৮
একটানা ঝিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে। ছাই-ছাই মেঘগুলো আকাশে ঢেকে রেখেছে, দমকা হাওয়ায় তুফান ওঠে নদীর বুকে। নৌকোগুলো ভয়ে সরে গেছে। চারিদিকে অন্তহীন শূন্যতা কী আতঙ্ককে প্রকট করে তুলছে।
রিলিফ পার্টির লোকজন ঘাবড়ে গেছেন রীতিমতো, সুন্দরবনের এত কাছে তাঁরা আসেননি। দু-একজন সরকারি লোকও চুপ করে বসে আছেন। স্বেচ্ছাসেবকদের অধিনায়ক বলেন –এই ‘রাফ ওয়েদারে’ দূর গাঙে পাড়ি দোব কি করে?
ভুবনবাবু ভাবছেন। তবু আশ্বাস দেন—দেখি, মধুসূদন আসুক! তাকে পেলে আপনাদের কিছুই ভাবতে হবে না। খুব কাজের লোক।
হঠাৎ দেখা যায় ওই বৃষ্টির মধ্যে আসছে। ছাতা-টাতার বালাই নেই। দমকা হাওয়া বইছে বিস্তীর্ণ গাঙ থেকে, ছিটকে ফেলে দেবে এই ভয়ে কেউ ওদিকে হাঁটে না।
মধু আসছে। বলিষ্ঠ কঠিন একটি তরুণ। সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে। গায়ের গেঞ্জিটা ভিজে ওর পুরুষ্ট দেহের ওপর চেপে বসেছে।
চঞ্চলবাবু ওকে দেখছেন। ভুবনবাবু বলেন—ওই যে মধুসূদন আসছে!
দৃঢ় পদক্ষেপে সে এগিয়ে আসে ওই কাদা-জলের মধ্য দিয়ে।
দাওয়ায় উঠে এসে বলে –এগেন দ্যাট ঝুট-ঝামেলা দারোগাবাবু? কিছুই তো করিনি বাবা, নো হাঙ্গামা। বাদলার লগন, ঘরে বসে অবিশ্যি গিলেছি, আর মাইরি তার জন্য দারোগাবাবুর তলব? ওইটুকু যদি অপরাধ হয় তা’লে বাদাবনের সব মহাপ্রভুদের ধরে আনতে হয়।
হঠাৎ মধুসূদন ভদ্রলোকদের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়। ওকে তাঁরা সবাই দেখছেন।
ভুবনবাবু বলেন—বসো।
—আর বসে কাজ নেই। পা-টা ছাড়িয়ে নিই। যা কাদা, শ্লা এক পা হাঁটি তো দু-পা পিছুই। মা কালী হয়ে যেতে হয়। তা বলে ফ্যালেন কেন ডেকেছেন? বুঝছেন তো স্যার, মাত্তর দুটো বোতল পেয়েছি। যতে, পদাও ঘরে রয়েছে। দেরি করে ফিরলে গিয়ে দেখব, নচ্ছারগুলো সব কিলিয়ার করে দিয়েছে। কুইক!
চঞ্চলবাবুই বলেন —আপনাদের এখানে এসেছি রিলিফের কাজে। অচেনা পথ, ওই গাঙ, বাদাবন। সে-সব জায়গায় আমাদের সঙ্গে যদি যেতেন, আমরাও কাজ করতে পারতাম। শুনেছেন তো কত বসত ভেসে গেছে, মহামারি শুরু হয়েছে আবাদে!
ভুবনবাবু বলেন – সেবা ধর্ম, মানুষের সেবা—এটাও মহৎ কাজ।
হঠাৎ ওই স্তব্ধতাকে যেন থাপ্পড় মারার ভঙ্গিতে বলে ওঠে মধু, –এগেন দ্যাট সুনীতি-সুধা। আমি ভাবলাম, আমারই ঠিকের কাজের কোনো ভেড়ি ভেঙেছে, ছয়লাপ হয়ে গেছে লোনাজলে, তাই ডেকে এনে কড়কাবেন। আমার কাজে ভেজাল নেই স্যার আমতলির ভেড়ি অলরাইট। যে শ্লা আমার কাছে মাটির কাজে জোচ্চুরি করবে পোঁদে লাথি মেরে গাঙের জলে ফেলে দোব না?
ভুবনবাবু বলেন –তার জন্যই তো এবার তোমার কাজ সব থেকে বেশি। আমি বলছিলাম এঁরা এসেছেন রিলিফের ব্যাপারে। তুমি যদি এঁদের নিয়ে যাও।
মধু চোখ মেলে ওঁদের দেখছে। কলকাতার তরুণের দল। চোখে হাইপাওয়ার চশমা অনেকের প্যান্ট আর তোয়ালে-জামা, তাতে জীবনরক্ষা সমিতির ব্যাচ। কারও বা টেরিলিনের জামা-প্যান্ট, সাবধানে কানা-জল বাঁচিয়ে চলেছেন। পায়ে পালিশ করা জুতো।
মধু ওঁদের বেশ কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে গম্ভীর গলায় বলে—ওঁদের ফিরে যেতে বলেন স্যার। ওই বরযাত্রীর দল নিয়ে বাদাবনে, এই গাঙে কাজ হয় না। ইয়ার্কি মারা এ নয়।
চঞ্চলবাবু চমকে ওঠেন –কেন, আমরা সকলেই ভালো সাঁতারু! ট্রেনড—
মধু খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠে—সাঁতারু! অ্যা—ওই নোনা গাঙে সাঁতারে কি হবে স্যার? এ তো কলকাতার লেকে আলো জ্বেলে সাঁতার খেলা করা নয়। এ গাঙে যমরাজ পড়লে কামট-কুমিরের দল তারই পরকালের ব্যবস্থা করে দেবে। আর ট্রেইনিং! অ্যা!
—হ্যাঁ! আমরা ওসব কিছু কিছু শিখেছি।
মধু জিভটা ঠোঁটে বুলিয়ে নিয়ে ওদের দেখছে। বলে ওঠে—বাদাবনের বাঘগুলো এই বাদলায় বন ছেড়ে বসতে হানা দেবে। তাদের হাঁকাড়ি শুনলে ওই বাবুদের পোঁদের গু মাথায় উঠে যাবে স্যার। জলে-কাদায় কোথায় পড়ে থাকতে হবে—বাপের নাম ‘খগেন’ হয়ে যাবে।
ওঁরা মধুর ওই সব আদি এবং অকৃত্রিম ভাষা প্রয়োগে একটু চমকে উঠেছেন। লোকটা ওসব খবর রাখে। কিন্তু বনের পাশে থেকে একেবারে বুনো হয়ে গেছে।
ভুবনবাবুও বলেন—কি বলছ মধু?
—ঠিকই বলছি স্যার। আমার কাছে সোজা কথা। ওসব ভড়ং-এর দরকার কি? সেবা খবরের কাগজে ছবি ছাপা হবে, নাম বেরোবে, এইসব তো আসলে চান মশাই? তার জন্যে অন্য জায়গায় যান। ওই বাদাবনের মানুষ বছর বছর এ যন্ত্রণা ভোগে, তবু মরে-হেজে শেষ হয়ে যায় না। ওদের জন্যে না-ই বা ভাবলেন! সমুদ্রে ছাতুমুঠো না-ই বা দিলেন!
ভুবনবাবু বলেন,—এবার অনেক বেশি সাহায্য আসছে। সরকার থেকে, বিভিন্ন দল থেকে মধু ফোঁস করে ওঠে,
—ওসব ঝুট-ঝামেলায় আমি নেই স্যার। সবাই সাধু-দয়াবান, চোর ব্যাটা আমরাই। অর্ধেক মাল যাবে, অর্ধেক পথেই পাচার হবে। ওষুধপত্তরও যাবে না। ইয়ার্কি মারতে আমি নেই। আমি শ্লা মাল-ঝাল খেয়ে একটু ফারাকেই থাকতে চাই। নমস্কার! নেশাটাই গেল আর কী, এতক্ষণে দিলে বোধহয় পদা পুরো বোতলটাই ফাঁক করে। ধ্যাত্তেরি!
ওঁদের মুখের ওপর কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে মধু চৌধুরী টলমল করতে করতে বের হয়ে গেল। ওঁদের সব প্রচেষ্টাকে সে যেন নস্যি করে দিয়েছে।
লেখা চুপ করে ব্যাপারটা দেখে। ও দেখেছে তার দৃষ্টি এড়িয়েছে মধুসূদন বারবার। যখনই লেখা ওর দিকে তাকিয়েছে, মধু এড়িয়ে গেছে তাকে।
মহিমবাবু যেন খুশি হয়েছে। বলে সে—ব্যাটার ডাঁট দেখলেন তো! কোনো কথাই কানে তুলল না, এঁরা এসেছেন কত কষ্ট করে—তাঁদের সঙ্গে একটু ভদ্র ব্যবহার কর, ভালো করে কথা বল—সেদিকে ওর খেয়াল নেই। কেবল নেশার কথা, আর অনর্গল খিস্তি শুনিয়ে চলে গেল। ওকে দিয়ে এসব সেবা, রিলিফের কাজ হয় না মশাই। ওটা একটা জানোয়ার।
ভুবনবাবু কী ভাবছেন।
চঞ্চলবাবু বলেন –কিন্তু দেখে মনে হয়, আসল কাজের লোক স্যার। দি ফিট ম্যান ফর দিস এরিয়া; একটা অভিযোগ ওঁর রয়েছে। আর সেটা একেবারে মিথ্যা নয়। কি-ই বা রিলিফ দিতে পারি, আর সরকারি সাহায্য যা আসে–যা আদায় হয় তারসব কি ঠিক জায়গায় পৌঁছায়? তাছাড়া ওই মওকায় নৌকো, লঞ্চ, লোকজন এসবের ভাড়া-মজুরিও তো দেখছি অনেকে চাপ দিয়ে বেশি আদায়ের চেষ্টা করছে।
মহিমবাবু চমকে ওঠে। কথাটা হয়তো তারই উদ্দেশ্য বলা। সে-ই লঞ্চের জন্য চেয়েছে দৈনিক পাঁচশো টাকা, নৌকোর জন্য একশো টাকা, ডিঙি পিছু পঁচিশ টাকা। সরকারি লঞ্চ এর চেয়ে কম খরচায় চলবে।
তাই মহিমবাবু বলে—ওটা বেশি পড়ে এ সময়। তবে ওই মধুর কথা বলছেন, ও যাবে না মশাই।
ভুবনবাবু হাল ছাড়েননি। তিনি বলেন,–এস ডি ও সাহেবও আসবেন কাল সকালে। তিনি কী বলেন দেখি!
চঞ্চলবাবুও ভাবছেন। তিনি বলেন—কাছাকাছি কাজ তো শুরু করি। তবে ওঁকে পেলে সত্যিকার বন্যা-অঞ্চলে গিয়ে কাজ করা যাবে।
মহিমবাবু বলে—ওর কথা ছেড়ে দিন মশাই। আমাদেরও চেষ্টা করতে হবে। ও যাবে না। দেখছেন না নেশাখোর! তাছাড়া অনেক বদ দোষ আছে ওর।
ভুবনবাবু চুপ করে থাকেন।
মহিমবাবুর কথাগুলোকে ওঁরা ঠিক যেন স্বীকৃতি দিতে পারেননি। চঞ্চলবাবু বলেন,–হয়তো নীতিগত অসুবিধে থাকতে পারে। এস ডি ও সাহেবকেও জানান ওঁর কথাগুলো। তবে মনে হয় আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করলে উনি চুপ করে বসে থাকতে পারবেন না। আমরা কাল-পরশুর মধ্যে কাজ শুরু করি।
ভুবনবাবু বলেন—অগত্যা!
অশ্বিনীবাবু বলেন—এ অবস্থায় যাবার কথা ভেবে দেখ লেখা!
লেখা কিছু বলল না। কী ভাবছে সে।
মনে হয় সব আয়োজনের মধ্যে কোথায় একটা ফাঁক থেকে যায়। লেখার কাছেও এটা যেন কঠিন শপথের মতোই ধ্বনিত হয়।
ওই লোকটাকে সে কাজে নামাবেই।
সন্ধ্যা নামছে। সন্ধ্যার আঁধার আর মেঘের আঁধার মিশে রাতের আসাটাকে ত্বরান্বিত করেছে। নদীর দিক থেকে ভেসে আসে কলোচ্ছ্বাসের শব্দ। ধারালো জিভের সাপটে ওই ঢেউগুলো এ-ওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ছে ক্রুদ্ধ আক্রোশে। নৌকো নেই, লঞ্চটা কাঁপতে কাঁপতে এসে কোনরকমে বুড়ি ছুঁয়ে ভয়ে ফিরে গেছে। মানুষগুলো মুখ-বুজে যেন কী সর্বনাশের প্রতীক্ষা করছে। হাটতলা জনশূন্য প্রায়, দু-একটা দোকানে হ্যারিকেন জ্বেলে কারা সুর করে রামায়ণ পড়ছে। পানের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। খেয়া বন্ধ পারঘাটে। সব কেমন স্তব্ধ প্রাণহীন হয়ে গেছে। জেগে আছে শুধু প্রকৃতির সর্বনাশা মাতনের সাড়া—গাছগুলো নুইয়ে সেই ঝোড়ো হাওয়ায় কোঁকাচ্ছে কী-যন্ত্রণায়।
ভেড়ির দিক থেকে নেমে এগিয়ে আসছে লেখা। বাতাসের সাপটে ছাতা মেলা যাচ্ছে না। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে কাপড়-জামা সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে। সামনেই বড়ো পাঁচিল ধসা বাড়িটার সামনে সে দাঁড়াল। লোকজন কেউ নেই। এককালে এখানে ছিল পাকা প্রাচীর। ঘরখানাও দালান ছিল, অযত্নে মেরামতের অভাবে বেশির ভাগই ধসে পড়েছে। এদিককার কোণের ঘরখানা তবু একটু বাস করার মতো রয়েছে। উঠোনের কাদা-জল পার হয়ে দাওয়ায় গিয়ে উঠল লেখা।
কারো দেখা নেই। আবছা অন্ধকার থমথম করছে চারিদিকে। দরজাটা খোলা, হ্যারিকেনের একফালি আলো বের হয়ে এসে পড়েছে দাওয়ার ওপর। লেখা এগিয়ে গেল ওইদিকে, কেমন বুক কাঁপছে তার। ভাবল ফিরে যাবে। নেহাত খেয়ালবশেই এসে পড়েছে সে। থমকে দাড়াল। মনের সেই কাঠিন্য জেগে ওঠে। এগিয়ে গেল লেখা।
—কে! কে এল আবার ঝামেলা করতে? অ্যাঁ!
কঠিন কণ্ঠস্বর ওই ভাঙা ঘরের মধ্যে ধ্বনিত হয়। মধুসূদন থানা থেকে ভিজে ফিরেছে। মেজাজটা ভালো নেই। তাই গলাটা ভিজিয়ে নেবার জোগাড় করছে, এমন সময় কাকে আসতে দেখে বিরক্ত হয়। দরজার কাছেই লেখাকে দেখে অস্ফুটকণ্ঠে বলে মধু –তুমি এখানে?
লেখার বৃষ্টি-ভেজা মুখে হ্যারিকেনের একটু আলো পড়েছে। ঝড়ো হাওয়ায় ওর চুলগুলো এলোমেলো। বৃষ্টিটাও জোরে এসেছে। ভিজছে তার ছাটে। লেখা বলে—একটু কাজে আসতে হল।
মধু বিরক্ত হয়, কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজছে মেয়েটা, তাকে একটু আশ্রয় তো দিতে হবে। খাটিয়া থেকে বোতলটা নামিয়ে বলে—কেতাখ্ করেছ এসে! বৃষ্টিতে ভিজে আর কী হবে, এসো, ভেতরে এসো। ওটা মদের বোতল, হাঁ-করে দেখছ কি? তোমার যেমন গীতা-টিতা, আমার কাছে ওই হচ্ছে সুনীতি-সুধা। ওটা তো তোমার চলবে না, তা মাছ-ভাজাটা গরম আছে, খেয়ে দ্যাখ না! অ্যাই পদা! ব্যাটা বুনো শুয়োরের বাচ্ছা!
অন্ধকার থেকে সাড়া ওঠে, –হি—ই-ই!
মধু গর্জন করে—এককাপ চা নিয়ে আয় এখুনিই! চা খাবে তো?
লেখা ওর মুখের ওপর প্রতিবাদ করতে পারে না। একটু টুল টেনে নিয়ে এসে বসল। মধুসূদন কী ভেবে মদের বোতলটা খাটিয়ার নীচে রেখে দিতে দিতে বলে—ভদ্রলোকদের সামনে ওটা খেতে নেই, কি বল? লোকে নিন্দে করে।
লেখা লোকটাকে দেখছে। ওর বলিষ্ঠ দেহের পেশীগুলো যেন ফুলে উঠেছে। চোখে-মুখে ওই রুক্ষতার আড়ালে কোথায় একটু কমনীয়তা রয়ে গেছে, ও অবশ্য সেটাকে ভুলেও প্রকাশ করতে চায় না। ওটাকে লুকিয়েই রাখতে চায়।
লেখা বলে—না। ইচ্ছে হলে খাবে বইকি। এতদিনের অভ্যেস!
–অ্যাঁ।
অবাক হয় মধুসূদন। সব কেমন যেন গুলিয়ে যায় তার। এতদিন ধরে পদে পদে সে শুনে এসেছে— সে মাতাল, হতচ্ছাড়া, নচ্ছার একটি জানোয়ার। ওই অখাদ্য খেয়ে অমানুষ হয়ে উঠেছে আর ঘৃণা কুড়িয়েছে সবার। লেখার কথাটা আজ ঠিক বুঝতে পারে না সে।
হঠাৎ দরজার কাছে কাকে উঁকি-ঝুঁকি মারতে দেখে মধু গর্জে ওঠে—অ্যাই, ভেতরে আয় দেখবি?
পদা লজ্জায় আর ভয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইছিল না বোধাহয়। মধু চা-টা নিজের হাতে নিয়ে ওকে অন্য হাতে চুলের মুঠি ধরে টেনে ভেতরে এনে গজরায়
—ব্যাটা এক নম্বরের শয়তান! কি রে, লজ্জা করছিল তোর?
পদা বলে, –কে না কে আসতিছে কী বেত্তান্ত—হিঃ হিঃ!
—অ! ব্যাটা তুইও আমাকে জানোয়ার ভাবিস! মারব এক লাথ।
লেখা ব্যস্ত হয়ে ওঠে—কী করছ? মরে যাবে যে—
পদা উঠে হাসিমুখে জানায়, –ই তো নিত্যিকার ব্যাপার গো দিদিমণি। বাবু দাও দিনি দুটো টাকা। মা-টা বলছিল চাল নাই, খাব কি বল দিকিন?
টাকাটা দিয়ে দিতেই সে বের হয়ে গেল হাসিমুখে। লেখা চায়ের কাপটা টেনে নিল।
মধুসূদনের মুখ-চোখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। জানলা দিয়ে দেখা যায় নদীর সেই বিস্তারটা। ওখানে ঢেউ ফাটছে, আর গর্জন করছে বাতাস। মধু বলে,
—আমার সম্বন্ধে সকলের ধারণাটা তো জানো। কেন এসেছ বল দিকি? আমার লাজশরম নেই, কিন্তু তোমার কথাটা ভেবেছ একবার? তোমার তো ওটা যথেষ্টই আছে।
লেখার মুখের রেখাগুলো স্পষ্ট পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সে আজ তৈরি হয়েই এসেছে। নিজের ওপর বিশ্বাস আছে। সে বলে ভুবনবাবু তোমাকে যে কথা বলেছিলেন সেই কথাই বলতে এসেছি আমি। রিলিফে যাবার কথা।
—তার জবাবও দিয়ে এসেছি ভুবনবাবুকে। মধু দৃঢ়কণ্ঠে শোনায়।
—কিন্তু আমার কথার জবাব পাইনি।
লেখা ওর দিকে তাকাল। মধু এসব ঝামেলা এড়াতে চায়। তাই বলে,
—তোমার জবাবও ওই একই হবে। বলেছি তো ওসব পরোপকারে আমি নেই। ব্যাস! কিলিয়ার কথা।
লেখা ওর কঠিন মুখের দিকে তাকাল। জানলা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা আসছে। ওর চুলগুলো ভিজছে সেই জলে। মনের ভেতরের একটা অসহ্য-জ্বালা আর যন্ত্রণাকে জুড়োবার জন্যই যেন সে ওই ঠাণ্ডা জোলো হাওয়াটা সর্বাঙ্গে মাখবার চেষ্টা করছে।
লেখা এগিয়ে আসে। বলে—কিন্তু আমি যে বড়োমুখ করে তোমার কাছে এসেছিলাম। তুমি ওদের ফিরিয়ে দিয়েছ, আমাকে ফেরাতে পারবে না আমি জানি।
মধু গর্জন করে ওঠে—তুমি কি এমন তালেবর যে, মধু চৌধুরী তোমার কথায় ওঠ-বোস করবে? অ্যাঁ!
ওর গর্জনে হেসে ফেলে লেখা ফিক করে। ওর মনে হয় এ সবই ওর সামনে ঘটবে তাও জানত। সহজভাবেই নিয়েছে ওর এই কথাগুলো।
মধুসূদন অবাক হয়েছে ওর হাসি দেখে। বলে—হাসছ তুমি? হাসির কি কথাটা হল যে, হাসছ দাঁত বের করে?
—হাসলাম! লোকের যদি উপকার হয়, করবে না সে কাজ? লেখা জবাব দেয়।
মধুর সারা দেহ অসহায় রাগে জ্বলছে। তার ঘরে দাঁড়িয়ে এমনি করে লেখাকে কথা বলতে দেখে অবাক হয়েছে সে। কী ভেবে মধু খাটিয়ার তলা থেকে বোতলটা বের করে গলায় ঢালতে থাকে। লেখা কোনো কথা বলল না। মদটা শেষ করে মধু যেন মনের অতলের সেই হারানো সাহসটা ফিরে পেতে চায়। মধু জবাব দেয়—চুলোয় যাক লোকের উপকার! নিজের কথা ভেবেছ? আমার এখানে আসতে এতটুকু ভয় হল না তোমার? মধু চৌধুরীকে জানো না? সবাই তাকে জানোয়ার বলে। বাদাবনের জানোয়ার।
—জানি!
নিষ্কম্প স্থিরকণ্ঠে জবাব দেয় লেখা। ওর চোখে কী প্রত্যয়ের দৃঢ়তা। সে বলে— যাকে ওরা জানোয়ার বলে তার কাছেই আমি সবচেয়ে বড়ো মানুষের মতো ব্যবহার পেয়েছি। আবাদের অনেকেই তাই পেয়েছে জানি। তাই এসেছি তোমার কাছে, ওদের এই বিপদে তুমি যাবে। যতটুকু সাধ্য তাদের জন্য চেষ্টা করব আমরা। তুমি যাবে ধরে নিয়েই আমি ওদের যাব বলেছি। তুমি না গেলে আমার যাওয়া হবে না। যেতে আমি ভরসা পাই না।
—অ্যাঁ!
মধু অবাক হয়েছে। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে দেখেছে ওই মেয়েটিকে। ওর টিকালো নাক, ওই দুটো চোখ—সব মিলিয়ে কেমন একটা বিচিত্র আবেশ আনে মধুর সারা মনে। অমন করে কেউ তার ওপর বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা নিয়ে আসেননি। এ চোখে কেউ দেখেনি তাকে।
কোথায় একটা সাড়া জাগে। মধু যেন হেরে যাচ্ছে। তার মনের সেই শক্ত প্রাচীরটা বৃষ্টির ধারা স্নানে যেন গলে গলে পড়ছে। লেখা ওকে দেখছে। হৃদয়ের উত্তাপের একটা প্রত্যক্ষ ফল আছে। তাকে কেউই ব্যর্থ করতে পারবে না।
মধু বলে—যাঃ বাবাঃ। ফের ওইসব সুনীতি-সুধার পাল্লায় টেনে নিয়ে যাবে? মাইরি, ওসব পোষাবে না। কখন মাল খেয়ে কাকে কী বলব!
—সে আমি বুঝব। তাহলে ওই ঠিক রইল তো? কথাটা আমিই বলব ভুবনবাবুকে?
চমকে ওঠে মধু—ব্যস! তারপর আর বাকি থাকবে কিছু?
হাসে লেখা। আজ যেন সে বদলে গেছে। মধুও অবাক হয়।
কী ভেবে মধু শোনায়—থাক। আমিই বলব। যত্তো সব ঝুট-ঝামেলা!
বৃষ্টি ধরেছে একটু। তখন ফিনফিন করে বৃষ্টি ঝরছে পথ অন্ধকার। এদিক-ওদিকে দু-একটা আলো জ্বলছে। লেখা বলে—একটু এগিয়ে দেবে না?
মধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, মেয়েটার সাহস দেখে অবাক হয়েছে সে। তাই বলে –এরপর ওই গাঙে ডুবে মরা ছাড়া আর পথ থাকবে না তোমার।
—ক্ষতি কী! হাসে লেখা। বলে, গাঙের ধারে বাস করে না হয় ডুবলামই।
লেখা নিজের সাহসে আজ নিজেই বিস্মিত হয়েছে। হালকা মনে ফিরছে সে। সারা আকাশ-বাতাসে ওই ঝোড়ো হাওয়ার মাঝে সে মুক্তির সুর শুনেছে।
পরদিন কথাটা এসে জানায় মধু ভুবনবাবুকে, ভুবনবাবু অবাক হন। মহিমবাবুও। চঞ্চলবাবু খুশি হন—তাহলে যাচ্ছেন? ব্যস!
মধু বলে—ভেবে দেখলাম কথাটা। বেশ, আপনারা বলছেন যখন যাচ্ছি। তবে হ্যাঁ, তঞ্চকতা দেখলে আমি কিন্তু খুন-খারাপি করে বসব। তখন দোষ দেবেন না। তারপর ওই বাদাবনে মেয়েছেলে নিয়ে যাওয়া কী ঝামেলা জানেন না।
লেখাও হাজির হয়েছে। সে কঠিনকণ্ঠে জানায়—নিজের দায়িত্বেই যাচ্ছি।
—অ!
মধু অবাক হয়। এ যেন অন্য মানুষ। তাকে যেন চেনে না। ওর মুখে-চোখে সেই কাঠিন্য। মহিমবাবুকে মধু সাবধান করে, – লঞ্চের ইঞ্জিনপত্তর ঠিক আছে তো? যদি গড়বড় করে, তোমার ওই লঞ্চ মাঝগাঙে আমিই ডুবিয়ে দোব। বুঝলে পেসিডেন?
ভুবনবাবু বলেন—আরও স্পিডবোট, লঞ্চ যাচ্ছে। মালপত্তরও যাতায়াত করবে তাতে। কোনো অব্যবস্থা হবে না।
মধু গজরায়—সেইটা দেখবেন। মাঝ-পথে মাল গায়েব করলে তার জিভ টেনে সলতে পাকিয়ে দোব। ইয়ার্কি মারতে যাচ্ছি না সেটা হুঁশ থাকে যেন। ওদের বলে দেবেন। আর জানিয়ে দেবেন আপনার এস ডি ও সাহেবকে, সরকার-ফরকারের খাতির থাকবে না বেচাল দেখলে!
অশ্বিনী ডাক্তার লেখার মতের ওপর কোনদিনই কথা বলেননি। বোনকে বিশ্বাস করতে পারেন তিনি। নিজের দৃঢ়তা আছে। তবু বলেন,
—সাবধানে থাকবি লেখা। অসুবিধে হলে জানাবি।
চঞ্চলবাবুও দলবল নিয়ে তৈরি হন। গাঁটবন্দি কাপড়-জামা, কম্বল, ওষুধের পেটি মায় ওদের খোরাকি চাল, ডাল, আলু-কুমড়ো, পেঁয়াজ উঠছে।
মধু দেখে-শুনে মাল তুলছে—পদা, চাল-ডালের বস্তা ওপাশে রাখ, জলের ছিটে লাগলে নষ্ট হয়ে যাবে। ওষুধগুলো ভালো করে রাখ।
পদা, যতিলাল বলে ওঠে—বিলেতি আছে গুরু?
চঞ্চলবাবু শুধোন—কেন, দিশি ওষুধও তো ভালো!
মধু হাসছে—ওদের কথা যেতে দিন স্যার! ও শ্লারা ওষুধ বলতে ওই দ্রব্যই বোঝে মাইরি! অ্যাই, খপরদার ওসব গিলবি না যখন-তখন, তা’লে কিন্তু পেঁদিয়ে বেন্দাবন দেখিয়ে দোব।
দু-একজন ভলানটিয়ার পাটভাঙা প্যান্ট-শার্ট পরে ঘুরছে। মধু বলে,—ও বাবু, ওসব ছাড়ুন আজ্ঞা। ওসব দেখবার জন্যে কেউ নেই এখানে। অ্যাই হাঁদা, তোলা হল মালপত্তর? জলের জালাগুলো ভরেছিস?
খাবার জলও নিয়ে যেতে হচ্ছে। লেখা দেখছে মধুকে। মালপত্তর তার ফদমতো তোলা হচ্ছে।
–অ্যাই যতে, তেরপলগুলো কই রে? দাঁড়িয়ে ভিজবি যে বানচোত!
—তুলেছি গ! যতে সাড়া দেয়।
মধু লঞ্চের মালপত্তর তন্নতন্ন করে দেখে বলে—এইবার উঠুন আপনারা!
লঞ্চ ঘাটে ভুবনবাবু, মহিমবাবু, অশ্বিনী ডাক্তার আরও অনেকে এসেছেন। হাটতলার মুরুব্বি দোকানদার আড়তদার মহাজনরাও মোটা টাকা চাঁদা দিয়েছে। আরও সাহায্য। একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল লেখা। তার জিনিসপত্তরও উঠে গেছে।
মধুর দিকে চোখ পড়তে মধু ওকে বলে—উঠে এস!
লেখা দাদাকে প্রণাম করে এগিয়ে এল।
মধু হাঁক পাড়ছে—নসো? অ্যাই ইয়াকুব!
সারেঙ নসু এগিয়ে আসে—কি গো!
—লঞ্চ ঠিক আছে তো? আবার যদি গড়বড় করে তোর লঞ্চ—লঞ্চসমেত তোকেই মাঝ গাঙে বেসজ্জন দিয়ে দোব।
নসু বলে—না, না। সব ঠিক-ঠাক করেছি।
মধু শাসায়—চল, দেখছি। ইঞ্জিন চালু কর।
ওরা তৈরি। মধু গজগজ করে—ফের ঝামেলায় জড়ালেন দারোগাবাবু। যত্তোসব! কই, উঠেছে সব?
মধু চিৎকার করে ওঠে—কালী মাইকি জয়!
তীরে দাঁড়িয়ে একটা বোতল থেকে কয়েক ঢোক তাজা মদ গলায় ঢেলে লাফ দিয়ে লঞ্চের ওপর উঠে নিজে স্টার্ট দিল এঞ্জিনে। ধাতব শব্দ ওঠে—টা…টা…ট্রা…ট্রা…
কাচের সেইঘর থেকে হাত নাড়াচ্ছে মধু চৌধুরী। ঘন্টা বাজে। লঞ্চটা প্রপেলারে জল কেটে পিছিয়ে গিয়ে ঘাট ছেড়ে মাঝগাঙের দিকে পাড়ি জমাল। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় লাফাচ্ছে ওটা। রাজহাঁসের মতো চলেছে লঞ্চটা। তীরে দাঁড়িয়ে আছে ধনেখালির অনেক মানুষ। মেয়ে, ছেলে সকলেই। দুর্গত মানুষগুলোকে বাঁচাতে চলেছে নতুন মানুষের দল।
অশ্বিনী ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছেন। ভুবনবাবুও। মহিমবাবু বলে—মদ ও খাবেই ভুবনবাবু!
ভুবনবাবু কথা বলেন না। মনে হয়, স্বভাবের মধ্যে এই প্রকৃতির উদ্দামতাই রয়ে গেছে। তাই সে দুর্বার।
অশ্বিনী ডাক্তার বোনের কথা ভাবছেন। ওর মনের অতলেও অমন কাঠিন্য আর দুর্জয় সাহস রয়েছে। ওরা কোন বিচিত্র জগতের মানুষ
একটা সাদা বিন্দুর মতো দূরে নদীর বাঁকে মিলিয়ে গেল লঞ্চটা।
.
লঞ্চটা চলেছে। লেখার এ জগৎ চেনা। কিন্তু সেখানে আজ এসেছে ভাঙনের সর্বনাশ। গাঙের বিস্তার বেড়ে চলেছে। নদীর বুকে তুফান ওঠে, ঢেউগুলো জোয়ারের জলে ফুলে উঠে লঞ্চটাকে নিয়ে লোফালুফি শুরু করেছে। দমকা হাওয়ার সাপটে কাঁপছে লঞ্চটা, যেন উলটে পড়বে। সেই সঙ্গে নেমেছে বৃষ্টি।
ভলানটিয়াররা পর্দা ফেলে লঞ্চের ভেতরে বসে আছে, এদের মুখ শুকিয়ে গেছে।
ইয়াকুব বলে—আজ্ঞে ওই চট-ফটগুলো তোলেন বাবু, হাওয়া বাধি গেলে লঞ্চটারে কাতাইয়া দেবানি।
মধু গর্জায়,–বাবুদিকে পর্দা তুলে ফেলতে বল। জল লাগবে লাগুক, এ তো বরযাত্রী যাচ্ছি না!
ওরা পর্দা তুলে ফেলে।
মধুই স্টিয়ারিং ধরেছে। ফুল স্পিডে লঞ্চটা ছুটে চলেছে ওই ঢেউয়ের মাথায় মাথায় টপকে।
হঠাৎ পেছনে ফিরে তাকাল মধু। জলের ছাট আসছে। লেখা দাঁড়িয়ে আছে পাশের রেলিং-ঘেরা জায়গাটায়। মাথার চুলগুলো উড়ছে, উড়ছে ওর শাড়ির আঁচল।
—কেন এলে বলতে পার? মধু তাকে শুধোয়।
লেখা তাকাল ওর দিকে। জবাবটা লেখাও জানে না। ও শুধু হাসল মাত্র। মনে হয় ওই হাসিটুকুতেই তার প্রশ্নের জবাব রয়ে গেছে।
মধুর ওসব বোঝার সময় নেই। স্টিয়ারিং-এ মোচড় দিয়ে লঞ্চ পারমুখো করে বলে,—অ নসু, মোল্লাখালির গঞ্জ শ্লা গাঙের জলে তলিয়ে গেছে র্যা!
মধুর কথায় নসুও জবাব দেয়—তাই তো দেখছি গ! হাটতলা, আড়ত, কলবাড়ি সব ভেঙে কেতিয়ে এক্কাকার, আর মাঠগুলান দ্যাখো মধুবাবু! লোনাজলে হেজে গেছে যি গ!
মধুও অবাক হয়। লোকগুলো তীরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে। শীর্ণ বন্দি, বুভুক্ষুর দল।
মধুর চোখে জল আসে। বলে সে—সত্যি লেখা, না এলে শ্লা পাপ হত।
.
বুভুক্ষা বন্যার্ত লোকগুলোর ক-দিন কেটেছে প্রায় অনাহারে। সাজানো গঞ্জের টিনের চালাঘর, গরানখুঁটি পোঁতা শনঘেরা দোকান-পসার, আড়ত সব ধুয়ে-মুছে গেছে। ভেড়ির হানামুখ দিয়ে কোটালের বান ঢুকে সব মুছে নিয়ে গেছে।
টিউবওয়েলগুলো ডুবে গেছে, বুজে গেছে পলি-কাদায়। মিঠে-জলের পুকুরও ভরে উঠেছে বিষাক্ত লোনাজলে। কাতারে কাতারে লোক এসে জুটেছে ওই মোল্লাখালিতে, দুর আবাদ অঞ্চল থেকে। সেখানে বাঁচার কোনো পথ নেই। কিন্তু এখানেও তারা নিশ্চিত মৃত্যুর পদধ্বনি শুনছে। হঠাৎ ওই তুফানে লঞ্চটাকে আসতে দেখে ওরা ছুটে আসে তীরে। চিৎকার করে দু-হাত তুলে ডাকছে তাদের।
লঞ্চ ধারে এলে কেউ কেউ কুমির-কামটের আক্রমণের কথা ভুলে গিয়ে জলে নেমে পড়েছে। কে অস্ফুটকণ্ঠে আর্তনাদ করছে।
চঞ্চলবাবু, ভলানটিয়ারের দল ঘাবড়ে গেছে। ওই জনতা এসে জলের মধ্যে লঞ্চে চড়াও হলে লঞ্চ এই গাঙেই ডুবে যাবে। তাই চিৎকার করছেন তিনি,
—অ্যাই, এসো না। আমরা যাচ্ছি।
কে শোনে কার কথা!
মধু লাফ দিয়ে এসে পাটাতনে নেমে কোত্থেকে একটা লগি নিয়ে দুমদাম জলে পিটছে আর গর্জাচ্ছে,—লঞ্চের কাছে এলে ঘা মেরে মাথা ফালা করে দোব। অ্যাই, অ্যাই! মারলাম। যাও, ধারে যাও! না’লে খুন করে দোব, মধু চৌধুরীকে চিনিস না?
লোকগুলো মধুকে দেখে আর তার ওই মারমূর্তি দেখে সরে গেল। মনে হয় অনেকেই খুশি হয়েছে মধুকে দেখে,—মধুবাবু, এলে শেষ পর্যন্ত! দেখি যাও আমাদের হাল!
—বাবু জমি দিলা, সব বানেই ডুবি গেল।
মধু চিৎকার করে,—সবাই সরে যা। সব ব্যবস্থা হবে। পদা-যতে, দুপাশে লগি হাতে দাঁড়া। যে শ্লা এগোবে, মাথা ফেঁড়ে দিবি। নসো, লঞ্চ ঘাটে ভিড়ো এইবার।
চঞ্চলবাবু, লেখা, এই ভলানটিয়ারের দল অবাক হয়।
মধুর তর্জন-গর্জনে ওরা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। একটি লোক যেন একাই একশো।
.
ক’দিনের মধ্যেই ওই লোকজনদের সাহায্যে ও পাশের উঁচু ঢিবির ওপর ভেঙে পড়া স্কুলবাড়িটাকে আবার টিন আর নতুন খুঁটি দিয়ে দাঁড় করিয়ে চক মোল্লাখালিতে রিলিফের হেডকোয়ার্টার গড়ে তুলেছে। লঙরখানা, ডাক্তারখানা, ওষুধপত্তরের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
মধু বলে—এখানে বসে থাকলে চলবে না স্যার, আপনার ছেলেদের বলুন এদিক-ওদিকের বসতেও যেতে হবে।
নদীর একদিকে আদিম অরণ্য, ভয়াল কালো রহস্য বুকে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। দেখছে ক-টি মানুষের এই বাঁচার সংগ্রাম। মাঝে মাঝে রাতের অন্ধকারে সেই আদিম অরণ্যভূমি কী হিংস্র গর্জনে কেঁপে ওঠে। বাঘগুলো হাঁকছে, জলের সীমানা পার হয়ে এই আবাদে ভেসে আসে সেই গর্জনের শব্দ।
মধু বলে—ঠিক জুত করতে পারছে না বাছারা, তাই গোঙাচ্ছে।
চঞ্চলবাবু ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। অন্ধকারে এদিক-ওদিকে আগুন জ্বলছে। মধুই এই ব্যবস্থা করেছে দু-একদিন রাতের অন্ধকারে বাঘের আক্রমণের পর।
আগুন আর কলরব শুনে ওরা এপারে এগোয় না।
দিন-রাত পরিশ্রম করে চলেছে লোকটা। লেখাও দেখেছে মধুকে। ওই নিঃস্ব সর্বহারার দলে মিশে গেছে। তাদের সঙ্গে আবার নতুন ভেড়ি বেঁধেছে। ওদের মুখে জুগিয়েছে, শাাকান্ন, নিজেও তাই খেয়েছে।
ইরিগেশনের ইঞ্জিনিয়ার মিঃ মিত্র, এস ডি ও সাহেব, ভুবনবাবু, অশ্বিনী ডাক্তার মায় মহিমবাবু অবধি লঞ্চে করে এসেছেন। ওঁরাও অবাক হন। কয়েকদিনের মধ্যে আবার ওই ধ্বংসপুরীতে প্রাণের সঞ্চার করেছে একটি মানুষ, ওই মধু চৌধুরী।
ভেড়ির হানামুখ বাঁধা হচ্ছে, আবার ভাদ্রের প্রথম দিকেই ওরা নতুন ফসল পুঁতেছে। মিত্র সাহেব বলেন,
—ইউ হ্যাভ ডান মিরাকল মধুবাবু!
মধু হাসে,—ধ্যাত্তেরি, কী সব আজে-বাজে কথা বলছেন স্যার! শাদের নিজের দায়েই ওরা ভূতের মতো খেটেছে। আমি কোন হরিদাস পাল! আরে ডাক্তারবাবু যে, নমস্কার! ভুবনবাবু! ব্যাপার কি স্যার? বলি মধু চৌধুরীকে আবার এত্তেলা কেন স্যার? মাইরি বলছি, এখানে এসে মদ খেতেও ভুলে গেছি। শ্লা ভাত জোটে না, মদ গিলি কি করে? লেখা বলে, এটা নাকি সোশ্যাল ক্রাইম, সামাজিক অপরাধ!
হাসছেন ভুবনবাবু
মধুর ভালো লাগে না। ও বলে, – হাসবেন না মাইরি! শ্লা মধুসুদন চৌধুরীর বারোটা বাজিয়েছেন আপনি। ঢের ঢের দারোগা দেখেছি, এমন মাল দেখিনি। ঠিক কায়দা করে মধু চৌধুরীর মতো লাটকেও সযুত করে দিলেন? অ্যাঁ!
হাসছেন ভুবনবাবু
রিলিফ ক্যাম্প থেকে বেশ কিছুটা দূরে এসে গেছেন তাঁরা। সামনে দিগন্তপ্রসারী ধানখেতে সবুজের ইশারা, মুক্ত গাঙের রুপালি বিস্তার, ওদিকে আদিম অরণ্যের সবুজে কী রহস্য-ঢাকা পৃথিবী। নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো পেঁজা তুলোর মতো ভেসে হারিয়ে যায়, বাতাসে মাথা নাড়ে সাদা কাশফুলের রাশি। গাঙচিলের তীক্ষ্ণ ডাক শোনা যায়
—মধু! একটা কথা আমারও বলার আছে।
ওঁর দিকে তাকাল মধুসূদন। এতদিন ধরে ভুবনবাবুকে দেখেছে। হয়তো তারই বয়সি একটি তরুণ। আজ ওঁর কণ্ঠস্বর অন্য কী সুর ফুটে ওঠে। পদমর্যাদায় রাশভারী কণ্ঠস্বরও নয়।
ওঁর হাতটা মধুর হাতে, সেই স্পর্শে কী আন্তরিকতা ফুটে ওঠে। মধু ওঁর দিকে তাকাল। ভুবনবাবু এতদিন ধরে দেখেছেন মধুকে। ও যেন তাঁর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়েই ফুটে উঠেছিল। মনস্তত্ত্বের ছাত্র ভুবনবাবু দারোগাগিরি করতে এসে একটা মানুষকে আবিষ্কার করেছেন, সেই সঙ্গে মনের দিক থেকেও তাদের নিবিড় একটি যোগাযোগ গড়ে উঠেছে।
দুজনে চিনেছে দুজনকে
মধু বলে—তা বলেই ফ্যালেন দারোগাবাবু!
ভুবনবাবু বলেন,—অনেক লোকের মধ্যে তোমাকে আমিই চিনেছিলাম মধু। চেয়েছিলাম তুমি ভুল পথে নিজেকে ফুরিয়ে দেবে না। আজ আমার সেই চাওয়া পূর্ণ হয়েছে, আজ মানুষ ভুবনবাবু তোমাকে ভালোবাসে মধু, সেই ভালোবাসায় কোনো ফাঁক নেই।
হাসে মধু—যাচ্চলে! আমিও প্রথম ঠোক্কর দিতেই চেয়েছিলাম স্যার। তবে মনে হয় দুজনেই আমরা একধাতের জীব। তাই আমারও কেমন ভালো লেগে গেল। আপনাকে, ব্যস!
হাসছে মধু। গাঙের বুকে পাল তুলে ভেসে চলে কোনো পসারি নৌকো, হঠাৎ ভেড়ির ওদিকে চেয়ে অবাক হয় মধু। লেখা আসছে, এলোমেলো হাওয়ায় উড়ছে ওর শাড়ি। রিলিফ সেন্টার থেকে কাজ সেরে ক্যাম্পে ফিরছে লেখা।
মধু বলে—ওই লেখা আর আপনি দুজনে মধু চৌধুরীর দফা নিকেশ করলেন স্যার। তবে আম্মো মধুসূদন চৌধুরী, শোধ আমি নোবই ভুবনবাবু।
হাসছেন ভুবনবাবু। লেখা এগিয়ে আসে।
—এত হাসির কী হল?
ভুবনবাবু বলেন—বুঝলেন মিস রায়, মধুসূদন আমাকে নাকি টাইট করে দেবে।
লেখা বলে—তা ও পারে ভুবনবাবু, ওর গুণের ঘাট নেই।
ভুবনবাবু বলেন—ঠিক আছে। ওই কথাই রইল!
মধুসূদন হাসছে—শেষে দোষ দেবেন না কিন্তু!
—দেখা যাক!
হঠাৎ লেখা বলে—দেরি হয়ে গেছে। খাবেন না?
—তাই তো! কথায় কথায় খেয়াল নেই। ভুবনবাবু বলেন, জোয়ারের সময় হয়ে এল। ফিরতে হবে ধনেখালিতে।
ওদিকে লঙরখানার লোকজনের ভিড় লেগেছে। মধু বলে—ওদের খাবার ব্যবস্থা দেখে যাই ভুবনবাবু। লেখা, তুমি বরং ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে এঁকে ডাল-ভাত যা হয় দুটো খাইয়ে দাও।
—তোমার? ভুবনবাবু শুধোন।
—পরে হবে, এখন ও ব্যাটাদের দেখি গে। যান স্যার, আমি একফাঁকে খেয়ে নোব। মধু চলে গেল ওদিকে।
ভুবনবাবু বলেন—বিচিত্র মানুষ! বুঝলেন মিস রায়, কোথায় ওর মনে ছিল দুর্বার একটা জ্বালা আর ব্যর্থতা। সেই আঘাতে ও জ্বলে উঠেছিল। আজ দেখছেন ওকে? এ চেঞ্জড্ ম্যান। ও বলে কি জানেন?
লেখা ওঁর দিকে তাকাল। লেখার ডাগর কালো চোখে কী কৌতূহল। রোদে-বৃষ্টিতে কাজ করে ওর চেহারায় এসেছে রুক্ষতা আর কাঠিন্য। তবু মনের শুচিতা ওর কমনীয়তার সঙ্গে মিশে একটি অপূর্ব শ্রী এনেছে, সেটুকু ওই রুক্ষতাকে ছাপিয়ে উঠেছে।
ভুবনবাবু বলেন—আপনিও নাকি মধুর এই কঠিন অবস্থার জন্য দায়ী।
লেখা একটু চমকে ওঠে। কথাটা মিথ্যে নয়। এটা তার নিজের মনের অতলের সান্ত্বনা। ওই লোকটার পরিবর্তনে তার এই খুশি হবার কারণ লেখা জানে না। তবে খুশি হয়েছে এটা মিথ্যা নয়। আর তার জন্য সলজ্জভাব ফুটে ওঠে ওর চোখে-মুখে। এটা ভুবনবাবুকে জানাতে চায় না লেখা, এটা তার মনের একান্ত গোপন একটি অনুভূতি। তাই ঢাকবার চেষ্টা করে, তবু সুর ওঠে মনের অতলে। মধু তাকে কোথায় নীরব স্বীকৃতি দিয়েছে।
তবু সহজ হবার চেষ্টা করে বলে লেখা—ওঁর কথা ছেড়ে দিন। কারও কথাই ও শোনে না। জীবনটা ওর কাছে শুধু খেয়ালে-ভরা। এটাকেও খেয়াল বলতে পারেন।
ভুবনবাবু বিশ্বাস করতে চান না। তাই শুধোন—এর কি কোনো দাম নেই ওর কাছে?
লেখা হাসল—কী জানি! তবে মনে হয় কোনো কিছুতেই ওর মোহ নেই। মন্দকে ঘৃণা করে, ভালোর জন্যও উচ্ছ্বাস নেই।
লেখার কথায় অভিমানের সুর ফুটে ওঠে। সহজ কণ্ঠে বলে সে—চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে আপনার।
দুজনে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যায়।
মধু তখন কাজে ব্যস্ত। বালতি হাতে এদিকে-ওদিকে দৌড়াচ্ছে। লোকগুলোকে খাবার দিতে ব্যস্ত। ওদের দিকে একবার তাকাল। একটু অবাক হয়েছে মধুসূদন, ওদের দুজনকে ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলতে দেখে। এই ব্যাপারটা তার কাছে নতুন ঠেকে, মনে হয় কী একটা অর্থবহ এই ঘটনাটুকু।
গাঙের দিক থেকে হাওয়া বইছে। কাশবনের সাদা ফুলগুলো মাথা নাড়ছে সেই দামাল হাওয়ায়। মধুসূদনের চোখের সামনে থেকে এই বাদাবন, গাঙ, ওই বুভুক্ষু জনতার মুখগুলো মুছে যায়।
লেখার হাসির সেই সলজ্জভাবটুকু ওর চোখে নতুন ঠেকে।
কে চিৎকার করে—বাবু গ’! আরও চাট্টি ভাত, অ বাবু!
মধুর মনের সব সুর কেটে যায়। মধুসূদন গর্জন করে ওঠে—কে!
—অ্যাই! কোন শ্লা পাস না, যে চেল্লাছিস? দাঁড়া চুপ করে। ওহে, অ ভলেনটিয়ার, একটু হাত চালাও ভাই! পেটে খিদে থাকলে এমন করবেই। পদা, শ্লা দাঁড়িয়ে মজা দেখছিস? মারব এক লাথ! নে, খিচুড়ির বালতি ধর।
পদাও দেখেছে ব্যাপারটা, লেখাকে দেখেছে ভুবনবাবুর সঙ্গে। পদা বলে,
—দিচ্ছি তো গুরু!
—হাত চালা।
মধু দলবল নিয়ে পরিবেশন করতে থাকে। কালো হয়ে গেছে সুগৌর রং, রোদে-পোড়া তামাটে কঠিন একটি মানুষ, কী যন্ত্রণাময় জীবনের মাঝে নতুন জীবনের আশ্বাস এনেছে।
পদা তবু শুধোয়—মাঝে মাঝে উদোস মেরে যাও কেন গুরু?
মধু গর্জায়—অ্যাই, মারব এক রদ্দা! কাজ কর!
.