কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ১৪
ভোরে ঘুম ভেঙে হাসান বিছানায় গড়াচ্ছে, মনে মনে বলছে, আজি আটত্রিশ পূর্ণ হলো, কিন্তু কী করতে পেরেছি আমি?
আজ যদি মরে যাই, কী থাকবে? কটি পংক্তি, কটি চিত্রকল্প, কটি রূপক, কটি উপমা? কটি দীর্ঘশ্বাস? কটি চন্দ্রোদয়? কটি সূর্যাস্ত কটি কবিতা?
কিছুই থাকবে না। কিছুই ক’রে উঠতে পারি নি। ব্যর্থতা, শুধু ব্যর্থতা।
মাত্র চারটি কাব্য, দেড় শোর মতো কবিতা। ওগুলার কটি কবিতা?
একজন কবির পক্ষে লেখা সম্ভব কটি কবিতা? দশটি? একশোটি? পাঁচশো?
ব্যর্থতায় কাটিয়ে দিলাম একটি সম্পূর্ণ জীবন?
আমার জীবন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে? হ্যাঁ, আজ যদি ম’রে যাই, তাহলে এটাই আমার সম্পূর্ণ জীবন, যার অর্থ শূন্যতা।
কিন্তু আমি সত্যিই বেঁচে থাকতে চাই, কবিতা লিখতে চাই, আরো, আরো।
কিন্তু কবিতা কি আবার আসবে আমার কাছে?
হ’তে হবে সুচারুরূপে দণ্ডিত, বদমাশ? তাহলেই আসবে কবিতা?
কবিতা এখন বদমাশের জঘনেই আটকে থাকতে পছন্দ করে?
কখন আমি হবো বিশুদ্ধ দণ্ডিত, এবং কবি?
বারান্দায় কাজের মেয়েটি পড়ে গেছে, হয়তো ইচ্ছে ক’রেই হয়তো অনিচ্ছায়, এবং গোঙাচ্ছে, তার শব্দ শুনতে পায় হাসান। শব্দটি বেশ ভারিই হয়েছে, চমকে বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে। সে; গিয়ে দেখে মেয়েটি বসার চেষ্টা করছে, গোঙাচ্ছে, এবং কাঁদছে। মেয়েটিকে কি সে ধ’রে তুলবে? না; মানুষের মাঝেমঝে পতন দরকার, পতন থেকে ওঠা দরকার। হাসানকে দেখে মেয়েটি ভালোভাবে বসার চেষ্টা করছে, পারছে না। মেয়েটি মাথা নিচু ক’রে কাঁদতে থাকে। মাথা নিচু ক’রে কাঁদা হাসান পছন্দ করে না; এভাবে যারা কাঁদে তারা কাঁদতে কাঁদতে জানায় যেনো তারা পুণ্যে পরিপূর্ণ, একটুও পাপ জানে না, পাপী শুধু অন্যরা, অন্যদের জন্যেই তাদের জীবনটা শেষ হয়ে গেলো।
হাসানের ইচ্ছে হয় বলে, গেট আউট, গেট আউট, এসব কান্দাকান্দি আমার ভালো লাগে না, বেরিয়ে যাও; তবে সে তা বলতে পারে না।
মেয়েটি কোনো কথা বলে না; হাসান মেয়েটির মুখ দেখতে পায় না, কিন্তু সে বোঝে কাদঁছে মেয়েটি।
নিষ্পাপ, আহা নিষ্পাপ, পবিত্র মেরি–ঘেন্না লাগে হাসানের।
এই মেয়েটির কান্না কি গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে? কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়; অজস্র মেয়ে কাঁদছে পৃথিবীতে, সে তাদের সবাইকে কান্না থেকে মুক্তি দিতে পারে না; যার কাঁদার সময় এসেছে, সে কাঁদুক; প্রত্যেককে নিজের জন্যে নিজেকেই কাঁদতে হয়। মেয়েটি কাঁদুক, এটা তার জীবন, সে-ই যাপন করুক।
হাসান বাথরুমে ঢুকে সকালের বিরক্তিকর ক্লান্তিকর কাজগুলো করে, মেয়েটির কান্নার কথা তার মনে থাকে না, বেরিয়ে খাবার খায়, জন্মদিন উপলক্ষে টেলিফোনে তিন চারটি শুভেচ্ছা গ্ৰহণ করে, নিজেকে পরিহাস করে বুড়ো আর ব্যর্থ হওয়ার জন্যে, বেরোনোর জন্যে প্রস্তুত হয়, কিন্তু মেয়েটি তখনও বসে আছে বারান্দায়; এবং কাঁদছেও। কান্নাটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না, মেয়েটি যে যায় নি, সেটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি এখনো যাও নি?
মেয়েটি আবার কেঁদে ওঠে। হাসান কান্নার দর্শক, সে কান্নার অন্তর্ভুক্ত নয়, তার কাছে মেয়েটির কান্নাকে শিল্পিত ও অ্যাড সম্মত মনে হয় না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বলো।
মেয়েটি বলে, আমার মরতে হইবো, ভাইজান।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো?
মেয়েটি বলে, আমার আর ইজ্জত নাই, আমার প্যাট হইছে।
হাসান বলে, পেটে জিনিশ ঢুকলে তো পেট হবেই। কিন্তু কাঁদছো কেনো, তাতে তো আনন্দ করার কথা। বাসায় গিয়ে লালপোড়ে শাড়ি পরে হাসো।
মেয়েটি বলে, আমার ত বিয়া অয় নাই।
হাসান বলে, পেট হ’তে বিয়ে লাগে না, জিনিশ ঢুকলেই পেট হয়।
মেয়েটি কেঁদে বলে, আমার জাইত গ্যাছে, ভাইজান।
হাসান জিজ্ঞেস করে, লোকটি কে?
মেয়েটি বলে, তা বোজতে পারি নাই, তিন চাইর খালুই তা করছে, খালুগো দুই পোলারাও করছে।
হাসানের প্রচণ্ড ঘেন্না লাগে; মেয়েটিকে কি সে লাথি মেরে বের ক’রে দেবে?
হাসান, ঘেন্নায় সে ভরে গেছে, জিজ্ঞেস করে, তখন তো খুব সুখ পেয়েছিলে, তখন তো কাঁদো নি।
মেয়েটি কথা বলে না; দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, বলো, সুখ পেয়েছিলে কি না?
মেয়েটি বলে, না, ভাইজান, পাই নাই।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো পাও নি? মে
য়েটি বলে, আমারে টাইন্যা ফেইল্যা কি করছে আমি বোজতে পারি নাই, খালি কষ্ট পাইছি, ব্যাদনায় প্যাট ফাইট্যা পরছে।
মেয়েটিকে আর পীড়ন করতে ইচ্ছে করে না হাসানের। সে জিজ্ঞেস করে, তুমি তাদের বলো নি?
মেয়েটি বলে, কইছি, তারা আমারে মাইর্যা খেদাই দিছে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, এখন কী করবে?
মেয়েটি কেঁদে ওঠে, মরুম, ভাইজান।
হাসান জিজ্ঞেস করে, মরতে হবে কেনো?
মেয়েটি বলে, আমারে অহন, কে জায়গা দিবো?
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি কি পেটের জিনিশটা ফেলে দিতে চাও?
মেয়েটি বলে, হ, ভাইজান, তয় কই ট্যাকা পামু, কোনহানে গিয়া ফালামু?
হাসান বলে, একটি মানুষ আসবে, তাকে তুমি ফেলে দিতে চাও?
মেয়েটি বলে, অইটা ত মানুষ হইব না, ভাইজান, অইটা জাউরা হইব; অইটারে আমি কোনহানে গিয়া ফালামু?
হাসান কি নিজেই জানে কোথায় গিয়ে ফেলতে হয়? এটা না ফেললে মরতে হবে মেয়েটিকে? পেটের ভেতর এমন ভয়ঙ্কর বস্তু ঘনীভূত হয়? জন্ম নেয় সাপ? সে কি মেয়েটিকে বাঁচাবে? কীভাবে বাঁচাবে? ওর বাঁচার কী দরকার?
হাসান বলে, তুমি একটি কাজ করতে পারো।
মেয়েটি বলে, কি কাম, ভাইজান?
হাসান বলে, রেল ইস্টেশনে গিয়ে গাড়ির নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারো।
মেয়েটি বলে, ভাইজান, আমার বাইচা থাকতে মন লয়।
হাসান বলে, তুমি কাল এসো, দেখি আমি কিছু করতে পারি কি না।
হাসান দুপুরে অফিস থেকে বেরোয়; তার মনে পড়ে আজ তার জন্মদিন, সে বেরোচ্ছে একটি জন্মকে প্রতিহত করার জন্যে, তার বেশ ভালো লাগে, জন্মে জন্মে জন্মে জন্মে দুঃখে দুঃখে দুঃখে দুঃখে পৃথিবী ভ’রে গেছে, আর জন্মের দরকার নেই, নিজেকে তার বুদ্ধ মনে হয়, সে জন্মচক্র থেকে একটি আত্মার নির্বাণ লাভের উপায় খুঁজতে বেরিয়েছে, কোনো অরণ্যে নয় মহাশহরে, উপায় তাকে বের করতেই হবে, নির্বাণ, অন্তত একজনের মহানির্বাণ, যে আসে নি তার নির্বাণ, সমস্ত দুঃখ কামনা বাসনা ক্ষুধা তৃষ্ণাহীন অপাপবিদ্ধ নির্বাণ। জন্ম এমন কি মহান ব্যাপার? জন্মই তো একমাত্র বিশুদ্ধ দুর্ঘটনা। মানুষ, করুণ মানুষ, দুর্ঘটনা ও দুঃখের সন্তান, তুমি কি জানো না সব কিছুর শ্রেষ্ঠ হচ্ছে জন্ম না নেয়া, কখনো ভ্ৰাণ না হওয়া, কিছুই না হওয়া; আর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ হচ্ছে জন্মের পরপরই ম’রে যাওয়া? রিকশা নিয়ে মগবাজার হাতিরপুল মোহাম্মদপুর গুলিস্থান আজিমপুর লালমাটিয়ার পথে পথে সে জন্ম প্রতিহত করার অ্যাড দেখতে পায়, একেকবার রিকশা থেকে নেমে পড়তে চায়, কিন্তু নেমে পড়তে পড়তে নামে না: অ্যাডগুলো সে মুগ্ধ হয়ে পড়তে থাকে, এমন অ্যাড সে কখনো লেখে নি, এমন উপকারী অ্যাড, নির্বাণলাভের অ্যাড, বুদ্ধের সক্রিয়তা দেখে সে মুগ্ধ হয়, শেষে সে একটি ক্লিনিকের সামনে নেমে পড়ে।
রিসিপশনিস্ট মেয়েটি তার দিকে গোলগোল চোখে তাকায়।
হাসান বলে, এখানে কি নির্বাণলাভের উপায় আছে?
মেয়েটি তার কথা বুঝতে পারে না, জিজ্ঞেস করে, কিসের উপায় আছে?
হাসান বলে, এমআর, এখানে কি এমআর করানো সম্ভব?
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, কবে করাইবেন? আইজই করাইতে চান?
হাসান বলে, না, আজ না।
মেয়েটি একটি ফর্ম বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, এইটা ফিলাপ কইর্যা দ্যান।
কী নাম লিখবে সে মেয়েটির? সে কি তার নাম জানে? কী নাম মেয়েটির? কী নাম মেয়েটির? সে মেয়েটির নাম মনে করতে পারে না; সে কি মেয়েটির নাম কখনো শুনেছে? কিন্তু একটা নাম তো লাগবে, নাম ছাড়া তো ফর্ম পূরণ হবে না; হাসান ধীরেধীরে লেখে— শ্যামলী ফরহাদ।
হাসান অবাক হয়, এ-নামটি অনেক দিন তার মনে পড়ে নি, এইমাত্র মনে পড়লো, এবং অবলীলায় লিখে ফেললো।
স্বামী? হাসান ধীরে ধীরে লেখে–মোহাম্মদ ফরহাদ আলি।
এটা কি শ্যামলীর হাজব্যান্ডের নাম? তার কি ঠিক মনে পড়ছে না, না কি সে ইচ্ছে ক’রেই ভুলে যাচ্ছে?
ফর্মটি পূরণ ক’রে সে রিসিপশনিস্টের হাতে দেয়।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, আপনের ওয়াইফ?
হাসান বলে, হ্যাঁ।
মেয়েটি ফর্মে একরাশ লেখা লেখে, শেষ হ’লে একটা অংশ ছিঁড়ে তার হাতে দিয়ে বলে, আইজ পাঁচশ ট্যাকা লাগবো, করনের দিন তিন হাজার ট্যাকা লাগবো।
হাসান পকেট থেকে বের করে তার হাতে টাকাটা দেয়।
মেয়েটি বলে, পাঁচ দিন পর ডেট দিলাম, আপনের ওয়াইফের প্র্যাগনেন্সি রিপোর্ট লইয়া আসবেন।
পাঁচটি দিন খুব চমৎকার লাগতে থাকে হাসানের; দুটি শব্দ তার মাথার ভেতরে ঘুরে ঘুরে তাকে সুখে ভরিয়ে রাখে : বুদ্ধ, নির্বাণ। আমি বুদ্ধ, আমি নির্বাণদাতা; যেজন্মে নি, তাকে নির্বাণের উপায় বের ক’রে দিচ্ছি। আমি, তার কোনো দুঃখ থাকবে না, তাকে ঘুরতে হবে না জীবনচক্ৰে, বন্দী হবে না, সে, বন্দী হবে না। তার আত্মা, থাকবে। চিরমুক্ত; তার নির্বাণের উপায় বের করেছি। আমি, লোভ কামনা বাসনা তাকে পীড়িত করবে না, সে হবে নির্লোেভ নিষ্কাম, তাকে জন্ম দিতে হচ্ছে না, তাকে দিচ্ছি। আমি পরিনির্বাণ, জন্মের আগেই সে অর্জন করবে বুদ্ধত্ব, অর্জন করবে। শূন্যতা; সে জানবে না। ক্লান্তি জ্বর যন্ত্রণা, তাকে কোনো ব্যাধি দহন করবে না; চিরশান্তির শূন্যতায় সে থাকবে চিরপরিপূর্ণ। সে জন্ম নেবে না, সব কিছুর শ্রেষ্ঠ যা, সে তা অর্জন করবে। আমি কি এমন নির্বাণ লাভ করতে পারি, পেতে পারি চিরশূন্যতা, মহাশূন্যতা? পারি না? আমার জন্যে নির্বাণ নয়? অনির্বাণ? অনির্বাণ জন্মচক্র? দুঃখচক্র? সব কিছুর শ্ৰেষ্ঠ আমার জন্যে নয়? এমনকি দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ও নয়। আমার জন্যে?
পাঁচদিন পর সন্ধ্যায় সে কাজের মেয়েটিকে নিয়ে ক্লিনিকে উপস্থিত হয়।
ডাক্তার মেয়েটি বেশ স্বাস্থ্যবতী, তাকে দেখেই বিশ্বাস হয় সে পারবে, সে নির্বাণ দিতে পারবে; তার হাত টেনে বের ক’রে ফেলতে পারবে সব কিছু।
ডাক্তার মেয়েটি বলে, আপনে চিন্তা করবেন না, ওয়েটিং রুমে ওয়েট করেন, পাঁচ মিনিটের ব্যাপার।
নার্সটি বলে, আপনে বইস্যা থাকেন, আপনের ওয়াইফের হইয়া গেলেই আপনেরে ডাকুম।
ওরা মেয়েটিকে নিয়ে ও-টিতে ঢুকে যায়; হাসান ওয়েটিং রুমে বসে থাকে। বেরিয়ে পড়ি, হাসানের মনে হয়, বেরিয়ে পড়ি, প্রতিটি মিনিটকে আমার একেকটি জন্ম মনে হচ্ছে, আমি জন্মচক্রে আটকে গেছি, আমি মুক্তি পাচ্ছি না, আমার নির্বাণ দরকার, বেরিয়ে পড়ি আমি।
পনেরো মিনিটে হাসান পনেরো হাজার পনেরো লক্ষ পনেরো কোটি জন্মচক্র অতিবাহিত করে; তারপরও তার জন্মচক্র থামে না।
নার্সটি দৌড়ে এসে বলে, হইয়া গ্যাছে, আপনের ওয়াইফের পাশে আসেন।
নির্বাণ, নির্বাণ। পনেরো মিনিটেই নির্বাণ লাভ হয়ে গেছে?
একটি ছোটো ঘরে হাসানকে নিয়ে যায় নার্স, দেখে মেয়েটি একটি বেডের ওপর শুয়ে থারথার ক’রে কাঁপছে, গোঙাচ্ছে।
নির্বাণ, নির্বাণ। নির্বাণদানের একটু যন্ত্রণা তো থাকবেই।
নার্স বলে, আমি যাই, আধঘণ্টার মইধ্যেই সব ঠিক হইয়া যাইবো। আপনে আপনের ওয়াইফের শরিলটা টিপ্পা দ্যান।
নির্বাণ, নির্বাণ। আমি কি নির্বাণ, পেতে পারি?
মেয়েটি গোঙাচ্ছে, থারথার ক’রে কাঁপছে, ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে।
সে কি কখনো কারো শরীর টিপেছে? সে কি টিপতে পারবে? তার হাতের ছোঁয়ায় মেয়েটি যদি লাফিয়ে ওঠে? মেয়েটির শরীরের ছোঁয়ায় তার হাত যদি বমি করতে শুরু করে? হাসান মেয়েটিকে টিপতে শুরু করে–বেশ মসৃণ মেয়েটি; তার পায়ের পাতা থেকে শুরু ক’রে ওপর থেকে ওপরের দিকে টিপতে থাকে, মেয়েটির শরীর থেকে একটা থারথার কম্পন্ন ঢুকতে থাকে তার চামড়ার ভেতরে; হাসান তার পা, উরু, বুক, মুখ, হাত, পিঠ, কাঁধ ধীরেধীরে টেপে, মেয়েটি আরো থারথার কাঁপতে থাকে।
কাঁপতে কাঁপতে মেয়েটি বলে, আমারে জোরে জরাইয়া ধরেন।
জোরে ধরতে হবে মেয়েটিকে? হাসানের মনে পড়তে থাকে খালু, খালু, খালু, খালুর পোলারা। তারাও হয়তো জোরে ধ’রেই চিৎ করেছিলো তাকে, তারপর হয়তো একমিনিট দুই মিনিট। না কি ঘন্টার পর ঘণ্টা? রান্নাঘরে? বাথরুমে? বারান্দায়? বেডরুমে? মেয়েটি তখন চিৎকার ক’রে ওঠে নি কেনো? সুখ লাগছিলো? তীব্ৰ সুখ? পরম সুখ? চরম সুখ? শীৎকারে চিৎকারে অন্য রকমে থরথর করছিলো সে? চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিলো? খালুদের, খালুদের পোলাদের সে জড়িয়ে ধরেছিলো? এখন তাকে জড়িয়ে ধরতে হবে হাসানকে? হাসানের ইচ্ছে হয় মেয়েটিকে ঠেলে ফেলে বেরিয়ে যেতে; কিন্তু সে পারে না, মেয়েটিকে জোরে জড়িয়ে ধ’রে বসে থাকে, তার হাত দুটি যেনো মাংসের নয়, জংধরা লোহার, ডাইনামোর মতো কাঁপছে মেয়েটি। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মেয়েটি উঠে বসে; হাসানের ইচ্ছে হচ্ছিলো মেয়েটি অনন্তকাল ধ’রে কাপুক এভাবে, তার সমস্ত সুখ অনন্তকাল ধ’রে কাঁপাক তাকে; কিন্তু যন্ত্রণাও চিরস্থায়ী নয়। নির্বাণলাভের উপায়ের খুবই উন্নতি ঘটেছে–বুদ্ধ এটা খুবই পছন্দ করতেন; জন্মজন্মান্তর লাগে না, গরু মেষ কুকুর হয়ে জন্মাতে হয় না, এক জন্মেই পরিনির্বাণ। একটু পরেই মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বেরোয় ক্লিনিক থেকে।
হাসানের ইচ্ছে হয়, মেয়েটিকে নিয়ে সে বারে গিয়ে বিয়ার খায়, মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করে, জিজ্ঞেস করে তার এখনো কষ্ট হচ্ছে কি না, ইচ্ছে হয় তার সাথে কবিতা নিয়ে কথা বলে, মেয়েটিকে একটির পর একটি কবিতা শোনায়, বদলেয়রের কবিতা মেয়েটির কেমন লাগে জিজ্ঞেস করে; কিন্তু হাসান এসব করে না, সে মেয়েটির হাতে একটি একশো টাকার নোট দিয়ে বলে, তুমি যাও, কাল থেকে আর এসো না।
মেয়েটি একবার পথে বসে পড়ে; কোনো কথা বলে না।
হাসান হাঁটতে থাকে; বেশ লাগছে তার, সে একজনকে নির্বাণ দিয়েছে, কিন্তু তাকে হাঁটতে হবে নির্বাণলাভের জন্যে। সে নির্বাণের জন্যে হাঁটছে, তখন অনেক দিন পর একটি কবিতার পংক্তি স্বপ্নের মতো আসে তার কাছে, গাছপালার অন্ধকারের ভেতর দিয়ে জোনাকির মতো আসে চিত্রকল্পের গুচ্ছ। সে হেঁটে হেঁটে মনে মনে কবিতাটি লিখতে থাকে, তাকে কয়েক মাইল হাঁটতে হবে, সে দেখতে পায় তার হাঁটার সাথে সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে শব্দ, বাক্য; পুরো কবিতাটিই লেখা হয়ে যাচ্ছে যেনো মাথার ভেতরে; এবং সে ভয় পেতে থাকে, মাথার ভেতরে লেখা এই কবিতা যখন কাগজে লিখবো, তখন এটি থাকবে তো, থাকবে তো? কবিতাটির সাথে খেলতে খেলতে সে হাঁটছে, তখন আকাশে অসংখ্য বীজ বেজে উঠতে থাকে, বিদ্যুতে ফালাফালা হয়ে যেতে থাকে আকাশের অন্ধকার, এবং আকাশ ভেঙে গ’লে উপচে বৃষ্টি নামে। এটা কী মাস? আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র? বৃষ্টির কথা মনে হ’লেই মাসের বাঙলা নামগুলো মনে পড়ে কেনো? অন্য সময় যে মনে পড়ে বিদেশি নামগুলো? পুরো শহর ভয় পেয়ে গেছে, সবাই ছুটছে, রিকশাগুলো চলছে ট্রাকের সাথে পাল্লা দিয়ে; হাসান হাঁটছে, কয়েক মিনিটেই থৈথৈ পথঘাট, বৃষ্টির কালো উজ্জ্বল আদরে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে সে, তার মনে হয়। জ্যৈষ্ঠের জোয়ার এসেছে, শহরের পথেপথে ঢুকছে জোয়ারের জল, এখনই হয়তো সামনে লাফিয়ে উঠবে একটি বোয়াল। কবিতাটি ভিজছে তার মাথার ভেতরে, একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়লো তার সামনে, এবং অনেক দিন পর তার মনে পড়লো গাছের পাতার রঙ সবুজ। অনেক দিন আমি সবুজ দেখি নি, সে একগুচ্ছ পাতা কুড়িয়ে নিয়ে বুকপকেটে রাখলো, মনে মনে বললো, সবুজ, আমার বুকের ভেতর ঢোকো। সারা শহর বৃষ্টিতে অন্ধকার হয়ে গেছে, সারা জগত বৃষ্টিতে আলোকিত হয়ে গেছে; অপূর্ব অন্ধকার ঢুকছে তার মগজে অপূর্ব আলো ঢুকছে তার মাংসে, ভেতরে ঢুকছে বীজ বিদ্যুৎ জল মেঘ। বৃষ্টির ভেতর দিয়ে জলের ওপর দিয়ে ভিজে ভিজে একটি কবিতা মাথায় নিয়ে এগোতে থাকে হাসান; সে জামা খুলে ছুড়ে দেয় রাস্তায়, ইচ্ছে হয় জিন্সটিও খুলে ফেলতে, সম্পূৰ্ণ নৈসর্গিক হয়ে যেতে, একবার হাত রাখে বেল্টে, হাত সরিয়ে নেয়, সরাসরি বৃষ্টি এসে অজস্র আঙুলে আদর করতে থাকে তার শরীর, তার মনে হয় বৃষ্টি প্রবল হয়ে উঠেছে তার বেল্ট ছিঁড়ে ফেড়ে জিপ টেনে তার জিন্স খুলে ফেলার জন্যে, তার সর্বাঙ্গ ধুয়ে দেয়ার জন্যে; ধুয়ে যাচ্ছে তার উধ্বাঙ্গের ময়লা, সজীব হয়ে উঠছে তার ত্বক, তার রক্তের ভেতরে বৃষ্টি, বৃষ্টি।
কয়েকটি দিনে হাসান একগুচ্ছকবিতা লিখে ওঠে; একটির পর একটি কবিতা আসতে থাকে, সে লেখে। এমন স্রোত অনেক দিন আসে নি; সে স্রোতে নিজেকে
প্রতিটি সরল পংক্তি ভ’রে আছে জটিল যন্ত্রণায়। আমি তো সরল পংক্তিতে সরল কবিতা লিখতে চাই, সুখ লিখতে চাই; কিন্তু আমি যন্ত্রণা লিখছি কেনো?
আমার উক্তি ও উপলব্ধির মধ্যে কি অভেদ ঘটছে না? তাই তো মনে হচ্ছে, সরল পংক্তিতে সরল সুখ আসছে না কেনো?
আমি সৎ হয়ে উঠতে চাই, আন্তরিক হতে চাই। আমি কি সৎ হয়ে উঠছি, আন্তরিক হয়ে উঠছি? সততা সততা আন্তরিকতা আন্তরিকতা কবিতা কবিতা।
এখন থেকে আমার কবিতা হবে সততার কবিতা, আন্তরিকতার কবিতা।
আগে কি আমি ছিলাম না সৎ, ছিলাম না আন্তরিক?
ছিলাম, কিন্তু দ্বিধা ছিলো, একটা দ্বিধা ছিলো, দ্বিধা ছিলো।
এখন আমি অনেক বেশি সৎ, অনেক বেশি আন্তরিক।
কিন্তু জীবনে কি আমি সৎ হ’তে পেরেছি, আন্তরিক হ’তে পেরেছি?
শ্যামলীর সাথে আমার সম্পর্ক কি সৎ, শ্যামলীর সাথে আমার সম্পর্ক কি আন্তরিক?
জীবন সততার স্থল নয়? আন্তরিকতার অঞ্চল নয়? জীবন শুধুই অসততা? অনান্তরিকতা?
জীবনে সৎ হ’লে বিপর্যয় ঘটে? তাই থাকতে হয় অসৎ?
শ্যামলীকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে, তার সাথে একটি দুপুরই তো আমার অনন্তকাল, সে-ই তো আমাকে জীবনের সম্পদ দিয়েছে, কিন্তু তার ডাকে আমি সাড়া দিচ্ছি না? কেনো? আমার ভেতর সাড়া জাগছে না কেনো? এক সময় তো আমি সাড়া দিতাম যেমন ঘাস সাড়া দেয় বৃষ্টির ছোঁয়ায়, নদী সাড়া দেয় জোয়ারে; আজ কি আমি ঘাস নই, নদী নই? শ্যামলীর সাথে কি আমি ছিন্ন হ’তে চাই? ছিন্ন হ’লে আমার কী থাকে? গুচ্ছগুচ্ছ কবিতা যে আমার ভেতরে জন্মেছে শ্যামলীর পায়ের শব্দে, জন্মেছে তার গালের আলোতে, সেগুলো কি ব্যথিত হবে না? আর আমার সেই আশ্চর্য ক্ষুধা, তার আশ্চর্য খাদ্য তো জুগিয়েছে সে-ই। তার থেকে ছিন্ন হ’লে কী থাকে আমার? থাকি আমি? কিন্তু সৎ যে আমাকে হ’তে হবে কবিতার প্রতি সৎ জীবনের প্রতি সৎ প্রেমের প্রতি সৎ।
কয়েক দিন ধ’রেই শ্যামলী একটি দুপুর চাচ্ছে, মাত্র একটি দুপুর।
হাসান বলছে, শুধু একটি দুপুর কেনো? সারাদিন নয় কেনো? সারারাত নয় কেনো? সারা বছর নয় কেনো? সারা জীবন নয় কেনো? সারা মৃত্যু নয় কেনো?
শ্যামলী বলছে, আমার সমস্যা তুমি জানো, তারপরও আমাকে বিব্রত করো। আমাকে বিব্রত ক’রে তুমি কী সুখ পাও?
হাসান বলছে তুমি তো মনে করো তুমি আমার স্ত্রী।
শ্যামলী বলছে, হ্যাঁ, তা তো মনে করিই।
হাসান বলছে, তাহলে তোমাকে সারাদিন, সারারাত, সারা জীবনের জন্য ডাকবো না কেনো?
শ্যামলী বলছে, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো; আমি সত্যিই মনে করি আমি তোমার স্ত্রী তুমি আমার হাজব্যান্ড।
হাসান বলছে, আমি যে একটি স্ত্রীর জন্যে পাগল, তা নয়। হাজব্যান্ড হওয়ার জন্যে আমি যে ব্যগ্র, তাও নয়।
শ্যামলী বলছে, তাহলে তো সব ঠিক আছে, আমি তোমার আছি তুমি আমার আছো, কোনো সমস্যা নেই।
হাসান বলছে না, সব ঠিক নেই; আমার মনে হচ্ছে সব ঠিক নেই।
শ্যামলী বলছে, কেনো ঠিক থাকবে না? আমি তো তোমার প্রতি সৎ, তোমার প্রতি ফেইথফুল, আমি অনেস্ট।
হাসান বলছে, না, আমরা সৎ নই।
শ্যামলী বলছে, না, আমরা সৎ, আমরা দুজনেই সৎ।
হাসান বলছে, তাহলে আমরা সততা কাকে বলে জানি না।
শ্যামলী বলছে, দুপুরে আমি আসবো।
হাসান বলছে, আসার কোনো দরকার নেই।
শ্যামলী বলছে, তুমি থাকবে, তুমি না থাকলে আমি তোমার দরোজার সামনে কুকুরের মতো শুয়ে থাকবো।
হাসান বলছে, তা তুমি পারবে না।
দুপুরে কি হাসান থাকবে? থেকে কী হবে? এর চেয়ে অনেক ভালো অ্যান্ড ২০০০এ গিয়ে স্পন্সরদের সাথে কথা বলা, অধস্তনদের পরামর্শ দেয়া, দু-একটি মাংসল মডেলের সাথে নিরর্থক দার্শনিক আলাপ করা। ওই মাংসল মেয়েগুলো দর্শন খুব পছন্দ করে; ওরা অবাক হয়, ওরাও মাংসে স্তনে ঠোঁটে ক্লান্ত; আত্মহত্যার দর্শন শুনতে ওদেরও ভালো লাগে। কিন্তু হাসান বেরোতে পারে না, বেরোনোর জন্যে পোশাকটোশাক প’রে আবার খুলে ফেলে; টেলিফোনে জানিয়ে দেয় দুপুরে সে আসবে না, আসবে সন্ধ্যায়।
দুপুরে শ্যামলী আসে; তারা এক সাথে খায় এবং ঘুমোয়। ঘুম শব্দটির অর্থ বদলে গেছে, অভিধানে একদিন নতুন অর্থটি মিলবে; প্রতিমুহুর্তে প্রতিটি রক্তকণিকার জেগে থাকার নাম হচ্ছে ঘুম। ঘুমের পর তারা গড়াচ্ছে, শ্যামলীর একটি হাত প’ড়ে আছে হাসানের বুকের ওপর, হাসানের একটি পা পড়ে আছে শ্যামলীর দু-পায়ের ভেতরে।
শ্যামলী বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমার শরীর তোমার শরীরকে ভালোবাসে, আমার হৃদয় তোমার হৃদয়কে ভালোবাসে।
হাসান বলে, শরীর আর প্রেম আর হৃদয় আমাকে ক্লান্ত করছে।
শ্যামলী বলে, কেনো ক্লান্ত হবে? আমি কি সুখকর নাই?
হাসান বলে, আমি সম্ভবত শরীর থেকে মুক্তি চাই প্রেম থেকে মুক্তি চাই।
শ্যামলী বলে, কিন্তু একটু আগে আমরা যে সুখে ছিলাম, তাতে তো মনে হয় না তুমি শরীর থেকে মুক্তি চাও প্রেম থেকে মুক্তি চাও।
হাসান বলে, শ্যামলী, আমি সৎ হতে চাই।
শ্যামলী বলে, তুমি তো সৎ আছেই, তোমার থেকে সৎ কে আছে?
হাসান বলে, আমার মনে হচ্ছে আমি সৎ নই।
শ্যামলী বলে, আমি জানি তুমি সৎ।
হাসান বলে, আমাদের সম্পর্ক সৎ নয়; আমরা পরস্পরের প্রতি সৎ নই।
শ্যামলী বলে, আমাদের সম্পর্ক সৎ পরস্পরের প্রতি আমরা সৎ।
হাসান বলে, না, না, আমরা সৎ নাই; পরস্পরের প্রতি আমরা সৎ নই।
হাসান একটি সিগারেট ধরায়, সিগারেটের ধুয়ো আটকে যেতে চায় তার গলায়, সিগারেট কি ছেড়ে দিতে হবে?–সে সিগারেটটি ছাইদানিতে চেপে রেখে টেলিফোন করতে শুরু করে, সিগারেট নেভে না।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, তুমি কাকে ফোন করছো?
হাসান বলে, মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন খান সাহেবকে।
শ্যামলী চমকে লাফিয়ে উঠে হাসানের হাত ধ’রে ফেলে, এবং বলে, না, না, তুমি এখন ফরহাদ সাহেবকে ফোন করতে পারো না, তুমি তাকে ফোন করতে পারো না, তুমি তাকে ফোন করো না।
হাসান বলে, আমি সৎ হ’তে চাই।
শ্যামলী হাসানের হাত থেকে রিসিভার টেনে নিতে চায়, পারে না, আবার চেষ্টা করে, পারে না; সে চিৎকার করে, তুমি তাকে ফোন কোরো না; একটা বড়ো বিপর্যয় ঘটে যাবে, তুমি তাকে ফোন কোরো না।
হাসান বলে, বিপর্যয়ের মধ্যেই তো আমরা আছি।
শ্যামলী বলে, না, তুমি ফোন করলে বিপর্যয় শুরু হবে, আমি ধ্বংস হয়ে যাবো, আমি শেষ হয়ে যাবো।
হাসান বলে, তুমি এতো ভয় পাচ্ছে কেনো? ভয়ের কিছু নেই, তার সাথে কথা ব’লে আমি সৎ হ’তে চাই; আমাদের সম্পর্ককে সৎ করতে চাই।
শ্যামলী বলে, তুমি জানো না, এতে আমার বিয়ে ভেঙে যাবে, আমার বিপদের শেষ থাকবে না।
হাসান বলে, অসৎ বিয়ের থেকে সৎ ভেঙে যাওয়া অনেক ভালো, শ্যামলী; এসো আমরা সৎ হই পরস্পরের প্রতি।
শ্যামলী বলে, আমি বিয়ে ভাঙতে চাই না, অসৎ হ’লেও আমি বিয়ে টিকিয়ে রাখতে চাই।
হাসান বলে, আমি অসততায় থাকতে চাই না, আমি ম’রে যাচ্ছি।
শ্যামলী কেঁদে ওঠে, চুলে মুখ ঢেকে নগ্ন সে মেঝেতে বসে পড়ে।
ওই দিকে কে যেনো টেলিফোন ধরেছে–কর্কশ কণ্ঠে হ্যাঁলো, হ্যাঁলো বলছে।
হাসান বলে, আমি হাসান রশিদ বলছি, আমি একটু মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন খানের সাথে কথা বলতে চাই।
শ্যামলী নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।
লোকটি বলে, বাস্টার্ড, তুই আমারে ফোন করছিছ ক্যান?
হাসান বলে, আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিলো।
ফরহাদ খান বলেন, তুই হারামজাদা আমার লাইফটারে হেল কইর্যা দিচ্ছ, বাস্টার্ড, আই সাফার্ড এ লট ফর ইউ।
হাঁটুর ওপর মাথা রেখে নগ্ন শ্যামলী নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।
হাসান বলে, আমি সৎ হ’তে চাই, তাই আপনাকে ফোন করেছি।
ফরহাদ খান বলেন, ইউ বাস্টার্ড, তুই চাছ সৎ হইতে, ইউ আর এ ডিজঅনেস্ট বাস্টার্ড, আই শ্যাল কিল ইউ।
হাসান বলে, আপনি জানেন আপনার স্ত্রী শ্যামলী আপনাকে ভালোবাসে না?
ফরহাদ হাসান বলেন, বাস্টার্ড, সেইটা তর লগে আমি আলাপ করুম ক্যান?
হাসান বলে, আপনি জানেন শ্যামলী আমাকে ভালোবাসে?
ফরহাদ খান বলেন, ইউ বাস্টার্ড, আই শ্যাল টিচ ইউ এ গুড লেসন।
শ্যামলী স্তব্ধ হয়ে বসে আছে; সে কিছু দেখছে না। সে কিছু শুনছে না।
হাসান বলে, দশ বছর আগেই আমার উচিত ছিলো আপনার সাথে কথা বলা, কিন্তু তখন আমি সৎ ছিলাম না, এখন আমি সৎ হ’তে চাই।
ফরহাদ খান বলেন, তর সৎ হওয়া আমি তর পাছা দিয়ে ঢুকাই দিমু।
হাসান বলে, শ্যামলী আমার সাথেই থাকবে।
ফরহাদ খান বলেন, শ্যামলী আমার ওয়াইফ, সে তার লগে থাকবো ক্যানরে হারামজাদা?
ফরহাদ খান ফোন রেখে দেন; কিন্তু হাসান বলতে থাকে, আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি সৎ হতে চাই, আমি সৎ হতে চাই; তাই আপনাকে ফোন করেছি, আপনাকে কষ্ট দিতে চাই নি।
শ্যামলী উঠে দাঁড়ায়, নিঃশব্দে কাপড় পরে।
হাসান বলে, এখন আমরা সৎ, আমাদের সম্পর্ক সৎ।
শ্যামলী বলে, তুমি একটা শয়তান।
হাসান বলে, আমি শয়তান ছিলাম, শ্যামলী, এখন আমি সৎ, দেবতাদের থেকেও সৎ। তুমি একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে।
শ্যামলী বলে, তুমি আমার সংসারটা নষ্ট ক’রে দিলে।
হাসান বলে, তুমি এখানে থাকো, আমরা সৎভাবে ভালোবাসবো।
শ্যামলী বলে, তোমার সাথে আমি থাকতে পারি না, তোমার ভালোবাসা আমার লাগবে না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো?
শ্যামলী বলে, আমার সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে।
হাসান বলে, আমরা আজ অসততা থেকে মুক্ত হলাম। আমার ভালো লাগছে আমি আর অসৎ নাই, আমি সৎ হ’তে পেরেছি।
শ্যামলী একদলা থুতু ছুড়ে দেয় হাসানের দিকে; হাসান বিস্মিত হয়।
শ্যামলী বলে, তোমার এই প্রাপ্য।
হাসান বলে, সততার জন্যে আমি যে-কোনো দণ্ড মেনে নিতে পারি, শ্যামলী; সততার জন্যে শাস্তি অবধারিত।
শ্যামলী একটি চায়ের কাপ তুলে ছুঁড়ে মারে হাসানের দিকে, লাগে না; কাপটি দেয়ালে লেগে চুরমার হয়ে যায়। শ্যামলী টেলিফোন সেটটি তুলে ছুঁড়ে মারে, শেল্ফ থেকে কয়েকটি কবিতার বই নিয়ে টেনে টেনে ছেঁড়ে, ঠেলে টেলিভিশনটি ফেলে দেয়, এবং ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে ব’সে পড়ে।
হাসান বলে, এই ফরাশি কাপ আর টেলিভিশন ভাঙা কিছু নয়, আমরা এসবের থেকে আরো বড়ো কিছু ভাঙছি।
শ্যামলী উঠে হাসানের দিকে না তাকিয়ে ধীরেধীরে বের হয়ে যায়।
হাসান কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে; তার নিজেকে শূন্য লাগে না পূর্ণ লাগে না, সুখী লাগে না, অসুখী লাগে না, জীবিত মনে হয় না মৃত মনে হয় না।
আমি কি সত্যিই সৎ হলাম? না কি আরো অসৎ হয়ে উঠলাম। আমি?
মানুষের পক্ষে কি সৎ হওয়া সম্ভব? সততা কাকে বলে?
মোহাম্মদ ফরহাদ খানকে আমাদের সম্পর্ক জানিয়ে দেয়া কি সততা?
তিনি কি জানতেন না। আমাদের সম্পর্ক? তিনি জানতেন, কিন্তু কোনোদিন আমাকে জানতে দেন নি। তিনি জানতেন। তিনি তাঁর ধরনে সৎ ছিলেন।
তার সততা আর আমার সততা বিপরীত; আজ আমাদের বিপরীত সততার মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে গেলো, ভেঙে পড়লো সব কিছু।
প্ৰত্যেককে তার নিজের ধরনের সততা নিয়ে বাঁচা উচিত? একজনের সততা চাপিয়ে দেয়া উচিত নয় আরেকজনের সততার ওপর?
আমি অপরাধ করেছি? শ্যামলীর কাছে? ফরহাদ হোসেনের কাছে?
আমি কি অপরাধ করেছি আমার কাছে?
আমি কি সৎ হয়েছি? আমি কি সুখী হয়েছি? আমি কি শান্তি পাচ্ছি?
হাসান, এর পরও কি তুমি কবিতা লিখতে পারবে? কবিতা আমাকে লিখতে হবে। সব ধ্বংস হয়ে গেলেও কবিতা লিখতে হবে; কবিতা লেখার জন্যে আমি দণ্ডিত।
সততার দণ্ডও তোমাকে পেতে হবে, হাসান।
গভীর রাতে হাসানের টেলিফোন বেজে ওঠে, হাসান ধ’রেই শোনে, এই শালা বাস্টার্ড, খানকির পো, তরে সাবধান কইর্যা দিতেছি, আমার ওয়াইফের লগে তুই মিশবি না; তার মার লগে গিয়া শো।
হাসান কিছু বলার আগেই ওপাশে একটি প্রচণ্ড চিৎকার ওঠে, মনে হয় লাথি মেরে ফরহাদ হোসেন শ্যামলীকে মেঝেতে বা খাটের কোনায় ফেলে দিয়েছেন।
হাসান বলে, আপনি শ্যামলীকে মারবেন না।
ফরহাদ খান বলেন, ওই খানকিরে আমি মারুম তর কি? পাইলে তরও হাড্ডি গুরা কইর্যা ফেলুম।
হাসান বলে, শ্যামলীকে দিন, আমি তার সাথে কথা বলবো।
ফরহাদ খান বলেন, তুই আর শ্যামলীর লগে মিশবি না। দুইটারেই খুন কইর্যা ফেলুম।
হাসান বলে, শ্যামলী চাইলে তাকে আমি নিয়ে আসবো, খুনকে ভয় করবো না।
ফরহাদ খান বলেন, ওই খানকি আর তর লগে মিশবো না।
হাসান ওই পাশে শ্যামলীর চিৎকার শুনতে পায়। ফরহাদ খান টেলিফোন রেখে দেন; হাসান বারবার ফোন করে, ফোন বাজে না।