অবাঞ্ছিত উইল – ৬

চৌধুরী সাহেব মারা যাওয়ার তিনমাস পর ব্যারিস্টার মোস্তাক একদিন ইয়াসিন সাহেবের বাসায় এলেন। ইয়াসিন সাহেব যখন ঢাকায় জায়গা কিনেছিলেন তখন ঐ জায়গার অংশিদাররা মামলা করেছিল। সেই সময় ব্যারিস্টার মোস্তাক ইয়াসিন সাহেবের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছিলেন। তখন তিনি জানতে পারেন, ইয়াসিন সাহেব মেহেরপুরের চৌধুরী বংশের ছেলে। তারপর উভয়ে উভয়ের পরিচয় পেয়ে কাছাকাছি এসে যান। ইয়াসিন সাহেব বাসাতে ছিলেন। সালাম ও কুশলাদি বিনিময়ের পর আপ্যায়ণের সময় ব্যারিস্টার মোস্তাক বললেন, আপনার মেয়েকে ডাকুন দরকার আছে।

ইয়াসিন সাহেব একটা কাজের মেয়েকে শাকিলাকে ডেকে দিতে বলে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার বলুন তো?

ব্যারিস্টার মোস্তাক বললেন, ব্যাপার কিছু একটা আছে। মেয়ে এলেই বুঝতে পারবেন।

শাকিলা এসে ব্যারিস্টার মোস্তাককে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন চাচা?

ব্যারিস্টার মোস্তাক বললেন, ভালো আছি মা, তুমি বস। তারপর ব্রীফকেস খুলে একটা দলিল বের করে শাকিলার হাতে দিয়ে বললেন, তোমার চাচা, মানে মেহেরপুরের চৌধুরী স্টেটের মালিক মেসবাহ উদ্দিন মারা যাওয়ার প্রায় বছর খানেক আগে আমাকে দিয়ে এই উইল করিয়েছিলেন। তখন বলেছিলেন, ওনার মৃত্যুর পর আমি যেন এটা তোমার কাছে পৌঁছে দিই। আমি ওনার মৃত্যুর খবর পেয়ে মেহেরপুরে গিয়েছিলাম। এই উইলের আর একটা কপি, বর্তমানে চৌধুরী স্টেটের যিনি ম্যানেজার তাকে দিয়ে এসেছি। চৌধুরী সাহেব সেই সময় এই উইলের কথা গোপন রাখতে বলেছিলেন। এগুলো আমানত হিসেবে আমি এতদিন রেখেছিলাম। এখন সেই আমানত তোমাদের হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম।

শাকিলা উইলটা পড়তে শুরু করল–

আমি, মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী, পিতা মরহুম আব্দুল বাসেত চৌধুরি, জিলা মেহেরপুর, নিঃসন্তান হওয়ায় আমার মৃত্যুর পর এই চৌধুরী স্টেটের সমস্ত সম্পত্তি থেকে আমার স্ত্রী নাগিনা বেগম ইসলামিক শরামতে যা পাবে তা বাদে এক তৃতীয় অংশ চৌধুরী মেমোরিয়াল বিদ্যাপীঠের নামে দান করে গেলাম। অবশিষ্ট অংশ, ঢাকায় বসবাসকারী আমার চাচাতো ভাই ইয়াসিনের মেয়ে শাকিলাকে নিম্নলিখিত শর্তে উত্তরাধিকারী করলাম।

(১) আমার স্টেটের ম্যানেজার কুষ্টিয়া নিবাসী রেদওয়ান আহম্মদের পুত্র শাকিল আহম্মদকে বিয়ে করবে এবং সেই বিয়ে এক বছর টিকে থাকতে হবে।

(২) যদি শাকিলা শাকিলকে বিয়ে না করে অথবা বিয়ে করলেও তা এক বছর না। টিকে, তা হলে শাকিলা এই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারবে না। তখন স্টেটের ম্যানেজার শাকিল আহম্মদ এই সম্পত্তির অর্ধেক পাবে, আর বাকি অর্ধেক তারই তত্ত্বাবধানে থাকবে। ঐ অর্ধেক সম্পত্তির আয় সে জনগনের কল্যাণের জন্য ব্যয় করবে। এ ব্যাপারে তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হল।

এই উইল আমি সুস্থ অবস্থায় অনেক চিন্তা ভাবনা করে ব্যারিস্টার মোস্তাককে দিয়ে করালাম। কারো ভয় ভীতি বা প্ররোচনায় করিনি। আমার মৃত্যুর পর কেউ যদি

এই সম্পত্তি দাবী করে, তা আইনগতঃ বাতিল বলে গণ্য হবে।

মেহবাহ উদ্দিন চৌধুরী,
মেহেরপুর
তারিখ………

উইলটা পড়া শেষ করে শাকিলা খুব অবাক হয়ে বাবার হাতে দিল।

চাচাতো ভাই মেসবাহ উদ্দিনের মৃত্যু সংবাদ নায়েবের পত্রে ইয়াসিন সাহেব জেনেছিলেন। এখন উইল পড়ে চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না। চোখ মুছে ব্যারিস্টার মোস্তাককে বিদায় দিয়ে উইলটা আর একবার পড়লেন। তারপর মেয়ের হাতে ফেরত দেওয়ার সময় বললেন, আল্লাহপাকের কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য। যিনি আমাকে দাদার কোলে এতিম করে যে সম্পত্তি থেকে নামাহরুম করলেন, আবার তিনিই সেই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী আমার মেয়েকে করার ব্যবস্থা করলেন। বন্ধুর ছেলের সঙ্গে শাকিলার বিয়ের কথা উইলে শর্ত আছে জেনে খুশী হয়েছেন। বললেন, তোর চাচা ঠিক রত্নই চিনেছিল। শাকিল যদি তার বাবার চরিত্রের শত অংশের এক অংশ পায়, তা হলে তোর জীবন ধন্য হয়ে যাবে। আল্লাহ তোর তকদ্বীরে এই সব লিখে রেখেছেন বলে তোর বিয়ে ভেঙে গেল।

শাকিলা উইলে শাকিলের নাম ধাম জেনে সন্দেহের দোলায় দুলতে লাগল। ভাবল, স্টেডিয়ামে যার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তার নামও শাকিল এবং তার বাড়িও

কুষ্টিয়ায়। যদি সে হয়, তা হলে সেই চরিত্রহীন লম্পটকে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। আর যদি তা না হয়, তা হলে যে ছেলের কথা বাবা বলল, তাতে ভালই হবে। বাবাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তুমি তো বলেছিলে তোমার বন্ধুর ছেলে স্কুলে মাস্টারী করে।

ইয়াসিন সাহেব বললেন, তখন হয়তো করত। এখন মেহেরপুর স্টেটের ম্যানেজারি করছে।

তুমি কি উইলের ব্যাপারে কিছু ভাবছ?

আমি কি ভাববো? যা কিছু তোকে ভাবতে হবে।

আমি একবার মেহেরপুর যাব।

বেশ তো যা। কবে যাবি আমাকে বলিস, আমি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।

বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর শাকিলা এম.এ. পড়ছে। বলল, কয়েক দিনের মধ্যে ভার্সিটি বন্ধ হবে, সেই সময় যাব।

ইয়াসিন সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাই যাস।

শাকিলা বাবাকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে দেখে বললেন, তুমি যেন কিছু চিন্তা করছ?

কি আর চিন্তা করব মা, তোর চাচা খুব বুদ্ধিমান লোক ছিল। তাই খুব বুদ্ধি করে আমার বন্ধুর ছেলেকে ম্যানেজার করেছে এবং তোকে তার সঙ্গে বিয়ে দেবে বলে এই উইল করে গেছে। ছেলেটাকে আমি একবার মাত্র দেখেছি এবং তার সঙ্গে দু একটা কথাও বলেছি। তাতেই বুঝেছি, উপযুক্ত বাপের উপযুক্ত ছেলে। এ যুগে এরকম ছেলে হয় না।

বাবা তুমি যে তোমার বন্ধু ও তার ছেলের এত গুনগান করছ, কিন্তু আজও আমার সেই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার দিন ছাড়া আগে তো তাদের কথা কখনো তোমার মুখে উচ্চারণ করতে শুনিনি।  

বন্ধুর কথা মুখে উচ্চারণ করিনি ঠিক; কিন্তু মনে মনে তার কথা অনেক ভাবি। সে আমার বিপদের সময় যে উপকার করেছিল, ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারব না তুই তো সব কথা জানিস না। যেদিন চৌধুরী বাড়ি থেকে তোর দাদিকে নিয়ে চলে আসি, সেদিন ঐ বন্ধু তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল। তারপর সেখানে বাড়ি ঘর ও জায়গা জমি করার পিছনে তার দান কোনদিন ভুলতে পারব না। সেই সব দিনের কথা মনে হলে, মনের মধ্যে যে কি হয় তা আল্লাহপাক জানেন।

উনি যদি তোমার এতবড় বন্ধু, তা হলে এতদিন যোগাযোগ রাখনি কেন?

ইয়াসিন সাহেব আবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, একটা খুব বেদনাদায়ক ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের দুজনের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আর সেই বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছে আমারই জন্য। তার কোন দোষ নেই। সে কোন দিন কোন দোষ করতে পারে না। এর বেশি কিছু তোকে বলতে পারব না। তুই আর কোন প্রশ্ন করিস না।

বাবার কথাগুলো শাকিলার কানে কান্নার মতো শোনাল। বলল, ঠিক আছে বাবা, আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না।

.

ব্যারিস্টার মোস্তাক মেহেরপুরে গিয়ে চৌধুরী বাড়ীর কাঁচারিতে যখন উইলটা সকলের সামনে পড়ে শুনিয়ে শাকিলের হাতে দিলেন তখন সবাই অবাক হয়ে গেল।

চৌধুরী সাহেব তাকে এত আপন করে নিয়েছিলেন ভেবে শাকিলের চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। মনে মনে আল্লাহপাকের কাছে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করতে করতে ব্যারিস্টার সাহেবকে আপ্যায়ণ করিয়ে বিদায় দিল। তারপর উইলটা নিয়ে বেগম সাহেবের কাছে গিয়ে ওনাকে দেয়ার সময় বলল, এটা আপনি রেখে দিন।

নাগিনা বেগম উইল পড়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, এটা তো তোমার জিনিস, আমাকে দিচ্ছ কেন?

আমার হলেও চৌধুরী বাড়ির ইজ্জত এটার উপর নির্ভর করছে। আমি সামান্য স্কুল মাস্টারের ছেলে। আমি কি চৌধুরী বাড়ির ইজ্জত বাঁচাতে পারব?

উনি যে দায়িত্ব তোমার ঘাড়ে দিয়ে গেছেন। এখন তোমাকেই সেই সব দায়িত্ব পালন করতে হবে। তা না হলে ওনার মতো আমিও শান্তি পাব না।

শাকিল নাগিনা বেগমকে কদমবুসি করে বলল, ঠিক আছে, আমি আপনার কথা মেনে নিলাম। দোয়া করুন, আল্লাহপাক যেন আমাকে সব দায়িত্ব পালন করার শক্তি দেন। আর উইলটা ছেলে হয়ে আম্মার কাছে গচ্ছিত রাখলাম।

নাগিনা বেগম দোয়া করে বললেন, বেশ তাই থাক।

শাকিল নাগিনা বেগমের কাছ থেকে নিজের রুমে এসে চিন্তা করতে লাগল, শাকিলা উইলে বিয়ের শর্তের কথা জেনে কি করবে? আমাকে চরিত্রহীন জেনে নিশ্চয় বিয়ে করতে রাজি হবে না। কিন্তু বিয়ে না করলে তো সে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। শেষে ভেবে ঠিক করল, যদি একান্ত সে বিয়ে করতে রাজি না হয়, তা হলে যা করার আমাকেই করতে হবে।

.

ভাসির্টি বন্ধ পড়লে শাকিলা একদিন বাবাকে বলল, আমি মেহেরপুর যাব।

ইয়াসিন সাহেব বললেন, নায়েবকে চিঠি দিয়ে আনাই। তারপরে তার সঙ্গে যাবি।

না, তাদের কাউকে জানাবার দরকার নেই। আমি গাড়ি নিয়ে ড্রাইভারের সাথে একা যাব।

তা কি করে হয়? এত দূরের রাস্তা, তা ছাড়া তোকে সেখানকার কেউ চেনে না।

না চিনুক, তবু কাউকে জানাবার দরকার নেই।

ইয়াসিন সাহেব একমাত্র মেয়ের জিদ জানেন। বললেন, তুই যখন আমার কথা শুনবি না তখন যা বুঝিস কর।

পরের দিন শাকিলা ড্রাইভারকে নিয়ে গাড়ি করে মেহেরপুরের কাঁচারি বাড়িতে এসে যখন পৌঁছাল তখন বিকেল পাঁচটা।

দারোয়ানের মুখে খবর পেয়ে নায়েব বেরিয়ে এসে অভ্যর্থনা করে কাঁচারি বাড়িতে এনে বসাল। তারপর বেগম সাহেবার কাছে খবর পাঠাল।

নাগিনা বেগম একজন কাজের মেয়েকে পাঠিয়ে শাকিলাকে নিয়ে এলেন। আর নায়েবকে বলে পাঠালেন, ড্রাইভারের থাকার ব্যবস্থা করতে।

শাকিলা নাগিনা বেগমকে কখনো দেখে নি। তাই চিনতে না পারলেও অনুমানের উপর নির্ভর করে প্রথমে কমবুসি করল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন চাচিআম্মা?

নাগিনা বেগম তার মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আল্লাহ যে অবস্থায় রেখেছেন, সেই অবস্থায় আছি। তোমার চাচা বেঁচে থাকতে যদি আসতে মা, তা হলে তিনি কত খুশী হতেন। তারপর চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আব্বা আম্মা ভাল আছেন?

জি ভাল আছেন।

নাগিনা বেগম তাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে এস, নাস্তা করবে।

শাকিলা আসার তিন চার দিন আগে শাকিল এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি এসেছে। আসার পরের দিন আব্বা আম্মাকে উইলের কথা জানাল।

রেদওয়ান শুনে কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আল্লাহ পাকের কাজ মানুষের বোঝা অসাধ্য।

উইলের কথা শুনে সুরাইয়া খাতুনের ইয়াসিনের প্রতি প্রতিহিংসার আগুণ জ্বলে উঠল। স্বামীকে বললেন, ইয়াসিনের মেয়ের সঙ্গে শাকিলের বিয়ে আমি কিছুতেই হতে দেব না। তুমি তাড়াতাড়ি মেয়ে দেখ। আমি ওর বিয়ে দেব। কতদিন থেকে তোমাকে মেয়ে দেখতে বলছি, তুমি কোন গা করছ না।

শাকিল মাকে রেগে যেতে দেখেও বিয়ের কথা শুনে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে এল।

ফৌজিয়া খাতুন বৌয়ের বড় গলার আওয়াজ পেয়ে সেখানে এসে বললেন, কি হয়েছে বৌমা? এত জোরে কথা বলছ কেন? তোমাকে না কতদিন বলেছি, মেয়েদের বড় গলায় কথা বলতে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) নিষেধ করেছেন?

সুরাইয়া খাতুন লজ্জা পেয়ে বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে আম্মা, আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। আসুন, খাটে আপনার ছেলের কাছে বসুন।  

ফৌজিয়া খাতুন ছেলের পাশে এসে বসলেন, তুই আবার বৌমাকে কি বললি যে, সে রেগে গেল।

রেদওয়ান বললেন, আমি কিছু বলিনি। তারপর উইলের কথা শুনিয়ে বললেন, এই জন্যে তোমার বৌমা রেগে গেছে।

ফৌজিয়া খাতুন বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বৌকে বললেন, তুমি শিক্ষিত মেয়ে। তোমার পেটে আল্লাহ’র এলেমও আছে। তুমি কি জান না, আপরাধীকে ক্ষমা করা মহৎ কাজ, আর যে অনুতপ্ত অপরাধীকে ক্ষমা করে, তাকে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) ভালবাসেন। আগেকার সব কিছু ভুলে এখন কি করা যায়, সে কথা চিন্তা কর। যদি তুমি ইয়াসিনের মেয়েকে বৌ করতে না চাও, তা হলে সবাই বলবে, চৌধুরী স্টেটের সম্পত্তির লোভে আমরা তা করছি না।

শাশুড়ীর কথা শুনে সুরাইয়া খাতুন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। বললেন, আমার অন্যায় হয়েছে আম্মা। কিন্তু আমরা ছেলের পক্ষ হয়ে আগে বেড়ে কিছু করতে যাব না। মেয়ের বাবাকে এগিয়ে আসতে হবে।

ফৌজিয়া খাতুন বললেন, তাতো বটেই। আমার দাদুর মতো ছেলে তারা পাবে কোথায়? এ যুগে লাখে একটা এমন ছেলে আছে কিনা সন্দেহ। আল্লাহর যা মর্জি তাই হবে। তাকে রোধ করার ক্ষমতা কারো নেই। তারপর তিনি শাকিলের রুমে গিয়ে তার পাশে বসলেন, দাদু ভাই, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, ঠিক উত্তর দিবি তো?

আমাকে কোন দিন মিথ্যে বলতে শুনেছেন?

না তা শুনিনি, তবে কি জানিস ভাই, বিয়ে শাদির ব্যাপারে অনেকে দুষ্টুমী করে অথবা লজ্জায় একটু আধটু মিথ্যে বলে, তাই বললাম।

আমি তাও বলব না। কি জিজ্ঞেস করবেন করুন।

ঐ মেয়েকে কি তুই দেখেছিস?

দেখেছি।

পছন্দ হয়?

হয়।

ওরে দুষ্টু, তা হলে আগের থেকে ডুবে ডুবে পানি খাচ্ছিস।

না খাইনি। কারণ প্রায় বছর দুই আগে হঠাৎ একবার মাত্র তার সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে বল খেলা দেখতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল। তবে তখন জানতাম না, সে আব্বার বন্ধুর মেয়ে। সে যখন ঠিকানা দিয়ে একদিন তাদের বাসায় যেতে বলল, তখন ঠিকানা পড়ে জানতে পারি ওর পরিচয়। আর সে এখনও বোধ হয় জানে না আমি তার বাবার বন্ধুর ছেলে।

আচ্ছা, তাই নাকি? তা হলে তারপর আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি?

না।

তা নাই হোক। তাকে যখন তোর পছন্দ তখন আর বাধা কোথায়? রেদওয়ানকে বলি, শুভ কাজ তাড়াতাড়ি যাতে হয় সেই ব্যবস্থা করুক।

না দাদি, এখন আব্বাকে কিছু বলবেন না।

কেন?

কারণ আছে।

কারণটা বল না শুনি।

এখন বলতে পারব না।

কখন বলতে পারবি?

আপনি দেখছি উঁকিলি জেরা শুরু করেছেন। তারপর গলা নামিয়ে কানের কাছে। মুখ নিয়ে বলল, দাদাকে বুঝি সব সময় এরকম উঁকিলি জেরা করতেন?

ওরে শালা, কথাটা ঘোরাবার চেষ্টা করছিস। বুড়ী হয়ে গেছি বলে বোকা মনে করিছ না? ওসব চালাকি আমার কাছে খাটবে না। কারণটা না শুনে ছাড়ছি না।

আল্লাহ রাজি থাকলে যেদিন ঐ মেয়েটাকে আপনার নাতবৌ করে আনব, সেদিন তার সামনে কারণটা বলব। এখন বলতে পারব না। বেয়াদবি মাফ করবেন।

ফৌজিয়া খাতুন নাতির না বলার কারণটা ঠিক বুঝতে না পারলেও এটা ঠিক বুঝলেন, মেয়েটাকে বিয়ে করতে তার আপত্তি নেই। বললেন, একান্তই যখন বলবি না তখন আর কি করা যাবে? নাতবৌয়ের অপেক্ষাতেই থাকি।

শাকিল এক সপ্তাহ বাড়িতে থেকে মেহেরপুর রওনা হল। বাস স্ট্যান্ডে নেমে আসরের নামায পড়ে একটা রিকশায় করে আসছিল। গ্রামের বিলের পাড়ের রাস্তায় একটা প্রাইভেট কার বন্ধ হয়ে রয়েছে দেখে রিক্সাওয়ালা বলল, কি করে যাব সাহেব?  

শাকিল গাড়িতে কাউকে দেখতে না পেয়ে চারপাশে তাকাতে গিয়ে অল্প কিছু দূরে বাগান বাড়িতে নায়েবের সঙ্গে একজন বয়স্ক লোক ও একজন সাওয়ার কামিজ পরা যুবতী মেয়েকে দেখতে পেল।

রিকশার বেলের আওয়াজ শুনে নায়েব সেদিকে তাকিয়ে শাকিলকে দেখতে পেলেন। তারপর শাকিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, ম্যানেজার সাহেব এসে পড়েছেন। চলুন ফেরা যাক। আমরা রাস্তা বন্ধ করে রেখেছি।

তারা কাছাকাছি এলে শাকিল রিকশা থেকে নেমে সালাম দিয়ে বলল, নায়েব চাচা কেমন আছেন? আপনাদের সব খবর ভালো?

নায়েব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, হ্যাঁ বাবা, আমরা সবাই ভালো আছি। আপনাদের বাড়ির খবর ভালো? তারপর শাকিলাকে দেখিয়ে বললেন, ইনি চৌধুরী সাহেবের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে, ঢাকায় থাকেন। তিনি চারদিন হল এসেছেন। আর লোকটিকে দেখিয়ে বললেন, ড্রাইভার।

শাকিল শাকিলার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করল, দু’বছর আগের থেকে সে অনেক স্বাস্থ্যবতী ও সুন্দরী হয়েছে। মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখে চোখ পড়ল। শাকিল তার চোখে রাগ ও ঘৃণা দেখতে পেল। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে নায়েবকে বলল, আপনারা গাড়িতে করে যান, আমি রিকশায় আসছি।

শাকিলা তাকে চিনতে পেরে ভাবল, আমি যা অনুমান করেছিলাম, তাই ঠিক হল। মনে মনে শাকিলের প্রতি খুব রাগ ও ঘৃণা হতে লাগল। তার কথা শুনে ড্রাইভারকে বলল, তুমি নায়েব চাচাকে নিয়ে যাও, আমরা এটুকু পথ হেঁটে যাব।

শাকিলার কথা শুনে শাকিল রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বিদায় দিল।

নায়েব গাড়িতে করে চলে যাওয়ার পর শাকিলা শাকিলকে জিজ্ঞেস করল, আমাকে না চেনার ভান করলেন কেন? এরকম করেই কি সবাইকে ঠকিয়ে চলেছেন?

শাকিল বিদ্রূপটা গায়ে মাখল না। মৃদু হেসে বলল, দুনিয়াটা এত কঠিন পরীক্ষার জায়গা যে, মাঝে মাঝে এরকম না করলে পাশ করা যায় না। তবে এর মধ্যে একটা কথা আছে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখে যারা সব কিছু বিচার করে, তাদের বিচার সব সময় খাঁটি হয় না। আর সমাজে অহরহ যা ঘটছে তার কারণ অনুসন্ধান না করে আমরা অনেক ক্ষেত্রে ভুল করি। ওসব কথা থাক, রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব আলোচনা করা যায় না। চলুন এগোনো যাক, বলে সে হাঁটতে আরম্ভ করল।

গ্রামের ভিতরে আসতেই রাস্তার দু’পাশের বাড়ি ঘর থেকে ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে এসে শাকিলকে সালাম দিতে লাগল। আর বড়রা সালাম দিয়ে হাত মোসাফাহ করে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে লাগল। বাড়ির বৌ ঝিরা দরজা জানালা থেকে শাকিলকে এক নজর দেখার জন্যে ভীড় করছে। যেতে যেতে শাকিল হাসি মুখে তাদের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছে। অনেকে তাদের সমস্যার কথা জানাচ্ছে। তাদেরকে সে কাঁচারিতে দেখা করতে বলছে। একটা ছয় সাত বছরের মেয়ে ছেঁড়া হাফ প্যান্ট পড়ে খালি গায়ে শাকিলের সামনে এসে বলল, আব্বার অসুখ আবার বেড়েছে, আব্বা আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছিল। আপনি দেশে গেছেন শুনে ফিরে এসেছি।

শাকিল তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে তার হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে বলল, এটা তোমার আব্বাকে দিয়ে বলল, আমি পরে আসব।

কাঁচারি বাড়ির গেটের কাছে এসে মাগরিবের আযান শুনে শাকিলাকে বলল, কিছু মনে করবেন না, আমার সঙ্গে হেঁটে এসে অনেক কষ্ট পেলেন। আপনি ভিতরে যান, আমি মসজিদ থেকে নামায পড়ে আসছি। তারপর দারোয়ানের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে ব্রীফকেসটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মসজিদের দিকে চলে গেল।

শাকিলাকে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে দারোয়ান বলল, আপনি ভিতরে যান, আমি নামায পড়ব। তাকে তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার বলল, ম্যানেজার সাহেব আসার পর শুধু চৌধুরী বাড়িতে নয়, সারা মেহেরপুরে কেউ বেনামাযি আছে কিনা সন্দেহ।

শাকিলা ভিতরে আসার সময় চিন্তা করল, শাকিল কি সত্যিই ভালো ছেলে? না শঠ? এগুলো কি তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য? না নিজের শঠতাকে ঢাকার কৌশল? গরিব মেয়েটার হাতে টাকা দিয়ে সত্যি তাদের উপকার করল? না পরের ধনে পোদ্দারী করে আমার কাছে মহত্ব প্রকাশ করল। উপরে এসে চাচি আম্মাকে নামায পড়তে দেখে সেও অজু করে নামায পড়ল। নামাযের পর চাচিআম্মাকে বলল, আপনাদের ম্যানেজার। এসেছেন। তার সঙ্গে আলাপ হল।

নাগিনা বেগম হাসি মুখে বললেন, তাই নাকি? ছেলেটা অত্যন্ত ভালো। আজকাল এরকম ছেলে হয় না। আলাপ করে তোমার কেমন মনে হল?

বাইরের দিকটা তো খুব ভালো মনে হয়। কিন্তু মানুষের অন্তরের খবর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানতে পারে না।

তোমার কথা অবশ্য ঠিক। তবে বাইরের দিকটা দেখেই মানুষের ভিতরের দিকটা বিচার করতে হয়। তোমার চাচা খুব বিচক্ষণ লোক ছিলেন। তিনি ইন্টারভিউ নিয়ে এসে বললেন, এতদিনে একটা মনের মতো ছেলে পেলাম।

আমার কি মনে হয় জানেন চাচিআম্মা, আপনাদের ম্যানেজার ভীষণ ধূর্ত। সে বাইরে সাধুতার খোলস পরে সবার মন জয় করেছে। ভিতরে ভিতরে শয়তানি বুদ্ধির জাহাজ। আমি তার চরিত্রের এমন একটা দিক জেনেছি। তা জানলে আপনি চমকে উঠবেন।

নাগিনা বেগম শাকিলার কথা শুনে যেমন একটু রেগে গেলেন তেমনি অবাক হলেন। বললেন, তুমি যা কিছু জেনেছ, তা তুমি বিশ্বাস করলেও আমি করব না। আমার মনে হয় তোমার জানার মধ্যে কোন ভুল আছে।

শাকিলা চিন্তা করল, শাকিল এদের মধ্যে বিশ্বাসের ভীত এত শক্তভাবে স্থাপন করেছে যে, সেখানে ফাটল ধরান অসম্ভব। চাচিআম্মা নিশ্চয় উইলের ব্যাপারটা জানেন এবং তিনিও চান শাকিলের সঙ্গে আমার বিয়ে হোক। তাই তাকে বেশি কিছু বলে বিরক্ত করা সমীচীন হবে না মনে করে চুপ করে গেল।  

মাগরিবের নামায পড়ে শাকিল নাগিনা বেগমের সঙ্গে দেখা করতে এসে শাকিলাকে ওনার সঙ্গে দেখল। তার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে নাগিনা বেগমের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, আমি একটু গ্রামের দিকে যাব। ফিরতে রাত হবে। আপনি চিন্তা করবেন না।

নাগিনা বেগম বললেন, আজই তো এলে, বিশ্রাম নাও। কাল গেলে হয় না?

কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করা খুব দরকার।

আমার কথা যখন শুনবে না তখন যাও। ফজুকে সঙ্গে নিও, দিনকাল ভাল না। সাবধানে থেকো।

তাই নেব চাচিআম্মা। আমার দেরি হলে জেগে থাকবেন না। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। তারপর সালাম বিনিময় করে নিচে এসে ফজুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

শাকিল বেরিয়ে যেতে শাকিলা বলল, গ্রামের লোকজন তো দেখলাম ওনাকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তা হলে ওনার শত্রু থাকবে কেন?

নাগিনা বেগম বললেন, শাকিল ম্যানেজার হয়ে আসার পর যাদের অপকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের অনেকে সৎপথে ফিরে এলেও সবাই আসেনি। তারা ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। তাদের মাথা হল চেয়ারম্যান আমজাদ। সে এমনি বাইরে বাইরে শাকিলকে খুব সম্মান করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে শত্রুতা করে চলেছে।

আপনি এসব কথা কার কাছে শুনেছেন? শাকিল সাহেব বলেছেন নাকি?

শাকিল এসব কথা বলবে? নায়েবের কাছে শুনে তাকে জিজ্ঞেস করতে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপনি ওসব আজেবাজে কথায় কান দেবেন না। আমি যদি সৎপথে থাকি, তা হলে আমাকে আল্লাহ হেফাজত কববেন। আপনি শুধু দোয়া করবেন, তিনি যেন আমাকে সর্বদা সৎপথে চালিত করেন। তারপর বললেন, ওর পিছনে যে অনেকে শত্রুতা করবে, তা তোমার চাচা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি ওকে লাঠি খেলায়, ছুরী খেলায় ও পিস্ত। চালানোয় পারদর্শী করেছেন। শুধু তাই নয়, সেই কথা সবাইকে জানাবার জন্য এই গ্রামে ও আশপাশের গ্রামে খবর দিয়ে এই কাঁচারি বাড়ির সামনের মাঠে প্রতিযোগিতা মূলক লড়াইয়ের ব্যবস্থা করেন। শাকিলের বীরত্ব দেখে দুষ্টরা অনেকে ওর কাছে নতি স্বীকার করলেও কেউ কেউ চেয়ারম্যানের দলে ভিড়েছে। তাই সাবধান করে দিলাম।

শাকিলের এত গুণাগুন শুনেও শাকিলা তার প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারল না। তার মনে হল, শাকিল দেশের মানুষের জন্য এত কিছু করছে, শুধু নিজের চরিত্র ঢাকার জন্য, আর নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য।

পরের দিন সকালে শাকিল নাস্তা খেয়ে কাপড় বদলাচ্ছিল। এমন সময় শাকিলা তার রুমে এল।

শাকিল সালাম দিয়ে বসতে বলে বলল, কিছু বলবেন?

শাকিলা সালামের উত্তর দিয়ে একটা চেয়ারে বসে বলল, দু’একটা কথা বলব বলে। এলাম। মনে হচ্ছে কোথাও বেরোচ্ছেন? এখন থাক না হয় পরে বলব।

হ্যাঁ একটু বেরোব। তবে এক আধ ঘণ্টা দেরি হলে কোন ক্ষতি হবে না। তারপর সে একটা চেয়ারে বসে বলল, বলুন কি বলবেন?

চাচার উইল পড়ে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?

আমার কোন সিদ্ধান্তই নেই, নেব আবার কি।

বুঝতে পারলাম না।

চৌধুরী সাহেব যে এরকম উইল করবেন, তা কল্পনাও করি নাই।

কল্পনা করলে কি করতেন?

উইলটা অন্যভাবে করাতাম।

কিভাবে করাতেন?

সেটা আমার ব্যক্তিগত পরিকল্পনা। তা আপনাকে এখন জানালে যেমন কাজ হবে না, তেমনি বলতেও পারব না।

তা নাই বললেন, কিন্তু উইলের ব্যাপারে কি করবেন?

আপনি যা বলবেন, তাই করব।

কিন্তু আপনি যে রকম শঠ ও ধূর্ত, আমার কথায় রাজি হয়ে শেষে আমাকেই। বিপদে ফেলে দেবেন না তো?

দেখুন, আমি একজন সাধারণ স্কুল মাষ্টারের ছেলে। আল্লাহ আমাকে হয়তো একটু বেশি জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। সে জন্যে ধূর্ত বললে সহ্য করলেও শঠ বললে করব না।

কি করবেন?

প্রথমে ধৈর্য ধরার চেষ্টা করব। পরে অক্ষম হলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইব। তারপরও যদি বলেন, তা হলে যা করব তা দেখতেই পাবেন।

তা তখন না হয় দেখব। কিন্তু আপনি যে বললেন, আমি যা বলব, তাই করবেন, কথাটা ঠিক থাকবে তো?

ইনশাআল্লাহ থাকবে।

অশেষ ধন্যবাদ। আপনাকে অনেক বিরক্ত করলাম। আপনার অনেক মূল্যবান সময়ও নষ্ট করলাম, মনে কিছু নেবেন না।

আমার যে মন আছে, তা স্বীকার করেন তা হলে?

মন প্রত্যেকের আছে।

কিন্তু এতক্ষণ আপনার কথা শুনে তা মনে হয় নি।

আমি কি আপনার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি?

তা আমি বলব না। ঠাণ্ডা মাথায় নিজের মনকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন। আশা করি উত্তর পেয়ে যাবেন।

আপনার মতো আমার অত জ্ঞান-বুদ্ধি নেই যে, নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজে বের করতে পারব।

জ্ঞান-বুদ্ধি সকলের আছে। তবে সেটা কাজে লাগাতে সবাই জানে না।

আপনি পুরোটা কাজে লাগাতে পারেন তাই না?

নিজের কথা নিজের মুখে বলতে নেই জানি। আর এটাও জানি, জ্ঞান-বুদ্ধির দ্বারা চিন্তা ভাবনা করে কাজ করতে আল্লাহর রসুল (দঃ) হাদিসে বলেছেন।  

আপনার সঙ্গে তর্কে পারব না। চলি, আশা করি কথার বরখেলাপ করবেন না। কথা শেষ করে শাকিলা চলে গেল।

শাকিল আরো কিছুক্ষণ বসে চিন্তা করল, শিশু একাডেমীর গেটের ঘটনাটা শাকিলার মনে খুব আঘাত করেছে। তাই সে আমাকে যেমন ঘৃণা করে তেমনি শঠ ও ধূর্ত ভাবে। উইলের ব্যাপারে সে আমাকে কি বলতে পারে? যাই বলুক না কেন? তা যদি ন্যায়ের পথে হয়, তা হলে তাই করে এই দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেতে হবে।

আরো কয়েক দিন থেকে শাকিলা ঢাকা ফিরে এল।

এর মধ্যে ইয়াসিন সাহেব বন্ধু ও বন্ধু পত্নীর কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে শাকিলকে জামাই করবে বলে চিঠি দিয়েছিলেন। উত্তরে ওনারা ছেলের মতামতের উপর নির্ভর করছে বলে জানিয়েছেন। ইয়াসিন সাহেব ভাবলেন, শাকিলা তো মেহেরপুর গেছে। শাকিলের সঙ্গে পরিচয় হলে নিশ্চয় তাকে ভাল লাগবে। তা ছাড়া উইলের ব্যাপার নিয়েও তার দিকে এগোতে পারে।

শাকিলা মেহেরপুর থেকে ফিরে এলে ইয়াসিন সাহেব তাকে সেখানকার ভালমন্দ জিজ্ঞেস করার সময় শাকিলের সঙ্গে কোন কথাবার্তা হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন।

শাকিলা বলল, কথাবার্তা হবে না কেন?

ছেলেটাকে কি রকম মনে হল বল দেখি? আমি বলেছিলাম না, সে একটা রত্ন।

শাকিলা বলল, বাবা, শুনে তুমি কি মনে করবে জানি না। সে যে একটা ইতর ধরনের ছেলে, তা আমি অনেক আগেই জানতাম। তবে তখন তাকে তোমার বন্ধুর ছেলে বলে জানতাম না। তাই উইলে তার নাম ধাম দেখে কিছু বলিনি। মেহেরপুরে গিয়ে জানতে হয়েছে?

শাকিলা স্টেডিয়ামের ঘটনা ও শিশু একাডেমীর গেটের ঘটনা বলে বলল, এরপরও কি তুমি তাকে ধার্মিক ও আদর্শবান ছেলে বলবে?

ইয়াসিন সাহেব আরো অবাক হয়ে বললেন, তুই সত্যি বলছিস? আমার কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না।  

তুমি তোমার মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারছ না বাবা? যার সম্বন্ধে কিছুই জান না, কেবল বন্ধুর ছেলে বলে তাকে বিশ্বাস করছ। স্বীকার করছি, তোমার বন্ধু একজন ধার্মিক ও আদর্শবান লোক। তাই বলে তার ছেলেও যে বাবার মতো হবে, তা জানলে কি করে? ভালর ঘরে কি খারাপ ছেলে জন্মায় না। তা ছাড়া আজকালের কটা ছেলের চরিত্র ভালো।

তোর কথা যেমন অবিশ্বাস করতে পারছি না, তেমনি তাকেও ইতর ভাবতে পারছি না। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, হতে পারে, আজকালকার ছেলেরা কি না করতে পারে? কথাটা বললেন বটে, কিন্তু মনের ভেতর থেকে সাড়া পেলেন না।

শাকিলাও বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, বাবা আমার মন রাখার জন্য কথাটা বলেছে। বলল, এখন আমরা কি করব চিন্তা করে দেখা উচিত।

চিন্তা আর কি করব? ঐ সম্পত্তিতে আমার কোনদিন যেমন লোভ ছিল না তেমনি এখনও নেই। আল্লাহ যে সম্পত্তি থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছেন, সেই সম্পত্তি আবার তোকে দিতে চাচ্ছেন। তুই নিবি কিনা চিন্তা করে দেখ। তবে একটা কথা জেনে রাখিস, আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া মানে, ইনডাইরেক্ট তাকে অস্বীকার করা। কোন ঈমানদার মুলসমান তা করে না।

আমিও তা জানি বাবা। কিন্তু জেনেশুনে কি করে ঐ ইতর ছোটলোক ছেলেটাকে বিয়ে করব? তুমি কি জেনেশুনে তোমার মেয়েকে তার হাতে দিতে চাও?

বাবাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলল, চাচার এই অবাঞ্ছিত উইলের জন্য তোমাদের পূর্ব পুরুষদের সম্পত্তি যাতে বেদখল না হয়ে যায়, তার একটা উপায় বের করতেই হবে।  

তুই আমাকে ভুল বুঝিসনে মা। সব বাবা মা’ই মেয়েকে সৎ পাত্রে দিতে চায়। এখন এসব কথা থাক। পরে চিন্তা ভাবনা করে যা করার করা যাবে। কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখা যাক, শাকিল কি করে? সেও তো উইলের একটা কপি পেয়েছে। আর সম্পত্তির ব্যাপারে যা বলার আগেই বলেছি।

আমার কি মনে হয় জান, ছেলেটা ভীষণ ধূর্ত ও শঠ। তাই ধর্মের খোলস পরে খুব চালাকির সঙ্গে চাচার মন জয় করে নিজেই এই উইল করিয়েছে।

কি জানি মা, হয়তো তোর কথাই ঠিক।

জান বাবা, স্টেটের টাকা পয়সা গ্রামবাসীদেরকে সাহায্য করে এবং সমাজ কল্যাণের কাজ করে নিজের সুনামের ভত খুব দৃঢ় করেছে। কিন্তু কয়েকদিন সেখানে থেকে আমি তার শঠতা ধরে ফেলেছি। ভেবে ঠিক করেছি, আমিও তাকে এমন কায়দায় কাজ হাসিল করে মেহেরপুর থেকে তাড়াবো, যা সে কল্পনাও করতে পারবেনা।

ইয়াসিন সাহেব মেয়ের কথা শুনতে শুনতে মনে আঘাত পেয়ে, ক্রমশঃ রেগে যাচ্ছেন। তবু সংযত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোন কায়দায় তা করতে চাও?

এখন বলব না। তুমি ব্যারিস্টার মোস্তাক চাচাকে একদিন আসতে বল। তার সামনে বলব।

ঠিক আছে, ইবলিস। আমি তাকে ফোন করে দু একদিনের মধ্যে আসতে বলে দেব।

ব্যরিস্টার মোস্তাক কয়েকদিনের জন্য ঢাকার বাইরে ছিলেন। ফিরে এসে স্ত্রীর মুখে ইয়াসিন সাহেব ফোন করেছিলেন শুনে তাকে ফোন করলেন।

ইয়াসিন সাহেব ফোন ধরে তাকে বাসায় আসতে বললেন।

ব্যারিস্টার সাহেব শাকিলাদের বাসায় এলে ইয়াসিন সাহেব নিজের মতামতের কথা এবং শাকিলা শাকিলের এত গুণাগুন দেখে শুনেও কেন তাকে ঘৃণা করে, সেই সব কথা বললেন। তারপর বললেন, শাকিলা উইলের ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলতে চায়। সে নাকি একটা চিন্তা ভাবনা করেছে। যাই হোক সে যা বলবে, তাতে আপনি রাজি হয়ে যাবেন। তারপর যা করার আপনার সঙ্গে যুক্তি করে আমি করব।

ব্যরিস্টার সাহেব মুচকি হেসে বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে।

ইয়াসিন সাহেব ওনাকে আপ্যায়ণ করার পর মেয়েকে ডেকে পাঠালেন।

শাকিলা এসে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করে বলল, চাচা, আমি উইলের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কিছু পরামর্শ করতে চাই।

বেশ তো মা, কি পরামর্শ করতে চাও বল, আমি তোমাকে সাহায্য করব।

আমি চাই আমার পূর্ব পুরুষদের সম্পত্তি যেন বাইরের কোন লোকের কাছে না যায়। উইলে যে বিয়ের কথা লেখা আছে তা কখনও সম্ভব নয়। আমি জেনে শুনে একজন চরিত্রহীন লম্পটকে বিয়ে করতে পারব না। তাকে বিয়ে না করে চৌধুরী স্টেটের সম্পত্তি কি করে রক্ষা করা যায়, সে পরামর্শ আমাকে দিন। আপনারা তো আইনজীবী, আইনের প্যাঁচে তা করা যায় না?

দেখ মা, তোমার কথা দিয়ে শুরু করছি। আমরা আইনজীবি। আইনের বাইরে আমরা কিছু করতে পারি না। তবে উইলটা তো আমিই করেছি। তাতে একটা কথা উল্লেখ আছে, তা যদি তুমি মেনে নাও, তা হলে সমস্যার সমাধান হতে কোন অসুবিধে হবে না।

আমাকে কি করতে হবে বলুন।

তুমিও জান, উইলে উল্লেখ আছে, বিয়ের এক বছর পর তুমি স্টেটের মালিক হবে। যদি আমার পরামর্শ নিতে চাও, তা হলে বলব, শাকিলকে তুমি এক বছরের কন্ট্যাক্টে বিয়ে কর। সে যে ধরণের ছেলেই হোক না কেন, বিয়ের পর এক বছর তুমি এখানেই থাকবে। তারপর কাগজপত্র রেডী করে মালিকানা স্বত্ব বুঝে পাওয়ার পর তাকে উঁকিলি চিঠি দিয়ে ডিভোর্সের ব্যবস্থা নিতে পার। তবে এখানে একটা কথা আছে, শাকিল যদি তোমার প্ল্যান বুঝতে পারে, তা হলে সে বিয়েতে রাজি নাও হতে পারে। আর রাজি না হওয়াটাই স্বাভাবিক। তোমার সঙ্গে তার বিয়ে না হলে, সেই লাভবান বেশি হচ্ছে। চাচা হয়ে তোমাকে একটা উপদেশ দিই, তুমি শাকিলের সসে ভাল ব্যবহার করার অভিনয় করে তাকে বিয়ে করতে রাজি করাও। এটা যদি তুমি। পার, তা হলে এক বছর পরে যা করার তা আমি করব। তারপর ইয়াসিন সাহেবকে বললেন, আমার পরামর্শ আপনার মনমত হয়েছে কি না বলুন?

ইয়াসিন সাহেব হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, নিশ্চয়ই হয়েছে। এর থেকে আর ভাল প্ল্যান আছে বলে আমার মনে হয় না। ঐ যে কথায় আছে না, “সাপও মরবে আর লাঠিও ভাঙ্গবে না।”

শাকিলকে রাজি করাতে আমি পারব। তবে বিয়েটা এখানে হতে হবে এবং আমার কথামত সবকিছু হবে।

ইয়াসিন সাহেব বললেন, বেশ তাই হবে। তারপর ব্যারিস্টার সাহেবকে বিদায় দিয়ে মেয়েকে বললেন, যা কিছু করবি আমি বাধা দেব ন। তবে করার আগে আমাকে

জানাবি।

তাই জানাব বলে শাকিলা নিজের রুমে এসে কিভাবে কি করবে চিন্তা করতে লাগল। অনেক চিন্তা ভাবনা করে শাকিলকে চিঠি লিখল

শাকিল সাহেব,

সালামান্তে জানাই যে, উইলের ব্যাপারে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেদিন আপনি বলেছিলেন, এ ব্যাপারে আমি যা বলব আপনি তা মেনে নেবেন। সেই কথার উপর নির্ভর করে এই পত্র দিলাম। আপনি অতি শিঘ্রী ঢাকা আমাদের বাসায় আসুন। সাক্ষাতে সিদ্ধান্তের কথা জানাব। আশা করি, আপনি আপনার কথার নড়চড় করবেন না এবং শিঘী আসার চেষ্টা করবেন।

ইতি
শাকিলা

শাকিল চিঠি পেয়ে ভাবল, শাকিলা উইলের ব্যাপারে তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করতে চায়। সে নাগিনা বেগমের অনুমতি নিয়ে নায়েবকে বলে কয়েকদিন পর ঢাকায় এসে আনিসাদের বাসায় উঠল।

গুলজার অফিস থেকে ফিরে তাকে জিজ্ঞেস করল, কিরে স্টেটের কাজে এসেছিস না নিজের কাজে?

স্টেডিয়ামের ঘটনাটা লজ্জায় বলে নি। তাই শাকিল ঢাকা এলেই গুলজার শাকিলাকে উদ্দেশ্য করে মাঝে মাঝে ইয়ার্কি করে। আজও সেই রকমভাবে বলল, এবার বিয়ে শাদী করবি, না শাকিলাকে চিরজীবন খুঁজে বেড়াব। শাকিলা যে আব্বার। বন্ধুর মেয়ে তা শাকিল গুলজারকে বলে নি। আনিসা স্বামীর কাছে শাকিলার কথা একটু আধটু শুনেছে।  

শাকিল বলল, তুই একসঙ্গে এত প্রশ্ন করলে কোনটার উত্তর দেব বল। তাই, আমিও একসঙ্গে বলছি শোন,-স্টেটের কাজ আর আমার নিজের কাজ এবং শাকিলা, সব একসঙ্গে পেঁচিয়ে তালগোল পাকিয়ে গেছে। সেই প্যাঁচ ছাড়াতে এসেছি।

বুঝলাম না, খুলে বল।

শাকিল উইলের কথা বলে বলল, সেই শাকিলা হল এই শাকিলা, এবং আব্বার বন্ধু ইয়াসিন সাহেবের মেয়ে।

কেস তো খুব জটিল। তবে তোকে কিন্তু খুব বোকা মনে হচ্ছে।

কেন?

বোকা না তো কি? উইলের ব্যাপারে মিমাংসা করতে তুই ঢাকায় এলি কেন? মাথা তো শাকিলার ফেটেছে। চুনের জন্য সে তোর কাছে ছুটবে। শাকিলা বিয়েতে রাজি না হলে উইল মোতাবেক তুই তো এক রকম চৌধুরী স্টেটের মালিক। তবে তোর এত মাথা ব্যাথা কেন?  

তোর কথা অস্বীকার করছি না। অন্য কেউ হলে হয়তো তাই করত। কিন্তু আল্লাহ মেহেরবাণী করে আমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা যদি অনুস্বরণ না করি, তা হলে কাল কেয়ামতের ময়দানে তার কাছে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াব? পৃথিবীর এই ক্ষণস্থায়ী। জীবনের সুখের জন্য চিরস্থায়ী সুখ হতে আমি বঞ্চিত হতে চাই না। তাই এর বিহিত করে নিষ্কৃতি পেতে চাই।

আমি তো তোকে অন্যায় কিছু করতে বলছি না। চৌধুরী স্টেটের মালিক স্বেচ্ছায় যে উইল করেছেন, সেটাকেই অনুস্বরণ করতে বলছি। এতে আমার অন্যায় কোথায়, আমি তো বুঝতে পারছি না।

তুই অন্যায় কিছু বলিস নি ঠিক; কিন্তু শাকিলা আমাকে পছন্দ করে না বলে বিয়েও করতে চায় না। এই অবস্থায় চৌধুরী স্টেটের সম্পত্তি ভোগ দখল করে তাদের মনে কষ্ট দিতে চাই না। আর ওরকম অশান্তির মধ্যে বেশি দিন থাকতেও আমার মন চায় না।

তোকে দু একটা কথা জিজ্ঞেস করব ঠিক উত্তর দিবি, তোর সঙ্গে শাকিলার যখন পরিচয় হয়েছিল তখন সে কি জানতো, তুই তার আব্বার বন্ধুর ছেলে?

না।

জানার পর বুঝি অপছন্দ করল?

শাকিল আসল ঘটনা চেপে গিয়ে বলল, হ্যাঁ।

তুই কি তাকে ভালবাসিস?

বাসি।

এতক্ষণে বুঝলাম। ঠিক আছে, কাল ওদের বাসায় গিয়ে দেখ কি বলে।  

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *