অপঘাত – ৫

তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই ছুটে গেলাম আমি, একটু আগে যেখানে বাবাকে দেখেছি।

মারা গেছেন তিনি। দুটো গুলি বিঁধেছে শরীরে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে।

বাবার পাশে পড়ে থাকা রাইফেল তুলে নিয়ে এক ছুটে কাছের ওয়্যাগনের আড়ালে চলে এলাম। পাটাতনের তলায় অবস্থান নিলাম। অন্য কেউ বেঁচে আছে কিনা জানি না, কিন্তু বাবা মারা গেছেন; সব গরু হারিয়েছি আমরা, সব স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে; এবং এই প্রথম নিজের ভেতর তীব্র ঘৃণা আবিষ্কার করলাম আমি।

ওয়্যাগনের নিচে, আংশিক আশ্রয়ে থেকে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবলাম। জাপাটা আর ওর লোকেরা কি করবে এখন? যুক্তি আর সহজাত প্রবৃত্তি বলছে পালানো উচিত আমার, সকাল হওয়ার আগেই কেটে পড়া উচিত, যদি ভুল না করে থাকি, নির্ঘাত ওয়্যাগন লুট করার জন্যে ফিরে আসবে কোমাঞ্চেরোরা।

আর ক’জন মারা গেছে? কেউ কি গুরুতর আহত হয়ে পড়ে আছে? যদি তাই হয়, ওদেরকে খুঁজে বের করা উচিত। যে-কোন বিচারেই হোক, এ মানুষগুলোর কাউকে কোমাঞ্চিদের অসহায় শিকার হওয়ার জন্যে রেখে যেতে পারি না আমি।

সতর্কতার সঙ্গে ভেজা পিস্তল মুছলাম। প্যাটার্সনটা ধারে-কাছে কোথাও পড়ে আছে, তবে ওটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না এখন, কারণ বাবার ব্রীচ-লোডিং শার্পসটা এখন আমার হাতে। বাবার কাছে যে শটগান ছিল, ওটাও নিশ্চই পড়ে আছে কোথাও।

ঝড় বন্ধ হয়নি। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, পেকোসের দুই কুল ছাপিয়ে উঠবে পানিতে। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কারও বাইরে থাকার কথা নয়, সম্ভবত আমাদের শত্রুরাও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে এখন, যদি চেনা কোন আশ্রয় থেকে থাকে ওদের; কিংবা আমাদের গরুর পালের পিছু নিয়েছে, নিঃসন্দেহে বলা যায় পালের দখল নেবে ওরা।

আচমকা, মাথার ওপর ওয়্যাগনের ভেতর ক্ষীণ নড়াচড়া টের পেলাম। দূরে মেঘের গর্জন হলো, বজ্রপাত হলো আবারও। নীল বিদ্যুতের আলোয় নদীর পাড়ে, বড়জোর বিশ গজ দূরে দুটো কাঠামো চোখে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলাম।

টিম অটম্যান আর ওর বউ!

অন্তত দু’জন বেঁচে আছে। আর…ওয়্যাগনে কে আশ্রয় নিয়েছে? নিঃসন্দেহে আমাদের একজন, কিন্তু নিশ্চিত বলা যায় কি? এমনও হতে পারে কোন কোমাঞ্চি, লুট করার ধান্ধায় উঠে পড়েছে ওয়্যাগনে।

সন্তর্পনে ওয়্যাগনের তলা থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। বৃষ্টির সুচাল ফোঁটা গায়ে খোঁচা মারছে যেন, মুখে চিমটি কাটার মত অনুভূতি হচ্ছে। ওয়্যাগনের ভেতরটা পুরোপুরি অন্ধকার, বাইরের অপেক্ষাকৃত আলোর বিপরীতে আমার কাঠামো নিশ্চই পরিষ্কার ফুটে উঠবে।কিন্তু ভেতরে কে আছে, জানতেই হবে। সুতরাং ঝুঁকিটা নিতে মনস্থ করলাম। অটম্যানরা আসছে, কোন ভাবেই ফাঁদে পড়তে দেয়া উচিত হবে না ওদের।

চাকার অনুভূমিক স্পোকের ওপর একটা পা রেখে, বাম হাতে ওয়্যাগনের কিনারা চেপে ধরে শরীর টেনে তুললাম, তারপর শরীর বাঁকিয়ে পাশ থেকে হঠাৎ ওয়্যাগনের ভেতরে উঁকি দিলাম।

অস্ফুট স্বরে বিস্ময় প্রকাশ করল কেউ।

জুয়ানিতা?

ড্যান! ওহ্, ড্যান! বেঁচে আছ তুমি!

টিকে আছি কোন রকমে। তুমি ঠিক আছ তো?

হ্যাঁ, কিন্তু এই লোকটা আহত হয়েছে। গুলি লেগেছে।

ঝুঁকি নিয়ে দেয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালালাম। স্যাম গার্ট। চাদিতে দীর্ঘ একটা আঁচড় কেটে চলে গেছে বুলেট, কাঁধ থেকে এক খাবলা মাংস তুলে নিয়েছে। দৃশ্যত, ওয়্যাগনে শুয়ে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে সে, চাদির চামড়ায় আঁচড় কেটে কাঁধের ওপরের অংশে গিয়ে আঘাত করেছে তপ্ত সীসা। প্রচুর রক্তপাত হয়েছে, এছাড়া মোটামুটি সুস্থ, সে।

টানা বৃষ্টি হচ্ছে, ওয়্যাগনের ক্যানভাসে বৃষ্টির ভোতা কিন্তু জোরাল শব্দ ছাপিয়ে আগুয়ান কারও পদশব্দ শুনতে পেলাম, একটু পর মিসেস অটম্যান আর টিম উঠে পড়ল ওয়্যাগনে।

মাথা চেপে ধরে উঠে বসল স্যাম, চারপাশে তাকাল শূন্য দৃষ্টিতে।

এবার বোধহয় বাতি জ্বালানো যেতে পারে, বললাম আমি। চলে গেছে ওরা, নইলে দেয়াশলাই জ্বালানোর পর আমার লাশ ফেলে দিত।

মোমবাতি জ্বেলে বাড়তি কার্তুজের খোঁজে ওয়্যাগনে তল্লাশি চালালাম।

এই যে, তোমার রাইফেল, প্যাটার্সনটা এগিয়ে দিল টিম অটম্যান। আসার পথে খুঁজে পেয়েছি।

শার্পসটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। প্যাটার্সটা মুছে, কার্তুজ বের করে তাজা বুলেট ঢোকালাম।

শুধু কি আমরাই বেঁচে আছি? প্রায় বিলাপের সুরে জানতে চাইল মিসেস অটম্যান। অন্যদের খবর জানো?

বাবা মারা গেছেন। স্কয়ার বেচারা স্ট্যাম্পিড ঠেকাতে গিয়ে পিষ্ট হয়েছে খুরের নিচে। বেন টিল্টনকে পড়ে থাকতে দেখেছি।

জিম মুর নদীর পাড় ধরে নেমে গিয়েছিল। নদীতে ডুবে মারা গিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই বেঁচে আছে ও।

ওয়্যাগনে গাদাগাদি অবস্থায় বসে সকালের অপেক্ষায় থাকলাম আমরা। লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। আর যাই হোক, পানির কোন ঘাটতি হবে না এখন। একটা গরু খুঁজে জবাই করতে হবে, নিরুদ্দিষ্ট একটা খুঁজে পেতেই হবে। আর যেভাবেই হোক রিও গ্রান্ড বা কপার মাইন পর্যন্ত পৌঁছতে হবে আমাদের।

খাবার নেই, এটাই দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ। অন্য ওয়্যাগনে খাবার ছিল। আগুনে নষ্ট না হলেও বৃষ্টিতে নিশ্চই নষ্ট হয়ে গেছে এখন। যদিও আমার প্রত্যাশা হয়তো কিছু খাবার পাব, তবে পরিমাণ নিতান্ত অল্প।

ঘোড়া নেই আমাদের, গরুর পালের সঙ্গে ওগুলোও পালিয়েছে। হয় চুরি হয়েছে, নয়তো ছড়িয়ে পড়েছে। ওগুলোর দু’একটাকে যে ধরতে পারব এমন সম্ভাবনা কম। সামনে কেবলই অনিশ্চয়তা, দুর্ভোগ আর কষ্টকর মৃত্যুর হাতছানি। এরচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি কেউ কল্পনাও করতে পারে না; অথচ সঙ্গে মহিলা আছে আমাদের।

পুরো দায়িত্বই আমার। এরা আমাদের লোক, আমাদের হয়ে কাজ করেছে; বাবা মারা যাওয়ায় স্বভাবতই পুরো দায়িতু এখন আমার। এ অবস্থায়, সব গরু হারানোর পরও দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না আমি। এখন বরং যে-কোন সময়ের চেয়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দরকার, অনিশ্চয়তায় ভরা এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হবে-খাবার আর ঘোড়া যোগাড় করতে হবে; এবং একটা আশ্রয় খুঁজে পেতে হবে।

ভেতরে ভেতরে গভীর শঙ্কা বোধ করছি, যেহেতু এমন ভয়াবহ এবং অসহায় পরিস্থিতিতে কখনও পড়িনি। মন জুড়ে ব্যর্থতার আশঙ্কা, আর ব্যর্থতা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু…সবাই না হলেও আমাদের মধ্যে যারা দুর্বল, তাদের জন্যে।

সারারাত ধরে বৃষ্টি হলো। পেকোসের দু’কুল ছাপিয়ে উঠেছে, কাছাকাছি সব অ্যারোয়োও ভরে গেছে। পশ্চিমে যাওয়ার পথে একাধিক বাধা তৈরি হয়ে গেছে। তবে সূর্য ওঠার পর অনেক অ্যারোয়ো শুকিয়ে যাবে, বালিময় তীর পানি শুষে নেবে। শুধু প্রাকৃতিক কিছু টিনাজায় পানি থাকবে।

মেঘের কম্বল মুড়ি দেওয়া ধূসর গম্ভীর আকাশের পেছন থেকে উদিত হলো সূর্য। বৃষ্টি ধরে এসেছে কিছুটা, কাছাকাছি, বজ্রপাত হচ্ছে না এখন। দূরে গুয়াডালুপে পর্বতশ্রেণীর আনাচে-কানাচে প্রতিধ্বনি তুলছে বজ্রপাতের গম্ভীর শব্দ।

আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর মাটিতে পা রাখলাম। গায়ে স্লিকার চাপিয়ে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি চালালাম।

ভেজা মাটি গাঢ় রঙ ধারণ করেছে, পুরো ক্যাম্প কর্দমাক্ত হয়ে আছে। আকাশে ভারী মেঘের আনাগোনা। ভরা যৌবন ফিরে পেয়েছে পেকোস-গাঢ় রঙের পানিতে স্রোত উঠেছে। বাবার শরীর তুলে নিয়ে ওয়্যাগনের কাছে ফিরে এলাম, ওয়্যাগনের তলায় রেখে চারপাশ খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম।

ক্যাম্পের কিনারে বাড সাইক্লীফের লাশ পড়ে আছে। নদীর তীরে পড়ে আছে আরেকটা লাশ-অপরিচিত লোক কোমাঞ্চেরোদের একজন। বেন টিল্টনের লাশ তুলে নিয়ে এসে বাবার পাশে রাখলাম।

যে-কোন কিছু করার আগে ঘোড়া দরকার আমাদের, কিন্তু দৃষ্টিসীমায় চোখে পড়ল না। মরা একটা ঘোড়া পড়ে আছে কাছাকাছি। এগিয়ে গিয়ে ওটার পিঠ থেকে স্যাডল ছাড়িয়ে নিলাম, ব্রিডল খুলে ওয়্যাগনে এনে রাখলাম।

ওয়্যাগন থেকে নেমে এসেছে টিম অটম্যান। তুমি আর মিসেস অটম্যান সাহায্য করতে পারো, ওকে বললাম, ওয়্যাগন খুঁজে দেখো খাবার কিছু পাওয়া যায় কিনা। ক্যান্টিন, বেড়িং, অস্ত্র বা কার্তুজ, যাই পাবে সংগ্রহ করো।

নড করল সে, বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল চারপাশে। আমাদের শেষ করে দিয়েছে ওরা, ড্যান। একেবারে ফকির বানিয়ে দিয়েছে।

অত হতাশ হয়ো না। প্রথমে কপার মাইনে যাব আমরা, তারপর দেখব কি করা যায়। বাবার কাগজপত্র, টালি-বুক বা ওরকম কিছু খুঁজে পেলে আমার জন্যে আলাদা করে রেখো।

স্যাম গার্টও নেমে এসেছে। অসুস্থ এবং ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে ওকে, কিন্তু স্মিত কৌতুকের হাসি উপহার দিল আমাকে। মনে হচ্ছে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হবে আমাদের। পারবে তো, ড্যান?

চারপাশে খোঁজ চালালাম আমরা। জিম মুরের পাত্তা নেই, হয় ডুবে গেছে নয়তো নদীর স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাকে।

একটা ব্যাপার সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছি আমরা, বাচ্চাদের প্রসঙ্গ তুলছি না কেউ। টিমের দুই ছেলে এবং বুচার্ডের বাচ্চারা। ক্যাম্পে হামলার পর এদের কাউকে দেখেনি কেউ, কিন্তু রাতে পাহারা দেয়ার জন্যে জেগে ওঠার পর ওদেরকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি আমি।

স্যাম গার্টের সঙ্গে নদীর তীর ধরে এগোলাম আমি। ট্র্যাক যদি কিছু পড়েও থাকে, বৃষ্টিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এতগুলো মানুষের বেঁচে থাকাই অস্বাভাবিক, কিন্তু এ পর্যন্ত কোন মৃতদেহ চোখে পড়েনি আমাদের-এটাই স্বস্তি এবং প্রত্যাশার ব্যাপার।

দুজনে আলাদা হয়ে গেলাম আমরা। একটু পর ওর চিৎকার শুনতে পেলাম। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে সে, পায়ের কাছে কি যেন দেখছে। ওখানে যাওয়ার পর দেখলাম, কিছু লাইমস্টোনের ডোবার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে।

সামনের মাটিতে বড়সড় গুহার মত গর্ত তৈরি হয়েছে, গর্তের ব্যাসার্ধ অন্তত ত্রিশ ফুট। গার্টের পাশে এসে দাঁড়িয়ে গর্তের দিকে তাকালাম, গুহার গাঢ় অন্ধকার মুখ চোখে পড়ল।

কেউ আছ নাকি? ডাকল স্যাম।

বিস্ময়কর হলেও সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া এল। গুহার কিনারায় এসে দাঁড়াল মিলো ডজ। তোমার গলা শুনলাম, বলল সে। ঠিক আছ তো তোমরা?

বাচ্চাদের দেখেছ?

আমার সঙ্গে আছে ওরা। এমা বুচার্ডও আছে এখানে।

ধীরে ধীরে গুহা থেকে উঠে এল বাচ্চারা। সবার শেষে মিসেস বুচার্ডের পিছু পিছু মিলো ডজ বেরিয়ে এল।

ফ্রাঙ্ক কেলসি মারা গেছে। সারারাত কষ্ট পেয়েছে বেচারা, সকালেই মারা গেল। দুটো গুলি বিধেছিল…একটা পেটে।

বাবা আর টিল্টন মারা গেছে, বললাম আমি।

প্রথম হামলার সময় বাচ্চাদের নিয়ে এদিকে চলে আসে মিসেস বুচার্ড। জায়গাটা আগেই দেখেছিলাম আমি, দ্রুত ওদেরকে এখানে রেখে বেরিয়ে গেলাম। দুটো গুলি লাগিয়েছি, কিন্তু যাঁকে লাগাতে পারলে সবচেয়ে শান্তি পেতাম, ওটাই মিস্ হয়েছে।

মানে? মিলো ডজের চোখে বিতৃষ্ণা দেখে বিস্ময় বোধ করছি।

কার কথা বলছ?

চার্লি হীথ! ওদের সঙ্গে ছিল সে। ক্যাম্পে হামলার সময় বাড সাটক্লীফের পাশে দেখেছি ওকে। একটা গুলি করেছিলাম ওকে।

ওয়েব হর্নারের সঙ্গে ট্যাপের গানফাইটের কথা মনে আছে? চার্লি যদি ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে থাকে, তাহলে অন্তত একটা ঘাপলা পরিষ্কার হয়ে যায়-আচমকা দু’জনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ওরা, মনে আছে? হীথ নিশ্চই সতর্ক করে দিয়েছিল ওদের।

হীথের সঙ্গে এটা আমার ব্যক্তিগত লড়াই, শীতল সুরে বলল মিলো। ওই লোকটাকে চাই আমি!

তাহলে আমার আগেই ওকে পাকড়াও করতে হবে তোমার, বলল স্যাম গার্ট। ওই ব্যাটাকে কখনোই পছন্দ হয়নি আমার।

সবাই একত্রিত হলাম আমরা। বিধ্বস্ত, পরাজিত, ক্লান্ত, হতোদ্যম কিছু মানুষ।

টিম অটম্যান, মিলো ডজ, স্যাম গার্ট এবং আমি…তিনজন মহিলা। পাঁচটা বাচ্চা। অটম্যানের ছেলে দুটোর বয়স চোদ্দ আর দশ, এমা বুচার্ডের মেয়েটার বয়স তেরো বছর, আর দুই ছেলের বয়স নয় এবং এক বছর।

সবার আগে, বললাম আমি। এই গুহায় আশ্রয় নেব আমরা, মিলল। তারপর, ঘোড়ার খোঁজে বেরোব পুরুষরা, মেয়েরা তখন বাচ্চাদের নিয়ে গুহায় থাকবে। আমার মনে হয় না সব ঘোড়া নিয়ে গেছে ওরা কিংবা তাড়িয়ে দিতে পেরেছে; সেজন্যেই চারপাশে চক্কর মেরে দেখা উচিত। ছড়িয়ে পড়া দু’একটা ঘোড়া ক্যাম্পেও ফিরে আসতে পারে।

ব্যবহার করা যাবে, এমন যা কিছু রয়েছে ওয়্যাগন থেকে নামিয়ে ফেললাম আমরা, তবে খুঁটিনাটি এবং সহজে বহন করা যাবে এমন জিনিসই নিয়েছি। বিছানা, রান্নার তৈজসপত্র, কার্তুজ গুহায় স্থানান্তর করলাম। সামান্য যে খাবার ছিল তাও সরিয়ে নেয়া হলো।

স্যামের সঙ্গে বেরোলাম আমি, দুজনের হাতেই দড়ি রয়েছে। মিলো আর টিম অন্য দিকে গেছে। দুর্ভাগ্য যে ঝড়ের পর কোন ট্র্যাকই নেই, তবে ঠিক করে নিয়েছি বেশিদূর যাব না আমরা; কোমাঞ্চিদের ব্যাপারে সতর্ক থাকছি, কয়েক মাইলের মধ্যে যদি কিছু খুঁজে না পাই, তাহলে ফিরে আসব।

রীজের দিকে চলে এসেছি স্যাম আর আমি। কর্দমাক্ত ঢালু জমি উঠে গেছে রীজের চূড়ায়। প্রায় গোলাকার ওটার মাথা; বেশ কিছু সোপইড, প্রিকলি পিয়ার, এবং মেস্কিট রয়েছে। দূরে ঘোড়ার মতই একটা অবয়ব চোখে পড়ল, বলদও হতে পারে-দূরত্বের কারণে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।

ওই যে, আরেকটা আঙুল তুলে দেখাল স্যাম। চলো! ধরি ওদের!

পশু দুটোর দিকে এগোলাম আমরা, প্রায় আধ-মাইল যাওয়ার পর কাঠামো পরিষ্কার হলো-ঘোড়া নয় বলদ। ডোরাকাটা বলদটা। আমাদের পালের লীডার।

কখনও বলদের পিঠে রাইড করেছ, ড্যান?

হ্যাঁ-বাচ্চা বয়সে। আমার মনে হয় না এটার পিঠে রাইড করতে পারবে কেউ।

হয়তো, হিসেবী দৃষ্টিতে বলদটার দিকে তাকাল স্যাম গার্ট। শেষ দিকে কিন্তু পোষা হয়ে এসেছিল এটা, এমন আচরণ করত যেন ও আর আমরা মিলে গরুর পাল সামলাচ্ছি। চলো যাই, আগে ধরি ওকে।

তো, এগোলাম দুজনে। অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদের দেখতে পেল বলদটা। ঝট করে মাথা তুলল, দুই শিংয়ের দূরত্ব আট ফুট; হেঁটে আমাদের দিকে এগিয়ে এল ওটা, মাথা নিচু করে রেখেছে, শিং দুটো সামনের দিকে ঝুঁকে আছে যেন লড়াই করার জন্যে প্রস্তুত। সাধারণত কোন অশ্বারোহীকে আক্রমণ করে না ওরা, অথচ সেই একই লোককে বাহনহীন অবস্থায় পেলে হামলা করতে দ্বিধা করবে না। অশ্বারোহীর সঙ্গে লড়াই করা যতটা কঠিন, ঠিক ততটাই সহজ মাটিতে দাঁড়ানো লোকের বিপক্ষে।

কাছাকাছি চলে এল ওটা। এদিকে নিচু কোমল স্বরে ওটার সঙ্গে কথা বলছি, আমি। চোখ বড়বড় করে আমাদের দিকে তাকাল ওটা, মাথা তুলল। ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্য পশুটা যেদিকে দেখেছি, সেদিকে এগোলাম। আয়, ব্যাটা! তুই আমাদের সঙ্গে আছিস এখনও।

অবিশ্বাস্য হলেও, সত্যি সত্যি এগোল ওটা, বাধ্য বিশাল একটা কুকুরের মত। আমরা যা করছি নির্দ্বিধায় তাই করছে-থামলে ওটাও থামছে, আবার চলা শুরু করলে ওটাও এগোচ্ছে।

মালপত্র চাপানো যাবে ওর পিঠে, আশান্বিত স্বরে বললাম। সেটাও বিরাট স্বস্তি। মালপত্র আমাদের নিজেদের বইতে হবে না।

চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।

তারপরই চমৎকার ঘটনাটা ঘটল।

মেস্কিটের ওপাশে রয়েছে অন্য পশুটা-ঘোড়া বা বলদ। কয়েক পা এগিয়ে মোড় ঘুরতে ওটাকে দেখতে পেলাম। নিচু একটা, খাদে ঘাস নিয়ে ব্যস্ত আমার ডান ঘোড়াটা। ওটার সঙ্গে আরও দুটো ঘোড়া রয়েছে। একটা বে পনি, অন্যটা পেইন্ট।

ডানটাকে ডাক দিলাম, কিন্তু ভ্রুক্ষেপ করল না ওটা। ফাস তৈরি করে ছুঁড়ে মারলাম। এড়ানোর জন্যে মাথা নিচু করল ওটা, সরে গেল কয়েক পা; তবে গলায় ফাঁস পড়া মাত্র স্থির হয়ে দাঁড়াল; মনে হলো ধরা পড়ায় যেন কৃতজ্ঞ বোধ করছে। ঘোড়া বা কুকুর, স্বভাবের কারণেই মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। সামাজিক পশু বলা যায় ওদের। মানুষের জন্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু এবং নিঃসঙ্গ সময়ের স্বস্তিকর সঙ্গী। অন্য কোন প্রাণী এ যোগ্যতা রাখে না।

হ্যাকামোর লতা সগ্রহ করে লাগাম হিসেবে চালিয়ে নিলাম, তারপর ডানের স্যাডলে চড়লাম। মিনিট কয়েক চেষ্টা করার পর পেইন্টটাকে ধরে ফেললাম। বাড সাটক্লীফের মৃত ঘোড়া থেকে সংগ্রহ করা ব্রিডল ওটাকে পরাল স্যাম গার্ট-তারপর চড়ে বসল পেইন্টে।

তৃতীয় ঘোড়াটাকে ধরতে সময় লাগল বটে, কিন্তু দুই সঙ্গীকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক নয় ওটা। যতই এড়িয়ে যাক, দূরে সরে যায়নি ওটা। দুই ঘোড়ায় চড়ে ক্যাম্পের দিকে যাত্রা করলাম আমরা, দেখলাম পিছু পিছু আসছে ওটা। মিনিট কয়েকের মধ্যে ওটার গলায় ফাস পরিয়ে ফেলল স্যাম।

টিম বা মিলোর ভাগ্য আমাদের মত সুপ্রসন্ন হয়নি। খালি হাতে ফিরেছে ওরা। তবে তাজা ট্র্যাক দেখেছে, বৃষ্টির পরের-গরু এবং ঘোড়া, দুটোরই।

রাতটা গুহায় কাটালাম আমরা। লবণ মেশানো শুয়োরের মাংস আর মটরশুটি দিয়ে সাপার করলাম।

এই গুহাটা অনেক বড়, মন্তব্য করল টিম অটম্যান। মনে হচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে অনেক দূর চলে গেছে। কেন্টাকির লাইমস্টোন এলাকায় ছিলাম আমি, বিশ্বাস করো, কয়েক মাইল দীর্ঘ এরকম গুহা প্রচুর আছে ওখানে। মাটির নিচে মাইলকে মাইল ছড়িয়ে পড়ে।

সকালে সামান্য জিনিসপত্র যা ছিল, সব নিয়ে বেরিয়ে এলাম গুহা থেকে। বাচ্চা আর মহিলারা পর্যায়ক্রমে ঘোড়ায় চড়ছে। বিস্ময়কর ব্যাপার, পিঠের বোঝাকে সহজ ভাবে নিয়েছে বলদটা। বুড়ো এই মসিহর্নটা সত্যিই বিস্মিত করেছে আমাদের। স্পষ্টত, মানুষের উপস্থিতি বা সঙ্গ উপভোগ করছে ওটা। জুয়ানিতা বা বাচ্চারা ওটাকে বিস্কুট এবং গুড় মেশানো কর্ন খেতে দিয়েছে, সেজন্যেই যে এত খাতির তা বলা যাবে না।

নিরুদ্যম অনিশ্চিত যাত্রা, তবে শুরু তো হয়েছে। বাবা আর অন্যদের কবর দিয়েছি আমরা। ফ্রিম্যান স্কয়ারের শরীরের অবশিষ্টাংশ যা খুঁজে পেয়েছি, তাই গোর দিয়েছি সসম্মানে। প্রত্যেকের জন্যে আলাদা মার্কার দেওয়া সম্ভব হয়নি, একটা মার্কারে কাজ চালিয়ে নিয়েছি।

কার্ল ক্ৰকেট, জিম মুর কিংবা জেপসনদের কোন খবর নেই। শেষ যখন কার্লকে দেখেছিলাম, এক ইন্ডিয়ানের স্যাডলে চেপে মরণপণ লড়াই করছিল, ছুটে ক্যাম্প পেরিয়ে গেছে ঘোড়াটা। হয়তো বন্দী হয়েছে ও, কিংবা অক্ষত অবস্থায় ইন্ডিয়ানকে কায়দা করে ফেলেছে। যাই হোক, আশপাশে অন্য কোন মৃতদেহ খুঁজে পাইনি আমরা, ঘোড়ায় চড়ে চারপাশে বেশ খানিকটা রেকি করেছি।

এগিয়ে চললাম আমরা। সন্ধেয় ডেলাওয়ার ক্রীকের বাকের কাছাকাছি এক জায়গায় ক্যাম্প করলাম। একসময় বোধহয় ক্যাম্প করেছিল কেউ এখানে, বামে প্রচুর কাঠ পড়ে আছে; পরিত্যক্ত একটা ওয়াগনও রয়েছে। দুটো চাকা নেই ওটার।

ক্রীকের পাড়ে বেশ ঘাস রয়েছে, খুব বেশি না হলেও, গত কয়েকদিনে তাও চোখে পড়েনি। প্রমাণ সাইজের কিছু মেস্কিটও রয়েছে।

সূর্য ডুবে যাওয়ার পরপরই একটা অ্যান্টিলোপ শিকার করল স্যাম গার্ট, সাপারে ওটার মাংস খেলাম আমরা। পেকোস ছাড়ার পর এই প্রথম ভাল এবং পর্যাপ্ত খাবার জুটল।

রাতে পাহারায় থাকছি আমরা, নিশ্চিত ভাবে বলা যায় কোমাঞ্চেরোদের সঙ্গে দেখা হবে আবার। এবার আর অসতর্ক অবস্থায় ওদের মোকাবিলা করতে চাই না। তৈরি থাকতে চাই। প্রায় মাঝরাতের দিকে দূরাগত খুরের শব্দ শুনতে পেলাম-ক্রমশ এগিয়ে আসছে। কিন্তু ক্যাম্পের কাছাকাছি এসে, অন্ধকারে থামল ঘোড়াটা।

ডানটা হেষাধ্বনি করল, উত্তরে ডেকে উঠল ঘোড়াটা, আরও এগিয়ে এল। জুয়ানিতার বিশাল কালো ঘোড়া ওটা।

জুয়ানিতাকে জাগালাম আমি, দ্রুত ব্যাখ্যা করলাম। বেডরোল ছেড়ে উঠে পড়ল ও, আগুনের কিনারে গিয়ে ঘোড়াটাকে ডাকল। দ্রুত এগিয়ে এল কালো রোয়ান, এসেই জুয়ানিতার হাত শুকতে শুরু করল যেন চিনি বা অন্য কিছু আছে ওর হাতে। স্প্যানিশ ধাঁচের স্যাডল-ব্রিডল চাপানো ওটার পিঠে, উঁচু ক্যান্টল; আমি অন্তত এত উঁচু ক্যান্টলে অভ্যস্ত নই। স্ক্যাবার্ডে একটা রাইফেল ঝুলছে, স্যাডল-ব্যাগ ফুলে-ফেঁপে-আছে। নিশ্চই ভেতরে কিছু আছে।

স্যাডল-ব্যাগ খুলল জুয়ানিতা। কার্তুজ আর বাকস্কিনের তৈরি থলেয় স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেল।

এগুলো কাজে লাগবে আমাদের, মুদ্রার থলে আমার হাতে ধরিয়ে দিল ও।

জুয়ারেজের প্রসঙ্গ আসেনি, কিন্তু জুয়ানিতার আড়ষ্ট মুখ বা চেপে বসা চোয়াল দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিজেকে সামলে রাখতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে ওর। জুয়ারেজের দেহ খুঁজে পাইনি আমরা, ক্যাম্পে হামলার পর কেউ তাকে দেখেওনি।

দৃশ্যত, বিশাল ঘোড়টাকে দখল করেছিল কোমাঞ্চেরোরা। রাইডও করেছিল, কিন্তু কোন ভাবে রাইডারকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়েছে ঘোড়াটা, তারপর ফিরে এসেছে আমাদের কাছে।

কোন লোকই সুবিধে করতে পারে না ওর সঙ্গে, ব্যাখ্যা করল জুয়ানিতা। আমাকে ছাড়া কাউকে সহ্য করে না ওটা, এমনকি কোন মহিলাকেও নয়। কেউ হয়তো সাময়িক ভাবে চড়তে পারে, কিন্তু ঘোড়াটা সুযোগ পাওয়া মাত্র পিঠ থেকে ছুঁড়ে ফেলবে তাকে।

পশ্চিমে এগোতে থাকলাম আমরা। মেঘ সরে গিয়ে রোদ উঠেছে আবার। খরতাপে তেতে উঠছে জমিন..ঘাসের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে, জ্বালানির ঘাটতিও পড়েছে। পুরুষরা হাঁটছি আমরা..ইন্ডিয়ানদের চিহ্ন চোখে পড়েনি এ পর্যন্ত।

তৃতীয় দিন মরুভূমিতে একটা ষাড় খুঁজে পেয়ে ওটাকে শিকার করলাম। সম্ভবত কোন ওয়াগন ট্রেন থেকে পিছিয়ে পড়েছিল ওটা কিংবা নিরুদ্দেশ হয়ে পড়েছিল বহু আগে। মেস্কিটের বীচি খেয়ে বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে উঠেছে ওটা। মাংস কেটে বেশিরভাগই সংগ্রহ করলাম ভবিষ্যতের জন্যে। সেদিনের সাপারটা দারুণ হলো। বহুদিন পর পেট পুরে খাওয়ার সুযোগ হলো।

দিগন্তে গুয়াডালুপে পর্বতশ্রেণীর চূড়াগুলো আবছা ভাবে চোখে পড়ছে। গরুর পাল বা ওয়্যাগন নেই। পায়ে হাঁটছি আমরা, তারপরও বেশ দ্রুত এগোচ্ছি। জুয়ানিতার ঘোড়াটা পাওয়ার পর প্রথমদিন ষোলো মাইল এগিয়েছি, সেদিন অবশ্য শুকনো খটখটে জায়গায় ক্যাম্প করতে হলো।

সূর্য ওঠার আগেই রওনা করলাম। সবার আগে পাশাপাশি এগোচ্ছি আমি আর স্যাম গার্ট। মাঝখানে বাচ্চা আর মহিলারা-ঘোড়ায় চড়েছে সবাই-শেষে মিলো ডজ এবং টিম অটম্যান।

মরুভূমিতে তাপতরঙ্গ নাচছে, বালিঝড় ছুটছে বালির সমুদ্র বরাবর, শয়তানের উন্মত্ততার সঙ্গে যার তুলনা করা যায়। একটা চ্যাপারাল মুরগীকে হঠাৎ দেখতে পেলাম, আমাদের পাশাপাশি এগোল কিছুক্ষণ। চারপাশে ছোটখাট পানির ডোবা চোখে পড়ছে-বৃষ্টির সময় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে, তলা ফেটে চৌচির। প্রায় সব ক্যান্টিনই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, আর ষাঁড়ের শুকনো মাংস ছাড়া কোন খাবার নেই আমাদের সঙ্গে।

মাটি শক্ত, পাথুরে, মাঝে মধ্যে লাইমস্টোনের আস্তর চোখে পড়ছে। নিচু পাহাড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পশ্চিমে গুয়াডালুপে পর্বতশ্রেণীর নীলাভ সবুজ শরীর আহবান করছে আমাদের। সন্ধের আগে ছোট একটা উপত্যকায় ক্যাম্প করলাম আমরা। বেশ ঘাস আছে এখানে। কিছু গাছ ছাড়াও তিনটা ঝর্না আছে, যার একটার পানিতে গন্ধকের তীব্র ঘ্রাণ; আরেকটার পানি প্রায় সোডার মত, কিন্তু তৃতীয়টায় স্বচ্ছ টলটলে বিশুদ্ধ পানি।

মিসেস অটম্যানকে স্যাডল ছেড়ে নামতে সাহায্য করল টিম, মুহূর্ত খানেক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকল ওরা, প্রবল নির্ভরতায় টিমের বাহু চেপে ধরেছে মহিলা। রোদ আর বাতাসের অত্যাচারে কিছুটা রোদপোড়া বা লালচে রঙের আড়ালে ফ্যাকাসে এবং পাণ্ডুর দেখাচ্ছে মুখটা। একটা গাছের নিচে গেল ওরা, ক্লান্ত দেহে বসে পড়ল মিসেস অটম্যান।

বাচ্চারা ছড়িয়ে পড়েছে-কাঠ আর গরুর চিপস খুঁজছে আগুন জ্বালানোর জন্যে। গাছের ছায়ায় সবগুলো ঘোড়াকে নিয়ে গেল স্যাম গার্ট।

স্যামের সঙ্গে কথা বলছি, এসময় আমাদের সঙ্গে যোগ দিল টিম অটম্যান। আমার মিসেস খুব ভাল অবস্থায় আছে তা বলা যাবে না। কিছু খাবার আর পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পেলে ওকে হয়তো চিরতরে হারাতে হবে।

ঠিকই বলেছ, টিম, বললাম আমি। মনে হচ্ছে এখান থেকে যাত্রা করার আগে কিছু মাংস যেভাবেই হোক যোগাড় করতে হবে।

এটা অ্যাপাচী এলাকা, জানাল মিলো ডজ। সুতরাং চোখ-কান খোলা রেখো।

শেষপর্যন্ত ঠিক হলো আমি একাই যাব, অন্য তিনজন আশপাশে থাকবে-সতর্ক নজর রাখবে। টিম অটম্যানের বড় ছেলেকে একটা রাইফেল দেয়া হয়েছে, উঠতি বয়সের তরুণ সে, গায়ে-গতরেও বেশ তাগড়া হয়ে উঠেছে। ঘোড়া আর মেয়েদের চারপাশে অবস্থান নিয়ে পাহারায় থাকল ওরা।

দুটো পিস্তলই সঙ্গে নিয়েছি, প্যাটার্সটা পুরো লোডেড। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। দু’বার র‍্যাটলার চোখে পড়ল, ওগুলোকে এড়িয়ে গেলাম।

বিকেল একেবারে শান্ত, স্থির হয়ে আছে যেন। মরুভূমির নিচু এলাকায় ছায়া ঘনাচ্ছে, দূরের পর্বতমালায় কোমল ফিকে লাল রঙের সঙ্গে বিকেলের বেগুনী রঙের ছোপ লেগেছে। আশপাশে কোথাও ডেকে উঠল একটা কোয়েল…মিনিট খানেক পর, উত্তর দিল আরও একটা। এগুলো নীল কোয়েল, বলতে গেলে উড়েই না। কিন্তু ছুটতে পারে দারুণ গতিতে। আকারে বড়জোর পায়রার চেয়ে বড় হবে।

দু’বার থামলাম। হতে র-হাইডের তৈরি স্ট্রিং। বাছুরের পা বাঁধার জন্যে এগুলো ব্যবহার করে কাউবয়রা। খরগোশের ট্র্যাক চোখে পড়ার পর কয়েকটা ফাঁদ তৈরি করলাম।

কিন্তু ফাঁদে কিছু আটকায়নি। সন্ধের দিকে একটা কোয়েল শিকার করলাম। ফিরতি পথে ক্যাম্পের দিকে এগোলাম, শুধু কোয়েলটাই একমাত্র শিকার। ভোরে ফাদগুলো পরখ করতে গিয়ে দেখলাম বিশাল একটা জ্যাকাস খরগোস ধরা পড়েছে। ওটার মাংস পুরোটাই বাচ্চা আর মহিলাদের জন্যে বরাদ্দ করা হলো।

সকালে আবার যাত্রা করলাম আমরা। গুয়াডালুপের চূড়াগুলোকে যে-কোন সময়ের চেয়ে উঁচু মনে হচ্ছে এখন, উত্তরের প্রেয়ারিকে দেখাচ্ছে অবারিত গাঢ় রঙের এক বিস্তৃত প্রান্তর। সেদিন দুবার পড়ে গেল টিম অটম্যান। আমাদের মধ্যে ওই বয়স্ক। প্রতিবারই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে, তারপর হাঁটতে শুরু করল আবার।

মাত্র কয়েক মাইল পর সেদিন ক্যাম্প করলাম আমরা। ওক আর পাইনের আড়ালে এক চিলতে জায়গা, পেছনে পাহাড়ের চূড়া যেন হামলে পড়েছে আমাদের ওপর।

ঝপ করে মাটিতে বসে পড়ল টিম অটম্যান, ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে। মিলল আর স্যাম মেয়েদের নামতে সাহায্য করল, তারপর ঘোড়ার স্যাডল-ব্রিডল খুলে যত্ন নিল। ক্যাম্প করার আগেই প্যাটার্সন হাতে শিকার করতে বেরিয়ে পড়লাম আমি।

ভেতরে ভেতরে সত্যিই শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। পুরো একটা দিন খাবার ছাড়া কেটেছে পুরুষদের, গত চার-পাঁচদিন যাও বা মুখে দিয়েছি প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই কম ছিল। টিম আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক, প্রায় সারাটা জীবনই স্যাডলে কেটেছে ওর। অথচ কুপার মাইন এখনও বহুদূরের পথ।

জেদ, মনোবল বা স্বপ্নও এখন আর ওদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। যদি খাবার যোগাড় না করতে পারি, হয়তো বেশিদূর এগোতে পারব না আমরা। 

কয়েকবার হরিণের লাদি চোখে পড়ল, কিন্তু সবই অনেকদিন আগের। হরিণ দূরে থাক, ট্রাকও চোখে পড়েনি। জাপাচী এলাকা বলেই, নিশ্চিত না হয়ে গুলি ছোড়ার ইচ্ছে নেই আমার।

শান্ত বিকেল। ঘাম জমেছে কপালে, শার্টের ভেতর বুকে গড়িয়ে পেটের দিকে নেমে যাচ্ছে, ঘামের ধারা। আকাশ সুনীল, মেঘ নেই কোথাও। অদ্ভুত কোন কারণে টানটান হয়ে আছে স্নায়ুগুলো। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না, দেখতে যাচ্ছি না। তাই সতর্কতার সঙ্গে এগোলাম।

দূরে আকাশের গায়ে অলস ভাবে চক্কর মারছে একটা বাজার্ড। ক্ষীণ ট্রেইল ধরে প্রায় হাজার খানেক ফুট উঁচু উপত্যকায় উঠে এলাম, নিচের ক্যাম্প আড়ালে পড়ে গেছে। শার্টের আস্তিনে হাতের তালু মুছে এগোলাম। হঠাৎ পঞ্চাশ গজ দূরে ক্লিফের কিনারে একটা বিগহর্ন ভেড়া চোখে পড়ল।

ভেড়াটা বেশ বড়সড়, ক্লিফের নিচে মনোযোগ ওটার। সামনের দিকে ঝুঁকে আছে লম্বা শিং, হরিণের মতই গায়ের রঙ ওটার, পশমগুলোও তাই। এটাই আমার দেখা প্রথম বিগহর্ন।

প্যাটার্সন তুলে সতকর্তার সঙ্গে নিশানা করলাম, ঠিক ওটার ঘাড়ের পেছনে-একটু নিচে। মেরুদণ্ডে গুলি বেঁধানোর ইচ্ছে, যাতে ঠিক যেখানে আছে সেখানেই ধরাশায়ী হয়। হৃৎপিণ্ডে গুলি করলেও ভেঁড়াটা ছুটে যেতে পারে কয়েকশো গজ, হয়তো পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে যাবে। হরিণের ক্ষেত্রে সচরাচর এটাই ঘটে, হৃৎপিণ্ডে গুলি লাগার পরও আধ-মাইল ছুটে যেতে সক্ষম ওরা। বিগহর্নটা হয়তো আরও বেশিদূর চলে যাবে। সামনে জমি হলে সমস্যা ছিল না, কিন্তু এটা পাহাড়ী এলাকা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বোল্ডারের কোন্ ফাঁকে গিয়ে লুকাবে, শেষে হয়তো খুঁজেই পাব না।

নিশানা স্থির করেছি, কিন্তু বিগহর্নের ধীর-স্থির শান্ত মূর্তি আর মনোযোগ বেখাপ্পা লাগছে। রাইফেল নামিয়ে সন্তর্পণে কয়েক পা এগোলাম, ক্লিফের ধারে পৌঁছে নিচের জমির দিকে তাকালাম।

প্রথমে একটা গরু চোখে পড়ল…সাদা-মুখো লংহর্ন। ওটার পেছনে আরও দুটো বেরিয়ে এল। আমাদের গরু এগুলো। তারপর ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক লোক।

জিম মুর!

দাঁড়িয়ে থেকে, গরুর পেছন পেছন মুরকে ড্র থেকে পাহাড়ের কিনারে বেরিয়ে আসতে দেখতে পেলাম। অন্তত ত্রিশটা বলদ রয়েছে ওখানে, তাছাড়া কয়েকটা গাভী, কিছু বাছুর বা বয়স্ক ষাড়ও আছে। পেছনে দুজন মানুষ এবং একমাত্র ঘোড়ার স্যাডলে একজন মহিলা।

চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বিগহর্নটার দিকে তাকালাম। খানিক পিছিয়ে গেছে ওটা, পাশ ফিরেছে, উপত্যকা থেকে নেমে যাবে। দ্রুত রাইফেল তুলে নিশানা করেই ট্রিগার টেনে দিলাম।

শূন্যে উঠে গেল ভেড়াটা। পা ছড়িয়ে আছড়ে পড়ল মাটির ওপর। ঝট করে উঠে দাঁড়াল ওটা, খিচে দৌড় দেবে মনে করে আবারও নিশানা করলাম। কিন্তু হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল মোষটা, গড়ান খেল শরীর, তারপর একেবারে স্থির হয়ে গেল।

নিচের বেসিনে তাকিয়ে কাউকে চোখে পড়ল না। গরুগুলো দাঁড়িয়ে আছে, ক্লিফের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে, নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। স্মিত হেসে রাইফেল নামালাম আমি, তারপর নিচু স্বরে ডাকলাম। জানি বিকেলের নিস্তরঙ্গ বাতাসে কারও কণ্ঠ অনেকদূর থেকে শোনা যাবে।

ভয় পেয়েছ নাকি তোমরা? আরে, বেরিয়ে এসো, গরম পাথরে পা রাখার দরকার নেই!

ড্যান? ড্যান ট্রেভেন? কার্ল ক্রকেটের কণ্ঠ।

যদি তা না হয়, পাল্টা চিৎকার করলাম আমি। শুধু শুধু এত বছর আমাকে খাইয়ে বড় করেননি বাবা!

খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল ওরা। ঘোড়ার স্যাডলে বসে আছে রোজিটা জেপসন, পুরুষরা কার্ল ক্ৰকেট, জিম মুর এবং জুয়ারেজ। তারপর ঝোঁপের আড়াল থেকে আরও একজন বেরিয়ে এল-টুম জেপসন!

আনন্দে চিৎকার করলাম আমি, ছুটে নামতে গিয়ে ভেড়াটার কথা মনে পড়ল।

জিম! জলদি এখানে চলে এসো! একটা বিগহর্ন শিকার করেছি!

ঢাল বেয়ে উঠে এল সে। তুমি আসলে আমার চেয়েও বড় কসাই, ড্যান। ঝটপট খালাস করে ফেলো এটাকে, ওস্তাদ। এই ফাঁকে অন্যদের সঙ্গে কথা বলে আসি। ফিরে এসে সাহায্য করব তোমাকে।

রোজিটা জেপসন, যে-ঘোড়ায় চড়েছে, চিনতে পারলাম। ইন্ডিয়ান পনি। এটার মালিকের ওপর চড়াও হয়েছিল কার্ল ক্ৰকেট। কার্লের কাছ থেকে পরে জেনেছি ছুটতে ছুটতে অনেকদূর, চলে গিয়েছিল সে, ইন্ডিয়ানকে কায়দা করে ফিরে আসার সময় তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়, এবং ততক্ষণে লড়াই শেষ হয়ে গিয়েছিল।

এলাকায় কোমাঞ্চি আর কোমাঞ্চেররাদের আধিপত্য, তাই নদীর কিনারে একটা খাদে আশ্রয় নেয় সে, ঘোড়া সহ লুকিয়ে পড়ে। পুরো রাত ভিজে কাটিয়েছে, সকালে দেখতে পায় কিছু গরু দক্ষিণে চলে যাচ্ছে। ওগুলোকে জড়ো করতে গিয়ে জেপসনদের দেখা পেয়ে যায়।

জুয়ারেজ ছিল ওদের সঙ্গে। অবস্থা বেশ খারাপ ছিল তার। ইন্ডিয়ানরা বন্দী করেছিল ওকে, কিন্তু দুই কোমাঞ্চিকে খুন করে পালিয়ে আসে জুয়ারেজ। তবে আবার জখম হয়েছে। ক্ষতগুলো গুরুতর না হলেও গত কয়েকদিনে মোটামুটি সেরে উঠেছে।

একসঙ্গে গরু জড়ো করেছে ওরা, তারপর দক্ষিণ-পুবে ড্রাইভ করেছে, মিগুয়েলের পরিচিত এক লাইমস্টোনের বেসিনে যাওয়ার উদ্দেশে। ওখানে পানি ছিল। কিছু লিপানের সঙ্গে দেখা হয়েছে ওদের, একটা বলদের বিনিময়ে লিপানদের কাছ থেকে কর্ন আর বীজ কিনেছে।

প্রায় বিশ মাইল পশ্চিমে আসার পর জিম মুরের দেখা পায় ওরা। খোড়া ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে..নদীর কিনারে আশ্রয় নিয়েছিল, সওয়ারহীন একটা ঘোড়া ধরে বৃষ্টির পর পশ্চিমে রওনা দেয়। ওর ধারণা ছিল ক্যাম্পের সবাই মারা পড়েছে।

নয়দিন পর এল পাসোয় পৌঁছলাম আমরা। ছোট্ট শহর। একতলা একটা অ্যাডোবি দালান, নদীর মেক্সিকান অংশে অবস্থান ওটার। উত্তর অংশে বেশ কিছু বসতি রয়েছে, সবচেয়ে বড়টা কুন র‍্যাঞ্চো এবং ম্যাগোফিন্সভিল, দুটোর মধ্যে দেড় মাইল তফাত। তৃতীয় আরেকটা বসতি রয়েছে, ম্যাগাফিন্সভিল থেকে এক মাইল দূরের এক র‍্যাঞ্চ।

শহরের কাছাকাছি করালে সব গরু জড়ো করেছি আমরা-ডোরাকাটা বলদটাই নেতৃত্ব দিয়েছে। কাছাকাছি চলনসই একটা আশ্রয়ও খুঁজে নিয়েছি আমরা।

ড্যান, এবার কি করব আমরা? জানতে চাইল কার্ল।

যা করার কথা ছিল, উত্তরে বললাম। অন্তত আমি তাই করব। এগিয়ে যাব। একটা আউটফিট দাঁড় করাব। যে-কটা গরু আছে তা নিয়েই র‍্যাঞ্চ শুরু করব।

তারপর?

তারপর? শিকারে-বেরোব। মুখে মাকড়সার মত একটা ক্ষত আছে এক লোকের, ওর নাম ফেলিপ জাপাটা, ওই লোকের খোঁজে বেরোব।

মনে মনে পরিস্থিত বিচার করলাম। সঙ্গে যারা আছে, বাবা বা আমার অধীনে কাজ করার জন্যে এসেছে সবাই। আমাদের ওপর বিশ্বাস আর আস্থা রেখেছে ওরা। ওদের কাউকে নিরাশ করা যাবে না, যেভাবেই হোক সফল হতে হবে। অথচ আমাদের সবার কাছে যে টাকা আছে সব মিলিয়ে হয়তো বড়জোর পঞ্চাশ ডলার হবে, গুটিকয়েক গরু ছাড়া সবই হারিয়েছি। এগোতে হলে ঘোড়া, গিয়ার আর বিভিন্ন ধরনের সাপ্লাই প্রয়োজন।

সামনে মাইলকে মাইল অ্যাপাচী এলাকা, এবং যেখানে আমরা বসতি করব, সম্ভবত সেই জায়গাটাও অ্যাপাচী এলাকায় পড়েছে। জাপাটা বা ওর লোকজনের ওপর শীতল অসন্তোষ আর বিষ্ণা ক্রমে রাগ এবং ঘৃণায় রূপ পাচ্ছে। জিনিসটাকে সত্যি ভয় পাই আমি।

আমার ভেতরে অদ্ভুত একটা প্রবণতা রয়েছে। এমনিতে আমি মিতভাষী, গম্ভীর চেহারার আত্মকেন্দ্রিক মানুষ, সকাল-সন্ধ্যা গাধার মত খাটতে পারি এবং মানুষের সঙ্গ উপভোগ করি, অথচ এসবের আড়ালে অদ্ভুত আর ভয়ঙ্কর একটা স্পৃহা আছে যেটাকে সত্যিই ভয় পাই আমি। অদম্য এই স্পৃহাকে প্রায়ই দমন করতে হয়, কারণ বিপজ্জনক বা ভয়ঙ্কর লোক হিসেবে নাম কেনার ইচ্ছে নেই আমার-এটা অতি উৎসাহী সব তরুণের জানা উচিত, পরিপকৃত আসেনি এমন বয়স্ক লোকদেরও জানা থাকা উচিত। কিন্তু তারপরও, এটা ঠিকই বাস করে আমার মধ্যে, খুব কম লোকেরই ভয়ঙ্কর এই রাগ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

বাবা জানতেন-স্যান এন্টোনিয়োতে আমার সঙ্গে ছিলেন তিনি; কার্লও জানে, কারণ লারেডোর ঘটনা সেও দেখেছে।

এবং এখন, ক্রমে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে ওটা, রাগ বাড়ছে আমার। উন্মত্ত আক্রোশ অনুভব করছি। বাবা মারা গেছেন, স্বাভাবিক মৃত্যু তা বলা যাবে না। বাবা ছাড়াও কয়েকজন ভালমানুষ খুন হয়েছে। ব্র্যান্ডের জন্যে রাইড করত এরা, বিশ্বস্ততা আর আন্তরিকতার কারণে অকালে ঝরে গেছে কয়েকটা প্রাণ।

মনের গভীরে প্রচণ্ড আক্রোশের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি, ক্রমে বাড়ছে সেটা। এই অনুভূতি অচেনা নয়। বাড়তে বাড়তে এমন একটা মুহূর্ত আসবে যখন ঠাণ্ডা মাথায় কিছুই ভাবতে পারব না আমি-যা করা উচিত, শুধু এ ব্যাপারটাই থাকবে মাথায়। সামান্য ভয়ও থাকবে না তখন, শত্রুকে খুঁজে বের করার নিরন্তর তাগাদা ছাড়া অন্য কিছু থাকে না মনে, কোন কারণ, ঘটনা বা পরিবেশই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না।

অনুভূতিগুলো তীক্ষ্ণ হয়ে আসে, হৃৎস্পন্দন হয়ে পড়ে শ্লথ, ধীর গতিতে শ্বাস নিই, সতর্ক পায়ে এগোনোর সময় চারপাশে সতর্ক চালাই। এমন সময়ে চরম নিষ্ঠুর হয়ে পড়ি আমি, অদম্য এবং দুর্জয় হয়ে উঠি।

এই অবস্থা কখনোই পছন্দ নয় আমার।

শুধু এ কারণেই পিস্তল ঝোলাই না আমি। বেশ কয়েকবারই, স্রেফ পিস্তল ছিল না বলেই বুনো রাগ আর আক্রোশকে চেপে রাখতে পেরেছি-যা করার ইচ্ছে হয়েছিল, পিস্তল না থাকায় করতে পারিনি। দু’বার সীমাহীন এই আক্রোশ চালনা করেছে আমাকে, প্রতিবারই সারা সত্তায় প্রবল আলোড়ন অনুভব করেছি, শপথ করেছি এই ঘটনা যেন আর না ঘটে।

ফেলিপ জাপাটার প্রতি যত বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসাই থাকুক, আপাতত বর্তমান কয়েকটা সমস্যার সমাধান করতে হবে। ঘোড়া, একটা ওয়্যাগন, এবং অপরিহার্য সাপ্লাই দরকার, ট্রিপটা চালিয়ে যেতে হবে। করুণ হাল আমাদের ছোট্ট পালের। কিন্তু ওটাকেও বড়সড় করে তোলা সম্ভব। দুটো কমবয়েসী বঁড় আর বিশটার মত গাভী রয়েছে, বেশিরভাগই অল্পবয়সী। অন্যগুলো বলদ, নগদ লাভের একমাত্র উপায়-এমনকি এ মুহূর্তে এদের মূল্য কম হলেও।

ম্যাগোফিন্সভিলের কিছু কিছু লোক শহরটাকে ফ্রাঙ্কলিন বলে। অন্যরা নাম দিয়েছে এল পাসো ডেল নার্ট, অর্থাৎ এল পাসোর উত্তর অংশ, যেটা আমেরিকার সীমানায় পড়েছে। তবে বেশিরভাগ লোকই আলাদা আলাদা নামে তিন শহরকে আখ্যায়িত করছে।

জেমস উইলি ম্যাগোফিনের সেলুনের সামনের হিচিং রেইলে ঘোড়া বেঁধে ভেতরে ঢুকলাম। স্যাম গার্ট আর কার্ল ক্ৰকেট রয়েছে আমার সঙ্গে।

ম্যাগোফিন কেন্টাকির লোক, প্রায় তেরো-চোদ্দ বছর আগে এখানে এসেছিল, বাড়ি তৈরি করার পর স্টোর আর ওয়্যারহাউস খাড়া করে ব্যবসা শুরু করে।

দীর্ঘ কামরা পেরিয়ে যাওয়ার সময় নিজের বাহ্যিক উপস্থিতি সম্পর্কে ভাবলাম-সমীহ করার মত বিশেষ কিছু নেই আমার মধ্যে। কোমাঞ্চেরোদের হামলার সময় রেজর হারিয়েছি, তাই কয়েকদিন ক্ষৌরি করা হয়নি। কালো জীর্ণ হ্যাট চাপানো মাথায়, ক্রাউনের কাছাকাছি একটা বুলেটের ফুটো রয়েছে। রঙ ঝলসে যাওয়া মলিন বাকস্কিন শার্ট পরনে। ঝালর দেয়া শটগান চ্যাপস রয়েছে গায়ে। স্পানিশ বুটের চেহারা ভোতা হয়ে এসেছে। গোড়ালি ক্ষয়ে গেছে ওগুলোর। গার্ট আর ক্রকেটকে আমার চেয়ে ধোপদুরস্ত এবং সমীহকরার মত দেখাচ্ছে।

মি, ম্যাগোফিন, বললাম আমি। কোমাঞ্চেরোরা আমার গরুর পাল নিয়ে গেছে। আমরা টি-বার আউটফিট, কাউ-হাউস থেকে পশ্চিমে এসেছি। এখান থেকে উত্তর-পশ্চিমের রেঞ্জ বসতি করব। এ মুহূর্তে করুণ দশা সবার। মেয়ে আর বাচ্চারা ঘোড়ায় চেপে এসেছে, পুরুষরা পায়ে হেঁটে এসেছি আমরা।

 চিন্তিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সে। কি চাও তুমি?

দশ-বারোটা ঘোড়া, একটা ওয়্যাগন এবং সতেরোজন লোকের দুই সপ্তাহের রসদ।

স্থির দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে সে, ক্ষণিকের জন্যে কার্ল আর স্যামের ওপর ঘুরে গেল তার দৃষ্টি। মহিলাদের কথা বললে না?

হ্যাঁ। আমার দু’জন লোকের স্ত্রী, একজনের বিধবা বউ। পাঁচটা বাচ্চা আর একটা মেয়ে। নিউ মেক্সিকো থেকে এসেছে ও।

ওর নামটা জানতে পারি?

জুয়ানিতা ম্যাকনেয়ার।

আমার কাঁধের ওপর দিয়ে দরজার দিকে তাকাল সে। আচমকা টের পেলাম ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে গেছে আমার সবক’টা চুল। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালাম, দরজায় ফেলিপ জাপাটাকে দেখতে পেলাম। লোকটার পেছনে আরও তিনজন কোমাঞ্চেরো রয়েছে।

অজান্তে মুঠি হয়ে গেল হাত, জাপাটা কাছে আসা মাত্র ঘুসি হাঁকালাম।

এমন কিছু আশা করেনি সে। হয়তো ভেবেছে তর্কাতর্কি হবে প্রথমে, তারপর ডুয়েল বা গোলাগুলি হবে। টেক্সাস বা নিউ মেক্সিকোর লোকেরা হাতাহাতি তেমন পছন্দ করে না। তখনকার দিনে দু’জন মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের নিস্পত্তি করার জন্যে পিস্তলকে ধরা হত সবচেয়ে ভদ্রোচিত উপায়, হাতাহাতি বা মুষ্টিযুদ্ধ ছিল বর্বরোচিত, অভদ্রলোক-সুলভ।

চিবুকে লাগল মোক্ষম ঘুসিটা। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা আমি, কয়েক আঙুল খাটো হব জাপাটার চেয়ে। জীবনের অর্ধেক সময় কেটেছে কুঠার চালিয়ে, ঘোড়া বলদ বা বুনো ঘোড়ার সঙ্গে কুস্তি লড়ে। কঠোর পরিশ্রমে সামর্থ্য বাড়িয়ে নিয়েছি। জাপাটা বিন্দুমাত্র টলল না, স্রেফ হুড়মুড় করে পড়ে গেল মেঝেয়।

অন্য কেউ কিছু করার আগেই, পিস্তলে তিন কোমাঞ্চেররাকে কাভার করল কার্ল, পিছিয়ে যেতে বাধ্য করল ওদের।

ঝুঁকে জাপাটার শার্ট খামচে ধরে টেনে তুললাম তাকে, পায়ের ওপর দাঁড় করালাম। তারপর জোরাল ঘুসি হাঁকালাম বিশালদেহী মেক্সিকানের পেটে। ঘুসির ধাক্কায় টলে উঠল সে, পা হড়কে পিছিয়ে গেল, কাউন্টারের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে পতন রোধ করল। পাল্টা ঘুসি চালাল সে এবার, কিন্তু মাথা নিচু করে ঘুসিটা এড়িয়ে গেলাম; উল্টো প্রচণ্ড ঘুসি বসিয়ে দিলাম ওর সোলার প্লেক্সাস বরাবর। সামলে নেয়ার সুযোগ দিলাম না ওকে, প্রচণ্ড হুক ঝাড়লাম লোকটার চিবুকে।

উন্মত্ত আক্রোশ নিয়ে, মরিয়া হয়ে লড়াই করল সে, বুঝে গেছে মরণপণ না লড়লে কপালে খারাবি আছে আজ, এবং একা লড়তে হবে-সঙ্গীরা সাহায্য করতে পারবে না। দারুণ শক্তিশালী মানুষ, বিশাল দেহ ওর জন্যে বাড়তি একটা অস্ত্র। মুগুরের মত হাতে জোরও আছে বেশ। কিন্তু দিনটা আমার। শীতল উন্মাদনায় রূপ পেয়েছে আমার সমস্ত রাগ আর প্রতিহিংসা। জাপাটার একটা আঘাতও গ্রাহ্য করছি না। আমাকে ফেলে দিল ও…দু’বার বোধহয়।

উঠে দাঁড়িয়ে, পা ছড়িয়ে দাঁড়ালাম, তারপর ঘুরতে শুরু করলাম। ঘুসি মেরেই সরে এলাম ওর নাগাল থেকে। এমন বেশ কয়েকবার ঘটল। মারের চোটে পিছিয়ে গেল সে ঘুসি মেরে দরজা দিয়ে বাইরের রাস্তায় ফেলে দিলাম ওকে, পিছু নিয়ে আমিও বেরিয়ে এলাম। নাক-মুখ থেঁতলে দিলাম দুই ঘুসিতে, দুই মুঠি একসঙ্গে চালালাম ওর চিবুকে।

পাল্টা আঘাত করছে সে, কিন্তু কিছুই অনুভব করছি না আমি। ওকে মেরে থেঁতলে বানানো ছাড়া অন্য কোন চিন্তা নেই মাথায়। এক ঘুসিতে থ্যাবড়া হয়ে গেল জাপাটার নাক, আরেক ঘুসিতে ঠোঁট ফেটে গেল। ভুরু কেটে গেছে ওর, রক্ত পড়ছে গলগল করে, কিন্তু, থামলাম না আমি। পথিবীতে কাউকে যদি ঘৃণা করে থাকি, তাহলে এই লোকটিকে। এত সহজে ওকে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছে নেই আমার। হিচিং রেইলের সঙ্গে ঠেসে ধরে একের পর এক ঘুসি হাঁকালাম ওর মুখে।

বুনো আক্রোশে উন্মত্ত হয়ে উঠেছি আমি। কে থামাবে আমাকে? স্যাম গার্টের হাতেও একটা সিক্সশূটার বেরিয়ে এসেছে, তিন কোমাঞ্চেররাকে নাচার বানিয়ে রেখেছে।

নিচু হয়ে মার এড়ানোর চেষ্টা করছে জাপাটা, প্রতিরোধ করার বা পাল্টা মার দেয়ার স্পৃহা হারিয়েছে। সুযোগটা তাকে দিতে নারাজ আমি। টেনে মুখ তুললাম ওর, একের পর এক ঘুসি বসিয়ে দিলাম মুখে। কিছুক্ষণের মধ্যে থকথকে মাংসের দলা হয়ে উঠল ওর, মুখ। ভূগোল পাল্টে গেছে। ধড়াস করে আছড়ে পড়ল সে, মাটি খামচে ধরল যেন তাতে উঠে দাঁড়াতে পারবে।

বেদম মার খেয়েছে সে, বিধ্বস্ত দেহটা পড়ে থাকল মাটিতে। সামান্যও নড়ছে না।

এগোতে গিয়ে পাশে জেমস ম্যাগোফিনকে দেখতে পেলাম। আমার কাধ চেপে ধরে থামাল সে। যথেষ্ট হয়েছে, ট্রেভেন! ওকে খুন করবে নাকি?

হাতের পাঞ্জা ফুলে গেছে আমার, রক্তাক্ত। টলমল পায়ে পিছিয়ে এলাম, কাঁধ ঝাঁকিয়ে ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে বুনো আক্রোশ নিয়ে ফেলিপ জাপাটার ভূপতিত দেহের দিকে তাকালাম, একটুও নড়ছে না। ঝট করে তিন কোমাঞ্চেরোর দিকে ফিরলাম, চোখে শঙ্কা ফুটে উঠল ওদের। ওকে বোলো ফের যদি কখনও দেখি–যেখানেই হোক, খুন করে ফেলব ওকে!

নড়ে উঠল লোকগুলো, জাপাটার পাশে এসে দাঁড়াল একজন।

আরেকটা কথা, যোগ করলাম। ওকে ওটাও বোলো পালের সব গরু ফেরত চাই আমি পুরো তিন হাজার গরু, বেশিরভাগই ব্রীডিং স্টক। আজ থেকে ত্রিশ দিনের মধ্যে রেডোন্ডোয় আমাকে সব গরু ফেরত দিতে হবে! আর হ্যাঁ, ষাটটা ঘোড়াও ছিল পালের সঙ্গে, ওগুলোও ফেরত চাই আমি। এক মাস পর, সব ফেরত না পেলে যেখানেই থাকুক, খুঁজে বের করে ওকে পিটিয়ে মারব আমি!

ঘুরে দাঁড়িয়ে সেলুনের দিকে এগোলাম। দারুণ দুর্বল বোধ করছি। দরজার পোস্টের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম সেকেন্ড কয়েক, তারপর স্টোরে ঢুকে পড়লাম। ফেলিপ জাপাটার দিকে একবার তাকিয়ে আমাকে অনুসরণ করল জেমস ম্যাগোফিন। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল স্যাম আর কার্ল, তিন কোমাঞ্চেররাকে জাপাটার দেহ টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখল।

ওই লোক ফেলিপ জাপাটা? কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইল স্টোর মালিক। ওর কথা অনেক শুনেছি।

মাথা ঝাঁকালাম। এখনও শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়নি আমার। বুক ধড়ফড় করছে। হয়তো ওকে খুন করা উচিত ছিল!

কিন্তু তারচেয়েও বেশি করেছ। শেষ করে দিয়েছ জাপাটাকে, সামান্য দ্বিধা করল সে। এবার বলো তো, কি কি যেন লাগবে তোমার?

তোমার মনে রাখা উচিত, নগদ টাকা…মাত্র পঞ্চাশ ডলার আছে আমার কাছে। কবে টাকা শোধ করতে পারব, তার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।

রেখে দাও-তোমার সঙ্গে ব্যবসা করে ঠকব না আমি। টাকা ছাড়াও অন্য কিছু আছে তোমার-এমন জিনিস, বুনো এই দেশে শান্তি আনার জন্যে এটাই দরকার।

আমাকে দেখামাত্র ফ্যাকাসে হয়ে গেল জুয়ানিতার মুখ। হয়তো সেটাই স্বাভাবিক, লড়াইয়ের উত্তেজনায় খেয়ালই করিনি নিজের দিকে, কম মার খাইনি, যদিও কোনটাই গ্রাহ্য করিনি। এক চোখ ফুলে গিয়ে প্রায় বন্ধ হওয়ার যোগাড়, অন্য দিকের হনুর হাড়ের কাছে কেটে গেছে, ইঞ্চি দেড়েক তো হবেই! ঠোঁট আর একটা কানও ফুলে গেছে, দুই হাতের পাঞ্জা ফুলে-ফেঁপে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

ওহ, খোদা, তোমার মুখের কি অবস্থা হয়েছে! আঁতকে উঠল ও, মুহূর্তের মধ্যে দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এদিকে এসো। মুখটার যত্ন নেব আমি…হাতেরও!

গরম পানির সঙ্গে বেসিনে লবণ মেশাল ও, তারপর আমার দুই হাত চুবিয়ে দিল গরম পানিতে। যতটা সম্ভব যত্ন আর সতর্কতার সঙ্গে আমার মুখ পরিষ্কার করল জুয়ানিত।

ব্যাপারটা অদ্ভুত, সম্পূর্ণ অচেনা আমার জন্যে। প্রিয়দর্শিনী কোন মেয়ে কাছে বসে ক্ষতের যত্ন নিচ্ছে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে, মৃদু স্বরে অনুযোগ করছে, সহানুভূতি আর মমতার কোমল স্পর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে…অদ্ভুত ভাল লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল আমার সারা শরীরে। বহু আগে, একবার বুনো একটা ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম, ট্যাপের মা এভাবেই শুশ্রূষা করেছিলেন। কিন্তু দুটো ঘটনায় বিস্তর তফাৎ!

ট্যাপের কথা মনে পড়ল। কোথায় আছে সে? ইলেনের কি হলো?

ইলেন চলে যাওয়ার পর কখনও এ নিয়ে আলাপ করেনি টিম, ভুলেও তোলেনি দু’জনের প্রসঙ্গ। কে জানে স্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করেছে কিনা। যত যাই হোক, আমার ধারণা দুঃসাহসই করেছে ইলেন, ট্যাপ এডলের মত বাঁধনহীন মানুষের পেছনে ছুটে যাওয়ার পরিণাম মেয়েদের জন্যে করুণার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। শুধু ইলেনের কারণে ট্যাপ বদলে যাবে, এ সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ।

স্যাম আর কার্লের কাছ থেকে ম্যাগাফিন্সভিলের কথা শুনেছে সবাই। প্রায় প্রত্যেক সন্তুষ্ট, আশার আলো দেখছে এখন। তখনকার দিনে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার, কারও মুখের কথাই তার কাজের নিশ্চয়তা, প্রতিজ্ঞাপত্ৰ; কথার বরখেলাপ হলে কাগুঁজে স্বাক্ষর বা নিশ্চয়তার কোন মূল্য নেই-বিবেচনাও করে না কেউ। সামান্য মুখের কথায় হাজার হাজার গরু কেনা-বেচা হয়, টাকা লেনদেনের সময় সাধারণত গরুগুলো গোনাও হয় না। সেজন্যেই একটা লোকের মুখের কথাই আগে বিবেচ্য। লোকটা গরু চোর, জুয়াড়ী বা খুনী হতে পারে এবং তারপরও পশ্চিমে নিশ্চিন্তে বাস করতে পারবে; কিন্তু তার মুখের কথার যদি দাম না থাকে, তাহলে কাপুরুষ হিসেবে তাকে দেখবে সবাই, পশ্চিমে থাকতে পারবে না সে, ব্যবসাও করতে পারবে না কারও সঙ্গে।

কি মনে হয় তোমার, গরুর পাল ফিরিয়ে দেবে জাপাটা? চিন্তিত স্বরে জানতে চাইল টিম অটম্যান।

যদি না দেয়, তাহলে পাকড়াও করব ওকে। ওর জায়গা চিনিয়ে দিয়েছি ওকে, সুতরাং কোন ভাবেই প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করতে পারব না আমি।

ও যদি ক্যানিয়ানে লুকিয়ে পড়ে?

ওকে অনুসরণ করে ঢুকে পড়ব ক্যানিয়নে।

ম্যাগোফিন্সভিল থেকে কিছুটা দূরে ক্যাম্প করলাম আমরা। জায়গাটা সুন্দর, ঝর্নার লাগোয়া। সিডার আর অ্যাসপেনের ছায়া প্রশান্তি বিলাচ্ছে ক্যাম্পে। রিও গ্রান্ড খুব বেশি দূরে নয়। দারুণ সুন্দর এক উপত্যকা। উত্তর-পশ্চিমে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি, ঢালু জমিতে আঙুরের চাষ করা হয়েছে। এই প্রথম আঙুরের চাষ দেখতে পেলাম।

অনেক রাত পর্যন্ত আগুনের পাশে বসে থাকলাম আমরা, গল্প করলাম, পুরানো দিনের গান গাইলাম। বুকে আগামী দিনের উজ্জ্বল স্বপ্ন। আমার পাশে বসেছে জুয়ানিতা, ঘনিষ্ঠ হয়ে, জীবনে এমন ভাল লাগার অনুভূতি কখনও হয়নি। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা অনুভূতি, কারণ এই প্রথম কোন মেয়েকে চাইছি মনে মনে…আজীবনের জন্যে, ভালবাসার জন্যে। নিজের ভাবনা প্রকাশ করার মত যুৎসই শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না আমি। সত্যি করুণ অবস্থা!

শিগগিরই আবার ট্রেইলে উঠব আমরা-উত্তর-পশ্চিমের অনাবাদী জমির উদ্দেশে যাত্রা করব। সম্ভবত ওদিকেই আছে ট্যাপ এডলে, ওর সঙ্গে দেখা হবে আবার…বাবা মারা যাওয়ার পর, এখন কি সম্পর্ক দাঁড়াবে আমাদের মধ্যে?

বাবাকে সবসময়ই সমীহ করত ট্যাপ…অথচ আমার প্রতি ছিটেফোঁটাও নেই। আমাকে এখনও তরুণ মনে করে সে, কিন্তু যে পরিকল্পনাই থাকুক আমাদের, তাতে যোগ দিতে পারে সে, যদি নিজের দায়িত্বটুকু ঠিকমত পালন করে।

উঠে দাঁড়িয়ে সিডার সারির দিকে এগোলাম আমি, ঘোড়াগুলো রয়েছে ওখানে। ওগুলো ঠিকঠাক আছে, দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে চাই। আলোর বাইরে এসে কান পেতে রাতের নৈঃশব্দ্য উপভোগ করলাম। আকাশে হাজার তারার মেলায় চোখ রেখে আনমনা হয়ে পড়লাম।

জেমস ম্যাগোফিন সাপ্লাই দেবে আমাদের, কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেনা শোধ করতে হবে। পুরোটাই আমার দায়িত্ব। নগণ্য একটা গরুর পাল রয়েছে আমাদের, এ থেকে কারও জীবিকা নির্বাহ হওয়া রীতিমত অসম্ভব। যাই ঘটুক, পালের সব গরু কোমাঞ্চেরোদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে হবে, কিংবা যেভাবেই হোক অন্য কোন উপায়ে হাজার কয়েক গরু যোগাড় করতে হবে।

ফেলিপ জাপাটা যদি গরু ফেরত না দেয়, তাহলে ওদের ধাওয়া করতে হবে, এমনকি পেলো ডিউরো ক্যানিয়ন পর্যন্ত যেতে হতে পারে।

পাশে এসে দাঁড়াল জুয়ানিতা, টের পেলাম আমার একটা হাত চেপে ধরেছে। দুশ্চিন্তা করছ, ড্যান?

ওরা আমার সঙ্গে এসেছে, ক্যাম্পের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম। বাবা এবং আমাকে বিশ্বাস করেছে ওরা, আস্থা রেখেছে। কোন ভাবেই ওদেরকে নিরাশ করতে পারব না আমি।

করা উচিতও হবে না।

কাজটা সত্যিই কঠিন হবে।

জানি, ড্যান, খুব কঠিন হবে, থামল জুয়ানিতা, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার সামনে চলে এল, হাতটা ছাড়েনি। কিন্তু তুমি যদি সুযোগ দাও, আমি তোমাকে সাহায্য করব।

ওর গভীর কালো চোখে তাকালাম-প্রতিশ্রুতি আর দৃঢ় প্রত্যয় দেখতে পেলাম। হাত বাড়িয়ে ওর কোমর চেপে ধরতে আমার বুকে চলে এল ও। মৃণাল দুই বাহু দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই, ড্যান-আজীবন! নিচু, রুদ্ধ স্বরে প্রতিশ্রুতি দিল ও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *