প্রতাপগড়ের মানুষখেকো

প্রতাপগড়ের মানুষখেকো

আগে জানলে এ বুড়োর পাল্লায় কিছুতেই পড়তুম না। ঢের ঢের বুড়ো মানুষ দেখেছি, গ্রীষ্মকালে তাঁরা নাতির হাত ধরে পার্কে গিয়ে বসে থাকেন এবং শীতের সময় ঘরের কোণে আলোয়ান মুড়ি দিয়ে কাগজ পড়েন। দু-চারজন বুড়োমানুষ অবশ্যি নেতা হয়ে দেশ শাসনও করেন। খবরের কাগজের খবর জোগাড় করতে গিয়ে তাদের সঙ্গে চেনাজানাও হয়েছে অল্পস্বল্প। কিন্তু তাঁরা কেউ এঁর মতো পাহাড়-জঙ্গলে বুনো ঘোড়ার দাপটে ছোটাছুটি করে বেড়ান না—স্রেফ দুখানা ঠ্যাঙের জোরেই। কিংবা প্রজাপতি বা পাখির পেছনে বাচ্চা ছেলের মতো হন্যে হয়ে ঘোরেন না তারা!

এ-বুড়োর কাণ্ডকারখানাই অদ্ভুত। নইলে এই জানুয়ারির হাড়কাঁপানো শীতে কেউ প্রতাপগড়ের জঙ্গলে ক্যামেরা নিয়ে রাতবিরেতে টো-টো করে ঘুরবে কোন সাহসে? বিশেষ করে যে জঙ্গলে সম্প্রতি একটা মানুষখেকো বাঘের দৌরাত্ম্য চলছে।

জঙ্গলে রাতবিরেতে ক্যামেরার কথা শুনে কেউ যদি ভাবে নিশ্চয় ফ্লাশ বাল্বের সাহায্যে জন্তুজানোয়ারের ছবি তোলা হচ্ছে—তাহলে সে মস্ত ভুল করবে। ক্যামেরাটাও বিষম বিদঘুটে। ভূতুড়ে বলতেও আমার আপত্তি নেই। কারণ, ওতে ফ্লাশ বাল্বের দরকার হয় না। অথচ অন্ধকারে লেন্সের সামনে কমপক্ষে বিশ-পঁচিশ মিটার দূরত্বে ১৮০ ডিগ্রির মধ্যে যা কিছু থাকে সবেরই ছবি উঠে যায়। শাটার টেপার জন্যে কারও বসে থাকার দরকার নেই। ওটার ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা এত সূক্ষ্ম আর স্পর্শকাতর যে, শুধু দরকার লেন্সের সামনে ওই দূরত্বের মধ্যে মাটিতে একটুখানি কাঁপন। কোনও জন্তু মাটিতে হাঁটলেই কিছু-না-কিছু কাঁপন জাগে। সেই যথেষ্ট শাটার ক্লিক করবে।

প্ৰতাপগড় জঙ্গলের বাংলোয় রাত দশটায় উনি যখন ফিরে এলেন ক্যামেরার ফাঁদ পেতে, আমি তখন ফায়ারপ্লেসের সামনে ইজিচেয়ারে বসে কড়া কফি খাচ্ছি আর পরদিন সকালে কেটেপড়ার মতলব ভঁজছি। কী শীত, কী শীত! বিহারের শীতের নামডাক আছে জানতুম। কিন্তু প্রতাপগড় এলাকা যে উত্তর-মেরুরই ছোট ভাই, সেটা জানতে বাকি ছিল।

হ্যালো ডার্লিং! যথারীতি সম্ভাষণ করে উনি টুপি ও ওভারকোট খুললেন এবং আমার পাশে বসে মৃদু হেসে বললেন, জয়ন্ত কি আমার ওপর রাগ করেছ?

আমার কাঁধে একটা হাত রেখে অন্য হাতে কফির মগ ধরে উনি হঠাৎ চাপা স্বরে বললেন ডার্লিং! আশা করছি, কাল সকালের মধ্যে তোমার চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠার মতো এক অত্যদ্ভুত ছবি তোমায় দেখাতে পারব। অতএব ধৈর্যসহকারে অন্তত আর একটা দিন অপেক্ষা করো। এবং জয়ন্ত এমনও হতে পারে, তুমি এবার প্রতাপগড় থেকে তোমার দৈনিক সত্যসেবকের জন্য একটি রোমাঞ্চকর সংবাদও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে।

ওঁর লোভ-দেখানো কথায় একটুও না গলে বললুম, কিসের ছবি দেখাবেন আর? গত রাতে তো ঝরনার জল খেতে আসা এক পাল হরিণের ছবি উঠেছিল আপনার ক্যামেরায়। কাল বড় জোর দেখব হয়তো একটা রোগা বাঘ!

ঠিক বলেছ ডার্লিং! বুড়ো সাদা দাড়ি খামচে ধরে হাসলেন। তারপর অভ্যাসমতো টাকে সেই হাতটা বুলিয়ে কী একটা ফেলে দিলেন। দেখলুম লাল রঙের একটা পোকা, অনেক সময় টাকে মাকড়সার জাল বা পাখির বিষ্ঠাও দেখেছি। বুড়ো পোকাটার গতিবিধিতে নজর রেখে বললেন, বাঘের ছবিই দেখাব। তবে এটা যে সে বাঘ নয়, সেই কুখ্যাত মানুষখেকো বাঘ! সরকার যাকে মারার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে।

বিরক্ত হয়ে বললুম, ধরুন তাই না হয় হল। মানুষখেকো বাঘটার ছবি আপনার ক্যামেরার সামনে এসে হাজির হবে, তাহলে ওই শিকারি ভদ্রলোকদের বললেন না কেন? ওঁরা তো বাঘটাকে। মারার জন্য হন্যে হচ্ছেন। আজ বিকেলে আপনার সামনেই ওঁরা দুজনে বেরিয়ে গেলেন। কোথায় মোষের বাচ্চা বেঁধে রেখে গাছের ওপর মাচান করে বসে থাকবেন সারা রাত। খামোকা ওঁরা কষ্ট পাবেন ঠাণ্ডায়!

আমার কথার জবাব দেবার জন্যে ঠোঁট ফাঁক করেছেন, এমন সময় চৌকিদার দরজায় উঁকি মেরে একটু কেশে বলল, হুজুর কর্নেলসাব! খানা তৈয়ার হ্যায়। হুকুম হোগা তো আভি লাবে গা।

জরুর। বলে হুজুর কর্নেলসাব অর্থাৎ আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ওরফে বুড়ো ঘুঘু অভ্যাসমতো বুকে ক্রস এঁকে যথার্থ ধার্মিকের মতো খাদ্য গ্রহণে প্রস্তুত হলেন।

বাংলোটা একেবারে জঙ্গলের মধ্যে। তাই সতর্কতার জন্য বারান্দা জুড়ে গ্রিল এবং এই শীতে গোটাটা রেলে ঢাকা রয়েছে। বারান্দার একদিকে কিচেন। চৌকিদার কিচেনের সামনে খাটিয়া পেতে ঘুমোয়। সম্প্রতি মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হওয়াতে সে আরও সতর্কতার জন্য পাশে একটা টর্চ আর বল্লমও রাখে। কর্নেলবুড়ো মানুষখেকোর ভয় তুচ্ছ করে এত রাত অব্দি জঙ্গলে ঘোরেন এবং নিরাপদে ফিরে আসেন। বারান্দায় গ্রিলের একটা অংশ খুলে সে হুজুর কর্নেলসাবকে ভেতরে আসতে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ফের সেই ফাঁকটা অর্থাৎ দরজা বন্ধ করে তালা এঁটে সন্দিগ্ধদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। আমার ধারণা, সে ভূত দেখছে, না মানুষ, তার দৃষ্টিতে এরকম একটা চাঞ্চল্য থাকে। কর্নেলের ওপর তার ভক্তি ক্রমশ বেড়ে গেছে।

জেলিমাখানো মোটা মোটা চাপাটির সঙ্গে বুনো মুরগির মাংস বেশ জমিয়ে খাওয়া গেল। খেতে খেতে কর্নেল আমার সেই কথাটার জবাব দিলেন। ঠিকই জয়ন্ত! মিঃ সেন এবং মিঃ দত্তকে আমার বলা উচিত ছিল, আপনারা ঝরনার ভাটিতে টোপ না বেঁধে আরও একটু উজানে এসে বাঁধুন। কারণ আমার ধারণা, বাঘটা ওখানেই টিলার ওপর একটা গুহায় থাকে। তার পায়ের দাগও খুঁটিয়ে দেখেছি। জঙ্গলবিদ্যায় আমারও কিঞ্চিৎ জ্ঞানগম্যি আছে।

তাহলে বললেন না কেন?

কর্নেল হাসলেন। যেচে পড়ে বলাটা সঙ্গত মনে করিনি। তাছাড়া লক্ষ্য করেছ নিশ্চয়, বিশেষ করে মিঃ দত্ত কেমন যেন অভদ্র প্রকৃতির লোক। এসেই আমাদের এখানে দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন না? মিঃ সেনও কেমন আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, দু-দুটো মানুষ-টোপ থাকতে আর মোষের বাচ্চা কিনতে খামোকা পয়সা খরচ কেন? ব্যাপারটা আমার গায়ে লেগেছে। জয়ন্ত!

ওঁর দুঃখ দেখে ঠাট্টা করে বললুম, আহা! ওঁরা তো কর্নেল নীলাদ্রি সরকার নামক প্রখ্যাত বুড়ো ঘুঘুকে চেনেন না! চিনলে নিশ্চয় সমীহ করে কথা বলতেন। তাছাড়া, যে জঙ্গলে মানুষখেকো বাঘ রয়েছে, সেখানে যারা বেড়াতে এসেছে শখের বশে, তারা নিছক টোপ হতেই এসেছে বৈকি!

কর্নেল কিন্তু হাসলেন না। গোমড়ামুখে গ্লাসের কনকনে ঠাণ্ডা জলটা পুরো গিলে ফেললেন।

শেষ রাতে কী একটা গণ্ডগোলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। জেগে কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। লণ্ঠনের দম বাড়িয়ে কর্নেল ব্যস্তভাবে ডাকছেন, জয়ন্ত! জয়ন্ত! বাইরে চৌকিদার দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচামেচি করছে। আর কেউ হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে।

কম্বল ছেড়ে বেরুনো সহজ কথা নয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সহজাত বোধ কাজ করে। হুড়মুড় করে উঠে পড়লুম। তারপর দেখি, কর্নেল লণ্ঠন হাতে এগিয়ে দরজা খুললেন। তার পিছন-পিছন দৌড়ে গেলুম। বারান্দায় বেরিয়ে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য চোখে পড়ল। মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসে আছেন সেই শিকারি মিঃ দত্ত এবং দু-হাতে মুখ ঢেকে ছেলেমানুষের মতো কাঁদছেন। তাঁর পোশাকে চাপ-চাপ টাটকা রক্ত লেগে রয়েছে। পাশে দুটো রাইফেল পড়ে রয়েছে। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে চৌকিদার বেচারা জড়ানো গলায় ক্রমাগত কী বলছে, বোঝা যাচ্ছে না।

কর্নেল মিঃ দত্তের কাধে হাত রেখে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, মিঃ দত্ত শান্ত হোন, বলুন কী হয়েছে। কর্নেলের কথা শুনে মিঃ দত্ত একটু শান্ত হলেন। তারপর ফ্যাচ করে নাক ঝেড়ে বললেন, ও হো হো হো! আমি কী করব? কী করব আমি? আমার সারাজীবনের সঙ্গী আমার প্রাণের বন্ধু। অমল……ও!

কর্নেল বললেন, প্লিজ মিঃ দত্ত! শান্ত হোন, শান্ত হোন। কী হয়েছে বলুন তো?

মেজাজি মিঃ দত্ত বিকৃত মুখে বললেন, বুঝতে পারছেন না মশাই কী হয়েছে? অমলকে বাঘে মেরে ফেলেছে। ও হো হো! কেমন করে ওর স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের সামনে এ-মুখ দেখাব?

এটাই অনুমান করেছি ততক্ষণে। কর্নেল ওঁর কাঁধ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, সর্বনাশ! মিঃ সেনকে মানুষখেকো বাঘটা মেরে ফেলেছে! কিন্তু কীভাবে ব্যাপারটা ঘটল বলুন। তো মিঃ দত্ত? আপনারা কি একই মাচানে ছিলেন?

দত্ত সাহেব রুমালে চোখ নাক মুছে বললেন, একই মাচানে তো ছিলুম। কখন বাঘটা চুপিচুপি গাছে উঠেছিল টের পাইনি। আমার একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। হঠাৎ অমলের আর্তনাদে জেগে গেলুম। টর্চ জ্বালতেই দেখি, ওঃ! সে এক বীভৎস দৃশ্য। বাঘটা অমলের গলা কামড়ে ধরে ঝাঁপ দিল।

কর্নেল বললেন, আপনি নিশ্চয় গুলি করেননি? ওঁর রাইফেলটাও তো নিয়ে এসেছেন দেখছি।

দত্তসায়েব শ্বাস টেনে বললেন, আমার গায়ে ধাক্কা লেগেছিল। টর্চ আর রাইফেল নিচে পড়ে গিয়েছিল তক্ষুনি। ওঃ! ও হো হো হো! অমল!

তারপর? তারপর? আমি দম-আটকানো গলায় প্রশ্ন করলুম।

মিঃ দত্ত বললেন, তারপর কীভাবে যে পালিয়ে এসেছি আমিই জানি। এই দেখুন, কত জায়গায় ছড়ে গেছে। আর এই দেখুন, কত রক্ত। অমলের রক্ত! ও হো হো হো!

কর্নেল একটু ভেবে নিয়ে বললেন, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এতক্ষণে নিশ্চয় বাঘটা শিকার নিয়ে সরে পড়েছে। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই…

বাকি রাত আর ঘুমোনো গেল না। পাশের ঘরে দত্তসায়েব সমানে বিড়বিড় করে শোকপ্রকাশ করছেন শোনা যাচ্ছিল। কর্নেল ও আমি ফায়ারপ্লেসের কাছে বসে রইলুম। কর্নেলবুড়ো একেবারে চুপচাপ। কোনও প্রশ্ন করেও জবাব পেলুম না। অভ্যাসমতো দাড়ি বা টাকে হাত বুলোচ্ছেন, কখনও চোখ বুজে বুকে ক্রস আঁকছেন।

জঙ্গল ও পাহাড় জুড়ে ঘন কুয়াশা। রোদ বাড়লে সেটা কাটল। তখন কর্নেল আমাকে নিয়ে বেরুলেন। দত্তসায়েবকে দেখলুম লনে রোদে বসে আছেন। হাতে রাইফেল। হিংস্র চেহারা। লাল চোখ। কর্নেল ডাকলেন, আসুন মিঃ দত্ত। দেখি, আপনার বন্ধুর ডেডবডি খুঁজে পাই নাকি।

দত্তসায়েব উঠলেন। ওই শয়তানটাকে খতম না করে আর আমি কলকাতা ফিরছি না। এই আমার প্রতিজ্ঞা।

যেতে যেতে কর্নেল বললেন, প্রথমে আমাদের মাচানের ওখানে যাওয়াই উচিত।

মিঃ দত্ত শুধু বললেন, হুঁ!

বাংলো থেকে ঝোপজঙ্গলে ভরা ঢাল বেয়ে নেমে আমরা ছোট্ট একটা সোঁতার ধারে পেঁৗছলুম, যেটা একটু দূরে ঝরনা থেকে বয়ে এসেছে। পাথরের ওপর দিয়ে ঝিরঝিরে স্বচ্ছ জল বইছে। ধারে ধারে কিছুটা যাওয়ার পর মিঃ দত্ত বললেন, ওই যে ওখানে।

চারপাশে ঘন গাছপালা, মধ্যিখানে এক টুকরো ফাঁকা ঘাসজমি। একটা বাচ্চা মোষ মনের সুখে এখন ঘাস খাচ্ছে। বুঝলুম, ওটাই টোপ। জমিটায় পৌঁছেই আমরা থমকে দাঁড়ালুম। মাচানের ঠিক নিচেই একটা ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। তারপর বিকট চিৎকার করে মিঃ দত্ত ছুটে গিয়ে মৃতদেহটার কাছে হাঁটু মুড়ে বসলেন এবং রাতের মতোই বুকফাটা কান্না জুড়ে দিলেন।

কর্নেল ও আমি এগিয়ে গেলুম। শিকারি মিঃ সেনের গলায় গভীর ক্ষতচিহ্ন এবং বুকে ওপরটা তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে ফালাফালা। পুরু পুলওভার ফেঁড়েফুঁড়ে গেছে। জমাট কালচে রক্তের ছোপ সবখানে। কর্নেল মুখ তুলে মাচানের দিকে তাকালেন। তারপর বেমক্কা গাছে চড়তে শুরু করলেন। গাছটার গুড়ি ও ডালে রক্তের ছোপ দেখতে পাচ্ছিলুম।

একটু পরে কর্নেল মাচান থেকে নেমে এসে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন মিঃ দত্ত। বাঘটা ওঁকে আচমকা মাচানের ওপরেই আক্রমণ করেছিল। উনি আত্মরক্ষার ফুরসত পাননি। তো ইয়ে ডেডবডিটা……

দত্তসায়েব শান্তভাবে বললেন, চৌকিদারকে বলেছি কজন লোক ডেকে আনতে। জিপে করে কলকাতা নিয়ে যাব। কিন্তু জানি না, অমলের স্ত্রীর সামনে দাঁড়াব কোন মুখে। ওঃ!

কর্নেল অন্যমনস্কভাবে মাচানের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ ঘুরে বললেন, দেখুন মিঃ দত্ত, আমার মনে হচ্ছে, আপনার বন্ধু মিঃ সেনকে যে বাঘটা মেরে ফেলেছে, সেটা মানুষখেকোটা নয়।

মিঃ দত্ত ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনি কি শিকারি? কীভাবে বুঝলেন যে মানুষখেকোটা নয়? মানুষখেকো না হলে ওভাবে কোনও বাঘ চুপিচুপি গাছে উঠে শিকারির ওপর হামলা করে না।

কর্নেল বললেন, তা ঠিক। তবে এ-জঙ্গলে আরও বাঘ থাকাও তো সম্ভব।

ধমকের সুরে দত্তসায়েব বললেন, যা জানেন না, তা নিয়ে বাজে বকবেন না।

কর্নেল ধমক খেয়ে কাঁচুমাচু মুখে সরে এলেন। চলো জয়ন্ত, ডেডবডি তো পাওয়া গেছে। আমরা নিজের কাজে যাই।

ঝরনার ধারে এসে বললুম, লোকটা অভদ্র। গোঁয়ার। একটা হামবাগ!

কর্নেল হেসে বললেন, শিকারিদের একটু রাগ হওয়া স্বাভাবিক। যাক গে, জয়ন্ত! তুমি বাংলোয় গিয়ে বিশ্রাম করো গে! এ-বুড়োর পিছনে ছোটাছুটি করা তোমার পোষায় না জানি।

সে আর বলতে? কিন্তু আপনি যাবেনটা কোথায়?

আপাতত ক্যামেরাটা নিয়ে আসি।বলে কর্নেল হনহন করে এগিয়ে গেলেন। আমি বাংলোয় ফিরলুম।….

 

কর্নেল ফিরলেন একেবারে দুপুর গড়িয়ে। তারপর খেয়েদেয়ে ফিল্ম ডেভলপ করতে বাথরুমে ঢুকলেন। ওটাই ওঁর ডার্করুম। রাতে ঘুম হয়নি। তাই আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম। সেই ঘুম ভাঙল কর্নেলের ডাকাডাকিতে। জয়ন্ত জয়ন্ত! শিগগির সব গুছিয়ে নাও। আমরা এক্ষুনি রওনা দেব। জিপ এসে গেছে।

বললুম, সে কী! অরণ্যপিপাসা এরই মধ্যে মিটে গেল? না কি মানুষখেকো বাঘের আতঙ্কে? আর জিপ কোথায় পেলেন? আমরা এই অবেলায় যাবই বা কোন চুলোয়?

বুড়ো ঘুঘু রহস্যময় হেসে বললেন, ওয়েট, ওয়েট ডার্লিং। সব প্রশ্নের জবাবে আপাতত আমার রাতের ফসল তোমাকে উপহার দিতে চাই। নাও।

হাত বাড়িয়ে যা পেলুম, তা একটা ছোট্ট ফটোগ্রাফ। কিন্তু দেখামাত্র চমকে উঠলুম। এ! কী এ যে দেখছি মিঃ দত্ত হাঁটু দুমড়ে পাথরের খাঁজে হাত পুরে কী একটা করছেন! অবাক হয়ে বললুম, এর মানে? কাল রাতে তো ওঁরা দুজনে মাচানে ছিলেন?—মানে মিঃ দত্ত এবং মিঃ সেন! অথচ মিঃ দত্ত দেখছি একা এখানে কী যেন করছেন।

কর্নেল বিদঘুটে ভঙ্গিতে ফের হাসলেন। রেডি হয়ে নাও ঝটপট। তোমায় যা দেখাব বলেছিলুম, তা দেখালুম। বাকিটা প্রতাপগড় টাউনশিপে গিয়ে দেখাব।

কিন্তু আপনি মানুষখেকো বাঘটা দেখাবেন বলেছিলেন!

তাই তো দেখালুম। বলে বৃদ্ধ গোয়েন্দাপ্রবর নিজেই আমার কম্বল বেডিং পত্তর গোছাতে শুরু করলেন। আমি তো হতভম্ব হয়ে গেছি। কিছুক্ষণ পরে জিপে ওঠার সময় কর্নেল বললেন, আসলে যে বুড়ো এবং রোগা বাঘটা তল্লাটে পাঁচটা মানুষ মেরে খেয়েছে, সে তার পাহাড়ি গুহায় স্বাভাবিকভাবে মরে পড়ে আছে। তাকে গতকাল আবিষ্কার করে এসেছিলুম। কবে কোন শিকারির গুলি খেয়ে বাঘটার অবস্থা এমনিতে শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। যাক গে, উঠে পড়ো বৎস, যথাস্থানে পৌঁছে সব টের পাবে।

প্রতাপগড় টাউনশিপে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হল। অবাক হয়ে দেখি, জিপ থানায় ঢুকছে। বুক কাপল। তাহলে কি মিঃ সেন বাঘের হাতে মারা পড়েননি? নিছক খুনখারাপির ঘটনা?

হুঁ, ঠিক তাই। লাল চোখে হিংস্র মুখভঙ্গিতে বসে আছেন মিঃ দত্ত। তাঁর হাতে হাতকড়া। টেবিলের চারপাশ ঘিরে কয়েকজন পুলিশ অফিসার রয়েছেন। আমাদের দেখে একজন পুলিশ অফিসার চেঁচিয়ে উঠলেন, হ্যাল্লো কর্নেল!

কর্নেল কোটের পকেট থেকে একগাদা ছবি এগিয়ে দিয়ে বললেন, আমার অত্যদ্ভুত ক্যামেরার রাতের ফসল মিঃ শর্মা। একটা ছবিতে দেখবেন দত্তসায়েব দুটো বাঘনখ লুকিয়ে রাখছেন। সময়ও ফিল্মে সাঙ্কেতিকভাবে লেখা হয়ে যায়। রাত দুটো তেত্রিশ মিনিট। এই দেখুন!

মিঃ শর্মা একগাল হেসে বলনে, আপনার নির্দেশমতো জায়গায় মার্ডার উইপন দুটো উদ্ধার করা হয়েছে। ডেডবডি মর্গে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট আসতে দেরি নেই। বলে উনি ড্রয়ার থেকে কাগজে মোড়া দুটো বাঘের থাবার মতো নখওলা সাংঘাতিক অস্ত্র বের করলেন। রক্তের ছোপ কালো হয়ে আছে।

মিঃ দত্ত মুখ নিচু করে বসে আছেন পাথরের মতো।

অনেক রাতে সার্কিট হাউসের একটা ঘরে কর্নেলের মুখোমুখি হলুম। বললুম, দত্তসায়েব বন্ধুকে খুন করলেন কেন?

কর্নেল জবাব দিলেন, কলকাতার প্রখ্যাত হোসিয়ারি দত্ত অ্যান্ড সেনের নাম শোননি জয়ন্ত? সেই যে বাঘমার্কা গেঞ্জি ইত্যাদি যাদের। যেটুকু অনুমান করছি, তাতে মনে হয় দত্তসায়েব ভেতর ভেতর পার্টনার বন্ধু সেনাসায়েবকে ঠকিয়ে একা মালিক হওয়ার চক্রান্ত করছিলেন। কারণ ওঁদের চাপা গলায় আগের রাতে কী সব তর্ক করতে শুনেছিলুম। যাইহোক, সেই চক্রান্তের চরম অবস্থা এই হত্যাকাণ্ড। বুঝে দ্যাখো জয়ন্ত, কী চমৎকার ফন্দি এঁটেছিলেন মিঃ দত্ত! মানুষখেকো বাঘ শিকার করতে এসে তার পাল্লায় একজনের মারা পড়াটা কত স্বাভাবিক দেখাত। শুধু বাদ সাধল এই বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ এবং তার অত্যদ্ভুত ক্যামেরা। তবে ডার্লিং জয়ন্ত, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—যদি তুমি এই বৃদ্ধকে নির্দয়ভাবে পরিত্যাগ না করে যাও, তাহলে কয়েকদিনের মধ্যে তোমায় সত্যিকার বাঘ দেখাবই দেখাব।

দাড়ি ও টাকওয়ালা বুড়ো ঘুঘুকর্নেল নীলাদ্রি সরকার নিজের বিশাল বুকে খাঁটি পাদ্রির মতো একবার ক্রস আঁকলেন। তারপর অস্ফুট স্বরে আওড়ালেন, আমেন! আমেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *