মনসার অভিশাপ

মনসার অভিশাপ

দুর্গাপূজার অষ্টমীর রাত। `রাত প্রায় সোয়া বারোটা। বৃহত্তর দুর্গাপুরের দেড়শো বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী পূজা মণ্ডপের পূজা দেখতে আসা দূর- দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জের লোকজন এক-এক করে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে।

তিমিরকাঠী গ্রামের সদরুল। বয়স বাইশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। মাঝারি উচ্চতা। অবিবাহিত। রোদে পোড়া বাউণ্ডুলে চেহারা। এমনিতে সে প্রতিটা সন্ধ্যা পার করে গ্রামের সমবয়সী বখাটে ছেলে-ছোকরাদের সাথে তাস পিটিয়ে আর গাঁজার কলকে টেনে। কিন্তু আজ বিকেলে সে গিয়েছিল দুর্গাপুরের পূজা দেখতে। তার বয়সী মুসলমান ঘরের ছেলে-ছোকরাদের পূজা দেখতে যাওয়ার পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য থাকে সেজে-গুজে পূজা দেখতে আসা হিন্দু রূপবতী মেয়েদের দু-চোখ ভরে দেখা। আর ভাগ্য ভাল থাকলে ভিড়ের মধ্যে সামান্য স্পর্শ পাওয়া।

সদরুল রিকশা ভ্যানে করে দুর্গাপুর থেকে কুমারখালী বাজারে এসে পৌঁছয়। দুদু মিয়ার চায়ের দোকানে বসে পর-পর দুই কাপ মালাই চা খেয়ে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করে। কুমারখালী বাজার থেকে ইঁট বিছানো যে রাস্তা তিমিরকাঠী গ্রামের মধ্যে গিয়েছে, সেই রাস্তা ধরে না গিয়ে সে যেতে শুরু করে জঙ্গলের পথ ধরে। জঙ্গলের পথ ধরে যাওয়ার পিছনে তার দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, এই পথে খুব অল্প সময়ে বাড়ি যাওয়া যাবে। আর পকেটে থাকা পাঁচটা গাঁজা ভরা বিড়ি নিরিবিলিতে আয়েশ করে টানা যাবে।

বিড়ি ধরিয়ে, ভারী ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নির্জন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে থাকে সদরুল। চারদিকে লতা, গুল্ম, ঝোপঝাড়, কোথাও-কোথাও অবহেলা আর অযত্নে বড় হওয়া গাব গাছ, সুপারি গাছ, তালগাছ আর বাঁশঝাড়। রাতের বেলা সাধারণত লোকজন এই পথে যাওয়া- আসা করে না। কারণ এই জঙ্গলটায় অনেক বিষধর সাপের বাস। গত বছরও দক্ষিণ পাড়ার বেলায়েত চাচাকে এই পথ ধরে যাওয়ার সময় সাপে কাটে। নামি-দামী ওঝা এনেও শেষ রক্ষা হয় না। কাতরাতে কাতরাতে তিনি মারা যান।

পথের মাঝে সন্দেহজনক কিছু রয়েছে মনে হলে সদরুল তার নকিয়া এগারোশো মডেল মোবাইল সেটটার ছোট্ট টাটা জ্বেলে দেখে নিচ্ছে। হঠাৎ একটা বাঁশঝাড়ের গোড়ায় ঝোপের মধ্যে তার চোখ আটকে যায়। কিছু একটা উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়াচ্ছে সেখানে। ভীত পায়ে আলোর উৎসের কাছে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে মোবাইলের ছোট্ট টর্চের আলো ফেলে দেখতে পায় মেয়েদের কানের দুলের মত একটা গয়না পড়ে আছে। সাপের ফণা তোলার মত একটা আংটার দু’পাশে দুটো গোল বল। আর সেই বলের চারপাশে ছোট-ছোট উজ্জ্বল পাথর বসানো। গয়নার মত সদরুলের চোখ দুটোও চকচক করে উঠল। মুহূর্ত সময়ও দেরি না করে গয়নাটা তুলে পকেটে রাখল।

বিকেলে জঙ্গলের পথ ধরে পূজা দেখতে যাওয়া কোন হিন্দু বনেদি ঘরের মেয়ে মানুষের গয়না হয়তো খুলে পড়েছে। এখন বাড়ি গিয়ে গয়না হারানোর ব্যাপারে টের পেয়ে নিশ্চয়ই সে বাড়ির লোকজন খুঁজতে আসবে–এই ভেবে সদরুল কিছুটা পূর্ব দিকে এগিয়ে কৃষ্ণার খালের সাঁকো পার হয়ে ইঁট বিছানো রাস্তায় উঠে আসে।

মনের ভিতর চাপা আনন্দ নিয়ে ঝড়ের গতিতে সদরুল ইঁট বিছানো রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। মাঝিবাড়ির সামনে শিমুল গাছটার নীচে এসে সে থমকে দাঁড়ায়। কালো পোশাকে বরফ সাদা রঙের একটা মেয়ে দু’হাত উঁচিয়ে পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য মেয়েটার গায়ে রঙের এই ভিন্নতা সদরুলের নজরে পড়ে না!

চড়া গলায় সদরুল জিজ্ঞেস করে, ‘কেডা তুই! এই আন্ধারে ভূতের লাহান দাঁড়াইয়া রইছ?’

মেয়েটা অপার্থিব গলায় বলে উঠল, ‘জঙ্গলের মধ্যে যেটা পেয়েছিস, সেটা আমাকে দিয়ে দে। ওটা আমার।’

‘কইলেই হইল ওনার! কোন প্রেমাণ আছে? মাইয়া মানুষ রাইত- বিরাইতে ত্যক্ত না কইরা বাড়িতে চইলা যা। নাইলে এমন কিছু কইরা দিমু… শেষে গলায় দড়ি দেওন ছাড়া উপায় পাবি না।’

ভোজবাজির মত মেয়েটার পিছন থেকে আরও দুটো মেয়ে উদয় হলো। প্রথম মেয়েটার মতই একই পোশাক, একই গায়ের রং। তিনজনই আগুন জ্বলা চোখে সদরুলের দিকে এগোতে থাকে। সদরুল শার্টের বুক পকেটে রাখা গয়নাটা চেপে ধরে পিছন দিকে সরতে সরতে বিভিন্ন অশ্লীল গালি- গালাজ শুরু করে। উত্তেজনায় হয়তো সদরুল তখন লক্ষ করেনি-তিনটি মেয়ের চেহারাও একই!

হঠাৎ মেয়ে তিনজন থমকে দাঁড়িয়ে সমস্বরে বলে উঠল, ‘আজ রাত পোহাবার আগে যা পেয়েছিস, যেখানে পেয়েছিস, সেখানে রেখে না আসলে তোর বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে। আর কথা মত কাজ করলে অঢেল সম্পদ উপহার দেব।’

কথা শেষ হওয়ার পর আচমকা তিন জনই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। পিছন থেকে ভেসে এল, ‘ওই, সদরুল্যা, এহানে বইয়া একলা একলা কারে গালিগালাজ করোস?’

সদরুল ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে টর্চ হাতে সবুর বেপারী দাঁড়িয়ে আছেন। অত্যন্ত দুষ্ট চরিত্রের লোক। আসল ঘটনা চেপে যেতে হবে!

‘না… ওই বাদুড়রে গালি দিচ্ছি। শিমুল গাছটার নীচে আইলাম পর গায়ে হাইগ্যা দিছে।

সদরুল সবুর বেপারীকে অনুসরণ করতে করতেই বাড়িতে পৌঁছে গেল। ঘরের দরজায় কয়েকবার কড়া নাড়বার পর ভাবির গলা শোনা গেল, ‘ওই… কেডা?’

‘ভাবি, মুই সদরুল।’

সদরুলের বড় ভাবি সালমা। সদরুলকে দু’চোখে দেখতে পারে না। রোজ রাতে নেশা-ভাঙ করে ঘরে ফেরায় সে খুবই ক্ষিপ্ত। সদরুলের বড় ভাই গত বছর সিঙ্গাপুর গিয়েছে। স্বামী দেশে না থাকায় এমনিতেই তার মন সব সময় দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। শুনেছে ওই সব দেশে গেলে পুরুষ মানুষের চরিত্র নাকি আর চরিত্র থাকে না!

সালমা দরজার ছিটকিনি খুলে দেওয়ার পর সদরুল নিজেই কপাটে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে, ভাবির দিকে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বিকট শব্দে চিৎকার শুরু করে, সাপ… সাপ… কাল সাপ… কালনাগিনী…’ সদরুলের চোখ তার ভাবিকে দেখছে-রাজ গোখরোর মত বড়সড় কালো রঙের একটা সাপ ফণা তুলে রয়েছে।

সদরুলের কাণ্ড দেখে প্রথমে সালমা খুবই হতভম্ব হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর যখন বুঝতে পারে তাকে দেখেই সদরুল সাপ-সাপ বলছে, তখন সদরুলের চেয়েও তীক্ষ্ণ গলায় পাশের কামরায় ঘুমানো শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে, ‘ও, আম্মা, দেইখা যান… সদরুল্যা গাঞ্জা টাইন্যা আইয়া কী শুরু করছে… মুই বোলে কালনাগিনী!!! ও, আম্মা, এহনো আহেন না ক্যান…সদরুল্যা মোরে মারবার লাইগ্যা লাডি হাতে লইছে…’

সত্যিই সদরুল দরজার পাশে থাকা গাব গাছের একটা মোটা লাঠি হাতে নিয়ে সালমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সদরুলের বিধবা মা, ষাট বছরের বৃদ্ধা ও ঘর থেকে রুদ্ধশ্বাসে কাঁপতে-কাঁপতে ছুটে এসে বলে, ‘ও বউ, কী হইছে… সদরুল্যা হারমজাদা কী করছে….?’

সদরুল তার মাকে দেখে হাত থেকে লাঠি ফেলে দিয়ে আরও ভয়ঙ্কর ভাবে বলে ওঠে, ‘সাপ… সাপ… দুইডা সাপ…’ বলে চিৎকার করতে-করতে ঘরের বাইরে ছুটে গিয়ে, উঠানের মধ্যে ধপাস করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।

সদরুলের চোখ তার মাকেও দেখেছে-আর একটা সাপ ফণা তুলে রয়েছে। মা ও ভাবি দুটো বড়-বড় সাপকে এক সাথে ফণা তুলে তার দিকে এগোতে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে, হাতের লাঠি ফেলে, ছুটে ঘরের বাইরে উঠানে গিয়ে দেখে, উঠান – ভরতি হাজার-হাজার সাপ কিলবিল করছে। সাপগুলো হিসহিস শব্দ তুলে হিংস্র ভাবে তার দিকে তেড়ে আসছে। প্রচণ্ড ভয়ে তখন সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়।

উঠানে পড়ে থাকা সদরুলকে ছুঁয়ে দেখা যায় তার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। চেঁচামেচিতে আশ-পাশের বাড়ি-ঘর থেকেও দু-চারজন লোক ছুটে এসেছে। সবাই মিলে ধরাধরি করে সদরুলকে ঘরে নিয়ে গিয়ে, বিছানায় শুইয়ে, মাথায় পানি ঢালা এবং চোখে-মুখে পানি ছিটানোর এক পর্যায়ে তার জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে পাবার পর চোখ খুলেই আবার সাপ-সাপ বলে চিৎকার শুরু করে। সদরুলের চোখ আশ-পাশের সব কিছুকেই সাপ রূপে দেখছে। বিছানার পাশে বসা-দাঁড়ানো মা, ভাবি, পাশের বাড়ির লোকজন এমন কী বিছানার কাঁথা-বালিশ সবই তার চোখে সাপের রূপ ধরেছে।

সাপ-সাপ বলে চিৎকার করা পাগলপ্রায় সদরুলকে সবাই মিলে চেপে ধরে বুঝাতে থাকে, ‘তুই যা দেখছিস ভুল দেখছিস, কোনহানে কোন সাপ নাই… তোর কী হইছে খুইল্যা ক… কোতায় ভয় পাইছোস…?’

সদরুলও এতক্ষণে কিছুটা বুঝতে পেরেছে, সে চোখে ধাঁধা দেখছে। তাই সে চোখ বন্ধ করে জঙ্গলে সেই গয়না পাওয়ার ঘটনা এবং পাওয়ার পর কী ঘটেছে সব খুলে বলল। বলা শেষ হলে, শার্টের বুক পকেট থেকে সেই গয়নাটা বের করল। ঘরে একটা মোম জ্বলছিল। মোমের মৃদু আলোতে নিমেষেই গয়নার উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল গোটা ঘরে। উপস্থিত সবাই চোখ ছানাবড়া করে অবাক গলায় বলে উঠল, ‘এইডা কী জিনিস!!!’

বাতাসের গতিতে সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল এই ঘটনা। গভীর রাতেও অনেক লোকজনে ভরে গেল সদরুলদের ঘর, বসার ঘর, উঠান। প্রত্যেকেই সেই আকর্ষণীয় গয়নাটা একবার দেখতে চায়। হিন্দু বাড়ি থেকে আসা এক বৃদ্ধা গয়নাটা দেখে আঁতকে উঠে বলল, ‘ওরে অনর্থ হইছেরে… এ তো সর্পমাতা মনসা দেবীর অলংকার!!!… আইজ রাইতের মধ্যে দেবীর কথা মত এই অলংকার ফেরত দিয়া না আইলে, সদরুল তো মরবোই লগে গ্রামবাসীগো কী হইব তা ভগবানই জানেন!’

গ্রামের মুরব্বীরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন-আজ রাত পোহাবার আগেই সদরুল যেখান থেকে গয়নাটা পেয়েছে সেখানেই রেখে আসা হবে। কিন্তু কে যাবে! যে কোন একজনকে যেতে হবে। বেশি লোক গেলে মনসা দেবী আবার ক্ষিপ্ত হতে পারে! আলোচনার এমন পর্যায়ে শায়েস্তাবাদ থেকে খবর পেয়ে সদরুলের ভগ্নিপতি ইদরিস চলে আসে। অত্যন্ত ধূর্ত চরিত্রের লোক। গয়নাটা দেখার পর তার চোখ লালসায় চকচক করে ওঠে। মনে-মনে ফন্দি আঁটতে শুরু করে, যে করেই হোক গয়নাটা হাতিয়ে নিতে হবে।

শেষ রাতের দিকে ইদরিসকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় গয়না যথাস্থানে রেখে আসার। যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! ইদরিস সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। গয়না নিয়ে কুমারখালী বাজার থেকে ট্রলার যোগে সোজা সদরে চলে যায়। সদরের বড় একটা সোনার দোকানে গয়নাটা দেখালে দোকান মালিক বিস্মিত চোখে তৎক্ষণাৎ ইদরিসকে গয়নার বিনিময়ে পাঁচ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়। কিন্তু দুষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন ইদরিস ভাবে, ঢাকা গেলে এই জিনিসের আরও অনেক বেশি দাম পাওয়া যাবে।

এদিকে সদরুলদের বাড়িতে যেন অভিশপ্ত ঝড় নেমে এসেছে। সকাল থেকে সদরুলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সাপ-সাপ বলে চিৎকার করতে- করতে একেবারে উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে, গ্রামের অনিল ডাক্তারকে ডেকে আনা হয়েছিল। ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে বলে গিয়েছে যত দ্রুত সম্ভব উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে।

সদরুলদের গোয়াল ঘরে দুটো দুধের গাভী ছিল। গাভী দুটোর দুটো বাছুরও ছিল। ভোরবেলা দেখা গেল চারটি জন্তুই মরে পড়ে রয়েছে। প্রত্যেকটি জন্তুর পায়ে সাপের ছোবলের দাগ। চোদ্দটা মুরগি ছিল। ভোরে খোপ খোলার পর দেখা গেল একটা মুরগিও বের হচ্ছে না। সব কটা মুরগি খোপের ভিতরে মরে পড়ে রয়েছে। এমনকী ঘরের পোষা বিড়ালটাও খাটের নীচে মরে পড়ে রয়েছে!

সদরুলের মা শুকনো উঠানে, আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়ে ডান পায়ের হাঁটুতে প্রচণ্ড আঘাত পায়। আঘাত পাওয়া হাঁটুটা নীল হয়ে যায়। আশ্চর্য ব্যাপার হাঁটুর সেই নীলচে ভাব অতি দ্রুত সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে! তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে থাকে এবং নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত। উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাবার আগেই অঘটন ঘটে যায়।

মা-ভাইয়ের দুর্ভোগের কথা শুনে সদরুলের বোন আকলিমা, (ইদরিসের বউ) শায়েস্তাবাদ থেকে টেম্পোতে চড়ে তিমিরকাঠী আসার পথে টেম্পো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদের মধ্যে উল্টে পড়ে। ঘটনাস্থলেই ঘাড় ভেঙে আকলিমা মারা যায়।

সদরুলের ভাবি সালমা, শাশুড়ির দাফন-কাফন হওয়ার আগেই ব্যাগ গুছিয়ে বাপের বাড়ি চড়ে যায়। বাড়িতে পড়ে থাকে অসুস্থ বিকৃত মস্তিষ্কের সদরুল একা।

৬-৭ দিন কেটে গেল। সদরুল এখন কিছুটা শান্ত। নির্জন প্রেতপুরীর মত বাড়িটা থেকে বিকটভাবে ‘সাপ-সাপ’ চিৎকারের শব্দ এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। সদরুলদের পাশের বাড়ির লোকজন দুই বেলা গিয়ে সদরুলের খোঁজ-খবর নিয়ে আসে। খাবার-দাবার খাওয়াবার চেষ্টা করে। কিন্তু সম্ভব হয় না, প্রতিটা খাবারের দিকে তাকিয়েই সদরুল হিসহিসে গলায় বলে ওঠে, সাপের বাচ্চা কিলবিল করছে। এখন আর তাকে বেঁধে রাখতে হয় না। লাল এক জোড়া পলকহীন চোখ নিয়ে সারাদিন বিছানায় মড়ার মত পড়ে থাকে। আর দিনে-দিনে তার শরীরটাও শুকিয়ে লিকলিকে হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন সাপের মত! আজকাল তার গা থেকেও তীব্র আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায়। ঠিক যেন সাপের গায়ের গন্ধ!

এমনি এক ভোরবেলা পাশের বাড়ির লোকজন সদরুলের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে সদরুলের লতার মত দেহটা চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে। মুখটা হাঁ হয়ে জিভ বেরিয়ে রয়েছে। জিভটা স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা এবং কালচে রঙের। তার চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার জিভটা মাঝখান থেকে চেরা। লাল চোখ জোড়া আগের মতই পলকহীন, স্থির। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কেমন দৃষ্টিভ্রম হয়। মনে হয় একটা মৃত সাপ পড়ে রয়েছে!

অনেক দিন হলো সদরুলদের বাড়িটা পোড়োবাড়ির মত পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে বাড়িটা গ্রামবাসীদের ভয়ের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রাতের বেলা তো দূরে থাক দিনের বেলাও কেউ ও বাড়ির ভিতরে ঢোকে না। সমস্ত বাড়ির এখানে-সেখানে বিষাক্ত সব সাপের আনাগোনা। এমনকী বাড়িটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও প্রকট ভাবে সাপের গায়ের আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায়! কেউ কেউ তো বলে, গভীর রাতে, কালো-মোটা অজগরের মত বড় একটা সাপ, অঙ্গারের মত লাল দুটো চোখ নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়! আর একটু পর পর তার কালো জিভটা লক- লক করে ওঠে!

ও বাড়িতে এ সব সাপের আবাসস্থলের খবর পেয়ে, দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে বড়-বড় সাপুড়েরা এসেছিল সাপ ধরতে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছে। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছে, বস্তুত ওগুলো কোন সাপ নয়! ওগুলো অলৌকিক জগতের কায়াহীন জীব। মানুষকে মায়াজালে বন্দি করে চোখে সাপ রূপে দেখা দেয়।

সদরুলের ভগ্নীপতি ধূর্ত ইদরিস এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে সাপের মত পলকহীন চোখ নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সর্বনেশে সেই মহামূল্যবান গয়না নিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে সে ঢাকা গিয়েছিল। পুরানা পল্টন থেকে রাস্তা ক্রস করে বায়তুল মোকাররমের সোনার দোকানগুলোর দিকে যাওয়ার সময় যাত্রী বোঝাই একটা মাইক্রোবাস তাকে ধাক্কা মেরে চলে যায়।

অ্যাক্সিডেন্টের পর অজ্ঞান হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সে দেখতে পায়, বোরখার মত কালো পোশাক পরা একটা মেয়েমানুষ, যার গায়ের রং বরফের মত সাদা, মূল্যবান সেই গয়নাটা নিয়ে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে অপার্থিব, অদ্ভুত সেই মেয়েমানুষটা শরীর হিম করা ক্রুদ্ধ একটা হাসি দেয়।

[এই কাহিনি আমি শুনেছি হানিফ মোল্লা নামে তিমিরকাঠী গ্রামের এক অশিক্ষিত যুবকের কাছ থেকে। যে যুবক, পঞ্জিকাকে বলে পুঞ্জিকা, হাসপাতালকে বলে হোসপাতাল, আর বিখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলে সোনাল গন্ধোপাদা। অতিশয় সহজ-সরল টাইপের লোক। তার কাছ থেকে এই কাহিনি শোনার পর আমার তেমন বিশ্বাস হয়নি, এখনও যে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছি তা জোর দিয়ে বলব না। ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য, তিমিরকাঠী গ্রামের বদমেজাজি, রুক্ষ স্বভাবের জহিরুল নামের সামান্য পরিচিত আরেক যুবককে ফোন করলাম। সে জানাল, ‘ঘটনা এক্কেবারেই হাছা।’ পুরো কাহিনি সেল ফোনে আবার আমাকে শুনতে হলো। কাহিনি শেষ করে জহিরুল বলল, ‘আফজাল ভাই, এই ঘটনা যদি কেউ মিছা কয় তাইলে হের মুহে মুই ‘ইয়ে’ করি।’- লেখক।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *