অদেখা ভুবনের সে

অদেখা ভুবনের সে

এক

‘স্যর, রাতে কি আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়! দয়া করে এই সেলের আলোটা নিভাবেন না। অন্ধকারে খুব ভয় লাগে।’

কারারক্ষীদের নেতা আরিফুর রহমান অবাক হয়ে কনডেম সেলের আসামী কালা খাঁ-এর দিকে তাকান। প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, মিশমিশে কালো কালা খাঁর লাল বড়-বড় দুটি চোখ, থ্যাবড়ানো নাক ও মোটা ঠোঁটের দিকে তাকালে মনে হয় জলজ্যান্ত একটা দানব। এমন দানব আকৃতির লোকটা এ কী কথা বলছে! আলো নিভালে অন্ধকারে ভয় লাগে!

কালা খাঁ কাতর স্বরে আবার মিনতি করল, ‘স্যর, দয়া করে আলোটা নিভাবেন না।’

সেন্ট্রাল জেলে কালা খাঁকে আজই আনা হয়েছে। জোড়া খুনের দায়ে তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। আট ও দশ বছরের দুই সহোদরা বোনকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে সে। মামলার বিবরণে বলা হয়েছে রামনগর গ্রামের চেয়ারম্যান মান্নান খানের দুই মেয়ে নিপা ও দিপাকে গত বছর ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ ধর্ষণ করে হত্যা করে সে। ঘটনার দিন দুপুর থেকে চেয়ারম্যানের মেয়ে দুটিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মেয়ে দুটি বাড়ির সামনের উঠানে খেলছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে, গ্রামের উত্তর দিকের জঙ্গুলে ঝোপ-ঝাড় ঘেরা ভাঙা মন্দিরের ভিতরে তাদের মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মেয়ে দুটি রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে ছিল। পাশে বসে কালা খাঁ চিৎকার করে কাঁদছিল আর বলছিল, ‘আমি পারলাম না, আমি বাঁচাতে পারলাম না…’

লোকজন কালা খাঁকে হাতেনাতে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। তবে একটা বিষয়-গ্রামের কেউ এর আগে কালা খাঁকে সেই গ্রামে দেখেনি। জেল-হাজতে রিমাণ্ডে কালা খাঁকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেও তার পরিচয়, তার বাবার নাম, তার গ্রামের নাম, তার আত্মীয়-স্বজন, সে কোথা থেকে এসেছে কিছুই জানা যায়নি। সব প্রশ্নের উত্তরে সে একই কথা বলেছে- আমি কিছুই জানি না।

এমনকী সে তার নিজের নামও বলতে পারেনি। পুলিশ চার্জশীট লেখার সময় কাজের সুবিধার জন্যে নিজেরাই নাম দিয়ে নেয় কালা খাঁ।

তার ব্যবহারের মধ্যেও কেমন অপ্রকৃতিস্থ ভাব। যখন তাকে খেতে দেওয়া হয় তখন সেই খাবারের দিকেও সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার ভাবলেশহীন চেহারা দেখে তখন মনে হয় খাবার দিয়ে সে কী করবে, কীভাবে খাবে, তা সে বুঝতে পারছে না।

কারারক্ষী আরিফুর রহমান ফাঁসির আসামী কালা খাঁ-এর আচরণে বেশ কিছুটা হতচকিত হয়ে গিয়েছেন। লোকটা দেখতে দানবের মত, কিন্তু আচার-আচরণ সহজ সরল আত্মভোলা লোকদের মত। তাকে দেখে মনে হয় পৃথিবীর কোনওকিছুর সাথেই সে পরিচিত নয়। তার ফাঁসির হুকুম হয়েছে-কথাটা শুনে, চোখ বড়-বড় করে শুধু তাকিয়ে ছিল। সন্দেহ হয়েছে ফাঁসি ব্যাপারটা কী সেটাও হয়তো সে বুঝতে পারেনি।

দুই

কারারক্ষীদের হেড আরিফুর রহমান বেশ কয়েক বছর ধরে একটা মারাত্মক রোগে ভুগছেন। ডাক্তারি ভাষায় যে রোগের নাম ইউরেথ্রাইটিস। মূত্রনালীতে ক্লামাইডিয়া ট্রাকোমটিস নামে এক ধরনের জীবাণুর সংক্রমণে এই রোগ হয়। প্রস্রাব করার সময় প্রচণ্ড ব্যথা ও জ্বালাপোড়া হয়। এতই জ্বালাপোড়া হয় যে কখনও ভালভাবে আরাম করে প্রস্রাবই করতে পারেন না। বেশ কয়েকজন ডাক্তারের চিকিৎসা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি, বরং দিনে দিনে রোগের প্রকোপ আরও বাড়ছে। এখন তো বেশ কয়েক মাস ধরে রাতে স্ত্রীকেও এড়িয়ে চলতে হয়। ধীরে ধীরে জীবনটা একেবারে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। অথচ আরিফুর রহমানকে উপর থেকে দেখে কেউ একটুও টের পান না তিনি কতটা যন্ত্রণাদায়ক জীবন অতিবাহিত করছেন।

গত দুই দিন ধরে আরিফুর রহমান বেশ ব্যস্ততার মধ্যে আছেন। হানিফ মোল্লা নামে এক ফাঁসির আসামীর ফাঁসি আগামী সপ্তাহে কার্যকর করা হবে। ফাঁসির মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে এই জেলে কোনও জল্লাদ না থাকায় যশোর থেকে এক জল্লাদ আনা হবে। সেই জল্লাদের ব্যাপারে যশোর জেলের সাথে যোগাযোগ করতে হচ্ছে।

এতসব ব্যস্ততার মধ্যে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত হারুন মৃধা হয়ে উঠেছে গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত। সে যে সব কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে তাতে ইচ্ছে করে থাবড়িয়ে মাড়ি সহ সব কটা দাঁত ফেলে দিতে। তার আবার দূর সম্পর্কের কেমন যেন মামা হয় বর্তমান এক সংসদ সদস্য। সেই মামার জোরেই তো কারারক্ষীর চাকরিটা পেল। কাজে যোগ দেয়ার পর থেকে প্রতিদিন একটার পর একটা উল্টাপাল্টা কাজ করছে হারুন মৃধা। কয়েদিদের সাথে পশুর মত আচরণ করে। বিশেষ করে ফাঁসির আসামীদের দেখলেই বিভিন্ন তিরস্কারমূলক গালি-গালাজ করে। আসামীরা যখন গারদের শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তখন হঠাৎ বাইরে থেকে তাদের হাতে রোলার দিয়ে প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় আঘাত করে। সেদিন ফাঁসির আসামী হানিফ মোল্লার আঙুলে আঘাত করে একটা আঙুল ভেঙে ফেলে। আর এক আসামী পানি খেতে চাইলে তাকে গ্লাসে প্রস্রাব করে তা খেতে দেয়।

এই সব কাজ কর্ম দেখে আরিফুর রহমান প্রচণ্ড রেগে, চড়া গলায় বলেছেন, ‘আপনার সমস্যা কী? আপনি কয়েদিদের সাথে এমন পিশাচের মত আচরণ কেন করেন?’

রগচটা হারুন মৃধা ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর দিয়েছে, ‘আমি এমনই। আমার যা ইচ্ছে হয় তা-ই করি। আপনার কোনও অসুবিধে আছে?’

হারুন মৃধার কথা শুনে আরিফুর রহমানের মেজাজ পুরোপুরি বিগড়ে গেছে। এর পরেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে অসহিষ্ণু গলায় বলেছেন, ‘আপনি এই জেল কয়েদিদের দায়িত্বে না থেকে ট্রান্সফার হয়ে কোনও থানা হাজতে চলে যান।’

‘না, আমি এখানেই থাকব। ফাঁসি দেওয়া দেখতে আমার খুব ভাল লাগে। খুব ইচ্ছে নিজের হাতে একটা ফাঁসি দেওয়া।‘

হারুন মৃধার কথা শুনে আরিফুর রহমান অবাক হয়েছেন। ফাঁসি দেওয়া দেখতে ভাল লাগে! কী অদ্ভুত কথা! অতি নিষ্ঠুর মানুষও কখনও বলবে না চোখের সামনে একটা মানুষ ছটফট করে মরবে সে দৃশ্য দেখতে ভাল লাগে। মনে হচ্ছে লোকটা স্যাডিস্ট টাইপের।

তিন

রাত আটটার মত বেজেছে। প্রত্যেক সেলের আসামীদের রুটি আর সবজি ভাজি খেতে দেওয়া হয়েছে।

আরিফুর রহমান, আব্দুল হক, হারুন মৃধা ও জয়ন্ত চার কারারক্ষী জেলের প্রতিটা সেলের সামনে চক্কর দিচ্ছে। আসামীদের আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করছে। ফাঁসির আসামী কালা খাঁ উদাস ভঙ্গিতে রুটি ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে। কালা খাঁয়ের পাশের সেলের আর এক ফাঁসির আসামী হানিফ মোল্লা একটা কালো ইঁদুর কোলে নিয়ে বসে, রুটি ছিঁড়ে-ছিঁড়ে নিজে খাচ্ছে এবং ছোট ছোট টুকরো করে ইঁদুরটাকে খেতে দিচ্ছে। স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যার দায়ে লোকটার ফাঁসির হুকুম হয়েছে। লোকটা কেমন যেন পাগলাটে ধরনের। ফাঁসির হুকুম হওয়ার পর এই কনডেম সেলে আনার কিছুদিনের মধ্যেই কেমন করে যেন একটা নেংটি ইঁদুরের সাথে খাতির জমিয়ে ফেলে। প্রতি বেলায় খাওয়ার সময় ইঁদুরটাকে সাথে নিয়ে খাবার খায়। নিজ সন্তানের মত ইঁদুরটার প্রতি তার স্নেহ-মমতা। ইঁদুরটার বাসা বোধহয় সেলগুলোর দক্ষিণ পাশের কোনার স্টোর রুমটায়। প্রতি বেলায় খাওয়ার সময় ইঁদুরটা হানিফ মোল্লার কাছে উপস্থিত হয়। কখনও যদি এমন হয় যে ইঁদুরটা আসতে দেরি করছে, তা হলে হানিফ মোল্লা অস্থির হয়ে ওঠে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করে। ইঁদুরটার একটা নামও রেখেছে, ‘সুজন’। আরিফুর রহমান একদিন হানিফ মোল্লাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইঁদুরের নাম সুজন রাখলে কেন?’

হানিফ মোল্লা সে প্রশ্নের উত্তরে অবাক হয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘কে বলেছে ও ইঁদুর! ও তো আমার ছেলে-সুজন।

চারজনের পর্যবেক্ষণ দলটা ফাঁসির আসামী হানিফ মোল্লার সেলের আরও কাছে এসে দাঁড়াল। হানিফ মোল্লা তাদের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে মৃদু হাসল। হানিফ মোল্লার কোলে থাকা ইঁদুরটা এত লোকজন দেখে আতঙ্কিত হয়ে কোল থেকে লাফিয়ে পড়ল, সেলের বাইরে এসে লুকিয়ে থাকার স্থান স্টোর রুমের দিকে যেতে শুরু করল। আচমকা হারুন মৃধা হাতের রোলারটা ছুঁড়ে মারল ইঁদুরটার গায়ে। রোলারটা ইঁদুরের গায়ে লেগে, পিঠের মাঝ বরাবর থেঁতলে দিল। রক্তাক্ত অবস্থায় ইঁদুরটা ছটফট করতে শুরু করল। এই দৃশ্য দেখে সেলের মধ্যে হানিফ মোল্লা পাগলের মত হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

‘আমার সুজন মরে যাচ্ছে, আমার সুজন মরে যাচ্ছে… কেউ ওকে বাঁচান…’

ঘটনার আকস্মিকতায় আরিফুর রহমান একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। অগ্নি দৃষ্টিতে হারুন মৃধার দিকে চাইলেন। ইঁদুরটার ছটফট করে মরে যাওয়া আর হানিফ মোল্লার চিৎকার করে কান্না দেখে কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসছে লোকটা। 1

হানিফ মোল্লার পাশের সেলের কালা খাঁ গারদের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, ইঁদুরটাকে জলদি আমার হাতে তুলে দিন আমার হাতে তুলে দিন…’

কালা খাঁর অবিরাম অনুরোধে জয়ন্ত মৃতপ্রায় রক্তাক্ত ইঁদুরটা কালা খাঁর হাতে তুলে দিল। কালা খাঁ তার ডান হাতের তালুতে ইঁদুরটাকে রেখে, বাম হাতটা উপুড় করে ইঁদুরকে দুই হাতের তালুর মধ্যে বন্দি করল, তারপর চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কী যেন আওড়াতে শুরু করল। দু-হাতের তালুর মধ্যে বন্দি ইঁদুরের শুধু লেজটা একটা আঙুলের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে থাকল। সেই লেজটা মৃদু নড়াচড়া করছে। কয়েক মুহূর্ত পর, দু-হাতের তালুর মাঝে তীব্র আলোর ঝলকানির সৃষ্টি হলো। আঙুলের ফাঁক-ফোকর দিয়ে সেই তীব্র রশ্মির কিছুটা বাইরে বেরিয়ে এল। সেলটা উজ্জ্বল আলোর প্রখরতায় ভরে উঠল। অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল এই সময়। জেলের সমস্ত বৈদ্যুতিক বাল্বের আলো কমে প্রায় নিভু-নিভু অবস্থা হলো।

কালা খাঁর হাতের তালুর ভিতরে আলোর ঝলকানি নিভে যাওয়ার সাথে- সাথে বালবগুলো আবার আগের অবস্থা ফিরে পেল। কালা খাঁ ডান হাতের তালুর উপরে উপুড় করা বাম হাতটা ধীরে-ধীরে সরিয়ে ফেলল। ডান হাতের তালুতে ইঁদুরটাকে দেখা গেল। সুস্থ সবল একটা ইঁদুর। ইঁদুরের গায়ে বিন্দুমাত্র কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই।

এ কী করে সম্ভব! আরিফুর রহমান, আব্দুল হক, জয়ন্ত—সবাই প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেল। নীরবে পলকহীন ভাবে তারা কালা খাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে।

নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলল হারুন মৃধা। জেদী গলায় তিরস্কার করার ভঙ্গিতে বলল, ‘ও একটা কালো জাদুকর। ওকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে না মেরে আগুনে পুড়িয়ে মারা উচিত। ও যতদিন বেঁচে থাকবে…’

আরিফুর রহমান হারুন মৃধাকে কড়া গলায় ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। ধীর পায়ে তিনি কালা খাঁর সেলের কাছে গিয়ে গারদের শিক ধরে দাঁড়িয়ে, নরম গলায় বললেন, ‘আপনি এটা কীভাবে করলেন?’

কালা খাঁ ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঝিম ধরা গলায় বলল, ‘স্যর, আমি এখন খুব ক্লান্ত, খুব ঘুম পাচ্ছে আমার। আপনি বরং ইঁদুরটা আমার হাত থেকে নিন যা জানতে চান তা পরে কোনও এক সময় বলব।’

কালা খাঁ সেলের ভিতরে এক কোনায় গিয়ে ময়লা কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল।

চার

আরিফুর রহমান চিন্তিত ভঙ্গিতে অফিস-ঘরে বসে আছেন।

হানিফ মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার দিন এগিয়ে আসছে। আর মাত্র চারদিন বাকি। এদিকে জল্লাদ পাওয়া যাচ্ছে না। যশোর থেকে যে জল্লাদ আসার কথা ছিল, সে আসতে পারবে না। তার নাকি ম্যালেরিয়া হয়েছে। ঢাকা, খুলনা বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করা হয়েছে, কিন্তু সেখানেও কোনও জল্লাদকে পাওয়া যাচ্ছে না।

চিন্তায় আরিফুর রহমানের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে আছে। অবশ্য শুধু চিন্তার কারণে ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে আছে বললে ভুল হবে। আজ সকাল থেকে তাঁর মূত্রনালীর জ্বালাপোড়া ও ব্যথার তীব্রতা আরও বেড়েছে। প্রস্রাবে পেট ভরে আছে কিন্তু এক ফোঁটাও প্রস্রাব করতে পারছেন না।

আরিফুর রহমান টয়লেট থেকে আর একবার প্রস্রাব করার চেষ্টা করে এলেন। কোনও কাজ হলো না, যন্ত্রণা আরও বেড়েছে। যন্ত্রণায় তিনি মুখ বিকৃত করে বসে আছেন।

ভিতর থেকে শোরগোলের শব্দ হচ্ছে। কে যেন উচ্চ শব্দে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। জয়ন্ত উত্তেজিত ভঙ্গিতে ছুটে এল, উত্তেজনা আর বিরক্তি নিয়ে আরিফুর রহমানকে জানাল, ‘হারুন মৃধা সেলের পাশের স্টোর রুমটা তছনছ করে খোঁজাখুঁজি করছে সেই ইঁদুরটাকে মারার জন্যে।’

আরিফুর রহমান যন্ত্রণা চেপে রেখে সেলের পাশের স্টোর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হারুন মৃধা স্টোর রুমের ভাঙা চেয়ার-টেবিলগুলো এক- এক করে সরিয়ে ইঁদুরটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।

আরিফুর রহমান কড়া গলায় কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করছেন আপনি?’

হারুন মৃধা আরিফুর রহমানের উপস্থিতির কোনও তোয়াক্কা না করে, নিজের মনে রাগে গজগজ করতে করতে স্টোর রুমের মাল-পত্র সরাতেই থাকল। সব কিছু সরানোর পর এক কোনায় পড়ে থাকা ছেঁড়া কম্বলটা তুলতেই দেখা গেল ইঁদুরটাকে। ইঁদুরটা ভয়ে চুপসে ছোট হয়ে আছে, এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে, কোনদিকে ছুটে পালিয়ে যাওয়া যায়।

হারুন মৃধা হাতের কাছে টেবিলের একটা ভাঙা পায়া পেয়ে সেটা নিয়ে মারার উদ্দেশ্যে ছুটল। আরিফুর রহমান তড়িৎ গতিতে গিয়ে হারুন মৃধাকে জাপটে ধরলেন। সুযোগ বুঝে ইঁদুরটাও দৌড়ে পালাল। হারুন মৃধা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে আরিফুর রহমানের হাতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে জোরাজুরি শুরু করল। আচমকা হাঁটু দিয়ে আরিফুর রহমানের তলপেট ও পুরুষাঙ্গ বরাবর আঘাত করল। ব্যথার স্থানে আঘাত লেগে প্রচণ্ড কষ্ট পেলেন আরিফুর রহমান, হারুন মৃধাকে ছেড়ে কুঁকড়ে বসে পড়লেন। ব্যথা আর যন্ত্রণায় আরিফুর রহমানের নাক-মুখ লাল হয়ে উঠল। হারুন মৃধা বন্ধন মুক্ত হয়েই, ইঁদুরের পিছনে তেড়ে ছুটতে শুরু করল। ইঁদুরটা হানিফ মোল্লার সেলের ভিতরে গিয়ে ঢুকল। হানিফ মোল্লার কোলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল ওটা।

আরিফুর রহমান বসা অবস্থা থেকে হেলে মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলেন, জয়ন্ত ছুটে এসে ধরে ফেলল। আরিফুর রহমানের অবস্থা দেখে কনডেম সেলের ভিতরে কালা খাঁ উদ্বিগ্ন গলায় বিলাপের মত করে বলতে লাগল, ‘স্যরকে আমার কাছে নিয়ে আসেন, আমার কাছে নিয়ে আসেন…‘

হারুন মৃধা ইঁদুরটাকে না মারতে পেরে হানিফ মোল্লার সেলের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ রাগে গর্জর-গজর করল। এদিকে তাকিয়ে আরিফুর রহমানকে ব্যথায় কাতরাতে দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে মিটিমিটি করে হাসতে থাকল। তাকে দেখে মনে হলো সে কোনও মজার দৃশ্য দেখছে।

কালা খাঁর কণ্ঠস্বর শুনে আরিফুর রহমান তাঁর লাল চোখ খুলে ফ্যাসফেঁসে গলায় বললেন, ‘জয়ন্ত, আমাকে কালা খাঁর সেলের সামনে নিয়ে যাও।’

জয়ন্তর কাঁধে ভর দিয়ে আরিফুর রহমান কালা খাঁর সেলের সামনে দাঁড়াতেই কালা খাঁ গরাদের ফাঁক দিয়ে তার ডান হাতটা বের করল, তারপর আরিফুর রহমানের পুরুষাঙ্গের উপর চেপে ধরল। ব্যথায় আরিফুর গুঙিয়ে উঠলেন। কালা খাঁ মোলায়েম গলায় আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ‘একটু সহ্য করেন, স্যর, সব ব্যথা ঠিক হয়ে যাবে।’

কালা খাঁ তার ডান হাত আরিফুর রহমানের পুরুষাঙ্গের উপরে চেপে রাখা অবস্থায়, চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কী যেন আওড়াতে থাকল। কয়েক মুহূর্ত পর তার চেপে থাকা ডান হাতের মধ্যে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখতে পাওয়া গেল।

কিছুক্ষণ পর আলোর ঝলকানি শেষ হয়ে গেল। কালা খাঁ চোখ খুলল। পুরুষাঙ্গের উপর থেকে ডান হাতটা সরিয়ে নিল। মুখটা হাঁ করল, অমনি তার মুখের মধ্য থেকে এক ঝাঁক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোকার মত কী যেন বেরিয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল!

দৃশ্যটা আরিফুর রহমান, জয়ন্ত, হারুন মৃধা প্রত্যেকেই দেখতে পেল। আরিফুর রহমান ও জয়ন্ত ইঁদুরকে সারিয়ে তোলার পর যতটা অবাক হয়েছিল তার চেয়েও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। হারুন মৃধা চেঁচিয়ে- চেঁচিয়ে বলতে থাকল, ‘ও একটা পিশাচ, এই জেলে পিশাচ এসে জুটেছে। আজই জেলার সাহেবকে জানাতে হবে।

আরিফুর রহমান কিছুটা ধাতস্থ হয়ে টের পেলেন তাঁর সমস্ত ব্যথা-যন্ত্রণা সেরে গিয়েছে। ভাবলেন, কালা খাঁকে তার এই ক্ষমতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। কিন্তু তার আগেই কালা খাঁ ক্লান্ত ভঙ্গিতে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল।

আরিফুর রহমানের রোগটা সম্পূর্ণ সেরে গেছে। টয়লেটে গিয়ে আরাম করে তিনি প্রস্রাব করলেন। আজ থেকে তিনি পরিপূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ!

পাঁচ

আজ রাতে হানিফ মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হবে।

জল্লাদ পাওয়া যাচ্ছিল না বলে জেলার সাহেব এবং আরিফুর রহমান বেশ চিন্তিত ছিলেন। দু-জনে আলোচনার মাধ্যমে একটা উপায় বের করেছেন।

বেশ কিছুদিন ধরে জেলার সাহেব ঠিকভাবে কাজে মন বসাতে পারছেন না। তিনি এক মহা বিপদে আছেন। তাঁর স্ত্রীর ব্রেইন ক্যানসার হয়েছে। রোগটার কাছে ডাক্তাররা হার মেনে নিয়েছেন। মৃত্যুর প্রহর গুনতে বলেছেন তাঁরা। জেলার সাহেব তাই মানসিক দিক দিয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছেন। বর্তমানে বলতে গেলে জেলের সব দায়িত্ব আরিফুর রহমানের উপর।

হানিফ মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করতে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা হলো, হারুন মৃধা জল্লাদের দায়িত্ব পালন করবে। হারুন মৃধার অনেক দিনের শখ পূরণ হবে। সে খুব আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে হারুন মৃধা ফাঁসির রশিতে কলা, মাখন, মবিল মাখিয়ে বালির বস্তা ঝুলিয়ে, ফাঁসি দেওয়ার মহরৎ করছে। আর মাঝে মধ্যে কর্কশ কণ্ঠে গান গাইছে, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে…’

.

রাত এগারোটা আটান্ন মিনিট। আর তিন মিনিট পরে বারোটা এক মিনিটের সময় হানিফ মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। আরিফুর রহমান, জেলার সাহেব, একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, মেডিকেল অফিসার ডা. আতিক, জেলা প্রশাসক আব্দুল হক, জয়ন্ত—বেশ কয়েকজন উপস্থিত।

হানিফ মোল্লাকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করানো হয়েছে। তার হাত পিছন দিকে বাঁধা। মাথা, মুখমণ্ডল কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে, গলায় ফাঁসির রশি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। হারুন মৃধা জল্লাদের দায়িত্ব পালন করছে। সে আনন্দিত ভঙ্গিতে কপিকলের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ডান হাতে সাদা রুমাল উঁচিয়ে রেখে বাম হাতের ঘড়ির দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছেন। বারোটা এক বাজতে এখনও এক মিনিট বাকি।

উপস্থিত সবাই যেন শ্বাস বন্ধ করে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু হারুন মৃধার মধ্যে কেমন চঞ্চলতা দেখা যাচ্ছে। তার দৃষ্টিতে কৌতূহল খেলা করছে। মনে হচ্ছে, বারোটা এক মিনিট বাজতে দেরি হওয়ায় সে অস্থির হয়ে উঠেছে।

নীরবতার মাঝে ক্ষীণ ফুস ফুস শব্দ হচ্ছে। এই শব্দ হানিফ মোল্লা করছে। লোকটা কাঁদছে। মুখমণ্ডল ঢাকা কালো কাপড়টার গালের দু-পাশ ভিজে চুপচুপে হয়ে উঠেছে। দৃশ্যটা দেখে আরিফুর রহমানের চোখ আর্দ্র হয়ে উঠছে। হানিফ মোল্লাকে যখন হাঁটিয়ে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে আসা হয়েছিল তখনও লোকটা কত স্বাভাবিক ছিল। হাতের মুঠে সেই কালো ইঁদুরটা ছিল। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে ইঁদুরটা আরিফুর রহমানের হাতে দিয়ে বলল, ‘স্যর, আমার সুজনকে একটু দেখে রাখবেন।’

বারোটা এক মিনিট। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হাতের রুমাল ছেড়ে দিলেন। রুমাল মাটিতে পড়ার সাথে সাথে হারুন মৃধা কপিকলের হাতলে চাপ দিল। মুহূর্তের মধ্যে হানিফ মোল্লার পায়ের নীচের পাটাতন সরে গিয়ে ফাঁসি কার্যকর হলো। তবে বড় ধরনের একটা দুর্ঘটনা ঘটল-হানিফ মোল্লার ধড়টা মাথা থেকে ছিঁড়ে পাটাতনের নীচে পড়ে গেল, আর মাথাটা রশির সাথে ঝুলে রইল। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল ফাঁসির মঞ্চ।

জেলার সাহেব রাগে হম্বিতম্বি শুরু করলেন। তিনি গর্জন করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী করে হলো?’

আরিফুর রহমান জেলার সাহেবকে বোঝালেন, ‘হারুন মৃধা জল্লাদ হিসেবে অনভিজ্ঞ, তাই এই দুর্ঘটনা। রশিটার ঝুল রাখা উচিত ছিল আসামীর বুক বরাবর কিন্তু সবার অলক্ষে রশির ঝুল হয়তো নাভির নীচে দেওয়া হয়েছিল, তাই এই বীভৎসতা।’

অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে জেলার সাহেবকে শান্ত করা হলো। তবে এই কাজের জন্য হারুন মৃধার মধ্যে কোনও অনুতাপ বা অপরাধ বোধ দেখা গেল না। সন্দেহ হলো আরিফুর রহমানের, হারুন মৃধা জেনে-বুঝেই এই অপকর্মটা করেছে। ফাঁসি দেওয়ার মহরৎ করার সময় তাকে অনেকবার বলে দেওয়া হয়েছে, রশির ঝুল আসামীর বুক বরাবর দিতে হয়, তার চেয়ে বেশি ঝুল দিলে, মাথা ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ছয়

আরিফুর রহমান কালা খাঁর কেস রিওপেন করাতে চান। তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, এই লোক খুনি হতে পারেন না, নিশ্চয়ই কোথাও বড় ধরনের কোনও ভুল হয়েছে।

কালা খাঁ কেস রিওপেন করাতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘এই যন্ত্রণাময় পৃথিবী থেকে যত দ্রুত চলে যাওয়া যায় ততই ভাল। যেখানে সত্যের চেয়ে মিথ্যের দাপট বেশি, ভালর চেয়ে খারাপের স্থান ওপরে, সেখানে আর এক দিনও থাকতে চাই না।‘

কালা খাঁ কেস রিওপেন করাতে রাজি না হওয়ায় আরিফুর রহমান বেশ ব্যথিত হয়েছেন। তিনি ক্লান্ত স্বরে কালা খাঁকে বলেছেন, ‘রামনগর গ্রামে চেয়ারম্যানের ওই দুই মেয়ে যেদিন খুন হয়েছিল, সেদিন আসলে কী ঘটেছিল একটু খুলে বলবেন? আর খুন হওয়া মেয়ে দুটিকে আপনার কোলেই বা কীভাবে পাওয়া গেল? আপনাকে নাকি ওই গ্রামে এর আগে কেউ কখনও দেখেনি, তা হলে আপনি এলেনই বা কোত্থেকে? আপনার কাছে অনুরোধ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অন্তত আমাকে দিন।’

কালা খাঁ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে, সেলের গরাদের ফাঁক দিয়ে তাঁর হাত বের করে বললেন, ‘স্যর, আমার হাতটা ধরুন।’

আরিফুর রহমান কিছুটা এগিয়ে কালা খাঁর হাত ধরলেন, হ্যাণ্ডশেক করার ভঙ্গিতে। কালা খাঁ তাঁর হাত তীব্র ভাবে চেপে ধরে বললেন, ‘এখন চোখ বন্ধ করুন।

চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে আরিফুর রহমানের মনে হলো, তাঁর শরীরের ভিতর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ চলে যাচ্ছে। এক সময় বিদ্যুৎ প্রবাহ থামল। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল ছায়াঘেরা একটা গ্রাম। গ্রামের বড় একটা বাড়ি। দুই-চালা টিনের বিশাল ঘর। সেই ঘরের সামনের উঠানে দুটি ফুটফুটে মেয়ে খেলা করছে। মেয়ে দুটি গ্রামের চেয়ারম্যানের মেয়ে। শহর থেকে চেয়ারম্যানের ভাগ্নে বেড়াতে এসেছিল। সে আজ চলে যাচ্ছে। ভাগ্নের কারারক্ষীর চাকরি হয়েছে তাই চাকরিতে জয়েন করার আগে মামার বাড়িতে কিছুদিন থেকে গেল। ঘরের ভিতরে থাকা চেয়ারম্যান ও তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে ভাগ্নে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল উঠানে। উঠানে তার দুই মামাতো বোন নিপা ও দিপা খেলা করছে। তাদের কাছ থেকেও সে বিদায় নিল।

চেয়ারম্যানের পাষণ্ড ভাগ্নের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে তার দুই মামাতো বোনের প্রতি। সে একটা প্ল্যান করে রেখেছে। চেয়ারম্যানবাড়ির অদূরে পেয়ারা বাগানে সে লুকিয়ে থাকবে। গ্রামের বাজারে মামার একটা কাঠ চেরাইয়ের মিল আছে। সেই মিলে প্রতিদিন মামা দশটা-এগারোটা নাগাদ চলে যায়। মামিও তখন রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। সেই সময় গিয়ে মামাতো বোনদের ভুলিলে-ভালিয়ে পেয়ারা বাগানে নিয়ে যাবে।

চেয়ারম্যানের ভাগ্নে তার মামাতো বোনদের পাকা পেয়ারার লোভ দেখিয়ে বাগানে নিয়ে গেল। পাষণ্ড ভাগ্নের সুচতুর কথার জালে আটকে অবুঝ মেয়ে দুটি চলে গেল বাগানের একেবারে উত্তর দিকে জঙ্গুলে ঝোপ-ঝাড়ে ঘেরা ভাঙা মন্দিরের কাছে। মন্দিরের ভিতরে ঢুকিয়ে পাষণ্ড লোকটা মেয়ে দুটির হাত-পা বেঁধে, মুখের ভিতর কাপড় গুঁজে দিয়ে, পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করল। তার অসৎ উদ্দেশ্য সফল করে, মেয়ে দুটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে চলে গেল।

আরিফুর রহমান চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করেন জেলের ২০১ নম্বর কনডেম সেলের সামনে। সেলের ভিতরে কালা খাঁ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর চোখ দিয়ে টপ-টপ করে পানি পড়ছে। আরিফুর রহমানের হাত ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।

রামনগর গ্রামের দৃশ্য দেখে আরিফুর রহমান হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন। চেয়ারম্যানের সেই পাষণ্ড ভাগ্নে আর অন্য কেউ নয়, এই জেলেরই কারারক্ষী হারুন মৃধা। আরিফুর রহমান নিজের হতভম্ব ভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে, অবাক হওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা হলে মেয়ে দুটিকে আপনার কোলে পাওয়া গেল কী করে!

কালা খাঁ চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘তা আমি জানি না। আমার কিছুই মনে নেই। আমার স্মৃতি এই থেকে… আমি মেয়ে দুটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি কিন্তু তার আগেই মেয়ে দুটি মারা গেছে।’

সাত

আরিফুর রহমান, আব্দুল হক, জয়ন্ত মিলে একটা পরিকল্পনা করেছে। রাত বারোটার পরে কালা খাঁকে নিয়ে জেলার সাহেবের বাড়িতে যাবে। জেলার সাহেবের স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য কালা খাঁকে দিয়ে শেষ চেষ্টা করাবে। কিন্তু উদ্দেশ্যের পথে বাধা হয়ে আছে হারুন মৃধা। ফাঁসির আসামীকে জেলের বাইরে নেওয়া আইনত অপরাধ। হারুন মৃধার চোখের সামনে কালা খাঁকে বাইরে নিলে সে নির্ঘাত উপর মহলে নালিশ জানাবে। তখন সকলের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে।

হারুন মৃধার জন্য একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার রাতের চায়ের মধ্যে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘুমের ওষুধ মিশানো চা খেয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চেয়ারে বসা অবস্থায় টেবিলের উপরে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

কালা খাঁকে নিয়ে জেলার সাহেবের বাড়িতে পৌঁছালে জেলার সাহেব ফাঁসির আসামীকে বাইরে দেখে প্রচণ্ড রেগে গেলেন। আরিফুর রহমান যখন তাঁর উদ্দেশ্যের কথা বুঝিয়ে বললেন, তখন তিনি কিছুটা শান্ত হলেন। কিন্তু অবিশ্বাসী গলায় বললেন, ‘যে রোগের কাছে বড় বড় ডাক্তারই হার মেনেছে সে রোগ কী করে এই সামান্য লোকটা সারাবে!

কালা খাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জেলার সাহেবের স্ত্রীর কাছে। রুগ্ন, মৃতপ্রায় মহিলা এমন ভাবে বিছানায় পড়ে আছেন যেন জীবন্ত একটা কঙ্কাল বিছানার উপরে। চোখের নীচ, ঠোঁট শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে। মাথায় চুল নেই বললেই চলে। রুগ্ন মহিলার পাশে গিয়ে বসলেন কালা খাঁ। পরম যত্নে হাত রাখলেন মহিলার কপালের উপরে। আগের মত চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কী যেন আওড়াতে থাকলেন। কিছু সময় পর হাতের মধ্যে সৃষ্টি হলো তীব্র আলোর ঝলকানি। এই মুহূর্তে বাড়ির সমস্ত বৈদ্যুতিক বাতি নিভু-নিভু অবস্থা হলো।

কালা খাঁর কাজ ‘শেষ হওয়ার পর পরই জেলার সাহেবের স্ত্রী সহজ স্বাভাবিক ভাবে উঠে বসলেন। মুহূর্তেই যেন রুগ্ন মহিলার চেহারার মাঝে সুস্থতার ঝিলিক দেখা দিল। জেলার সাহেব খুশিতে দৌড়ে এসে কালা খাঁকে জড়িয়ে ধরলেন আর বলতে থাকলেন, ‘গত তিন মাস পর ও শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসল।’

আরিফুর রহমানরা কালা খাঁকে নিয়ে জেলে ফিরে আসার পর ঘটল এক অঘটন। হারুন মৃধা ঘুম থেকে উঠে দেখেছে কালা খাঁকে সেলের ভিতরে ঢোকানো হচ্ছে। তার আর বুঝতে বাকি নেই কী ঘটেছে-তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে কালা খাঁকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে কালা খায়ের সেলের সামনে গিয়ে রাগে ফুঁসতে শুরু করল! কালা খাঁ গারদের শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ হারুন মৃধা হাতের রোলার দিয়ে কালা খাঁর হাতে আঘাত করতে ছুটে গেল। কালা খাঁ তড়িৎ গতিতে খপ করে হারুন মৃধার রোলার ধরা হাতটা ধরলেন, হারুন মৃধাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে, মুখটা বিকট ভাবে হাঁ করলেন। হাঁ করা মুখের ভিতর থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোকা বেরিয়ে এল। এগুলো হারুন মৃধার নাকের ভিতরে ঢুকতে শুরু করল। জয়ন্ত ছুটে গিয়ে হারুন মৃধাকে টেনে কালা খাঁর হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু এক চুলও নড়ানো সম্ভব হলো না। কালা খাঁর শক্তির কাছে জয়ন্ত ও হারুন মৃধা দুজনেই হার মানল।

কিছুক্ষণ পর কালা খাঁ নিজেই হারুন মৃধাকে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে কালা খাঁর মুখ দিয়ে বের হওয়া হাজার-হাজার পোকার ঝাঁকের সবটাই হারুন মুথার নাকের ভিতরে ঢুকে গেছে।

কালা খাঁর হাত থেকে যুক্ত হওয়ার পর হারুন মৃধা অদ্ভুত আচরণ করতে থাকল। সে শিশুদের মত হামা দিতে শুরু করল, মুখ দিয়ে কুকুরের মত জান্তব এক ধরনের শব্দ করতে থাকল।

আট

রাত তিনটা। আর এক মিনিট পরে কালা খাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হবে। মাথা, মুখমণ্ডল কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে গলায় ফাঁসির রশি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কালা, খাঁর কেস রিওপেন করানোর ব্যাপারে জেলার সাহেবও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু কালা খাঁ রাজি হননি। জেলার সাহেবের স্ত্রীর ব্রেইন ক্যান্সার পুরোপুরি সেরে গেছে। তাঁর মস্তিষ্ক স্ক্যান করে বড় বড় ডাক্তাররা অবাক হয়ে গেছেন।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হাতের রুমাল ছেড়ে দিলেন। রুমাল নীচে পড়ার সাথে সাথে জল্লাদ কপিকলের হাতলে চাপ দিল। পায়ের নীচের পাটাতন সরে গিয়ে মুহূর্তে ফাঁসি কার্যকর হলো।

কালা খাঁর ফাঁসি হওয়ার পর পরই জেলের প্রতিটি বৈদ্যুতিক বাল্ব বিকট শব্দ করে চূর্ণবিচূর্ণ হতে শুরু করল। শহরের সমস্ত স্ট্রিট বাল্বও একে একে ফাটতে লাগল। কিছু সময়ের জন্যে শহর ডুবে গেল গভীর অন্ধকারে।

.

একশ’ বছর পর।

ঢাকা চিড়িয়াখানা।

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এক বৃদ্ধ ধীরে ধীরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন চিড়িয়াখানায়। বৃদ্ধের শার্টের বুক পকেটে একটা ইঁদুর। ইঁদুরটার গায়ের পশম বাদামি মলিন ধরনের। দেখে মনে হচ্ছে ইঁদুরটাও বৃদ্ধের মতই বয়সী। অদেখা ভুবনের একজনের আশীর্বাদে তারা আজও বেঁচে আছে।

বৃদ্ধ তাঁর ইঁদুর সঙ্গী সহ চিড়িয়াখানার একটা নির্দিষ্ট খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। গত একশ’ বছর ধরে প্রতিমাসে একবার বৃদ্ধ এই খাঁচাটার সামনে এসে দাঁড়ান। এই খাঁচার ভিতরে অদ্ভুত একটা প্রাণী। প্রাণীটা দেখতে কিছুটা কুকুরের মত। কিন্তু ওটার মুখের সাথে মানুষের চেহারার বেশ মিল

অদ্ভুত জন্তুটা এতক্ষণ চাপা গর্জন করছিল। বৃদ্ধকে দেখে, গর্জন থামিয়ে বৃদ্ধের চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। বৃদ্ধ তাঁর বুক পকেট থেকে  ইঁদুরটাকেও বের করে সেই অদ্ভুত জন্তুটাকে দেখালেন, আর ইঁদুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘সুজন, চিনতে পেরেছিস পাষণ্ড হারুন মৃধাকে!’

জন্তুটার অবাক হওয়া চাহনি দেখে বোঝা গেল সেও বুঝতে পারছে, এই বৃদ্ধ আসলে আরিফুর রহমান!

[বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *