আয়নামহল – ১১

এগারো

…হেঁইও মারি জোয়ারদারি, হেঁইও মারি জোয়ারদারি…

মাগো মা, সকাল থেকে এই এক ষাঁড়চেল্লানি শুনে শুনে মাথা ধরে গেল কল্পনার। সেই পরশু থেকে মাটির তলায় পাইপ চালান চলছে তো চলছেই, এখনও সাদা জলের দেখা নেই! দশ দশখানা মুশকো জোয়ান মিলে কী গুষ্টির পিন্ডি করছে কে জানে! চিৎকারের কোনও বিরামবিশ্রাম নেই, মাঝে ওদের টিফিন টাইমটুকুন যা জিরেন পায় কান দুটো। মুখের ভাষা কী কল মিস্তিরিগুলোর, গান গেয়ে গেয়ে যার-তার চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করছে! গাল পাড়লে নাকি গতরের জোশ বাড়ে! কী বেহায়া, কী বেহায়া! নিজেদের গানে নিজেরাই আবার দাঁত বার করে হাসে! সুবর্ণলতায় টিউবওয়েল বসছে না তো, কল্পনার বাপের শ্রাদ্ধ হচ্ছে!

কুয়োতলায় আঁচাতে এসে কল্পনা আপন মনে হেসে ফেলল। বাপ কোথায় ঠিক নেই, তার আবার শ্রাদ্ধ! সে লোক কোন কালে মাকে ছেড়ে ভেগেছে— স্মরণ করতে গেলে কল্পনাকে মাথার চুল ছিঁড়তে হবে। আবছা শুধু মনে পড়ে তার শুঁটকোপানা বাপ চুল্লু টেনে এসে রাতদুপুরে হল্লা করত খুব, আর মাকে গোবেড়েন দিত। মা’রও বলিহারি, প্রেম করে বিয়ে করল কিনা এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে। তাও স্বজাতি নয়, বিহারি। আরে বাবা, যার পেটই চলে সওয়ারি বদল করে, বউ তো সে বদল করবেই। দু’-দু’খানা বাচ্চা পয়দা করে বেমালুম কেটে পড়ল একদিন। খোঁজ নেই, খোঁজ নেই, তারপর জানা গেল সাহানগরের মালতিকে নিয়ে নাকি ঘর বেঁধেছে। এখন তো শোনা যায়, মালতী, পুষ্পা, শ্যামা সব ক’টাকে শাঁখা-সিঁদুর পরিয়ে, ডজনখানেক অ্যান্ডাবাচ্চা চতুর্দিকে ছড়িয়ে বাবু নাকি ধাঁ। শেষ বয়সে আপন মুলুক গয়ায় ফিরে দেশওয়ালি বউ- ছেলে নিয়ে খেতিবাড়ি করছে। ওই লোকের মরার খবর কোনওদিন কি পৌঁছোবে কলকাতায়? মাঝখান থেকে কল্পনার মা’র সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হয়ে গেল।

ভিনদেশি চুল্লুখোর বাপটার কথা ভাবতে ভাবতে এঁটো থালা-গেলাস মেজে ফেলল কল্পনা। থালাখানা নাকের ডগায় এনে শুঁকল ভাল করে। গন্ধের ব্যাপারে তার একটু পিটির পিটির আছে। কী অভ্যেসই যে গড়ে দিয়েছে চেতলার দিদা, থালাবাটি একটু আঁশটে বাস ছাড়লেই কল্পনার গা গুলিয়ে ওঠে।

বাসনকোসন কুয়োতলাতেই রেখে, আঁচলে হাত মুছতে মুছতে, কল্পনা হানা দিল মিস্ত্রিদের কর্মযজ্ঞে। শালের খুঁটি, বাঁশ, মোটা মোটা দড়ি, ইয়া ইয়া পাইপ, সব মিলিয়ে বাড়ির পিছন ভাগের চাতালটার একেবারে ছিড়িবিড়ি দশা। তার মধ্যেই লোহার ডান্ডা ধরে গোল হয়ে ঘুরে চলেছে পাঁচ জোয়ান। তাদেরই একজন হেঁকে উঠল, কাদা ছিটবে, সরে যাও… ও মাসি ….

কল্পনা কটমট চোখে দেখল সুখেনের বয়সি বোনপোটাকে। দু’হাত কোমরে রেখে বলল, তোমাদের পাইপ দিয়ে কবে আর জল বেরোবে?

এক আধবুড়ো মিস্ত্রি উবু হয়ে বসে বিড়ি ফুঁকছিল। বলে উঠল, বেরোচ্ছে তো। ভসকা ভসকা। হলদে হলদে। ঘোলা ঘোলা।

মরণ! সে তো দেখতেই পাচ্ছি। বলি, কাজ শেষ হবে কবে?

মাথায় টুপি, হাফপ্যান্ট, তদারকি বাবুটি ছায়ায় চেয়ার পেতে বসে। কানে পালক ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ভাল জল খেতে হলে একটু সময় তো দিতে হবে গো, মেয়ে।

চটপট ফিনিশ করুন। মেয়ে-বউদের অসুবিধে হচ্ছে।

আর তো মাত্র কালকের দিন। তারপর ঘটাং ঘটাং হাতল, ছড়াং ছড়াং জল।

হুঁহ্, হোক আগে।

কল্পনা মুখ বেঁকিয়ে সরে এল। ঘটা করে টিউবওয়েল বসানোর দরকারটা কী ছিল কে জানে! সুবর্ণলতার সবাই কি এতকাল জলের অভাবে গলা শুকিয়ে মরছিল? কুয়োর জল কী এমন খারাপ, অ্যাঁ? ভালমতোই ঢাকা থাকে, নোংরা পড়ে না…। মামার মাথায় কী খেয়াল যে চাপল, এখন জলের ছুতোয় রাজ্যের মানুষ ভিড় জমাবে সুবর্ণলতায়। বাগান মাড়াবে, ফুল ছিঁড়বে, যেখানে সেখানে পেচ্ছাব সারবে…! হরিশ কত পাহারা দিয়ে বেড়াবে? কল্পনাই বা কোনটা ছেড়ে কোন দিকে চোখ রাখবে? নাম ফাটবে মামার, আর দায় বাড়বে কল্পনার। এবার দেখা হলে মামাকে সাফ বলে দেবে, ওই কল সামলানোর জন্য আলাদা একটা লোক চাই।

মাজা বাসন ক’টা তুলে নিয়ে কল্পনা ফিরল রান্নাঘরে। রাখল জায়গা মতন। সুবর্ণলতার এই ঘরখানা তার একেবারেই নিজস্ব। প্রাইভেট। ঢুকতে পারো যে খুশি, কিন্তু কারও খবরদারি এখানে চলবে না। মামারও নয়। মনে বড় সাধ ছিল, যদি কখনও নিজের একটা সংসার হয়, অন্তত রান্নাঘরটুকু যেন পছন্দ মতো সাজাতে পারে। বড় মানুষের সমান সমান হওয়া তো কপালে নেই, নিদেনপক্ষে হেঁশেলটুকু কি চেতলার দিদার মতো হতে পারে না? তা কল্পনার প্রার্থনা বিধাতাপুরুষ শুনেছে খানিকটা। দেওয়ালে টানা টানা তাক, রোজকার থালা বাটি রাখতে স্টিলের কিচেনকুইন, কাপডিশ ঝোলানোর ব্র্যাকেট, কাঠের আলমারি বোঝাই ডিনার সেট, টি সেট, শরবত সেট, ননস্টিক কড়া, ননস্টিক কুকার, কাঁটাচামচ, ছুরি, কী নেই! আছে একখানা ঢাউস ফ্রিজও। এসব ব্যাপারে মামার কিপটেমি নেই এতটুকু। কল্পনা যা চেয়েছে, এসে গেছে টপাটপ। শুধু নাকের বদলে নরুন, গ্যাসের জায়গায় দু’খানা পাম্প স্টোভ। তবে তেল পোড়াও যত খুশি, কেরোসিন জুটে যাবে। লাগোয়া ছোটমতন একখানা ভাঁড়ারঘরও পেয়েছে কল্পনা। এটা উপরি।

সুখেনের এখনও খাওয়া হয়নি। সে গেছে উলুবেড়িয়ায়, টেলিফোনের তাগাদা দিতে। ঢিকির ঢিকির মানুষ কখন ফেরে ঠিক নেই, হাঁড়িকুড়ি কোলে বসে থাকা কল্পনার পোষায় না। স্বামী হয়েছে তো কী, তার অপেক্ষায় পেটে কিল মেরে পড়ে থাকতে হবে নাকি? অত পিরিত বাপু কল্পনার নেই। তবু কী ভেবে, হাঁড়ি ঝাঁকিয়ে, ভাতের পরিমাণটা একবার দেখে নিল কল্পনা। খোরাকি একটু বেশিই সুখেনের, তবে কুলিয়ে যাবে। ডাল, চচ্চড়ি আর ফ্যাসামাছের ঝালও আলাদা আলাদা করে তুলল বাটিতে, ভাল করে ঢাকা দিল। কোত্থেকে এক হুলো জুটেছে সুবর্ণলতায়, বজ্জাতটার বেজায় নোলা, একটু বেখেয়াল হলেই সৰ্বস্ব চেটেপুটে খেয়ে যায়। কল্পনাও তক্কে তক্কে আছে, একদিন বাগে পাক, আস্ত চেলাকাঠ ভাঙবে পিঠে।

বাড়তি মাছ তরকারি ফ্রিজে তুলে কল্পনা রান্নাঘর ছাড়ল। দরজায় শিকল এঁটে হেলেদুলে চলেছে কর্মশালায়। এই সময়টায় ঘরে ঘরে ঢু মারতেই হয়। নজরদারি না থাকলে দুপুরবেলা প্রাণের সুখে গপ্পো মারে মেয়ে-বউগুলো।

মাদুর বোনার ঘর পেরিয়ে সেলাই ঘরে যেতে গিয়ে কল্পনার কান খাড়া। হুঁ হুঁ বাবা, যা ভেবেছ তাই। আজ ওই ঘরেই আসর বসেছে। হি-হি, হু-হু, হা-হা… যেন হাসির দোকান খুলেছে দল বেঁধে। ঘরে যাদের নিত্যি অভাব, নিত্যি অশান্তি, তাদের যে এত রস আসে কোত্থেকে!

কল্পনা বাইরে থেকেই হাঁক ছাড়ল, হচ্ছেটা কী, অ্যাঁ? এটা কি ফুর্তি লোটার জায়গা?

ব্যস, আর টু শব্দটি নেই। ঢালা শতরঞ্চি পাতা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা জনা চোদ্দো মেয়ে-বউ অমনি ভিজে বেড়ালটি সেজে ছুঁচ গাঁথছে কাপড়ে।

দুপদাপিয়ে ঘরে ঢুকল কল্পনা। তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করল সকলকে। আহা, মনোযোগের কী বহর, যেন হাতের কাজটি ছাড়া আর কিচ্ছুটি বোঝে না!

বেঁটে টুলের ওপর একখানা পা তুলে কল্পনা হিটলারি ভঙ্গিতে দাঁড়াল। কর্কশ স্বরে বলল, দ্যাখো, রোজ রোজ এক প্যাচাল পাড়তে আমার ভাল লাগে না। সুবর্ণলতাকে কী ভেবেছ তোমরা? দানছত্তর? যদি মনে করো, এক দিনের কাজ তিন দিনে করলে বেশি মজুরি পাবে, সে গুড়ে বালি। অসঙ্গত কারণে বেশি সময় লাগালে আমি কিন্তু মজুরি কেটে নেব। তখন যেন কাঁদতে বসো না, কল্পনাদিদি দিল না, কল্পনাদিদি পাষাণ…! কান খুলে শুনে রাখো, ফাঁকিবাজদের জন্য কল্পনা নস্করের পরানে সত্যিই কিন্তু কোনও মায়াদয়া নেই, হ্যাঁ।

গুছিয়ে বকুনি দিতে পেরে বেশ তৃপ্তি জাগল কল্পনার। তবে ফল কিছু হল কি না বোঝার উপায় নেই, কর্মরত মুখগুলো একই রকম নির্বিকার।

পেট থেকে কথা বার করতে কল্পনা গলা নরম করল, কী নিয়ে রঙ্গতামাশা হচ্ছিল শুনি?

বাক্যিটুকু খসার অপেক্ষা, সঙ্গে সঙ্গে সদ্য ছিপিখোলা সোডার বোতলের মতো হাসি ফিনকি দিয়ে উঠেছে সুনীতার ঠোঁটে, সালমা ভাবী যা একখানা… হি-হি-হি-হি… খবর শোনাল… হি হি…

সবে পরশু থেকে আসা শুরু করেছে সালমা, এর মধ্যেই আড্ডার মধ্যমণি!

কল্পনা চোখ খর করল, কী এমন রসের খবর, শুনি?

ও আমার মুখে আসবে না… হি হি… রমাবউদিকে জিজ্ঞেস করো…. হি হি…

ন্যাকাপনা করিস না তো। বলবি তো কী হয়েছে? শোনার জন্য কল্পনারও এবার বুক হাঁসফাস, রমাদি, তুমিই বলো তবে।

রমা পা ছড়িয়ে কাপড়ে সুতোর ফুল তুলছিল। ফিক করে হেসে বলল, আমাদের আমিনা নাকি তার বরের কাছে ঘেঁষতে চাইছে না।

কেন?

বর নাকি যখন তখন জাপটে ধরে…

তা এতে হাসার কী আছে? ওটাই তো ব্যাটাছেলের ধম্মো। কল্পনার স্বর রুক্ষতর, আহ্লাদিপনা ছেড়ে হাত চালাও। আমি কিন্তু চারটে বাজলে ইঞ্চি মেপে হিসেব বুঝে নেব, হ্যাঁ।

ঘর যেন চুপসে গেল কল্পনার মেজাজে। তবু তার মধ্যেই সুনীতা বলে উঠল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কল্পনাদি?

কী?

মাস্টারমশাই নাকি এখন হাঁটাচলা করছেন?

হ্যাঁ। কেন?

তা হলে তো এবার সুবন্নলতায় আসতে পারেন।

তাঁর বিহনে তোমাদের কী অসুবিধেটা হচ্ছে, শুনি?

তা নয়… তিনি এলে এখানকার চালচিত্তিরটাই বদলে যায় কিনা। কী আমুদে মানুষ… হাসছেন, গপ্পো করছেন, গান শোনাচ্ছেন… সুবন্নলতা যেন ভরে থাকে।

শ্যামলী বলল, সেই মানুষটাকে বিধাতা কিনা পঙ্গু করে দিচ্ছিলেন! কী অধম্মো হত বলো তো!

রমা বলল, মাস্টারমশাই বলেছিলেন সবাই মিলে সুবন্নলতায় একদিন ফিস্ট হবে। উনি নিজের হাতে মাংস রাঁধবেন। উনি এলে ফিস্টটা কিন্তু হওয়া চাই, কল্পনাদিদি।

দেখা যাবেখন। এখন কাজ সারো তো।

বাইরে ফের কলের গান। ফের শুরু হল কেত্তন। শ্যামলী-রমারা চোখ মটকাচ্ছে। গনগনে দৃষ্টিতে তাদের আবার একবার শাসন করে বাঁধানো দাওয়ায় এসে বসল কল্পনা। রোদ আজ বেজায় চড়া। তাপ যেন চামড়া ঝলসে দেয়। হাওয়াও নেই বিশেষ, সামনের গাছপালা যেন কেমন নিথর দাঁড়িয়ে। আচমকা কোত্থেকে একটা পাপিয়া ডেকে উঠল। কোন পাতার আড়াল থেকে কে জানে, শির ফুলিয়ে চেঁচিয়ে চলেছে, পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা!

কল্পনা হাই তুলল একখানা। খরখরে গলায় বলল, মরণ!

.

সুখেন ফিরল প্রায় সাড়ে তিনটেয়। কল্পনা তখন নিজের ঘরে তক্তপোশে গড়াচ্ছে।

জামা ছাড়তে ছাড়তে সুখেন বলল, শালার বাসটা মাঝরাস্তায় দুম করে বিগড়ে গেল, বুঝলে।

পাশবালিশ ছেড়ে চিত হল কল্পনা। জড়ানো গলায় বলল, জানা কথা। তুমি কাজে বেরিয়েছ, পথে কোনও অঘটন ঘটবে না….

সত্যি বলছি। মাইরি। পরের বাসের জন্য ঠায় চল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে। তাতেও যা ভিড়, বাপ। চালে লোক বসে গেছে।

তোমার বেত্তান্ত পরে শুনব। কাজের কাজ কিছু হল?

কই আর। আজও তো ঘুরিয়ে দিল।

কেন?

কী সব ঝঞ্ঝাট চলছে। এখন কোনও অর্ডার বেরোবে না।

মামার নাম করেছিলে?

রোজই তো বলি। ওরা মামাটামা বোঝে না। শুধু নোট চেনে।

তার মানে ঝামেলাটা ওদের বাহানা?

সুখেন হাত উলটে দিল, তাই হবে।

তাই-ই। কল্পনা উঠে বসল। চোখ-নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কত নেবে জিজ্ঞেস করলে পারতে।

মাথা খারাপ! মামাবাবু নিষেধ করেছেন না! আগের দিনও বলেছেন, লাইনের জন্য খবরদার কাউকে ঘুষ দিবি না। একটা পয়সাও নয়।

কল্পনা বেজার মুখে বলল, মিছিমিছি দেরি। টেলিফোনটা লেগে গেলে কত উপকার হয়।

বটেই তো। মামাবাবুর খোঁজটা তো রোজকার রোজ রাখা যায়।

ওরে আমার মামাবাবুর ভাগনিজামাই রে! কল্পনা ভেংচে উঠল, এই দাসীবাঁদির কোনও উপকার হয় না? নিজের মা-ভাইয়ের সঙ্গে আমিও তো দু’-চারটে কথা বলতে পারি।

সেটাও একটা সুবিধে অবশ্য। গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে সুখেন দেঁতো হাসল, শালাবাবু যখন মোবাইল নিয়েছে…

তা হলে? আগে তো মামা রাজিই ছিল না।… এখন সুযোগ যখন এসেছে, তোমার তো উঠেপড়ে লাগা উচিত। নাকি নিজের সাত কুলে কেউ নেই বলে গা করছ না?

কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয় অবশ্য। সুখেনের বাবা আছে একটা। দূর সম্পর্কের। সৎমার বর।

ম্লান মুখে সুখেন বলল, আর কী করি বলো দিকিনি? বারবার তো ছুটছি।

ও তো ঢঙের যাওয়া। বোঝোই যখন পাত্তি খাবে, ঠেকিয়ে দিলেই হয়।

তারপর? মামা জানতে পারলে? তিনি ন্যায়নীতি মেনে চলা মানুষ…!

ফের ঝামরে উঠতে গিয়েও মুখে কুলুপ আঁটল কল্পনা। পোড়ামুখ থেকে আলটপকা কিছু বেরিয়ে গেলে নিজেরই তো ক্ষতি। যে-ডালে বসে পুচ্ছ নাচাচ্ছে, সে-ডালে কেউ কুডুল মারে!

হাত ঘুরিয়ে এলোচুলের গোছা শক্ত করে বেঁধে নিল কল্পনা। ফ্যাসফেসে গলায় সুখেনকে বলল, যাও, চান সেরে এসো।

কাঁধে গামছা ফেলে পুকুরে গেল সুখেন। বাথরুমে তার পোষায় না, কুয়োতলাতেও নয়, কবে কোন যুগে গ্রামে ছিল, তখনকার অভ্যেসটাই ফিরিয়ে এনেছে আবার। দিব্যি সুখে আছে। চাল ছিল না, চুলো ছিল না, মা-মরা বাপে খেদানো লোকটা সাতঘাটের ঠোক্কর খেতে খেতে এসে ভিড়েছিল চেতলার মুদিখানায়। দাঁড়িপাল্লায় ডাল, চাল, আটা, ময়দা মাপত, মাল বয়ে পৌঁছে দিত বাড়ি বাড়ি, উঠতে বসতে গাল খেত মালিকের, আর ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর ছুঁচোর সঙ্গে লড়াই করে রাতে পড়ে থাকত ওই দোকানঘরেই। মামার কৃপায় সেই লোকের একখানা বউ জুটল, সঙ্গে সুবর্ণলতায় মহাসুখের ঘরবাড়ি…। পুকুরে মাছ, গাছে ফলপাকুড়, খেতে শাকসবজি… মামার মতো মানুষের ওপর সুখেন নস্করের তো অটল ভক্তি থাকবেই।

কিন্তু মামা কি সত্যিই ন্যায়নীতির মানুষ? নাকি ন্যায়নীতিকে কাঁচকলা দেখানো মানুষ?

নাহ্, কল্পনা আজও ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারল না। ভাবতে গেলে সব কিছু কেমন গুলিয়ে যায়। সেই কোন কাল থেকে দেখছে মামাকে, তবু ধন্দ জাগে। বড় ধন্দ জাগে।

চেতলায় মামাদের বাড়ি মা যখন কাজে ঢুকল, কল্পনা কতটুকুই বা! স্পষ্ট মনে আছে তাকে দেখেই দিদা আঁতকে উঠেছিল, ওইটুকু মেয়ে বাসন মাজবে কী গো? লেখাপড়া না শিখিয়ে ওকে দিয়ে কাজ করাচ্ছ?

দুখিনী মা’র ঘাড় ঝুলে গেল, কী করি মা, পেট বড় বালাই। একা হাতে সংসার টানতে হয়। ছেলেমেয়ে দুটোকেই কী করে পড়াই, বলো? উঁহু, ও বললে তো চলবে না। মেয়ে বলে কি বানের জলে ভেসে এসেছে? ওকে স্কুলে ভরতি করে দাও, খরচখরচা আমি দেব।

তা দিদা চেষ্টা করলে কী হবে, কল্পনার যে মাথাই নেই। বই দেখলেই ঘুম পায়, অঙ্ক কষতে গেলে পেট কামড়ায়…। মামা-মামির ইংরেজি বাংলা দেখিয়ে দেওয়া, টিউশন পড়ার জন্য দিদার পয়সা জোগানো, সবই বিফলে। গড়িয়ে গড়িয়ে সিক্সে উঠে কল্পনার দম ফুভুত। লেগে পড়ল রাতদিনের কাজে, দিদার বাড়িতেই।

তখনও পর্যন্ত মামা তার চোখে হিরো নাম্বার ওয়ান। চেহারা, স্বাস্থ্য, হাঁটাচলা, কথা বলা, সবেতেই মারকাটারি। মামা যখন গমগমিয়ে হাসে, সলমন খান, গোবিন্দারাও তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে যাবে। কিন্তু ও-বাড়িতে দিনরাত থাকতে গিয়ে কল্পনার তো আক্কেল গুড়ুম। যাহ্ বাবা, হিরোর ক্যারেক্টার তো বেশ লুজ! নিজের মাসতুতো বোনকে ও কিনা বুকে চেপে ময়দা ঠাসার মতো ঠাসে! মনের দুঃখে মামি বেচারি ইশ্বক চালায় মামার এক কচি ছাত্রর সঙ্গে। আর মামা-মামি একত্র হল, তো ওমনি ঠোকাঠুকি। মামির চিল্লানি থেকেই তো কল্পনা জানল, শুধু ঝুনিমাসি নয়, স্বর্গের দেবীর মতো দেখতে রুনিমাসিকেও মামা নাকি চুষে মুষে ছিবড়ে করে দিয়েছে!

তারপর তো মামি একদিন ভাগলবা। রুনি-ঝুনিরাও আর চেতলার ছায়া মাড়ায় না। বড় বোন কলকাতার বাস তুলে সোজা দিল্লি, আর ছোটটি সেজেগুজে বিয়ের পিঁড়িতে বসে রাতারাতি সতীলক্ষ্মী। বাড়িতেও অখণ্ড শান্তি। মামা যেন খানিক বিবাগী, আপন মনে ছবি আঁকে, আর মাঝে মাঝেই পাড়ি দেয় বিদেশ। দিদা চাকরি থেকে রিটায়ার করে বাড়িতেই থাকে সারাক্ষণ। টিভি দেখে আর দিদার সঙ্গে শুয়ে বসে গল্প করে সময়টা বেশ কেটে যায় কল্পনার। মা একের পর এক সম্বন্ধ দেখে যাচ্ছে তার, কিন্তু একটাও লাগছে না। বাবুর বাড়ি থেকে থেকে কল্পনার নাক উঁচু হয়েছে, যাকে-তাকে গলায় ঝুলিয়ে দিলে সে মানবে কেন? মা’র আনা পাত্র কল্পনার পছন্দই হয় না, শুধুমুদু বয়স গড়িয়ে যায়।

ওদিকে কে একজন তখন হাসছিল অলক্ষ্যে। কে যে সে? বিধাতাপুরুষ? নাকি শয়তান? কল্পনার শুকনো চোখ দুটো জ্বালা জ্বালা করে উঠল। কে যে তাকে ঠেলে দিল গর্তে?

সেদিন নার্সিংহোমে গিয়েছিল দিদা। ন্যাকাষষ্ঠী ঝুনিমাসির পেট কেটে বাচ্চা হয়েছে সকালে, নাতনির মুখ দেখতে। মামা কলেজ থেকে ফিরতেই তার জন্য চা করে নিয়ে গেল কল্পনা। রোজকার মতোই।

মামা কাপডিশ ছুঁল না। কেমন যেন আনমনা গলায় বলল, আমার গ্লাস বোতল দিয়ে যা তো।

এই বিকেলবেলা তুমি মদ খাবে? তোমার টাইম তো রাত্তিরে, ন’টার পর।

আহ্, যা বলছি কর।

মামার আলমারি থেকে সাজসরঞ্জাম এনে দিল কল্পনা। বসার ঘরে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জলের বোতল বার করে বলল, তুমি নার্সিংহোম গেলে না যে বড়?

মামা যেন চমকে তাকাল। তারপরই গোমড়া। বলল, গেলাম না। এমনিই।

ঝুনিমাসির বাচ্চা দেখতে তোমার ইচ্ছে করছে না?

মামা জবাব দিল না। হুইস্কি ঢালছে গ্লাসে।

কী যে তখন ক্যারা নড়ল কল্পনার, ফস করে বলে বসল, জানি তুমি কেন যাওনি!

কেন?

বলব? রাগ করবে না?

বল।

কল্পনার সঙ্গে মামার ঠাট্টাইয়ারকি তো চলেই। কল্পনা খিলখিল হেসে উঠল, ঝুনিমাসির বিয়ে হয়ে গেছে বলে তুমি খুব কষ্ট পেয়েছ।

দু’-এক সেকেন্ড থমকে থেকে হো হো হেসে উঠেছে মামা। জলের বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে বলল, তোর তো খুব বুদ্ধি!

আহা, বুদ্ধির কী আছে! আমি আর এখন বাচ্চা আছি নাকি, যে কিছু বুঝব না?

তাই নাকি? মামার চোখ কল্পনার মাথা থেকে পা অবধি নামল। উঠল। হেসে হেসেই বলল, তুই তো পুরোদস্তুর যুবতী হয়ে গেছিস রে!

হব না? একুশ পুরতে চলল …

মামা আবার বলল, বটেই তো। তাই তো। এতদিন সেভাবে খেয়ালই করিনি! বলতে বলতে হাত নেড়ে সামনে ডাকছে, এদিকে আয়, তোকে ভাল করে দেখি।

কী দেখবে?

আয় না।

কাছে যাওয়ামাত্র মামা সটান হাত তুলে দিল বুকে। টিপেটুপে দেখতে লাগল, যেন সাইকেল রিকশার হর্ন বাজাচ্ছে। কল্পনার গা কেঁপে উঠল। ছিটকে সরে গেছে দু’পা, এ কী করছ, মামা?

পরখ করছি। শাঁসেজলে দিব্যি হয়েছিস তো! সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল মামা। ফের গায়ে হাত বোলাচ্ছে, নাহ্, তোর শরীরটা তো বেশ।

এর পর যা যা ঘটল, তা তো একেবারেই অভাবনীয়। মুরগির ছাল ছাড়ানোর মতো টেনে টেনে খুলল কল্পনার সালোয়ার কামিজ। তাকে পুরো উদোম করে দিয়ে বলল, বড় হতে গেলে পুরুষমানুষের শরীরটাও চিনতে হয় রে।

সেদিনই প্রথম চিনল কল্পনা। বসার ঘরের মেঝেয় শুয়ে। মামির বড়মতন ছবিটার সামনে। তারপর কতবার যে মামার বিছানায় যেতে হয়েছে কল্পনাকে। দিদা ঘুমিয়ে পড়ার পর। চুপিচুপি। পা টিপে টিপে। একটু একটু করে কল্পনারও তো নেশা ধরে গিয়েছিল। নিজেকে কেমন রানি রানি মনে হত। মামার মতো মানুষ শেষে তারই হাতের মুঠোয়, ভাবা যায়! শরীর দিয়ে যদি মামাকে বশে রাখতে পারে, তা হলে আর চিন্তা কীসের!

অলক্ষ্যে সেই অলুক্ষুনেটা আবার বুঝি হাসছিল তখন। পেটে বাচ্চা

এসে গেল কল্পনার।

টের পেয়ে মামাকে জানাতেই মামার সটান জবাব, নষ্ট করে ফ্যাল।

কেঁদে ফেলেছিল কল্পনা, তা কী করে হয়?

মামা খানিকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল কান্না। তারপর কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বলল, ওরে বোকা মেয়ে, নিজের ভবিষ্যৎটাও ভাবছিস না? আমার মতো একটা বুড়োর কাছে পড়ে থাকলে তোর চলবে? আমাকে দেখে তো বুঝেছিস, সংসারধর্ম আমার ধাতে নেই। কিন্তু তোকে তো ঘরসংসার করতে হবে, না কী?

কিন্তু আমি যে ভেবেছিলাম…

আমিও তো অনেক কিছু ভেবেছি রে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোর একটা ভাল বিয়ে দেব। সারাটা জীবন যাতে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারিস, তার একটা পাকা বন্দোবস্ত তো করতে হবে।… জানিসই তো, হাওড়ায় জমিটমি নেওয়া কমপ্লিট, এবার ঘরদোর তুলে ফেললেই সুবর্ণলতা চালু। তবে আমার পক্ষে তো সর্বক্ষণ ওখানে পড়ে থাকা সম্ভব নয়। দেখাশোনাটা তা হলে কে করবে? তুই। এটা তোর আজীবনের ব্যবস্থা। আমার অবর্তমানেও যাতে কেউ তোকে নড়াতে না-পারে, এ আমি লিখে দিয়ে যাব। তুই ছাড়া আমার আর আছেটাই বা কে? তোর চেয়ে বেশি আর কাকে বিশ্বাস করব? আমার কাজ তুই যতটা বুক দিয়ে আগলাবি… ভাব তুই, ভেবেচিন্তে উত্তর দে। সমস্ত পিছুটান ঝেড়ে ফেলে আমি এগোতে চাইছি, আবার কি আমাকে ছোট গন্ডিতে আটকে ফেলতে চাস?

ব্যস, কল্পনা গলে জল। সুড়সুড় করে মামার সঙ্গে গিয়ে পেট খসিয়ে এল, কাকপক্ষীটিও জানতে পারল না। তবে কপাল যার মন্দ, দুর্ভোগ তার পিছু ছাড়ে না। বাচ্চা ফেলতে গিয়ে জন্মের মতো বুঝি বাঁজা হয়ে গেল কল্পনা। নইলে বিয়ের সাড়ে পাঁচ বছর পরেও কল্পনা মা হয় না কেন?

মামা অবশ্য কথা রেখেছে। এমনকী যে-শরীরের বিনিময়ে এত কিছু পাওয়া, সেই শরীরের দিকেও আর হাত বাড়ায়নি। রাতবিরেতে কল্পনাকে তো যেতেই হয় মামার ঘরে, অনেক সময়ে সুখেন হয়তো সুবর্ণলতায় থাকেও না, তবু নয়। এটাই বুঝি উচিত কাজ। এখানেই মামা বুঝি মামা। একদম অন্য রকম। সুখেনের ভাষায় ন্যায়নীতির মানুষ।

তাও কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয়, কোথাও একটা ফাঁকি রয়ে গেছে। বিচ্ছিরিভাবে ঠকানো হয়েছে কল্পনাকে। কিন্তু কোথায় যে সে ঠকল, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। আর পারে না বলেই বুঝি অহর্নিশি এত জ্বালাপোড়া।

বাইরে ফের হতচ্ছাড়া পাপিয়াটা ডাকাডাকি শুরু করেছে, পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা!

কল্পনা ঘাড় ঘুরিয়ে জানলার দিকে তাকাল। বিরক্ত স্বরে বলল, মরণ।

.

সোনামাটিতে রাত বড় তাড়াতাড়ি নামে। দু-চারটে ঘরে টিভি চলে হয়তো, বাদবাকি গাঁ আট সাড়ে-আট বাজতে না বাজতে গাঢ় নিঝুম। শুধু গ্রামের এ প্রান্তে, রাস্তার এ পারটায়, সুবর্ণলতাই যা জেগে থাকে খানিকক্ষণ।

জেগে থাকে কল্পনা। অগত্যা সুখেনও। রাতের খাওয়া সেরে কল্পনা টহল দিতে বেরোয়, টর্চ ফেলে ফেলে দেখে সুবর্ণলতার এ কোনা, ও কোনা। শেয়াল না-থাক, হুমদো হুমদো কুকুর তো আছে। একটু বেখেয়াল হলেই ব্যস, হাঁস-মুরগির দফারফা। প্রথম প্রথম টহলদারির কাজটা ঘুমকাতুরে হরিশের ওপর ছেড়ে রেখেছিল কল্পনা, ঠেকে শিখে এখন নিজেই চৌকিদারি করছে।

এ কাজে যেন একটা নেশাও আছে। ঘুরতে ঘুরতে কখনও সে দাঁড়িয়ে পড়ে কোনও গাছের তলায়, অন্ধকারে ঘাপটি মেরে শোনে তক্ষকের ডাক। শুনতে শুনতে ফের এগোয়। ঝিঁঝির উল্লাসে কখনও বা কান ঝালাপালা, আবার হঠাৎ তারা থেমে গেলে চরাচর যেন বিলকুল শুনশান। কল্পনার গা শিরশির করে। পায়ের নীচে শুকনো পাতা ভাঙার মড়মড় কেমন ভূতুড়ে লাগে তখন। আরও কত যে না-চেনা আওয়াজ, অজানা গন্ধ ঠিকরে আসে গাছগাছালি থেকে। মাটি ফুঁড়ে। ওইসব ছমছমে শব্দগন্ধের মাঝখানে, অন্ধকার গায়ে মেখে, ডাকসাইটে কল্পনা যক্ষিণীর মতো হেঁটেচলে বেড়ায়। টর্চের আলোয় যেটুকু দেখা গেল, সবটাই যেন কল্পনার। শুধু কল্পনার। ভাবনাটাতেই যে কী আজব মৌতাত।

পুকুরপাড়ে চক্কর মেরে, হাঁস-মুরগির ডেরায় উঁকি দিয়ে, কল্পনা আজ ঘরে ফিরে দেখল সুখেন মশারি টশারি টাঙিয়ে ফেলেছে। মেঝেয় বসে ছোট ডায়েরিতে হিসেব লিখছে। দিনের খরচ।

কুঁজো থেকে জল গড়াতে গড়াতে কল্পনা বলল, চেয়ারটেবিল তো আছে, সব সময়ে মেঝেয় বসো কেন?

সুখেন চোখ তুলে হাসল, আমার মেঝেই ভাল। সুবিধে হয়। কুঅভ্যেসগুলো আর গেল না। সাধে কি হাভাতে বলি!… তুমি ফের কলকাতা যাচ্ছ কবে?

দেখি। ভাবছি সামনের হপ্তায়….

ক্ষীরসাপাতিগুলো কি অদ্দিন থাকবে? এখনই তো পাকা বাস ছাড়ছে।

আগে যাব বলছ?

যাওয়া তো উচিত। দিদা আম ভালবাসে…। লিচু, কালোজাম, জামরুল, সবই কিছু কিছু করে নিয়ে যেয়ো। আমার বাড়ির জন্যও আলাদা করে কটা দিয়ে দেব…

সুখেন ডায়েরি বন্ধ করল, এবার কলকাতা গেলে একবার দক্ষিণেশ্বর ঘুরে আসব। শালাবাবু বলেছে, নিজের অটোয় চড়িয়ে নিয়ে যাবে।

হঠাৎ তার এমন শখ! তেলের দাম সস্তা হয়ে গেল নাকি?

তা আমি জানি না! আমাকে বলল… তোমার মা’রও নাকি খুব যাওয়ার ইচ্ছে। উঠে তক্তপোশের কোনা ঘেঁষে বসল সুখেন, শালাবাবুর ইনকাম কিন্তু এখন ভালই হচ্ছে। নতুন সিট বানাল, বডি রং করাল…।

ভাল কথা। সুখের কথা। তবে যার দৌলতে এত লপচপানি, তাকে দেখতে যাওয়ারই বাবুর সময় হয় না।

কেন, স্বপন তো গেছে মামাকে দেখতে।

ও তো দায়সারা যাওয়া। কল্পনা ঘাড় তুলে মাথার ওপর ঘুরন্ত পাখাটাকে দেখল একবার। ভোল্টেজ কম, বাতাস কেমন মরা মরা। গায়ের ব্লাউজটাকে খুলতে খুলতে বলল, আমার মায়ের পেটের ভাইকে আমি চিনি না? একের নম্বরের বেইমান। যে-মামা তোকে অটোখানা কিনে দিল, লাইন ধরার টাকাটা পর্যন্ত জোগাল, তার প্রতি তোর একটা কর্তব্য নেই? দিদা যখন হাঁচোড়-পাঁচোড় করে হাসপাতাল আর বাড়ি করছিল, তোর কি উচিত ছিল না গাড়িটা নিয়ে এসে দাঁড়ানো? দরকারে লাগুক, না-লাগুক? মাল কামাতে তুই তখন কিনা শাল মেরে বেড়াচ্ছিস! আগেরবার গিয়ে মাকেও আমি শুনিয়ে এসেছি কথাটা।

মা কী করবে! সুখেন মশারিতে ঢুকে পড়েছে। বালিশে মাথা ছেড়ে দিয়ে বলল, যে যেমন স্বভাব নিয়ে জন্মায়। কেউ উপকারীর উপকার মাথায় রাখে না। কেউ বা যেচে পড়ে মানুষের জন্য করে মরে।

কল্পনা চুপ করে শুনল কথাটা। তারপর আলো নিবিয়ে সেও এসেছে বিছানায়। শুল পাশ ফিরে।

সুখেন ফের বলল, মামাবাবুর ছাত্রছাত্রীদেরই ধরো না। সকলেই কেমন উপযাচক হয়ে ছুটে ছুটে এসেছে। তারপর ধরো গিয়ে রুনিমাসি। মায়ের পেটের বোন নয়, তবু দাদাকে দেখতে সেই কোন দিল্লি থেকে চলে এলেন। ডাক্তার মানুষ, হাতে কত কাজকম্মো থাকে…। দাদা একবার মুখ ফুটে বলতেই এখানে পর্যন্ত এসে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করে গেলেন। যাদের পেটে সত্যিকার বিদ্যে থাকে, তারা এরকমই হয়, বুঝলে।

রুনিমাসির নামে, নাকি তার প্রশংসায় কে জানে, কল্পনার মামা-দরদ মুহূর্তে উধাও। একটা কুণ্ডলী পাকানো সাপ হঠাৎই নড়ে উঠেছে মস্তিষ্কে। গরগরে গলায় বলল, হয়েছে। কচকচানি থামাও তো। ঘুমোও। না বলছিলাম… উনি যদি না-আসতেন, কেউ কি দুষত? তুমিই বলো? আহ্, আর ভাল্লাগছে না।

এবার বুঝি ঝাঁঝটা কানে ঠেকেছে। সুখেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। কল্পনাও গুম। সাপটা মাথা বেয়ে শরীরে নামছে যেন। ফণা মেলছে। তার হিসহিস আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছিল কল্পনা। একটা বিষ যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে দেহে, জ্বলছে গা হাত পা। আঁধার বিছানায় জ্বালাটা তাপ হয়ে ফুটে উঠছিল ক্রমশ।

দু’-চার মিনিট পর কল্পনা টের পেল সুখেন হাত রেখেছে কাঁধে। টানছে।

ঝটকা মেরে ঘুরল কল্পনা, কী?

যদি খুব রাগ না-করো তো একটা কথা বলি।

ভ্যানতাড়া কোরো না। বলো।

উলুবেড়িয়ায় টেলিফোন অফিসের পাশে এক ডাক্তারদিদি বসছে। মেয়েদের ডাক্তার।

ফের ওই কথা? কতবার বলেছি, ছেলে ডাক্তার হোক, মেয়ে ডাক্তার হোক, কারও কাছে আমি যাব না। কপালে থাকলে এমনিই হবে বাচ্চা। না হলে দরকার নেই।

আহা, অবুঝপনা করো কেন?… জানো, এবার মামাবাবুও বলছিলেন….

মামা?… মামা…?

হ্যাঁ। বলছিলেন, জোর করে তোমায় ডাক্তারের কাছে…

ভেতরের সাপ ছোবল দিয়েই ফেলল। কল্পনা তীব্র স্বরে বলে উঠল, ঢ্যামনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *