৫
দিন পনেরো কেটে গেল।
গ্রামে গ্রামে লোকে একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেচে। চাল পাওয়া বড় কঠিন হয়ে পড়েচে।
রাধিকানগরের হাটে, যেখানে আগে বিশ-ত্রিশখানা গ্রামের চাষাদের মেয়েরা ঢেঁকি ভানা চাল নিয়ে আসতো, সেখানে আজকাল সাত-আটজন স্ত্রীলোক মাত্র দেখা যায়। তাও চাল পাওয়া যায় না। বড়তলার মোড়ে আর ওদিকে সামটা বিলের ধারে ক্রেতার দল ভিড় পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে চাল কাড়াকাড়ি করে নিয়ে যায়।
হাটুরে লোকেরা চাল বড় একটা পায় না।
আজ দু’হাটে আদৌ চাল না পেয়ে গঙ্গাচরণ সতর্ক হয়ে এসে সামটা বিলের ধারে দাঁড়িয়েচে একটা বড় জিউলি গাছের ছায়ায়। সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন লোক আছে বিভিন্ন গ্রামের। বেলা আড়াইটে থেকে তিনটের মধ্যে, রোদ খুব চড়া।
কয়রা গ্রামের নবীন পাড়ুই বলচে—বাবাঠাকুর, আমরা তো ভাত না খেয়ে থাকতি পারি নে, আজ তিন দিন ঘরে চাল নেই।
গঙ্গাচরণ বললে—আমার ঘরে আজ দু’দিন চাল নেই।
আর একজন বললে—আমাদের দু’দিন ভাত খাওয়া হয় নি।
নবীন পাড়ুই বললে—কি খেলে?
—কি আর খাবো? ভাগ্যিস মাগীনরা দুটো চিঁড়ে কুটে রেখেছিল সেই বোশেখ মাসে, তাই দুটো করে খাওয়া হচ্ছে। ছেলেপিলে তো আর শোনবে না, তারা ভরপেট খায়, আমরা খাই আধপেটা!
—তা চিঁড়ের সেরও দেখতি দেখতি হয়ে গেল বারো আনা, যা ছিল দু’আনা।
—এ কি বিশ্বেস করতি পারা যায়? কখনো কেউ দেখেচে না শুনেচে যে চিঁড়ের সের বারো আনা হবে?
গঙ্গাচরণ বলল—কখনো কি কেউ শুনেচে যে চালের মণ ষোল টাকা হবে?
নবীন পাড়ুই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল। সে জোয়ান মানুষ যদিও তার বয়েস ঠেকেচে পঞ্চাশের কোঠায়; যেমন বুকের ছাতি, তেমনি বাহুর পেশী। ভূতের মত পরিশ্রম করেও যদি আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়, তবে আর বেঁচে সুখ কি? আজ দু-তিন দিন তাই জুটেচে ওর ভাগ্যে।
এমন সময় দেখা গেল আকাইপুরের মাঠের পথ বেয়ে তিন-চারটি স্ত্রীলোক চালের ধামা, কেউ বা বস্তা মাথায় বড় রাস্তায় এসে উঠলো।
সবাই এগিয়ে চললো অমনি।
মুহূর্তমধ্যে উপস্থিত পাঁচ-ছ’জনের মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে গেল, কে কতটা চাল কিনতে পারে! হঠাৎ ওদের মধ্যে কার যেন মনে পড়লো কথাটা, সে জিগ্যেস করলে—কত করে পালি?
একজন চালওয়ালী বললে—পাঁচ সিকে।
গঙ্গাচরণ এবং উপস্থিত সকলেই আশ্চর্য হয়ে গেল, পাঁচ সিকে পালি, অর্থাৎ কুড়ি টাকা মণ!
