কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০২
দু-তিনটি পদ্য ছাপা হওয়ার পর আলাউদ্দিন রেহমান, যে আর কবিতা লেখে না, যে এখন অ্যান্ড ইন্ডেন্টিং গামেন্টস, হো হে ক’রে হেসে বলেছিলো, দোস্ত তাইলে তুমি হইতে যাইতাছো কবি মোহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার। কবিতা না লেইখ্যা একটা একতারা লইয়া বাজারে গিয়া ওঠ, গলা ছাইরা উত্তর দক্ষিণ বন্দনা কর, এই নামে ভাল কবিয়াল হইতে পারবা, দোস্ত; একটা লালন ফকিরও হইয়া যাইতে পার।
আলাউদ্দিন আরো বলেছিলো, ভালোই হইব দোস্ত, বাঙলায় কবির দরকার নাই, বাঙলায় কবিয়ালই দরকার, এইটা কবিয়ালের দ্যাশ।
খুব লজ্জা পেয়েছিলো হাসান, সত্যিই তো, এই নামে কবি হওয়া যায় না। অতলে ডুবতে হবে অন্ধকারে হাঁটতে হবে যাকে আশ্চর্য সৌরভের জ্যোৎস্নায় অন্ধকারে আলোতে যে দেখবে অন্য আলো অন্ধ অন্ধকার, তার এমন নাম হ’তে পারে না। সেই শুরু হয় ভাঙাচোরা;- প্রথম সে তালুকদার বাদ দিয়ে নামটি লিখে দেখে- মোহাম্মদ আবুল হোসেন। ভালো লাগে না, তখন মোহাম্মদ বাদ দিয়ে লেখে— আবুল হোসেন। না, আবুল আর হোসেন দিয়ে চলবে না; আবুলটিকে বাদ দেয় সে, হোসেনটিকে করে হাসান, এবং হঠাৎ দারোগা মোহাম্মদ রশিদ আলি তালুকদারের নামটি তার মনে পড়ে। হাসান এবং রশিদ পাশাপাশি বসিয়ে দেখে বেশ চমৎকার দেখাচ্ছে, বেশ চমৎকার শোনাচ্ছে। হাসান রশিদ।
এক মধ্যরাতে একলা সে হয়ে ওঠে হাসান রশিদ। নিজেকে মনে হয় স্বয়ম্ভ; কেউ তাকে জন্ম দেয় নি, নিজের ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছে সে নিজে।
নিজের নামের ভেতর থেকে আরেকটি নাম সে উঠতে দেখে, যার আছে একটি নিজস্ব সত্তা; নিজের ভেতর থেকে সে দেখে আরেকজনের উত্থান। একটা বিপুল ভূমিকম্প ভাঙা ভাঙি প্লাবন সে টের পায় নিজের ভেতরে, ঠাণ্ডা একটা দীর্ঘ কষ্ট তাকে চেপে ধরে, ধীরেধীরে তার মনে হয় তার জন্মান্তর হচ্ছে, সে কবি হ’তে যাচ্ছে, হাতে যাচ্ছে দণ্ডিত মানুষ। এক সময় মোহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার নামটি সে প্রাণের সমান ভালোবাসতো, কতোভাবে সে এই নামটি লিখেছে। খাতায় আর বইয়ের পাতায়, বাঙলায় ইংরেজিতে, সংক্ষেপে স্বাক্ষর দিতে শিখেছে; কবিতা লিখতে এসে সেই নামটিকেই তার প্রথম বাদ দিতে হলো? এ কি এক নিজেকে বর্জন ক’রে আরেক নিজেকে অর্জন করা; এক নিজেকে ভেঙে আরেক নিজেকে সৃষ্টি করা; এক নিজেকে মৃত্যুর অন্ধকারে সমাহিত ক’রে আরেক নিজেকে লেজারুসের মতো তুলে আনা? কয়েক রাত ঘুমোতে পারে নি হাসান, বারবার ঘুম ভেঙে গেছে, দেখেছে একটা নাম একটা কিশোর হিজল গাছের নিচে একলা দাঁড়িয়ে আছে। আজ কেউ মোহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার বললে সে সহজে মনেও করতে পারে না এটা কার নাম, এই নামে কে ছিলো একদিন মাটিতে জলে আগুনে জ্বলজ্বল ক’রে।
তাড়াতাড়ি গোশলটা সেরে নেয় হাসান। এ-কাজটি সে দ্রুত করতে পারে।
একটা শাওয়ার আছে মাথার ওপরে, হাসান জানে না সেটি দিয়ে পানি পড়ে কি না; কোনো দিন খুলে দেখে নি, মাথায় শরীরে ঝরঝর ক’রে পানি পড়া সে সহ্য করতে পারে না। শাওয়ারের পানির কোনো আদর নেই, শরীরে ওই পানি প্লাবনের মতো নামে না জোয়ারের মতো নামে না, মগের পানিতে অনেকটা দিঘির আর জোয়ারের স্বাদ আছে। বালতি থেকে মগ দিয়ে পানি ঢেলে গোশল শেষ ক’রে বেরিয়ে এসে চুল মুছতে মুছতে হাসান দেখে কাজের মেয়েটি যায় নি, বারান্দার গ্রিলের শিক ধ’রে দাঁড়িয়ে আছে একটি মডেলের মতো।
মেয়েটির তো এর মাঝে চলে যাওয়ার কথা। নিচের তলার বিবিসাব এই ছুটা ঝিটিকে ঠিক ক’রে দিয়েছেন; হাসান বিবিসাবকে উঠতে নামতে সব সময়ই মনে মনে ধন্যবাদ জানায়, এবং সে বিব্রত বোধ করে যে বিবিসাব তাকে কবি বলে একটু সম্মানও করেন, দেখা হ’লে কথা বলতে চান তার সাথে–কবি হিশেবে এর থেকে বেশি সম্মান সে আর পাবে না ব’লেই তার মনে হয়। মেয়েটি সকালে এসে চা আর খাবারটাবার বানায়, ঘর পরিষ্কার করে, আর সন্ধ্যের পর এসে রেঁধে রেখে যায়। একটা চাবি তার কাছে আছে। হাসানের সাথে মেয়েটির দেখাই হয় না। সকালে কিছুক্ষণ ছাড়া; বাথরুম থেকে বেরিয়ে সে প্রত্যেক দিনই দেখে মেয়েটি দরোজা টেনে চ’লে গেছে, এই দিন দশেক হলো। এর আগে একটা খটখটে বুড়ী ছিলো, পাঁচতলার ছাদে উঠতে তার কষ্ট হতো, তাকে দেখেও বেশ কষ্ট হতো। হাসানের; কিন্তু এই মেয়েটাকে কিছুক্ষণ ধ’রে দেখা যায়, যদিও তাকে বেশি দেখতে পায় না হাসান। আজই একটু ভালো ক’রে দেখলো, মেয়েটি বারান্দার গ্রিলের শিক ধ’রে শ্যাম্পুর মডেলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বেশ মেয়েটি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কী হে, তুমি যে এখনো যাও নি?
মেয়েটি বলে, হাতে কাম নাই। আর যাইতেও ইচ্ছা লাগতা ছিল না, ভাইজান।
চমৎকার সে মেয়েটির ভাইজান; এতো দিন বিশেষ কোনো কথা হয় নি ব’লে সে এটা জানতে পারে নি। হাসানের ভালো লাগে।
মেয়েটি আরো বলে, ভাইজানের লগে আইজ পর্যন্ত কোন কতাবার্তা হইল না, আইজ মনে হইল ভাইজানের লগে একটু কথা কই।
হাসান বলে, ঠিক আছে বলো কী কথা।
মেয়েটি বলে, ভাইজান যে কি কন, অন্য সব বাসার খালুরা আমার লগে কতা কওনের লিগা কত ছুতা বিচরায়, খালাগো ফাঁকি দিয়া কত কতা কয়, আর আপনে কতা না কইয়া আমারে কথা কইতে কন।
হাসান বলে, কোনো কথা তো আমার নেই।
মেয়েটি খিলখিল ক’রে হেসে ওঠে, কি যে কন ভাইজান, পুরুষপোলাগো, কওনের কতার অভাব আছে নি দুনিয়ায়? ক’তা না পাইলে খালুরা আমার ঠোডের আর মোখের শোভা লইয়া কত কতা কয়।
হাসান বলে, তোমার কেমন লাগে?
মেয়েটি বলে, শোনতে আমার ভালই লাগে। খালুগো মোখে বড় রস, আমারে খালুরা রসগোল্লার মতন গিলতে থাকে।
হাসান বলে, আমি তো খালু নাই।
মেয়েটি বলে, হ, হেই কথা আমি জানি, আপনে বিয়াশাদি করেন নাই, হেই লিগাই ভাইজান কইলাম, বিয়াশাদি না হইলে তো রস আরও বেশি হওনের কতা।
হাসান বলে, তোমার কি টাকা পয়সা লাগবে?
মেয়েটি বলে, হ, ভাইজান, পঞ্চাশটা ট্যাকার খুব দরকার।
বেশ ঝলমলে মেয়েটি, হাসান তাকে একটা একশো টাকার নোট দেয়। মেয়েটি টাকাটা নিতে নিতে চোখ বড়ো ক’রে বলে, ভাইজান আপনে আমার কাছে যা চাইবেন তা’আই পাইবেন, আপনেরে আমি না করুম না।
হাসান বলে, ঠিক আছে, দরকার হ’লে চাইবো।
মেয়েটি বলে, রাইতে থাকতে কইলেও থাকুম।
মেয়েটি একটি তীব্ৰ হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায়, মেয়েটিকে বেশ চমৎকার লাগে। হাসানের; কিন্তু কোনো দিন কি কিছু তার চাইতে হবে মেয়েটির কাছে?
এই বাসায় সে উঠেছে। বছর দশেক আগে; এবং এই বাসা ও এলাকাটির সাথে সে জড়িয়ে গেছে এক অবর্ণনীয় সম্পর্কে। সে এখানে থাকে। কিন্তু তার মনে হয় সে এখানে থাকে না, আবার এখানে ছাড়া অন্য কোথাও থাকার কথাও সে ভাবতে পারে না, কখনো তার মনেই হয় না। অন্য কোথাও সে থাকবে। শহরের একপাশে এই এলাকাটি, এখানে ঢোকার অনেক আগেই এর জীবনের গানগনে তাপ বাঘের মতো শরীরের সবখানে থাবা দেয়; এটি কখনো ঘুমোয় না, দুপুরে যেমন উত্তেজিত জেগে থাকে রাত চারটায়ও জেগে থাকে তীব্রভাবে, বড়ো রাস্তাটি ও গালিগুলোতে কখনো সঙ্গমে সঙ্গমে জন্মপাওয়া মানুষের অভাব হয় না, এই এলাকায় হয়তো প্রতিরাতে শ-দুয়েক নারী গর্ভবতী হয়, দোকানগুলো কখনো বন্ধ হয় না, সব সময় কেনাবেচা চলছেই। এতো কেনার আছে, এতো বেচার আছে? রিকশা, বেবি, ট্রাক, ঠেলা, ভ্যান, অন্ধ, পঙ্গু, কুণ্ঠরোগী, আর সুস্থ মানুষ সব সময় ঠেলা ঠেলি করছে; এটা এক চিরজাগ্রত এলাকা। এর প্রচণ্ড হৃৎপিণ্ড অজস্র ট্রাকের ইঞ্জিনের মতো সব সময় গর্জন করছে। এই বাড়িটার যিনি মালিক, তিনি এটি তৈরি করতে করতে এই পাঁচতলাটির মতোই নিজেকে অসম্পূর্ণ রেখে চ’লে গেছে, তার মনে হয় এমন অসম্পূর্ণ কিছুই সে খুঁজছিলো। পাঁচতলায় একটিমাত্র বিরাট ঘর, সাথে একটা বাথরুম, সামনে বারান্দা; আর পশ্চিমে পড়ে আছে। শূন্য ছাদ, যেখানে দুটি বড়ো ঘর উঠতে পারতো, কিন্তু ওঠে নি। এই শূন্যতাটাকে হাসানের ভালো লাগে; এবং ভালো লাগে সে অনেক উঁচুতে একলা আছে, তার ঘর আর ছাদ থেকে সে যেমন আকাশ দেখতে পায়- আকাশ সে বেশি দেখে না, তেমনি দেখতে পায় দূরে স্তূপ স্তূপ আবর্জনা, পৌর আবর্জনার তেতলা পাহাড়, একদিন এই আবর্জনা আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে, সেদিন সে মন ভ’রে আকাশ দেখবে, দিকে দিকে বিবর্ণ তেতিলা চারতলা বিকলাঙ্গ বাড়ি, তার মনে হয় সে এক নিরন্তরতরঙ্গিত মলসমুদ্রের ওপর এক উচু নিঃসঙ্গ একান্ত বিজন মিনারে বাস করছে। এই পাঁচতলার ঘরটি তার টাওয়ার; কবিকে টাওয়ারেই থাকা দরকার, তাতে ডানা না থাকার অভাব পূরণ হয় অনেকখানি; কবির পায়ে মল মাটি কাদা লেগে থাকবে, কিন্তু তার চুল মেঘ আর নীলের ছোঁয়ায় মেঘ হবে নীল হবে। যদি সে একটা চুপচাপ এলাকায় এমন উচ্চ নিঃসঙ্গতায় থাকতো, যদি এই এলাকাটি হতো চার বর্গমাইলের একটি নিবিড় উদ্যান, তাহলে হয়তো কোনো এক অদ্ভুত আঁধারে সে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তো, কিন্তু এখানে তার লাফিয়ে পড়ার কথা মনে আসে না, সে জানে নিচে বয়ে চলছে প্রাণবন্ত জীবন, অশ্লীল অসুন্দর জীর্ণ পংকিল সুন্দর; ওই জীবন তাকে গলগল ক’রে বলছে, তুমি কখনো লাফিয়ে পড়বে না, মলস্তূপের মধ্যে ফুটে উঠবে তুমি, জীবন লাফিয়ে পড়ার জন্যে নয়, একদিন জীবন নিজেই প’চে গ’লে আবর্জনা হয়ে উঠবে।
দিঘির কালো জলে নয়, সে দেখতে পায় অনন্ত মলের স্থির প্লাবনের ওপর ফুটে আছে আদিগন্ত শুভ্ৰ পদ্ম; সে দেখে ডাস্টবিনে ঝলমল করছে সূর্যের থেকে বড়ো সূর্যমুখি। জীবন হচ্ছে বিপরীতের শিল্পকলা, কবিতাও তাই, সুন্দর অসুন্দরের অভাবিত অনিন্দ্য সঙ্গম।
হাসানের মনে হয়, বৃষ্টির হরিণের ধানখেতের মেঘের সৌন্দর্যের থেকে অনেক সুন্দর পথ জুড়ে যানজট, ট্রাকে ট্রাকে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাসস্টপে প’ড়ে থাকা কুণ্ঠরোগীটি চমৎকার কবিতার জন্যে, কবিতা ওকে রজনীগন্ধার পাপড়িতে পরিণত করবো, কবিতা রূপান্তরের আশ্চর্য রসায়ন।
গোলাপ রজনীগন্ধা আর এ-সময়ের ফুল নয়, আজকের ফুল আবর্জনায় গঠিত অভাবিত অপূর্ব, সুন্দর, যার কথা কেউ আগে ভাবতে পারে নি।
তার মনে হয়, কবিতা এখন সুশীল বিনীত পবিত্র পূজারী চায় না, চায় নষ্টভ্ৰষ্ট বদমাশ প্রচণ্ড দণ্ডিত প্রতিভা; সে নষ্টভ্ৰষ্ট হবে কিন্তু তার মতো সৎ। কেউ হবে না, সে বদমাশ হবে কিন্তু তার মতো মহৎ। কেউ হবে না, আর সে বইবে সকলের পাপ সকলের অপরাধ, সে হবে কবি।
হাসানের মনে হয় কবিতার জন্যে এই এলাকাটিই শ্রেষ্ঠ; এই মলস্তূপ থেকে একটি একটি ক’রে উঠে এসেছে তার অনেক কবিতা, আরো আসবে। কবিতা হচ্ছে পঙ্কজ মলজ: সেই কবিতা সে লিখবে।
পাশ করার পর সে কয়েক বছর কাটিয়ে এসেছে সম্পূর্ণ বিপরীত এক এলাকায়, যেখানে থাকলে গাধা গরু গাড়লদেরও কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে, দু-একটি গাড়ল তাকে কবিতা লিখে দেখিয়েছেও, ওরা যে কোনো কবিতার কামড় বোধ করে, কিন্তু ওই তিন বছর সে কোনো কবিতা লেখে নি, কোনো পংক্তি এসে তাকে ধাক্কা দেয় নি। একটা চাকুরি তার দরকার হয়েছিলো–কবিরও চাকুরির দরকার হয়! ঢাকায় কিছুতেই পাচ্ছিলো না; তখন তাকে চাকুরি নিয়ে যেতে হয়েছিলো একটা প্রায় গ্রামের কলেজে।
ইন্টারভিউর পর লিকলিকে থুতুঝরা প্রিন্সিপালটি তাকে বলেছিলো, আপনেরেই সবচাইতে কম্পিটেন্ট মনে হইতেছে, আপনেই সবচাইতে ভাল করছেন, কিন্তু একটা প্ৰব্লেম হইতেছে আপনে কবিতা লেখেন।
নিজেকে খুবই দণ্ডিত মনে হয়েছিলো তখন, ঘেন্না লাগছিলো নিজেকে, কেনো যে সে আবেদনপত্রে উল্লেখ করেছিলো তার দুটি প্রবন্ধ আর কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়।
হাসান জিজ্ঞেস করেছিলো, কবিতা লিখি, তাতে কী সমস্যা?
প্রিন্সিপালটি বলেছিলো, কবিরা ক্যারেক্টারলেস অয়, খালি মাইয়ালোক লইয়া ফষ্টিনষ্টি করে। আমার কলেজে আবার মাইয়ারা পড়ে।
হাসান বলেছিলো, রবীন্দ্রনাথ নজরুলও কবি ছিলেন।
প্রিন্সিপালটি বলেছিলো, অই তাগোও ক্যারেক্টর আছিল না, তারাও খালি মাইয়ালোকের কথা বলছে, খালি প্রেমলীলার কথা।
হাসান বলেছিলো, কিন্তু তাঁরা তো মহাপুরুষ বলে গণ্য।
প্রিন্সিপালটি বলেছিলো, হ, মহাপুরুষ, মরণের পর এই কবিগুলি মহাপুরুষ হয়, বাচনের সময় অইগুলি ক্যারেক্টারলেস মানুষ। আমাদের ধর্মে বলে কবিরা মরণের পর দোজগে যাইবো।
হাসান কোনো উত্তর দেয় নি, লোকটিকে দেখছিলো; সে দেখেছে। এই নোংরা লোকটিই চারপাশে ছড়িয়ে আছে।
প্রিন্সিপালটি আরো বলেছিলো, আপনেরে লইতে পারি, ইন্টারভিউ আপনে সব চাইতে ভালই দিছেন, তয় কথা দিতে হইবো কবিতা লেখতে পারবেন না, আর মাইয়া স্টুডেন্টগো লগে ফষ্টিনষ্টি করতে পারবেন না। মাইয়ালোকও যেমুন, কবি শোনালে কাইত হইয়া পড়ে, আর আপনে দেখতেও খারাপ না।
ওই তিন বছর তার বুকে কেঁপে ওঠে নি। কোনো পংক্তি, রক্তে গুঞ্জন করে নি। কোনো রঙিন শব্দ, রোদ মেঘ অন্ধকার জ্যোৎস্নালাগা দৃশ্য চােখে ঝলমল ক’রে ওঠে নি, মাংসকোষকে উত্তেজিত করে নি কোনো অভাবিত আকস্মিক তুলনা, কোনো চিত্রকল্প তাকে মত্ত প্ৰমত্ত উন্মত্ত করে নি ধ্বনিগন্ধ স্বাদস্পর্শরূপে, সে কোনো কবিতা লিখতে পারে নি, লেখে নি; গাড়ল মোষের মতো প্রিন্সিপালটির আদেশ মানার জন্যে নয়, ওই প্রথাগত সুন্দর চারপাশ তার ভেতরে কোনো কবিতা সৃষ্টি করে নি। হাসান বিস্মিত হয়ে দেখেছে চারপাশ অত্যন্ত সুন্দর; দিঘি ধানখেত তালগাছ আছে, নিবিড় সবুজ ঘন গাছে ঢাকা কয়েকটি পরিত্যক্ত হিন্দুবাড়িও আছে, নীল আকাশ, মেঘ, নিবিড় বৃষ্টি, শিশির, সরষে ফুলের হলুদ বিস্তারও আছে, কিন্তু তার ভেতর নেই কোনো কবিতা। বইপত্র পড়েছে, ছাত্রদের পড়িয়েছে যদিও ছাত্ররা পড়তে চায় নি, গদ্যপদ্য বই নিরর্থক তাদের কাছে, আড্ডা দিয়েছে, মাঝেমধ্যে ঢাকা এসেছে সে, কিন্তু কবিতা লেখে নি; তার মনে হয়েছে হাসান রশিদ থেকে সে আবার মোহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার হয়ে গেছে। এক মান বিকেলে তার ভেতরে হাসান রশিদ কথা ব’লে ওঠে যদি কবিতাই না হয়, কবিতাই না সৃষ্টি করো, তাহলে কী দরকার ছিলো তোমার হাসান রশিদ হওয়া, নিজেকে ভাঙা, কী দরকার ছিলো ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে গ্রামের তুচ্ছ কলেজে তুচ্ছতর বাঙলার মাস্টার হওয়া? তুমি কি এই গ্রামের কলেজে সাতটা কায়কোবাদ এমদাদ আলি পাঁচটা শহিদুল্লাহ বরকতুল্লাহ পড়ানোর জন্যে নিজেকে ভাঙা শুরু করেছিলে? তুমি না হ’তে চেয়েছিলে এমন কিছু যা গুড বয়রা কলেজের মাস্টাররা কখনো হ’তে চায় না? তুমি এখান থেকে কেটে পড়ো হাসান, ভাগো, তুমি নষ্ট হচ্ছো, কবিতা সৃষ্টি না করাই তোমার জন্যে নষ্ট হওয়া; তুমি নষ্ট হও, সম্পূর্ণ নষ্ট হও, কবিতার জন্যে, চিত্রকল্পের জন্যে; কুষ্ঠরোগী হও, দুরারোগ্য কুষ্ঠরোগী হও, কবিতার জন্যে; পাপী হও, অমোচনীয় পাপী হও, কবিতার জন্যে; তুমি দণ্ডিত হও, চিরদণ্ডিত হও, ধ্বংস হও, কবিতার জন্যে; আর কিছু নয়, তুমি শুধু কবিতার জন্যে, তুমি বিকশিত হবে শুধু কবিতার জন্যে, নষ্ট হবে শুধু কবিতার জন্যে। কবিতা তোমার জীবন, কবিতা তোমার তিলে তিলে ভয়াবহ মৃত্যু।