অবগুণ্ঠিতা – পরিচ্ছেদ ১

০১.

শীতের সকাল।

রাস্তার ওপাশে কৃষ্ণচূড়ার গাছটা ফুলে ফুলে যেন রক্ত রাঙা হয়ে উঠেছে।

সুব্রত তার শয়নঘরে একটা আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে ঐদিনকার সংবাদপত্রটা খুলে চোখ বোলাচ্ছিল।

কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢাকা একটা গেরুয়া রঙের কাশ্মীরী শাল! পাশের টিপয়ের ওপরে রক্ষিত নিঃশেষিত চায়ের কাপটা।

ভৃত্য এসে একটা চিঠি সামনে ধরে বললে, দারোয়ান চিঠিটা দিলে। চিঠিটা লেটার-বক্সে ছিল।

সুব্রত হাত বাড়িয়ে চিঠিখানা ভৃত্যের হাত থেকে নিয়ে দেখল—আকাশ-নীল রঙের একখানা পুরু খাম!

চিঠিখানা নাড়াচাড়া করতে করতে সুব্রত বললে, তুই যা।

ভৃত্য ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

সুব্রত দেখল, ঘন ভায়োলেট রঙের কালিতে খামের উপরে পরিষ্কার ইংরেজি হরফে সুব্রতর নাম-ঠিকানা লেখা। চিঠিটা নিশ্চয়ই কেউ হাতে করে ডাকবাক্সে ফেলে গেছে।

সুব্রত খামটা ছিঁড়ে ফেলল।

ভিতরে সাদা কাগজে পরিষ্কার করে ঘন ভায়োলেট কালিতে লেখা বাংলায় একখানা চিঠি।

প্রিয় সুব্রতবাবু,

বিখ্যাত জুয়েলার ও ব্যাঙ্কার গজেন্দ্রকুমার সরকারকে নিশ্চয়ই চিনবেন। কারণ কলকাতা শহরে তিনি একজন টাকার কুমীর বললেও অত্যুক্তি হয় না। বহুদিন হল তার স্ত্রী মারা গেছেন। তার দুটি ছেলে। বড় গণেন্দ্র সরকার অনেকদিন হল বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে আলাদা হয়ে গেছেন। কলকাতা মহালক্ষ্মী ব্যাংকের এখন তিনি অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার। অবিবাহিত। ছোট ছেলে সৌরীন্দ্র বি.এস-সি পাস করে বাপের কাছেই থাকেন ও বাপের ব্যবসা দেখেন। বড় গণেন্দ্রের বয়স প্রায় বছর চল্লিশ হবে। ছোট সৌরীন্দ্র ছাব্বিশ-সাতাশ বৎসরের হবে। সংসারে সৌরীন্দ্র ছাড়াও একটি বোনপো অশোক, মেডিকেল কলেজের ফিফথ ইয়ারের ছাত্র। সংসারে তার আপনার বলতে এক বিধবা মা। গজেন্দ্রের একটিমাত্র ভগিনী পাবনায় দেশের বাড়িতে থাকেন।

অশোক গজেন্দ্রের অত্যন্ত প্রিয়। বোনপো অশোক ছাড়াও গজেন্দ্রের আর একটি পোয্য আছে। সে হচ্ছে বিনয়ে। গজেন্দ্রের বৈমাত্রেয় ভাই!

বিনয়ের একটি পা (বাম) জন্মাবধি একটু খোঁড়া। অত্যন্ত নিরীহ শান্তশিষ্ট, বি. এস-সি পাস করে মেডিকেল কলেজে ঢুকেছিল। কিন্তু সেকেণ্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়ে, পড়া ছেড়ে বছর। তিনেক হল নিষ্ক্রিয় হয়ে বাড়িতেই বসে আর্টের চর্চা করেন।

বিনয়েন্দ্রের যখন নয় বৎসর বয়স, তখন হঠাৎ বিসূচিকা রোগে একদিনেই দুঘণ্টার আগেপিছে গজেন্দ্রের পিতা ও বিমাতা মারা যান! ঐ গজেন্দ্রবাবুকেই আজ সকালে হঠাৎ তার শয়নঘরের সংলগ্ন লাইব্রেরি ঘরে মৃত অবস্থায় চেয়ারের উপরে বসে আছেন দেখা গেছে। আমার মনে হয় ওঁর মৃত্যুর সঙ্গে কোন রহস্য জড়িয়ে আছে! অর্থাৎ মৃত্যু তার স্বাভাবিক নয়। তাকে কেউ খুন করেছে বলে আমার ধারণা। আপনি যদি হত্যাকারীকে ধরিয়ে দিতে পারেন, তবে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হব। নমস্কার।

ইতি–

সরকারবাড়ির জনৈক বন্ধু।

চিঠিখানা আগাগোড়া এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললে সুব্রত। সুব্রত যেন একটু আশ্চর্যই হয়। কে এমন চিঠি লিখতে পারে—ব্যাপারটা কি সত্যি?

চিঠিখানা আরও একবার আগাগোড়া পড়ে ফেলল সে। তারপর কৌচ থেকে উঠে ঘরের কোণে রক্ষিত টেলিফোনের কাছে গিয়ে দেওয়ালের গায়ে লোহার হুকে টাঙানো টেলিফোন গাইডটা হাতে নিয়ে দ্রুত পাতা ওলটাতে লাগল।

সহজেই সুব্রত ব্যাঙ্কার ও জুয়েলার মিঃ গজেন্দ্র সরকারের ফোন নম্বরটা খুঁজে পেল। ডায়েলটা ঘুরিয়ে ওই নম্বরটা লাগাতেই ওপাশ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যে জবাব এল, হালো?

এটা কি জুয়েলার ব্যাঙ্কার গজেন সরকারের বাড়ি? সুব্রত প্রশ্ন করলে।

হ্যাঁ, কে আপনি?

সুপার সুব্রত রায়। বাড়ি থেকে কথা বলছি…আপনি কে?

কে, মিঃ রায়? আমি তালুকদার…

কে মফিজউদ্দিন?

হ্যাঁ। আপনি শুনেছেন নাকি কিছু? হঠাৎ আজ সকালে মিঃ সরকারকে তার…

আমি জানি—এখুনি আমি যাচ্ছি। সুব্রত তালুকদারকে আর কোন জবাব দেবার অবকাশ মাত্র না দিয়ে ফোনটা নামিয়ে রেখে, ক্ষিপ্রহস্তে বেশভূষা করে নিয়ে সোজা নীচে এসে গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বের করে স্টার্ট দিল।

গাড়ি বড় রাস্তায় এসে পড়ল।

মাঘের মাঝামাঝি। শীতের সকাল। বেলা প্রায় সাড়ে নয়টা হবে, আমহার্স্ট স্ট্রীটের মোড়ে বসন্ত কেবিনে চা-সেবীদের প্রচণ্ড ভিড়।

সোমবার। রেস্টুরেন্টে রেডিও সেটে পংকজ মল্লিকের রবীন্দ্র সংগীত হচ্ছে।

শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন,
আমলকির ঐ ডালে ডালে…

ট্রামে বাসে এর মধ্যেই অফিসমুখো বাবুদের ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেছে।

মিঃ সরকারের বাড়ি আপার সারকুলার রোডে মানিকতলা বাজারের কাছাকাছি।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই সুব্রত মিঃ সরকারের আধুনিক কেতায় নির্মিত প্রাসাদোপম। অট্টালিকার গেটের মধ্যে এসে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করল।

লোহার গেট। একপাশে শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা মর্মরাবাস। অন্য পাশে পিতলের প্লেটে লেখা, মিঃ জি, সরকার।

গেটের সামনেই দারোয়ানের পাশে একজন লালপাগড়ি মোতায়েন ছিল। সুব্রতকে গাড়ি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে দেখে সেলাম দিল এবং পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল। সুব্রত একেবারে গাড়িবারান্দার নীচ বরাবর এসে গাড়ির ব্রেক কষল।

গাড়ি থেকে নামতেই সামনে দরজার গোড়ায় আরও দুজন লালপাগড়ি। লালপাগড়ি দুজনেই সুব্রতকে বেশ ভালভাবেই চিনত। সেলাম ঠুকে তারাও পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল।

সুব্রত গিয়ে সামনের ঝুলন্ত দামী পর্দাটা সরিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।