়েছে। বাঙালীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এক অগ্নিপরীক্ষার পর্যায় এসেছে এবার।
গত রবিবার রেসকোর্সের বিশাল জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এ-কথা মনে হয়েছে যে, সমুদ্রের জোয়ারকে যেমন আটকে রাখা যায় না তেমনি জনগণের প্রাণের দাবীকে দাবিয়ে রাখা যায় না। একতার চেয়ে বড় শক্তি আর নেই। তাই গত ক’দিনে হাটে ঘাটে মাঠে ঐক্যের সর্বদিক প্রসারিত শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করা গেছে। বুলেটের মুখে নিরস্ত্র জনতা অকাতরে প্রাণ দিয়ে ঐক্যের জয়গান গেয়ে গেছেন।
তাঁদের আত্মদান আমাদের সংগ্রামের পথে প্রেরণা হয়েছে। আমাদের হৃদয়ে সংগ্রামী আগুনের শিখা আরও দীপ্ত হয়েছে। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে প্রবঞ্চিত শোষিত নিপীড়িত আমাদের অসন্তোষ বিস্ফোরিত হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, দেশ জনতার ঐক্যবদ্ধ কন্ঠস্বরের সামনে কোন শক্তি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না।
আজ রাজপথে হাটে মাঠে লোকালয়ে শহরে নগরে বন্দরে জনতার চোখে মুখে মুক্তির আগুনই জ্বলতে দেখা যায়। সামনে অনাগত কঠোর দিন। দুর্দশা বিপর্যস্ত সময় দেখেও জনতা ভীত নয়। দাবী-দাওয়া আদায় করতে এদেশের মানুষ বাহান্ন থেকে অকাতরে রক্ত দিয়ে আসছে। রক্ত দিতে শিখেছে এই দেশের মানুষ প্রতি পদক্ষেপে। তাই আরও রক্ত দেয়ার প্রস্তুতি চলেছে ঘরে ঘরে। বঙ্গবন্ধু অহবানে প্রতি ঘর একটি করে দুর্জয় দুর্গে পরিণত হচ্ছে। আজ আমাদের অহংকারের দিন যেমন এসেছে তেমনি সদাসতর্ক থাকার দিনও এসেছে। আমাদের চোখে জ্বলবে সূর্যের রোশনাই, হাতে থাকবে স্পর্ধার ভারী অস্ত্র, বুকের দরজা সন্ধ্যা- সকাল-রাত্রি খোলা থাকবে মৃত্যুকে অনায়াসে প্রবেশের পথ দেয়ার জন্যে। ঠিক তারই পাশাপাশি আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি আচরণে, প্রতিটি মুহূর্তে। সেদিনের বিশাল জন-সমুদ্রকে বাংলার সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু সতর্ক করে দিয়েছেন যে আমাদের মধ্যে ছদ্মবেশী শত্রু ঢুকে পড়ে আমাদের ক্ষতি করতে পারে। তাই আমাদের হতে হবে ‘নিয়মতান্ত্রিক সতর্ক প্রহরী’।
একথা সত্যি যে, জাতির সংগ্রামের লক্ষ্যে পৌছুতে প্রচুর অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়। গণশত্রুরা আমাদের মধ্যে বিভেদ ও ত্রাস সৃষ্টি করে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামকে বানচাল করে দিতে পারে। তাই আজ আমাদের দিন এসেছে নিজেদের প্রয়োজনবোধে সংশোধন করে নেয়ার।
আজ আমাদের জাতীয় চরিত্রে যদি কোন ত্রুটি থেকে থাকে তা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে সংশোধন করে নেয়ার পথে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, প্রতিটি মানুষের ভালো মন্দ মিলিয়ে একটি জাতির চরিত্র সৃষ্টি হয়। সে কারণে, আমাদের মনে রাখতে হবে আজ সাত কোটি বাঙালী এক প্রাণ। আমরা সবাই একটি গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আমাদের আরও স্মরণ রাখতে হবে যে,আমাদের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিক সতর্কতা না থাকলে নেতৃবৃন্দের পদক্ষেপ নিখুঁত ও নির্ভুল হলেও ব্যর্থতা আসতে পারে। কারণ, নেতার দায়িত্ব হলো সঠিক ভাবে পরিচালিত করা এবং জনতার দায়িত্ব হলো সঠিক-সংগ্রাম চালানোর যোগ্যতা অর্জন করা। আমাদের মধ্যে এ গুণ বিদ্যমান থাকলে আমাদের নেতৃবৃন্দও ভুল করতে পারবেন না।
৯ই মার্চ পল্টনের বিরাট জনসভায় মজলুম জননেতা মৌলানা ভাসানী ও আমাদের ‘চরিত্র’কে নিখুঁত ও অনুপম করার প্রয়োজনীতার কথা উল্লেখ করেছেন। ‘চরিত্র’ বলতে তিনি সততা, নিষ্ঠা, সাহস এবং সংগ্রামী মনোভাবের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, আমাদের জাতীয় চরিত্রে ত্রুটি থাকলে আমরা সংগ্রাম শেষে গন্তব্যে পৌঁছেও তার ফল ভোগ করতে পারব না। তাই প্রতি মূহুর্তে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে–নিজের ও দেশের জনতার কাছে আমি কতখানি সৎ ও সাহসী। আজ মৃত সমুদ্রে প্রচন্ড জোয়ার এসেছে, যা কেউ বাধা দিতে পারবে না। আপন বেগে, আপন শক্তিতে, আপন মহিমায় গণচেতনার এই জোয়ার প্রবাহিত হবেই। কারণ দেশের মানুষের কন্ঠে শোনা যায় :
“মৃত্যুকে করেছি তুচ্ছ
জীবনের নান্দীপাঠ সারা
জীবন জয়ের রণে,
দিকে দেকে সংগ্রামের তাড়া।
[আজাদ–১৪ই মার্চ, ১৯৭১]
সাত কোটি বাঙালী যেখান হইতে আজ নির্দেশ গ্রহণ করে
ইসলামাবাদের কর্তৃপক্ষ আজ ক্ষমতা হস্তান্তর না করিলেও বিশ্ববাসীর কাছে আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, বাংলার শাসনক্ষমতা এখন আর সামরিক কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারে নাই। বরং সাত কোটি মানুষের ভালবাসার শক্তিতে ধানমন্ডীর ৩২ নং সড়ক এখন বাংলার শাসন ক্ষমতার একমাত্র উৎস হইয়া পড়িয়াছে। হাজার চোখ রাঙানী সত্ত্বেও এই সড়ক হইতে যে নির্দেশ জারী হয়, বাংলার সাত কোটি মানুষ এখন যে কোন মূল্যে তাহা বাস্তবায়িত করেই। আর যাহার নির্দেশ জনগণ পরম শ্রদ্ধায় ও চুড়ান্ত ত্যাগের বিনিময়ে কার্যকরী করে তিনি হইতেছেন বাংলার মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর এখন বাংলার মুক্তি- সংগ্রামের জীবন্ত প্রতীক। এই জন্যই ধানমন্ডীস্থ শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন এখন একটি আঘোষিত সরকারীসদর দপ্তরে পরিণত হইয়াছে। হোয়াইট হাউস বা ১০ নং ডাউনিং ষ্ট্রীটের মত এই বাড়ীটির কোন সরকারী মর্যাদা নাই বটে–কিন্তু বাংলার সাতকোটি মানুষের ভালবাসার রাজ্যে এই বাড়ী এক অনন্য মর্যদায় প্রতিষ্ঠিত।
[আজাদ-১৮ই মার্চ, ১৯৭১]
বাংলার শ্যামল প্রান্তর আজ বহ্নিমান
তবুও শোষক শ্রেণী দুঃস্বপ্নে বিভোর
শ্যামল বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে প্রায় একপক্ষ কাল যাবৎ যে বিদ্রোহের বহ্নিশিখা জ্বলিতেছে কায়েমী স্বার্থবাদী মহলে এখনও তাহা কোন শুভ প্রতিক্রিয়ার সূচনা ঘটাইতে পারে নাই। পরিস্থিতি দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, শোষকগোষ্ঠী শক্তির দাপটে বাংলাদেশকে সংরক্ষিত বাজার হিসাবে ব্যবহারের দুঃস্বপ্নে এখনও বিভোর আর সেই জন্যই দেশব্যাপী গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী উত্থিত হইলেও এই মহল যে কোন প্রকারে ক্ষমতা আঁকড়াইয়া থাকিতে চাহিতেছে। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা; এই মনোভাবের আশু পরিবর্তন না হইলে পরিস্থিতি এমন গুরুতর মোড় নিতে পারে, যাহা নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা কোন গোলা বারুদের নাই। কেননা শত শহীদের তপ্ত রক্তে সিক্ত বাংলার চেতনা এখন আর কোন আপোসে রাজী নয়। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলার মানুষের এই সামান্য অধিকার প্রদান করিতে স্বার্থবাদী মহলের কেন এত অনীহা –বহ্নিমান অগ্নিগিরির উপর দাঁড়াইয়া আজ তাহা বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে।
প্রথমত ‘স্বাধীনতা’র ২৩ বৎসরে বাংলাদেশ কেবলই দিয়াছে, বিনিময়ে পাইয়াছে অবজ্ঞা আর বঞ্চনা। বাংলাদেশের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় পশ্চিম পাকিস্তানের মুষ্টিমের শোষকের ভোগ-বিলাসের জন্য গড়িয়া উঠিয়াছে শিল্পকারখানা ব্যবসা-বাণিজ্য। সাধারণ মানুষ এইসব প্রতিষ্ঠানে ক্রীতদাসের মত শ্রম দিয়াছে। আর শোষকগোষ্ঠী সেই শ্রমের বিনিময়ে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করিয়াছে সাত কোটি মানুষের দেশ বাংলায়। বাংলাদেশের শিল্পের বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করিয়া এখানে গড়িয়া তুলিয়াছে প্রতিযোগিতাহীন একটি সংরক্ষিত বাজার। তাহারা আরও বুঝিতে পারিয়াছে যে, সাত কোটি মানুষের এই নিরাপদ বাজার ছুটিয়া গেলে তাহাদের কল-কারখানা ও ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হইয়া যাইবে। কিন্তু ইতিমধ্যে তাহারা কোন বিকল্প ব্যাপারেরও ব্যবস্থা করিতে পারে নাই।
সুতরাং এই কায়েমী স্বার্থবাদী মহল আজ যে কোন প্রকারে বাংলাদেশের বাজার অক্ষুণ্ণ রাখিতে চায়। আর সেই জন্যই নুন্যতম অধিকার দানের পরিবর্তে চালায় দমননীতি।
দ্বিতীয়ত, শাসনতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃত হইলে তাহা কেবল বাংলাদেশের জন্যই প্রযোজ্য হইবে; পশ্চিম পাকিস্তানের বঞ্চিত অপরাপর প্রদেশও একই অধিকার পাইবে না। এবং তাহা হইলে শোষকগোষ্ঠীর ‘দোহন-নীতি’র অপমৃত্যু ঘটিবে।
পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, প্রধানত এই দুইটি কারণেই পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট দিন দিন জটিল আকার ধারণ করিতেছে। ক্ষমতাসীন মহল সমগ্র পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করিয়া আসল সমাধান এড়াইয়া যাওয়ার চেষ্টা করিতেছে।
কিন্তু রাজনৈতিক ওয়াকেবহাল মহল দৃঢ়মত পোষণ করেন যে শাসকগোষ্ঠীর এই পলায়নী মনোবৃত্তি পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করিতে পারে। বিশেষত বিদ্রোহী বাংলার মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান দেশব্যাপী যে অভূতপূর্ব জনতার ঐক্য গড়িয়া তুলিয়াছেন এবং ঘরে ঘরে প্রতিরোধের দূর্গ প্রতিষ্ঠার যে আহ্বান জানাইয়াছেন তাহা নিস্ফল রাজনৈতিক প্রচারণায় পর্যবসিত হইবে না।
[আজাদ- ১৪ই মার্চ, ১৯৭১]
ইয়াহিয়া খাঁর একজন দূত এলেন ঢাকায়। তাঁর নাম এম খুরশিদ। জনাব খুরশিদ হলেন আওয়ামী লীগের পাঞ্জাব শাখার সভাপতি। পশ্চিম পাকিস্তানেও শেখ মুজিবুরের সমর্থনে সক্রিয়ভাবে জনমত গড়ে উঠেছে। জাতীয় আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী খাঁ), জামাতে ইসলামী, জমিয়তে উলেমা, মুসলিম লীগ (কনভেনশান), মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) প্রভৃতি দলগুলির নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে মুজিবুরকে পরোক্ষ সমর্থন করেন ও ভুট্টোর নীতির বিরোধিতা করেন। তাঁরা বলেন, জনাব ভুট্টো আগুন নিয়ে খেলা করছেন। তাঁরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুরের ৪ দফা দাবী মেনে নিতে বলেন। এদিকে জেঃ আসগর খানও মুজিবুরের দাবী মেনে নেবার দাবী জানান। জনাব খুরশিদ ঢাকায় এসে শেখ মুজিবুরের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ১১ই মার্চ সকালে ঢাকা বেতার-কেন্দ্রে শেখ মুজিবুরের একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়। এই বিবৃতিতে মুজিবুর বলেন, সামরিক প্রশাসনের বিপর্যয়কর নীতি বাংলাদেশে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বিদেশীদের চলে যেতে বাধ্য করেছে। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, কোন রকম হুমকীর কাছে বাংলাদেশের মানুষ নতী স্বীকার করবে না। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের মার্শাল ল শাসক বৃহস্পতিবার ১১ই মার্চ এক হুকুমনামা জারী করে হুঁশিয়ারী জানিয়েছেন যে, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে ফৌজ চলাচলে কোন বাধার সৃষ্টি করলে সামরিক আইনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। এই আদেশের পর বাংলাদেশে আশঙ্কা : শেষ মুজিবুরের অসহযোগ আন্দোলন বানচাল করার উদ্দেশ্যে সব রকমের ধর্মঘট কর্মবিরতি নিষিদ্ধ করার প্রস্তুতিতেই আর্মি হাইকমাণ্ডের এই ফতোয়া। ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান শনিবার (১৩ই মার্চ, ৭১) ঢাকায় বলেন যে, অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের দাবীর প্রতি তাঁহার পূর্ণ সমর্থন রহিয়াছে। শনিবার করাচী হইতে ঢাকা আগমনের পর বিমান-বন্দরে সাংবাদিকদের নিকট জনাব ওয়ালী খান উপরোক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত আলোচনা করার ও বাংলাদেশের ক্রম অবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য তিনি ঢাকা আগমন করিয়াছেন। তিনি জানান যে, রাজনৈতিক সংকট বর্তমানে যে স্তরে পৌঁছিয়াছে তাহাতে দেশের সংহতিই বিপদাপন্ন হইয়া পড়িয়াছে।
মুজিব-ওয়ালী বৈঠক
রবিবার তিনি শেখ মুজিবের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন বলিয়া সাংবাদিকদের আভাস দেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের পর হইতে শেখ মুজিবের সহিত তাঁহার কোন সাক্ষাৎ ঘটে নাই।
তিনি জানান যে, লণ্ডনে অবস্থানকালে সেখানকার ডাক ধর্মঘটের দরুণ তিনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন কিছুই জানিতে পারেন নাই। তবে দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য তিনি প্রেসিডেন্টের একটি জরুরী বার্তা পাইয়াছিলেন।
দেশের বর্তমান সঙ্কট নিরসনের উপায় সম্পর্কে জনাব ওয়ালী খানের মতামত জানিতে চাওয়া হইলে তিনি বলেন যে, ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়। তিনি জানান যে, শেখ মুজিবরের সহিত আলোচনার জন্য তিনি খোলা মনে আগমন করিয়াছেন। জনাব ওয়ালী খানের সহিত পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ও নবনির্বাচিত এম এন এ জনাব গাউস বখশ বেজেঞ্জোও ঢাকা আগমন করিয়াছেন।
১৩ই মার্চ ১৯৭১ সামরিক কর্তৃপক্ষ ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসকে (ই পি আর) নিরস্ত্র করার কাজ শুরু হয়। ই পি আর এর অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আশঙ্কাতেই পাক সরকার এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। ঢাকার সিভিল লাইন অঞ্চলে এক সংঘর্ষে সৈন্যদের গুলী চালনায় ই পি আর বাহিনীর কয়েকজন লোক নিহত হয়। আহতও হয় অনেকে। ই পি আর বাহিনীর অনেককে ক্যান্টনমেন্টে এনে বন্দী করে রাখা হয়। বন্দী ই পি আর বাহিনীর লোকেরা ধ্বনি তোলেন “জয় বাংলা”। মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, যতদিন না বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধিকার অর্জন করেছেন ততদিন পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেকগুলি জাহাজ সৈন্য বোঝাই হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পথে রওনা হয়েছে। বঙ্গীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি এক আবেদন জানিয়ে বাঙ্গালীদের পাকিস্তানী পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। এদিনের আর একটি সংবাদ : ইয়াহিয়া খাঁ করাচী থেকে ঢাকার পথে রওনা হয়েছেন।
১৫ই মার্চ বাংলাদেশের বুক চিরে এক নূতন সূর্যের রক্তিম আভা দেখা দিল। সোমবার সকালে মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন : পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ প্রশাসনভার তিনি নিজের হাতে গ্রহণ করলেন। ৩৫টি নির্দেশনামা জারী করে বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর স্বশাসন কায়েম করলেন। মুজিবুর ঘোষণা করলেন তাঁর দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, জাতীয় পরিষদে তাঁর দলের প্রধানতার ভিত্তিতে তিনি বাংলাদেশের ৭ কোটি ৫০ লক্ষ অধিবাসীর কল্যাণের জন্য দেশের শাসনভার হাতে নিলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করার অর্থ বাংলাদেশের মুক্তি। সকালে মুজিবুরের ঘোষণা প্রচার হল, বৈকালে ইয়াহিয়া খাঁ করাচী থেকে ঢাকা পৌঁছলেন। কয়েক হাজার সামরিক বাহিনীর লোক ইয়াহিয়া খাঁকে বিমান বন্দর থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনে নিয়ে যান। ইয়াহিয়া খাঁ যে পথে যান, সে পথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিল সামরিক বাহিনী। গুলী চলল জনতার উপর। একজন রিক্সাওয়ালা মারা গেল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁকে বিমান-বন্দরে স্বাগত জানালেন টিক্কা খান। মুজিবুর রহমান তার ৩৫ দফা নির্দেশ জারী করে বলেন, ইসলামাবাদ সরকারের এই অবস্থা মেনে নেওয়া উচিত। নির্বাচনের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই প্রকৃত ক্ষমতার উৎস। পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা ৩৫টি নির্দেশনামা কার্যকরী করে স্বশাসন ব্যবস্থা নেবে। এই নির্দেশনামার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার, প্রাদেশিক সরকার ও আধা-সরকারী অফিস আদালতে ধর্মঘট চালাবার নির্দেশ জারী হয়েছে। অফিস না খুলে ডেপুটি জেলা কমিশনারদের, মহকুমা অফিসারদের কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে এক্ষেত্রে মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ কর্মীরা পুলিশকে সাহায্য করবেন।
