আমি মুজিব বলছি – ৫

শহীদুল্লাহর আরও কয়েকটি বক্তব্যঃ

“স্বাধীন পূর্ববাংলার স্বাধীন নাগরিক রূপে আজ আমাদের প্রয়োজন হয়েছে সর্ব শাখায় সুসমৃদ্ধ এক সাহিত্য। এই সাহিত্য হবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়, পৃথিবীর কোন জাতি জাতীয় ভাষা ছেড়ে বিদেশী ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হতে পারে নি … স্বাধীন পূর্ববাংলায় কেউ আরবী হরফে, কেউবা রোমান অক্ষরে বাংলা লিখতে উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বাংলার শতকরা ৮৫ জন নিরক্ষর, তাদের মধ্যে অক্ষর জ্ঞানে বিস্তারের জন্য চেষ্টা হচ্ছে? যদি পূর্ববাংলার বাইরে বাংলাদেশ না থাকতো আর যদি গোটা বাংলাদেশ মুসলমান ভিন্ন অন্য সম্প্রদায় না থাকতো তবে এই অপর প্রশ্নটা এত সঙ্গীন হত না। আমাদের বাংলাভাষী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে, কাজেই বাংলা অক্ষর ছাড়তে পারা যায় না।” শহীদুল্লাহ আরও বলেন, “পূর্ববাংলা জনসংখ্যায় গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালী, স্পেন, পর্তুগাল, আরব, পারস্য, তুর্কি প্রভৃতি দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই সোনার বাংলাকে কেবল জনে নয়, ধন ধান্যে, জ্ঞানে গুণে, শিল্প বিজ্ঞানে পৃথিবীর যে কোন দেশের সমকক্ষ করে তুলতে হবে। তাই কেবল কাব্য উপন্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। দৰ্শন, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল বিভাগে বাংলাকে উচ্চ আসন দিতে হবে।”

১৯৪৮ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারী শ্রীধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচীর কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে সর্বপ্রথম দাবী জানান যে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও সরকারী কাজে ব্যবহার করতে হবে। তিনি বলেন যে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হিসাবে বাংলা তার যোগ্য মর্যাদা পাবার দাবী নিশ্চয়ই জানাতে পারে।

উত্তরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খান ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জানান যে, ‘একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু এবং অন্য কোন ভাষা নয়।’ পূর্ববাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন জনাব লিয়াকতের আরেক ডিগ্রী উপরে গিয়ে বলেন যে, ‘পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ লোক উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে দেখতে চান। বাংলার রাষ্ট্র ভাষা হবার কোন যৌক্তিকতাই তাঁরা দেখতে পান না।

খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮-এর ৪ঠা মার্চ কলকাতায় এক বিবৃতিতে বলেনঃ-

“I am sure nobody excepting a handful of persons in East Bengal demand that Bengali should be the official language of Pakistan.” লিয়াকত-নাজিমুদ্দিনের উক্তি পূর্ববঙ্গে ধিকৃত হল, কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলেন বিপুল ভাবে অভিনন্দিত। করাচীর লীগ- পাণ্ডারা ভেবেছিলেন যে হিন্দু ধীরেন্দ্রবাবুর ঔদ্ধত্যের জন্য পূর্ববঙ্গ তাঁকে ‘হিন্দুস্থানের দালাল’ বলে উপহাস করবে।

পূর্ববঙ্গের সর্বত্র বাংলাভাষার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিদ্বেষমূলক মনোভাবের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠতে লাগল। বাংলাকে অন্যতম সরকারী ভাষা করবার দাবী জানিয়ে জনসভা, মিছিল অনুষ্ঠিত হল, পথে পথে পোস্টার পড়ল। গঠিত হল ভাষা সংগ্রাম কমিটি। পূর্ববঙ্গে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হল। ভাষা সংগ্রাম সমিতির নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন ছাত্রনেতা মুজিবুর তাঁদের অন্যতম। শোভাযাত্রা বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল সারা পূর্ববঙ্গে, পুলিশী হামলায় আহত হলেন শের-ই-বাংলা ফজলুল হক। একটি শোভা-যাত্রা নিয়ে রাজপথে যাচ্ছিলেন ৭৬ বৎসরের হক সাহেব, পুলিশ লাঠিপেটা করল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী তাবৎ মানুষকে। লাঠির আঘাত থেকে নিস্তার পেলেন না হক সাহেবও। পায়ে আঘাত লাগল–সেই আঘাতজনিত বেদনার নিরাময়ের জন্যে ১৯৫৪ সালে ছুটে এসেছিলেন কলকাতায়, বন্ধু বিধানচন্দ্র রায়কে দেখাতে।

ভাষা আন্দোলনের বিক্ষোভ যখন ধূমায়িত হয়ে উঠেছে তখনই জনাব জিন্না এলেন ঢাকায়। ঢাকার ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করলেনঃ “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” সেই দিন রাত্রেই সভা বসল ছাত্র নেতাদের। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব- পাকিস্তান ছাত্রলীগ, শামসুল হক ও আতাউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত গণতান্ত্রিক যুব লীগ। সকলের এক কথাঃ উর্দুকে কখনোই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মানা হবে না।’ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘না, কখনই নয়, বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।” এই সভাতেই ঠিক হল ২০ শে মার্চ কার্জন হলে যে সভা হবে সেখানে প্রতিবাদ করা হবে। কার্জন হলের সভাতে জিন্না যখন আবার বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, তখন হলের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তের ‘না-না’ ধ্বনিতে জিন্নার কণ্ঠস্বর ডুবে গেল। পাকিস্তানের স্রষ্টা, পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল, যাঁর ব্যক্তিত্ত্ব অতীতে বহুবার গান্ধী, নেহরু, প্যাটেলকে পর্যন্ত মূক করে দিয়েছে, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে এই ‘না’ ধ্বনি তোলবার স্পর্ধা প্রকাশ করেছিল যে সে হল আজকের মুজিবুর রহমান। ক্ষোভে, রাগে, অপমানে জিন্না সভাকক্ষ ত্যাগ করে গেলেন।

পাকিস্তান-স্রষ্টা জিন্নার জীবনে তাঁকে প্রথম অপমান ও বিক্ষোভের সন্মুখীন হতে হল পূর্ব পাকিস্তানে। জিন্নার ‘হ্যাঁ’ কে ‘না’ করবার প্রথম আওয়াজ তুললেন মুজিবুর রহমান।

এই সময়ে একদিন জনাব লিয়াকত আলী খান আতাউর রহমানকে বলেছিলেনঃ “বাংলাভাষা হিন্দু সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, সেই ভাষার পক্ষে দাবী তুলে আপনারা পাকিস্তানের মূল আদর্শটাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছেন।” আতাউর রহমান খান জবাব দিয়েছিলেন, “আদর্শ? বাংলাদেশেকে লুঠ করাই আদর্শ নাকি? বাংলাকে কেবল হিন্দুর ভাষা একথা বলা শুধু অন্যায় নয়–অপরাধ।” জনাব লিয়াকত আলী খান বলেন, “বুঝেছি আপনাদের মতলব। আপনারা চান আলাদা হয়ে যেতে। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে।”

কথাটা চাপা থাকেনি। লিয়াকত আলী খাঁর সন্দেহের কথা ছড়িয়ে পড়ে পাঁচজনের মধ্যে। মুজিবুর বাংলাভাষা নিয়ে সংগঠিত করলেন ছাত্র সমাজকে। সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল নিপীড়ন। প্রথমে তাঁর নাম কেটে দেওয়া হল। কলেজ থেকে, তারপর গ্রেপ্তার। ১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মুজিবুরকে গ্রেপ্তার করা হল।

এল ১৯৪৮ সাল। মার্চ মাসে মুজিবুরকে আবার জেলে পোরা হল। লীগ সরকারের আশা মুজিবুরকে জেলে পুরে ভাষা-আন্দোলনের নামে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনকে বিনষ্ট করতে হবে। মুজিবুর সম্পর্কে অভিযোগঃ কমিউনিষ্টদের সঙ্গে মিশে বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। কিন্তু সম্ভব হল না বেশী দিন জেলে রাখা। জেল থেকে মুক্তি পেলেন মুজিবুর। তখন তিনি শুধু ছাত্র নেতা নন, মুজিবুর জননেতার আঙ্গিনায় পা দিলেন।

১৯৪৮ সালে গঠিত হল আওয়ামী লীগ। জেলে থেকেই নেতৃপদে নির্বাচিত হলেন মুজিবুর। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন মুজিবুরকে বের করে দেওয়া হয় তখন একটা শর্ত দেওয়া হয়েছিল যদি সে ভবিষ্যতে ভাল করে চলবার মুচলেকা লিখে দেয় তবেই সে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার পাবে। কিন্তু মুজিবুর সেই মুচলেকা লিখে দেননি। সেদিন তিনি বলেছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আবার ফিরে আসব, তবে ছাত্র হিসাবে নয়। মুজিবুর তাঁর কথা রেখেছিলেন। ১৯৪৯ সালে মার্চ মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার আড়াই বছর পরে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে, আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুর ক্যান্টিনে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু সেদিন মুজিবুর আর ছাত্রও নন, ছাত্র-নেতাও নন, তিনি তখন আওয়ামী লীগের নেতা।

মুসলিম লীগ যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন তখনই পূর্ববাংলার তরুণ ও প্রবীণ রাজনৈতিক নেতারা বুঝতে পারলেন মুসলিম লীগের দিন শেষ হয়ে গেছে, মুসলিম লীগ এখন শুধু কতিপয় নেতার ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার।

মৌলানা ভাসানী ঢাকা আসবার পর প্রথম এক বৈঠকে মিলিত হলেন মিঃ ম্মহম্মদ আলী, ডাঃ মালেক ও তোফাজ্জল আলী প্রমুখের সঙ্গে। এই বৈঠকে সকলে কোরান স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করলেন, তাঁরা নাজিমুদ্দিন আকরম খাঁর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। ঢাকায় আসার পর থেকেই মৌলানা ভাসানী তরুণদের নেতৃত্বে নিয়ে আসবার চেষ্টায় ব্রতী হন। “Maulana Bhasani embarked on the uphill task of building up popular leaders from among uncorrupted younger people. The Maulana pinned his hope on a student leader. Shaikh Mujibur Rahman While in London in 1954, Maulana Bhasani had told khondakar Mohammed Elias, a young leftist journalist, that Pakistan’s prosperity was assured if Mujibur could grow into a man.’

[ Eclipse of East Pakistan ]

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন নারায়ণগঞ্জে এক সম্মেলনে গঠিত হল আওয়ামী মুসলিম লীগ। মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খান, শামসু : হক, মুজিবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিরা এই দলের নেতৃত্ব নিলেন।

মৌলানা ভাসানী সভাপতি, আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আবুল মনসুর আহমদ সহ-সভাপতি, শামসুল হক নির্বাচিত হলেন সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমান, রফিকুল হোসেন ও খোন্দকার মুস্তাক আহমদ নির্বাচিত হলেন সহকারী সম্পাদক হিসাবে। মুজিবুর জেলে থেকেই সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। পাকিস্তানের রাজনীতি যখন মুসলিম লীগের উঁচু মহলের কোন্দলে দূষিত, সেই সন্ধিক্ষণে জন্মগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ প্রায় সমস্ত জনপ্ৰিয় কৃষক নেতা, শ্রমিক নেতা ও ছাত্র নেতাদের দলে টেনে নেয়।

এই নতুন দলে আরও যাঁরা এলেন প্রধানতঃ তাঁরা হলেন মুসলিম লীগ রাজনীতিতে বিক্ষুব্ধ আর যাঁরা পাকিস্তানে প্রকৃতই গণতন্ত্র চান। মুসলিম লীগের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর আপাত লক্ষ্য ছিল নতুন দলের মাধ্যমে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করা। অপর দলের লক্ষ্য শুধু ক্ষমতা দখল নয়, গণতান্ত্রিক শাসনই হবে প্রধান কথা। তাই দলের নামকরণ নিয়েই সম্মেলনে বেশ কিছুটা গণ্ডগোল হল। মহম্মদ তোয়াহা, মিঃ ওয়ালী আহাদ দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেবার দাবী জানালেন, এমনকি এক সময় তাঁরা বিষয় নির্বাচনী কমিটির সভা ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলেন। মৌলানা ভাসানী দেখলেন মুসলিম লীগের নেতাদের রাতারাতি প্ৰগতিশীল করবার চেষ্টা করা হলে সম্মেলনই ভেস্তে যাবে, তাই তাঁকে শেষ পর্যন্ত সভাপতির আসন থেকে রুলিং দিতে হলঃ প্রথম–জমিদারী প্রথা বিলোপ করতে হবে, দ্বিতীয়–গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পার্টির পোড় খাওয়া নেতারা তখনকার মানুষের মেজাজটা বুঝতে পারেন। তাই ভাষা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন দুটিকেই সবচেয়ে বেশী অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। মুখে কেউ না বললেও পূর্ব পাকিস্তান বাঙালীদের জন্য এই মনোভাব জনমনে বিদ্যুৎ সঞ্চার করে।

এসে গেল ১৯৫০ সাল। ‘৫০ সালে লীগ সরকারের দমন নীতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেব্রুয়ারী মাসে লীগ সরকারের কারসাজিতে দাঙ্গা শুরু হল সারা পূর্ববঙ্গে। লিয়াকত আলি খান পূর্ববঙ্গে এসে বললেন, ‘পূর্ববঙ্গের হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা পূর্ববাংলায় স্বাধীনতা ঘোষণার ষড়যন্ত্র করেছিল, তারই বিরুদ্ধে মুসলিম জনগণের এই অভ্যুত্থান। লিয়াকত ভাষ্য এই অভ্যুত্থানে শিকার হলেন শ্রীমতী ইলা মিত্র, শিকার হলেন রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলের খাপরা ওয়ার্ডের বন্দীরা।

১৯৫০ সাল। নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়েছেন, লিয়াকত আলী খান প্রধানমন্ত্রী। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে পূর্ববঙ্গ। প্রায় ২০ হাজার লোক অনাহারে মারা গেছে। লিয়াকত আলী খাঁ ঢাকায় এলেন। বর্ধমান হাউসে অবস্থান করছেন লিয়াকত আলী খান। বিরাট এক ভুখা মিছিল নিয়ে এগিয়ে চললেন মৌলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হক। রমনার কাছে পুলিশ প্রথমে গতিরোধ করল শোভাযাত্রার, তারপর নির্মম ভাবে লাঠি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দিল শোভাযাত্রাকে। গ্রেপ্তার করল, ভাসানী, মুজিবুর ও শামসুল হককে। জেলে বসেইে ভাসানী, মুজিবুর শামসুল হক দিনের পর দিন আলোচনা করলেন তাঁদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, কর্মসূচী। মুজিবুর জানালেন, মিঃ সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনা দরকার। এখানে উল্লেখযোগ্য মুজিবুর জেলে আসবার আগেই লাহোরে গিয়ে সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন।

এর পরেই সোহ্রাওয়ার্দী পূর্ব-পাকিস্তানে আসতে সুযোগ পেয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে পুনর্বাসন পেয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পাকিস্তান রাজনীতিতে সোহ্রাওয়াদীর পুনর্বাসন সম্ভব হয়েছির একমাত্র মৌলানা ভাসানী ও মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে। যদিও পরে ভাসানীর সঙ্গেও সোহ্রাওয়ার্দীর ঝগড়া বাঁধে এবং উভয়কে উভয়ের বিষ নজরে পড়তে হয়। কিন্তু সে কথা পরে। তার আগে ‘৫০ সালে পাকিস্তান জেলের অভ্যন্তরের কিছু কাহিনী বলে নিই। সে কাহিনী হল খাপরা ওয়ার্ডের কাহিনী।

এই বর্ণনা তুলে ধরছি সেদিন খাপরা ওয়ার্ডের বন্দীদের জবানবন্দী থেকেঃ

খাপরা ওয়ার্ডেঃ ২৪শে এপ্রিল-১৯৫০

১৯৫০ সালে এই অগ্নিঝরা দিনে রাজশাহী জেলের খাপরা ওয়ার্ডে রাজবন্দীদের উপর গুলি চলে। ফলে সাতটি প্রাণ ঢলে পড়ে মৃত্যুর মুখে, প্রায় ২০/২৫ জন হয় মারাত্মক ভাবে আহত, এবং সঙ্গে সঙ্গে নির্মম লাঠিচার্জের ফলে ৩/৪ জন আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব প্রাপ্ত হয়।

একটু পটভূমিকা দিয়ে ওইদিনকার ঘটনাটি সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরতে চাই।

জেলে তখন চলছিল রাজবন্দীদের মর্যাদা আদায়ের লড়াই। ঢাকা জেলের বন্ধুরা প্রায় দেড়শ দিন অনশন ধর্মঘট শুরু করে যে সামান্য সুবিধাটুকু আদায় করেছিল, যে সংগ্রামে কুষ্টিয়ার শিবেন রায় জেলখানাতেই আত্মাহুতি দিল, নানাভাবে সরকার সেটুকুও কার্যকরী করতে গাফিলতি দেখাতে লাগল।

স্বভাবতই প্রায়ই এটা ওটা নিয়ে জেলের সুপারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হতো। কথা কাটাকাটি অনেক সময় চরম তিক্ততা সৃষ্টি করত।

এসময় আমরা বাধ্য হলাম জেলখানায় কয়েদীদের দুর্দশার দিকে নজর দিতে। আমাদের সবচেয়ে যেটা পীড়া দিত সেটা হলো বৃটিশ আমল থেকে কয়েদীদের শাস্তিস্বরূপ ঘানির লোহার রড কাঁধে করে গরুর মত ঘুরে তেল ভাঙ্গা। আমরা এই অমানুষিক ব্যবহারের অবসান দাবী করলাম। এছাড়া কয়েদীদের আরও কিছু দাবী উত্থাপন করায় তারাও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চাঙ্গা হয়ে উঠল। এমন কি একবার কয়েক শত কয়েদী কোন একটা দাবী আদায়ের ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে অনশন ধর্মঘটেও যোগ দিল। সাধারণ কয়েদীদের এরূপ অবাধ্যতা সরকার ও জেল কর্তৃপক্ষকে উৎক্ষিপ্ত করে তুলল।

এই সময় আই জি পি জেল পরিদর্শন করতে চাইলে আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। তিনি শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে দেখা করলেন কিন্তু যাবার সময় সুপারকে ডেকে আমাদের খাপরা ওয়ার্ডে একত্রে থাকার উপর আক্রমণ চালালেন এবং ওখান থেকে ১৫/১৬ জনকে বিচ্ছিন্ন করে অন্যত্র ১৪ নং কনডেমড বা খারাপ সেলে নেবার আদেশ দিয়ে গেলেন।

এ থেকেই ঘটনা চরমে উঠে এবং শেষ পর্যন্ত তা রক্তাক্ত সংঘর্ষে পরিণত হয়।

আমরা জেলখানার খাপরা ওয়ার্ডে একত্র থাকা আমাদের একটি মৌলিক অধিকার বলে মনে করি এবং কোন মতেই আমরা সে অধিকারকে খর্ব করতে পারি না। তাছাড়া ১৪ নং হলো শাস্তি প্রাপ্তদের সেল বা কনডেমন্ড সেল। সেখানে আমরা যাব কেন? তাই আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই–আমরা অন্য সেলে যাব না।

মাত্র একজন খোলাখুলি এই সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে পুনর্বিবেচনা করার কথা বলেছিলেন। তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় ডাঃ গুণেন সরকার, বাড়ী খুব সম্ভব দিনাজপুরে। যশোরের ফরওয়ার্ড ব্লক মার্ক্সিস্ট পার্টির সদস্য কমরেড হীরেন সেন বলেছিলেন, দেখ এ সিদ্ধান্তের পরিণতি অতি মারাত্মক হতে পারে–কিন্তু তখন কে শোনে কার কথা। পরবর্তী সময় নেতৃবৃন্দের মুখে শুনেছিলাম যে তাঁরা বড় জোর এর পরিণতিতে লাঠি চার্জ পর্যন্ত ভেবেছিলেন–এবং তাঁরা তার মোকাবেলা করতে প্রস্তুত ছিলেন।

যাই হোক, যেদিন আমাদের জেলে যাবার কথা সেদিন সকাল থেকে আমরা নিজেদের মধ্যে কোন এক বিষয়ে আলোচনা বৈঠক করছি। কমরেড হানিফ আলোচনা পরিচালনা করছেন, বক্তৃতা করেছেন কমরেড মনসুর হাবীব। বেলা তখন নটার কাছাকাছি হবে–সভাপতি হানিফ ভাই মনসুর হাবীবের বক্তৃতা সংক্ষেপ করতে বলছেন–কারণ তার কয়েক মিনিটের মধ্যে সুপার তার সাপ্তাহিক জেল পরিদর্শনে আসবেন। দেখতে দেখতে তিনি এসেও গেলেন। সঙ্গে বেশ কয়েক জন সিপাহী, দু’জন ডেপুটি জেলার প্রায় ৬০/৬৫ জন মেট কয়েদী নিয়ে খাপরার ঢুকে পড়লেন। আমরা আমাদের মুখপাত্র জনাব আবদুল হককে সামনে ঠেলে দিলাম কথা বলতে। সুপার বিল এগিয়ে এসে আমাদের তখনই ১৪ নং সেলে যেতে বলায় হক সাহেব আপত্তি জানাতেই সে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করতে আদেশ দেয় এবং নিজে বিদ্যুৎবেগে ওয়ার্ডের বাইরে চলে আসে এবং সঙ্গে সঙ্গে হুইসেল দেয়। আমাদের কমরেডরা ইতিমধ্যেই গেটটি বন্ধ করে দেয়।

তারপর ১৫ মিনিট পর্যন্ত বাইরে সিপাহী আর আমাদের সঙ্গে সংষর্ঘ চলে। এ সময় সুপার ফায়ার বলে চিৎকার করে উঠতেই চকিতে চেয়ে দেখি প্রায় ৩০/৩০ টি বন্দুকের নল খাপরার জানলার ফাঁকে তাক করা রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি শুয়ে পড়ি, বালিশের তলায় মাথা গুঁজেদি। বন্দুকের শব্দে আমার কানের পর্দাই ছিঁড়ে যেতে চাইল। বালিশের বাইরের অংশ আমার কনুইতে এবং হাঁটুতে গুলী লাগল–মাথায় একটা স্পিল্‌টার লাগল। ওই সময় এক মুহূর্তের মধ্যে চোখে পড়ল মেঝের দিকে রক্তের ঢেউ খেলছে। যেন মনে হ’ল আমার পাশেই কমরেড হানিফের বাহুর মাংসটা ছিঁড়ে কোথায় ছুটে গেছে। যতদূর মনে পড়ে কমরেড আনোয়ারের মুখের একটা অংশ বুলেট লেগে চূর্ণ বিচূর্ণ হতে দেখেছি। ততক্ষণে আমি চৈতন্য হারিয়েছি।

ঘটনার বিবরণ বাড়াবনা, যখন হুঁশ হলো দেখলাম রক্তের মধ্যে ডুবে আমি। পরে আমাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওখানে প্রায় এক মাস চিকিৎসা চলে। পরে আবার আমাদের পূর্বকথিত ১৪ নং সেলেই নিয়ে যায়। সরকার তার জেদ পুরো করে। আমাদের সাত-সাতটি প্রাণ নিয়েও তাঁর আদেশ রক্ষা করতেই হবে।

যাই হোক, যারা মারা যায় সেই সাতটি রক্ত-তারকা হলো-কমরেড বিজন সেন, ইনি আন্দোলন থেকে ফিরে এখানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কমরেড হানিফ শেখ, ইনি দীর্ঘদিন কৃষক শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। কমরেড সুধীন ধর, ইনিও দীর্ঘদিন সৈয়দপুর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। কমরেড সুখেন ভট্টাচার্য ময়মনসিংহ জেলার কোন এক কলেজের সুযোগ্য ছাত্র নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এরপরে কমরেড আনোয়ার, তিনি ছিলেন খুলনা জেলা স্কুলের ছাত্র, ম্যাট্রিক পাস করে রাজনীতিতে ঢুকেছিলেন। এছাড়া কমরেড দেলওয়ার, ইনি করতেন কুষ্টিয়ায় শ্ৰমিক আন্দোলন। এছাড়া মরেছেন কমরেড কম্পরাম সিং, দিনাজপুরে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম বীর সৈনিক।

যা হোক আজ এদেশে বিপ্লবী আন্দোলনে যে প্রাণ দেওয়া নেওয়ার খেলা চলেছে, দেশকে মুক্ত করার জন্য জীবন উৎসর্গ করা, অকাতরে রক্ত ঢেলে দেওয়ার যে প্রতেযোগিতা চলেছে, এই সাত সাতটি বীরই তার পথ-প্রদর্শক। এখানেই তাদের আত্মাহুতির বৈশিষ্ট্য।

২৪ শে এপ্রিলের ঘটনা আমাদের কাছে দুটো দিক তুলে ধরে। একটা হলো চরম আত্মত্যাগে বিপ্লবীরা কোনদিনই ভয় পায় না। দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য অকুতোভয়ে এগিয়ে যায় বন্দুক বেয়নেটের সামনে। আর একটি হলো ফ্যাসিস্ত সরকার বেশীদিন তার গণতান্ত্রিক মুখোশ পরে থাকতে পারে না। গণশক্তিকে রোধ করার জন্য তাকে সশস্ত্র হামলা চালাতে হয় জনতার উপর, জনতার অগ্রবাহিনীর উপর। ২৪শে এপ্রিল ঘটেছিলও তাই।

দেশ ভাগের পর বাইরে যেমন তাকে রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে উলঙ্গভাবে উর্দুকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলতে হয়েছিল ঠিক ভিতরেও তেমনি গণআন্দোলনের অগ্রবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য চালাতে হয়েছিল সশস্ত্র আক্রমণ।

২৪শে এপ্রিলের বীর শহীদদের প্রতি এবং ঐ সময়কার নেতৃবৃন্দের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করেও আমার জিজ্ঞাসা থেকে যায় যে ২০ শে এপ্রিলের ঐ দুঃখজনক ঘটনা কি আমরা এড়াতে পারতাম না।

আমরা কি তখন বাইরের পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ করতে পেরেছিলাম? তখন ১৯৫০ সাল। কায়েদে আজমের সর্বপ্রধান উত্তরাধিকারী লিয়াকত আলীর তখন দেশবাসীর উপর অপ্রতিহত প্রভাব। ‘৪৮ সনে কাশ্মীর সমস্যার কথা লোক তখনও ভোলেনি। মোহাজের সমস্যা মূলতঃ ভারতীয়দের সৃষ্টি বলে মনে ক’রে তখন দেশবাসী চরমভাবে ভারত-বিদ্বেষী, দেশের প্রকৃত মুক্তিকামী বিপ্লবীদের সম্পর্কে দেশবাসীর ধারণা তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা তাদের পঞ্চম বাহিনী বলে মনে করত।

হায়দ্রাবাদ, জুনাগড়, কাশ্মীর প্রশ্নে সমগ্র দেশ তৎকালীন শাসক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা ছিল সম্পূর্ণ প্রভাবান্বিত। তখন সমস্ত দেশে সাম্প্রদায়িকতা উগ্ররূপে বিরাজমান।

বাইরের এরূপ পরিস্থিতি থাকাকালীন ভিতরে আমাদের দাবী-দাওয়া আদায় সম্বন্ধে কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল তা আজ ভেবে দেখার প্রয়োজনীয়তা আছে।

তা ছাড়া জেলখানা একটা বিশেষ এলাকা। সেখানের প্রতিটি পদক্ষেপ সেখানের বাস্তব অবস্থা বিচার করেই নিতে হবে। মাও সে তুঙ-এর কথা উল্লেখ করে বলতে হয়, আমাদের জীবন দিতে হবে, সেজন্য আমরা যতটা পারি যেন অনাবশ্যক জীবন ক্ষয় এড়িয়ে চলি।

এ কথা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই যে জেলখানায় রাজবন্দীদের মর্যাদা আদায়ের সংগ্রামের একটা বৃহত্তম সময় আমরা সম্পূর্ণ সঠিক ছিলম। অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ সঠিকই ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কয়েদীদের দাবী আদায় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রস্তুতি ছিল মূলত ভুল।

আমার মনে হয় ২৪ শে এপ্রিলের জন্য শোক না করে বা সেই দিন শুধু সূর্য-শপথের তীব্রতা প্রকাশ না করে ঐ দিনটিকে বিরাট জিজ্ঞাসার দিনে পরিণত করা দরকার।

২৪শে এপ্রিলকে যেমন আমরা একটা মহৎ আত্মত্যাগের গৌরবোজ্জ্বল দিন বলে স্মরণ করব, তেমনি তাকে একটি বিরাট জিজ্ঞাসার দিনে পরিণত করব। মনে রাখতে হবে ২৪শে এপ্রিলকে আমাদের কঠোর সমালোচনা, আত্মসমালোচনার দিনে পরিণত করতে হবে।

ফ্যাস্টিদের তীক্ষ্ণ বেয়নেটের, সঙ্গীনের সামনে আমাদের বীর সন্তানগণ যে ভাবে লড়াই করে চরম বিপ্লবী নিষ্ঠা এবং অকল্পনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করে গেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে চিরদিনই অম্লান থেকে বিপ্লবীদের প্রাণে অপূর্ব উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে। আবার অন্যদিকে পুঁজিবাদী সমাজের ক্ষয়িষ্ণু যুগে সর্বোচ্চ মুনাফাখোররা কী বীভৎস উন্মত্ততায় দেশবাসীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তারও নজির এখানে রয়েছে।

২০ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২।

“অস্থিরভাবে নিজের ঘরে কার্পেটের উপর উদ্বিগ্নভাবে পায়চারী করছেন লিয়াকত আলী। একটু আগে নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে কথা হয়েছে টেলিফোনে। যে করেই হোক কালকের হরতালকে পণ্ড করতে হবে। কিছুতেই আন্দোলন করতে দেওয়া হবে না। ফোন তুলে ইংরাজীতে চীফ সেক্রেটারীকে বললেন ১৪৪ ধারা জারী করুন। আর্মি তৈরী থাকতে বলুন। পুলিশী শক্তি জোরদার করুন।

চীফ সেক্রেটারী দু’মুহূর্ত কি ভাবলেন। তারপর ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ১৪৪ ধারা জারীর আদেশ দিলেন। দ্রুত একটার পর একটা ফোন করে চললেন তিনি। ডাকলেন পুলিশ কমিশনারকে। ক্যামেরা মিটিং-এ বসলেন সরকারী প্রশাসন বিভাগের চাঁইরা।

সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় ঢাকা বেতার থেকে ঘোষিত হল ১৪৪ ধারা।

দোকান পাট বন্ধ হয়ে গেল। আটটার মধ্যে ঢাকা শহরে গভীর নীরবতা নেমে এল।

এদিকে ফোনে যোগাযোগ করে ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সভা বসল। এ অবস্থায় কি করা উচিত? কর্তব্য নির্ধারণ নিয়ে সদস্যদের মধ্যে তীব্র মত-পার্থক্য দেখা দিল। রাজনৈতিক দলের নেতারা জানালেন, এ অবস্থায় আমাদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা উচিত নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে গেলে ব্যাপক গোলযোগ দেখা দিতে পারে। লীগ সরকার সেই অজুহাতে আগামী সাধারণ নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারেন।

নির্বাচন বন্ধ হবার ভয়ে ভাষা আন্দোলন স্থগিত থাকবে? সাড়ে ৪ কোটি মানুষের প্রাণের দাবী থেকে গদীর মোহ বড় হলো? অবাক হলেন অলি আহাদ! অলি আহাদ মানলেন না ১৪৪ ধারা। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন নির্বাচন পণ্ড এবং মামুলি ১৪৪ ধারার ভয়েই যদি পিছিয়ে পড়ি আমাদের আন্দোলন থেকে তাহলে কোনদিনই আমাদের দাবী আদায় হবে না। লীগ সরকারের বেয়নেট আর টিয়ার গ্যাসকে ভয় করলে আন্দোলনে নামা বৃথা। আমরা তো জানি লীগ সরকার আমাদের ওপর সব রকম দমন নীতিই চালাবে। বিনা সংঘর্ষে আমাদের দাবী তারা মেনে নেবে যদি কেউ মনে করে থাকি তাহলে মূর্খের স্বর্গে বাস করছি।

১৪৪ ধারা অমান্য করতেই হবে। তা অমান্য না করার অর্থ হবে, সরকারী দমন-নীতির কাছে বশ্যতা স্বীকার করা এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা।

এমন সময় সলিমুল্লাহ হলে মিটিং শেষ করে এসে দুইজন ছাত্র প্রতিনিধি জানাল, কাল তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারী দমন নীতির কাছে কিছুতেই তারা মাথা নোয়াবে না।

কিন্তু সর্বদলীয় কর্মপরিষদের বৈঠকে ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল এবং আরও বলা হলো এই সিদ্ধান্ত অমান্য করে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে এই কর্মপরিষদ সঙ্গে সঙ্গে বাতিল বলে ধরে নেওয়া হবে।

ওদিকে ছাত্ররা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। গভীর রাত পর্যন্ত হলগুলিতে আলোচনা চলল। ছাত্ররা রক্ত দিতেও প্রস্তুত। কখন ভোর হয় এরই প্রতীক্ষা তারা করছে।

বেশীর ভাগ দোকানপাট বন্ধ। রাস্তায় যানবাহন কম। যে সব দোকান খুলেছে ছাত্র স্বেচ্ছাসেবকদের অনুরোধে তা বন্ধ করে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ভ্যানের পর ভ্যান পুলিশ জমায়েত হতে লাগল। কোমরে টিয়ার গ্যাসের বাক্স। কারো হাতে লাঠি, কারো বা বেয়নেট লাগানো রাইফেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ব্যারিকেড করে দাঁড়িয়েছে তারা। বেলা দশটা থেকে জমায়েত হতে লাগল ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে।

বারোটায় সভা শুরু হলো গাজীউল হকের সভাপতিত্বে। বটতলায় দাঁড়িয়ে ছাত্রনেতারা বক্তৃতা দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন গিসগিস করছে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীতে। মহাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্‌গ্রীব সবাই।

বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক আব্দুল মতিন দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ভাইসব, ফ্যাসিস্ট লীগ সরকার আমাদের দাবী বানচাল করবার জন্য ১৪৪ ধারা জারী করেছে। কিন্তু কাপুরুষের মতো আমরা পিছিয়ে যেতে পারি না। মায়ের অপমান মুখ বুজে সহ্য করার চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়। মরণে আমাদের ভয় কী? রক্ত ছাড়া কবে কোন্ আন্দোলন হয়েছে। বাংলার সাড়ে চার কোটি লোক আমাদের দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে। আম্মা সজল চোখে তার অপমানের প্রতিকার করতে ডাক দিয়েছে। বলুন, আপনারা সে ডাকে সাড়া দিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবেন, না ঘরে ফিরে যাবেন?

সহস্র কণ্ঠে চীৎকার উঠেঃ আমরা ১৪৪ ধারা মানব না, মানব না।

এমন সময় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ থেকে শামসুল হক এলেন। ছাত্রদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন কেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা উচিত নয়।

কাপুরুষের কথা শুনতে চাই না। বসে পড়ুন। হাজার কণ্ঠের চীৎকার ওঠে। কেউ কেউ টিপ্পনী কাটেঃ ঘরে গিয়ে চুড়ি পড়ে বসে থাকুন। শামসুল হক অগত্যা বসে পড়লেন।

এই সময় ছাত্র নেতা আবদুস সাত্তার একটা প্রস্তাব দিল। বলল, দশজন দশজন করে বেরুলে একদিকে আইনও অমান্য করা হবে, অন্যদিকে ব্যাপক গোলযোগ এড়ানো যাবে।

এ প্রস্তাব মেনে নিতে আপত্তি নেই। সকলেই এতে সায় দিল।

দশজন দশজন করে একটা দল তৈরী হলো। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। নাজিম-নুরুল নিপাত যাক। ১৪৪ ধারা মানি না-মানব না। চলো চলো অ্যাসেম্বলি চলো। ধ্বনি দিতে দিতে প্রথম দলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

পুলিশ বাহিনী সচকিত হয়ে উঠল। হুইসল বাজে। মাইকে জনৈক পুলিশ অফিসারের কণ্ঠ ভেসে এলো। আপনারা বেরুবেন না। বেরুলেই গ্রেপ্তার করব।

“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে গেল প্রথম দশজনী মিছিলটি। গেটের বাইরে আসতেই এক ঝাঁক পুলিশ হুমড়ি খেয়ে পড়ল তাদের উপর। টেনে হিঁচড়ে তুলল ট্রাকে। ট্রাকের উপর থেকে ওরা আওয়াজ দিতে লাগলঃ “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

এবার দ্বিতীয় দশজনী দলটি বেরুলো। তারাও গ্রেপ্তার হল। আবার দশজন বেরুলো। তারাও গ্রেপ্তার হল। এর কিছুবাদে মেয়েদের একটা দশজনী দল বেরুল। মুখে তাদের স্লোগান “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।”

এবারে শাহাবউদ্দিনের নেতৃত্বে আরেকটা দশজনী মিছিল এগিয়ে গেল। বিনা প্ররোচনায় একজন পুলিশ অফিসার একটা ছেলেকে এক লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। ছেলেটা তাড়াতাড়ি মাটি ছেড়ে উঠে পুলিশ অফিসারের মুখে থুথু দিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক পুলিশ ছেলেটির উপর নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাঠি পড়তে লাগল এলোপাথাড়ি। ছাত্ররা ক্রোধে ফেটে পড়ল। ঝাঁকে ঝাঁকে ঢিল ছুটে যায় ওদের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে টিয়ারগ্যাসের একটা শেল এসে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরেও পুলিশ আক্রমণ চালালো। ছাত্রদের উপর পুলিশের আক্রমণ দেখে জনতাও ক্ষেপে গেল। তারাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়তে লাগল। পুলিশ তাড়া করল। অবশেষে পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ চলল।

পুলিশ মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসেও টিয়ারগ্যাস ছুঁড়েছে। রোগীদের কথাও ওরা একবার ভাবেনি।

পুলিশ মেডিকেল কলেজে ঢুকতে চেষ্টা করছে। মরিয়া হয়ে সকল ছাত্র বাধা দিচ্ছে। পুলিশ সমানে টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে চলেছে।

মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের নীচে আবার ছাত্ররা জমায়েত হতে শুরু করেছে। তিনটে বাজে প্রায়। অধিবেশন বসার সময় এসে গেল। কয়েকজন সরকারী দলের এম এন এ-কে নিয়ে একটা জীপ ছুটে গেল। ছাত্ররা ধ্বনি দিতে লাগলঃ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

ছাত্ররা এবার মেডিকেল কলেজের দিকে এগিয়ে গেল। মুখে তাদের স্লোগানঃ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই–চলো চলো অ্যাসেম্বলি চলো।

একজন পুলিশ অফিসার চীৎকার করে বলে উঠল, দু’জন প্রতিনিধি গিয়ে আপনাদের বক্তব্য অ্যাসেম্বলিতে বলে আসুন।

পুলিশ অফিসারের কথায় ছাত্ররা থমকে দাঁড়াল। এই সময় আতোয়ার চীৎকার করে বলে উঠলঃ ভাইসব, আন্দোলন বানচাল করার এটা একটা চাল। ওরা আমাদের নিষ্ক্রিয় করে রেখে নিজেরা তৈরী হয়ে নিতে চায়। প্রতারকদের কথায় ভুলবেন না। আওয়াজ তুলুন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

অদূরে সঙ্গে সঙ্গে টিয়ারগ্যাসের শেল ফাটল। কিন্তু তবুও তারা নির্ভীক। তাদের কণ্ঠে সেই স্লোগান, “পুলিশী জুলুম চলবে না। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।”

সঙ্গে সঙ্গে আবার টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটল এবং তার সঙ্গে চলল গুলী। এমন সময় ছাত্রদের কে যেন বলল, বেঈমানরা গুলী চালাচ্ছে, সাবধান, সাবধান। এদিকে সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররাও পাল্টা পুলিশকে আক্রমণ করল। ছাত্রদের একমাত্র অস্ত্র ইঁটের খোয়া।

গুলী চালাবার আগে ‘লাল ফ্ল্যাগ’ দেখানোর কথা। কিন্তু পুলিশ তা দেখালো না। তারা ছাত্রদের মারতে চায়।

পুলিশের গুলীতে শহীদ হল জব্বার, রফিক ও আরো অনেকে। ‘পুলিশ ক্রমাগত টিয়ারগ্যাসের শেল ফাটানোর জন্য আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। এর কিছু বাদে আবার গুলী চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর এল আনোয়ারের পায়ে গুলী লেগেছে এবং বহু ছাত্র আহত হয়েছে।

কিন্তু তবুও তারা ভীত নয়। তাদের সকলের কণ্ঠে ঐ একই আওয়াজঃ “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। জালিম মুসলিম লীগ সরকার নিপাত যাক।

পরিষদ কক্ষেও পৌঁছায় সে খবর। মনোরঞ্জন ধর এবং গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম পরিষদ কক্ষে ঝড়ের বেগে ঢুকে খবর দিলেন, পুলিশের গুলীতে ছাত্র মারা গেছে। বিরোধী দলের সদস্যারা ফেটে পড়ে উত্তেজনা আর ক্রোধে। এই হত্যাকাণ্ডের জবাব চান নুরুল আমীনের কাছে। মুলতুবি প্রস্তাবের দাবী ওঠে।

নুরুল আমীন তো প্রথমে স্বীকার করতে চাইলেন না যে পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলী চালিয়েছে। তিনি বললেন, ‘ইটস এ ফ্যানটাসটিক স্টোরি।’ বিরোধীদলের চাপে কথাটা স্বীকার করে নিলেন নির্লজ্জের মত আত্মপক্ষ সমর্থন করে। তিনি বললেন, “উচ্ছৃঙ্খলতা দমানোর জন্য পুলিশ গুলী চালিয়েছে। এর পিছনে কম্যুনিষ্টদের উসকানি আছে। আমরা তাদের নির্মূল করব।’

টেবিল চাপড়ে হৈ-হৈ করে উঠল বিরোধীদলের সদস্যরা। সরকার পক্ষের অনেক সদস্যও নুরুল আমীনের এই নির্লজ্জ উক্তির নিন্দা করলেন। নিন্দা করলেন পুলিশের গুলী চালনার। ছাত্রদের ওপর পুলিশী নির্যাতনের এবং মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের নির্লজ্জ উক্তির প্রতিবাদে মুসলিম লীগ পার্টি থেকে সেই মুহূর্তে পদত্যাগ করলেন তাঁরা। পরিষদ কক্ষে দাঁড়িয়ে মৌলানা তর্কবাগীশ বললেন, আমাদের ছাত্ররা যখন শহীদত্ব বরণ করছেন, আমরা তখন আরামে পাখার হাওয়া খেতে থাকব–এ বরদাস্ত করা যায় না। চলুন, মেডিকেল চলুন। এরপর তর্কবাগীশ এবং খয়রাত হোসেন সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেব পরিষদ কক্ষের সদস্যপদে ইস্তফা দেন।

শহীদদের শেষ দেখা দেখবার জন্য হাজার হাজার মানুষ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভিতরে, বারান্দায়, বাইরে, রয়েছে। কয়েকজন রক্তমাখা ধুলি তুলে কপালে ছোঁয়াচ্ছে।

কাতারে কাতারে লোক আসছে বরকত, শফিক আর জব্বারকে দেখবার জন্য। মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ভবনে তোলা হয়েছে শহীদদের রক্তে ছোপানো পতাকা। মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে শহীদের নাম, ঠিকানা। মাইকে ঘোষনা করা হল, “পুলিশ আমাদের উপর গুলী চালিয়েছে। নৃশংসভাবে হত্যা করেছে রফিক, জব্বার, আর বরকতকে। লাঠি আর বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেছে শত শত ছাত্রছাত্রীকে। আমাদের অপরাধ আমরা বলতে গিয়েছিলাম আমাদে মুখের ভাষা, আমাদের হৃদয়ের ভাষা কেড়ে নিতে দেব না। কতো রক্ত ওরা নেবে? বাংলাদেশের ছেলেমেয়ে রক্ত দিতে ভয় পায় না। আমাদের আন্দোলন চলবে। লিয়াকত-নাজিমকে আমরা বাংলা ছাড়া করবই।”

.

২১শের রক্তে স্নান করে ২২শে সূর্য উঠল। ভোরের নীরবতা ভঙ্গ করে মাইকে ছড়িয়ে পড়ল রবীন্দ্রনাথের গানঃ

“চলো যাই চলো যাই চলো যাই
চলো পদে পদে সত্যের ছন্দে
চলো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে।।”

মেডিকেল কলেজ ছাত্রবাসের মাইকে একজন ছাত্র বলে চলেছেন,

“জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কারো শেখীরা
শিশুহত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা
দেশে সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন লগনের ক্রান্তি লগনে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, খুন-রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারী, একুশে ফেব্রুয়ারী।

…. …. ….

ওরা গুলী ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণাপদাঘাত এই বাংলার বুকে।
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্নবস্ত্র শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারী, একুশে ফেব্রুয়ারী

… …. …. ….

তুমি আজ জাগো, তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারী
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী।
আমার শহীদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে।
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালাবে ফেব্রুয়ারী
একুশে ফেব্রুয়ারী, একুশে ফেব্রুয়ারী।”

গায়েবী জানাজার সময় হল, হঠাৎ শোনা গেল লীগ সরকার শহীদদের লাশ দেবে না। জনতা ক্ষুদ্ধ। ক্রুদ্ধ গর্জন উঠল জনসমুদ্রে। শহীদদের লাশ দাফনের সুযোগ পাবে না দেশবাসী এ হতেই পারে না। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও লাশ পাওয়া গেল না। তখন লাশ ছাড়াই গায়েবী জানাজা হবে। ইমাম সাহেব দু-হাত তুলে মোনাজাত করলেন, “আল্লাহ, জালিমের গুলীতে কচি ছেলেরা মারা গেছে, শিশুর খুনে রাঙা হয়েছে পথের ধূলো আর ঘাস। আল্লাহ, তুমি তো জানো ওরা নিরপরাধ। জালিমরা খালি করে দিল কতো মায়ের বুক, তোমার রোষের আগুনে নিশ্চিহ্ন কর জালিমদের দুনিয়ার বুক থেকে।” তারপর উপস্থিত জনতার কাছে ভাষণ দেবার জন্য উঠলেন অলি আহাদ। তিনি বললেন, “বাংলা ভাষার কণ্ঠরোধ করে, বাংলার সাড়ে চার কোটি মানুষকে পঙ্গু করে রাখার ষড়যন্ত্র চলছে অনেক দিন ধরে। সে চক্রান্ত ব্যর্থ করবই। রফিক, জব্বার, বরকতের রক্ত তুলে নিয়ে আপনারা শপথ নিন, আমরা সরকারের চক্রান্ত ব্যর্থ করবই।”

তারপর মিছিল বেরুল পথে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে লাখো জনতার মিছিল। বেরুল মৌন মিছিল। নবাবপুর রোডে গিয়ে পড়েছে মিছিলের প্রথম অংশ আর শেষ অংশ তখনও হাইকোর্টের কাছে। পুলিশ হাতে বন্দুক, লাঠি, বেয়নেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর একজন পুলিশ অফিসার বলে উঠলেন–চার্জ। পরমুহূর্তে মিছিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশ বাহিনী। চলল লাঠি, গুলী। পুলিশের লাঠিতে আহত হলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। নিহত হলেন ল- ক্লাশের ছাত্র। আরো কতো জন নিহত হল সে কথা জানা যায় না, কারণ পুলিশ লাশগুলি সরিয়ে ফেলেছিল। মিছিলের জনতা আছড়ে পড়ল অ্যাসেম্বলির সামনে। পরিষদের তখন অধিবেশন চলছে। বিরোধী দল থেকে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কোণঠাসা নুরুল আমীন সেই প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হলেন। মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের সামনে ছাত্ররা নিজ হাতে গড়ে তুলল শহীদ বেদী। শহীদ বেদীর আবরণ উন্মোচন করতে এলেন শফিকুরের পিতা। শহীদ পুত্রের ও তাঁর সতীর্থদের শহীদ বেদীর আবরণ উন্মোচন করে শফিকুরের পিতা বললেন, “আজ আমার শফিক নেই। শফিক, বরকত, রফিক, জব্বার, সকলের আত্মা সেইদন তৃপ্ত হবে যেদিন বাংলাভাষা পাবে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। ঐ দেখ শহীদদের চোখ আকুল প্রতীক্ষায় তাকিয়ে আছে তোমাদের দিকে। বাংলার চার কোটি মানুষের দিকে। হে খোদা, এই সব বুকের রক্ত যারা ঝরিয়েছে তাদের তুমি রক্ষা করো না।’

শহীদ স্মৃতি তৰ্পণ চলছে। এই সময় পুলিশ ঢুকে পড়ল মেডিকেল কলেজে। ছাত্রাবাস ভেঙ্গে তছনছ করল।

আর একটা দিন কেটে গেল। হরতাল চলছে। রাত্রে পুলিশ গ্রেপ্তার করল আবুল হাশিম খয়রাত হোসেন, মৌলানা তর্কবাগীশ, অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক পুলিন দে, সতীন সেন প্রমুখকে। মৌলানা ভাসানীকে তাঁর গ্রামের বাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করে আনা হলো।

রাইফেলের কুঁদো আর পুলিশের বুটের আঘাতে ভেঙ্গে ফেলা হল শহীদ মিনার আলাউদ্দীন আল-আজাদ লিখলেন,

“ইঁটের মিনার ভেঙ্গেছে ভাঙ্গুক। একটি মিনার গড়েছি
আমরা চার কোটি কারিগর
বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়।
পলাশের আর
রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়
দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই
শহীদের নাম
এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নামে
তাই আমাদের
হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে
শুধু এক শপথের ভাস্কর।”

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন জনজীবনে যে তুফান তুলল সেই তুফান ধসিয়ে দিল মুসলিম লীগের স্বপ্নসৌধ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ৩০৯ টি আসনের মধ্যে তারা পেল মাত্র ৯ টি আসন। বাংলার প্রবল প্রতাপান্বিত নুরুল আমীন নিজের জেলায় নিজের এলাকায় একজন ছাত্র খালেক নওয়াজের কাছে পরাজিত হলেন। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে এমন নির্বাচনী প্রচারের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল যে শুধু ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত তথা সর্বশ্রেণীর জনতাই এই প্রচারে অংশ গ্রহণ করে নি, সরকারী কেরানী, পদস্থ বাঙালী কর্মচারী এবং চাপরাসীরা পর্যন্ত যুক্তফ্রন্টের প্রচারে পথে বেরিয়ে পড়েন। সে এক অসাধারণ জনজাগরণ, এক অভূতপূর্ব উদ্দীপনা। ঢাকার পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগ আয়োজিত এক জনসভায় পাক প্রধান মন্ত্রী মহম্মদ আলির পক্ষে ভাষণ দেওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে এবং সভা ভেঙ্গে যায়। নির্বিচারে পুলিশের লাঠি চলতে থাকে। নির্বাচনের আগে প্ৰায় ১৪০০০ যুক্তফ্রন্ট কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন সাহেব তাঁর নিজের কেন্দ্রে একটি পঁচিশ বছরের যুবকের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং বহু মুসলিম লীগ নেতার জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন পূর্ববঙ্গের জাতীয় জীবনে হয়ে উঠল এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা।

যুক্তফ্রন্টের এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পিছনে ছিল তাদের একুশ দফা প্রোগ্রাম যার মর্মকথা হোল বাংলাভাষার মর্যাদা ও অধিকার সহ পূর্ব বাংলার বাঙালীদের পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার। একুশ দফা দাবীর মধ্যে একটি ছিল শহীদ মিনার নির্মাণ করা এবং যে বর্ধমান হাউস থেকে বাংলাভাষা আন্দোলনকারীদের উপর নুরুল আমীন গুলী ছোঁড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই বাড়ীটিকে ‘বাংলা অ্যাকাডেমিতে’ পরিণত করা। একুশ দফাতে আরও দাবী জানান হয়েছিল যে সশস্ত্র বাহিনী, মুদ্রা ও পররাষ্ট্র ছাড়া আর সব বিষয় পূর্ব বাংলা সরকারের হাতে থাকবে। এছাড়া পাক গঠণতন্ত্র রচনার প্রশ্নে দাবী করা হয় যে পূর্ব বাংলাকে পূর্ণ ও অখণ্ড অটোনমি দিতে হবে। দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ছাড়া অন্যান্য সব বিষয়ে অধিকার থাকবে পূর্ব বঙ্গের। দেশরক্ষার বিষয়েও পূর্ব বঙ্গের আঞ্চলিক বাহিনী গঠন, এই প্রদেশে অর্ডিন্যান্স কারখানা প্রতিষ্ঠা ও পূর্ববঙ্গে নৌ বাহিনীর হেড কোয়ার্টার স্থাপনের দাবী জানান হয় নির্বাচনী ইস্তাহারে। যুক্তফ্রন্টের প্রচারের মুল ভিত্তি ছিলঃ “পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি কলোনীতে পরিণত করা চলবে না।”

‘৫৪ সালের নির্বাচনে জনসমর্থন লাভের মূলে ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষা ও পূর্ববঙ্গে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবী। পূর্ববঙ্গের উপরে জাতীয় ঐক্যের নামে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসান–এই ধ্বনি মূর্ত হয়েছিল নির্বাচনী রায়ের মাধ্যমে। পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে ১৯৫৫ সালে পূর্ববঙ্গে ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এই সময়ে কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বাংলাকে শোষণ করে তার বিবরণ দিয়ে ‘কেন অটোনমি চাই’ নামে একটি পুস্তিকা আওয়ামী লীগ থেকে প্রকাশিত হয়। এই পুস্তিকায় বলা হয়ঃ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংগঠনের মৌলিক প্যাটার্নের পটভূমিতে ভূগোলের দিক দিয়ে পূর্ববঙ্গের অটোনমির দাবীকে স্বীকার না করে উপায় নেই। পাকিস্তান একটি অখণ্ড ভৌগোলিক অঞ্চল নয়। এই রাষ্ট্রের দুটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল বিমান পথে ১,০০০ এবং জলপথে ৩,০০০ মাইল ব্যবধানে অবস্থিত। ক্যানাডা ও ব্রিটেনের মধ্যে যে ব্যবধান, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবধান তার চেয়েও বেশী।

বাস্তব ক্ষেত্রে করাচী সরকারের কাছে পূর্ববঙ্গের কণ্ঠস্বর পৌঁছায় না এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই অঞ্চলের বক্তব্যেরও কোন গুরুত্ব নেই। ১,০০০ মাইল দূরে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে তাই অবিচার হতে বাধ্য। পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং তার ফলে দুই ভুখণ্ডের জনসাধারণের পক্ষে পরস্পরকে জানা এবং পরস্পরের সমস্যা অনুধাবন করাও সম্ভব নয়।

অর্থনীতির দিক দিয়েও পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবী অতি যুক্তিসঙ্গত। কারণ, পরস্পরের মধ্যে পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের অর্থনীতির ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে পৃথক। যোগযোগের অভাব, উৎপাদন ব্যবহারে ভিন্ন প্রকৃতি এবং মূল্য মানের বিরাট পার্থক্যের ফলে এক অঞ্চলের পারস্পর্য রক্ষা করাও সম্ভব নয়।

পাকিস্তানের ফেডারেল রাজধানী ও পূর্ব বঙ্গের মধ্যে ১৪০০ মাইলের ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত স্থলপথে এই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে কোন সংযোগ নেই। বিমান বা স্থলপথে পরস্পরের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন এবং ব্যয়সাধ্য। খাদ্য, শস্য এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় ও নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ববঙ্গের তুলনায় অনেক কম। প্রায় সমস্ত জিনিসই প্রথমে করাচীতে আমদানী করা হয় এবং তার পরে রপ্তানী করা হয় পূর্ববঙ্গে। তার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের রপ্তানীকারীরা যে শুধু অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করে তাই নয়–পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাল রপ্তানী করার জন্যও অতিরিক্ত দাম ধার্য করে। সেজন্য বৈদেশিক জিনিসপত্রের দামই যে পূর্ববঙ্গের চাহিদার তুলনায় অনেক কম পাওয়া যায় বলে পূর্ববঙ্গের বাজারে অত্যন্ত চড়া দামেও বিক্রি হয়। রাজনীতির দিক দিয়েও পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবী অনস্বীকার্য। বর্তমান যুগে সব দেশেই সরকারী কাজকর্ম জনসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্বন্ধ রেখে পরিচালিত করা হয়।

৩০০০ মাইল দূর থেকে পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সামান্য যোগযোগ রাখাও সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের উপর অধিকতর দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পণ করে তাই রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরে এই রাষ্ট্রে সমস্ত কাজকর্ম ‘ইউনিটারী’ বা ঐকিক ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু তার ফলে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে কতখানি ঐক্যস্থাপন করা সম্ভব নয়।

পূর্ববঙ্গের ইতিহাস এক শোষণের ইতিহাস। এই অঞ্চলের জনসাধারণের আয় থেকে এবং বৈদেশিক সাহায্য থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নমূলক কাজে। এই অর্থ থেকে পূর্ববঙ্গের ভাগ্যে সামান্য অংশও জোটেনি। পাকিস্তান গঠনের পরে এই রাষ্ট্রের সমস্ত সামরিক সংগঠন স্থাপিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। মিলিটারী কলেজ, প্রি-ক্যাডেট স্কুল এবং অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীর সবই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে ও করাচীতে। এরূপ কাজে অথবা এরূপ সংগঠন তৈরীর ব্যাপারে পূর্ববঙ্গ কোন অংশই পায় নি। প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার ৬০-৭০ কোটি টাকা পূর্ববঙ্গ থেকে সংগ্রহ করে কিন্তু তার প্রায় সবই ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এরূপ এবং অন্যান্য শোষণের ফলে পূর্ববঙ্গের সর্বশ্রেণীর জনজীবন আজ এক শোচনীয় দারিদ্র্যের সম্মুখীন। পূর্ব ও পশ্চিম পাক ভূখণ্ড দুইটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভূখণ্ড হওয়ায় একটি অর্থনৈতিক সংগঠন বা অঞ্চল না হওয়ায় পূর্ববঙ্গের পুঁজি পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়ে এই পূর্ব ভূখণ্ডের অর্থনীতিকে আজ এক চরম দুর্বিপাকের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানী ক্ষেত্রে এমন পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে যে তার ফলে পূর্ববঙ্গের জনজীবন একেবারে বিপন্ন হচ্ছে। পূর্ব বাংলা বহুবার এই অভিযোগ করেছে যে ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইসেন্স এবং বৈদেশিক আমদানীর সুযোগ পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের এমন পক্ষপাতিত্বের সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে যে তার ফলে আমদানী প্রায় অধিকাংশই যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। এরূপ পক্ষপাতিত্বের জন্য পূর্ববঙ্গের বাজারে জিনিসপত্র শুধু দুষ্প্রাপ্য নয় অগ্নিমূল্যও বটে। বর্তমানে পূর্ববঙ্গকে সমস্ত বৈদেশিক জিনিসপত্র আমদানী করতে হয় করাচী থেকে এবং তার ফলে প্রত্যেক জিনিসের জন্য পূর্ববঙ্গকে ৫০ শতাংশ বেশী দাম দিতে হয়। এই ভাবেও পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ববঙ্গের পুঁজি নিয়মিত ভাবে শোষণ করে নিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্মে কি ভাবে পূর্ববঙ্গকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কি ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের কুক্ষিগত–কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত কর্মচারীদের আঞ্চলিক বন্টনের তথ্যে তা অতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কেন্দ্রীয় সরকারের সিনিয়র গেজেটেড পোস্ট

কেন্দ্রীয় সরকারের সিনিয়র গেজেটেড পোস্ট  ১
কেন্দ্রীয় সরকারের সিনিয়র গেজেটেড পোস্ট ২

“মুসলিম লীগ বহুদিন পর্যন্ত জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে থাকে। অবশেষে তার প্রতিফল এল হিন্দুদের কাছ থেকে নয়, মুসলমানদের কাছ থেকে–যারা ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের উপর চরম আঘাত হানল। মুসলমানরা পূর্ববঙ্গ থেকে মুসলিম লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিল বলা যায়–যেহেতু হিন্দুরা শুধু তাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের জন্যই ভোটদানের অধিকারী ছিল এবং মুসলমানরা মুসলমানদের জন্য। পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের এই ধ্বংস পশ্চিম পাকিস্তান এবং কেন্দ্রের মুসলিম লীগের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলল। এই প্রধান সাধারণ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় কর্তাদের সর্বপ্রকার হুমকি ও শাসানিই বাঙালী মুসলমানদের আত্মিক শক্তিকে বিনষ্ট করতে পারল না।

দেশবিভাগের পর পূর্ববঙ্গ আইনসভার আর নির্বাচন হয়নি। এই সময়ের আইনসভার সদস্যরা প্রকৃতপক্ষে দেশভাগের আগে নির্বাচিত। ১৯৪৭ সালে ঢাকায় প্রথম আইনসভার অধিবেশনের পর থেকে এর কার্যকাল পাঁচবছর বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। এই মেয়াদ সংসদ কর্তৃক আরও একবছর বাড়ানো হয়েছিল। শাসক মুসলিম লীগ জানত নির্বাচন হলে কী হবে। এই বিষয়ে তারা প্রথম সতর্ক হয় টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে সরকার পক্ষীয় নির্বাচনপ্রার্থীর বিরুদ্ধে মৌলানা ভাসানীর বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভের ফলে।

মুসলিম লীগ সরকার ২৫ টি উপনির্বাচন স্থগিত রাখল। সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগেই ১৭১ সদস্য বিশিষ্ট আইন সভার ৩৪টি আসন শূন্য ছিল।

তবে কোন্ সাহসে মুসলিম লীগ সাধারণ নির্বাচনের সম্মুখীন হল? এর কয়েকটা কারণ ছিল। তাদের হাতে ছিল শাসনযন্ত্র, প্রেস, অফুরন্ত ধনভাণ্ডার। ধনী, শিল্পপতি, জমিদার এবং ব্যবসাদাররা ছিল তাদের পক্ষে। আর সাধারণের মধ্যে তখনও পর্যন্ত যে সাম্প্রদায়িকতা ছিল সেটাও তাদের একটা বড় পুঁজি। শক্তিশালী বিদেশী সাহায্যও ছিল তাদের পক্ষে। শাসক হিসাবে তারা শত শত কম্যুনিস্ট ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীকে জেলে রেখে দিয়েছিল। শ্রমিক ও কৃষকদের প্রতিষ্ঠানসমূহকে তারা অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দিয়েছিল।

Dawn, Morning News, Azad, Sangbad প্রভৃতি পত্রিকার সহায়তায় তারা জোর প্রচার করতে থাকে যে যারা লীগের বিরুদ্ধে ভোট দেবে তাদের দেশের শত্রুপক্ষের সহায়ক বলে গণ্য করা হবে। শাসকদলের জিগির হল পাকিস্তান বিপন্ন। কাশ্মীর প্রশ্নটি তুলে ধরা হল। ১৯৫৩ সালের ২৪শে ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার-ভাষণে গভর্ণর জেনারেল গোলাম মহম্মদ ‘পূর্ববঙ্গকে ভারতীয় ইউনিয়নে ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার’ বিরুদ্ধে সতর্ক প্রহরার সম্বন্ধে সাবধান করে দিলেন। মিঃ নুরুল আমিন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বললেন, “মুসলিম লীগ যদি ক্ষমতায় ফিরে না আসে তবে সেটা হবে পাকিস্তান ও মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক।” নির্বাচনী প্রচারে বেরিয়ে মিস ফাতেমা জিন্নাও পাকিস্তানের অখণ্ডতা সম্বন্ধে হুঁশিয়ার করে দেন।

কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সর্বপ্রকার নির্বাচনী প্রচারের বিরুদ্ধেই জনমত মুসলিম লীগের বিপক্ষে গঠিত হতে থাকে। প্রত্যহ রাস্তায় ট্রাফিক জাম করে একাধিক বিরাট বিরাট মিছিল বের হতে থাকে, যাদের ধ্বনি ছিল, “হক-ভাসানী জিন্দাবাদ”-”শহীদ-ভাসানী জিন্দাবাদ।” ইতিমধ্যে সোহরাওয়ার্দ্দী ভারত থেকে ফিরে এসে পাকিস্তান রাজনীতিতে এক বিরাট ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা খর্ব করার কাজের দ্বারা। ১৯৫১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর রংপুরের এক সভায় সোহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন, “মুসলিম লীগ যদি জনপ্রিয়তা হারিয়ে থাকে তবে তার কারণ এই যে সে যা হতে চেয়েছিল তা হতে পারেনি এবং সে শুধু মুষ্টিমেয় লোকের ভোগের জন্য স্বাধীনতার ফল।”

এইভাবে মুসলিম লীগের মধ্যে ফাটল শুরু হয়। মিঃ নাজিমুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর পর তিনি ভগ্নমনোরথ হয়ে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ডন পত্রিকায় ১৯৫৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী সম্পাদকীয় মন্তব্য করা হয় মুসলিম লীগকে অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা, বিচ্ছিন্নতার প্রতীক বলে।

পূর্ববঙ্গে সাধারণ নিবাচনের দিন স্থির হওয়ার পর ঐ প্রদেশের নেতারা মুসলিম লীগের বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। এ কে ফজলুল হক সাহেব সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল পদ ত্যাগ করে বিপক্ষদলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। হক সাহেবের এই কার্যের ফলে জনসাধারণ উল্লসিত হয়ে জয়ধ্বনি করে-‘শের-ই-বাংলা’ জিন্দাবাদ।

হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক দল এবং মৌলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। তারা যুক্তভাবে সমগ্র প্রদেশে এই বলে প্রচারকার্য শুরু করে যে মুসলিম লীগ আদর্শচ্যূত, অগণতান্ত্রিক এবং দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের পাকিস্তানকে পশ্চিমী শক্তিজোটের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা এই মুসলিম লীগ বিরোধী প্রচারের প্রধান অস্ত্রস্বরূপ হয়।

যুক্তফ্রন্ট গঠিত হওয়ার সময় নেতারা জানতে পারেন যে কেন্দ্রীয় সরকার মিঃ ফজলুল হককে পূর্ববঙ্গের গভর্ণর করার প্রস্তাব দিয়েছে, তখন তাঁরা প্রস্তাব দেন যে যুক্তফ্রন্ট জিতলে মিঃ হকই হবেন প্রদেশের মুখমন্ত্রী। একথার সত্যতা প্রমাণের জন্য ১৯৫৩ সালের ৬ ডিসেম্বর তাঁকে যুক্তফ্রন্টের নেতা নির্বাচিত করা হয়।

মুসলিম লীগের জয়লাভের আশা নেই দেখে নিজাম-ই-ইসলাম দল, মৌলানা আতাহার আলীর দল সকলেই যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয়। এই সকল দলের যোগদান যথেষ্ট তা্যপূর্ণ ছিল কারণ মতবাদ ও আদর্শের যথেষ্ট অমিল থাকা সত্ত্বেও তারা প্রত্যেকেই মুসলিম লীগকে পরাস্ত করতে চেয়েছিল। এই সময়ের সভাসমিতিগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নেতারা প্রত্যহ পূর্ব পাকিস্তানের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির বিরুদ্ধে ভাষণ দিচ্ছিলেন।

যুক্তফ্রন্ট নেতারা নির্বাচনী ইস্তাহারের আকারে পূর্ববঙ্গের জন্য এক ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেন যা নির্বাচিত হলে তারা প্রথম পাঁচবছরের মধ্যেই কার্যকরী করার আশ্বাস দেন। এই ২১ দফা সূচির মুখবন্ধে বলা হয় “প্রাদেশিক আইনসভায় এমন কিছু করা হবে না। যা পবিত্র কোরাণের নীতির বিরোধী অথবা যার দ্বারা পাকিস্তানী নাগরিকের ইসলামিক একতা ও ভ্রাতৃত্ব ক্ষুণ্ন হতে পারে।”

২১ দফা সূচি:-

১। বাংলা ভাষা হবে পাকিস্তানের অন্যতম একটি রাষ্ট্রভাষা

২। ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকে যে কোন প্রকারের জমিদারি বিলুপ্তিকরণ এবং উদ্ধৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন। করের পরিমাণ হ্রাস।

৩। পাটশিল্পকে জাতীয়করণ, পাট উৎপাদকদের জন্য উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ। মুসলিম লীগ আমলের পাটশিল্পের দালালদের অনুসন্ধান করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ।

৪। সমবায় শিল্পপ্রথা প্রতিষ্ঠার দ্বারা কুটিরশিল্প ও শ্রমশিল্পের উন্নতি।

৫। লবনশিল্পে পূর্ব পাকিস্তানের স্বনির্ভরিতার জন্য এই শিল্পের পত্তন এবং পাট- দালালদের মত লবনশিল্পের দালালদের সম্বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।

৬। সর্বপ্রকার উদ্বাস্তু–বিশেষত কারিগর ও শিল্প শ্রমিকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ।

৭। বন্যা ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য সেচ-পরিকল্পনা।

৮। পূর্ববঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠার দ্বারা শিল্পশ্রমিকদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবিধান।

৯। বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতা ব্যবস্থা।

১০। সরকারী ও বেসরকারী ব্যবস্থা বিলোপের দ্বারা মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন।

১১। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুন বাতিল করে তাদের স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরকরণ।

১২। প্রশাসনিক ব্যয়সঙ্কোচন, উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের বেতনে সমতা আনয়ন। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীরা ১০০ টাকার বেশী বেতন গ্রহণ করবেন না।

১৩। সর্বপ্রকার দুর্নীতি, আত্মীয় পোষণ, উৎকোচের অবসান এবং এই উদ্দেশ্যে ১৯৪০ সালের পরের সময়ের প্রত্যেক সরকারী অফিসার ও বাণিজ্যপতিদের সম্পত্তির হিসাব গ্রহণ।

১৪। বিভিন্ন জননিরাপত্তা আইন ও অডিন্যান্স কর্তৃক ধৃত সকল বন্দীদের মুক্তি এবং সভাসমিতি, প্রেস ও বাকস্বাধীনতা দান।

১৫। বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনব্যবস্থার পৃথকীকরণ।

১৬। বর্ধমান ভবনকে প্রথমে ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগারে পরিণতকরণ।

১৭। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বাংলাভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিতে একটি শহীদ-স্তম্ভ নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের ক্ষতিপূরণ।

১৮। ২১শে ফ্রেব্রুয়ারী “শহীদ দিবস” এবং ছুটির দিন ঘোষণা।

১৯। ঐতিহাসিক লাহোর সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং মুদ্রাব্যবস্থা ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা। প্রতিরক্ষা বিষয়েও কেন্দ্ৰে যেমন থাকবে “নেভি হেডকোয়াটার্স” এবং পূর্ববঙ্গকে অস্ত্র ব্যাপারে স্বনির্ভর করার জন্য পূর্ববঙ্গে ‘অস্ত্রকারখানা” প্রতিষ্ঠা। আনসারদের পুরোপুরি সৈনিকরূপে স্বীকৃতি।

২০। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কোন কারণেই আইনসভা বা মন্ত্রিসভার কার্যকাল বৃদ্ধি করবেন না এবং যাতে নির্বাচনী কমিশনারের মাধ্যমে স্বাধীন পক্ষপাতহীন নির্বাচন হতে পারে তার জন্য তাঁরা নির্বাচনের ছ’মাস পূর্বে পদত্যাগ করবেন।

২১। প্রত্যেকটি আইনসভা সদস্যদের শূন্যপদ শূন্য হওয়ার তিনমাসের মধ্যে উপনির্বাচন দ্বারা পূর্ণ করা হবে এবং যদি যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী পরপর তিনটি উপনির্বাচনে পরাজিত হয় তবে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।

মুসলিম লীগ সরকার পূর্ববঙ্গের ৬০,০০০ হাজার মসজিদকে নির্বাচনী প্রচারের কেন্দ্র করে মোল্লাদের প্রচারকার্যে নিযুক্ত করে। যুক্তফ্রন্টের পক্ষে বিপুল সমর্থন লক্ষ্য করে সরকার এই সময় প্রদেশব্যাপী দমননীতি প্রয়োগ করে ১৪৪ ধারা প্রবর্তন, সভাসমিতি নিষিদ্ধকরণ, বই কাগজ বাজেয়াপ্তকরণ এবং হাজার হাজার গ্রেপ্তারের দ্বারা।

১৯৫৪ সালের ৩রা জানুয়ারী ঢাকা পল্টন ময়দানের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলী ভাষণ দিতে উঠলে জনতা ইংরেজীর পরিবর্তে বাংলাভাষায় বলার দাবীতে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। তারা চীৎকার করে থাকে “মুসলিম লীগ নিপাত যাক।” পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং সভা পণ্ড হয়ে যায়।

অগত্যা মুসলিম লীগ হাইকমাণ্ড জয়লাভের আশায় ক্ষমতাসীন এম এন এ-দের বাদ দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনাময় ব্যক্তিদের থেকে প্রার্থী নির্বাচন করতে থাকে।

এদিকে মৌলানা ভাসানী ও ফজলুল হক প্রতিটি জনসভায় বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হতে থাকেন। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে পাওয়ার দাবীই জনসাধারণের কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে। মুসলিম লীগ তাদের কাছে ক্ষমতালোভী কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে উপেক্ষা করার প্রতিষ্ঠানরূপেই গণ্য হয়।

যদিও কেন্দ্রীয় শাসকদল অভিযোগ করেন যে যুক্তফ্রন্ট কম্যুনিষ্ট পরিচালিত দল তথাপি সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্ব এবং ফ্রন্টের নির্বাচনী প্রস্তাবের মুখবন্ধই প্রমাণ করে যে এটা পুরোপুরি ইসলামী মতবাদের সমর্থক ছিল। কেন্দ্রীয় ক্ষমতাবানদের সবচেয়ে রাগের কারণ ছিল যুক্তফ্রন্টের দুটি নীতি–জমিদারী লোপ ও কৃষকদের জমিবন্টন। কারণ মুসলিম লীগ নেতারা অধিকাংশই ছিলেন জমিদার। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের জমিদারী বিলোপ নীতিই তাদের কম্যুনিস্ট বলার সবচেয়ে বড় কারণ, যদিও পাকিস্তান জন্মের সময় থেকেই কম্যুনিস্ট বেআইনী ঘোষিত হয়েছিল। অধিকাংশ কম্যুনিস্ট কর্মী ও নেতা ছিল জেলে বন্দী এবং তাদের কোন অর্থ সামর্থ্য কিছুই ছিল না।

পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, যুক্ত প্রগতিশীল দল এবং তফসিল দল মিলে আরও একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন এবং তাঁরা ৭২টি আসনে প্রার্থী দাঁড় করান।

বর্ণ হিন্দুরাও একটি কো-অর্ডিনেটিং কমিটি গঠন করে যাঁদের প্রার্থী ছিলেন বসন্তকুমার দাস, সুরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত, নেলী সেনগুপ্তা, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ নেতারা। সংখ্যালঘিষ্ঠ যুক্তফ্রন্ট উক্ত প্রার্থীদের সমর্থন করেন সংখ্যালঘুদের প্রতি খসড়া শাসনতন্ত্রের অবিচার দূর করার দাবীতে এবং যুক্ত-নির্বাচন দাবীও ছিল এঁদের অন্যতম দাবী। এই দাবীর স্বপক্ষে মনোরঞ্জন ধর এক ভাষণে বলেন, “এতদ্বারা সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তি ও দমন আইনের অপসারণ সম্ভব। যার ফলে গনতন্ত্রের উন্নতি সম্ভব।”

নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল স্পীকারসহ ৩১০ সদস্য বিশিষ্ট আইসভার ২১৮ টি আসনই যুক্তফ্রন্ট লাভ করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২১৮ টি পেয়েছে। অবশিষ্ট ৭২টি আসনের তফসিলীদের জন্য সংরক্ষিত আসন, ৯টি মুসলিম লীগ, ১টি চট্টগ্রাম থেকে নির্দল প্রার্থী পরে যিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন, ১টি খিলাফৎ-ই- রাব্বানী এবং ৯টি নির্দল। সংখ্যালঘু সংরক্ষিত আসনের মধ্যে কংগ্রেস ও তফসিলী ফেডারেশন প্রত্যেকে ২৪টি করে আসন পেয়ে বিপুল সংখ্যাধিক্য লাভ করে। যুক্ত প্রগতিশীল দল পায় ১২টি এবং তপসিলী সম্প্রদায় ফেডারেশনের নেতা শ্রী ডি এন বারুই পরিচালিত দল পায় ১টি আসন। সংখ্যালঘু আসনের চারটি কম্যুনিস্ট পার্টি, অমুসলমান আসনের ৩টি গণতন্ত্রী দলের হিন্দু, ২টি বৌদ্ধ আসনের ১টি শ্রী কামিলাকুমার দেওয়ান এবং অপরটি শ্রীসুধাংশুবিমল বড়ুয়া লাভ করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন নিছক ভোটের লড়াই ছিল না। সাত বছর ধরে মুসলিম লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ববঙ্গের উপর যে নির্মম শাসন ও শোষণ চালিয়েছিল এই নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তার সক্রিয় প্রতিবাদ জানাবার সুযোগ পেল। এই নির্বাচনের তাৎপর্য করাচী লাহোর নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং পূর্ববাংলার বিদ্রোহী রূপ দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন যে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্টকে মন্ত্রিত্ব গঠন করবার সুযোগ দেওয়া হলে পূর্ববাংলা বিদ্রোহ করবে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। পূর্ববঙ্গ থেকে পাঞ্জাবী অবাঙালী অফিসাররা অনবরত রিপোর্ট পাঠাতে থাকে যে যুক্তফ্রন্টকে মন্ত্রিত্ব গঠন করবার সুযোগ দিলে ব্যাপক অরাজকতা শুরু হবে, আইন শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়বে, অবাঙালীদের জীবন ও জীবিকার কোন নিরাপত্তা থাকবে না। করাচী থেকে গভর্ণর জেনারেল গোলাম মহম্মদ পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে যুক্তফ্রন্টকে মন্ত্রিত্ব গঠন করার সুযোগ না দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু গণতন্ত্রে বিশ্বাসী অবিভক্ত ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন লীগ নেতা কেন্দ্রের এই পরামর্শকে যথাযথ মনে করতে পারেন নি। তিনি যুক্তফ্রন্টের নেতা ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই মন্ত্রিত্ব গঠনের কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকা জেলের বাঙালী অবাঙালী ওয়ার্ডারদের মধ্যে এক সংঘর্ষ বেঁধে গেল। এই ঘটনাকে কেন্দ্ৰ করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করার জন্য আবার পূর্ববঙ্গের অবাঙ্গালী আমলাতন্ত্র যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কাজ বানচাল করার জন্য নানাভাবে মন্ত্রীদের আদেশ ও নির্দেশ অমান্য করে, সরাসরি কেন্দ্রের কাছে নানা মনগড়া, উদ্দেশ্যপ্রসূত রিপোর্ট পাঠিয়ে এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি করতে আরম্ভ করে দিল। পূর্ববাংলায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সেই অজুহাতে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় স্বার্থচক্র শিল্পক্ষেত্রকেই বেছে নিল। পূর্ববঙ্গের পাঞ্জাবী ও অবাঙালী শাসক গোষ্ঠী এবং আদমজী মিলের অবাঙালী কর্তৃপক্ষ এক মারাত্মক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। ১৯৫৪ সালের মে মাসে নারায়নগঞ্জের আদমজী জুট মিলে বাঙালী- অবাঙালী শ্রমিকদের মধ্যে এক প্রচণ্ড দাঙ্গা বেঁধে গেল। অবাঙালী মিল কর্তৃপক্ষ অবাঙালী শ্রমিকদের লাঠি, তরবারী এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত সরবরাহ করে বাঙালী শ্রমিকদের আক্রমণ করার জন্য উসকিয়ে দিয়ে ছিল। এই দাঙ্গায় প্রায় শতাধিক শ্রমিক নিহত হয়, বহু নরনারী ও শিশুর মৃতদেহ শীতলক্ষ্যা নদীর জলে ভাসতে দেখা যায়। আদমজী জুট মিলে প্রধানতঃ বাঙালী শ্রমিকদের যে ইউনিয়ন ছিল তার সভাপতি ছিলেন মৌলানা ভাসানী সাহেব। সাধারণ নির্বাচনের সময় এই ইউনিয়নভুক্ত সদস্যরা যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছিলেন। সেজন্য মালিকপক্ষ আগে থেকেই তাদের উপর বিক্ষুব্ধ ছিলেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের সাফল্যের পর তারা যখন কেন্দ্রীয় স্বার্থ চক্রের উসকানী পেল, তখন বাঙালী শ্রমিকদের ‘উপযুক্ত শিক্ষা’ দেবার জন্য তারা এগিয়ে এল। তার ফলেই এ হাঙ্গামা।

যুক্তফ্রন্টের পিছনে যে আছে সাড়ে ৪কোটি মানুষ, তাদের কথা ভেবেই কর্তারা অন্য পথ ধরলেন। কর্তারা ডাইরেক্ট অ্যাকশনের পথ ধরে উত্তেজিত করে তুললেন আদমজীর অবাঙালী শ্রমিকদের। তারা ছোরা আর পেট্রোল নিয়ে আক্রমণ চালাল বাঙালী শ্রমিকদের ব্যারাকে। কী, এত বড় আস্পর্ধা! বাংলাদেশে বসে বাঙালী শ্রমিকদের উপর হামলা। রুখে দাঁড়াল বাঙালী শ্রমিকরাও। দাঙ্গা বেঁধে গেল দুই দলে। আদমজী জুট মিল এমন দুর্গ বিশেষ যে দিন কয়েক তো সে খবর বহির্জগতে পৌঁছলই না, শেষে খবর পেয়ে মুজিবুর রহমান ভ্যান ভ্যান পুলিশ নিয়ে গেলেন সেখানে। ছুটে এলেন মৌলানা ভাসানী। তিনি যে বাঙালী শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। তারা গিয়ে দেখলেন কংক্রিটের রাস্তায় চাপ চাপ তাজা রক্ত। তখনো মৃতদেহ পড়ে রয়েছে এখানে সেখানে।

ছুরির আঘাতে ফেঁসে গেছে ভুঁড়ি। ভিতরের পুকুরটা লাশে গাদা হয়ে গেছে। শ’য়ে শ’য়ে নয়, হাজারে হাজারে শ্রমিক মারা গিয়েছিল সে দাঙ্গায়? কেউ জানেনা কতো হাজার। শীতলক্ষ্যার জলে ভেসে গেছে কত কত হতভাগ্যের দেহ। গোলাম মহম্মদ আর মহম্মদ আলির ষড়যন্ত্রের বলি ওরা। দৃঢ়হাতে মুজিবুর রহমান অবস্থা আয়ত্তে আনলেন। তাতে কী? আদমজীর জুট মিল দাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগের করাচী শাখা জিগির তুললঃ পূর্ব বাংলায় আইন শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে! সেখানে কারও জান মাল আর নিরাপদ নয়। সেখানে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে অবিলম্বে কেন্দ্রীয় শাসন চালু কর। কোন রকম তদন্তের আগেই কেন্দ্রীয় সরকার ফতোয়া জারী করলেনঃ এই হাঙ্গামার জন্য দায়ী কমিউনিস্ট ও একশ্রেণীর দেশদ্রোহী। কমিউনিস্টদের পাকড়াও কর। সীমান্তে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের দিকে নজর রাখ। এই সময়কার ঘটনা প্রবাহের দিকে একটু সতর্ক দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে যে পূর্ববাংলার নবজাত মন্ত্রিসভাকে খতম করবার উদ্দেশ্যে গভর্ণর জেনারেল গোলাম মহম্মদ ও তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানী সাঙাতের দল কি অদ্ভুত কৌশলের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছিলেন। আদমজী জুট মিলের ঘটনায় তৎক্ষণাৎ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করা না হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের হুকুমে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পুলিশ বাহিনী–যার নাম ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্–তাকে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার নিয়ন্ত্রণ থেকে সরিয়ে এনে তার মাথার উপর বসিয়ে দেওয়া হল পূর্ববঙ্গের পাঞ্জাবী জিও-সি-কে অর্থাৎ সামরিক কর্তৃপক্ষকে। পূর্ববঙ্গ সরকারের হোমরা চোমরা অবাঙালী দু-হাজারী, চার-হাজারী অফিসাররা প্রাদেশিক যুক্তফ্রন্ট সরকারকে এ সময় বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে চললেন। তাঁদের কাছ থেকে মদদ পেয়ে কোন কোন থানার দারোগা পর্যন্ত মন্ত্রিসভার নির্দেশকে অমান্য করে চললেন। অন্যদিকে মুসলিম লীগ ওয়ালাদের মালিকানায় পরিচালিত সংবাদপত্রগুলি যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে এমন জোর গলা ফাটাতে লাগল যে পারলে তারা তখনই যুক্তফ্রন্ট সরকারকে শূলে চড়িয়ে দেয়। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে চারিদিকে যখন চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হচ্ছিল, সে সময় মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক সাহেব কলকাতায় এলেন। ফজলুল হক কলকাতা থেকে ঢাকা ফিরে যাবার কয়েক দিন পরেই গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব মহম্মদ আলী তাঁকে করাচীতে জরুরী তলব করলেন। হক সাহেব ২১শে মে শুক্রবার করাচীতে উপস্থিত হলেন। গভর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জনাব হকের সপ্তাহব্যাপী বাকবিতণ্ডায় আলোচনা হল। শের-ই বাংলা ফজলুল হক পূর্ববঙ্গের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবী করলেন। ৩১শে মে রবিবার গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ, জনাব ফজলুল হক ও তাঁর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করে পূর্ব-পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন প্রবর্তিত করলেন। জবরদস্ত সেনাপতি (সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব) মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠান হলো। তৎকালীন গভর্নর বৃদ্ধ চৌধুরী খালিকুজ্জামান অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন। ইস্কান্দার মীর্জা তাঁর সঙ্গে পূর্ববঙ্গের চীফ সেক্রেটারী করে নিয়ে এলেন দোর্দণ্ড প্রতাপ সিভিলিয়ান জনাব নিয়াজ মহম্মদ খানকে (এন এম খান নামে কুখ্যাত এই পাঞ্জাবী আই-সি-এস অফিসার অবিভক্ত বাংলার নানা জেলায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন)।

৩০শে মে সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী জনাব মহম্মদ আলী জনাব ফজলুল হককে পাকিস্তানের শত্রু, পূর্ববঙ্গের প্রতি বিশ্বাস-ঘাতক বলে অভিযুক্ত করলেন। করাচী থেকে ঘটা করে প্রচার করা হল যে যুক্তফ্রন্ট পূর্ববঙ্গকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার ষড়যন্ত্র করেছিল, তাই পাকিস্তানকে অন্তর্ঘাতীদের কবল থেকে রক্ষা করার জন্যই পূর্ববঙ্গের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে খারিজ করে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হলেন।

পদচ্যুত মুখ্যমন্ত্রী জনাব ফজলুল হক সাহেব ৩০শে মে সকাল সোয়া নটা নাগাদ করাচী থেকে ঢাকা ফেরবার পথে ঘন্টাখানেক তাঁর বিমানটি দমমদ বিমানঘাঁটিতে থেমেছিল। হক সাহেবের সঙ্গে ছিলেন তাঁর মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্য–জনাব আজিজুল হক, জনাব আতাউর রহমান খান, যিনি পরে কিছুদিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিনে, এবং শেখ মুজিবুর রহমান।

৩১শে মে গভর্নর ইস্কান্দার মীর্জা ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বললেনঃ “আমার শাসনের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করলেও তা বরদাস্ত করা হবে না। দরকার হলে আমি জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে সৈন্য বাহিনী নিয়োগ করব। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করবার জন্য যদি দশ বিশ হাজার মানুষকে হত্যা করতে হয়, তা হলেও আমি পিছপা হব না।” সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্র দলন শুরু হল। সংবাদপত্রের অফিসে অফিসে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্ বাহিনীর পাহারা বসল। সরকারের অন্ধ সমর্থক মর্নিং নিউজ আর আজাদ ছাড়া অন্যান্য সব সংবাদপত্রের উপর আদেশ জারী করা হল যে সেন্সর ছাড়া কোন সম্পাদকীয় এমন কি সংবাদও প্রকাশ করা চলবে না। পূর্ব বাংলায় ইস্কান্দার ও এন এম খান শাহী চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় চার হাজার রাজনৈতিক নেতাও কর্মীকে ধরে নিয়ে কারারুদ্ধ করা হল। এঁদের অনেকে মুসলিম লীগ আমলেও জেলে ছিলেন। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এঁরা মুক্তিলাভ করেছিলেন। কিন্তু এই মুক্তি মাত্র এক মাসের বেশী স্থায়ী হল না। এঁরা ইস্কান্দারী রোষের বলি হলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, গণতন্ত্রী দলের সম্পাদক মাহমুদ আলী এবং আরো অনেক প্রগতিশীল যুব নেতা। এই সময় পূর্ব বাংলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিপ্লবী নেতা বরিশালের সতীন সেন কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জেলের অত্যাচারে ও অযত্নে তাঁর দেহ দ্রুত ভেঙ্গে পড়তে লাগল এবং তাঁকে প্রথম বরিশাল জেল থেকে রংপুর জেলে এবং পরে ঢাকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হল। কিন্তু তখন তার অন্তিম অবস্থা। ১৯৫৫ সালের ২৫শে মার্চ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুর পর এই মহান বিপ্লবী নেতা যিনি জীবনের প্রায় ২৬ বছর ইংরেজের কারাগারে কাটিয়েছেন এবং পাকিস্তানের জেলেও বন্দী থেকেছেন দীর্ঘদিন, তাঁর দেহাবশেষটি পর্যন্ত বেওয়ারেশি মৃতদেহের সঙ্গে মর্গের মধ্যে টেনে নিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

শেখ মুজিবুর রহমান এই সময়ে জেলে সতীন সেনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। মুজিবুরের জীবনে যে কয়জন রাজনৈতিক নেতার চরিত্রের প্রভাব পড়ে তাঁরা হলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্ৰ বসু, এ কে ফজলুল হক আর সতীন সেন। সতীন সেনের আত্মদানও মুজিবের জীবনে গভীর রেখাপাত করেছিল। সতীন সেনও মুজিব সম্পর্কে খুবই উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। কিন্তু সেই সব কথা বলার আগে সতীন সেনের আত্মদান সম্পর্কে কিছু বলে নিই। পাক ভারত উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ ঋষিকল্প ত্যাগী পুরুষ কি নির্যাতন ও দুঃসহ নিপীড়নের মধ্যে পাকিস্তানের কারাগারে তিলে তিলে মৃত্যু বরণ করেছিলেন সেকথা লিপিবদ্ধ আছে তাঁর নিজের লেখা দিনলিপিতে। সতীন সেনের কারাবাসের ও জীবন দীপ নির্বাপনের শেষ অধ্যায়টা তুলে ধরছি।

শেষ কারাবাস

১৯৫৪ সনের মে মাসে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি এক বৈপ্লবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করিল। নাটকীয় ভাবে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার গভর্নর রূপে শপথ গ্রহণ, ৯২ এ ধারা প্রবর্তন মিঃ ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল, মিঃ হকের স্বগৃহে আটক, দেশব্যাপী ব্যাপক ধরপাকড় প্রভৃতি ঘটনাবলীর ক্ষিপ্রগতি জনসাধারণকে কতকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় করিল। বরিশালেও দ্রুতগতিতে যুক্তফ্রন্টের সমর্থক প্রগতিশীল ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হইল। এই গ্রেপ্তারের হিড়িকে ১লা জুন তারিখে সতীন্দ্রনাথকেও তাঁহার পটুয়াখালীস্থ স্বগৃহ হইতে গ্রেপ্তার করা হইল। ৫০ বৎসর বয়সে যখন সাধারণত লোকে শারীরিক বিশ্রাম কামনা করেন, তখন সেই দেহে কারাগারের কঠোরতা গ্রহণে মন স্বভাবতই ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী হয়। কিন্তু সতীন্দ্রনাথের মন বা প্রকৃতি ছিল অদ্ভুত ধাতুতে গঠিত। ক্ষণিকের তরেও এই ক্লেশজনক জীবন যাপন করিবার দরুণ তাঁহার কোন বিরক্তি বা ক্ষোভ প্রকাশ পাইল না, বরং কারাগারে প্রগতিশীল মুসলমান কর্মীদের মধ্যে নিজেকেও দেখিয়া তাঁহার মন বেশ উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। আদর্শবাদী জীবনের দৃষ্টিতে তিনি তাঁহার এই নূতন কারাবাসকে সানন্দে বরণ করিলেন। কেননা তাহার নিজের ভাষায় “প্রধানকর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিবার সুযোগ হইল। ইহার ফলে কর্মক্ষেত্র সুদূরপ্রসারী হইতে পারে। Suffering-এর পথে এদের দীক্ষা শুরু হইল মাত্র।” কারাগারের ক্লেশের মধ্যে রহিয়াও বাঙালী তরুণ মুসলমান যুবকগণ দেশের বৃহত্তর মঙ্গলের প্রয়াসে দুঃখ কষ্ট বরণ করিবার জন্য যে প্রস্তুত হইতেছে ইহাই তাঁহার জীবনের রূপায়িত আদর্শ।

গ্রেপ্তার করিবার সংবাদ শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গেই পটুয়াখালীর মুসলমান সম্প্রদায়ের ছাত্র ও স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে শত সহস্র জনতা যেভাবে তাঁহাকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করিল তাহা সতীন্দ্রনাথের জীবনে অভূতপূর্ব! তিনি হিন্দু না মুসলমান এ প্রশ্ন তাহাদের ছিল না, তিনি তাহাদের একান্ত আপনার জন–জনতার এই অভিব্যক্তিই তাঁহাকে মুগ্ধ করিল, অভিভূত করিল। পটুয়াখালী জেল হইতে ৭ই জুন যখন তাঁহাকে বরিশাল জেলে পাঠান হইল তখন পথে, স্টেশনে, স্টীমারে কাতারে কাতারে জনতার আবেগপূর্ণ ব্যবহারের মধ্যে জাগ্রত নবশক্তির দুর্লভ ইঙ্গিত দৃষ্টিতে প্রতিভাত হইল।

দেহের বার্ধক্যকে উপেক্ষা করিয়া মনের তারুণ্যের সহিত তিনি কারসাজি শুরু করিলেন। প্রত্যহ ভোর ৪ঘটিকায় শয্যা ত্যাগ করিবার অভ্যাস তাঁহার বরাবরের ছিল। প্রাতঃকৃত্যাদির পর গীতা ও বিভিন্ন পুস্তকাদি পাঠ, তৎপরে ঠিক এক ঘন্টা চরকায় সূতাকাটা, পরে জেল প্রাঙ্গণে ভ্রমণ ছিল তাহার নিত্যকার্য। সমস্ত নিরাপত্তা বন্দীদের কাহার কি অসুবিধা আছে অনুসন্ধান করিয়া কর্তৃপক্ষের দ্বারা উহা দূরীভূত করিবার চেষ্টা করিতেন।

একদিন কথাপ্রসঙ্গে একজন বন্দী তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “মুসলমানদের দেশে civil liberty সম্ভব নয়, democracy অসম্ভব, democratically minded লোক টিকিতে পারে না’।

কিন্তু এই প্রকারে অন্ধ কারণ দর্শাইয়া দেশ পরিত্যাগ করিবার মানসিক অবসাদ বা আত্মবিশ্বাসের অভাব সতীন্দ্রনাথের কোন দিনও ছিল না। কাজেই এই সম্পর্কে তাঁহার মনোভাব তিনি ব্যক্ত করিলেন মিঃ টমাস পেইনের সেই বিখ্যাত উক্তির দ্বারা-‘My home is there, where liberty is not. ‘

এই বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হইল এবারকার বন্দিজীবনে এই সব নূতন সহযোগীদের সংস্পর্শে আসিয়া। তিনি দেখিলেন–কি fine কতগুলি feature এই সব মুসলমানদের ভিতর– শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী নির্ধন, ছোট বড় সবার ভিতর। Disinterested, selfless, courageous leadership হইলে brilliant কার্য হইত–material খুব fine।

রংপুর জেল

প্রায় দেড় মাস বরিশাল জেলে আটক থাকিবার পর তাঁহাকে রংপুর জেলে বদলী করা হইল। ২১শে জুলাই তিনি রংপুর জেলে পৌঁছিলেন। প্রথমে উঠিলেন ৩নং ওয়ার্ডে। সেখানে অন্যান্য নিরাপত্তা বন্দীদের মধ্যে দুইজন এম এন এ ছিলেন-মিঃ আজিজ মিঞা ও মিঃ এম মণ্ডল। এখানে উঠিবার কিছু পরেই সংবাদ আসিল যে আই-জি-র নির্দেশমত তাঁহাকে পৃথক থাকিতে হইবে। সুতরাং হাসপাতালের একটি কামরায় তাঁহার থাকিবার স্থান নির্দিষ্ট হইল।

চিরাচরিত অভ্যাসবশে এখানেও তিনি সকল নিরাপত্তা বন্দীদের অভাব অভিযোগর সন্ধান লইতেন এবং আবশ্যকীয় সহায়তা করিতেন। এই সময় প্রবল বর্ষা চলিতেছিল কাজেই তিনি তাঁহার waterproof খানা ৩নং ওয়ার্ডের ব্যবহারের জন্য পাঠাইয়া দিলেন এবং তৎসহ কতিপয় নিজস্ব পাঠ্য পুস্তকও পাঠাইলেন। অযাচিত এই ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হইলেন। জেলে হাসপাতালের নীচতলার যে কামরায় তাঁহার থাকিবার স্থান নির্দিষ্ট ছিল তাহারই ঠিক উপরের তলায় ছিল জেলের টি বি ওয়ার্ড-এবং তখন যক্ষ্মা রোগীগণ সেখানে থাকিত। উক্ত টি বি ওয়ার্ড-এর মেঝের বিভিন্ন ভগ্ন স্থান হইতে প্রত্যহ তাঁহার কামরার মধ্যে জল পড়িতেছে তিনি লক্ষ্য করিলেন। ২৪শে জুলাই দিন-রাত্রে বেশ পরিমাণে জল পড়িল। এই গুরুতর ছোঁয়াচে রোগের সংস্পর্শে থাকিবার বিপদের কথা উল্লেখ করিয়া পরদিনই তিনি জেল কর্তৃপক্ষকে জানাইলেন তাঁহাকে অন্যত্র থাকিবার ব্যবস্থা করিবার জন্য, পরেও বহুবার মৌখিকভাবে এবং পত্রযোগে এই কথা তিনি কর্তৃপক্ষকে জানাইলেন। কিন্তু তাঁহার স্থান পরিবর্তনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কার্যত কোন প্রতিকারই হল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *