অশনি সংকেত – ১০

১০

পরদিন গঙ্গাচরণ শাঁখাজোড়া গ্রামের সর্ব স্যাকরার দোকানে বিক্রি করলে। সর্ব স্যাকরা বললে—এ জিনিস বিক্রি করবেন কেন?

—দরকার আছে।

কিন্তু চাল পাওয়ার যে এত বিপুল বাধা তা গঙ্গাচরণ জানতো না। শঙ্করপুরের নিবারণ ঘোষের বাড়ী চালের সন্ধান একজন দিয়েছিল। খুব ভোরে পরদিন উঠে সেখানে পৌঁছে দেখলে দশজন লোক সেখানে ধামা নিয়ে বসে। বাড়ীর মালিক তখনো ওঠে নি। নিবারণ দোর খুলে বাইরে আসতেই সবাই মিলে তাকে ঘিরে ধরলে। সে বললে—আমার চাল নেই—

গঙ্গাচরণ বললে—সে আমি জানি। তবুও তোমার মুখে শুনবো বলে এসেছিলাম—

গঙ্গাচরণ সেখানেই বসে পড়লো। চাল না নিয়ে ফিরবে কেমন করে? বাড়ীর সকলেই আজ দু’দিন থেকে ভাত খায় নি। ছেলেদের মুখের দিকে তাকালে কষ্ট হয়। অন্য কয়েকজন লোক যারা এসেছিল, তারা একে একে সবাই ফিরে গেল। নিবারণ ঘোষ বাইরের বাড়ী আর ভেতর বাড়ীর মধ্যেকার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

কতক্ষণ পরে নিবারণ ঘোষ আবার বাইরে এল। গঙ্গাচরণকে বসে থাকতে দেখে বললে—বাবাঠাকুর কি মনে করে বসে? চাল? সে দিতে পারবো না। ঘরে চাল আছে, সে তোমার কাছে অস্বীকার করতে যাচ্চি নে—শেষে কি নরকে পচে মরবো? কিন্তু সে চাল বিক্রি করলি এরপর বাচ-কাচ না খেয়ে মরবে যে।

—কত চাল আছে?

—দু’মণ।

—ঠিক?

—না ঠাকুরমশাই, মিথ্যে বলবো না। আর কিছু বেশী আছে। কিন্তু সে হাতছাড়া করলি বাড়ীসুদ্ধ না খেয়ে মরবে। ট্যাকা নিয়ে কি ধুয়ে খাবো? ও জিনিস পয়সা দিলি মেলবে না।

গঙ্গাচরণ উঠবার উদ্যোগ করছে দেখে নিবারণ হাত জোড় করে বললে—একটা কথা বলি বাবাঠাকুর। ব্রাহ্মণ মানুষ, এত দূর এয়েচেন চালির চেষ্টায়—আমি চাল দিচ্চি, আপনি আমার বাড়ীতে দুটো রান্না করে খান। রসুই চড়িয়ে দিন গোয়ালঘরে। মাছ পুকুর থেকে ধরিয়ে দিচ্চি, মাছের ঝোল ভাত আর গরুর দুধ আছে ঘরে। এক পয়সা দিতে হবে না আপনার।

গঙ্গাচরণ বললে—না, তা কি করে হয়? বাড়ীতে কেউ খায় নি আজ দু’দিন। ছেলেপিলে রয়েছে, তা হয় না। তুমি আমাকে রান্নার জন্যে তো চাল দিতেই, আর দুটো বেশী করে দাও। আমি দাম দিয়ে নেবো। ষাট টাকা করেই মণ দেবো, কিছু বেশি না হয় নাও।

নিবারণ কিছুতেই রাজী হল না। তার ওপর রাগ করা যায় না, প্রতি কথাতেই সে হাত জোড় করে, এখানে বসে খাওয়ার নিমন্ত্রণ তো করে রেখেচেই। গঙ্গাচরণ চলে আসছে, নিবারণ এসে পথের ওপরে আবার তাকে হাত জোড় করে রান্না করে খাওয়ার অনুরোধ জানালো।

গঙ্গাচরণ রাগ করে বললে—আমি কি তোমার বাড়ী খেতে এসেছি? যাও যাও—ওকথা বলো না—

কিন্তু গঙ্গাচরণের মনের মধ্যে আর সে জোর নেই। হঠাৎ তার মনের চক্ষে ভেসে উঠেছে, দিব্যি হিঙের টোপা টোপা বড়ি ভাসচে মাছের ঝোলে, আলু বেগুন, বড় বড় চিংড়ি মাছ আধভাসা অবস্থায় দেখা যাচ্চে বাটির ওপর। ভাতে সেই মাছের ঝোল মাখা হয়েচে। কাঁচা ঝাল একটা বেশ করে মেখে…

নিবারণ বললে—আসুন, চলুন। আমার একথা আপনাকে রাখতেই হবে। সে শোনবো না আমি। দুপুরবেলায় না খেয়ে বাড়ী থেকে ফিরে যাবেন?

হাবু ভাত খায় নি আজ দু’দিন। অনঙ্গ-বৌ খায় নি দু’দিনেরও বেশি। ও যে কি খায়-না-খায় গঙ্গাচরণ তার খবর রাখে না। নিজে না খেয়েও সবাইকে যুগিয়ে বেড়ায়। তার খাওয়া কি এখানে উচিত হবে? গঙ্গাচরণ বললে, আচ্ছা যদি খাই, তবে এক কাঠা চাল দেবে?

—না বাবাঠাকুর। মিথ্যে বলে কি হবে? চাল হাতছাড়া করবো না। আপনি একা এখানে বসে আধ কাঠা চাল রেঁধে খান তা দেবো।

—তোমার জেদ দেখচি কম নয়!

—এই আকালে এমনি করেছে। ভয় ঢুকে গিয়েছে যে সবারই।

—চাল আর যোগাড় করতে পারবে না?

—কোথা থেকে করবো বলুন! কোনো মহাজনের ঘরে ধান নেই। বাজারে এক দানা চাল আসে না। আমাদের গেরামের পেছনে একটা বিল আছে, জানেন তো? দাসপাড়ার বিল তার নাম। এখন এই তো বেলা হয়েছে, গিয়ে দেখুন সেখানে ত্রিশ-চল্লিশ জন মেয়েমানুষ জুটেছে এতক্ষণ। জলে পাঁকের মধ্যি নেমে পদ্মগাছের মূল তুলছে, গেঁড়ি-গুগলি তুলছে—জল-ঝাঁঝির পাতা পর্যন্ত বাদ দেয় না।

—বল কি?

—এই যাবার সময় দেখবেন সত্যি না মিথ্যে। যত বেলা হবে তত লোক বাড়বে, বিলির জল লোকের পায়ে পায়ে ঘোল দই হয়ে যাবে কাদা ঘুলিয়ে। এক-একজনের কাদামাখা পেত্নীর মতো চেহারা হয়েছে—তবুও সেই কাদা জলে ডুব দিয়ে পদ্মের মূল, গেঁড়ি-গুগলি এসব খুঁজে বেড়াচ্ছে।চেহারা দেখলি ভয় হয়। তাও কি পাচ্চে বাবাঠাকুর? বিল তো আর অফুরন্ত নয়। যা ছিল, তিন দিনের মধ্যে প্রায় সাবাড় হয়ে গিয়েচে। এখন মনকে চোখ ঠারা।

—তবে যাচ্ছে কেন?

—আর তো কোথাও কিছু খাবার নেই। যদি তবুও বিলের মধ্যি খুঁজলি পাওয়া যায়। ভেবে দেখুন বাবাঠাকুর, আপনাকে যদি চাল বেচি, তবে একদিন আমার বাড়ীর ঝি-বউদের অমনি করে পাঁক মেখে বিলের জলে নামতে হবে দুটো গেঁড়ি-গুগলি ধরে খাবার জন্যি। চলুন বাবাঠাকুর, আসুন দুটো খেয়ে যান। পেট ভর্তি চাল দেবো এখন।

গঙ্গাচরণ ফিরলো। মাছের ঝোল ভাত খেয়ে—গেঁড়ি-গুগলি সেদ্ধ নয়। এখনো এ গ্রামে এ দিনেও ভাত খেতে পাওয়া যাচ্চে। এর পরে আর পাওয়া যাবে কি না কে জানে।

গোয়ালঘর নিকিয়ে পুঁছে দিলে নিবারণের বিধবা বড়মেয়ে ক্ষ্যান্তমণি। কাঠ নিয়ে এক পাশে রাখলে। গঙ্গাচরণ পুকুরের জলে স্নান করে আসতেই ক্ষ্যান্তমণি তসরের কেটে-কাপড় কুঁচিয়ে হাতে দিলে। রান্নার জন্য কুটনো-বাটনা সব ঠিক করে এনে দিলে। একবার হেসে বললে—দাদাঠাকুর, অতটা নুন? পুড়ে যাবে যে বেন্নন!

—দেবো না?

—বেন্নন মুখে দিতে পারবেন না। আপনার রসুই করবার অভ্যেস নেই বুঝি?

—না।

—আপনি বসে বসে রাঁধুন, আমি দেখিয়ে দিচ্চি।

ক্ষ্যান্তমণি যে বেশ ভালো মেয়ে, গঙ্গাচরণ অল্প সময়ের মধ্যেই তা বুঝতে পারলে। কোথা থেকে একটু আখের গুড়, গাওয়া ঘি যোগাড় করে নিয়ে আসে। যাতে গঙ্গাচরণের খাওয়াটা ভালো হয়, সেদিকে খুব লক্ষ। খেতে বসে গঙ্গাচরণের কিন্তু ভাত যেন গলা দিয়ে নামে না—আশ্চর্যের কথা, হাবুর জন্যে দুঃখ নয়, পটলার জন্যেও নয়—দুঃখ হল অনঙ্গ-বৌয়ের জন্যে। সে আজ দুদিন খায় নি। তার চেয়ে হয়তো আরও বেশি দিন খায় নি। মুখ ফুটে তো কোনো দিন কিছু বলে না।

—আর একটু আখের গুড় দি?

—না। এ দুধ তো খাঁটি, গুড় দিলে সোয়াদ নষ্ট হয়ে যাবে।

এমন ঘন দুধের বাটিতে হাত ডুবিয়ে সে খাচ্চে এখানে, ওখানে অনঙ্গ-বৌ হয়তো উঠোনের কাঁটানটের শাকের বনে চুবড়ি নিয়ে ঘুরচে, অখাদ্য কাঁটানটে শাক তুলবার জন্যে। নইলে বেলা হতে না হতে পাড়ার ছেলেমেয়েরা এসে জুটবে। তাদের উৎপাতে গাছের পাতাটি থাকবার জো নেই।

ক্ষ্যান্তমণি পান আনতে গেল। পাতে দুটি ভাত পড়ে আছে—গঙ্গাচরণের প্রবল লোভ হল ভাত দুটি সে বাড়ী নিয়ে যায়। কিন্তু কি করে নিয়ে যাবে? চাদরের মুড়োয় বেঁধে? ছিঃ—সবাই টের পাবে। এঁটো ভাত ব্রাহ্মণ হয়ে চাদরের মুড়োয় বেঁধে নেবে?

গঙ্গাচরণ বসে বসে মতলব ভাঁজতে লাগলো—কি করা যাবে? বলা যাবে কি এই ধরনের যে, আমাদের বাড়ি একটা কুকুর আছে তার জন্যে ভাত কটা নিয়ে যাবো! তাতে কে কি মনে করবে? বড় লজ্জা করে যে! অনেকগুলো ভাত নয় বটে, তবুও চার-পাঁচ গ্রাস হবে অনঙ্গ-বৌয়ের। বড় বড় চার-পাঁচ গ্রাস। নিয়ে যাবেই সে। কিসের লজ্জা? এমন সময়ে ক্ষ্যান্তমণি এসে পান দিতেই ওর মুখের দিকে চেয়ে গঙ্গাচরণের সাহস চলে গিয়ে রাজ্যের লজ্জা ও সঙ্কোচ এসে জুটলো। দিব্যি সুন্দরী মেয়ে, যৌবন-পুষ্ট দেহটির দিকে বার বার চেয়ে দেখেও আশ মেটে না। কালো চুল মাথায় একঢাল, নাকের ডগায় একটা ছোট্ট তিল। মুখে দু-দশটা বসন্তের দাগ আছে বটে, তবুও ক্ষ্যান্তমণির সুশ্রী মুখ।

গঙ্গাচরণ বললে—ক্ষ্যান্ত, তোমার বসন্ত হয়েছিল?

