৬
আটান্ন সালের গ্রীষ্মে মিম্বার্স নদীর তীরের উপত্যকায় পৌঁছলাম আমরা-গুটিকয়েক গরু আর সাপ্লাই ভরা ওয়াগন নিয়ে কয়েকজন মানুষ।
কুক’স প্রিংকে পেছনে ফেলে, ব্ল্যাক রেঞ্জ পর্বতমালাকে হাতের বাম পাশে রেখে নদী পেরিয়ে আরও এগিয়ে গেলাম, মোগোলন পর্বতশ্রেণীর বুনো নির্জন এলাকায় প্রবেশ করলাম। স্ক্যাবার্ডে বা হাঁটুর ওপর রাইফেল প্রস্তুত আমাদের, যেহেতু অ্যাপাচী এলাকার ঠিক মাঝখানে আছি এখন, দিন দুই চলার পর আমাদের স্বপ্নের জমিতে পৌঁছলাম।
সেন্ট অগাস্টিন পর্বতমালার পাহাড়ী এলাকা এটা, নয়ন জুড়ানো বিস্তৃত তৃণভূমি ছড়িয়ে আছে মাইলকে মাইল। এরচেয়ে সুন্দর সমৃদ্ধ তৃণভূমি সারা জীবনেও দেখিনি। ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো অ্যান্টিলোপ আর বুনো ঘোড়ার কিছু পাল চোখে পড়ল।
ঝর্নার ধারে ক্লিফের লাগোয়া উঁচু একটা জায়গায় ক্যাম্প করলাম আমরা। ক্লিফের গুহায় অসংখ্য বাদুড় বাসা বেঁধেছে। দীর্ঘ ঘাসে চরছে গরুগুলো। এদিকে আমরাও হাত গুটিয়ে বসে নেই-পোল-করাল তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছি।
পাহাড়ে ভালুক আর হরিণের ছাপ চোখে পড়েছে। কাঠ কাটার মাঝখানে বিশ্রামের জন্যে থামল স্যাম গার্ট। নিষ্কণ্টক জমি এটা; ড্যান, কিন্তু যদূর শুনেছি ইন্ডিয়ান একটা ট্রেইল আছে ধারে-কাছে, এ পথে যাওয়া-আসা করে ওরা। আমাদের বোধহয় সতর্ক থাকা উচিত।
করালের কাজ শেষ হলে দুর্গ তৈরি করব আমরা, কিন্তু সবার আগে ঘোড়ার জন্যে করাল আর শেড তৈরি করতে হবে। আশপাশে বুনো ঘোড়া যা দেখলাম, ঘোড়া নিয়ে ভাবতে হবে না।
দুৰ্গটা শুরুতে নেহাত সাদামাঠা গোছের মনে হলো। ইংরেজি ভি আকৃতির একটা শেড তৈরি করলাম প্রথমে, খোলা উপত্যকার দিকে ওটার মুখ। একপাশে করালের জন্যে খুঁটি গেড়েছি, অন্যপাশে মাটির দেয়াল দাঁড় করিয়েছি। পেছনে ক্লিফের খাড়া নিরেট দেয়াল। দেখতে দুর্গের মত না হলেও, নিরাপত্তার বিচারে চলনসই-মাঝারি ধরনের যে কোন আক্রমণ ঠেকিয়ে দেয়া যাবে।
তিনদিন পর আমাদের বাড়ি-টেক্সাস হাউস-খাড়া হয়ে গেল। একপাশে অটম্যানরা থাকবে, অন্যদিকে বুচার্ডরা। বাঙ্কহাউসের কাজ প্রায় শেষ। এদিকে উপত্যকার সমৃদ্ধ ঘাসে চরে মোটা-তাজা হতে শুরু করেছে গরুগুলো। চারপাশের এলাকায় স্কাউট করেছি আমরা, হরিণ আর পাহাড়ী সিংহ শিকার করেছি।
বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে, সত্যিকার বাড়ি-কারণ এখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব আমরা।
চারপাশের সব খবরই আসে আমাদের কাছে। মিম্বার্স ভ্যালির ওদিকে দু’একটা গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, হোনাস গান্ট নামটা শোনা যাচ্ছে খুব। এই লোকের কথাই বলেছিল ট্যাপ এডলে।
তারপর একদিন উপস্থিত হলো ওরা-গান্ট এবং ট্যাপ। আরও একজন রয়েছে ওদের সঙ্গে। সাটক্লীফের সঙ্গী ব্লন্ড লোকটা।
খেপে আছে ট্যাপ, ঈর্ষায় পুড়ছে-ওর ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট। চারপাশে চকিত দৃষ্টি চালাল ও। ব্যাপারটা কি, ড্যান? আমি তো জানতাম, মিম্বার্স ভ্যালিতে আমাদের সঙ্গে বসতি করবে তোমরা?
তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব, শান্ত স্বরে বললাম ওকে, ব্লন্ড লোকটার দিকে আঙুল তাক করলাম। আগে ওকে এখান থেকে কেটে পড়তে বলো। ফের যদি এখানে দেখি, ওকে খুন করব আমি।
ও আমার বন্ধু। বাদ দাও।
ও কিভাবে তোমার বন্ধু হয়, ট্যাপ? আমাদের পাল ছিনিয়ে নিয়েছে কোমাঞ্চেরোরা, দলে এই লোকটাও ছিল। ওদের কারণেই মারা গেছেন বাবা।
আড়ষ্ট হয়ে গেল ট্যাপের মুখ। শুনেছি। খবরটা বিশ্বাসই করতে পারিনি।
করালের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে কার্ল ক্ৰকেট, টেক্সাস হাউসের দরজায় জিম মুর আর মিলো ডজ অবস্থান নিয়েছে। সতর্ক, তৈরি ওরা।
ওকে চলে যেতে বলো, ট্যাপ।
চোয়ালের পেশী শক্ত হলো ট্যাপের, কঠিন চাহনিতে তাকাল আমার দিকে। হয়েছে কি কিড, আমাকেও পরামর্শ দেয়া শুরু করেছ দেখছি! তোমার কথামত…
সবার ওপর চোখ রেখেছি, বিশেষ করে ব্লন্ড লোকটাকে। তুমি, তাকে বললাম। স্পার দাবাও, স্রেফ কেটে পড়ো এখান থেকে! ফের যদি দেখি তোমাকে, কথা না বলে গুলি চালাব।
জিভ চালিয়ে ঠোঁট ভেজাল লোকটা। নিজেকে কি মনে করো তুমি, আঁ? বেশি বাড়…
গুলি করে স্যাডল থেকে ফেলে দিলাম লোকটাকে।
মুহূর্ত খানেকের নীরবতা, সামান্য টু শব্দ করল না কেউ, নড়লও। পিস্তলের নল কিছুটা নিচু করলাম আমি, ধোঁয়া উঠছে এখনও। মাটিতে পড়ে আছে ব্লন্ড লোকটা।
হোনাস গান্টের মনে যাই থাকুক, সেটা বাস্তবে পরিণত করার দুঃসাহস হলো না। কার্লের হাতে রাইফেল চলে এসেছে, মিলোও ওর শার্পসটা তাক করে রেখেছে ওদের দিকে।
ট্যাপ, বললাম আমি। এই লোকটাকে তুলে নিয়ে কেটে পড়ো। যে-কোন সময়ে আসতে পারো এখানে, কিন্তু যখনই আসবে, ভুলেও ওর মত খুনী রেনিগেডদের সঙ্গে এনো না।
কাধে গুলি লেগেছে লোকটার, কিন্তু ব্যাটার চেহারা দেখে মনে হলো যেন বুকে বিঁধেছে গুলিটা।
স্যাডলে স্থির হয়ে বসে আছে ট্যাপ এডলে, অদ্ভুত দৃষ্টি ওর চোখে-যেন এই প্রথম দেখছে আমাকে।
আবার আসব আমি, ড্যান। তোমার খোঁজে আসব। কেউ আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলে নিস্তার পায়নি!
তুমি আমার ভাই, ট্যাপ, হয়তো রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্তু এভাবেই বড় হয়েছি আমরা। তোমার সঙ্গে কোন গোলমালে যেতে চাই আমি, তবে শুক্রর সঙ্গে তোমাকে মেলামেশা করতে দেখলে প্রশ্নটা উঠবেই-আসলে কার প্রতি বিশ্বস্ত তুমি?
আমাকেও দেখতে পাবে! শীতল স্বরে ঘোষণা করল গান্ট।
ওর দিকে তাকালাম। ভাবছিলাম কখন তুমি এই খেলায় যোগ দেবে। যাকগে, যে-কোন সময় তৈরি থাকব আমি, মি. গান্ট!
তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল সে। এখন নয়…বিপক্ষে অনেক লোক। তোমার চামড়া বাঁচাতে ব্যস্ত ওরা।
তাহলে ভাগছ না কেন?
ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল হোনাস গান্ট। এদিকে স্যাডল ছেড়ে নামল ট্যাপ, আহত লোকটাকে ঘোড়ার পিঠে চাপতে সাহায্য করল।
যখন ইচ্ছে আসতে পারো, ট্যাপ। একা অথবা ইলেনকে নিয়ে আসো, আপত্তি নেই আমাদের, কিন্তু উদ্দেশ্যটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৎ হতে হবে।
ইলেন কোথায়? হঠাৎ জানতে চাইল টিম অটম্যান।
সকোবরায় আছে ও, বিষণ্ণ স্বরে বলল ট্যাপ। ভাল আছে।
একটা শটগান রয়েছে অটম্যানের হাতে। তোমরা কি বিয়ে করেছ?
শূন্য দৃষ্টিতে অটম্যানের দিকে তাকাল ট্যাপ। ঠিক ধরেছ। তুমি কি ভেবেছ অন্য কিছু করব?
ওর দিকে খেয়াল রেখো। আমি গানফাইটার নই, ট্যাপ এডলে, কিন্তু এই শটগান থেকে গুলি করতে বন্দুকবাজ হওয়া লাগবে না!
চলে গেল ট্যাপ, আহত লোকটার ঘোড়া লীড করছে। সমানে বিলাপ করছে ব্লন্ড। শপথ করছে সুযোগ পেলে দেখে নেবে আমাকে।
দাঁড়িয়ে থেকে, উপত্যকা ছেড়ে ওদের চলে যেতে দেখলাম আমি। প্রখর রোদ গ্রাহ্য করছি না। ট্যাপ এডলের অপসৃয়মান কাঠামোয় স্থির হয়ে আছে দৃষ্টি, কৈশোরে ও-ই ছিল আমার আদর্শ-নায়ক, আর এখন একমাত্র বন্ধন, আত্মীয় বলতে কেবল ওকেই চিনি। নিজেকে কেমন নিঃসঙ্গ, একাকী মনে হলো।
বুনো দেশ এটা। কঠিন এখানকার জীবনযাত্রা। জীবিকা আর বেঁচে থাকার তাগিদে কঠিন হতে হয় সবাইকে। নিয়ম বা রীতিগুলোও প্রয়োগ করতে হয়, সীমারেখা টেনে দিতে হয় যাতে অনায়াসে পড়তে পারে সবাই।
ট্যাপ এডলে ভিন্ন খাতে গড়া। আমার কাছে মনে হয়েছে ও আসলে ছন্নছাড়া, শুধু সেজন্যেই নিজের অবস্থান কখনও উপলব্ধি করতে পারেনি, সীমানা নিয়েও ভাবেনি কখনও। তো, আজ একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে। সে জেনে গেছে কোথায় আমার অবস্থান।
ওই ব্লড লোকটা পিস্তল বের করার চেষ্টা করলে কি করতাম জানি না, নিশ্চিত নই আমি, কিংবা পরোয়াও করি না। বাবার মৃত্যুর সময় ধারে-কাছে ছিল: লোকটা, সে নিজে গুলি করুক বা না-করুক, সমান দায়ী বাবার মৃত্যুর জন্যে-আবার সে নিজেও কাজটা করে থাকতে পারে।
একটা জিনিস শিখেছি আমি। এতে তর্ক আর ঝামেলা থেকে বাঁচা যায়। সম্ভবত ভুল থেকেই সংঘাতের পথ তৈরি হয়; যদি কারও সঠিক অবস্থান অন্যরা জানতে না পারে। বুনো এবং নির্জন অঞ্চলে এসেছি আমরা, আইন বিবর্জিত একটা অঞ্চল, সামাজিক রীতি বা নিয়মের থোড়াই পরোয়া করে এমন লোকের অভাব নেই এখানে-আবার ঠিক বিপরীত চরিত্রের লোকও আছে যারা স্কুল, চার্চ তৈরি করতে চায়; চায় একটা দিন ঘুরে বেড়ানোর জন্যে বা বাজার করার জন্যে উন্মুক্ত থাকবে, যারা হৃদ্যতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সমাজ গড়তে চায়।
এখন, নিজের অবস্থান পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছি আমি, ভুল বোঝাবুঝির কোন অবকাশ নেই…
ট্যাপরা চলে যাওয়ার পর, এ নিয়ে কেউই কোন মন্তব্য করল না। যার যার কাজে ফিরে গেলাম আমরা, এটাই ধ্রুব সত্য-জন্ম-মৃত্যুর মতই চিরন্তন। দৈনন্দিন কাজ কখনও পুড়ে থাকে না। জীরন ধারণের জন্যেই করতে হয়। খাবার তৈরি, গরুর যত্ন, মাংস যোগাড়, বেড়া তৈরি বা মেরামত, কাঠ সংগ্রহ-সবই চলছে পুরোদমে। শুধু রুটি খেয়ে বাঁচতে পারে না মানুষ, অন্য কিছু পাওয়ার আগে রুটির রুজি করতে হয়। অবকাশ থেকে সভ্যতার ঠিকানা তৈরি হয় বটে, কিন্তু জমিতে ফসল ফলানোর পরই কেবল অবকাশ মেলে।
অন্তস্তল থেকে এসব উপলব্ধি করি আমরা, কারণ নিঃসঙ্গ মানুষ মাত্রই চিন্তাশীল এবং সুবিবেচক, জীবনের অসঙ্গতিগুলো পুরণ করার উপায় বাতলে অবসরটুকু কাটায় এরা।
পুবে যাওয়ার সময় হয়েছে এখন, পালের গরু ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে আমাদের। মনে হয় না গরু বিক্রি করে ফেলেছে ওরা, অন্তত আমি যথেষ্ট সন্দিহান; আমার নির্দেশ শুনে ফেলিপ জাপাটা খেপে গিয়ে গরু বিক্রি করার ব্যাপারে তাড়া অনুভব করবে, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু মনে হয় না গরু বিক্রি করেছে সে। সে চাইলেও-আমার সন্দেহ-অন্য কেউ জড়িত আছে এসবে।
টিম, পালের খোঁজে যাচ্ছি তামি, টিম অটমানকে ডেকে বললাম। তোমাকে দায়িত্বে রেখে যাচ্ছি। জিম মুর আর টম জেপসন থাকবে তোমার সঙ্গে-সুয়ারেজও থাকছে।
আমি তোমার সঙ্গে যাব, ড্যান, একটা রিয়াটা তৈরি করছিল মেক্সিকান, মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে। আমি সঙ্গে থাকলেই মঙ্গল হবে। জাপার্টার অনেক লোকজন। ওঁকে ধরতে হলে মেক্সিকানদের সঙ্গে দেখা করতে হবে। ওদের কাছে তুমি একজন আগন্ত্রক, জাপাটা মেক্সিকান বলে কেউ তোমাকে সাহায্য করতে চাইবে না। তোমার বিরুদ্ধে না গেলেও কেউই সাহায্য করবে না।
কিন্তু আমি সঙ্গে থাকলে, জাপাটার কুকর্মের কথা আমার কাছ থেকে জানতে পারলে বিশ্বাস করবে ওরা। তাহলে শুধু কোমাঞ্চেরোদেরই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে তুমি। সামান্য হাসল সে। দলটা অনেক বড়, সেনর, আমি সঙ্গে থাকলে উপকারই হবে তোমার। তাছাড়া ওদের সঙ্গে কিছু দেনা-পাওনা বাকি রয়ে গেছে আমার।
ঠিকই বলেছে সে, যুক্তির সঙ্গে তর্ক করা চলে না। টেক্সাস বা নিউ মেক্সিকোর এসব স্প্যানিশ-আমেরিকানরা গোষ্ঠিপ্রিয়। বাইরের লোকদের পছন্দ করে না, তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। এমন মানসিকতার জন্যে দোষ দেওয়া যায় না ওর। একজন আগন্তুক গ্রিংগো হিসেবে আমাকে দেখবে ওরা। আমাদের এই সমস্যার ব্যাপারে মোটেই ভাববে না-সত্যি কি মিথ্যে বলছি আমি; এক্ষেত্রে দুটো ব্যাপার ঘটতে পারে-হয় স্রেফ আমাকে উপেক্ষা করবে, নয়তো বিরুদ্ধে চলে যাবে।
কার্ল, গার্ট, মিলো, জুয়ারেজ আর আমি-পাঁচজনে রওনা দিলাম। ছোট্ট একটা দল, অন্তত কাজের তুলনায় দুলটা নেহাতই ছোট।
রিও গ্রান্ডের তীরে ছোটখাট শান্ত শহর সকোরো। পুয়েবলোর এক পাশে গড়ে উঠেছে। বহু আগে, ১৬২৮ সালে মিশন তৈরি হয়েছিল এখানে, কিন্তু পুয়েবলো বিদ্রোহের সময় লোকজন দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ে, রিও গ্রান্ডের তীরে একই নামে একটা বসতি তৈরি করে। ১৮১৭ সালে ফিরে গিয়ে এরাই পুনরায় তৈরি করে গ্রামটা। এর সবই জুয়ানিতার কাছ থেকে শোনা, ম্যাগোফিন্সভিল থেকে পশ্চিমে যাওয়ার সময় বলেছে ও।
সংখ্যায় অল্প হলেও, এ ধরনের কাজে অভিজ্ঞ আমরা-ঝামেলা সামাল দিতে দক্ষ। টেক্সাসের বুনো অঞ্চলে এমনিতে বড় হয় না কেউ। তেরো বছর বয়সে এক কিওয়াকে প্রথম খুন করে কার্ল ক্ৰকেট, তারও আগে, পুরো এক সপ্তাহ কোঞ্চিদের একটা দলকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছেড়েছে ও, নিজের চোখে পরিবারকে খুন হতে দেখেছে।
স্যাম গার্টের আদি নিবাস কেন্টাকি এবং টেনেসি। নাচেল ট্রেসের ধারে-কাছে কেটেছে ওর, পাহাড়ী মানুষ। জীবনের বেশিরভাগ সময় শিকারী ছিল। মিলো ডজ টেক্সাস রেঞ্জার ছিল একসমসয়, মেক্সিকান যুদ্ধের সময় বালক বয়সেই যুদ্ধে শামিল হয়েছিল।
সকোরোয় ঢুকলাম আমরা। ছোটখাট কিন্তু টাফ একটা দল। সাপ্লাই কিনে পশ্চিমে যাত্রা করব, কোমাঞ্চেরোদের এলাকায় যেতে কয়েকদিন লেগে যাবে।
একটা ক্যান্টিনায় ঢুকলাম আমরা। ড্রিঙ্ক গেলার চেয়ে খবর সগ্রহ করার আগ্রহই বেশি। তবে চারজন ঢুকেছি ভেতরে। আঙুর থেকে ওয়াইন তৈরি করে এরা, তারই ফরমাশ দিলাম। অবশ্য বহু পুরোনো কিছু আপেল গাছও আছে এদিকে, শোনা যায় রোমানরা লাগিয়েছিল এগুলো।
ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। শান্ত। টেবিলে হ্যাট রেখে দীর্ঘ বাদামী চুলে আঙুল চালাল কার্ল, মেয়েদের মতই লম্বা চুল ওর। আকর্ষণীয়। গোঁফে তা দেয়ার ফাঁকে, নীরবে ওকে দেখছে স্যাম গার্ট।
অপেক্ষা করার গভীরে এক ধরনের শান্ত স্থৈর্য রয়েছে আমাদের মধ্যে। প্রত্যেকেই জানি নিকট ভবিষ্যৎ কি রয়েছে, কিংবা সকোরো পেরিয়ে পশ্চিমে, যাওয়ার সময় কি ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। প্রথমে অ্যাপাচীদের এলাকা, তারপর কোমাঞ্চি অঞ্চল-রাইডার হিসেবে দুর্ধর্ষ ওরা, দুর্দান্ত লড়য়ে। অসংখ্য শত্রুকে পেছনে ফেলে যেতে হবে। মাত্র গুটিকয়েক লোক আমরা। কিন্তু এটা আমাদের কর্তব্য, পিছিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে কারও নেই।
ওয়াইনটা ভাল। কিছুক্ষণ পর ক্যান্টিনার মালিক ফ্রিগোল পরিবেশন করল। টরটিয়া আর মশলাদার ডিমও রয়েছে মেনুতে।
ক্যান্টিনায় ঢুকল জুয়ারেজ। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল সে, ভেতরের অপেক্ষাকৃত স্নান আলোয় চোখ সয়ে আসার পর টেবিলে এসে বসল। ঝুঁকে এল সে, চোখ দারুণ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। বন্ধুদের কাছ থেকে জবর একটা খবর পেয়েছি!
অপেক্ষায় থাকলাম আমরা। সিগারেটো বের করে দুই ঠোঁটের সঙ্গে, চেপে ধরল জুয়ারেজ।
পেলো টিউটে যেতে হবে না আমাদের…টুলারোসায় আছে জাপাটা।
এখান থেকে পুবে শহরটা, তাই না? জানতে চাইল স্যাম।
খুব ছোট জায়গা। অ্যাপাচীরা ঘনঘন আক্রমণ করে বলে বেড়ে ওঠেনি। লাস প্লাসিটাস নামে একটা জায়গা আছে কাছাকাছি। পাশে ফোর্ট স্টান্টন, সৈন্যরা আছে ওখানে। সিগারেটো ধরাল সে। শুনলাম সৈন্যদের কাছে বিক্রি করার জন্যে গরুর পাল, ওখানে নিয়ে গেছে জাপাটা।
জানতাম না ফোর্ট আছে ওখানে, বলল মিলো ডজ। স্টান্টন, তাই তো বুললে? কয়েক বছর আগে স্টান্টন নামে এক ক্যাপ্টেন মারা গিয়েছিল ওখানে।
সি, ওর নামেই জায়গাটার নামকরণ করা হয়েছে। ফোর্ট তৈরি হয়েছে পঞ্চান্ন সালে। লোকজন রিও বনিটোর আশপাশে বসতি করছে, কিন্তু আমার তো মনে হয় অ্যাপাচীদের তোপের মুখে দেশছাড়া হবে সবাই।
জাপাটা আছে ওখানে?
সি...সঙ্গে প্রায় সব কু আছে ওর। গরুর পাল ছাড়াও কিছু ঘোড়াও আছে সঙ্গে।
ওখানেই যাব আমরা, টেবিলের চারপাশে তাকালাম আমি। ঝটপট পেটপূজা সেরে ফেলল।
বেরিয়ে এসে বোড়ওঅকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলাম আমরা, রাস্তার দু’ধারে সতর্ক দৃষ্টি চালালাম। জানি যে-কোন সময় বিপদ আসতে পারে।
হঠাৎ ইলেনকে দেখতে পেলাম। আসলে বলা উচিত মিলো ডজই দেখতে পেল ওকে। ড্যান…দেখো!
উজের উত্তেজিত স্বরে তাকালাম। আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে ইলেন। মনে হলো বয়স বেড়ে গেছে ওর, কিছুটা স্বাস্থ্যহানিও হয়েছে। বরাবরের মত পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন পোশাক পরনে। আমাদের দেখে থমকে দাঁড়াল মুহূর্তের জন্যে, তারপর চিবুক উঁচু রেখেই এগিয়ে এল।
ইলেন…মিসেস এডলে, বললাম আমি। তোমাকে দেখে সত্যি খুশি হয়েছি।
কেমন আছ? যেন পরস্পরের অপরিচিত আমরা, এমন সুরে বলল ও। তারপর পাশ কাটিয়ে নিজের পথ ধরল।
তোমার পরিবারের সবাই আছে আমাদের সঙ্গে। ট্যাপ জানে কোথায় জায়গাটা। তোমাকে দেখলে খুশি হবে ওরা।
কয়েক পা এগিয়ে গেছে ও। থেমে, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। আমার তো মনে হয় আমার স্বামীকে পছন্দ করো না তুমি!
যখনই বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হবে তোমাদের, স্মিত হেসে বললাম আমি। নির্দ্বিধায় চলে আসতে পারো। তোমাদের জন্যে যথেষ্ট জায়গা আছে আমাদের-হৃদয়ে এবং ওই উপত্যকায়। কি জানো, বাবা কোন উইল রেখে যায়নি এবং ট্যাপকে তাড়িয়ে দিলেও ওকে যথেষ্ট পছন্দ করতেন তিনি। যাকগে, ওসবে কিছু যায়-আসে না এখন। ট্যাপ ফিরে এলেই বরং খুশি হব আমি। সমান-সমান ভাগাভাগি করব আমরা।
ধন্যবাদ।
ফের এগোতে গিয়েও থামল ইলেন। হয়তো আমাদের আচরণে এমন কিছু ছিল, কিংবা আমাদের সাজসজ্জা দেখে-কারণ প্রত্যেকের কাছে রাইফেল ছাড়াও দুতিনটে করে পিস্তল রয়েছে।
কোথায় যাচ্ছ…কি করছ তোমরা?
গরুর পালের খোঁজে বেরিয়েছি আমরা, ইলেন। আমাদের সব গরু নিয়ে লাস প্লাসিটাসে গেছে ফেলিপ জাপাটা।
কিন্তু…ওই, ওরা তো অনেক লোক! সামান্য সুযোগও পাবে না তোমরা। অন্তত, বিশজন লোক আছে ওর সঙ্গে…দ্বিগুণও হতে পারে।
জানি, ম্যাম, কিন্তু গরুগুলো আমাদের। ওগুলো ফিরিয়ে আনতেই হবে।
এটাই আমাদের মূলমন্ত্র-গরু ফিরিয়ে আনতে হবে। গরু তো আনতে হবেই, উপরন্তু গরুচোরদেরও ছাড় দেব না-কৃতকর্মের শাস্তি ওদের পেতেই হবে। বুনো একটা জায়গায় বসতি করতে হবে আমাদের, শান্তি আনতে হবে। আগামী কয়েক বছর বন্দুকের জোরেই সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ঝামেলাবাজদের কাছে শুধু ঝামেলাই গুরুত্ব পায়-সুবিচার তখনই মানে ওরা; মেনেও নেয়-যখন শক্তি থেকে আসে। অর্থাৎ যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল।
পুবের পাহাড়ের পেছনে সূর্য হারিয়ে গেল, ততক্ষণে বেশ কয়েক মাইল চলে এসেছি আমরা। মরুভূমির মত একটা জায়গা পেরিয়ে এসেছি, লাভার চাঙড় ছাড়িয়ে ঘেসো এক উপত্যকা ধরে এগোলাম। জায়গাটা রিও বনিটোর ধারে। প্রচুর পাইন আর ওক রয়েছে আশপাশে। পাইনের সারিকে পাশে রেখে কিছুদূর এগোতে দূরে অ্যাডোবি দালান আর জীর্ণ কিছু শ্যাক চোখে পড়ল নদীর তীরে।
সব মিলিয়ে হয়তো আট-দশটা হবে। কয়েকটা তাবুও রয়েছে, আর কিছু টিপি। কাছাকাছি গিয়ে ছড়িয়ে পড়লাম আমরা। শহরের ওপাশে গরুর পালটা চোখে পড়েছে। পালের ধারে-কাছে কয়েকজন রাইডার রয়েছে, কারও কারও পরনে ইউনিফর্ম আর মাথায় হেলমেট। এরা নিশ্চই ক্যাভালরির সদস্য।
ঢাল ধরে নিচে নেমে শহরে ঢুকলাম, এগোলাম পালের দিকে। কৌতূহলী লোকজন আমাদের পিছু নিয়েছে। রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে অনেকেই।
একটা ব্যাপার খোলসা করা উচিত, বন্ধুদের বললাম। এটা আমার লড়াই। অন্য কেউ যদি উৎসাহী হয়, আপত্তি নেই, যা ইচ্ছে করতে পারো তোমরা…কিন্তু কথাবার্তা আমিই বলব। জাপাটার সঙ্গে ফয়সালা করব আমি একা। সমানে-সমানে।
না বোঝার কিছু নেই। আমার কাজের ব্যাপারে যাতে কোন সন্দেহ থাকে, সেজন্যেই বলা।
ফেলিপ জাপাটা আছে ওখানে। সঙ্গের লোকটাকে দেখে ভেতরটা শীতল হয়ে গেল আমার। ট্যাপ এঙলে। সঙ্গে হোনাস গান্টও রয়েছে। বোঝা গেল সেদিনের কথাগুলো কোন কাজেই আসেনি।
আট বা নয়জন ওরা। চার-পাঁচজন সৈন্য গরুর পাল জরিপ করছে।
সৈন্যদের দিকে এগোনোর সময় হঠাৎ গান্টকে কথা বলতে দেখতে পেলাম। ঝট করে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল জাপাটা।
জাপাটা বা গান্টের ওপর থেকে চোখ সরালাম না। ক্যাপ্টেন, সামনের দীর্ঘদেহী সৈন্যের উদ্দেশ্যে বললাম। এগুলো চুরির মাল। আমার কাছ থেকে চুরি করেছে ওরা। পরে মার্কা পরিবর্তন করেছে, কিন্তু যে-কোন একটা গরুর চামড়া ছিললে ভেতরে টি-বার ব্র্যান্ড দেখতে পাবে।
গরু কিনছি আমি, মিস্টার, বিরক্ত স্বরে বলল ক্যাপ্টেন, প্রায় শীতল শোনাল কণ্ঠ। এ নিয়ে লড়াই করার খায়েশ নেই আমার, কিংবা গরুর মালিকানা নিষ্পত্তি করার দায়িত্বও দেয়া হয়নি আমাকে। ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল সে। তোমরা নিজেরাই ঠিক করে নাও। লাস পাসিটাসে পাবে আমাকে।
ঘোড়া ঘুরিয়ে এগোল সে। কয়েকজন অফিসার আর সার্জেন্ট অনুসরণ করল।
প্রত্যেকটা লোককে খুঁটিয়ে দেখলাম-একজন একজন করে। প্রত্যেকের প্রতি মনোযোগ দিলাম, অন্তত মিনিট খানেকের জন্যে। আমি চাই প্রতিটা লোক ভাবুক তাকেই গুরুত্বপূর্ণ বা টার্গেট হিসেবে বিবেচনা করছি আমি।
তো, জাপাটা, গরুর পাল ডেলিভারি দাওনি তুমি। বাধ্য হয়ে আমার নিজেরই আসতে হলো।
ড্যান…!ট্যাপের কণ্ঠ। ড্যান, খোদার দোহাই!
ট্যাপ, গোলাগুলি শুরু হওয়ার আগেই বরং ঠিক করে নাও কোন পক্ষে থাকবে, নির্লিপ্ত স্বরে বললাম ওকে। বেড়া ডিঙাতে গেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। বহুদিন ধরেই ওই কাজটা করছ তুমি। যথেষ্ট হয়েছে বোধহয়।
দেখো, আগে তো…
কিসের দেখাদেখি, এডলে!? হঠাৎ খেপে উঠল হোনাস গান্ট। হয় আমাদের সঙ্গে থাকবে, নয়তো বিপক্ষে! সরে দাঁড়াও, দেখো কিভাবে খুন করি ট্রেভেন হারামজাদাকে!
আমি যা করলাম, ঘুণাক্ষরেও এমন কিছু আশা করেনি ওরা। বহু বছর ধরেই ছোটার মধ্যে গুলি করার অনুশীলন করেছি আমি আর ট্যাপ, তুমুল গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে অনায়াসে লক্ষ্যভেদ করেছি, পাহাড়ী মানুষদের মত ঈর্ষণীয় দক্ষতা অর্জন করেছি। স্পার দাবাতে লাফিয়ে এগোল ডানটা, ঠিক ওদের ওপর হামলে পড়ল।
সংখ্যায় বেশি ওরা, সুতরাং গুলিও শুরু করলাম।
দেখে মনে হবে হঠকারি এবং দারুণ বিপজ্জনক একটা কৌশল, কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা যখন এসেছি, বেশিরভাগই বসে ছিল ওরা, নিঃসন্দেহে সবাই একজন করে টার্গেটও ঠিক করে নিয়েছিল। পরিস্থিতি ঠিকই বিচার করেছে ওরা, আমাদের মতই, জানে মুহূর্তের ব্যবধানে কয়েকটা লাশ পড়ে যাবে এখানে।
কিন্তু ভাবেনি নিজেদের লাশ পড়বে।
ঠাণ্ডা মাথায়, নিশানা করে লড়াই শুরু করলে হয়তো সঠিক নিশানায় গুলি করা যাবে, কিন্তু শেষপর্যন্ত হেরে যাব আমরা। সুতরাং সরাসরি ঘোড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওদের ওপর। সব ক’জনকে নড়ে উঠতে বাধ্য করলাম, যার যার টার্গেটকে নিশানায় আনতে সরে যেতে হলো ওদের।
স্যাভলের ওপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে আছে প্যাটার্সনটা। লাফের সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলাম। জাপাটাকে অল্পের জন্যে মিস্ করলাম। কিন্তু ওর পেছনের লোকটা হড়কে পড়ল স্যাডল থেকে। পরমুহূর্তে ওদের ঠিক মাঝখানে আবিষ্কার করলাম নিজেকে। আরেকটা গুলি করলাম প্যাটার্সন থেকে, তারপরই রাইফেল ছেড়ে দিলাম মুঠি থেকে। অল্প দূরত্বে ওটা দিয়ে সুবিধে করা যাবে না। ভোজবাজির মত বাম হাতে উঠে এসেছে বেল্টের পেছনে গুঁজে রাখা কোল্টটা, রাইফেল ছেড়ে দেয়ার সময় ড্র করেছি।
ঘুরে দাঁড়াল জাপাটা, প্রায় আমার মুখের সামনে গর্জে উঠল ওর পিস্তল। ডানের ধাক্কায় কেঁপে উঠল ওর ঘোড়া, স্যাডলে জাপান্টার শরীর টলে গেল। ইতোমধ্যে গুলি করেছি আমি। চাবুকের বাড়ি খেয়েছে যেন, এমন ভাবে স্যাডলে হেলে পড়ল ওর দেহ। ফের গুলি করল সে, কিন্তু ততক্ষণে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছি।
ঘোড়া ঘোরাল সে, কিন্তু ওর ঘোড়াটা বিস্ময়ের কারণেই দ্রুততায় হেরে গেল ডানের সঙ্গে। সামান্য হেরফের হলো বটে, দুজনেই গুলি করলাম আমরা। ফেলিপ জাপাটার নাকের ঠিক নিচে বিঁধল আমার এবারের বুলেট।
ঘুরে গেল জাপাটার দেহ, স্যাডল থেকে খসে পড়ল। প্রায় শেষ মুহূর্তে স্টিরাপ থেকে পা মুক্ত করে নিয়েছে। উঠে দাঁড়ানোর প্রয়াস পেল সে, মুঠিতে পিস্তল ধরে রেখেছে, গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে বুলেটের ফুটো দিয়ে।
তুফান বেগে ছুটল ডানটা, খানিক নিচু করলাম পিস্তলটা, একেবারে কাছ থেকে গুলি করলাম। গুলির তুবড়িতে জাপাটার শার্ট থেকে ধুলো চটকে উঠতে দেখতে পেলাম-দু’বার; তারপরই পড়ে গেল সে। ডানটা মাড়িয়ে গেল ওকে।
ঝটিতি ঘোড়া ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম দৃশ্যটা-হোনাস গান্টের মুখোমুখি হয়েছে ট্যাপ এডলে। ওদের সঙ্গে আছি আমি, হোনাস! ও আমার ভাই!
নরকে যাও তুমি! ট্যাপের বুকে নিশানা করল গান্ট। আমার মতই, ছোটার মধ্যে গুলি করল ট্যাপ।
স্যাডল থেকে খসে পড়ল গান্ট, ধুলোয় পড়ার পর পাক খেয়ে চিৎ হলো শরীর। একবার ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু নিথর হয়ে গেল দেহটা।
বাতাসে ধুলো উড়ছে, চক্কর খাচ্ছে। ধীরে ধীরে থিতিয়ে এল। সওয়ারহীন ঘোড়াগুলো এলোমেলো পা ফেলল, ঝুলন্ত স্টিরাপ ঝাঁকি খেল। তার শান্ত হয়ে মাথা তুলল ঘোড়াগুলো। ধুলোয় পড়ে আছে। কয়েকটা লাশ।
গার্ট ভূপতিত হয়েছে। যন্ত্রণাকাতর মুখে এক হাতে রক্তাক্ত বাহু চেপে ধরেছে কার্ল।
প্রতিপক্ষের চারজন শেষ। আচমকা ওদের ওপর লাফিয়ে পড়ার জন্যেই লড়াইয়ের সমীকরণ ওলট-পালট হয়ে গেছে, আমাদের পক্ষে চলে এসেছে। প্রয়োজন পড়া মাত্র, মুহূর্তের মধ্যে গুলি করতে অসুবিধে হয়নি আমার বন্ধুদের, নিশানা ঠিক করাই ছিল ওদের।
ঘোড়া ছুটিয়ে ওখানে পৌঁছল সৈন্যদের একটা দল। একজন পৌঁছে গেল কার্লের পাশে। দেখি! তোমার ক্ষতটা দেখতে দাও! আমি আর্মির সার্জন!
চারপাশে, পড়ে থাকা লাশগুলো দেখলাম। ফেলিপ জাপাটা মারা গেছে, অন্যদের মধ্যে কেবল একজন জীবিত। মৃতদের মধ্যে চার্লি হীথও আছে। ক্ষণিকের এই লড়াইয়ে ওকে খেয়াল করিনি, কিংবা জানিও না কার বুলেটে মারা পড়েছে সে। কিন্তু কুৎসিত মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে তাকে।
ক্ষত দেখে বোঝা গেল ভারী ক্যালিবারের বুলেট ওটা, নিশ্চই পমেল বা অন্য কিছুতে আগে লেগেছিল, তারপর ছিটকে গিয়ে ঢুকেছে হীথের পেটে। ক্ষতটা রিকোশেটের। পেট ফুড়ে চলে গেছে সীসা, নাড়ি-ভুঁড়ি ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। করুণ এবং বীভৎস মৃত্যু, জাতশত্রুরও এমন মৃত্যু কামনা করে না কেউ।
অফিসার চলে এসেছে। তার দিকে এগোলাম আমি। ক্যাপ্টেন, ওই লোকের নাম ফেলিপ জাপাটা, পড়ে থাকা বিশালদেহী কোমাঞ্চেরোকে দেখিয়ে বললাম। বহু বছর ধরে ইন্ডিয়ানদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছে ও। ওর জাতভাইরা আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করবে।
আমি গরু কিনছি, মিস্টার, ব্যক্তিগত কোন কলহ বা সংঘাতে মাথাব্যথা নেই আমার। যাই হোক, জাপাটা সম্পর্কে শুনেছি, তবে জানতাম না এই লোকের সঙ্গেই ব্যবসা করছি। আমার দিকে ফিরল সে আমার নাম ডবসন! কেলি ডবসন। তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, স্যার দারুণ দেখিয়েছ তোমরা বিশেষ করে তুমি! জবাব নেই ওই কৌশলটার।
মাটি থেকে প্যাটার্সনটা তুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিল কার্ল ক্রকেট। তুমি বরং ডাক্তারের কাছে যাও, ড্যান। রক্ত বেরোচ্ছে তোমার ক্ষত থেকে।
ঠিকই তো আছি। আমি স্রেফ… নিচে তাকাতে সেডলের স্কার্টে রক্ত দেখতে পেলাম, পুরো বাম পা ভিজে গেছে রক্তে।
তুমি! আঙুল তুলে আমাকে নির্দেশ দিল সার্জন। স্যাডল থেকে নেমে এদিকে এসো!
নামতে গিয়ে পড়ে গেলাম আমি, নিজেও জানতাম না সত্যিই কতটা আহত হয়েছি ছুটে এসে আমাকে চেপে ধরল ট্যাপ। ধরাধরি করে একটা গাছের নিচে আমাকে বসাল ও, শার্ট খুলে ফেলল।
কোমরের ঠিক ওপর দিয়ে মাংস, কুঁড়ে চলে গেছে বুলেট! প্রচুর রক্ত হারিয়েছ বটে, কিন্তু ক্ষতটা তেমন মারাত্মক নয়, ক্ষতটা দেখার পর জানাল ডাক্তার।
খুরের শব্দ শুনতে পেলাম, তুমুল বেগে ছুটে আসছে কয়েকটা ঘোড়া। চোখ তুলে তাকাতে জুয়ানিতাকে ঘোড়া থেকে নামতে দেখতে পেলাম আমি, ছুটে কাছে চলে এল ও{ সরু চোখে ওর দিকে তাকাল ডাক্তার, তারপর আমার দিকে। ও যদি তোমাকে সুস্থ করতে না পারে, শুকনো স্বরে বলল সে। তাহলে কেউ পারবে না।
স্যাম গার্ট মারা যায়নি। দুটো বুলেট ঢুকেছে ওর শরীরে। অবস্থা গুরুতর হলেও ঠিক সেরে উঠবে ও। পরে আমাকে বলেছে ট্যাপ। এদিকে জুয়ানিতা আসার পর সবকিছু ঘোলাটে হয়ে যায়, কিছু বলার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু জিভটাকে খুব ভারী মনে হলো। সারা পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে।
পরে নিজেকে ফোর্টের হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করলাম।
গরু নিয়ে যেতে কোন অসুবিধে হয়নি তো?
সব বেচে দিয়েছি, বলল ট্যাপ। অবশ্য কয়েকশো ব্রীডিং স্টক রেখে দিয়েছি।
মনে হচ্ছে এখানে কয়েকটা দিন থাকতে হবে আমার, বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বললাম আমি, প্রশান্তি অনুভব করছি। তুমি বরং গরু নিয়ে বাড়ি চলে যাও।
ড্যান, দ্বিধা করছে ট্যাপ, জীবনে এমন বিব্রত হতে দেখিনি ওকে। বেকুবের মত কাজ করেছি আমি। আমি…স্বীকার করছি, বস্ক রেডোণ্ডোয় ওই গরুর পাল নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আগেই ছিল আমার। মিম্বার্স ভ্যালির জমির দখল নেওয়ার জন্যে পালটাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম আমি আর হোনাস গান্ট।
আমিও এরকম কিছু সন্দেহ করেছিলাম।
মিনিট কয়েক স্থির দৃষ্টিতে আমাকে দেখল ও। ড্যান, ইলেনকে নিয়ে সবার কাছে চলে যাব আমি। তুমি সুস্থ হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকব, তারপর একসঙ্গে বাড়ি ফিরে যাব আমরা।
নিশ্চয়ই, ক্লান্ত কিন্তু সন্তুষ্ট স্বরে বললাম আমি। বাবা সবসময় এটাই চাইতেন-একসঙ্গে থাকব আমরা!