কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ১৩
শ্যামলী ফোন করেছে, অনেক দিন তোমাকে দেখি না, কাছে পাই না, খুব শূন্য হয়ে আছি, আমি বেঁচে নেই।
শ্যামলীর কণ্ঠস্বরটাকে একটি ছোট্ট বালিকার স্বর মনে হয়। হাসানের, অনেক দিন পর তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, মনে হয়। ওই স্বর তাকে অন্ধকার থেকে উদ্ধার করছে, তাকে নিশ্বাস ফিরিয়ে দিচ্ছে।
হাসান বলে, আমিও তোমার অভাব খুব বোধ করছি, তুমি কি আসতে পারো?
শ্যামলী বলে, আসার জন্যেই তো পাগল হয়ে আছি, তুমি তো ডাকো না।
হাসান বলে, এসো, আমি অন্ধকারে আছি, আমাকে উদ্ধার করো, আলো জ্বলো, নিশ্বাস ফিরিয়ে দাও আমাকে।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, কেনো, কী হয়েছে?
হাসান বলে, তুমি কি দেশ জুড়ে একদলের অন্ধকার দেখতে পাচ্ছো না?
শ্যামলী বলে, চুপ, চুপ, কেউ শুনতে পাবে, তোমার বিপদ হবে।
হাসান বিছানা থেকে ওঠে না, গড়াতে থাকে, উঠতে তার ইচ্ছে করছে না; আজি সে অফিসে যাবে না, জানিয়ে দিলেই চলবে। অন্ধকার কাটানোর জন্যে শুয়ে শুয়ে সে নিজের নগ্নতা উপভোগ করতে থাকে; ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শ্যামলী এসে ঘণ্টা বাজালে সে নগ্নদেহেই গিয়ে দরোজা খুলে দেয়।
শ্যামলী তাকে দেখে মধুর চিৎকার ক’রে ওঠে, হায়, তুমি যে উস্থুর ন্যাংটা।
হাসান বলে, আমার ইচ্ছে হয় প্রত্যেক ভোরে তুমি আমাকে এভাবে দেখো।
শ্যামলী বলে, আর তুমিও আমাকে প্রতিভোরে এভাবে দেখতে চাও?
হাসান বলে, হুঁ, চাই; শুধু ভোরে নয়, দুপুরে, বিকেলেও, সন্ধ্যায়ও রাতেও।
শ্যামলী হোসে, হাসানের একটি প্রত্যঙ্গ ছয়ে বলে, তোমাকে এভাবে দেখতে আমার ভালোই লাগছে, চমৎকার শরীর তোমার। একটু দাড়াও দেখি।
হাসান বলে, তোমাকে এভাবে দেখতেও আমার ভালো লাগবে; তোমার শরীরও চমৎকার।
শ্যামলী হেসে সুখে বলে, জানো তো আমি তোমার ছ-বছরের বড়ো?
হাসান বলে, কিন্তু তুমি এখনো বিশ বছরের মতো দেখতে, আমার সাথে তোমাকে বেশ মানায়।
শ্যামলী বলে, তুমি বোধহয় একটি বউ চাও।
হাসান বলে, তা জানি না, হয়তো চাই, হয়তো চাই না।
শ্যামলী বলে, আমাকে তুমি তোমার বউ হিশেবে চাও?
হাসান বলে, তাও জানি না, হয়তো চাই, হয়তো চাই না। শ্যা
মলী বলে, তোমার বউ হতে পারলে বেশ হতো।
হাসান গড়াতে থাকে; দেখে অবাক হয় যে শ্যামলী তার পাশে বসছে না, খুঁজে খুঁজে পাউরুটি, ডিম, মাখন, জ্যাম বের করছে টোস্টারে পাউরুটি সেঁকছে, মাখন লাগাচ্ছে, কেটলিতে পানি গরম ক’রে চা বানাচ্ছে।
শ্যামলী দূর থেকে চিৎকার ক’রে বলে, মুখ ধুয়ে নাও, শেভ ক’রে নাও, তোমার ব্রেকফাস্ট প্রায় তৈরি।
হাসান বলে, আজ মুখ ধুবো না, শেভ করবো না, আজ নতুন জীবন শুরু।
হাসান, তুমি এই চাও শ্যামলীর সাথে? এই জীবন তোমার কাছে অপূর্ব লাগে?
এক নারীর হাতে ব্রেকফাস্টে, যে-নারী তোমার স্ত্রী? স্ত্রী কি অপূর্ব?
হাসান এটুকু ভাবতে না ভাবতে শ্যামলী ব্রেকফাস্ট এনে রাখে বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলে।
শ্যামলী হোসে, হাসানের মুখের কাছে তার টলটলে মুখটি এনে, বলে, মনে করো আমি তোমার বউ।
হাসান ব্রেকফাস্টে হাত লাগায় না, হাত লাগায় শ্যামলীর শরীরে; তাকে টেনে এনে চুমো খায়, বলে, আজ আমি মেল শভিনিস্ট পিগ, পুংগবী শুয়োর, আজ নারী, আমার রমণী, আজ তুমিই আমার ব্রেকফাস্ট, তুমিই আমার মাখনমাখা পাউরুটি, তুমিই আমার কাঁচা ওমলেট।
শ্যামলী বলে, না, না, এখন নয়, আগে খেয়ে নাও।
হাসান বলে, না, আগে আমি বউ খাবো। যখন তারা সুখকরভাবে ক্লান্ত হয়, বন্যার ধীর জলে ভেসে যাওয়া খড়ের ঘরের মতো সুন্দরী কাঠের কোশানৌকোর মতো কলাগাছের ভেলার মতো এদিক সেদিক ভাসতে থাকে, তখন দুপুর।
হাসান শ্যামলীর তলপেটে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলে, আমি চাই আজি এখানে একটি ভ্রণ জন্ম নিক।
শ্যামলী অন্য জগত থেকে জেগে উঠে। জিজ্ঞেস করে, কী চাও, তুমি কী চাও?
হাসান বলে, আমি চাই এখানে একটি ভ্রণ জন্ম নিক।
শ্যামলী বলে, না, না, আমি আর সন্তান চাই না।
হাসান বলে, আমি দেখতে চাই কীভাবে তোমার ভেতরে বেড়ে ওঠে তোমার আমার সন্তান।
শ্যামলী বলে, তোমার সন্তান তো আমি নিতে পারি না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো পারো না? আমার সন্তান কি চণ্ডাল?
শ্যামলী বলে, আমার হাজব্যান্ড আছে; তোমার আমার সন্তান হ’লে তা হবে। অবৈধ, লোকে বলবে জারজ।
হাসান বলে, সন্তান হচ্ছে সন্তান, সন্তানের আবার বৈধ অবৈধ কি?
শ্যামলী বলে, বিয়ের বাইরে সন্তান অবৈধ।
হাসান বলে, ক্লান্তিকর অপ্রেমের বিয়ের সন্তান বৈধ, আর সুখকর সুন্দর প্রেমের সন্তান অবৈধ? এটা কী ক’রে হয়?
শ্যামলী বলে, হ্যাঁ, প্রেম সমাজে স্বীকৃত নয়, বিয়ে স্বীকৃত।
হাসান বলে, তাহলে চলো, আমরা বিয়ে করি; আজই করি।
শ্যামলী বলে, কী ক’রে করবো? আমি তো বিবাহিত, বিয়ে তো আমার একটা হয়েছে, আমার হাজব্যান্ড আছে।
হাসান বলে, তাহলে তাকে ছেড়ে দাও, তাকে তো তুমি ভালোবাসো না।
শ্যামলী বলে, হ্যাঁ, তাকে ভালোবাসি না; তবে তাকে ছেড়ে দিলে স্ক্যান্ডাল হবে, আমার ছেলেমেয়েদের জীবন কষ্টে ভরে যাবে, তারা আমাকে ঘেন্না করবে।
হাসান বলে, তাহলে সে তোমার স্বামী থাক, আর আমিও তোমাকে বিয়ে করি, আমিও স্বামী হই; তুমি দুজনের স্ত্রী হও।
হো হো ক’রে হেসে ওঠে শ্যামলী, তুমি কি পাগল হ’লে? মেয়েদের একসঙ্গে দুটি স্বামী থাকতে পারে না; মেয়েদের জরায়ু একজনের জন্যে।
হাসান বলে, আমরা শুরু করলেই থাকতে পারে। শ্যামলী বলে, তুমি তো পাগলা আউল-বাউল কবি ছিলে না, কিন্তু এখন তো তোমারও পাগলামো দেখা দিচ্ছে।
হাসান বলে, আমি তো তাকে বেশ ছাড়ই দিচ্ছি, তুমি কয়েক দিন তার সাথে থাকবে কয়েক দিন আমার সাথে থাকবে।
শ্যামলী বলে, আমার হাজব্যান্ড তাতে রাজি হবে কেনো? জেনেশুনে তার জমিতে সে অন্যকে চাষ করতে দেবে কেনো?
হাসান বলে, রাজি না হ’লে তাকে ছেড়ে দাও, তুমি তো তাকে ভালোবাসো না, তার সাথে শুতে তো তোমার ঘেন্না লাগে। জমি চিরকাল একজনের থাকে না।
শ্যামলী বলে, বিয়েতে ভালোবাসা লাগে না, গাড়িবাড়ি সন্তানেই চলে।
হাসান বলে, তাহলে তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।
কেঁদে ওঠে শ্যামলী, না, তোমাকে ছাড়তে আমাকে বোলো না, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি শূন্য হয়ে যাবো।
হাসান বলে, তাহলে আমিই শুধু শূন্য থাকবো?
শ্যামলী হাসানকে আদর করতে করতে বলে, মনে করো আমি তোমার বউ, তুমি আমাকে বউ ব’লেই ডেকো।
হাসান বলে, আর আমি তোমার?
শ্যামলী একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়, তারপর বলে, ঠিক আছে তোমাকে আমি আমার হাজব্যান্ডই মনে করবো, তুমি আমার হাজব্যান্ড।
হাসান বলে, বাইরে এ-পরিচয়টা তুমি দিতে পারবে?
শ্যামলী কেঁপে ওঠে, বাইরে এটা বলতে হবে কেনো? এ-পরিচয়টা শুধু তোমার আমার মধ্যে।
হাসান বলে, বিয়ে, স্বামী, স্ত্রী, সংসার এসব হাস্যকর আমার কাছে, কিন্তু আমি তোমাকে কাছেই চাই, সব সময় পেতে চাই।
শ্যামলী বলে, আমিও চাই, আমি যে কী করি।
হাসানের ওপর একটি চাপ এসেছে, কবিলেখকদের একটা জরুরি অবধারিত সভায় যেতে হবে, সেখানে একটা শক্তিমান ছোকরা লেখককবিদের জ্ঞান দেবে, বোঝাবে কেনো একদল করতে হলো, কেনো তাদের অবশ্যই ওই দলে যোগ দিতে হবে; হাসানকেও একদলে যোগ দিতে হবে। হাসান ওই পেশল মূর্খ ছোকরাকে চেনে, সে খুনটুন করতে দ্বিধা করে না, ছোকরা শিঘ্রি মন্ত্রীটন্ত্রী হবে, মহানায়কের একান্ত পেশি সে, এবং খুবই শক্তিমান, তার আদেশ মেনে চলতে হবে কবিলেখকদের।
হাসান ফোন করে কবি কামর আবদিনকে, আপনি কি শহিদালি সাহেবের সভায় যাচ্ছেন?
কামর আবদিন তোতলাতে থাকেন, তিনি খুব ভয় পেয়ে গেছেন, বলেন, আআমি বুবুঝতে পারছি না, কিকিন্তু না গিয়ে উউপায় নেই, আমি বেঁচে থাথাকতে চাই, শুনেছি না গিয়ে উডউপায় নেই। আআমি বেঁচে থাকতে চাই ককাকবিতা লিখতে চাই।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আপনি কি একদলে যোগ দিচ্ছেন?
কামর বলেন, দলটিল তো আমি বুঝি না, কিন্তু যোগ দিতে বললে যোগ তো দিতেই হবে; এটা প্রতিবাদ করার সময় নয়, বেঁচে থাকার সময়, কবিদের জীবনে একটা সময় আসে যখন বেঁচে থাকাই কবিতা।
হাসান বলে, একাত্তরেও তো আপনি বেঁচে ছিলেন।
কামর কাঁপতে কাঁপতে বলেন, আমি কবিতা লিখতে চাই, কবিতা লেখার জন্যে বেঁচে থাকা দরকার, আমি প্রেমের ভাষা জানি প্রতিবাদের ভাষা জানি না, আমি কবি, পলিটিশিয়ান নাই, বীর নই, বিপ্লবী নই।
খুব সুখে আছে মনে হচ্ছে রাকিব সুলতান; হাসানকে সে ফোন করেছে, দোস্ত, শ্ৰদ্ধেয় শ্যাক শহিদালি সাব যে কবিল্যাখকগো ডাকছেন, চিঠি দিছেন, তুমি তার চিঠি পাইছো নি? তোমারে বাদ দেয় নাই তো?
হাসানের বলতে ইচ্ছে করে সে কোনো চিঠি পায় নি, পাওয়ার সে যোগ্য নয়, কিন্তু ভুল বাঙলায় ধমকের পর ধমকের ভাষায় লেখা চিঠিটি তার সামনে পড়ে আছে, এবং তাকে ধমকাচ্ছে।
সে বলে, পেয়েছি।
রাকিব জিজ্ঞেস করে, তুমি নিশ্চয়ই যাইবা?
হাসান বলে, আমি জানি না।
রাকিব বলে, কও কি, দোস্ত, তুমি জানো না? আমাগো যাইতেই হইবো, সব কবিল্যাখ্যকরাই যাইবো, তোমারেও যাইতে হইবো। রাজাবাদশারা ডাকলে যাইতে হয়, কবিগো কাম ত তাগো বন্দনা করা।
হাসান বলে, হয়তো আমি যাবো না।
রাকিব বলে, কও কি দোস্ত? তোমারে যাইতেই হইবো, দ্যাশে, নতুন দিন আসছে, আমরা কবিরাও নতুন দিন রচনা করবো। কবিগো খালি কবিতা ল্যাখলে চলবো না, দ্যাশে নতুন সোসাইটিও ইস্টাবলিশ করতে হইবো। মহানায়কের প্রত্যেকটি কথা কবিগো মাইন্যা চলতে হইবো, তিনি ত সম্রাট।
হাসান বলে, তুমি যেয়ো।
আলাউদ্দিন রেহমান উদ্বিগ্ন হয়ে চ’লে এসেছে, বলছে, দোস্ত, তুমি নিশ্চয়ই শ্যাক শহিদালির চিঠি পাইছো?
হাসান বলে, হ্যাঁ পেয়েছি।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, এখন কী করব? দ্যাশে ত ফ্যাশিবাদ শুরু হইয়া গ্যাছে, তোমারে ত বাইচ্যা থাকতে হইবো।
হাসান বলে, আমি বেঁচে থাকতে চাই, কিন্তু ওই সভায় আমি যাচ্ছি না।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, কবিল্যাখকরা সবাই যাইতেছে, দুই চাইরজন মহানায়করে লইয়া পইদ্যও লেইখ্যা ফ্যালছে, আরও হাজার হাজার পইদ্য লিখবো; অরা কায়দে আজম কায়দে মিল্লাতরে বাবা বাবা ডাইক্যা পদ্য লেইখ্যা বাঙলা ভাষার পাছা ফাটাইছে। অয়া আইউব খাঁয় বুনিয়াদি গণতন্ত্ৰ লইয়া পাগল হইছে, দাউদ আদ-মজি পাইছে; আইউব খাঁর দিকে চাইয়া ক্রীতদাসের মতন হাইস্যা প্রাইজ লাইছে। তার রেভোলেশন টেরেনে ওঠছে, আইজ আবার বিপ্লবের নাওয়ে ওঠাবো। তুমি না গ্যালে বিপদে পড়বা, সময় ভাল মনে হইতেছে না, সব সলিউশন কইরা ফ্যালবো।
হাসান চুপ ক’রে থাকে; যদি সে বোবা হয়ে যেতে পারতো!
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, লাও, বিয়ার খাইয়া আসি, বিয়ারই তোমারে বইল্যা দিবো। তুমি বাচতে চাও না মরতে চাও।
হাসান ওই সভায় যায় না; কিন্তু রাতেই শুনতে পায় শহিদালি কবিলেখকদের ধমকে, দাঁড় করিয়ে, মহানায়কের নামে শ্লোগান দিয়ে, বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের একদলে যোগ দেয়া ছাড়া কোনো পথ নেই; কবিতা উপন্যাস নাটক কিছু না, এখন সবই হচ্ছে মহানায়ক, এবং একদল। যারা গিয়েছিলো, তারা সবাই একদলে যোগ দিয়ে এসেছে; অনেকে মঞ্চে উঠে একদল ও মহানায়কের জয়গানও গেয়ে এসেছে, বলেছে মহানায়কই দেশ, রাষ্ট্র, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, তিনিই মহাকাল।
শ্যামলী ফোন করেছে, হাসান, তোমাকে অনেক দিন দেখি না; তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, শুতে ইচ্ছে করছে।
হাসান বলে, তুমি কিছু মনে কোরো না, আমার কাউকে দেখতে ইচ্ছে করছে না, আমার অন্ধ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
শ্যামলী বলে, শুতেও ইচ্ছে করছে না?
হাসান বলে, আমার নপুংসক হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, হয়তো হয়ে গেছি।
শ্যামলী বলে, তা তুমি কখনো হবে না, হাসান, তোমার ওটি কেটে ফেলে দিলেও তুমি পুংসক থাকবে; তোমার একটা না, বারোটা।
হাসান বলে, তোমার এমন কেনো মনে হয়?
শ্যামলী বলে, আমি তোমাকে জানি বলে; তোমার বারোটা আছে, তোমার বারোটাই আমার ভালো লাগে।
হাসান বলে, আমি চাই একটিও না থাক।
শ্যামলী বলে, সত্যিই কি আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না?
হাসান বলে, মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
শ্যামলী বলে, আমি জানতে চেয়েছি আমাকে কি দেখতে ইচ্ছে করছে না?
হাসান বলে, মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, তোমারও একজন মা আছে?
হাসান বলে, তোমার সন্দেহ হচ্ছে কেনো?
শ্যামলী বলে, তুমি তো কোনোদিন মাবাবার কথা বলো নি। আমার বুড়ো হাজব্যান্ডটাও মা বাবার কথা ব’লে কাইন্দা জারে জার হইয়া যায়, বারবার ডান হাতে বা হাতে চোখ মোছে, তার কান্দন দেখে মনে হয় তার মা তারে দুই দিন আগে বিইয়েছে, কিন্তু তুমি তো কখনো বলো নি।
হাসান বলে, আমি তো তোমার হাজব্যান্ড নই।
শ্যামলী বলে, কেনো, আমি তো তোমাকে বলেছি তোমাকে আমি আমার হাজব্যান্ডই মনে করি।
হাসান বলে, তোমাকে ধন্যবাদ যে অন্তত তুমি ওটা মনে করো।
শ্যামলী বলে, সত্যিই বিশ্বাস করো তোমাকে আমি হাজব্যান্ডই মনে করি।
হাসান বলে, আমার খুব ভালো লাগে যে সারাদেশে শুধু আমারই একটি অবিবাহিত স্ত্রী আছে, যে অন্যের স্ত্রী কিন্তু আমাকে হাজব্যান্ড মনে করে।
শ্যামলী বলে, আমি নিজেকে সত্যিই তোমার স্ত্রী মনে করি।
হাসান বলে, সারাদেশে একমাত্র আমার স্ত্রীই অন্য পুরুষের সাথে ঘুমোয়, অন্য পুরুষের সন্তানের জননী হয়।
শ্যামলী বলে, আমার সমস্যা তো তুমি বোঝে।
হাসান বলে, তা বুঝি।
শ্যামলী বলে, তাহলে আমাকে এমন কষ্ট দাও কেনো?
হাসান বলে, আমি খুব খারাপ মানুষ ব’লে।
শ্যামলী বলে, আমার আসতে ইচ্ছে করছে, আমি কি আজি দুপুরে আসবো?
হাসান বলে, এসে কী হবে?
শ্যামলী বলে, হাজব্যান্ডকে কি আমার দেখতে ইচ্ছে করে না, তার সাথে শুতে ইচ্ছে করে না?
হাসান বলে, তারচেয়ে বরং আমিই আসি।
শ্যামলী আঁতকে উঠে বলে, না, না, ফরহাদ সাহেব এসে পড়লে বিশ্রী ঘটনা ঘটবে, জানো তো সে তোমাকে সহ্য করতে পারে না।
হাসান বলে, তাহলে তুমি এসে পড়ো, সারারাত আমার সাথে থাকবে।
শ্যামলী বলে, তুমি তো আমার সমস্যা জানো।
হাসান বলে, সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়।
শ্যামলী বলে, অতো সহজ নয় জীবন, খুবই জটিল।
হাসান বলে, আমি জটিল কবিতা আর সহজ সরল জীবন পছন্দ করি।
শ্যামলী বলে, জানো, গতকাল কী হয়েছে?
হাসান জিজ্ঞেস করে, কী?
শ্যামলী বলে, ফরহাদ সাহেব আমার ওপর উপগত হ’তে চেয়েছিলো।
হাসান বলে, তাহলে নিশ্চয়ই একটি জমজমাট রাত কাটিয়েছো।
শ্যামলী বলে, না, না, আমি রাজি হই নি; তাকে ঢুকতে দিই নি।
হাসান বলে, দিলেও পারতে, তার দাবি আছে, সে তোমার বিবাহিত হাজব্যান্ড, তার কাবিন আছে, ফেরেশতারা ওই ময়লা কাবিন হাতে সারারাত তোমাকে অভিশাপ দিয়েছে।
শ্যামলী বলে, আমি দিতে পারি না; আমি তোমার প্রতি ফেইথফুল থাকতে চাই, অনেস্ট থাকতে চাই।
হাসান বলে, তোমার সতীত্বে প্রাচীন দেবতারা মুগ্ধ হবেন, সতী হিশেবে তোমার নাম দ্যুলোকে ভূলোকে কীর্তিত হবে; স্বৰ্গলোকে তোমার নাম হবে সতী শ্যামলী, বিশশতকের একমাত্র সতী।
শ্যামলী বলে, আমার সমস্যা তুমি বুঝতে চাও না।
হাসান বলে, আমি মাকে দেখতে যেতে চাই।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, এখনি?
হাসান বলে, তা জানি না।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, মায়ের মুখ তোমার মনে আছে তো, তাকে চিনতে পারবে তো?
হাসান বলে, আমার মুখ মা নিশ্চয়ই চিনতে পারবে।
শ্যামলী বলে, আমার তা মনে হয় না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো?
শ্যামলী বলে, আমার মনে হচ্ছে এখন আমিই হয়তো তোমার মুখ চিনতে পারবো না।
হাসান মায়ের মুখটি মনে করতে চেষ্টা করে, কিছুতেই মনে করতে পারে না; মায়ের মুখটি দেখতে ইচ্ছে করলেই ঘুরেফিরে নানা মুখ আসতে থাকে, শ্যামলীর মুখ আসে, অ্যাডের কয়েকটি মডেলের মুখ আসে, অনেক আগে মরো-যাওয়া পাশের বাড়ির এক মহিলার মুখ মনে আসে, যে একবার তার গাছ থেকে বরই পাড়ার জন্যে তাকে ‘চোরা দারোগার পো’ বলে বকেছিলো; কিন্তু মায়ের মুখটি আসে না। মায়ের মুখটি কেমন? মায়ের মুখটি কেমন? মায়ের মুখটি কেমন? সে কল্পনা করার চেষ্টা করে মা তাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে, কিন্তু মায়ের মুখ আসে না; সে কল্পনা করে মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরছে, কিন্তু মায়ের মুখ সে দেখতে পায় না; সে কল্পনা করে ইস্কুল থেকে দেরি ক’রে ফিরছে সে, আর তার মা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে আছে তাকে দেখবে ব’লে, কিন্তু সে মায়ের মুখটি দেখতে পায় না। আমার মায়ের মুখটি কেমন ছিলো? তার গালে কি কোনো দাগ ছিলো? মারা কি জোড়া ভ্রু ছিলো? মা হাসলে কি গালে টোল পড়তো? মার চোখ দুটি কি তাদের পুকুরের মতো ছিলো? মায়ের মুখে কি একটা অমোচনীয় বিষন্নতা ছিলো? কপালে একটা দুঃখের দাগ ছিলো? তাঁর ঠোঁট কি শুকনো ছিলো, যাতে কখনো চুম্বনের ছোঁয়া লাগে নি?
হাসান জিজ্ঞেস করে, শ্যামলী, তুমি কি বলতে পারো?
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, কী, বলো?
হাসান বলে, আমার মার মুখটি দেখতে কেমন?
শ্যামলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমার মার চোখ কেমন?
শ্যামলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমার মার ঠোঁট কেমন? শ্যা
মলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমার মারা ভ্রু কেমন?
শ্যামলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান বলে, তুমি দেখো নি কেনো? তুমি দেখো নি কেনো? দেখো নি কেনো?
কয়েক দিন পর চারজন শক্তিমান জিন্স ট্রাউজার পাজামা পাঞ্জাবি কৃষক-শ্রমিক আসে হাসানের অফিসে; তাদের চেনে হাসান, তারাও ভালো ক’রেই চেনে হাসানকে। তারা অফিসে ঢোকার পর কলরাবিত বর্ণাঢ্য অফিসটি প্রাচীন অরণ্যের মতো নীরব নিঝুম হয়ে ওঠে, বিবর্ণ হয়ে ওঠে; মনে হয় সবাই গঙ্গার তীরে পদ্মাসনে ব’সে সমাধিমগ্ন ধ্যান করতে শুরু করেছে, চঞ্চল বালিকাদের মতো মুখর বাচাল টেলিফোনগুলোও বটগাছের নিচে সমাধিমগ্ন, দেয়ালের রূপসী মডেলটি হঠাৎ হাসি বন্ধ ক’রে টানটান দেয়াল হয়ে গেছে।
একজন বলে, আপনে শ্ৰদ্ধেয় শ্যাক শহিদালি সাহেবের সভায় যান নাই।
হাসান বলে, হ্যাঁ, আমি সাধারণত নিমন্ত্রণে যাই না।
আরেকজন বলে, ওইটা নিমন্ত্রণ ছিল? বোঝাতে পারেন নাই ওইটা অর্ডার?
হাসান বলে, না, আমি বুঝতে পারি নি।
একজন বলে, দলের অর্ডার অমান্য কইর্যা আপনে অপরাধ করছেন।
হাসান বলে, আদেশ আমার ভালো লাগে না।
আরেকজন বলে, বাচতে হইলে অক্ষরে অক্ষরে অর্ডার মানতে হইবো।
হাসান কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে বলে, বাঁচা সম্ভবত আমার হবে না।
একজন বলে, বেশি সময় আমাগো নাই, একদলে যোগ দ্যাওনের ফর্ম আমরা লাইয়া আসছি, একটা সাইন কইর্যা দ্যান সে আপনে একদলে যোগ দিলেন।
হাসান বলে, আমি তো রাজনীতি করি না, তাই আমার দলে যোগ দেয়ার তো কোনো দরকার নেই।
আরেকজন বলে, রাজনীতি আপনের করতে হইবো না, পলিটিক্স আমরাই করবো, আপনেগো কাম আমাগো সাপোর্ট করা, আমাগো নামে শ্লোগান দেওয়া।
হাসান বলে, আমি কী ক’রে স্বৈরাচারকে সমর্থনা করি?
একজন বলে, সাবধান হইয়া কথা কইয়েন, এইটা স্বৈরাচার না, এইটা গণতন্ত্র এইটা সমাজতন্ত্র, দ্যাশের জইন্যে এইটা দরকার।
আরেকজন বলে, আপনের কোনো ফিউচার নাই মনে হইতেছে, এমন করলে খরচ হইয়া যাইবেন।
একজন বলে, আমাগো টাইম নাই, তরাতিরি একটা সাইন দ্যান।
হাসান বলে, এখন সম্ভবত আমি সাইন দিতে পারবো না।
আরেকজন জিজ্ঞেস করে, কখন পারবেন?
হাসান বলে, একদিন নিশ্চয়ই পারবো, তখন আমি না করবো না, যেখানে সাইন দিতে বলবেন সেখানেই দেবো, তবে তখন হয়তো আমি থাকবো না।
তারা ওঠে, তার চেয়ারেটেবিলে লাথি মারে, বলে, মনে করেন আপনে নাই।
একটি কবিতা কয়েক দিন ধ’রে তার ভেতরে ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রজাপতির মতো, ফিরে আসছে ডানায় পরাগ মেখে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে; আজ তার ইচ্ছে করছে প্রজাপতিটি ধরতে কবিতাটি লিখে ফেলতে, নইলে হয়তো চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে; সন্ধ্যায় সে বসে কবিতাটি লিখে ফেলতে; অবাক হয় যে সে ঠিকমতো বলপেন ধরতে পারছে না। আমি কীভাবে ধরি বলপয়েন্ট, নিজেকে সে জিজ্ঞেস করে, কীভাবে ধরি? আজি ধরতে পারছি না কেনো? এতো দিন কি আমি বলপয়েন্ট ধ’রে লিখি নি? কলম ধরা কি ভুলে গেছি আমি? হাসান বলপয়েন্টের ঢাকনা খুলে পাশে রেখে বলপয়েন্ট ধরতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঠিকমতো ধরতে পারে না। আমি কি লেখার সময় ঢাকনাটা পেছনের দিকে লাগিয়ে নিই? তাতে সুবিধা হয়? পেছনের দিকে লাগিয়ে না নিলে কি আমি লিখতে পারি না? হাসান ঢাকনাটি তুলে বলপয়েন্টের পেছনে লাগিয়ে বলপয়েন্টটি ধরতে চেষ্টা করে; কিন্তু ঠিকমতো ধরতে পারে না। আমি প্রথম কীভাবে লিখতে শিখেছিলাম? একটি মাটির পেন্সিল, তার মনে পড়ে, একটি মাটির শ্লেট, চারদিকে সোনালি কাঠের ঘের, তার মনে পড়ে; বাবা তাকে পেন্সিল ধরতে শিখিয়েছিলেন, বাবার হাত কাঁপছিলো, কিন্তু তার হাত কাঁপছিলো না। সে তো শুরুতেই ঠিকমতো পেন্সিল ধরেছিলো; আজ কেনো পারছে না? আচ্ছা, বলপয়েন্টটাকে যদি আমি মাটির পেন্সিল আর ডায়েরিটাকে স্লেট মনে করি, তাহলে কি ধরতে পারবো? গোড়া থেকে শুরু করবো আবার? হাসান পারে না, তার মনে হয় কলম সে আর ধরতে পারবে না; বলপয়েন্টটিকে তার অচেনা মনে হয়। এরকম কোনো বস্তু আমি আগে কখনো ধরি নি, ধরার অভ্যাস নেই আমার, হাসানের মনে হয়, আমি লেখনি ধরতে জানি না, আমার আদিম পূর্বপুরুষ যেমন এটা ধরতে জানতো না তার মতো আমিও এটা ধরতে জানি না। এটা ভেবে তার ভালো লাগে; হাসান তাকিয়ে থাকে বলপয়েন্টটার দিকে, বলপয়েন্টটিকে তার অচেনা থেকে অচেনোতর মনে হয়, বলপয়েন্টটি একটি লিকলিকে সরীসৃপ হয়ে তার আঙুলে জড়িয়ে যেতে থাকে, তার শরীর কেঁপে ওঠে, ঝাঁকুনি দিয়ে হাসান সেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
আলাউদ্দিন রেহমান হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিতে দিতে বলে, দোস্ত, তুমি মাসখানেক ঢাকার বাইরে চুপচাপ বেড়াই আসো।
আলাউদ্দিন বলে, ক্লাইমেইট একটু সফ্ট্ হইবো এইর মইধ্যে।
হাসান বলে, আমার মনে হয় কিছুই কোমল হবে না, আমরা ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্কর দুৰ্ঘটনার দিকে যাচ্ছি।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, আমারও সেই রকমই মনে হইতাছে।
হাসান বলে, আমি দিকে দিকে রাইফেলের নল দেখতে পাচ্ছি, লেফরাইট লেফরাইট শুনতে পাচ্ছি।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, লও, আমিও তোমার লগে বেড়াই আসি।
হাসান কি মাকে দেখতে যাবে আলাউদ্দিনকে নিয়ে? কিন্তু মায়ের মুখই তো মনে পড়ছে না। যদি সে মাকে চিনতে না পারে? মা যদি তাকে চিনতে না পারে?
কোথায় যেতে পারি আমি? আমি কি পরিচিত প্রিয়দের মুখ দেখতে চাই? আমার পরিচিত কারা? প্রিয় কারা? আমার কি কোনো পরিচিত আছে, প্রিয় আছে? মায়ের মুখ দেখলে কি সুখী হবো? মায়ের মুখটি কেমন? আমার যেতে ইচ্ছে করছে এমন কোথাও যেখানে আমাকে কেউ চেনে না, আমি কাউকে চিনি না; সেটা যদি হতো কোনো প্রাচীন আদিম অরণ্য নির্জন দ্বীপ ধুধু চর, সুখী হতাম। সুখী? আমি কি সুখী হ’তে চাই? কোথায় পাবো প্রাচীন অরণ্য? কোথায় নির্জন দ্বীপ? ধুধু চর? কেমন হয়। হাতিয়া? সন্দ্বীপ? মহেশখালি? পদ্মার চর? সেখানে কি নির্জনতা আছে? সেখানে কি মানুষহীনতা আছে? মানুষের মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না; আমি দেখতে চাই পাহাড়, বন, কুঁড়েঘর, নদীর বিষন্ন তীর, কাশবন, পালে পালে গাভীর মুখ, সবুজ ঘাসের প্রান্তর।
পদ্মার একটি চরে একটা উঁচু কুঁড়েঘরে যখন তারা সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি কাটাচ্ছিলো, এপাশে ওপাশে কাশবন দেখছিলো, হারিয়ে যাচ্ছিলো কাশফুলের শাদা মেঘের মধ্যে, কাশ ভেঙে চিবোচ্ছিলো, মোটা ভাত আর ইলিশের গানগনে ঝোল ডিম খেয়ে জিভের স্বাদ ফিরে পাচ্ছিলো, এক সন্ধ্যায় একটা ছোটো ডিঙ্গিতে দুই মাঝির সাথে ইলিশ ধরতে গিয়ে ইলিশের ধবধবে শাদা নাচ আর মৃত্যু দেখে সুখী ও কাতর হয়ে উঠছিলো, তখন তারা সংবাদটি পায়। তারা তখন সভ্যতা থেকে বহু দূরে, সভ্যতাকে তারা পায়ের ময়লার মতো ধুয়ে এসেছে; সংবাদ, অ্যাড, রাজনীতি থেকে দূরে থেকে সুস্থ হয়ে উঠছে, তখন সংবাদটি তারা পায়।
এক মাঝি তার ছোটো ট্রানজিস্টরে প্রথম সংবাদটি পায়।
মাঝি ছুটে এসে সংবাদ দেয়, ছার, দ্যাশে খুনখুনি শুরু অইয়া গেছে, সবতেরে মাইর্যা ফ্যালাইছে, সবতেরে মাইর্যা ফ্যালাইছে।
হাসানের মাথার ভেতরে তীব্ৰ অন্ধকারের ঝাকঝাক ছুরি ঢুকে যায়; সে নদী জুড়ে কলকল খলখল অন্ধকার বয়ে যেতে দেখে।
আলাউদ্দিন বলে, না, এইটা হইতে পারে না, এইটা সম্ভব না।
মাঝি বলে, না, ছার, হইছে, অন্যরা দ্যাশ দখল করছে।
আলাউদ্দিন বারবার ঘোষণা শোনে, আর বলে, না, এইটা হইতে পারে না, এইটা সম্ভব না।
হাসান অন্ধকারের কলকল খলখল শুনতে পায়, কলকল খলখল দেখতে পায়।
হাসান বলে হয়তো অসম্ভবই ঘটে গেছে কিছুই অসম্ভব নয়।
আলাউদ্দিন বলে, তাইলে এখন দ্যাশের কি হইবো?
বুটের শব্দ পাচ্ছি, দশকজোড়া বুট।
আলাউদ্দিন আর মাঝিটি ভয় পায়; হাসান বলে, আমি একটু একা থাকতে চাই, নদীর পারে একা হাঁটতে চাই।
আলাউদ্দিন বলে, সাবধানে হাইটো।
হাসান হাঁটতে থাকে, যেনো সে চোখে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু একটি বিশাল লাশ দেখতে পায়; লাশটি একবার নদী হয়ে ওঠে নদীটি একবার লাশ হয়ে ওঠে, চারটি একবার লাশ হয়ে ওঠে। লাশটি একবার চর হয়ে ওঠে।
হাসান নদীকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, এরকম কি কথা ছিলো?
হাসান চরকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, এরকম কি কথা ছিলো?
নদী আর চর শুধু তার দিকে একটি বিশাল লাশ তুলে ধরে।
অনেক দিন কবিতা লেখি নি হাসান; তার ভেতর গুঞ্জন করে নি কোনো পংক্তি, কোনো চিত্রকল্প জ্ব’লে ওঠে নি স্থির বিদ্যুতের মতো, ঝিলিক দেয় নি কোনো নাচ; মগজটাকে তার মনে হচ্ছে ঝামাপাথর, যেখানে কোনো গুলা জন্মে না, যার ভেতর দিয়ে কোনো নদী বয় না, যার ভেতরে কোনো মেঘ নেই। কিন্তু কবিতা তো লিখতে হবে তাকে–আমাকে কবিতা লিখতে হবে, আমি কবিতা লেখার জন্যে দণ্ডিত, কবিতা লেখাই আমার দণ্ড, আমি যদি এই দণ্ডকে অস্বীকার করি তাহলে অস্বীকার করি নিজেকেই, নিজের জীবনকেই। সব কিছু অস্বীকার করতে পারি। আমি, কিন্তু জীবনকে পারি না, তাই কবিতা লেখাকে অস্বীকার করতে পারি না, হয়তো জীবনকেও পারি অস্বীকার করতে, কিন্তু কবিতা লেখাকে পারি না–জানি আমি জানি এটা সিসিফাসের শ্ৰম, যে-পাথর গড়িয়ে পড়ে যাবে তাকে গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের শিখরে নেয়া; স্বেচ্ছায় আমি, আমার রক্তধারা, এই দণ্ডকে বেছে নিয়েছি, এই দণ্ডের প্রতি সৎ থাকতে হবে আমাকে। আমি জীবনের প্রতি সৎ থাকতে না পারি, জীবনকে আমি শুয়োরের খাদ্যে পরিণত করতে পারি, ঢেলে দিতে পারি নর্দমায়; কিন্তু সৎ থাকতে হবে আমার দণ্ডের প্রতি, কবিতার প্রতি, আর প্রতিটি পংক্তি, ধ্বনি, রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্পের প্রতি। কবিতার প্রতি সৎ থাকাই আমার সততা। মানুষের প্রতি মানুষের সৎ থাকা সম্ভব নয়, আমি হয়তো সৎ থাকতে পারি নি মানুষের প্রতি, আমি সৎ নই শ্যামলীর প্রতি, শ্যামলী সৎ নয় আমার প্রতি, অসততাই জীবনের দণ্ড; কিন্তু শিল্পের দণ্ড সততা, তার প্রতি আমাকে সৎ থাকতে হবে, আমাকে সৃষ্টি ক’রে যেতে হবে।
আমি কেনো সৃষ্টি করতে পারছি না? নিষ্ফলা সময় আমার এতো শীঘ্ৰ এসে গেছে? এখনো তো কোনো অনশ্বর মুক্তো ফলাতে পারি নি, ভেতরে তো অনেক রোগ জন্মালো ময়লা ঢুকলো, কিন্তু সেগুলো ঘিরে তো সৃষ্টি হলো না সেই সৌন্দর্য, যা অক্ষয় হয়ে জ্বলজ্বল করবে। ভবিষ্যতের অন্ধকার ভ’রে। আমি কি জীবন দ্বারা আক্রান্ত, জীবন দিয়ে পর্যুদস্ত? মাছি পোকা পশু বেড়াল মানুষের জীবন দিয়ে? ওটা আমি কাউকে বকশিশ দিয়ে দিতে পারি? শিল্পকলার প্রতিপক্ষ কি জীবন? তাহ মনে হচ্ছে আমার- মাছির জীবন আছে, শিল্পকলা নেই; ওই কুকুরগণের জীবন আছে, শিল্পকলা নেই; আর মানুষও সামান্যই দাম দেয় শিল্পকলাকে, তারা চায় ভাত, জল, বিছানা, সঙ্গমের পর সঙ্গম এবং আরো সঙ্গম। আমি, এই আমি, যখনই জীবনের জন্যে বেশি ব্যাকুল হয়েছি, দূরে স’রে গেছে শিল্পকলা; কিন্তু জীবন ছাড়া কার গর্ভে জন্ম নেবে শিল্পকলার ভ্ৰাণ, বাড়বে কার জরায়ুতে, প্রসাবিত হবে কার যোনিদ্বার দিয়ে? এখন যে আমি সৃষ্টি করতে পারছি না, তার অর্থ কি এই নয় যে জীবন আমাকে আলোড়িত করছে না, জীবন আমাকে ক্ষুধার্তা করছে না? ক্ষুধা বোধ করছি না ব’লেই লিখতে পারছি না। কবিতা? আমি চমৎকার ঘুম যাচ্ছি? আমার ঘুমের ক্ষুধা নেই? আমি নিয়মিত পান করছি? আমার পানের ক্ষুধা নেই? আমি মানুষের সঙ্গ পাচ্ছি? আমার সঙ্গলাভের ক্ষুধা নেই? আমি সুস্থ আছি? আমার সুস্থ হওয়ার ক্ষুধা নেই? আমি সঙ্গম করছি? আমার সঙ্গমের ক্ষুধা নেই? কিন্তু কয়েক মাস তো হলো আমি নারী ছুঁই নি ওষ্ঠ ছুঁই নি অভ্যন্তর ছুঁই নি? তবু আমার কেনো ক্ষুধা নেই? তাই কি আমার ভেতর কবিতা নেই?