অপঘাত – ৪

নদীর পানি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। এক রাতের ব্যবধানে তৃষ্ণার্ত গরুর পেটে চলে গেছে সব পানি। একটু আগেও যেখানে পানি ছিল, সেখানে এখন থকথকে কাদা, সকালের সূর্যের আলোয় ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসছে।

বেশ, ড্যান, এবার তোমার পালা, গম্ভীর মুখে বললেন বাবা। আমি ক্যাটলম্যান নই, এটুকু বোঝার মত বুদ্ধি আছে আমার। এখন থেকে তুমি ড্রাইভ নিয়ে যাবে। তোমাকে নতুন করে বলার দরকার নিশ্চই হবে না, এই ড্রাইভের সাফল্যের ওপর কতটা নির্ভর করছি আমরা।

আশি মাইল পথ-কম-বেশি হতে পারে-পেরিয়ে হর্স হেড যেতে হবে, সবার উদ্দেশে বললাম আমি। পেকোসের কাছাকাছি অবশ্য কিছু ওঅটরহোল পাওয়া যাবে। আমি বা অন্য যে-কোন একজন আগে আগে রাইড করব, বিপজ্জনক ওঅটরহোলগুলো স্পট করতে হবে। গরুর দলকে ওসব উৎসে যেতে দেয়া যাবে না, যেভাবে হোক ঠেকিয়ে রাখতে হবে।

ওসব পানিতে ক্ষারের ঘন স্তর পড়ে আছে, পানি পান করা মানেই মৃত্যু। আমাদের পালে সব ধরনের গরুই রয়েছে, তবে কষ্টকর ড্রাইভের জন্যে অভ্যস্ত গরুগুলো। এখন থেকে যেটাই পিছিয়ে পড়বে; ওটাকে পেছনে ফেলে যাব আমরা। পথে কোন বাছুর জন্ম নিলে মেরে ফেলতে হবে।

সারাদিনে হয়তো পনেরো-ষোলো মাইল এগোতে পারব আমরা। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, এরচেয়ে বেশি যেতে হবে আমাদের এবং পানি ছাড়া।

প্রথম রাতে একটু দেরি করে ঘুমাব আমরা, সকালে আগে আগে রওনা দেব। কিন্তু তারপর থেকে পুরুষরা দিনে-রাতে প্রায় সারাক্ষণই রাইড করবে।

আমি রাইড করতে পারব, ভিড়ের শুরুতে দেখতে পেলাম জুয়ানিতাকে। বাচ্চা বয়স থেকে গরু নিয়ে কাজ করেছি আমি। এই ডাইভে কোন ভাবে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারলে খুশি হব আমি। জুয়ারেজ সুস্থ হলে সেও হাত লাগাতে পারবে।

তোমার সাহায্য কাজে লাগবে, ম্যাম, জবাব দিলাম আমি। ধন্যবাদ।

কয়েক মিনিট কেউই কিছু বলল না, শেষে মুখ খুলল টিম অটম্যান। আশি মাইলের মধ্যে কোন পানি নেই? তাহলে মাসট্যাঙ পুলের ব্যাপারটা কি গুজব?

হয়তো সত্যিই আছে, ওখানে যে পানি পাওয়া যাবে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় নেই। তাই পানি পাওয়া যাবে না ধরে নেয়াই ভাল।

শ্রাগ করলেন বাবা। এমন কিছু হতে পারে ভেবেই এসেছি আমরা। কেউ বলতে পারবে না যে আগেই তাকে সতর্ক করা হয়নি। এখন, আসলে যা করা উচিত আমাদের-সব ব্যারেল, জার পানিতে পূর্ণ করে ফেলতে হবে, আর যতটা সম্ভব কম পানি ব্যবহার করতে হবে।

কার্ল নেতৃত্ব দিচ্ছে, আগে আগে চলল সে, বড় বড় বাদামী চুল উড়ছে বাতাসে। ওর পিছু নিল ডোরাকাটা বলদটা, এখনও যে ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে ওটা খোদা মালুম; এবং ঠিক পেছনেই রয়েছে গরুর পাল।

দু’পাশে-পালের কিনারে-রয়েছে বেন টিল্টন আর মিলো ডজ। ওদের পেছনে রয়েছে ফ্রিম্যান স্কয়ার এবং স্যাম গার্ট।

ঘুরে টিম অটম্যানের দিকে এগোলাম আমি। ওয়্যাগনে উঠছে সে, এদিকে আগেই আসনে চেপে বসেছে মিসেস অটম্যান। বিষণ্ণ মুখ, দৃষ্টি দিগন্ত ছাড়িয়ে গেছে।

সব ঠিকঠাক আছে তো, টিম?

ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল সে। না–তুমি ভাল করেই জানো। ইলেন চলে গেছে, অথচ ওকে আটকে রাখতে পারতে তুমি, ড্যান!

আমি? আর যাই হোক, এমন কোন মন্তব্য টিম অটম্যানের কাছ থেকে আশা করিনি আমি। টিম, আমার জন্যে থাকত না ও। আমার তো মনে হয় অন্য কারও জন্যেও থাকত না।

আমরা তো ভেবেছি বিয়ে করবে তোমরা। অন্তত আমার ধারণা ওরকমই ছিল। ছন্নছাড়া ওই ট্যাপ এডলেকে কখনোই পছন্দ হয়নি আমার।

মানুষ হিসেবে মন্দ নয় ও। আর…আমার এবং ইলেনের মধ্যে বিয়ে সম্পর্কে কোন কথা হয়নি। গল্পগুজব করেছি আমরা, এলাকায় সমবয়সী আর কোন ছেলে-মেয়ে ছিল না…স্রেফ আমরা দুজন। ইলেন কিন্তু সত্যিই ট্যাপকে পছন্দ করে।

মেয়েটাকে শেষ করে দেবে সে, যদি না পথে কোথাও মরে পড়ে থাকে।

ট্যাপের সঙ্গে আছে ও। ওদের ট্র্যাক দেখেছি। ট্যাপকে ধরে ফেলেছে ইলেন, পরে একসঙ্গে পশ্চিমে এগিয়েছে ওরা।

অ্যারোয়োর ভয়াবহ ওই ঘটনাটা মনে পড়লেও চেপে গেলাম, এদেরকে বলার কোন মানে হয় না। বাবাকে বলেছি আমি, অন্য বেশ কয়েকজনকেও বলেছি, কারণ আমি চাই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুক ওরা। মেয়েরা শুনলে শুধু শুধু উদ্বিগ্ন হবে।

আমার যদি স্ত্রী থাকত, তো, অবশ্যই সবকিছু ওকে বলতাম আমি। বেশিরভাগ পুরুষ মেয়েদের অন্ধকারে রাখতে পছন্দ করে; অথচ পুরুষদের মতই বিপদ বা ঝামেলা উতরে যেতে জানে মেয়েরা। স্ত্রীকে ঝামেলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কোন অধিকার নেই পুরুষের, কিন্তু মিসেস অটম্যান, মিসেস বুচার্ড বা রোজিটা জেপসন ভিন্ন ধাতে গড়া। ওদের উদ্বিগ্ন না করাই ভাল।

ওয়াগনগুলো নড়ে উঠল, ভারী চাকা গড়াল ঘড়ঘড় শব্দে, ধীর গতিতে এগোতে থাকল গরুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। পশ্চিমে এগোচ্ছি আমরা। খুরের দাপটে ধুলো উড়ছে, পেছনে উদীয়মান সূর্যের আলো ঝিলিক মারছে হাজারো শিং-এ। পালের একপাশ থেকে গান ধরল কেউ, সুর মেলাল অন্য একজন; ওদের গান শুনতে পেয়ে সন্তুষ্ট হলাম-দীর্ঘ ড্রাইভ শেষ করার জন্যে যে সাহস, ধৈর্য আর সহিষ্ণুতা দরকার, তার সবই দরকার হবে নিকট ভবিষ্যতে-হর্স হেড পর্যন্ত, আশি মাইল পাড়ি দেয়ার সময়।

হেলে-দুলে এগিয়ে চলেছে গরুর পাল, চিৎকার করছে, ডাক ছাড়ছে। ধুলো আরও ঘন হয়ে এসেছে। সতেজ সকাল পেরিয়ে রৌদ্রদগ্ধ দুপুর হলো একসময়। ঘামের ফোঁটা নেমে আসছে গরুর পেট বেয়ে। কিন্তু থামলাম না আমরা। প্রতিটি পদক্ষেপ বিজয়ের দিকে একেকটা মাইলফলক, প্রতিটি মাইল মানে পানির আরও নিকটবর্তী হওয়া। কিন্তু আমার জানা আছে, পালে অনেক গরু পানি স্পর্শ করার আগেই মারা পড়বে, কিছু ঘোড়াও, হয়তো মানুষও মারা যাবে।

বুনো পশ্চিমের রীতি এমনই কঠিন, পরিশ্রমী মানুষ এভাবেই এগিয়ে চলে; এটাই তাদের জন্যে একমাত্র পথ, উপায়-রীতি, এবং পছন্দও। যত এগোবে, ততই তেষ্টা বেড়ে যাবে। এদিকে সকালের সূর্যও তপ্ত হলকা ছড়াচ্ছে বেরসিকের মত; সময় পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে আরও তেতে উঠছে রোদ। ধুলোর অত্যাচার বাড়ছে।

দুপুরের আগে দু’বার ঘোড়া বদল করেছি। জিম মুরের সঙ্গে পালের পেছনে ড্রাগের দায়িত্বে আছি আমি। কার্ল ক্রকেটের সঙ্গে পালের সামনে রয়েছেন বাবা।

শেষপর্যন্ত প্রশান্তিময় ঠাণ্ডা রাত এল, যখন, যোলো মাইল পেরিয়ে থামলাম। একদিনের জন্যে যথেষ্টরও বেশি দূরত্ব। সবার মধ্যেই চাপা আতঙ্ক, স্রেফ যন্ত্রের মত চলছি আমরা, জানি সামনে কি আছে-ভেতরে ভেতরে এ নিয়ে আতঙ্কিত। জুয়ানিতা যখন আমার দিকে তাকাল, বিস্ময় দেখতে পেলাম ওর চোখে, জানি কি ভাবছে ও। ভাবছে আমরা পাগলামি করছি..অসম্ভব জেনেও চেষ্টা করছি এবং সর্বস্ব, বিসর্জন দিচ্ছি।

সাপার একেবারে সংক্ষিপ্ত হলো আজ। ভরপেট কফি গিললাম। এদিকে অস্থির হয়ে পড়েছে গরুর দল-পানি নেই, তেষ্টা মেটাতে পারছে না। অনেক, অনেকক্ষণ ধরে ছটফট করল ওরা, একসময় ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়ল।

সমস্ত দায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। একে একে সবার মুখ জরিপ করলাম, সময় নিয়ে নিরীখ করলাম সবক’টা মুখ। বোঝার চেষ্টা করলাম, কতটা সহিষ্ণুতা বা ধৈর্য দেখাতে পারবে এরা। এদের সামর্থ্যই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।

বেশ রাত করে ঘুমালাম। সকালে উঠলাম সবার আগে, বেডরোল গুছিয়ে ডানের পিঠে স্যাডল চাপালাম। আগুনের কাছে ফিরে এসে দেখলাম কফির আয়োজন করছে স্যাম গার্ট। তাজা জিনিস, আঙুল তুলে পাত্র দেখাল সে। নিয়ে নাও।

কাপ ভরে ওর বিপরীতে বসলাম।

কথাবার্তায় তেমন পটু নই আমি, হঠাৎ মন্তব্য কল গার্ট। সেজন্যেই কিছু বলিনি। বিশেষ করে, ট্যাপ যখন তোমার ভাই।

কফি গেলার ফাঁকে ওর দিকে তাকালাম, কিছু বললাম না।

ট্যাপ যদি আমাদের জন্যে ভোলা রেঞ্জ ঠিক করে থাকে-তাহলে এতদিনে কেউ বসতি করেনি কেন?

আশপাশে কেউ নেই বলেই বোধহয়।

ফালতু অজুহাত! ওই রেঞ্জে আগেও লোক এসেছে, জমি ব্যবহার করেছে-এমনকি তোমার জন্মের আগে থেকে, ড্যান।

তো, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। ট্যাপ ওই রেঞ্জ সম্পর্কে বলেছে আমাদের, কারও মালিকানা নেই, কাউকে জিজ্ঞেসও করতে হবে না, বিস্তৃত তৃণভূমি পড়ে আছে মাইলকে মাইল-কেবল দখল করে নিলেই হলো।

স্যাম গার্ট কথা কম বলে, এবং যা বলে তার সবই সত্যি-জানি আমি। না জেনে কখনোই কিছু বলে না সে। ট্যাপ নিজেই জায়গাটা খুঁজে বের করেছে, আমাদের জন্যে, প্রতিবাদ করলাম আমি। একজন লোক রেখে এসেছে ওখানে।

হোনাস গান্টকে?

তুমি চেনো ওকে!?

হাসি পাচ্ছে আমার, ড্যান। হোনাস গান্ট জঘন্য চরিত্রের লোক। ট্যাপের মুখে ওর কথা শুনেছি বেশ কয়েকবার, স্রেফ ঝামেলা এড়ানোর জন্যেই কিছু বলিনি। প্রতিবাদ করতে যাওয়া মানেই ট্যাপকে মিথ্যুক বলা, তাই না? আমি গানফাইটার নই, তাই ট্যাপের ধারণা ভুল প্রমাণ করার জন্যে ভুয়েল লড়তে রাজি নই। সত্যি কথা হচ্ছে, ওই হোনাস লোকটা গরুচোর এবং আউটল।

এই তাহলে অবস্থা। রুক্ষ বিরান প্রান্তর ধরে পশ্চিমে ছুটছি আমরা, জীবন আর জীবিকার ঝুঁকি নিয়েছি, মনে স্বপ্ন যে একেবারে আনকোরা একটা জায়গায় বসতি গড়ব; যে-জমির স্বপ্ন বুকে নিয়ে এই দুর্ভোগ পোহানো, এখন দেখা যাচ্ছে সেটা আরেকজনের জমি এবং ওখানে পৌঁছে হয়তো পুরোদস্তুর লড়াই করতে হবে আমাদের।

সবাই বলে বিপদ একাকী আসে না; আমাদের বর্তমান অবস্থায় কথাটা একশো ভাগ সত্যি। কফি গেলার ফাঁকে পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছি, কিন্তু কোন সমাধান খুঁজে পেলাম না। পশ্চিমে যেতেই হবে আমাদের, ফিরে যাওয়ার উপায় নেই, অথচ গন্তব্যে পৌঁছে লড়াই করতে হবে-পৌঁছব যখন, আমরা থাকব ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। গরুগুলোর অবস্থা এরচেয়ে ভাল থাকবে, তা বলা যায় না।

স্যাম, ব্যাপারটা আমাদের দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক। আপাতত কাউকে কিছু জানাব না। এ নিয়ে ভাবতে হবে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ট্যাপের আরও খোঁজখবর নেয়া উচিত ছিল।

কফির কাপ নামিয়ে রেখে পাইপে তামাক ভরল গার্ট। নিচু স্বরে কথা বলল যাতে অন্য কেউ শুনতে না পায়। কিছু মনে কোরো না, ড্যান, ট্যাপ এডলেকে স্রেফ স্বার্থপর একজন লোক মনে হয়েছে আমার। বলতে চাইছি, সবার আগে নিজের কথা ভাবতে অভ্যস্ত ও। ধরো, ওই জমিটা চাই আমরা। কিন্তু সঙ্গে যদি গরু না থাকে? এই এলাকায় কোন জমি ক্লেইম করতে হলে গরু থাকতেই হবে..জমিতে গরু চরাতে হবে।

আসলে নিজের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করতে চেয়েছে ও। জানত যে তোমরা কাউ-হাউসে থাকতে পারছ না, পশ্চিমে নতুন কোন জায়গায় নিঝঞ্ঝাট বসতি করতে চাইছ, তাই বস্ক রেভোরন্ডার কথা বলেছে তোমাদের। অথচ জায়গাটা নিয়ে ইতোমধ্যে কামড়াকামড়ি লেগে গেছে। আমার তো মনে হয়, পুরোদস্তুর রেঞ্জ ওঅরের মধ্যে গিয়ে পড়ব আমরা, হোনাস গান্টের পাশে হবে আমাদের অবস্থান…অর্থাৎ জমি দখলের জন্যে নিরীহ কিছু মানুষকে ব্যবহার করতে চেয়েছে ট্যাপ।

স্বীকার করছি পরিস্থিতি খুব খারাপ। গান্ট সম্পর্কে আর কি জানো?

যা বলেছি, নীচ জাতের লোক। যে-কোন অস্ত্র নিয়ে লড়াই করবে সে, এবং প্রচুর মানুষ খুন হয়ে যাবে ওর হাতে। কেউ কেউ বলে আসলে ও বাল্ড নেব পরিবারের লোক, মিসৌরীতে কেমন আধিপত্য ছিল ওদের, শুনেছ তো? সত্যি-মিথ্যে জানি না, তবে আমার কাছে মনে হয়েছে জর্জিয়ার লোক সে-কথাবার্তায় টান স্পষ্ট।

ট্রেইলে গরুর পাল নিয়ে এলাম আমরা। কাজটা সহজ হলো না। গরুগুলো অস্থির, অধৈর্য হয়ে উঠেছে। তেষ্টা মেটেনি ওদের, গতরাতের পর এ পর্যন্ত পেটেও কিছু পড়েনি; অথচ দৃষ্টিসীমায় পানি বা ঘাস-কোনটার চিহ্নমাত্র নেই।

সূর্য ওঠার আগেই গরুর পাল রওনা করিয়ে দিলাম আমরা, ধীর গতিতে এগোচ্ছে গরুগুলো। সেদিন অন্য যে-কোন দিনের চেয়ে বেশি খাটুনি গেল আমাদের। পানি না পাওয়ায় ফিরতি পথে কাউ-হাউস বা মিডল কঞ্চোয় চলে যাওয়ার কুবুদ্ধি উঁকি দিয়েছে ওদের মাথায়, সামনের কক্ষ এলাকার দিকে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কোন একটাকে উল্টো ঘুরতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে অন্যগুলোও ফিরতি পথ ধরতে চাইছে।

ড্রাগের দায়িত্ব নিলাম আমি। এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। পালের নেতৃত্ব এখন আমার, সুতরাং দায়িত্ববোধের কারণে কঠিন কাজটা আমারই করা উচিত। দুপুরের দিকে একটা ব্লফের কিনারায় পৌঁছলাম আমরা। প্রায় আধ-মাইলের মত জায়গায় ছায়া পড়েছে। সব গরু ছায়ার মধ্যে এনে থামলাম। দুপুরের সময়টা এখানেই কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছে।

ওয়াগনে ঢুকে দেখলাম উঠে বসেছে জুয়ারেজ। আগের চেয়ে বেশ সুস্থ এবং সবল দেখাচ্ছে ওকে। শিগগিরই রাইড করতে পারব আমি, স্মিত হেসে বলল সে। তোমাদের সাহায্য করতে পারব।

আশপাশে তাকালাম, কাউকে চোখে পড়ল না। জুয়ারেজ, নিউ মেক্সিকোয় যাচ্ছি আমরা।

সি, জানি আমি।

মিম্বার্স ভ্যালি চেনো তুমি?

সি, টানটান হয়ে গেল মেক্সিকানের মুখ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে আমাকে।

ওখানকার জমি কি ক্লেইম করা?

সামান্য দ্বিধা করল সে। সি…বেশিরভাগই ক্লেইম করেছে লোকজন। ঝামেলাও হয়েছে সেজন্যে। তবে উপত্যকাটা বিশাল-হয়তো আমি যেটার কথা বলছি সেটা নয়।

আর লেক ভ্যালি?

সি…চিনি। ওখানেও ঝামেলা হচ্ছে, অ্যাপাচীরা কাউকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না…সাদা মানুষ বা মেক্সরাও রেহাই পাচ্ছে না। মেক্সিকানদের মধ্যে অনেকেই খারাপ, যেমন ফেলিপ জাপাটা।

কি মনে হয় তোমার, ওখানে গিয়ে ঝামেলায় পড়ব? আমরা যদ্দূর জানতাম উপত্যকাটা উন্মুক্ত। কেউ ক্লেইম করেনি-তাই শুনেছি। কিন্তু আসলে উন্মুক্ত নয়, তাই না?

না…সত্যিই ঝামেলায় পড়তে হবে তোমাদের। সেনর, আফসোস হচ্ছে আমার…রাইড করতে পারতাম যদি! সবকিছু সামলাতে ধকল যাচ্ছে তোমার।

ওদিকে কখনও গেছ নাকি-এই ট্রেইল ধরে?

না.. উত্তর দিক থেকে এসেছি আমি। পালানোর ধান্ধায় ছিলাম, আহত হওয়ার পর পানির খোঁজে কঞ্চোর দিকে যাচ্ছিলাম।

বিকেলের দিকে রওনা দিলাম আমরা। জুয়ানিতা পুরুষদের মতই রাইড করছে, ড্রাইভে খাটছে সাধারণ কাউবয়ের মত। বিশাল কালো ঘোড়ায় চড়েছে ও। বিস্ময়কর হলেও, ঘোড়াটা কাটিং-হর্স হিসেবে দক্ষ, যা দরকার ছিল আমাদের।

প্রতিটি লোককে দরকার আমাদের এখন। ধীর গতিতে চলছে গরুগুলো, পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছে কিংবা উল্টোদিকে চলে যেতে চাইছে; কিন্তু ওগুলোকে এগোতে বাধ্য করলাম আমরা-টানা তাগাদার মধ্যে রাখতে হলো। সন্ধে গড়িয়ে রাত হলো, থামলাম না আমরা, তারার আলোয় পথ চলতে অসুবিধে হচ্ছে না-টানা পশ্চিমে এগিয়ে চলেছি। একসময় থামলাম আমরা, কি গরুর দল থামতে চাইছে না, বিশ্রাম নেওয়ার ইচ্ছে দেখা গেল না ওদের মধ্যে, অস্থির ভঙ্গিতে নড়াচড়া করছে। বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম আমি।

বাবা, ওদেরকে বরং হাঁটার মধ্যে রাখাই ভাল। বিশ্রাম নেওয়ার ইচ্ছে নেই ওদের, হয়তো হাঁটবে ওরা।

তো, আবার যাত্রা করলাম আমরা। ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছি সবাই। গর্তে বসে গেছে চোখ, কিন্তু থামার উপায় নেই। ধুলোর অত্যাচারে হাঁসফাঁস অবস্থা সবার।

সকাল হওয়ার পরও থামলাম না আমরা। পুব আকাশে সূর্য উঠল অগ্নিবলয়ের মত, গাঢ় টকটকে লাল রঙ। বাতাস স্থির। বিন্দুমাত্র কাঁপন নেই কোথাও। নিঃশ্বাস নেয়া হয়ে উঠল আয়াসসাধ্য। পুরো একটা দিন টানা চলার পর, এবার থামার লক্ষণ দেখা গেল গরুগুলোর মধ্যে, কিন্তু থামলাম না আমরা।

মাঝে মধ্যে পড়ে গেল দু’একটা, এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ করলাম না কেউ। ঘোড়ার গতি ধীর হয়ে গেছে, মাঝে মধ্যে থেমে গেল, তারপর মিনিট কয়েকের বিশ্রাম পেয়ে আবার এগোল।

দুপুরের মধ্যে প্রতিটি গরুর পাঁজরের হাড় বেরিয়ে পড়ল, বুনো দৃষ্টি ফুটে উঠেছে ওগুলোর চোখে। ডোরাকাটা বলদটা খেপে গিয়ে আক্রমণ করতে এল, কোন রকমে এড়িয়ে গেল ক্লান্ত পর্যুদস্ত পনিগুলো, ওটার পথ থেকে সরে গেল।

থেমে কফি তৈরি করলাম আমরা। রাইডাররা একে একে আসছে ক্যাম্পে। রক্তলাল চোখ সবার, ক্লান্তি এতটাই যে স্যাডল থেকে হেঁচড়ে নামছে। কেউ কেউ পড়েই গেল। তারপরও অভিযোগ করল না কেউ। জুয়ানিতাও রয়েছে এদের মধ্যে। গর্তে বসে গেছে ওর বড় বড় চোখ, কিন্তু আমার উদ্দেশে হাসল ও, ওকে বিশ্রাম নিতে বলায় মাথা নেড়ে নাকচ করে দিল।

আমার কাছে চলে এল অটম্যান। ড্যান, একেবারে পর্যুদস্ত সবাই। ঘোড়াগুলোর অবস্থাই বেশি খারাপ। বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

ঠিক আছে…দুটো ওয়্যাগনে সব মালপত্র তুলে ফেলল।

নিজেই ওয়্যাগনের দরজার কাছে চলে এল জুয়ারেজ। আমি রাইড করতে পারব। এখন রাইড় করাই উচিত।

জুয়ারেজ জেদী মানুষ, মানা করলেও শুনবে না। তাছাড়া রাইড করলেই সাহায্য হবে, যদিও নিজের যত্ন করার সুযোগই সে পাবে না।

সব মালপত্র দুটো ওয়্যাগনে ভরা হলো। রদপত্র কমে এসেছে। বাদ পড়া ওয়্যাগনের ঘোড়া অন্য দুটোয় জুড়ে দেয়া হলো।

গরুর খুরের দাপটে ধুলো উঠছে, ভারী করে তুলেছে বাতাস। মাথার ওপর গনগনে সূর্য তপ্ত হক্কা ছড়াচ্ছে, দূরে দিগন্তের কাছাকাছি তাপতরঙ্গ নাচছে, মরীচিকা দেখা যাচ্ছে প্রায়ই। প্রতিটি মাইল এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আরও অস্থির হয়ে উঠছে গরুগুলো, বারবার পেছনে পড়ে যাচ্ছে, খেদিয়ে কিংবা পাছায় চাপড় মেরে পালের সঙ্গে তাল মেলাতে বাধ্য করা হলো ওগুলোকে।

মাঝে মধ্যে বয়স্ক গরু পড়ে গেল, ময়দার বস্তার মত ঢলে পড়ল, মারাও গেল তৎক্ষণাৎ। তেষ্টা আর ধুলোর অত্যাচারে গলা জ্বলছে আমাদের, শুকনো খটখটে হয়ে গেছে মুখ, গলার স্বর মিইয়ে এসেছে সবার-তৃষ্ণার্ত গরু পালের ডাকের সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। কিন্তু এর কোন শেষ নেই। এগিয়ে চলেছি আমরা, থামার মত জুতসই কোন জায়গা চোখে পড়ছে না।

দুপুরের পর থামতেই হলো। কয়েকটা গরু ঢলে পড়ল, একটা ঘোড়া মারা পড়ল। আকাশ যেন জ্বলন্ত একটা ছাদ, খরতাপ ঢলে পড়ছে জমিনের ওপর। ঘামে জবজব করছে আমাদের দেহ। গরুর পেটের ওপর অদ্ভুত আঁকাবাঁকা চিহ্ন ফুটিয়ে তুলেছে ঘামের রেখা।

দুর্ভোগের সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদের মেজাজেরও অবনতি ঘটছে। অধৈর্য হয়ে উঠেছে সবাই। যখনই দরকার হলো, অন্যদের সাহায্য করলাম আমি, অন্য যে-কারও চেয়ে দ্বিগুণ ছোটাছুটি করছি, মরিয়া চেষ্টার যেন কোন শেষ নেই। ক্ষার মেশানো ধুলোয় গা চটচট করছে, প্রখর রোদ আর ঘামে কুঁচকে গেছে চোখজোড়া।

অমানুষিক শ্রমের পরও জুয়ানিতাকে ব্যস্ত এবং স্বতঃস্ফুর্ত দেখে সত্যিই বিস্মিত হলাম। অন্য যে-কোন লোকের সমান কাজ করেছে ও, মেয়ে বলে বিশেষ সুবিধা নেয়নি। এমনকি জুয়ারেজও হাত গুটিয়ে বসে ছিল না, মাঝে মধ্যে ওকে দেখেছি দলছুট গরু খেদিয়ে পালে ঢোকাতে।

ক্লান্ত দিশেহারা গরুগুলো লড়ছে অবসাদ, ক্ষুধা আর তৃষ্ণার সঙ্গে, মাঝে মধ্যে টলমল পায়ে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কোন কোনটা পড়ে গেল দড়াম করে, কিন্তু ওগুলোকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করলাম আমরা।

পাল ছেড়ে এগিয়ে গেলাম আমি। স্কাউটিং করে ক্ষারে পূর্ণ ওঅটরহোলগুলো খুঁজে বের করতে হবে। ট্যাপ এ সম্পর্কে সতর্ক করেছিল আমাদের।

হাজারবার মনে হলো, ও সঙ্গে থাকলে কত ভাল হত, হাজারবার বাড়তি একজন লোকের জন্যে আফসোস হলো। পুরো তিনদিন কোন রকম বিরতি ছাড়াই এগিয়ে চলেছি আমরা, এক ফোঁটা ঘুমাইনি কেউ। স্রেফ কফি গিলে স্যাভলে চেপে বসেছি, ঘাম আর ধুলোর অত্যাচারে দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে অর্ধেক। গরুগুলোকে পালের মধ্যে রাখতে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে। এখোনো ছাড়া উপায় নেই। পানিই ওদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে, এবং পানির কাছে পৌঁছতে হলে এগোতেই হবে।

ডোরাকাটা বলদটা নেতৃত্ব দিচ্ছে এখনও। প্রায় দিশেহারার মত এগোচ্ছে ওটা, অদম্য মনোবল নিয়ে লড়ে চলেছে ক্লান্তির সঙ্গে, যেন আমাদের মরিয়া প্রয়াস আর প্রয়োজন আঁচ করতে পেরেছে ওটা

প্রতিদিনই জ্বলন্ত উনুনের মত তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে সূর্য। ঠাণ্ডা শীতল রাত্রিতেও থামলাম না আমরা। অনেক গরু পড়ে গেল। পা ছড়িয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। মাথা নুয়ে পড়েছে ওগুলোর। এ পর্যন্ত কত গরু খোয়া গেছে?

সময় সম্পর্কে সমস্ত জ্ঞান লোপ পেয়েছে আমাদের। গরুগুলোকে সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, প্রচণ্ড তাপ আর ধুলোর অত্যাচারের মধ্যেও মরিয়া হয়ে ওগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

স্কাউটিঙের সময় মাসট্যাঙ পুল আবিষ্কার করলাম আমি, কিন্তু দেখে হতাশ হলাম। কাদার ওপর সামান্য পানি আছে এ মুহূর্তে। গত কয়েক মাসেও পানি ছিল না এখানে। ফ্ল্যাটরক হোলসের ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা হলো, নদীর এপাশে পানির কোন নমুনা চোখে পড়ল না। দূরে, উত্তরে ওয়াইল্ড চেরি হোলস রয়েছে, কিন্তু ভিন্ন রুট ওটা, তাছাড়া ওখানে পানি আছে কিনা সেটাও জানা নেই আমাদের।

ধুধু তাপতরঙ্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেলাম, মনে পড়ল কেন এখানে এসেছি। কেন পশ্চিমে আসে মানুষ? এর আগে কখনও ভাবিনি, যদিও সুউচ্চ পর্বতাশ্রণীর নির্জনতা আর সুনীল আকাশের সাহচর্য যে-কাউকে ভাবুক করে তুলবে।

পশ্চিমে আসতেই হত, আমাদের, নয়তো অন্যদের সঙ্গে জমি ভাগাভাগি করতে হত। হয়তো এই দুর্ভোগের চেয়ে হার আউটফিটের সঙ্গে লড়াই করাই শ্রেয়ঙর ছিল। কিন্তু এই ড্রাইভ কি স্রেফ নতুন একটা ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি? হয়তো অবচেতন মনে পশ্চিমে সুরে আসার ইচ্ছে ছিল আমাদের, নতুন এলাকা দেখার, নতুন জমি জয়ের আনন্দ ভেতরে ভেতরে তাড়া করেছে আমাদের।

রোমাঞ্চ বা অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মানুষ সব সমাজেই থাকে, কিন্তু পশ্চিমা মানুষ স্বভাবগত অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। বহু লোককে ভাল জমি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে দেখেছি আমি, ভাগ্য পরীক্ষা করার ইচ্ছে তাদের শেষ হয় না কখনও।

দুবার ক্ষারীয় ওঅটরহোল চোখে পড়ল। সাদা ক্ষারের স্তর জমেছে পানির ওপর, সুপের চেয়েও ঘন, যে-কোন পশু মারা পড়বে এই পানি পান করলে।

এগিয়ে গেলাম আরও। উঁচু একটা জায়গায় উঠে ওপাশে পেকোসের লাগোয়া ঢেউ খেলানো প্রান্তর চোখে পড়ল। সরু রেখার মত গাঢ় একটা ঝিলিক দেখা যাচ্ছে পেকোসের কাছাকাছি। অধীর হয়ে সেদিকে ফিরল ঘোড়াটা। স্যাডল ছেড়ে রুমাল বের করে পানিতে চুবিয়ে ঘোড়ার নাক মুছে দিলাম দু’বার। তারপর ফিরতি পথের দিকে তাকালাম।

পাল থেকে ষোলো কি সতেরো মাইল এগিয়ে আছি আমি।

চোঙাকৃতির একটা পাহাড়ের ওপর থেকে গরুর পালটাকে আসতে দেখতে পেলাম। দৃশ্যটা করুণ, ভয়াবহ এবং হতাদ্যম হওয়ার মত। সবার সামনে বাবা, বরাবরের মতই মাথা উঁচু করে স্যাডলে বসে আছেন, কিন্তু ক্লান্তি, উদ্বেগ বা অস্থিরতা ঢাকতে পারেননি-অন্তত আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে ঠিকই। বিশ ফুট দূরে ডোরাকাটা বলদটা, পঞ্চাশ গজ পেছনে মূল পাল।

ঠিক পেছনে বেন টিল্টন আর জিম মুর। প্রথম দিকের গরুগুলোকে তাগাদার মধ্যে রেখেছে যাতে সঠিক পথে এগিয়ে যায়।

পুরো পালের ওপর ধুলোর আস্তর ছেয়ে আছে, যেন ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে ধুলোর মেঘ। ক্ষারের উপস্থিতির কারণে মেঘটাকে সূর্যের আলোয় দেখাচ্ছে শুদ্র তুষারের মত। গরু, রাইডার আর ঘোড়াকে ঢেকে ফেলেছে…এমনকি ওয়্যাগনও ঢাকা পড়েছে।

পেছনে, ফেলে আসা ট্রেইলে কয়েকটা গরু দেখতে পাচ্ছি-দৃষ্টিসীমায় অন্তত দশ-বারোটা চোখে পড়ল। দুটো পড়ে গেছে, কয়েকটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে হয়তো লুটিয়ে পড়বে।

যাই হোক, শেষপর্যন্ত আসতে পেরেছে গরুর পাল-অন্তত বেশিরভাগ। পাহাড়ী ঢাল ধরে ট্রেইলের দিকে নেমে এলাম আমি।

বাবা, টিকতে পারবে শুধু এমন গরুকে নদীর দিকে নিয়ে যাব আমরা, বাবাকে বললাম। ভাগাভাগি না করে উপায় নেই। যে কটাকে নিয়ে যেতে পারব, বেঁচে যাবে ওগুলো।

থামলাম আমরা। চরম ক্লান্তির পরও কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে বেশিভাগ গরু, কিন্তু ভাগ করে ফেললাম আমরা-সেরাগুলোকে আলাদা করে ফেললাম। বাবার নেতৃত্বে ওগুলোকে নিয়ে তখনই পেকোসের হর্স হেডের দিকে যাত্রা করল মিলো আর গার্ট।

রৌদ্রদগ্ধ দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। পশ্চিমাকাশে নেমে গেছে। সূর্য। সোনালী গোলাপের শুভ্রতায় সেজেছে পশ্চিম আকাশ, মেঘের আড়াল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল সূর্যের শেষ রশ্মি, দীর্ঘ রক্তিম তীর যেন, মেঘের রক্তলাল বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। নিচে বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণীর ধূসর বাদামী শূন্যতা অদ্ভুত মায়া তৈরি করেছে, মেঘের দল ক্ৰমে কাঁধে কাঁধ মেলাচ্ছে, সাদা পেঁজা তুলোর মত বিশাল একেকটা প্রাসাদ উঠে গেছে স্বর্গের দুয়ার পর্যন্ত।

বহুবার এই সৌন্দর্যের কথা শুনেছি, কিন্তু নিজের চোখে এই প্রথম দেখলাম। অপূর্ব সুন্দর। শেষ বিকেলের সৌন্দর্য কখনও এতটা মনোমুগ্ধকর মনে হয়নি আজকের আগে। সামনে হর্স হেড ক্রসিং, কাছাকাছি পবর্তশ্রেণীর খাঁজকাটা চূড়ার ওপর অসীম শূন্যতা, তারওপর মেঘের দলের সঙ্গে বিকেলের সূর্যের আলোকমালা। এত উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, হৃদয়ছোঁয়া দৃশ্য-না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

অটম্যানদের ওয়্যাগনের কাছে চলে এলাম আমি। চালাতে থাকো, ম্যাম, মিসেস অটম্যানকে বললাম। হর্স হেডের আগে থামছি না আমরা!

গম্ভীর, ক্লান্ত মুখে নড করল মহিলা। চাবুক আর মুখ চালিয়ে পরিশ্রান্ত ঘোড়াগুলোকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করল। হাতের চেটো দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ মুছে আমার দিকে তাকাল ফ্রাঙ্ক কেলসি। হাসল। নরক, তাই না, বাছা? জীবনেও এমন দেখিনি!

এগোতে থাকো! এগোলাম আমি। জুয়ারেজ আর জুয়ানিতা আসছে পাশাপাশি তোমরাও, জুয়ানিতার উদ্দেশে বললাম, ভাইকে ধরে রেখেছে সে। পালের ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ো না। পারলে আগে ভাগেই নদীর কাছে চলে যাও।

টকটকে লাল আর গোলাপী আভা বিদায় নিয়েছে আকাশ থেকে, নীল বা নীলচে রঙ গাঢ় হচ্ছে এখন। দূরে পাহাড়শ্রেণীর চূড়ার কাছাকাছি ঘন বেগুনী বর্ণ পেয়েছে আকাশ, বাতাসেও যেন সেই ছোঁয়া। গোধূলি লগ্নে, হর্স হেডের দিকে এগোল ক্লান্ত গরুর দল। চলার গতি খুবই ধীর, জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে, ওগুলোর, মাথা নিচু হয়ে গেছে। বদ্ধ মাতালের মত এগোচ্ছে ওরা, হেলে-দুলে, ছন্দহীন এবং ক্লান্ত চলন।

ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে রাত আর অন্ধকার।

ক্রুদের অবস্থাও যে ভাল বলা যাবে না। চেহারায় ক্লান্তি, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার ছায়া। কোন রকমে স্যাডলে টিকে আছে এরা, রক্তলাল হয়ে গেছে চোখ। কিন্তু তারপরও অদ্ভুত এক স্বপ্নের আকর্ষণ তাদের টেনে নিয়ে চলেছে পশ্চিমে। গরুর চিৎকার নেই, মৃদু স্বরে যোৎ ঘোৎ করে সবসময়, এমনকি তাও করছে না এখন। পড়ন্ত বিকেলের নিস্তব্ধতায় এগিয়ে চলেছে ওরা।

একটা বাছুর পিছিয়ে পড়েছিল। ওটার পাশে চলে এলাম আমি, কয়েল করা দড়ি দিয়ে পাছায় আঘাত করলাম। বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করল না ওটা, ডান ঘোড়াটা ওটাকে মুখ দিয়ে ঠেলা দিতে নড়ার ইচ্ছে দেখা গেল ওটার মধ্যে, টলমল পায়ে এগোল।

অনেক গরু লুটিয়ে পড়েছে। দুবার পড়ে যাওয়া গরুর মুখে কয়েক ফোঁটা পানি দিলাম কান্টিন থেকে দুটোই উঠে দাঁড়াল। রাতের ঠাণ্ড বাতাসে একসময় কিছুটা হলেও শক্তি ফিরে পাবে ওরা, অনুসরণ করবে আমাদের, কারণ অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

হঠাৎ দমকা বাতাস বয়ে এল পাহাড়ের দিক থেকে, বাতাসে পানির সোঁদা গন্ধ!

যাদুর মত কাজ হলো। ঝট করে মাথা তুলল গরুর দল, দ্রুত এগোল, তারপর হালকা চালে ছুটতে শুরু করল। মিনিট কয়েক পর তুমুল বেগে ছুট লাগাল, রীতিমত স্ট্যাম্পিড় ঘটে গেল। পানির গন্ধ খেয়েছে ওরা, পানির কাছে কে কার আগে পৌঁছা’বে-তাই নিয়ে হিড়িক পড়ে গেছে। কয়েকটা পড়ে গেলেও পানির টানে ঠিক খাড়া হয়ে গেল এবং ছুটতে শুরু করল আবার।

ছুটন্ত খুরের শব্দ কাঁপিয়ে দিয়েছে প্রান্তরের নিস্তব্ধতাকে, যেন গুড়গুড় শব্দে মেঘ ডাকছে; তারপর হঠাৎ করে নীরবতা নেমে এল। ধুলোর উৎকট গন্ধ ট্রেইলে।

পেকোসের ধারে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে আকাশে তারা ফুটেছে। আগুন জ্বালানো হয়েছে, ওয়াগনগুলো পৌঁছে গেছে।

ঘোড়াটার পা কাঁপছে থরথর করে। হেঁচড়ে স্যাডল ছাড়লাম, মিনিট খানেক ডানের গায়ের সঙ্গে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর ধীর ভঙ্গিতে স্যাডল-ব্রিডল খুলে দলাইমলাই করে দিলাম ওটাকে।

আগুনের কাছে এসে রিপোর্ট করল কার্ল। এক রাউন্ড পান করেছে ওরা। পানির কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছি ওদের।

ভাল…সকালের আগে আর পানি দেয়া যাবে না, আগুনের কাছাকাছি বসে স্ক্যাবার্ড থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে ওটা পরিষ্কার করতে শুরু করলাম। যাই ঘটুক, এটাকে ঝকঝকে কার্যকর অবস্থায় রাখা উচিত।

চারজন লোক পাহারায় থাকবে আজ, বললাম কালকে। একজন ক্যাম্প থেকে দূরে থাকবে; শুনবে, চারপাশে নজর রাখবে। এ পথে প্রায়ই যাতায়াত করে ইন্ডিয়ানরা।

আমার হাতে কফির কাপ ধরিয়ে দিল মিসেস বুচার্ড। গিলে ফেল, বয়, বলল মহিলা! এটা তোমার পাওনা, অর্জন করেছ।

কফি তো অবশ্যই, সঙ্গে খানিকটা আইরিশও মেশানো, চুমুক দিয়ে টের পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে চাঙা বোধ করলাম। রাইফেল পরিষ্কার করে, ওয়্যাগনে গিয়ে আমার ডাফ-ব্যাগটা বের করলাম। পিস্তল দুটো বের করে একটা হোলস্টারে ঝুলিয়ে দিলাম, অন্যটা ভেস্টের পেছনে কোমরে গুঁজে রাখলাম।

আগুনের কাছে এসে বাবাকে দেখতে পেলাম। চট করে আমার হোলস্টারের দিকে তাকালেন তিনি, কিন্তু কিছুই বললেন না।

অনেকক্ষণ ধরে আমাকে দেখছে টম জেপসন, শেষে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। জানতাম না হ্যান্ডগান চালাও তুমি। ঝামেলা, আশা করছ নাকি

তুমি ক্লান্ত, টম। আজ রাতে খানিকটা ঘুমিয়ে নাও। যাকগে, আমি চাই সব ব্যারেল ভরে ফেলবে তোমরা। এখনই।

এখন? ভুরু কুঁচকে তাকাল জেপসন। মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার? ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে সবাই। এ অবস্থায় তুমি ওদের পানি ভরার জন্যে বলতে…

পারি, এবং বলছি। কাজ শুরু করো, টম-ঘুমানোর আগে সব কটা ব্যারেল ভরবে।

সত্যি তাই করল ওরা।

প্রায় রাত একটার পর ঘুমাতে গেলাম আমি। ধীরে ধীরে শরীর শিথিল করে দিলাম, আড়ষ্ট মাংসপেশীর খিল ছাড়িয়ে, উদ্বেগ আর উত্তেজনার প্রভাব কাটাতে চাইছি শরীর থেকে। ক্লান্তি, দারুণ ক্লান্তি লাগছে-ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর…তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়লাম, নিজেও জানি না।

সচেতন হওয়া মাত্র প্রথমে পানির শব্দ শুনতে পেলাম-স্বস্তিকর কুলকুল ধ্বনি। পেকোসের ঝর্না…পানি। চারটে দিন পানির আশায় হন্যে হয়ে ছুটেছে সাড়ে তিন হাজার গরু।

আকাশে ক্ষীণ ধূসর আভা। প্রায় দু’ঘণ্টা ঘুমিয়েছি, চাঁদ দেখে আন্দাজ করলাম।

গড়ান দিয়ে সিধে হয়ে বসে, মাথায় হ্যাট চাপালাম। সব শান্ত। নিস্তব্ধ। পায়ে বুট গলিয়ে গানবেল্ট ঝুলিয়ে আগুনের কাছে চলে গেলাম।

পেকোসের ধারে দেখা ছায়াঘেরা নদীর উঁচু তীরকে একটু আগে গাছপালা আর ঝোঁপ মনে করেছিলাম। নদী এখানে খোলামেলা-গাছ, গুলু বা ঝোঁপ কিছুই নেই। কেবল অল্প কয়েকটা লতা জাতীয় উদ্ভিদ জন্মেছে।

নদীর তীর বেশ উঁচু, পাড় থেকে পানি ছয় থেকে দশ ফুট গভীর। নদী প্রায় একশো ফুট প্রশস্ত, আর সবচেয়ে গভীর জায়গায় চার ফুট। ওপাশে পাহাড়ী ঢালে, বেলে মাটির জমিতে গ্রিজউড, বেঁটে মেস্কিট আর গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠা কিছু ঘাস জন্মেছে।

আগুনের কাছে এসে ঘোড়াকে পিকেট করল কার্ল ক্ৰকেট। স্যাডল ছেড়ে কফির কাপ হাতে বসে পড়ল।

চারপাশ শান্ত•••একেবারে নীরব। গরুগুলো শুয়ে পড়েছে, তবে ক্লান্ত ঘোচেনি ওদের। মাঝে মধ্যে দু’একটা নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু খানিক পরই সজাগ ক্রুদের তাগাদায় ফিরে আসছে।

এখানেই শোবে নাকি?

না।

আমার দিকে তাকাল টিম অটম্যান। মানুষটা চমৎকার। কিন্তু প্রায়ই মনে করে কাজের তুলনায় এখনও বয়স হয়নি আমার। বয়সের ব্যাপারটা কখনোই বড় মনে হয়নি আমার কাছে। বয়স কাউকে বেশি বুদ্ধিমান বা ক্ষিপ্র বানায় না, বরং বয়স বাড়ার সঙ্গে কেবল অভিজ্ঞতা আর বিচক্ষণতাই বাড়তে পারে। কারও কর্মক্ষমতা, সামর্থ্য বা স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে ওই দুটোর কোন সম্পর্ক নেই।

ক্রসিং পেরিয়ে, নদীর উজান ধরে কয়েক মাইল এগোব আমরা, কাছাকাছি পড়ে থাকা করোটির হাড়ের স্তুপের দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি, ক্রসিঙের উপস্থিতি নির্দেশ করছে ওগুলো। কোমাঞ্চিদের সঙ্গে লাগার কোন ইচ্ছে নেই।

ঘোড়া নিয়ে আমাদের কাছে চলে এল কার্ল ক্ৰকেট, হঠাৎ থেমে গেল। ড্যান…!

অস্বাভাবিক কিছু ছিল ওর কণ্ঠে, ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। ঘোড়সওয়ারদের একটা দল আসছে আমাদের দিকে। চোখ কুঁচকে তাকালাম-ছয় কি সাতজন।

পিস্তল আছে তোমার সঙ্গে, টিম?

হ্যাঁ।

আমার সঙ্গেও আছে, জানাল স্যাম গার্ট।

পেছনে, ক্যাম্পে ক্ষীণ নড়াচড়া শুনতে পাচ্ছি। নদীর দিকে চলতে থাকা গরুর পালের ওপর চোখ বুলালাম, চারজন আছে ওখানে…কিন্তু প্রথম লোকটার কি হলো? আগুয়ান রাইডারদের: দেখেনি সে? নাকি তাকেই খুঁজে বের করেছে অনাকাক্ষিত অশ্বারোহীরা?

কাছাকাছি দেখতে পেলাম জুয়ানিতাকে, ওয়্যাগনের চাকার আড়ালে অবস্থান নিয়েছে।

সবচেয়ে সামনের লোকটার ওপর স্থির হলো আমার দৃষ্টি। দারুণ শক্তিশালী একটা ঘোড়ায় চেপেছে সে, বিশালদেহী। দেখার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেলাম-ফেলিপ জাপাটা।

ক্যাম্পের কিনারে এসে দাঁড়াল সে, সতর্ক চাহনি হানল-প্রায় সবকিছুই খুঁটিয়ে দেখে নিল; লোকটার চোখের দৃষ্টি দেখেই বুঝলাম। যদিও আদপে ঠিক কতটা দেখেছে সে জানি না, কারণ দেখে মনে হবে ঘুমন্ত একটা ক্যাম্পে এসেছে ওরা, সময়টাও তাই। স্রেফ তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছি আমরা। আগুনের ওপাশে, আগন্তুকদের কাছ থেকে বেশ কিছুটা দূরে টিম অটম্যানের অবস্থান, আমার আশপাশে বিশ ফুট দূরে স্যাডলে আছে কাল। মাঝখানে আমি, এবং এখানেই থাকার ইচ্ছে আমার।

প্রায় ডজন খানেক দূরে বেভারোলের ওপর পড়ে আছে প্যাটার্সনটা।

মিগুয়েল জুয়ারেজকে খুঁজছি আমি, বলল বিশালদেহী জাপাটা। ওকে তুলে দাও আমার হাতে, তাহলে কোন রকম ঝামেলা হবে না তোমাদের।

এক পা আগে বাড়লাম, পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ তুলে নিলাম হাতে। কি বললে, ঝামেলা? ঝামেলা হবে না বলতে কি বোঝাতে চাইছ? মিস্টার, এই আউটফিটের কাউকে যদি চাও তুমি, তাহলে সবাইকে নিতে হবে। ঝামেলার শেষ নেই আমাদের, তোমার কাছে যা আছে দিয়ে যেতে পারো

সতর্ক চাহনিতে আমাকে দেখছে সে, মুখ দেখেই বুঝলাম সে ভাবছে কথাগুলোর কতটা ব্লাফ আর কতটা সত্য। দেখো, সেনর, তুমি বোধহয় পরিস্থিতি ঠিক বুঝতে পারোনি, পেছনে ইঙ্গিত করে বলল সে। প্রচুর লোক আমার মাত্র কয়েকজন এসেছে এখন। মহিলা আছে তোমাদের সঙ্গে, সম্ভবত ঝামেলা বা বিপদ না হলেই ভাল তোমাদের জন্যে।

বলে যাও, ইচ্ছে হলে হাজারবার বলতে পারো, শান্ত স্বরে বললাম। কিন্তু তোমাদের মতই তৈরি আছি আমরা। এ পর্যন্ত ড্রাইভ নিয়ে আসতে বেগার খাটুনি গেছে আমাদের, একেবারে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি। তুমি যদি সত্যিই ঝামেলা করতে চাও, আপত্তি নেই। ঝামেলা দিতে গেলে বিনিময়ে ভোগান্তি বা দুর্ভোগ, বিশ্বাস করো, বিস্তর দিতে পারব আমরা। দেরি করার দরকার নেই, শুরু করে দাও।

জাপাটার লোকজনকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করতে দেখে বাধা দিল কার্ল ক্ৰকেট। দাঁড়াও! যেখানে আছ ওখানেই দাঁড়াও, নইলে গুলি শুরু করব আমি! শীতল স্বরে বলল সে। গোলাগুলি যদি হয়ই, তোমাদের সবাইকে একসঙ্গে, কাছাকাছি চাই আমরা।

আমার ওপর থেকে দৃষ্টি সরায়নি জাপাটা, মনে মনে আমাকে খুন করতে চাইছে কিনা কে জানে, কিন্তু তৈরি আছ আমি

মনে যাই থাকুক, দ্রুত সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলল সে, সম্ভবত স্যাম গার্টের কারণে। বিশাল বপুকে তোমার ওপর ছেড়ে দিলাম, ড্যান, আলাপী সুরে বলল গার্ট। ওর ডানের লোকটাকে চাই আমি।

দৃষ্টি সামান্যও নড়ল না জাপাটার, কালো গোঁফের নিচে পরস্পরের সঙ্গে চেপে বসল ঠোঁটজোড়া। স্যামকে দেখেনি ওরা, এমনকি আমিও জানি না ঠিক কোথায় অবস্থান নিয়েছে সে। আমাদের তিনজনকে দেখতে পাচ্ছে ওরা…কিভাবে নিশ্চিত হবে যে আরও কয়েকজন লুকিয়ে নেই?

সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয়, তাই স্যাম গার্টের সঙ্গে পরামর্শ চালিয়ে গেলাম আমি। স্যাম, একটা দারুণ ব্যাপার ভুলে গেছ। নদীর পাড়ে ছেলেরা আছে না? আমার তো মনে হয় তুমি আর ওরা মিলে বেশ কিছু চাদির চামড়া সংগ্রহ করতে পারবে।

পরিস্থিতি পছন্দ হচ্ছে না জাপাটার, এক ফোঁটাও নয়। নদীর তীরে কেউ আছে কিনা, জানা নেই ওর, সেটা পরখ করতে গিয়ে বিপদে পড়ার চিন্তাও ভাল লাগছে না তার। সে জানে, গরুর ২ঙ্গে অবশ্যই লোক থাকবে, ওদের আগে থেকে আসতে দেখলে সত করে দেবে অন্যদের, নদীর উঁচু তীরের কাছাকাছি অবস্থান নিতে পারে-বেচাল দেখলে কচুকাটা করে ফেলবে ওদের।

বেশি লোক নিয়ে আসিনি বলে আফসোসই হচ্ছে, আড়ষ্ট হাসি ফুটল জাপাটার ঠোঁটে। আর যখন আসব, তখন অনেক লোক থাকবে আমার সঙ্গে আমি কিছু বন্ধুও থাকবে-কোমাঞ্চি। তোমরা বরং এই ফাঁকে জুয়ারেজকে বের করে দিতে পারো ক্যাম্প থেকে।

পেছনে একটা কবর ফেলে এসেছি আমরা, মনে করিয়ে দিলাম ওকে। এক মেক্সিকানকে পেয়ে গোর দিয়েছিলাম।

ফের হাসল জাপাটা। কৌশলটা মন্দ নয়…কিন্তু আমি সাবধানী মানুষ কিনা, তাই কবর খুঁড়ে দেখলাম। কারও লাশ ছিল না। ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল সে, তারপর ধীর গতিতে ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেল।

আমরা সবাই জানি, আবার আসবে সে। হয়তো শিগগিরই। তখন যে ঝামেলা হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বেশ, এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই, দ্রুত ঘোষণা করলাম। নাস্তা সেরে ঝটপট রওনা দেব।

রাতে বেশ কয়েকটা বলদ আর গাভী নদীর কাছে যেতে সক্ষম হয়েছে, পরে আবার ফিরেও এসেছে। ড্রাইভে মোট কত গরু খোয়া গেল গোনার উপায় নেই, ফুরসতও নেই এখন, তবে আন্দাজ করা যায় কয়েকশো গরু হবে।

এগোলাম আমরা। মোটামুটি একই গতিতে এগিয়ে চলেছি। দুপুরে পানি পান করার জন্যে পেকোসে থামলাম, পাহাড়শ্রেণীর লাগোয়া ট্রেইল ধরে সমান্তরালে এগোচ্ছি এখন। মাঝে মধ্যে পাহাড়ে উঠে গিয়ে চারপাশে নজর চালাচ্ছে ক্রুদের কেউ, শত্রুর উপস্থিতি আগেই টের পাওয়ার ইচ্ছে। কখনও কখনও পেছনে চলে গিয়েও অপেক্ষায় থাকলাম।

মাটি শুকনো খটখটে, বেশিরভাগ জায়গায় সাদা স্যালাইনের মত আবরণে ঢাকা-ক্ষারের অবশেষ। যেখানেই পানি ছিল, জমি বা মাটি সাদা হয়ে আছে, যেন তুষার জমেছে।

পিছিয়ে পড়ে আমার পাশে চলে এলেন বাবা। সংখ্যায় নিতান্তই কম আমরা, ড্যান, বললেন তিনি। পঞ্চাশ-ষাটজন লোক নিয়ে ফিরে আসবে ওরা।

জীবন্ত কোন কিছু চোখে পড়ছে না। এখানে-সেখানে মরা গরু পড়ে। আছে। শুকনো হাড় আর চামড়ার সংস্করণ, নেকড়ে বা অন্য কোন প্রাণী হামলা করেনি মৃত গরুর ওপর। এর মানে পরিষ্কার-এমনকি নেকড়েও এই এলাকায় থাকে না।

রাত হয়ে গেল, তখনও কোন ঘাস চোখে পড়েনি, তাই নিচু একটা টিলার কাছাকাছি ওয়্যাগনগুলো জড়ো করলাম আমরা, ঠিক পেছনেই রয়েছে সব গরু।

কাছাকাছি বনে প্রিকলি পিয়ার রয়েছে। গরুর জন্যে ঘাসের বিকল্প হতে পারে। জিনিসটা সঁাাতে ও ভেজা বলে পানির চাহিদা অনেকটা মিটে যাবে। প্রায় দশ-বারোজন বনের ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমরা, প্রিকলি পিয়ারের কাটা ছেটে ফেললাম। মশাল জ্বেলে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাঁটা না থাকায় সাগ্রহে প্রিকলি পিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল গরুর দল।

সকালে, বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে ধুলোর মেঘ উঠল। মাথার ওপর পুরো আকাশ ভরে গেল, ধুলোর ঘূর্ণি ছুটে গেল জমিন ধরে। সূর্য যেন আগুনের বলয়, ধুলোর মেঘ ঢেকে ফেলেছে। পেছনে দমকা বাতাস নিয়ে এগিয়ে চলেছে গরুর পাল, পেকোসের প্রায় সমান্তরালে, তবে একেবারে কাছেও নয়, কারণ কাছে থাকলেই বাঁক আর উঁচু-নিচু পথ পাড়ি দিতে হবে।

রাতে ধুলো থিতিয়ে এল বটে, কিন্তু বাতাস অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা মনে হলো। বড়সড় একটা টিলার পেছনে ওয়্যাগন থামিয়ে ক্যাম্প করলাম আমরা।

কার্ল ক্ৰকেট সবার সাথে আগুনের কাছে গিয়ে বসল। এমা বুচার্ডকে রান্নায় সাহায্য করছে। খাবার বলতে গেলে নেই তেমন, খোড়া কয়েকটা বলদ জবাই করেছি আমরা, কিছু মাংস শুকিয়ে রাখা হয়েছে। আটা প্রায় শেষ এবং গুড় নেই একটুও।

স্যাম গার্ট এসে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গড়িয়েছে ওর, বড়বড় বিষণ্ণ চোখে আমাদের নিরীখ করল। কলোরাডো যাওয়ার পথে ক্যানাড়া নদীর তীরে কাটানো একটা রাতের কথা মনে পড়ছে। এমন ধুলো ঝড়ে পড়েছিলাম যে সূর্যও দেখা যাচ্ছিল না। প্রেয়ারি কুকুরগুলো দূরে থাক, নিজেদেরকেও ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিলাম না।

আগুনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হাত বাড়িয়ে দিলাম শিখার দিকে, খানিকটা উষ্ণতার আশায়, মনে মনে বেশ কয়েকটা ব্যাপারে ভাবছি। ট্যাপ চলে যাওয়ার পর বাবা পুরোপুরি আমার ওপর নির্ভর করছেন; কিন্তু এ পর্যন্ত নির্ভার হওয়ার মত কিছুই করতে পারিনি। এই গরুগুলোই আমাদের শেষ সম্বল, অথচ পালের অবস্থা মোটেও সুবিধের নয়। ফেলিপ জাপাটা আর কোমাঞ্চেলরদের সঙ্গে সম্ভাব্য একটা লড়াই রয়েছে হাতে, দেখা হওয়া মাত্র মরণপণ লড়াই করতে হবে, অথচ ওদের তুলনায় আমাদের লোকজন নিতান্তই অল্প।

ইতোমধ্যে কয়েকশো গরু হারিয়েছি আমরা। আর হারানো যাবে। জুয়ানিতা বা জুয়ারেজের কাছ থেকে যা শুনেছি, তাতে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে-জায়গার জন্যে এই দুর্ভোগ, গন্তব্যে আমাদের জন্যে রয়েছে। অনিশ্চয়তা এবং বিপদের সম্ভাবনা। ভয়াবহ ঝামেলায় পড়ে যেতে পারি।

রসদপত্র প্রায় ফুরিয়ে গেছে, শিকার করারও সুযোগ নেই। বুনন পশু এখানে থাকলেও দূরে চলে গেছে কোন কারণে। শুধু একটা কাজই করার আছে আমাদের-গরু দলকে সামনে নিয়ে যাওয়া।

ঘোড়ার ব্যাপারে সন্তুষ্ট আমরা, প্রত্যাশার চেয়েও বেশি নৈপুণ্য দেখিয়েছে ওগুলো। হর্স হেড পর্যন্ত আসতে আসতেই বেশিরভাগ ঘোড়া মারা যায় নয়তো ইন্ডিয়ানরা চুরি করে নিয়ে যায়; কিন্তু এ পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটেনি। বেশিরভাগ লোকের ড্রাইভের সঙ্গে পায়ে হাঁটার কথা, এখন স্যাডলে চড়ছি আমরা। এ মুহূর্তে, কেনল এগিয়ে যাওয়াই একমাত্র কাজ, কারণ দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজটাও লেগে থাকলে সম্পন্ন করা যায়, কিন্তু আমার অনেকবারই মনে হয়েছে চলার মধ্যে থাকলে কখনও কখনও সমস্যার সমাধানও হয়ে যায়।

ফেলিপ জাপাটাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। কঠিন, বেপরোয়া মানুষ। ধূর্ত এবং জেদী। আবার আসবে সে। মওকামত চেপে, ধরবে আমাদের। কোমাঞ্চেরা বা পেলো ডিউরো ক্যানিয়ন সম্পর্কে কেউ আলাপ-আলোচনা করুক চায় না ওরা, ওই ক্যানিয়নের ধারে-কাছেও কাউকে দেখতে অনিচ্ছুক; ইতোমধ্যে জাতভাইদের সামলাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।

যতটা সম্ভব পালের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করব আমরা, স্যামকে বললাম আমি। শিগগিরই ডেলাওয়ারে পৌঁছতে হবে।

পানি আর স্বল্প সময়ের বিশ্রামের ফলাফল সত্যিই বিস্মিত করেছে আমাকে। দারুণ চটপটে মনে হচ্ছে গরুর পালকে। ঘাস প্রায় ছিলই না, কিন্তু প্রিকলি পিয়ারের মধ্যে চাহিদার যোগান খুঁজে পেয়েছে এরা, এগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কোন সমস্যাই হলো না, বলা যায় স্বেচ্ছায় এগোচ্ছে। যেন ওরা কোন ভাবে টের পেয়ে গেছে দীর্ঘ ড্রাইভের সবচেয়ে কঠিন অংশ পেছনে ফেলে এসেছে। সুদূর শুনেছি বা জানি, আমি অন্তত নিশ্চিত নই।

গরুগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে এগোতে বাধ্য করলাম, দু’পাশে রয়েছে ওয়াগনগুলো। স্যাম গার্ট আর ফ্রিম্যান স্কায়ার পেছনে রয়ে গেছে, পিছিয়ে পড়া বা রয়ে যাওয়া গরু নিয়ে আসবে; পাশাপাশি স্কাউটিঙের কাজও করবে। বাবা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, মাঝে মধ্যে পাল ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছেন, অ্যাম্বুশ বা ট্র্যাকের খোঁজে রেকি করছেন। অন্যরা, যতটা সম্ভব পালকে ছোট করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

টোয়াহ্ ক্রীক শুধু নামেই ক্রীক, তলায় চকচকে বালি দেখতে পেলাম আমরা। বছরের অন্য সময়ে হয়তো পানি থাকে, কিন্তু এখন নেই। সুতরাং এগিয়ে চললাম আমরা। চলার পথে পরিত্যক্ত বা ভাঙা ওয়্যাগন থেকে কাঠ সগ্রহ করলাম, যেহেতু ট্রেইলের ধারে-কাছে বাফেলো চিপস আর মেস্কিট ছাড়া জ্বালানি হিসেবে ব্যরহার করার জন্যে কিছুই নেই। মেস্কিট বা বাফেলো চিপসগুলো বেশিরভাগই মাটি খুঁড়ে বের করতে হলো।

শীতল পরিবেশ বদলে তেতে উঠল, খরতাপে পুড়তে শুরু করল মাটির ওপর সবকিছু। গরুগলো পরস্পরের গা ঘেঁষে থাকায়, ওদের শরীর থেকেও যে-ভাপ বেরোল, সেটাও সহ্য করার মত নয়।

ঘোড়া দাবড়ে আমার পাশে চলে এল জুয়ানিতা।

জুয়ারেজের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার, খানিক দ্বিধার পর বলল ও। তুমি আমাদের না বাঁচালে এতক্ষণে হয়তো খুন হয়ে যেতাম।

এমন কিছু নয় ওটা।

কিন্তু এটুকুও আশা করিনি আমরা, জুয়ারেজ তো নয়ই…মেক্সিকান বলেই কারও কাছ থেকে কোন রকম সহায়তা আশা করে না ও।

কারও কারও কাছে হয়তো কথাটার গুরুত্ব আছে, কিন্তু আমাদের কাছে নেই। প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম আমরা।মানে বাবার কথা বলছি-প্রতিবেশী মেক্সদের সাহায্য না পেলে বাবা বখনোই টিকতে পারতেন না।

তোমাদের ড্রাইভের ব্যাপারেও পরামর্শ করেছি আমরা। একটা জায়গার কথা জানি-খুব ভাল জায়গা। ইন্ডিয়ানদের হামলার ভয় আছে বটে, কিন্তু পশ্চিমের কোন জায়গাই বা নিরাপদ? সবখানে ইন্ডিয়ান হামলার আশঙ্কা আছে।

জায়গাটা কোথায়?

দেখিয়ে দেব। পাদ্রীরা যাতায়াত করত ওদিকে। ব্যবসায়ীরাও যেত। পানি, ঘাস সবই প্রচুর আছে। আমার তো ধারণা ওখানেই বসতি করতে পারো তুমি। ইন্ডিয়ান আক্রমণ ছাড়া কোন ঝামেলা হওয়ার কথা নয়।

তোমরা কি করবে-যাবে কোথায়?

বাড়ি যাব। মিগুয়েলের মা আর বউ আছে। স্ত্রীর কথা তো বলেনি ও! আমি তো ভেবেছি হয়তো তুমি আর ও…

না, সেনর, ও বিবাহিত। একসঙ্গে বড় হয়েছি আমরা, ভাইবোনের মত। ভাল বন্ধু বলতে পারো আমাদের। জুয়ারেজ বা ওর মা, দুজনেই ভালমানুষ…ওর বউয়ের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক আমার।

ট্যাপ আর আমার মত। কখনোই সমস্যা হত না আমাদের মধ্যে।

প্রায় সারাটা দিন একসঙ্গে রাইড করলাম আমরা, এটা-সেটা নিয়ে কথা বললাম। গরুর পাল টানা এগিয়ে চলেছে। রাত নামার আগে প্রায় বারো মাইল পেছনে ফেলে এলাম।

ধুলো ঝড়ে হয়তো আমাদের ট্র্যাক মুছে যাবে। বিরাট স্বস্তির ব্যাপার। কিন্তু এ ধরনের এলাকায় মানুষ মাত্রই পানির উৎসের খোঁজে থাকে, থাকতে বাধ্য হয়, তাই একবার ট্র্যাক হারিয়ে ফেললেও পানির উৎসের কাছে এলে হারানো ট্র্যাক ফিরে পাওয়া সম্ভব।

পেকোসের কিনারে এটাই আমাদের শেষ বিরতি। ড্রাইভের উত্তরের কিনারায় দায়িত্বে রয়েছে চার্লি হীথ। এখান থেকে অনায়াসে ডেলাওয়ারের দিকে চলে যেতে পারব।

সন্ধের আগে আগে একটা অ্যান্টিলোপ শিকার করে ক্যাম্পে ফিরে এল হীথ। এত মানুষের তুলনায় সামান্য মাংস, কিন্তু স্রেফ রুচি বদলের সুযোগ হলো বলেই কৃতজ্ঞ সবাই।

পালের কোন গরু জবাই করার ইচ্ছে নেই আমাদের। নতুন ভাবে শুরু করতে প্রতিটা কমবয়েসী গরু দরকার হবে আমাদের, আর বলদগুলো সেনাবাহিনী বা অন্য কারও কাছে বেচে দেব। গরু বিক্রির টাকা রসদপত্র কিনতে লাগবে-পুরো একটা বছর কাটাতে হবে। আমরা নেহাতই গরীব মানুষ, গরুর পাল আর জনবলই আমাদের ভরসা। মূলধন।

সে-রাতে আগুনের পাশে এসে বসলাম সবাই। কাট্টহ্যান্ডদের ক্লান্ত মুখে নেচে বেড়াচ্ছে আগুনের শিখার প্রতিফলন। পরস্পরের কাছ ঘেঁষে বসেছি আমরা। জানা সব গান গাইলাম, গল্প করলাম বিভিন্ন বিষয়ে-তবে শিকার আর ভ্রমণের গল্পই হলো বেশি। ভেতরে ভেতরে হয়তো উদ্বেগ বা অনিশ্চয়তার দোলায় ভুগছি সবাই, কিন্তু পেকোস অঞ্চল ছেড়ে যাচ্ছি আমরা-যে-কোন লোকের জন্যে এটা বিরাট এক স্বস্তি।

ক্যাম্পের আলোয় দুলছে ওয়্যাগনের ছায়া। মিসেস অটম্যান এসে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। জুয়ানিতার সোনালী চুলে আগুনের ছোপ লেগেছে, মাথা নাড়তে ঝিকিয়ে উঠল মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকলাম, বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ওর দিকে…আহ, এত সুন্দর ও!

রোজিটা জেপসনও এসেছে, স্বামীর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে ও; তবে একটা কথাও বলেনি। একেবারে নীরব হয়ে, আছে মহিলা। ট্যাপের সঙ্গে তিক্ত ওই ঘটনা প্রায় সবাই ভুলে গেছে, রোজিটাকে কেউই তিরস্কার বা ভৎর্সনা করেনি, কারণ আমাদের চেয়ে আর বেশি কে জানবে যে মানুষের মন আসলে সবচেয়ে দুর্বল এবং স্পর্শকাতর জায়গা?

বাবাও আছেন আমাদের মধ্যে, চুপচাপ শুনছেন সবার গল্প। মুখ দেখে মনে হচ্ছে বয়স কয়েক বছর কমে গেছে। নতুন একটা জায়গা খুঁজে নেব আমরা, এক ফাঁকে বললেন তিনি। বসতি করব। টি-বারকে নিয়ে যেন গর্ব করতে পারি, এমন আউটফিট তৈরি করব আমরা।

প্রায় সবার মধ্যে নতুন ভাবে আশা জেগে উঠছে, স্বপ্ন দেখছে সবাই; কিন্তু একইসঙ্গে শঙ্কিতও। আমরা জানি, অনিশ্চিত ভাগ্য, ভবিষ্যৎ বা শত দুর্ভোগের পরও, কোমাঞ্চি আর কোমাঞ্চেরোদের হামলার হুমকি খড়গের মত ঝুলে আছে মাথার ওপর। যে-কোন সময় আক্রমণ করতে পারে ওরা।

উঠে দাড়ালাম আমি, জুয়ানিতার দিকে তাকাতে দেখলাম সেও উঠে দাঁড়িয়েছে। হেঁটে আমার পাশে চলে এল ও, আগুনের কাছ থেকে সরে এলাম আমরা। ওয়্যাগনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জুয়ারেজ, ওর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তিনটা শব্দে শুভেচ্ছা জানাল সে; ‘ভায়া কন ডিয়োস’। 

ফ্রিম্যান স্কয়ার ঘুম থেকে জাগাল আমাকে। ঝটপট উঠে বসে মাথায় হ্যাট চাপালাম। সবুকিছু শান্ত…আকাশে তারা নেই, মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ, ভারী বাতাসে সোঁদা গন্ধ। গায়ে বুট গলিয়ে পিস্তল দুটো তুলে নিলাম। গানবেল্ট কোমরে জড়িয়ে অন্যটা বেল্টের পেছনে গুঁজে রাখলাম।

রাইফেলের দিকে হাত বাড়ালাম, তখনই পাহাড়ের কাছে তীক্ষ্ণ শব্দ শুনতে পেলাম। সেকেন্ড কয়েক পর তীক্ষ্ণ চিৎকার কানে এল-বুনো উন্মাদনায় যুদ্ধ ঘোষণা করল একদল কোমাঞ্চি। ছুটন্ত ঘোড়া রাতের নিস্তব্ধতা কাঁপিয়ে ছুটে আসছে ক্যাম্পের দিকে।

মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল গরুর পাল-ছুটতে শুরু করল। স্ট্যাম্পিড ঠেকাতে মরিয়া হয়ে গরুর দিকে ছুটে গেল ফ্রিম্যান স্কয়ার, কিন্তু হোঁচট খেল ঘোড়াটা। মাটিতে ভূপতিত হলো সে। উন্মত্ত গরুর দল ছুটে গেল ওর ওপর দিয়ে।

ফ্রিম্যানের জন্যে দুঃখ করে লাভ নেই। চট করে এক হাঁটু গেড়ে বসলাম আমি, গুলি শুরু করলাম।

ক্যাম্পে ঢুকে পড়া এক কোমাঞ্চিকে গুলি করলাম প্রথমে, স্যাড়ল থেকে খসে পড়ল সে। চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেলাম গড়ান দিয়ে বিছানা থেকে সরে গেলেন রাবা, শটগানের ট্রিগার টিপলেন!

মুহূর্তের মধ্যে মুখর হয়ে উঠল জায়গাটা-পিস্তল আর রাইফেল গর্জে উঠছে, কমলা আগুন ওগরে দিচ্ছে, রক্তলাল ঝলক ছুটে যাচ্ছে রাতের অন্ধকার ভেদ করে!

ওয়াগনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কার্ল ক্ৰকেট, সমানে গুলি করছে সিক্সশূটার থেকে। ঘোড়া ছুটিয়ে ওকে পিষে ফেলার চেষ্টা করল এক ইন্ডিয়ান। কিন্তু সুবিধে করতে পাল্প না। ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে কোমাঞ্চিকে খামচে ধরল সে, তারপর এক লাফে ইন্ডিয়ানের পেছনে, পনির পিঠে চেপে বসল। অন্ধকারে ছুটে গেল ঘোড়াটা, পিঠে দুই সওয়ার নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে দারুণ ব্যস্ত।

ধূসর ঘোড়ায় বিশালদেহী এক লোক ছুটে গেল পাশ দিয়ে-সঙ্গে সঙ্গে লোকটাকে চিনতে পারলাম। ব্লন্ড চুল লোকটার। ওয়েব হর্নারের সঙ্গে ছিল সে।

কোত্থেকে ছুটে এসে আমার কাঁধে ধাক্কা মারল একটা ঘোড়া, তৎক্ষণাৎ ভূপতিত হলাম, মুখের সামনে ধুলো চটকাল একটা বুলেট।

গড়ান দিয়ে উঠে বসলাম আমি। দেখলাম হাঁটু গেড়ে বসে গুলি করছেন বাবা। মুখে রক্ত লেগে আছে ওঁর, কিন্তু এত ধীর-স্থির ভাবে এবং ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করছেন যেন শূটিং গ্যালারিতে অনুশীলন করছেন। মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে বেন টিল্টন, দেখলাম হঠাৎ করেই উঠে বসে নতুন অবস্থানের দিকে খিচে দৌড় মারল জিম মুর, গুলির তুবড়ি ছুটছে ওর আশপাশ দিয়ে।

আচমকা বাড সাটক্লীফকে দেখতে পেলাম, ক্যাম্পে চার্জ করেছে সে,, বাবার উদ্দেশে গুলি করছে। হোলস্টার থেকে পিস্তল তুলে নেওয়ার সময় দেখলাম বুলেটের ধাক্কায় চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন বাবা। পরমুহূর্তে সাটক্লীফের বিশাল বুকের ছাতি ফুটো হয়ে গেল আমার গুলিতে। স্যাডল থেকে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল সে, ঘোড়াটা তুফান বেগে ক্যাম্প পেরিয়ে গেল। গোড়ালির ওপর আধ-পাক ঘুরলাম আমি, উঠতে উদ্যত হওয়া সাইক্লীফের মাথায় নিশানা করলাম এবার, কোমরের কাছ থেকে করলাম গুলিটা। কাটা কলা গাছের মত দড়াম করে আছড়ে পড়ল সে, ধীর ভঙ্গিতে গড়ান খেয়ে চিৎ হলো শরীরটা।

যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল, তেমনি শেষ হয়ে গেল লড়াই। অখণ্ড নীরবতা নেমে এল চারপাশে।

একটা ওয়াগনের ছাদে আগুন জ্বলছে, দেখেই পানি ভরা বালতি তুলে নিয়ে আগুনের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। এক লাফে উঠে পড়লাম ওয়্যাগনে, জ্বলন্ত ক্যানভাসের কিনারা ধরে ফ্রেম থেকে টেনে ছিড়ে ফেললাম। পুরো ক্যানভাস খুলে আসার পর মাটিতে ফেলে ঠেসে ধরলাম, বুট দিয়ে মাড়ালাম। তীক্ষ্ণ শব্দে পাশ দিয়ে ছুটে গেল একটা সীসা, ওয়্যাগনের পাটাতনে বিঁধল। ঝটপট মাটিতে শুয়ে পড়লাম আমি, স্থির হয়ে পড়ে থাকলাম।

গরুর পাল উধাও হয়ে গেছে। ফ্রিম্যান স্কয়ারমৃত, সম্ভবত বেন টিল্টনেরও একই পরিণতি হয়েছে।

কিছুই নড়ছে না। কোন শব্দ নেই। অন্ধকারে শুয়ে থেকে সিক্সশূটারে তাজা শেল ঢোকালাম আমি, প্যাটার্সনের খোঁজে আশপাশে তাকালাম।

ধারে-কাছে অন্ধকারে অস্কুট গোঙানি শুনতে পেলাম, তারপর নীরব হয়ে গেল সব। ধুলো উড়ছে বাতাসে, নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে ধুলো। গায়ে আড়ষ্ট ব্যথা অনুভব করছি। হাতের তালুতে পিস্তলের বাঁটের স্পর্শ স্বস্তি আর নির্ভরতা এনে দিল শরীরে। পেছনে নদীর কুলকুল ধ্বনি কানে আসছে, কিন্তু এছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

ধারে-কাছেই আছে ওরা, জানি আমি। নড়লেই খুনী বুলেট ছুটে আসবে।

জুয়ানিতার কি হয়েছে? মিসেস অটম্যানের ভাগ্যে কি ঘটল? বাবা কোথায়?

দূরে মেঘের গুড়গুড় শব্দ হলো…রাতটা নিঃশব্দ আর শূন্যতায় ভরা। দমকা হিমেল বাতাস বয়ে গেল, ছড়িয়ে দিল ক্যাম্পের জ্বলন্ত কয়লাকে, একটা কাপ কাৎ হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

সন্তর্পণে মাটিতে হাতের তালু রেখে, হাতের ওপর ভর করে ধীরে ধীরে শরীর তুললাম। উঠে বসলাম এরপর, পিছিয়ে গাঢ় অন্ধকারে চলে এলাম। কয়েক মুহূর্ত পর আরও দুই গজ পিছিয়ে এলাম।

বজ্রপাত হলো ধারে-কাছে..নীল বজ্র চিরে গেল ঘন অন্ধকার। আবার বজ্রপাত হলো, এবং পরপরই বৃষ্টি শুরু হলো। প্রচণ্ড বৃষ্টি। মাত্র কয়েক মিনিটেই তৃষিত ধুলোময় জমির উষ্ণতা ছাপিয়ে গেল, স্যাতস্যাঁতে এবং ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল।

আবার যখন বজ্রপাত হলো, নীলচে রূপালী আলোয় বাবাকে চিৎ হয়ে পড়ে থাকতে দেখতে পেলাম। মাত্র এক মুহূর্তের জন্যে, তারপর মেঘের গর্জন ভেসে এল। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *