ঘটোৎকচের জাগরণ

ঘটোৎকচের জাগরণ

সেহরাগড় ফরেস্ট বাংলোয় ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। নাম ডক্টর আর পি গুন্টা। তিনি এক বিস্ময়কর মানুষ!

প্রথমে চোখে পড়েছিল ওঁর অস্বাভাবিক দৈর্ঘ্য! অত লম্বা মানুষ গিনেস রেকর্ড বইতেও উল্লিখিত হননি বলে আমার বৃদ্ধ বন্ধু আক্ষেপ করেছিলেন। তাই শুনে ডাঃ গুন্টা হাসতে হাসতে বলেন, কী দরকার? আসলে কী জানেন, নিজের এই লম্বা হওয়া নিয়ে আমার নিজেরই ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। রাস্তাঘাটে বেরুলে সাড়া পড়ে যায়। যেখানে যাই, পেছনে ভিড়। তার ওপর সমস্যা হল, দরজার মাপ। কোনও বাড়িতে ঢুকতে হলে প্রতি মুহূর্তে আমাকে নিজের উচ্চতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হচ্ছে। আবার অনেক সময় মনেও থাকে না কথাটা এবং মাথায় ঠোক্কর খাই। এই দেখুন না, কী অবস্থা হয়েছে।

কপালে অনেক কালো ছোপ দেখে সমস্যাটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। বললাম, আপনার এই দৈর্ঘ্যের সঙ্গে প্রস্থটাও যদি বাড়ত, তাহলে লোকেরা আপনাকে ভয়ও পেত।

ডঃ গুন্টা বললেন, রক্ষে করুন মশাই। তাহলে লোকেরা আমাকে ঘটোৎকচ বলতে শুরু করত। কী বলে কর্নেল?

কর্নেল চোখ বুজে সাদা দাড়ি টানাটানি করছিলেন। বললেন, আচ্ছা ডঃ গুন্টা, কবে থেকে আপনি লম্বা হতে শুরু করেছেন?

ডঃ গুন্টা কর্নেলের কথায় অবাক হলেন যেন। তা তো লক্ষ্য করিনি। তবে যতদূর মনে পড়ছে, মাস তিনেক আগে একদিন ভোরবেলা বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে চৌকাঠে ঠোক্কর লাগল মাথায়। তখন…মাই গুডনেস!

উনি আরামকেদারা থেকে সোজা হলেন হঠাৎ। কর্নেল বললেন, কী ব্যাপার?

আমার মতো বোকা দেখছি পৃথিবীতে নেই। ডঃ গুন্টা মুখে হতাশার ভাব ফুটিয়ে বললেন, কী আশ্চর্য! সত্যি তো ব্যাপারটা ভেবে দেখা উচিত ছিল আমার। ওই প্রথম মাথায় ঠোক্কর খাওয়ার আগের দিন সম্ভবত আমার উচ্চতা প্রায় স্বাভাবিক ছিল।…হ্যাঁ, স্বাভাবিক ছিল কারণ তার আগে তো বাথরুম কেন, কোনও ঘরের দরজার সামনে আমাকে মাথা হেঁট করতে হয়নি। কর্নেল, এই ব্যাপারটা আমার লক্ষ্য করতে ভুল হয়ে গেছে দেখছি।

কর্নেল ওঁকে যেন আশ্বস্ত করতে চেয়েই বললে, পৃথিবীর অধিকাংশ বিজ্ঞ মানুষই নিজের সম্পর্কে অসচেতন। ও নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই। পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের একটা হেরফের ঘটলে মানুষ বামন কিংবা দৈত্য হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, তাদের গায়ে প্রচণ্ড শক্তিও এসে যায়।

ডঃ গুন্টা আস্তে বললেন, তা ঠিক। কিন্তু আমার বয়স প্রায় পঞ্চান্ন হয়ে এল। এই বয়সে হঠাৎ আমার পিটুইটারি গ্ল্যান্ড কেন এ খেল দেখাল বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য আমি অনেকের তুলনায় একটু লম্বা ছিলাম ছেলেবেলা থেকেই। হঠাৎ একটা যেন দুর্ঘটনা ঘটল। আমি রাতারাতি শত ফুট উঁচু হলাম। অথচ খেয়াল পর্যন্ত করলাম না। কর্নেল, ব্যাপারটা ভারি গোলমেলে মনে হচ্ছে। আমি যাই।

 

উনি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দরজা দিয়ে মাথা যতদূর সম্ভব নিচু করে বেরিয়ে গেলেন! কর্নেল তাকিয়ে রইলেন অবাক চোখে। আমিও।

ডঃ গুন্টা উঠেছিলেন পাশের ঘরে। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে সে ঘরের দরজায় তালাবন্ধ দেখলাম। বললাম, কর্নেল, ডঃ গুন্টা কি বাংলো ছেড়ে চলে গেলেন নাকি?

এই বাংলোটা একেবারে সংরক্ষিত জঙ্গলের ভেতর একটা টিলার গায়ে! নিচে ছোট্ট এক নদী। কাঠের সাঁকো পেরিয়ে বন-জঙ্গল শুরু। দুর্গে পৌঁছুতে ঘন্টাখানেক লাগল।

কিন্তু যা ভেবেছিলাম, তাই ঘটল! প্রকৃতিবিদ দুর্গের ওপর থেকে বাইনোকুলারে কী পাখি দেখতে পেয়ে আমার অস্তিত্ব ভুলে গেলেন এবং ধ্বংসাবশেষের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। দেয়ালের ওপর বসে আমি নিচের জঙ্গলের শোভা দেখতে থাকলাম।

কতক্ষণ পরে পেছনে কী একটা শব্দে চমকে উঠে দেখি, ডঃ গুন্টা একটা প্রকাণ্ড পাথর ধরে টানাটানি করছেন। আমি ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

ডঃ গুন্টা চাপা হুঙ্কার দিয়ে এক ঝটকায় বিশাল পাথরটা দুহাতে শূন্যে তুললেন। তারপর সেটা নিচে ছুড়ে ফেললেন। নিচে বিকটা শব্দ করে পাথরটা পড়ল এবং গড়াতে গড়াতে চলল। ডঃ গুন্টা হাত নাড়তে নাড়তে হাসিমুখে তাকালেন আমার দিকে। মুখের চেহারায় কেমন অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে আমার অস্বস্তি হল। বললাম, ডঃ গুন্টা। আপনি দেখছি সুপারম্যানও বটে!

ডঃ গুন্টা আমার কাছে এগিয়ে এসে সহাস্যে বললেন, মিঃ চৌধুরি, আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে তুলে দূরে ছুড়ে ফেলি!

আঁতকে উঠে বললাম, সে কী! না—না। দয়া করে ইচ্ছেটা একটু সামলে রাখুন মশাই!

আমাকে ঘটোৎকচই মনে হচ্ছে না আপনার?

হচ্ছে। খুব হচ্ছে। আপনি ঘটোৎকচই বটে।

ডঃ গুন্টা ফিকফিক করে হাসতে হাসতে বললেন, খুব ভয় পেয়েছেন মনে হচ্ছে?

পেয়েছি বৈকি! আপনি অমন প্রকাণ্ড পাথরটা যেভাবে ছুড়ে ফেললেন!

আরও শক্তি দেখবেন নাকি? বলে ডঃ গুন্টা দুর্গের উঁচু পাঁচিলটার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর দুহাতে ঠেলতে শুরু করলেন। প্রকাণ্ড পাঁচিলটা সশব্দে ভেঙে পড়ল।

আমি এত ভয় পেয়ে গেছি যে পালিয়ে যাওয়ার জন্য এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিরাপদ পথ খুঁজছি। ডঃ গুন্টা ফটকের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন আগের মতো দুহাতের ধুলো ময়লা ঝাড়তে ব্যস্ত। মুখে তৃপ্তির হাসি—কিন্তু কেমন অস্বাভাবিকতাও ফুটে আছে।

হঠাৎ উনি ফের চাপা হুঙ্কার দিয়ে লাফ মারলেন এবং ওই লাফে অন্তত ফুট বিশেক উঁচু ফটকের মাথায় পৌঁছে গেলেন।

অমনি আমি নিচু পাঁচিলের ভাঙা অংশটা পেরিয়ে নামতে শুরু করলাম। এদিকটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। অজস্র পাথর আর ঝোপজঙ্গলে ভর্তি। ভাগ্যিস নিচের গভীর গড়খাইটা শুকনো ছিল। হাঁচড়-পাঁচড় করে ওপারে উঠতেই প্রকৃতিবিদের দেখা পেলাম। রুদ্ধশ্বাসে বললাম, ডঃ গুন্টা সুপারম্যান হয়ে গেছেন! কী সব সাংঘাতিক কাণ্ড শুরু করেছেন, দেখলে বুদ্ধিসুদ্ধি ঘুলিয়ে যাবে!

কর্নেল কিন্তু হাসছিলেন। বললেন, এখান থেকে বাইনোকুলারে আগাগোড়া সবটাই আমি দেখেছি ডার্লিং! তবে ডঃ গুন্টাকে তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই!

নেই মানে? আমাকে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে বলেছিলেন!

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, সেই গল্পটা জানো তো? এক এক পাগল যাচ্ছেতাই পাগলামি শুরু করেছে। একটা লোক যেই বলেছে, ওরে! দেখিস যেন ঢিল ছোড়ে না— অমনি পাগল বলে উঠল, বাঃ! মনে পড়িয়ে দিয়েছে রে! বলে, সে তখন ঢিল ছুড়তে লাগল। ডঃ গুন্টাকে আমরা হয়তো ওইরকম মনে পড়িয়ে দিয়েছি। যাই হোক, এস-বাংলোয় ফেরা যাক।..

বিকেলে লনে বসে আছি কর্নেলের সঙ্গে, সেই সময় ডঃ গুন্টাকে ফিরতে দেখলাম। হাসিমুখে সুম্ভাষণ করে বললেন, সেহরাগড় ফরেস্টকে জব্দ করে এলাম, কর্নেল! শখানেক শালগাছ উপড়েছি। একটা বাঘকে ছাতু করে দিয়েছি। একটা দাঁতাল হাতিকে আধমরা করে দিয়েছি। ঠ্যাং ভেঙে পড়ে আছে। আর ফোর্টের অবস্থাটাও দেখে আসুন গিয়ে। একখানা দেওয়ালও আস্ত নেই!

কর্নেল বললেন, কিন্তু আপনার খাওয়া-দাওয়া? চৌকিদারকে আপনার খাবার টেবিলে রাখতে বলেছিলাম। দেখুন তো।

ডঃ গুন্টা বললেন, আরে তাই তো! আমার খিদে পেয়েছে যে! আমি খাব—প্রচুর।

তারপর ধুপধাপ শব্দে মাটি কাঁপিয়ে দৌড়ুলেন। কর্নেল চেঁচিয়ে বললে, মার্থায় ঠোক্কর। লাগবে ডঃ গুন্টা!

ডঃ গুন্টা তক্ষুণি নিচু হয়ে বারান্দায় উঠলেন এবং দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। তারপর মিনিট দুই হয়েছে, পর্দা তুলে চৌকিদারকে ডাকতে থাকলেন। চৌকিদার এসে বলল, হুজুর।

এটুকু খানা তুমি আমার জন্য রেখেছ? আমি কি মাছি, না পিঁপড়ে?

চৌকিদার বেজার মুখে বলল, আর তো কিছু নেই হুজুর।

চলো দেখি, তোমার কিচেনে কী আছে।

ডঃ গুন্টা কিচেনের দিকে গেলেন। চৌকিদারও গুটিসুটি পেছনে পেছনে গেল। কিন্তু একটু পরে সে দৌড়ে এল আমাদের কাছে।

হুজুর! হুজুর! উনি আদমি না রাক্ষস? বাপরে বাপ! চাল ময়দা সবজি যা ছিল—সব আস্ত গিলে খাচ্ছেন! একটা ব্যবস্থা আপনারা করুন হুজুর!

ডঃ গুন্টার হাঁক শোনা গেল, চৌকিদার! চৌকিদার!

চৌকিদার চাপা গলায় বলল, দোষ-গলতি মাফ করবেন হুজুর। আমি এখনি ওপরয়ালার কাছে রিপোর্ট করতে চললুম।

বেচারা চৌকিদার প্রায় লেজ তুলে দৌড়ুনোর মতো গেট দিয়ে উধাও হয়ে গেল। তারপর কিচেনের দিক থেকে ডঃ গুন্টা বেরিয়ে এলেন। মুখে একরাশ ময়দা লেগে আছে। বললেন, এ

কী বিচ্ছিরি খিদে বলুন তো কর্নেল! ইচ্ছে করছে, আপনাদেরও খেয়ে ফেলি!

কর্নেল সহাস্যে বললেন, জঙ্গলে গিয়ে হরিণ-টরিণ ধরে খান ডঃ গুন্টা। কী আর করবেন!

ডঃ গুন্টা সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়ালেন। আরে তাই তো বটে! বলে মাটি কাপিয়ে বাংলোর প্রাঙ্গণের ধারে উঁচু বেড়া মড়মড় করে ভেঙে বেরিয়ে গেলেন।

উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, কর্নেল! ব্যাপারটা বড় ঘোরালো হয়ে যাচ্ছে! চলুন এখান থেকে চলে যাই আমরা। এ যে সত্যি ঘটোৎকচের কাণ্ড বেধে গেল।

কর্নেল শুধু হাসলেন। আমার কথার কোনও জবাব দিলেন না।

ঘণ্টা দুই পরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বাংলোয় বিদ্যুতের আলোর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মশার বড় জ্বালাতন। তাই আমরা ঘরে বসে আছি। ডঃ গুন্টার আর পাত্তা নেই। বলছিলাম, এতক্ষণে হয়তো জঙ্গলের সব হরিণ ওঁর পেটে চলে গেল। এমন সময় জিপের শব্দ হল বাইরে।

দুজন ফরেস্ট অফিসার আর একদল গার্ড হন্তদন্ত এসে গেলেন। রেঞ্জার সায়েব আমার চেনা। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, কর্নেল। এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছে। আপনার পাশের ঘরের সেই লম্বা ভদ্রলোক….

কর্নেল কথা কেড়ে বললেন, বুঝেছি। জঙ্গলে হরিণের পাল সাবাড় করে বেড়াচ্ছেন।

রেঞ্জার বললেন, দুঃখের কথা, আমরা ওঁকে গুলি করে মারতে বাধ্য হয়েছি।

সে কি!

গুলি না করে উপায় ছিল না। উনি একজন ফরেস্ট গার্ডকে আছাড় মেরে খুন করেছেন। সে এক বীভৎস দৃশ্য কর্নেল! লোকটা একেবারে নরদানব কিংকং বললেই চলে।

কর্নেল আস্তে বললেন ঠিকই করেছেন! তা না হলে এবার ভদ্রলোককে আটকানো কঠিন হত। ক্রমশ ওঁর ভেতর একটা ভয়ঙ্কর শক্তি জেগে উঠছিল। এরপর জঙ্গল ছেড়ে হয়তো উনি বসতি এলাকায় গিয়ে ঢুকতেন। তারপর আরও বীভৎস ঘটনা ঘটত।

কথা থামিয়ে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। চলুন তো, ওঁর ডেডবডিটাকে দেখে আসি।

জিপে চেপে আমরা জঙ্গলের রাস্তা ধরলুম। মাইল দুই এগিয়ে বাঁদিক একখানে আগুন জ্বলতে দেখা গেল। রেঞ্জার বললেন, ওই যে ওখানে। ডেডবডির পাহারায় দুজনকে বসিয়ে রেখে এসেছি।

কাঠকুটো জ্বেলে লোক দুটো আসলে ভয় তাড়ানোর চেষ্টা করছিল। আমাদের দেখে সাহস ফিরে পেল। তারা বন দফতরেরই কর্মী। একজনের হাতে একটা বন্দুক, অন্যজনের হাতে নিছক বল্লম। মুখে প্রচণ্ড আতঙ্কের ছাপ লেগে আছে। একটু তফাতে দলাপাকানো রক্তাক্ত একটা লাশ পড়ে ছিল। রেঞ্জার টর্চের আলোয় সেটা দেখিয়ে বললে, এটা ফরেস্টগার্ড মনি সিংয়ের ডেডবডি। কী অবস্থা হয়েছে দেখুন।

কর্নেল বললেন, ডঃ গুন্টার ডেডবডি কোথায়?

রেঞ্জার পা বাড়িয়ে বললেন, আসুন, দেখাচ্ছি।

জায়গাটা খোলামেলা। একটু এগিয়ে টর্চের আলোয় একটা ছোট্ট নদী দেখা গেল। বালি আর পাথরে ভর্তি। রেঞ্জার অবাক হয়ে বলেন, সর্বনাশ! ডেডবডিটা কোথায় গেল? জানোয়ারে নিয়ে গেল না তো?

বালির ওপর একটু রক্তের ছাপ চোখে পড়ল। কর্নেল টর্চের আলোয় খুঁটিয়ে জায়গাটা দেখে বলেন, নাঃ। টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও চিহ্ন নেই। কিন্তু….আশ্চর্য তো!

কী কর্নেল?

মনে হচ্ছে, ডঃ গুন্টা মারা যাননি। দিব্যি পায়ে হেঁটে চলে গেছেন।

অসম্ভব! গুলি করার পর আমরা ওঁকে পরীক্ষা করে দেখেছিলুম। দেহে প্রাণ ছিল না। দুটো গুলিই হার্টে লেগেছিল।

যে দুটি লোক পাহারায় ছিল, তাদের একজন বলল, কী একটা শব্দ শুনেছিলুম কিছুক্ষণ আগে। টর্চ জ্বেলে কিন্তু কিছু দেখতে পাইনি।

অন্য লোকটি বলল, আমি ভেবেছিলুম কোনও জানোয়ার।

রেঞ্জার তাদের খুব বকাবকি করলেন। তারা আমতা-আমতা করছিল। বুঝতে পারছিলুম, ওদের বকাবকি করা বৃথা। বেচারারা ভয়ে আধমরা হয়ে বসে ছিল। যদি দেখত, ডঃ গুন্টার মড়া হেঁটে যাচ্ছে, তাদের ভিরমি খেয়ে পড়ে থাকতে হত।

কর্নেল পায়ের ছাপ অনুসরণ করে নদীর ওপার পর্যন্ত গেলেন। আমরাও ওঁর সঙ্গে গেলুম। কিন্তু তারপর কঠিন পাথুরে মাটিতে আর কোনও ছাপ দেখা গেল না। কর্নেল উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, সেহরাগড় টাউনশিপের লোকেদের ভাগ্যে কী আছে কে জানে! আমার মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা অনেকদূর গড়াবে।…

 

ফরেস্ট বংলোয় ফিরে এ রাতে আর অন্ধকার বনভূমির সৌন্দর্য দেখার মন ছিল না। তাছাড়া মশার খুব উৎপাত সে কথা আগেই বলেছি।

অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কাটাচ্ছিলুম। কর্নেলের নাক ডাকছিল যথারীতি! এক সময় হঠাৎ বাইরে কী একটা ধাক্কার শব্দ হল। অমনি কর্নেলের নাক ডাকাও থেমে গেল। ওঁর ঘুম বরাবর এমনি পাতলা। ওদিকে পাশের ঘরে কেউ যেন চুপিচুপি তালা খুলছে। তারপর টেবিল বাতিটা জ্বলে উঠল। ফিসফিস করে বললুম, কর্নেল! পাশের ঘরে কে যেন ঢুকল।

কর্নেলও ফিসফিস করে বললেন, চুপ!

উনি বারান্দার দিকের জানালার পর্দা তুলে উঁকি দিলেন। আমিও ওঁর কাছে গিয়ে উঁকি দিলুম। বারান্দায় আলো আছে। একটু পরে শিউরে উঠে দেখি, পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন স্বয়ং ডঃ আর পি গুন্টা। হাতে একটা প্রকাণ্ড সুটকেস। পোশাকে ধুলো-ময়লা আর চাপচাপ রক্ত লেগে আছে। বারান্দা থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে চলে গেলেন।

কর্নেল বললেন, যাক গে। এবার নিশ্চিতে ঘুমোনো যাবে।

বললুম, রহস্যটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত রহস্যই থেকে গেল, কর্নেল!

কর্নেল একটু হাসলেন। তা ঠিক। তবে যা আশঙ্কা করেছিলুম, সম্ভবত তত কিছু ঘটবে না। কারণ ফ্রাংকেনস্টাইনের সেই দানব শেষ পর্যন্ত দানবই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু ডঃ গুন্টাকে দেখলুম, দিব্যি ভদ্রলোকের মতো নিজের জিনিসপত্র নিতে এসেছিলেন। তার মানে, সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে ওঁর এবং ঘরের ছেলে ঘরে ফেরাই সাব্যস্ত করেছেন।..

পরদিন আমরা জঙ্গল থেকে সেহরাগড় টাউনশিপে ফিরে গেলুম। তারপর সেখান থেকে বাসে চেপে ফৈজাবাদ। কলকাতা ফেরার ট্রেন রাত বারোটা নাগাদ। একটা হোটেলে খাওয়া-দাওয়া সেরে কর্নেল হঠাৎ বললেন, চলো জয়ন্ত, ডঃ গুন্টার খোঁজখবর নিয়ে আসি! অবাক হয়ে বললুম, সর্বনাশ! উনি কি ফৈজাবাদের লোক নাকি?

বাংলোর খাতায় সেই ঠিকানাই তো জেনেছি।

কিন্তু…

কর্নেল আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমার ধারণা, ডঃ গুন্টা এখন আর নরদানব বা ঘটোৎকচ হয়ে নেই। কাজেই ওঁকে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। হয়তো ভুলটা আমারই। আমি ওঁকে সচেতন করে দেওয়াতে ওইসব বীভৎস ঘটনা ঘটেছে। তোমাকে সেই পাগলের গল্পটা বলেছিলুম, আশাকরি মনে আছে। কোনও কারণে মানুষের মধ্যে অস্বাভবিকতা এলে তাকে উত্যক্ত করা উচিত নয়।

রাত তখন প্রায় নটা। কিন্তু ফৈজাবাদ ছোট্ট শহর! ডঃ গুন্টাকে সবাই চেনে—সেটা উনি লম্বা মানুষ বলেই! শেষদিকে একটা টিলার গায়ে একটা পুরনো গড়নের বাড়ি। টাঙ্গাওয়ালা গেটের কাছে নামিয়ে দিল আমাদের। লন পেরিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, বাড়িতে যেন জনমানুষ নেই। অস্বাভাবিক স্তব্ধ পরিবেশ। তবে আলো দেখা যাচ্ছিল একটা ঘরে।

দরজার বোতাম টেপার বেশ কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলল। সেই অস্বাভাবিক ঢ্যাঙা মানুষ, চেনা মুখ, অমায়িক হেসে বললেন, কোখেকে আসছেন আপনারা?

আমি তো অবাক। কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আপাতত আসছি সেহরাগড় থেকে। আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে, ডঃ গুন্টা।

ডঃ গুন্টা ভুরু কুঁচকে কী স্মরণ করার চেষ্টা করে বললেন, সেহরাগড়? সেখানে তো একটা জঙ্গল আছে শুনেছি। যাক্ গে, ভেতরে আসুন।

ভেতরে ঢুকে আমরা বসলুম! ডঃ গুন্টাও বসলেন। ওঁর মুখে বিস্ময় লক্ষ্য করছিলুম! কর্নেল বললেন, ডঃ গুন্টা, আপনার প্রোজেক্ট যে সাকসেসফুল সেই কথাটা বলতে এসেছি–যদিও দেশের আইনে আপনি অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন!

ডঃ গুন্টা চমকে উঠলেন। কী বলছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।

হ্যাঁ। এক ডজন হরিণ, একটা বাঘ আর একজন ফরেস্ট গার্ডকে আপনার ফ্যান্টম প্রতিমূর্তি খুন করে ফেলেছে। অসংখ্য গাছ উপড়ে ফেলেছে! সেহরাগড় কেল্লাটা ভাঙচুর করেছে। এমনকী, একটা দাঁতাল হাতিকেও মারাত্মক জখম করেছে।

ডঃ গুন্টা দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ভাঙা গলায় বললেন, কিন্তু আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।

কিন্তু আপনি একজন বায়ো-ফিজিসিস্ট। আপনি জানতেন আপনার ফ্যান্টমপ্রোজেক্টের পরিণতি সাংঘাতিক হতে পারে।

ডঃ গুন্টা উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে বললেন, বিশ্বাস করুন, মাসতিনেক আগে হঠাৎ আমার উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার পর কী কী ঘটেছে, এখন একটুও মনে নেই।

আইন কিন্তু আপনাকে ছেড়ে দেবে না ডঃ গুন্টা।

ডঃ গুন্টা হঠাৎ সবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তারপর ঝনঝন দুমদাম প্রচণ্ড শব্দ শোনা গেল। উদ্বিগ্ন হয়ে বললুম, কী ব্যাপার কর্নেল?

কর্নেল হাসলেন, ল্যাবরেটরি ভাঙছেন! প্রমাণ লোপের চেষ্টা। যাই হোক, আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়, জয়ন্ত। চলো, আমরা কেটে পড়ি।

স্টেশনে পৌঁছে বললুম, ফ্যান্টম প্রতিমূর্তি ব্যাপারটা কী, খুলে বলুন তো?

কর্নেল বললেন, প্রতিবস্তুর কথা নিশ্চয় শুনেছ, মানুষের ব্যক্তিসত্তার তেমনি কোনও প্রতিরূপ আছে কি না, এ নিয়ে বায়োফিজিসিস্ট গবেষণা করেছেন। কতকটা ডঃ জেকিল এবং মিঃ হাইডের ব্যাপারটা যেমন। তবে ওই প্রতিরূপ ফ্যান্টম অস্তিত্ব কোনও মানুষের স্বাভাবিক চরিত্রে একেবারে উল্টো না হতেও পারে। আমাদের মধ্যে একটা করে প্রতি-মানুষ আছে। সে অসম্ভব শক্তিমান। তাকে দিয়ে যেমন ভাল কাজ করানো যায়, তেমনি খারাপ কাজও করানো যায়। কাজেই ওই ফ্যান্টম প্রতিমূর্তিকে তুমি ঘটোৎকচ বলতেও পারো। ভুলে যেও না মহাভারতের ঘটোৎকচ। একজন মানুষ ছাড়া কিছু নয়। তবে অতিমানুষ। তাকে জাগালে ভাল বা মন্দ, দুই-ই ঘটতে পারে।

ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকছিল না! তাই বললুম, নিকুচি করেছে ফ্যান্টম ব্যাটার। তাকে জাগিয়ে কাজ নেই।..

1 Comment
Collapse Comments

কর্নেলের অন্য সকল গল্প ও উপন্যাস পড়তে চাই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *