কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০৩
পর দিনই সে কলেজকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে, গাড়ল প্রিন্সিপালটি আর তার সুস্থ স্বাস্থ্যবান সহকর্মীরা খুবই অবাক হয়।
ঢাকা, কবিতার জন্যে নষ্ট হওয়ার এই একটিই শহর রয়েছে, একটিই স্বৰ্গ একটিই নরক রয়েছে, এই একটিই অশেষ অন্ধকার একটিই অনন্ত জ্যোতি রয়েছে, একটিই সুস্থতা একটিই অসুস্থতা রয়েছে।
হাসান অনেক দিন পর এই অন্ধকারে এই জ্যোতিতে এসে ওঠে।
প্রথম একটি শস্তা হোটেলে ওঠে, এবং শিউরে ওঠে হাসান যে ট্রেন থেকে নামতেই একটি পংক্তি একটি দ্রুত ট্রেনের মতো গমগম ক’রে তার ভেতরে ঢুকে যায়, পংক্তিটিকে মাথায় আর বুকে আর রক্তে নিয়ে সে তিন চার দিন ধরে শহরের পথে পথে ঘোরে, বন্ধুদের অফিসে বিব্রতভাবে প্রবেশ করে, আড্ডা দেয়, দু-একটি পত্রিকার অফিসে যায়, এবং এক রাতে পংক্তিটি একটি সম্পূর্ণ কবিতা হয়ে কাগজে আত্মপ্রকাশ করে। তার মনে হয় এই প্রথম সে শব্দ আর বাক্য লিখলো, এই প্রথম সে শব্দকে বাক্যকে এমন রূপ দিলো, যাকে কবিতা বলা যায়।
ধন্যবাদ, ঢাকা, ধন্যবাদ তোমাকে; তুমি বদমাশের, তুমি কবির।
অনেক বছর পর একটি কবিতা লিখে সে শারীরিক পুলক বোধ করে। তার মনে হয় অনেক বছর পর সে একটি পরিতৃপ্ত সঙ্গমের স্বাদ পেলো, দীর্ঘ সর্বাঙ্গ বহুতল বহুপ্রকোষ্ঠময়।
কবিতা কি আমার শরীরের সাথেও জড়িত? জড়িত অণ্ডকোষের সাথেও? হাসান নিজের ভেতরে তাকায়। কবিতাটি আমাকে কেনো ক্ষরণের সুখ দিলো, যেমন ক্ষরণের সুখ আমি অনেক দিন পাই নি? কবিতা কি আমার মগজ থেকে দূরে? কবিতা কি আমার অণ্ডকোষ আর শিশ্নের সন্তান?
কবিতা তুমি এভাবেই এসো, আমাকে কাঁপিয়ে এসো, শিউরে দিয়ে এসো, ভেঙে এসো, আমাকে পুলকিত নিস্তেজ মৃত্যুর স্বাদ দিয়ে রচিত হয়াে। আমার চােখ রক্ত মাংসের ভেতর দিয়ে এসো, আমার শরীরকে শুষে তুমি নির্গত হয়ো। কবিতা, মৃত্যু হয়ে এসো, আমার, জীবন হয়ে এসো।
আরেকটি পংক্তি তার মাথায় ঢোকে একটি ট্রাক তার রিকশার পেছনে শহর কাঁপিয়ে ব্ৰেক কষতেই, ব্রেকের শব্দে চাকার নিচে পড়া অজস্র রিকশার চিৎকারের মতো এইবার কবিতাটি বেজে ওঠে তার ভেতরে।
সে পেছনে ট্রাকটির দিকে তাকিয়ে বলে, ধন্যবাদ, ট্রাক, তুমি আমাকে একটি পংক্তি দিয়েছাে; তুমি মৃত্যুর থেকেও সুন্দর, জীবনের থেকেও অপরূপ।
ট্রাকটি যেনো বলে, ধন্যবাদের কথা বলো না, কবিতা লেখো।
সে-রাতেই কবিতাটিকে সে কাগজে জন্ম দেয়।
কিন্তু এই শহর অন্যের হয়ে গেছে, এককালে এই রূপসী তারও দখলে ছিলো; তারও স্যান্ডলের শব্দে এই পংকিল তিলোত্তমা বুঝতো সে হাঁটছে; এখন অন্যদের দখলে, অভিচারিণী তাকে চিনতে পারছে না, তার স্যান্ডলের শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু শহর, মায়াবিনী, সুন্দরী রূপসী, অপূর্ব পংকিলা, আমার স্যান্ডলের শব্দ তোমাকে শুনতেই হবে, যেমন শুনতে একদিন, তুমি শুনবে, শুনতেই হবে, পৃথক দুরূহ গভীর অন্তরঙ্গ নির্মম স্যান্ডলের শব্দ- হাসান শহরের কানে কানে নিঃশব্দে বলে। একদা বন্ধু কবিদের আড্ডায় গিয়ে দেখছে একটি ক’রে কবিতার বই বেরিয়েছে অনেকের, আর তাদের মাথা আকাশে ঠেকে গেছে; তারা কবি, সে কেউ নয়; তাদের পায়ের নিচে পড়ে আছে বাঙলা কবিতা, দয়া ক’রে তারা তাদের ছেঁড়া জুতো দিয়ে কবিতা মাড়াচ্ছে, ধন্য হচ্ছে কবিতা।
আড্ডায় গেলেই হাসানের মনে হয় সে একদল দণ্ডিত ছিন্নভিন্ন মানুষ দেখছে, যারা বুঝতে পারছে না যে তারা দণ্ডিত ছিন্নভিন্ন। কাদের আবদুল, বিভূতিভূষণ মণ্ডল, সালেহ ফরিদউদ্দিন, আহমেদ মোস্তফা হায়দার খুবই দাপটের সাথে আছে; তারাই কবিতার যুবরাজ; একেকটি লিটল ম্যাগাজিন দুই হাতে আঁকড়ে তারা ভাগ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দলে, নিজেদের লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা ছাপছে— ছাপছে দৈনিকের সাময়িকীতেও, বন্ধুদের দিয়ে নিজেদের কবিতা সম্পর্কে তিরিশ পাতার প্রবন্ধ লেখাচ্ছে, প্রশংসা লেখাচ্ছে শহরের জীবাশ্ম বুড়োদের দিয়ে, কেউ কেউ লিখছে না, সম্পাদনা করছে লিটল ম্যাগাজিন, পালন করছে গুরুর ভূমিকা, হয়ে উঠছে কবিতার পৃষ্ঠপােষক সন্ত। কবিতার শহর এখন তিন চারটি যুবরাজের, আর দুটি একটি কবিতার সন্তের।
এক সন্ধ্যায় গুলিস্থানের উত্তরের এক রেস্তোরাঁয় খুব জমজমাট ঘোলাটে তীব্ৰ আড্ডা জমে। আড্ডায় মহারবীর সন্ত রহমত আলি মাহমুদ আছে, আর আছে কবিতার যুবরাজগণ–কাদের আবদুল, সালেহ ফরিদউদ্দিন, বিভূতিভূষণ মণ্ডল, আহমেদ মোস্তফা হায়দার, এবং আরো কয়েকটি তরুণ কবি, যারা হয়তো বই পুড়িয়ে ফেলা ছাত্র, যাদের হাসান চেনে না, কিন্তু তাদের চোখে মুখে ভাঙা চোয়ালে চুলে গালে পাঞ্জাবিতে ঝুলছে কবিত্বের পরাকাষ্ঠা।
আড্ডায় যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে কবি নয়, সে এক মাংসল ভনিতা; সে কবিতার সন্ত রহমত আলি মাহমুদ। এই বিপুল হা হা সন্তকে হাসান আগেও দেখেছে, জন্মসূত্রেই মহাপুরুষের মতো ভাব, কিন্তু হাসানের মনে হয়েছে সে আপাদমস্তক শূন্য, শুধু ঠোঁট শুধু গলা, শুধু প্রচ্ছদপট, শুধু হা হা হাস্য, তাই তার কাছে কখনো যায় নি। সে কোনো লিটল ম্যাগাজিনের নিজস্ব কবি হ’তে পারে নি। এবার দেখছে সন্ত আরো প্রতিষ্ঠিত, কবিতার মহাগুরু, সেই ঠিক ক’রে দিচ্ছে সে কবি আর কে কবি নয়, কে কবি হবে। আর কে হবে না।
কবিতার অভিভাবকেরা চিরকালই আস্ত অকবি, হাসান মনে মনে বলে, রহমত আলি মাহমুদ তুমি কখনো কিছু হবে না, তুমি একটা শূন্য।
সন্ত রহমত আলি মাহমুদ বলে, বাঙলা কবিতা এখন তাকিয়ে আছে আমাদের লিটল ম্যাগাজিন ‘চর্যাপদ’-এর দিকে,–আমাদের লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া বাঙলা কবিতার আর কোনো পথ নেই। আমাদের ম্যাগাজিনের অ্যাভেনিউ দিয়েই বাঙলা কবিতাকে ইটারনিটির দিকে যেতে হবে।
হা হা ক’রে হাসে সন্ত রহমত আলি মাহমুদ।
টেবিলের চারদিকে গাঁজাভরা সিগারেটের ধুঁয়ো, ঘোলাটে চায়ের কাপের খুব দ্রুত জ’মে উঠছে ম্রিয়মাণ ছাঁই, আর অনন্ত অপচয়।
কাদের আবদুল বলে, মাহমুদ ভাই, আপনি আছেন ব’লেই আমরা কবি, আপনি সৃষ্টি করছেন কবি, যা কবিতা লেখার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাঙলা কবিতার ইতিহাসে কেউ আর এভাবে কবি তৈরি করে নি।
হাসান ব’লে ওঠে, বুদ্ধদেব বসু?
কাদের আব্দুল বলে, বুদ্ধদেব বসুকে ভুলে যান, সে ছিলো ডাকযোগে কবি করার সম্পাদক, মাহমুদ ভাই তার থেকে অনেক বড়ো, মাহমুদ ভাই আমাদের কবিতার প্রফেট।
সন্ত রহমান আলি মাহমুদ হো হো ক’রে হাসে আর বলে, হাসান সাহেব মফস্বল থেকে এসেছে, সব বুঝতে তার সময় লাগবে, মফস্বলে থাকলে মানুষ চাষা হয়।
কাদের আবদুল বলে, বলুন আপনি মাহমুদ ভাই, আপনার কথা ধ্রুবতারার শিখার মতো এসে পড়ুক আমাদের এই আবর্জনার ওপর।
সন্ত রহমান আলি মাহমুদ বলে, লিটল ম্যাগাজিনের সাক্সেস নির্ভর করে দুটি ব্যাপারের ওপর; ম্যাগাজিনটি কটি কবি ক্রিয়েট করলো আর কটি তরুন কবিকে আত্মহত্যায় ইন্সপায়ার করলো, তার ওপর। আত্মহত্যার ওপরই বেশি নির্ভর করে লিটল ম্যাগাজিনের সাফল্য; আত্মহত্যা মানে সুইসাইড।
হা হা ক’রে হাসে সন্ত রহমান আলি মাহমুদ।
সন্ত রহমান আলি মাহমুদ বলে, যদি আমার ‘চর্যাপদ’ একটি কবি সৃষ্টি করতে পারে, বেশি নয় দশটি নয় বারোটি নয়, মাত্র একটি কবি, আর অন্তত একটি তরুণ কবিকে পবিত্র উজ্জ্বল অবিনশ্বর বিশুদ্ধ আত্মহত্যায় ইন্সপায়ার করতে পারে তাহলেই মনে করবো আমার ম্যাগাজিন সাক্সেসফুল। বাঙলা কবিতার ইতিহাস থেকে এর নাম কেউ বাদ দিতে পারবে না; হা হা হা হা।
সন্ত রহমান আলি মাহমুদ চারদিকে তাকায়; হাসান দেখে কয়েকটি তরুণ নির্বই নির্গ্রন্থ ছাত্র কবি খুবই অনুপ্রাণিত উদ্বেলিত হচ্ছে তার কথায়; চোখ বুজে টেনে চলছে গাঁজাভরা সিগারেটপরম্পরা, আর বলছে, কবিতা, কবিতা, আত্মহত্যা, আত্মহত্যা, অমরতা, অমরতা।
সন্ত রহমত আলি মাহমুদ বলে আমাদের বুঝতে হবে, বিংশ শতাব্দীর টুয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরির এই অভিনব কবিতার দশকে যে কবিতা লিখবে, তাকে বুঝতে হবে কবিতা। আজ আর ডিভাইন গডেজ না, কয়েক হাজার বছরের কন্টিনিউয়াস চোষাচুষিতে টানাটানিতে দেবীদের স্তন ঝুলে গেছে পচা কাঁঠালের মতো, নাভির কাছে নেমে এসেছে, বোঁটা খ’সে গেছে, থকথক করছে, ঠোঁট ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, তাতে ভনভন ক’রে মাছি বসছে, তলপেট ঢিলে গোস্তে ভ’রে গেছে, আরো নিম্নে প্ৰবাহিত হচ্ছে শুধু পৌর আবর্জনা, দেবী সিফিলিসে গনোরিয়ায় ভুগছে, কবিতা আজ বাদামতলি টানবাজারের গ্রাম থেকে আসা পনেরো বছরের টাটকা বেশ্যা, ওইটা যাকে ঘরে বসায় সে-ই কবি হয়, তরুণ কবির কাজ হচ্ছে টাটকা ভার্জিন বেশ্যাকে বলাৎকার করা।
কাদের আবদুল খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বলে, দেবীর থেকে বেশ্যাই পরমােত্তম, তার স্তব করতে হয় না, তার দেহ আছে, স্তন আছে, ত্রিভুজ আছে, লোমে সুগন্ধ আছে, থুতুতে মাদকতা আছে, ট্রাউজার খুলে সায়া তুলে তাকে বলাৎকার করলেই চলে। আমি তাকে বলাৎকার করি, তাই আমি কবি।
একটি প্রচণ্ড উত্তেজনার ঝড় বয়ে যায় টেবিলের ওপর দিয়ে।
কাদের আবদুল তখন খুব বাহবা পাচ্ছে, এক বুড়ো তার সম্পর্কে দশ পাতার একটা প্ৰবন্ধ লিখেছেন, সেই প্ৰবন্ধটি বগলে বইয়ে বেড়াচ্ছে কাদের আবদুল; বলছে, আমি কবিতার যুবরাজ।
কাদের আবদুল এখন আধুনিকতার পরাকাষ্ঠা, সে কুকুরীর বুকে তিন চারটি স্তন দেখে বেড়াচ্ছে; কিন্তু হাসান দেখেছে তার ভেতর লুকিয়ে আছে ইসলাম; বুড়ো হ’লে এটা হাম্দ্ নাত লিখবে।
বেশ কবির মতো চেহারা, চুল, আর পোশাকও হয়েছে কাদের আবদুলের। হাসানের থেকে সে কয়েক বছরের বড়ো।
চারদিকে গাঁজাভরা সিগারেটের উৎকট কাব্যিক ধুঁয়ো, ময়লা চায়ের কাপে সিগারেটের বিষণ্ণ ক্ৰিয়মাণ ছাই।
বিভূতিভূষণ মণ্ডল এতোক্ষণ গাঁজা ভরা সিগারেট টানছিলো চােখ বন্ধ ক’রে বিলি কাটছিলো নিজের লম্বা জটিল চুলে, জটা ছাড়াচ্ছিলো টেনে টেনে, একগুচ্ছ চুলত সান এতোটা আটকে গেছে যে সহজে ছাড়াতে পারছিলো না, কিন্তু সাধনা ক’রে চলছিলো, আর মাথা নািড়ছিলো ডানে বাঁয়ে, মাঝে মাঝে থুতু ফেলছিলো।
বিভূতিভূষণ মণ্ডল এবার চিৎকার ক’রে ওঠে, মাহমুদ ভাই, কাদের ভাই, আপনেরা খুব বেশ্যা, বেশ্যা করতেছেন, বেশ্যার চিনেন কি আপনেরা, কয়টা বেশ্যার লগে শুইছেন, আমি দেড় বছর ধরে বেশ্যাবাড়িতে আছি, আমি বেশ্যারটা খাই,বেশ্যার বিছানায় শুই, আমি জানি ওইগুলিতে কোনো কবিতা নাই।
বিভূতিভূষণ মণ্ডল আবার সিগারেট পাকাতে থাকে, সবাই ভয় পেয়ে তার দিকে, বিনীতভাবে তাকায়। সে ভীতিকর, আধুনিকতাকে সে ছিঁড়ে ফেড়ে ফেলতে পারে।
বিভূতিভূষণ মণ্ডল বলে, কবিতা বেশ্যা না, বেশ্যা কবিতা না, কবিতা হইছে সমাজতন্ত্র। আধুনিকতার মুখে আমি মুতি, কবিতা হইল সমাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ছাড়া কবিতা নাই। মার্ক্স লেনিন স্ট্যালিন হইছেন পৃথিবীর শ্ৰেষ্ঠ কবি, চিরকালের শ্ৰেষ্ঠ মহাকাব্যের নাম হচ্ছে সোভিয়েট ইউনিয়ন।
বিভূতিভূষণ মণ্ডল সিগারেটে টান দিয়ে টেবিলের নিচে একদলা থুতু ফেলে। অনেকক্ষণ থুতুর দলার সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সন্ত রহমত আলি মাহমুদ একটু বিব্রত হয়, নিজের কাব্যতত্ত্বকে বিস্তৃত করার তার সাহস হয় না। বিভূতিভূষণের দুটি কাব্য বেরিয়েছে, এবং সে খুবই জনপ্রিয়, ছেলেপেলেরা তার বই কিনছে, আবৃত্তি করছে; তরুণ কবিদের মধ্যে সে একনম্বরে আছে, আর সমাজতন্ত্রের ওপর কোনো কথা নেই, কোনো কাব্যতত্ত্ব নেই।
সালেহ ফরিদউদ্দিন পরিবেশটািকে একটু রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে। সালেহ ফরিদউদ্দিন বলে, মাহমুদ ভাই, চর্যাপদ-এর আগামী সংখ্যায় আমাগো কবিতা সম্পর্কে একটা বড়ো লেখা থাকা দরকার, আমাদের প্রতিভার ক্যারেক্টারটা তাতে ধরিয়ে দেয়া দরকার, যাতে লোকজন বুঝতে পারে আমরা কি লিখতেছি, কেনো লিখতেছি, আমাদের কবিতা কিভাবে নতুন, কিভাবে অসাধারণ, কিভাবে মর্ডান (সালেহ ফরিদউদ্দিন’মডার্ন’কে ‘মর্ডান’ই বলে)।
সন্ত রহমত আলি মাহমুদ বলে, আমি তো একটা বড়ো আর্টিকেল ছাপতে চাই আপনাদের প্রতিভা সম্বন্ধে, কিন্তু লেখাটা লিখবে কে?
সালেহ ফরিদউদ্দিন বলে, হাসান রশিদ লেখাটা লেখতে পারে বইল্যা আমার মনে হয়, গদ্য লেখায় হাসানের হাত আছে; ও আগেও আমাগো লইয়া লেখছিলো।
নিজের নাম শুনে চমকে ওঠে হাসান, এবং খুবই বিব্রত বোধ করে।
সালেহ ফরিদউদ্দিন হাসানকে বলে, দোস, তুমি ত কবিতা লেখা ছাইরাই দিছো, চাইর বছর আগে তুমিই আমাগো লইয়া একটা প্ৰবন্ধ লিখছিলা, আমাগো কবি বলছিলা, তারপর থিকাই তা আমরা কবি, আবার আমাগো লইয়া একটা প্রবন্ধ লেখো, তুমি ক্রিটিক হইয়া যাও। আমাগো একজন ক্রিটিক দরকার।
হাসান বলে, না, না, সমালোচক হওয়ার আমার ইচ্ছে নেই, তোমাদের কবিতা নিয়ে আমি এখন লিখে উঠতে পারবো ব’লে মনে হচ্ছে না।
বিভূতিভূষণ মণ্ডল সিগারেটে টান দিতে দিতে জট ছাড়াতে ছাড়াতে একদলা থুতু ফেলতে ফেলতে চোখ বন্ধ ক’রে বলে, ল্যাখো ল্যাখো দোস্ত, আমাগো লইয়া ল্যাখো, আমাগো মইধ্যে তুমিই একটু-আধটু লেখাপড়া জানো, আমরা কোন গুমুত লিখতাছি তুমিই তা ভাল বোঝতে পারছো, তোমার চাইর বছর আগের প্রবন্ধটায়ই তা আমার নাম প্রথম ক্রিটিসিজম লিটারেচারে স্থান পায়, আমি সেই কথা ভুলি নাই। আর্টিকেলের ভিতরে নিজের নাম দেখতে আমার সুখ লাগে। আমাগো লইয়া ল্যাখো, আমি তোমার নামে একটা বই ডেডিকেট কইর্যা দিমু, একটা খানকিরে কথা দিছিলাম, তার বদলে তোমার নামেই ডেডিকেট করুম।
হাসান বলে, আমি ঠিক এখন লিখে উঠতে পারবো না, বিভূতি, গদ্য লেখার জন্যে আমি ঠিক প্রস্তুত নই।
কাদের আবদুল বলে, কেনো পারবেন না হাসান সাহেব? আপনি লিখুন, আমাদের কবিতা সম্পর্কে লিখে আপনিও ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন; কবিদের সঙ্গে থেকে অনেক ক্রিটিকও ইম্মরটাল হয়েছে।
হাসান এবার একটু উত্তেজিত হয়, এবং বলে, বন্ধুদের কবিতা সম্পর্কে কোনো কবির সমালোচনা লেখা ঠিক নয়, এটা আত্মহত্যা।
আহমেদ মোস্তফা হায়দার জিজ্ঞেস করে, কেনো ঠিক নয়?
হাসান বলে, বন্ধুদের কবিতা সম্পর্কে লিখলে নিজের ক্ষতি হয়।
আহমেদ মোস্তফা হায়দার বলে, কেনো ক্ষতি হয়?
হাসান বলে, দেখেন নি কেমন ক্ষতি হয়েছে, বুদ্ধদেব বসুর? তিনি বন্ধুদের নিয়ে লিখেছেন, আর বন্ধুরা মনে করেছেন তাঁরাই কবি, বুদ্ধদেব বসু কবি নন। নির্বোধ নির্বোধ বােকাসোজা জীবনানন্দও প্রবন্ধে কবিতা উদ্ধৃত ক’রে কবির নাম দেন নি, বলেছেন ‘এক আধুনিক কবি লিখেছেন’, ‘এক কবির কবিতায় পাই’ ধরনের কথা, বন্ধু কবির নামটি তিনি উল্লেখ করেন নি। বোকা বোকা লাগলেও জীবনানন্দ চালাক ছিলেন। বুদ্ধদেবের থেকে। কবি হয়ে কবিবন্ধুদের কবিতা আলোচনা করতে নেই, তাতে বন্ধুরা মনে করে তারাই কবি, আর মুর্খ পাঠকেরা ভুলে যায় যে আলোচকও কবি, গুরুত্বপূর্ণ কবি।
কাদের আবদুল বলে, আপনাকে খুব কৃপণ মনে হচ্ছে।
হাসান বলে, আপনারাও কিন্তু অন্যের কবিতা সম্পর্কে লেখেন না, দু-চার পংক্তি গদ্য লিখলে বন্ধুদের নাম নেন না, সেখানে হেল্ডার্লিন হাইনে র্যাঁবোর নাম নেন। আমিও এখন আপনাদের সম্পর্কে লিখতে পারবো না। আমি এখন কবি হ’তে চাই, সমালোচক নয়, কবি, শুধুই কবি।
আড্ডা ভাঙলে বিভূতিভূষণ মণ্ডল হাসানকে বলে, দোস্ত, যাইবা নি আমার লগে, বাদামতলির পাড়ায়, আমি ত সেইখানেই আছি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, পাড়ায় কী ক’রে তুমি থাকো?
বিভূতিভূষণ মণ্ডল বলে, কবির লিগা পাড়া আর নিজের বাড়ির তফাৎ কি? কবির আবার ঘরবাড়ি কি? কবি যেখানে থাকে, সেইটাই তার বাড়ি। আমার লগে লও, দেখবা মাইয়া তিনটা ভাল, আমারে বাপ ডাকে গুরু ডাকে, আবার বিছনায়ও শোয়, ট্যাকাপয়সা অরাই দ্যায়।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি এটা পারো কীভাবে, বিভূতি?
বিভূতি বলে, কবিগো সব পারতে হয়, হাসান, কবি হইলে সব পারতে হয়। কবি হইলে এমন মানুষ যার ফাঁসি হইয়া গেছে। বছরখানেক আমি গুলশানে একটা বিলাতফেরত মাইয়ালোকের লগে আছিলাম, তার গাড়িবাড়ি সব আছিল, সমাজতন্ত্র তার প্রিয় জিনিশ, কিন্তু তার লগে থাকতে আর ভাল লাগল না, এখন মালতিগো লগে আছি, অগোই আমার ভাল লাগে, এডুকেটেড মাইয়ালোকের লগে শুহিয়া আমি সুখ পাই না। এডুকেটেড মাইয়ালোকেরা কবিতা বোঝে না, বেশ্যারা তাগো থিকা কবিতা অনেক ভাল বোঝে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কতো দিন ওদের তোমার ভালো লাগবে?
বিভূতি বলে, তা জানি না, ভাল না লাগলে বাইর হইয়া পরুম, হাইকোর্টের মাজার ত আছেই, ওইখানে থাকতেও আমার খারাপ লাগবো না। হিজড়াগো লগেও আমি আছিলাম ছয় মাস, খারাপ লাগে নাই।
বিভূতি গাঁজাভরা সিগারেট টানতে টানতে দক্ষিণ দিকে-হাঁটতে থাকে।
হাসান একটি রিকশা নিয়ে তার হোটেলের দিকে রওনা হয়, কিছু দূর গিয়েই তার মনে হয় বিভূতির সাথে বাদামতলির পাড়ায় গেলেই আজ রাতে, সে সুখ পেতো, হোটেলে সে অগ্নিগিরির মতো শূন্যতায় পড়বে, পুড়তে থাকরে লেলিহান আগুনে। শূন্যতার আগুনকে সে ভয় পায়, কিন্তু সে-স্থির করতে পারে না হোটেলের শূন্যতার চ্যান অগ্নিগিরিতে যাবে, না বাদামতলির পূর্ণতার দিকে রিকশাটাকে ফেরাবে, ভেতরে ঢুকে পূর্ণতার ভিতর দিয়ে বিভূতিকে খুঁজবে। সে তো বাদামতলি কখনো যায় নি, কী করে সে খুঁজে পাবে বিভূতিকে?
হাসান বলে, রিকশা, বাদাম তুলি চলো।
রিকশাআলা জিজ্ঞেস করে, পাড়ায় যাইবেন, ছার?
হাসান বলে, হ্যাঁঁ।
রিকশাআলা বলে, তার চাইতে একটা ভাল জায়গা আছে, মাইয়াটাও নতুন গেরাম থিকা আসছে, আমি লইয়া যাইতে পারি, ছার।
হাসান বলে, না বাদামতলিই চলো।
রিকশাআলা রিকশা ঘুরিয়ে বাদামতলির দিকে চালাতে থাকে; কিছুক্ষণ পর হাসান রিকশা অলাকে বলে, রিকশা, থামো।
রিকশাআলা রিকশা থামিয়ে বলে, পাড়ায় যাইবেন না ছার?
হাসান রিকশা থেকে নামতে নামতে বলে, না।
রিকশাআলা বিস্মিত হয়ে বলে, আপনে পাগল নি, ছার?
হাসান বলে, শুধু আমিই পাগল নাই, দশ হাজার বছর ধরে আমার বংশের সবাই পাগল, আমার বাপ পাগল, দাদা পাগল, তার বাপ পাগল…
রিকশাঅল বলে, কন কি, ছার, এমন পাগলের বংশে আপনে হইছেন?
হাসান বলে, হ্যাঁ, আমি, পাগলের বংশের শেষ পাগল, তবে আমার পরও আরো পাগল আসবে, পাগলু ছাড়া পৃথিবী সুন্দর
রিকশাআলা ভীষণ বিস্মিত হয়ে বলে, আপনের বংশের নাম কি, ছার?
হাসান বলে, কবি, কিন্তু তুমি তা বুঝবে না।
রিকশাআলা বলে, বুঝুম না, কন কি ছার? আপনে হইলেন কবিয়াল, আমাগো গ্রামের দবিরদ্দি ফকিরও কবিয়াল, আপনের মতনই পাগল, বউ পোলাপান ফেইল্যা খালি একতারা লইয়া দ্যাশে দ্যাশে ঘুইর্যা বেরায়।