অশনি সংকেত – ৮

দিনকতক পরে চালের ঘোর অনটন লোকের ঘরে ঘরে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ী এসে চাল ধার চায়, কে কাকে দেবে? অনঙ্গ-বৌ দুদিন ছেলেদের মুখে ভাত দিতে পারলে না, শুধু সজনে শাক সেদ্ধ। একদিন এসে কাপালী-বৌ দুটো সুষনি শাক দিয়ে গেল, একদিন গঙ্গাচরণ কোথা থেকে একখানা থোড় নিয়ে এল। ভাতের ফ্যান চেয়ে ঘরে ঘরে ফিরচে ত্রিপুরা জেলা থেকে আগত মেয়ে-পুরুষ। গ্রামে হাহাকার পড়ে গেল।

সন্ধ্যার দিকে রামলাল কাপালী এসে গঙ্গাচরণকে চুপি চুপি বললে—পণ্ডিতমশায়, চাল নেবেন?

গঙ্গাচরণ বিস্ময়ের সুরে বললে—কোথায়?

—মেটেরা বাজিতপুর থেকে আমার শ্বশুর এক বস্তা চাল নিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে এসেচেন আমার বাড়ী। দেড় মণ চাল, বেনামুড়ি ধানের ভালো চাল। ছোট-বৌ বললে—বামুনদিদির বাড়ী বলে এসো।

—কি দর?

—শ্বশুর বলচে চল্লিশ টাকা করে মণ—

—আউশ চালের মণ চল্লিশ টাকা?

—তাই মিলচে না দাদাঠাকুর। আপনি তো সব জানো।

গঙ্গাচরণ ইতস্তত করতে লাগলো। দু’গাছা পাতলা রুলি আছে অনঙ্গ-বৌয়ের হাতে। একবার গেলে আর হবে না।

কিন্তু উপায় কি? ছেলেপুলেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তো? বাড়ীতে এসে স্ত্রীর কাছে বলতেই তখুনি সে খুলে দিলে। এক মণ চালই এসে ঘরে উঠলো।

রামলাল কাপালী বলে দিলে—চুপি চুপি নিয়ে যাবেন দাদাঠাকুর।

সন্ধ্যার অনেক পরে চাল নিয়ে আসতে গিয়ে গঙ্গাচরণ ও তার দুই ছেলে পড়ে গেল নিমাই জেলের সামনে। সে নদীতে যাচ্চে আলোয় মাছ ধরতে। ওদের দেখে বললে—কে?

গঙ্গাচরণ বললে—এই আমরা।

—কে পণ্ডিত মশাই? পেন্নাম হই। কি ওতে?

—ও আছে।

—ধান বুঝি পণ্ডিত মশাই?

—হাঁ।

নিমাই জেলের বিধবা মেয়ে পরদিন ভোর না হতে এসে হাজির। না খেয়ে মারা যাচ্ছে ওরা, দুটো ধান দিতে হবে। অনঙ্গ-বৌ মিথ্যে কথা বলতে তেমন পারে না, না ভেবেই বলে বসলো—ধান তো নেই ঘরে, চাল এনেছিলেন কিনে উনি।

—তাই দুটো দ্যান বামুন-দিদি, না খেয়ে মরচি।

দিতে হল। ঘরে থাকলে না দিয়ে পারা যায় না। ফলে দলে দলে এ-পাড়া ও-পাড়া থেকে লোক আসতে লাগলো—কেউ ভাত চায়, কেউ চাল চায় দুটি। এক মণ চাল দশ দিনে উঠে গেল, মাঝে পড়ে অনঙ্গ-বৌয়ের শেষ সম্বল রুলি দু’গাছা অনন্তের পথে যাত্রা করলো।

.

ইতিমধ্যে একদিন ভাতছালা থেকে মতি মুচিনী এসে হাজির।

অনঙ্গ-বৌ বললে—কি রে মতি? আয় আয়—

মতি গলায় আঁচল দিয়ে দূর থেকে প্রণাম করে বললে—গড় করি দিদি-ঠাকরুণ।

—কি রকম আছিস? এ রকম বিচ্ছিরি রোগা কেন?

—ভালো না দিদি-ঠাকরুণ। না খেয়ে খেয়ে এমনি দশা।

—তোদের ওখানেও মন্বন্তর?

—বলেন কি দিদি-ঠাকরুণ, অত বড় মুচিপাড়ার মধ্যে লোক নেই। সব পালিয়েচে।

—কোথায়?

—যে দিকি দু’চোক যায়। দিদি-ঠাকরুণ, সাতদিন ভাত খাই নি, শুধু চুনো মাছ ধরতাম আর গেঁড়ি-গুগলি। তাও এদানি মেলে না। ভাতছালার সেই বিলির জল ঘোল-দই। শুধু দ্যাখো মুচিপাড়া, বাগদিপাড়ার মেয়ে-ছেলে বৌ-ঝি সব সেই একগলা জলে নেমে চুনো মাছ আর ছেলেমেয়ে ডাঙায় বসে কাঁদছে, ওদের মা কাঁচা গেঁড়ি-গুগলি তুলে ওদের মুখে দিয়ে কান্না থামিয়ে এসে আবার জলে নেমেচে। কত মরে গেল ওই সব খেয়ে। নেতু বুনোর ছোট মেয়েটা তো ধড়ফড় করে মরে গেল পেটের অসুখে।

—বলিস কি মতি?

—আর বলবো কি অত বড় মুচিপাড়া ভেঙে গিয়েচে দিদি-ঠাকরুণ।

—কেন?

—কে কোথায় চলে গেল! না খেয়ে কদিন থাকা যায়, বলুন? যার চোক যেদিকে যায় বেরিয়ে পড়েচে। আমার ভাই দুটো, অমন জোয়ান ভাইপো দুটো না খেয়ে খেয়ে এমনি খ্যাংরা-কাটি—তারপর কোনো দিকি যে তারা চলে গেল তা জানি নে। আহা, অমন জোয়ান দুই ভাইপো! আর এই দ্যাখো আমার শরীল—

হাত দুটো বের করে দেখিয়ে মতি মুচিনী হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠলো।

অনঙ্গ-বৌ তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে বললে—কাঁদিস নে মতি। জল খা, একটু গুড় ভাত দেবো। ক’দিন খাস নি?

মতি দু’হাতের আঙুল ফাঁক করে বললে—সাতদিন।

শেষ পর্যন্ত মতি মুচিনীর অবস্থা অনঙ্গ-বৌয়ের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিলে।

না খেয়েও তাহলে মানুষ কষ্ট পায়, নয়তো ভাতছালার অতগুলো মুচির অবস্থা আজ এরকম হল কি করে?

এই অসময়ে আবার একদিন এসে পড়লো কামদেবপুরের দুর্গা পণ্ডিত।

সেদিন অনঙ্গ-বৌ দুটো সুষনি শাক তুলে এনেচে নোনাতলার জোল থেকে, সে যেন এক পরম প্রাপ্তি। খুব বেলা গেলে কাপালীদের ছোট-বৌ সেদিন ডাকলে—ও বামুন-দিদি, চলো এক জায়গায়—

—কোথায় রে ছুটকি?

—নোনাতলার জোলে—

—কেন রে, এত বেলা গেলে নোনাতলার জোলে? তোর নাগর বুঝি নুকিয়ে তোর সঙ্গে দেখা করবে?

—আ মরণ বামুন-দিদির! সোয়ামী আছে না আমার? অমন বুঝি বলতি আছে সোয়ামী যাদের আছে তাদের? তোমরা রূপসী-বৌ, তোমাদের নাগর থাকুক, আমার দিকি কে তাকাবে তোমরা থাকতি? তা না গো—সুষনি শাক হয়েচে অনেক, নুকিয়ে তুলে আনি চলো। কেউ এখনো টের পায় নি—টের পেলে আর থাকবে না।

নোনাতলার জোল গ্রামের পেছনদিকের বাঁশবন আমতলার পেছনে ঘন ঝোপে ঘেরা জায়গা। বর্ষাকালে নিচু জায়গাতে জল বাধে—এখন জল নেই—শরতের শেষে জলাশয় শুকিয়ে উঠচে। ভিজে মাটির ওপর নতুন সুষনি শাক একরাশ গজিয়েচে দেখে অনঙ্গ-বৌয়ের মুখে হাসি ধরে না। বলেন—এ যে ভাই অনেক!

কাপালী-বৌ হাসতে হাসতে বললে—একেই বলে কাঙালকে শাকের ক্ষেত দেখানো!

—তা হোক, কারো চুরি তো করচি নে।

—ভগবানের জিনিস হয়ে আছে, তুলে খাও। এখনো কেউ টের পাই নি তাই রক্ষে! নইলে ভেসে যেতো সব এতদিন।

অনঙ্গ-বৌ আবার ভীতু মেয়ে, একটা শেয়াল ঝোপের দিকে খসখস করতেই চমকে উঠে বলে উঠলো—কি রে কাপালী-বৌ, বাঘ না তো?

—বাঘ না তোমার মুণ্ডু বামুন-দিদি! দ্যাখো না চেয়ে—

—তুই কি করে এ বনলা জায়গায় শাকের সন্ধান পেলি? সত্যি কথা বল ছুটকি—

অনঙ্গ-বৌ কাপালীদের ছোট-বউয়ের স্বভাবচরিত্রের কথা কিছু কিছু না জানতো এমন নয়। গোড়া থেকেই ওর মনে সন্দেহ না হয়েছিল এমন নয়।

কাপালী-বৌ হাসতে হাসতে বললে—দূর—

—আবার ঢাকছিস? এখানে তুই কি করে এলি রে? কখন এলি? এখানে মানুষ আসে?

—এ্যালাম।

—কেন এলি?

কাপালী-বৌয়ের মুখ সলজ্জ হয়ে উঠলো। বললে—এমনি।

—মিথ্যে কথা। এমনি নয়। বলি হ্যাঁরে ছুটকি, তোর ও স্বভাব গেল না? ভারি খারাপ ওসব, জানিস? স্বামীকে ঠকিয়ে ওসব এখনো করতে তোর মন সরে? ছিঃ—

কাপালী-বৌ চুপ করে রইল। অন্য কেউ এমন কথা বললে সে রেগে ঝগড়াঝাঁটি করতো, কিন্তু অনঙ্গ-বৌয়ের মধ্যে এমন কিছু আছে যাতে কারো সাধ্য হয় না তার মুখের ওপর কথা কইতে। বিশেষ করে যখন সে একটা এমন ধরনের ব্যাপারের প্রতিবাদ করচে।

অনঙ্গ-বৌ বললে—না সত্যি ছুটকি, তুই রাগ করিস নে। আমি ঠিক কথা তোরে বলচি—

কাপালী-বৌ ঝাঁকি মেরে মুখ ওপরের দিকে ফুটন্ত ফুলের মত তুলে বললে—আমি কি আসতে চাই? আমাকে ছাড়ে না যে—

—কে?

—নাম নাই বললাম বউ-দিদি?

—বেশ যাক সে। না ছাড়লেই তুই অমনি আসবি?

—আমার চাল যোগাড় করে এনে দেয়। সত্যি, বউ-দিদি তুমি সতী নক্ষ্মী ভাগ্যিমানি—মিথ্যে বলবো না তোমার কাছে, বামুন দেবতা। সেদিন আমি না খেয়ে উপোস করে আর পারি নে। খিদে সহ্যি করতে পারি নে ছেলেবেলা থেকি। বাপ মা থাকতি, সকাল সকাল এক পাথর পান্তভাত দুটো কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে বেড়ে দিত, খেতাম পেট ভরে।

—তার পর বল—

—সেদিন উপোস করে আছি সারাদিন, ও এসে বললে—

—এই পর্যন্ত বলে কাপালী-বৌ লজ্জায় মুখ নিচু করে বললে—না, সে কথা আর—

—কি বললে?

—চাল দেবো আধ কাঠা।

—তাইতে তুই—

এই পর্যন্ত বলেই অনঙ্গ-বৌ চুপ করে গেল। ওর কাছে এসে ওর হাত ধরে গম্ভীর সুরে বললে—ছুটকি?

কাপালী-বৌ চুপ করে রইল।

—তুই আমার কাছে গেলি নে কেন?

—তুমি সেদিনও আমার সঙ্গে শাক তুলে নিয়ে গেছলে। তোমার কাছে কিছু ছিল না সেদিন।

—যেদিন মতি মুচিনী এল ভাতছালা থেকে?

—হুঁ।

অনঙ্গ-বৌয়ের চোখ ছলছল করে এল। সে আর কিছু না বলে কাপালী-বৌয়ের ডান হাতখানা নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিলে।

.

দুর্গা পণ্ডিত এসে আড় হয়ে শুয়ে পড়েছিল ওদের দাওয়ায়। বাড়ীতে কেউ ছিল না, গঙ্গাচরণ পাঠশালায়, ছেলেরা কোথায় বেরিয়েছিল। অনঙ্গ-বৌ শাক তুলে বাড়ী ফিরে এসে দেখে প্রমাদ গনলো। আজই দিন বুঝে! শুধু এই শাক ভরসা, দুটো কটা মোটা নাগরা চাল কোথা থেকে উনি ওবেলা এনেছিলেন, তাতে একজনেরও পেট ভরবে না।

দুর্গা পণ্ডিত বললেন—এসো মা। তোমার বাড়ী এলাম।

—বসুন, বসুন।

—তোমাদের সব ভালো?

—এক রকম ওই।

আধঘণ্টা পরে দুর্গা পণ্ডিত হাত-পা ধুয়ে সুস্থ ঠাণ্ডা হয়ে অনঙ্গ-বৌয়ের কাছে তাঁর দুঃখের বিবরণ দিতে বসলেন। যেন অনঙ্গ-বৌ তাঁর বহুদিনের আপনার জন।

অনঙ্গ বললে—তিন দিন খান নি? বলেন কি?

—আমিই তো নয়, বাড়ীসুদ্ধ কেউ নয় মা। বলি না খাওয়ার কষ্ট আর সহ্যি হয় না, আমার মায়ের কাছে যাই।

—তা এলেন ভালোই× করেছেন।

অনঙ্গ আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো, আপাতোক বুড়োকে কি দিয়ে একটু জল দেওয়া যায়। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল পুরোনো দুটো চা পড়ে আছে হাঁড়ির মধ্যে পুঁটুলিতে। বললে—একটু চা করে দেবো?

দুর্গা পণ্ডিত খুশির সঙ্গে বলে উঠলো—আহা, তা হলে তো খুব ভালো হল। কতদিন চা পেটে পড়ে নি।

অনঙ্গ-বৌ চিন্তিত মুখে বললে—কিন্তু নুন-চা খেতে হবে। দুধ নেই।

—তাই দাও মা। লবণ-চা আমি বড্ড ভালোবাসি।

শুধু একবাটি নুন-চা। তা ছাড়া অনঙ্গ-বৌয়ের কিছু দেবার উপায়ও ছিল কি?

.

রাত্রে গঙ্গাচরণ এসে দুর্গা পণ্ডিতকে দেখে মনে মনে ভারি চটে গেল। স্ত্রীকে বললে—জুটেচে ওটা আবার এসে?

অনঙ্গ-বৌ রাগের সুরে বললে—জুটেচে! তা কি হবে এখন?

—চলে যেতে বলতে পারলে না? কি খেতে দেবে শুনি?

—তুমি আমি দেবার মালিক? যিনি দেবার তিনিই দেবেন।

—হ্যাঁ, তিনি তো দিলেন দুবেলা। তাহলে ওকেও তো তিনি দিলেই পারতেন। তোমার স্কন্ধে নিয়ে এসে চাপালেন কেন?

—ছিঃ, অমন বলতে নেই তাঁর নামে। তিনি ঠিক জোটাবেন। এখানে যিনি পাঠিয়েচেন, এও তাঁর কাজ। যোগাবেন তিনি।

—বেশ, যোগান তবে। দেখি বসে বসে।

—নাও, হাত-পা ধুয়ে—এখন নুন-চা খাবে একটু?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *