অপহরণ-২.২

দুই

ইলেকট্রনিক বোর্ডে সংখ্যাগুলো জ্বলে উঠছে, সেদিকে তাকিয়ে ভোটের হিসেব কষছে মেরিলিন শার্প। হাউস ফ্লোরের ওপর, গ্যালারি রেইলের মাথায় বোর্ডটা, বোর্ডের উজ্জ্বল আলোর আভায় উল্লাসিত হয়ে আছে তার মুখ। মিটি মিটি হাসি ফুটল কমনীয় চেহারায়। অনেক ভোটের ব্যবধানে জিতছে তারা।

সামনে চেম্বারের পিছনের দেয়াল, প্যাসেজের শেষ সারির একটা আসনে বসে আছে সে। তার আশপাশে দাঁড়িয়ে আছে দলীয় কংগ্রেস সদস্যরা, গভীর রাত পর্যন্ত বিতর্কে অংশগ্রহণ করে সবাই খুব ক্লান্ত, বাড়ি ফেরার জন্যে ছটফট করছে। গলা একটু চড়িয়ে ইন্টেলিজেন্স ওভারসাইট সাবকমিটি চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে, বাঁ হাতের তর্জনী আর মধ্যমা খাড়া করে চার্চিলের বিখ্যাত বিজয় সঙ্কেত দেখাল।

জটিল কোন ইস্যু নয়, কৃষি বিল। কৃষি খাতে মোটা টাকা বরাদ্দ করা হবে, সবারই তা জানা। দীর্ঘ আলোচনা হলো, তবে কারও তরফ থেকে তেমন কোন জোরাল আপত্তি বা প্ৰতিবাদ উঠল না। ভাগ্যিস ভোটাররাও অনেকে জানে না, বরাদ্দ টাকার মোটা একটা অংশ মোটেও কৃষি খাতে ব্যয় করা হবে না। ওই টাকা দিয়ে কেনা হবে ট্রেনিং প্লেন, বেতন দেয়া হবে গোপন সৈনিকদের, সি.আই.এ. এজেণ্ট বললে যাদের সহজেই চেনা যায়।

হাত নেড়ে বিজয় সঙ্কেতের জবাব দিলেন চেয়ারম্যান। ইন্টেলিজেন্স কর্মকাণ্ড বজায় রাখার স্বার্থে অনেক সময়ই গণতান্ত্রিক বিধি-বিধানকে কাঁচকলা দেখাতে হয়। কংগ্রেস যে-সব সিদ্ধান্ত নেয় জনসাধারণ ইচ্ছে করলেই সেগুলো কি জেনে নিতে পারে, জেনে নিতে পারে বিদেশী ইন্টেলিজেন্সগুলোও। কাজেই শত্রুপক্ষের কাছে কিছু গোপন করতে হলে তার কোন রেকর্ড না রাখাই উচিত

মেরিলিন শার্প ইশারায় জানতে চাইল, চেয়ারম্যান কি চান আরও কিছুক্ষণ থাকুক সে? মাথা নাড়লেন তিনি। ইতোমধ্যে নিজের হ্যাঁ-সূচক ভোটটা দেয়া হয়ে গেছে তার, নামের পাশে ইলেকট্রনিক বোর্ডে নাম্বারটা জ্বলে উঠেছে। প্রচুর ভোটে এগিয়ে আছে সরকারি দল, ভোট দিতে যারা বাকি আছে তারা সবাই বিরোধিতা করলেও বিলটা পাস হয়ে যাবে। বিলের ত্রুটি নিয়ে যারা সমালোচনা করেছে তাদের প্রভাবিত করার এখন আর কোন দরকার নেই।

মেরিলিন শার্পের বয়স চল্লিশ পুরো হয়নি এখনও। তরুণ মেধাবীদের নতুন যে দলটা হাউসে ঠাঁই করে নিয়েছে, সে তাদেরই একজন।

আজ রাতের মত কাজ শেষ হলেও, বাড়ি ফেরার উপায় নেই। কাঁধে আরেকটা দায়িত্ব রয়েছে, রোটাণ্ডায় যেতে হবে তাকে। হেনরি পিকেরিং যোগাযোগ করেছিল।

কোট নেয়ার জন্যে ক্লোকরূমে একবার থামল সে, পুব দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল চেম্বার থেকে। এখানে কোন মেটাল ডিটেকটর নেই, শুধু ওপরতলার গ্যালারি দরজাগুলোয় আছে। ছোট্ট এই একটা ত্রুটি রয়ে গেছে ক্যাপিটল দুর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থায়-হঠাৎ কোন কংগ্রেস সদস্য উন্মাদ হয়ে গেলে তাকে ঠেকাবার কোন আয়োজন রাখা হয়নি। অবশ্য এখন পর্যন্ত সে-ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি, কংগ্রেস সদস্যদের উন্মাদনা হাউসে বিতর্কের ঝড় তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

গার্ডদের পাশ কাটাবার সময় হাসল মেরিলিন, ওরা সবাই তাকে চেনে। দরজার সামনে লবিইস্টদের ভিড়, ভিড়ের মাঝখান দিয়ে পথ করে নিয়ে এলিভেটরগুলোর দিকে এগোল সে। অধিবেশন শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই, লোকজন হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসবে। চট্ করে একবার হাতঘড়ির দিকে চোখ বুলাল সে, সোয়া এগারোটা। তার জন্যে মাত্র শুরু হলো রাত। এর আগে যতবার রোটাণ্ডায় হেনরি পিকেরিঙের সাথে দেখা করেছে সে, আলোচনা শেষ হতে ভোর হয়ে গেছে। জরুরী কোন ব্যাপার ছাড়া রোটাণ্ডায় তাকে তলব করে না ডেপুটি ডিরেক্টর।

আশপাশে আর কেউ নেই, এলিভেটরের জন্যে একা দাঁড়িয়ে আছে মেরিলিন। রোটাণ্ডা বলতে আসলে দুটো জায়গার কথা বোঝায়—গজ আকৃতির মাথা নিয়ে ক্যাপিটলের হলরূম, অথবা আইভি স্ট্রীটের প্রাইভেট পলিটিকাল ক্লাব। নির্দিষ্টভাবে ক্লাবটাতেই যেতে বলে দিয়েছে হেনরি পিকেরিং। মেরিলিন ক্যাপিটলে কাজ করে, রোজই যায় সেখানে। ক্লাবেরও সদস্য সে, তবে ঘন ঘন যায় না।

হেনরি পিকেরিং বারবার সতর্ক করে দিয়েছে তাকে, আমাদের দেখা হবে কেউ যেন না জানে, আর, খুব সাবধানে থেকো।

আপনমনে হাসল মেরিলিন। ডেপুটি ডিরেক্টর তাকে সাবধান না করলেও পারত। সি.আই.এ. ট্রেনিং স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী নেয়া আছে তার। মাঠ-কর্মী হিসেবে পাঁচ বছর কাজ করার পর সি.আই.এ. হেডকোয়ার্টার ল্যাংলিতে অফিসার পদ নিয়ে ডেস্কে বসে। ওখানে কাজের কিছু কিছু পদ্ধতি অসন্তুষ্ট করে তোলে তাকে। তার অভিযোগ ফেডারেল ইন্টেলিজেন্স বোর্ডকে জানায় সে, শুনানির জন্যে কংগ্রেস একটা কমিটি গঠন করে। ইন্টেলিজেন্স সাব-কমিটির সামনে মেরিলিন যে বক্তব্য রাখে, রাজনৈতিক মহলে ছোটখাট একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে সেটাও, প্রায় রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে পড়ে সে। দু’বছর পর নিজেই কংগ্রেস নির্বাচনে দাঁড়ায়, এবং বিজয়ী হয়। ইন্টেলিজেন্স কর্ম-পদ্ধতি সম্পর্কে তার আগ্রহ থাকায় ইন্টেলিজেন্স ওভারসাইট কমিটিতে জায়গা পেতেও তার কোন অসুবিধে হয়নি।

কেউ যদি সি.আই.এ-র সমালোচনা করে, তাকে সি.আই.এ-র এজেণ্ট নিয়োগ করা সবচেয়ে নিরাপদ। গোটা ব্যাপারটা ছিল পূর্ব-পরিকন্ধিত, প্রমাণ ইত্যাদি সহ লিখিত অভিযোগগুলো মেরিলিনের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। ইন্টেলিজেন্স সাব-কমিটি যে শুনানির ব্যবস্থা করে তার মধ্যে কোন বানোয়াট ব্যাপার ছিল না, কিন্তু মেরিলিন যে বক্তব্য রাখে সেটা তৈরি করে দেয় সি.আই.এ-র অভিজ্ঞ গবেষকরা। গোপন সরকারি ফাণ্ড থেকে টাকা পেয়ে নির্বাচনে দাঁড়ায় মেরিলিন। আসলে সি.আই.এ-র কাজ কখনও ছাড়েনি সে, আগাগোড়া করে যাচ্ছে।

এলিভেটরের একটা দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল মেরিলিন। দরজা বন্ধ হতে শুরু করল। হঠাৎ একটা লোমশ হাত ঢুকল ভেতরে, সচল দরজাটাকে মুহূর্তের জন্যে থামিয়ে দিয়ে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকল এক লোক।

চওড়া কাঁধ লোকটার, শক্ত ঘাড়। মাথায় ধূসর রঙের চুল, ম্লান নীল চোখ। মুখের বাঁ দিকে কাটা দাগ, চোখের নিচ থেকে জুলফি পর্যন্ত।

‘ডানিয়েল! এখানে কি করছ তুমি?’

‘তোমার সাথে কথা আছে,’ শান্ত সুরে বলল ডানিয়েল। হাত তুলে ফার্স্ট ফ্লোরের বোতামে চাপ দিল সে। ‘আমার পিছু পিছু আসবে, কিন্তু মনে রেখো, আমরা একসাথে নই।’

মাথা ঝাঁকাল মেরিলিন, কোন প্রশ্ন করল না। ডানিয়েলকে চেনে সে, জানে সি.আই.এ-তে কাজ করে। ভাবল, নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু ঘটেছে।

দোতলায় থামল এলিভেটর। খুলে গেল দরজা। মেরিলিনকে পিছনে রেখে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল ডানিয়েল। সামনে কয়েকজন গার্ডকে দেখে ঝট করে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দেখাল, তারপর হন হন করে হেঁটে বেরিয়ে গেল হলরুম থেকে।

গার্ডদের একজন চিনতে পারল মেরিলিনকে। বাউ করে পথ থেকে দ্রুত সরে দাঁড়াল, বলল, ‘আজ অনেক রাত হয়ে গেল।’

‘সবারই,’ বলে মৃদু হাসল মেরিলিন, হলরূম পেরিয়ে এল করিডরে। সামনে, বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে ডানিয়েল। মেরিলিন ভাবল, প্রেস কার্ড, নাকি কংগ্রেশনাল আই.ডি., গার্ডদের কী কার্ড দেখাল ডানিয়েল? ল্যাংলিতে এ-ধরনের কার্ড তৈরি করা থাকে, দরকার হলেই পাওয়া যায়। দুটোর যে-কোন একটা সাথে থাকলে ক্যাপিটলে অবাধে ঘোরাফেরা করা যায়, রাত যত গভীরই হোক, লোকজন থাকুক বা না থাকুক।

বাঁক নিয়ে চওড়া একটা করিডরে চলে এল ডানিয়েল, দালানটার পুরো দৈর্ঘ্য জুড়ে লম্বা হয়ে আছে। পিছু পিছু আসছে মেরিলিন, মোজাইক করা মেঝেতে তার পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনি তুলল। হাউস চেম্বার থেকে একতলা নিচে রয়েছে ওরা। আশপাশে কোথাও কোন লোকজন নেই, আছে শুধু মার্বেল পাথর আর ব্রোঞ্জে তৈরি বিশাল আকারের অসংখ্য মূর্তি। মেরিলিন আন্দাজ করতে পারল, কোথায় যাচ্ছে ডানিয়েল। দালানের গভীর তলায়, ছোট একটা চেম্বারে। ক্রিপ্ট বললে সবাই চিনবে জায়গাটা। জর্জ ওয়াশিংটনের সমাধি হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছিল ওটার। এত রাতে ক্রিপ্টে কোন গার্ড থাকবে না।

বাঁক নিয়ে একটা দরজার সামনে থামল ডানিয়েল দরজার ভেতর প্যাচানো একটা সিঁড়ি শ্যাফট ঘেঁষে নেমে গেছে নিচের সেলারে। নিজের মনে মাথা দোলাল মেরিলিন, ঠিকই আন্দাজ করেছিল সে। এর আগেও ক্রিপ্টে নেমেছে সে, ডেপুটি ডিরেক্টরের সাথে গোপনে দেখা করেছে। এমন কি লোহার গেটের একটা চাবিও আছে তার রিঙে।

প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে একটা করিডরে নেমে এল মেরিলিন, করিডরের দু’পাশে মসৃণ পাথুরে দেয়াল। এই করিডর ধরে দালানের মাঝখানে পৌঁছানো যায়। দেয়াল ঘেঁষে মোটা পাইপ, ঢাকনি মোড়া আণ্ডারড্রেন চলে গেছে সামনের দিকে। করিডরের শেষ মাথায় লোহার গেটটা।

গেটে তার জন্যে অপেক্ষা করছে ডানিয়েল। গেটের ওপর সাদা রঙ করা দেয়াল খিলান আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরটা ক্যাথেড্রালের মত দেখতে। খিলানের নিচে লম্বা কালো একটা বাক্স, ভেলভেটে মোড়া। লিংকন ক্যাটাফ্যালক, রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যে ব্যবহার করা হয়। এখানেই রাখা হয় ওটা।

গেটের দিকে পিছন ফিরল মেরিলিন, ডানিয়েলের দিকে মুখ তুলল। ‘কি ঘটেছে?’

মুচকি একটু হাসল ডানিয়েল। শান্ত এবং নিরুদ্বিগ্ন। ‘কিছু না।’

‘কিছু না মানে?’ মেরিলিনের দুই ভুরুর মাঝখানটা কুঁচকে উঠল।

জবাব দিল না ডানিয়েল, যেন প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। জ্যাকেটের পকেটে হাত দুটো ভরে ঘুরে দাঁড়াল সে। মেরিলিনকে পিছনে রেখে হেঁটে ফিরে যাচ্ছে। শান্ত ভঙ্গি, হাঁটার মধ্যে কোন রকম আড়ষ্ট ভাব নেই। অবাক হয়ে তার মাথার পিছনে তাকিয়ে থাকল মেরিলিন। তারপর হঠাৎ, দ্রুত আধপাক ঘুরল ডানিয়েল।

হাসল সে, সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল হাসিটা, কিন্তু নীলচে চোখ পর্যন্ত পৌঁছুল না। মাথার ওপর থেকে আলো পড়ায় মুখের কুৎসিত দাগটাকে মনে হলো চামড়া ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে। হাতের ছোট্ট অটোমেটিকটাকেও কদর্য লাগল।

আতঙ্কে আর অবিশ্বাসে পাথর হয়ে গেল মেরিলিন। ‘ডানিয়েল! এ কি? কি করছ?’

হাসিটুকু স্থির হয়ে থাকল মুখে, গলার আওয়াজ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, ‘নির্দেশ আছে তোমাকে আমার খুন করতে হবে।

হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মেরিলিন। জানে ব্যাপারটা ঠাট্টা নয়। কিন্তু ডানিয়েল! দু’জনেই ওরা সি.আই.এ. এজেণ্ট!

মেরিলিনের হাত দুটো কোটের পকেটে আরও একটু ঢুকে গেল। ‘হেনরি পিকেরিং তোমাকে পাঠায়নি।

‘কে পাঠিয়েছে সেটা বড় কথা নয়,’ বলে সেফটি ক্যাচ নামাল ডানিয়েল, নিস্তব্ধ লম্বা করিডরে ক্লিক শব্দটা প্রতিধ্বনি তুলল। ‘কেউ একজন তো নিশ্চয়ই পাঠিয়েছে। বড় কথা হলো, তোমাকে বিদায় নিতে হচ্ছে। জানি না কেমন লাগছে তোমার, আমার কিন্তু খারাপই লাগছে। ক্যারিয়ারের শুরুটা তুমি ভালই করেছিলে, আরও অনেক ওপরে উঠতে পারতে। আমি দুঃখিত, বিলিভ মি। কিন্তু নিয়তিকে কেউ খণ্ডাতে পারে না, বুঝলে। তবে তোমাকে আমি কয়েক সেকেণ্ড সময় দিচ্ছি, পাপ-টাপ করে থাকলে প্রার্থনা করার এটাই তোমার শেষ সুযোগ।’

প্রার্থনা নয়, দ্রুত কয়েকটা ঘটনার কথা স্মরণ করল মেরিলিন। অ্যারো নামে একজন লোক বার্লিনের গোল্ডেন বারে খুন হয়েছে। আরেকজন লোক, এগম্যান, মারা গেছে আফ্রিকার এক চার্চে। আজ তার পালা। এখানে, ক্যাপিটল রোটাণ্ডা থেকে দো’তলা নিচে।

মৃদু হাসল মেরিলিন, ভান করল যেন ভয় পায়নি। ‘তুমি যে একটা কী, এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছ!’ পকেট থেকে বাঁ হাতটা বের করে নাড়ল সে। ‘খেলনাটা সরাও এবার, অনেক হয়েছে! হেনরি পিকেরিং যদি শোনে তুমি আমার সাথে এ-ধরনের রসিকতা করেছ…’

হো হো করে হেসে উঠল ডানিয়েল। ‘হলিউডে যাওনি কেন?’ হঠাৎ হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল সে। ‘সেখানেও তুমি প্রতিভার ছাপ রাখতে পারতে।’

এবার চোখ রাঙাল মেরিলিন। ‘আমি কিন্তু চিৎকার করব, ডানিয়েল! এখনও বলছি, খেলনাটা সরাও! ত

ডানিয়েলের চোখ কুঁচকে গেল, নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে তাকাল সে। ‘তোমাকে আর সময় দেয়া গেল না, মেরিলিন। পিস্তল ধরা হাতটা লম্বা করে দিল সে।

গুলি করল মেরিলিন।

কোটের পকেট থেকে বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে এল বুলেট, সোজা ঢুকে গেল ডানিয়েলের বুকে। পিস্তল পেঁচিয়ে থাকা আঙুলগুলোয় ঢিল পড়ল। মুখের ভাব বদলে গিয়ে হাস্যকর ভাঁড়ামির ভঙ্গি ফুটে উঠল। খটাখট আওয়াজ হলো মেঝেতে, অটোমেটিকটা অসাড় আঙুল থেকে খসে পড়েছে। টলছে ডানিয়েল, কিন্তু আশ্চর্য, এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। তারপর বাঁকা হতে শুরু করল তার হাঁটু।

দড়াম করে পড়ে গেল সে, এক পা পিছিয়ে এল মেরিলিন। পকেটের ভেতর খুদে পিস্তলটা এখনও ধরে আছে সে। মুখ তুলে তাকাল, নির্জন করিডর। কান পাতল, কোথাও কোন আওয়াজ নেই। ডানিয়েলের দিকে তাকাল আবার। মোজাইক করা মেঝেতে রক্তাক্ত একটা লাশ।

গুড গড! হেনরি পিকেরিংকে দরকার তার! এখুনি!

.

আইভি স্ট্রীটের পার্কিং লটে একটা গাড়িতে বসে রয়েছে ডেপুটি ডিরেক্টর হেনরি পিকেরিং। দেখল, ক্লাবের দরজার দিকে এগোচ্ছে মেরিলিন, চেহারায় সন্ত্রস্ত ভাব। জানালার কাঁচ নামিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকল সে, ‘মেরিলিন।’

চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মেরিলিন, ঘুরল, পিকেরিংকে দেখতে পেয়ে ছুটে এল গাড়িটার দিকে। তার কোটের পকেটে একটা গর্ত রয়েছে, গর্তের মুখ গানপাউডারে পুড়ে গেছে। চোখ জোড়া বিস্ফারিত, সশব্দে হাঁপাচ্ছে সে। গাড়ির দরজা খোলার সময়, পিকেরিং লক্ষ করল, হাত দুটো কাঁপছে তার। লাফ দিয়ে ভেতরে ঢুকল সে, পিকেরিঙের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বসল সীটে।

‘কি ব্যাপার, মেরিলিন?’ জরুরী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল পিকেরিং।

‘ডানিয়েল, মাই গড! এইমাত্র তাকে আমি খুন করেছি!’

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল পিকেরিং, হতভ’। ‘ডানিয়েল?’

‘আমাদের ডানিয়েল,’ চাপা গলায় বলল মেরিলিন, কান্নায় বুজে আসছে গলা। কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে হড়বড় করে সব ব্যাখ্যা করল সে। ক্যাপিটলে তাকে খুঁজে বের করে ডানিয়েল, ক্রিপ্টে নামিয়ে নিয়ে যায় তাকে, হঠাৎ তার দিকে রিভলভার ধরে। পিকেরিং তাকে সাবধানে থাকতে বলে দিয়েছিল, তাই না? সেজন্যেই সাথে পিস্তলটা রেখেছিল সে আজ। ভাগ্যিস! কি? হ্যাঁ, লাশটাকে ওখানেই রেখে এসেছে সে।

বিস্ময়ে বিহ্বল পিকেরিং কোন বাধা না দিয়ে শুনে গেল। মেরিলিন থামতে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল সে, ‘ডানিয়েল! কি আশ্চর্য, এত থাকতে ডানিয়েল! দুনিয়াটার হলো কি!’ মেরিলিনের দিকে ফিরল সে। ‘কেন, মেরিলিন? কেন? তোমাকে কিছু বলেনি সে?’

দ্রুত মাথা নাড়ল মেরিলিন। ‘দুঃখিত, স্যার। জানি ওর মুখ থেকে কথা বের করার জন্যে…কিন্তু সময় পেলাম কোথায়! আর এক সেকেণ্ড দেরি করলে সে-ই আমাকে…’

‘বুঝেছি,’ বাধা দিয়ে বলল পিকেরিং। ‘শান্ত হও, মেরিলিন। যা করেছ ঠিক করেছ, সবচেয়ে আগে দরকার বেঁচে থাকাটা। বরং তুমি মারা গেলেই তোমার ওপর রাগ হত আমার। গুলির আওয়াজ?’

‘কেউ শোনেনি…সেলারে কেউ থাকলে তো!’

‘লাশটা তাহলে লোহার গেটের সামনেই পড়ে আছে?’

‘না-না, গেট খুলে ভেতরে নিয়ে গেছি,’ তাড়াতাড়ি বলল মেরিলিন। ‘ক্যাটাফালকের ভেতর লুকিয়ে রেখে এসেছি।’

ক্ষীণ একটু তিক্ত হাসি ফুটল পিকেরিঙের ঠোঁটে। ‘ভাল জিনিসই হাতের কাছে পেয়ে গেছে। ওর পিস্তলটা?’

‘আমার কাছে,’ পকেট থেকে অটোমেটিক পিস্তলটা বের করে দিল মেরিলিন।

‘তোমারটাও,’ বলল পিকেরিং। ‘কেউ যদি আমাদের আগে লাশের কাছে হাজির হয়, বুলেট দেখে পিস্তলের খোঁজ পেয়ে যাবে। তোমার নামে নতুন একটা ইস্যু করতে হবে।’

নিজের পিস্তলটাও হাতছাড়া করল মেরিলিন

মেরিলিন। বিশেষ অ্যাসাইনমেণ্ট ছাড়া সে অবশ্য সাথে পিস্তল রাখে না। ‘আপনি এখনও চান রোটাণ্ডায় যাই আমি?’ জিজ্ঞেস করল সে।

এক মুহূর্ত ইতস্তত করল পিকেরিং। তারপর বলল, ‘এখন আর কোন ফায়দা হবে বলে মনে হয় না, তবু একবার গিয়ে দেখা যেতে পারে। যাও, বলা তো যায় না। আমি এদিকে দেখি ফোনে জেফ রিকার্ডকে পাওয়া যায় কিনা।’

দরজার হাতলে হাত রেখে মাথা ঝাঁকাল মেরিলিন।

‘সাবধানে থেকো,’ মেরিলিনের পিঠ চাপড়ে দিল পিকেরিং।

গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে ঝুঁকল মেরিলিন, পিকেরিংকে দেখল। অভয় দিয়ে হাসল পিকেরিং। বলল, ‘কোন ভয় নেই। ওখানে আমাদের অনেক লোক আছে। কেউ তোমার গায়ে আঁচড়টিও কাটতে পারবে না।’

দৃঢ়, ধীর পায়ে ক্লাবের দিকে এগোল মেরিলিন।

.

আসলে রোটাণ্ডার এখন আর কোন অস্তিত্বই নেই। ওই নামে এক সময় একটা প্রাইভেট রেস্তোরাঁ ছিল, সেটা উঠে যাবার পর জায়গাটা দখল করেছে ক্লাব। এটাও একটা প্রাইভেট ক্লাব, আলাদা একটা নামও আছে। কিন্তু ক্যাপিটল হিল-এ যারা কাজ করে, তারা রোটাণ্ডা নামটা ভুলতে পারেনি, ক্লাবটাকেও সেই পুরানো নামে ডাকে। জিজ্ঞেস করলে অনেকেই ক্লাবের আসল নাম বলতে পারবে না।

ভেতরটা অবশ্য অনেক বদলানো হয়েছে। বিশাল হলটাকে ভাগ করা হয়েছে কয়েক ভাগে। ঢোকার মুখে অস্বাভাবিক চওড়া সিঁড়ি, কারুকাজ করা কাঠের রেইলিং বসিয়ে কয়েক প্রস্থে ভাগ করা হয়েছে। দুই প্রস্থ সিঁড়ি দু’দিক থেকে উঠে গেছে প্রকাণ্ড এক ঝুল-বারান্দায়, প্রেসিডেনশিয়াল পোর্ট্রেট গ্যালারি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কেনেডি, জনসন, নিক্সন, ট্রুম্যান, সব ক’জন প্রেসিডেন্টের ছবিই আছে ওখানে।

ঢোকার মুখ থেকে তৃতীয় আরেক প্রস্থ সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। নিচে লিনেন মোড়া সার সার টেবিল, মৃদু আলো। ডিনার পর্ব শেষ হয়েছে, লোকজন যারা আছে তারা সবাই গলা ভেজাবার জন্যে আছে। বেশিরভাগই কংগ্রেশনাল স্টাফ, দীর্ঘ অধিবেশনের পর, বাড়ি ফেরার আগে, দু’এক ঢোক গিলে তাজা হয়ে নিতে চায়।

মেরিলিনকে দেখেই চিনতে পারল বারটেণ্ডার। ‘হাই, মিস শার্প। বলুন কি দেব আপনাকে?’

গায়ের কোট আগেই খুলেছে মেরিলিন, ভাঁজ করে বুলেটের ফুটোটা লুকিয়ে রেখেছে। উঁচু একটা টুলে বসল সে। ‘ব্র্যাণ্ডি, প্লীজ।’

‘শিওর থিং।’

স্পীকার একটা গন্ধ শুনিয়েছিলেন, মনে পড়ে যেতে হাসি পেল মেরিলিনের। একজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী শ্রমিকদের জন্যে একটা বারে পার্টির আয়োজন করেছেন। সবার জন্যে বিয়ারের অর্ডার দিলেন তিনি। বারটেণ্ডার জিজ্ঞেস করল, আপনাকে কি দেব, স্যার? প্রার্থী বললেন, স্কচ হুইস্কি। খুব স্বাভাবিক, নির্বাচনে হেরে যান ভদ্রলোক।

গ্লাস তুলে ছোট্ট একটা চুমুক দিল মেরিলিন। অনুভব করল, টেনশন কেটে গেছে তার, ঢিল পড়েছে পেশীতে। ডানিয়েলের সাথে যা ঘটে গেছে, মনে হলো অনেকদিনের পুরানো ঘটনা, তার সাথে যেন কোন সম্পর্কই নেই। তারপর উপলব্ধি করল, ঢিল পড়েনি, স্রেফ অসাড় হয়ে গেছে পেশী। উত্তেজনা বোধ করছে না, কারণ ভোঁতা হয়ে গেছে স্নায়ুগুলো। অনেক বছর হলো এ-ধরনের ব্যাপারে জড়ায়নি সে। স্পীকারের বন্ধুর মত, আরেক ধরনের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সে।

সান্ত্বনা এইটুকু যে এখানে আর নতুন করে কিছু ঘটবে না। এত লোকের ভিড়ে কি ঘটতে পারে? তাছাড়া, আশপাশে সি.আই.এ-র বেশ কিছু এজেণ্টও আছে। নিশ্চয়ই তারা সবাই ছদ্মবেশ নিয়ে আছে, তা না হলে দু’একজনকে অন্তত চিনতে পারত সে।

বারের আরেক প্রান্তে ছোটখাট একটা ভিড়, ভিড় থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে এল এক লোক। লোকটা হাসছে, তার দিকে তাকিয়ে। চিনতে পারল মেরিলিন। একজন লবিইস্ট। বক বক করা অভ্যেস, তেল মাখানো স্বভাব।

গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিয়ে নিজেকে শক্ত করল মেরিলিন অন্য এক ধরনের হামলার জন্যে তৈরি হলো মনে মনে।

.

রোটাণ্ডার সামনের দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে নেই। মেম্বারশিপ কার্ড লাগে শুধু খাবার বা পানীয় কেনার সময়। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল কর্নেল উইলিয়াম অবসন।

সিঁড়ির মাথা থেকে নিচের দিকে, বারের ভেতর তাকাল সে। তারপর বাঁদিকে ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ঝুল-বারান্দায়। ঢিলেঢালা একটা রেনকোট পরে আছে সে, তাতে ঢাকা পড়েছে নিজের আকৃতি। জ্যাকেটের কলার তোলা, খাড়া হয়ে ঢেকে রেখেছে ঘাড়, হ্যাটের কিনারা প্রায় ছোঁয় ছোঁয়।

মেন’স রূমের দরজার দিকে এগোল সে, যেন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্যেই এখানে তার উঠে আসা। কিন্তু দরজাটার পাশ ঘেঁষে এগোল, ভেতরে ঢুকল না। কাউকে দেখতে পেলে হয়তো ঢুকত, কিন্তু সিঁড়িতে বা সামনের দরজায় কাউকে দেখা গেল না।

একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল অবসন। টেলিফোনের আওয়াজ শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে।

.

‘আপনার ফোন, মিস শার্প,’ বলল বারটেণ্ডার। ‘কোটরূমের পাশের রিসিভারটা তুলতে পারেন।’

তাড়াতাড়ি টুল থেকে নেমে পড়ল মেরিলিন। নিশ্চয়ই ডেপুটি ডিরেক্টর হেনরি পিকেরিং ফোন করেছে, তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলবে। আধ ঘণ্টার ওপর হয়ে গেল এখানে রয়েছে সে, কিছুই ঘটেনি। লবিইস্ট লোকটা ছাড়া কেউ তার কাছে পর্যন্ত আসেনি।

লোকটা মূর্তিমান একটা আতঙ্ক। সাংবিধানিক বিধি-বিধান সম্পর্কে তার আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। একটা মুদ্রাদোষ আছে, খানিক পর পর যন্ত্রচালিতের মত আওড়ায়, আপনি এত জানেন! লোকটাকে এড়াবার সুযোগ পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। ক্ষমা চেয়ে নিয়ে দ্রুত ফোনের দিকে এগোল। ফোনটা সিঁড়ির পাশে।

‘হ্যালো?’

‘মিস শার্প?’ পুরুষমানুষের গলা। কিন্তু হেনরি পিকেরিং নয়।

‘ইয়েস?’

উত্তরটা এল ওপর দিক থেকে, তীক্ষ্ণ বাতাস কাটার আওয়াজ। মেরিলিনের মাথার পিছনে লাগল বুলেটটা। বেরিয়ে গেল হাঁ করা মুখ দিয়ে। দাঁত, ঠোঁট, জিভ, মাড়ি-কিছু থাকল না, ওগুলোর জায়গায় বড় একটা গর্ত দেখা গেল। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত, লাল হয়ে গেল দেয়াল।

তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল একজন ওয়েট্রেসের গলা থেকে। বারে বসা লোকগুলো ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। আর্তনাদ থামার পর কোথাও কোন শব্দ নেই, নিস্তব্ধতা জমাট বাঁধল। কেউ নড়ল না।

সবাই যখন হতভ’, সিঁড়ি বেয়ে ঝুল-বারান্দা থেকে তীর বেগে নেমে গেল এক লোক। ঢিলেঢালা রেনকোট পরনে, হ্যাটটা নেমে এসে মুখ ঢেকেছে। বিস্ফোরিত হলো দরজা, বাইরের অন্ধকারে বেরিয়ে গেল সে।

লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে সিঁড়ির দিকে ছুটল কয়েকজন লোক, তাদের পিছু নিল লবিইস্ট আর বারটেণ্ডার। লোকগুলো দরজা খুলে বেরিয়ে গেল, কিন্তু লবিইস্ট আর বারটেণ্ডার হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেরিলিনের দিকে। বাইরে একটা গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ হলো।

মেরিলিন মারা গেছে।

.

বাইরে অন্ধকার, লোকগুলো শুকনো মুখে ফিরে এল।

কর্নেল অবসন পালিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *