অপার্থিব প্রেয়সী

অপার্থিব প্রেয়সী

এক

খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা আমার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ। গত পনেরো দিন ধরে আমাকে সেই কাজটিই করতে হচ্ছে। আমি এখন মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামের হাজী আব্দুল কাদের ডিগ্রী কলেজের প্রিন্সিপাল মোবারক হোসেনের বাংলা ঘরের বাসিন্দা। পনেরো দিন আগে আমি এই গ্রামে এসেছি। চাকরির সুবাদে আসা। অনেক চেষ্টা-প্রচেষ্টার পরেও যখন একটা চাকরি জোটাতে পারিনি তখন এই কেশবপুর গ্রামের হাজী আব্দুল কাদের ডিগ্রী কলেজের হিসাব বিজ্ঞানের প্রভাষকের চাকরিটা পাই। কী আর করা! মফস্বল শহরের ছেলে হয়েও বাধ্য হয়ে গ্রামের এই অজ পাড়া-গাঁয়ে এসে পড়ে থাকতে হচ্ছে।

গ্রামে হোটেল, মেস বা ওই জাতীয় থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। আমার ইচ্ছে ছিল কারও বাড়িতে ভাড়া থাকার। সেটাও সম্ভব নয়। গ্রামের মানুষ বাড়ি ভাড়া দেয় না। শেষ পর্যন্ত কলেজ কমিটির সিদ্ধান্তে আমার থাকার ব্যবস্থা হয় প্রিন্সিপাল মোবারক হোসেনের বাংলা ঘরে।

প্রিন্সিপাল মোবারক হোসেন খুবই আন্তরিকতার সাথে আমাকে গ্রহণ করে, তাঁর বাড়িতে এনে ওঠান। এমনিতেও তিনি যথেষ্ট মার্জিত ব্যবহারের অধিকারী। ছোটখাট মানুষ। মাথায় সব সময় গোল টুপি পরে থাকেন। মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি, বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চোখ, সৌম্য চেহারা, ফর্সা গায়ের রং। সারাক্ষণ জাবর কাটার মত পান চিবুতে থাকেন। জর্দা দেওয়া পান। কাছে গেলে গা থেকে ভুর-ভুর করে জর্দার গন্ধ আসে। যে গন্ধে আমার মাথা ঝিম ঝিম করে। তা যা-ই হোক, সব মিলিয়ে তাঁকে আমার ভাল মানুষ বলেই মনে হয়। অবশ্য কয়েক দিনের পরিচয়ে একটা মানুষকে পুরোপুরি চেনা যায় না।

আমার আশ্রয়দাতা প্রিন্সিপাল সাহেবকে, থাকা খাওয়ার বদলে নগদ কিছু টাকা দেবার প্রস্তাব করেছিলাম। তা শুনে প্রিন্সিপাল সাহেব জিভ কেটে লজ্জিত গলায় বলেন, ‘ছিহ্! এসব কী কথা বলছেন! লোকে জানলে গ্রামে আর আমার মুখ দেখানোর অবস্থা থাকবে না।’

আমি ইতস্তত করে আবার বলেছিলাম, ‘বর্তমান এই দুর্মূল্যের বাজারে একটা লোকের ঘাড়ের উপরে বসে-বসে খেতে তো আমার খুব লজ্জা হয়।’

প্রিন্সিপাল সাহেব এক গাল হাসি দিয়ে বলেন, ‘আপনার যদি ঋণ শোধ করার এতই ইচ্ছে হয়, তা হলে প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে আমার মেয়ে দুটিকে ঘণ্টাখানেক পড়াবেন।’

প্রিন্সিপাল সাহেবের দুই মেয়ে। বড় মেয়ের নাম রেবু আর ছোটটির নাম টুনি। রেবু হাজী আব্দুল কাদের ডিগ্রী কলেজেরই এইচ.এস.সি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী আর টুনি ক্লাস সেভেনে পড়ে।

প্রিন্সিপাল সাহেবের কথা মতই প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে তাঁর মেয়েদের পড়াই। নিজেকে কিছুটা ভার মুক্ত মনে হয়, কিন্তু প্রিন্সিপাল সাহেবের আতিথেয়তার কাছে সে ভার আবার দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়।

সব কিছু মিলিয়ে বলতে হয়, প্রিন্সিপাল সাহেবের বাড়িতে বেশ আরামেই আছি। শুধু ভোর বেলা…

গ্রামের লোকজন রাত দশটার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। আমি শহুরে মানুষ। দীর্ঘদিনের অভ্যেস অনেক রাত করে ঘুমানো এবং সকালে দেরিতে ওঠা। ভোরের ঘুম আমার কাছে স্বর্গীয় পরশ বলে মনে হয়। কিন্তু প্রিন্সিপাল সাহেবের বাড়িতে এখন আর আমি ভোরের স্বর্গীয় ঘুমটা দিতে পারি না। ফজরের আযানের পরই প্রিন্সিপাল সাহেব এসে ডাকাডাকি শুরু করেন, ‘আসাদ সাহেব, উঠে পড়ুন। আযান হয়ে গিয়েছে, নামাজ পড়তে যেতে হবে…’

অগত্যা স্বর্গীয় ঘুমটা ভেঙে চোখ ডলতে ডলতে আমাকে প্রিন্সিপাল সাহেবের সাথে মসজিদের দিকে যেতে হয়। দিনের পর দিন এভাবে আমার ঘুমের ঘাটতি হওয়ায় সারাদিন আমাকে এক ধরনের অস্বস্তি আর মাথা ধরা নিয়ে কাটাতে হয়।

দুই

রেবু আর টুনি দুই বোন, প্রতি সন্ধ্যায় বই-খাতা নিয়ে আমার কাছে পড়তে আসে।

সেভেনে পড়ুয়া মিষ্টি চেহারার টুনি বেশ চঞ্চল ও চটপটে স্বভাবের। সারাক্ষণ হড়বড় করে কথা বলতেই থাকে। কিন্তু রেবু, টুনির সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের। শান্ত-লাজুক টাইপের মেয়ে। অল্প কথা বলে। নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কখনোই কিছু বলে না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে, ক্ষীণ স্বরে সংক্ষেপে সেই প্রশ্নের জবাব দেয়। মেয়েটা এতই নিচু স্বরে কথা বলে যে মাঝে-মাঝে আমি তার সব কথা বুঝিও না।

রেবু আর একটা কাজ করে, তা হলো সে সব সময় বোরখা পরে থাকে। মুখটাও নেকাব দিয়ে ঢেকে রাখে। সে বাইরে বা কলেজে যায় বোরখা পরে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আশ্চর্য, সে আমার কাছে পড়তেও আসে বোরখা পরে। কোনও মেয়ে বাড়িতে বসেও বোরখা পরে, এমনটা এর আগে আমি আর দেখিনি! এ বাড়িতে এত দিন হয়ে গেল, আজ পর্যন্ত রেবুর চোখ দুটি আর ফর্সা কোমল হাত দুটি ছাড়া তার চেহারার ছায়াও কখনও দেখতে পাইনি।

দিঘির জলের মত টলমলে মায়াকাড়া সেই দুটি চোখ। অপূর্ব চাহনি সে চোখের। চোখে-চোখ পড়লে, বুকের ভিতরটা টিপ-টিপ করে ওঠে। তবে চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, চোখে চোখ পড়তেই তৎক্ষণাৎ সে চোখ সরিয়ে নেয়।

সন্ধ্যায় যথারীতি রেবু আর টুনি এসে উপস্থিত। ভিতরে ঢুকে না বসেই, রেবু হালকা গলায় টুনিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ফিরে চল। আজ আমরা পড়ব না। স্যরের শরীর ভাল নেই।’

আমি বেশ অবাক হলাম। অবাক চোখে রেবুর দিকে তাকালাম। বরাবরের মতই রেবু সঙ্গে-সঙ্গে চোখ সরিয়ে ফেলল। আমার অবাক হওয়ার কারণ-সত্যিই আজ বিকেল থেকে আমার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। গায়ের উত্তাপও বেড়ে যাচ্ছে। জ্বর আসছে বোধ হয়। কিন্তু রেবু ঘরের ভিতরে ঢুকেই তা বুঝল কী করে! তা হলে মেয়েটা কি খুব গভীর মনোযোগের সাথে আমাকে লক্ষ করে?

রেবু, টুনি চলে গেল। যাওয়ার সময় রেবু একবার পিছন ফিরে তাকাল। আমি চমকে উঠলাম। রেবুর চোখ দুটিতে যেন দরদ উথলে পড়ছে!

আমার প্রতি বেলার খাবার প্রিন্সিপাল সাহেব নিজেই নিয়ে আসেন। নিজ হাতেই আমাকে খাবার বেড়ে খাইয়ে যান। আজ একটু আগে-ভাগেই চলে এলেন

প্রিন্সিপাল সাহেব আমার কপালে হাত রেখে ঝিম ধরা গলায় বললেন, ‘সত্যিই তো আপনার গায়ে বেশ জ্বর! মেয়েরা গিয়ে বলেছে, আপনার যে জ্বর এসেছে। তাই তো এশার নামায পড়েই খাবার নিয়ে চলে এলাম। সাথে জ্বরের ওষুধও নিয়ে এসেছি।’

আমার মোটেই খেতে ইচ্ছে করছিল না। প্রিন্সিপাল সাহেবের পীড়াপীড়িতে কয়েক নলা ভাত গিলে ওষুধটা খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ভাত খাওয়ার মধ্যে প্রিন্সিপাল সাহেব গিয়ে ঘর থেকে একটা মোটা কাঁথা আর একটা কম্বল নিয়ে এসেছেন।

মোটা কাঁথা আর কম্বল মুড়ি দেওয়ার পর বেশ ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে শরীরটা হালকা হয়ে যাচ্ছে, মাথা ব্যথাটা ছেড়ে দিয়ে মাথা কেমন ফাঁকা- ফাঁকা লাগছে। তবে যতই ভাল লাগুক বেশ বুঝতে পারছি, জ্বর আরও বাড়ছে। চোখের সামনে নানা ধরনের অদ্ভুত দৃশ্য ফুটে উঠছে। আমি যেন খোলা মাঠের মাঝে হেঁটে বেড়াচ্ছি। শিরশিরে বাতাস বইছে। সে বাতাস গায়ে কাঁপন ধরাচ্ছে। আবার কখনও দেখি, আমি যেন সমুদ্র সৈকতে বসে আছি। দমকা বাতাসে আমার শীত লাগছে। আবার দেখি, আমি যেন বৃষ্টির মাঝে হেঁটে চলেছি। ঠাণ্ডা পানির ছোঁয়ায় আমার শরীর কাঁপছে।

অদ্ভুত দৃশ্যগুলোর মাঝে কখন যেন হারিয়ে গেলাম। ঠিক বলতে পারব না ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। গভীর রাতে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। চোখ না খুলেই অবাক হয়ে টের পেলাম, কে যেন আমার কপালে শীতল একটা হাত রেখে বসে আছে। তার গা থেকে দামি পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি।

টেবিলের উপরে হারিকেনটা টিমটিম করে জ্বলছে। প্রিন্সিপাল সাহেব হারিকেন জ্বেলে রেখে গিয়েছেন অসুস্থ মানুষের ঘর একেবারে অন্ধকার করতে নেই, কখন কী প্রয়োজন হয়!

চোখ খুলে হারিকেনের টিমটিমে আলোতে দেখি, আমার শিয়রে এক তরুণী বসে আছে। তরুণীর গায়ে ঝলমলে লাল শাড়ি। হাত ভর্তি লাল কাঁচের চুড়ি। কপালে লাল টিপ। ঠোঁটে রক্তরাঙা লাল লিপস্টিক। অত্যন্ত মিষ্টি চেহারা তরুণীর। ফর্সা রঙ, ভাসা-ভাসা আয়ত চোখ, দীর্ঘ আঁখি পল্লব, তীক্ষ্ণ নাক, প্রশস্ত কপাল, কাঁধের উপরে ছড়ানো এক রাশ রেশমি কালো চুল। তরুণীর আলতো নড়াচড়ায়ই তার কাঁচের চুড়িগুলো টুনটুন শব্দ তুলছে।

আমি অবাক গলায় প্রশ্ন করলাম, ‘কে তুমি?’

তরুণী আমার প্রশ্ন শুনে মুখ টিপে হাসতে লাগল। শরীর দুলিয়ে সে হাসছে। তার হাসি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার খেয়াল হলো- আরেহ্! এ তো রেবু! রেবুকে বোরখা ছাড়া অন্য কোনও পোশাকে দেখা হয়নি বলে এতক্ষণ চিনতে পারিনি।

রেনুর শীতল হাতখানা আমার কপাল বেয়ে নেমে চোখের উপরে স্থির হলো। ঠিক তখনই যেন আমি সম্মোহিতের মত ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে বেশ বেলা করে আমার ঘুম ভাঙল। ততক্ষণে রোদের মিষ্টি আলো পূবের জানালা গলে আমার বিছানায় এসে পড়েছে। শরীরটা বেশ ঝরবারে লাগছে। গায়ে বোধ হয় জ্বর নেই। তবু ভাল আজ প্রিন্সিপাল সাহেব ফজরের নামাজ পড়তে ডাকেননি।

রাতের কথা মনে পড়া। সঙ্গে-সঙ্গে পুলকিত হয়ে উঠলাম। রেবু বিছানার শিয়রের যে জায়গায় বসে ছিল, সে জায়গার বিছানার চাদর এখনও আলুখালু তার পায়ের পারফিউমের মিষ্টি গন্ধটা এখনও ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আনন্দে নেচে উঠল আমার মন। আজ সব কিছু ভাল লাগছে। ভাল লাগছে সকালের মিষ্টি রোদ। ভাল লাগছে শরতের ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ। ভাল লাগছে ঝিরঝিরে বাতাস। এমন কী ভাল লাগছে জানালার পাশের বড় আম গাছটার মগডালে ডেকে যাওয়া কাকটার এক ঘেয়েমি কা… কা…কা ডাকও!

হঠাৎ আমার বুকটা কেঁপে উঠল, দরজার দিকে তাকিয়ে। দরজা তো ভিতর থেকে বন্ধ। তা হলে রাতে…সব কিছু কি জ্বরের ঘোরে আমার মস্তিষ্কের কল্পনা! না, তা হতে পারে না! আমার ঘরের বাতাসে মিষ্টি পারফিউম, বিছানার শিয়রের চাদর আলুথালু, সেই নরম হাতের শীতল স্পর্শ…সবই কি মিথ্যে!

আমার বিশ্বাসকে দৃঢ় করতে, হঠাৎ আমার চোখে পড়ল বালিশের পাশে পড়ে আছে একটা লাল টিপ। এই লাল টিপটা কাল রাতে রেবুর কপালে দেখেছি। কোনও কারণে হয়তো কপাল থেকে টিপটা খসে পড়েছে। সযত্নে টিপটা তুলে নিলাম। মনে-মনে ভাবলাম, একদিন নিজের হাতে এই টিপটা রেবুর কপালে পরিয়ে দেব।

দরজার দিকে তাকিয়ে আবার আমার মনের ভিতরে দুলে উঠল। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ! তা হলে কী করে কাল রাতে রেবু এই ঘরে এসেছিল!

তিন

সন্ধ্যায় যথারীতি রেবু ও টুনি আমার কাছে পড়তে এল।

রেবুর মধ্যে কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ল না। সে আগের মতই বোরখা পরে, নেকাব দিয়ে মুখ ঢেকে এসেছে। আগের মতই মোলায়েম গলায় কথা বলছে। চোখে চোখ পড়লে তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নিল।

আমি অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে রেবুকে পর্যবেক্ষণ করে কিছু বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। রাতের সেই লাল শাড়ি পরা রেবুর সাথে, এই রেবুর কোনও মিল খুঁজে পাচ্ছি না। বরং লক্ষ করছি, বারবার তৃষ্ণার্তের মত রেবুর দিকে তাকানোর ফলে রেবু কেমন সংকোচ বোধ করছে। ছোট্ট টুনি তো মুখ ফুটে বলেই ফেলল, ‘স্যর, আপনি কেমন যেন আগের মত আর মনোযোগ দিয়ে পড়াচ্ছেন না। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে কী যেন ভাবছেন।

আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘না…মানে…জ্বর থেকে ওঠার পর শরীরটা ঠিক আগের মত…এখনও বোধ হয় গায়ে সামান্য জ্বর আছে।’

বেশ কয়েক দিন হতে চলল, আমাকে স্থায়ী ভাবেই যেন, অন্যমনস্ক রোগে পেয়ে বসেছে। কলেজে ক্লাস নেয়ার সময়ও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। ব্যাপারটা প্রিন্সিপাল সাহেবের চোখেও পড়ল। প্রিন্সিপাল সাহেব একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, আসাদ সাহেব, আজকাল আপনাকে কেমন যেন অন্য রকম লাগছে! শরীর ঠিক আছে তো?’

আমি প্রিন্সিপাল সাহেবের প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে পারিনি।

আগে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প-উপন্যাসের বই পড়তাম। এখন রাত জেগে রেবুকে নিয়ে ভাবি। শুধু রেবুকে নিয়েই যে ভাবি সেটা বললে ভুল হবে। অনেক বিচিত্র ভাবনা মাথায় আসে। সেদিন রাতের সেই লাল শাড়ি পরা রেবু আর বোরখা পরা রেবুর যে অনেক তফাৎ! রেবু যথেষ্টই নম্র-লাজুক একটা মেয়ে-সে কী করে সেদিন রাতে আমার ঘরে এসেছিল! দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, তা হলে সে এসেছিল কী করে! আমি ওই রাতের স্মৃতিকে একটা স্বপ্ন বলেই ভেবে নিতাম, যদি-না কুড়িয়ে পাওয়া লাল টিপটা বুকে কাঁটার মত বিঁধে থাকত। লাল টিপটা তো মিথ্যে নয়। টিপটা এখনও আমার কাছে আছে। আমার বইয়ের পাতার ভাঁজে রেখে দিয়েছি। প্রতিদিন একবার বের করে, টিপটাকে দেখে-দেখে আবোল- তাবোল ভাবি।

ভাবতে-ভাবতে মাঝে-মাঝে আমার বিবেক আমাকে দংশন করে। প্রিন্সিপাল সাহেব আমার আশ্রয় দাতা, অন্ন দাতা…আর সেই আমি কি-না তাঁর মেয়ের সাথে প্রেম করার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছি। পাতে খেয়ে বুকে ঠোকর দিতে চাচ্ছি আমি! রেবু, টুনিকে আমি পড়াই। সেই অর্থে আমি শিক্ষক, ওরা ছাত্রী, ছাত্রী-শিক্ষকের যতটুকু সম্পর্ক রাখতে হয় সেটাই থাকা উচিত, ব্যস। এ কী করছি আমি!

উল্টো-পাল্টা ভাবতে-ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি, ঘুমের মধ্যেই শুনতে পেলাম মৃদু টুন-টুন শব্দ। এক সময় ঘুম পুরোপুরিই ছুটে গেল। মেয়েদের কাঁচের চুড়ির টুনটুন শব্দ হচ্ছে। অন্ধকারেও স্পষ্টই বুঝতে পারলাম ঘরের মধ্যে কারও অস্তিত্ব। টেবিলের উপরে আলো কমিয়ে প্রায় নিভু-নিভু অবস্থায় হারিকেনটা জ্বালানো রয়েছে। গ্রামের মানুষ ঘুমাবার আগে এভাবেই হারিকেনের আলো কমিয়ে নিভু নিভু অবস্থায় জ্বালিয়ে রাখে। তা না হলে ঘুম ভেঙে পানি খেতে চাইলে বা টয়লেটে যেতে চাইলে, আলো পেতে সমস্যা হয়।

বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে হারিকেনের আলোটা বাড়ালাম। আলো স্পষ্ট হতেই দেখলাম, লাল শাড়ি পরা আমার সেই স্বপ্ন কন্যা সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে কী যেন খুঁজছে। আমি হতবাক হয়ে গেলাম! হতবাক ভাবটা সামলে কোনও মতে প্রশ্ন করলাম, ‘কী খুঁজছ তুমি? কে তুমি?’

লাল শাড়ি পরা তরুণী আমার বইয়ের মধ্যে খুঁজতেই তার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে গেল। আমিও ততক্ষণে বুঝলাম সে তার টিপটা খুঁজছিল। ওটা পাওয়ার পরে, কপালে টিপটা পরে, আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিল সে। এত সুন্দর সে হাসি! হাসিটা আমার হৃদয় স্পর্শ করল! আচমকা হাসির সাথে-সাথেই ঘরের ভিতরে দমকা হাওয়ার সৃষ্টি হলো। দমকা হাওয়ায় হারিকেনটা নিভে গেল। সমস্ত ঘর ডুবে গেল গভীর অন্ধকারে, সেই সাথে এক রাশ নিস্তব্ধতা। আমি টেবিলের উপরে হাতড়ে দেয়াশলাইটা পেয়ে গেলাম। দেয়াশলাই ধরিয়ে আবার হারিকেনটা জ্বাললাম। হারিকেনের আলোতে দেখি ঘরে কেউ নেই, লাল শাড়ি পরা স্বপ্ন কন্যা উধাও! ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ!

আমার মাথাটা এলোমেলো লাগছে। কী হচ্ছে এসব! বাস্তবিকই লাল শাড়ি পরা কেউ কি আমার ঘরে এসেছিল! নাকি ভুল দেখেছি!

বইয়ের ভাঁজে খুঁজে দেখি লাল টিপটা নেই। তা হলে! এই তরুণী কে! আমি এখন শতভাগ নিশ্চিত এই তরুণী রেবু নয়। রেবু হতে পারে না। রেবুর মত সহজ-সরল একটা মেয়ে এত রাতে আমার ঘরে আসার প্রশ্নই ওঠে না। তা হলে মেয়েটা কি অপার্থিব কেউ!

ভাবতে-ভাবতে আমার দিশেহারা অবস্থা। কার কাছে আমি এই সব কথা বলি? রেবু-টুনির কাছে? প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছে? না, তা উচিত হবে না। ভিত্তিহীন এমন কথা শুনলে তাঁরা আমাকে পাগল ভাববেন। তাঁদের মুখ থেকে এই কথা ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত গ্রামে, এমনকী কলেজে। তখন কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও আমাকে পাগল ভাববে।

সারারাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে ভোরের দিকে একটু তন্দ্রার মত এল-অমনি শুনতে পেলাম প্রিন্সিপাল সাহেবের গলা, আসাদ সাহেব, উঠে পড়ন…ফজরের আযান হয়ে গেছে…’

কী আর করা, বিছানা ছেড়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের সাথে মসজিদের দিকে গেলাম।

নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে গ্রামের এক লোকের কাছে আমরা ভয়ানক এক খবর শুনলাম।

শুনলাম, গ্রামের চেয়ারম্যান গফুর মিয়ার ছেলে মনির গত রাতে খুন হয়েছে। তার বীভৎস লাশ পাওয়া গেছে উত্তর পাইক পাড়ার তিন রাস্তার মোড়ের বট গাছের নীচে। রাতে মনির বন্ধুদের নিয়ে সাহেরপুর বাজারে যাত্রা দেখতে গিয়েছিল। যাত্রা চলাকালীন সময়ে মনিরকে লাল শাড়ি পরা, লম্বা করে ঘোমটা টানা এক নারী এসে ডাকে। মেয়েটি মনিরকে বন্ধুদের কাছ থেকে আড়ালে নিয়ে যায়। বন্ধুরা মনিরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। তারা ধরে নেয়, যাত্রার কোনও মেয়ে মনিরকে ডেকে নিয়েছে। কারণ মনিরের সাথে যাত্রার বেশ কয়েকটা মেয়ের ভাব-ভালবাসা আছে। কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন মনির ফিরে এল না, বন্ধুরা মনিরকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। সারারাত খুঁজেও মনিরকে পাওয়া যায় না। ভোর বেলা উত্তর পাইক পাড়ার বট গাছের নীচে মনিরের লাশ দেখতে পাওয়া যায়। বীভৎস লাশ-চোখ দুটি খুবলে তুলে ফেলা হয়েছে, সমস্ত শরীর তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত, কোমরের নীচে শিশ্নটাও টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। লোকজন কেউ-কেউ বলছে এ মানুষের কাজ নয়, কোনও হিংস্র জন্তু-জানোয়ার এমনটা করেছে। আবার কেউ বলছে ভূত, জিন পরীর কথা। তবে যা-ই হোক, লাশটা দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রচণ্ড আক্রোশে মানুষ জিন-ভূত হোক আর জানোয়ারই হোক, মনিরের এই অবস্থা করেছে।

মনে-মনে ভেবেছিলাম সরাসরি না হোক, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অন্য ভাবে লাল শাড়ি পরা নিশিকন্যা সম্পর্কে প্রিন্সিপাল সাহেব বা রেবু-টুনিকে কিছু জিজ্ঞেস করব। কিন্তু চেয়ারম্যানের ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে সেই সিদ্ধান্তও বদল করলাম। কারণ চেয়ারম্যানের ছেলের মৃত্যুর সাথেও লাল শাড়ি পরা, বড় করে ঘোমটা টানা কোন নারী জড়িত।

চার

আজকাল রাত আটটা-নয়টা বাজতেই গ্রামের পথ-ঘাট একেবারে জনশূন্য হয়ে যায়। সাহেবপুর বাজারের যাত্রার পালাও বন্ধ হয়ে গেছে। চেয়ারম্যানের ছেলের মৃত্যু সম্পর্কে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়েছে। সবার মনে ভূত-পেত্নী, দৈত্য- দানবের ভয় ঢুকে গেছে। ভয়ে অধিকাংশ লোকজনই সন্ধ্যার পর আর বাড়ি থেকে বের হয় না।

আমি যথারীতি সন্ধ্যার পরে রেবু-টুনিকে ঘণ্টা খানেক পড়াই। পড়ানো শেষে নিজের ঘরে বসে গল্পের বই পড়ি অথবা নিশিকন্যাকে নিয়ে ভাবি।

আজকাল একটা ব্যাপার লক্ষ করছি, নিশিকন্যাকে নিয়ে ভাবতে আমার খুব ভাল লাগে। মনের ভিতরে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করি। সত্যি কথা বলতে কী, এর আগে কোনও মেয়েকে আমার এত ভাল লাগেনি। কী অপূর্ব তার চাহনি! মনে হয় ওই চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে সারা জীবন পার করে দেয়া যাবে। কী লাবণ্য তার চেহারায়! কী মিষ্টি তার হাসি!…

ও রকম অদ্ভুত গতিবিধির একটা মেয়েকে আমার ভয় পাওয়ার কথা! ভয় যে একেবারে পাই না তা বললে ভুল হবে। তবে ভয়ের চেয়ে ভাল লাগাটা আরও বেশি।

.

অনেক রাত। ঘুমন্ত গ্রাম। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। মাঝে-মাঝে রাত জাগা পাখি আর কুকুরগুলোর নিজেদের ভাষার কথোপকথন শোনা যাচ্ছে।

আমি বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি। চোখে ঘুম নেই। নিশিকন্যার কথা ভাবছি। টেবিলের উপরে আলো কমিয়ে রাখা হারিকেন। আবছা আলোর মাঝে আমার অস্থির চোখ দুটো যেন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আচমকা আমার শিয়রের পিছনে কাঁচের চুড়ির টুনটুন শব্দ। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি লাল শাড়ি পরা নিশিকন্যা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি-হাসি। আমার বুকটা টিপ-টিপ করে উঠল। নিশিকন্যা পিছন থেকে সরে এসে আমার শিয়রের পাশে বিছানায় বসল। তার গায়ের সৌরভে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। নিশিকন্যা প্রথমবারের মত মুখ খুলল। কী মিষ্টি গলার স্বর!

‘তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? এতক্ষণ ধরে তো আমার অপেক্ষাই করছিলে।’

আমি দৃঢ় গলায় বললাম, ‘আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না। সত্যি করে বলো তো কে তুমি?’

‘আমি কে তা জানলে তুমি আরও ভয় পাবে। তার চেয়ে বরং আমার পরিচয়টা গোপনই থাক।’

‘না, আমি ভয় পাই না। কারণ…’ কথা শেষ না করে আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

‘কী কারণ!’

ভণিতা না করে বললাম, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি।’ আমার গলা কেঁপে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বললাম, ‘ভালবাসার মানুষকে কেউ ভয় পায় না।’

ভালবাসার কথা শুনে নিশিকন্যার চোখ আর্দ্র হয়ে উঠল। ভাঙা গলায় নরম স্বরে বলল, ‘তুমি কী করে বুঝলে, আমি যে মানুষ।’

‘তা হলে তুমি কী!’

চোখ মুছতে মুছতে নিশিকন্যা বলল, ‘তা আরেক দিন বলব। এখন আমি চলে যাব।’

আমি নিশিকন্যার হাত চেপে ধরলাম। মখমলের মত কোমল আর মাখনের মত নরম সেই হাত। মুখে বললাম, ‘আজই বলতে হবে।’

‘আজ নয় কাল, আমি কাল আবার আসব। এখন আমাকে যেতেই হবে।

নিশিকন্যা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। দরজার সামনে গিয়ে পিছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিল। আমিও বিছানা থেকে নেমে ভার পিছু নিলাম। দরজার কাছে আমি পৌছাতে পৌছাতে সে বন্ধ দরজা গলে বেরিয়ে গেল। আমার নার্ভ তখন এতই উত্তেজিত ছিল যে সেই ব্যতিক্রম চোখেই পড়ল না। দরজা খুলে আমিও বাইরে বের হলাম। ফকফকা চাঁদের আলো। নিশিকন্যা কেমন অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে। আমিও তার পিছু-পিছু হাঁটতে লাগলাম। আমি যতই দ্রুত হেঁটে তার কাছে পৌঁছাতে চাই সে ততই দূরে সরে যায়। নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব রয়েই যাচ্ছে। এক সময় সে ঝোপ-ঝাড়ে ঘেরা অন্ধকারের মাঝে মিলিয়ে গেল। আমার সম্বিত ফিরে এল। দেখলাম আমি প্রিন্সিপাল সাহেবের বাড়ির একেবারে উত্তর দিকে এসে পৌছেছি। ঝোপ-জঙ্গলে ভরা একটা জায়গা। চারদিক থেকে বুক সমান দেয়াল দিয়ে ঘেরা।

পাঁচ

সন্ধ্যায় রেবু-টুনিকে পড়াচ্ছি। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে গত রাতের নিশিকন্যার স্মৃতি।

বাড়ির উত্তর দিকের জংলা জায়গায়, যেখানে গিয়ে নিশিকন্যা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল, সেখানটা দিনের আলোতে আজ ভালভাবে দেখে এসেছি। দুই থেকে আড়াই কাঠা জায়গা, পলেস্তারা খসে পড়া নোনা ধরা ইঁটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। রাতের বেলা যতটা ঝোপ-ঝাড়ে ঘেরা জংলা জায়গা বলে মনে হয়েছিল দিনের আলোতে দেখা গেল বাস্তবে ততটা নয়। অযত্ন আর অবহেলায় বড় হয়ে ওঠা কয়েকটা গাছ আর সামান্য ঝোপ-ঝাড়। ভিতরে ঢোকার জন্য মরিচা ধরা জীর্ণ একটা গেটও রয়েছে।

আমি এখন বুঝতে পারছি ওই জায়গাটায় কী! তার পরেও নিশ্চিত হওয়ার জন্য টুনিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের বাড়ির উত্তর দিকের দেয়াল ঘেরা ওই জায়গাটা কী?’

টুনি তার স্বভাবসুলভ হড়বড় করে বলতে লাগল, বাড়ির কবরস্থান। ওখানে আমার দাদা-দাদীর কবর আছে, অনেক পুরানো কবর। আর আমার…’ টুনির গলার স্বর বাষ্পরুদ্ধ হয়ে ওঠে, ‘বড় আপুর কবর আছে। বড় আপুর নাম ছিল রেণু। রেণু আপু আমাকে খুব ভালবাসত… ‘

হঠাৎ রেবু চটে যাওয়া গলায় বলে উঠল, টুনি, এসব কী হচ্ছে! পড়া বাদ দিয়ে গল্প বলা হচ্ছে! রেবু কটমট চোখে টুনির দিকে তাকাল। রেবুর এমন রুক্ষ মূর্তি এর আগে আমি আর দেখিনি।

টুনি রেবুর ধমক খেয়ে কথা বন্ধ করে, বই খুলে, ছলছল চোখে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমি কৌতূহল নিয়ে দু’জনকেই উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘তোমাদের বড় বোন কীভাবে মারা গিয়েছিল?’

রেবু-টুনি দু’জনই মাথা নিচু করে বসে আছে। রেবুর চোখও এখন ছলছল করছে। তাদের মুখভঙ্গি দেখে বুঝলাম তারা তাদের বোনের মৃত্যুর কারণ বলতে চায় না। তা ছাড়া রেবুর বোধ হয় কিছুটা অভিমানও রয়েছে তার মৃত বোনের প্রতি।

.

রাতের খাবার নিয়ে প্রিন্সিপাল সাহেব আমার ঘরে এলেন।

খাওয়ার ফাঁকে আমি প্রিন্সিপাল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যর, আপনার বড় মেয়েটি কীভাবে মারা গিয়েছিল?’

কথাটা শোনার পর প্রিন্সিপাল সাহেব চোখ বড়-বড় করে পলকহীন চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বললেন, ‘আপনি কার কাছে জেনেছেন আমার যে আর একটি মেয়ে ছিল!’

আমি চুপ করে রইলাম। বুঝলাম টুনির নাম বললে, ঘরে গিয়ে টুনিকে বকাঝকা করবেন। কারণ, বড় মেয়ের নাম শুনে তিনি যেমন আপসেট হয়ে পড়েছেন!

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে, প্রিন্সিপাল সাহের রাগী-রাগী গলায় বললেন, ‘আপনি ভুল শুনেছেন। আমার আর কোনও মেয়ে ছিল না। রেবু আর টুনি আমার দুটি মাত্র মেয়ে।’

গত রাতের মত ঠিক বারোটা এক মিনিটের সময় নিশিকন্যা এসে আমার ঘরে হাজির হলো।

আমরা দু’জন মুখোমুখি হয়ে বসলাম। মৃদু আঁচে হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের ম্লান আলোতে দু’জনের চোখ টলমল করছে। দু’জন-দু’জনার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে দু’জন-দু’জনার কত দিনের চেনা! কত আপনজন!

আমি নিশিকন্যার একটা হাত কোলে তুলে নিয়ে বললাম, ‘এখন বলো কে তুমি? কেন তুমি আমাকে এভাবে তোমার রূপের মোহে পাগল করলে!’

নিশিকন্যা কাতর গলায় বলল, ‘তুমি শুনবে আমার কথা! আমার কষ্টগুলো! আমার না বলা কথাগুলো! যে কথাগুলো আজ পর্যন্ত কাউকে আমি বলতে পারিনি।’

আমি নিশিকন্যার হাতে ভরসা দেয়ার ভঙ্গিতে মৃদু চাপ দিয়ে বললাম, ‘অবশ্যই শুনব! তোমার কথা শুনব বলেই তো আজ সারাদিন ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি।’

‘শোনো তা হলে, আমি প্রিন্সিপাল মোবারক হোসেনের বড় মেয়ে রেণু। রেবু-টুনির বড় বোন রেণু।’

এই পর্যন্ত শুনেই আমি অবাক গলায় বললাম, ‘তুমি তো…’

নিশিকন্যা আমার ঠোঁটে তার আঙুল চেপে ধরে বলল, ‘আগে সব শোনো, তার পরে যা বলার বলবে।’

‘…ঘরের বড় মেয়ে বলে বাবা আমাকে খুব ভালবাসতেন। বাবার সাধ্যের মধ্যে আমার এমন কোনও আবদার নেই যা বাবা পূরণ করতেন না। আমি যদি বলতাম বাবা, আমাকে আলতা এনে দাও। বাবা চার মাইল দূরের হাট থেকে আমার জন্যে আলতা কিনে আনতেন। আমি নেইলপালিশ চাইতাম, বাবা নেইলপালিশ কিনে এনে দিতেন। আমি চুল বাঁধার ফিতে, চুড়ি চাইতাম, বাবা কিনে এনে দিতেন। বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিলাম আমি।

‘সেবার আমি এইচ.এস.সি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বাবার সাথেই কলেজে যাই, কলেজ থেকে ফিরে আসি। বাবা তিন দিনের জন্যে ঢাকা গেলেন। কলেজের কী এক ব্যাপারে তাঁকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যেতে হবে।

‘ঢাকা যাওয়ার আগে বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মা, ঢাকা থেকে তোর জন্য কী আনব?’’

আমি খুশিতে নেচে উঠে বললাম, ‘বাবা, আমার জন্যে একটা লাল রঙের জামদানি শাড়ি আনবে।’ লাল রঙ আমার খুব পছন্দের।

‘বাবা ঢাকায়। আমাকে একা একাই কলেজে যেতে হয়, কলেজ থেকে ফিরতে হয়। একা-একা যেতে-আসতে আমার ভয়-ভয় লাগে। মনকে অভয় দেই, মাত্র তো তিনটা দিন, তার পরেই তো বাবা ফিরে আসছেন।

‘সেদিন কলেজের ক্লাস শেষে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। আমরা কয়েক বান্ধবী মিলে কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টাখানেক বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করলাম। বৃষ্টিটা থামছেই না। আকাশ ভেঙে যেন বৃষ্টি শুরু হয়েছে! বৃষ্টি না থামায় বান্ধবীদের সবাই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই বাড়ির দিকে রওনা দিল। কলেজের বারান্দায় আমি একাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। যদি বৃষ্টি থামে সেই অপেক্ষায়, খিদেয় পেটের ভিতর চোঁ-চোঁ করছে। সকালে প্রায় না খেয়েই কলেজে এসেছি। আর সইতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিতে ভিজেই বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে, আমি একা হেঁটে চলছি।

‘হাঁটতে-হাঁটতে ইঁট বিছানো রাস্তার পাশের ক্লাবটার সামনে এসে পৌছালাম। চেয়ারম্যানের বখাটে ছেলে মনির এবং তার আরও কিছু বখাটে বন্ধুরা মিলে এই ক্লাবটা বানিয়েছে। তারা সব সময় ক্লাবের সামনে বসে কেরাম খেলে আর স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের দেখলে উত্ত্যক্ত করে। ক্লাবের সামনে এসে আমার কেমন ভয়-ভয় লাগছে। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই, নির্জন চারদিক, ক্লাবেও কেউ নেই। হঠাৎ কোথা থেকে যেন মনির এসে আমার সামনে দাঁড়াল। তার চোখে-মুখে একটু আগেই নেশা করার স্পষ্ট ছাপ। সে আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই যে, রূপবতী, বৃষ্টিতে ভিজে তোমার যৌবন যে একেবারে উপচে পড়ছে।’ আমি ভয়ে জবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পশুটা আবার বিচ্ছিরি ভাবে হেসে বলল, ‘তুমিও একা, আমিও একা, চল না ক্লাব ঘরের ভিতরে গিয়ে একটু রঙ- তামাশা করি।’ সে আমার গায়ে হাত দিতে চাইল। আচমকা আমি তার গালে একটা চড় বসালাম। চড় খেয়ে সে সত্যি-সত্যিই জানোয়ার হয়ে উঠল। আমাকে টেনে-হিঁচড়ে ক্লাব ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল। সেদিন আমার চিৎকার আর কান্না কেউই শুনতে পেল না।

নিশিকন্যা কেঁদে উঠে বলল, ‘শয়তানটা আমাকে নষ্ট করল।’

আমি নিশিকন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ কাঁদার পর নিশিকন্যা ভাঙা-ভাঙা গলায় আবার বলতে শুরু করল, ‘বাড়িতে ফিরে এলাম। আমার মা-বোনেরা আমাকে দেখে কিছুই বুঝল না! বাথরুমে ঢুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোসল করলাম। কিছুতেই যেন আমার গা থেকে ওই পশুটার শরীরের দুর্গন্ধ যাচ্ছে না। নিজেকে অপয়া মনে হলো। কী করে এই মুখ বাবা-মাকে দেখাব? বৃষ্টি ঝরা আকাশটার মত আমিও সারাদিন আমার ঘরে বসে কাঁদতে থাকলাম।

‘সন্ধ্যার পরে বাবা ঢাকা থেকে ফিরে এলেন। বাড়ি ফিরেই বাবা তাঁর আদরের মেয়েকে রেণু-রেণু বলে ডাকলেন। বাবা তো জানেন না তাঁর আদরের মেয়েটা আজ শেষ হয়ে গেছে।

‘বাবা বসার ঘরে বসে আছেন। আমি ভাল ভাবে চোখ-মুখ মুছে, বসার ঘরের দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

‘বাবা আমাকে দেখেই অনুতপ্ত গলায় বললেন, ‘মা, আমাকে ক্ষমা করে দে। তোর লাল রঙের জামদানি শাড়ি আনতে একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। বাড়িতে এসে মনে পড়ল। এত ব্যস্ততা ছিল! আগামী বার ঠিক এনে দেব।’

‘আমি ভারাক্রান্ত গলায় বললাম, ‘ঠিক আছে, বাবা।’

‘বাবা উদ্বিগ্ন গলায় আবার বললেন, ‘মা, তোকে অমন দেখাচ্ছে কেন? গায়ে জ্বর এসেছে নাকি! কাছে আয় দেখি গায়ে জ্বর কি-না। ‘

‘আমি কোনওমতে নিজেকে সামলে বললাম, ‘না, জ্বর আসেনি।’ ছুটে নিজের ঘরে চলে গেলাম।

‘আমি নিজের ঘরে বসেও শুনছি, বাবা চেঁচিয়ে বলছেন, ‘রেণু, মা, শাড়ি আনিনি বলে তুই তো আমার উপর রাগ করেছিস! দেখিস সবচেয়ে দামি শাড়িটাই তোকে এনে দেব।’

‘বাবা ভেবেছেন শাড়ির জন্য আমি মন খারাপ করেছি। অথচ আমি যে…আমার মনের ভিতর ঝড় বইতে শুরু করেছে। আমি নষ্ট হয়ে গেছি। আমার এই শরীরটা আজ থেকে অপবিত্র। কী করে এই কলঙ্কিত মুখ আমি সবাইকে দেখাব। বুকের ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছিল।

‘রাত বারোটা। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম। ঘরের আড়ার সাথে গলায় দড়ি দিয়ে আমি আত্মহত্যা করলাম।

‘ভোর বেলা বাবা-মা, বোনেরা আমার ঝুলন্ত লাশ দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। মা-বোনেরা অনেক কাঁদল কিন্তু বাবা একটুও কাঁদল না। বাবা মনে করলেন, তিনি শাড়ি আনেননি বলেই আমি আত্মহত্যা করেছি। বাবার প্রচণ্ড অভিমান হলো। যে আদরের মেয়ে সামান্য একটা শাড়ির জন্য বাবা-মায়ের ভালবাসাকে উপেক্ষা করে চির বিদায় নিতে পারে, তার জন্যে কেঁদে কী লাভ! বাবা আমাকে ভুল বুঝলেন! সবাই আমাকে ভুল বুঝল!’

নিশিকন্যা ডুকরে কেঁদে উঠল। আমি নিশিকন্যার মাথাটা আমার বুকের মাঝে গুঁজে নিয়ে হাত বুলাতে লাগলাম। তার চোখের জলে আমার বুকটা ভিজে গেল, আর বুকের ভিতরটা হু-হু করতে লাগল।

কাঁদতে-কাঁদতে নিশিকন্যা এক সময় বলে উঠল, ‘তুমি জানো না আমি বেঁচে থাকলে তোমার সাথেই আমার বিয়ে হত! আমি তোমার বউ হতাম! যেদিন থেকে এটা আমি বুঝলাম, সেদিন থেকেই আমি তোমার সাথে দেখা দিতে শুরু করলাম। কী মধুর হত আমাদের বিবাহিত জীবন! সব শেষ হয়ে গেল। আজ আমি একটা অতৃপ্ত আত্মা। যে আত্মার কখনোই মুক্তি মিলবে না।’

আমি ভেজা গলায় বললাম, ‘কিছুই শেষ হয়নি। আমি আজও তোমার। শুধু তোমার। শুধু তোমারই জন্যই এই আমি।’

পরিশিষ্ট

রোজ রাতে নিশিকন্যা আমার কাছে আসে। না সে আর এখন নিশিকন্যা নয়, সে আমার প্রেয়সী।

আমার প্রেয়সী আর আমি সারারাত জেগে গল্প করি। কত কথা বলি আমরা দু’জনে-সুখের কথা, দুঃখের কথা, হাসির কথা, কষ্টের কথা… কত শত বিচিত্র বিষয় নিয়েই না কথা হয় আমাদের! যেন কথা ফুরায়ই না! রাত ফুরিয়ে যায়, রাত আসে, সে আমার আরও আপন হয়।

জোছনা রাতে আমরা দু’জন হাত ধরে গ্রামের মেঠো পথে হেঁটে বেড়াই। বৃষ্টির রাতে দু’জনে এক সাথে বৃষ্টিস্নান করি। কী আনন্দ দু’জনার মনে!

মাঝে-মাঝে আমি তাকে কবিতা পড়ে শোনাই। সে মুগ্ধ হয়ে শোনে। তার চোখ দিয়ে মুক্তোর মত অশ্রু ঝরে পড়ে। সে চোখ মুছে গাঢ় স্বরে বলে, ‘এই, কবিতাটা আবার পড়ো তো!’

চন্দ্রভুক রাতে,
আবছা অন্ধকার ঘরে বসে থাকি চুপচাপ।
শোনা যায় নূপুরের মৃদু শব্দ।
সহসা চমকে উঠি কে? কে?
চাপা হাসির আওয়াজ,
চুড়ির হালকা গুঞ্জন ভেসে আসে।
অজানা ফুলের সৌরভ ঘিরে রাখে চারিদিক,
মুগ্ধ নয়নে দেখি আমার প্রেয়সীর মুখ।
অধীর আগ্রহে আছি আমি
ভোরের অপেক্ষায়,
প্রথম সূর্যের, প্রথম আলোয়
তাকে দেখব বলে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *