॥ ১০২ ॥
দরজা খুলে বৃদ্ধা স্নিগ্ধ ও প্রসন্ন মুখে বললেন, আয়। মনে পড়ল তাহলে?
মনু ঠাকুমা, আমি তোমার কাছে কিছু কথা জানতে এসেছি।
দরকার না হলে যে এই পোড়াকপালীকে তোদের মনে পড়ে না সে আমি জানি। আয় বোস এসে।
বাইরের ঘরে নয়, ভিতরের দিকের চিক-ঢাকা বারান্দায় একটা মোড়ায় রঙ্গময়ীর মুখোমুখি বসল ধ্রুব। রঙ্গময়ীর বাঁ হাঁটুতে কঠিন বাত। উঠতে বসতে কষ্ট হয়। কষ্টেই বললেন, পুরোনো কথা জানতে এসেছিস তো!
তা বলতে পারো।
আমার বাপু আজকাল মাথায় বুড়োমি ঢুকেছে। ভীমরতি না কী বলে। কিছু তেমন মনে থাকে না। যা জানতে চাস এইবেলা জেনে নে।
সত্যি করে বলবে আমার পিতৃদেবতাটি কেমন লোক?
কী কথার ছিরি ছেলের! আবার বেঁধেছে নাকি তোদের বাপ-ব্যাটায়?
বাঁধলে বাঁধতেও পারে।
বাঁধলে যদি বাঁধতেই পারে তো গিয়ে ধুন্ধুমার লাগিয়ে দে না সোরাব-রুস্তমের কাণ্ড। আমার কাছে এসেছিস কেন?
তোমার কাছে কিছু পয়েন্ট নিতে এসেছি। ঝগড়া করতেও তো কিছু পয়েন্ট লাগে! তুমি যে টোপলা নিয়ে বসে আছে।
কিসের টোপলা রে বদমাশ?
পুরোনো কথার। তুমি ছাড়া আর তো কেউ জানে না।
সে সব জেনে গিয়ে বাপের সঙ্গে লাগবি?
ধ্রুব একটু হাসল, আমার যে জানা দরকার ঠাকুমা।
পুরোনো কথা অনেক শুনেছিস। আর শুনে ডানা গজাবে না।
তবু বলো। আমার একটা কথাই জানা দরকার। কৃষ্ণকান্ত কেমন লোক।
সেও তোকে অনেকবার বলেছি। কৃষ্ণর মতো মানুষ হয় না।
এই যে তোমরা বলো এতে আমার ভীষণ অবাক লাগে। কৃষ্ণকান্ত যদি এতই ভাল তবে আমি কেন লোকটাকে শ্রদ্ধা করতে পারিনি? কেন লোকটাকে আমার ভণ্ড আর দাম্ভিক বলে মনে হয়?
ছিঃ ধ্রুব। ওসব কথা মুখে বা মনে আনাই পাপ। কৃষ্ণ যদি ভণ্ড তবে দেশে আর খাঁটি লোক একটাও নেই।
কেন ঠাকুমা, সেটাই বুঝিয়ে বলো।
আগে বল তোদের বাপে ব্যাটায় হয়েছেটা কী?
ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, নতুন করে কিছু হয়নি, ভয় নেই। যা হয়ে আসছে তারই জের চলছে। বাইরে আমাদের ঝগড়া বা অশান্তি কিছুই নেই। হয়তো তোমার কৃষ্ণর মনেও কিছু নেই। শুধু আমার ভিতরেই লোকটা সম্পর্কে যত সন্দেহ।
রঙ্গময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সেইসব দিনে যদি তুই থাকতি, দেখতি কৃষ্ণ কেমন মানুষ। ওইটুকু বাচ্চা ছেলে যেন দেশ কাঁপিয়ে দেওয়ার শক্তি রাখে। রামকান্ত রায়কে খুন করে পাবনায় পালিয়ে গিয়েছিল। ঢাকায় গিয়ে ধরা দিল। তাকে দেখতে গাঁ গঞ্জ ভেঙে পড়েছিল সেখানে।
সেসব শুনেছি। দিল্লীতে নিয়ে গিয়েছিল। ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পাবনার আশ্রম থেকে লোক গিয়ে কী সব কলকাঠি নেড়ে তাকে ছাড়িয়ে আনে।
রঙ্গময়ী মাথা নেড়ে বললেন, ছোট্ট করে বললি, কথাটা ফুরিয়ে গেল। কিন্তু সেদিন কী উত্তেজনা, কী তোলপাড়! তোর দাদু বোধহয় তিন দিন তিন রাত জলস্পর্শ করেনি, ঘুমোয়নি।
লোকটা যে হীরো ছিল তা তো আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু হীরোর মুখোশ আঁটা মানুষটার ভিতরের কথা জানতে চাই।
রঙ্গময়ী মাথা নেড়ে বললেন, কৃষ্ণর ভিতর-বার আলাদা ছিল না কখনো, ও তো তোদের যুগের মানুষ নয়, তোদের দলেরও নয়।
আমরা কি খুব খারাপ ঠাকুমা?
তোর খারাপ হওয়ার কথা তো নয় দাদু। খারাপ হবি কেন? কৃষ্ণ যার বাপ সে কি খুব খারাপ হতে পারে কখনো? তবে তোকে যে ভূতে পেয়েছে সে কথাও সত্যি। নইলে ওসব ছাইপাঁশ গিলে মাতলামি করে বেড়াতে পারিস কখনো?
তুমি জানো না, আমি কিন্তু ছেড়ে দিয়েছি।
সব জানি। ছেড়ে দিলি ভাল কথা, কিন্তু ধরেছিলি কেন? কোন দেবদাস রে তুই?
ধ্রুব একটু হাসল। কিছু বলল না।
রঙ্গময়ী বললেন, যদি ইচ্ছে ছিল না তবে মদ খেতি কেন? সেইজন্যই তো বলি তোদের ভিতর-বার এক নয়। তোরা কোন সাহসে কৃষ্ণর বিচার করিস?
নাঃ ঠাকুমা, তুমিও হিপনোটাইজড।
কৃষ্ণৰ কথাই শুনতে এসেছিস তো! শোন বলি, সে ভাবের মানুষ ছিল না, অলস চিন্তা করে সময় কাটানোর মানুষ ছিল না। সে সারাজীবন কাজ করেছে। জেল থেকে বেরিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাজে। ফের জেলে গেছে। বন্দী অবস্থাতেও সংগঠন করেছে। কত বদমাশ, পাজি, গুণ্ডা, চোর, ডাকাতকে স্বদেশী করে তুলেছে। প্রাণ হাতে করে চলতে হয়েছে তাকে। তোদের মতো বাবুগিরি করে সময় তো কাটায়নি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তোমার কৃষ্ণব চরিত্র তাহলে পালটাল কেন?
কে বলেছে পালটাল? তোরা তাকে বুঝতেই পারলি না বলে ওসব কথা বলিস। মন্ত্রী হয়েছিল বলে ওরই যেন সব দোষ। আমি তো বলি বাপু, কৃষ্ণর যা পাওনা ছিল তা দেশ ওকে দেয়নি। তোরা সেদিনের ছোঁড়া ওসব বুঝবি না। যা, গিয়ে মানুষটার পায়ের ওপর পড়ে থাক।
বলছো?
বলছি কি সাধে? বলাচ্ছিস বলে বলছি। ওর সম্পর্কে কেউ আকথা কুকথা বললে তার জন্যই আমার দুঃখ হয়। আহা বেচারা তো জানে না।
শোনো ঠাকুমা, আমি কৃষ্ণকান্তর মুখে কালি মাখাতে চাই না। সত্যিই চাই না।
তবে কী চাস?
ঠিক তোমরা যে চোখে লোকটাকে দেখ সেই চোখেই দেখতে চাই। কিছুতেই সেটা পারছি না। আমারও ইচ্ছে হয় লোকটাকে শ্রদ্ধা করতে, ভালবাসতে। পারি না। কেন পারি না বলো তো!
সেটা তুই বোঝ গিয়ে। আমাকে জ্বালাস না।
তোমার নাতবউ রেমিও অসম্ভব ভালবাসে শ্বশুরকে। নিজের বাপের চেয়েও বেশি। আমি অনেক বলেও টলাতে পারিনি।
তবেই বুঝে দেখ কৃষ্ণ কেমন মানুষ।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, তুমি বা রেমি বা আর সবাই লোকটার কেবল একটি দিক দেখতে পাও, দিকটা আলোকিত। কিন্তু ওঁর একটা অন্ধকার দিকও তো আছে। তোমরা সেটা দেখতে পাও না কেন?
কৃষ্ণর নামটাই কৃষ্ণ। তাছাড়া ওর মধ্যে আর কোনো অন্ধকার নেই। চিরকাল লোকে ওকে ঠকিয়েছে, ন্যায্য পাওনা দেয়নি, কলঙ্ক রটিয়েছে। কৃষ্ণ নির্বিকার। ভোগসুখ বলে ওর জীবনে কিছু নেই। কাশীতে গিয়ে আমার কাছে যখন ছিল তখন ভালমন্দ বেঁধে খাওয়াতে গেলে খুব বকত। বলত, দেশের লোক যতদিন⋯
আঃ ঠাকুমা, তোমার ঝাঁপ খুললে বন্ধ করা বড় মুশকিল।
তাহলে খোলাস কেন? বোস, চা করে আনি। মুখখানা তো শুকিয়ে আমের আঁটি হয়েছে দেখছি।
চা দাও।
আর কী খাবি?
যা দেবে।
রঙ্গময়ী কষ্টে উঠলেন। চা আর জলখাবার নিয়ে এসে ফের বসে বললেন, কী যে তোর হয় মাঝে মাঝে বুঝি না। বাপ যার অমন পিতৃভক্ত তার ছেলের এ দশা কেন হয়?
ধ্রুব আস্তে আস্তে আনমনে খাচ্ছিল। জবাব দিল না। খাওয়া শেষ করে বলল, একটা কথা ঠাকুমা।
বল না।
অনেক ভেবেচিন্তে মনে হচ্ছে, আমারই কোথাও একটা ভুল হয়ে থাকবে, দোষ কৃষ্ণকান্তর নয়, আমার।
তোদের কারোই দোষ নয় দাদু। মনটাকে পরিষ্কার কর, বুঝতে পারবি। কৃষ্ণ কখনো দশজনেরটা মেরে নিজের ঘর গোছায়নি। বরং নিজেরটা দিয়ে দশজনকে খুশি করতে চেয়েছে। আমার তো মনে হয় কৃষ্ণর আর একটু স্বার্থপর হওয়া উচিত ছিল। তাতে ভাল হত।
ধ্রুব বসে রইল চুপ করে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ঠাকুমা, নোটন এ বাড়িতে আসে?
নোটন! কেন বল তো!
বলোই না।
রঙ্গময়ীর মুখে ভূকুটি দেখা দিল। মাথা নেড়ে বললেন, নোটনের অত সাহস নেই।
তুমি কি তাকে ঘেন্না করো?
ঘেন্নার কাজ করে বেড়ালে তো ঘেন্না করাই উচিত।
তুমি কি জানো নোটনের সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব উঠেছিল বলে….?
রঙ্গময়ী ধমক দিয়ে বললেন, সব জানি। পাপ।
তার মানে?
নোটনের সঙ্গে তোর বিয়ে হয় নাকি? আত্মীয়তায় আটকায় না?
লতায় পাতায় আত্মীয়। সেকথা বলছি না। বলছিলাম বিয়ের প্রস্তাব উঠেছিল বলে তার দাদাকে কৃষ্ণকান্ত কী করেছিলেন জানো? লোকটার আজও কোনো খোঁজ নেই।
বললাম তো, সব জানি। কৃষ্ণ নিজে এসে জানিয়ে গেছে। ঠিক করেছে।
দোষটা কী বলো তো!
বিয়ের প্রস্তাব তোলাই দোষের।
নোটন যে জীবন যাপন করে তার জন্য কি সে দায়ী? না দায়ী কৃষ্ণকান্ত?
রঙ্গময়ী বার্ধক্যের তেজহীন দুই চক্ষু যথাসম্ভব তীক্ষ করে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বললেন, নোটনকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। সে তার কর্মফল ঠিক ভোগ করবে।
ধ্রুব ধীরে ধীরে উঠল। তারপর বলল, তুমি নোটনকে যত ঘেন্না করো কৃষ্ণকান্ত ততটা করেন না। তিনি নোটনকে…
ধ্রুব মাঝপথে থামতেই রঙ্গময়ী ব্যঙ্গের স্বরে বললেন, তিনি নোটনকে⋯বল, বল না, থামলি কেন?
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে বলা যাবে না। কিন্তু শুনে রাখো, তিনি নোটনকে আমার পিছনেও লেলিয়ে দিয়েছেন।
রঙ্গময়ী অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, তাই যদি হয় তবে জেনে রাখ, ওর মধ্যেও কিছু মঙ্গল আছে।
নোটন না তোমার নাতনী? আত্মীয়?
বটেই তো। এমন আত্মীয় যে পরিচয় দিতে ঘেন্না হয়। এখন বল তো ঘটনাটা কী? নোটন তোকে পেল কোথায়?
আর একদিন ঠাকুমা। আজ চলি।
না বললে বলিস না। কিন্তু নোটনের মুখ থেকে কথা আমি টেনে বার করবই।
ধ্রুব ম্লান হেসে বলে, তোমাদের নিয়ে পারা যাবে না ঠাকুমা, কিছুতেই পারা যাবে না। যত দিন যাচ্ছে তত মনে হচ্ছে দিস ওয়ার্ল্ড বিলংস টু কৃষ্ণকান্ত, ওনলি কৃষ্ণকান্ত। আমরা তোমাদের কাছে ফাউ, ফালতু। আজ চলি ঠাকুমা, আবার আসব।
ধ্রুব বাড়ি ফিরল একটু গাঢ় রাতে। ঘড়িতে বোধ হয় দশটা। ফটকের ধারেই দাঁড়িয়ে ছিল জগা। নিঃশব্দ শ্বাপদের মতো। বলল, এই ফিরলে?
ফিরলাম। কিছু বলবে জগাদা?
একটু ওপরে যাও। কর্তাবাবু তোমার জন্য বসে আছেন।
হঠাৎ কী ব্যাপার?
কি করে বলব? আমরা চাকরবাকর মানুষ।
চাকর বলে চিনতে পারছো নিজেকে এতদিনে?
বরাবরই চিনি।
চিনলে অনেকদিন আগেই নিজের ভিতরের চাকরটাকে নিকেশ কৱে কৃষ্ণকান্তর তাঁবেদারি ছেড়ে চলে যেতে। তুমি যে চাকর, তোমাকে যে চাকর করে রাখা হয়েছে সেটা বুঝতেই পারোনি।
বুঝলাম। এখন ওপরে যাও। কর্তাবাবু তোমার জন্যই বসে আছেন। সকালের প্লেনে দিল যাবেন। তাড়াতাড়ি ঘুমোনো দরকার। যাও।
ধ্রুব ধীর পায়ে ওপরে উঠে কৃষ্ণকান্তর অফিসঘরে উঁকি দিল। কৃষ্ণকান্ত একখানা বই পড়ছিলেন। চোখ তুলে তাকালেন।
কিছু বলবেন আমাকে?
কষ্ণকান্ত স্মিত মুখে বললেন, এসো, ভিতরে এসো।
ধ্রুব খুব বিস্মিত পায়ে ঢুকল।
বোসো, বোসো।
ধ্রুব বসল।
কাল সকালে আমাকে একবার দিল্লি যেতে হচ্ছে।
জগাদা বলছিল।
ফিরব কবে তার ঠিক নেই। তারপর…
ধ্রুব অপেক্ষা করতে লাগল। কৃষ্ণকান্ত বেশ কিছুক্ষণ থেমে ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, অনেক কাজ।
কাজ! ধ্রুব প্রতিধ্বনি করল মাত্র। কৃষ্ণকান্তর কথাবার্তা তার বেশ অসংলগ্ন লাগছিল।
কৃষ্ণকান্ত স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, ছেলে দুটো বাইরে রয়ে গেল। লতুটার কথাও ভাবা দরকার।
ধ্রুব একটু ধৈর্যহীন গলায় বলে, আমাকে কি কিছু করতে হবে?
কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, সেইজন্যই ডাকা।
বলুন কী করতে হবে।
তোমার দাদা আর ভাইয়ের একটু খোঁজ নাও। ওদের চিঠিপত্র অনেককাল পাই না।
দাদাকে তো আপনি ত্যাজ্যপুত্র করেছেন।
আমার ত্যাজ্যপুত্র হলেও সে তোমার ত্যাজ্য ভাই তো নয়।
ঠিক আছে। খবর নেবো। লতুর কথা কী বলছিলেন?
লতুর বিয়ে দেওয়া দরকার।
ও। সে ক্ষেত্রেই বা আমার করণীয় কী?
করণীয় অনেক। যদি করো।
পাত্র দেখা তো!
হ্যাঁ। উপযুক্ত ঘর বর চাই। কাজটা সহজ নয়।
দেখব। আর কিছু?
আপাতত তোমাকে নাসিক যেতে হবে না।
প্রোগ্রামটা কি ক্যানসেল হল?
হল। ভেবে দেখলাম এসময়ে তোমাকে নাসিক পাঠালে এদিকে অসুবিধে দেখা দেবে। দিব্য এখনও ছোটো। তাকে নিয়ে বউমা অত দূরে যেতে পারবে না।
এখানে থেকে আমি কী করব?
সেটা তোমার ওপর নির্ভর করছে।
তার মানে?
তুমি একটা চাকরি করছে শুনেছি। চাকরি জিনিসটা আমার পছন্দ নয়। একটু বাঁধা কাজ, একটু বাঁধা মাইনে, ওতে মানুষ ক্ষুদ্র হয়ে যায়, খণ্ডিত হয়ে যায়, জীবনের স্বাদ পায় না। আমি কেমন চাই জানো? কাজ অফুরন্ত, আয় অফুরন্ত, আয়ু অফুরন্ত। ইংরিজীতে একটা কৃপণ-কথা আছে, কাট ইত্তর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ। আর ঠাকুর ঠিক উল্টো করে বলতেন, কাট দি ক্লথ অ্যাকর্ডিং টু ইওর কোট।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
বোঝা সহজও নয়। যাক গে, সবটাই তোমার ওপর নির্ভর করে। তুমি চাইলে চাকরিই করবে, আমার সাজেশন যদি নাও তো বলব, ব্যবসা কর। একটা কোনো প্রোডাকশনে নামো। তাতে এমপ্লয়ী না থেকে নিজেই এমপ্লয়ার হতে পারবে।
ভেবে দেখব।
দেখ। আর একটা কথা।
বলুন।
বউমা খুব কান্নাকাটি করেছে আজ।
কেন?
তোমার জন্য।
আমার জন্য?
হ্যাঁ। প্রথমে আমাকে বলতে চায়নি। কিন্তু শেষ অবধি একটু বলেছে। তোমার নাকি একটা ডেথ উইশ হয়েছে আজকাল।
ধ্রুব চোখ নামিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়াল। তারপর বলল, ওটা কিছু নয়।
কৃষ্ণকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তাহলেই মঙ্গল। বাবা হয়েছে দায়িত্বও অনেক। মরলেই মরা যায় বটে, কিন্তু সেটা প্রকৃতির আইন নয়, জৈবিক চাহিদাও নয়। বাবা পিতামহের কাছ থেকে পাওয়া এই জীবন যতটা সম্ভব প্রলম্বিত করাই হচ্ছে জৈবিক আকৃতি। বউমা আমার কাছে কথাটা ভেঙেছে বলে তাকে আবার বকো না, সে বড় নরম মানুষ। পাজি হলে চেপে রাখতে পারত।
আজ্ঞে।
সে তোমার অতিশয় অনুগত। নিশ্চয়ই সেটা টের পাও?
ও সব কথা থাক।
আচ্ছা থাক, যে কথাটা বলছিলাম। কাল দিল্লি যাচ্ছি বিশেষ একটা কাজে। খুব ব্যস্ত থাকব। হয়তো আমার চিঠিপত্র পাবে না। ফিরতেও দেরি হবে। সেক্ষেত্রে তোমাকে কিছু দায়িত্ব নিতে বললে অসন্তুষ্ট হবে না তো!
ধ্রুব এবার কৃষ্ণকান্তর দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা আঁচ করতে চেষ্টা করল। কৃষ্ণকান্তকে বেশ প্রশান্ত, পরিতৃপ্ত ও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। দিল্লিতে একটা বড় রকমের অফার আছে নিশ্চয়ই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব নাকি? সেটাই সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী এবং হাই কম্যাণ্ডের সঙ্গে সম্ভবত একটা আঁতাত হয়েছে।
ধ্রুব বলল, অসন্তুষ্ট হব কেন?
জগা রইল, অন্য সবাই রইল। বউমা তো আছেই।
ঠিক আছে।
এখনই উঠো না। একটু বসো।
ধ্রুব অপেক্ষা করল। কৃষ্ণকান্ত তাঁর দেরাজের চাবি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটা রাখো। নিচের দেরাজে আরও কিছু চাবি পাবে। আলমারি, সিন্দুক এই সবের।
এগুলো আমাকে দিচ্ছেন কেন?
যদি দরকার হয়?
আপনার সব জিনিস, আমি হাত দিতে যাব কেন?
হাত দেওয়ার কথা বলিনি। চাবি নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোন মানে হয় না বলে তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। রাখো।
অনিচ্ছের সঙ্গে ধ্রুব হাত পেতে চাবি নিয়ে বলে, আর কিছু বলবেন?
হ্যাঁ। এনিমি প্রপার্টির কিছু টাকা পেয়েছি। সেটা ক্যাশ করে আলমারিতে রাখা আছে। যদি কোন ব্যবসার কথা ভাবো তাহলে নিও। আমার অনুমতি দেওয়া রইল।
সে টাকা নিয়ে আত্মীয়দের কি সব ঝামেলা চলছে না?
এখন আর নেই। ঝামেলা হলেও গ্রাহ্য করো না। টাকা আমার। ওরা প্রাপ্যের অনেক বেশি আমার কাছ থেকে পেয়ে এসেছে।
ঝামেলা আমার ভাল লাগে না।
কৃষ্ণকান্ত একটু হেসে বললেন, এ ব্যাপারে আমি আর কিছু বলতে চাই না। তবে তোমার যদি ইচ্ছে করে তাহলে আত্মীয়দের ওই টাকা থেকে কিছু ভাগ দিতেও পারো। তাতে তোমার সুনামই বৃদ্ধি পাবে।
আমার সুনাম নেই।
আমারও বোধহয় নেই। তবে সকাজ করে গেলে একদিন না চাইতেও সুনাম হয়ে যায়। প্রসঙ্গটা থাক। মোট কথা যা ভাল বুঝবে করবে। আমি দৃরে যাচ্ছি, সেখানেই থাকতে হবে আপাতত। নিজের বুদ্ধি বিবেচনা খাটিয়ে চলো।
আচ্ছা।
এবার যাও। বিশ্রাম করো।
ধ্রুব উঠল। ঘরে আসবার পথে সে ভারী অন্যমনস্ক রইল। কৃষ্ণকান্ত কি সত্যিই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হচ্ছেন?