অবাঞ্ছিত উইল – ১

ইয়াসিন সাহেব বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন, আপনার ভাগিনার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না। আপনারা চলে যান।

আরমান সাহেব খুব আশ্চর্য হয়ে বললেন, কি বলছেন বেয়াই সাহেব, কিছুই যে বুঝতে পারছি না?

না বোঝার কি আছে? যারা খেসী করতে এসে আমাদেরকে বিশ্বাস করে না, তাদের বাড়িতে মেয়ে দেব না।

ইয়াসিন সাহেবের প্রতিবেশী মাহফুজ সাহেব তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কথাটা চিন্তা করে বলেছেন?

চিন্তা না করে আমি কোনদিন কোন কথা বলি না বা কাজ করি না।

পাত্রের বাবা আনসার সাহেব অপমান বোধ করে খুব রাগের সঙ্গে বললেন, মেয়ের বাবার মুখে একথা শোভা পায় না। এখনও সময় আছে, কথাটা ফিরিয়ে নিন।  

না, যাদের মন এত নীচ, তাদের সঙ্গে সম্বন্ধ করব না, এটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

এমন সময় একজন বয়স্ক চাকর এসে ইয়াসিন সাহেবকে বলল, একটা ছেলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে।

কোথা থেকে এসেছে জিজ্ঞেস করেছ?

জি করেছি, কুষ্টিয়া থেকে।

ঠিক আছে তাকে ড্রইংরুমে বসাও, আমি আসছি। তারপর পাত্র পক্ষকে বললেন, আপনারা এখন আসতে পারেন।

আনসার সাহেব ও আরমান সাহেব রাগে ও অপমানে লাল হয়ে আর কোনো কথা বলে বিয়ের মজলিসে এসে সবাইকে মেয়ের বাবার কথা বলে বর ও বরযাত্রীদের নিয়ে চলে গেলেন। বরযাত্রীদের মধ্যে অনেকে অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য গোলমাল সৃষ্টি করে মারামারি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারল না। কারণ এই রকম ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা ইয়াসিন সাহেব অনুমান করেছিলেন। সেইজন্যে আগে থেকে মহল্লার কয়েকজন পাণ্ডা ধরণের ছেলেদের মজলিসে থাকার ব্যবস্থাও করেছিলেন। বরযাত্রীরা তাদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে বর নিয়ে চলে গেল।

মহল্লার লোকজনদের বিদায় করে ইয়াসিন সাহেব ড্রইংরুমে এসে ঢুকলেন।

ছেলেটা দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

ইয়াসিন সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে ছেলেটার আপাদমস্তক লক্ষ্য করলেন, তেইশ চব্বিশ বছরের সুন্দর স্বাস্থ্যবান ছেলেটাকে চিনতে না পেরে বললেন, তোমাকে তো চিনতে পারছি না, দাঁড়ালে কেন বস।

ছেলেটা একটা বড় খাম ওনার হাতে দিয়ে বলল, আব্বা খামটি আপনাকে দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। এগুলো আপনার খুব দরকারি কাগজ পত্র।

ইয়াসিন সাহেব খাম থেমে কাগজপত্র বের করে দেখে বললেন, হ্যাঁ দরকারি, তারপর বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তা হলে রেদওয়ানের ছেলে?

জি।

তোমার আব্বা আম্মা ভাল আছেন?

জি, আল্লাহ পাকের রহমতে ভাল আছেন। তবে আব্বা প্রায় এক বছর হল বিছানায় পড়ে আছেন। হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে পুরো বাম সাইডটা অবশ হয়ে গেছে।

তাই নাকি? ডাক্তার কি বলেছে?

ডাক্তার বলেছেন একেবারে নরমাল না হলেও কিছুটা ভাল হবে। তবে সময় লাগবে।

তোমার নাম কি?

শাকিল আহমদ।

তুমি এখন কি করছ?

গ্রামের স্কুলে মাস্টারী করছি।

লেখাপড়া কতদূর করেছ?

বি.এ. পাশ করেছি।

আমি যখন আমার আম্মাকে আনতে দেশে গিয়েছিলাম তখন তোমাকে খুব ছোট দেখেছিলাম, তাই চিনতে পারি নি। আচ্ছা, তোমার আব্বা কি আমার কথা তোমাকে কিছু বলেছে?

তেমন কিছু বলেন নি। তবে মাঝে মাঝে যখন আব্বা চুপচাপ বসে চিন্তা করেন তখন জিজ্ঞেস করলে বলেন, “কি আর চিন্তা করব বাবা, আমার বন্ধুর কথা ভাবছি। সে এখন ঢাকার একজন বিরাট বড় ব্যবসায়ী। অনেক দিন তাকে দেখিনি। দেখতে খুব ইচ্ছা করে। আমি তখন বলি, চলুন না আপনাকে ওনার কাছে নিয়ে যাই। আব্বা বলেন, না আমি যাব না। সে যদি আমাকে না দেখে থাকতে পারে, তা হলে আমি। পারব না কেন?

ইয়াসিন সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার আব্বা ঠিক কথা বলেছে। আমার একটা ভুলের জন্য তোমার আব্বা মনে খুব দুঃখ পেয়েছে। তোমার আব্বা আর আমি যে কি রকম বন্ধু ছিলাম, তা সময় মতো তোমাকে একদিন বলবো। তুমি কি বিয়ে করেছ?

লজ্জা পেয়ে শাকিল মাথা নিচু করে বলল, জি না।

আমার মেয়ের আজ বিয়ে হতে যাচ্ছিল। পাত্র পক্ষের ব্যবহারে তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছি। তা বোধ হয় তুমি বুঝতে পেরেছ। এখন আমি তোমার সঙ্গে তার বিয়ে দিতে চাই। এ ব্যাপারে তুমি কি কিছু বলবে?

শাকিল নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, মাথা নিচু করে চিন্তা করতে লাগল, যে নাকি একটা গ্রাম্য স্কুলের সামান্য মাস্টার, তাকে কিনা শহরের এক বিরাট ধনী ব্যবসায়ী তার একমাত্র মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন। কথাটা চিন্তা করে সে। ঘামতে শুরু করল।

ইয়াসিন সাহেব তাকে মাথা নিচু করে ভাবতে দেখে বললেন, কিছু বলছ না কেন?

শাকিল মাথা তুলে ওনার মুখের দিকে একবার চেয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে বলল, বেয়াদবি মাফ করবেন, এ ব্যাপারে আব্বা-আম্মা যা করবেন তাই হবে। এখন আমাকে যাবার অনুমতি দিন।

ইয়াসিন সাহেব আবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি ঠিক কথা বলেছ। আমারই সে কথা ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু এত রাতে কোথায় যাবে? এখানেই থাক।

আমি এক আত্মিয়ের বাসায় উঠেছি, না গেলে ওরা খুব চিন্তা করবে। তা হলে খেয়েদেয়ে তারপর না হয় যেও।

ইয়াসিন সাহেব মেহেরপুর চৌধুরী স্টেটের মালিকের বংশধর। ওনার দাদা গাফফার চৌধুরী জমিদার না হলেও জমিদারের মতো তার সব কিছু ছিল। মেহেরপুরের আশপাশের কয়েকটি গ্রামে ওনার প্রচুর জমি-জায়গা, আগান-বাগান এবং তিন চারটে জলমহল ছিল। এখন অত কিছু না থাকলেও যা আছে তা কম না। মালিকের উদাসীনতার সুযোগে কর্মচারীরা নিজেদের আখের গুছিয়ে চলেছে। তাই বর্তমানে যিনি মালিক, তিনি দাদার আমলের ঠাট বজায় রাখলেও চৌধুরী স্টেটের সেই ঐতিহ্য আর নেই। গাফফার চৌধুরীর দুই ছেলে। বড় ছেলের নাম আব্দুল বাসেত। আর ছোটর নাম আব্দুল আলিম। বাসেত কিছুটা উচ্ছঙ্খল হলেও আলিম বেশ ধার্মীক।। বাসিতের এক ছেলে। নাম মেসবাহ উদ্দিন। আব্দুল আলিমের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলের নাম ইয়াসিন আর মেয়ের নাম জেবুন্নেছা। জেবুন্নেছা খুব সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু বোবা। মেসবাহ উদ্দিন ও ইয়াসিন দু’চাচাতো ভাইয়ের মধ্যে বেশ সখ্যতা ছিল। ইয়াসিনের আব্বা আব্দুল আলিম গাফফার চৌধুরী বেঁচে থাকতেই মারা যান। ইয়াসিন ও মেসবাহ উদ্দিন তখন ইন্টারে পড়ে। মেসবাহ উদ্দিন আই.এ. পাশ করে পড়াশুনা বন্ধ করে দেন। সেই সময় প্রথম যৌবনের তাড়নায় ও শয়তানের প্ররোচনায় মেসবাহ উদ্দিন চাচাতো বোন জেবুন্নেছার সাথে অবৈধ মেলামেশা করে। ফলে জেবুন্নেছা গর্ভবতী হয়ে পড়েন। আব্দুল আলিমের স্ত্রী ফারজানা বেগম জানতে পেরে ভাসুর বাসেতকে ঘটনাটা জানিয়ে তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু উনি ও ওনার ছেলে মেসবাহ উদ্দিন কেউই রাজি হলেন না। বরং এই ব্যাপার নিয়ে বাসেত ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া ঝাটি করেন। আলিম মারা যাওয়ার তিন মাস পর গাফফার চৌধুরীও মারা যান। তাই জেবুন্নেছার বিয়ের কথা বলতে এলে বাসেত রাগারাগি করতে করতে এক সময় বললেন, আলিম আব্বা বেঁচে থাকতে মারা গেছেন, তুমি বা তোমার ছেলে এই সম্পত্তি থেকে কিছুই পাবে না। দয়া করে যে থাকতে ও খেতে পরতে দিচ্ছি, সেটাই যথেষ্ট।

সেখানে ইয়াসিন ছিলেন, তিনি আম্মাকে ঘরের ভিতর নিয়ে এসে বললেন, এ ব্যাপারে তুমি আর চাচার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করো না। জেবুন্নেছার তকদ্বীরে যা আছে হবে।

ভাসুরের কথা শুনে ফারজানা বেগম নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। ছেলের কথা শুনে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, না বাবা আর কোনো ব্যাপারেই কিছু বলব না।

জেবুন্নেছা বোবা কালা হলেও সব কিছু বুঝতে পারলেন। সেই রাত্রেই গলায় শাড়ী পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন।

এই ঘটনায় ফারজানা বেগম ও ইয়াসিন প্রচণ্ড দুঃখ পান। বছর দই পর আব্দুল বাসেত মারা যান। বাবা মারা যাবার পর মেসবাহ উদ্দিন আরো বেশি উচ্চুঙ্খল হয়ে পড়েন। ইয়াসিন তাকে অনেক বোঝান। কিন্তু কোনো কাজ হয় নাই। আরো কিছু দিন পর মেসবাহ উদ্দিনকে মদ ও মেয়ে মানুষ নিয়ে মেতে উঠতে দেখে ইয়াসিন খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। একদিন চাচি আম্মা জাহানারা বেগমকে কথাটা জানালেন।

জানাহারা বেগম দেওরের ছেলেকে খুব ভালবাসতেন। ধার্মিক দেখে তিনি আল্লাহপাকের কাছে ছেলের হেদায়েতের জন্য কেঁদে কেঁদে দোয়া চাইতেন। এখন তার কথা শুনে বললেন, আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি। আমার কথায় কান দেয় না। তোর সঙ্গে তো আগে খুব ভাব ছিল। তুই ওকে বোঝাবার চেষ্টা কর।

চাচি আম্মার কথা ইয়াসিন সেদিন তাকে কুরআন হাদিসের কথা বলে বোঝাতে গেলে মেসবাহ উদ্দিন রেগে গিয়ে তার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেন। এমন কি বলেন, আমি যা ইচ্ছা তাই করব, তুই বলার কে? তোর আব্বার টাকায়ততা করছি না। তোর আব্বার যেমন এই সম্পত্তিতে কোনো হক ছিল না, তেমনি তোরও নেই। বেশি বাড়াবাড়ি করলে এ বাড়ি থেকে বের করে দেব। এই কথা শুনে ইয়াসিন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মায়ের কাছে এসে মেসবাহ উদ্দিনের কথাগুলো বলে বললেন, আমরা আর এ বাড়িতে থাকব না। আজই যেখানে চোখ যায় সেখানে চলে যাব।

ফারজানা বেগমের চোখেও পানি এসে গেল। বললেন, তাই চল বাবা আমারও আর এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না।

ইয়াসিন তখন বি.এ. পরীক্ষা দিয়েছেন। মেহেরপুরে তখন ভালো কলেজ ছিল না। তাই কুষ্টিয়া কলেজ হোস্টেলে থেকে মেসবাহ উদ্দিন ও ইয়াসিন পড়েছেন। সেই সময়ে সেখানকার রেদওয়ান নামে একটা ধার্মিক ছেলের সঙ্গে ইয়াসিনের বন্ধুত্ব হয়। দু’জনে এক সঙ্গে বি. এ. পরীক্ষা দিয়েছেন। ইন্টারে পড়ার সময় থেকে উভয়ে উভয়কে ধার্মিক জেনে বন্ধুত্ব করেন। অনেকবার তাদের বাড়িতেও গেছেন। রেদওয়ানের আম্মা ফৌজিয়া খাতুন তাকে নিজের ছেলের মতো দেখতেন। রেদওয়ানের আব্বা রেদওয়ানকে ছোট রেখে মারা যান। মেসবাহ উদ্দিন অন্য স্বভাবের ছিলেন বলে রেদওয়ানের সঙ্গে পরিচয় থাকলেও তার সঙ্গে মিশতেন না।

ইয়াসিন মাকে নিয়ে চৌধুরী বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেই বন্ধু রেদওয়ানের কথা তার মনে পড়ল। মায়ের কথা শুনে বললেন, আজ হোক কাল হোক একদিন না একদিন আমাদেরকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। এই বাড়িতে, এই সম্পত্তিতে আমাদের যখন কোনো হক নেই, তখন আমি চলে যাবার জন্য মনস্থির করেছি।

ফারজানা বেগম চোখের পানি মুছে বললেন, তুই শুধু এই বাড়ি, এই বিষয় সম্পত্তির কথা বলছিস কেন? প্রত্যেক মানুষকেই তো একদিন না একদিন এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। আমার এখান থেকে যেতে কোনো অমত নেই। আমি বললাম তো, তুই যেখানে নিয়ে যাবি। সেখানেই যাব।

কয়েকদিন পর ইয়াসিন কুষ্টিয়ায় এসে বন্ধু রেদওয়ান ও তার আম্মাকে সব কথা জানিয়ে তাদের কাছে পরামর্শ চাইলেন।  

রেদওয়ানের আম্মা ফৌজিয়া খাতুন বললেন, ঐ পাপপূরীতে তোমাদের থাকার দরকার নেই। তোমার আম্মাকে নিয়ে তুমি আমাদের বাড়িতে চলে এস। তুমি আমার রেদওয়ানের মতো। আল্লাহ চাহে তো একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই।

কুষ্টিয়া থেকে ফিরে এসে ইয়াসিন আম্মাকে নিয়ে রেদওয়ানের বাড়িতে চলে আসেন। ফারজানা বেগম আসবার সময় স্বামীর জমানো অনেক টাকা-পয়সা ও সোনাদানা সঙ্গে এনেছিলেন। তা থেকে রেদওয়ানদের বাড়ির কাছে জায়গা কিনে দুটো ঘর উঠিয়ে বাস করতে থাকেন। কিছু বাগান এবং আবাদি জমিও কেনেন। সব কিছু রেদওয়ানই ব্যবস্থা করে দেন।  

এর মধ্যে রেদওয়ান গ্রামের হাইস্কুলে মাস্টারি করতে শুরু করেছেন। তিনি ইয়াসিনকে দরখাস্থ করতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি স্কুল মাস্টারী করতে চান নাই। ফারজানা বেগম ছেলেকে কিছু একটা করার কথা বললেন। ইয়াসিন বললেন, আমি। ব্যবসা করার চিন্তা ভাবনা করছি।

ফারজানা বেগম বললেন, বেশ তো তাই কর। টাকা যা লাগে আমি দেব। ইয়াসিন মায়ের কাছ থেকে হাজার বিশেক টাকা নিয়ে ঢাকায় এসে ছোট খাট ব্যবসা শুরু করেন। তারপর ভাগ্যগুনে ও কর্মদক্ষতায় আজ ঢাকায় একজন বড় ব্যবসায়ী। গ্রীণ রোডে বিরাট ছয়তলা বাড়ি। ব্যবসায় উন্নতি করে বাড়ি গাড়ি করার আগে একবার কুষ্টিয়ায় গিয়ে মাকে নিয়ে আসেন। আর কোনো দিন কুষ্টিয়া যান নাই। সেখানে যা কিছু ছিল, আসবার সময় বন্ধু রেদওয়ানকে দেখাশুনার ভার দিয়ে চলে আসেন। রেদওয়ান প্রতি বছর তার জমির ও বাগানের ফসল বিক্রি করে সব টাকা ঢাকায় তার কাছে পাঠিয়ে দেন।

রেদওয়ান তার ফুপাতো বোন সুরাইয়াকে ছোট বেলা থেকে ভালবাসতেন। যখন তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন তখন রেদওয়ানই ওনাকে পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যেতেন আসতেন। শেষ পরীক্ষার দিন ফেরার পথে রেদওয়ান তাকে ভালবাসার কথা জানালে সুরাইয়া ডিনাই করেন। তারপর বন্ধু ইয়াসিনের সঙ্গে পরিচয় হবার পর ওনাদের দুজনকে দু’জনের দিকে এগোতে দেখে রেদওয়ান মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে আল্লাহপাকের কাছে সাহায্য চেয়ে সবর করে নেন।

সুরাইয়াদের বাড়ি তাদের বাড়ি থেকে অল্প দূরে। কথাটা দু ফ্যামিলির মধ্যে জানাজানি হবার পর কথাবার্তা ঠিক হয়, ইয়াসিন কিছু একটা করলেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবে।

কিন্তু আল্লাহপাকের ইচ্ছা অন্য রকম। তাই ইয়াসিন ঢাকায় এসে উন্নতি হতে দেখে তিনি আরো বড় হবার জন্যে পিছনের দিকে তাকাবার সময় পেলেন না। সুরাইয়ার কথাও মনে রাখলেন না। একদিনের জন্যে এসে সেই যে মাকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন, আজ পর্যন্ত আর কুষ্টিয়ায় যান নাই। বাড়ি গাড়ি করার পর ঢাকার এক বড় লোকের শিক্ষিত মেয়ে মাহমুদাকে বিয়ে করেছেন। অবশ্য স্ট্যাবলিস্ট হবার পর এবং বিয়ের সময় কয়েকটা চিটি দিয়ে রেদওয়ানকে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু রেদওয়ান বন্ধুর ব্যবহারে খুব আঘাত পেয়ে আসেন নাই। ফারজানা বেগম ছেলের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে প্রায় রাগারাগি করতেন।

এদিকে যখন সুরাইয়ার বয়স দিন দিন বেড়ে যেতে লাগল তখন তার আব্বা ও রেদওয়ান ইয়াসিনকে অনেকবার চিঠি দিয়ে কোনো উত্তর পান নাই। শেষে সুরাইয়ার আব্বা একদিন ঢাকায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন।

ইয়াসিন তখন বলেছিলেন, আমি স্ট্যাবলিস্ট না হয়ে বিয়ে করব না। আপনার মেয়ের বিয়ে অন্যত্র দেয়ার ব্যবস্থা করুন।

সুরাইয়ার আব্বা ফিরে এসে মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র খুঁজতে লাগলেন। সুরাইয়া শুনে যেমন দুঃখ পেলেন তেমনি রেদওয়ানও পেলেন। সুরাইয়ার আব্বা পাত্র খুঁজলে কি হবে। ইয়াসিন ও সুরাইয়ার ভালবাসার কথা এবং তাদের বিয়ের কথা গ্রামের ও আশপাশের গ্রামের অনেকে জেনে গিয়েছিল। ফলে সুরাইয়ার বিয়ে হওয়া খুব মুস্কিল হয়ে পড়ল। শেষ মেষ রেদওয়ানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। রেদওয়ান সে কথা পত্রের দ্বারা বন্ধু ইয়াসিনকে জানিয়েছিলেন। তাদেরই ছেলে শাকিল। শাকিলরা দুই ভাই বোন। বোনের নাম আনিসা। আনিসা ম্যাট্রিক পাশ করার পর রেদওয়ান ছেলের বন্ধু গুলজারের সঙ্গে তার বিয়ে দেন। গুলজারদের বাড়ি পাশের গ্রামে। তার বাবার অবস্থা মোটামুটি ভালো। স্কুল-লাইফ থেকে দু’জনে বন্ধু। দুজন দুজনের বাড়িতে অনেকবার গিয়েছে। গুলজারের স্বভাব চরিত্র খুব ভাল। তার আব্বা আম্মা শাকিলকে খুব ভালবাসেন। তাই যখন গুলজার বি.এ. পাশ করার পর ঢাকায় অগ্রণী ব্যাংকে চাকরি পেল তখন মনে মনে ভেবে রাখল, আনিসা ম্যাট্রিক পাশ করলে তার সাথে বোনের বিয়ে দেবে। সেকথা শাকিল আব্বাকে জানিয়ে রেখেছিল। আনিসা পরের বছর ম্যাট্রিক পাশ করার পর ছেলের বন্ধুর সঙ্গে রেদওয়ান মেযের বিয়ে দেন। রেদওয়ান নিজে যেমন ধার্মিক তেমনি ছেলে মেয়েকেও সেই ভাবে মানুষ করেছেন। গুলজার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় থাকে।

শাকিলের এম.এ পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু রেদওয়ান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে অনেক দিন থেকে ভুগছেন। তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। শরীরের বাম সাইড প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তাই শাকিলের এম.এ পড়া হল না। চাষের ধানে টেনে টুনে তাদের ছমাস চলতো। বাকি ছমাস রেদওয়ান স্কুলের বেতনের টাকায় এবং প্রাইভেট পড়িয়ে যা পেতেন তাতে চালিয়ে নিতেন। ছেলের লেখাপড়ার পিছনেও খরচ করতেন। অনেক দিন বিছানায় পড়ে থাকায় চাকরি চলে যায়। রেদওয়ান যেমন ধার্মিক ছিলেন তেমনি আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন। ওনার আদর্শের কথা নিজেদের গ্রাম ছাড়াও অন্যান্য গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল।

শাকিল বি.এ. পাশ করে অভাবের সংসারে অনেক দিন বেকার রয়েছে জেনে স্কুল কমিটি তাকে মাস্টারি করার জন্য বলে। শাকিলের মাস্টারি করার ইচ্ছা না থাকলেও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে মাস্টারি করতে হল। কিছুদিন পর শাকিল আব্বার কথামতো ইয়াসিন সাহেবের জমি জায়গার দলিল ও কাগজপত্র নিয়ে ঢাকায় ওনাকে দিতে এসেছিল।

শাকিল চলে যাবার পর ইয়াসিন সাহেব বন্ধু রেদওয়ানের কথা ভাবতে ভাবতে চাচাতো ভাই মেসবাহ উদ্দিনের কথা মনে পড়ল। সেদিন মনের কষ্টে মাকে নিয়ে চলে এলেও আগের জীবনের কথা মনে পড়লে খুব অস্থিরতা অনুভব করেন। মেসবাহ উদ্দিনও অনেক দিন পর তার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি লোক পরস্পরায় শুনেছিলেন, ইয়াসিন তার মাকে নিয়ে কুষ্টিয়ায় বন্ধু রেদওয়ানদের ওখানে আছেন। সে সময় লজ্জায় সেখানে যেতে না পারলেও পরে যখন জানতে পারলেন, ইয়াসিন ঢাকায় ব্যবসা করে সেখানে গাড়ি বাড়ি করেছেন তখন কয়েকবার তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য গিয়েছিলেন। উনি যখন যেতেন তখন ফারজানা বেগম ভাসুরের ছেলের সঙ্গে দেখাও করতেন না। বছর তিনেক হল ফারজানা বেগম মারা গেছেন। মেসবাহ উদ্দিন নিয়ে যেতে এলে ইয়াসিন সাহেবের মনে হয়েছে, আজ সে ধনী হয়েছে বলে তাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছে। বছর খানেক আগেও একবার মেসবাহ উদ্দিন এসে যখন বললেন, তোর তবু একটা মেয়ে আছে, আমার তাও নেই। আমাদের বিশাল সম্পত্তি কে ভোগ দখল করবে? তখনও ইয়াসিন সাহেবের মন গলে নি। বলেছিলেন, যেখান থেকে আমার মা অপমানিত হয়ে এসেছে, সেখানে আমি যেতে পারব না। মেসবাহ উদ্দিন অশ্রুভরা চোখে ফিরে গেছেন।

ইয়াসিন সাহেবের কোন পুত্র সন্তান নেই। একটা মাত্র মেয়ে। তার নাম শাকিলা। সে এ বছর বাংলায় অনার্স পাশ করেছে। ইয়াসিন সাহেব লালবাগের এক ধনাঢ্য লোকের ইঞ্জিনিয়ার ছেলে নাদিমের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তার আগে পাত্রের সঙ্গে শাকিলার বার তিনেক এ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে। কেউ কাউকে অপছন্দ করেনি। মেয়ের মত নিয়েই ইয়াসিন সাহেব বিয়ের দিন ঠিক করেন। বিয়ের পাকা কথাবার্তা হবার সময় পাত্রের মামা আরমান সাহেব, উনিও একজন ব্যবসায়ী, লেনদেনের কথা তুলেছিলেন। তখন ইয়াসিন সাহেব বলেছিলেন, বিয়ের সময় লেনদেনের কথা বলা ইসলামে নিষেধ। স্বেচ্ছায় সামর্থ অনুসারে যে যা দেয়, তা খুশী মনে সবাইকে মেনে নিতে হয়।

আরমান সাহেব বললেন, উভয়েরই সামর্থ আছে। আমরা যদি তা করি, তাতে কোন দোষ হবে বলে মনে হয় না।  

ইয়াসিন সাহেব বললেন, আমাদের কি মনে হবে, না হবে তা নিয়ে ইসলামের কোন আইন তৈরী হয়নি। স্কুল মাখলুকাতের যিনি মালিক, একমাত্র তিনি যা মনে করবেন বা ইচ্ছা করবেন তাই হবে। আপনারা এ ব্যাপারে আর মুখ খুলবেন না। আল্লাহপাক আমাকে যতটা দেয়ার সামর্থ দিয়েছেন, ততটা দেব। তিনি বিয়েতে মেয়েকে দেবার জন্য ওনার আম্মার বিশ ভরী সোনার গহণা না ভাঙ্গিয়ে শুধু পালিশ করে এনেছেন। মেয়েকে সাজাবার আগে সেগুলো পাত্র পক্ষকে দেখাবার জন্য বিয়ের মজলিসে পাঠিয়েছিলেন।

পাত্রের মামা আরমান সাহেব খুব কূটীল লোক। ভাগিনা যে এক সময় তার শ্বশুরের সবকিছু পাবে তা জেনেও সোনাতে কতটা খাদ আছে জানার জন্য একজন স্যাকরাকে সঙ্গে করে এনেছিলেন। আপ্যায়ণ ও খাওয়া দাওয়ার পর ইয়াসিন সাহেব বিয়ে পড়াবার কথা তুললে আরমান সাহেব বললেন, তার আগে আপনি মেয়েকে যে সব সোনার গহনা দিচ্ছেন, সেগুলো আমরা পরীক্ষা করতে চাই।

ইয়াসিন সাহেব শুনে খুব রেগে গেলেন। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করলেন না। গম্ভীর স্বরে বললেন, বেশ তা হলে ভিতরে চলুন।

আরমান সাহেব পাত্রের বাবাকে ও স্যাকরাকে নিয়ে ভিতরে গেলেন। ইয়াসিন সাহেব একজনকে মজলিস থেকে গহনার বাক্সগুলো নিয়ে আসতে এবং পাত্রকেও সঙ্গে করে আনতে বললেন।

আরমান সাহেব বললেন, পাত্র আবার এখানে আসবে কেন?

ইয়াসিন সাহেব বললেন, আসলে জিনিসগুলোর মালিক তো সে-ই। অতএব কতটা আসল আর কতটা নকল জিনিস সে পাচ্ছে, তা নিশ্চিয় তার দেখা উচিত? তারপর লোকটাকে বললেন, যা বললাম তাড়াতাড়ি কর। লোকটা সোনার বাক্সগুলো ও বরবেশী নাদিমকে নিয়ে ফিরে এল। ইয়াসিন সাহেব নাদিমকে বসতে বলে স্যাকরাকে বললেন, পরীক্ষা করুন।

স্যাকরা দু একটা বাক্স খুলে গহনাগুলো উল্টে পাল্টে দেখে বললেন, এগুলো দেখছি সাবেক কালের খাঁটি জিনিস। কষ্টি পাথরে ঘষে আর পরীক্ষা করা লাগবে না। কথা শেষ করে তিনি নিজেই আবার সেগুলো বাক্সে রাখার সময় বললেন, এ যুগে এরকম সোনা পাওয়া দুষ্কর। তারপরের ঘটনা যা ঘটেছিল, তা পাঠক পাঠিকারা কাহিনীর শুরুতেই পড়েছেন।

শাকিলার বান্ধবীরা তাকে সাজাবার জন্য এসে সোনার গহনার খোঁজ করতে গিয়ে যা শুলন, তাতে তারা খুব অবাক হয়ে গেল। পাত্রপক্ষ গহনা পরীক্ষা করায় শাকিলার আব্বা তাদেরকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। বান্ধবীরা বিস্ময় কাটিয়ে উঠে ফিরে এসে শাকিলাকে জানাল।  

শাকিলা ধর্মশীলা মেয়ে না হলেও ফরয নামায, ফরয রোযা করে। তবে পর্দা মেনে চলে না। বাইরে বেরোবার সময় চাদর বা বোরখা ব্যবহার করে না। শুধু একটা প্রচলিত সরু ওড়নার দুই প্রান্ত দুই কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে ঝুলিয়ে মাঝখানটা টেনে বুকের ওপর দেয়। আযান শুনলে ওড়নার একদিকটা নিয়ে মাথায় দেয়। পরে নামিয়ে ফেলে। কখনো কখনো রুমাল দিয়ে মাথা চুলসহ বেঁধে রাখে। খুব সুন্দরী না হলেও সুন্দরী। গায়ের রং ফর্সা ও কালর মাঝামাঝি। স্বাস্থ্য মোটামুটি ভাল। যে কোনো ছেলের দৃষ্টি তার দিকে পড়লে ফিরিয়ে নেয়া শক্ত। ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়ে হিসাবে যতটা অহংকার থাকা উচিত ততটা নেই। হয় তো সে অপরূপ নয় বলে, না হয় তার মধ্যে কিছু ধর্মীয় জ্ঞান আছে বলে। বান্ধবীদের কাছে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার কথা শুনে শাকিলা স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। বান্ধবীদের কেউ কেউ তাকে প্রবোধ দিতে থাকলে শাকিলা তাদেরকে বলল, তোরা এখন যা। আমাকে একটু একলা থাকতে দে। বান্ধবীরা চলে যাওয়ার পর সে ভাগ্যের কথা চিন্তা করে নিজেকে সামলে নিল। তারপর মায়ের রুমে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা কোথায়?

মাহমুদা বেগম বললেন, কুষ্টিয়া থেকে কে একটা ছেলে এসেছে, তার সঙ্গে দেখা করতে ড্রইংরুমে গেছে।

শাকিলা ড্রইংরুমের দরজার কাছে এসে পর্দা ফাঁক করে দেখল, বাবা একা চুপ করে বসে আছে। ভিতরে ঢুকে বাবা বলে ডেকে তার কাছে এসে দাঁড়াল।

ইয়াসিন সাহেব ততক্ষণ আগের জীবনের কথা চিন্তা করছিলেন। মেয়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে তার একটা হাত ধরে পাশে বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আমার ওপর তোর খুব মনে কষ্ট হয়েছে না?

শাকিলা কোন কথা বলতে পারল না। বাবার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠল।

ইয়াসিন সাহেবের চোখেও পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বললেন, আমার ওপর তুই মনে কষ্ট আনিস না। আল্লাহপাকের ইচ্ছা হয়তো অন্যরকম, তাই এ রকম হল। তারপর তিনি হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে বললেন, বাপ হয়ে তোর কাছে ক্ষমা। চাইছি।

শাকিলা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, এ তুমি কি বলছ বাবা। আর কখনো এমন কথা বলবে না। তোমার ওপর আমার কোন মনো কষ্ট নেই। তুমি যা ভাল বুঝেছ করেছ। বাবাকে আবার চোখ মুছতে দেখে বলল, তুমি অত ভেঙে পড়ছ কেন? আল্লাহ আমার তকৃদিরে যা রেখেছেন তা হবেই।

ইয়াসিন সাহেব বললেন, আমার কেবলই মনে হচ্ছে, তোর প্রতি অবিচার করে ফেললাম।

শাকিলা বলল, না বাবা তুমি কোনো অবিচার করনি। আল্লাহর ইচ্ছাতেই সব কিছু হয়েছে। এখন আর ওসব কথা চিন্তা করো না। মা বলল, কুষ্টিয়া থেকে কে যেন এসেছিল?

ইয়াসিন সাহেব টেবিলের ওপর থেকে খামটা নিয়ে মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন, আমি আর তোর দাদি যখন মেহেরপুর থেকে এসে কুষ্টিয়ায় এক বন্ধুর বাসায় ছিলাম তখন সেই বন্ধু কিছু জমি জায়গা কিনে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেই সব জমি জায়গার দলিলপত্র এতদিন বন্ধুর কাছেই ছিল। তারই ছেলে এসে দিয়ে গেল। জানিস মা, আমার ঐ বন্ধুটা যেমন ধার্মিক তেমন আদর্শবান শিক্ষক ছিল। তার ছেলের কাছে শুনলাম, তার বাম সাইডটা এক বছর হতে চলল অবশ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। সে যে আমার কি রকম বন্ধু ছিল, তা তোকে বোঝাতে পারব না।

শাকিলা বলল, এ সময় ওনাকে একবার তোমার দেখতে যাওয়া উচিত।

যাওয়া তো একান্ত উচিত, কিন্তু মা যাওয়ার রাস্তা যে আমি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছি।

সেই রাস্তা আবার কি খোলা যায় না বাবা?

আল্লাহ রাজি থাকলে সেই চেষ্টা করব মা। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে আবার বললেন, তার ছেলেকে তার বাবার মত মনে হল। ছেলেটা বি.এ. পাশ করে স্কুল মাস্টারি করছে।

তাকে আজ এখানে থাকতে বললে না কেন?

বলেছিলাম, সে তার এক আত্মিয়ের বাসায় উঠেছে। না গেলে তারা চিন্তা করবে, তাই চলে গেল। তারপর আবার বললেন, যে সময় আমাদের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ছেড়ে ওদের বাড়িতে চলে আসি তখন তোর দাদি ও আমি চোখের পানিতে বুক। ভাসিয়েছিলাম। কথা শেষ করে তিনি আবার চোখ মুছলেন।

তোমাকে না সেইসব পুরনো কথা ভাবতে নিষেধ করেছি। ওসব চিন্তা আর কখনও করো না। আল্লাহ কি তোমাকে সে সবের চেয়ে কম কিছু দিয়েছেন?

না মা তা দেন নি। বরং তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছেন। সে জন্য তাঁর পাক দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই।

আমি দাদীর কাছে তোমাদের পূর্ব পুরুষদের অনেক কথা শুনেছি। আমার কি মনে হয় জান বাবা, আল্লাহ পাকের ইশারায় ঐ রকম ঘটনা ঘটেছিল বলে আজ তুমি এত উন্নতি করতে পেরেছ। আর তারই ঈশারায় আবার আজ আমার বিয়েতেও এই বিপর্যয় ঘটল। তার কথা স্মরণ করে তোমাদেরকে সবর করে থাকতে হবে।

তুই খুব দামী কথা বলেছিস মা। তোর কথা শুনে আমার দুশ্চিন্তা দূর হল। চল মা এশার নামায পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইব।

এমন সময় মাহমুদা বেগম এসে বললেন, বাপ মেয়েতে সারারাত গল্প করবে, না নামায পড়ে খাওয়া দাওয়া করবে?

শাকিলা বলল, তুমি যাও মা, আমরা এক্ষুনি আসছি। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বাবার একটা হাত ধরে বলল, চল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *