২
বাতাসে জলকল্লোলের শব্দ ওঠে। ওটা এখানকার আকাশ-বাতাসে মিশিয়ে আছে। কখনও কমে, কখনও বা ওই নদীর জোয়ারের সময় মুখোট হাওয়ার সাপ্টে ওঠে। সেই গর্জন যেন হাজারো সাপের ক্রুদ্ধ ছোবলের শব্দ নিয়ে ওঠে আকাশে বাতাসে। মাটির রং কেমন সাদাটে, একেবারে নোনতা; ঊষরতা ওর মরেনি। ভুবনবাবু ধুতি-পাঞ্জাবি পরেই পথে বের হয়েছেন। এখনও এখানে তাঁকে কেউ চেনে না।
ভুবনবাবু চলেছেন হাটের পরিত্যক্ত জায়গার পাশ দিয়ে। বাড়িগুলো অধিকাংশই টিনের, না হয় ছনের বেড়ার, মাথায় টিনের ছাউনি। নদীর ভাঙন-মুখ, বেতাল দেখলে মালিকরা ওই চারাঘরগুলো তুলে নিয়ে অন্যত্র সরে যাবে। বাকি কিছু ঘর-বাড়ি যা আছে তা ওই মাটিরই। জীর্ণ ছোটো নিচু নিচু ঘরগুলোয় অধিকাংশ খেটে-খাওয়া জনমজুর, না হয় ভূমিহীন কৃষকদের বাস। দু-চারটে গোরু বলদ আছে। কোনওরকমে টিকে আছে তারা। ওদের নিজেদের অবস্থাও ঘরের মতোই জরাজীর্ণ। যাই-যাই করে কোনমতে রয়ে গেছে দিন-রাত শুধু ঝড়-বাদল আর ওই নোনা হাওয়ার সাপটানি সহ্য করে।
ভুবনবাবুকে ওরা কেউ চেনে না। তাই স্বচ্ছন্দেই তিনি এদিক-ওদিক ঘুরছেন। বাজার অঞ্চলে সারবন্দি টিনের ঘর, দু-চারটে দোকান বেশ বড়োই। আবাদের শেষ সীমা—এখানকার মানুষের কাছে শহর কোন স্বপ্নের বস্তু।
.
আরও দক্ষিণের আবাদ অঞ্চল থেকে তারা গঞ্জে আসে।
তাদের ওই দূর নির্জনের বসতি থেকে বনের স্বাদ আনা জগৎ থেকে তারা এক গোণের পথ এই হাটে এসেই কাজ সেরে যায়। আর নৌকো-মহাজনদের মাঝি-বাওয়ালিদের থাকতে হয় ওই জঙ্গলে। কাঠ কাটার জন্য ওরা নৌকোতেই পড়ে থাকে মাসাবধি কাল সেই সুন্দরবনের গহনে। সেই সময়কার রসদপত্তর তরি-তরকারি, চাল, ডাল, তেল, ময়দা, কাপড়, গামছা অবধি সবই যায় এখান থেকে। তাই এ হাটের বোলবোলাও আছে।
তাছাড়া আর একটা কারবার এখানে আছে। সেটার খবরও জানেন ভুবনবাবু। পাকিস্তান সীমান্ত বেশি দূর নয়, মাঝে কয়েকটা গাঙ আর ওই গহন বনের রাজ্য। ওই দুর্গম পথে এদের যাতায়াত আছে বোধহয়। নইলে এমনি পাণ্ডববর্জিত সভ্যতার শেষ সীমান্তে এইসব সেরা দেশি-বিদেশি জিনিস—ঘড়ি, বিদেশি রেডিও এর আমদানি সম্ভব হয় কি করে?
এরা যে বেশ শাঁসে-জলে ফুলে উঠেছে তা বোঝা যায়। ওপাশে খালের দিকে গড়ে উঠেছে একটা ধানকল, তার কালো চিমনি থেকে নীল আকাশে ধোঁয়া বের হচ্ছে। কালো সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওই আকাশের বুকে হিজিবিজি দাগ কেটে চলেছে হাওয়ার ইশারায়।
পথে লোকজন আজ বেশি নেই। হাটের দিন নয়। খালের ঘাটে তাই দু-চারটে নৌকো, কিছু লোকজন, যারা এখানেরই বাসিন্দা তারাই রয়েছে মাত্র। ওদিকে দু-চারটে কেওড়া, গরান গাছ নদীর চরে মাথা তুলেছে। ঘন সবুজ গাছগুলো জনবসতে সুন্দরবনের ইশারা আনে।
ফরেস্ট-অফিসটা গ্রামের একটু বাইরে। ওরা যেন লোকালয়ের এই ভিড়টাকে ঠিক পছন্দ করে না। নিজেদের সীমানায় ভেড়ি বাঁধ দিয়ে জায়গাটাকে পোক্ত করে আরও সবুজ করে তুলেছে নানা গাছপালা লাগিয়ে। মাঝে একটা মিঠে জলের পুকুর, টিউবওয়েলও রয়েছে। বাদাবনের গাঙের জল নোনা। বনে যাবার নৌকোর মাঝিরা ওই কল থেকে মিঠে জল তুলে নৌকোর জ্বালাগুলো ভর্তি করছে। শান্ত-স্তব্ধ একটি ছোটো জনপদ। ভুবনবাবুর মনে হয় সভ্যজগৎ থেকে নির্বাসিত হয়ে এই দূর-দুর্গমে মানুষ নিজেদের মতো করে একে গড়ে নিয়েছে। সুখেই আছে ওরা। এই বিপদের মধ্যে বাস করে একে মেনে নেবার চেষ্টা করেছে।
ওদিকে গাছগাছালির আড়াল থেকে ছেলে-মেয়েদের প্রার্থনার সুর ভেসে আসে :
তুমি বিশ্ববিপদ হস্তা
দাঁড়াও রুধিয়া পন্থা
বোধহয় স্কুল হবে। ওই কলরবটা এখানে যেন প্রাণের সাড়া এনেছে। একটি মেয়ের কন্ঠস্বরও শোনা যায় ওই সঙ্গে। সে প্রথমে গাইছে, তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইছে বাকি ছেলেমেয়েরা। এই পরিবেশের মধ্যে ওরা ছায়া-সবুজ জায়গাটুকু কী স্নিগ্ধতা আনে। মনে হয়, মানুষ একেবারে সব ভুলে যায়নি, এই অরণ্যরাজ্যেও তারা অন্য জগৎ গড়ে তুলতে চায়। তারই চেষ্টা চলেছে এখানে। ভুবনবাবু ওই দিকেই এগিয়ে চলেন কি খেয়াল-বশে।
ওপাশে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। বড়ো নদী থেকে ছোটো খালটা বের হয়ে মাঠের বুক চিরে গেছে। জোয়ারের সময় ওই খালের জল ফুলে ওঠে। এখন ভাঁটার সময় খালের জল কমে গেছে। দুদিকে বের হয়ে পড়েছে কালো থিকথিকে কাদা। ওই কাদায় দু-চারটে বক কী খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, বক কাদাখোঁচা পাখির দল।
বাঁধের ওপাশে ধোঁয়া উঠছে। আগুন জ্বেলেছে কয়েকটা লোক। একটা নৌকোকে উলটে ফেলে তার পিঠ থেকে পুরনো আলকাতরাগুলো আগুন দিয়ে তুলছে। চাঁচছে। কয়েকটি বড়ো টিনে পিচ ফুটছে, বোধহয় নৌকোটাকে রং করা হবে। ওদিকে একটা কাঠের তৈরি বাংলো। সামনেই খালের বুকে ছোটো-বড়ো অনেক নৌকো রাখা। ভুবনবাবু সেখানে দাঁড়ালেন।
কয়েকজন কাজ বন্ধ করে মুখ তুলে দেখছে। ওদের পাশেই একজন যুবক দাঁড়িয়েছিল। পরনে চেক-চেক একটা লুঙি। এককালে ওটার বাহার ছিল, এখন অবহেলায় আর ব্যবহারে সেটার রং বিবর্ণ হয়ে গেছে। গায়ে পাতলা গেঞ্জি। বয়স বেশি নয়। নিটোল দেহ। তবু কেমন একটা চোয়াড়ে ভাব ওর চোখে-মুখে ঠেলে উঠেছে। চোয়ালটা শক্ত। সারা দেহে এই বাদাবনের বাঘের মতো সবল ভাব, চোখ-দুটো একটু লালচে। বেশ বোঝা যায় এই বয়সেই ও একটু বেশি তৈরি হয়ে গেছে।
ভুবনবাবুকে সিগ্রেট টানতে দেখে এগিয়ে এল সে। বললে,—একা একাই খাচ্ছেন যে মশাই! ছাড়ুন না দু-একটা!
ভুবনবাবু ওর এই সতেজ ভাব দেখে একটু অবাক হন। ওর যেন এখানের সকলের কাছ থেকেই এমনিভাবে নেবার একটা অধিকার জন্মে গেছে। না দিলে কীভাবে জোর করে আদায় করতে হয়, এটা সে বোধহয় জানে।
ভুবনবাবু প্রথমটায় চটে উঠেছিলেন। হাজার হোক তিনি এখানকার দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা। তাঁর সঙ্গে এমনি ইয়ার-দোস্তের মতো ব্যবহারটা পছন্দ করেন না তিনি। জীবটির দিকে তাকিয়ে দেখছেন।
তবু কি ভেবে ওর দিকে সিগ্রেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলেন। ও প্যাকেটটা হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখে একটু অবাক হয়, একটা সিগ্রেট বের করে কানে গুঁজে অন্যটা ধরিয়ে বলে,
—ক্যাপস্টান! এ যে অনেক দাম মোশাই! গুড!
দেশলাইটা ওঁর হাত থেকে খপ্ করে নিয়ে দমকা বাতাসের দাপট বাঁচিয়ে অভ্যস্ত হাতে কাঠি জ্বেলে ওটা ধরিয়ে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে চোখ বুজে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে,
—খাসা মাল! কী মোশাই, টানা চিজ, না কলকাতার বস্তু?
এরই মধ্যে ভুবনবাবু লোকটির সম্বন্ধে মনে মনে একটা ধারণা করে নিয়েছেন। এখানের অন্ধকার জীবনের ওরাই শরিক। তাই ওসব লোককে হাতে রাখতে চান তিনি। বলেন,
—না। কলকাতার জিনিসই। টানা মাল এখানে মেলে নাকি?
—কী মেলে না মশাই এখানে? সব মেলে।
লোকটি তাঁকে দেখছে। নিরীক্ষণ করছে ভালোভাবে। ওই পরিবেশে ভুবনবাবুর মতো লোক যে বেমানান, সেটা বুঝেছে সে।
ওই যে লোকগুলো নৌকোয় গাব আলকাতরা দিচ্ছিল, তারাও দেখছে তাঁকে। লোকটি গলা নামিয়ে শুধোয়,
—চলবে?…..এ মুলুকে কিসের মতলবে স্যার? তা’লে মাল—মানে দ্রব্য ট্রব্য এনেছেন কিছু? থাকে তো বের করে ফেলুন। ওই যে—
দুটি হাতের তালুর মধ্যে একটু ব্যবধান সৃষ্টি করে তার পরিচয়টা জানাল একটা বোতলের মাপে।
ভুবনবাবু বলেন,
—না না। এমনিই একটু বেড়াতে এসেছি।
লোকটি হতাশ হয়,
—অ! এমনি মজা দেখতে এসেছেন এখানে? ধ্যাত্তেরি—! কইরে পদা—গরম হল তোর আলকাতরা? গাব দিইছিস?
ও আর যেন তাঁকে চেনে না। ওদিকে কাকে ইশারায় ডাকতে দেখে এগিয়ে গেল সে।
ভুবনবাবু দেখলেন, ওই কেওড়া গাছের ছায়ায় বসে একটা থলি থেকে দেশি মদের বোতল বের করে দিল একটা লোক, সে-ও ছিপি খুলে গট গট করে গলায় ঢেলে, মুখ-মুছে আবার এগিয়ে এসে ভুবনবাবুকেই শুধোয়,
—চলবে নাকি স্যার দু-এক ঢোক? বেড়াতে এসেছেন বাদাবনে, একটু মধু খাবেন না? টেস্ট করে যান। বেড়াতে এলে কলকাতার বাবুরা এসব চোখে দেখেন। ভালো মাল কিন্তু।
নিজের রসিকতায় হাসতে হাসতে বলে সে,
—মধুও পাবেন, আর মৌমাছি, মানে মক্ষীরানি চান, তাও পাবেন। দুদিন এসেছেন, একটু এনজয় করে যান মোশাই। কলকাতায় যাই মাঝে মাঝে। বিলকুল ভেজালের দেশ মাইরি। সব নকল—ফসো। দেখছেন বেশ সেজেগুজে একেবারে পরিটি হয়ে আছে, গেলেন—ব্যস, দেখবেন সেই পত্নী। আর ওসব ফসো। এখানে তা পাবেন না মোশাই। হুল আছে বটে—তবে রিয়েল মক্ষীরানি। আর খরচও কম। মানে ভেরি চিপ। কি স্যার?—নিন!
মধু বোতলটা ভুবনবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
—লজ্জা করবেন না, গলায় ঢেলে দিন, মেজাজ খুশ হয়ে যাবে।
—এসব চলে না আমার। ভুবনবাবু জবাব দেন।
মধু অবাক হয়ে বলে,
—তবে কন্ঠিগলায় দিয়ে বাদাবনে হাওয়া খেতে এসেছেন? ধ্যাৎ তেরি! ভুবনবাবু সরে এলেন। লোকটির নেশা শুরু হয়ে গেছে বোধহয়।
লোকটি বলে,
—ধ্যাৎ, ইয়ংম্যানের এসবে অরুচি! কি র্যা পদা?
পদা চোখ বুজে বলে,
—যেতে দাও গুরু! ছেলেমানুষ!
ভুবনবাবু সরে গেলেন ওপাশে।
মনে হয় পাঁড়মাতাল না হলে দিন-দুপুরে প্রকাশ্যে নেশা করে, আর ওইসব বাজে কথা বলে? বিশেষ করে একজন অপরিচিত ভদ্রলোককে?
ভুবনবাবু চলে আসছেন, নিজের পরিচয় এখানে না দেওয়াই ভালো। তবে একবার কোনো লোককে দেখলে তিনি চিনে রাখেন! ওকেও মনে রাখবেন। এই ব্যাপারটা তিনি ভুলবেন না।
চলে আসছেন ভুবনবাবু, পেছনে হাসির শব্দ শোনা যায়।
হাসছে সেই মাতাল যুবকটি।
—ভয়ে কেটে পড়লেন স্যার? আরে বাবা, দু-চারদিন বাদাবনে থাকো, তখন বুঝবে এ শর্মা মিছে কথা বলেনি। হক কথা বলেছে। ছোঁক ছোঁক করে ধুমসো বাঘের মতো তখন ওই মালোপাড়ায় না হয় বুনো পাড়ার আশপাশে শিকারের সন্ধানে ঘুরছ, এও দেখব তখন। সতীপনা ঢের দেখা আছে।
ভুবনবাবুর মতো শান্ত-লোকটাও এইসব কথাতে বিগড়ে গেছেন। ফিরে আসছেন থানার দিকে।
.
এখানে একটু ছায়া ছায়া ভাব রয়েছে, কতকগুলো কৃষ্ণচূড়ায় সবুজ পাতা ছেয়ে এসেছে লাল ফুলের ইশারা; ছাতিম গাছের সবুজ পাতাগুলো ঘন ছায়া মেলেছে আঙিনায়। চারিপাশে সন্ধ্যামালতী, দু-একটা জুঁই আর কলকে ফুলের গাছ রয়েছে।
টিনের শেডের নিচে বোধহয় স্কুল বসেছে। ওদিকে নদীর ঘাটের পাশেই ডাক্তারখানা। নৌকা করে রুগি এসেছে দূর-দূরান্তের আবাদ অঞ্চল থেকে। অনেকে এসেছে কাছাকাছি অঞ্চল থেকে গোরুর গাড়িতে—না হয় হেঁটে। ওরা গাছের ছায়ায় বসে আছে।
—নমস্কার স্যার! ওঁকে দেখতে পেয়ে অশ্বিনী ডাক্তার দাওয়া থেকে নেমে আসেন, আসুন! আসুন! ওরে একটা চেয়ার দে।
ভুবনবাবু এগিয়ে যান। একটা চেয়ার বের করে আনল একজন।
অশ্বিনীবাবু তাকে বলেন,
—লেখা-দিদিমণিকে ডেকে আন, স্কুলে আছে বোধহয়। বলবি আমি ডাকছি, বিশেষ দরকার। অশ্বিনীবাবু দারোগাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন,
—না হলে ক্লাস ফেলে আসবেই না। বুঝলেন মশাই, আমি এক পাগল। তার চেয়ে এককাঠি বেশি পাগল ওই লেখা। ওরে বিষ্টে, একটু চা করে আন দারোগাবাবুর জন্যে। ওঁর আবার ঘন ঘন চা খাওয়া অভ্যেস।
ভুবনবাবু দেখছেন স্কুলের দাওয়া থেকে একটি মেয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে।
সাদা খোলের লালপাড় শাড়িটা বেশ আঁটোসাঁটো করে পরা, সাদা ব্লাউজ পরেছে—ওর হাতটা নেমে এসেছে কনুই অবধি। কাঁধের কাছে শাড়িটা একটা পিতলের সেফটিপিন দিয়ে আটকানো। ওর হাঁটা-চলার মধ্যে মেয়েলি সেই ছন্দ আর লাবণ্য অনেক কম। পুরুষের কাঠিন্য নিয়েই ও যেন পা ফেলে এগিয়ে আসছে এইদিকে।
ওর পোশাকে চলনে ফুটে ওঠা একটা শুচিতার আভাস। সেটা কাঠিন্যের বর্ম দিয়ে ঘেরা। আর স্বাস্থ্যও তেমনি। তবে সেই স্বাস্থ্যের লাস্য নেই—মাদকতা নেই। ওটা যেন ওর অন্তর মনের পুঞ্জীভূত শক্তিরই একটা অংশে পরিণত হয়েছে।
দাওয়ায় উঠে এল মেয়েটি। ভুবনবাবুকে দেখে দাঁড়াল। একটু যেন অবাক হয়েছে মেয়েটি এখানে অপরিচিত একজন ভদ্রলোককে দেখে। তাই ওর মুখে একটু গাম্ভীর্য ফুটে ওঠে।
অশ্বিনী ডাক্তার পরিচয় করিয়ে দেন,
—আমার বোন লেখা। আর উনি এখানের নতুন দারোগাবাবু।
লেখা ছোট্ট একটু নমস্কার জানাল।
ভুবনবাবু হাত তুলে প্রতি-নমস্কার জানালেন। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। ওর মুখ-চোখের সেই কাঠিন্য ওঁর দৃষ্টি এড়ায় না। হাসির কোনো ছায়া ওতে নেই। কমনীয়তাটুকু ওর মন থেকে মুছে গেছে এই কঠিন পরিবেশে। যা আছে, সেটা শুধু কর্তব্য আর নীতিবোধই।
অশ্বিনীবাবু বলেন,
—আমার ডাক্তারিতে ও সাহায্য করে মশাই। লেবার কেসগুলো ও আমার চেয়ে ভালো পারে। তাছাড়া টুকটাক চিকিৎসা, জ্বর, এটা সেটা মায় ছোটখাটো অপারেশন অবধি শিখে ফেলেছে ও। কম্পাউন্ডার না এলে ওই-ই চালিয়ে দেয়। আর নেশা বলতে ওই স্কুল। লেখা ওই নিয়েই মেতে আছে। যত ছেলেপুলে কিল্লি-বিল্লি দেখছেন, সবাই ওর ভক্ত। ওদের নিয়ে আর ওই সেবাশ্রম নিয়ে আছে বেশ।
লেখার ওই কঠিন কর্তব্যনিষ্ঠার ছায়া-লাগানো মুখে একটু যেন সলজ্জ ভাব ফুটে ওঠে। লেখা বলে,
—না না। দাদার কথায় কান দেবেন না। কী আর করা যাবে—এইখানেই বাস করি, সময়ও আছে—এদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি। এটা তো সেবারই কাজ। বিবেকানন্দই বলেছেন, ‘জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ এইটুকুই না হয় ধর্ম-আচরণ করলাম।
ভুবনবাবু ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। এমন কিছু বেশি মেয়েটির নয়। যতই কাঠিন্যের আবরণে নিজেকে লুকিয়ে রেখে রাশভারী হতে চেষ্টা করুক, ওর বয়স পঁচিশের কাছাকাছি হবে। এই বয়সে ওর মুখে সেবাধর্ম এবং নিজেকে এইসব কাজে বিলিয়ে দেবার চেষ্টা দেখে অবাক হয়েছেন তিনি। মেয়েটির কাঠিন্যটা যেন বাইরের সাজ, কমনীয়তাটুকুকে ঢাকবার ওটা চেষ্টা মাত্র
চুপ করে থাকেন মাত্র দু-একবার সমর্থনসূচকভাবে মাথা নেড়ে।
তিনি একটা সিগ্রেট ধরালেন। মনে হয়, এসব শুনে ওই সিগ্রেট ধরানো ছাড়া আর কিছু করা যায় না। ওদিকে চাকরটা চা নিয়ে এসেছে মাত্র এক কাপ। লেখার মুখে ফুটে ওঠে কাঠিন্যের স্পর্শ। অশ্বিনীবাবুও একটু যেন ক্ষুণ্ণ হয়েছেন।
ভুবনবাবু অপ্রস্তুতের মতো বলেন,
—সিগ্রেটে অসুবিধে হচ্ছে নাকি আপনার?
অশ্বিনী ডাক্তার ভদ্রতার খাতিরেই বলেন,
—না না। আমার ওসব গন্ধ সহ্য-করার অভ্যেস আছে। লেখারই ভালো লাগে না। তবে এখানে তো দমকা হাওয়া রয়েছে মশাই—খান খান। ও গন্ধ লাগবেই না—বাতাসে উড়ে যাবে।
লেখা ইতিমধ্যে ঘরের ভেতরে গিয়ে একটা প্লেটে করে ক্ষীরের কয়েকটা প্যাড়া এনে দিয়ে বলে,
—খালি পেটে চা খাবেন না। ও তো বিষ। ওই নিকোটিন আর ট্যানিক অ্যাসিড—দুটোই খুব খারাপ। নিন, কিছু খেয়ে নিন।
ভুবনবাবু লেখার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
এ সময় তিনি কিছু খান না, তবু ওই মেয়েটির কথায় প্লেটটা হাতে নিলেন। মনে হয় ওর কণ্ঠস্বরে একটা ব্যক্তিত্ব আছে, স্বাতন্ত্রও।
অশ্বিনী ডাক্তার বলেন,
—খান ভুবনবাবু লেখার আবার নইলে রাগ হবে।
—না না, খাচ্ছি তো!
ভুবনবাবু খাচ্ছেন। লেখা একটা টুল টেনে নিয়ে বসেছে। দারোগাবাবুকে তার বোধহয় ভালো লেগেছে।
তাই কথাগুলো বলে লেখা,
—এখানে এসেছেন, এখানকার মানুষদের দুঃখ-দুর্দশাটাও দেখুন। যাতায়াতের পথ নেই, বর্ষাকালে চারিদিক দুর্গম হয়ে ওঠে। এইখানেই দেখুন না–থানা, এতবড়ো হাট-গঞ্জ, সব রয়েছে। তেমন স্কুলও নেই। আর সরকারি ডাক্তারখানায় তো ডাক্তারও নেই, ওষুধও নেই।
ভুবনবাবুও ওসব কথা শুনছেন। নিজেও দেখেছেন ঘুরে ঘুরে ইতিমধ্যে। মানুষগুলোর আর সব আছে, এদিকেই দৃষ্টি নেই।
ঘাটে দেখা সেই মাতাল লোকগুলোর কথা মনে পড়ে। ওরাই যেন এখানকার আসল জীব। ওদের দাপটের সামনে অশ্বিনীবাবু—এই লেখার মতো মানুষদের কোনো স্থান নেই।
তাই মধুসূদনের মতো মানুষরাই এখানের আসল জীব।
লেখার মুখ-চোখে কী আবেগ ফুটে উঠেছে। বলে সে,
—এদের কথা বলারও কেউ নেই। অথচ এদের কষ্ট-দুঃখ কত তা দেখে যান!
ভুবনবাবু বলেন,
—কেন, মধুসূদনের মতো লোকও তো অনেক আছে এখানে!
লেখার মুখের ভাব বদলে যায়। কঠিন হয়ে ওঠে সেই মুখটা। বলে সে,
—ওটা একটা জানোয়ার। ওকে এদের মধ্যে ধরবেন না। কাজ করবে না, জীবনভোর শুধু ও সব ঘুচিয়েছে মাত্র। নিজের বিবেক-মনুষ্যত্বটুকুও।
লেখা একটু চুপ করে থেকে বলে,
—তবু জানেন, এখানে লোক এখনও সৎ, পরিশ্রমী। সামান্য সুযোগ পেলে এরাও মানুষ হয়ে উঠবে। ছেলেদের দেখেছেন? ব্রাইট—প্রমিসিং বয়। দেখবেন এরা মানুষ হলে এখানকার রূপ বদলাবে।
অশ্বিনীবাবুও মাথা নাড়েন,
—কথাটা মিথ্যে নয় ভুবনবাবু। দেখবেন এদের সঙ্গে মিশে, সবাই মধু চৌধুরীর মতো বুনো নয় এরা।
ভুবনবাবুর মনে হয় ওই ভাই-বোন দুটি একদিকে সত্যিই ভালো। খুব ভালো। এই এলাকার মানুষদের কথা ভাবে, তাদের ভালোর জন্য চেষ্টা করে। সেটা যে আন্তরিক, তাও বুঝেছেন এইসব দেখে। আবার তাঁর নিজের যুক্তি দিয়ে ভাবলে মনে হয়, এরা সত্যিই একটু বোকা। না হলে একালে নানা সমস্যার মাঝে মানুষ বিনা স্বার্থে মানুষের জন্য এসব ভাবে না। এটা নিছক দুর্বলতা আর বোকামি।
তবু মনে হয়, কোথায় ওদের দুজনের মনের অতলে একটা জোর আছে, যুক্তি আছে এর স্বপক্ষে—সেটা তিনি হয়তো অনুভব করতে পারেন না। তবু মনে মনে এদের শ্রদ্ধা করেন তিনি।
বাইরে লোকজন জুটেছে। অশ্বিনী ডাক্তার উঠে পড়েন,
—আমার স্যার কয়েকটা জরুরি কেস আছে। দেখে ওদের ছেড়ে দিই দূরে যাবে, বেগোণ হয়ে গেলে কষ্ট পাবে ওরা। পরে দেখা হবে।
ভুবনবাবুও বলেন,
—না না, ঠিক আছে। নমস্কার!
.
লেখাই তাঁকে এগিয়ে দিতে এসেছে স্কুলের পাশ দিয়ে। ভুবনবাবু দেখছেন ওদের। মনে হয় ওদের মনে কোথায় একটা স্বপ্ন আর একটা আদর্শ রয়েছে।
লেখা বলে,—তবু একাজে অনেক বাধাই আসে দারোগাবাবু। থাকছেন যখন—দেখবেন সব কিছুই
বাধার নমুনা কিছু দেখতে পান তিনি। এখানের শান্ত-জীবনে প্রকৃতির আক্রমণ আর আঘাত আছে। ওটা তাদের কাছে একটা নির্মম সত্যে পরিণত হয়েছে। তাকে মেনে নেবার চেষ্টা করে তারা।
কিন্তু এ ছাড়াও আছে বাদামের তাড়া খাওয়া—না হয় ছিটকে এদিকে চলে আসা বাঘের উৎপাত। প্রতিটি ভূখণ্ড এখানে ছোটো-বড়ো খাল দিয়ে ঘেরা। ওই ঘেরের মধ্যে হাজার হাজার বিঘে ধানজমি, কিছু সামান্য জনবসত। ওই মাঠের বাড়তি জল ওইসব খাল দিয়ে বের করে দেওয়া হয় দরকার মতো ছোটো গেট বসিয়ে। আর নোনা গাঙের জল যাতে ঢুকতে না পারে তার জন্য ওই বাঁধ দেওয়া হয়েছে।
মাঝে মাঝে ওইসব জনবসতে এসে হানা দেয় সুন্দরবনের বাঘ। গোরু বাছুর তো মারেই, সুবিধে পেলে মানুষও খুন করে। এছাড়াও আছে অন্য একশ্রেণির জীব, তারা বাঘের চেয়েও হিংস্র আর সন্ধানী, আর তেমনি উদ্দাম। তাদের অত্যাচারও আছে। ভুবনবাবুকে লেখা বোধহয় সেইসব কথাই বলতে চেয়েছে। তবু ভুবনবাবুর সব মিলিয়ে জায়গাটা ভালো লাগে।
নদীর ধারে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে সুন্দর একটা বাংলো–তিনদিকে অনেকগুলো ঝাউগাছ ওই জোলো হাওয়ায় শনশনিয়ে কাঁপছে। বেশ খানিকটা বাগান মতো।
পেছনে গরান খুঁটি পুঁতে বেড়াঘেরা অনেকটা জায়গা, নদীর দিকে ঘাট করা—লঞ্চ বা নৌকো থেকে ওইখান দিয়ে, ওঠা-নামা করা হয়।
কাঠের গোলা, ওপাশে ধানকল। সব মিলিয়ে এইখানটাকেই গঞ্জের সুন্দর ঠাঁই বলে মনে হয়।
ওপাশের ঘাটের ধারের লম্বা চালায় মহিম ঘোষাল আরও ক-জন লোক কী কথাবার্তা বলছে। পীতাম্বরই বলে,
—মধুটা অমনিই বাবু, বদনাম করে বেড়ায়। বলে মহিমবাবু নাকি রাঘববোয়াল। মহিম ঘোষাল হাসে মাত্র। রাগতে জানে না সে। শৌখিন চেহারা, পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা।
হঠাৎ পীতাম্বরই খালের দিকে তাকিয়ে বলে,
—ইয়াকুব মিঞা যাচ্ছে না?
মহিম ঘোষাল কিছু বলার আগে পীতাম্বরই বলে,
—গেল সন আদায় দেয়নি ও। বলে বিনা অজন্মায় গেছে, ইদিকে নতুন নৌকোর জুত দেখেন?
পীতাম্বরের ওই ছোট ডিঙিখানার দিকেই নজর গেছে। লোভ ওরই বেশি। তাই বলে,
—ডাকব ওকে? টাকা না দিলে, ডিঙি দিয়ে যাক।
মহিমবাবু ওসব সামান্য ব্যাপারে হাত গলায় না। তবে আশপাশের লোকদের কিছু পাইয়ে দেবার সুযোগ দিতেও কার্পণ্য নেই তার। তাই বলে,
—এখানে ওসব ঝামেলা কেন পিতে? অন্যত্র যা পারিস করিস। আমার টাকা ঠিকই দিতে হবে বাবা। এ সনে পারেনি, সামনের সনে সুদে-মূলে দান দিতে হবে। তবে যদি কোনোরকমে আদায় করতে পারিস করবি।
হঠাৎ মহিম ঘোষাল চমকে ওঠে,
—স্যার না? আসুন, আসুন। নমস্কার!
মহিমবাবু নিজেই এগিয়ে আসে ভুবনবাবুকে দেখে। ভুবনবাবু দাঁড়ালেন। মহিম ঘোষাল বলে,
—যাব-যাব করছিলাম। আপনি স্যার সকালেই বের হয়ে গেছেন শুনলাম। যাক, কত ভাগ্যি যে আপনার পায়ের ধুলো পড়ল!
ভুবনবাবু বলেন।—একটু ঘুরে দেখছি জায়গাটা। আপনার পঞ্চায়েত অফিসেও এসে গেলাম মহিমবাবু।
—কী ভাগ্যি আমার। কি আর দেখবেন এখানে, নেহাত বাদাবন বলতে পারেন। আমাদেরও আর ঠাঁই নেই, পড়ে আছি এখানে। আসুন, ভেতরে আসুন! ঘরেই বসা যাক।
ভুবনবাবু দেখছেন চারিদিক।
সুন্দর বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটা নদীর ধারেই, সুন্দর করে সাজানো। কাঠের মেঝেতে কার্পেট পাতা। কার্পেটটা যেন বিদেশি। টেবিলে একটা বিদেশি রেডিও রাখা। ওপাশে রয়েছে জার্মানির তৈরি দামি টেপরেকর্ডার। এখনও প্ল্যাস্টিকের কভার জড়ানো। টেবিলের প্রসাধনের জিনিসগুলো অবধি বিদেশি। দু-একটা বিদেশি প্যাকেটের ছেঁড়া কাগজও রয়েছে। দু-চারটে মদের বোতল, তাও বিলিতি, না হয় ফ্রান্সের তৈরি।
মহিম ঘোষালও তাকিয়ে দেখছে নতুন দারোগাবাবুকে। বয়স এমন কিছু বেশি নয়। মুখে চোখে বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা।
মহিম ঘোষাল বলে,– বসুন স্যার! এলেন গরিবের বাড়ি—
হাসছেন ভুবনবাবু,
—গরিব কি বলছেন? আপনি তো রীতিমতো ভালো আছেন স্যার। বিদেশি রেডিও, টেপ-রেকর্ডার, মায় ওই জিনিসগুলো-
মহিমবাবু একটা চমকে ওঠে। তার অন্ধকারের কারবারের খবরটাও জেনে গেছে কিনা কে জানে?
মহিমবাবু বলে,–আমার একটু গান-বাজনার নেশা আছে কিনা? তাই ওইসব—একদিন আসুন!
—পিতে!
পিতেও তৈরি ছিল। ইতিমধ্যে সে গরম কাটলেট এনে বোতল থেকে দামি মদ ঢেলে এগিয়ে দেয়।
মহিমবাবু বলে—একটু প্লিজ! বাদাবন, কি-ই বা মেলে এখানে-
ভুবনবাবু দামি মদটার দিকে তাকিয়ে বলেন,—ওসব তো চলে না।
মহিম ঘোষাল অবাক হয়,—মানে, ফার্স্টক্লাস ড্রিঙ্ক—চলে না? বিলিতি স্যার!
ভুবনবাবু হাসছেন—না। ধন্যবাদ!
—অ! কেমন যেন হতাশ হয় মহিমবাবু।
পিতুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়, তাতে কি নীরব একটা ইশারা ফুটে ওঠে। ভুবনবাবু বের হয়ে এলেন।
—যাই, নতুন এসেছি, জায়গাটা একটু দেখতে বের হয়েছিলাম।
মহিমবাবু যে আশা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল, ততটা খুশি হয়নি ওঁর সঙ্গে কথা বলে। ভুবনবাবু হাসলেন—চলি! পরে দেখা হবে।
মহিমবাবু ওঁকে এগিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল।
—পিতে!
পীতাম্বর তখন বাইরে দারোগাবাবুর ফেলে-রাখা কাটলেটটা গিলছিল। বাবুর ডাক শুনে কোনোরকমে গিলে এগিয়ে আসে।
মহিমবাবু বলে—এসব বাইরে কেন রেখেছিস? এই জিনিসগুলো দেখে গেছেন দারোগাবাবু।
পিতু বলে,—ওগুলো? আর থাকবে না। আর ওই ছোকরা দারোগাবাবুর কথা বলছেন? পিতু একটু হেসে বলে—কত ঝানু দারোগাকে ফুসমন্তর দিয়ে দিলাম, আর ইতো কালকের ছেলে!
—থাম! মহিমবাবু ধমকে ওঠে।
পিতু হকচকিয়ে গেল।
মহিমবাবু বলে,–ছোকরাকে দেখে খুব সোজা বলে মনে হল না। ওকে ফুসমন্তর দেওয়া সহজ নয়। তাই বলছিলাম, বেশি বুদ্ধি জাহির না করে একটু হুঁশিয়ার থাকবি।
পিতু জানে হুজুরদের হুকুম তামিল করতে। তাই চুপ করে ঘাড় নাড়ল সে। তবে বেশ বুঝেছে, মহিমবাবু দারোগাবাবুকে দেখে খুশি হয়নি।
পীতাম্বর ওপাশে কাছারিবাড়ির দিকে এগোল। তখনও ইয়াকুব মিঞা ঘাটে কার সঙ্গে কথা বলছে। এখান থেকেই খাল বেয়ে ইয়াকুব ওদিকে ডাক্তারখানার ঘাটে যাবে।
পীতাম্বর এই ফাঁকে বের হয়ে গেছে। তার নজর ওই ইয়াকুব মিঞার ডিঙির দিকে। পায়ে পায়ে সে গিয়ে হাজির হয়েছে গাঙের ধার ধরে ওই ডাক্তারখানার ঘাটের কাছে।
ইয়াকুব নৌকো থেকে নেমে নোঙর করে উঠে আসছে। সামনে পীতাম্বরকে দেখে দাঁড়াল। মহাজনের লোক, তাই ইয়াকুবই সেলাম জানায় ওকে,—ভালো তো পিতু ভাই?
পীতাম্বর ঘাটের ধারে একটা কেওড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশে দেখছে মধুসূদন, পদা আরও কারা নৌকোয় গাব দিচ্ছে। পীতাম্বর ইয়াকুবের ডাকে ফিরে তাকাল। ইয়াকুব জানে মহিমবাবুর জমির ভাগচাষি সে। গত সনের ধান দিতে পারেনি। ওই জমি মধু চৌধুরীরই ছিল এককালে। ক-বছর থেকে দেনার দায়ে তার দখল নিয়েছে মহিমবাবু।
পীতাম্বরকে বলে সে,
—বাড়িতে বড়ো বিপদ ভাই। ছেলেটার একজ্বরি চলছে। মুনিবের কাছেও যেতে পারিনি। জানোই তো, খোদাই ফেরে ফেলেছে।
ও যেন কৈফিয়ত দিচ্ছে পীতাম্বরকে।
পীতাম্বর শুধোয়,——তা’লে চল্লে কোথায়?
—ডাক্তারবাবুর কাছে, যদি ওষুধ-টষুধ দ্যান। চলি ভাই, আবার দেরি হই গেলে বেগোণে পড়ব। ঘর ফিরতে হবে।
ইয়াকুব চলে গেল। পীতম্বর দেখছে ওর ডিঙিটাকে। সুন্দর হালকা নতুন ডিঙিটা নোঙর করা আছে।
ওদিকে মধুসূদন ওর নৌকোয় রং তুলে রং করাচ্ছে। গাছতলাতেই মুড়ি-তেলেভাজা আর মদের বোতল খুলে বসে গিলছে আর চিৎকার করছে।
—অ্যাই পদা, শ্লা দেখছিস না গাবগুলো তুলতে হবে আচ্ছাসে! ওহে বাওয়ালি, ধরে কাজ করো বাবা। না’লে পয়সা তো পাবেই না, উলটে প্যাঁদানি দিয়ে বিন্দাবন দেখিয়ে দোব।
পীতাম্বর কী ভেবে এগিয়ে গেল ওখানের ডিঙিটার দিকে। মনে মনে তার মতলবটা খেলে যায়। মহিমবাবুর হয়েই ধমক দিয়ে সে কাজ হাসিল করবে।
মধুসূদন মুড়ি চিবোতে চিবোতে বলে,—ওটা কে এসেছিল র্যা পদা, ওই যে সিগ্রেটওয়ালাবাবু? নতুন মনে হল না?
পদা মাথা নাড়ে—তাই তো লাগলো গ? হবে কেউ, নতুন এয়েছে। আজকাল তো কত নতুন সাহেব হয়েছে। বি-ডি-ও সাহেব, এগ্রিকালচার সাহেব, ওই হাঁস-পাঁঠার সাহেব, ভেড়ির সাহেব। সাহেবের আর ভাবনা আজকাল! হবে কেউ।
মধুও জানে তাদের খবর। দিনকতক সাহেবদের কাছে তাকেও জোড়হাত করতে হয়েছিল ঠিকাদারি করতে গিয়ে। যত ভালোই কাজ করো, কাজ পছন্দ হবে না। কেবল বাঁ-হাত পাতবে, দিতে না পারলেই ব্যস—বিল পাস আর হবে না।
মধু অনেক খেসারত দিয়েছে, দিয়ে-থুয়ে আজ সরে এসেছে। পদার কথায় তাই হাসে,
—পাঁঠা সাহেব! অ্যাই—শ্লা ঠিক বলেছিস মাইরি।
মধু হঠাৎ ইয়াকুব মিঞার চিৎকার শুনে ফিরে তাকাল। ডাঙায় দাঁড়িয়ে আছে ইয়াকুব, হাতে ওষুধের শিশি, আরও কী সব। ওর ডিঙিটায় পীতাম্বর উঠে বসেছে। নামবার নাম নেই।
বুড়ো ইয়াকুব বলে,—মশকরা করিস না পিতু ভাই। বাড়িতে অসুখ। তাড়াতাড়ি ফিরতি হবে, দে—ডিঙিখান দে ভাই।
পীতাম্বরের মেজাজ বেশ চড়ে উঠেছে।
সূর্যের তেজের চেয়ে বালির তাত অনেক বেশি। পীতাম্বর জানত ইয়াকুব আদায়পত্তর দিতে পারেনি এবার। কর্তাবাবুও চটে আছে তার ওপর। এই বিরাগের সুযোগ নিয়েই সে ওই ডিঙি নিজে দখল করেছে। পিতু সাফ জবাব দেয়,
—ও ডিঙি আর পাবে নাই, বাকি ধান শোধ দিই ডিঙি নিই যাবা মিঞা। মহিমবাবু তাই হুকুম দেছেন।
ইয়াকুব বিপদে পড়েছে। সহায়-সম্বলহীন বৃদ্ধ সে। ওই ডিঙিটুকু তার চলাচলের বাহন। মাঝে মাঝে ওই দিয়ে কিছু রোজগারও হয়। মুখের গ্রাস জোটে ওই থেকেই। সেটাকে ছিনিয়ে নিতে দেখে চিৎকার করে সে,
—হেই পিতু! দে বাবা! বুড়োমানুষকে দিক করিস না। অন্ধের নড়ি ওটুকু, কেড়ে নিস না বাবা!
পিতুর ওসব কথায় কান দেবার প্রয়োজন নেই। সে জানায়,
—বকবক করোনি মেলা। যাও দিকি! ডিঙি নে যাব।
ইয়াকুব কাতর আবেদন জানায়,
—পিতু ভাই, গরিবেরে মেরো না।
ব্যাপারটা দেখছিল মধুসূদন ঘাট থেকে। বুড়োমানুষটা কাঁদছে, তাছাড়া পিতুকে চেনে মধুসূদন। মহিমবাবুর লুঠ করে পাবার স্বভাবকে সে ঘৃণা করে। তাকেও ঠকিয়েছে মহিমবাবু। তার লোকজনেরা পর্যন্ত আবাদের সবাইকে ঠকাবার দাবিদার হয়ে উঠেছে।
মধুসূদনের মেজাজটা সহসা কঠিন হয়ে ওঠে। চিৎকার করে বলে সে,—অ্যাই পিতে, ওর নৌকো দিয়ে দে।
পিতুর মনে একটা তেজ আছে। মহিমবাবু এখানকার প্রেসিডেন্ট, তাছাড়া শাঁসালো লোক। তারই খাস চাকর সে। পিতু জানায়,
—লবাব এল হে! বলে কিনা, দিয়ে দে! দিলাম আর কী! অঃ!
ইয়াকুব এসে মধুকেই নালিশ করে। ওকে সে-ও চেনে। জানে ওর তেজের কথা। সাহসের কথা। ইয়াকুব কান্নাভিজে স্বরে জানায়, একটু বলে দ্যান বাবু। মিছামিছি কেড়ে নেবে ডিঙিটা—বলে কিনা দখল নিলাম ও-ডিঙি! ডিঙি নে গেলে উপোস দিই মরতি হবে বাবু।
পীতাম্বর গর্জন করে,
—আবাদের ইনি মালিক হে? অ্যাঁ! ও বললেই দিয়ে দোব?
মধুর মাথায় রক্ত চড়ে ওঠে, সে গর্জন করে,
—দিয়ে দে ডিঙি! বলছি, দিয়ে দে পিতে!
পীতাম্বরও রুখিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে,
—দোব না। তুমি কে হে?
পদা আর দুজন বাওয়ালি নৌকোটায় গাব ধরাচ্ছে। মধু একটু এগিয়ে গেছে ইয়াকুবের সঙ্গে। লোকটা অনুনয়-বিনয় করছে,
—ডিঙিটা দেও পিতু ভাই। মুনিবেরে বল—ধান উঠলেই সব দিই দিব।
পীতাম্বর বলে,
—মুনিবের হুকুম ডিঙি ফেরত পাবা নাই।
মধুর সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে ওইসব কথাতে। মানুষের এই অন্যায় লোভ আর লালসাকে সে দেখতে পারে না। মহিমবাবু আর তার দলবল এখানেও সকলকেই ঠকাবার অধিকার নিয়ে জন্মেছে! পিতেও কিনা মেজাজ দেখায়!
মধু হাঁক পাড়ে,
—অ্যাই পিতে, ডিঙি দিয়ে দে। না দিলে ভালো হবে না কিন্তু!
পীতাম্বরও রুখে দাঁড়ায়,
—তুমি কোন তালেবর এলে হে যে, বল্লেই দিতে হবে? বুঝলে মধু চৌধুরী, আমার কাছে মেজাজ দেখিয়ো না; এ তোমার বাপের জমিদারি লয়।
পীতাম্বর ডিঙিটা ধারে এনে লাফ দিয়ে নেমে এগিয়ে আসছে। মধুর দু’চোখ জ্বলে ওঠে। মাথায় রক্ত উঠে যায়,
—পিতে।
পীতাম্বর জবাব দেবার আগেই ওই মধুর বলিষ্ঠ হাতের একটা ঘুষিতে আশমানে উঠে ছিটকে পড়ল পলি-কাদার ওপরে, পরক্ষণেই একটা লাথির চোটে গড়িয়ে পড়ল গাঙের জলে।
মধুও ওর ওপর লাফ দিয়ে এসে পড়েছে। দমাদ্দম ঘুষি চালাচ্ছে, আর ওকে ঠেসে ধরেছে নরম কাদায়, যেন ওকে পুঁতে ফেলবে।
পীতাম্বর এমনি আঘাতের জন্য তৈরি ছিল না। ও আশা করেনি যে, তাকে এইভাবে পেটাবে মধুসূদন। নাক-মুখ ফেটে গেছে, কাদায়-জলে রক্তারক্তি হয়ে গেছে মুখটা।
মধুসূদন নৌকোর খোঁটা তুলে গর্জাচ্ছে,
—শেষ করে দোব তোকে। যতবড়ো মুখ নয় ততবড়ো কথা! দেখি তোর মহিমবাবু কি করতে পারে?
পদা ও আরও কারা এসে ধরে ফেলে ওকে,
—কী করছ গুরু! মেরে ফেলবে নাকি পিতেকে?
পিতে ততক্ষণে কাদা জল থেকে উঠে এসেছে। ভয়ে পালাচ্ছে সে। জানে, মধুর অসাধ্য কাজ নেই।
মধুকে ওরা ধরে ফেলেছে। মধু গর্জায়,
—কই, নিয়ে যা ডিঙি। মগের মুলুক পেয়েছিস যে, যা ইচ্ছে তাই করবি? যাও মিঞা, ডিঙি নিয়ে যাও। পিতে ফের যদি কোনো কথা বলেছে—আমাকে খপর দেবা। পিতে, তোর বাপ, সেই পেসিডেন মহিম ঘোষালকে ডেকে আন। পালাচ্ছিস কেন?
পিতে মারধোর খেয়ে রক্তারক্তি অবস্থাতেই দৌড়োচ্ছে। লোকজন জুটে গেছে গাঙের ধারে! ওরাও জানে মধুকে, পিতের মতো শয়তানকে মারতে দেখে ওরা কেউ এগিয়ে আসেনি।
নিরাপদ দূরত্বে বাঁধের মাথায় উঠে এসে পিতে জানায়,
—দেখাব তোমাকে!
—যাঃ—যাঃ—মধু গজাচ্ছে।
পিতে রাগে-অপমানে জ্বলছে। ডিঙিটাও বেহাত হয়ে গেল। মহিম ঘোষালের লোক সে। পীতাম্বরও আইন-কানুন জানে। তাই থানার দিকেই চলেছে। একটা বিহিত সে করবেই।
.
ভুবনবাবু মোটামুটি জায়গাটাকে দেখেছেন। হাটবারের জনসমাগমও দেখেছেন। ওইদিনই একটু সাবধানে থাকতে হয়। গোলমাল হতে পারে। অন্য সময় বিশেষ ঝামেলা নেই। তবু দু-চারটে ডাকাতি-রাহাজানির ঘটনা ঘটে আশপাশে।
ভুবনবাবু এখানকার মানুষগুলোকেও দেখেছেন। কিন্তু সেই মধুসূদনের দেখা মেলেনি। ওকে চিনতেও পারেননি। এর মধ্যেই কয়েকটা অভিযোগের কথা কানে এসেছে। সেই রাতের গোলমালের কথাও শুনেছেন।
মদ গিলে দলবল সমেত কোন মন্দিরের বাইরে হল্লা করছিল, পূজারি বামুন কী বলতে গেছে আর তাকেই ধরে নামাবলি কেড়ে নিয়ে মদ গেলাবার চেষ্টা করেছিল। পূজারি বামুনও থানায় এসে খবরটা জানিয়ে যায়। অবশ্য ভুবনবাবু তাকে কিছু বলার আগে ডাক্তারবাবুই পূজারি বামুন ঠাকুরকে বলে-কয়ে ব্যাপারটার মীমাংসা করে দিয়েছিলেন, তবু মধুর সম্বন্ধে ভুবনবাবুর মনে একটা প্রশ্ন ছিল।
মনে হয় ওই একটি মানুষ, যে এই এলাকার সব কিছু শাসন আর প্রাধান্যকে ইচ্ছে করে আঘাত করে চলেছে। কোথায় ওর একটা অফুরান জ্বালা রয়ে গেছে।
মহিমবাবুও এসেছে থানায়। এখানে ওকে প্রায়ই আসতে হয়! ভাব-সাবটা একটু জমিয়ে রাখতে চায় মহিমবাবু। কারণ, রাতের অন্ধকারের কারবার তার চালু রাখতেই হবে।
ভুবনবাবুকে এর আগেই জানিয়েছে দু’একবার,
—মধুর কথাই আলাদা ভুবনবাবু। এত নামকরা ঘরের ছেলে এমনি হবে জানতাম না। লেখাপড়াও শিখল না। এখানের বিষয়-আশয় দেখল না, মদ গিলে স্ফুর্তি করে সব উড়িয়ে দিল। রাগ আমার ওপর, আমিই নাকি ওকে ঠকিয়েছি। ওকে ভেড়ির কাজ দিলাম, তা মশায় কাজ করবে কী, দিল একদিন ওভারসিয়ারকে ঠেঙিয়ে। কোন সার্ভেয়ার কী বলেছিল তাকেও মেরে বসল। ওসব থানার রেকর্ডে আছে।
ভুবনবাবু ওর কথাগুলো শুনে চলেছেন। যেন তিনি একটি জীব দেখেছেন।
নিমাই জমাদারও বলে,
—কাজের বেলায় নেই, অথচ মধুর দাপট দেখুন গে, যেন রাজার ছেলে। দ্যান স্যার, একটা কেসে বেশ কায়দা করে বেঁধে বছরখানেকের জন্য শ্রীঘর ঘুরিয়ে তবে ঠাণ্ডা হবে।
ভুবনবাবু হাসছেন। মহিম ঘোষাল বলে,
—আপনা থেকেই যাবে একদিন।
ভুবনবাবু কথাগুলো ভাবছেন থানায় বসে।
হঠাৎ রক্তারক্তি অবস্থায় পীতাম্বর ঢুকেছে থানায়। পেছনে ছেলেপুলে, দু-চারজন কৌতূহলী লোকও রয়েছে। পীতাম্বর কিছু বলার আগেই হাউমাউ করে পড়ল মহিমবাবু আর ভুবনবাবুর পায়ের কাছে। ধূর্ত লোকটা জানে কীভাবে অভিনয় করতে হয়। তাই নিজের সব দোষ চেপে বলে,
—মধু আমাকে খুন করে ফেলত স্যার! বলে কিনা মহিমবাবুর লোক তুই, তোর জান খেয়ে ফেলব। খামোখাই ঘাটের ধারে কাদায় ফেলে মারতে লাগল স্যার। খুন করেই ফেলত, গাঙে পড়ে বেঁচে এসেছি। ওর হাত থেকে বাঁচান স্যার!
মহিমবাবুও রেগে উঠেছে। নিমাই জমাদার যেন এমনি একটা মৌকা খুঁজছিল। খুনের দায়ে এবার মধুকে জড়ানো যাবে।
ভুবনবাবু জ্বলে উঠেছেন মধুসূদন এখানকার মূর্তিমান আতঙ্ক আর দুঃস্বপ্ন তাকে কঠিন আঘাতই করবেন তিনি। মধু যেন বারবার তাঁর আসার পর থেকেই বেশি মাত্রায় গোলমাল শুরু করেছে।
তাই শুধোন ভুবনবাবু—কোথায় আছে সেই জানোয়ারটা?
পীতাম্বর জানায়,—হাটের ওদিকে গাঙের ধারে। ভুবনবাবু বলেন—নিমাই, ওই মধুকে ডেকে আনো।
পীতাম্বর জানে চিজটিকে, আবার পুলিশ নিয়ে গেলে মধু হয়তো তাকে এইবার খুন করেই ফেলবে। তাই বলে সে,
—একটু ডাক্তারখানায় যেতুম। স্যার। ঘাগুলো জ্বলছে। দ্যাখেন কেমন করে মেরেছে! —ঠিক আছে। ছোটোবাবু, একটা ডায়েরি লিখিয়ে নিন ওর থেকে
নিমাই জমাদার নিজের এলেম দেখাবার জন্যই বলে,
—মধুকে অ্যাদ্দিন কেউ টাইট করেনি স্যার, তাই বেড়ে উঠেছে। ওটা ডাকাত—খুনে। ভুবনবাবু হুকুম দেন,
—ওটাকে ডেকে আনো। ভালো কথায় না এলে জোর করে নিয়ে আসবে।
নিমাইও এমনি হুকুম চাইছিল। সে-ও দেখাবে সকলকে তার দাপট। তাই খুশি হয়ে সে শীর্ণ দেহখানা নিয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল,
—ঠিক আছে। এখুনিই এনে হাজির করছি ওটাকে।
নিমাই তড়তড়িয়ে বের হয়ে আসে থানা থাকে। মহিমবাবুও পিছন পিছন এসে নিমাই-এর হাতে একটা নোট গুঁজে দিতে, নিমাই পরিমাণটা একবার দেখে দ্বিগুণ বেগে বের হয়ে গেল।
মধু গুম হয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে তার মাথাটা কেমন গরম হয়ে ওঠে। মানুষের মনের লোভ আর জুলুমটাকে সইতে পারে না সে। তাই পিতেকেই এন্তার পিটিয়েছে। মনে হয় অন্যায় সে কিছুই করেনি। নাহলে গরিব ইয়াকুবের ডিঙিটাই ওরা কেড়ে নিত। দু-চার ঢোক মদ পেটে পড়তে আবার সহজ হয়ে আসে সে। মধু আবার কাজে মন দেয়—কই রে, হাত চালা বাবা।
ডিঙিগুলোয় আবার আলকাতরা পাট মাখানো হচ্ছে। এতক্ষণ তারাও ওই দৃশ্যটা দেখছিল। ওদের ভালোই লাগে মধুর এই কাজগুলো।
এমন সময় নিমাইকে আসতে দেখে মধু ফিরে তাকাল। নিমাই এসে একেবারে মিলিটারি মেজাজে বলে,
—চল! এখুনি থানায় চল। বড়োবাবুর হুকুম।
মধুর মেজাজটা খিঁচড়ে যায়। ওর দিকে তাকাল সে। জবাব দেয়,
—বড়োবাবুকে বলগে, এখন যেতে পারব না। কাজ করছি। কাজ শেষ হলে যাব।
নিমাই কোন জবাব না দিয়ে লাফিয়ে এসে ওর হাতটাই ধরে হুকুম করে,
—না গেলে তোমায় অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাব।
মধুর সারা মনে আগুন জ্বলে ওঠে। ডাকাতি করছিল ওই পীতাম্বরই। বাধা দিয়েছে সে। তবু থানায় যেতে মধুর আপত্তি নেই। একথাটা স্পষ্ট করে জানাবার সাহস তার আছে। কিন্তু নিমাইকে এভাবে তার গায়ে হাত দিতে মধু গর্জে ওঠে,
—হাত ছাড়! হাত ছাড় বলছি!
নিমাই ছাড়বার পাত্র নয়। মহিমবাবুর লোককে সে মেরেছে, সুতরাং সে অপরাধীই। তাই জানায় নিমাই,
—তোমাকে ধরে নিয়ে যাব।
মধুর এত রাগেও হাসি আসে। নিমাইয়ের সিড়িঙ্গে দেহটা দাপাচ্ছে, সে চিৎকার করে জানায়,
—হুকুম আছে, ভালো কথায় না গেলে ধরে নিয়ে যেতে হবে হাতকড়ি পরিয়ে। হঠাৎ কোনদিকে কী হয়ে গেল টের পায় না সে। মরাভাটির পলিকাদার ওপর ছ’হাত দূরে ছিটকে পড়েছে নিমাইয়ের শীর্ণ শরীর। পুরু পলিতে পড়ে ওলট-পালট খেয়ে সর্বাঙ্গ কাদায় ঢেকে গেছে, আর চেনা যায় না তাকে। মধু তার হাতখানা ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে মাত্র। ওই ওই কাদামাখা মূর্তি দেখে মাঝি-বাওয়ালির দল হাসছে, মধুও হো-হো করে হাসতে থাকে। রাগেনি, মজাটা দেখে সে-ও হাসছে বিকট শব্দে।
নিমাই উঠে দাঁড়িয়েছে কার সাহায্যে। তড়পাচ্ছে সে,
—দেখে নোব এইবার। দরকার হলে রাইফেল নিয়ে আসব।
—তাই আনো গে। বললাম তো, তোমার দারোগাবাবুকে বলো কাজ করছি। কাজ শেষ হলেই যাব।
—অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাব লোকজন এনে।
ওকে শাসিয়ে লাফাতে লাফাতে চলেছে নিমাই।
মধু বলে—তোর বড়োবাবুকে বলিস–যাব সময়মতো। ডাকতে যেন না পাঠায়। মধু লুকিয়ে থাকে না, সে বাপের ব্যাটা।
নিমাই তখনও গজরাচ্ছে। ওর পেছনে জুটেছে কিল্লি-বিল্লি ছেলের দল। ওরাও হাসছে তার বিচিত্র কাদামাখা মূর্তির দিকে তাকিয়ে। নিমাই রাগে জ্বলে উঠে থানার দিকে ফিরে চলেছে ফুঁসতে ফুঁসতে। দূর থেকে নিমাই গজরাচ্ছে—শয়তান—ডাকাত—শুয়োরের বাচ্চা!
ভুবনবাবুর সব ব্যাপারটা শোনেন। তিনিও মধুসূদনের এই কাজটাকে সমর্থন করেননি। এই তাঁর এলাকায় প্রথম কেস নিয়ে নাড়াচাড়া করা। এর ওপরই তাঁর সুনাম নির্ভর করছে। তবু সহজ হবার চেষ্টা করেন তিনি। এ সময় উত্তেজিত হলে চলবে না। ভেবে-চিন্তে পথ একটা বের করতে হবে।
হঠাৎ দেখা যায় থানার ফটক দিয়ে সেইদিনের দেখা সেই নৌকোর পাশে দাঁড়ানো চিজটি এগিয়ে আসছে। আজ ওর পরনে একটা লাটপাট ভাঙা ফুলপ্যান্ট; তার ইস্ত্রির বালাই নেই, একটা শার্ট পরেছে, বোতাম নেই। গেঞ্জি নেই ভেতরে। শার্টটা তার বিশাল দেহের ওপর লটপট করে ঝুলছে।
লোকটা ঠিক সোজা হয়ে চলতে পারে না। দেখেই মনে হয় নেশা করেছে। কোনো রকমে টাল সামলে দাওয়ায় উঠে এসে দারোগাবাবুর সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে বলে,
—নমস্কার স্যার! চিনতে পারছেন? সেই যে দেখা হয়েছিল ঘাটের ধারে! ভুবনবাবু রাগটা চেপে বলেন—এখানে কেন এসেছেন? এই অবস্থায়?
সামনের সিগ্রেটের বাক্স থেকে একটা সিগ্রেট তুলে নিয়ে ধরিয়ে একটা টান দিয়ে মধু বলে,
—একটা নালিশ আছে স্যার! কনস্টেবল পাঠাবেন, ওরা গিয়ে যা-তা বলে তড়পাবে কেন স্যার? হ্যাঁ, নেশা-টেশা করি, বাইরের দোষ আছে সত্যি, তাই বলে ওই ব্যাটা পীতাম্বর মশাই হাড়-বজ্জাত। গরিব লোকটার ডিঙি এমনিতেই কেড়ে নেবে হুমকি দিয়ে? বড়োলোকের চাকর- হয়ে যেন মস্তান হয়ে গেছে। তাতেই একটু ঠ্যাঙানি দিয়েছি তাকে। তা অমনি আপনার কনস্টেবল খিস্তি শুরু করবে স্যার? ভালো কথায় বলতে পারে না যা বলার? এইসব সইতে পারি না মাইরি!
ভুবনবাবু ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রশ্ন করেন,—তুমিই সেই মধুসূদন চৌধুরী? ভুবনবাবুর মুখ-চোখ কঠিন হয়ে ওঠে। রাগটাকে চাপবার চেষ্টা করেন তিনি। মধু চেয়ারে বসে সিগ্রেট টানতে টানতে বলে ওঠে,
—কারেক্ট। ঠিক ধরেছেন স্যার। আমার নাম শ্রীমধুসূদন রায়চৌধুরী।
আমেজ করে সিগ্রেট টানে আর পা নাচায় সে।
ওর চোখের পাতাগুলো যেন বুজে আসছে নেশার ঘোরে। তবু একবার পিট পিট করে তাকাবার চেষ্টা করে বলে,
এককালে এ চাকলার জমিদার ছিলাম মশাই আমরা। আর ওই মহিম ঘোষাল ছিল নায়েব আর দ্যাট পীতু—পীতাম্বর ছিল পাইক। আরও দুটো লাট ছিল এর সঙ্গে। আজ সব গেছে। তা যাক—তাই বলে বাপ-মা তুলে গাল দিলে যে প্রাণে লাগে স্যার! আমি না হয় শুয়োর; শুয়োরেরও অধম। কিন্তু আমার পিতৃপুরুষ ওসব তো ছিলেন না স্যার! তাঁরা ছিলেন লর্ড। সদাশয় ব্যক্তি।
ভুবনবাবু ওকে দেখছেন। মধুর মনের অতলে অপরাধবোধ আর তার জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখ, ভয়ও নেই। ভুবনবাবু ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
থানার আশপাশেও লোকজন জুটে গেছে। কনস্টেবল, কর্মচারীরাও দেখছে তাঁদের। ভুবনবাবুর মনে হয় এটা তাঁর এখানকার প্রথম কেস, এটার ফয়সালা করতেই হবে। এর ওপরই তাঁর ভবিষ্যৎ সুনাম এবং জনপ্রিয়তা নির্ভর করছে।
মধুসূদনের কথায় ধমকে ওঠেন ভুবনবাবু,
—আর সেই লর্ডদের বংশধর হয়ে তুমিও ভেবেছ যা ইচ্ছে তাই করবে? লোকজনের মাথা ফাটাবে, একে-ওকে মারবে সম্ভ্রমহানি করবে? মদ খেয়ে হল্লা করবে?
মধু ওঁর দিকে তাকাল,
—কি বলছেন স্যার? অল ফলস! নেশা-টেশা করি, তবে অন্যায় সইতে পারি না। আপনারাও সেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন তাহলে?
—শাট আপ! ভুবনবাবু গর্জে ওঠেন।
মধু হাসছে,
—যাঃ বাব্বা! বল্লাম তো, সত্যি কথা বলা পাপ। চুরি না করা মহাপাপ। আর অন্যায় সমর্থন না করা গুরুতর পাপ। ওসব পারলাম না তাই ফেকলু মহম্মদ দি গ্রেট হয়েই রইলাম।
ভুবনবাবু ওর কথায় রেগে উঠেছেন। মনে হয় লোকটা শুধু বদমায়েশ আর গুণ্ডাই নয়, শয়তানও। নিজের গুণ্ডামিকে আদর্শ দিয়ে ঢাকবার ফন্দিও জানে।
ভুবনবাবু ওকে শায়েস্তা করতে চান। আর সেটা করবেন এদের সকলেরই সামনে। তাই বলেন তিনি,
—তোমাকে ধরে চাবকানো উচিত।
মধু চোখ বুজেই বলে,
—ব্যস! ক্লিয়ার! তাহলে আগে ওই লোভী পীতাম্বর, রাঘববোয়াল মহিম ঘোষাল, সরকারি ওভারসিয়ার, ওই নিমে জমাদার ওদেরও চাবকান স্যার। তালে আম্মোও চাবুক কেন, জুতো খেতে রাজি আছি।
ভুবনবাবু দপ করে জ্বলে ওঠেন,
—জানো, আমার নাম ভুবন দারোগা। তোমার মতো জানোয়ারকে কী করে ঠাণ্ডা করতে হয় তা জানি! চাবকে ছাল তুলে দেব।
মধুর মুখ-চোখ কঠিন হয়ে ওঠে। উঠে দাঁড়ায় সে। ওর নেশাও বোধহয় ছুটে গেছে। স্থিরদৃষ্টিতে সে ভুবনবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর কাছে সব ভীরুতা আর ভণ্ডামির মুখোশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। মধু যেন আজ ওই ভুবন দারোগার প্রকৃত স্বরূপ জেনেছে। অন্য কারও থেকে স্বতন্ত্র তো নয়ই।
এখানে বিচার সে পাবে না। তাই সে-ও কঠিন হয়ে উঠেছে। সোজা এগিয়ে গিয়ে ঢোলা জামাটা ফস করে খুলে পিঠ বের করে দিয়ে বলে সে,
—তাহলে চাবকান মশাই। যত খুশি চাবকান। ওইসব ধানাই-পানাই গাইবেন না। আপনি ভুবনবাবু, আমি অমন ত্রিভুবন ঢের দেখেছি। শাসাবেন না, যা করতে হয় করে ফেলুন! কুইক!
ভুবনবাবুর মাথায় যেন রক্ত উঠে আসে। সামনেই পড়েছিল ঘোড়ার চাবুক একটা। ওইটাই তুলে নেন। মধুসূদনের মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। তার ওই বিশাল বলিষ্ঠ পেশীবহুল দেহটা ফুলে উঠেছে। ও যেন ভুবনবাবুর সব কাঠিন্যকে আজ চ্যালেঞ্জ করেছে থানার সব লোকদের সামনে।
ভুবনবাবু নিজে ওর সেই অনাবৃত মাংসল পিঠের ওপর সজোরে সেই চাবুক নিয়ে হাঁকাচ্ছেন তীক্ষ্ণ শব্দ করে চাবুকটা ওর পিঠে চেপে বসেছে।
মধুসূদনের পিঠের চামড়াটা কেটে রক্ত ঝরছে। বিন্দু বিন্দু রক্ত। ভুবনবাবু গোটাকয়েক চাবুক বসিয়ে নিজেই কেমন বিশ্রী বোধ করেন। লোকটার মুখ থেকে বিন্দুমাত্র যন্ত্রণার শব্দ ওঠে না। ভুবনবাবু চাবুকটা ফেলে দিয়ে চুপ করে দাঁড়ালেন।
উত্তেজনায় কাঁপছে তাঁর সারা দেহ, উত্তেজনার বশে তাঁর মতো লোকও এমনি একটা গর্হিত কাজ করে ফেলেছে। চারিদিকে থমথমে নীরবতা আর আতঙ্ক। ওরা সবাই চুপ করে গেছে এই কাণ্ড দেখে।
ভুবনবাবুর মতো লোকও দরকার হলে এত কঠিন হতে পারেন, তা দেখছে ওরা। মধুর গায়ে হাত তোলার সাহসও তাঁর আছে।
চাবুকটা থেমে যেতে মধু অবাক হয়। বেদনা-যন্ত্রণাটা সহ্য করছিল মুখ টিপে। এইবার সামনে ঘুরে দাঁড়াল,
—ব্যস! এই মাত্র! মধুসূদন ব্যঙ্গভাবে কথাগুলো বলে ওঁর দিকে তাকাল। ওর দুচোখে হাসির মধ্যে কী নিষ্ঠুর একটা প্রতিশোধের জ্বালা প্রকট হয়ে উঠেছে। জামাটা গলিয়ে সে বুকটান করে দাঁড়াল। শুধোয় ভুবনবাবুকে,
—আর কিছু বলবেন?
ভুবনবাবু চুপ করে থাকেন।
মধুসূদন বলে—চল্লাম! তবে বিচারটা ঠিক করলেন না। মনে থাকবে।
ভুবনবাবু ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
ছেলেটা বলিষ্ঠ পদক্ষেপে থানার এত লোকের সামনে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বের হয়ে গেল। ও যেন জানিয়ে গেল ওর ওই চাহনি আর ওই যাবার দৃপ্ত ভঙ্গিতে এই অত্যাচার সে নীরবে মাথা নিচু করে সইবে না।
ভুবনবাবু বাসার দিকে চলে গেলেন। নিজেকে কেমন ক্লান্ত বোধহয়
মধুসূদন এখানে ঠিক এই ব্যবহার পাবে আশা করেনি। তাই ভুবন দারোগাকে চাবুক হাঁকড়াতে দেখে প্রথম চমকে উঠেছিল। যতবার চাবুকের-ঘা পিঠে পড়েছে, জ্বলে উঠেছে সেই আঘাতে সারা দেহ-মন, ততই কঠিন হয়ে উঠেছে মধুসূদন। এই কাঠিন্য তার সহজাত। যতবারই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেছে, ততবারই ওরা তাকে নানাভাবে শাস্তি দিয়েছে। মধুসূদনের পিঠের কয়েক জায়গায় কেটে গেছে, জামাটায় রক্তের দাগ। সে মাথা উঁচু করে থানা থেকে বের হয়ে চলেছে। মনে তার তীব্র-জ্বালা। পিঠটা টনটন করছে। কী ভেবে মধুসূদন ডাক্তারখানার দিকেই এগিয়ে গেল। একটু ওষুধ লাগাতে পারলে বোধহয় ব্যথাটা কমবে। তা সহচর পদাকে বলে,
—একটু মাল ঢেলে দে পিঠে।
পদা চমকে ওঠে—সেকি গুরু, ডাক্তারখানায় চল।
—ধ্যাৎ! মধু প্রতিবাদ করে। তবু পদা আর অন্যতম চেলা মতিলাল মধুকে ধরে নিয়ে যায় ডাক্তারের কাছে।
.