যেখানে কর্নেল
হরিচরণ এবং হরদয়ালের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মাদ্রাজ মেলের ফাস্টক্লাস কম্পার্টমেন্টে। আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার গায়ে পড়ে লোকের সঙ্গে আলাপ জমাতে পারেন বটে! সারাটা রাত্তির গল্প করতে করতেই কাটিয়ে দিলেন।
ট্রেন জার্নিতে ঘুমনো আমার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। তার ওপর ওই বকবকানি আর মাঝে-মাঝে কর্নেলের হা-হা-হা-হা- বিকট অট্টহাসি। কেন হাসছেন, গল্পটাই বা কী, ওপরের বার্থে শুয়ে একটুও ঠাহর হচ্ছিল না আমার। তার চেয়ে বিকট হাসি হরদয়াল নামে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লোকটির! বিকটই বলছি। কারণ, নাদুসনুদুস গড়নের মধ্যবয়সী এবং প্রচণ্ড গুফো কোনও লোকের কণ্ঠস্বর যে অমন মেয়েলি আর ভূতুড়ে হতে পারে, কস্মিনকালে শুনিনি। ভূতুড়ে বলারও কারণ আছে। ভূত-পেরেত নাকি খোনা গলায় কথাবর্তা বলে। হরদয়ালবাবু যদি আড়াল থেকে কথাবার্তা বলেন, দিন-দুপুরে রীতিমতো সাহসী লোককেও আঁতকে উঠতে হবে।
হরিচরণবাবু দেখছিলুম একেবারে উলটো। কথাবার্তা বলছিলেন কম। গড়ন বা চেহারায়, তা ছাড়া পোশাকেও তার সঙ্গীর একেবারে উলটো। লম্বাটে শক্তসমর্থ গড়নের লোক। চিবুকে কুচকুচে কালো দাড়ি এবং দুপাশে জাঁকালো জুলপি। পরনে প্যান্ট শার্ট। তাঁর কণ্ঠস্বরটিও বেশ গম্ভীর।
প্রথম আলাপেই জানতে পেরেছিলুম আমাদের মতো ওঁদেরও গন্তব্য গোপালপুর অন-সি। কলকাতার চৌরঙ্গি এলাকার হরিহর এন্টারপ্রাইজেস প্রাইভেট লিমিটেড নামে দুজনে মিলে একটি কোম্পানি গড়েছেন। আমদানি-রপ্তানি কারবার করেন। কারবারি জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে মাঝে-মাঝে কয়েক দিনের জন্য বেরিয়ে পড়েন। মাদ্রাজ মেল চিল্কা স্টেশনে পৌঁছতে সূর্য উঠিয়ে ছাড়ল। তখন কর্নেলের তাড়ায় আপার বার্থ থেকে নেমে এলুম। হরিচরণবাবুও ওপাশের আপার বার্থ থেকে নামলেন। একটু পরে চা খেতে-খেতে হরিচরণবাবু কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা উঠছেন কোথায়?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, কিছু ঠিক করে আসিনি। শুনেছি গোপালপুর-অন-সিতে টুরিস্টদের চেয়ে নাকি হোটেল বা লজের সংখ্যা বেশি। এও শুনেছি, ওখানে সমুদ্রতীরও নাকি বেশ নির্জন আর খোলামেলা।
হরদয়ালবাবু তাঁর ভূতুড়ে গলায় হি হি করে হেসে বললেন, অপূর্ব। অপূর্ব! আমরা তো মশাই প্রতি বছর পুজোর ঠিক পরেই ওখানে যাই। বুঝলেন না? কারবারি মগজ ঠাণ্ডা করার জন্য এমন সি-বিচ আর পাব কোথায়?
হরিচরণবাবু বললেন, সি-ভিউ হোটেলে উঠতে পারেন। আমাদের সঙ্গে মালিকের খুব চেনাজানা আছে। তা ছাড়া এখন নভেম্বরে সব হোটেল তো খালিই পড়ে থাকে। ট্যুরিস্ট সিজন শুরু হবে ডিসেম্বর থেকে।
হরদয়ালবাবু মাথা দোলালেন। হ্যাঁ, সি-ভিউ নতুন হোটেল। একেবার মডার্ন ব্যবস্থা। সায়েব-টুরিস্টরা এলে দেখেছি ওখানেই ওঠেন।
বহরমপুর স্টেশনে পৌঁছতে আটটা বেজে গেল। ট্রেন বেশ খানিকটা লেট করেছে। চারজনে মিলে একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে গোপালপুর-অন-সিতে পৌঁছতে মাত্র আধঘণ্টা লাগল। মাইল পঁয়ত্রিশেক দূরত্ব। সি-ভিউ হোটেলটি সত্যিই সুন্দর। ম্যানেজার ভদ্রলোক অত্যন্ত অমায়িক আর হরদয়ালবাবুর সঙ্গে ওঁর ভালরকম চেনা-জানা। চারতলা হোটেলের চারতলাতেই একটি স্যুইট পেয়ে গেলুম আমরা। দক্ষিণ-পূর্ব কোণের স্যুইটটির নম্বর চার। তারই উল্টো দিকে উত্তর-পূর্ব কোণে তিন নম্বর সুইটটি হরিচরণবাবু তদ্বিরেই আমাদের ভাগ্যে জুটল। এক মন্ত্রীমশাই নাকি হঠাৎ এসে পড়ার আভাস পাওয়া গেছে। তাই ম্যানেজার একটু ইতস্তত করছিলেন শেষে হরিচরণবাবু রফা করে দিলেন, যদি সত্যিই মন্ত্রীমশাই এসে পড়েন, আমরা অন্য একটি স্যুইটে চলে যাব। হোটেল তো এখন প্রায় ফাকা। চারতলার মোট বারোটা স্যুইটের মধ্যে গোটা পাঁচেক স্যুইট ভর্তি আছে।
চারতলার চার নম্বর স্যুইটটি হরিচরণ-হরদয়ালের কলকাতা থেকে বুক করা ছিল। দুই বন্ধু মিলে সেটিতে ঢুকলেন। তিন নম্বরে ঢুকলাম আমরা। ব্যালকনিতে গিয়ে অভ্যাসমতো কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে সম্ভবত সামুদ্রিক পাখপাখালি খুঁজতে থাকলেন। আমি দেখতে থাকলুম সমুদ্র। সমুদ্রের বুকে প্রকাণ্ড সব কালো-কালো পাথর মাথা তুলে আছে। সেইসব পাথরের সঙ্গে সমুদ্র যেন খেলা করছে। মাঝে-মাঝে সেগুলোর ওপর এসে আছড়ে পড়ছে। ড়ুরিয়ে দিচ্ছে। আবার সরে যাচ্ছে। কর্নেলের মতোই হা-হা করে সমুদ্র হেসে উঠছে আর ফেনাগুলো যেন কর্নেলেরই সাদা দাড়ি।
ভাবলুম, এই লাগসই উপমাটি ওঁকে শুনিয়ে দিই। কিন্তু উনি বাইনোকুলার নামিয়ে রেখে গম্ভীর মুখে বললে, জয়ন্ত, তুমি তো একজন সাংবাদিক। ওদের সম্পর্কে তোমার কাগজে কিছু লেখা উচিত।
অবাক হয়ে বললুম, কাদের সম্পর্কে?
এখানকার মৎস্যজীবীদের, কর্নেল দুঃখিত মুখে বললেন, দূরের সমুদ্রে জলটা তত অশান্ত নয়। সেখানে মাছও প্রচুর। কিন্তু লক্ষ্য করো, বিচের কাছাকাছি অনেকটা দূর পর্যন্ত সমুদ্রের কী সাংঘাতিক অবস্থা! ভেবে দ্যাখো, জয়ন্ত, ছোট্ট সব নৌকো নিয়ে এই অংশটা পেরোতে বেচারাদের কী লড়াই না করতে হয়। প্রতিদিন ওরা এই লড়াই করে তবে সামান্য কিছু মাছ ধরতে পারে। ফেরার সময় আবার সেই লড়াই। তাছাড়া দেখতেই পাচ্ছ, সমুদ্রে কতসব পাথরও মাথা উঁচিয়ে আছে। দৈবাৎ ধাক্কা লাগলে নৌকো ভেঙে গুড়িয়ে তো যাবেই, ওরাও বাঁচবে না! ওদের এই প্রচণ্ড জীবনসংগ্রামের কথা তোমার লেখা উচিত ডার্লিং। আমরা ডাইনিং টেবিলে বসে যখন বিশেষ বিশেষ সামুদ্রিক মাছের সুস্বাদ নিয়ে প্রশংসা করি, তখন কি চিন্তা করে দেখি যে…
আমার বৃদ্ধ বন্ধুর সারগর্ভ ভাষণে বাধা পড়ল দরজার কলিংবেলের বাজনায়। গিয়ে দরজা খুলে দেখি, হরিচরণবাবু, একেবারে সমুদ্রস্নানের জন্য তৈরি হয়ে আমাদের ডাকতে এসেছেন। বললেন, আসুন কর্নেল, সমুদ্রস্নান করে খিদে চাঙ্গা করা দরকার, নইলে ব্রেকফাস্ট জমবে না। জয়ন্তবাবু দেরি করবেন না! পোশাক বদলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। বাই দা বাই আপনারা বাথ-সুট সঙ্গে এনেছেন তো? এখানে সমুদ্র কিন্তু বিপজ্জনক।
কর্নেল একটু হাসলেন, বাথ-সটের দরকার হবে না হরিচরণবাবু! কারণ, এ-বেলা আমি সমুদ্রে নামছি না। তবে জয়ন্তের কথা আলাদা। ইয়াংম্যানরা সমুদ্রের সঙ্গে লড়তে ভয় পায় না। কী বলো ডার্লিং?
ঝটপট বললুম, আমার একটুতেই ঠাণ্ডা লেগে যায়।
হরিচরণ হাসতে হাসতে বললেন, সমুদ্রের জলে ঠাণ্ডা লাগার ভয় নেই। আসুন না, নুলিয়া পাওয়া যাবে। পুরীর সমুদ্রে কি কখনও স্নান করেননি?
আমাকে টেনে ঘর থেকে বের করলেন হরিচরণবাবু। টের পেলুম, ভদ্রলোকের গায়ের জোর আছে বটে! কর্নেলও বেরোলেন। করিডোরে দাঁড়িয়ে বললেন, হরদয়ালবাবু স্নান করতে যাবেন? নাকি আমার মতোই জলকাতুরে মানুষ?
হরিচরণবাবু বললেন, যা বলছেন! ওকে টেনে ওঠাতে পারলুম না বিছানা থেকে। দাঁড়ান, আবার চেষ্টা করে দেখি।
উল্টোদিকে চার নম্বর স্যুইটের দরজা উনি ফাঁক করে ডাকলেন, হর, ও হর, স্নান না-ই বা করলে। অন্তত বিচে বসে আমাদের স্নান করা দেখবে। সমুদ্র দেখলে খিদে বাড়বে হে, রাক্ষসের মতো খেতে পারবে!
দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলুম, খাটে হরদয়ালবাবু চিত হয়ে শুয়ে আছেন। মাথার ওপর একটা হাত। এই অবস্থায় শুয়ে থেকেই সেই ভূতুড়ে কণ্ঠস্বরে বললেন, আরে ট্রেন-জার্নির ধকল সামলে নিতে দাও আগে। বরং দুপুরের দিকে দেখব। .
হরিচরণ সহাস্যে বললেন, তুমি তো বরাবর এখানে এসে আগে স্নান না করে ব্রেকফাস্ট করতে না! এবার হলটা কী? বলে কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। আমার ফ্রেন্ড, বুঝলেন তো, বড্ড খামখেয়ালি! গত বছর ও আমাকেই টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রে ছেড়েছিল। সত্যি বলতে কী, এখানকার সমুদ্রকে আমারও বড্ড ভয় করত। ওর পল্লায় পড়েই সে-ভয়টা কেটে যায়।
কর্নেল ডাকলেন, হরদয়ালবাবু কি অসুস্থ বোধ করছেন? ও হরদয়ালবাবু!
হরদয়াল সেইরকম মেয়েলি এবং খোনা গলায় জবাব দিলেন, আরে না, না, আপনারা যান। না, আমি দুপুরে স্নান করবখন।
হরিচরণ রাগ করে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে বললেন, ছেড়ে দিন। ও বরাবর ওইরকম একগুঁয়ে!
হোটেল থেকে বেরিয়ে সি-বিচে নামার সময় কর্নেল বললেন, হরদয়ালবাবুর টনসিলের গণ্ডগোল আছে। কাল রাত্রে সে নিয়ে আলোচনা করছিলুম। উনি বললেন, দুবার অপারেশন করিয়েও কিছু হয়নি।
হরিচরণ বললেন, আসল গণ্ডগোল থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে। ডাক্তারদের মতে, ওই গ্ল্যান্ডে অপারেশন না করলে গলার স্বর বদলাবে না, তাছাড়া ক্রমশ বডিটাও আরও মোটা হয়ে যাবে। কিন্তু সার্জারিতে হর-র বড় আতঙ্ক। দুবার যে টনসিল অপারেশন করিয়েছিল, সে একরকম আমারই চেষ্টায়। বড় জেদি ও।
সমুদ্রের বিচ ভাটার সময়ও তত কিছু চওড়া নয়। খানিকটা ঢালুও। আমাকে টানাটানি করে হরিচরণ সমুদ্রে নামাতে পারলেন না। কর্নেল বিচে বসে বাইনোকুলারে লাইটহাউস কিংবা অন্য কিছু দেখতে থাকলেন। হরিচরণ ভাল সাঁতারু নিঃসন্দেহে। একদল কাচ্চাবাচ্চাও ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটতে থাকল। ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলো মৎস্যজীবী বস্তির। এখন থেকেই ওরা এমনি করে এই সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই শুরু করে। ভবিষ্যতের বড় লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়। কর্নেল ঠিকই বলেছেন, এদের কথা দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় আমার লেখা উচিত।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল সবে উঠে দাঁড়িয়েছেন, বিচের ওপরদিকের বালিয়াড়ি থেকে প্রায় আছাড় খেতে নেমে এলেন সি-ভিউ হোটেলের সেই ম্যানেজার ভদ্রলোক। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, সর্বনাশ হয়েছে স্যার! হরদয়ালবাবু খুন হয়েছেন। বলে সাঁতারু হরিচরণের উদ্দেশে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো হাত ছোড়াছুড়ি এবং লম্ফঝম্ফ করে ডাকাডাকি করতে লাগলেন।
কর্নেল তৎক্ষণাৎ হন্তদন্ত হয়ে বালিয়াড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। বালিয়াড়ি দিয়ে ওঠার সময় তাঁর টুপি খসে পড়ল। প্রশস্ত টাকটি ঝকঝক করে উঠল। কিন্তু টুপির দিকে মনই দিলেন না। অদৃশ্য হয়ে গেলেন বালিয়াড়ির ওধারে।
এতক্ষণে আমায় ঘিলু চাঙ্গা হল এবং আমিও দৌড়ে চললুম। বালিয়াড়ির খাঁজ থেকে কর্নেলের টুপিটি কুড়িয়ে নিয়ে গেলুম।
হরদয়ালবাবুর মাথার পেছনে গুলি করা হয়েছিল। হোটেলের পরিচারক গোবিন্দরাম আমরা বেরিয়ে আসার আন্দাজ মিনিট পনেরো পরে জিজ্ঞেস করতে যায়, ব্রেকফাস্টে কী কী খাবেন বাবুরা। দরজায় তালা দেওয়া ছিল না। প্রথমে সে কলিং বেলের বোতাম টেপে। তারপর সাড়া না পেয়ে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে। সে হরিচরণকে বেরোতে দেখেছিল। কাজেই সে জানত, হরদয়ালবাবু ভেতরে আছেন। বাথরুমে আছেন ভেবেই সে অপেক্ষা করেছিল। শেষে অধৈর্য হয়ে দরজা খোলে এবং হরদয়ালবাবুকে চিত হয়ে শুতে থাকতে দ্যাখে। বাবুর সাড়াশব্দ না পেয়ে তার সন্দেহ হয়। তখন সে ওঁর দিকে ঝুঁকে কপালে হাত রাখে। কপাল ভীষণ ঠাণ্ডা ছিল। তারপর তার চোখে পড়ে বালিশের ওপর রক্তের ছোপ। মাথার পেছন দিকটা থেকে সামান্য একটু রক্ত গড়িয়ে এসে বালিশে ছোপ ফেলেছিল।
পুলিশ এসে যথারীতি মৃতদেহ বহরমপুর শহরের মর্গে নিয়ে গেল। সবাইকে তন্নতন্ন জেরা করে বিবৃতিও লিখে নিয়ে গেল। হরিচরণ বন্ধুর শোকে কাঁদতে-কাঁদতে পুলিশের গাড়িতে বহরমপুর চলে গেলেন। সেখান থেকে ট্রাংকল করে হরদয়ালের আত্মীয়স্বজনকে খবর দেবেন।
হরিচরণের মুখেই আমরা জানতে পেরেছিলুম, হরদয়ালের অ্যাটাচিকেসে প্রচুর টাকা ছিল। সেটা উধাও হয়ে গেছে।
পুলিশের গাড়িতে উনি চলে যাওয়ার পর আমাদের স্যুইটে ফিরে কর্নেলকে বললুম, আপনার সঙ্গে আর কোথাও যাচ্ছি না। যেখানে আপনি, সেখানেই খুনখারাপি। ব্যাপারটা কী?
কর্নেল একটা চাপা শ্বাস ছেড়ে বললেন, ব্যাপার তত কিছু গুরুতর নয়।
অবাক হয়ে বললুম, গুরুতর নয়? কী বলছেন! যে-হোটেলে এভাবে খুনে চোর-ডাকাত ঢোকে, সেই হোটেলে আমার আর একটুও থাকতে ইচ্ছে করছে না!
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, সাড়ে এগারোটা বাজে। ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়নি। চলো, দেখি, ক্যান্টিনে একটু সকাল-সকাল লাঞ্চ পাওয়া যায় কি না।
সূর্যাস্তের পরও কর্নেল ও আমি সি-বিচে গিয়ে বসে আছি, সেই সময় পিছনের বালিয়াড়িতে কয়েকটি ছায়ামূর্তি ভেসে উঠল। ডান দিকে বিচের মাথায় কতকগুলো পাথরের ভাঙাচোরা বাড়ি। খুব পুরনো আমলের বাড়ি। ছায়ামূর্তিগুলো বালিয়াড়ি থেকে সোজা না নেমে সেই ভাঙা বাড়িগুলোর ভেতর ঢুকে পড়ল। অমনি ভয় পেয়ে চাপাস্বরে বলে উঠলুম, কর্নেল, নির্ঘাত চোর ডাকাতের দল!
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, আমরা তো ব্যবসায়ী নই। টাকাকড়ি-ওয়ালাও নই। চোর-ডাকাত লোক চেনে ডার্লিং!
তাহলে ওরা কারা?
যারাই হোক, আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
একটু পরে সমুদ্রের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে উঠল ঝলমলে এক বিশাল লাল-হলুদ রঙের গোলা। ওটা যে চাদ, বুঝতে সময় লাগল। তারপর পিছন থেকে কে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, কর্নেলসায়েব নাকি?
কর্নেল ঘুরে বললেন, হরিচরণবাবু? আসুন, আসুন। কখন ফিরলেন বহরমপুর থেকে?
এইমাত্র, বলে হরিচরণ এসে আমাদের পাশে বসলেন।
কয়েক মিনিট চুপচাপ থাকার পর ফেঁস ফেঁস করে নাক ঝেড়ে ভাঙাগলায় বললেন, আপনি কী বলবেন বলছিলেন, তাই চলে যাওয়ার আগে দেখা করতে এলুম।
কর্নেল আমাকে ভীষণ চমকে দিয়ে বললেন, আচ্ছা হরিচরণবাবু, আপনি কি প্রেতাত্মা বিশ্বাস করেন?
হরিচরণও চমক-খাওয়া গলায় বললেন, কেন বলুন তো?
কর্নেল বললেন, আমি অনেকদিন যাবৎ তন্ত্রসাধনা করেছি। প্রেতাত্মাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। আপনার বন্ধু হরদয়ালবাবুর আত্মার সঙ্গে যদি আপনি বাক্যালাপ করতে চান। করতে পারেন। ডাকব তাকে?
হরিচরণ বললেন, এ-কথা বলতেই ডেকেছিলেন কি?
কর্নেল জবাব না দিয়ে ডাকলেন, হরদয়ালবাবু, আপনার বন্ধু এখানে উপস্থিত আছেন। কিছু বলার থাকলে বলুন ওঁকে।
সামনে সমুদ্রের প্রচণ্ড আলোড়ন এবং সেই আলোড়নের মধ্যে ফিকে জ্যোৎস্নার রং দুলছে। ঝকমক করছে। যেন এক বিশাল অলৌকিক দৃশ্যের সামনে বসে আছি। আর সেই অলৌকিকতাকেও তুচ্ছ করে দিয়ে ভেসে এল হরদয়ালবাবুর ভূতুড়ে কণ্ঠস্বর, কী হরি, এখনও কী করছ এখানে? শিগগির কলকাতা চলে যাও। আমার তো ছেলেপুলে নেই। এখন তোমারই সব। হরিহর এন্টারপ্রাইজের একচ্ছত্র মালিক হতে অসুবিধেও নেই।
হরিচরণ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এই চালাকির অর্থ কী?
কথাটা বললেন কর্নেলকে। জবাল এল হরদয়ালের প্রেতাত্মার কাছ থেকে। চালাকি তুমিও কম জানো না হরি, ও কী পালাচ্ছ কেন? আরে শোনো, শোনো।
হরিচরণ সত্যি পালাচ্ছিলেন। আমি তো হতভম্ব হয়ে বসে আছি। হঠাৎ ডান দিকের সেই ভাঙা পাথুরে বাড়িগুলো থেকে একঝক টর্চের আলো এসে পড়ল এবং একদল ছায়ামূর্তি ঘিরে ধরল হরিচরণকে। তখন বুঝতে পারলুম, সেই ছায়ামূর্তিগুলো পুলিশ। হরিচরণকে গ্রেফতার করছে।
কর্নেল বললেন, কী ডার্লিং, বোবা হয়ে গেলে যে? বললুম, কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না।
কর্নেল হাসলেন, স্রেফ ভেন্ট্রিলোকুইজিম! আমি এই স্বর-জাদু বিদ্যাটি সম্প্রতি শিখেছি। যাই হোক, হরদয়ালের মাথার পিছনে সাইলেন্সার-লাগানো পিস্তল দিয়ে গুলি করে মেরে হরিচরণ ওঁকে বিছানায় শুইয়ে রেখেছিল। আমরা ওঁদের সুইটের দরজার ফাঁক দিয়ে ওঁকে দেখেছিলুম ঠিকই। তখন আসলে উনি মৃত। কিন্তু এই হরিচরণ ভেন্ট্রিলোকুইজিমে খুব পাকা। বিশেষ করে হরদয়ালবাবুর টলসিলের ত্রুটি থাকায় হরিচরণের সুবিধে হয়েছিল। আমাদের সাক্ষী রাখতে চেয়েছিল যে, হোটেল থেকে বিচে আসার সময় আমরা হরদয়ালকে জীবিত দেখেছি, কারণ, ওঁর কথাবার্তা শুনেছি।
সবকিছু আমি দেরিতে বুঝি। ঝটপট বললুম বুঝেছি, বুঝেছি।
কর্নেল বললেন, এখনও সবটা বোঝোনি। গতরাত্রে ট্রেনে হরদয়ালবাবুর সঙ্গে কথাবার্তার সময় জানতে পেরেছিলুম হরিচরণ একসময় ম্যাজিসিয়ান ছিল। আর আজ সকালে সমুদ্রস্নানে সে এসেছিল পিস্তলটা সমুদ্রে ফেলতে।