নির্দেশনামায় আরও বলা হয়েছে যে, বন্দর কর্তৃপক্ষরা বন্দরে জাহাজ আসা এবং বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ার বিষয়ে কাজকর্ম চালিয়ে যাবেন। কিন্তু কোন সামরিক বাহিনীর অবতরণ অথবা সামরিক দ্রব্যাদি উঠানো-নামানো সম্পর্কে কোন প্রকার সহযোগিতা করা চলবে না। ডাক ও. তার বিভাগ কেবল মাত্র ‘বাংলাদেশ’-এর অভ্যন্তরে চিঠি-পত্র, টেলিগ্রাফ এবং মনিঅর্ডার বিলি করার জন্য কাজকর্ম চালিয়ে যাবেন। বিদেশে চিঠিপত্র ও তারবার্তা সরাসরি পাঠানো চলবে।
তিনটি সামরিক ছাউনিকে মুজিবের ঘোষণার আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই তিনটি ছাউনি হল ঢাকায়, কুমিল্লায় এবং যশোরে। যশোর ঢাকা থেকে ২৭০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে। শেখ মুজিবুর সকল পূর্ব পাকিস্তানীকে সর্বশক্তি দিয়ে সম্ভাব্য সকল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ও সর্বস্ব ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে আবেদন জানান।
যে ৩৫টি নির্দেশনামা জারী করা হয়েছে তার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আয়কর আদায় স্থগিত। সকল কেন্দ্রিয় শুল্ক বাবদ অর্থ পাঠানো বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। পূর্ব- পাকিস্তান সরকারের রাজস্ব খাতে সকল প্রাদেশিক কর আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের টেলিপ্রিন্টার লাইন সোমবার, মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার বেলা ২-৩০ টা থেকে ৩-৩০ টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা খোলা রাখার জন্য আদেশ জারী করা হয়েছে। এই সময় ব্যাঙ্কগুলি তাদের বার্তা বিনিময় করতে পারবে।
রেডিও ও টেলিভিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, সকল বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ এবং জনগণের আন্দোলনের সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। নির্দেশে বলা হয়েছে, খাদ্যশস্যের আমদানী, বণ্টন, গুদামজাত করা এবং বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানোর বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
সকল প্রাদেশিক ও স্থানীয় কর সংগ্রহ করে ‘বাংলাদেশ’ সরকারের রাজস্ব খাতে জমা দেবার নির্দেশ জারী করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য সংগৃহীত পরোক্ষ কর প্রদেশের দুটি বাঙালী ব্যাঙ্ক-দি ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল এবং দি ইস্টার্ন ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনে জমা দিতে হবে। পুনরায় নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আয়কর আদায় স্থগিত থাকবে। ব্যাঙ্কগুলিকে প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা করে খোলা রাখতে বলা হয়েছে। সকল বেসরকারী বাণিজ্য ও শিল্প-সংস্থাগুলিতে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম চালাতে বলা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষায়তনগুলি বন্ধ থাকবে। নির্দেশনামায় ভবনশীর্ষে কালো পতাকা উড়াবার আদেশ বলবৎ রাখা হয়েছে। শেখ মুজিবুর সারা বিশ্বের স্বাধীনতা-প্রেমিকদের কাছে এবং স্বাধীনতার জন্য যাঁরা সংগ্রাম করছেন বিশ্বের সেই সকল মানুষের সমর্থন কামনা করে আবেদন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যারা ষড়যন্ত্র করে শক্তির দ্বারা আমাদের শাসন করতে চেয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের জনগণ সংঘবদ্ধভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়ে কি ভাবে স্বাধীনতা রক্ষা করতে হয় তার প্রমাণ রেখেছেন। বাংলাদেশের মানুষের এই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে দমন করা যাবে না।
আমাদের পদানত করা যাবে না, কারণ প্রয়োজন হলে আমরা মরণকে বরণ করতে প্রস্তুত। কারণ আমরা নিশ্চিত হতে চাই যে আমাদের বংশধররা মর্যাদার সঙ্গে এক স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিকের জীবন যাপন করতে পারবে।
শেখ মুজিবুর রহমান আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি নরনারী ও শিশু আজ উন্নত শিরে দাঁড়াতে পারছেন। যাঁরা ভেবেছিলেন চরম শক্তি প্রয়োগের দ্বারা আমাদের দাবিয়ে রাখা যাবে তাঁরা ভুল করছেন। আজ বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষ– অফিসের কর্মী, কারখানার শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-সবাই নির্দ্বিধায় এটা প্রমাণ করেছেন যে, আত্মসমর্পণের পরিবর্তে তাঁরা মৃত্যুবরণে প্রস্তুত।
আজ সারা দেশবাসী তাঁদের সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। তাঁরা জানাচ্ছেন সামরিক শাসনের কাছে তাঁরা নতিস্বীকার করবেন না। অতএব আমি সকলের কাছে আবেদন জানাই, বিশেষ করে যাঁদের কাছে সর্বশেষ সামরিক হুকুম জারী করা হয়েছে, তাঁরা যেন ভীতি প্রদর্শনের কাছে নত না হন। সারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাঁদের পিছনে রয়েছেন।
[ইউ. পি. আই] ঢাকায় এসেছেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। সঙ্গে এসেছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেঃ আবদুল হামিদ খান, প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লেঃ জেঃ পীরজাদা, মেজর জেঃ ওমর, আরও ছয়জন ব্রিগেডিয়ার। টিক্কা খান তো আগে থেকেই আছেন। টিক্কা খান সেই ব্যক্তি যিনি ১৯৬৪ সালে বেলুচিদের নৃশংভাবে দমন করেছিলেন এবং ১৯৬৫ সালে কচ্ছের লাড়াইয়ের সময় বলেছিলেন, “আমি একাই বোম্বাই দখল করে নিতে পারি।” কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভবনকে ঘিরে যে সামরিক তৎপরতাই চলুক না কেন, সারা পূর্ববাংলায় নূতন তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল ঢাকা বেতার-কেন্দ্র থেকে। ঢাকা বেতার কেন্দ্রে সোমবার সকালে শ্রোতাদের শোনানো হয় এক নুতন অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান-সূচী হল দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। এই অনুষ্ঠান-সূচীতে বলা হয় আমরা এতদিন অন্ধকার যুগে ছিলাম, আমরা এগিয়ে চলেছি, আমরা বীর-মরণকে আমরা ভয় করি না।
বেতারে শ্রুত হল গান :-‘ও আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।” সেই সঙ্গে শোনা গেল-
“জয় জয় জয় বাংলা
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা
মুক্তিধারার সীমানা
জয় জয় জয় বাংলা।”
পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা আজ আর উড়ছে না পূর্ব পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে। প্রতি বাড়ীতে, প্রতি ঘরে জাতীয় পতাকার স্থান নিয়েছে কালো পতাকা। ঢাকার ১৬ হাজার সাইকেল রিকসার উপরেও ঐ কালো পতাকা। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সৈন্যবাহী ট্রাকগুলো উড়িয়েছে কালো পতাকা। ঢাকার বেতার-কেন্দ্র থেকে আজ আর বলা হচ্ছে না-”রেডিও পাকিস্তান ঢাকা”, সেখানে বলা হচ্ছে “ঢাকা বেতার কেন্দ্র”। পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়েও আর অনুষ্ঠান শেষ হয় না। ১৬ই মার্চ প্রত্যুষে ঢাকাবেতার-কেন্দ্রে শোনা গেল গীতার একটি শ্লোক। পাকিস্তান বেতারে গীতার শ্লোক চমক লাগিয়ে দিল, সেই সঙ্গে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত।
আর একটি গান-
“তোমার দেশ আমার জমি,
আমাদেরই মাটি,
একসাথে মোরা সবাই হাঁটি।”
আর একটি গান-
“দূর আকাশে সূর্যোদয়
আকাশ আলোয় ঝলমল
জয় জয় জয় বাংলা
জয় বাংলা জয়।”
আর একটি গান-
অন্ধকারের দিন পেরিয়ে
পৌঁছেছি আমরা নতুন দিনের
ভোরে।
একতাই মর্যাদা, একতাই শক্তি।
যাত্রা পথের ভয় হয়েছে শেষ।
আমরা এখন নির্ভয়ে, সব বাধা উপেক্ষা
করে এগিয়ে চলব।… আমরা
নতুন পথের দিশারী, আমরা নতুন
দিনকে আলিঙ্গন করি।”
পাকিস্তানের ২৩ বৎসরের ইতিহাসে মঙ্গলবার সকালে সর্বপ্রথম প্রেসিডেন্ট ভবনে কালো পতাকা প্রবেশ করে। এই পতাকাটি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গাড়ীতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেলা ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে যখন যান তখন প্রহরারত পুলিশবাহিনী তাঁকে পূর্ণ মর্যাদায় অভিবাদন করে। প্রেসিডেন্ট ভবনের নিরাপত্তারক্ষায় ভবনের বাইরে পুলিশ এবং অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়। ১১ টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রবেশ করিলে জেঃ ইয়াহিয়া খান বারান্দায় নামিয়া আসিয়া তাঁহাকে অভ্যর্থনা করেন কিন্তু আলো চনা শেষে বেলা ১১ টায় শেখ মুজিবুর রহমান যখন কক্ষের বাহিরে আসেন তখন প্রেসিডেণ্টকে বিদায় অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করিতে দেখা যায় নাই। প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে আলোচনা শেষে দেশ- বিদেশের সাংবাদিকদের কাছে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি মাত্র তিনটি পূর্ণবাচ্য উচ্চারণ করেন। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট ভবন হইতে বাহির হইয়া আসিয়া বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন তাঁহারা দেশের রাজনৈতিক সমস্যা আলোচনা করিতেছেন, আলোচনা চলিতে থাকিবে। সমস্যা এমন নহে যে দু-তিন মিনিটের মধ্যেই সমাধান করা যায়। বেলা ১০ টা ৫০ মিনিটে মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে নিজ বাসভবন ত্যাগ করেন। দেশী বিদেশী সাংবাদিকরা বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে শেখ মুজিব স্মিত হাস্যে জবাব দানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং “জয় বাংলা” ধ্বনি উচ্চারণ করিয়া গাড়ীতে আরোহণ করেন। বেলা ১১ টায় বঙ্গবন্ধু তাঁর সাদা ‘মাজদা’ গাড়ীতে কালো পতাকা উড়াইয়া প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রবেশ করেন। গাড়ী হইতে নামিয়া শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন।
[আজাদ- ১৭ই মার্চ, ১৯৭১]
রুদ্ধদ্বার কক্ষে দলীয় নেতাদের সহিত মুজিবুরের বৈঠক
জেঃ ইয়াহিয়া খানের সহিত আলোচনায় যোগদানের পূর্বে মঙ্গলবার বেলা ৯টায় নিজ বাসভবনে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সহিত রুদ্ধদ্বার কক্ষে এক বৈঠকে মিলিত হন।
প্রেসিডেন্টের সহিত আলোচনার পর দলীয় অপরাপের নেতাদের সহিত আওয়ামী লীগ প্রধান কয়েক দফা আলোচনায় মিলিত হন। রাত সাড়ে আটটায় আওয়ামী লীগ হাই কমাণ্ড রুদ্ধদ্বার কক্ষে পুনরায় আলোচনা শুরু করেন। অধিক রাত পর্যন্ত এই আলোচনা অব্যাহত থাকে।
উক্ত আলোচনায় দলীয় প্রধানের সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোসতাক আহমেদ, ক্যাপটেন মনসুর আলী, জনাব তাজউদ্দিন আহম্মদ, জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ডক্টর কামাল হোসেন অংশ নেন বলে জানা যায়।
শেখ মুজিবুর রহমান চরম সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন এই দিন। বললেন, ‘আমি যদি আপনাদের মধ্যে না থাকি তাহলেও আপনারা যেন নিজেদের স্বাধিকার অর্জনের এই আন্দোলনে আমার সহকর্মীদের নির্দেশ নিয়ে কাজ করেন।’ সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর সাথে আলোচনা-বৈঠকে মিলিত হতে যাবার আগে শেখ মুজিবের মনে পড়েছিল- আমি যদি না থাকি।
কিন্তু তাজউদ্দিন আহমেদ শেখ মুজিবুরের এই প্রশ্নের জবাব দিতে এগিয়ে এলেন। তাজউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হল। আহমেদ বলেন, ‘দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান দেখা দিয়েছে। জনগণের এই অপূর্ব উৎসাহকে দেশের উন্নয়নের কাজে লাগিয়ে আমরা জগতকে দেখাতে চাই যে বাঙালীরা সর্বাপেক্ষা শোচনীয় বিপর্যয়ের মধ্যেই জয়ী হতে জানে।’
পূর্ব বঙ্গ ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্র পরিষদ ঘোষনা করেছেন, পূর্ববঙ্গ একটি স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র যার নাম ‘বাংলাদেশ’। এই দিন অস্ত্র বোঝাই একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছলে ডক কর্মীরা জাহাজটি খালাস করতে অস্বীকার করে। অপর দিকে প্রায় ৮ শত বাঙালী সৈনিককে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান দেবার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালী সৈন্য বহন করতে অস্বীকার করে।
বুধবার ১৭ই মার্চ-আজ মুজিবুরের ৫৩তম জন্মদিন। ঢাকা বেতার কেন্দ্রে তাঁকে মুক্তিদাতা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় দিনে শেখ মুজিবুর যখন প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খাঁর সঙ্গে আলোচনা করছিলেন তখন হাজার হাজার ছাত্র ঢাকার রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিলে ঝড় তুলেছিল। তাদের মুখে ধ্বনিঃ ইয়াহিয়া ফিরে যাও। মুজিব- কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কোন আপোস নয়।
বাঙালী তরুণেরা হাজারে হাজারে এসে মুজিবের বাসভবনের সামনে সমবেত হন। এইদিন জেঃ টিক্কা খান এক ঘোষণায় জানান যে, ২রা থেকে ৯ই মার্চ যে পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনী তলব করা হয়েছিল তার তদন্ত করা হবে। এইদিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনা ১ ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল। আলোচনা বৈঠক থেকে ফিরে শেখ মুজিব বলেন, আলোচনা যখন চলছে তখন তিনি কিছু বলবেন না। তবে আওয়ামী লীগের ৪ দফা দাবী মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আইন অমান্য আন্দোলন চলতে থাকবে। এই দিন ঢাকা বেতারে বলা হয় : বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার নূতন দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা। তাঁদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর সাফল্যের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত ভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার-শেখ মুজিবুর রহমান টিক্কা খাঁর দ্বারা গঠিত তদন্ত কমিশনকে অগ্রাহ্য করলেন। শেখ মুজিবুর রহমান এই দিন ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশ গঠনের নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
শেখ মুজিবুর বলেছেন, ন্যায্য দাবীর জন্য লড়াই চলবে, কোন আপোস নয়। মুজিবুর তদন্ত কমিশন অগ্রাহ্য করেছেন এই সংবাদে হাজার হাজার মানুষ বৃহস্পতিবার মুজিবুরের ধানমণ্ডী বাসভবনের সামনে জমায়েত হয়ে ধনি তোলে, “পরিষদ না রাজপথ– রাজপথ রাজপথ।”
শেখ মুজিব সামরিক বাহিনীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আপনারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকলে আগুন জ্বলতেই থাকবে। সেই অগ্নিশিখা থেকে আপনারাও রেহাই পাবেন না।’
শুক্রবার-ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে জয়দেবপুরে পাকিস্তানী ফৌজের গুলীতে ২৪ জন নিহত হল, আহত হল বহু ব্যক্তি। এই দিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর সঙ্গে মুজিবের ৩য় দফা বৈঠক হল। ৯০ মিনিট ধরে এই বৈঠক চলে। বৈঠক থেকে বেরিয়ে মুজিব বলেন, “যে কোন পারিণামের জন্য আমি প্রস্তুত।” আজকের বৈঠকে ইয়াহিয়া ও মুজিবুর ছাড়া অন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন না। দলের সর্বোচ্চ নেতাদের সঙ্গে মিলিত হন। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মনসুর আলী, ডঃ কামাল হোসেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মুস্তাক আহমদ ও তাজউদ্দিন।