নবীন পাড়ুইয়ের মুখ শুকিয়ে গেল, সে একটা টাকা এনেছে—পাঁচ সিকে না হলে এক কাঠা চাল কেউ বিক্রি করবে না। এক টাকার চাল কেউ দেবে না।
এরা সকলেই আশ্চর্য হয়ে গেলেও দেখলে যে চাল যদি সংগ্রহ করতে হয় তবে এই বেলা। বিলম্বে হতাশ হতে হবে। আরও পাঁচ-ছ’জন ক্রেতাকে দূরে আসতে দেখা যাচ্চে।
দু’জন লোক এদের মধ্যে নিরুপায়। ওদের হাতে বেশি পয়সা নেই। সুতরাং চাল কিনবার আশা ওদের ছাড়তে হল। এই দলে নবীন পাড়ুই পড়ে গেল।
গঙ্গাচরণ বললে—নবীন, চাল নেবে না?
—না বাবাঠাকুর, একটা সিকি কম পড়ে গেল।
—তবে তো মুশকিল। আমার কাছেও নেই যে তোমাকে দেবো।
—আধসের পুঁটিমাছ ধরেলাম সামটার বিলে। পেয়েলাম ছ’আনা। আর কাল মাছ বেচবার দরুণ ছেল দশ আনা। কুড়িয়ে-বুড়িয়ে একটা টাকা এনেলাম চাল কিনতি। তা আবার চালের দাম চড়ে গেল কি করে জানবো?
—তাই তো!
আধপেটা খেয়ে আছি দু’দিন। চাষীদের ঘরে ভাত আছে, আমাদের তা নেই। আমাদের কষ্ট সকলের অপেক্ষা বেশি। জলের প্রাণী, তার ওপরে তো জোর নেই? ধরা না দিলে কি করছি! যেদিন পালাম সেদিন চাল আনলাম, যেদিন পালাম না সেদিন উপোস। আগে ধান চাল ধার দিতো, আজকাল কেউ কিছু দেয় না।
গঙ্গাচরণ কাঠা দুই চাল সংগ্রহ করেছিল কাড়াকাড়ি করে। তার ইচ্ছে হল একবার এই চাল থেকে নবীন পাড়ুইকে সে কিছু দেয়। কিন্তু তা কি করে দেওয়া যায়, চালের অভাবে হয়তো উপোস করে থাকতে হবে কালই। গ্রামে ধান চাল মেলে না যে তা নয়, মেলে অতি কষ্টে। ধান চাল থাকলেও লোকে স্বীকার করতে চায় না সহজে।
নবীন পাড়ুইকে সঙ্গে নিয়ে গঙ্গাচরণ রাধিকানগরের বাজারে এল। এক টাকার চালই কিনে দেবে তাকে। দোকান ছাড়া তো হবে না। কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার, বড় বড় তিন-চারটি দোকান খুঁজে বেড়ালে, সকলেরই এক বুলি—চাল নেই।
গঙ্গাচরণের মনে পড়লো বৃদ্ধ কুণ্ডু মশায়ের কথা। এই গত বৈশাখ মাসেও কুণ্ডু মশায়ের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্চে সে, কুণ্ডু মশাই তাকে ডেকে আদর করে তামাক সেজে খাইয়ে বলচে—পণ্ডিত মশাই, আমার দোকান থেকে চাল নেবেন, ভালো চাল আনিয়েচি। কত খাতির করেচে।
কুণ্ডু মশায়ের দোকানে গেলে ফিরতে হবে না, ঠিক পাওয়া যাবেই। কিন্তু সেখানেও তথৈবচ, গঙ্গাচরণ দোকানঘরটিতে ঢুকবার সময় চেয়ে দেখলে বাঁ পাশের যে বাঁশের মাচায় চালের বস্তা ছাদ পর্যন্ত সাজানো থাকে, সে জায়গা একদম খালি, হাওয়া খেলচে।
বৃদ্ধ কুণ্ডু মশায় প্রণাম করে বললে—আসুন, কি মনে করে?
অভ্যর্থনার মধ্যে বৈশাখ মাসের আন্তরিকতা নেই যেন। প্রণামটা নিতান্ত দায়সারা গোছের।
গঙ্গাচরণ বললে—কিছু চাল দিতে হবে।
—কোথায় পাবো, নেই।
—এক টাকার চাল, বেশি নয়। এই লোকটাকে উপোস করে থাকতে হবে। দিতেই হবে আপনাকে।
কুণ্ডু মশায় সুর নিচু করে বললে—সন্ধের পর আমার বাড়ীতে যেতে বলবেন, খাবার চাল থেকে এক টাকার চাল দিয়ে দেবো এখন।
গঙ্গাচরণ বললে—ধান চাল কোথায় গেল? আপনার এত বড় দোকানের মাচা একদম ফাঁকা কেন?
—কি করবো বাপু, সেদিন পাঁচু কুণ্ডুর দোকান লুঠ হবার পর কি করে সাহস করে মাল রাখি এখানে বলুন। সবারই সে দশা। তার ওপর শুনচি পুলিসে নিয়ে যাবে চাল কম দামে মিলিটারির জন্যে।
—কে বললে?
—বলচে সবাই। গুজব উঠেচে বাজারে। আপনার কাছে মিথ্যে বলবো না, চাল আমি বাড়ী নিয়ে গিয়ে রেখে দিইচি। কিন্তু লোকের কাছে কবুল যাবো না, আপনাকে তাই বললাম, অন্যকে কি বলি?
—আমরা না খেয়ে মরবো?
—যদিন থাকবে, দেবো। তবে আমার জামাই গরুরগাড়ী করে বদ্দিবাটির হাটে কিছু চাল নিয়ে যেতে চাইচে। তাই ভাবচি।
—পাঠাবেন না, লুঠ হবে পথে। বুঝে কাজ করুন, কিছু চাল দেশে থাকুক, নইলে দুর্ভিক্ষ হবে যে! কি খেয়ে বাঁচবে মানুষ?
—বুঝি সব, কিন্তু আমি একা রাখলি তো হবে না। খাঁ বাবুরা এত বড় আড়তদার, সব ধান বেচে দিয়েচে গবর্নমেন্টের কনট্রাকটারদের কাছে। এক দানা ধান রাখে নি। এই রকম অনেকেই করেচে খবর নিয়ে দেখুন। আমি তো চুনোপুঁটি দোকানদার, পঞ্চাশ-ষাট মণ মাল আমার বিদ্যে।
গঙ্গাচরণ সন্ধ্যার অন্ধকারে চিন্তান্বিত মনে বাড়ীর পথে চললো।
নবীন পাড়ুই সঙ্গেই ছিল, তাকে যেতে হবে দোমোহানী, নতুন গাঁয়ের পাশেই। বললে—পণ্ডিত মশাই ছেলেন তাই আজ বাচকাচের মুখে দু’টো দানা পড়বে। মোদের কথা ওসব বড় দোকানদার কি শোনে! মোরা হলাম টিকরি মানুষ। কাল দু’টো মাছ পেটিয়ে দেবো আনে।
.
গঙ্গাচরণ বাড়ী নেই, পাঠশালায় গিয়েচে পড়াতে। হাবু ও পটল বাপের সঙ্গে পাঠশালায়। একা অনঙ্গ-বৌ রয়েছে বাড়ীতে। কে এসে ডাক দিলে—ও পণ্ডিত মশাই—বাড়ীতে আছ গা—
অনঙ্গ-বৌ কারো সামনে বড় একটা বার হয় না। বৃদ্ধ ব্যক্তি ডাকাডাকি করচে দেখে দোরের কাছে এসে মৃদুস্বরে বললে—উনি বাড়ী নেই। পাঠশালায় গিয়েচেন—
—কে? মা-লক্ষ্মী?
অনঙ্গ সলজ্জ ভাবে চুপ করে রইল।
বৃদ্ধটি দাওয়ায় উঠে বসে বললে—আমায় একটু খাবার জল দিতি পারবা মা-লক্ষ্মী?
অনঙ্গ তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে এক ঘটি জল নিয়ে এসে রাখলে। তারপর বাড়ীর গামছাখানা বেশ করে ধুয়ে ঘটির ওপর রেখে দিলে। একটু আখের গুড় ও এক গ্লাস জলও নিয়ে এল।
বললে—দু’কোষ কাঁটাল দেবো?
—খাজা না রসা?
—আধখাজা। এখন শ্রাবণ মাসে রসা কাঁটাল বড় একটা থাকে না।
—দাও, নিয়ে এসো—মা, একটা কথা—
—কি বলুন?
—আমি এখানে দু’টো খাবো। আমি ব্রাহ্মণ। আমার নাম দীনবন্ধু ভট্টাচার্য। বাড়ী কামদেবপুরের সন্নিকট বাসান-গাঁ।
অনঙ্গ-বৌ বললে—খাবেন বই কি। বেশ, একটু জিরিয়ে নিন। ঠাঁই করে দি—
একটু পরে দীনু ভটচাজ মোটা আউশ চালের রাঙা ভাত, ঢেঁড়শভাজা, বেগুন ও শাকের ডাঁটাচচ্চড়ি দিয়ে অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছিল। অনঙ্গ-বৌ বিনীতভাবে সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
দীনু খেতে খেতে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে যেন একটু দম নিলে। তারপর বললে—মা-লক্ষ্মীর রান্না যেন অমর্তো। চচ্চড়ি আর একটু দাও তো?
অনঙ্গ লজ্জা কুণ্ঠিত স্বরে বললে—আর তো নেই। ঢেঁড়শভাজা দুখানা দেবো?
—তা দাও মা।
এত বৃদ্ধ লোক যে এতগুলো ভাত এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলতে পারে, অনঙ্গ-বৌ নিজের চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করতো না। বললে—আর ভাত দেবো?
—তা দুটো দাও মা।
—মুশকিল হয়েচে, খাবেন কি দিয়ে। তরকারি বাড়ন্ত।
—তেঁতুল এক গাঁট দিতি পারবা?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—আমরা হলাম গিয়ে গরীব মানুষ। সব দিন কি মাছ-তরকারী জোটে? কোনো দিন হল না, তেঁতুল এক গাঁট দিয়ে এক পাত্তর ভাত মেরে দেলাম—
অনঙ্গের ভালো লাগছিল এই পিতার বয়সী সরল বৃদ্ধের কথাবার্তা। ইনি বোধ হয় খুব ক্ষুধার্ত ছিলেন। বলতে নেই, কি রকম গোগ্রাসে ভাত কটা খেয়ে ফেললেন। আরও থাকলে আরও খেতে পারতেন বোধ হয়। কিন্তু বড্ড দুঃখের বিষয়, ভাত-তরকারী আর ছিল না। খাওয়া-দাওয়ার পর অনঙ্গ বললে—তামাক সেজে দেবো?
—তোমাকে দিয়ে তামাক সাজাবো মা-লক্ষ্মী? না না, কোথায় তামাক বলো। আমি নিজে বলে তামাক সাজতি সাজতি বুড়ো হয়ে গেলাম। ঊনসত্তর বছর বয়েস হল।
—ঊনসত্তর?
—হ্যাঁ। এই আশ্বিন মাসে সত্তর পোরবে। তোমরা তো আমার নাতনীর বয়সী।
দীনু ভটচায হ্যা-হ্যা করে হেসে উঠলো কথার শেষে।
অনঙ্গ-বৌ নিজেই তামাক সেজে কল্কেয় ফুঁ দিতে দিতে এল, ওর গাল দুটি ফুলে উঠেচে, আগুনের আভায় রাঙা হয়ে উঠেচে।
দীনু শশব্যস্তে বললেন—ওকি, ওকি,—এই দ্যাখো মা-লক্ষ্মীর কাণ্ড!
—তাতে কি? এই তো বললেন—আমাকে নাতনীর সমবয়সী।
—না না, ওটা ভালো না। মা-লক্ষ্মী তুমি কেন তামাক সাজবে? ওটা আমি পছন্দ করি নে—দ্যাও হুঁকো আমার হাতে। ফুঁ দিতে হবে না।
অনঙ্গ-বৌ একটা মাদুর ও বালিশ নিয়ে এসে পেতে দিয়ে বললে—গড়িয়ে নিন একটু।
.
বেলা পাঁচটার সময় পাঠশালার ছুটি দিয়ে গঙ্গাচরণ বাড়ী ফিরে কে একজন অপরিচিত বৃদ্ধকে দাওয়ায় শুয়ে থাকতে দেখে কিছু বুঝতে পারলে না। পরে স্ত্রীর কাছে সব শুনে বললে—ও, কামদেবপুরের সেই বুড়ো ভটচায? চিনেচি এবার। কিন্তু তুমি তা হোলে না খেয়ে আছ?
অনঙ্গ বললে—আহা, আমি তো যা-তা খেয়েই এক বেলা কাটাতে পারি। কিন্তু বুড়ো বামুন, ওর না-খাওয়ার কষ্টটা—
—সে তো বুঝলাম। কিন্তু যা-তা খেয়ে যে কাটাবে—যা-তা ঘরে ছিলই বা কি?
—তোমার সে ভাবনা ভাবতে হবে না।
স্ত্রীকে গঙ্গাচরণ খুব ভালো করেই জানে। ওর সঙ্গে মিছে তর্ক করে কোনো লাভ নেই। মুখের ভাত অপরকে ধরে দিতে ও চিরকাল অভ্যস্ত। অথচ মুখ ফুটে বলবে না কখনো কি খেয়েচে না খেয়েচে। এমন স্ত্রী নিয়ে সংসার করা বড় মুশকিলের কাণ্ড। কত কষ্টে গত হাটে চাল যোগাড় করেছিল সে-ই জানে।
ইতিমধ্যে দীনু ভটচায ঘুম ভেঙে উঠে বসলো। বললে—এই যে পণ্ডিত মশাই!
গঙ্গাচরণ দু’হাত জুড়ে নমস্কার করে বললে—নমস্কার। ভালো?
দীনু হেসে বললে—মা-লক্ষ্মীর হাতে অন্ন খেয়ে আপাতোক খুবই ভালো। বড্ড জমিয়ে নিয়েচি। মা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী।
গঙ্গাচরণ মনে মনে বললে—ওর মাথাটি খেলে কেউ লক্ষ্মী, কেউ অন্নপূর্ণা বলে। আমি এখন মাঝে পড়ে মারা যাই।
মুখে বললে—হেঁ হেঁ, তা বেশ—তা আর কি—
—কোথা থেকে ফিরলেন?
—পাঠশালা থেকে।
—আমি একটু বিপদে পড়ে পরামর্শ করতে এলাম পণ্ডিত মশায়।
—কি বলুন?
—বলবো কি, বলতি লজ্জা হয়। চাল অভাবে সপুরী উপোস করতে হচ্চে। কম দুঃখে পড়ে আপনার কাছে আসি নি।
—কামদেবপুরে মিলচে না?
—আমাদের ওদিকি কোনো গাঁয়ে না। আর যদিও থাকে তো দেড় টাকা করে কাঠা বলচে। এ কি হল দেশে? আমার বাড়ী চার-পাঁচজন পুষ্যি। দেড় টাকা চালের কাঠা কিনে খাওয়াতে পারি আমি?
—এদিকেও তো ওই রকম ভটচায মশায়। আমাদের গাঁয়েও তাই।
—বলেন কি?
—ঠিক তাই। ও হাটে অতি কষ্টে দু’কাঠা চাল কিনে এনেছিলাম।
—ধান?
—ধান কেউ বিক্রি করচে না। করলেও ন’ টাকা সাড়ে ন’ টাকা মণ।
—এর উপায় কি হবে পণ্ডিত মশায়? আপনি বসুন, সেই পরামর্শ করতি তো আমার আসা। সত্যি কথা বলতি কি আপনার কাছে, কাল রাতি আমার খাওয়া হয় নি। চাল ছিল না ঘরে। মা-লক্ষ্মীর কাছে অন্ন খেয়ে বাঁচলাম। বুড়ো বয়সে খিদের কষ্ট সহ্যি করতে পারি নে আর।
—কি বলি বলুন, শুনে বড্ড কষ্ট হল। করবারও তো নেই কিছু। আমাদের গ্রামের অবস্থাও তথৈবচ।
দীনু ভটচায দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে—বুড়ো বয়সে এবারডা না খেয়ে মরতি হবে দেখচি।
গঙ্গাচরণ বললে—তাই তো পণ্ডিত মশাই, কি যে করি, বুঝতে তো কিছু পারি নে। তা ছাড়া আমাদের গাঁয়ের ব্যবস্থা এখান থেকে কি করে করা যাবে! কতটা চাল চান? চলুন দিকি একবার বিশ্বেস মশায়ের বাড়ী।
কিন্তু বিশ্বাস মশায়ের বাড়ী যাওয়া হবে কি, দীনু ভটচায ম্লানমুখে বললে—তাই তো, পয়সাকড়ি তো আনি নি।
গঙ্গাচরণ একটু বিরক্তির সুরে বললে—আনেন নি, তবে আর কি হবে? কি করতে পারি আমি?
গঙ্গাচরণ বোধ হয় একটু কড়া সুরে বলে ফেলেছিল কথাটা।
দীনু ভটচায হতাশভাবে বললে—তাই তো, এবারডা দেখচি সত্যিই না খেয়ে মরতি হবে।
গঙ্গাচরণ ভাবলে—ভালো মুশকিল! তুমি না খেয়ে মরবে তা আমি কি করবো? আমার কি দোষ?
এই সময় অনঙ্গ-বৌ দোরের আড়াল থেকে হাতনাড়া দিয়ে গঙ্গাচরণকে ডাকলে।
গঙ্গাচরণ ঘরের মধ্যে গিয়ে বললে—কি বলচ?
—জিজ্ঞেস করো উনি এখন দুখানা পাকা কাঁকুড় খাবেন? ঘরে আর তো কিছু নেই।
—থাকে তো দাও না। জিজ্ঞেস করতে হবে না। ফুটি কাঁকুড় কি দিয়ে দেবে? গুড় বা চিনি কিছুই তো নেই।
—সে ব্যবস্থার জন্যে তোমার ভাবতে হবে না। সে আমি দেখচি। আর একটা কথা শোনো। উনি অমন দুঃখু করচেন বুড়ো বয়েসে না খেয়ে মরবেন বলে, তোমাকে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। আমাদের বাড়ী এয়েচেন কেন, একটা হিল্লে হবে বলেই তো। আমি দুটো কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে ঘর করি। বুড়ো বামুন আমাদের বাড়ী থেকে শুধু হাতে শুধু মুখে ফিরে গেলে অকল্যাণ হবে না? তাছাড়া যখন আমাদের আশা করে এতটা পথ উনি এয়েচেন, এর একটা উপায় না করলে হয়?
গঙ্গাচরণ বিরক্ত মুখে বললে—কি উপায় হবে? খালি হাতে এসেচে বুড়ো! ও বড্ড ধড়িবাজ। একদিন অমনি কামদেবপুর থেকে ফিরবার পথে চালগুলো নিয়ে নিলে—
অনঙ্গ-বৌ জিভ কেটে বললে—ছিঃ ছিঃ—অতিথি নারায়ণ, আমার বাড়ী উনি এয়েচেন, আমাদের কত ভাগ্যি! ও কথাটি বোলো না। অতিথিকে অমন কথা বলতে আছে? কাকে কি যে বলো! নিয়েছেন চাল, নিয়েছেন। আমাদের বাপের বয়িসী মানুষ। ওঁকে অমন বোলো না—
—তা তো বুঝলাম, বলবো না! কিন্তু পয়সা না থাকলে চাল ধান পাবো কোথায়?
—উনি কি বলেন দ্যাখো—
—উনি যা বললেন বোঝাই গিয়েচে। উনি এয়েচেন ভিক্ষে করতে, সোজা কথা। মেগে পেতে বেড়ানোই ওঁর স্বভাব।
অনঙ্গ-বৌ ধমক দিয়ে বললে—আবার ওই সব কথা?
—তা আমি কি করব এখন? বলো তাই করি।
—শুধু হাতে উনি না ফেরেন। বাপের বয়িসী বামুন। না হয় আমার হাতের পেটি বাঁধা দিয়ে দুটো টাকা এনে ওঁকে চাল কিনে দাও। দিতেই হবে, না দিলে আমি মাথা খুঁড়ে মরবো। চাল তো আমাদেরও কিনতে হবে। রাতে রান্না হবে না।
গঙ্গাচরণ বাড়ীর বাইরে যাচ্ছিল, অনঙ্গ-বৌ বললে—পাকা কাঁকুড় দুখানা খেয়ে যাও। বেরিও না।
গঙ্গাচরণ বিরক্তির সুরে বললে—আমি বিনি মিষ্টিতে ফুটি কাঁকুড় খেতে পারি নে। ওসব বাঙালে খাওয়া তোমরা খাও।
অনঙ্গ-বৌ সকৌতুক হাসি হেসে চোখ নাচিয়ে বললে—বাঙাল বাঙাল করো না বলচি, ভালো হবে না! আমি বাঙাল, আর উনি এসেচেন একেবারে মুকসুদোবাদ জেলা থেকে—
—সে আবার কি গো? ও কথা তুমি আবার কোথায় শিখলে?
—শিখতে হয় গো, শিখতে হয়। সেই যে ভাতছালায় উত্তুরে ঘরামি জন ঘর ছাইতে আসতো, মনে পড়ে? ওরা বলতো না, মা, আমাদের বাড়ী মুকসুদোবাদ জেলা—হি-হি-হি—
একটু পরে বাইরের দাওয়ায় বসে দীনু ও গঙ্গাচরণ দু’জনেই পাকা ফুটি কাঁকুড় খাচ্ছিল খেজুরগুড়ের সঙ্গে। কোথায় অনঙ্গ-বৌ একটু খেজুরগুড় লুকিয়ে সঞ্চয় করে রেখেছিল সময় অসময়ের জন্যে। অনঙ্গ-বৌ ওই রকম রেখে থাকে। গঙ্গাচরণ জানে, অনেক সময় জিনিসপত্র ভেলকিবাজির মত বার করে অনঙ্গ।
দীনু ভটচায কাঁসার বাটী থেকে গুড়টুকু চেটেপুটে খেয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে—আহা, খেজুরগুড়ের মুখ এবার আর দেখি নি।
গঙ্গাচরণ বললে—তা বটে।
—আগে আগে পণ্ডিত মশায়, গুড় আমাদের কিনতি হত না। মুচিপাড়ায় বানে খেজুর রস জাল দিতো, ঘটি হাতে করে গিয়ে দাঁড়ালি আধ সের এক সের গুড় এমনি খেতি দিতো। সে সব দিন কোথায় যে গেল!
গঙ্গাচরণ বাড়ী থেকে বার হয়ে গেলেই অনঙ্গ-বৌ দাওয়ায় এসে দাঁড়িয়ে বললে—কাঁকুড় কেমন খেলেন?
—চমৎকার মা চমৎকার। তুমি সাক্ষাৎ মা-লক্ষ্মী, কি আর বলবো তোমায়। একটা কথা বলবো?
—কি বলুন না?
—মা একটু চা করে দিতি পারো?
অনঙ্গ-বৌ বিপন্ন মুখে বললে—চা?
—কতদিন চা খাইনি। মাসখানেক আগে সবাইপুরের গাঙ্গুলীবাড়ী গিয়ে একদিন চা খেয়েছিলাম। চা আমার বড্ড খেতি ভালো লাগে। আগে আগে বড্ড খ্যাতাম। এদানি হাতে পয়সা অনটন, ভাতই জোটে না বলে চা! আছে কি?
অনঙ্গ-বৌ ভেবে বললে—আচ্ছা, আপনি বসুন—
হাবুকে বাড়ীর মধ্যে গিয়ে বললে—হ্যাঁরে, কাপাসীর মা’র বাড়ী ছুটে যা তো। আমার নাম করে বলগে, একটু চা দাও। যদি সেখানে না থাকে, তবে শিবু ঘোষদের বাড়ী যাবি। চা আনতি হবে বাবা।
হাবু বললে—ও বুড়ো কে মা?
—যাঃ, বুড়ো বুড়ো কি রে? ও রকম বলতে আছে? বাড়ীতে নোক এলে তাকে মেনে চলতে হয়, শিখে রাখো।
—হ্যাঁ মা, চা দিয়ে কি হবে? চিনি নেই যে—
—তোর সে ভাবনার দরকার কি? তুই যা বাপু, চা একটু এনে দে—
আধঘণ্টা পরে প্রফুল্লবদনে দীনু ভটচাযের সামনে হাসি হাসি মুখে চায়ের গ্লাস স্থাপন করে অনঙ্গ-বৌ বললে—দেখুন তো কেমন হয়েচে? সত্যি কথা, চায়ের পাটাপাট তেমন তো নেই এ বাড়ীতে। কেমন চা করলাম কে জানে?
দীনু ভটচায চা-পূর্ণ কাঁসার গ্লাস কোঁচার কাপড়ে জড়িয়ে দু-হাতে ধরে এক চুমুক দিয়ে চোখ বুজে বললে—বাঃ, বেশ বেশ মা-লক্ষ্মী—এই আমার অমর্তো। দিব্যি হয়েচে—
এই সময় গঙ্গাচরণ বাড়ী ফিরে স্ত্রীকে বললে—চলো, ওদিকে একটা কথা শোনো।
অনঙ্গ-বৌ আড়ালে এসে নিচু সুরে বললে—কি?
—চাল আনলাম এক কাঠা বিশ্বেস মশায়ের বাড়ী থেকে চেয়ে-চিন্তে। আর ধারে তিন কাঠা ধানের ব্যবস্থা করে এলাম। দীনু ভটচাযকে কাল সকালে এনে দেবো। আজ আর বুড়ো নড়চে না দেখচি। ও খাচ্চে কি? চা নাকি? কোথায় পেলে? বুড়ো আছে দেখচি ভালোই। আর কি নড়ে এখান থেকে?
—তোমার অত সন্ধানে দরকার কি? তুমি একটু চা খাবে? দিচ্চি। আর ওঁকে অমন বোলো না। বলতে নেই। বুড়ো বামুন অতিথি—ছিঃ—
গঙ্গাচরণ মুখ বিকৃতি করে অতিথির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করলে। মুখে বললে—ওঃ, ভারি আমার অতিথি রে!
ধমক দিয়ে অনঙ্গ-বৌ বললে—ফের? আবার?