অমানুষ – ৫

ভুবনবাবু কিছুদিন আগেই গিয়েছিলেন আমতলির নতুন আবাদে। নিজেই বিশ্বাস করতে পারেননি সেখানে মধুসূদন এমনিভাবে কাজ করতে পারবে। হরিণগাড়ার গাঙের বিস্তার ক্রমশ বেড়ে চলেছে। একদিকে তার নয়া আবাদ, অন্যদিকে মাথা তুলেছে বড়ো বড়ো কেওড়া গরান গাছের ঘন সবুজ রাজ্য। কী বিভীষিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিম অরণ্য! নদীর একপাশে এখনও রাতের অন্ধকারে বাঘ হুংকার দিয়ে ফেরে। 

অন্যদিকে নতুন আবাদের ভেড়ি পত্তন হচ্ছে। 

ভুবনবাবু আরও নীচের বসতিতে গিয়েছিলেন, পথে নৌকো বেঁধে মধুর খবর নিয়ে আসেন।

চড়চড়ে রোদ। ওই রোদেই তালপাতার মাথালি মাথায় দিয়ে মধু চিৎকার করছে—এইদিকে জোড়বাঁধে ভালো করে মাটি ফেল। পদা, ওদিককার মাটিগুলো যেন চারানো হয় দেখবি, না’লে ঘোগের গর্ত হয়ে যাবে। তখন দেখবি নোনা জলের খেল, আর কর্তারা বলবে শ্লা মধো চৌধুরী ফাঁকি দিয়েছে। 

পদা বোতলে শেষ চুমুক দিয়ে বলে—যেছি গ’, ইযি তুর্কি নাচন লাগল। অয় বাপ! 

সামনেই ধড়চূড়া পরা অবস্থায় ভুবনবাবুকে দেখে অবাক হয় পদা, খালি বোতলটা লুকোবার চেষ্টা করে, অবশ্য পা ওর টলছে। আর মধু ওই রোদেই চোখ লাল করে চিৎকার করছে কুলিদের উদ্দেশে। সামনে দারোগাবাবুকে দেখে মধু অবাক হয়,—যাচ্চলে! আরে দারোগাবাবু যে? আসুন, আসুন! বসতেই বা দিই কোথায়? অ্যাই যতে বানচোত, একটা কিছু লিয়ে আয়! 

সামনেই ওদের হোগলার চালা, ওইটাই ওদের অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার। বাঁশের তেপায়া করে তাতে রোদে শুকোতে দেওয়া হয়েছে একটা আস্ত বাঘের চামড়া, দু-একটা হরিণের চামড়াও রয়েছে। এই নদীর ধার বরাবর উঠেছে নতুন বাঁধ। সুন্দর শক্ত মজবুত বাঁধটা এদিক থেকে ওদিকে চলে গেছে ছত্রাকারে। ক-মাসেই জায়গাটার রূপ বদলে দিয়েছে, মাঠে মাঠে চাষিরাও নতুন আবাদে সার গোবর দিয়ে জমি চাষ করছে, মরামাটির বুকে সবুজ ধান-শিশুর দল মাথা তুলবে। 

ভুবনবাবু দেখছেন মধুকে। রোদে-জলে ওর ফর্সা রং-পুড়ে তামাটে হয়ে উঠেছে। হাজার কুলিকে একাই কাজ করাচ্ছে। 

ওদিকে তাদের জন্য সার সার জোল কেটে হাঁড়ি চাপিয়ে রান্না হচ্ছে। মধু বলে—তা এখানেও কি অ্যারেস্ট করতে এসেছেন মধু চৌধুরীকে? শ্লা—নিরিমিষ্যি জায়গায় ফেলে রেখেছেন ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে, তাতেও খুশি হননি মাইরি? 

হাসছেন ভুবনবাবু। তিনি বলেন—না, না। দেখতে এলাম কাজ-কম্মো কেমন হচ্ছে। চমৎকার কাজ করেছ কিন্তু! 

মধু মাথালিটা খুলে ঘাম—মুছে জবাব দেয়,—গ্যাস দেবেন না মাইরি। কইরে পদা, চা হল? আর স্যারকে দে গোটাকতক কাছিমের ডিমের মামলেট করে। 

ভুবনবাবু সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক। তাই বলেন—না, না। চা-ই দাও। আর এই জোয়ারেই ফিরতে হবে হে! 

—তা’লে হরিণের মাংসই দে খানিকটা 

মধু আরও বলে,—শ্লা বীজধান বের হয়েছে, আর হরিণের দলও পিছু লেগেছে। দিলাম দু-একটা পেড়ে। আর ওই যে উনি— 

বাঘের চামড়াটা দেখায় মধু। বলে চলেছে, 

—উনি মহারাজ দিনকতক হাঁকাড়ি দিয়ে ফিরছিলেন। কুলি-কাবারি তো পালায় আর কী! ফেঁসে যাব তা’লে। তাই দিলাম একদিন সাবড়ে এক গুলিতে। 

ভুবনবাবু দেখছেন ওকে। বলিষ্ঠ একটি মানুষ। এই বন্য আদিম বিভীষিকাকে সে জয় করেছে, আর অসাধ্য সাধন করেছে। 

খুশি হয়েই ফিরেছিলেন সেদিন। মনে হয় ভুবনবাবুর, তাঁর হিসেবে ভুল হয়নি। 

আজ ওঁদের মুখে ওইসব কথাগুলো শুনে চুপ করেই থাকেন ভুবনবাবু। থানার বারান্দা থেকে দেখা যায় একটা লঞ্চ ভাঁটির দিক থেকে উজানে আসছে। 

কর্মহীন দিন। এই আবাদের জনপদে দিনের অবকাশ মুহূর্তগুলো মন্থর। অশ্বিনীবাবু কী ভাবছেন। 

লঞ্চটা থানার ঘাটে এসে ভিড়ছে। ইরিগেশনের তরুণ ইঞ্জিনিয়ার মিঃ মিত্র উঠে আসেন।

–কই ভুবনবাবু চায়ের ব্যবস্থা করুন। পনেরো মিনিট পরেই ফিরব। কুইক। আরে মহিমবাবু যে, নমস্কার! 

মাত্র ক-টি মানুষ এঁরা, তাই আসা-যাওয়ার ফলে সকলেই সকলের চেনা। 

মিঃ মিত্র শুধোন,

—আপনার কাজ কেমন চলছে? 

মহিমবাবুর ঠিকাদারির কাজও আছে। তাই জবাব দেয়,—চলছে, তবে যা রেট দিয়েছেন স্যার, তাতে আর কাজ করা যাবে না। সব তো বেড়ে গেছে। 

মিঃ মিত্র ঘড়ি দেখছেন। চা এসে গেছে। মিঃ মিত্র বলেন—তবে কাজ করছে ভুবনবাবু আপনার ওই মধুসূদন। প্রথমে আমিও ঠিক রিলাই করতে পারিনি ওকে। তবে ভাবলাম, দেখি। এখন দেখছি অসাধ্য সাধন করেছে মশায়। ওর কাজই আইডিয়াল হয়েছে। ওখানেই গিয়েছিলাম ইন্‌সপেকশনে। 

মহিম ঘোষালের মুখে কিসের কালো ছায়া পড়েছে। অশ্বিনীবাবু বলেন, 

—কাজ ও করতে পারে, লেবারদের সঙ্গে সহজভাবে মিশে। তবে মশায়—গোঁয়ার, বেহেড।

হাসছেন মিঃ মিত্র—ইয়েস! স্যার মাস্ট বি সাম ভাইসেস্, তবে মধু অনেস্ট আর সিনসিয়ার। আমি তো মশায় ওকে আরও কাজ দিতে চাই। মহিমবাবু, আপনার দুর্গাতলির বাঁধও দেখলাম, আরও ভালো করা দরকার। বড়ো গাঙের মুখের বাঁধ, তাছাড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ ওই বাঁধ। ওর দিকে একটু নজর দিন। না হলে বিপদ হবে, চলি ভুবনবাবু, আরও দুটো ইনস্পেকশন সেরে ফিরতে হবে। 

ওঁদের আড্ডায় কয়েক মিনিট থেকে একটা সাড়া তুলে আবার বের হয়ে গেলেন মিঃ মিত্ৰ। ভুবনবাবুও খুশি হয়েছেন মধুর কথা শুনে। মহিম ঘোষাল কী ভাবছে। ওর সেই মেজাজটা নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে মিঃ মিত্র তাকে ওই বাঁধের সম্বন্ধে একটু হুঁশিয়ার করে গেলেন তার সামনে মধুর প্রশংসা করেই। 

মহিম ঘোষাল কূট-কচালে লোক। ওই ব্যাপারটাকে সে আমলই দিতে চায় না। তাই সহজভাবেই আবার কথা বলার চেষ্টা করে। 

কিন্তু কোথায় তবু বেসুর বাজে। 

বেলা হয়ে গেছে। ওঁদের আড্ডাও এবেলার মতো ভেঙে যায়। 

.

মহিম ঘোষাল আর অশ্বিনী ডাক্তার ফিরছে ওদের বাড়ির দিকে। রোদ বেড়ে উঠেছে। শান্ত জনপদের নিচে গাঙে জলস্রোত চলকে ওঠে। পাখিগুলো কলরব করে। দু-একটা জেলে নৌকো মাঝ-গাঙে মাছ ধরছে, ভেসে ভেসে চলেছে স্রোতের টানে। 

মহিম ঘোষাল মধুর এই প্রশংসায় ঠিক খুশি হতে পারে না। মনে হয় মধু তাকেই যেন টোক্কর মারবার জন্য ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। মহিম ঘোষাল হাসছে, 

—বুঝলেন অশ্বিনীবাবু, শেষরক্ষা করা নিয়ে কথা। সেইটাই যে কতদূর হবে তা জানি না। মদ আর ওই গিয়ে ইয়ে—মানে বুঝলেন, ও রোগ সারবার নয়। রক্তের দোষ কিনা। 

অশ্বিনী ডাক্তার চুপ করে থাকেন। তাঁর বয়স হয়েছে। বাতে পা-গুলো টনটন করে, শরীরটাও ভেঙে পড়েছে। এককালে সারা আবাদ অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন, আজ আর বাইরে কোথাও যাবার শক্তি-সামর্থ্য নেই। ধনেখালির এই বদ্ধ-পরিবেশে দিন কাটাতে হয়। 

মহিমবাবু বলে,—তাহলে ওই স্কুলের ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখবেন। 

অশ্বিনী ডাক্তারের ওসবে আর মন নেই। সারা জীবনটা এভাবেই কেটে গেছে, লেখার জীবনেও রয়ে গেছে শূন্যতা। অশ্বিনীবাবু এতদিন এমনিভাবে জীবনের হিসেব-নিকেশটাকে দেখেননি, আজ দেখতে গিয়ে হতাশই হয়েছেন। জমার খাতায় কিছু নেই, সবই খরচ করে ফেলেছেন। 

লেখার জন্য ভাবনা হয়। ও কি নিয়ে থাকবে? 

মহিমবাবুর কথায় অশ্বিনী ডাক্তার বলেন,

—লেখাকে বলে দেখবেন ও কী বলে। 

—তবু একটা কাজ যদি ভালোভাবে হয়, হোক। টাকা আমি দেব। মহিম ঘোষাল যেন দানবীর হতে চায়। 

.

শান্ত—স্তব্ধ জনপদ। 

হাটে দুদিন লোকজন আসে, নৌকোর ভিড় জমে। কলরব ওঠে। বাকি ক-দিন গাঙের ধারে ঝিমিয়ে পড়ে থাকে এই বসত। 

শীতের দিন পার হয়ে আসে বসন্ত। গাঙের ধারে কেওড়া-গরানের গাছগুলো একদিন নতুন পাতা আর জিরি জিরি চন্দন ফুলে ভরে ওঠে। জোয়ারে নদীর জলে ভেসে আসে ফুলের রাশি। 

তারপরই কালবৈশাখির কালো মেঘের মাতন শুরু হয়। গাঙের রূপ বদলে যায়। কালো মেঘগুলো উত্থাল-পাথাল ঝড়ে ছিটকে পড়ে দিগন্তজোড়া আকাশের বুকে। বিজলির রেখায় জনপদ, শস্যরিক্ত নির্জন প্রান্তর উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কোন অসীম নিঃসঙ্গতা আর আতঙ্কে মানুষগুলো মুখ—বুজে থাকে। গুরু গুরু গর্জনে কেঁপে ওঠে আকাশ-বাতাস। 

লেখারও মনে পড়ে একজনকে। ধনেখালির আবাদ থেকে তার চিহ্ন যেন মুছে গেছে। আর মারামারির গোলমাল নেই। একটা মহীরুহকে ওরা যেন চক্রান্ত করে এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে। কিছুদিন থেকে দেখছে লেখা মহিম ঘোষালকে। এতদিন লোকটা ওর সামনে বড়ো একটা আসত না। এখন কাজে-অকাজে ডাক্তারখানায় আসে, সেদিন স্কুলেও এসেছিল মহিম ঘোষাল। 

লেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওই তাকানোর অর্থ জানে সে। লেখার সারা মনে নীরব একটা জ্বালা ওঠে। 

মহিম ঘোষাল এদিক-ওদিক দেখে বলে,

— চালাগুলো নতুন করে ছাওয়ানো দরকার, না হলে এই বর্ষাতেই জল পড়বে। 

হঠাৎ যেন খুব দরদি হয়ে উঠেছে সে। 

লেখা বলে—এবার গ্রান্টের টাকা এলে করাব। 

ও যেন এড়িয়ে যেতে চায় মহিমকে। মহিম ঘোষাল হাসে,—কেন, ধরো আমরা যদি করাই? সকলেরই তো এটা কাজ! তাছাড়া আমাকে কেন এড়িয়ে চল তুমি? 

লেখা জবাব দেয়নি। 

তবু ভালো লাগে না ওর। মহিম ঘোষাল ধীরে ধীরে মাথা তুলছে, আর এই সুযোগ সে পেয়েছে মধুর অনুপস্থিতির জন্যই। আজ লেখাও সেই কঠিন সত্যটা বুঝে মনে মনে ভয় পেয়েছে, আর মধুর প্রয়োজনও বোধ করে সে এখানে। 

সেদিন দাদাকেও কথাটা বলতে দেখে লেখা ওঁর দিকে তাকাল। বর্ষার মুখ। তখনও আকাশ ছেয়ে মেঘগুলো নামেনি। দিগন্তে দু-চারটে কালো মেঘের দল বাতাসে ঘুরে বেড়ায় আগামী দুর্দিনের আতঙ্ক নিয়ে। বর্ষার করাল রূপটাকে ওরা চেনে। সেদিন এই সভ্যজগতের সঙ্গে সব সম্পর্ক কাটিয়ে আদিম আরণ্যক জগতে ফিরে যায়। 

অশ্বিনী ডাক্তার বলেন—মহিমই বলছিল কথাটা। এককালীন ও মোটা টাকা দিতে চায় স্কুলের জন্য, বলে বোর্ডিং হোক। আরও মাস্টার আসুক, ছাত্র-ছাত্রী আসুক। 

লেখা দাদার দিকে তাকাল। 

মহিম ঘোষালের বাইরের রূপটাকে চেনেন দাদা, সে ভালোমানুষ। সাধারণ মানুষের অতলে যে লোভী-পাপী মনটা লুকিয়ে আছে উনি তার পরিচয় জানেন না। লেখা ভাবনায় পড়ে। 

মহিম সবদিক থেকেই তাকে জালে ফেলবার চেষ্টা করছে। ধূর্ত-কঠিন লোকটার সেই চাহনি ভেসে ওঠে লেখার চোখের সামনে। 

লোকটার অনেক পয়সা, অন্ধকারের কারবারে সে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। টাকার লোভ দেখিয়ে সে অনেক কিছু পেয়েছে, আরও পেতে চায়। লেখা ভাবনায় পড়েছে। ওর সামনে কালবৈশাখির কী দুর্বার ঝড় এগিয়ে আসছে। 

লেখা বলে—এখন ওসব কথা থাক দাদা। পরে যা হয় জবাব দেব। 

লেখা এড়িয়ে গেল।

অশ্বিনীবাবু বোনের দিকে তাকিয়ে থাকেন, ঠিক বুঝতে পারেন না। কী যেন একটা ভুল কথাই বলেছেন তিনি। তাই চুপ করে গেলেন। 

লেখাও সরে গেল। 

লেখা জানত মহিম ঘোষাল আবার আসবে। কারণ, ওদের মতো মানুষের লোভ সহজে যায় না। ওরা নিজেদের শুধু মাত্র টাকার জোরেই শক্তিমান বলে মনে করে, সেই অধিকারে অপরকে অপমান করতেও তাদের বাধে না। 

বিকেলের রোদ হলুদ হয়ে আসে। 

স্কুলের ঘণ্টা বাজছে। ঝোড়ো বাতাসে লাল করবী ফুলের দল মাথা নাড়ে। লেখা হঠাৎ মহিমবাবুকে স্কুলের দিকে আসতে দেখে দাঁড়াল। ওর জবাব সে ঠিক করে নিয়েছে। লেখার মনের অতলে সাবধানী কঠিন মন আজ ওকে আঘাত দেবার জন্যই তৈরি হয়েছে। লেখা বাড়ি থেকে স্কুলের দিকে যাচ্ছে, পথের মধ্যে মহিমের ডাকে দাঁড়াল। লেখার ফর্সা-মুখ কী কাঠিন্যে লাল হয়ে উঠেছে। 

—কেমন আছ? মহিম ঘোষাল ওকে দেখছে। 

বারান্দার মুখেই তাকে দেখে লেখা জবাব দেয়—স্কুলে যাচ্ছি। 

—তা তো যাবেই। কত কষ্ট তোমার! আহা! খেটে খেটে সোনার অঙ্গ কালি হয়ে গেলে, তোমার স্কুলের ব্যাপারটা ভেবে দেখলে লেখা? এভাবে চিরকাল চলবে না। ধর, তোমার দাদার রোজগার কমে আসছে। তোমাদের খরচ-খরচাও আছে। তাই বলছিলাম, স্কুলটা বড়ো করে তোল, তবু কিছু মাইনে পাবে বেশি টাকা। 

লেখার সারা মন বিষিয়ে উঠেছে। জবাব দেয় সে—আপনার অনেকে টাকা, না? 

মহিমবাবু খুশি হয়। ওই কথাটাই সে জানাতে চায় লেখাকে। এইটাই তার মূলধন। কারবার, ভোগবিলাস—সব কিছুর মূলে এই টাকাটাই সার কথা। তাই হাসে মহিমবাবু—মানে, আছে কিছু! ধর, সৎকাজে লাগলে খুশি হব। 

লেখা জবাব দেয় কঠিন স্বরে, 

—ওই অন্ধকারের পাপ টাকায় স্কুল চালাব না। দরকার হয় স্কুল তুলে দেব। 

মহিম ঘোষাল যেন গালে একটা চড় খেয়েছে মেয়েটার কাছ থেকে। জানে সে, ওকে সহজে নোয়ানো যাবে না। তাই বলে মহিম শান্ত স্বরে,— 

তা’লে ওটা তুলেই দিতে হবে দু-একমাসের মধ্যেই।

মহিমবাবুও ওকে আজ চরম আঘাত হানতে চায়।

-–কেন? লেখা দেখছে মহিমবাবুকে স্থির দৃষ্টিতে। 

মহিমবাবু বলে—জায়গাটা আমার, মায় চালাঘরগুলোও। আমারও গুদোমের জায়গায় দরকার। তাই ভাবছি, এসব তুলে দিয়ে দখল নেব। 

লেখা চমকে উঠেছে। বলে সে, জায়গাটা চৌধুরীবাবুদের। মধুসূদন এখন ওর মালিক।

হাসছে মহিমবাবু—বেশ, ফয়সালা তাহলে হয়েই যাক! তার তো টিকি বাঁধা আমার কাছেই। এতদিন নানান কথা ভেবে হাত বাড়াইনি। এবার বাড়াতে হবে। আচ্ছা চলি — অ্যাঁ! 

মহিমবাবু টেনে টেনে হাসছে। যাবার আগে লেখার কঠিন মুখখানার দিকে চেয়ে বলে,

—এখনও ভেবে দেখ কথাটা। মাথা গরম কোরো না। 

ধূর্ত কঠিন লোভী মানুষটার দিকে চাইতে ঘৃণা করে লেখার। ও জানে সে কব্জা চায়। লেখার জীবনে এমনি বিপদ অনেকবারই এসেছে। কিন্তু এতটুকু টলেনি সে। আজও টলবে না। 

ওপাশ থেকে ছেলেমেয়েদের পড়ার শব্দ ভেসে আসে। ছাতিম শিরীষ গাছে পাখিগুলো কলরব করছে। শান্ত-স্তব্ধ জনপদ ওই সমুদ্রস্বপ্ন-মাখা গাঙের ধারে কী প্রশান্তিতে মগ্ন, ওর অন্তরের অতলে সুপ্ত জানোয়ারদের মূর্তিগুলোও দেখছে লেখা। 

মনে হয় সব নিয়েই জীবন, একে মেনে নিতে হবে। তবু থামবে না লেখা। এর শেষ দেখবে সর্বশক্তি দিয়ে সে মহিমবাবুর ওই লোভী হাতটাকে বাধা দেবে। 

.

নতুন আবাদে এসব কাণ্ড প্রায়ই বাধে। লাটকে লাট জমি হাসিল হচ্ছে। তারই লোভে অনেক চাষি এসে জোটে। জমি পাবে, ঘরবসত করবে। মধুসূদন এরই মধ্যেও এ চকে পরিচিত হয়ে উঠেছে। আদিম বন্য পরিবেশে সেও মিশে গেছে। 

চারিদিকের নিটোল বাঁধটা ওদের মনে নিশ্চিন্ততার আভাস আনে। কুলিকামিনরা মাটি কাটছে। মধুসূদন দাঁড়িয়ে আছে গাঙের ধারে। ওপারের বনে বনে ঘন সবুজ গাছগাছালির বুকে এসেছে কালো কালো ভাব। আকাশে কালো মেঘের দল ছিটকে ঘুরে বেড়ায়। মধুসূদন বাতাসে কিসের আভাস পায়। বলে সে, 

—অ্যাই নিতে, লোকগুলোকে হাত চালাতে বল বাবা! বর্ষার কাড়ান নামবে এইবার, তার আগে বাঁধ শেষ করতে না পারলে জমি-ধান, ঘর-বাড়ি সব ভেসে যাবে শাদের। সেদিন কি মধু চৌধুরীর বাপ আসবে শাদের বাঁচাতে? অ্যাই মদনা, হারামজাদাকে মারব পোঁদে এক লাথি, মাটি তুলছে দ্যাখ না? ঝুড়ি ভর্তি করে তোল। পয়সা কম নিস? অ্যাঁ! 

মদনা হাসে। ওরা কাজ করে চলেছে। আর দু-একদিনেই আমতলির বাঁধ মজবুত হয়ে যাবে। গাঙের ধারে গড়ে উঠেছে শক্ত বাঁধ। 

ওদিকে চাষ-বাস শুরু হয়েছে। হঠাৎ কাদের চিৎকার কলরব শুনে মধুসূদন ফিরে তাকাল দক্ষিণের মাঠে কলরব উঠছে। পদা বলে ওঠে, 

—জিতেন লস্করকে দেখছি গুরু! সাতজেলের জিতেন লস্কর। শ্লা মহিম ঘোষালের ল্যাংবোট, ওখানে পেরায় দেখতাম। ও ব্যাটা আবার লাঠিয়াল লিয়ে এয়েছে মনে হচ্ছে! 

অবাক হয় মধুসূদন, 

—জিতেন নস্কর! ও কি মতলবে এলো র‍্যা? 

ওকে চেনে মধু। এখানকার সঙ্গতিপন্ন জোতদার। ওই লোকজন নিয়ে এসেছে এখানকার জমির দখল নিতে। 

পূরণ দাসও কাঁদতে কাঁদতে আসে। তার হালের গোরু দুটোর গলার দড়ি ওরা খুলে দিয়েছে। গোরুগুলো ভয়ে দৌড়োচ্ছে মাঠময়, পূরণকেও ঘা-কতক লাঠি কষেছে জিতেনের লাঠিয়ালরা। মধুই খাসমহল অফিসারকে বলে পূরণকে বিঘে পাঁচেক জমি দিয়েছিল। পূরণ জানায়,

—জিতেন লস্কর বলে ওসব ওর জমি! দ্যাখেন না, মেরে তাড়িয়ে দিলে আমারে। বলে আমিই নাকি জবর-দখল করেছি। 

শুধু পূরণ নয়, আরও ক-জন গরিব চাষিকে উৎখাত করে তখন জিতেন নস্করের লোকজন সদ্য দখল নেওয়া জমিতে চাষ দিচ্ছে। ওর লাঠিয়াল ক-জন মাথায় লাল শালু বেঁধে লাঠি ঠুকে মালসাট মারছে। হুংকার ছাড়ে তারা, 

—চলে আয়, বাপের বেটা কে আছিস! অর-র-রা-ও-ও…. 

মুখে হাত দিয়ে রণহুঙ্কার ছাড়ছে জোর করে জমির দখল নিয়ে। 

ভীত-ত্রস্ত গরিব দল অসহায়ভাবে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ওই জমিগুলোই ছিল সম্বল। ওই নিয়েই এই বাদাবনের ধারে তারা বসত করেছিল, আজ তাও চলে গেল ওদের হাত থেকে।

মধুসূদনকে বলে তারা—আমরা মরে যাব মধুবাবু! জোর করে জমি থেকে তাড়িয়ে দেবে আমাদের। এর বিচার নাই? 

মধু কী ভাবছে। লোকগুলো তাকিয়ে আছে তার দিকে। যতিলালও এসে দাঁড়িয়েছে, পদা বাঁধের ওপর থেকে দেখেশুনে বলে,—দশ-বারোজন আছে লাঠিয়াল, জিতেনের হাতে যেন বন্দুক রইছে গ! 

মধু এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে। পদাই বাধা দেয়, 

—গুরু! যেও না গুরু গতিক ভালো লয়। 

মধুর মুখ-চোখ কঠিন হয়ে ওঠে কী প্রতিবাদের কাঠিন্যে। ও জানে এমনি করে সব-হারানোর বেদনা কত গভীরে বাজে। ও তারই একজন ভুক্তভোগী; এই অন্যায়গুলো সে নিজেও করে না, সহ্যও করতে পারে না আজ। পদা তবু ওকে বাধা দেয়, 

—গুরু! জিতেন লস্কর একটা শয়তান! 

মধু ধমকে ওঠে,–তুই শ্লা মাদি না মরদ র‍্যা? এতই যদি জানের ভয়, যাসনে। থাক! আমি একাই যাচ্ছি। 

মধু নিজেই এগিয়ে গেল। পদা আর যতিলাল কী ভেবে ওর সঙ্গেই গেল। সাবধানে এগোচ্ছে ওরা জিতেনের দিকে নজর রেখে। 

.

জিতেন নস্কর ভেড়ির ওপর দাঁড়িয়ে সদ্য দখল নেওয়া জমিগুলোয় লাঙল নামিয়ে চাষ দেওয়াচ্ছে। দখল প্রতিষ্ঠার এই প্রাথমিক কর্তব্য। এত সহজে বিনা বাধায় এতখানি জমি একচকে দখল পেয়ে যাবে, তা ভাবেনি জিতেন। তাই খুশিই হয়েছে। তাড়া দেয় সে লোকগুলোকে,—জোরে লাঙল চালা রে বাপধনরা! 

লাঠিয়ালরা ওদিকে গাঙের ধারে কেওড়া গাছের ছায়ায় বসে জিরোচ্ছে। তারাও নিশ্চিন্ত হয়েছে। কোনো লড়াই করতে হয়নি, স্রেফ হাঁকাড়িতেই কাজ হয়েছে। 

—নমস্কার জিতেনবাবু! মধু এগিয়ে গিয়ে সম্ভাষণ জানায় ওকে। 

জিতেন নস্করও মধুবাবুর মুখচেনা। ভেড়ি ঠিকেদার। তাই জিতেনও নমস্কার করে। মধু সিগ্রেট টানতে টানতে এগিয়ে এসে জিতেন নস্করের পাশে দাঁড়াল। জিতেন নস্করই আপ্যায়নের সুরে শুধোয়—ভালো আছেন মধুবাবু? জমিটা বেহাত হয়েছিল, তাই দখল নিলাম। 

এককালে ওরা এ তল্লাটের জমিদারই ছিল, তাই জিতেনও খাতির করেই কথা বলে। মধু হাসল একটু, পদাকে ইশারায় কী জানিয়ে বলে, 

—ভালো করলেন কাজটা? 

হঠাৎ পেছন থেকে অতর্কিতে প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ল জিতেন। যতিলাল আর পদা জিতেনের উপর লাফ দিয়ে পড়ে দড়ি দিয়ে বাঁধতে থাকে। মধুসূদনও নিমেষের মধ্যে বন্ধুকটা আর জিতেন নস্করের গলায় ঝোলানো কার্তুজের বেল্টটা কেড়ে নিয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিৎকার করছে জিতেন সেই বন্দি অবস্থায়। ওদিক থেকে লাঠিয়ালরা ছুটে আসছে, হঠাৎ ওরা বন্দুকের গুলির শব্দে থমকে দাঁড়াল। 

—গুড়ুম! গুড়ুম! 

মধু ব্ল্যাংক ফায়ার করছে। ওদিকে পদা আর যতিলাল ততক্ষণে জিতেন নস্করকে কেওড়া গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে। সেনাপতি বন্দি! 

পূরণ আর চাষির দল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এইবার কোদাল, টাংনা নিয়ে তাড়া করেছে লাঠিয়ালদের। কয়েকশো লোক আর মেয়ে-মদ্দকে তেড়ে আসছে দেখে লাঠিয়ালের দল লাঠি ফেলে মাঠ ভেঙে দৌড়োল, চাষিরাও তাড়া করছে ওদের পিছু পিছু। 

জিতেন নস্কর ব্যাপার দেখে কাতর কণ্ঠে বলে, 

—দোহাই বাবু! প্রাণে মারবেন না আজ্ঞে! 

মধু বলে—বেদখলি জমি দখল নেবে না? নিয়ে যাও দখল! 

নিমেষের মধ্যে জায়গাটার রূপ বদলে যায়। ওরা জয়ধ্বনি করছে! বন্দি জিতেন তখন কাঁদতে বাকি। ও জানে ফৌজদারির-দায়ে ওরা তাকে পুলিশেই দিতে পারে। জিতেন বলে, 

—হেই বাবু! দোহাই আপনার! 

হঠাৎ এমনি সময় লঞ্চটা এসে পড়ে। মি. মিত্র এদিকে ইন্‌সপেকশনে এসেছিলেন, মাঠের মধ্যে কলরব আর গুলির শব্দ শুনে এগিয়ে আসেন। লঞ্চ থেকে নেমেই লোকটাকে গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় দেখে, আর ওই মানুষগুলোকে আনন্দে জয়ধ্বনি দিতে দেখে অবাক হন। 

—কী ব্যাপার মধুবাবু? 

—নমস্কার স্যার! অপরের জমি দখল করতে এসেছিলেন উনি লাঠিয়াল আর নিজে বন্দুক নিয়ে। তাই একটু মশকরা করছি এঁর সঙ্গে। কিহে জিতেন, এমন লাঠিয়াল আনলে যে, তাড়া খেয়ে তোমাকেই ফেলে পালাল! যা শাঃ! 

জিতেন নস্কর মিত্র সাহেবকে দেখে সাধু সাজবার চেষ্টা করে, 

—শিকারে এসেছিলাম স্যার। 

পূরণ আর অন্যান্য চাষিরা গর্জে ওঠে,—শিকারে এসেছিলে? 

—মধুবাবু মিছে কথা বলছে স্যার! জিতেন নিপাট ভালো মানুষের মতো কথাটা বলে উঠতে মধুও ওর গালে একটা চড় কষেছে সপাটে। গর্জে ওঠে মধু, 

—মিছে কথা আমি বলি না জিতেন; ফের একটি কথা বলেছ তো জিভ টেনে ছিঁড়ে দোব। মধু চৌধুরীকে চেনো না? 

একটি চড়েই জিতেন নেতিয়ে পড়েছে। মুখ দিয়ে লালার সঙ্গে রক্ত পড়ছে। মিঃ মিত্রই ছাড়িয়ে দেন, 

—যাক্, যাক। তবে ব্যাপারটা আমি জেনে রাখলাম নস্করমশাই, আর এদিকে আসবেন না। এটা সরকারি জমি, যান। 

মধু বলে,—যাক, তবে বন্দুক ওকে দোব না স্যার, থানায় জমা দিয়ে দেবেন। ও শার বাপ আছে মহিম ঘোষাল, তাকে ধরে-করে ফিরিয়ে আনুক গে। 

জিতেন তখন প্রাণের ভয়ে কাঁপছে। বন্দুক যায় যাক, প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচে। লোকগুলো খুশি হয়েছে। বাদাবনের আইন-কানুনও এমনি। আর মধুসূদন সেই পথেই কাজ করেছে। মধু বলে,—কই রে পদা! আছে? দে দু-টোক পেঁদিয়ে দিই বদাম বদাম করে। ধ্যাত্তেরি-যত্তো সব ঝুট ঝামেলা। 

.

মিত্র সাহেব বাঁধগুলো দেখছেন, খুশি হন তিনি বাঁধের কাজ দেখে। 

মধুসূদনও সঙ্গে রয়েছে। ওরই মধ্যে পদাও কোত্থেকে গুরুর জন্য পানীয় এনে হাজির করেছে।

পলায়মান জিতেন নিরাপদ দূরত্ব থেকে চোট-খাওয়া বাঘের মতো ফিরে চাইতেই মধু গর্জন করে ওঠে—আর এ-মুখো হয়ো না জিতু, ধরতে পারলে গাঙের জলে চুবিয়ে পাঁঠা চোবান দিয়ে ছেড়ে দোব। 

মধুসূদনের প্রতাপ এখানেও ছড়িয়ে পড়েছে। অসহায় মানুষগুলোর মনে ও এনেছে আশ্বাস তাই প্রাণ দিয়ে কাজ করছে ওরা। মধুসূদনের কাজ দেখে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবও খুশি। ওভারসিয়াররা ওর ভয়ে এগোয় না এদিকে। ইঞ্জিনিয়ার বলেন—চমৎকার কাজ হয়েছে। 

মধুসূদন হাসে—চুরি করিনি স্যার! ন্যায্য দাম দিয়েছি, আর মজুরদের পোঁদে লাথি মেরে কাজ করিয়েছি। কাজে ফাঁকি দেবে কোন শা? 

ওর ওই ভাষা-প্রয়োগে সভ্য ইঞ্জিনিয়ার সাহেব একটু হকচকিয়ে যান। 

মধু তখন বোতলে চুমুক দিচ্ছে ওপাশে। বুনো কঠিন একটি মানুষ। এখানের জীবনের সঙ্গে সে মিশে আছে। ওকে দিয়েই এসব কাজ করানো সম্ভব। মিত্র সাহেব বলেন—সামনের সিজনে আরও কিছু কাজ করুন। বর্ষার ক-মাস পরই, পুজোর পর থেকেই শুরু করুন সাত নম্বর লাটের ভেড়ি। খুবই খারাপ কাজ হয়েছে ওটায়। ওই মহিমবাবুর ঠিকাদারি আমি ক্যানসেল করে দিয়েছি। এ বর্ষা কাটলে হয়—হি সুড বি পানিশড। এত লোকের জীবন, ধান, বাড়ি-ঘর নিয়ে কথা! ওরা লাভটাই বড়ো হল? 

মহিমের কথা শুনে মধুসূদন মনে মনে কঠিন হয়ে উঠেছে। মিত্র সাহেব ওর হাতের বোতলটা দেখিয়ে বলেন,—ওটা একটু কমান না মধুবাবু! মানে, ওই ড্রিঙ্কের কথা বলছিলাম! 

মধুসূদন হাসল মাত্র। 

এটা তার অনেক দিনের সঙ্গী। একমাত্র সঙ্গীই বলা যায়। মধুসূদনের জীবনে আর কোনো নেশা নেই। এককালে এটাকে ধরেছিল অসহায়ের মতো সব আঘাত আর যন্ত্রণাকে ভোলবার জন্যই। আজও সেটা রয়ে গেছে। মনে হয় সে সমাজ-বিতাড়িত একটি জীব। মধুসূদন জবাব দেয়,—কাজ ছাড়তে বলেন, ছাড়ব। এটা কি অপরাধ করল স্যার? ভদ্রলোক হতে বলছেন? অ্যাঁ! তাহলেই কিন্তু চুরি করতে হবে। দরকার নেই স্যার তাতে। এই বেশ আছি।

হাসছেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ওর সোজা কথায়। ভালো লাগে ছেলেটিকে। 

.

মধুসূদনও কথাটা মাঝে মাঝে ভেবেছে। কিন্তু মদটাকে ছাড়তে চায়নি। এখানের কাজ শেষ হয়ে গেছে। নিজেই দেখে অবাক হয়। বিশাল নতুন ভেড়ির এপাশে গড়ে উঠেছে নতুন বসত, ধানের খেতে এসেছে সবুজের ইশারা। বন্ধ্যা-রিক্ত মৃত্তিকা পূর্ণতার আস্বাদে ভরে উঠেছে। 

মধুসূদনের কাছে সার্থক সুন্দর জীবনের একটা ছবি হঠাৎ যেন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। রাখালের বাঁশির সুর ওঠে, দূরে আদিম হিংস্র অরণ্য আর জোয়ারের জলে ফুলে ওঠা মারমুখী গাং—তারই তীরে মানুষ ঘর বেঁধেছে, সুখী হয়েছে। নিজের জীবনের স্তব্ধ হাহাকারটুকু কী বেদনা নিয়ে তার মনকে ছেয়ে ফেলে। 

এক জায়গায় সে নিঃস্ব। এই নিঃস্বতার খবর সে জানত না আগে। একে ভোলবার জন্যই যেন আকণ্ঠ মদ গিলে সেসব ভুলে থাকতে চায়। 

—গুরু! পদা ডাকছে তাকে। 

গর্জন করে ওঠে মধুসূদন,—চোপ বে! 

এ যেন অন্য কোনো মানুষ, যেসব কিছু ধ্বংস করতে চায়। নিজের জীবনের লাভ-ক্ষতির হিসেব করতে গিয়ে দেখে চারিদিকে সেই শূন্যতাকেই। 

.

ধনেখালিতে বর্ষা নেমেছে। এখানের বর্ষার রূপ ভয়াবহ। সেই গাঙ হয়ে ওঠে মারমুখী। জোয়ারের সময় গাঙের নিচেকার জলস্রোত ফেঁপে-ফুলে মরা খাত বুজিয়ে ঠেলে আসে ভেড়ির গায়ে। বাতাসে ঢেউগুলো ফুলে ওঠে। ওরা যেন গজরাচ্ছে আর দিনরাত ছোবল মারছে। আকাশ-বাতাসে ওঠে তারই গর্জন। ভেড়ি বাঁধগুলোয় বৃষ্টির জলধারা ধুয়ে ধুয়ে পিছল করে দিয়েছে। হাট বসে নামমাত্র। বাঁধা দোকানদারই আসরে টিকে থাকে, দু-চারটে মাত্র ব্যাপারির নৌকো আসে। ঠিক নেই তাদের আসারও। 

লঞ্চটা তবু সভ্যজগতের সঙ্গে এর ক্ষীণতম যোগসূত্রটুকু টিকিয়ে রেখেছে। সাদা লঞ্চটা ঢেউয়ের মাথায় লাফাতে লাফাতে আসে, নদীর ওই তুফান তাকে যেন সাপটে কাত করে ফেলে দিবে! 

ইঞ্জিনের গুরু-গুরু শব্দ ওঠে, ওটা ওই ঢেউয়ের আঘাতে আর নদীর মত্ত-আক্রমণের আঘাতে কঁকাচ্ছে, আর্তনাদ করে সিটির শব্দ তোলে। ঘাটে যাত্রীদের ভিড় নেই। 

কোনো কোনো দিন লঞ্চও আসে না। সেদিন নদীর ঢেউগুলো ফুলে ওঠে। নজর চলে না। বৃষ্টির সাদা অস্বচ্ছ যবনিকাটা ঢেকে দিয়েছে নদীর বুক। শিরীষ গাছের মাথায় দাপাদাপি করে মাতাল বাতাসের ঝাপটা। নরম পলকা ডালগুলো মড়মনিয়ে ভেঙে পড়ে। নদীর দিক থেকে ওঠে কলগর্জন। 

অশ্বিনী ডাক্তারের কাছে এই সময়টা বিশ্রী লাগে। প্রাণ-চাঞ্চল্য নেই। মানুষগুলো এই মারমূর্তি গাঙের গর্জনে ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। আর ওই বৃষ্টিটা তাঁর চোখের বিষ। ঠাণ্ডায় বাতের ব্যথাটাও বেড়ে ওঠে। লেখাই রোগীদের দেখাশোনা করে, ওষুধ তৈরি করে দেয়। অশ্বিনীবাবু বসে বসে দু-চারটে রোগী দেখেন, প্রেসক্রিপশানটা করে দেন কোনরকমে। 

স্কুলেরও ছুটি। এখন চাষের কাজ চলেছে। মাঠে মাঠে তাদের কাজ। এ সময় তাই ছেলেরা স্কুলে আসে না। ওদের কৃষি-অবকাশ চলছে। ধানচারাগুলো মাঠ ছেয়ে গজিয়ে উঠছে। কালো মেঘের বুক থেকে বৃষ্টি নামে—অঝোরে বৃষ্টি। 

ক-দিন পর বৃষ্টি নেমেছে। আকাশে মেঘগুলো ঘুরছে যেন এক নিষ্ফল আক্রাশে। ওই হাওয়ায় ভর করে তারা ভেসে চলেছে দিক-দিগন্তরে। নদীর বুকে তখনও ঢেউয়ের মাতন। ভীরু চাহনিতে মাঝে মাঝে সূর্য মেঘস্তরের ফাঁক দিয়ে উঠছে, আবার তাকে ঢেকে দিয়ে নিজেদের দখল কায়েম করতে চাইছে ওই কালো মেঘের দল। 

সকালের কাজ-কর্ম শেষ করে লেখা বাড়ি ফিরবে, এমন সময় দুজন লোক আসে। অশ্বিনীবাবুর ওরা চেনা। এখান থেকে এক গোণ নিচে কোন দূর আবাদের বসতে ওদের ঘর। 

হাঁপাচ্ছে লোক দুটো। সারা দেহে ঘাম আর বৃষ্টি ঝরছে। গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে এসে অশ্বিনী ডাক্তারের পায়ের কাছেই বসে পড়ে অনুনয়-বিনয় করে ওরা,–একবার যেতেই হবে ডাক্তারবাবু, না’লে বউটা বাঁচবে না। প্রসব বেদনা জানাইছে, কিন্তু দুবলা রোগী — ওই বাচ্চাসমেত মরবে বাবু। দোহাই ডাক্তারবাবু, যা লাগে, যত টাকা লাগে, দোব। গোণে চলে যাবেন, ফেরার সময় মহিমবাবুর লঞ্চ আসবে বাদাবন থেকে—সেই ফিরতি লঞ্চেই বলে রেখেছি, ওরা তুলে নিয়ে আসবে আপনাকে। কোনো কষ্ট হবে না। 

অশ্বিনী ডাক্তার ওদের দিকে তাকালেন। বাতের ব্যথা রয়েছে সর্বাঙ্গে। জ্বরও হয়ে আছে। দুদিন কিছু খাননি। এ সময় গিয়ে ওই ডেলিভারি কেসে কিছুই করতে পারবেন না তিনি। পা-হাত কাঁপছে দুর্বলতায়। তারপর এতটা পথ খোলা নৌকায় ঠাণ্ডা লাগিয়ে গিয়ে আর করার কিছুই থাকবে না। নিজেই ঘায়েল হয়ে পড়বেন অশ্বিনীবাবু। কষ্ট হয় কথাটা জানাতে। তবু অশ্বিনীবাবু বলেন,—আমার নিজেরই জ্বর, উঠতে পারছি না নিবারণ, আর তোমার ঘরে ওই বিপদ। কিন্তু কি করব বল, আমার সাধ্যি নেই আজ করার। কোনো উপায়ই নেই আমার যাবার। 

নিবারণের চোখে-মুখে ব্যাকুলতা জাগে। অসহায় কণ্ঠে বলে সে—তা’লে মেয়েটা এমনিই মারা যাবে ডাক্তারবাবু? কোন পিতিকারই হবে না? 

ক্লান্তকণ্ঠে বলেন অশ্বিনী ডাক্তার—এই লঞ্চেই গোসাবা চলে যাও। কোনো ডাক্তার সেখানে পাবে নিশ্চয়ই। তাঁকেই নিয়ে যাও! 

সে অনেক দূর পথ। ফেরারও কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। তাছাড়া ডাক্তারও অত দূরে যাবে কি না জানে। বাদাবনের কাছাকাছি এলাকায় এই তুফানের সময় তাঁরা কেউ যাবেন না। বেশি টাকা কবুল করলেও কেউ রাজি হবেন না। 

নিবারণ বলে—তা’লে মেয়েটা মরুক ভগবানের এই ইচ্ছে দেখছি! কিন্তু বিনা চিকিৎসায় যাবে, এই তো দুখ্যু ডাক্তারবাবু! 

নিবারণের চোখ দিয়ে দু-ফোঁটা জল ঝরে পড়ে। সে-ও দেখেছে ডাক্তারবাবুর দেহের অবস্থা। জানে, ভালো থাকলে তিনি নিশ্চয়ই যেতেন। কিন্তু কোনো উপায় নেই। তবু কাঁদ কাঁদ স্বরে বলে—কোনো উপায় হবে না ডাক্তারবাবু? বাদানে বাস করি বলে এমনি হেনস্থায় মরব আমরা? আমাদের কেউ নাই, ভগবানও নাই? 

নিবারণ কাঁদছে। চোখের সামনে দেখেছে সেই অসহায় রোগিণীর যন্ত্রণা। 

লেখা এতক্ষণ শুনছিল সব কথা। দাদার শরীরের অবস্থা সে জানে। এদিকে ওরা এসেছে বিপদে পড়ে; সত্যি, মেয়েটার খুব বিপদ। নাহলে এমনি অবস্থায় ছোটো-বড়ো গাঙ পাড়ি দিয়ে এতখানি পথ ওরা ছুটে আসত না। লেখা এগিয়ে আসে। সে মনে মনে তৈরি হয়ে নেয়। একবার সে চেষ্টা করে দেখবে। লেখা জানায়–দাদা, আমি যাব ওদের সঙ্গে? 

অশ্বিনী ডাক্তার চমকে ওঠেন—তুই! এই বাদলায় তুফানে যাবি এতখানি পথ? কী বলছিস রে! 

লেখার বিশ্বাস আছে নিজের ওপর। এসব আবহাওয়াও তার পরিচিত। আর লেবার কেসের সে কিছু কিছু জানে। তাই বলে—মোটামুটি কেস হলে আমি সামলে নোব। তবু শেষ চেষ্টা করা যাবে। আর এমন পথে পাড়ি দেওয়া অভ্যেস আছে। তাই বলছিলাম, আমিই যাই। ওরা এত আশা নিয়ে এসেছে! 

নিবারণ ওর দিকে তাকাল! মেয়েটিকে ও চেনে। দেখেছে ডাক্তারখানায় কাজ করতে। ইনজেকশন দেয়, ওষুধ দেয়, এটা-সেটা করে। জলে-ডোবা লোকের কাছে খড়গাছিই বহু মূল্যবান, মনে হয় সেই তৃণখণ্ড ধরেই সে বেঁচে যাবে। 

এই বিপদে ওই দিদিমণিকে যেতে রাজি হতে দেখে নিবারণ ব্যাকুলকণ্ঠে বলে—তাই চলুন দিদিমণি! আপনি গেলেই হবে। তবু সান্ত্বনা থাকবে ওষুধপত্তর করেছিলাম। বরাতে যা হবার হবে! 

অশ্বিনীবাবু বোনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। লেখার মুখে-চোখে একটা দৃপ্ত কাঠিন্য ফুটে ওঠে। সে বলে—আমি পারব দাদা। 

—তা তুই পারবি। কিন্তু এই তুফানে যাবি-আসবি কি করে? 

নিবারণ অভয় দেয়—সে দায়িত্ব আমাদের ডাক্তারবাবু। মাথায় করে নিয়ে যাব, ফেরবার সময় লঞ্চে তুলে দোব। চেনাজানা লোক ওরা। যত্ন করে এনে আবার গঞ্জে পৌঁছে দিয়ে যাবে। কোনো অসুবিধে হবে না। 

লেখার ওপর ভরসা করতে পারেন অশ্বিনীবাবু। নিবারণকে বলেন,—তাই হোক। দ্যাখো শেষ চেষ্টা করে। 

নিবারণ খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে। 

.

লেখা ইতিমধ্যে ওষুধের বাক্স, কিছু যন্ত্রপাতি, স্যালাইন, ফরসেপস্‌, তুলো গজ এটা-সেটা দেখে নিয়ে ওষুধের বাক্স আর ব্যাগটা তুলে দিল ওদের হাতে। নিজেও তৈরি হয়ে আসে। 

অশ্বিনীবাবু বলেন—সাবধানে যাবি লেখা। যদি মরফিন দিতে হয়, পালসটা একটু দেখে নিয়ে তবে দিবি। আর যন্ত্রপাতিগুলো গরম জলে ফুটিয়ে নিবি ভালো করে। স্টেডি থাকবি। 

লেখা হাসে—ওসব ভাবতে হবে না। দেখবে, ঠিক ব্যবস্থা করে আসব। কোনে অসুবিধে হবে না। চাকরটাকে বলে গেছি। কমপ্রেস নিও, আর ওষুধগুলো ঠিকমতো খাবে। গরম দুধ ও দিতে বলে গেলাম। কিছু ভেব না। তুমি সাবধানে থেকো। 

অশ্বিনীবাবু বারান্দা থেকে চেয়ে থাকেন। বড়ো নদীর বুকে ছোটো নৌকোটা তুফানের মধ্যে ঢেউগুলো কাটিয়ে ওদের তালে তালে চলেছে। ভাঁটার টান শুরু হয়েছে। পালতোলা নৌকোটা বেগে ওই নদীর বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল লেখাকে নিয়ে। 

.

লেখা নৌকোয় বসে ভাবছে কথাটা। কোথায় যেন একটু বেশি সাহসই দেখিয়ে ফেলেছে। এমনি দুর্যোগে নিজে কখনও এমন করে বের হয়নি। ওদের অনুনয়-বিনয় আর মেয়েটার ওই নিশ্চিত মৃত্যুর কথা শুনেই সে ঠিক থাকতে পারেনি। তবু যদি বেলাবেলি পৌঁছাতে পারে, দিনের আলোতে কাজ করতে পারবে। না হলে হ্যারিকেনের আলোয় ফরসেপ ব্যবহার করাও কষ্টকর হবে। লেখা জিজ্ঞেস করে—আর কতদূর? 

নিবারণ নিজে হালে বসেছে। পালে হাওয়া লেগেছে। গলুইয়ের জল কাটছে, জল কাটার একটানা শব্দ ওঠে। কোঁ-ও-ও নৌকোটাও চলেছে হাওয়ার বেগে বিচিত্র ছন্দে। ঢেউগুলোর ওপর লাফ দিয়ে উঠছে-নামছে। দুলে দুলে ওঠে নৌকোটা। ওর নীচে দিয়ে ঢেউগুলো মসৃণ গতিকে ব্যর্থ আক্রোশে ফুলতে ফুলতে বের হয়ে যাচ্ছে। দূরে দেখা যায় তীরের সীমারেখা। দু-চারটে কেওড়া-গরানগাছ বাঁকের মাথায় তীরভূমিতে মাথা তুলেছে। 

নিবারণ বলে—আর দু-বাঁক দিদিমণি। পালে হাওয়া যা লাগতিছে, লঞ্চ বরাবর যাব। এলাম বলে!

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। ওরা এসে ছোটো বসতের ধারে পৌঁছাল। মাত্র কয়েকটা ছোটো ঘর, ওখানের লোকেরা বোধহয় ব্যাকুল হয়ে ওদের পথ ছিল। 

লেখা দেখছে এই আবাদ অঞ্চলকে। নদীর একদিকে আদিম অরণ্য। বড়ো বড়ো সুন্দরী-গরান-কেওড়াগাছগুলো অরণ্যের কালো সীমা-প্রাচীর রচনা করেছে। বিকেলের মেঘলা আঁধার এখন থেকেই রাত্রির বিভীষিকা এনেছে ওখানে। 

নদীর এপারে কয়েক ঘর মানুষ টিকে আছে এই আরণ্যক পরিবেশে পদে পদে ওই নদী আর বনের সঙ্গে সংগ্রাম করে। দু’ একটা টিনের চালাও রয়েছে। বাঁধের নীচেই কয়েক ঘর বসতির ছেলে-মেয়ে-লোকজন ভিড় করেছে ওদের ঘিরে। ওদিকে ধানখেত—বর্ষার জলে ঘনসবুজ ধানগাছগুলো মাথা নাড়ে। চারিদিকে কী বিষণ্ণ নির্জনতার বেদনা জেগে ওঠে মেঘলা পরিবেশে। লেখা তীরে নেমে কোনরকমে কাদা ঠেলে ওপরে ওঠে। কে এগিয়ে আসে। বলে, হাতটা ধরব মা? 

লেখা বলে–না না। আমিই যাচ্ছি। 

ওষুধের বাক্স নিয়ে নিবারণ ততক্ষণে ভেড়ি পার হয়ে ওই ঘরগুলোর দিকে এগিয়ে চলেছে। মনে হয় ওষুধের অস্তিত্বই তার মেয়ের সব রোগব্যাধি ভালো করে দেবে। 

ততক্ষণে ওরা জল গরম করতে শুরু করেছে। 

লেখা রোগিণীকে দেখে দুটো ইনজেকশন দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। যন্ত্রপাতিগুলোর দরকার হবে কিনা। তবু যদি কাজে লাগে, এই ভেবেই এগুলো গরমে ফুটতে দিল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কয়েকটা হ্যারিকেন জ্বেলে এনেছে তারা। লেখার সারা দেহ-মন কী উত্তেজনায় ভরে ওঠে। তবু এ-কাজ তাকে করতেই হবে। 

কয়েকঘণ্টা কেটে গেছে। ওই ভ্যাপসা বন্ধ ঘরে গরমে পরিশ্রমে আর উত্তেজনায় ঘেমে নেয়ে উঠেছে লেখা। তার সব বিদ্যা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে সে কাজে লেগেছে। এ তার দুর্বার শপথ। ওর মনে একটা জোর আসে। ফরসেপস্ ব্যবহার করেছে বাধ্য হয়ে। নিজেই অবাক হয়, এমন নিখুঁতভাবে কাজ করতে পারবে ভাবেনি। স্তব্ধ-ঘর। মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় আৰ্তনাদ করছে রোগিণী। 

লেখা স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। ওর দেহে কী বেদনার সাড়া। নিপুণভাবে কাজ করে চলেছে লেখা। নিজের মনে আজ সে নতুন একটা শক্তিকে খুঁজে পেয়েছে। 

বাইরে প্রতীক্ষা করছে তারা। 

রাতের অন্ধকারে নদীর গর্জনে ভেসে আসে আরণ্যক জগতের সাড়া। মেঘের অন্ধকারে বৃষ্টির ধারা নেমেছে। হু-হু করে বইছে ঝোড়ো বাতাস। 

এরই মাঝে ভূমিষ্ঠ হল নবজাতক। চিৎকার করে কাঁদছে সে। ওদের মুখে ফুটে ওঠে আনন্দের আভাস। কে শাঁখ বাজাচ্ছে। ওই সুরেলা শব্দটা আরণ্যক পরিবেশে যেন কী জয়ের সংবাদ আনে। মৃত্যুকে জয় করে জন্ম নিয়েছে কোনো নবজাতক। ওরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। 

.

কাজ শেষ করে দাওয়ায় বের হয়ে এলো লেখা। তখন সে ক্লান্ত। তার সব শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। তবু মনে তার অসীম তৃপ্তির স্বাদ। একটি নয়, দুটি প্রাণীকে সে মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে এনেছে। 

রাত্রি হয়ে আসছে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে। ওরা গরম দুধ এনে দেয় লেখাকে। চিঁড়ে, গুড় আর দুধ। 

নিবারণ আর ওর বাড়ির মেয়েরা অনুরোধ করে—কিছু খেতে হবে মা। আজ এত ধকল গেছে, রাতটা গরিবের কুঁড়েঘরে থাকবেন। কাল সকালেই না হয় পৌঁছে দিয়ে আসব। এত কষ্ট করে আবার আজই যাবেন! 

লেখা জানে দাদা ভাববে। তাই থাকা তার সম্ভব নয়। তাছাড়া অজানা জায়গায়, এই বাদাবনের ধারে রাত কাটাতে ইচ্ছা নেই তার। সে বলে—লঞ্চ এলেই চলে যাব। তোমরা ভেব না। কাউকে বরং ঘাটে পাঠিয়ে দাও, লঞ্চ দেখলে যেন দাঁড়াতে বলে। 

নিবারণ সেই ব্যবস্থাই করল। লেখা ওদের অনুরোধে গরম দুধ খানিকটা খেল। ক্লান্ত শরীর-মন এইবার সতেজ হয়ে উঠেছে। মনটাও হালকা লাগছে। চারিদিকে জমাট অন্ধকার। আদিম-আরণ্যক পরিবেশে রাত নেমেছে। 

আবছা অন্ধকারে গুরু-গুরু শব্দ উঠছে। আশপাশের গাছের মাথায় লঞ্চের তীব্র আলোটা পড়ছে। কে এসে খবর দেয় লঞ্চ এসে গেছে ঘাটে। লেখা খুশি হয়। বাড়ি ফিরতে পারবে সে।

রোগিণীর জন্য কয়েকটা ওষুধপত্তর দিয়ে ও ঘাটের দিকে এগোল। ওরা তাকে তুলে দিতে এসেছে ঘাটের ধারে। 

.

সার্ভিস লঞ্চ এ নয়। মহিম ঘোষালের নানা ব্যাবসা, ধান-চাল-কাঠ অন্যান্য মালপত্র আনা-নেওয়া করতে হয়। তাছাড়া রাতের অন্ধকারে অনেক কারবারই তার আছে। কলকাতা থেকেও মালপত্তর আনাতে হয় গোলার জন্য। তাই মহিমবাবু নিজের প্রয়োজনে লঞ্চ রেখেছে। আর ধান—গঞ্জের বিভিন্ন হাটে কারবারিদের মালও পৌঁছে দেয় চড়া ভাড়ায়। কোথাও দূর-হাটে মালপত্তর পৌঁছে দিয়ে ফিরছিল লঞ্চটা। ওতে তুলে নিয়েছে কিছু মধু আর মৌচাকের দলা। মধু নিঙড়ে বের করে নেবার পর ওই দলাগুলোও বেশ দামে বিক্রি হয়। 

লঞ্চে জায়গা আর বেশি নেই। স্তূপ করা আছে খালি বস্তা, মধুর জালা, খালি জলের ট্যাঙ্ক, টিন আর ওই মৌচাকের দলা, লোহা-লক্কড়-শিকল, বেশ কয়েক বস্তা ধান-চাল ইত্যাদি। 

ওরই মধ্যে কোনরকমে উঠে বসল লেখা। বস্তার এপাশে একটু জায়গা করে দিল নিবারণের লোকজন। ওষুধের বাক্সটাও তুলে দিয়ে গেছে ওরা। লেখা চলন্ত লঞ্চ থেকে বনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটানা ইঞ্জিনের শব্দ ওঠে, অতল অন্ধকারে ওইটুকুই যেন প্রাণের স্পন্দন আনে। লেখা চুপ করে বসে আছে, ক্লান্তিতে চোখ-বুজে আসে তার। দু-চারটে তারা মেঘ ঠেলে উঠেছে। নদীর বিস্তারে ঢেউ ফাটছে। লঞ্চটা পথহারা অন্ধকারে গর্জন ভুলে চলেছে। 

লেখার মনে তবু তৃপ্তি জাগে। এখানে এসে ও একটা কাজ করে গেছে। নইলে মেয়েটা বোধহয় বাঁচত না। লঞ্চটা চলছে। মনে হয় ঘণ্টা তিন-চার লাগবে ওদের পৌঁছাত। 

খানিকটা এসেই লঞ্চটার ঘণ্টা বাজে—একটা-দুটো। পেছন দিকে জল কেটে লঞ্চটা ঘুরে পারমুখো হল। 

দূরে তীরে দেখা যায় কয়েকটা গাছ জায়গাটাকে আরও আঁধার করে তুলেছে। গাছের নীচে একটা শিকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে কে হ্যারিকেন নেড়ে ইশারা করছে। লঞ্চটা এইখানে গিয়ে থামল। ঘাট ওটা নয়। কোনোমতে ভেড়ালে তারা লঞ্চটাকে ওই কাদার পাশে। 

আবছা অন্ধকারে ঠিক ঠাওর হয় না। একটা রং-চটা বাক্স আর চট-জড়ানো বিছানা তুলছে ওরা। দুটো আধকাঁচা নুন-মাখানো হরিণের চামড়া, কয়েকটা শিং-ও উঠল। আর রয়েছে একটা বিরাট লাউয়ের খোল, তার মুখটা ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা। সেটার গলার সঙ্গে দড়ি দিয়ে ঝুলছে একটা এনামেলের মগ। 

মনে হয় ওতে মদই আছে। যারা ওই খোল থেকে তরল পানীয় ঢেলে খায়—যে-কোনো কারণেই হোক তারা সেই পাত্রটাকে ফেলে দেয়—খেয়াল রাখতে পারে না। তাই পানপাত্রটাকে পানীয়ের পাত্রের সঙ্গে পাকাপোক্তভাবেই বেঁধে রেখেছে ওরা। হারাবার ভয় নেই। ঢালো আর গেলো। বেহুঁশ হলেও মগটা হারাবে না। 

মালপত্তর ওঠার পালা শেষ হল। এইবার ওদিকে অন্ধকারে লঞ্চে উঠল কে লাফ দিয়ে। খোলের ভেতর এল না সে, ছোটো মই দিয়ে উঠে গেল ছাদের ওপর সারেংয়ের কাচের কেবিনে। সুখানি ঘণ্টা দিচ্ছে। টং টং টং। 

লঞ্চটার ইঞ্জিন আবার গর্জন করে উঠে এইবার তীরভূমি ছাড়িয়ে একটু গভীর জলের দিকে এগিয়ে আবার চলতে শুরু করল। দুলছে। লঞ্চটা ওই গতিবেগে। ইঞ্জিনের একটানা ধাতব শব ওঠে। 

লঞ্চটা মৃদু মৃদু কাঁপছে ওই ইঞ্জিনের শব্দে। জল কাটছে সামনের দিকে। ছিটিয়ে উঠছে ঠাণ্ডা জলের কণাগুলো। খোলের একপাশে বসে আছে লেখা—বস্তার স্তূপের ধারে। এদিকে-ওদিকে নজর যায় না। তীরভূমি দেখা যায় শুধুমাত্র কালো একটা রেখার মতো। এদিকে আদিম-অরণ্য—অন্ধকারে সেখানে জ্বলছে ছোট ছোট নীল বিন্দুর মতো হরিণের চোখগুলো। ওপরে কাদের টুকরো কথার শব্দ ভেসে ওঠে। 

লেখা এতক্ষণে দেখে লঞ্চে সারেঙ ছাড়া আর একজন কর্মচারীও আছে। ওইপাশের কাঠের একটু ঘেরের আড়ালে এসে সেই লিকলিকে লোকটা লাউয়ের খোল থেকে মগে মদ ঢেলে ঢক ঢক করে গিলছে। লোকটার গালের হাড়গুলো ঠেলে উঠেছে, তাতেই প্রকট হয়ে উঠেছে খাঁড়ার মতো নাকটা। মদ গিলে লোকটা উঠে গেল ওপরে। 

এবার নেমে এল মোটা গোলমতো একটি লোক। ওই বোধহয় সারেঙ। সেও বেশ অভ্যস্ত হাতে লাউয়ের খোলের ঢাকনা খুলে কয়েক মগ মদ পর-পর গলায় ঢেলে মুখ-মুছে বের হয়ে এল বেশ আমেজ ভরে একটা ঢেকুরও তোলে সশব্দে। 

লেখা দেখছে ব্যাপারটা। সে রীতিমতো চটে উঠেছে এইসব মোদো মাতালের পাল্লায় পড়ে। এরা মদ গিলে লঞ্চ চালাবে কী করে জানে না সে। তার ভয় হয়। সে বলে—মদ খেয়ে লঞ্চ চালাবে? 

সারেঙ একটু হাসল। ওর পিঠুলি পড়া লালচে দাঁতগুলো বের হয়ে আসে। মোটা ঠোঁটজোড়া ঝুলে পড়েছে। লোকটা হাসছে কদর্য ভঙ্গিতে। 

মদ খেলে কেউ বিরক্ত হয়, এটা দেখে একটু অবাক হয়েছে সে। তাই অবজ্ঞা ভরে হাসছে যেন।

আর লেখার এই কথাটার প্রতিবাদ জানাবার জন্যই ফিরে গিয়ে মদের পাত্রটা খুলতে থাকে।

লেখার কথায় যেন আদৌ গুরুত্ব দিল না সে। ওর সামনেই আবার এক মগ মদ ঢেলে গিলতে থাকে। লেখার মুখ-চোখ কঠিন হয়ে ওঠে। জানায় সে—মহিমবাবুকে গিয়ে আমি রিপোর্ট করব। মদ খেয়ে লঞ্চ চালাও তোমরা? 

সারেঙ এইবার বেশ জোরেই হাসতে থাকে। কে ওদিক থেকে বলে ওঠে—মহিমবাবুকে কে নালিশ করছে র‍্যা! অ-নসু…. অ্যাঁ! মহিমবাবু কি পীর–দ্যাবতা! শ্লা মালে ডুবে থাকে রাতদিন, তার বেলায় দোষ নাই, তোর-আমার বেলায় যত্তো দোষ! যাচ্চলে! 

এইবার লঞ্চের খোলের ওপরকার ফোকর থেকে ছোটো মই বেয়ে আসরে অবতীর্ণ হল যে লোকটা, তাকে দেখে লেখা চমকে ওঠে। ধনেখালির এতদিনের হারানো মধুসূদন চৌধুরী স্বয়ং এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। টলছে, লাল চোখ মেলে দেখছে ওকে। 

মধুও লেখাকে এখানে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয়—তুমি! 

পরক্ষণেই গলা তুলে শুধোয় মধুসূদন,—অ নসু! বলি এ মালটিকে আবার কোত্থেকে জোটালি র‍্যা? তাই ভাবছিলাম, রাত দুপুরে বাদাবনে এই ভরা গাঙের ওপরেও কে সুনীতি সুধা শোনাচ্ছে!……. তা ভালো। কই, বলি সুধা আর আছে, না জালা পেটে সবটাই ঢেলেছিস? দে একটুন। নেশাটা চাগিয়ে নিই। 

মদের পাত্রটা তুলে দেয় মধু। 

সামনে দাঁড়িয়েছিল সেই লিকলিকে লোকটা। তাকেই ধমকে ওঠে মধু—শ্লা, রাতদুপুরে হরিণের মাংস এনে দিলাম, জুত করে রাঁধবি, তা নয়—ও এল হাঁ-করে মেয়েছেলে দেখতে! মারব শ্লাকে একলাথ। যা-রাঁধগে মাংসটা। ভাগ, লুচ্চা কোথাকার! 

লেখা একপাশে চুপ করে বসে আছে, ওদের দিকে তাকিয়েও দেখল না। ওর মুখ-চোখ কঠিন হয়ে উঠেছে। 

মধু কয়েক মগ মদ গিলে জামার হাতা দিয়ে মুখ-মুছে খানিকটা থুতু ফেলে বলে—ভালো মাল তুলেছিস, নসু! কথাও বলে না। একেবারে সুনীতিসুধা ভাগবত র‍্যা! কোত্থেকে জোটালি রাতদুপুরে? 

নসু সারেঙ জবাব দেয়—মানুষমারির নিবারণ বলে রেখেছিল ওর কে ধনেখালি যাবে, ফেরার মুখে তাই তুলে দিয়ে গেল লঞ্চে। 

মধু মুখ বিকৃত করে বলে—অ! তুলে দিয়ে গেল লঞ্চে! ভালো! মধু টলতে টলতে ওপরে উঠে গেল। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *