অশনি সংকেত – ২

গঙ্গাচরণের পাঠশালা বেশ জমে উঠেছে।

আজ সকালে সাত-আটটি নতুন ছাত্র দড়ি-বাঁধা মাটির দোয়াত হাতে ঝুলিয়ে এসে উপস্থিত। গঙ্গাচরণ তাদের নিয়ে বেলা দুপুর পর্যন্ত ব্যস্ত রইল। ছাত্রদের মধ্যে সকলেই স্থূলবুদ্ধি, ওদের বাপ-ঠাকুরদাদা কখনও নিজের নাম লিখতে শেখে নি, জমি চষে কলা বেগুন করে জীবিকানির্বাহ করে এসেচে, লেখাপড়া শেখাটা এদের বংশে একেবারে অভিনব পদার্থ।

গঙ্গাচরণ বললে, সকাল থেকে চেষ্টা করে ক’য়ের আঁকুড়ি দিতে শিখলি নে? তা শিখবি কোথা থেকে? এখন ওসব আঙুল সোজা হ’তে ছ’মাস কেটে যাবে। লাঙলের মুঠি ধরে ধরে আড়ষ্ট হয়ে আছে যে! এই ভুতো, যা একটু তামাক সেজে নিয়ে আয় দিকি! রান্নাঘরে তোর কাকিমার কাছ থেকে আগুন নিয়ে আয়—

দুটি ছাত্র ছুটলো তখুনি আগুন আনতে।

গঙ্গাচরণ হেঁকে বললে—এই! যাবার দরকার কি তোমার?—ভুতো একাই পারবে।

অন্য একটি ছেলের দিকে চেয়ে বললে—তোর বাবা বাড়ী আছে?

ছেলেটি বললে—হ্যাঁ সার—

—কাল যেন আমায় এসে কামিয়ে যায় বলে দিস—

—সার, বাবা কাল ভিনগাঁয়ে কামাতে গিয়েচে।

—এলে বলে দিস, এখানে যেন আসে।

অনঙ্গ-বৌ ডেকে পাঠালে বাড়ীর মধ্যে থেকে।

গঙ্গাচরণ গিয়ে বললে—ডাকছিলে কেন?

অনঙ্গ বললে—শুধু ছেলেদের নিয়ে বসে থাকলে চলবে? কাঠ ফুরিয়েছে, তার ব্যবস্থা দ্যাখো—

গঙ্গাচরণ আশ্চর্য হবার সুরে বললে—সে কি? এই যে সেদিন কাঠ কাটিয়ে দিলাম এক গাড়ী! সব পুড়িয়ে ফেললে এর মধ্যে?

অনঙ্গ রাগ করে বললে—কাঠ কি খাবার জিনিস যে খেয়ে ফেলেচি? রোজ এক হাঁড়ি ধান সেদ্ধ হবে, চিঁড়ে কোটা হল দশ-বারো কাঠা—এতে কাঠ খরচ হয় না?

অনঙ্গ কথাটা একটু গর্ব ও আনন্দের সুরেই বলল, কারণ সে যে দরিদ্র ঘর থেকে এসেচে, সেখানে একদিনে এত ধানের চিঁড়ে-কোটারূপ সচ্ছলতা স্বপ্নের বিষয় ছিল—সে দারিদ্র্যের মধ্যে এসে পড়েছিল প্রথম শ্বশুরবাড়ী এসে, এখন সে-কথা ভাবতেও পারা যায় না।

বাসুদেবপুর এসে আগের চেয়ে অবিশ্যি অবস্থা ভালোই হয়েছিল। তবে সে গ্রামে শুধু পাঠশালার ছেলে পড়ানোর আয় ছিল সম্বল, জিনিসপত্র কেউ দিত না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এখনও বাসুদেবপুর নিয়ে কথা ওঠে।

সেদিনই দুপুরের পর আহারান্তে গঙ্গাচরণ একটু বিশ্রাম করছিল, অনঙ্গ এসে বললে—বাসুদেবপুর আবার যাবার ইচ্ছে আছে?

গঙ্গাচরণ বিস্ময়ের সঙ্গে বললে—কেন বল দিকি?

—না, তাই বলচি। সেখানকার ঘরখানা তো এখনও রেখেই দিয়েচ, বিক্রি করেও তো এলে না!

—তখন কি জানি এখানে বেশ জমে উঠবে?

—ভাতছালার জন্যে কিন্তু মন কেমন করে। সেখানকার পদ্মবিলের কথা মনে আছে?

—পদ্মবিল তো ভালোই ছিল। বেশ জল।

—চত্তির মাসে জল থাকতো না বটে, কিন্তু না থাকুক বাপু, গাঁখানার লোকগুলো ছিল বড্ড ভালো। তিনদিকে মাঠ, একদিকে অতবড় বিল, সুন্দর দেখতে ছিল।

—তুমি তো বলেছিলে পদ্মবিলের ধারে ঘর বাঁধবে!

—ভেবেছিলাম নতুন খড় উঠলেই পদ্মবিলের ধারে ঘর তৈরী করবো। লোকজনকে বলেও রেখেছিলাম। সস্তায় খড় দিত।

অনঙ্গ আপনমনে হিসেব করবার ভঙ্গিতে বললে আঙুল গুনে গুনে—হরিহরপুরে বিয়ে হল, সেখান থেকে ভাতছালা, তারপর বাসুদেবপুর, তারপর এখানে। অনেক দেশ বেড়ানো হল আমাদের—কি বলো?

গঙ্গাচরণ গর্বের সুরে বললে—বলি হরিহরপুর গাঁয়ের ক’জন এত দেশ দেখে বেড়িয়েচে?

অনঙ্গ বললে—শুধু দেখে বেড়ানো কি বলো গো! বাসও করা হয়েচে!

—নিশ্চয়ই।

—কিন্তু একটা কথা বাপু…

—কি?

—এ গাঁ ছেড়ে অন্য কোথাও আর যেও না।

—যদ্দিন চলা-চলতির সুবিধে থাকে, থাকবো বৈকি। এখন তো বেশই হচ্ছে—বিশ্বাস মশায় এ গাঁয়ের মোড়ল। সে যখন ভরসা দিয়েচে, তখন আর ভয় করিনে—

—তা তো বুঝলাম, কিন্তু তোমার যে মন টেকে না কোথাও বেশিদিন!

—হাতে পয়সা এলেই মন টিকবে। তা ছাড়া দিব্যি নদী—

—আমার কিন্তু ইচ্ছে করে একবার ভাতছালা দেখতে।

—তা একবার গেলেই হয়। গরুর গাড়ীতে একদিনের রাস্তা। বিশ্বেস মশায়ের কাছে বললেই গরুর গাড়ী দিতে পারে।

অনঙ্গ আগ্রহের সঙ্গে বললে—হ্যাঁগা তা বলো না। বলবে একবার বিশ্বেস মশায়কে?

গঙ্গাচরণ হেসে বললে—কেন? ভাতছালা যাবার খুব ইচ্ছে?

—খু-উ-ব।

—তুমি তাহলে পটল আর খোকাকে নিয়ে ঘুরে এসো একদিন।

—কেন তুমি?

—আমার পাঠশালার ছুটি কই? আচ্ছা দেখি চেষ্টা করে।

—কতকাল যাই নি ভাতছালা। চার বছর কি পাঁচ বছর। ভাতছালার বিনি নাপতিনীকে মনে আছে? আহা, কি ভালোই বাসতো। আবার দেখা হলে সেও কত খুশী হয়! সেই—সেই আমবাগানের ধারে আমাদের ঘরখানা—আচ্ছা কত জায়গায় ঘর বাঁধলে বলো তো?

গল্পগুজবে শীতের বেলা পড়ে এল। গঙ্গাচরণ উঠে বললে—যাই। একবার পাশের গাঁয়ে যাবো। পাঠশালার জন্যে আরও ছাত্র যোগাড় করে আনি। ছাত্র যত বেশি হবে ততই সুবিধে।

—একটু কিছু জল খেয়ে যাও—

গঙ্গাচরণ আহ্লাদে হেসে বললে—অভ্যেস খারাপ করে দিও না বলচি। এ সময় জলখাবার খেয়েছি কবে?

অনঙ্গ হাসিমুখে বললে—মা-লক্ষ্মী যখন জুটিয়ে দিয়েচেন তখন খাও। দাঁড়াও আমি আনি—

একটা পাথরের বাটিতে কয়েক টুকরো পেঁপে কাটা ও আখের টিকলি এবং অন্য একটা কাঁসার বাটিতে খানিকটা সর নিয়ে অনঙ্গ-বৌ স্বামীর সামনে রাখলে। গঙ্গাচরণ খেতে খেতে বললে—আচ্ছা, একটা কাজ করলে হয় না?

—কি?

—আচ্ছা, একটু চায়ের ব্যবস্থা করলে হয় না?

অনঙ্গ ঠোঁট উল্টে বললে—ওঃ, তোমার যদি হল তো সব চাই! চা!

—কেন?

—ওসব বড়মানুষে খায়। গরীবের ঘরে কি পোষায়?

গঙ্গাচরণ হেসে বললে—আসলে তুমি চা তৈরী করতে জান না তাই বলো!

অনঙ্গ মুখভঙ্গি করে বললে—আহা-হা!

—পারো চা করতে? কোথায় করলে তুমি?

অনঙ্গ এক ধরনের হাসলে, যার মানে হচ্ছে, আর ভান করে কি করবো?

গঙ্গাচরণ বললে—কেমন, ধরে ফেলেচি কি না?

অনঙ্গ প্রত্যুত্তরে আর একবার হেসে বললে—না করি, করতে দেখেচি তো! বাসুদেবপুরে চক্কত্তি-বাড়ী চা খেতো সবাই। আমি গিন্নীর কাছে বসে বসে দেখতাম না বুঝি?

গঙ্গাচরণ পাশের গ্রামে যখন মাঠের পথ দিয়ে বেরিয়ে গেল তখন বেলা বেশ পড়ে এসেচে। সারাদিনের তাজা খর রোদে উলু ও কাশবনে কেমন সুন্দর একটা সোঁদা গন্ধ। শীতও আজ পড়েচে মন্দ নয়।

একটা লোক খেজুর গাছে মাটির ভাঁড় নিয়ে উঠচে দেখে গঙ্গাচরণ ডেকে বললে—বলি ও ছিদাম, একদিন খেজুর-রস খাওয়াও বাবা।

লোকটা গাছের ওপর থেকেই বললে—গুরুমশায়? কাল সকালে পেটিয়ে দেবেন একটা ছেলে। এক ভাঁড় যেন নিয়ে যায়—

গঙ্গাচরণের মনে যথেষ্ট আনন্দ ও সন্তোষ এই ভেবে যে, কেউ তার কথা এখানে ঠেলতে পারে না। সবাই মানে, যার কাছে যে জিনিস চাওয়া যায়, কেউ দিতে অস্বীকার করে না। বাসুদেবপুরে এমন ছিল না, ভাতছালাতেও না।

পাশের গ্রামের কোনো নাম নেই—‘পশ্চিমপাড়া’ বলে সবাই। এর একটা কারণ—এসব গ্রাম আজ কয়েক বৎসর হল বসেচে। আগে এসব পতিত মাঠ বা অনাবাদী চর ছিল, এদেশের চাষাদের জমির অভাব ছিল না, তাদের মধ্যে কেউ এসে সব জঙ্গল ও নলখাগড়া ভরা পতিত জমিতে চাষ করতে রাজী নয়। অন্য জেলা থেকে কাপালী জাতীয় চাষীরা এসে এই অনাবাদী চরে সোনা ফলিয়েছে, এরাই নতুন গ্রামগুলো বসিয়েছে—গ্রামের নামকরণ এখনও হয় নি।

পশ্চিমপাড়াতে ঢুকেই গ্রামের মণ্ডপ ঘর। বিকেলে দু-পাঁচজন লোক এখানে বসে তামাক পোড়াচ্চে।

একজন গঙ্গাচরণকে দেখে বললে—কি মনে করে দাদাঠাকুর? পেরণাম হই। আসুন—

গঙ্গাচরণ ভড়ং দেখাবার জন্যে ফতুয়ার নিচে থেকে পৈতেটা বার করে আঙুলে জড়িয়ে হাত তুলে বললে—জয়স্তু!

তারপর বসে একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললে—এটা বেশ ঘরখানা করেচ তো? পুজো হয়?

দলের মধ্যে একজন গঙ্গাচরণকে তামাক খাওয়াবার জন্যে কলাপাত আনতে ছুটলো। একজন বললে—পুজো হয় নি দাদাঠাকুর। সামনের বারে করবার ইচ্ছে আছে—আচ্ছা, আপনি পারবেন দাদাঠাকুর?

গঙ্গাচরণ অবজ্ঞাসূচক হাসি হেসে চুপ করে রইল, উত্তর দিলে না। ওতে পসার থাকে না।

ওদের মধ্যে আর একজন পূর্বের লোকটিকে ধমক দিয়ে বললে—জানিস নে শুনিস নে কথা বলতে যাস—ওই তো তোর দোষ! উনি জানেন না পুজো কত্তি তো কে করবে? উনি নেকাপড়া জানা পণ্ডিত মানুষ।

গঙ্গাচরণ ধীরভাবে বললে—থাক থাক, ও ছেলেমানুষ বলেচে বলেচে—

ইতিমধ্যে কলার পাতা এল, একজন হুঁকো থেকে কল্কে খুলে গঙ্গাচরণের হাতে দিতে যেতেই গঙ্গাচরণ বিস্মিতভাবে বললে—কি?

—তামাক ইচ্ছে করুন—

—তোমাদের উচ্ছিষ্ট কলকেতে আমি তামাক খাবো?

দলের যে লোকটি কল্কে এগিয়ে হাতে দিতে গিয়েছিল, সে দস্তুরমত অপ্রতিভ হল।

তখন ওদের মধ্যে সেই বিজ্ঞ লোকটি আবার ধমক দিয়ে বললে—এ কি পাঁচুঠাকুরকে পেয়েছিস তোরা, কাকে কি বলিস তার ঠিক নেই। দাঁড়ান দাদাঠাকুর, আমার বাড়ীতে নতুন কলকে আড়ায় টাঙানো আছে, নিয়ে আসি।

গঙ্গাচরণ গম্ভীরভাবে বললে—হাত ধুয়ে এনো—

উপস্থিত লোকগুলি ভক্তিতে গদগদ হয়ে পড়লো। হাত ধুয়ে নতুন কল্কেতে তামাক সাজতে হয় যার জন্যে, এমন ব্রাহ্মণ সত্যি কথা বলতে গেলে তারা কখনো দেখে নি।

নতুন কল্কে আনীত হল, নতুন কলাপাতাও। গঙ্গাচরণের হাতে ভক্তিভাবে টাটকা-সাজা তামাক এগিয়ে দেওয়া হল।

গঙ্গাচরণ বললে—কথাবার্তা বলতে হয় বুঝে-সুজে বাপু। আমি পুজো করতে জানি না-জানি তোমরা যে জিজ্ঞেস করলে—তোমরা এর কিছু বুঝবে?

বিজ্ঞ লোকটি তাচ্ছিল্যের সুরে বললে—হুঁ, একদম অর্গ মুখ্যু!

এই কথা বলে নিজের বিজ্ঞতা প্রমাণ করে সে গঙ্গাচরণের দিকে চেয়ে বললে—বাদ দিন ওদের কথা। ওরা কাকে কি বলতে হয় জানে?

গঙ্গাচরণ বললে—সে কথা যাক গে। এখন তোমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য কি জানো?

দলের অন্য লোকেরা কথা বলতে সাহস না করতে শুধু বিজ্ঞ লোকটিই এর উত্তরে বললে—কি বলুন দাদাঠাকুর?

—আমি একটা পাঠশালা খুলেচি নতুন গ্রামে। তোমাদের গ্রামের ছেলেগুলি সেখানে পাঠাতে হবে।

—বেশ কথা দাদাঠাকুর। এ তো খুব ভালো। আমাদের ছেলেপিলেদের একটা হিল্লে হয় তা হলে—

—খুব ভালো। সেজন্য তো আমি এলাম তোমাদের কাছে। তুমি একবার সবাইকে বলো—

লোকটি দলের দিকে চেয়ে বললে—শুনলে তো সবাই দাদাঠাকুর যা বললেন? আপনি বসুন, আমি ওদের ডেকে নিয়ে একটু পরামর্শ করি—

একটা কাঁটালতলায় সকলে মিলে জোট পাকিয়ে কি বলা-কওয়া করলে, তারপর বিজ্ঞ লোকটি আবার ফিরে এসে গঙ্গাচরণের কাছে বসলো। বললে—সব ঠিক হয়ে গেল দাদাঠাকুর—

—কি?

—সবাই ছেলে পেটিয়ে দেবে কাল থেকে। ওনারা আর একটা কথা বলচেন—

—কি কথা?

—আমাদের এখেনে যদি পাঠশালা খোলেন তবে কেমন হয়?

—দু’জায়গায় হয় না। ও গ্রামে বাস করি, এ গ্রামে পাঠশালা—তাও হয় না।

—কত দিতে হবে আমাদের, একটা ঠিক করে দ্যান—

—আমার বাপু জোরজবরদস্তি নেই, বিদ্যাদানং মহাপুণ্যং, বিদ্যাদান করলে কোটি অশ্বমেধের ফল লাভ হয়। তবে আমারও তো চলা-চলতির ব্যবস্থা একটা চাই, এই বুঝে তোমরা যা দাও। নিজেরাই ঠিক করো। আমার মুখে বলাটা ভালো হবে না।

গঙ্গাচরণ অভিজ্ঞ ব্যক্তি। এভাবে অগ্রসর হলে ফল ভালো হয় সে জানে। কাজেই বাড়ীতে ফিরে অনঙ্গ যখন বললে—তা ওদের ওপর ফেলে দিলে কেন? তোমার নিজের বলা উচিত ছিল—তখন গঙ্গাচরণ হেসে বললে—আরে না জেনে কি আর আমি তাড় ঘাঁটতে গিয়েচি! আমি নিজের মুখে হয় তো বলতাম চার আনা—ওরা দেবে আট আনা দেখে নিও তুমি।

.

পরদিন সকালে খোদ বিশ্বাস মশায়কে নিজের বাড়ীতে আসতে দেখে গঙ্গাচরণ বিস্মিত হল। ছেলেকে ডেকে বললে—পটলা, ডেকসোটা নিয়ে আয় চট করে—

ডেকসো মানে একটা কেরোসিন কাঠের পুরোনো প্যাক বাক্স। এর নাম ‘ডেকসো’ কেন হয়েচে তার ঐতিহাসিকতা নির্ণয় করা দুষ্কর।

বিশ্বাস মশায় বললেন—থাক থাক—আমার জন্যে কেন—

—সে কি হয়? বসুন বসুন—তারপর কি মনে করে সকালবেলা?

—একটা কথা ছিল। আমার বাড়ীতে কাল আপনি সমস্কৃতো বলেচেন, বাড়ীর মেয়েরা সব শুনেচে। আমার একটা গাইগরুর আজ মাসাবধি হল দড়ি গলায় আটকে অপমিত্যু ঘটেচে। সবারই মন সেজন্যে খারাপ। আমার নাতির অসুখ সেই থেকে সারচে না—জ্বর আর সর্দি লেগেই আছে—বুঝলেন?

গঙ্গাচরণ গম্ভীর ও চিন্তাকুল ভাবে ঘাড় নাড়তে লাগলো। ভাবটা এই রকম যে, ‘‘ও তো না হয়েই যায় না’’—

বিশ্বাস মশায় বললেন—এখন কি করা যায়? কাল রাত্তিরে আমার পরিবার বললে—ওনার কাছে যাও, উনি পণ্ডিত লোক, একটা হিল্লে হবে।

গঙ্গাচরণ পূর্ববৎ চিন্তাকুল। সংক্ষেপে শুধু বললে—হুঁ—

ওর হাবভাব দেখে বিশ্বাস মশায় ভয় পেয়ে গেলেন। খুব গুরুতর কিছু ঘটবার সূত্রপাত নাকি তাঁর সংসারে? শাস্ত্র জানা ব্রাহ্মণ, কি বুঝেচে কি জানি? আর কিছু বলতে তাঁর সাহস যোগাল না।

গঙ্গাচরণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে—কিছু খরচ করতে হবে। বিপদে ফেলেচে।

বিশ্বাস মশায় উদ্বেগের সুরে বললেন—কি রকম? কি রকম?

—গোবধ মহাপাপ। এত বড় মহাপাপ যে—

বিশ্বাস মশায় বাধা দিয়ে বললেন—কিন্তু এ তো আমরা ইচ্ছে করে করি নি? মাঠে বাঁধা ছিল, দড়ি গলায় কি করে আটকে—

—ওই একই কথা। গোবধ ওকেই বলে—মহাপাপ।

—এখন কি করা যায় তা হলে?

স্বস্ত্ব্যয়ন করতে হবে, সামনের আমাবস্যের দিন যোগাড় করতে হবে সব। টাকা-পনেরো-কুড়ি খরচ হবে।

বিশ্বাস মশায় উদ্বিগ্ন সুরে বললেন—কি কি লাগবে একটা ফর্দ করে দিন না ঠাকুর মশাই।

গঙ্গাচরণ গম্ভীরভাবে বললে—দেখে শুনে ফর্দ করতে হবে। একটা গুরুতর ব্যাপার, আপনার নাতির অসুখ সারা না-সারা এর ওপর নির্ভর করচে। যা-তা করে দিলেই তো হবে না? দাঁড়ান একটু, আসচি—

গঙ্গাচরণ বাড়ীর মধ্যে ঢুকতেই দেখলে অনঙ্গ-বৌ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওদের কথাবার্তা সব আড়াল থেকে শুনেচে।

স্বামীকে দেখে বললে—ও কে গা? কি হয়েছে?

গঙ্গাচরণ স্ত্রীকে হাতছানি দিয়ে ভেতরের উঠোনে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল—বড় খদ্দের। উনি হলেন বিশ্বাস মশায়। তোমার কাপড় আছে ক’খানা?

—আমার?

—আঃ, তাড়াতাড়ি বল না! তোমার না তো কি আমার?

—আমার আটপৌরে শাড়ী আছে দু’খানা, আর একখানা—তিনখানা তোরঙ্গের মধ্যে তোলা, ভালো শাড়ী আছে দু’খানা।

—কি নেবে বলো? ভালো শাড়ী না আটপৌরে?

—ভালো শাড়ী একখানা হলে বড্ড ভালো হয়, কস্তাপেড়ে, এই—এই রকম জলচুড়ি দেওয়া, বাসুদেবপুরে চক্কত্তি-গিন্নীর পরনে দেখে সেই পর্যন্ত বড্ড মনটার ইচ্ছে—হ্যাঁ গা, কে দেবে গা?

—আঃ, একটু আস্তে কথা বলতে পারো না ছাই? দাঁড়িয়ে রয়েচে বাইরে। আর শোনো, গাওয়া ঘি আছে ঘরে?

অনঙ্গ ঠোঁট উল্টে তাচ্ছিল্যের সুরে বললে—গাওয়া ঘি? বলে ভাত পায় না, মুড়কি জলপান—

গঙ্গাচরণ বাইরে এসে বললে—এই যে বিশ্বাস মশায়, বসিয়ে রাখলাম। কিন্তু এসব কাজ ভেবেচিন্তে করে দিতে হয়। শুনে নিন, ভালো লালপাড় শাড়ী একখানা, গাওয়া ঘি আধ সের—ওটা—তিন পোয়াই ধরুন, চিনি পাঁচপোয়া, পাকাকলা একছড়া, সন্দেশ পাঁচপোয়া, গামছা দুখানা, পেতলের থালা একখানা, ঘটি একটা, ধুনো একপোয়া…ওঃ ভুলে গিয়েছি, মধুপর্কের বাটি একটা, আসন একটা—

বিশ্বাস মশায় মন দিয়ে ফর্দ শুনে বললেন—আর সব নতুন দেবো, কিন্তু ও থালাঘটি কি নতুনই দিতে হবে? আপনার বাড়ী থেকে না হয় দিন, কিছু দাম ধরে দিলে হয় না?

—তা হয়। তবে খুঁৎ না রাখাই ভালো। আপনি নতুনই দেবেন।

—দিন ঠিক করে দিন—

—সামনের আমাবস্যায় হবে, ও আর দিন ঠিক কি। বলেছি তো। দক্ষিণে লাগবে দু’টাকা।

বিশ্বাস মশায় অনুরোধের সুরে বললেন—টাকা খরচের জন্যে আপত্তি নেই—যাতে নাতিটি আমার—ঠাকুর মশাই—যাতে সেরে ওঠে—

প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠলেন উনি।

গঙ্গাচরণ আশ্বাসের ভঙ্গিতে বললে—হুঁ, গোবধ! বলে কত কত শক্ত কাণ্ডের জন্যে শান্তি-স্বস্ত্ব্যয়ন করে এলাম! কোনো ভয় নেই, যান আপনি।

অন। স্বামীর কৃতিত্বে খুশি না হয়ে পারলো না যেদিন গঙ্গাচরণ বিশ্বাস মশায়ের বাড়ী থেকে একরাশি জিনিসপত্র বহন করে বাড়ী নিয়ে এল। একগাল হেসে বললে—দেখি শাড়ীখানা? বাঃ, চমৎকার কস্তাপেড়ে—গাওয়া ঘি? কতটা?

—তা আছে পাকি তিনপোয়া। বাড়ীর তৈরী খাঁটি ঘি।

—এইবার একবার ভাতছালা বেড়িয়ে আসি, কি বলো?

—বিশ্বেস মশায়কে বলেও এসেছি। গরুর গাড়ী দেবে বলেচে—

—তুমি যাবে না?

—আমার কি সময় আছে যে যাবো? ছেলে পড়াতে হবে না? তুমি যাও ছেলেদের নিয়ে। এসময়ে টাকাও পেয়েছি দুটো। একটা থাক, একটা খরচ করে এসো।

.

কিন্তু যাই যাই করে শীত কেটে গিয়ে ফাল্গুন মাস পড়ে গেল। তখন অনঙ্গ একদিন বিশ্বাস মশায়ের গরুর গাড়ীতে ছেলেদের নিয়ে ভাতছালা রওনা হল। দু’ক্রোশ পথ গিয়ে কাঁটালিয়া নদী পার হতে হল জোড়া খেয়ানৌকাতে গরুরগাড়ীসুদ্ধ। অনঙ্গ-বৌয়ের বেশ মজা লাগলো এমনভাবে নদী পার হতে। ওপারে উঁচু ডাঙায় নদীতীরে প্রথম বসন্তে বিস্তর ঘেঁটুফুল ফুটে আছে, বাতাসে ভুর ভুর করচে আমের বউলের মিষ্ট সুবাস, আঁকাবাঁকা শিমুলগাছে রাঙাফুল ফুটে আছে।

অনঙ্গ ছেলেদের বললে—এখানে এই ছায়ায় বসে দুটো মুড়ি খেয়ে নে—কখন ভাতছালা পৌঁছবি তার ঠিক নেই।

বড় ছেলেটা বললে—ওঃ, কি আমের বোল হয়েচে দ্যাখো সব গাছে। এবার বড্ড আম হবে, না মা?

—খেয়ে নে মুড়ি। আমের বোল দেখবার সময় নেই এখন।

ছেলে দুটি ছুটোছুটি করে বেড়াতে লাগলো নদীর পাড়ে গাছপালার ছায়ায় ফড়িং ধরবার জন্যে। অনঙ্গ ওদের বকেঝকে আবার গাড়ীতে ওঠালে।

নিস্তব্ধ ফাল্গুন দুপুরে মেঠোপথে আমবন, জাম, বট, বাঁশ, শিমুল গাছের ছায়ায় ছায়ায় গরুর গাড়ীর ছইয়ের মধ্যে বসে অনঙ্গ-বৌয়ের ঝিমুনি ধরলো। বড় ছেলে বললে—মা, তুমি ঢুলে পড়ে যাচ্চ যে, উঠে বোসো!

অনঙ্গ অপ্রতিভ হয়ে বললে—চোখে একটু জল দিলে হত। ঘুম আসচে।

ভাতছালাতে পৌঁছুতে বেলা পড়ে গেল। গাড়োয়ান বললে—তবু সকালে সকালে এসে গ্যালাম মা-ঠাকরোণ। ন’কোশ রাস্তা আমাদের গাঁ থে। গরুদুটোর সুধার বয়েস তাই আসতে পারলে।

ভাতছালাতে অনঙ্গ-বৌয়ের ঘর ছিল গ্রামের বাগদিপাড়া থেকে অল্পদূরে খুব বড় একটা বিলের কাছে। একখানা খড়ের ঘর, সঙ্গে ছোট একখানা রান্নাঘর, অনেকদিন কেউ না থাকাতে চালার খড় কিছু কিছু উড়ে পড়েচে, মাটির দাওয়াতে ছাগল গরু উঠে খুঁড়ে ফেলেচে। উঠোনের চারিধারে বাঁশের বেড়া দেওয়া ছিল, ফাঁকে ফাঁকে রাংচিতার গাছ। বেড়ার শুকনো বাঁশ লোকে ভেঙে নিয়েচে অনেক।

মতি বাগদিনী ছুটে এল ওদের গরুর গাড়ী দেখে। মহাখুশির সঙ্গে বললে—বামুন-দিদি আলেন নাকি? ওমা, আমাদের কি ভাগ্যি—

অনঙ্গ-বৌ বললে—আয় আয় ও মতি, ভালো আছিস?

—দাঁড়ান, আগে একটু গড় করে নিই। পায়ের ধুলো দ্যান এট্টু—খোকারা বেশ বড় হয়েছে দেখচি। বাঃ—

—ভালো ছিলি?

—আপনাদের ছিচরণের আশীর্বাদে। এখন আছেন কোথায়?

—ওই নতুন গাঁ, কাপালী পাড়ায়। ন’কোশ রাস্তা এখান থেকে।

—এখানে এখন থাকবেন তো?

—বেশিদিন কি থাকতে পারি? সেখানে উনি ইস্কুল খুলেচেন মস্তবড়। একঘর ছাত্তর। দুদিন থাকবো তাই তাঁকে রেঁধে খেতে হবে।

—খাওয়াদাওয়ার যোগাড় করবো?

—আমাদের সঙ্গে চালডাল আছে পুঁটুলিতে। তুই দুটো শুকনো কাঠ কুড়িয়ে দিয়ে যা।

পদ্মবিলের থেকে কিছু দূরে মুচিপাড়া। প্রায় একশো ঘর মুচির বাস। পদ্মবিলে মাছ ধরে আশপাশের গ্রামে বেচে এরা জীবিকা-নির্বাহ করে। পোয়াটাক পথ দূরে গ্রামের অন্য অন্য জাত বাস করে। ব্রাহ্মণের বাস এ গ্রামেও নেই—এর একটা প্রধান কারণ, গঙ্গাচরণ এমন গ্রামে বাস করে নি যেখানে ব্রাহ্মণের বাস আছে। কারণ সে গ্রামে তার পসার থাকবে না। তার বদলে অন্য ব্রাহ্মণ যেখানে ডাকবার সুবিধে আছে, এমন গ্রামে সে ঘর বাঁধতে যাবে কি জন্যে? তাতে আদর হয় না।

অনঙ্গ-বৌয়ের আগমনের সংবাদে গোয়ালাপাড়া থেকে বৌ-ঝিয়েরা দেখা করতে এল। কেউ নিয়ে এল একটি ঘটিতে সেরখানেক দুধ, কেউ নিয়ে এল খানিকটা খেজুরগুড়ের পাটালি, কেউ একছড়া পাকা মর্তমান কলা। অনেক রাত পর্যন্ত ঝি-বৌয়েরা দাওয়ায় বসে গল্প করলে। সকলেই মহাখুশি অনঙ্গ-বৌ আসাতে। সকলেই অনুরোধ জানালে এখানে কিছুদিন থাকতে। এখানে আবার উঠে এলে কেমন হয়? তারা সব সুবিধে করে দেবে বসবাসের। কোনো অভাব-অভিযোগ থাকতে দেবে না। আসুন না বামুনদিদি তাদের গাঁয়ে আবার?

ওরা নিজেরাই ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দিলে। মাটির প্রদীপে সলতে দিয়ে আলো জ্বেলে দিলে।

মতি মুচিনী বললে—রাত্তিরে আমি এসে শোবো ঘরের দাওয়ায়। দুটো খেয়ে আসি—

অনঙ্গ-বৌ তাকে বাড়ী গিয়ে খেতে দিলে না। যা রান্না হয়, এখানেই দুটো ভাত খেয়ে নিলেই হবে। গরুর গাড়ীর গাড়োয়ানও তো খাবে।

সন্ধ্যার পরে বেশ জ্যোৎস্না উঠলো। একটু ঠাণ্ডা পড়েচে জোর দক্ষিণ বাতাসে। বৌ-ঝিয়েরা একে একে চলে গেল। মতি মুচিনী কলার পাত কেটে এনে বিলের ধারে ঘাসের উপর ভাত খেতে বসলো। গাড়োয়ান বললে তার শরীর খারাপ হয়েচে, সে কিছু খাবে না রাত্রে।

অনঙ্গ মাদুর পেতে গল্প করতে বসলো বিলের দিকের জ্যোৎস্নালোকিত দাওয়ায়। শ্যামাচরণ ঘোষের বিধবা মেয়ে একটা কেরোসিনের টেমি ধরিয়ে এসে হাজির হল অনেক রাত্রে। সেও রাত্রে এখানে শোবে। অনঙ্গ-বৌকে সেও বড় ভালোবাসে। এ মেয়েটির বিবাহ হয়েছিল পাশের গ্রামে কুমুরে। এগারো বছর বয়সে বিধবা হয়েচে, এখন প্রায় সাতাশ-আটাশ বছর বয়েস, দেখতে এখনও সুন্দরী, টকটকে ফর্সা রং, মুখশ্রীও ভালো।

অনঙ্গ হেসে বললে—আয় কালী, চাঁদনি রাতে আবার একটা টেমি কেন?

কালী আঁচল দিয়ে টেমিটা বাঁচিয়ে আনচে পদ্মবিলের জোর দক্ষিণে হাওয়া থেকে। বললে—সেজন্যে নয় দিদি, ওই মুচিপাড়ার বাঁশবাগান দিয়ে আসতে গা ছমছম করে এত রাত্তিরে।

—কেন রে? ভূতে তোর ঘাড় মটকাবে?

কালী হেসে বললে—ওসব নাম কোরো না রাত্তিরবেলা। তুমি ডাকাত মেয়েমানুষ বাবা—

—দূর পোড়ারমুখী, ব্রাহ্মণের আবার ভয় কি রে?

—ভূতে বামুন-বোষ্টম মানে না বৌদি, সত্যি কথা বলচি। সেবার হল কি—

মতি মুচিনী ভয় পেয়ে বললে—বাদ দেও, ওসব গল্প এখন করে না। এই খেজুরের চটখানা পেতে শুয়ে পড় বামুন-দিদির পাশে।

অনঙ্গ-বৌয়ের মনে আজ খুব আনন্দ। অনেকদিন পরে সে তার পুরোনো ঘরে ফিরে এসেচে। আবার পুরোনো সঙ্গিনীদের সঙ্গে দেখা হয়েচে। পদ্মবিলের ওপর এমন জ্যোৎস্নারাত্রি কতকাল সে দেখে নি। অথচ এখানে যখন ছিল, তখন কোনোদিন খাওয়া জুটতো, কোনোদিন জুটতো না। এই মতি মুচিনী কত পাকা আম কুড়িয়ে এনে দিয়েচে, লোকের গাছের পাকা কাঁটাল চুরি করে পর্যন্ত এনে খাইয়েচে। এই কালী গোয়ালিনী বাড়ী থেকে ভাই-বৌকে লুকিয়ে নতুন ধানের চিঁড়ে এনে দিয়েচে।

অনঙ্গ-বৌ বিলের জলের দিকে চেয়ে অন্যমনস্কভাবে বললে—মনে আছে কালী, সেই একদিন লক্ষ্মীপুজোর রাতের কথা?

কালী মৃদু হেসে চুপ করে রইল। বামুনের মেয়েকে খাবার যোগাড় ক’রে দিয়েচে একদিন, তা কি সে এখন মুখে বলবে?

—মনে নেই?

—ও কথা ছেড়ে দাও বৌদিদি।

—তুই সেদিন চিঁড়ে না আনলে উপোস দিতে হত।

—আবার ও কথা? ছিঃ—

অনঙ্গ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললে—ওই পদ্মবিলের ওখানটাতে একটা শোল মাছ ধরেছিলাম, মনে আছে মতি?

মতি বললে—গামছা দিয়ে। ওমা, সেদিনের কথা যে! খুব মনে আছে—তুমি আর আমি নাইতি গিয়েছিলাম—

—মস্ত বড় মাছটা ছিল—না রে?

—ভালো কথা মনে হল। কাল মনে করে দিয়ো দিকিনি। দেওর মাছ ধরবে কাল, একটা বাণ মাছ কাল খাওয়াবো বামুনদিদিকে। বড্ডো সোয়াদ বিলির মাছের—

—সে যেন তুই আমায় নতুন শেখাচ্ছিস মতি!

কালী বলে উঠলো—ওই শোনো মতির কথা! মুচি তা আর কত বুদ্ধি হবে? বৌদিদি যেন আর এ গাঁয়ের মানুষ না? দু’দিনের জন্যে চলে গিয়েচে, তাই কি? আবার ফিরে আসবে না বৌদি?

—কেন আসবো না? আমার সাধ ছিল পদ্মবিলের একেবারে ধারে একখানা ঘর বাঁধবো।

—তোমার এ ঘরও তো বিলের ধারে বৌদি। কত দূর আর? ওই তো কাছেই।

—তা না রে, বিলের একেবারে ধারে ওই যে বাঁশঝাড়টা, ওরই পাশে ঘর বাঁধবার ইচ্ছে ছিল। বেশ ভালো হত না?

—এখন বাঁধো। আমি বাঁশ খড় সব জুটিয়ে দেবো বাবাকে বলে।

.

অনঙ্গ-বৌয়ের ঘুম এল না অনেক রাত পর্যন্ত।

সে ভাবছিল তার জীবনের গত দিনগুলির কথা। ছুতোরখালি গ্রামে তার বাপেরবাড়ী। বাবা ছিলেন সামান্য অবস্থার গৃহস্থ, জমিজমার সামান্য আয়ে সংসার চালাতেন। হরিহরপুরে কি একটা কাজে গিয়ে গঙ্গাচরণের বাবার সঙ্গে আলাপ হয়—সেই সূত্রে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ করেন গঙ্গাচরণের সঙ্গে। কিন্তু বিবাহের কিছুদিন পূর্বেই হঠাৎ তিনি মারা যান। মামাদের চেষ্টায় ও গঙ্গাচরণের বাবার দয়ায় হরিহরপুরেই বিবাহ হয়। একখানা মাত্র লালপাড় শাড়ী ও মায়ের হাতের সোনা-বাঁধানো শাঁখা—এর বেশি কিছু জোটে নি অনঙ্গ-বৌয়ের ভাগ্যে বিয়ের সময়ে।

এদিকে বিয়ের কিছুদিন পরে গঙ্গাচরণের বাবাও মারা গেলেন। গঙ্গাচরণের জ্ঞাতিরা নানারকম শত্রুতা করতে লাগলো। হরিহরপুরে একখানা পুরোনো কোঠাবাড়ী ও একটা আমবাগান ছাড়া অন্য কিছু আয়কর সম্পত্তি ছিল না, জ্ঞাতিদের শত্রুতায় অবস্থা শেষে এমন দাঁড়ালো যে আমবাগানের একটি আমও ঘরে আসে না। কোনো আয় ছিল না সংসারের, উঠোনের মানকচু তুলে কামারগাঁতির হাটে নিজের মাথায় করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে গঙ্গাচরণকে চাল কিনে আনতে হয়েছে, তবে স্বামী-স্ত্রীর সংসার চলেছে।

একদিন খুব বর্ষার দিন। ফুটো ছাদ দিয়ে জল পড়ে ঘর ভেসে যাচ্ছে, অনঙ্গ-বৌ স্বামীকে বললে—হ্যাঁগা, বাড়ীঘর না সারালে এখানে তো আর থাকা যায় না!

গঙ্গাচরণ বললে—কি করি বৌ, বসন্ত মিস্ত্রিকে জিজ্ঞেস করি নি ভাবছো? আমি বসে নেই। দুশোটি টাকার এক পয়সার কমে ও ছাদ উঠবে না।

—কোথায় পাবে দুশো টাকা? দু’টাকার সম্বল আছে তোমার? আমার পরামর্শ শোনো, এ দেশ ছেড়ে অন্য জায়গায় যাই।

—কোথায় যাই বলো দেশ ছেড়ে, কে জায়গা দেবে?

—সে কথা আমি জানি? পুরুষমানুষ—সে তুমি বোঝো। আর জ্ঞাতিশত্তুরের সঙ্গে বিবাদ করে এখানে টিকে থাকতে পারবে না তুমি।

সেই হল ওদের দেশত্যাগের সূত্রপাত। তারপর আশ্বিন মাসে পুজোর পরই ওরা প্রথমে এল এই ভাতছালা। এখানে প্রথম প্রথম ভালোই× চলেছিল, পরে একটু অসুবিধে হয়ে গেল। তার প্রধান কারণ, ভাতছালায় এরা এসেছিল স্থানীয় গোয়ালারা ধানের জমি করে দেবে আশা দিয়েছিল বলে। কিন্তু দু’বছর হয়ে গেল, ধানের জমির কোনো বন্দোবস্তই আর হয়ে উঠলো না। এক বেলা খাওয়া হয় ওদের তো অন্য বেলা হয় না। সেই সময় এই কালী গোয়ালিনী যথেষ্ট সাহায্য করেছিল ওদের। বিরক্ত হয়ে ওরা এখান থেকে উঠে যায় বাসুদেবপুরে। সেখানে অন্য সুবিধে মন্দ ছিল না, কিন্তু ম্যালেরিয়াতে অনঙ্গ-বৌ মরে যাওয়ার যোগাড় হল। তখন নতুন গাঁয়ের কাপালীদের সঙ্গে বাসুদেবপুরের হাটেই আলাপ হয় গঙ্গাচরণের, কাপালীরা পাঠশালার মাস্টার চাইচে শুনে গঙ্গাচরণ যেতে রাজী হয়। ওরাও খুব আগ্রহ করে নিয়ে যেতে চায়। সেই থেকেই নতুন গাঁয়ে বাস।

অনঙ্গ বলে—কালী ঘুমুলে নাকি? বাবাঃ কি ঘুম তোদের!

মতি ঘুমজড়িত স্বরে বলে—বামুন-দিদি ঘুমোওনি এখনো? রাত যে পুইয়ে এল। ঘুমিয়ে পড়ো। পুবে ফর্সা হল—

—তোর মুণ্ডু হল পোড়ারমুখী—

অনঙ্গ-বৌ ভাবছিল তার জীবনে কত জায়গায় যাওয়া হল, কত কি দেখা হল। তার বয়সী ক’টা মেয়ে এমন নানা জায়গায় বেড়িয়েছে? ওই তো তার সমবয়সী হৈম রয়েছে হরিহরপুরে, তার শ্বশুরবাড়ীর গ্রামে। কোথাও যায়নি, কোনো দেশ দেখে নি।

সে ভাবলে—ভালো কাপড় পরতে পারিনি, খেতে পাই নি তাই কি? আমার মত এত জায়গা বেড়িয়েছে হৈম? কত জায়গা! ধর হরিহরপুর, সেখান থেকে ভাতছালা, ভাতছালা থেকে বাসুদেবপুর—তারপর এখন নতুনগাঁ। উঃ—কথাটা কালীকে বলবার জন্যে সে ব্যাকুল হয়ে উঠলো। ডাক দিলে—ও কালী, কালী, একটা কথা শোন না?

মতি ঘুমজড়িত স্বরে বললে—বামুন-দিদি, তুমি জ্বালালে দেখছি, ঘুমুতি দেবা না রাত্তিরে? কালী ঘুমিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ, ওকে আর ডাকাডাকি কোরো না। রাত পুইয়ে গেল যে।

অনঙ্গ-বৌ হেসে তার গায়ে একটা কাটি ছুঁড়ে মেরে বললে—দূর পোড়ারমুখী—

যে দু’দিন অনঙ্গ এখানে রইল, এমন নিছক আনন্দের দুটি দিন ওর জীবনে কতকাল আসে নি। চলে আসবার দিন মতি মুচিনী কেঁদে আকুল হল। সে এ গাঁয়ে আর থাকতে চায় না, অন-বৌয়ের সঙ্গে চলে যাবে। কালী গোয়ালিনী আধ সের ভালো গাওয়া ঘি ও দুটো মানকচু নিয়ে এসে দিল। মতি খেজুরগুড়ের পাটালি নিয়ে এলো খেজুরগাছের বাকলায় বেঁধে।

.

গঙ্গাচরণ জিনিসপত্র দেখে বললে—বাঃ, অনেক সওদা করে এনেছ দেখছি—

অনঙ্গ হাসি হাসি মুখে বললে—দাম দিতে হবে আমাকে কিন্তু।

—ভালো কথাই তো। কেমন দেখলে?

—অতি চমৎকার। আমার যে কি ভালো লেগেছে। মতি এল, কালী এল, গাঁয়ের কত ঝি-বৌ দেখতে এল—

—ওরা এখনো ভোলে নি আমাদের?

—ভুলে যাবে? সবাই বলে এখানে এসে আবার বাস করুন বামুন-দিদি। হ্যাঁগা, পদ্মবিলের ধারে একখানা ঘর বাঁধো না কেন? আমার বড্ড সাধ কিন্তু।

—আবার ভাতছালা ফিরে যাবে? সে হয় না। পাঠশালা জমে উঠেছে। এখন কি নড়া যায়, গেলেই লোকসান।

—তুমি যা ভালো বোঝো। আমার কিন্তু বাপু ওখানে একখানা ঘর বাঁধবার বড্ড ইচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *