১
—কি রে! ব্যস—এই! কিলিয়ার? যা শ্লা—
মধুসূদন চৌধুরী মুখটা বিকৃত করে খানিকটা ধেনো মদ গলায় ঢেলে কোঁক্ কোঁক্ শব্দে গিলছে। মদ গিললেও তার চোখ রয়েছে ওই দলা-পাকানো নোটগুলোর দিকে।
ওগুলো দেখে আদৌ খুশি হয়নি সে, এটা পানের দোকানদার গদাইও বুঝতে পারে। ওদিকে দোকানের বাঁশের মাচার ওপর বসে আছে পীতাম্বর। মহিম ঘোষালের লোক সে—ওর কাঠগোলাতে কাজ করে। টাকাটা মহিমবাবু তার হাত দিয়েই পাঠায় গদাইয়ের দোকানে। গদাইয়ের মারফত লেনদেন হয় এইখানেই। মহিম ঘোষাল আইনের চোখে একেবারে নিরপরাধ সাধু ব্যক্তি সেজে থাকে। ওই ভেক্টা তাকে প্রকাশ্যে নিতে হয়। কারণ, মহিম ঘোষাল এই অঞ্চলের অঞ্চল-প্রধান, মাতব্বর ব্যক্তি। সরকারি মহলে তার দহরম-মহরমের কথা সকলেরই জানা।
—সাধু! শালা খচ্চর কোথাকার! মনে মনে গজরায় মধুসূদন। মদের বোতলটা শেষ করে টাকাগুলো গদাইয়ের হাত থেকে নিয়ে বলে,–এই মাত্তর! মহিম কি সব একাই খাবে নাকি রে!
পীতাম্বর বসেছিল চুপ করে, ও বলে,
—ই খেপে আর বেশি নাকি লাভ হয়নি।
মধু ওর দিকে তাকাল। পীতাম্বরও আজকাল মাতব্বর হয়ে উঠেছে ওই মহিম ঘোষালের সঙ্গে থেকে থেকে।
মধু ওর কথায় অবাক হয়। এককালে পিতে ছিল তাদের কাছারির পাইক, লাঠি হাতে করে নায়েব মহিম ঘোষালের পেছনে পেছনে যেত জাবেদা খাতা বগলে। সেই দিনগুলোর কথা এখনও ভোলেনি মধুসূদন। আজ জমিদারি নেই, টিকে আছে কাছারিবাড়িটা, মেরামতের অভাবে নোনা হাওয়ায় চুন-বালি খসে পড়েছে। ছাদের কার্নিশে গজিয়ে ওঠা বটগাছগুলো আরও ডালপালা মেলে—শিকড়ের বাঁধনে সেই বাড়িখানাকে এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।
আর নায়েব মহিম ঘোষালের নতুন করে কারবার পত্তন করেছে। শাঁসে-জলে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। এখন এখানকার সে-ই অন্যতম মাতব্বর। বাইরের কারবার ছাড়াও অন্ধকারের ফলাও কারবার তার আছে, সেইদিনের জমিদার-বংশধর মধুসূদন আজ ওর সেই অন্ধকারের সঙ্গী হয়েছে
অন্য কোনো পথ না পেয়ে।
তার সেই কারবারের মোটা মুনাফা লোটে ওই সাধু-মহাজন মহিম ঘোষাল, তাতে ফোড়ন কাটে সেদিনের পাইক পীতাম্বর।
মধুসূদনের সারা মন জ্বলে ওঠে কি ব্যর্থতার অপমানে আর বঞ্চনায়, মহিম ঘোষাল তাকে ঠকায়। বোকা ভাবে।
পীতাম্বর বলে,—জমি-পত্তরের তেমন দর নাই কিনা!
মধুসূদন গর্জে ওঠে,
—অ্যাই পিতে! তোকে জ্ঞান দিতে কে বলেছে? বুঝব আমি মহিম ঘোষালের সঙ্গে। তুই ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করবি না।
পীতাম্বর চুপ করে গেল। মধু বলে—উনি ব্যাটা এলেন সর্দারি করতে! যা—
পীতাম্বর রেগে উঠেছে। কিন্তু জানে, ওকে কিছু বলার সাধ্য তার নেই। মধুকে ভয় করে না এ চাকলায় হেন ব্যক্তি নেই। পীতাম্বর রাগটা চেপেই সরে এল। মধুসূদনের মহিমের ওপর রাগ এখুনি তার ওপরই ফেটে পড়তে পারে। গদাইও জানে মধুর এই স্বভাবটাকে। তাই বলে,
—যাও গো পিতুদা, ওসব কথায় কাজ কি!
মধু চুপ করে বসে কী ভাবছে।
রাতের অন্ধকারের সেই কাজগুলোর ছবি ওর চোখে ভেসে ওঠে। দুস্তর গাঙ, রায়মঙ্গল— ছাপাকুপ্রা নদীর বিস্তার আর তুফান পার হয়ে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তান থেকে মালপত্তর আনতে হয়। চারদিকে ওদের সাবধানি দৃষ্টি। জল-পুলিশের লঞ্চ ফেরে সন্ধানী আলো ফেলে। আদিম অরণ্য আর সেই তুফান-জাগা গাঙের বুক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সেই আলোয়। জানতে পারলে গুলি চালাবে। ঢেউ ফাটছে নদীর বুকে—জল আর জল! সীমা নেই। অতি বড়ো সাহসীরও বুক কেঁপে ওঠে। মধুসূদন সেই গাঙ পাড়ি দিয়ে ওদের চোখে ধুলো দিয়ে হাজার হাজার টাকার মাল আনে মহিম ঘোষালের গদিতে। মধু গজগজ করে,—শালা একাই সব খাবে! এতদিন ধরে খাচ্ছে—এখনও খাবে!
বেলা পড়ে আসছে। হাটের নিচে খালের বুকে আজ নৌকো আর লোকজনের ভিড় নেই। মধু দোকানের মাচায় বসল। কি ভাবছে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। দু-একটা নৌকো ভেসে চলেছে। ওপারের শস্য-রিক্ত খেতের ধারে দু-চারটে বাড়ি ভেড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে হাটতলার ঘরগুলোর ওপাশে ধ্বংসপ্রায় কাছারিবাড়ির ওদিকে গাঙের ধারে মহিম ঘোষালের নতুন বাড়িটা চোখে পড়ে।
কাঠগোলা, লম্বা টিনের শেড রোদে চকচকে করছে—যেন মহিম ঘোষালের গৌরবেই ওরা ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। আর মধু—ওই বট-অশ্বত্থ গাছ-জড়ানো কাছারিবাড়ির মতোই একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধ্যাত্তোর! মরুক গে মহিম!
কি সব আজে-বাজে কথা ভাবছে সে! নতুন একটা বোতল নিয়ে বসেছে। এলেম আছে, তাই মহিম ব্যাটা মাথা তুলেছে।
মহিম এককালে তাদের কাছারিতেই কাজ করত। মধু তখন ছোটো। ক্রমশ মহিম ঘোষালই টিকে রইল, ছত্রভঙ্গ হয়ে ছিটকে পড়ল চৌধুরী বংশ। মধুসূদন আজ বানে-ভাসা খড়কুটোর মতো আবাদের একটা হাটের ঘাটে পড়ে আছে। কথাটা ভাবলে তার রাগ হয়। মহিম ঘোষাল তার চোখের সামনে কোথায় উঠে গেছে। কারবার—ধানের ব্যাবসা, কাঠের চালানি কারবার তো আছেই, তাছাড়া আরও অনেক অন্ধকারের কারবার আছে। মধুসূদনও সেইসব খবর জানে, নিজেও সামান্য কিছু টাকার জন্য সেইসব অন্ধকারের ব্যাপারে জড়িয়ে আছে। গদাই পানওয়ালা মধুকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে একটু ঘাবড়ে যায়। কারণ, এই টাকা পেয়ে মধু যে খুশি হয়নি আদৌ, তা বুঝতে পেরেছে সে। ওকে চটাতে সাহস নেই গদাইয়ের। তাই বোঝাবার চেষ্টা করে,
—টাকাটা নাও মাইরি মধুদা, পরে একদিন বলবে মহিমবাবুকে।
মধু কী ভেবে টাকাটা নিল। গজরায় সে,
—একদিন পেটিকে পেটি ফাঁক করে দোব, সেদিন বুঝবে তোদের ওই পেসিডেন! একা একা সব গেলা বের করে দোব।
মহিমবাবুর তাকে দরকার, তা মধুও জানে। বড়ো গাঙ পাড়ি দিয়ে বাদাবনের দিক থেকে মাল আনা অনেক হাঙ্গামার কাজ, তাদের আবার শহরেও নিয়ে গিয়ে পাচার করে আসতে হয়। এই লোকসান সে উশুল করে নেবে। বিরক্ত হয়ে মধু বলে,
—দে আর একটা বোতল। মেজাজটা খাট্টা হয়ে গেল।
এমন সময় খালের ভেড়ি থেকে নিমাই কনস্টেবলকে নেমে আসতে দেখে গদাই একটু ইতস্তত করে সেই লুকোনো দ্রব্যটি বের করতে। নিমাই কনস্টেবল এমনিতেই কড়াধাতের জবরদস্ত সেপাই। ও এখানকার পুরনো লোক, তাছাড়া কথাগুলোও ওর কেমন ত্যাড়া-বাঁকা। গদাই ওকে ভয় করে। মধু তাড়া করে,
—কই রে, দে? ব্যাটা যেন মহাদেব হয়ে গেল! মাল বার কর।
গদাই ফিসফিস করে গলা নামিয়ে বলে,
—নিমাই দারোগা আসছে যি গো!
নিমাইকে ওরা দারোগা বলে ঠাট্টা করে। অবশ্য নিমাই তাতে বরং খুশিই হয়, রাগে না।
খালের ধারে একটা শিরীষ গাছের ছায়া পড়েছে পড়ন্ত বেলায়। হাটতলা আজ ফাঁকা। সপ্তাহের দুটো দিন আবাদের এই হাটতলা জমজমাট হয়ে ওঠে লোকজন পসারির ভিড়ে। দূর-দূরান্তর থেকে ডিঙি বেয়ে পসারি আর খদ্দেরের দল এসে হাজির হয়।
আজ সেখানে লোকজন বিশেষ নেই। ভেড়ি বাঁধের নিচে সারবন্দি দরমার চালাগুলো ফাঁকা পড়ে আছে, দু-চারটে দোকান—তাতেও আজ খদ্দেরের ভিড় নেই। পারঘাটের যাত্রীর ভিড়ও কম। সব কেমন ছুটি ছুটির মতো লাগে।
নিমাইকে আসতে দেখে মধু বলে,
—ছুঁচোর গোলাম চামচিকে। যেমন তোর দারোগা আর তেমনি ওই নিমাই! দে তো বোতলটা। একটি কথা বললে ওটাকেও খালের জলে চুবিয়ে দোব। বড়ো বাড় বেড়েছে ওর।
অবশ্য মধুর পক্ষে ওসব কাজ অতি সোজা। গদাই তাই ঝঞ্ঝাট আর না বাড়াবার জন্যই বোতলটা বের করে দিল।
না দিয়ে উপায় নেই। ওদিকে নিমাইও এগিয়ে আসছে।
তাই গদাই বলে,
—একটু সামলে নাও মধুদা। নিমাই দারোগার শকুনের চোখ, বুঝলা?
গদাই সাবধানি লোক, তাই সবদিক দেখে-শুনে কাজ করে সে। মধু চটেই ছিল। তার রাগ সকলেরই ওপর। একদিন তার সামনে এখনকার রূপটা ছিল স্বতন্ত্র। শান্তি ছিল, শুদ্ধতা ছিল আর প্রাচুর্য ছিল। মধুসূদন সেদিন ভাবেনি দিনগুলো এত তাড়াতাড়ি বদলে যাবে, আর মানুষ এত লোভী হয়ে উঠবে। মহিম ঘোষালও বদলে গেছে, মায় ওই পাইক পীতাম্বরও আজ তাকে কথা শোনায়।
দেখেছে মধুসূদন চারিদিকে মানুষের লোভ আর নীচতা। সে কাউকে ঠকাতে চায়নি। কিন্তু সকলেই তাকে ঠকিয়েছে। ওই মহিম, বসিরহাটের অফিসের বাবুরা, হাটের মহাজন অনেকেই তাকে ঠকায়। আজও ঠকেই চলেছে সে। তাই মনে মনে সে কোথায় কঠিন আর বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
মধু বলে—হ্যাঁ, সবাই সব করেছে, বাকি আছে নিমে! ঠাণ্ডা করে দোব ব্যাটাকে এইবার। এ্যাই পদা—মাছ পেলি?
পদা কাদা মেখে ভূত হয়ে নেমে আসছে ডিঙি থেকে। লম্বা টিকটিকে চেহারা, আর কালো কুচকুচে গায়ের বর্ণ; চোখ-দুটো পিটপিট করছে পদার। মধুসূদনের ও নিত্যসঙ্গী। পদাও ধনেখালির অন্যতম হতভাগ্য একটি জীব। পদার নজর মধুর হাতের বোতলটার দিকে।
জোয়ারের সময় সরু খালগুলো জল ঠেলে ওঠে, তারই মধ্যে বেড়াজাল পেতে রাখে, ভাঁটার টানে জল নেমে যায়। পলিকাদার ওপর পড়ে থাকে পারশে, ভাঁওন, ভেটকির বাচ্চাগুলো।
পদা মাছের পেছনেই ছিল এতক্ষণ। ওই বস্তু দেখে বলে,
—একটু পেসাদ দেবে না গুরু? কাদায় জলে গা-হাত-পা কালিয়ে গেল মাইরি!
মধুর মেজাজ ভালো নেই। পদাও ছিল দলে। ওর হাতে কয়েকটা ময়লা নোট দিয়ে বলে,
—কিনে নে গা! বুঝলি, মহিমটা বড্ড ফাঁকি দিল।
পদা যা পায় তাতেই খুশি। ওরা কিছু করার জন্যই রাত-বিরেতে গাঙ পাড়ি দেয়। বিপদ সম্বন্ধে চেতনা-ভাবনাও নেই। তবু বলে সে,
—ও তো দেবেই গুরু। তাই বলি, টানা মালের কারবারে নিজেই নেমে যাও দুগ্গা বলে। ফাঁক থেকে মহিমকে পুজো দেওয়া কেন?
মধু জানে, মহিমকে চটানো নিরাপদ হবে না, বিশেষ করে এইসব কাজে। তাকেই পুলিশে ধরিয়ে দেবে! দিয়েছেও এর আগে। তাই মহিমের সব অত্যাচার সে বাধ্য হয়েই সহ্য করছে। কিন্তু জবাব সে দেবে একদিন। মহিমের জন্যই পদে পদে ঠকেছে মধু। ভেড়ির ঠিকাদারি করতে গিয়ে মহিমের কাছে ও ঠকেছে। নেশাটা ছুটে আসছে। গলা ভেজানো দরকার। তাই বলে পদাকে,
—মাছগুলো নিয়ে আয়। আর নে—টাকা নিয়ে যা। একটা ভালো বোতল আনবি। পদা দৌড়োল ভেড়ির ওপাশে বসতির দিকে।
গদাই মধুকে দেখছে। ওর চোখ-মুখের ভাব বদলে গেছে। অনেকদিন ধরেই দেখছে গদাই ওই মধুসূদনকে। তখন ওকে সবাই ডাকত মধুবাবু বলে।
তখনও কাছারির বোলবোলাও যাই-যাই করেও রয়ে গেছে বেশ। গদাইকে ওরাই হাটতলার ধারে এই গাঙের ঘাটের মুখে জায়গাটা দিয়েছিল। এইখানে দোকান, ঘর-বাড়ি ফেঁদে বসেছে গদাই লঞ্চঘাটের ওপরেই।
সেদিন মহিম ঘোষাল গুছিয়ে নিচ্ছে। মধুসুদন তখন সবে কৈশোর ছড়িয়ে যৌবনে পা দোব-দোব করছে। বলিষ্ঠ সুন্দর চেহারা। মাঝে মাঝে নৌকো নিয়ে খালের বুকে বেড়াতে যেত। হাটতলায় ঘুরে বেড়াত কাঁচি ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি পরে। কোনো বেচাল দেখলে হাত চালাতেও দ্বিধা করত না সে। ছেলেবেলা থেকেই গোঁয়ার দুর্দান্ত।
মহিম ঘোষালই ওকে মদ ধরায়, আর সেই মদ ধরানোর দরকার ছিল তারই। এক-একটা লাট বেনামি করে নিয়েছে। আর যা জমিজিরেত ছিল এখানে-ওখানে, বাকি খাজনার দায়ে নিলাম করিয়ে নিজের নামে ডেকে নিয়েছে। মধু তখন হাওয়ায় উড়ছে। খালের বুকে পানসি ভাসিয়ে মদ গিলে ঘুরে বেড়ায়, বাদাবনে শিকারে যায়।
হঠাৎ সব তলিয়ে গেল কোনদিকে।
আজ মধুর নিজের বলতে সামান্য কিছু ধানি জমি আর দুটো পুকুর টিকে আছে। আর ওই ভাঙা কাছারিবাড়িটা। মহিম নায়েব আজ ধাপে ধাপে কোথায় উঠেছে।
মহিমের বাংলো থেকে রেডিওর সুর ভেসে আসে। ঝকঝকে রং-করা বাংলো। কয়েকটা ঝাউগাছ সবুজ স্নিগ্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওদিকে ধানকলের চিমনি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আকাশছোঁয়া চিমনিটা ওই মহিম ঘোষালের জয়ের প্রতীক।
গদাই মধুকে দেখে তাই দুঃখবোধ করে। আজ ভদ্রঘরের, জমিদার-বংশের ছেলে হয়ে সে করল না কিছুই মন দিয়ে।
গদাই বলে,—জানো যদি মহিমবাবু এমনিই লোক, ওসব রাতের কারবারে থাকো কেন মধুবাবু? বিপদের কাজ, প্রাণ নিয়ে টানাটানির কাজ!
মধু ওর দিকে তাকাল। গদাই মাঝে মাঝে খুব ভব্যিযুক্ত হয়ে ওঠে। মধুর নেশাটা থিতিয়ে আসছে। ওর দিকে তাকিয়ে বলে মধু,
—তোর তো খুব ভাবনা দেখছি, অ্যাঁ? দরদ যে উথলে উঠল রে?
গদাই বলে,—না, কত বড়ো ঘরের ছেলে তুমি! এ চাকলার রাজা ছিলে তোমরাই। এসব কাজ কি তোমার সাজে? তারপর ধর, মদ গিলে এখানে-ওখানে ঘোরো-
মধু জানে, সবাই তাকে যেন খরচার খাতাতেই লিখে দিয়েছে। ও এখানকার মধ্যে একটি সাংঘাতিক জীব। অশ্বিনী ডাক্তার, যাদব মাস্টার, মায় থানার দারোগাবাবু অবধি ওকে বলে-কয়ে পারেনি, অনেকেই তাকে সমীহ করে চলে। রীতিমতো ভয়ও করে অনেকে।
গদাই বলে—ওই যে ভেড়ি বাঁধার ঠিকাদারি করছিলে, তাই করো। এসব ঝঝাটে দরকার কি?
হাসে মধু,—জ্ঞান দিচ্ছিস? কেন বাবা—মদের দাম দিই না? সব তো নগদা-নগদি কারবার আমার। কোন্ শ্লা বলবে মধু চৌধুরীর কাছে কানাকড়ি পাই, বলুক?
গদাই জানে মধু সব কিছুরই উল্টো মানে করে মেজাজ বিগড়ে থাকলে। দুনিয়ার কাউকে সে পরোয়া করে না। গদাই বলে,
—পাঁচজন মানুষের মতো দিব্যি থিতু হও, কাজ-কম্মো করো।
মধু ওর দিকে তাকাল,—মানুষের মতো বাঁচতে হবে?
বাঁচতে একদিন চেয়েছিল সেও। পড়াশুনা তার হয়ে ওঠেনি। ওসব ভালো লাগেনি। জমিদারি চলে যাবার পর ঠিকাদারিই শুরু করেছিল। কিন্তু দু-এক বছর যেতে না যেতেই দেখেছিল সব কিছুই চুরির কারবার। ভেড়ি বাঁধ হবে—সরকারের টাকা পাঁচ-ভূতে ভাগ করে খাবে তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে। ওই মহিম ঘোষলেই তাই করে সব কাজগুলো হাতিয়ে নেয়।
আর খেসারত দিতে গিয়ে মধুর একটা দিঘিই বিক্রি হয়ে গেল। কোন অফিসারকে নাকি মারতে গিয়েছিল সে মদ খেয়ে। পুলিশের হাঙ্গামা থেকে বেশ ভুগে হাজতবাস করে বের হয়ে আসে অনেক খরচা করে।
আজ গদাইয়ের ওই ভালোভাবে থাকার কথা শুনে জ্বলে ওঠে মধু,
—শালা দেখছি খুব ভাবনা আমার জন্যে? অ্যাঁ!
গদাই শোনায়,—অল্যায্য কথা কি বলেছি গ! সব্বাই বলে।
মধু দপ করে জ্বলে ওঠে,–কোন শ্লা বলে, নাম কর? গাঙের জলে চুবিয়ে তাদের সাধুগিরি কাপড়ে-চোপড়ে করে ছাড়ব। সব মামুই সাধু খচ্চর শ্লা এই মধো চৌধুরী!
গদাই থেমে যায়। জানে, কথা বলা আর নিরাপদ নয়। মধু রাগের জ্বালায় জ্বলছে। অনেক দেখেছে সে। মধু বলে ওঠে,
—আর ওসব কথা বলবি না; বুঝলি?
গদাই মাথা নাড়ে। মধু গজগজ করে,
—যা করছি, ঠিক করছি। অলরাইট করছি। বেইমানের দুনিয়ায় মানুষ হতে গেলেই বিপদ। লাইফ হেল্ করে দেবে। বেশ আছি বাবা!
মধু টলতে টলতে চলে গেল ভেড়ির ওদিকে; সন্ধ্যা হয় হয়। গদাই জানে ওর গন্তব্যস্থল কোথায়। কোন ঘরছাড়া বাওয়ালির শূন্য ঘরে তাদের মেয়েদের সন্ধানেই চলেছে বোধহয়। শুধু মদই নয়—আরও অনেক কিছু তার দরকার। একটা মানুষ ধীরে ধীরে নরকের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। দিনের আলো মুছে গিয়ে আঁধার নামছে, মধুও তেমনি জমাট অন্ধকারে কোথায় হারিয়ে গেছে।
মধু চলে যেতে তবে এগিয়ে আসে এইদিকে নিমাই কনস্টেবল। ব্যাপারটা দেখেছে সে।
—এই যে গদাই, অ্যাঁ, কারবার তালে বেশ চলছে?
নিমাই সামনে বাঁশের মাচাটার ওপর চেপে বসল। লোকটার শীর্ণ পিটপিটে চাহনিতে ধূর্ত ভাব ফুটে ওঠে। মধুকে এখান থেকে মদ নিয়ে যেতে দেখেছে নিমাই। গদাই ওকে হাতে রাখবার জন্যই খাতির করে,
—আসুন গো! বসুন। পান দিই? অরে ও গুপি, জমিদার সাহেবকে চা দে শিগগির
নিমাই জুত করে বসে চা খাবার জন্যে। বাদাবনে বদলি হয়ে এসেছে ক’বছর। এর আগে কোন থানায় ছিল, সেখানে নানা কমপ্লেন হতে তাকে বাদাবনে বদলি করেছে। তবু নিমাই বলে, কর্তারা ওর কাজে খুশি হয়ে এখানে পাঠিয়েছে।
নিমাই এখানে এসে কাজ দেখাবার জন্য কেবল চেষ্টাই করে চলেছে, তাই মাঝে মাঝে তার বাড়াবাড়িটা চোখে ঠেকে অনেকেরই।
নিমাই বলে—বুঝলি গদা, এইবার ওই মধু জব্দ হবে। খুব টানা কারবার চালাচ্ছে শুনছি, আর তেমনি বেড়ে উঠেছে। এইবার যে দারোগাবাবু এখানে আসছেন, তিনিই ওকে টাইট করে দেবেন। ছোকরা, আর তেমনি তার দাপট। মধু বুঝবে এইবার দারোগা কি চিজ! নতুন পাশকরা হলে কি হয়, কড়া লোক।
মধুসূদনের টাইট হবার আগেই, ওই নতুন দারোগা আসার খবর শুনে গদাই মনে মনে ভয় পেয়েছে। মধুবাবু বেপরোয়া লোক, গদাই তার তুলনায় চুনোপুঁটি; টুকটাক কারবার করে। গদাই চায়ের কাপটা এগিয়ে দেয় নিমাইয়ের হাতে, তাড়াতাড়ি কাচের বয়েম থেকে দুটো লেড়ো বিস্কুটও দিয়ে নিমাইকে আজ আপ্যায়ন করার চেষ্টা করে। নিমাই জানে এসব তার পদমর্যাদার জন্যই মিলবে। তাই চা নিয়ে গম্ভীরভাবে চুমুক দিতে দিতে বলে নিমাই,
—যিনি আসছেন নতুন দারোগা, ওই ভুবনবাবু আমার খুব চেনা। আর তেমনি দুদে লোক সেবার উনি নিকাশিপাড়া থানার চার্জে, তাবড় গ্যাংকে ঢিট করে দিলেন। এখানেও নানা কারবার চলে, সরকার তা জানে; সেই জন্যেই তো ওই ভুবনবাবুর মতো কড়া লোককে পোস্টিং করেছে। ক’বছর চাকরিতে ঢুকেই এর মধ্যে নাম কিনেছেন।
গদাই সিগ্রেটও এগিয়ে দেয় ওর দিকে।
গদাই জানে, ওসব রাঘববোয়াল মহিমবাবুদের গায়ে কোনোকালেই হাত পড়েনি, আজও পড়বে না। প্রথম চোটেই তাদের মতো লোকই বিপদে পড়বে। টুকটাক টানা পাকিস্তানি মালপত্তর সেও বেচে। তাছাড়া বন থেকে চোরাকাটাইয়ের কিছু কাঠ আসে তার পেছনের বেড়াঘেরা জায়গাটায়; তার থেকেই কিছু বাণিজ্য হয় গদাইয়ের। গদাই সেই কারণেই হাতে রাখতে চায় নিমাইকে। মধু ওকে পরোয়া করে না। নিমাইয়ের রাগটা তার জন্য মধুর ওপরও অনেক।
গদাইকে খাতির করতে দেখে নিমাই মনে মনে খুশি হয়। তার এই খাতির আর কিছু পাবার দিকেই বেশি নজর, আর সেটা কিভাবে আদায় করতে হয় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে, তা জানে নিমাই। সে বলে, বুঝলি গদাই, তোদের ওই মধুকে আমিই পারি জব্দ করে দিতে। নেহাত ভদ্দরলোকের ছেলে বলে ছেড়ে দিয়েছি। তবে আর বাঁচানো যাবে না।
গদাই ওকে খুশি করার জন্য সায় দেয়,
—বুঝলেন জমাদার সাহেব, যা দিন-কাল পড়েছে কড়া লোকেরই দরকার।
গদাই ভালোমানুষ সাজতে চায়। নিমাই তবু দেখতে পায় ওর মুখে-চোখে ভয়ের ছায়া। খুশি হয়েছে সে। তাই বলে চলেছে নিমাই,
—কড়া মানে? ভুবনবাবু মিছরির ছুরি। মুখে মিষ্টি কথা—ইদিকে কখন তোমাকে কিসের দায়ে ফেলে শ্রীঘরে যাবার ব্যবস্থা পাকাপাকি করে দেবেন, বুঝতেই পারবে না। তাই বলছিলাম, তোমাদের গুরুকে এইবার সাবধান করে দিও। তাছাড়া জলপুলিশও জানতে পেরেছে গুরুদেবের ওই চোরাকারবারের কথা। পথেই কোনদিন ক্যাক করে ধরবে বমালসমেত। তখন দেখবে মধুবাবুর কি হলে হয়!
গদাই কথাগুলো শুনছে। পুরোনো দারোগাবাবুও মধুকে জব্দ করতে পারেননি এত চেষ্টা করে। নতুন দারোগাবাবু মধুকে না পারুন, গদাইকে জব্দ করে দিতে পারবেন। তাই তাকেও সাবধান হতে হবে। গদাই মনের ভয়টা প্রকাশ করতে চায় না। পান সাজা হলে পানটা এগিয়ে দেয়,
—নেন গো জমাদার মশায়। আর একটা সিগ্রেট ধরান, ওটা ফুরিয়ে গেছে।
.
বড়ো নদীটা এখানে এসে বাঁ-পাশে আর একটা গাঙের ধারানি মেলে দিয়ে আবার সোজা বাদাবনের দিকে বয়ে গেছে। বাঁকের মাথায় উঁচু ভেড়ির ওদিকে দেখা যায় দুচারটে পুরনো বট-অশ্বত্থ গাছের জটলা। পাকাবাড়ির দেয়ালের সাদা রং নোনা গাঙের জোলো বাতাসে বিবর্ণ মেটে মেটে হয়ে গেছে। ওদিকে মাথা তুলেছে বেতারের দুটো উঁচু এরিয়াল, দুটোর মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে রয়ে গেছে কয়েকটা তার, ঝোড়ো বাতাসে তারা দোল খায়, তবু শক্ত বাঁধনে ইনসুলেটার দিয়ে আটকানো আছে, তাই ছেঁড়ে না।
জায়গাটা আবাদ অঞ্চলের বেশ ভেতরে। ইতিমধ্যে গাঙের বিস্তার বেড়ে গেছে, সমুদ্রের স্বাদ পেয়ে বদলেছে ওর জলের রং। সেই জল মুখে তোলা যায় না। নোন্তা আর বিস্বাদ গাঙের ধারে ধারে ভেরিতে উঁচু বাঁধ দিয়ে ওই নোনা জলকে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। নইলে ওই জল ভেড়ির ওদিকে ঢুকলে মাঠকে মাঠ ধানচারাকে বিবর্ণ করে দেবে। পোড়া শনের মতো তারা মরে যাবে শুকিয়ে।
তবু এই সুন্দরবনের আবাদের ওই দিগন্তজোড়া খেতে সোনা ধান ফলে। তার জন্যই ওরা পড়ে আছে। মানুষ বন কেটে বসত করেছে, আবাদের পত্তন করেছে। আদিম অরণ্যের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে ওই মাটিকে। গোরুয় দুধও হয় প্রচুর। তাছাড়া গাঙে আছে মাছ, আশপাশের বসতের ধারে নিচু জমিতে জল জমে থাকে শত শত বিঘে, ওই জলায় মাছের চাষ হয়। মেছো ভেড়িতে মাছ আছে প্রচুর, তাছাড়া নদীতেও নানা রকম মাছের অভাব নেই।
তাই জেলে ব্যাপারিরাও মাছের চালান দেয়। এইসব নিয়ে গড়ে উঠেছে এই গঞ্জ, ধনেখালির গঞ্জ। বাদাবনে ঢোকবার পথ, একগোণের পরই সুন্দরবন। গহন বন। কাঠ, মধু, মোম ও গোলপাতার কারবারও চলে। বহু নৌকো নিয়ে যাতায়াত করে বাওয়ালির দল, কাঠ-মহাজনরা। ফরেস্ট-অফিসও তাই এই জলপথের ধারেই ধনেখালি গঞ্জে রয়েছে।
এক কথায়, বাদাবনের ধারে ওই আদিম আরণ্যক পরিবেশে গড়ে উঠেছে এই ধনেখালির গঞ্জ।
থানা, ছোটখাটো দু-একটা অফিস, ফরেস্ট-অফিস্—মায় একটা ইউনিয়ন বোর্ড, হেলথ সেন্টার, ছোটো স্কুলও রয়েছে। আর ওপাশে বেশ খানিকটা সমতল জায়গার ওপর হাটতলা।
টিনের সারবন্দি চালাগুলো চৌখুপি হয়ে কোনাকুনি এদিক-ওদিকে ছিটিয়ে গড়ে উঠেছে ঠিক গাঙের ওপরেই। কিছু বাঁধা দোকান-পসার আছে, তবে এই হাটের বাহার খোলে হাটবারে। সেদিন অনেক দোকান-পসার আসে নৌকায় করে। দূর-দূরান্তর, আশপাশের অনেক লোক, বাদাবনের ধারের বসত থেকে লোকেরা জিনিসপত্তর বেচতে-কিনতে আসে। সেদিন এই ঝিমিয়ে পড়া হাটতলায় লোক ধরে না।
সেদিন জমে ওঠে গঞ্জ লোকজনের কলরবে আর নৌকো-ডিঙির ভিড়ে। বড়ো গাঙ থেকে খালের ও-মাথা পর্যন্ত কেবল ভিড় আর ভিড়।
তবু অন্যদিনও এখানে সাড়া ওঠে। স্তব্ধ বাতাসে থেকে থেকে ওঠে নদীর ঝোড়ো হাওয়ার গর্জন। নদী কেবলই ফুঁসছে। পিঠেন হাওয়া লাগে জোয়ারের জলে, মেতে ওঠে গাঙের বিস্তৃত সেই জলসীমা।
হঠাৎ সেই জলস্রোতে মিশে একটা সুর ওঠে। অনেকগুলো ছোটো ছেলের গলার সুর—তার সঙ্গে মিলিছে আর একটি কন্ঠস্বর।
.
তরুণ ভুবন দারোগা প্রথম এই থানার চার্জে এসে একটু অবাক হন। সুন্দরবনের এই সীমান্ত-থানায় যেন তাঁকে নির্বাসনে পাঠাচ্ছেন কর্তারা। কয়েক বছর কাজ করেছেন। জেলা সদর থেকে অনেক বড়ো থানাতেও ছিলেন তিনি। ঘোরার চাকরি, তাই ঘুরতে ফিরতেই হয়। ভুবনবাবু এই বদলিতে অরাজি হননি।
কিন্তু এমনি জায়গাতে বদলি হয়ে আসতে হবে, তা ভাবেননি। বসিরহাট থেকে আরও বেশ খানিকটা এসে হাসনাবাদে লঞ্চে উঠেছিলেন বিকেলের কাছাকাছি বেলায়।
লঞ্চ চলেছে। বিকেল গেল—সন্ধ্যা এল–এল রাত্রি। তারাগুলো জ্বলে ওঠে কালো আকাশে। সামনে নদীর বিস্তার আরও বেড়ে গেছে। লঞ্চটা নদীর একূল-ওকূলে পাড়ি দিয়ে জনমানবহীন জায়গায় থামছে। কোথাও দূরে লোকালয় আছে বোধহয়। তবে নদী থেকে দেখা যায় না।
সেই আঁধার গাঙের ধারে কাদার মধ্যেই দু-চারজন, যাত্রী নামছে, আবার চলছে লঞ্চ। তার ইঞ্জিনের একটানা শব্দ ওঠে। অন্ধকারে সেই বিরাট গাঙ পাড়ি দিতে লঞ্চটা যেন ক্লান্তি আর যন্ত্রণায় কোঁকাচ্ছে।
ধনেখালি গঞ্জ হয়ে লঞ্চটা আরও ভেতরে যাবে—সেই মোল্লাখালি অবধি। ওই লঞ্চই একমাত্র যাতায়াতের উপায়। যোগসূত্র ওই সভ্যজগতের সঙ্গে।
লঞ্চের সারেঙ-খালাসিরাও জেনে গেছে নতুন দারোগাবাবু যাচ্ছেন। তাই তারাও একটু সমীহ করে কথা বলে। ধনেখালি আসার আগেই তাঁর মাল-পত্তরগুলো ওরা টেনে আনল। জানিয়ে
দেয়,
—ধনেখালি আসতিছে স্যার। ভাববেন না, মালপত্তর আমরাই নামাই দেবোনি। অ মামু—মরা ভাঁটার গোণ, ঘাটের তক্তাখান লাগাইবা। দারোগা সাব নামবেন ইখানে।
অন্ধকারে জল কেটে চলেছে লঞ্চ, সামনে তীরভূমিতে দু-চারটে আলো দেখা যায়।
ওরা দুজনে ধরাধরি করে তক্তাটা টেনে আনে সামনে।
এটা ভুবনবাবুর জন্য স্পেশ্যাল খাতির। নাহলে দেখেন অন্য ঘাটে যাত্রীরা লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে ওই হাঁটুভোর কাদায় নেমেছে, তারপর লটাপটি খেয়ে টেনেটুনে উঠেছে কোনোমতে সেই পলিকাদা থেকে।
.
ভুবনবাবু যখন নতুন চাকরিস্থলে পৌঁছালেন তখন বেশ রাত্রি হয়ে গেছে। ঘাটে থানার লোকজন ছিল, তারাই নিয়ে আসছে ওঁকে।
রাতের অন্ধকারে জায়গাটার ম্যাপ-নকশা আকৃতি-প্রকৃতি ঠিক ঠাওর করা গেল না। তবু মনে হয় বসতি কিছু আছে। দোকান-পসারও রয়েছে। দু একটা বড়ো দোকানে হ্যাজাক বাতি জ্বলছে। কোথাও উঠছে ট্রানজিস্টার রেডিওর সুর।
লম্বা শেডের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছেন ভুবনবাবু।
ছোটোবাবু বলল,—এখানকার স্কুল এটা। মেয়েদের স্কুলও আছে। আর, ওপাশেই হেলথ-সেন্টার। বাজারও রয়েছে। ওইসব হাটের চালা—নামকরা হাট।
ওরা যেন ভুবনবাবুকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ভুবনবাবু মনে মনে হাসলেন মাত্র। তাঁর মতো ছুঁদে
লোক বনবাসেও থাকতে পারেন।
তাই বোধহয় এমনি একটা বিশ্রী থানার চার্জে এঁরা পাঠিয়েছেন। একদিকে এর সুন্দরবন, অন্যদিকে পাকিস্তান সীমান্ত। নানা গোলমাল লেগেই আছে এখানে। এখানে আসার আগেই এখানকার সম্বন্ধে খবরাখবর নিয়েছেন তিনি।
ভুবনবাবু ছোটো দারোগাকে শুধোন,
—সেই মধুসূদন না রতিকান্ত, কে একটি আছেন এখানে—না? সদাশয় ব্যক্তি নাকি তিনি?
ছোটো দারোগা শরৎবাবু একটু অবাক হল। মধুসূদন এখানের একটি নামকরা লোক। এককালে তাদেরই জমিদারি ছিল এটা। এখানকার কাছারিতেই থাকত মধুসূদন। লেখাপড়া শেখাবার চেষ্টা করেছিলেন চৌধুরীবাবুরা তাঁদের বংশের ছেলেকে, তাঁদের আদি বাড়ি ওই বারাসাতের ওদিকেই। কিন্তু সেখানে মধুসূদনকে শায়েস্তা করা সম্ভব হয়নি। নানা গোলমাল সে পাকিয়েছিল সেখানেই।
সে অনেক ইতিহাস। তখন বাধ্য হয়েই তাঁরা বাদা অঞ্চলের অনেক কাছারির মধ্যে এইখানেই তাকে পাঠিয়েছিলেন আদায়-উশুল করতে। কিন্তু মধুসূদনের এসবে নজর ছিল না। সে কেবল মদ গিলেছে আর বুনো প্রজাদের মেয়েদের নিয়ে স্ফূর্তি করেছে।
তারপর জমিদারি চলে গেল। ফৌত হয়ে গেল বাবুরা। আজ মধুসুদন-এর তেমন কিছুই নেই কিছু খাস জমি ছাড়া, যাবারও জায়গা নেই। এইখানেই পড়ে আছে। আর নানা কীর্তি-কাহিনির নায়কে পরিণত হয়েছে সে।
শরৎবাবু বলে—আছে বটে। ভদ্রলোকের ছেলে, লেখাপড়া শিখল না। বখে গেল। জাহান্নমে গেছে স্যার ওটা।
.
ভেড়িগুলো লম্বা বাঁধের মতো চলে গেছে খালের ধারে বরাবর। সেই বাঁধগুলো সরকার থেকে করানো। ওই নোনা গাঙের জল যাতে মানুষের আবাদে না ঢোকে তার জন্যই ওই ভেড়িগুলো সারা বসতকে ঘিরে রেখেছে। এদিকে-ওদিকে টিন-ছনের ঘরগুলো দাঁড়িয়ে আছে। হাটতলায় দু-একটা দোকানে হ্যাজাক জ্বলছে। ভুবনবাবু দলবল নিয়ে চলেছেন।
তিনিও বুঝতে পারেন, অনেক কৌতূহলী মানুষ দোকান, আশপাশের রাস্তায় ভিড় করে তাদের দেখছে। এখানে আগত নতুন মানুষের জন্যে তাদের কৌতূহল রয়েছে। কেউ এগিয়ে এসে কোমরের পাক দেওয়া বাড়তি খুঁটটা খুলে গলবস্ত্র হয়ে প্রণামও করে।
বাদাবনের ধার লাগা এই গঞ্জের মানুষদের কাছে দারোগা সাহেব একটি বিশেষ মানুষ। ভুবনবাবুও চারিদিকে চোখ মেলে দেখছেন। কি যেন শুনছেন।
রাতের বাতাসে জোয়ারে ফুলে ওঠা নদীর মত্ত গর্জন শোনা যায়। দিনরাত মারমুখী ওই গাঙ কি আক্রোশ ফুঁসছে। মানুষকে এখানে বসত করতে দেবে না নিষ্ঠুর প্রকৃতি, আর মানুষও কঠিন সংগ্রাম করে এখানে তার স্থায়িত্ব বজায় রাখবার জন্য চেষ্টা করে চলেছে। তাই এখানের মানুষ আরও কঠিন। ভুবনবাবুর তাই মনে হয়, মধুসূদনের মতো লোকের এখানে বাস করাই সম্ভব। আর এখানে তিনি এসেছেন নতুন কিছু করতে।
বাজার ছাড়িয়ে ওঁরা এগিয়ে চলেছেন। এদিকে একটা পুকুর। কার জড়িত-কণ্ঠের চিৎকার শোনা যায়। একটা কলরব উঠছে।
ওঁরা থমকে দাঁড়ালেন। নিমাই জমাদারও পেছনে ছিল, সেও শুনেছে কলবরটা। বলে,
—ওই মধুরই কাণ্ড স্যার। মদ খেয়ে রাতের বেলায় কোথায় ঝামেলা করতে গেছে। ভুবনবাবু ওদের দিকে তাকাচ্ছেন। ছোটো দারোগা শরৎবাবু বলে—ও একটা প্রবলেম স্যার, ওই মধুসূদন।
ভুবনবাবু কী ভাবছেন।
সামনে থানার ঘরগুলো দেখা যায়। গাঙের একটা বড়ো খাল ওপাশ দিয়ে চলে গেছে। একজন সেন্ট্রি বন্দুক ঠুকে স্যালুট করে গেটের পাশে।
থানার এলাকায় ওঁরা ঢুকলেন। মফসসলের থানা। তবু এখানের একটু গুরুত্ব আছে। যাতায়াতের পথ নেই। দুর্গম ওই নদী। বর্ষাকালে সবদিন লঞ্চ আসে না। কালবৈশাখির সময়ও যাতায়াত বন্ধ। চারিদিকের এর মত্ত নদীর প্রহরা। ছোটো-বড়ো দ্বীপের সমষ্টি আবাদ অঞ্চলকে ভরিয়ে রেখেছে। মনে হয় এগুলো নদী নয়। বঙ্গোপসাগরই তার লোভী হাতের পাঞ্জাটা বসিয়েছে এই মাটিতে, ওর ধারালো জিভের সাপটে একে ওর অতল গহ্বরে প্রবেশ করিয়ে নেবে। গ্রাস করবে সবকিছু। আকাশ-বাতাস সেই গর্জনে মুখর হয়ে ওঠে।
দুর্গম সীমান্তের এই থানায় তাই রেডিও যোগাযোগ রয়েছে সদরের সঙ্গে। বেশ কয়েকজন কনস্টেবলও আছে। কাজ এখানে অনেক।
সামনে খানিকটা ঘাসে ঢাকা মাঠ মতো। এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে আছে কোয়ার্টারগুলো, মধ্যখানে থানা-বিল্ডিং। উঁচু দাওয়ায় একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। ওঁরা এগিয়ে গেলেন ওইদিকে।
.
সকালবেলায় কাজকর্ম দেখছেন ভুবনবাবু, ডায়ারি খাতাগুলো পড়ছেন। গাছগুলোয় কলরব করছে পাখির দল। মাঝে মাঝে কয়েকটা শিরীষ গাছ মাথা তুলেছে কালো ডাল আর জিরি জিরি পাতার বিরাট ছাতা মেলে। রোদে ভরে উঠেছে চারিদিক।
মোটা মতো একটু গোলগাল লোককে ঢুকতে দেখে তাকালেন ভুবনবাবু। বোধহয় এখানকার কোনো মহাজন, না হয় অন্য কোনো কাঠের কারবারি লোকই হবে। ওপাশে দেখেছেন একটা বাংলো মতো। গুদামও রয়েছে। ধান কল মাথা তুলেছে। কোন কাঠ-মহাজনের গদি রয়েছে, বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে। নৌকা তৈরি করার ব্যবস্থা আছে, তাছাড়া নৌকো-পত্তর মেরামত করাও হয়।
কাছে আসতে দেখেন, ভদ্রলোক ধুতির নিচে একটা শার্টকে গলিয়ে দিয়েছেন, গলা-অবধি বোতাম আঁটা। গলায় ঝুলছে স্টেথিসস্কোপ। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো। জলে কাদায়-ধুলোয় চলে চলে সেটার আসল বর্ণ আর চেনার উপায় নেই। ডাক্তারদের একটা স্বাতন্ত্র্য থাকে চেহারার মধ্যে, পোশাক-আশাকের মধ্যেও। কিন্তু গলায় ওই স্টেথিসস্কোপ না থাকলে একে ওই কাঠ-মহাজন, না হয় গোলাদার বলেই চালানো যেত। ভদ্রলোক নিজে এসে পরিচয় দেন,
—আমার নাম অশ্বিনীবাবু, এখানকার ডাক্তার। নমস্কার! এলেন, ভাবলাম পরিচয়টা করে যাই। তারপর দেখা হবে হামেশাই। ক’টি তো প্রাণী আমরা।
ভুবনবাবুও শুধোন,—ইউনিয়ন বোর্ডের হেলথ-সেন্টার দেখলাম—ওরই ডাক্তার?
হাসেন অশ্বিনীবাবু—আজ্ঞে না। ওখানে তো শুনি যাঁরই বদলির হুকুম হয়, তিনিই গিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ধর্না দেন। মায় মন্ত্রীদের কাছ অবধি। তার পরদিন মেডিক্যাল লিভ। এমনি করেই কেটে পড়েন। আমি অবশ্য এইখানেই রয়ে গেছি আগে থেকে। গেড়ে বসেছি, এখন আর যাই কোথায়? তাই বাদাবনেই রয়ে গেছি। কেমন ভালো লেগে গেছে জায়গাটা।
ভুবনবাবু লোকটার দিকে চেয়ে থাকেন। এমন জায়গা, এখানকার দুর্ধর্ষ মানুষ আর মৃত্যুমুখী গাঙ—এই পরিবেশকে কারোও ভালো লাগতে পারে, এমন কথা তাঁর জানা ছিল না।
দেখে মনে হয় এখানে ভালোই আছেন অশ্বিনীবাবু। ওঁর চেহারার মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। সাদামাঠা চেহারার মধ্যে একটা সরল ঋজুতা আর কাঠিন্যও রয়ে গেছে, যেটা তাঁর সন্ধানী চোখের সামনে ধরা পড়তে দেরি হয় না।
নেহাত ভদ্রতার খাতিরেই বলেন ভুবনবাবু,
—নিন সিগ্রেট নিন। বসুন, ওহে সুকুল, একটু চায়ের ব্যবস্থা করো না—ডাক্তারবাবু এসেছেন।
অশ্বিনী ডাক্তার বলেন,
—না না, থাক স্যার। সিগ্রেট আমি খাই না। লেখা মোটেই সহ্য করতে পারে না এসব। আর বেশি চা খাবারও উপায় নেই। দু-বেলা দু-কাপ খাই। লেখা এসব দিকে খুব পারটিকুলার।
ভুবনবাবু দারোগাগিরি করলেও এমনিতে রসিক ব্যক্তি। এখনও তরুণ—আড্ডাবাজ। বেশ হই-চই করেই থাকতে চান। দেখেছেন এতে তাঁর কাজের সুবিধেই হয় অনেক সময়! চট করে লোকের কাছে আসা যায় এমনি প্রাণখোলা ব্যবহারে আর সহজ ধরনের কথাবার্তায়। ধমক, শাসন, দাপট পরে প্রয়োগ করার কথা ভাবেন তিনি। এগুলো দিয়েই আগে লোকজনকে বশীভূত করতে চান। না হলে অন্য পথ নিতে হয়।
ভুবনবাবু বলেন,—লেখা? মানে আপনার—
অশ্বিনীবাবু হাসলেন,
—আমার বোন। বিয়ে-থা অবশ্য করেছিলাম। কিন্তু কি জানেন? টিকল না। ভদ্রমহিলা মারা গেলেন এই বনবাসেই। আমারও মনে হল সেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো। ‘মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে। তাই লিখি দিলা বিশ্বনিখিল দু-বিঘার পরিবর্তে!’ একজনকে হারিয়ে এইসব নিয়েই মেতে রইলাম। চলে যাচ্ছে সুখে-দুঃখে। যাক, এসেছেন ভালোই হল। মাঝে মাঝে আসা যাবে। যদি বেড়াতে যান—গরিবের ওখানে পায়ের ধুলো দিলে খুশি হব। যাকে বলবেন দেখিয়ে দেবে আমার বাড়ি। স্কুলের কাছেই আমার ডাক্তারখানা। নমস্কার!
অশ্বিনীবাবু চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ফিরে এসে বললেন,
—যাক, আপনি এসেছেন একটা কথা বলে রাখি মশাই, ওই মধুকে সামলান। ওই যে ভাঙা কাছারিতে থাকে, একটু ডেকে বলে-কয়ে দেখুন না! দেখেছেন বোধহয় তাকে?
ভুবনবাবু ওঁর কথায় তাকালেন।
অশ্বিনীবাবু বলেন গলা নামিয়ে,
—মহা নচ্ছার মশাই। জ্বালিয়ে মারল মানুষগুলোকে। ভদ্রলোকের ছেলে, একেবারে গোল্লায় গেছে। কাল রাতেই কী সব গণ্ডগোল বাধিয়েছে। তাই নিয়ে রক্তপাত, আর ধাক্কা এসে পৌঁছোয় আমার কাছে।
ভুবনবাবু ওঁকে আশ্বাস দেন,
—দেখি কী করা যায়! একটা ব্যবস্থা যাহোক করতে হবে।
অশ্বিনীবাবু চলে গেছেন। ভুবনবাবু কি ভাবছেন। একবার সেই মধুকে ডেকে পাঠাবেন কিনা ভেবে কিছু করতে পারেন না।
নিজেই উঠলেন। জায়গাটাকে দেখাও হবে ঘুরে-ফিরে আর যদি সেই জীবটিকে দেখতে পান—ভালোই হবে। তাকেও একটু বাজিয়ে দেখে নেবেন।
.