॥ ১০৬ ॥
কৃষ্ণকান্ত দিল্লি চলে যাওয়ার পর ধ্রুব কিছুদিন বুঝতে পারল না তার কী করার আছে বা কী করা উচত। আলমারি এবং সিন্দুক খুলে সে বিস্তর দলিল দস্তাবেজ, টাকা এবং শেয়ারের কাগজ ইত্যাদি পেল। কিছুই সরাল না। কৃষ্ণকান্ত তাকে একরারনামা দিয়ে গেলেও নিজের ভিতরে কোনো অধিকারের জোর বোধ করল না সে। সবই জায়গামতো আবার যেমন-কে-তেমন রেখে দিল। কৃষ্ণকান্ত হয়তো তাকে লোভ দেখাচ্ছেন। সংসারমুখী গৃহস্থে পরিণত করতে চাইছেন। কিন্তু ধ্রুব জানে, যতদিন কৃষ্ণকান্ত বেঁচে আছেন ততদিন কোনো উত্তরাধিকারই তাতে বর্তাবে না। রাশ সবসময়ই অলক্ষে থাকবে কৃষ্ণকান্তর হাতে। সংসারের কর্তা হওয়ার অবশ্য কোনো সাধই নেই ধ্রুবর। কর্তা হওয়ার অনেক অসুবিধে, অনেক ভজঘট, অনেক মন রেখে চলা। একথাও ঠিক যে, কৃষ্ণকান্তও প্রকৃত অর্থে সংসারী ছিলেন না। তাঁর জীবনের প্রায় সবটাই বহির্মুখী, বৃহৎ জীবন। ঘর-সংসারে তাঁর একটা নাম-লেখানো ছিল মাত্র। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর খানিকটা হাল তাঁকে ধরতেই হয়েছিল এবং তখন দেখা গেল, সংসার চালানোটাও তাঁর কাছে শক্ত কিছু নয়। সব ব্যাপারেই তাঁর এক অনায়াস সিদ্ধি।
ধ্রুব এইসব ভাবে আর মাঝে মাঝে কৃষ্ণকান্তর চেয়ারে বসে অনেকক্ষণ ধরে কৃষ্ণকান্তর মন এবং চোখ নিয়ে সবকিছুকে বিচার করার চেষ্টা করে। লোকটাকে বুঝতে চায়।
রেমি এসে বলে, এখানে কেন ভূতের মতো বসে থাকো বলো তো?
সিংহাসনটা কেমন তা ফিল করার চেষ্টা করি।
সিংহাসন হবে কেন?
সিংহাসনই তো। হি ইজ এ কিং ইন হিজ ওন কিংডম। উনি আমাকেই যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করে গেছেন। তাই নেট প্র্যাকটিস করছি।
তুমি কোনোদিন ওরকম হতে পারবে না। তোমার সেই মুরোদই নেই।
কৃষ্ণকান্তর মতো থার্ডরেট পলিটিসিয়ান হওয়ার ইচ্ছেও আমার নেই।
শ্বশুরের পক্ষ নিয়ে রেমি কিছুক্ষণ তর্ক করার চেষ্টা করে তারপর হাল ছেড়ে রণে ভঙ্গ দেয়। আজকাল সে ধ্রুবকে একেবারেই চটাতে চায় না।
কৃষ্ণকান্ত মাঝে মাঝে দিল্লি থেকে ট্রাংক কল করেন। কথা হয় রেমির সঙ্গেই। কী কথা হয় তা ধ্রুব জানে না।
তবু একদিন ধ্রুব রেমিকে জিজ্ঞেস করল, তোমার শ্বশুরের মন্ত্রী হওয়ার আর কদ্দূর? কাগজে তো কোনো উচ্চবাচ্য নেই দেখছি।
রেমি বিরস মুখ করে বলে, তোমার বুঝি সে জন্য ঘুম হচ্ছে না? শ্বশুরমশাইকে ঠিকই মন্ত্রী করা হবে।
কোন দফতরের সর্বনাশ করবেন তা শুনেছো?
সেটা নিয়েই একটু মতের অমিল হচ্ছে। প্রাইম মিনিস্টার ওঁকে রাষ্ট্রমন্ত্রী করতে চাইছেন। উনি চাইছেন ক্যাবিনেট স্ট্যাটাস।
ও বাবাঃ, একেবারে ক্যাবিনেট মন্ত্রী! সাঙ্ঘাতিক কথা।
ওঁকে তাই করা হবে। কথা এগোচ্ছে।
ধ্রুব একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বিচিত্র নয়। এ দেশে সবই সম্ভব।
একদিন কৃষ্ণকান্তব ট্রাংক কল এল রাত এগারোটায়। রেমি গিয়ে ফোন ধরল। কিছুক্ষণ কথা বলার পরই দৌড়ে এসে ধ্রুবকে ডাকল, ওগো, শ্বশুরমশাই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। শীগগীর যাও।
আমার সঙ্গে কী কথা?
যাও না, উনি কী বলবেন যেন তোমাকে।
ধন্য হলাম। যাচ্ছি, আর হাতে খিমচি দিও না।
ধ্রুব গিয়ে বৈঠকখানার এক্সটেনশন ধরল।
কিছু বলবেন?
তেমন কিছু বলার নেই। কেমন আছো সব?
ভালোই তো।
আজ প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে ফাইন্যাল কথা হয়ে গেল। আমাকে উনি ইনফর্মেশন অ্যান্ড ব্রডকাস্টিং দিচ্ছেন।
ধ্রুব একটুও উৎসাহ বোধ না করে বলল, তাই নাকি?
বুঝতেই পারছো, এখন স্থায়ীভাবে দিল্লিতেই থাকতে হবে। তোমাদের সঙ্গে হুট করে দেখা হবে না। সংসারের দায়দায়িত্ব এখন সবই তোমার হাতে।
এদিকে সবই ঠিক আছে।
বউমার কাছে সব খবরই পাই। আজ হঠাৎ তোমার গলার স্বর শুনতে ইচ্ছে করল। তাই ডাকলাম। ঘুমোচ্ছিলে নাকি?
না। বই পড়ছিলাম।
দিব্য কি জেগে আছে?
না, অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে।
জেগে থাকলে ওর সঙ্গে একটু কথা বলার চেষ্টা করতাম। আমাকে খুব চিনে গিয়েছিল। আফটার অল রক্তের টান তো, শিশুরাও বোঝে।
এই অপ্রাসঙ্গিক কথায় ধ্রুব বিরক্ত হল। বলল, আর কিছু বলবেন?
না। বেশি কথা কিছুই বলার নেই। এই একটু আগে প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে বৈঠক শেষ হল। ফিরে এসেই ফোনটা করলাম। এখন একটু বেড়াতে বেরোবো।
ও। বেশ তো।
যাও, তুমি গিয়ে ঘুমোও। আর একটা কথা।
বলুন।
আলমারি সিন্দুক সব খুলে দেখেছো নাকি?
দেখেছি।
কাগজপত্র সব দেখেছো?
না, সব দেখা হয়নি।
দেখো। দলিল-দস্তাবেজ সব তুমি বুঝবে না। আমাদের উকিল ভট্টাচার্যের কাছে সব বুঝে নিও। ওকে আমার বলা আছে।
আমার বুঝে কী হবে? বুঝে রাখা ভাল। কখন কিসের দরকার হয় কে জানে।
আমার তো বিষয় সম্পত্তির কোনো প্রয়োজন নেই।
তোমার না থাক দিব্যর আছে। তাছাড়া সম্পত্তি, বিষয়, টাকা এসব হাতে থাকলে তুমি পাঁচজনের উপকারও করতে পারবে, যদি চাও। এগুলো এমনিতে কিছু নয়, কিন্তু কাজে লাগাতে পারলে এগুলো মস্ত সহায়।
আপনার জিনিস আপনিই কাজে লাগাবেন।
কৃষ্ণকান্ত একটু হেসে বললেন, এইসব সম্পত্তির বেশির ভাগই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আমি ওকালতি করে খুব একটা অর্জন করিনি। ওকালতি করলে অবশ্য পারতাম। তুমি যদি কাজে লাগাতে না চাও তবে অন্তত রক্ষণাবেক্ষণ কোরো।
দেখা যাবে।
ধৈর্য হারিও না। সব দিকে চোখ রেখে চললে ভাল হবে। আর বউমাকে কষ্ট দিও না! অমন মেয়ে দুটি হয় না। কী ধৈর্য, সহ্য আর অধ্যবসায়। সে যখন মরতে বসেছিল তখন আমি দুনিয়া হারিয়ে ফেলেছিলাম। বুঝলে?
বুঝেছি। এ সবই আপনি আমাকে আগে বলেছেন।
আবার বললাম। বারবার শুনলে কথাটা মনে গেঁথে যায়।
তাহলে ছাড়ছি।
হ্যাঁ।
ধ্রুব ফোন রেখে দিল। কোনো জরুরী কথা নয়, তবু লোকটা এত রাতে তাকে ডেকে এই খেজুরে আলাপ কেন করল তা বুঝতে পারল না সে।
রেমি এতক্ষণ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ফোন রাখতেই বলল, একবার ওঁকে বাবা বলে ডাকলে না?
ধ্রুব অবাক হয়ে বলে, ডাকার কী হল?
ডাকতে হয়।
তার মানে?
ওঁর খুব ইচ্ছে ছিল তোমার মুখে একবার বাবা ডাকটা শোনেন।
তাই নাকি?
আমাকে কী বললেন জানো? বললেন, ধ্রুবর মুখে বহুকাল বাবা ডাক শুনিনি, ওকে একটু ডেকে দাও তো বউমা, কথা বলি।
ওসব সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার ওঁর আছে নাকি?
না থাকলে বলবেন কেন?
ওঁকে বাপ ডাকার অনেক লোক আছে রেমি। আমি না ডাকলেও ওঁর চলবে।
ছিঃ, ও কী কথা?
কিছু খারাপ নয়। ওঁকে বহু লোক দায়ে পড়ে বাপ ডাকে। আরো বহু লোক ডাকবে। আর আমরা—আমরা ওঁর কে? ‘ছেলেবেলায় লোকটাকে মনে হত বাড়ির পেয়িং গেস্ট। সম্পকটা তো হুট করে তৈরি হয় না, ধীরে ধীরে গড়ে নিতে হয়। উনি তা গড়েননি।
রেমি ছলছল চোখে চেয়ে থেকে বলল, তুমি মানুষকে কষ্ট দিয়ে খুব আনন্দ পাও, তাই না?
জানোই তো আমি স্যাডিস্ট।
মোটেই নয়। স্যাডিস্টরা অন্যরকম হয়। তুমি সেরকমও নও।
এখন ঘুমোতে চলল।
তুমি ভীষণ নিষ্ঠুর।
নিষ্ঠুর হয়ে থাকলে সেটাও কৃষ্ণকান্তর কাছ থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া।
রেমি আর তর্ক করল না।
পরদিন সকালে ফের দিল্লি থেকে ট্রাংক কল এল। কৃষ্ণকান্ত নন, তাঁর সেক্রেটারি ফোন করছে, ধ্রুব চৌধুরিকে চাই। আর্জেন্ট মেসেজ।
ধ্রুব গিয়ে ফোন ধরল, কী হয়েছে?
মিস্টার চৌধুরি ভীষণ অসুস্থ। হাসপাতালে রিমুভ করা হয়েছে। আপনাদের এক্ষুনি আসা দরকার।
কী হয়েছে? স্ট্রোক?
ঠিক বুঝতে পারছি না।
কণ্ডিশন কি খুব সিরিয়াস?
খুব। ডাক্তাররা কোনো ভরসা দিতে পারছেন না। ওর একটা চিঠি রয়েছে, আপনাকে। অ্যাড্রেস করা। আর একটা পুলিশকে।
পুলিশকে?
হ্যাঁ। আপনি চলে আসুন। ফোনে সব বলা যাবে না।
ফোনটা রেখে ধ্রুব কিছুক্ষণ বুঝতে পারল না, কী করবে বা কী করা উচিত। একধরনের পাথুরে অসাড়তা তার সর্বাঙ্গে। বোঝা ভার।
জগা কখন এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল পিছনে। হঠাৎ সে ধ্রুবর হাতটা ধরে একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কী হয়েছে?
ধ্রুব তার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল। কিছু বলল না।
কর্তার কিছু হয়েছে?
ধ্রুব খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, অবস্থা খারাপ। হাসপাতালে।
জগা কোনো আহা উহু করল না, বেশি, জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যেও গেল না। বরং সত্যিকারের কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিয়ে এক ঝটকায় টেলিফোন তুলে ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইনস-এ ডায়াল করে বিকেলের ফ্লাইটে দুটো সীট বুক করে ফেলল। তারপর ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলল, বউমাকে কিছু জানিও না। চেঁচামেচি করবে। অফিসের জরুরী কাজে যাচ্ছে বলে বাক্স গুছিয়ে নাও। আমি তোমার সঙ্গে যাবো।
ধ্রুব স্বস্তির শ্বাস ফেলল। জগাদা সঙ্গে থাকলে অনেকখানি ভরসা।
জগা জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বলল? স্ট্রোক?
কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
জগা বিশেষ বিচলিত হল না। কাজের মানুষরা হয়ও না। তাদের কাছে যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। ধ্রুবকে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, যাও গুছিয়ে নাও। বেশি কিছু নিও না। দুটো জামা, দুটো প্যান্ট, গেঞ্জি, আণ্ডারওয়ার আর পাজামা। দিল্লিতে এখন খুব গরম, একটা টুপি নিও। বউমাকে কিছু বোলো না। আমি টিকিট কাটতে এয়ারলাইনস অফিসে যাচ্ছি। কেটে না রাখলে পরে গড়বড় হতে পারে।
ধ্রুব ঘরে এল।
রেমি উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কার টেলিফোন গো?
অফিসের। আজ একটু বাইরে যেতে হবে।
কোথায়?
জয়পুর।
ক’দিনের জন্য?
ঠিক নেই। দেখি। তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো।
তোমাকে ওরকম দেখাচ্ছে কেন?
ধ্রুব আনমনে একটা কম্পিত হাত নিজের মুখে বুলিয়ে নিল। রেমির কথাটার জবাব না দিয়ে জগার কথাটা মুখস্থ বলে গেল, দুটো প্যান্ট, দুটো জামা, গেঞ্জি, আণ্ডাওয়্যার, পাজামা আর একটা টুপি বড় অ্যাটাচি কেসটায় গুছিয়ে দাও।
কৃষ্ণকান্ত হাসপাতালে, এই সংবাদটা ধ্রুবকে তেমন চঞ্চল করেনি। যেটা রহস্যময় তা হল, কৃষ্ণকান্ত ধ্রুবকে একটি এবং পুলিশকে একটি চিঠি লিখেছেন। তাঁর সেক্রেটারি বলেছে, টেলিফোনে সব কথা বলা যাবে না। এইসব ব্যাপারকে ধ্রুব মনে মনে নানাভাবে উল্টেপাল্টে মিলিয়ে জুলিয়ে দেখেছিল। ভাবতে ভাবতে বড্ড বেশি অস্থির আর চঞ্চল লাগছিল তার।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াল। অনেক সিগারেট খেল পরপর। দুপুর গড়িয়ে বাড়ি ফিরে সে খুব অনিচ্ছের সঙ্গে কয়েক গ্রাস ভাত মুখে তুলল মাত্র। রেমি খুব লক্ষ করছে তাকে। সেই দৃষ্টির সামনে আরো অস্বস্তি বোধ করছে ধ্রুব।
রেমি খুব সন্দেহের গলায় বলল, তোমার একটা কিছু হয়েছে।
কিছু না।
টেলিফোনটা পাওয়ার পর থেকেই তোমাকে অন্যরকম দেখছি।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, অফিসের একটা প্রবলেম নিয়ে ভাবছি।
অফিস নিয়ে তুমি এত ভালো নাকি?
মাঝে মাঝে ভাবতে হয় বৈকি।
আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছো না তো?
আরে না। এটা অন্য ব্যাপার।
খেয়ে উঠে ধ্রুব কিছুক্ষণ ঘুমের ভান করল। করতেই হল, নইলে রেমি আরো অনেক প্রশ্ন করবে।
বিকেল চারটের মধ্যেই জগা এসে গেল। মুখ থমথমে গম্ভীর। চোখ টকটকে লাল। প্লেন ছাড়তে অনেক দেরী, তবু জগা তাড়া দিয়ে বলল, চলো চলো, অনেক ঝামেলা আছে।
একটু হাঁফ ছাড়ল ধ্রুব। রেমির আওতা থেকে একটু দূরে গিয়ে তার ভালই লাগবে।
গাড়ি এয়ারপোর্টের পথে রওনা হতেই জগা বলল, শেষ খবরটা পেয়েছো?
না। কী খবর?
জগা একবার ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, নেই।
মানে?
তোমার বাবা বেঁচে নেই।
সামনের সীটটা একবার আঁকড়ে ধরল ধ্রুব। তারপর শ্লথ শরীরে বসে বলল, কখন?
দুপুরে মারা গেছেন।
কিছু বলল কী হয়েছিল?
জগা মাথা নাড়ল, না। ওখানে না গেলে কিছু বোঝা যাবে না।
ধ্রুব খুব ধীরে ধীরে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিল। কৃষ্ণকান্তর মৃত্যুটা তার খুব স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল না। কাল রাতে কৃষ্ণকান্ত নিজে যেচে তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই কথাতেও কিছু অসংলগ্নতা ছিল। সব কিছু মিলে একটা দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। কিন্তু কেন? কেন? তাঁর তো কোনো ফ্রাস্ট্রেশন ছিল না!
দিল্লি পৌঁছোতে সন্ধে হয়ে গেল। তবে গ্রীষ্মকাল বলে এবং দিল্লি কলকাতার পশ্চিমে বলে একটু দিনের আলোর আভা তখনো ছিল। সেই গোধূলিতে ধ্রুব দিল্লিতে নামল। দেখল চারদিকে মৃত্যুর বিবর্ণতা।
এয়ারপোর্টে কৃষ্ণকান্তর সেক্রেটারি উপস্থিত ছিলেন গাড়ি সহ। ধ্রুব গাড়িতে উঠতেই উনি মুখ-আঁটা একটা খাম ধ্রুবর হাতে দিয়ে বললেন, এটা আগে পড়ে নিন। মনে হচ্ছে চিঠিতে জরুরী কোনো কথা আছে।
কি করে বুঝলেন? চিঠিটা আপনি পড়েছেন?
সেক্রেটারি মাথা নেড়ে বললেন, না। তবে কাল রাতে উনি আমাকে হঠাৎ বললেন, আমার ছেলেকে লেখা একটা চিঠি তোমার হেফাজতে রইল। মানুষের কখন কী হয় বলা যায় না। যদি আমার হঠাৎ কিছু হয় তবে আমার ছেলেকে সবার আগে খবর দিও। চিঠিটা পড়বার পর সে যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে।
এ কথা উনি বললেন?
হ্যাঁ। প্রথমটায় আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম শুনে। উনি খুব সেন্টিমেন্টাল মানুষ ছিলেন না যে মৃত্যু নিয়ে বিলাসিতা করবে।
আপনার খটকা লাগেনি?
লেগেছিল। কিন্তু বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয়নি।
ধ্রুব চিঠিটা খুলল।
প্রিয় ধ্রুব, ঠাকুর তোমার মঙ্গল করুন। আজ তোমার জনা যত শুভকামনা করা যায় সবই করিলাম। ঠাকুর তোমাকে রক্ষা করিবেন, আনন্দে রাখিবেন, আয়স্মান করিবেন—এই আশা লইয়া আজ বিদায় হইতেছি।
বিদায় লওয়াটা কিছু নাটকীয় হইল। কিন্তু যাহা বুঝিতেছি, স্বাভাবিকভাবে এই জীবনের উপর যবনিকাপাত হইতে এখনো বহুদিন লাগিবে। আমার রক্তচাপ বা হৃদরোগ আছে বটে, কিন্তু তবু এই শরীরের ভিত স্বাধীনতার পূর্বে ভেজালহীন খাদ্য ও পরিষ্কার জলবায়তে রচিত হইয়াছিল। ব্রিটিশের জেলখানায় ইহার উপর অনেক উপদ্রব গিয়াছে এবং তাহাতে এই দেহ বরং আরো পাকাপোক্ত হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু এখন এই বাঁচিয়া থাকার উপর একটি যতিচিহ্ন টানিয়া দেওয়া একান্তই প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। সেই প্রয়োজনটি হইল তুমি।
হিসাব কষিয়া দেখিয়াছি গত পাঁচ বৎসর তুমি আমাকে একবারও পিতৃ সম্বোধন কর নাই। বউমার কাছে জানিয়াছি, আমার আড়ালেও তুমি আমাকে বাবা বলিয়া উল্লেখ কর না। ইহাতে আমার দুঃখের কিছুই নাই। আমার প্রতি তোমার মনোভাব অনুকূল নহে তাহা জানি। আমার ভাবপ্রবণতা বিশেষ নাই, কাহার স্নেহ পাইলাম বা পাইলাম না তাহা লইয়া বড় একটা মাথাও ঘামাই না। কিন্তু মানুষকে একসময়ে পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবিতেই হয়। আমার জীবন বারো আনা কাটিয়া গিয়াছে, কাজেই এখন নিজেকে লইয়া ভাবিবার কিছুই নাই। কিন্তু এখন কী বা কাহাকে রাখিয়া যাইতেছি তাহা একটু হিসাব করিতে হয়। তোমাকে যতটুকু বুঝিয়াছি, তাহাতে অনুমান হয় তোমার মদ্যপান বা অন্যান্য বিরূপ আচরণ আমার বিরুদ্ধে একটি অপ্রত্যক্ষ বিদ্রোহ। কিন্তু সেই বিদ্রোহের মূল কোথায় তাহা বহু চিন্তা করিয়াও সঠিক সন্ধান পাই নাই। তোমার সহিত আমার প্রজন্মগত ব্যবধান বা জেনারেশন গ্যাপই বোধহয় সে জন্য দায়ী। কিন্তু এটুকু বুঝিতে অসুবিধা নাই যে, যতদিন আমি বাঁচিয়া আছি ততদিন তুমি সুখী হইবে না। আমার তিন পুত্রের মধ্যে কেহই বোধহয় সুখী নয়। এবং সেই জন্য বোধহয় প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে কমবেশি আমিই দায়ী। আজকাল এই জন্য বড় আত্মগ্লানি বোধ করিতেছি। সত্য বটে, সমাজে আমার প্রতিষ্ঠা আছে, সম্মানও আছে, নিন্দাও বড় কম নাই। কিন্তু নিজের পুত্রদের কাছ হইতে আমি যাহা পাইয়াছি তাহা অবিমিশ্র ভীতিমিশ্রিত ঘৃণা। কেন এই বিদ্বেষ জন্মাইল তাহার কারণ অনুসন্ধান করিয়া কিছুই লাভ নাই। কিন্তু এইটা বুঝিতেছি, এই ঘৃণা ভয় ও বিদ্বেষ আর তোমাদের মন হইতে সম্পূর্ণ মুছিয়া ফেলা যাইবে না। যেমন নিজেকে এই পরিণত বয়সে আর আমূল পরিবর্তনও আমি করিতে পারিব না। তিন পুত্রের কথা কহিতেছি বটে, কিন্তু আমার প্রধান সমস্যা তোমাকে লইয়াই। পিতৃহৃদয়ে সন্তানবিশেষের প্রতি পক্ষপাত থাকিবার কথা নহে। আমারও না থাকিবার কথা। কিন্তু আমার জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্র নিজেদের বিপন্ন করে নাই। জ্যেষ্ঠ ঘোরতর একটি অন্যায় কাজ করিয়াছে বটে, কিন্তু সে নিজে নিজের দায়িত্ব লইতে জানে। কনিষ্ঠটি—যতদূর খবর পাই—তাহার মতোই লায়েক হইয়া উঠিয়াছে। কেবল তুমিই ভিন্নরকম। তিনজনের মধ্যে তুমি ছিলে উজ্জ্বলতম। আবার তুমিই সবচেয়ে বেশী চঞ্চল ও অবিমৃষ্যকারী। সম্ভবত সেই জন্যই তোমাকে লইয়া যত ভাবিয়াছি তত আর কাহাকেও লইয়াই ভাবি নাই। আর এইরূপে আমার চিন্তারাজ্যে তুমি যত অনুপ্রবেশ করিয়াছ ততই তোমার প্রতি এই পিতৃহৃদয় বিগলিত হইয়াছে। আমার বাহিরটা যতই পাষাণনির্মিত বলিয়া মনে হউক না কেন, এ জীবনে আমি আপনজনের স্নেহ কমই পাইয়াছি। বাবা আমাকে বড় ভালবাসিতেন, কিন্তু তাঁহাকেই বা কতটুকু পাইয়াছি? তাই হৃদয়টি বড় স্নেহবুভুক্ষু হইয়া রহিয়াছে। সেই স্নেহক্ষুধা নানাজনকে নানা সময়ে অবলম্বন করিতে চাহিয়াছে, কিন্তু আশ্রয় মিলে নাই। সর্বাপেক্ষা অধিক যাহার স্নেহের জন্য আমার কাঙালপনা ছিল সে তুমি। কতবার যে আমার তাপিত হৃদয় ভিতরে ভিতরে তোমার দরজায় স্নেহ ভিক্ষার আশায় দাঁড়াইয়া থাকিয়াছে সে ইতিহাস অলিখিত থাকুক। কতবার যে আমার শ্রবণ তোমার বাবা ডাক শুনিবার জন্য উৎকর্ণ হইয়াছে তাহা আজ বলিয়া লাভ নাই। এই মরণের লগ্নটি স্থির করিবার পর তোমাকে টেলিফোনে ডাকিয়া একবার জন্মের শোধ সেই বাবা ডাকটি শুনিবার অক্ষম চেষ্টা করিলাম। তুমি ডাকিলে না। না, তুমি অস্বস্তি বোধ করিও না। আমার হৃদয়ে তোমার প্রতি কোনো অভিশাপই উদ্যত হইবে না। তোমার প্রতি আমার স্নেহ ধৃতরাষ্ট্রের ন্যায় অন্ধ। সেই স্নেহবুভুক্ষু হৃদয়টি আজ ছুটি চাহিতেছে। পরজন্ম অবশ্যই আছে। আবার যদি জন্মগ্রহণ করি তবে যেন ঈশ্বর আমাকে সুমতি দেন। আর যেন নিজদোষে এইরূপ মরুভূমিতে বসবাস করিতে না হয়।
দুই ক্ষুদ্র মুষ্টি ভরিয়া আমাকে অকৃপণ স্নেহ দিয়াছেন বউমা। আমার মাকে সেই কোন শৈশবে হারাইয়াছি। বৃদ্ধবয়সে ফের তাহার ভিতর দিয়া মা আসিলেন। বিসর্জনের বাজনা বাজাইয়া আসিয়াছিলেন। ঈশ্বরপ্রসাদাৎ তিনি আমাদের ত্যাগ করেন নাই। তাঁহার হৃদয়টিকে চিনিবার চেষ্টা করিও। আমার মায়ের অপমান করিও না। মনে রাখিও তিনি যথেষ্ট লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা পাইয়াও আমাদের নিকটে আছেন। তিনি বিদায় লইলে কুললক্ষ্মী আমাদের ছাড়িবে। আমি তাঁহার মস্ত সহায় ছিলাম। আজ আর আমি থাকিব না। তুমি তাঁহার যথার্থ রক্ষক হইও।
তোমার সারা জীবন ধরিয়া পিতারূপ যে পাষাণভার চাপিয়া বসিয়াছিল আজ সেই ভার অপসৃত হইল। তোমাকে সুখী করিবার জন্য, তোমাকে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য, তোমাকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পথে ফিরাইয়া আনিবার জন্য আজ স্বেচ্ছায় বিদায় লইতেছি! পোস্টমর্টেমের নামে আমার দেহটি লইয়া কিছু টানাহ্যাঁচড়া হওয়ার সম্ভাবনা। ডাক্তার বিকাশ জৈনের সঙ্গে দেখা করিও। তিনি আমার সব জানেন। বিনা কাটাছেঁড়ায় আমার দেহটি তিনি হস্তান্তর করিতে সাহায্য করিবেন। কোনোক্রমেই এই মৃতদেহ কলিকাতায় নিও না। দিল্লি ভারতবর্ষের রাজধানী, সেখানেই আমার শেষকৃত্য সম্পন্ন করিও। আমার মৃতদেহ কলিকাতায় লইয়া গেলে বউমা বড় অস্থির হইবেন। সেটা অভিপ্রেত নহে।
আর একটা কথা। দিব্য চিরকাল শিশু থাকিবে না। বড় হইবে, ব্যক্তিত্ববান হইবে। তাহার প্রতি তুমি এমন আচরণই করিও যাহাতে পিতাপুত্রে সহজ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তোমার ও আমার মতো দুস্তর দুরধিগম্য দূরত্বে দু’জনকে বাস করিতে না হয়। আমি যাহা পারি নাই তুমি তাহা পারিও।
আজ আমি সুখী ও তৃপ্ত। আমার কোনো ক্ষোভ নাই। আজ তোমাকে মুক্তি দিলাম, নিজেও মুক্তি লইলাম। আজ অনাবিল হৃদয়ে তোমাকে আশীর্বাদ করি, সুখী হও, সকলকে সুখী করিয়া তোলো। বউমা ও দিব্যকে আমার প্রাণভরা আশীর্বাদ করিলাম। মঙ্গলময়, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হউক। ইতি,
শ্রীকৃষ্ণকান্ত চৌধুরি
ধ্রুব নিথর হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। কান্না এল না, তেমন কষ্ট হল না। শুধু বুকের ভিতরটা মথিত হয়ে একটা ডাক উঠে আসতে চাইছিল—বাবা!
___
|| সমাপ্ত ||