অবগুণ্ঠিতা – পরিচ্ছেদ ১১

১১.

কিন্তু এমনি করে বসে থাকলে তো চলবে না।

মুক্তির একটা কিছু উপায় বের করতেই হবে। আবার তখন দ্বিগুণ উৎসাহে সুব্রত উঠে দাঁড়াল। এবারে সে হাতের টর্চটা জ্বেলে আলো ফেলে ফেলে ঘরের মেঝেটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করল।

শক্ত সিমেন্টে গড়া মেঝে। লোহার মত কঠিন।

প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ ধুলো পুরু হয়ে জমে আছে।

ধুলো সরিয়ে সরিয়ে সুব্রত মেঝে ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। হঠাৎ এক জায়গায় ওর নজরে পড়ল, একটা লোহার উঁচু বন্টুর মত কী যেন মেঝে থেকে উঁচু হয়ে আছে।

সুব্রত তখন সেটাতে নিয়ে প্রবল উৎসাহে নাড়াচাড়া করতে শুরু করল। কিন্তু সেটা মেঝের সিমেন্টের সঙ্গে একেবারে গাঁথা।

সুব্রত ভাবলে এটা যখন মেঝেতে আছে, এর একটা উদ্দেশ্যও নিশ্চয়ই আছে।

হঠাৎ মেঝেতে একটা লোহার বন্টুর মতই থাকতে যাবে কেন?

সুব্রত আবার আলো ফেলে ফেলে ঘরের মেঝের সর্বত্র খুঁজে দেখলে। কিন্তু আর কোথাও ও রকম লোহার বন্টু তার নজরে পড়ল না।

সুব্রত যখন অনেক চেষ্টা করে ও গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও সেটাকে এতটুকু নড়াতে পারল না, তখন সে তার ছুরিটা দিয়ে বন্টুর চারপাশে কুরে কুরে ফেলতে লাগল।

ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বল্টুটা আরও একটু সজাগ হয়ে উঠল। এবার হঠাৎ কী ভেবে সুব্রত বন্টুটার ওপরে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড একটা চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘড়ঘড় শব্দ। চোখের। নিমেষে বন্টুটার ঠিক হাতখানেক দূরে মেঝের পাথর সরে গিয়ে একটা গোলাকার গর্ত দেখা গেল। সুব্রত এক লাফ দিয়ে সেখান থেকে সরে দাঁড়াল।

বুকটার মধ্যে তখনও তার উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে।

সুব্রত এগিয়ে এসে গর্তটার মুখে আলো ফেলল। দেখল মেঝেতে যেখানে পাথর সরে গিয়ে ফাঁক হয়ে গেছে, সেখানে একটা গোলাকার সিমেন্টের ঢাকনা মত নিচের দিকে ঝুলছে। গর্তের মুখে ও আবার আলো ফেলল। ধাপে ধাপে অপ্রশস্ত সিঁড়ি নীচে কোন্ অন্ধকার গহ্বরে নেমে গেছে কে জানে! ও এতক্ষণে বুঝতে পারলে এটা একটা গোপন সুড়ঙ্গ পথ। কোন স্প্রিং বা ওই জাতীয় কিছুর সাহায্যে কাজ করে।

সুব্রত মনে মনে ভাবলে, আশ্চর্য! জানি না এই সিঁড়ি কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে। এই সিঁড়ি ধরে এগোলে শেষ পর্যন্ত কোথায় যেতে হবে কে জানে? হয়তো বা সাক্ষাৎ মৃত্যুর গহ্বর বরাবর। চলে গেছে। এখন এই পথ ধরে অগ্রসর হওয়া উচিত কিনা? কিন্তু অগ্রসর না হয়েই বা লাভ কী? এইখানে এই ঘরের মধ্যে বসে থাকলেও তো মুক্তির কোনই উপায় হবে না। এখানে তাকে এইভাবে বন্দী করে রেখেছে শত্রুপক্ষ, তারা নিশ্চয়ই আরামে বসে থাকবে না। তারা যদি দলে ভারী হয় এবং তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র থাকে, তবে মুক্তির পথ আরও দুরূহ হওয়াই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় বিবেচনা করে দেখতে গেলে অগ্রসর হওয়াই উচিত। হয়তো বা এই পথের শেষে মুক্তি মিললেও মিলতে পারে। চান্স একটা নেওয়া দরকার।

সুব্রত উঠে দাঁড়াল। হ্যাঁ, সে এই পথ ধরেই অগ্রসর হবে।

সুব্রত গর্তের ভিতরে নামল এবং সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল। উঃ, কী অন্ধকার। গাঢ় কালির মতই শ্বাসরোধকারী জমাট-বাঁধা অন্ধকার।

সুব্রত সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে একবার থমকে দাঁড়াল। কোন শব্দ শোনা যায় কিনা?

না, কিছুই শোনা যায় না।

সুব্রত আবার সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। এক, দুই। এমনি করে প্রায় বারোটা সিঁড়ির ওপরে ওর পা সমতলভূমিতে ঠেকল।

ও দাঁড়াল। হাতের টর্চটা জ্বেলে ও চট করে একবার তার আশপাশ আলোতে দেখে নিল। সরু অপ্রশস্ত গলিপথ। কিন্তু কোথায় গিয়ে যে ঐ পথ শেষ হয়েছে কিছুই তার বোঝবার উপায়। নেই। যেন বিরাট একটা কালো অজগর মুখব্যাদান করে আছে।

সুব্রত আবার অগ্রসর হল।

বোধ হয় দশ পাও সে অগ্রসর হয়নি, সহসা কার তীব্র কণ্ঠস্বর নির্ঘোষে ওর কানে এসে। বাজল, থাম!

তারপরেই একটা তীব্র আলোর রশ্মি ওর চোখেমুখে এসে সুতীব্র ঝাপটা দিল।

কিহে মাস্টার, চলেছ কোথায়?

বিস্ময়ে ও ঘটনার আকস্মিকতার সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

ও দেখলে গলিপথ কখন প্রশস্ত হয়ে গেছে, সামনে যমদূতের মত দুজন লোক তাদের দুজনেরই হাতে উদ্যত পিস্তল।

সুব্রত তার হাতের টর্চটা জ্বাললে এবং নিঃশব্দে লোক দুটোর মুখের ওপরে প্রতিফলিত করল। শান্ত অবহেলার ভঙ্গিতে লোক দুটি দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তাদের কঠোর সংকল্পের নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি।

সুব্রত নিরস্ত্র। সম্বল মাত্র জাপানী ছুরিটা! দুটো পিস্তলের কাছে ওটা কিছুই নয়।

সুব্রত চকিতে তার আশেপাশে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে দেখে নিল। সামনের গলিপথটা প্রশস্ত হয়ে গেছে। সামনেই দেখা যায় দুদিককার দেওয়ালে দুটো দরজা। একটার কবাট বন্ধ, অন্যটার খোলা। খোলা কবাটের সামনেই লোক দুটো দাঁড়িয়ে।

তিনজনেই নিস্তব্ধ, নিঝুম। কারও মুখে কোন কথা নেই। যেন একটা বরফের মত ঠাণ্ডা নিস্তব্ধতা—অন্ধকারে কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। সহসা আবার সুব্রত তার টর্চের আলো একজনের মুখের ওপরে প্রতিফলিত করলে। লোকটা হঠাৎ চোখটা বুজে ফেললে মুহূর্তের জন্য। আর সেই মুহূর্তের অবকাশে সুব্রত চোখের পলকে মরিয়া হয়ে বিড়ালের মত নীচু হয়ে বসে পড়ে লোকটার পায়ে এক লাথি মারলে।

লোকটার হাতে টর্চ ছিল। সে হঠাৎ ঐভাবে আক্রান্ত হয়ে একপাশে ছিটকে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চীৎকার করে উঠল। লোকটার হাত থেকে টর্চ ও পিস্তলটা ছিটকে পড়ল মাটিতে।

অন্য লোকটা ততক্ষণে সুব্রতর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সুব্রত তাকে জাপানী যুযুৎসুর প্যাচে মুহূর্তে ধরাশায়ী করল।

অন্য লোকটার পায়ে বেশ চোট লেগেছিল। কিন্তু তবু সে উঠে বসেছে। সুব্রত তাকে আক্রমণ করবার সুযোগমাত্র না দিয়ে আবার যুযুৎসুর পাঁচে ধরাশয়ী করলে এবং পরক্ষণেই সে আলো জ্বেলে প্রথমেই পিস্তল দুটো করায়ত্ত করে নিল।

একটা পিস্তলের লোহার বাঁট দিয়ে উঠে বসা লোটারই মাথায় প্রচণ্ড এক আঘাত করতেই লোকটা অস্ফুট কাতর শব্দ করে তখুনি আবার জ্ঞান হারিয়ে ঘুরে পড়ে গেল। দ্বিতীয় লোকটা

তখন উঠে বসে সুব্রতর দিকে পিটপিট করে চাইছে।

সুব্রত লোকটার দিকে এগিয়ে এসে তার মাথায় পিস্তলের নলটা দিয়ে একটা মৃদু খোঁচা দিয়ে ব্যঙ্গ করে বললে, কি হে বন্ধু, কেমন মনে হচ্ছে এখন! লক্ষ্মী ছেলের মত উঠে দাঁড়াও তো দেখি।

লোকটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।

শোন সোনার চাঁদ, যা বলব আমি তাই কর তো দেখি। নইলে আমার হাতে পিস্তল—

লোকটা দেখতে যেমন মোটা, তেমনি লম্বা-চওড়া।

মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় ঝড়া আঁড়া চুল—বিস্ত, এলোমেলো।

ডান দিককার কপালে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন। চোখ দুটো গোল কুতকুতে। দৃষ্টি নিষ্ঠুর ধারাল ছুরির ফলার মতই। রক্তলালসায় হিংস্র যেন।

পরিধানে সাধারণ কুলিদের মত ময়লা ধুতি ও একটা কোর্তা।

লোকটা তার কুতকুতে দৃষ্টিতে সুব্রতর মুখের দিকে চেয়ে ভারী খনখনে গলায় বললে, কি চাও তুমি?

এই সুড়ঙ্গ থেকে প্রথমে বের হতে চাই। লক্ষ্মী ছেলের মত এখন আমায় বের হবার পথ দেখিয়ে দাও দেখি সোনার চাঁদ!

বেশ, চল। লোকটি অগ্রসর হল।

লোকটার পিছু পিছু সুব্রতও অগ্রসর হল।