—হ্যাঁ দাদাঠাকুর। আজ তিন বছর আগে।

—ডাবের জল দিয়ে মুখ ধুলে ও দাগ কটা আর থাকতো না।

—আপনিও যেমন দাদাঠাকুর! আর কি হবে মুখের চেহারা নিয়ে বলুন? সে দিন চলে গিয়েচে—কপাল যেদিন পুড়েচে, হাতের নোয়া ঘুচেছে। এখন আশীর্বাদ করুন, যেন ভালোয় ভালোয় যেতে পারি।

তারপর চুপি চুপি বললে—আপনি ওই পুকুরের বাঁশঝাড়ের ধারে দাঁড়িয়ে থাকুন গিয়ে।

গঙ্গাচরণ সবিস্ময়ে বললে—কেন?

—চুপ চুপ। বাবাকে লুকিয়ে দুটো চাল দিচ্চি আপনাকে। কাউকে বলবেন না। আধ পালিটাক চাল আমি আলাদা করে রেখে দিইচি আপনার রান্নার চাল আনবার সময়। নিয়ে যান চাল কটা। আপনার মন খারাপ হয়েচে বাড়ীর জন্যি আমি তা বুঝতে পেরেচি।

মেয়েরাই লক্ষ্মী। মেয়েরাই অন্নপূর্ণা। বুভুক্ষু জীবের অন্ন ওরাই দু’হাতে বিলোয়। ক্ষ্যান্তমণিকে আঁচলের মুড়োতে লুকিয়ে চাল আনতে দেখে দূর থেকে গঙ্গাচরণের ওই কথাই মনে হল। ক্ষ্যান্ত গঙ্গাচরণের পায়ের ধুলো নিয়ে বললে—হাতে করে দুটো চাল দেবো ব্রাহ্মণকে, এ কত ভাগ্যি! কিন্তু বাবাঠাকুর, যে আকাল পড়েচে, তাতে কাউকে কিছু দেবার জো নেই। সবই অদেষ্ট। লুকিয়ে নিয়ে যান—

—লুকিয়েই নিয়ে যাচ্ছি—

—না লুকিয়ে গেলি নোকে চেয়ে নেবে। না দিলি কান্নাকাটি করবে, এমন মুশকিল হয়েচে। আমাদের গাঁয়ে তো দোর বন্ধ না করে দুপুরে খেতে বসবার জো নেই। সবাই এসে বলবে, ভাত দ্যাও। দেখে দুঃখুও হয়—কিন্তু কতজনকে দেবেন আপনি? খ্যামতা যখন নেই, তখন দোর বন্ধ করে থাকাই ভালো। একটা কথা বলি—

—কি?

—যদি কখনো এমন হয়, না খেয়ে থাকতি হয়, তবে আমার কাছে আসবেন, আমি যা পারি দেবো। আমার নিজের সোয়ামী-পুত্তুর নেই, দেবতা ব্রাহ্মণের সেবাও যদি না করলাম, তবে জীবনে করলাম কি বলুন!

.

বাড়ী ফিরবার পথে নসরাপুরের বিলের ধারে একটা দোকান। বেলা পড়ে এসেছে। দোকানীকে তামাক খেতে দেখে গঙ্গাচরণ দোকানে গিয়ে উঠে বললে—তামাক খাওয়াও দিকি একবার—

দোকানী বললে—আপনারা?

—ব্রাহ্মণ।

—পেরণাম হই।

—জয়ন্ত।

দোকানী উঠে গিয়ে একটা কলার পাতা নিয়ে এসে ঠোঙা করে কল্কে বসিয়ে গঙ্গাচরণের হাতে দিলে—বললে—আপনার নিবাস?

—নতুনপাড়া, চর পোলতা।

—গিয়েছিলেন কোথায়?

—নিবারণের বাড়ী, ও গাঁয়ের নিবারণ ঘোষ।

—বাবাঠাকুরের পুঁটুলিতে কি? চাল?

—হ্যাঁ বাপু।

—ঢেকে রাখুন। এসব দিকে বড্ড আকাল। এখুনি এসে ঘ্যান ঘ্যান করবে সবাই।

গঙ্গাচরণ বসে থাকতে থাকতে তিন-চারটি দুলে বাগদি জাতীয় স্ত্রীলোক এসে আঁচলে বেঁধে কলাই নিয়ে গেল। একজন নিয়ে গেল অপকৃষ্ট পাতা চা ও একটা ছোট্ট পাথরবাটিতে একবাটি গুড়। দোকানী বললে—বসুন ঠাকুরমশায়—

—না বাপু, আমি যাবো অনেক দূর—উঠি।

—না, একটু চা খেয়ে যেতেই হবে। আর তো কিছু দেওয়ার নেই, বসুন—

—চা খাবো আবার।

—হ্যাঁ, একটুখানি খেয়ে যান দয়া করে।

—আরও পাঁচ-ছটি খদ্দের দোকানে এল গেল। সকলেই নিয়ে গেল কলাই। শুধু কলাই, আর কিছু নয়।

চা একটু পরে তৈরি হয়ে এল, একটা কাঁচের গ্লাসে করে দোকানী ওকে চা দিলে। গঙ্গাচরণ লক্ষ করলে দোকানের মধ্যে তাকে, মেজের ওপর, নানা জায়গায় পেতল কাঁসার বাসন থরে থরে সাজানো। বেশির ভাগ থালা আর বড় বড় জামবাটি। গঙ্গাচরণ ব্যাপারটা বুঝতে পারলে না, এরা কি কাঁসারি? বাসন কেন এত বিক্রির জন্যে?

দোকানী আবার তামাক সাজলে। গঙ্গাচরণের মনের কথা বুঝতে পেরে বললে—ও বাসন অত দেখচেন, ওসব বাঁধা দিয়ে গিয়েচে লোকে। এ গাঁয়ে বেশির ভাগ দুলে বাগদি আর মালো জাতের বাস। নগদ পয়সা দিতি পারে না, ওই সব বাসন বাঁধা দিয়ে তার বদলে কলাই নিয়ে যায়।

—সবাই কলাই খায়?

—তা ছাড়া কি মিলবে ঠাকুরমশায়। ওই খাচ্চে—

—তোমার চাল নেই?

—না ঠাকুরমশায়।

—আমি দাম দেবো, সত্যি কথা বলো। নগদ দাম দেবো।

—না ঠাকুরমশায়। হাত জোড় করে বলচি ও অনুরোধ করবেন না।

—তোমরা কি খাও বাড়ীতে?

—মিথ্যে কথা বলবো না, ভাত চার আনা, কলাই বারো আনা। ডাঁটা শাক দুটো করেলাম বাড়ীতে, তা সে রাখবার উপায় নেই। দিনমানেই ক্ষেতে লোকজন, মেয়েছেলে, খোকা-খুকীরা ঢুকে গোছা গোছা উপড়ে নিয়ে যাচ্চে। সাবাড় করে দিয়েচে সব। কিছু রেখে খাবার জো নেই। চালকুমড়ো ফলেছিল গোটাকতক এই দোকানের চালে, কে তুলে নিয়ে গিয়েচে।

গঙ্গাচরণ তামাক খাওয়া সেরে ওঠবার যোগাড় করলে, দোকানী বললে—ঠাকুরমশায় কলাই নেবেন?

—দাও।

—নিয়ে যান সেরখানেক। এর দাম আপনাকে দিতে হবে না। আর একটা জিনিস—দাঁড়ান, গোটাকতক পেয়ারা দিই নিয়ে যান, আমার গাছের ভালো পেয়ারা—তাও আর কিছু নেই, সব পেড়ে নিয়ে গেল ওরা। আমি ডাঁসা দেখে দশ-বারোটা জোর করে কেড়ে নিয়ে রেখেছিলাম।

.

গঙ্গাচরণ বাড়ী পৌঁছে দেখলে অনঙ্গ-বৌ চুপ করে শুয়ে আছে। এমন সময়ে সে কখনো শুয়ে থাকে না।

গঙ্গাচরণ জিজ্ঞেস করলে—শুয়ে কেন? শরীর ভালো তো? দেখি—

অনঙ্গ-বৌ যন্ত্রণাকাতর হয়ে বললে—কাউকে ডাকো।

—কাকে ডাকবো?

—কাপালীদের বড়-বৌকে ডাকো চট করে। শরীর বড্ড খারাপ।

গঙ্গাচরণ বড় ছেলেকে বললে—দৌড়ে যা কাপালী-বাড়ী—বলগে এক্ষুণি আসতে হবে! মার শরীর খারাপ—

অন।-বৌ যন্ত্রণায় চীৎকার করতে লাগলো, কখনো ওঠে কখনো বসে। যূপবদ্ধ আর্ত পশুর মত চীৎকার। গঙ্গাচরণ নিরুপায় অবস্থায় বাইরের দাওয়ায় বসে তামাক টানতে লাগলো। তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েচে, আকাশে পঞ্চমী তিথির এক ফালি চাঁদও উঠেচে। ঝিঁঝিঁ ডাকচে লেবুঝোপে। গঙ্গাচরণ আর সহ্য করতে পারচে না অনঙ্গ-বৌয়ের চীৎকার। ওর চোখে প্রায় জল এল। ততক্ষণে বাড়ীর মধ্যে আশেপাশের বাড়ীর মেয়েছেলে এসে গিয়েচে।

ওদের মধ্যে একজন বর্ষীয়সীকে ডেকে গঙ্গাচরণ উদভ্রান্ত সুরে জিজ্ঞেস করলে—দিদিমা, বলি ও অমন করছে কেন?

ঠিক সেই সময় একটা যেন মৃদু গোলমাল উঠলো। একটি শিশুকণ্ঠের ট্যাঁ ট্যাঁ কান্না শোনা গেল। বার-কয়েক শাঁক বেজে উঠলো।

সতীশ কাপালীর মেয়ে বিন্দি বাড়ীর ভেতর থেকে ছুটে এসে বললে—ও দাদাবাবু, বৌদিদির খোকা হয়েচে—এখন সন্দেশ বের করুন আমাদের জন্যে—দিন টাকা—

গঙ্গাচরণের চোখ বেয়ে এবার সত্যিই ঝর ঝর করে জল পড়লো।

.

তারপর দিনকতক সে কি কষ্ট! প্রসূতিকে খাওয়ানোর কি কষ্ট! না একটু চিনি, না আটা, না মিছরি। অনঙ্গ-বৌ শুয়ে থাকে, নবজাত শিশু ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কাঁদে, গঙ্গাচরণ কাপালীদের বড়-বৌকে বলে—ওর খিদে পেয়েচে, মুখে একটু মধু দ্যাও খুড়ী—

—মধু খেয়ে বমি করেছে দুবার। মধু পেটে রাখছে না।

—তবে কি দেবে খুড়ী, দুধ একটু জ্বাল দিয়ে দেবো?

—অত ছোট ছেলে কি গাইয়ের দুধ খেতে পারে? আর ইদিকি আঁতুড়ে পোয়াতি ঘরে, তার খাবার কোনো যোগাড় নেই। হিম হয়ে বসে থাকলে চলবে না বাবাঠাকুর, এর যোগাড় কর।

গ্রামে কোনো কিছু মেলে না, হাটেবাজারেও না। আটা সুজি বা চিনি আনতে হলে যেতে হবে মহকুমা শহরে সাপ্লাই অফিসারের কাছে। গঙ্গাচরণ দু’একজনের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলে, মহকুমা শহরেই যেতে হবে।

সাড়ে সাত ক্রোশ পথ।

সকালে রওনা হয়ে বেলা এগারোটার সময় সেখানে পৌঁছলো। এখানে দোকানে অনেক রকম জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। গঙ্গাচরণের হাতে পয়সা নেই, জলখাবারের জন্য মাত্র দু’আনা রেখেছিল, কিন্তু খাবে কি, চিঁড়ে পাঁচসিকে সের, মুড়িও তাই। মুড়কি চোখে দেখবার জো নেই। দু’আনার মুড়ি একটা ছোট্ট বাটিতে ধরে।

ক্ষেত্র কাপালী বললে—ও দাদাঠাকুর, এ যে ভয়ানক কাণ্ড দেখছি! খাবা কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *