অপহরণ-২.৯

নয়

মোলাঞ্জা রমিউলাসের সামনে চীনা মাটির প্রকাণ্ড একটা ধূমায়িত গামলা, পাশেই একটা রুপোর থালা। গামলাটা মশলাদার চর্বি আর মাংসে টইটর, থালায় ঘরে তৈরি রুটির পাহাড়। নিউ ইয়র্ক থেকে আসা লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকেই আবার মস্ত হাঁ করল সে, ভেতরে চালান হয়ে গেল কয়েক টুকরো লালচে মাংসের সাথে গোটা একটা রুটি। ‘কল’িয়ান শিপমেন্টের খবর কি?’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘ওগুলোর তো দারুণ চাহিদা হওয়ার কথা।’

‘তা হওয়ার কথা,’ লোকটা বলল। ‘কিন্তু কিছু ডিস্ট্রিবিউটর তাদের মেক্সিকান মাল কল’িয়ান বলে চালাবার চেষ্টা করছে। কাজেই সমস্ত মালকেই সন্দেহের চোখে দেখছে সবাই। এই ঝামেলাটা না মেটা পর্যন্ত কেউ কিছু কিনবে না।’

‘কোন্ ডিস্ট্রিবিউটর?’

‘ইটালিয়ান।’

‘হুঁ।’ ছোট, চোঙ আকৃতির মাথাটা নাড়ল মোলাঞ্জা রমিউলাস। গ্লাস ভর্তি ওয়াইন এক চুমুকে শেষ করে আবার ভরে দেয়ার ইঙ্গিত করল।

‘এখন আপনি যা ঠিক করেন, স্যার,’ বলল লোকটা।

ছোটখাট রমিউলাস ভরা ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে চেয়ার ছাড়ল। ‘হ্যাঁ।’ টেরেসের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল সে। তার এই বাড়ি, বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই উচিত, ডেলফি গ্রাম থেকে অনেক ওপরে পারনাসাস পাহাড়ের ঢালে তৈরি করা হয়েছে। টেরেস থেকে নিচে তাকালে গ্রাম ছাড়িয়ে আরও বহুদূর দৃষ্টি চলে, অ্যাপোলোর মন্দির দেখা যায়, চাঁদের আলোয় কেমন যেন ভৌতিক আর রোমাঞ্চকর মনে হয়। একটু দূরে ছোট কিন্তু আরও প্রশান্ত অ্যাথেন প্রোথেন মন্দির। তারপর, পাহাড়ের পাদদেশ ঘিরে থাকা সবুজ জলপাই ঝোপ। তারপর উপসাগর, উপসাগরের ওপারে প্যাট্রাস-এর আলো।

তার পিছনে চাঁদের আলো মাখা আকাশের গায়ে প্রায় খাড়াভাবে উঠে গেছে পাহাড়। এই চূড়া থেকেই তো অ্যাপোলো এক সময় পারসিয়ান সেনাবাহিনীকে পাথর ছুঁড়ে থামিয়ে দিয়েছিলেন। সেই একই চূড়ায় বসে অবৈধ ব্যবসার বিশাল জাল তৈরি করেছে মোলাঞ্জা রমিউলাস প্রায় গোটা পৃথিবী জুড়ে।

মারিজুয়ানার খেতে মেক্সিকো সরকার যতদিন খুশি বিষ স্প্রে করুক, তার কিছু করার নেই ওখানে। ইটালিয়ানরা মেক্সিকোর বিষাক্ত মারিজুয়ানা কল’িয়ান বলে চালাবার চেষ্টা করছে করুক। সব রসাতলে যাচ্ছে এমনটি মনে করার কোন কারণ নেই। তার সঙ্গতি আছে, কাজেই উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার কি?

ছোট ছোট চুমুক দিয়ে গ্লাসটা শেষ করল রমিউলাস। তারপর নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধির দিকে ফিরল। ‘মাল সব গুদামজাত করো,’ বলল সে। ‘মউজুদ ভাল ব্যবসা। আগামী বছর এই মাল দ্বিগুণ দামে বিক্রি হবে।’ একজন চাকর ভেতরে ঢুকতে মুখ তুলে তাকাল সে।

‘একজন ভিজিটর, স্যার। আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।’

চোঙ আকৃতির মুখ বিকৃত হয়ে উঠল রমিউলাসের, যেন ভেংচাল। ‘কারও সাথে আমি এখন দেখা করব না।’

‘উনি একজন প্রিস্ট। সামনের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন।’

‘প্রিস্ট হোক বা আর্চবিশপ হোক, বিদায় করো!’

কিন্তু চাকর নড়ল না। ‘আপনাকে উনি বলতে বললেন, তাঁর নাম ফাদার মলিউস-আপনাকে নাকি পাঁচ বছর আগে চিনতেন।’

জমাট পাথর হয়ে গেল মোলাঞ্জা রমিউলাস। তার চেহারায় একাধারে রাগ এবং ভীতির ছাপ ফুটে উঠল। স্থির দাঁড়িয়ে থাকল সে। ধীরে ধীরে চোখ জোড়া ছোট হয়ে এল।

ফাদার মলিউস! মাই গড, ফাদার মলিউস? আবার কি চায় ওরা?

নিঃশব্দে ইঙ্গিত করল রমিউলাস, নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধি বিদায় নিয়ে চলে গেল।

চাকরের দিকে ফিরল রমিউলাস। ছোটখাট একটা দৈত্যই বলা যায় লোকটাকে, সাদা জ্যাকেটের তলায় হোলস্টারে রিভলভার আছে। তাকে কাছে ডেকে নিচু গলায় বলল রমিউলাস, ‘ভালমানুষ ফাদারকে বোলো তিনি দয়া করে আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি। যাও, তাঁকে সম্মানের সাথে নিয়ে এসো। কিন্তু তারপর কাছেপিঠেই থেকো।’

প্রজেক্ট মলিউস-সি.আই.এ-র সহজ একটা অপারেশন ছিল। লৌহ-যবনিকার অন্তরালে, একজন লোককে প্যারাস্যুট যোগে নামানো। জায়গাটার নাম ক্যারেলিয়া পেনিনসুলা, ওখানে রাশিয়ানদের বেশ কয়েকটা টপ-সিক্রেট ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে।

লোকটাকে পাঠানো হবে, কিন্তু সে ধরা পড়লে সি.আই.এ-র সাথে তার সম্পর্ক আছে এটা প্ৰকাশ পাওয়া চলবে না—এই ছিল সমস্যা। সমাধানের দায়িত্ব চাপানো হয় মোলাঞ্জা রমিউলাসের ওপর। সে তার ব্যক্তিগত বিশাল বিমান বহর থেকে একটা বিমান ব্যবহার করতে দেয়। অবশ্যই স্বেচ্ছায় নয়।

তার বিরুদ্ধে প্রমাণ ছিল সি.আই.এ-র হাতে। মৌখিক প্রমাণ নয়, সই করা কাগজ-পত্র, ফটো, ইত্যাদি। যা ফাঁস হয়ে গেলে বাকি জীবন জেলখানায় কাটাতে হত তাকে।

সেটা পাঁচ বছর আগের ঘটনা। আর কখনও তার সাহায্য চাওয়া হবে না, ওদের এই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করেছিল সে। অথচ আবার ফিরে এসেছে।

কি মনে করে!

টেরেসে উদয় হলো ধর্মযাজক। লম্বা একহারা গড়ন, সারা মুখে কালো দাড়ি, পরনে গ্রীক অর্থোডক্স প্রিস্টের ঢিলেঢালা আলখাল্লা।

‘ফাদার মলিউস।’

রানা মাথা ঝাঁকাল।

‘আবার আপনারা কি চান আমার কাছে?’

‘সেই একই জিনিস, আগে যা চেয়েছিলাম। আপনার সহযোগিতা।

গ্রীক ব্যবসায়ী একটা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করল, তারপর নিজে আরেকটায় বসল। চেয়ারে হেলান দিয়ে ফাদারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল সে। ‘আবার ক্যারেলিয়া পেনিনসুলায়?’

‘না,’ বলল রানা। ‘এবারকার টার্গেট নিউআর্ক।’

‘নিউআর্ক?’ বিমূঢ় দেখাল রমিউলাসকে। তারপর মাথাটা পিছন দিকে হেলিয়ে সশব্দে হেসে উঠল সে। ‘আপনি ঠাট্টা করছেন! নিউআর্ক, নিউ জার্সি?’

‘নিউআর্ক, নিউ জার্সি,’ ওকে নিশ্চিত করল রানা।

‘কিন্তু কেন?’

‘কারণ যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার জন্যে নিউআর্ককেই নিয়মিত ব্যবহার করেন আপনি। কারণ ওখানে আপনার টাকা-খাওয়া প্রচুর অফিসার আছে যারা আপনার আসা-যাওয়া নিরাপদ করে তোলে।

রমিউলাস হাসল। ভাবল, লোকটা বেশ গুছিয়ে কথা বলতে জানে। ‘তা ঠিক,’ বলল সে। ‘নিউআর্কে যাওয়ার নিজস্ব রাস্তা আমার আছে।’

‘আর আপনার সাথে,’ বলল রানা, ‘আমার যাওয়ারও একটা উপায় হতে পারে।’

‘আমার সাথে?’

মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘প্লেনে আপনাকেও থাকতে হবে।’

ঘন ঘন মাথা নাড়ল রমিউলাস। ‘না, অসম্ভব। প্লেনে আমি চড়ি না। ‘

‘জানি,’ বলল রানা। ‘দুর্ঘটনায় আরেকটু হলে মারা যাচ্ছিলেন, ভয়টা এখনও কাটেনি। তিন বছর-হ্যাঁ।’

‘কি তিন বছর?’

‘তিন বছর আপনি প্লেনে চড়েননি।’

রমিউলাস তাকিয়ে থাকল। কিছুই কি সি.আই.এ-র অজানা থাকে না?

‘আপনাকে আমি ভাল একটা ফি দিতে রাজি আছি,’ বলল রানা।

রমিউলাস হাসল। ‘টাকা দিয়ে আমার সিদ্ধান্ত বদলাবেন?’

‘টাকা নয়। একটা নাম?’

রমিউলাসের চোখ সরু হয়ে উঠল।

‘আপনার বিরুদ্ধে ডকুমেন্টগুলো সি.আই.এ-র হাতে তুলে দিয়েছিল যে লোক,’ বলল রানা। ‘লোকটা আপনার প্রতিষ্ঠানেই ছিল-আজও আছে। তার নামটা আপনি জানতে চান না?’

রমিউলাস চোখ বুজল। গত পাঁচ বছর ধরে প্রশ্নটা কাঁটার মত বিঁধছে তার বুকে। কে সেই বেঈমান? চোখ খুলল সে। ‘কে সে?’

‘আপনি আমার সাথে নিউআর্কে যাবেন?’

এক মুহূর্ত ইতস্তত করল রমিউলাস। তারপর সে জিজ্ঞেস করল, ‘কবে আপনি রওনা হতে চান?’

‘আজ রাতে।’

‘আজ রাতে?’

‘এখুনি।’

.

রিসিভার নামিয়ে রাখলেন জেফ রিকার্ড, প্রেসিডেন্টের স্টাডিরূমে পায়চারি শুরু করলেন, আপনমনে এদিক ওদিক মাথা নাড়ছেন। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে খুঁজে বের করা গেছে, তার কাছ থেকে জানা গেছে এথেন্স এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ওমোনিয়া স্কয়ারে গিয়েছিল রানা।

ওমোনিয়া স্কয়ার? আরেকটু সামনেই তো সি.আই.এ. এথেন্স স্টেশন! ফোন করে মূল্যবান আরও কয়েকটা তথ্য পাওয়া গেছে। হ্যাঁ, ওখানেই গিয়েছিল রানা। আধ ঘণ্টা পর বেরিয়ে আসে সে।

তবে এবার রানা একটা ভুল করেছে।

একটা সূত্র ফেলে গেছে ও! উত্তরটা নিশ্চয়ই আর লেখা দেরাজে আছে, কোন সন্দেহ নেই। কিছু একটা দেখতে চেয়েছিল রানা, অবশ্যই রিজওয়ের ফাইলে নয়। রিজওয়ের ফাইলের সাথে আরও অনেক ফাইল আছে, প্রত্যেকের নামের প্রথম অক্ষর আর।

ওই একই ফাইল ল্যাংলির কমপিউটর টেপেও আছে। যা-ই রানা দেখতে চেয়ে থাকুক, সারারাত লেগে গেলেও, ঠিকই তিনি খুঁজে বের করবেন সেটা।

বের করতেই হবে। রানা একবার ভুল করেছে, দ্বিতীয়বার না-ও করতে পারে।

.

একটু মাথা ঘামাতেই পিকেরিং বুঝল, রিজওয়ের নয়, রানা আসলে রমিউলাসের ফাইল দেখে গেছে।

রিসিভার তুলে কেলীর নাম্বারে ডায়াল করল সে। বিশ মিনিট পর অফিস থেকে কেলী তাকে ফোন করল। হ্যাঁ, রমিউলাসের ফাইল থেকে একটা পাতা চুরি গেছে। গ্রীক ইন্টেলিজেন্সে সি.আই.এ-র লোক আছে, তার সাথে এরই মধ্যে যোগাযোগ করে কেলী জেনেছে, রমিউলাসের একটা জেট উত্তর ডলফির এয়ার স্ট্রিপ থেকে একঘণ্টাও হয়নি টেক-অফ করেছে। রমিউলাস নিজে আছে প্লেনে, সাথে দু’জন বডিগার্ড, আর একজন গ্রীক অর্থোডক্স প্রিস্ট।

প্লেনের গন্তব্য-নিউআর্ক, নিউ জার্সি।

টিউলিপকে উদ্ধার না করে আমেরিকায় ফিরে যাওয়া উচিত হবে না, পিকেরিং জানে। মস্ত ঝুঁকি নেয়া হয়ে যায়। কিন্তু রানা রমিউলাসের প্লেনে রয়েছে, তারমানে নিশ্চয়ই রানার সাথে টিউলিপও আছে?

সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল পিকেরিং। এই সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। বড় একটা প্লেন দরকার তার, বড় আর শক্তিশালী। মাঝখানে রিফুয়েলিঙের দরকার হবে না, একটানে পৌঁছে যাবে নিউআর্ক, নিউ জার্সি।

রিসিভার তুলে আবার ডায়াল করল পিকেরিং, এবার অ্যারোফ্লটের নাম্বারে। নির্দিষ্ট একজনকে চাইল সে। আপন মনে হাসছে। গোটা ব্যাপারটার সাথে প্রজেক্ট মলিউসের প্রচুর মিল আছে, তবে এবারেরটা আরও বেশি কৌতুককর। এবার রমিউলাস মাসুদ রানাকে ডেলিভারি দেবে পিকেরিঙের হাতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *