অপহরণ-২.১৩

তেরো

ধনুকের মত বাঁকা হয়ে নেমে এসেছে সিঁড়িটা। পরিচিত সিঁড়ি, তবু হোয়াইট হাউসের ঝুল-বারান্দা থেকে গ্রাউণ্ড ফ্লোরে নামার সময় কেমন যেন দিশেহারা বোধ করলেন পামেলা কনওয়ে। মন ভাল নেই, নাকি শরীরও খারাপ? নিচে প্রচুর লোকজন, বেশিরভাগই তাঁর পরিচিত, অথচ কয়েক মুহূর্ত তাদের কাউকেই তিনি চিনতে পারলেন না। মাসুদ রানা নামে কিডন্যাপার লোকটা কি এদের মধ্যে আছে? যদি থাকে, কোথায় সে? কে সে? তাকে চেনার কি কোন উপায় নেই?

আছে! তার সাথে টিউলিপ থাকবে!

সত্যিই কি থাকবে? সত্যিই কি টিউলিপকে ফিরিয়ে দেবে লোকটা? একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ধীরে ধীরে নামতে লাগলেন তিনি। মাথার ভেতর কত রকম দুশ্চিন্তা আনাগোনা করছে। জেফ হয়তো নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে মিথ্যে আশ্বাসবাণী শুনিয়েছে তাঁদের। টিউলিপ হয়তো… অনেক কষ্টে চিন্তার লাগাম টেনে ধলেন তিনি।

ভিড়ের মধ্যে স্বামীকে দেখতে পেলেন পামেলা। পুরানো বন্ধুদের সাথে গন্ধ করছেন প্রেসিডেন্ট, পুরুষ আর মহিলারা ঘিরে আছে তাঁকে, এরা সবাই তাঁর সেই কংগ্রেসে থাকাকালীন সুহৃদ।

রঙিন পর্দার ফাঁক দিয়ে ফালি ফালি রোদ ঢুকছে ভেতরে। হোয়াইট হাউস কর্মীরা সাদা জ্যাকেট পরে হট ডগস, হ্যামবার্গার, আইসক্রীম, আর কটন ক্যাণ্ডি পরিবেশন করছে। চারদিকে কচি কচি ছেলে-মেয়েদের ভিড়। কংগ্রেস সদস্য আর সিনেটরদের সন্তান ওরা, পিকনিকে এসেছে। কেউ কেউ বাবা-মার গায়ের সাথে সেঁটে আছে, বেশিরভাগই দৌড়াদৌড়ি করছে লনের ওপর-গাছে চড়ছে, লুকোচুরি খেলছে, ফোয়ারার কাছে সফট বল খেলছে।

বাচ্চাদের দেখতে দেখতে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল পামেলা কনওয়ের। সবাই আছে, শুধু নিজের বাচ্চাটা এখানে নেই।

চারদিকে হাসি-আনন্দ, উৎসব-উৎসব ভাব। ছোঁয়াচে। উঁচু মঞ্চের স্কয়্যার ডান্সাররা এইমাত্র একটা অনুষ্ঠান শেষ করে নতুন আরেকটা ধরল। সংগীতের তালে তালে খোকা-খুকিরা মার্চ করে গেল লনের এক দিক থেকে আরেক দিকে। আবার তারা ফিরে আসছে। তাদের সাথে ভিড়ে গেল পামেলার পরিচিত একজন সিনেটর, বয়স আশির ওপর। নিজের অজান্তেই হেসে ফেললেন পামেলা। আরেক মঞ্চে যাদু খেলা দেখানো হচ্ছে। খালি তালু থেকে রঙচঙে মাছ বের করছে যাদুকর, একের পর এক অনেকগুলো। আরেক দিকে পুতুল নাচের আসর বসেছে। ক্লাউনরা ঘুরে বেড়াচ্ছে কিম্ভূতকিমাকার চেহারা নিয়ে। চারদিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে পামেলা আন্দাজ করলেন, অতিথিদের সংখ্যা হাজার না ছাড়ালেও, কাছাকাছি হবে।

স্বামীর সাথে পামেলাও কংগ্রেস সদস্যা ছিলেন। ওঁরা চলে আসার পর কংগ্রেস অনেক বদলে গেছে। চারদিকে এমন অনেক মুখ ঘুরে বেড়াচ্ছে যাদের তিনি চেনেন না। ওদের মধ্যে কে অতিথি কে সিকিউরিটি গার্ড তাও বোঝার কোন উপায় নেই।

এদের মধ্যে কেউ একজন মাসুদ রানা? সে কি সত্যি এসেছে? নাকি এখনও পৌঁছায়নি, তবে আসবে?

টিউলিপকে অন্য কোথাও যদি রেখে আসে?

তাঁর মাথা ঘুরে উঠল। নিজের জায়গায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করলেন তিনি। আচ্ছন্ন ভাবটা একটু পরই কেটে গেল। ভাবলেন, জেফের প্ল্যান সফল হতেও পারে, নাও পারে। প্ল্যানটা মোটামুটি মন্দ না। বড় একটা পিকনিকের আয়োজন করা, রানা যাতে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সুযোগটা নেয়। সে যদি টিউলিপকে ফিরিয়ে দিতে চায়, তবেই আসবে, তাই না? প্ল্যানটা জেফের, আয়োজনটাও তার। পিকনিক হবে হোয়াইট হাউসের লনে, নিরাপত্তার ব্যবস্থা হবে নামমাত্র। নিমন্ত্রণ পাবে শুধু কংগ্রেস আর সিনেটর পরিবারগুলো। নিমন্ত্রণ পত্রে লেখা থাকবে, ছেলেমেয়েদের অবশ্যই সাথে আনতে হবে।

শর্তটা রানার জন্যেও প্রযোজ্য।

তবে জেফ কোন গ্যারান্টি দেয়নি। সম্ভাবনা আছে ফাঁদে পা দিতে পারে রানা, তার বেশি কিছু না।

চিন্তায় ছেদ পড়ল, পামেলা দেখলেন সপরিবারে একজন সিনেটর তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করলেন তিনি। হাসলেন জোর করে।

কেউ জানে না টিউলিপ কিডন্যাপ হয়েছে। সম্পূর্ণ শান্ত আর স্বাভাবিক থাকতে হবে তাঁকে। সবার সাথে কথা বলতে হবে। হাসতে হবে। সবার সাথে বসে খেতে হবে।

কেন? আমার মেয়ের কোন খবর নেই, আমি কেন হাসব? ‘হাই!’ সিনেটরের স্ত্রী জড়িয়ে ধরলেন পামেলাকে।

‘হাই!’ সাড়া দিয়ে বান্ধবীর উÌ আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করলেন ফার্স্ট লেডি। হাসছেন তিনি। কুশলাদি জানতে চাইছেন।

জোর করে হাসলেও, তার একটা প্রতিক্রিয়া আছে। হঠাৎ করেই পামেলা কনওয়ের মনে হলো, প্ল্যানটা সফল হবে। আসবে রানা। মেয়েকে আবার ফিরে পাবেন তিনি।

সিনেটর তার ছোট্ট দল নিয়ে আরেক দিকে সরে গেল। স্বামীর দিকে তাকালেন পামেলা। প্রেসিডেণ্ট কাছাকাছিই রয়েছেন, তবে তাঁর দিকে পিছন ফিরে। পামেলা জানেন, এই ভিড়ের মধ্যে স্বামী তাঁকে সান্ত্বনা দিতে পারবেন না, তবু তাঁর পাশে থাকতে ইচ্ছে করল। আর কিছু না হোক, চোখের দৃষ্টি, হাতের একটু চাপ, এ-সবও এখন পরম শান্তি এনে দেবে তাঁর মনে। এ-সব এখন তাঁর দরকার। জানেন, তাঁর স্বামীও এ-সবের জন্যে কাঙাল হয়ে আছেন।

কিন্তু এত কাছে, তবু যেন দু’জনের মধ্যে এক সাগর ব্যবধান। এদিক ওদিক থেকে ডাক এসে তাঁকে থামিয়ে দিল, একদিক থেকে আরেক দিকে যেতে হলো। স্বামীর সামনে দাঁড়াবার সুযোগ পাওয়া গেল না।

ওয়েজ অ্যাণ্ড মীনস চেয়ারম্যান তাঁর পথ আগলে ধরল, বাধ্য হয়ে তার স্ত্রীর সাথে করমর্দন করলেন পামেলা। বাড়িয়ে দেয়া আরেকজনের হাত নিজের হাতে নিতে হলো।

‘তারপর বলুন,’ আগ্রহের সাথে জানতে চাইল একজন। ‘আপনার মেয়েকে যে দেখছি না? কেমন আছে সে?’

পামেলা মিষ্টি করে হাসলেন। ‘ভাল আছে।’

‘ভাল আছে?’ সাথে সাথে আরেকজন প্রশ্ন ছুঁড়ল। ‘কিন্তু

কোথায় যেন পড়লাম টিউলিপ অসুস্থ?’

‘হ্যাঁ, মানে…’

‘সিরিয়াস কিছু না, কি বলেন?’ তৃতীয় কণ্ঠস্বর।

স্বামীকে খুঁজলেন পামেলা, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে এখন আর তাঁকে দেখতে পেলেন না। মনে হলো খোলা লনে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন তিনি। আতঙ্কবোধটা আবার ফিরে আসতে শুরু করল মনে। ‘টিউলিপ ভাল আছে। সত্যি। আগের চেয়ে অনেক ভাল।’

সম্ভবত পামেলার কথা বলার ধরনেই সহানুভূতি-মাখা হাসি হাসি মুখগুলোয় কেমন যেন আড়ষ্ট ভাব ফুটল। তাঁর মনে হলো, এরা সবাই তাঁর শত্রু, তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ করছে।

‘বাড়ি থেকে দূরে অথচ অসুস্থ, আহা বেচারি,’ অচেনা একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন পামেলা। ‘নিশ্চয়ই মায়ের জন্যে তার মন খুব খারাপ হয়ে আছে।’

‘খাঁটি কথা। অসুস্থ বাচ্চা তোমাকে কাছে চাইবেই।’

‘আপনারও নিশ্চয়ই কিছু ভাল লাগছে না?’

‘কার লাগে, বলুন? কিন্তু যাই কিভাবে, এখানেও যে আমাকে দরকার,’ বলে ওদের দিকে পিছন ফিরলেন পামেলা। কোন কারণ নেই, অথচ সবার ওপর প্রচণ্ড রাগ হলো তাঁর। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসতে চাইল, অনেক কষ্টে ঠেকালেন। আরেক দল অতিথি তাঁর সামনে দাঁড়াল। জোর করে হাসতে হাসতে চোয়াল ব্যথা করছে। চোয়ালের ভেতর মাংস কাঁপছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন তিনি। ইচ্ছে হলো চিৎকার করে বলেন, এভাবে আর আমি হাসতে পারব না!

তবু হাসতে হবে। হাসলেন। ঘিরে থাকা লোকজনের দিকে ক্ষমাপ্রার্থনার দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। পুরানো কৌশলটা ব্যবহার করলেন। ‘দুঃখিত। রিচার্ডের সাথে জরুরী কথা বলতে হবে আমাকে।’

সাথে সাথে ভিড় ফাঁক হয়ে গেল। স্বামীকে দেখতে পেলেন পামেলা। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন প্রেসিডেন্ট, তিনিও স্ত্রীকে দেখতে পেলেন। হাসলেন তিনি, একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন।

হন হন করে স্বামীর কাছে চলে এলেন পামেলা।

‘তোমাকে আমি খুঁজছিলাম,’ বললেন রিচার্ড কনওয়ে। একটা হাত দিয়ে স্ত্রীর কোমর পেঁচিয়ে ধরলেন তিনি। নরম একটু চাপ, কথার চেয়ে বেশি সান্ত্বনাদায়ক। ‘লিজা আর রিপনকে তোমার মনে পড়ে?’

পামেলার পেশীতে ঢিল পড়ল, সুস্থ বোধ করলেন তিনি। কংগ্রেস সদস্য আর তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মহিলা একটা পত্রিকার সম্পাদিকা। ওদের দু’জনকেই তাঁর ভাল লাগে। ‘হ্যাঁ, অবশ্যই-কি যে বলো! হাউ আর ইউ?’

আলাপ শুরু হলো।

কথা বলার ফাঁকে এক সময় পামেলা লক্ষ করলেন, আইসক্রীম তাঁবুর কাছে একজন ক্লাউন দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাকে ঘিরে আছে পনেরো বিশজন শিশু-কিশোর। ক্লাউনের নামটা তিনি জানেন না, শুধু চেহারায় চেনেন। এই একই পোশাক পরে আগেও হোয়াইট হাউস পিকনিকে এসেছে লোকটা। গাঢ় কমলা রঙের চুল-রঙ করা। লাল স্যুট। দুধের মত সাদা মুখ-পেইণ্ট করা, অবশ্যই। নাকটা টকটকে লাল। তাকে ঘিরে থাকা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকালেন পামেলা। এক এক করে সবগুলো মুখ দেখলেন। হেসে ফেললেন তিনি।

শিশু-কিশোরের দলটা ক্লাউনের সাথে নানা রকম অঙ্গ-ভঙ্গি করে চারপাশের দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছে।

হঠাৎ দপ্ করে নিভে গেল হাসি। হায়, ওদের মধ্যে তাঁর নিজের মেয়েটা যদি থাকত! একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে আবার তিনি আলোচনায় যোগ দিলেন। নতুন কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব জুটল।

কমলা রঙের চুল নিয়ে ক্লাউন লোকটা যেখানে ছিল সেখানেই থাকল, আইসক্রীম তাঁবুর কাছাকাছি, পামেলা কনওয়ের চোখের কোণে। খানিক পর তার দিকে আরেকবার তাকালেন তিনি। শিশু-কিশোরদের দলটা আগের চেয়ে আরও বড় হয়েছে। এই প্রথম তাঁর চোখে পড়ল, বাচ্চাদের ভিড়ের মাঝখানে আরও একজন ক্লাউন রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ট্র্যাম্প ক্লাউন-কালো টুকরো কাপড় দিয়ে তৈরি স্যুট পরনে, এক রঙা মুখে বড় বড় বহুবর্ণের চোখ আঁকা। দূর থেকে ঠিক বুঝতে পারা গেল না, ক্লাউন মুখোশ পরে আছে, নাকি সত্যি সত্যি রঙ মেখেছে মুখে। এ-ও পরিচিত একটা দৃশ্য, তবে এই ক্লাউনকে আগে তিনি দেখেছেন কিনা মনে করতে পারলেন না। কিন্তু আইডিয়াটা চমৎকার। ট্র্যাম্প ক্লাউন একটা বামন।

পামেলা বড় ক্লাউনের দিকে তাকালেন। দু’জনের চোখাচোখি হলো। ক্লাউনের রঙ মাখা চেহারায় কোন ভাব ফুটলেও বোঝার উপায় নেই। তবে তার হাত নড়ে উঠল। বামন ক্লাউনের কাঁধ ছুঁলো সে। হাস্যকর, বেমানান লাগল বামনটাকে। কাঁধে স্পর্শ পেয়ে মুখ তুলে বড় ক্লাউনের দিকে তাকাল সে। তারপর ওস্তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ফেরাল পামেলা কনওয়ের দিকে।

কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকল বামন। তারপর অকস্মাৎ ওপর দিকে লাফ দিল সে। খিলখিল করে হেসে উঠল ছেলেমেয়ের দল।

বামন লাফাচ্ছে, ছুটছে। লাফাতে লাফাতে এদিকে আসছে।

একটু যেন থতমত খেয়ে গেলেন পামেলা কনওয়ে। এত ছোট একটা শরীর, দেখলে মায়া হয়। আহা বেচারির মনে কত দুঃখ! কিন্তু এত কি আনন্দের ঘটল যে হঠাৎ এমন লাফাচ্ছে? এদিকেই বা আসছে কেন? এদিকে আসছে, তাঁর দিকে?

তারপর সমবেত অতিথিদের গুঞ্জনকে ছাপিয়ে উঠল একটা মধুর শব্দ।

‘মা!’

সত্য উন্মোচিত হবার মুহূর্তে গলায় দম আটকে এল পামেলা কনওয়ের। এখনও তাঁর বিশ্বাস করতে ভয় লাগছে। রঙচঙে মুখের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। অপরিচিত পোশাকের ভেতর পরিচিত নড়াচড়া!

হঠাৎ সব ভুলে গেলেন পামেলা কনওয়ে।

লনের ওপর হাঁটু ঠেকালেন তিনি। বাহু দুটো বাড়িয়ে দিলেন সামনে। চিরন্তন একটা ভঙ্গি-বাহুডোরে ফিরে আসার জন্যে সন্তানের প্রতি মায়ের ব্যাকুল আহ্বান।

টিউলিপ! ও টিউলিপ!

পিছু হটল ভিড়। প্রতিটি মানুষ যেন স্তব্ধ পাথরের মূর্তি। কিন্তু এ-সব দিকে কোন খেয়ালই নেই পামেলা কনওয়ের। তিনি পাগলের মত হাসছেন। তাঁর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রাণপ্রিয় সন্তান। ওকে তিনি বাহুবন্ধনে আটকালেন। অস্থির করে তুললেন আদরে আদরে। চোখের পানিতে ভিজিয়ে দিলেন মেয়ের রঙ করা মুখ।

‘মা, আমার লাগছে!’ হাঁস ফাঁস করে উঠল টিউলিপ।

চমকে উঠলেন পামেলা। উপলব্ধি করলেন, এতক্ষণ তিনি বুকের সাথে পিষছিলেন মেয়েকে। এখনও তাঁর ভয়, কেউ বুঝি আবার তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে টিউলিপকে।

রিচার্ড কনওয়েও ছুটে এসেছেন। স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে তাঁরও কোন খেয়াল নেই। স্ত্রী এবং কন্যাকে জড়িয়ে ধরে আছেন তিনি। চোখ জোড়া চিকচিক করছে, কিন্তু হাসছেন।

দু’হাতে ধরে মেয়ের মুখ একটু উঁচু করলেন পামেলা। টিউলিপের চোখেও পানি, সে পানিতে তার মুখের রঙ এরই মধ্যে মুছে যেতে শুরু করেছে। নিজের মুখের সাথে মেয়ের মুখ আবার তিনি চেপে ধরলেন। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন স্বামীর দিকে। কথা হলো না। শুধু দৃষ্টি বিনিময় হলো। চরম বিজয়। গভীর ভালবাসা। পরম শান্তি।

ওঁদের পাশে দাঁড়িয়ে একজন এজেন্ট তার মাইক্রোফোনের সুইচ অন করল, তারপর সগর্জনে নির্দেশ দিল একটা। কিন্তু পামেলা কনওয়ে খেয়াল করলেন না। লনের একদিকে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা লাফ দিয়ে তৈরি হলো। আগে থেকে ঠিক করা পজিশনের দিকে ছুটল তারা। কিন্তু এরই মধ্যে দেরি হয়ে গেছে।

ক্লাউন হাওয়া!

.

রঙিন পর্দার পিছনে দাঁড়াল রানা। ক্লাউন-স্যুট খুলে ফেলেছে, মঞ্চের তলায় ফেলে দিয়ে এসেছে সেটা। স্যুটের সাথে ফেলে দিয়েছে কমলা পরচুলা, লাল নাক, পাতলা রাবার মাস্ক। উপস্থিত আর সব অতিথিদের মত ওর পরনেও এখন অত্যন্ত দামী বিজনেস স্যুট।

ধনুকের মত বাঁকা গাড়ি-পথ ধরে ধীর পায়ে হেঁটে এগোল রানা। সামনেই লোহার গেট। গেট পেরিয়ে যেতে পারলেই স্বাধীনতা।

ওর পিছনে লন থেকে একটা শোরগোল ভেসে এল। ঘাড় ফেরাল রানা, টিউলিপকে তার মায়ের বুকে দেখতে পেল। কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন রিচার্ড কনওয়ে।

পুনর্মিলন।

ওর দায়িত্ব ও পালন করেছে। এবার চাচা আপন পরাণ বাঁচা।

জানে, খুব বেশি সময় পাওয়া যাবে না। গেট আর বেড়ার বাইরে বেরিয়ে যাবার পর ওরা যদি ধাওয়া শুরু করে, চোখে ধুলো দেয়ার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু তার আগেই যদি…

গেটের কাছে পৌঁছে গেছে ও। গার্ডদের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল। গেট পেরিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।

বড়সড় একটা বাড়িকে পাশে রেখে এগোল রানা। হোয়াইট হাউসেরই একটা অংশ এই বাড়ি। সাদা ভ্যান গাড়িটা যেখানে রেখে গিয়েছিল সেখানেই রয়েছে, এটায় চড়েই এসেছে ও।

ঝনাৎ করে আওয়াজ হলো পিছনে। চেইন তুলে দেয়া হলো, বন্ধ হয়ে গেল গেট। ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ। এদিকেই আসছে। পিছন দিকে তাকাল না ও। একজন ক্লাউনকে খুঁজছে ওরা। তল্লাশি চালাবে সাদা ভ্যানে।

হাঁটার গতি একই রকম থাকল। শুধু বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে।

সামনে একটা বাঁক। বাঁক ঘুরে সেভেনটি স্ট্রীটে পড়ল রানা। যেখানে রেখেছিল সেখানেই রয়েছে ফিয়াট একশো চব্বিশ স্পাইডার-শক্তিশালী ইঞ্জিনসহ ছোট একটা গাড়ি। যানবাহনের ভিড় গলে সহজেই বেরিয়ে যেতে পারে। ছয় ব্লক দূরে আরও একটা গাড়ি রাখা আছে, একটা চার্চের সামনে, চার্চের নিজস্ব পার্কিং এরিয়ায়। শেষ গাড়িটা আছে একটা হাসপাতালের ভেতর, উঠানের একধারে। হাসপাতালটা ওয়াশিংটন সার্কেলের কাছে।

ফুটপাথ ধরে হাঁটছে রানা। লোকজনের ভিড় ঠেলে এগোতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেল ও। পকেট থেকে স্পাইডারের চাবিটা বের করে হাতে নিল। ফুটপাথ থেকে নামল ও। গাড়িটার পিছন দিক হয়ে ড্রাইভার সাইডে চলে এল। কিন্তু আরও একজন লোক ফুটপাথ থেকে নেমে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে।

গাঢ় রঙের স্যুট পরেছে লোকটা। হাত দুটো ট্রাউজারের পকেটে। ডানহাতে নিশ্চয়ই রিভলভারের বাঁট ধরে আছে। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রানার দিকে তাকিয়ে থাকল সে। কোন কথা বলল না। রানা ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল।

পিছন থেকে এগিয়ে এল আরও দু’জন।

তারপর কালো একটা গাড়ি ঠিক ওর পাশে এসে থামল। একটা সরকারি লিমুসিন। প্রথমে নামল ড্রাইভার। লিমুসিনের নাকের সামনে দিয়ে ঘুরে এল সে, দরজা খুলে সরে দাঁড়াল এক পাশে।

লিমুসিনের পিছনে বসা লোকটা মৃদু হাসল। উত্তরে হাসতে পারল না রানা। ওর কাঁধ দুটো ঝুলে পড়ল। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা। চোখ জোড়া নিষ্প্রভ।

ধরা পড়ে গেছে রানা। লিমুসিনের পিছনের সীটে বসা ভদ্রলোককে চিনতে পেরেছে ও। জেফ রিকার্ড। সি.আই.এ. চীফ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *