সুবাসওয়ালা

সুবাসওয়ালা

ঘুঘু ডাকা দুপুর। সবেমাত্র ভাত খেয়ে উঠেছি। বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে খবরের কাগজের পাতা উল্টাতে-উল্টাতে হাই চাপছি। শরীর দুপুরের ভাত ঘুমের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। এমন সময় পিপ-পিপ, মোটরসাইকেলের হর্নের শব্দে মুখ তুলে দেখি, বাসার সামনে আমার প্রাণের দোস্ত সুমন মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে তাকাতে দেখেই, আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসি দিয়ে, চেঁচিয়ে বলল, ‘প্যান্ট পরে চলে আয়।’

ছেলেবেলা থেকেই সুমন খেয়ালী স্বভাবের। যখন যা মন চায় তাই করে। বাধা দিয়েও কোন লাভ হয় না। আর মোটরসাইকেলটা কেনার পর উড়নচণ্ডী স্বভাবটাও পেয়েছে। কথা নেই বার্তা নেই বলবে, ‘চল।’

‘কোথায়!’

‘ডৌয়াতলা।’

ডৌয়াতলা এক অজ পাড়া গাঁয়ের নাম। কাদা প্যাকপ্যাকে রাস্তাঘাট। প্রায় হাঁটু সমান কাদায় ডজন খানেক আছাড় খেয়ে যেখানে পৌঁছেছিলাম, তা হলো এক মহিলাপীরের আস্তানা। পীরসাহেবা বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করেন। সব চিকিৎসারই ওষুধ হচ্ছে কলা পাতায় মোড়ানো এক মুঠ কাদা। বড়ি বানিয়ে, রোদে শুকিয়ে, প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেতে হবে। সুমনের পাল্লায় পড়ে এমন মহিলাপীর, শিশুপীর, সাধুবাবা, মেয়ে ছেলে হয়ে গিয়েছে, চল্লিশ দিনের জিন্দা কবর, গণ্ডগ্রামের মেলা-উৎসব এ ধরনের বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার অগণিত পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। এসব ক্ষেত্রে ও এমনভাবে অধিকার নিয়ে প্রস্তাব করে, যে না বলতে পারি না, শেষ পর্যন্ত যেতেই হয়।

প্যান্ট পরে, পরিপাটী করে চুল আঁচড়িয়ে, সানগ্লাসটা চোখে লাগিয়ে সুবোধ বালকের মত গিয়ে সুমনের মোটরসাইকেলের পিছনে চেপে বসলাম। কাশিপুরের পোস্ট অফিস, বাজার অতিবাহিত হওয়ার পর কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘কোথায় যাচ্ছি?

‘আজ রাসপূর্ণিমা।’

রাসপূর্ণিমা! তার মানে আজ মাধবপাশার দুর্গারসাগরের (বরিশালের ঐতিহ্যবাহী দিঘি) পশ্চিম পাড়ে রাসউৎসব উপলক্ষে মেলা বসেছে। আমরা সেই মেলায় যাচ্ছি।

আমরা অনেকক্ষণ ধরে মেলার ভিতরে ঘুরছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম সুমন আমার পাশে নেই। আমি তেমন উদ্বিগ্ন হলাম না-এমনটাই বরাবর হয়। ও হয়তো এখন কোন মেয়েকে পটানোর কাজে ব্যস্ত। ও পারেও! ওর সুদর্শন চেহারা আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মার্জিত ব্যবহারে যে কোন মেয়েই প্রথম দেখাতেই মোমের মত গলে যায়। দুশ্চিন্তার কিছুই নেই, সময় মত ওর দেখা পেয়ে যাব-এই ভেবে একা-একাই মেলার ভিতরে ঘুরতে শুরু করলাম।

ঘুরতে-ঘুরতে উত্তর মাথার বট গাছের গোড়ায় বসে থাকা এক লোকের উপর আমার দৃষ্টি পড়ল। লোকটার গায়ে কালো আলখাল্লার মত পোশাক। পিঠ পর্যন্ত ছড়ানো কোঁকড়ানো জট পাকানো চুল। সারা মুখ ভর্তি দাড়ি- গোঁফ। দাড়ি বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলের মধ্যে জ্বলজ্বলে জ্যোতির্ময় দুটো চোখ। লোকটার সামনে সাদা ধবধবে এক টুকরো কাপড় বিছানো। সেই কাপড়ের উপরে লাল, নীল, সাদা, হলুদ বিভিন্ন রঙের ছোট-ছোট শিশি সাজানো। শিশিগুলোর মুখ ছিপি দিয়ে আটকানো। দেখে মনে হচ্ছে আতরের শিশি। হিন্দুদের রাস উৎসবের মেলায় কেউ আতর বিক্রি করতে এসেছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই শিশিগুলোতে কী?’

খসখসে গলায় উত্তর এল, ‘সুবাস।’

সুবাস! মানে সুগন্ধ! তা সুগন্ধই তো, না দুর্গন্ধ?’ এই বলে নুয়ে একটা শিশি তুলতে গেলে, লোকটা আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘আপনি কি বিবাহিত না অবিবাহিত?’

‘অবিবাহিত!’

‘প্রেমিকা আছে?’

এবার আমি কিছুটা চটে গেলাম। কঠিন গলায় বললাম, ‘আবোল- তাবোল এসব কী জিজ্ঞাসা করছেন?’

‘এই শিশিগুলোর প্রতিটায় ভিন্ন-ভিন্ন সুবাস। আর প্রতিটা সুবাসের বিশেষ-বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে।’

‘দয়া করে একটু খুলে বলুন!’

লোকটা আমার দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলতে শুরু করলেন, ‘আপনি যদি বিবাহিত হতেন,’ আঙুল তুলে লাল রঙের একটা শিশি দেখিয়ে, ‘তা হলে আপনাকে ওই শিশির সুবাস নিতে বলতাম। কারণ ওই শিশিতে যে সুবাস রয়েছে তা গায়ে মেখে কেউ যদি তার স্ত্রীর সাথে রাত্রি যাপন করে তা হলে তারা দু’জনেই এমন সুখ পাবে যা তারা জীবনেও ‘পায়নি।’

নীল রঙের একটা শিশির দিকে আঙুল তুলে, এই শিশির সুবাস কেউ গায়ে মেখে কোন মেয়েকে গিয়ে ‘ভালবাসি’ বললে, সাথে-সাথে সেই মেয়ে তার প্রেমে পাগল হয়ে যাবে।

সবুজ রঙের একটা শিশি দেখিয়ে, এই সুবাস গায়ে মাখলে পৃথিবীর সমস্ত জন্তু-জানোয়ার তার বশ হয়ে যাবে। তা বাঘ-সিংহই হোক আর বিষাক্ত সাপই হোক।’

গোলাপি রঙের শিশি দেখিয়ে,- ‘মাঝ রাতে এই সুবাস গায়ে মাখলে পরীস্থান থেকে দলে-দলে পরীরা ছুটে আসবে। তবে খুব সাবধান! অপবিত্র অবস্থায় থাকলে বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

রোগ সারাবার, ব্যবসায় উন্নতি করার, অনিদ্রা দূর করবার, সুন্দর স্বৰ্গীয় স্বপ্ন দেখবার—এ ধরনের বিভিন্ন সমস্যার জন্য বিভিন্ন রঙের শিশির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন সুবাসওয়ালা। যত্ত সব বুজরুকি!

রং-বেরঙের শিশির সারির এক কোনায় মিশমিশে কালো রঙের একটা শিশি রয়েছে। সেই শিশিটার সাথে এখন পর্যন্ত আমার পরিচয় হয়নি। কালো শিশিটা দেখিয়ে বললাম, ‘ওই শিশিতে কী ধরনের সুবাস?’

সুবাসওয়ালা এবার যেন কেমন একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, ‘রাত যখন ঠিক বারোটা তখন এই সুবাস গায়ে মাখলে মৃত আত্মারা এসে দেখা দেবে। অবশ্য ব‍্যবহারের প্রথম দিকে নিকট আত্মীয়, প্রিয়জন, পরিচিতজন কেউ মারা গিয়ে থাকলে, তাদের আত্মা এসে দেখা দেয়।’

‘নিকট আত্মীয়ের আত্মা এসে দেখা দেয়’ সুবাসওয়ালার এই কথাটা শুনে আমার হৃদয়ে সূক্ষ্ম খোঁচা অনুভব করলাম। খুব ছোট সময় আমার একমাত্র মামাকে হারিয়েছিলাম। মামার চেহারাও এখন আর ঠিক মত মনে করতে পারি না। মামার কথা ভাবলে ভাসা-ভাসা মনে পড়ে, এক বৃষ্টির দিন মামা আমাকে স্কুল থেকে আনতে গেলেন। গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। মামা তাঁর ঘাড়ের উপর আমাকে বসিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি মামার মাথার কোঁকড়ানো চুল মুঠো করে ধরে শক্ত ভাবে বসে আছি। কী আনন্দ মনে, সবার চেয়ে উঁচুতে আমি!

বেশ কয়েক বছর আগে বিনা নোটিশে বাবাও চলে গেলেন। বাবা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সহকারী রেজিস্ট্রার ছিলেন। সেই সুবাদে তাঁকে ঢাকা থাকতে হত। মাসে একবার এসে দুই-তিন দিন থেকে চলে যেতেন। এই সময়ে আমাদের প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই করে দিতেন। বাজারে যেতেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে। যেহেতু তাঁর দূরে থাকতে হয় তাই আমাকে বাজার করা শিখাতে চাইতেন। মাছের বাজারে ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে বাবা আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলতেন, ‘তোর কী মাছ খেতে ইচ্ছে করছে?’ বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি নিজেই বাজার করি। মাছের বাজারে ঘুরে-ঘুরে মাছ পছন্দ করি। কিন্তু বহুদিন হয়ে গেল কেউ আর আমাকে মমতা ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে না, ‘তোর কী মাছ খেতে ইচ্ছে করছে?’

সুবাসওয়ালাকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত দাম ওই কালো শিশির সুবাসের?’

‘বিশ টাকা।’

‘মাত্র বিশ টাকা! এত মূল্যবান জিনিসের দাম মাত্র বিশ টাকা?’ মনে- মনে ভাবি যতসব বুজরুকি আর ভণ্ডামি, মানুষের আবেগ নিয়ে ব্যবসা।

আমার প্রশ্ন শুনে সুবাসওয়ালা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসি দিলেন। তাঁর হাসি দেখে আমার পিলে চমকে উঠল। মনে হলো, এই হাসির উৎস চেনা পৃথিবীর নয়, কোন অদেখা ভুবনের।

শেষ বিকেলে সুমনকে পেয়ে গেলাম। দিঘির দক্ষিণ দিকের একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বসে এক রূপবতীর সঙ্গে বাদাম চিবুচ্ছে। আমাকে দেখেই লাজুক হাসি দিয়ে বলল, ‘এতক্ষণ মনে-মনে তোকেই খুঁজছিলাম।’ চেহারায় কেমন অনুতপ্ত ভাব ফুটিয়ে তুলল। আমি কিছুই বললাম না, শুধু কটমট করে তাকালাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে বলে রূপবতীও যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

রূপবতী বিদেয় হওয়ার পর সুমন বলল, ‘চল, আপার বাসায় যাই।’

আমি বললাম, ‘অসম্ভব!’ সুমনের বড় বোন নূপুর আপার শ্বশুরবাড়ি বানারীপাড়ায়। প্রায় সাত-আট কিলোমিটার দূরে। এখন সেখানে গেলে রাত সেই বাড়িতেই কাটাতে হবে।

সুমন আমতা-আমতা করে বলল, ‘এতদূর আসার পরেও আপার সাথে দেখা না করে চলে গেলে আপা শুনলে তো কষ্ট পাবে!’

‘বাড়িতে মা একা। এখন নূপুর আপার বাড়িতে গেলে রাতে ফেরা যাবে না। তা হলে তুই-ই ভেবে দেখ, আমার পক্ষে কি যাওয়া সম্ভব?’

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো- সুমন একা বানারীপাড়া যাবে, আমি ফিরে আসব। কিছুক্ষণ পর নতুল্লাবাদগামী একটা লোকাল বাসে উঠে পড়লাম।

রাত বারোটা। আমি আমার ঘরে। সুবাসওয়ালার কাছ থেকে কিনে আনা কালো শিশিটার ছিপি খুললাম। অদ্ভুত একটা গন্ধ নাকে লাগল, হাসনাহেনা ফুলের গন্ধের সাথে কাঠ পোড়া ঝাঁঝাল গন্ধ মেশালে যেমন গন্ধ হবে, কিছুটা সেরকম মনে হচ্ছে। শিশির ভিতরে আতরের মতই ঘোলাটে এক ধরনের তরল। এক টুকরো তুলোয় শিশি থেকে খানিকটা তরল মাখিয়ে আমার দু’হাতের পিঠে ঘষে লাগালাম। সমস্ত ঘর হাসনাহেনা ফুল আর কাঠ পোড়া ঝাঁঝাল গন্ধে ভরে গেল।

মনের ভিতরে বিচিত্র সব ভাবনা এসে ভর করল। এই গন্ধেই কি আকৃষ্ট হয়ে আত্মারা চলে আসবে! ভাল কথা, সুবাসওয়ালাকে তো জিজ্ঞেস করা হয়নি, সুবাস গায়ে মাখার পর ঘর কি অন্ধকার করে ফেলতে হবে! নাকি আলোতেও আত্মারা আসবে! ভূত, প্রেত, আত্মারা অন্ধকার পছন্দ করে এই ভেবে আলো নিভিয়ে, বিছানায় শুয়ে আবার ভাবতে শুরু করলাম, আত্মা কী? কোথায় আত্মার বাস? প্রতিটা জীবিত প্রাণীর মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় যে সত্তা বিরাজ করে সেটাই তো আত্মা। যখন সেই আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায় তখন সেই নিথর দেহটাকে আমরা মৃতদেহ বলি, লাশ বলি। কোথায় চলে যায় এই আত্মা? হয়তো অপার্থিব কোন জগতে!

ভাবতে-ভাবতে কখন যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। দরজায় অনবরত কড়া নাড়াবার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম জড়ানো গলায় প্রশ্ন করলাম, ‘কে?’

উত্তর এল, ‘আমি।’

গলা শুনেই বুঝলায় কে এসেছে। আলো জ্বেলে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুটো বেজে পাঁচ মিনিট। এত রাতে সুমন এসেছে! কী ব্যাপার!

দরজা খুলে দেখি বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে সুমন দাঁড়িয়ে আছে। রেশমি কোমল চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের উপর ছড়িয়ে রয়েছে। চেহারায় কেমন বিষণ্ণ ছাপ। মেলায় যাওয়ার সময় গায়ে থাকা কফি কালারের ফুলহাতা শার্ট আর ব্লু জিন্স এখনও পরনে। শার্টের পকেটের কাছটা ছিঁড়ে ঝুলে পড়েছে। শার্টের বুকের কাছের দুটো বোতামও নেই। প্যান্টের হাঁটুর কাছটা ছিঁড়ে ছিবড়ের মত সুতো বেরিয়ে আছে।

আমি উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ কী অবস্থা তোর!’

সুমন ম্লান হাসি দিয়ে বলল, ‘ছোট-খাট একটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছি। উদ্বিগ্ন হবার কিছুই নেই।‘

‘ব্যথা পাসনি?’

‘অ্যাক্সিডেন্ট করে প্রথমে যখন মোটরসাইকেল নিয়ে পড়ে যাই তখন প্রচণ্ড ব্যথা লাগছিল। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি কিছুক্ষণ পরে কোন ব্যথা নেই!’

‘কই দেখি, কী রকম ক্ষত হয়েছে।’

‘আরে, দেখতে হবে না! হাঁটুর চামড়া সামান্য একটু ছড়ে গিয়েছে, অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে নিয়েছি, এখন সব ঠিক।’

‘তা তোর আর নূপুর আপার বাড়িতে যাওয়া হয়নি?’

কী করে যাব, মোটরসাইকেলটা বিকল হয়ে গেল আর শার্ট-প্যান্টের যে অবস্থা! মোটরসাইকেলটা সামসু মিয়ার গ্যারেজে রেখে একটা বাস ধরে চলে এলাম।

সুমন যেন দম নেওয়ার জন্য একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, ‘এত রাতে বাসায় যাওয়া সম্ভব নয়। ইদানীং বাবার ব্লাড প্রেশার খুব বেড়েছে। এত রাতে, এই অবস্থায় বাসায় গেলে, বাবা-মা ঘুম থেকে উঠে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে। তাই তোর কাছে থাকতে এসেছি।’

‘তা হলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে আমার একটা লুঙ্গি পরে হাত-মুখ ধুয়ে আয়। রাতে কিছু খাওয়া হয়েছে?

দেখা গেল, লুঙ্গি পরে হাত-মুখ ধোয়ার ব্যাপারে সুমনের কোন আগ্রহই নেই। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় বসে বলল, ‘মোহনা হোটেল থেকে মোরগ পোলাও খেয়ে এসেছি।

সুমন আর আমি বিছানায় শুয়ে পড়েছি। আলো নিভানো। খাটের ডান পাশে শুয়েছে সুমন। ও শার্ট-প্যান্ট পরা অবস্থায়ই শুয়ে পড়েছে।

আমি নরম গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিকেলে যে রূপবতীর সাথে বাদাম চিবাচ্ছিলি, তার নাম কী?’

ক্লান্ত গলায় উত্তর দিল, ‘সুমনা।’

‘তা সুমনার সাথে সুমনের মন দেওয়া-নেওয়া হলো, নাকি বাদাম চিবানো পর্যন্তই শেষ?’

ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘জানি না।’

আমি আর সুমনকে ঘাঁটালাম না। ভাবলাম ও বোধ হয় খুব ক্লান্ত, ওকে ঘুমোতে দেই। শুধু-শুধু বেচারাকে বিরক্ত করে লাভ নেই।

ভোরবেলা মায়ের বিলাপের মত কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তড়াক করে উঠে, বিছানা থেকে নেমে মায়ের কাছে ছুটে গেলাম।

‘মা, তুমি এভাবে কাঁদছ কেন?’ ভিতু গলায় জিজ্ঞেস করলাম।

‘ওরে, সর্বনাশ হয়ে গেছে রে! সর্বনাশ!’ ডুকরে ডুকরে কেঁদে উত্তর দিল মা।

উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘কী হয়েছে, মা! কী হয়েছে! বলো আমায়!’

‘ওরে, সুমন আর নেই। ও আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। গতরাতে ও অ্যাম্বিডেন্ট করেছে।’

‘তুমি কোন্ ভ্রমনের কথা বলছ?’

‘আমাদের সুমন! তোর বন্ধু সুমন!’ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মা।

কথাটা শোনার পর মনে হলো, কেউ আমার গায়ে এক বালতি ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দিয়েছে। আমার বুকের ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। কাঁদতে পারছি না আমি। চোখ-মুখ দিয়ে গরম হলকা বেরুচ্ছে। মা এসব কী আবোল-তাবোল কথা বলছে! গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে মাধবপাশার দুর্গারসাগরের পূর্ব পাড়ের রাস্তার মোড় ঘোরার সময় নাকি সুমন একটা ট্রাকের সাথে অ্যাক্সিডেন্ট করে। স্থানীয় লোকজন অচেতন অবস্থায় সুমনকে শের-ই-বাংলা হাসপাতালে নিয়ে আসে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না, রাত ১০ টা ১০ মিনিটে সুমন মারা যায়। ওর পকেটে থাকা কলেজ আইডি কার্ড দিয়ে ঠিকানা খুঁজে বের করে, ভোরবেলা ওদের বাসায় খবর পাঠানো হয়। আমি এসব কথা বিশ্বাস করি না! গতরাতে সুমন আমার সঙ্গে ঘুমিয়েছে। আমার বিছানার ডান পাশের বালিশটা, যে বালিশটায় ও শুয়ে ছিল, সেটা এখনও ঢালু হয়ে রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি না সুমন মারা গিয়েছে! সুমন যদি সত্যিই মারা গিয়ে থাকে, তা হলে গতরাতে ২টা ৫ মিনিটে কে এসেছিল আমার কাছে? তা হলে কি সুবাসওয়ালার কাছ থেকে কিনে আনা কালো শিশির সুবাস গায়ে মাখায় সুমনের আত্মা এসেছিল?

শের-ই-বাংলা হাসপাতালের মর্গের ট্রলির উপরে সুমনের দেহটা পড়ে আছে। অ্যাক্সিডেন্টের মৃত্যু বলে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশের পোস্ট মর্টেম না করে নিতে দেবে না। সুমনের গায়ে সেই কফি কালারের শার্ট আর ব্লু জিন্স। শার্টের পকেটের কাছটা ছেঁড়া আর প্যান্টের হাঁটুর কাছটাও ছিঁড়ে ছিবড়ের মত সুতো বেরিয়ে রয়েছে। রাতে ও যে অবস্থায় আমার কাছে এসেছিল ঠিক তেমন! শুধু বুকের কাছে শার্টের ছেঁড়া জায়গাটা রক্তে মাখামাখি হয়ে চপচপে হয়ে আছে। হাঁটুর কাছে প্যান্টের ছেঁড়া জায়গাটাও ছোপ-ছোপ রক্তের দাগে একাকার। রাতের মতই রেশমি চুলগুলো এলোমেলো ভাবে কপালে বিছানো! ঠোঁটের কোণে জমে থাকা রক্তে চার- পাঁচটা পিঁপড়া মুখ ডুবিয়ে রয়েছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে সুমন। আর কখনওই ওকে জাগানো সম্ভব নয়।

আসরের নামাজের পরে সুমনের লাশ দাফন করা হয়ে গেলে আমি চলে আসি দুর্গারসাগরের পশ্চিম পাড়ের সেই রাসউৎসবের মেলায়। আজও মেলা বসেছে। সারা মেলার মাঠ তন্নতন্ন করে খুঁজে ফিরি সেই সুবাসওয়ালাকে। কোথাও তাকে পাই না। আমার পকেটে সেই কালো শিশিটা। যে শিশির প্রায় গলা পর্যন্ত ভরা তরল সুবাস রয়েছে এখনও। এই সুবাস গায়ে মাখলে মৃত প্রিয়জনদের আত্মা এসে দেখা দেবে। কিন্তু সেটা আর আমি চাই না। এক সময় যে প্রিয়জনদের সাথে সুখ-দুঃখের কত দিন-রাত্রি পার করেছি, আজ তাদের মৃত আত্মার দেখা পেয়ে কোন লাভই নেই। তাতে কষ্টটা বরং আরও বেড়ে যাবে-একটুও কমবে না। এসেছিলাম শিশিটা সুবাসওয়ালাকে ফেরত দেবার জন্য। সন্ধ্যা মিলিয়ে যাবার পরেও তাঁর দেখা পেলাম না। শিশিটা ছুঁড়ে মারলাম দিঘির জলে। কূপ করে শব্দ তুলে ডুবে গেল শিশিটা।

নতুল্লাবাদগামী একটা বাসে উঠে পড়লাম। বাসের সিটে বসেও দিঘির টলমলে জলে পূর্ণিমার চাঁদের প্রতিবিম্বের লাফালাফি দেখা যাচ্ছে। বাস ছুটতে আরম্ভ করল, ঠিক সেই মুহূর্তে চোখে যেন বিভ্রম দেখলাম। দেখলাম, ছায়ার মত কালো একটা অবয়ব শূন্য থেকে ভেসে-ভেসে নেমে, দিঘির জলে মিলিয়ে গেল। অবয়বটা ছিল সেই অদ্ভুত চেহারার সুবাসওয়ালার।

ইতিকথা

পাঠকদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ২০০০ সালে একটা গুজব উঠেছিল, সে বছরের পঞ্চম মাসের পঞ্চম তারিখে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে! অর্থাৎ মে মাসের ৫ তারিখ। এই গুজবে অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল আমার বন্ধু সুমনও বেশ উদ্বিগ্ন হয়েছিল। মে মাসের ৪ তারিখ সকালে সে নিজের হাতে বাজার করে এনেছিল। তরিতরকারি, ইলিশ মাছ এবং দুটো মুরগি। তার মায়ের হাতে বাজার দিয়ে বলেছিল, ‘মা, মোরাগ পোলাও, সরিষা ইলিশ আর মুরগির চামড়া পাখনা দিয়ে মুগ ডাল রান্না করবে। কাল যদি সত্যিই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় তবে তার আগে পছন্দের খাবারগুলো শেষবারের মত খেয়ে নিতে চাই।’ সুমনের মা তাঁর ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করে রাত ১০টা ১০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ছেলে আর ফিরে আসেনি!

মে মাসের ৫ তারিখে পৃথিবী ধ্বংস হয়নি। ভোর বেলার সূর্যটা ঠিক আগের মতই সোনালি আলো ছড়িয়ে জেগে উঠেছিল। কিন্তু সুমন আর জেগে ওঠেনি। সে তখন ঘুমে-ঘুমে পাড়ি দিচ্ছিল অদেখা ভুবনের পথ।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *