অবাঞ্ছিত উইল – ৩

নায়েব ও সরকার এক বয়সি হলেও গোমস্তার বয়স তাদের চেয়ে কম। কাঁচারি বাড়িতে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা। প্রথম বারে এসে শাকিল তাদের সঙ্গে ছিল। এবারে এসে দেখল, ভিতর বাড়ির বৈঠকখানার পাশের রুমে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কাজের জন্য কাঁচারিতে অন্য একটা আলাদা রুমে অফিস করা হয়েছে। সেই রুমের এক পাশে নামায পড়ার জন্য একটা দামী মছল্লা বিছান রয়েছে। এবারে আসার পর নায়েবের কথামতো শাকিল অফিস রুমে কাজ করছে। সে লক্ষ্য করল, কাঁচারীর সবাই তাকে আগের থেকে বেশি সমীহ করছে। আর সব চাকর চাকরানিরাও তাকে ভয় ভয় করছে। দিনে সকলের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করলেও রাতে তাকে নিজের রুমে খেতে হয়। এসব ব্যাপারে শাকিল একদিন সরকারকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, চৌধুরী সাহেবের হুকুম। ওনার হুকুমের বাইরে কোনো কিছু হবার উপায় নেই। আপনি কিছু দিন থাকুন, আস্তে আস্তে সব কিছু বুঝতে পারবেন।  

শাকিল অভ্যাস মতো একদিন ভোরে উঠে ফজরের নামায পড়ে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করছিল। দরজায় কারো করাঘাত শুনে কুরআন শরীফ বন্ধ করে চিন্তা করল, কে হতে পারে? কাজের মেয়ে নয়তো? কিন্তু সে এখন কেন আসবে? ভিতর বাড়ির একজন আধা বয়সী কাজের মেয়ে তাকে খাওয়া দাওয়া করায়। প্রতিদিন সকাল বিকেল তার রুম ঝাড়ু দেয়। বিছানা পত্রও ঝেড়ে ঠিক করে দিয়ে যায়।

দরজায় আবার বেশ জোরে ধাক্কা দেয়ার আওয়াজ পেয়ে কুরআন শরীফ টেবিলের উপর রেখে দরজা খুলে দেখল, চৌধুরী সাহেবের বডিগার্ড হীরু। এর মধ্যে একদিন হীরুর সঙ্গে শাকিলের অনেক কথা হয়েছে। তার পরিচয় এবং তার কি কাজ সব জেনেছে। আজ এই সময়ে তাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে সালাম দিয়ে বলল, কি খবর হীরু চাচা, এমন সময়ে?

হীরু সালামের প্রতি উত্তর দিয়ে বলল, মালিকের হুকুম আপনাকে লাঠিয়াল হতে হবে।

কথাটা শুনে শাকিল চমকে উঠল। তারপর চিন্তা করল, লাঠিয়াল হতে তো দোষ নেই বরং ভালো। প্রয়োজনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লাঠিয়ালি করা যাবে। তখন তার চৌধুরী সাহেবের কথা মনে পড়ল-”আমার নাম করে যে কেউ কোন কাজ করতে বললে করবে।”

শাকিলকে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে দেখে হীরু বলল, কই আসুন দেরী করছেন কেন?

শাকিল লুঙ্গী পাঞ্জাবী ছেড়ে পাজামা ও গেঞ্জী গায়ে বেরিয়ে এল।

হীরু তাকে মূল বাড়ির পিছনে নিয়ে গেল। নানারকম গাছপালার মাঝখানে বেশ। খানিকটা ফাঁকা জায়গা। একপাশে একটা পাকা রুম। হীরু সেই রুম থেকে দুটো পাঁচহাতি লাঠি নিয়ে এসে একটা শাকিলের হাতে দিয়ে নিজে অন্যটা নিয়ে কিছুক্ষণ লাঠি খেলার প্রথম অনুশীলনগুলো দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল। তারপর তাকে অনুশীলন করাতে লাগল। প্রায় ঘন্টা খানেক অনুশীলন করার পর হীরু বলল, আজ এ পর্যন্ত। থাক। আপনি প্রতিদিন রেডী থাকবেন, আমি ডেকে নিয়ে আসবো। আর শুনন, আপনি যা কিছু করছেন এবং করবেন, সে সব কারো কাছে প্রকাশ করবেন না।

শাকিল বুঝতে পারল, এটাও চৌধুরী সাহেবের হুকুম। বলল, ঠিক আছে তাই হবে।

শাকিল কমার্স নিয়ে ডিগ্রী পাশ করেছে। ছাত্র হিসাবেও বেশ ভাল ছিল। এক সপ্তাহের মধ্যে সব কিছু বুঝে নিয়ে নিজে খাতা পত্র চেক করতে লাগল। নায়েব তাকে গত বিশ বছরের প্রত্যেক বছরের আয় ব্যয়ের হিসাব করতে বলেছেন। খাতা পত্রে প্রথম দিকে ছোট খাট ভুল দেখতে পেয়ে ভিতরের দিকে ভালো করে চেক করতে গিয়ে ক্রমশঃ বড় বড় অংকের ভুল দেখতে পেল। হঠাৎ শাকিলের মনে হল, চৌধুরী সাহেব বোধ হয় কিছু টের পেয়েছেন। তাই তাকে দিয়ে চেক করাচ্ছেন। শাকিল কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে এক মাসের মধ্যে বিশ বছর আগের এক বছরের স্টেটমেন্ট তৈরী করল। তাতে ঐ এক বছরেই পঁচিশ হাজার টাকার নগদ ক্যাশ কারচুপি হয়েছে দেখতে পেল। চিন্তা করল, নায়েব বা সরকারকে খাতাটা দেখাবার আগে চৌধুরী সাহেবকে ব্যাপারটা জানান উচিত। এবারে আসার পর থেকে চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে মাত্র একবার দেখা হয়েছে। সে সময় সালাম ও কুশলাদি বিনিময় ছাড়া আর কোনো কথা হয়নি। আর একদিন সান পুকুর থেকে অযু করে আসার সময় দোতলার বারান্দায় বেগম সাহেবের সঙ্গে ওনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাথা নিচু করে চলে এসেছে। আজ রাতে খাবার পর কাজের মেয়েটা বলল, ম্যানেজার সাহেব, সাহেব আপনাকে ডেকেছেন। আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

শাকিল মনের মধ্যে অজানা এক আতঙ্ক নিয়ে তাকে অনুসরণ করল। দোতালায় উঠে সিঁড়ির পাশের রুমের দরজার কাছে এসে কাজের মেয়েটা বলল, আপনি ভিতরে গিয়ে বসুন।

শাকিল ভিতরে ঢুকে বুঝতে পারল, এটাও একটা ড্রইংরুম। এখানকার আসবাবপত্র সব এ যুগের। দেয়ালে কলেজে পড়ার সময়কার একটা যুলগ ফটোর দিকে তাকিয়ে চিনবার চেষ্টা করল। চৌধুরী সাহেবকে একটু একটু চিনতে পারলেও অন্য জনকে চিনতে পারল না।

চৌধুরী সাহেব রুমে ঢুকে তাকে ফটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ফটোর মালিকদের চিনতে পারলে?

শাকিল চৌধুরী সাহেবের গলার আওয়াজ শুনে ঘুরে সালাম দিয়ে বলল, একজন খুব সম্ভব আপনি। অন্যজনকে চিনতে পারছি না।

চৌধুরী সাহেব তাকে বসতে বলে নিজেও বসে বললেন, অন্যজন আমার চাচাতো ভাই। যে তোমার বাবার বন্ধু। এখন বল,সব কিছু কি রকম চলছে?

শাকিল বলল, এখন মনে হয় সব কিছু ঠিকমতো চলছে। তবে আগে ঠিকমতো চলেনি।

যেমন?

আমি গত বিশ বছর আগের এক বছরের হিসাব দেখেছি। তাতে পঁচিশ হাজার টাকার গোলমাল আছে।

চৌধুরী সাহেবের মুখে এক ঝিলিক হাসি ফুটে মিলিয়ে গেল। বললেন, বাকি বছরগুলোর হিসাব করে যাও। আর সেই সঙ্গে চলতি হিসাবের দিকেও লক্ষ্য রাখবে। তুমি কি এর মধ্যে বাড়ি যাবে?

জি, তবে কবে যাব এখনো ঠিক করিনি।

গেলে তাড়াতাড়ি ফিরে এস। তোমাকে কাঞ্চনপুরে যেতে হবে। তার আগে হীরুর কাছে তোমাকে সব বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। ওখানকার লোকেরা বেশ কয়েক বছর ধরে ঠিকমত ফসলের ভাগ দিচ্ছে না।

এমন সময় চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী নাগিনা বেগম ঘরে ঢুকলেন।

শাকিল দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে নিল।

নাগিনা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে তাকে বসতে বলে নিজেও বসল। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের কাজের কথা শেষ হয়েছে?

চৌধুরী সাহেব স্ত্রীর কথার উত্তর না দিয়ে উঠে চলে গেলেন।

নাগিনা বেগম শাকিলকে বললেন, তুমি অমন মাথা নিচু করে বসে রয়েছ কেন? আমি তো তোমার আম্মার মতো। আল্লাহ দিলে তোমার মতো আমার ছেলে থাকতে পারত। কথা শেষ করে তিনি চোখের পানি মুছলেন।

শাকিল ওনার ভিজে গলা শুনে তাকিয়ে দেখল, উনি চোখ মুছছেন। সে জানে চৌধুরী সাহেব নিঃসন্তান। তাড়াতাড়ি উঠে এসে কমদবুসি করে বলল, বেয়াদবি মাফ করবেন, আমাকে ছেলে মনে করেছেন জেনে নিজেকে ধন্য মনে করছি। জানলাম আজ থেকে এখানেও আমার একজন আম্মা আছেন।

নাগিনা বেগম চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না। বললেন, সেই কথা ভেবেই তো তোমাকে আজ এখানে আনিয়েছি। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে আবার বললেন, থাক বাবা থাক, বেঁচে থাক। তোমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?

জি না, বরং অনেক ভালো আছি।

কোন অসুবিধে হলে জানাবে। এখন যাও ঘুমাওগে, অনেক রাত হয়েছে।

শাকিল সালাম জানিয়ে ফিরে এসে চিন্তা করল, আল্লাহর কি কুদরত, এতবড় ষ্টেট, অথচ ভোগ করার কেউ নেই। কয়েকদিন পর নায়েবকে বলে শাকিল বাড়ি গেল।

শাকিল বাড়ি যাওয়ার পর একদিন রাতে নায়েব, সরকার ও গোমস্তা গোলটেবিলে বসলেন। নায়েব বললেন, আপনারা ম্যানেজার চোকরাকে কি রকম বুঝছেন?

সরকার বললেন, প্রথমে আপনি বলুন, কি বুঝেছেন?

নায়েব বললেন, ছোকরাটাকে খুব বোকা বলে মনে হয় না। লোভী ও চালাক হতে পারে। তবে সেয়ে ধার্মিক তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সরকার বললেন, সে বোকা না চালাক বুঝি না। তবে ধার্মিক এ কথা আমিও ‘বুঝেছি। তারপর নায়েবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সামনে আপনি যেদিন পুরনো এক বছরের হিসাব ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন, সেদিন ধর্মের কত কথা বলল শুনলেন না? “আপনারা আমার বাবার বয়সি। মিথ্যা বলব না, হিসাবে যথেষ্ট গোলমাল আছে। আপনারা বহুদিন থেকে এখানে কাজ করছেন। ছেলে হয়ে আপনাদের কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করছি, এখন আর কোনো অন্যায় করবেন না। যা করেছেন, সে জন্যে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে মাফ চেয়ে নেন। আপনাদের কি মউতের, কবরের, দোযখের ভয় নেই? কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহর কাছে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবেন? সেই সব কথা স্মরণ করে তওবা পড়ে নামায পড়ন। কারণ নামাযই মানুষকে অসৎ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। আল্লাহ কুরআন পাকে বলিয়াছেন, “নিশ্চয় নামায নির্লজ্জ ও অশোভনীয় কাজ হইতে বিরত রাখে।” [সূরা-আলকাবুত, পারা-২১, ৪৫ নং আয়াতের মাঝখানের অংশ।] আপনারা কি জানেন না, “অন্যের ক্ষতি করলে ভবিষ্যতে নিজের ক্ষতি হয়?”

গোমস্তা বলে উঠল, আমাকেও একদিন ঐ সব কথা বলেছে।

নায়েব বললেন, সবই তো বুঝলাম। কিন্তু হিসাবের গোলমালের কথা চৌধুরী সাহেবকে বলেছে কিনা সেটাই চিন্তার কথা। একটা কথা বলে রাখি, আমাদেরকে এখন। সৎ সেজে কাজ করে যেতে হবে। সেই সঙ্গে ছোকরাটাকে সরাবার ব্যবস্থা করতে হবে। ও থাকলে একদিন না একদিন আমাদেরকে চৌধুরী সাহেবের কাছে ধরা পড়তে হবে। চৌধুরী সাহেব একদিন বললেন, এ বছর ফলস ওঠার সময় ছোকরাটাকে কাঞ্চনপুরে পাঠাবেন। তারপর গোমস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার বাড়ি সেখানে। আর ঐখান থেকে সবচেয়ে কম ফলস উসুল হয়। তাই মনে হয় চৌধুরী সাহেবের মনে সন্দেহ হয়েছে। ঘটনাটা জানিয়ে বাছাধনকে একেবারে শেষ করে দেয়ার ব্যবস্থা করুন। নচেৎ ফিরে এলে চৌধুরী সাহেব আপনাকে ছেড়ে কথা বলবেন না।

সরকার বললেন, আমরা ম্যানেজারকে যা ভাবছি, তা নাও হতে পারে। তা না হলে হিসাবপত্রে আমাদের কারচুপি জেনেও কেন কিছু করল না?

নায়েব মৃদু হেসে বললেন, বুঝলেন না, ছোকরা খুব চালাক। কিছু করলে আমরাও যে তার বিরুদ্ধে কিছু করব, সে কথা ভেবে কিছু করতে সাহস পায়নি। তবে কিছু না করার আরো একটা কারণ থাকতে পারে। আমাদের কাছ থেকে হয়তো কিছু মালপানি পেতে চায়। সে কথা সরাসরি বলতে না পেরে ধর্মের কথা বলেছে। আরে বাবা, এই কলিযুগের ছেলেদেরকে জানতে আমার বাকি নেই।

সরকার বললেন, দেখা যাক না, এবারে এসে কি করে।

সেদিনের মতো গোলটেবিল শেষ করে যে যার মত ঘুমাতে গেল।

নায়েব জমীরুদ্দিন যেমন খুব চতুর তেমন স্বার্থপর। একে শাকিল ম্যানেজার হয়ে আসার পর তার স্বার্থে ঘা পড়েছে। তার উপর আজ যখন চৌধুরী সাহেব বললেন, শাকিল যা কিছু করুক না কেন কোন কৈফিয়ত তলব করবেন না। তখন থেকে তিনি তার উপর ভীষণ রেগে আছেন। এতদিন সকলের উপর জোর জুলুম করে লুটে পুটে খাচ্ছিলেন। ভয়ে কেউ টু শব্দ করতে পারেনি। আর ঐ পুচকে ছোকরা কিনা দুদিন এসে তাকে টপকে গেল? কি করে তাকে এখান থেকে সরান যায় চিন্তা করতে লাগলেন। সরকারকে দলে টানা যাবে না। সে ভীতু। গোমস্তাকে দিয়ে কাজটা করাতে হবে। একদিন গোপনে গোমস্তার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হল, কাঞ্চনপুরে ম্যানেজার গেলে তার ছেলে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করবে।

.

শাকিল প্রায় দুমাস পরে বাড়িতে এল, সুরাইয়া খাতুন ও ফৌজিয়া খাতুন তার স্বাস্থ্যের উন্নতি দেখে খুব খুশী হয়ে দোয়া করলেন।

রেদওয়ান এখন আগের থেকে একটু সুস্থ্য হয়েছেন। অল্প অল্প হাঁটতে পারেন। তিনিও খুশী হলেন।

পরের দিন সকালে নাস্তা খাবার সময় রেদওয়ান বললেন, ও পাড়ার সারোয়ার ভাই একটু আগে এসেছিল। সে কি কাজে ঢাকা গিয়েছিল। ফেরার সময় আনিসাকে দেখতে গিয়ে জানতে পারে, গুলজার একসিডেন্ট করে আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। তুমি গিয়ে তাকে দেখে এস।

সুরাইয়া খাতুন শুনে চমকে উঠে বললেন, উনি হাসপাতালে গিয়ে গুলজারকে দেখে আসেননি?

সে কথা আমি তাকে জিজ্ঞেস করিনি।

সুরাইয়া খাতুন চোখের পানি মুছে শাকিলকে বললেন, তুই নাস্তা খেয়ে ঢাকা যা। মেয়েটা হয়তো খুব কান্নাকাটি করছে। আল্লাহ পাক, তুমি আমার মেয়ে জামাইকে সহি। সালামতে রেখ।

শাকিল ঐ দিন ঢাকা রওয়ানা হল। আনিসাদের বাসায় গিয়ে তাকে পেল না। কাজের মেয়েটা বলল, আপা কিছুক্ষণ আগে মেডিকেলে গেছে। শাকিল ব্রীফকেসটা রেখে মেডিকেলে যাওয়ার মনস্থ করে জিজ্ঞেস করল, কত নাম্বার ওয়ার্ডে আছে জান?

বার নাম্বার ওয়ার্ডে। আমি আপার সঙ্গে একদিন গিয়েছিলাম।

শাকিল মেডিকেলে এসে দেখল, গুলজার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আর আনিসা সব কিছু গুছিয়ে ব্যাগে ভরছে। শাকিল সালাম দিয়ে তাদের কাছে এগিয়ে এসে বলল, রীলিজ হয়ে গেল বুঝি?

হাঁ বলে গুলজার ও আনিসা একসঙ্গে সালামের উত্তর দিল। আনিসা প্রথমে ভাইয়াকে ও পরে স্বামীকে কদমবুসি করে ঘরের সবাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করল।

শাকিল বলল, আমাদের ঘরের সকলের খবর ভালো। তবে তোর শ্বশুর বাড়ির খবর বলতে পারব না। গতকাল মেহেরপুর থেকে এসেছি। আজ সকালে গুলজারের এ্যাকসিডেন্টের কথা শুনে চলে এলাম।

মেহেরপুর চৌধুরী ষ্টেটে চাকরি হওয়ার পর শাকিল, গুলজার ও আনিসাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। আনিসা বলল, জান ভাইয়া, তোমার বন্ধু না ব্যাংকের কর্মচারী ইউনিয়নের-তাকে কথাটা গুলজার শেষ করতে দিল না। বলল, এই কি হচ্ছে? এটা হাসপাতাল না? তোমার জিনিসপত্র সব নেয়া হলে চল।

ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে শাকিল গুলজারকে জিজ্ঞেস করল, কি করে এ্যাকসিডেন্ট হল?

রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা বাসের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে পায়ে ও মাথায় খুব আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।

গেটে এসে আনিসা বলল, একটা স্কুটার নাও।

শাকিল তাদেরকে স্কুটারে তুলে দিয়ে বলল, তোরা যা। আমি একজনের সঙ্গে দেখা করে পরে আসছি।

আনিসা বলল, কালকে দেখা করলে হত না।

শাকিল বলল, বিয়ের পর তোর সাহস তো খুব বেড়ে গেছে দেখছি। বেয়াদবের মত আমার কথার ওপর কথা বলছিস।

গুলজার বলে উঠল, বাসায় এসে খুব শাসন করে দিস। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গেও বেয়াদবি করে।

কথাটা শুনে আনিসাকে লজ্জা পেতে দেখে শাকিল বলল, ঠিক আছে এখন যা, আমি এসে যা করার করব। তারপর ড্রাইভারকে বলল, আপনি স্টার্ট দেন তো ভাই।

ওরা চলে যাওয়ার পর শাকিল হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করতে লাগল, শাকিলাদের বাসায় তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া ঠিক হবে কিনা? বাড়িতে আব্বা যখন গুলজারকে দেখতে ঢাকায় আসতে বললেন, তখন শাকিলার কথা মনে পড়ে পুলক অনুভব করে ভেবেছিল, তাদের বাসায় যাবে। এখন তাদের বাসায় যাবার কথা চিন্তা করতেই মনে সেই রকম পুলক অনুভব করল। আবার চিন্তা করল, তাদের বাসায় গেলে শাকিলা তাকে তার আব্বার গরিব বন্ধুর ছেলে জেনে কি ভাববে। যদি ভাবে ছেলেটা নিজের সত্তা ভুলে জেনে শুনে বাপের বড় লোক বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে ভাব করতেই এসেছে। এই সব চিন্তা করতে করতে বাংলা দোয়েল চত্বর পার হয়ে হাইকোর্টের রাস্তার ফুটপাত দিয়ে আসছিল। তখন সন্ধে হতে বেশি দেরি নেই। অল্প দূর থেকে দেখতে পেল, শিশু একাডেমীর গেটের কাছে চারজন লারেলাপ্পা ধরণের ছেলে ও শালওয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে খুব হাসাহাসি করছে। শাকিল গেটের কাছে এসে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে আসবে, ঠিক সেই সময় মেয়েটা জড়িয়ে ধরে বলল, সেই কখন থেকে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। মেয়েটা জড়িয়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ঐ চার জন ছেলে শাকিলের হাতের ঘড়ি এবং পকেটে যা কিছু ছিল সব ছিনিয়ে নিয়ে মেয়েটাকে সরে যেতে বলল। মেয়েটা সরে যেতে সবাই মিলে শাকিলকে মারতে লাগল।

শাকিল চিন্তার মধ্যে একটু অন্যমনস্ক ছিল। তা ছাড়া এরকম ঘটনা যে ঘটতে পারে তা সে কল্পনাও করে নাই। হঠাৎ ঘটে যেতে সে প্রথমে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। ব্যাপারটা উপলব্ধি করে যখন সে তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্যে প্রস্তুতি নিল তখন তার কানে একটা মেয়ের শ্রুতি মধূর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কি ব্যাপার ভাই? ওনাকে মারধর করছেন কেন?

শাকিলার বান্ধবী চৈতি শিশু একাডেমিতে চাকরি করে। সে অনেক আগে তার কাছে এসেছে। শাকিলা আজ সন্ধ্যায় শুধু বান্ধবীদের নিয়ে একটা পার্টি দিচ্ছে। সে চৈতিকে আজ ছুটি নিতে বলেছিল। কাজের চাপ থাকায় চৈতি বলেছে, ছুটি পাব না। তবে ছুটির পর আসব। চারটেয় ছুটি হবার পর কাজ থাকায় বসের হুকুমে কাজ করতে হচ্ছে। সে কথা ফোনে শাকিলাকে জানিয়েছে। তাই সব কিছু ব্যবস্থা করে শাকিলা চৈতিকে নিয়ে যেতে এসেছিল। সঙ্গে করে নিয়ে যাবে বলে সে এতক্ষণ চৈতির কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিল। তারপর তাকে নিয়ে গাড়িতে করে ফেরার সময় গেটের বাইরে মারামারি দেখে ড্রাইভার গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়েছে। শাকিলা জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে তাদেরকে ঐ কথা জিজ্ঞেস করল। ছেলেগুলো গাড়ি দেখে ও শাকিলার কথা শুনে শাকিলকে ছেড়ে দিতে শাকিলা তাকে চিনতে পেরে খুব অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

তাদের মধ্যে একটা ছেলে তাদের দলের মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল, দেখুন না আপা, এই শালা ভদ্রলোকের বাচ্চা, আমার বোনের হাতে দুশো টাকা দিয়ে হোটেলে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। তাই একটু ধোলাই করছিলাম।

কথাটা শুনে শাকিলার গা ঘিন ঘিন করে উঠল। সেই সঙ্গে শাকিলের প্রতি তার প্রচণ্ড রাগ ও ঘৃণা জন্মাল। সে আর কোনো কথা না বলে মাথাটা ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি ছেড়ে দিতে বলল।

শাকিলার গাড়ি চলে যাবার পর তাকে আর তারা মারধর করল না। কারণ প্রথমতঃ তাদের আসল উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ সেখানে অনেক পথিক দাঁড়িয়েছে। তারা আসল ঘটনা জেনে গেলে হিতে বিপরিত হয়ে যাবে। তাই সেই ছেলেটা শাকিলকে বলল, যান, এবার ভদ্রলোকের ছেলের মতো চলে যান, নচেৎ জানে শেষ করে দেব।

তাদের হুমকি শুনে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শাকিলের প্রচণ্ড রাগ হল। কিন্তু সামলে নিয়ে চিন্তা করল, পথিকরা মেয়েঘটিত ব্যাপার শুনলে তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। তার কথা কেউ বিশ্বাসও করবে না। তাই চুপচাপ একটা রিকশায় উঠে শাহজাহানপুর যেতে বলল। একটার পর একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে যেতে দেখে শাকিল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। এখন রিকশায় বসে সেই কথা ভাবতে গিয়ে তার মনে হল, শাকিলা এই মিথ্যে ঘটনা দেখে নিশ্চয় আমাকে খুব খারাপ ভেবে গেল। এরপর আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাব কি করে?  

বাসায় এলে গুলজার তার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার? তোর মন অত খারাপ কেন? কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলি? তারপর তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোর জামা কাপড়ের অবস্থা এরকম কেন?

শাকিল বলল, তুই থামতে, বড় বেশি কথা বলিস। তারপর আনিসাকে বলল, পনেরটা টাকা দে, রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে।

আনিসা টাকা এনে দিলে শাকিল রিকশাওয়ালাকে দিয়ে এসে বলল, ব্যাপার কিছু হয় নি। তোদের এই রাজধানীতে এসে হাইজ্যাকারদের পাল্লায় পড়েছিলাম। তারা মারধর করে যা ছিল সব কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিল।  

গুলজার বলল, অমন ষাঁড়ের মতো গতর নিয়ে কিছু করতে পারলি না?

আনিসা স্বামীকে ধমকের সুরে বলল, তুমি চুপ কর। তারপর ভাইয়ার একটা হাত ধরে ভিজে গলায় বলল, শরীরে কোথাও জখম হয়নি তো?

শাকিল বোনের চোখে পানি দেখে বলল, না রে পাগলি না, কোথাও জখম হয় নি।

আরো দু’দিন থেকে শাকিল বাড়ি ফিরে এল।

শাকিলার বান্ধবী চৈতি ফেরার পথে তার মন খারাপ দেখে বলল, কিরে তোর। আবার কি হল? মনে হচ্ছে ঐ ছেলেটাকে তুই চিনিস?

শাকিলা স্টেডিয়ামে বল খেলা দেখতে গিয়ে শাকিলের সঙ্গে কিভাবে পরিচয় হয়েছিল, সেই ঘটনা বলল।

চৈতি বলল, আজকাল মানুষ চেনা বড় কঠিন। ছেলেটা ভীষণ ধূর্ত। তাই অপমানিত হয়েও ফাঁদে ফেলার জন্য সাহায্য করার অজুহাতে তোর মন জয় করার চেষ্টা করেছিল।

তুই ঠিক কথা বলেছিস। সেদিন পরিচয় হওয়ার পর ছেলেটাকে ভালো মনে করেছিলাম। রাত্রে ঘুমাবার সময় শাকিলার বিকেলের ঘটনাটা মনে পড়ল, প্রথমদিন পরিচয় হবার পর থেকে তার কথা প্রায় মনে পড়ে। তাকে আর দশটা ছেলের চেয়ে আলাদা মনে করেছিল। কিন্তু আজ তার আর এক রূপ দেখে শিউরে উঠে চিন্তা করল, ভাগ্যিস তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক হবার আগে তার আসল রূপ দেখতে পেলাম, নচেৎ কি হত আল্লাহই জানেন।

.

এক সপ্তাহ বাড়িতে থেকে শাকিল কর্মস্থলে ফিরে এল। দিন পনের পর একদিন হীরু লাঠি খেলার সময় বলল, আপনি এই দু আড়াই মাসে যা শিখেছেন তা এক বছরেও কেউ শিখতে পারে না। এবার তলোয়ার ও ছুরি খেলা শিখতে হবে। তিন মাস প্র্যাকটিস করে শাকিল ঐ গুলোতেও দক্ষতা অর্জন করল। তারপর কিছুদিনের মধ্যে সুটিং-এও পারদর্শীতা লাভ করল।

একদিন হীরু শাকিলকে বলল, চৌধুরী সাহেবের কথামতো আমি আপনাকে সব বিদ্যা শিখিয়েছি। আপনার মতো সাগরেদ পাইনি। তাই এতদিন কাউকে শেখায় নি। আপনাকে মনের মতো পেয়ে মন উজাড় করে শিখিয়েছি। এখন আপনি পুরো ওস্তাদ বনে গেছেন।  

শাকিল হীরুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল, হীরু চাচা, আপনি এই সব খেলা শেখাবার জন্য যে দিন প্রথম হাতে খড়ি দেন, সে দিন থেকে মনে মনে আপনাকে ওস্তাদ বলে স্বীকার করেছি। আজ তা প্রকাশ্যে স্বীকার করলাম। দোয়া করুন, আমি যেন সব সময় ন্যায় পথে থেকে দুর্বলের সাহায্যকারী হতে পারি।

হীরু বলল, দোয়া করবো কি? সেই প্রথম দিন থেকে সব সময় করেই আসছি। আর সারাজীবন করেও যাব। আপনি চৌধুরী বাড়ির ও কাঁচারি বাড়ির সবাইকে এমন কি চাকর চাকরানিদেরকেও পর্যন্ত নামায পড়া না পড়ার সুফল কুফল জানিয়ে নামায ধরিয়েছেন। রাত তিনটের দিকে আপনি যখন কুরআন পড়েন তখন চৌধুরী সাহেব ও বেগম সাহেবের সঙ্গে আমিও শুনি। আপনার গলার স্বর এত সুন্দর, তা আমি কোনো মৌলানা বা হাফেজের গলাতেও শুনিনি। শুধু নায়েব আপনার প্রতি অসন্তুষ্ট। তিনি নামায পড়েন নি ঠিক, তবে দেখবেন অল্প দিনের মধ্যে তিনিও শুধরে যাবেন।

শাকিল আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, প্রত্যেক মুসলমানের যা কর্তব্য তাই আমি করেছি। বাকি সব কিছু আল্লাহপাকের মর্জি।

প্রায় একবছর হয়ে এল শাকিল এখানে কাজ করছে। এর মধ্যে কয়েকবার বাড়ির সবাইকে দেখা দিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে বেগম সাহেব তাকে উপরে ডেকে ভালমন্দ জিজ্ঞেস করেন। তখন চৌধুরী সাহেব সেখানে থাকেন না। আজ রাতে চৌধুরী সাহেব তাকে ডেকে পাঠালেন।

উপরে এসে পর্দা ঠেলে রুমে ঢুকে শাকিল দেখল, চৌধুরী সাহেব একটা কৌচে বসে আছেন। সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

চৌধুরী সাহেব সালামের জবাব দিয়ে তাকে বসতে বললেন।

চৌধুরী সাহেবকে আজ সালামের জবাব মুখে দিতে শুনে শাকিল মনে মনে আল্লাহ পাকের শোকরগুজারী করল।

এমন সময় দরজার বাইরে হীরুর গলা শোনা গেল, মালিক।

চৌধুরী সাহেব বললেন, ভিতরে আয়।

হীরু ভিতরে এসে এক পাশে দাঁড়াল।

চৌধুরী সাহেব শাকিলকে বললেন, কাঞ্চনপুরে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তুমি নায়েবের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলবে। হীরুর ছেলে ফজু তোমার সঙ্গে যাবে। সে তার বাবার মতো সব বিষয়ে পারদর্শী। তোমাদের দুজনের কাছে ছুরী ও পিস্তল থাকবে। তবে সে খবর কেউ জানবে না। শুধু ফজুর হাতে লাঠি থাকবে। তারপর হীরুকে বললেন, তোর ছেলেকে এনেছিস?

জি মালিক। সে বাইরে অপেক্ষা করছে।

এখানে নিয়ে আয়।

হীরু বাইরে গিয়ে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল।

ফজু সালাম দিয়ে বাবার পাশে দাঁড়াল।

শাকিল তাকে লক্ষ্য করল, বাবার মতো অত লম্বা না হলেও বেশ হৃষ্টপুষ্ট বলিস্ট চেহারা। রংটা বাবার মতো বেশ কাল।

চৌধুরী সাহেব ফজুর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে শাকিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, পরশু বিকেলে কাঁচারির সামনের মাঠে তোমাদের দুজনের লড়াইয়ের প্রতিযোগীতা হবে। যে জিতবে সে পুরস্কার পাবে। তবে একটা কথা মনে রেখ, প্রতিযোগীতা করতে গিয়ে কেউ কাউকে আহত করবে না। অন্যায়ের আশ্রয় নেবে না। আমি দেখতে চাই, হীরু কাকে বেশি পারদর্শী করেছে। তারপর হীরুকে বললেন, তুই নায়েবকে গ্রামের সবাইকে জানিয়ে দিতে বলবি তারপর লড়াইয়ের ব্যবস্থা করবি।

লড়াইয়ের দিন দুপুরের পর থেকে কাঁচারি বাড়ির সামনের বিরাট মাঠে লোক ভেঙে পড়তে লাগল। একদিন আগে হীরু নায়েবকে মালিকের কথা ভেঁড়া পিটিয়ে দেয়ার কথা বলেছিল। নায়েব তাই করেছিলেন। এর আগেও চৌধুরী বাড়ির কাঁচারির সামনে এ রকম লড়াই হয়েছে। তখন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লাঠিয়ালদের ও লড়াকুদের খবর দিয়ে আনা হত। আজ চৌধুরী স্টেটের ম্যানেজার ও খোদ চৌধুরী সাহেবের বডিগার্ড হীরুর ছেলে ফজুর সঙ্গে লড়াই হবে শুনে আগের থেকে এবারে বেশি লোকের সমাগম হয়েছে। তারা জানে ফজু বাঘের বাচ্চা বাঘ। আগে বাইরের লাঠিয়াল ও লড়াকুদের সঙ্গে হীরু বিজয়ী হয়ে পুরস্কার লাভ করত। তারপর তার ছেলে ফজু সেই পুরস্কার প্রতি বছর লাভ করে আসছে। এবছর বাইরের কেউ আসেনি। শুধু ম্যানেজারের সঙ্গে ফজুর লড়াই হবে।

কাচারি বাড়ির বারান্দায় চৌধুরী সাহেব ও গ্রামের গণ্যমান্য লোকজন বসেছেন। বেগম সাহেব দোতালার বারান্দায় চিকের আড়ালে গ্রামের অনেক মেয়েদের সঙ্গে বসেছেন।

সময় মতো লড়াই শুরু হল। শাকিল ট্রাকসুট পরেছে আর ফজু হাফ প্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জী। প্রথমে লাঠিখেলা পরে তলোয়ার ও ছুরী খেলায় প্রত্যেকটায় প্রথমে দুজনে বেশ কিছুক্ষণ কেউ কাউকে হারাতে পারল না। শেষ দিকে ফজু হেরে গেল। তারপর সুটিং এ দুজনে ড্র করল।  

চৌধুরী বাড়ির সকলে এবং গ্রামের লোকেরা ম্যানেজার শাকিলকে একজন শিক্ষিত, ভদ্র ও ধার্মীক বলে জেনে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। সকলে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর করবে নাই বা কেন? এই এক বছরের মধ্যে গ্রামের উন্নতির জন্য অনেক কাজ করেছে। স্কুল, মাদ্রাসা ও মসজিদে সাহায্য করেছে। রাস্তা ঘাট মেরামত করেছে। গরিবদের সুবিধে অসুবিধের খোঁজ খবর নিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করেছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার গুরুত্ব বুঝিয়ে তাদের গার্জেনদের সাহায্য করে স্কুল মাদ্রাসায় পাঠাবার উৎসাহ দিয়েছে। ছোট বড় অনেককে নামায ধরিয়েছে। আজ তার লড়াই দেখে তাকে শ্রেষ্ঠ লড়াকু জেনে প্রশংসা করতে করতে ফিরে গেল। কিন্তু গ্রামের যারা মাস্তান ধরনের ছেলে, তাদের মনে ভীতির সঞ্চার হল। শাকিল ম্যানেজার হয়ে আসার পর তার আধিপত্য বেড়ে যেতে দেখে তারা আগে থেকে তার উপর রেগে ছিল।.আজ তাকে অন্যরূপে দেখে ভাবল, একে এখান থেকে সরাতে না পারলে আমরা কোনো কিছুতে সুবিধে করতে পারব না। একদিন তারা চেয়ারম্যান আমজাদ সাহেবকে তাদের মনের কথা জানাল।

শাকিল ম্যানেজার হয়ে আসার পর থেকে চেয়ারম্যানেরও ইনকাম কমে গেছে। তিনিও শাকিলের প্রতি খুব অসন্তুষ্ট। তাদের কথা শুনে বললেন, তোমরা আমার হয়ে কাজ করলে ঐ পুচকে ছোঁড়াটাকে জব্দ করতে বেগ পেতে হবে না। তোমরা এই গ্রামের ছেলে। তোমাদেরকে টপকে কোথাকার কে একটা ছোকরা মাতবরী করবে, তা তোমরা সহ্য করবে কেন? তবে জেনে রেখ ম্যানেজার চৌধুরী সাহেবের খুব পেয়ারের লোক। কাজটা খুব সাবধানে করতে হবে। চৌধুরী সাহেব জানতে পারলে কারোরই রক্ষে থাকবে না। তোমরা এখন যাও, সময় মত আমি তোমাদের ডাকব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *