১০৪. গুজবটা কী করে ছড়াল কে জানে

গুজবটা কী করে ছড়াল কে জানে। কিন্তু খবরের কাগজে একদিন বেশ ফলাও করে ছাপা হল, কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব পাচ্ছেন। হাই কম্যান্ডের সঙ্গে তার আঁতাত হয়ে গেছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে তিনি শীঘ্র দিল্লি যাচ্ছেন।

খবরটা ছাপা হওয়ার পর আত্মীয়, বন্ধু ও পরিচিত মহলে একটা উল্লাসের হাওয়া বয়ে গেল। সর্বভারতীয় এই পরিচিতি কৃষ্ণকান্তর তো পাওনাই ছিল। দেশের জন্য তিনি তো কিছু কম করেননি!

এ খবরে উল্লসিত হল না শুধু ধ্রুব। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে একটু চোখ বুলিয়ে খবরের কাগজটা ফের টেবিলে ফেলে রেখে রেমিকে বলল, তোমার শ্বশুর আবার মন্ত্রী হচ্ছেন, খবর রাখো?

না তো!

খবরের কাগজে আছে। সেন্ট্রাল মিনিস্টার। ল্যাজ বেশ মোটা হল।

ও কী রকম কথা! ছিঃ।

ল্যাজ মোটা নয়? ওয়েস্ট বেঙ্গলের মতো একটুখানি এক রাজ্যে গণ্ডুষজলের সফরী আর তো নয়। এবার ভারতবর্ষের মতো বিশাল চারণভূমি।

যোগ্য বলেই ওঁকে নিচ্ছে।

হ্যাঁ, যোগ্য বই কী, ভাল চেঁচাতে পারেন। পার্লামেন্টে ওঁর ভয়েস ভালই শোনা যাবে।

উঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না।

ধ্রুব ফের খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে খবরটার দিকে চেয়ে রইল। সে খবরটা দেখছিল না। সে ভাবছিল। কৃষ্ণকান্ত কলকাতার পাট প্রায় চুকিয়ে দিলেন। তাকে চাবি দিয়ে দিয়েছেন। টাকাপয়সার উত্তরাধিকার দিয়েছেন। আর দিচ্ছেন দুর্লভ স্বাধীনতা। সবচেয়ে বড় কথা, নিজের জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্রের জন্য তেমন কোনও বিলিব্যবস্থাও করেননি। সম্ভবত সেটাও ধ্রুবর বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন। এটাকে কৃষ্ণকান্তর মহৎ ত্যাগ বলে ধরে নিতে পারত ধ্রুব। বা এক ধরনের বানপ্রস্থ। কিন্তু তা তো নয়। কৃষ্ণকান্ত চললেন বৃহত্তর মৃগয়ায়। ধ্রুব জানে, কৃষ্ণকান্ত সাদামাটা ভাবে চোর নন, ঘুষ নেন না। কিন্তু তার দুর্নীতির রকমটাই আলাদা, যাকে দুর্নীতি বলে চেনাও যাবে না। অগাধ প্রশাসনিক ক্ষমতা ভোগ করতে করতে ভিতরের কঠিন নীতিবোধ গলে জল হয়ে যায়। আর সেই ক্ষমতার রন্ধ্রপথেই ঢোকে ক্ষমতার নানারকম অপব্যবহার। আসে দাম্ভিকতা, অত্যাচারী মনোভাব, আসে পরমত-অসহিষ্ণুতা। ভাল-মন্দের বিচারবোধ লুপ্ত হয়ে যায়। অতীতের ব্রহ্মচারী, ত্যাগব্রতী স্বদেশপ্রেমিক কৃষ্ণকান্ত খুব ধীরে ধীরে নিজের অজান্তে নেমেছেন নীচে। তার পতন তিনি নিজেও টের পাননি কখনও। অতীতের কঠিন আদর্শপ্রাণতা কবে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন আদর্শের কথা তিনি মুখস্থ বলে যান মাত্র, সেগুলোকে অপরিহার্য বলে বোধ করেন না, পালনযোগ্য বলে মনে করেন না।

ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

রেমি তার বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে সাবধানে মশারিতে ঢাকা দিল। তারপর এসে ধ্রুবর হাত থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে সাগ্রহে খবরটা পড়ল। তারপর বলল, এ মাঃ!

কী হল!

সেন্ট্রাল মিনিস্টার! তার মানে তো ওঁকে দিল্লিতে থাকতে হবে।

সেটাই তো স্বাভাবিক।

উনি দিল্লি গেলে চলবে কী করে? চলবে না কেন?

বাঃ, এদিক সামলাবে কে?

কী সামলানোর আছে? একরত্তি একটু সংসার। এটা সামলানোর জন্য কৃষ্ণকান্তর মতো বৃহৎ মস্তিষ্কের দরকার কী? উনি ভারতবর্ষের জনগণের বৃহৎ সংসার সামলানোর পবিত্র দায়িত্ব নিয়ে যাচ্ছেন, রেমি।

আর দিব্য! ওকে ছেড়ে উনি থাকতে পারবেন?

পারার কী আছে? উনি একদিন ওঁর প্রিয় বাবা এবং সংসার ছেড়েছিলেন। দীর্ঘদিন জেলে কাটিয়েছেন। বিয়ের পরই ওঁকে একবার গ্রেফতার করা হয়। তখন সদ্য পরিণীতা স্ত্রীকে ছেড়েও থাকতে হয়েছে। বৈরাগ্য ওঁর রক্তে।

ঠাট্টা করছ?

বাপ রে, ওঁকে নিয়ে ঠাট্টা! ডন কুইকসোটকে নিয়ে ঠাট্টা চলে নাকি?

কে ডন কুইকসোট! শ্বশুরমশাই! তাহলে ওঁকে তুমি ছাই চেনো।

সেটা ঠিক। আমি ওঁকে চিনি না। কে বলো তো লোকটা? কেমন লোক?

ফের ইয়ার্কি? চুপ করো।

কেন চুপ করব, রেমি? আমি ভারতের জনগণের একজন। আমার জানার অধিকার আছে, আমাদের পরবর্তী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীটি কেমন লোক।

ভাল লোক। এত ভাল লোক কোথাও পাবে না। তোমার ভারতবর্ষের অনেক ভাগ্যি যে ওর মতো লোক মন্ত্রী হচ্ছেন।

সাবাস, এ না হলে পুত্রবধূ!

শুধু পুত্রবধূ নই, আমি ওঁর মেয়েও।

তুমি পারো বটে, রেমি। এত জেনে এত বুঝেও অন্ধ। হিপনোটাইজড অ্যান্ড ব্রেন-ওয়াশড।

বেশ। আমরা কিছু লোক এই রকমই অন্ধ এবং হিপনোটাইজড হয়ে থাকতে থাকতে চাই। লেট আস বি হোয়াট উই আর।

ওটা যুক্তি হল না।

এটাই যুক্তি মশাই, কারণ এই হিপনোটিজম অনেক চেষ্টা করেও তুমি ভাঙতে পারেনি। আমাদের জ্ঞানচক্ষুও খুলতে পারোনি। পেরেছ, বলো?

তাই দেখছি।

তাহলে এবার স্বীকার করো, ওঁর মধ্যে একটা দারুণ পজিটিভ ফোর্সও আছে।

ছিল।

এখনও আছে। তুমি অপোজিশনের লোক বলে টের পাও না।

অপোজিশন?– বলে ধ্রুব খুব হোঃ হোঃ হাসল।

অপোজিশনই তো। তাছাড়া আর কী বলা যায় তোমাকে?

বেশ বলেছ! আসলে কী জানো? আমরা হচ্ছি সোরাব রুস্তম।

আমি একটু ওঁর কাছে যাই, প্রণাম করে আসি।

যাও।

কিন্তু উনি দিল্লি চলে গেলে যে কী করে এই ভূতের বাড়িতে থাকব। সংসারটাই বা কে সামলাবে কিছু বুঝতে পারছি না।

উনি পরশুদিন আমাকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়েছেন।

তার মানে?

মানে আমাকে কলকাতার সিংহাসনে অভিষিক্ত করেছেন।

কী বলতে চাইছ?

আরও বুঝিয়ে বলতে হবে?

জানোই তো আমি একটু বোকা।

উনি আমার হাতে সিন্দুক আলমারি ইত্যাদির চাবি তুলে দিয়েছেন।

তোমার হাতে! বলো কী?

আমিও বিস্মিত এবং তোমার মতোই বজ্রাহত, রেমি। কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছে।

তুমি চালাবে?

তা বলতে পারি না। তবে কৃষ্ণকান্ত দি গ্রেট-এর এটা একটা নতুন চালও হতে পারে। মে বি হি ইজ হ্যাচিং সামথিং, নইলে আমার হাতে চাবি কেন? মাইন্ড ইউ মাই ডিয়ার, তুমি ওঁর এত আপন, এত বিশ্বস্ত এবং প্রিয়পাত্রী হওয়া সত্ত্বেও চাবির গোছা তোমার হাতে দেননি। অথচ সেটাই স্বাভাবিক হত।

উনি যা ভাল বুঝেছেন তাই করেছেন। তার মধ্যে ষড়যন্ত্র থাকবে কেন?

নেই বলছ?

ওঁর বিষয়-সম্পত্তি তো কম নয়। আমি মেয়েমানুষ, সামলাতে পারব না বুঝেই তোমাকে ভার দিয়েছেন।

এমন নয় তো রেমি যে, তোমাকে উনি আর বিশ্বাস করেন না। কিংবা তেমন ভালও বাসেন না আর!

কক্ষনও নয়। ওঁর ভালবাসা উপচে পড়ে। মাপা জিনিস নয় সেটা। তুমি বুঝবে না।

তাহলে কেসটা কী?

আমি ওঁর কাছে যাই।

হিপনোটাইজড। কমপ্লিটলি হিপনোটাইজড।

বেশ। হিপনোটাইজড তো হিপনোটাইজড।

ধ্রুব হাত বাড়িয়ে রেমির একখানা হাত ধরল, শোনো রেমি। আমি ফের তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, বাস্তবিকই কৃষ্ণকান্ত লোকটি কী রকম? উনি কি জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার উপযুক্ত?

একশোবার উপযুক্ত। ওরকম মানুষ দেশে বেশি নেই।

তাহলে সেটা আমি ফিল করি না কেন?

সেটা তোমার দোষ।

হি কিলড হার।

কী বললে?

হি কিলড মাই মাদার।

কক্ষনও নয়। এটা হতেই পারে না। তুমি ভুল ব্যাখ্যা করছ।

ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেমির হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, যাও, প্রণাম করে এসো।

তুমিও চলো না।

আমি ওঁকে প্রণাম করি না।

ছিঃ, কী যে হচ্ছ দিন দিন!

উনি জন্মদাতা মাত্র। তার বেশি কিছু নন। তুমি যাও।

রেমি মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।

ধ্রুব আবার খবরের কাগজটা তুলে নেয়। অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে থাকে খবরটার দিকে। পড়ে না। শুধু চেয়ে থাকে।

আজ সকাল থেকে অবিরাম টেলিফোন বেজে যাচ্ছে। অজস্র লোকের আগমনও ঘরে বসে টের পাচ্ছে ধ্রুব। এ এক অলিখিত উৎসব। খবরটা বেরোনোর পর লোকের মনে নানা আশা আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশা উদ্বেল হয়ে উঠেছে তাই তারা থাকতে না পেরে আগাম সেলাম বাজাতে চলে এসেছে। মেরুদণ্ডহীন অয়েল মাস্টারস। এদের নিয়েই কৃষ্ণকান্তর কারবার। এদের ক্ষুধাতৃষ্ণা লোভ লালসা মিটিয়ে তারপর এদের কাঁধে ভর দিয়েই কৃষ্ণকান্তকে চলতে হবে। তার আর উপায় নেই।

করিডোরের মুখে দাঁড়ালে বাইরের ঘরের দৃশ্য খানিকটা দেখা যায়। ধ্রুব নিঃশব্দে উঠে এসে দাঁড়াল। প্রচুর লোক হা হা, হি হি করে উল্লাস জানিয়ে যাচ্ছে। মস্ত এক একক সোফায় কৃষ্ণকান্ত সমাসীন। উনি লোকের তোষামোদ এবং সাধুবাদ গ্রহণ করতে খুব ভালবাসেন। ভালবাসেন তুতি ও অন্যের মুখে নিজের গুণকীর্তন। ভালবাসেন লোককে ভয় দেখাতে এবং ভেঙে ফেলতে। নিজেকে ছাড়া উনি আর কিছুই বোঝেন না।

ধ্রুব বিষাক্ত এক দৃষ্টিতে দৃশ্যটা দেখছিল। ঘোমটা মাথায় রেমি শ্বশুরের সোফার পিছনে দাড়িয়ে। তার মুখে অহংকার জ্বলজ্বল করছে। সামনে স্তাবকের দল। তাদের মুখ বিগলিত, চোখ সশ্রদ্ধ, দেহ বিনয়ে নজ। জাদুকর তার সম্মোহন বিস্তার করে রেখেছেন চারধারে।

ধ্রুব মুখ ফিরিয়ে নিল। ঘরে এসে পোশাক পরে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাইরে।

যখন অফিসে এসে পৌঁছল তখন অফিস শুরু হতে অনেক দেরি। ফাঁকা ঘরে বসে ধ্রুব চুপচাপ চেয়ে রইল। সে এখনও জানে না, কৃষ্ণকান্তের ওপর তার এই বিরাগের প্রকৃত কারণ কী? সত্য বটে এক সময়ে নিজের পরিবারকে তিনি বড় হেলাফেলা করেছিলেন। তাঁর অমনোযোগ এবং নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যই তাঁর স্ত্রীকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ধ্রুবর মনে আছে মরার আগে তার মা যে চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিলেন তাতে স্পষ্ট ভাষায় তিনি তার স্বামীকে নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী। করে যান। এ গেল স্ত্রীর কথা। নিজের সন্তানদের সঙ্গেও কৃষ্ণকান্তর কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। নিজের পরিবারের চেয়ে ভোটদাতা বা দলীয় কর্মীদের সঙ্গে তার বোঝাপড়া অনেক বেশি। বড় এবং ছোট দুই ছেলে তার অবহেলাতেই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। মেয়ে লতু বাড়িতে থেকেও নেই। বুড়ো বয়সে যখন আর আপনজন বলতে কেউ অবশিষ্ট নেই তার, তখন রেমিকে আঁকড়ে ধরেছেন কাঙাল ছেলের মতো। পরোক্ষে তোয়াজ করছেন ধ্রুবকেও। কিন্তু ধ্রুব মনে-প্রাণে লোকটিকে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারছে না। এই মানুষের সঙ্গে তার কোনও আত্মীয়তা গড়ে ওঠেনি যে!

ধ্রুবর কি কোনও দোষ নেই? আছে। কৃষ্ণকান্তর বিপুল প্রভাব ও প্রতিপত্তি সে দেখে আসছে জ্ঞান হওয়ার সময় থেকে। বিখ্যাত ও প্রভাবশালী পিতাদের পুত্ররা বড় হতভাগ্য। বাপের জ্যোতির পাশে তারা মিট মিট করে। ক্ষমতা, প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব থাকলেও তা সহজে স্বীকৃতি পেতে চায় না। লোকে তাদের আমল দেয় না। এই সত্য ধ্রুব খুব ছেলেবেলা থেকে টের পেয়ে আসছে। তার কোনও আলাদা সম্মান নেই, স্বীকৃতি নেই, তার ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠতে পারেনি নিজের মতো করে। কৃষ্ণকান্তের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া ধ্রুবর সামনে আর কোন পথই বা খোলা ছিল? আর-একটা পথ ছিল। তা বিদ্রোহের এবং বিনাশের। বিখ্যাত বাপের কুপুত্ররা কিছু মনোযোগ পায়। ধ্রুব দ্বিতীয় পন্থা বেছে নিয়েছিল। কিন্তু কোথাও পৌছোতে পারেনি, কিছু লাভ হয়নি।

আজ কৃষ্ণকান্ত তাকে দয়া করছেন। দয়া ছাড়া আর কী? নিজেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিচ্ছেন, ধ্রুবকে দিয়ে যাচ্ছেন দায়দায়িত্ব। বিকশিত হওয়ার সুযোগ। ইটের নীচে চাপা ঘাস হলুদবর্ণ ধারণ করেছে, এখন ইট সরে গেলে হয়তো বা সবুজ হয়ে উঠবে। কিন্তু এই দায়টা নিতে হচ্ছে বলে ধ্রুবর ভিতরটা আজ তেতো, বিষাক্ত।

অফিসে আজ অনেকেই তাকে অভিনন্দন জানাতে এল। তার বাবা কেন্দ্রে মন্ত্রী হচ্ছেন, সোজা কথা তো নয়। অভিনন্দনটা ধ্রুবর পাওনা নয়। কিন্তু সে হাসিমুখেই কৃষ্ণকান্তর পাওনা গ্রহণ করল। টেলিফোনটা এল দুপুরে। প্রথম রেমির।

কী গো, না বলে কয়ে চলে গেছ যে বড়! খেয়েও যাওনি!

যা অবস্থা দেখলাম ভাই, তাতে মনে হল আজ ধ্রুব চৌধুরীর মতো একজন নগণ্য লোককে অফিসের ভাত দেওয়ার কথা কারও খেয়াল হওয়ার নয়।

বাজে কথা বোলো না। সব রেডি ছিল। ঘরে এসে দেখি বাবু নেই।

বাবু যে নেই তা এতক্ষণে খেয়াল হল?

বাড়ি ভর্তি লোক, সকলের তদারক করতে হচ্ছে না! আমি তো ধরে নিয়েছি তুমি কোথাও আড্ডা মারতে গেছ।

বাঃ, চমৎকার।

ইয়ার্কি কোরো না। কিছু খেয়েছ?

খেয়েছি। ওটা কোনও প্রবলেম নয়।

রাগ করোনি তো!

আরে না।

দিব্য ভীষণ দুষ্টুমি করছে, ফোন ছাড়লাম।

আচ্ছা।

দ্বিতীয় ফোনটা কৃষ্ণকান্তর। কদাচিৎ তিনি ধ্রুবকে ফোন করেছেন। আদৌ কোনওদিন করেছেন কি না তাই আজ ধ্রুব মনে করতে পারল না।

ধ্রুব? আমি কৃষ্ণকান্ত বলছি।

কথাটা ধ্রুবর কানে খট করে লাগল। ধ্রুব যে কৃষ্ণকান্তকে বাবা বলে ডাকে না এটা হয়তো তারই পালটি।

ধ্রুব একটু চমকে উঠলেও স্বাভাবিক স্বরেই বলল, বলুন।

তুমি বোধহয় আজ বউমাকে না জানিয়েই অফিসে চলে গেছ। বউমা খুব চিন্তা করছিল।

একটু কাজ ছিল, তাই।

তা থাকতেই পারে। বউমা ভাবছিল বলেই আমি তোমার খবরটা নিলাম।

আচ্ছা।

আজ সকালে বাড়িতে অনেক লোক এসেছিল। মোস্ট ডিস্টার্কিং। তবে আমি লোককে ফিরিয়ে দিতেও পারি না। তোমাদের হয়তো একটু অসুবিধে হয়েছে।

না, অসুবিধে কীসের? আমি তো ছেলেবেলা থেকেই বাড়িতে ভিড় দেখছি।

তা অবশ্য বটে। এখন বড় হয়েছ, নিজস্ব মতামত হয়েছে। বলে কৃষ্ণকান্ত একটু থামলেন। তারপর বললেন, আমি আগামীকাল দিল্লি যাচ্ছি। বিকেলের প্লেনে। আমার ইচ্ছে কালকের দিনটা তুমি বাড়িতেই থাকো।

ধ্রুব একটু অবাক হয়ে বলল, আমি!

হ্যাঁ। যদি একটু অসুবিধে হয়ও তবু চেষ্টা করো।

আচ্ছা।

আমি হয়তো শিগগির ফিরব না। বউমা খুব কান্নাকাটি করছে। দিব্যর জন্য আমারও মনটা খারাপ হবে। তবু কী আর করা!

ধ্রুব কী বলবে! চুপ করে রইল।

কৃষ্ণকান্ত একটু গলা খাঁকারি দিলেন। তারপর বললেন, কালকের দিনটার কথা ভুলে যেয়ো না।

না, ভুলব না।

কৃষ্ণকান্ত ফোন ছেড়ে দিলেন।

ধ্রুবর শরীরটা হঠাৎ খুব শিথিল এবং শীতল লাগতে লাগল। কৃষ্ণকান্তর হলটা কী?

সন্ধেবেলাই আজ ধ্রুব বাড়ি ফিরে এল। কেন এল তা সে নিজেও জানে না। এসে ভাল ছেলের মতো মুখ-টুখ ধুয়ে একটা চেয়ারে বসে একখানা বই খুলল। রেমি ঘরে নেই। বোধ হয় ওপরে শ্বশুরের গোছগাছ করে দিচ্ছে। বইখানা খুলেও ধ্রুব কিছু পড়তে পারছিল না। মনটা চঞ্চল।

কৃষ্ণকান্ত বাড়িতে থাকলে কতগুলো লক্ষণ দেখে তা বোঝা যায়। বাড়িটা নিস্তব্ধ থাকে, চাকর-বাকরেরা ফিস ফিস করে কথা বলে, বাসনের শব্দ হয় না, কেউ রেডিয়ো চালায় না বা হঠাৎ গান গেয়ে ওঠে না, পা টিপে টিপে হাটে। এমনকী বাড়ির আবহাওয়াটাও যেন একটু থমথমে থাকে। ধ্রুব সেই আবহাওয়াটা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করল। তারপর বুঝল, কৃষ্ণকান্ত বাড়িতে নেই। বই রেখে সে ওপরে উঠে এল।

কৃষ্ণকান্তর ঘরে বাস্তবিকই রেমি বিশাল এক ফাইবার গ্লাসের স্যুটকেস গোছাতে বসেছে। তাকে সাহায্য করছে দুজন ঝি।

কী করছ?

গোছাচ্ছি। বাবা কাল দিল্লি যাচ্ছেন।

জানি।

তুমি এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে!

এমনি। ছেলেটা কোথায়?

ঘুমোচ্ছে।

এত ঘুমোয় কেন ওটা?

বাচ্চারা ঘুমোয়, ওটাই নিয়ম। কেন? তোমার কি একটু ছেলেকে আদর করতে ইচ্ছে করছে?

না বাবা, আদর করতে হলে তো বোধ হয় ডেটল দিয়ে হাত-মুখ ধুতে হবে! অতটা পেরে উঠব না।

ডেটল না হলেও চলবে। সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধুলে আর বাধা নেই। বাচ্চাদের চট করে ইনফেকশন হয় বলেই শ্বশুরমশাই সাবধান হয়েছেন। ওরকম বাঁকা ভাবে সব কথা ধরো কেন?

তোমার শ্বশুরমশাই কোথায়?

পার্টির কী একটা জরুরি মিটিং-এ গেছেন। জানো, আজ প্রাইম মিনিস্টারের ট্রাংকল এসেছিল?

বলো কী! তাহলে তো আমরা ধন্য। বাড়িতে আলোকসজ্জা করতে বলো।

ফের ইয়ার্কি?

তা প্রাইম মিনিস্টার কী বলল?

কী করে জানব?

ধ্রুব একটু হাসল। তারপর বলল, তোমার শ্বশুর একটা অদ্ভুত আবদার করেছেন।

কীসের আবদার?

কাল উনি দিল্লি যাবেন বলে আমাকে বাড়িতে থাকতে বলেছেন।

তাই নাকি? তুমি রাজি হলে?

হলাম। উনি নাকি দিল্লি থেকে আর সহজে আসছেন না।

তাই শুনছি। কী যে খারাপ লাগছে!

তুমিও দিল্লি গেলে পারো। যাবে?

সে কি আর বলতে বাকি রেখেছি ভাবো?

উনি কী বললেন?

বললেন, বউমা, তুমি গেলে আমার ছেলেটাকে কে দেখবে?

বটে! এত বড় কথা!

কেন বড় কথার কী হল?

বড় কথা নয়? আমি কি ছেলেমানুষ?

তুমি তার চেয়েও অধম।

 

কৃষ্ণকান্ত ফিরলেন অনেক রাতে। সঙ্গে এক দঙ্গল লোক। অনেক রাত অবধি বৈঠকখানায় মিটিং চলল। ধ্রুবর সঙ্গে চোখাচোখিও হল না। ঘুমও হল না তার। মনটা চঞ্চল। ভীষণ চঞ্চল। রাত তিনটের সময় উঠে সে দু পেগ-এর মতো হুইস্কি খেল জোর করে। দশ মিনিটের মধ্যে পেটে প্রবল ব্যথা উঠল। হুইস্কিটা গলায় আঙুল দিয়ে তুলে ফেলতে হল তাকে। তারপর সারারাত এক ধরনের মানসিক ছটফটানির মধ্যে ছেঁড়া-ছেড়া তন্দ্রা এল মাত্র।

পরদিন ধ্রুব অফিসে গেল না। কিন্তু তা বলে কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে তার ভাল করে দেখাও হল না। কৃষ্ণকান্তকে সকাল থেকেই ফের হেঁকে ধরেছে লোক। বেলা দশটায় পার্টি অফিসে যাওয়ার আগে ধ্রুবকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে ভাল করে দুটো কথাও বলতে পারছি না আজ। বড় ঝামেলা হয়েছে। অথচ কয়েকটা কথা বলার ছিল।

কী কথা?

কাজের কথাই। তা সে আর সময় হবে না। তবু তুমি আজ বাড়িতেই থেকে। যদি সম্ভব হয় তবে এয়ারপোর্টে আমার সঙ্গে যেয়ো। রাস্তায় বলা যাবে।

কিন্তু সেটাও সম্ভব হল না। বিকেল পর্যন্ত কৃষ্ণকান্ত ফিরতে পারলেন না। ফোন করে তার জিনিসপত্র এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দিতে বললেন। তারপর ফোনেই ধ্রুবকে ডেকে বললেন, সব দিক সামলে চলো। সাবধানে থেকো। এখন তুমিই অভিভাবক।

ধ্রুব বলল, ঠিক আছে।

বউমাকে একটু যত্ন কোরো। লতুর বিয়ের কথা ভুলো না। সব তোমাকেই করতে হবে।

চেষ্টা করব।

চলি।

আচ্ছা।

ফোন রেখে দিল ধ্রুব। কিন্তু সে একটা অস্থিরতা বোধ করছিল ভিতরে-ভিতরে! এটার কোনও কারণ নেই। অন্তত কারণ কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *