১০৫. কাশী আসিবার পর

“কাশী আসিবার পর চার বৎসরের বেশি অতিক্রান্ত হইল। ইতিমধ্যে কত কী ঘটিয়া গেল। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে কত ঘটনার চমক। তবে তাহার ঢেউ আমাকে বড় একটা স্পর্শ করে না। রাজনীতিতে আমি কোনওদিনই জড়িত নহি। শুধু প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের জন্য যেটুকু খবর রাখা আবশ্যক তাহাই রাখি। একদিন কানে আসিল, কৃষ্ণকান্তকে দিল্লি লইয়া যাওয়া হইয়াছে। ভোলানাথ সরকার নামক পাবনার আশ্রমবাসী এক ভদ্রলোক আসিয়া একদিন খবর দিয়া গেলেন, পাবনায় অন্তরিন থাকিবার শর্তে কৃষ্ণকে মুক্তি দেওয়া হইবে। আমার নানা প্রশ্নের জবাবে তিনি যাহা জানাইলেন তাহা কিন্তু বিস্ময়কর। কৃষ্ণ ঢাকায় আত্মসমর্পণ করিলে তাহাকে গ্রেফতার করিয়া দিল্লিতে চালান দেওয়া হয়। তাহার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোেগ ছিল, যাহাতে ফাঁসি বা দ্বীপান্তর নিশ্চিত। পাঁচ বৎসরের মেয়াদ সেই তুলনায় কিছুই না। সেই মেয়াদ ফুরাইবার আগেই সে মুক্তি পাইল। আশ্রমবাসী কতিপয় ব্যক্তি গিয়া দিল্লিতে দরবার করায় সরকার খুবই আকস্মিক ও অদ্ভুত ভাবে তাহাদের আবেদন মানিয়া লন।

“ইহার কিছুদিন পর পাবনা আশ্রম হইতে কৃষ্ণর চিঠি আসিল। সে লিখিয়াছে, আপনি চিন্তা করিবেন না, আমি ভাল আছি। তারপর অন্যান্য সব কথা। আমার ও মনুর প্রসঙ্গ সে এড়াইয়া গিয়া শুধু লিখিয়াছে, নূতন মাকে প্রণাম দিবেন।

“চিঠি পড়িয়া মনু রাগিয়া বলিল, আমি আবার ওর নতুন মা হতে গেলাম কবে? আমিই তো আসল মা, শুধু ডাকের পিসি ছিলাম। এখন শুধু মা বলে ডাকবে, নয়তো পিসি, ওকে লিখে দাও।

“আমি হাসিয়া কহিলাম, তুমি ওর পিসি হলে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয় ভাইবোন। সেটা কি ভাল দেখাবে?

“কৃষ্ণ যে আর ঘরের ছেলে হইয়া ঘরে ফিরিবে না তাহা মনে মনে বুঝিতে পারিতেছিলাম। তাই তাহার বিরহের অনুভূতিও ধীরে ধীরে তীব্রতা হারাইতেছিল। উপরন্তু আমি এই অগ্র বয়সে আজ কিছু গৃহসুখ উপভোগ করিতেছি। লজ্জার মাথা খাইয়া বলি, নারীপ্রেমও। ফলে প্রিয়জনদিগের সহিত বিচ্ছেদ সত্ত্বেও তেমন একটা অভাব কিছু বোধ করি না। সম্ভবত ইহাই মানবের ধন, ইহাই সত্য।

“আজকাল আলস্যে সময় কাটাইব সাধ্য কী? মনু নতুন সংসার পাতিয়াছে, সুতরাং সেই সংসারের জোগানদার, বাজার সরকার, বরকন্দাজ সব ভূমিকাই আমাকে পালন করিতে হয়। আমি কর্মচারী নিয়োগের কথা তুলিয়াছিলাম, মনু আমল দেয় নাই। তার বক্তব্য, এতটুকু সংসারে একজন বাজার সরকার বা হিসাবরক্ষকের দরকার নাই। জমিদারের ঠাটবাট কিছু ছাড়িতে হইবে। বুড়াবয়সে যাতে বাতে না ধরে তাহার ব্যবস্থাও করিতে হইবে। একজন ঝি ও একজন চাকর সম্বল করিয়া আমাদের চলিতেছে।

“এইসব কাজ করিতে আমার খারাপও লাগে না। তাছাড়া কাশীতে বাজার করিয়া সুখ আছে। আমাদের দেশ বেগুনের জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে দেখিলাম তদপেক্ষা বৃহৎ ও সুস্বাদু বেগুন মিলে। অন্যান্য সবজির স্বাদও ভাল। মনুর রান্না তো চমৎকারই। রাবড়ি, প্যাড়া ইত্যাদিও এখানে সস্তা ও খাঁটি। গুরুভোজনে আমার কোনওকালেই আসক্তি নাই। কিন্তু সুস্বাদু খাদ্যের প্রতি আকর্ষণ আছে। সুতরাং নতুন সংসারে এবং নতুনরকম জীবনধারায় প্রবেশ করিয়া অতীতের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিতে যে ক্লেশ বোধ করিতে পারিতাম তাহার অনেকটাই মনু নানাভাবে নিবারণ করিয়াছে। তাহার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।

“কনক বা জীমূত এবং আমার জ্যেষ্ঠা দুই কন্যা বড় একটা খোঁজখবর করে না। ইহাতে দুঃখ অনুভব করি না। কারণ এইরূপই ঘটিবার কথা। তবে বিশাখা ও শচীন একদিন আকস্মিকভাবে আসিয়া কাশীতে হানা দিল। বিশাখার কোলে একটি ফুটফুটে শিশু। তাহাদের পাইয়া আনন্দে আত্মহারা হইলাম।

“শচীন জনান্তিকে আমাকে জানাইল, পাবনা হইতে কৃষ্ণকান্ত আবার উধাও হইয়াছে। আমাকে দুশ্চিন্তা করিতে নিষেধ করিয়া শচীন বলিল, সে সম্ভবত আপনার কাছে আসবে।

“আমি অবাক হইয়া কহিলাম, কী করে জানলে?

“সে হাসিয়া কহিল, পাবনায় আমি গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। আর কারও জন্য নয়, আপনার জন্য সে সবসময়েই বেশ উদ্বিগ্ন ও ব্যাকুল।

“বুকটা ভরিয়া গেল। স্নেহ স্বভাবত নিম্নগামী। পিতা যেমন পুত্রকে স্নেহ করেন, পুত্র ততটা স্নেহ পিতাকে করিতে পারে না। আমার ক্ষেত্রে স্নেহের প্রকৃতি আরও বিচিত্র। কৃষ্ণ ছাড়া অন্যান্য পুত্রকন্যার সহিত আমার তেমন সম্পর্ক রচিত হয় নাই। কৃষ্ণ আমাকে কিছু স্নেহ করে জানিতাম। আজ আবার নতুন করিয়া তাহার ব্যাকুলতার কথা শুনিয়া আমার ক্ষুধার্ত পিতৃত্ব জাগিয়া উঠিল।

“কহিলাম, আমার জন্য সে কি খুব ভাবে?

“শচীন কহিল, খুব ভাবে। আপনার অসুস্থতার সংবাদ সে শুনেছে। তাই খুব দুশ্চিন্তা।

“যে কয়দিন বিশাখা ও শচীন আমাদের কাছে ছিল সেই কয়টা দিন বড় আনন্দে কাটিয়া গেল। ভাবিতে লজ্জা করে আমরা উভয়পক্ষই নববিবাহিত দম্পতি। আমি ও মনু বয়সে কিছু প্রবীণ, উহারা নবীন। প্রায় একই সময়ে আমাদের বিবাহ হয়। আমার ও মনুর মধ্যে প্রগৰ্ভতা নাই, উচ্ছ্বাস নাই, এক শান্ত তৃপ্তি আছে। উহাদের মধ্যে উচ্ছলতা, প্রগলভতা কিছু বেশি। আমি মনে মনে উভয় দম্পতির তুলনা না করিয়া পারিলাম না। শুধু একটা ব্যাপারে বিশাখা ও শচীনের তুলনায় আমরা পিছাইয়া আছি। আমার ও মনুর সন্তান হয় নাই।

“কয়েকদিন থাকিয়া বিশাখা ও শচীন ফিরিয়া গেল। বাড়িটা বড়ই শুন্য মনে হইতে লাগিল। কিন্তু শুন্যতা ভরিয়া দিতে মনুর জুড়ি নাই। গানে, গল্পে, সেবায় সে আমাকে সর্বদা ঘিরিয়া থাকে। আমার মনের কথাটি মুখে আসিবার আগেই সে কী করিয়া যেন টের পায়। তাই অভাব থাকিতে দেয় না। আমার কাছে তাহার যেন চাহিবার কিছুই নাই, শুধুই দেওয়ার আছে। মনু দিবসরজনী সেই দানযজ্ঞই করিয়া চলিয়াছে। উজাড় করিয়া নিজেকে সে যতই দিতেছে ততই যেন অফুরান হইয়া উঠিতেছে। স্ত্রীলোক আমি বেশি দেখি নাই সত্য, তবু মনে হয় এইরূপ স্ত্রীর পৃথিবীতে অল্পই আছে।

“শীঘ্রই মরিব এমন মনে হয় না। তবু একদিন তো ভবের খেলা সাঙ্গ করিতেই হইবে। তখন মনুর কী হইবে? আমা অপেক্ষা সে বয়সে প্রায় বিশ বৎসরের ছোট। তাহার দেহে মনে কোথাও বয়সের ভাটা পড়ে নাই। সে এখনও দীর্ঘদিন বাঁচিবে। সুতরাং তাহার প্রতি আমার কিছু কর্তব্য থাকিয়াই যায়। তাই কাশীর বাড়িটি আমি তাহার নামে রেজিস্টারি করিয়া দিলাম। ডাকঘরে তাহার নামে অ্যাকাউন্ট খুলিয়া কিছু টাকাও রাখিলাম। কিছু গহনা গড়াইয়া দিলাম যাহা ইহজন্মে তাহার অঙ্গস্পর্শে ধন্য হইবে কি না জানি না। সে গহনা পরে না।

“আমাকে এইসব আঁটঘাঁট বাঁধিতে দেখিয়া একদিন সে হাসিয়া কহিল, যদি মরার কথা ভেবে থাকো তাহলে এই বলে দিচ্ছি, যমের সাধ্যি নেই তোমাকে ছোয়। ঝটা মেরে তাকে তাড়াব।

“আমি কহিলাম, তোমার চেয়ে বয়সে আমি বড়। আমার আগে মরাই তো স্বাভাবিক। তোমাকে ভাসিয়ে দিয়ে যেতে পারব না।

“একথায় মনু রাগিল, কাদিল এবং ঝগড়াও করিল। তাহাকে কী করিয়া বুঝাইব? বোধ হয় বুঝাইবার কিছুই নাই। ভালবাসার কাছে পরাজয় মানিয়া লওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি তাহাকে শান্ত করিয়া কাছে টানিয়া লইয়া কহিলাম, তোমার ওরকম স্বভাব কেন বলো তো? যত যাই হোক তুমি তো আমার নতুন বউ। একটা ভাল শাড়ি পরোনা, গয়না পরো না, সাজো না, কিছু আবদার করে চাও না। এরকম হওয়া কি ভাল? যৌবনে যোগিনী সাজার কী হল তোমার?

“সে আমার চোখে বিহুল চোখ রাখিয়া কহিল, আমি সাজব কেন? কাকে ভোলাতে? তাছাড়া আমি বড় বড় ছেলেমেয়ের মা, আমার নাতিপুতি আছে।

“করুণভাবে হাসিয়া কহিলাম, তা বটে, তবে একতরফা। তোমাকে তারা এই জন্মে মা বলে স্বীকার করবে না।

“মনু মাথা নাড়িয়া কহিল, কৃষ্ণ স্বীকার করবে, বিশাখাও করবে। স্বীকার না করলেও দুঃখ নেই। আমি তো জানি, তাহলেই হবে।

“মনু প্রত্যহ বিশ্বনাথ মন্দিরে যায়। আমাকেও টানাটানি করে। মাঝে মাঝে যাইতে হয়। কিন্তু আমি মন্দিরের বিগ্রহে তেমন আকর্ষণ বোধ করি না। বিগ্রহ মূক, স্থবির। মানুষ ইচ্ছা করিলে বিগ্রহকে সামনে রাখিয়া নানা দুস্কার্য করিতে পারে। বিগ্রহ আমাদের শাসন করে না, উপদেশ দেয় না, বিগ্রহের কোনও জীবনদর্শন নাই। আমি বিশ্বাস করি, তিনি যেমন শ্রীকৃষ্ণ বা রামচন্দ্ররূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন তেমনই এখনও অবতীর্ণ হন। মানুষ তাঁহাকেই খোঁজে। পরম প্রেমময় করুণাঘন, সর্বজ্ঞ, মানুষের প্রতি তাঁহার ভালবাসার শেষ নাই। ঈশ্বরকে আমি মানুষের মধ্যেই পাইতে চাই। কিন্তু মনু তত প্রাজ্ঞ নহে। সে ঠাকুরপূজা বোঝে। এই ব্যাপারে তাহার সহিত আমার কিছু মতভেদ আছে। কখনও কখনও তর্কও হয়। মনু শেষে হাল ছাড়িয়া দিয়া কহে, বেশ তো, তোমার কথাই মেনে নিচ্ছি।

“আমি বলি, মানবে কেন? বুঝতে হবে।

“সে মাথা নাড়িয়া বলে, অত বুঝে কাজ নেই। আমি এই বেশ বুঝেছি আমার ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর সব তুমি। আর ঠাকুরে আমার দরকার নেই। বিশ্বনাথ মন্দিরে যাই তোমার কথাই বলে আসতে। বলি, ও দেবতা, আমার দেবতাটিকে ঠিক রেখো।

“উচ্চৈস্বরে হাসিয়া ফেলি। আমাকে দেবতা বানাইয়াও তাহার ভয় কাটিতেছে না। আর একজন দেবতাকে রক্ষক হিসাবে ধার করিতেছে।

“মাঝে মাঝে দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়া বসি। একা একা নিজের জীবনের কথা বসিয়া বসিয়া ভাবি। বছরের হিসাবে অনেক দিন পৃথিবীতে আছি বটে, কিন্তু এই জীবনের পরিসর কতটা? গভীরতাই বা কতখানি? আত্মগ্লানিতে মনটা বড় তিক্ত হইয়া ওঠে। আমি আত্মমুগ্ধ অন্ধ নহি। নিজের দোষ ত্রুটি দুর্বলতা কোনও কিছুকেই এড়াইয়া যাই না। জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করায় আমাকে খাটিয়া খাইতে হয় নাই। যদি উপার্জন করিতে হইত তবে আমি কী করিতাম? অর্জনপটু হইতে পারিতাম কি? না কি উঞ্ছবৃত্তি করিয়া নাজপৃষ্ঠ অকালবৃদ্ধ খিটখিটে এক কৃপণে পরিণত হইতাম?

“নিজেকে লইয়া আমার এই নিরবচ্ছিন্ন ভাবনাও হয়তো একপ্রকার আত্মরতি। কিন্তু আমার সমস্যাও যে নিজেকে লইয়াই। উত্তরবাহিনী গঙ্গা ওই যে অবিরল বহিয়া চলিয়াছে উহার স্রোতোধারার মধ্যে যে অবিরল চরৈবেতি-চরৈবেতি মন্ত্র জপ হইয়া চলিয়াছে জীবনের মূলমন্ত্রও তাহাই। চলো, অগ্রসর হও, তীব্রতা ও ক্রমাগতিতেই জীবনের সৌন্দর্য ও সার্থকতা। নদীর বিশ্রাম নাই, ঘুম নাই, আছে শুধু চলা। উৎস হইতে মোহনা পর্যন্ত তাহার গতিতে কোথাও মৃত্যুর ছায়াপাত ঘটে নাই। যতক্ষণ জীবন, যতক্ষণ গতি, ততক্ষণ মৃত্যু নাই।

“আমি আজকাল ফের মৃত্যুর কথা একটু বেশি ভাবিতেছি। গত বৎসর আমার হৃদযন্ত্র বেশ কয়েকবার বেয়াদপি করিয়াছে। রক্তচাপটাও যে বিদায় লয় নাই তাহা অভ্যন্তরে টের পাই। আর এইসব বৈকল্যই বোধ করি আমাকে মৃত্যুর কথা মনে করাইয়া দেয়। সেই যে কয়েক বৎসর আগে এক প্রত্যুষে কুয়ার দড়ি হাত হইতে পড়িয়া গেল সেদিন হইতেই আমার জীবনে মৃত্যুর ছায়া আসিয়া পড়িল। সেই ছায়া প্রলম্বিত হইয়া এত দূর আসিয়াছে। নদীর ধারে আসিয়া দাঁড়াইলে মাঝে মাঝে মনে হয়, এইখানেই বুঝি যাত্রাশেষ। আর কোথাও যাওয়া হইবে না। আর কোথাও যাওয়ার নাই।

“দশাশ্বমেধের বিশাল ঘাটে পুরোহিত, জ্যোতিষী, গণকার, হেটোমেঠো পণ্ডিতের অভাব নাই। তীর্থস্থানে সর্বত্রই ইহাদের দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাদের মধ্যে একজনের সহিত আমার কিছু সম্ভাব হইয়াছে। লোকটি বাঙালি। পূর্ববঙ্গেই নিবাস। লোকটি ভৃগুজ্যোতিষী। গ্রামে থাকিতে জ্যোতিষচর্চায় বিশেষ আয়পয় হইত না। কাশী পুণ্যার্থীদের জায়গা বলিয়া এখানে আসিয়া থানা গাড়িয়াছেন। মক্কেল যে বিশেষ জুটিয়াছে তাহা মনে হয় না। তবে নিত্যই বিকালের দিকে আসিয়া একটি শতরঞ্চি পাতিয়া চাতকের ন্যায় বসিয়া থাকেন। দু-একজন আসে, দুই চারি আনা দক্ষিণা পান। দুজনেই প্রায় নিষ্কর্মা বলিয়া আলাপ হইয়া গেল। আলাপ হওয়ার পর বুঝিলাম, মানুষটি লোক ঠকাইয়া খাওয়ার মানুষ নহেন। রীতিমত কষ্ট করিয়া অধ্যবসায় সহযোগে ভৃগু পরাশর আয়ত্ত করিয়াছেন। এই কাশীতেই তিনি যৌবনকালে এক পণ্ডিতের চেলাগিরি করিয়াছিলেন। তাহার নাম ধনঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়।

“জ্যোতিষে আমার বিশ্বাস পাকা নহে। সব কিছুর মতো এই বিষয়টির প্রতিও আমার ঔদাসীন্য ছিল। ধনঞ্জয়ের সহিত আলাপ হইবার পর একটু কৌতূহল জন্মিল। আমার কোষ্ঠী একটা আছে বটে, কিন্তু কোথায় আছে জানি না। ধনঞ্জয়কে তাই কোষ্ঠী দেখানো হইল না। তবে উনি আমার কররেখা দেখিয়া কিছু আঁক কষিয়া কহিলেন, আপনার দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করার যোেগ দেখছি। আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী সুলক্ষণা।

“একটু বিস্মিত হইলাম! ধনঞ্জয় নিবিষ্টমনে আরও আঁক কষিয়া কহিলেন, আপনি ভূমি ও সম্পদের অধিপতি। সুপুত্রের পিতা। আপনার কোষ্ঠী বিচার করার আর কী আছে?

“আমি কহিলাম, মৃত্যুর কথা কি কিছু বলা সম্ভব?

“উনি বলিলেন, সম্ভব। তবে আরও ভাল করে বিচার করতে হবে। সময়-সাপেক্ষ।

“কয়েকদিনের মধ্যে আলাপ আরও গাঢ়তর হইল। ধনঞ্জয় আমার মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলিলেন না। কিন্তু আমি একটি অন্য প্রসঙ্গ তুলিলাম। আমি তাহাকে ধরিয়া পড়িলাম, এ বিদ্যে আমাকে শিখিয়ে দিন।

“আশ্চর্য এই যে, ধনঞ্জয় ইহাতে আপত্তি প্রকাশ করিলেন না। সাগ্রহে বলিলেন, শিখবেন? বেশ তো কাছেই আমার বাসা। সকালের দিকে চলে আসবেন।

“পরদিনই ধনঞ্জয়ের বাসায় গেলাম। নিতান্তই হতদরিদ্র অবস্থা। ব্রাহ্মণী রোগাভোগা মানুষ, নিঃসন্তান। বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিয়া ধনঞ্জয় আমাকে শাস্ত্র ব্যাখ্যা করিয়া শুনাইতে লাগিলেন। প্রথমটায় খটোমটো লাগিল। তারপর বেশ মজিয়া গেলাম।

“নূতন শেখা বিদ্যা পরখ করিতে মাঝে মাঝে মনুর কোষ্ঠী লইয়া পড়ি। কখনও নিজের হস্তরেখা বিচার করি। মনু হাসিয়া বলে, এ কোন নতুন বাই চাপল মাথায়! অত ভাগ্য বিচার করার আছেই বা কী?

“না কিছু নাই। জীবনের বারো আনা পার করিয়াছি। স্রোত এখন মোহনার মুখে। আমার আর ভবিষ্যৎ কী? কিন্তু আমি তো ভবিষ্যৎ জানিবার জন্য শিখিতেছি না। শাস্ত্রটা কতটা খাঁটি তাহাই বিচার করিতেছি। এসব বুঝাইয়া বলায় মনু বলিল, তাহলে বলো তো আমি সধবা মরব কি না!

“আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলাম। সধবা মরিবে কি না তাহা জানি না। অত পাকা জ্যোতিষী আমি হইয়া উঠি নাই। তবে মনুর কোষ্ঠী বেশ জটিল। ধনঞ্জয়বাবুও আজকাল মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসেন। আমাদের জমিদারি ঠাটবাট এই কাশীর বাড়িতেও কিছু আছে। ঝাড়লণ্ঠন হইতে বার্মা সেগুনের মহার্ঘ আসবাব, খিলান গম্বুজও কিছু কম নাই। উনি কিছু জড়োসড়ো বোধ করেন। একদিন আমি তাহাকে মনুর কোষ্ঠী দেখাইলাম। বহুক্ষণ দেখিয়া এবং আঁক কষিয়া কহিলেন, ইনি অনেকদিন বাঁচবেন।

“ইহা শুনিয়া মনু জনান্তিকে কহিল, মরণ!

“ভাগ্যক্রমে ধনঞ্জয় এবং আমি সমবয়স্ক। বহুকাল আমার তেমন কোনও বন্ধু জোটে নাই। ধনঞ্জয়ের মধ্যে আমি একজন বন্ধুকে পাইলাম। শাস্ত্র শিক্ষার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলি। দিন বেশ কাটিয়া যায়। মানুষের যে বন্ধুকে কত দরকার তাহা ধনঞ্জয়ের সহিত সখ্য হইবার পর বুঝিতে পারিলাম। সকালে বিকালে তাহার সঙ্গ পাইবার জন্য রোজ মন আনচান করে। মনু একদিন কপট রাগের গলায় কহিল এ যে আমার সতীন হয়ে দাঁড়াল দেখছি গো। তোমার যে আর টিকির নাগাল পাই না।

“নৌকায় করিয়া একদিন দুই পরিবার বেড়াইতে বাহির হইলাম। মণিকর্ণিকার ঘাট পার হইয়া অনেকদূর যাওয়া গেল। বেশ লাগিল এই জলভ্রমণটি। মনুর সহিত ধাঞ্জয়ের স্ত্রীরও বেশ আলাপ জমিয়া গেল। কথায় কথায় প্রকাশ হইয়া পড়িল যে, আমি এস্রাজ বাজাইতে জানি। মনুই আগ বাড়াইয়া প্রচারটি করিল। ইহাতে ধনঞ্জয় আনন্দে উদ্বেল হইয়া কহিল, আমারও কিছু গানবাজনার চর্চা ছিল। তা ভায়া একদিন জলসা বসানো যাক।

“ধনঞ্জয় যে বাস্তবিকই গুণী লোক তাহাতে আর সন্দেহ কী। জলসার দিন সে একজন তবলায় ঠেকা দিবার লোক ও একজন সারেঙ্গিদারকে কোথা হইতে ধরিয়া আনিল। দুজনেরই পাকানো চেহারায় দুর্দশার ছাপ। আমার বৈঠকখানায় সেদিন বিরল-শ্রোতা জলসা খুবই জমিয়া গেল। ধনঞ্জয় পুরানো বাংলা গান চমৎকার সুরে লয়ে গাহিল। আমি এস্রাজ মন্দ বাজাইলাম না। মালকোষ ধরিয়াছিলাম। বাজাইতে বাজাইতে চক্ষু দুইটি বারবার অপূর্ণ হইয়া আসিতেছিল। বারবার কৃষ্ণর কথা মনে হইতেছিল। ইহজন্মে কি আর তাহাকে দেখিব? পিতৃহৃদয় এস্রাজ বাজাইয়া কেবল কাঁদিতেছিল।

“পরদিন সকালেই রুক্ষ শুষ্ক চেহারার এক যুবক উদভ্রান্তভাবে আমাদের দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল। তাহাকে চিনি না। তবু সে খুব উচ্চগ্রামে ডাকিল, বাবা!

“আমি বৈঠকখানায় বসিয়াই দুগ্ধপান করিতেছিলাম। শ্বেতপাথরের গেলাসটি হাত হইতে পড়িয়া ভাঙিয়া গেল। বুক কাপিয়া উঠিয়া শ্বাসকষ্ট হইতে লাগিল। যুবকটি আসিয়া আমার পায়ের উপর উপুড় হইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, কেমন আছেন?

“কী বলিব? এই যুবককে কী বলিব? কে বিশ্বাস করিবে যে একদিন এ কীটাণুকীট হইয়া আমার শরীরের অভ্যন্তরে ছিল। মাতৃজঠর হইয়া পৃথিবীর আলো দেখিল এই তো সেদিন! ইহার মধ্যেই লম্বা চওড়া চেহারার বিশাল যুবক হইয়া উঠিল কীরূপে? রুক্ষতা ও শুষ্কতার ভিতর দিয়াও তাহার বিশাল কাঠামো ও অভ্যন্তরীণ তেজ প্রকাশ পাইতেছে। একটি অগ্নিশিখা।

“বুকটা ব্যথাইয়া উঠিল কি? শ্বাসকষ্ট হইতেছে। কোনওক্রমে দুটি হাত বাড়াইয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিলাম, এলে! অবশেষে এলে!

 

“বেশ কয়েকদিন ডায়েরি লিখি নাই। শরীরের অবস্থা ভাল বুঝিতেছি না। বুকের মধ্যে এখনও অসহনীয় কষ্ট আছে। শ্বাসের গতিও অনিয়মিত। ডাক্তার বলিয়া গিয়াছে, রক্তচাপও মারাত্মক। সবই ঠিক, তবু মরি তো নাই। দুই চক্ষু ভরিয়া পুত্রের মুখ দেখিয়াছি। আর এখন মরিলেই বা দুঃখ কী? মনু বিধবা হইবে। সে আর বেশি কথা কী? সে তো জানিয়াই আমার সহিত সংসার পাতিয়াছে।

“না, আজ আর অন্য কথা নহে। শুধু কৃষ্ণর কথা ভাবিব। পুত্রের ভিতর দিয়া পিতাই আবার জন্মগ্রহণ করে বলিয়া শাস্ত্রে একটা কথা আছে না! আজ মনে হইতেছে ওই তো আমি জন্মগ্রহণ করিয়াছি। আর কেন মিথ্যা এই দেহটি লইয়া থাকা?

“কৃষ্ণ আছে। থাকিবার কথা ছিল না। তিনদিনের কড়ারে আসিয়াছে। কিন্তু তাহাকে দেখিয়াই আমার রক্তচাপ বাড়িয়া যাওয়ার এবং দুর্বল হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ করায় সে যাইতে পারে নাই। মনে মনে প্রার্থনা করিতেছি, সে যেন একেবারে আমার মুখাগ্নি করিয়া যায়।”

হেমকান্ত মারা গেলেন ভোররাতে। কেউ টেরও পেল না। শেষ সময়টায় শুধু তিনি নিজেই টের পেয়েছিলেন। বুকে অসংখ্য ছুরির আঘাতের মতো ব্যথার ফলা ঢুকে যাচ্ছে। টনটনে জ্ঞানে সবটাই তিনি অনুভব করতে পারলেন। শ্বাসকষ্ট প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছিল বুক। হেমকান্ত উঠে বসবার চেষ্টা করলেন। রঙ্গময়ী পর পর সাতদিন একটানা রাত জেগে আর পারেনি। পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে অঘোর ঘুমে ঢলে পড়েছে। হেমকান্ত তাকে আর ডাকলেন না। তিনি গঙ্গার স্রোতের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। অন্ধকারে নদী বয়ে চলেছে।

অস্ফুট একটা শব্দ করলেন হেমকান্ত। বুঝি বললেন, ওরা রইল। দেখো।

কাকে বললেন তা স্পষ্টভাবে তিনি নিজেও জানেন না। কিন্তু তার মনে হল, কেউ শুনল। মনে রাখল।

পরদিন মণিকর্ণিকার ঘাটে হেমকান্ত পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলেন। তাঁর আর কোনও চিহ্ন রইল না।

কৃষ্ণকান্ত বসে নিভন্ত চিতার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। সে বুঝতে পারছিল না, বাবা কেন শুধু তার আগমনটুকুর জন্যই প্রাণটা রেখেছিল কোনওক্রমে। কোনও গৃঢ় কারণে সে পিতৃঘাতী হল না তো!

চিতায় জল ঢেলে অস্থি নিয়ে কৃষ্ণকান্ত যখন স্নান সেরে ফিরে এল তখনও রঙ্গময়ী অচেতন। তাকে পাখার বাতাস দিচ্ছেন ধনঞ্জয়ের স্ত্রী।

বিছানাটার পাশে মেঝেয় বসে কৃষ্ণকান্ত খাটের পায়ায় একটু হাত বোলাল। শোক গভীর শোক গুরুভার। তবু অপেক্ষা করার সময় তো তার নেই। যেতে হবে।

খাটে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল কৃষ্ণকান্ত। শেষরাতে রঙ্গময়ী তাকে ডেকে তুলল।

ওরে ওঠ। আয়, দুজনে মিলে একটু কাঁদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *