আয়নামহল – ১

এক

এইমাত্র সূর্য ডুবে গেল। দিগন্তের ক্যানভাসে এখন কত যে রঙের বাহার! লালের তো ছড়াছড়ি। সিঁদুরে লাল, রক্ত লাল, রক্তিম বেগুনি সঙ্গে মিশেছে পীতাভ কমলা, রজন হলুদ। একটা আধচেনা মভও। আকাশের জমিনে অতিনাবিকনীল আভা। আরও আরও কত যে চোরা রং উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। টুকরো টুকরো পলকা মেঘে বিচ্ছুরিত হচ্ছে রংগুলো।

পরানবিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে দিব্যজ্যোতি নেশাগ্রস্তের মতো দৃশ্যটা দেখছিল। ছবিটা শুষে নিচ্ছিল চোখে। আকাশের এই বিভঙ্গ তার কত অজস্রবার দেখা। জাহাজের ডেক থেকে, এরোপ্লেনের জানলা দিয়ে, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে। আটলান্টিক, ক্যাসপিয়ান, প্রশান্ত মহাসাগর, সাহারা মরুভূমি, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, কোথায় না সূর্যাস্ত দেখেছে সে। তবু তৃষ্ণা মেটে কই! দৃশ্যটা তাকে পিপাসার্ত করে রাখল আজীবন। সে ল্যান্ডস্কেপ আঁকে না। তার বিষয়, মানুষ আর সময়ের জটিল আবর্ত। তবু এই দৃশ্যটা দেখার জন্যই যেন আরও লক্ষ বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে দিব্যজ্যোতির।

অথচ ছবিটা তো উলটো সংকেতই পাঠায়। দিব্যজ্যোতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়, মৃত্যু আরও একটু কাছে এগিয়ে এল। এখনও কত কিছু করা হয়নি জীবনে, কত কী যে পাওয়া বাকি! বড় ছোট্ট এই জীবনটা, বড্ড ছোট।

পরের ভাবনাটাকে অবশ্য বেশিক্ষণ পাত্তা দেয় না দিব্যজ্যোতি। পঞ্চাশে পৌঁছোলে ওরকম শৌখিন মৃত্যুচিন্তা তো একটু আধটু আসেই। হাহ্, আজকালকার দিনে পঞ্চাশ একটা বয়স নাকি! সামনে এখনও অফুরান সময়। দিব্যজ্যোতির শরীরস্বাস্থ্যও যথেষ্ট মজবুত, এখনও সে পাহাড়ি খচ্চরের মতো খাটতে পারে, ছুটে বেড়ানোয় জংলি ঘোড়াকে ও সে হার মানায়, শ্রমিক পিঁপড়ের মতো ব্যস্ত থাকতে পারে কাজে। তার ছ’ফুট লম্বা ঋজু দেহকাণ্ডে, শক্ত পেশিতে, চওড়া কাঁধে, এখনও টগবগ করছে যৌবন। খুচরোখাচরা ফালতু আশঙ্কায় পীড়িত হওয়া তাকে অন্তত মানায় না।

দূরের ক্যানভাস থেকে প্রিয় রংগুলো মুছে যাচ্ছে ক্রমশ। মাঘ শেষের বিকেল ফুরিয়ে এল, এবার আঁধার নামবে। পশ্চিমের আকাশ থেকে মুখ ফেরাল দিব্যজ্যোতি। লম্বাঝুল পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে বার করল টর্চখানা। জ্বালাল। নেবাল। গলা ছেড়ে গান ধরেছে।

গান গাইতে গাইতে হাঁটছে দিব্যজ্যোতি। লম্বা লম্বা পায়ে। মেঠো রাস্তার বন্ধুরতাকে পরোয়া না করে। তার সুরজ্ঞান প্রায় নিখুঁত, প্রতিটি শব্দের উচ্চারণও অতি স্পষ্ট। গানের আবেগে মাথা আন্দোলিত হচ্ছে দিব্যজ্যোতির, প্রসারিত দুই বাহু হঠাৎ হঠাৎ উঠে যাচ্ছে ঊর্ধ্বপানে।

পরানবিলের এদিকটা ভারী শুনশান। বেশ কিছুটা পথ দু’ধারে অনাবাদি জমি, জংলা ঝোপঝাড়। তবু মানুষের দর্শন মিলে যায় মাঝে মাঝে। তারা অনেকেই দিব্যজ্যোতিকে চেনে। কলকাতা থেকে এসে সোনামাটিতে সুবর্ণলতার মতো একটা প্রতিষ্ঠান গড়েছে সে, আশপাশের আর পাঁচটা গ্রামের মেয়ে-বউরাও সেখানে কাজ শিখতে আসে। কাজ শিখছে, করছে, সুবর্ণলতার সূত্রে দুটো-চারটে বাড়তি পয়সা আসছে গরিবগুরবোর সংসারে। বিডিও, পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে জেলা সভাধিপতি, সকলের সঙ্গেই দিব্যজ্যোতির খাতির। স্বয়ং মন্ত্রীমশাই দিব্যজ্যোতির ডাকে সাড়া দিয়ে ঘুরে গেছেন সুবর্ণলতায়। এ হেন ব্যক্তি নির্জন পথে একা একা দু’হাত ছড়িয়ে গান গাইতে গাইতে চলেছে, হাওয়ায় উড়ছে তার কাঁচাপাকা ঝাঁকড়া চুল— দৃশ্যটা দেখে শিহরিত হয় মানুষজন। সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়ে, কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার জানায়।

তা যথেষ্ট ওজনদার হওয়া সত্ত্বেও দিব্যজ্যোতির চালচলনে কিন্তু কণামাত্র উন্নাসিকতা নেই। চেনা হোক, কি অচেনা, পথচলতি সকলের সঙ্গেই গান থামিয়ে দু’-চারটে বাক্য বিনিময় সে করবেই করবে।

কী গো কর্তা, আছ কেমন? পরিবারের সব কুশল তো?

এবার চাষবাসের কী হাল? কপিটপি হল? দাম পাচ্ছ ঠিকঠাক? নাকি সবই দালালদের গভভে যাচ্ছে?

হ্যাঁগো মিঞা, ছেলেকে স্কুল ছাড়ালে কেন? বাগাল খাটাতে চাও নাকি?

এমন আন্তরিক প্রশ্নে বিগলিত হয় গ্রামের মানুষ, দিব্যজ্যোতির প্রতি শ্রদ্ধাভক্তির পারা আপনাআপনি চড়ে যায়।

আজ অবশ্য একটি জনপ্রাণীর সঙ্গেও দেখা হল না। গানের পর গান, গানের পর গান, কণ্ঠচর্চাতেই কেটে গেল পথটুকু।

বিলের দিক থেকে সোনামাটি এলে প্রথমে মুসলমান পাড়া। গ্রামের এপাশটায় এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। ঘরে ঘরে টেমি জ্বলছে। বাতাসে ভাত ফোটার গন্ধ। দ্রুত পায়ে জায়গাটা পার হতে গিয়েও কী ভেবে দাঁড়াল দিব্যজ্যোতি। রাস্তা ছেড়ে সটান ঢুকেছে এক মাটির উঠোনে।

গমগমে গলায় হাঁক পাড়ল, মকবুল? মকবুল আছ নাকি?

কুপি হাতে বেরিয়ে এসেছে মকবুল। বছর চল্লিশ বয়স, রোগা ঢ্যাঙা শরীর, পরনে লুঙ্গি, গায়ে সুতির চাদর। শশব্যস্তভাবে বলল, ছালাম মাস্টারমশাই। সাঁঝবেলায় হঠাৎ আমার ঘরে যে?

দিব্যজ্যোতি রগুড়ে গলায় বলল, কেন? সাঁঝবেলায় আসা মানা নাকি?

তোবা, তোবা। কী যে বলেন! আসেন, আসেন মাস্টারমশাই, আসতে আজ্ঞা হোক।

স্থানীয় মানুষদের মুখে এই মাস্টারমশাই ডাকটা শুনতে দিব্যজ্যোতির বেশ লাগে। অন্য রকম। কলকাতার স্যার সম্বোধনটি দিব্যি এখানে কেমন মাস্টারমশাই হয়ে গেছে। অবশ্য ছাত্রছাত্রীমহলেও সে আর এখন স্যার নয়, দিব্যদা। শুধুই দিব্যদা। বছর দুয়েক হল আর্ট কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকের তকমাটা ঝেড়ে ফেলেছে দিব্যজ্যোতি।

হাসিমুখে দিব্যজ্যোতি এগিয়ে এল, তা চাটাই টাটাই কিছু পাতো, হাত-পা ছড়িয়ে বসি।… আর একটু জল খাওয়াও তো দেখি।

কথাটুকু শুধু বলার অপেক্ষা। মকবুল নির্দেশ দেওয়ার আগেই মকবুলের বিবি সালমা বেরিয়ে এসে পার্টি বিছোতে শুরু করেছে দাওয়ায়। ঘরে গিয়ে জল নিয়ে এল ঘটিতে। বাঁ হাত কনুইয়ে রেখে ডান হাতে ঘটি বাড়িয়ে দিয়েছে।

খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসল দিব্যজ্যোতি। জিনস্ পরা পা দুটো মেলে দিল টানটান। গলায় জল ঢালতে ঢালতে চোখ চলে গেছে সালমায়। আলগা ঘোমটা টানা মুখে আলোছায়ার খেলা। বছর পাঁচেক আগেও দিব্যি লাবণ্যময়ী ছিল সালমা, এখন রীতিমতো চোয়াড়ে। নাকছাবিটা একেবারেই বেমানান লাগে। গাঁ-ঘরের এই মেয়েগুলো যেন তিরিশ পেরিয়েই বুড়িয়ে যায়। অভাবের কারণে কি? নাকি শরীরের যত্নআত্তি নিতে জানে না বলে?

ঘটি ফিরিয়ে নিয়ে সালমা ঘোমটাটা টেনে নিল আর একটু। চেটোর উলটো পিঠে চিবুক মুছল দিব্যজ্যোতি। এবার দৃষ্টি ঘরের দিকে, কী গো, তোমাদের বাড়ি আজ এত চুপচাপ কেন? ছেলেমেয়েগুলো সব কোথায়?

ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সালমা নিচু গলায় বলল, তিন ভাইবোনই গেছে খালার বাড়ি। রসুলপুর। আগের হপ্তায় তাদের খালাতো ভাইয়ের শাদি কিনা।

তাই বলো।… কবে গেল?

এই তো, পরশু।

পরশু? তবে যে কল্পনা বলল, আমিনা দশ-বারো দিন হল সুবর্ণলতায় আসছে না?

সালমা চুপ। মিঞার সঙ্গে কী যেন কথা হল চোখে চোখে। টুকুস সেঁধিয়ে গেল ঘরে।

মকবুল কাশছে খুকখুক। গলা ঝেড়ে বলল, আমিনাকে আর পাঠানো যাবে না, মাস্টারমশাই।

কেন গো?

ওর শাদির ঠিক হয়েছে। এখন মেয়েটার ঘরে থাকাই ভাল।

বলো কী গো! ওইটুকু মেয়ের বিয়ে দেবে?

ওইটুকু কী বলছেন মাস্টারমশাই! পনেরো পুরে ষোলোয় পড়ল। তা ছাড়া… মকবুল একটু সময় নিয়ে বলল, যেচে এসে পছন্দ করল… ছেলের রোজগারপাতিও ভাল… কুলগাছিয়া বাজারে নিজেদের ফলের দোকান…. দাবিদাওয়াও বেশি নেই…। এমন পাত্র হাতছাড়া করি কী করে?

ধ্যাত, তোমরা না…! দিব্যজ্যোতি মাথা ঝাঁকাল, মেয়েটাকে ট্রেনিং ফেনিং দিয়ে তৈরি করলাম, চমৎকার জরির কাজ শিখে নিয়েছিল…। আর দুটো বছর সুবর্ণলতায় থাকলে ওর কত রোজগার হত জানো? নিজের বিয়েশাদির খরচা নিজেই তুলে নিতে পারত।

কী আর করা যাবে, মাস্টারমশাই? আমিনার কপালে নাই।

কপাল কপাল কোরো না তো। মেয়ের কপাল তো তোমরাই নষ্ট করছ।

দিব্যজ্যোতির ঝাঁঝে এতটুকু হেলদোল নেই মকবুলের। উদাসীন স্বরে বলল, ছাড়েন না মাস্টারমশাই। যা হবে না, তা ভেবে কী লাভ? … চা খাবেন?

না।

রাগ করেন কেন, মাস্টারমশাই? আপনার মতো মানী লোক মুখ ফেরালে আমরা গরিবরা যাই কোথায়!

গ্যাস দিয়ো না, আমায় ফোলাতে পারবে না। মানী লোকই যদি ভাবো, বিয়েশাদি ঠিক করার আগে আমার সঙ্গে একবার পরামর্শ করতে পারতে। আমি তো ফি হপ্তাতেই আসি। আসি না? দিব্যজ্যোতি গজগজ করছে। গোমড়া মুখে বলল, অঘ্রান মাসে সরস্বতীটা চলে গেল। কী সুন্দর কাঁথাস্টিচের কাজ করছিল, সবাই ধন্য ধন্য করত। ওই একরত্তি মেয়েটাকে একটা আধবুড়ো পয়েন্টসম্যানের গলায় ঝুলিয়ে দিল! ব্যস, খেল খতম, পয়সা হজম, ভবিষ্যতের বারোটা।

তা কেন মাস্টারমশাই? শিক্ষা তো কাজে লাগেও। দরকার হলে ঘরসংসার করেও তো…

হুম। ওইসব সাত পাঁচ ভেবেই তো আমার সুবর্ণলতা তৈরি করা। দিব্যজ্যোতি ঠোঁট কুঁচকোল, যাক গে যাক, আমি বললেও তো তোমরা কেউ শুনবে না, আইনকানুন না মেনে পনেরো-ষোলো বছরেই মেয়েগুলোর বিয়ে দিয়ে দেবে। এতে যে মেয়েদের কত ক্ষতি হয়, তা সরস্বতীর বাবাও বোঝেনি, তুমিও বুঝবে না।

মকবুল করুণ মুখে বলল, কী করি মাস্টারমশাই? দেশগাঁয়ের রীতি তো মানতে হবে।

মানো। দুষ্ট রীতি আঁকড়ে বসে থাকো। আমি কিন্তু রাগ করেছি, সাফ বলে দিলাম। দু’-চার সেকেন্ড ঝুম হয়ে রইল দিব্যজ্যোতি। ফের বলল, যাক গে, আমার কিছু মান তো রাখবে? আমিনা যে কাজটা ধরেছিল, সেটা অন্তত শেষ করে আসুক।

মকবুল মাথা চুলকোল, ক’দিন লাগবে?

কত আর! তিন-চার দিন।

ঠিক আছে। রসুলপুর থেকে ফিরলেই পাঠিয়ে দেব। তবে ওকে কিন্তু আর নতুন কাজ দিতে মানা করে দেবেন, মাস্টারমশাই।

হুম।

আর একটা কথা, মাস্টারমশাই। বলছিলাম… আমিনার শাদি মিটে গেলে যদি আমিনার মা সুবর্ণলতায় যায়… সেলাইফোঁড়াইয়ের কাজ ও শিখে নিতে পারবে না?

দিব্যজ্যোতি হা-হা হেসে উঠল, এই তো, পথে এসেছ! তোমার বউয়েরও তবে রোজগারপাতির সাধ জেগেছে?

মকবুল লজ্জা লজ্জা মুখে হাসল।

আমি তো এইটাই চাই। তোমাদের ভালর জন্যই চাই। তোমরাই শুধু বুঝতে চাও না।… ও কে। কোনও সমস্যা নেই, তোমার বিবিকে কল্পনার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। ঘরের মেয়ে-বউদের জন্য সুবর্ণলতার দরজা তো খোলাই থাকে।

তা হলে এবার একটু কালো চা করতে বলি? চিনি ছাড়া?

দিব্যজ্যোতির মনে হল, জিভটা একটু চা-চা করছে বটে। কিন্তু গাঁ- ঘরের লোক লিকার চা করতেই জানে না। সস্তা দামের গুঁড়ো চা জলে ফুটিয়ে একটা হাকুচতেতো ক্বাথ বানায়।

হেসে বলল, না না, তোমাদের কষ্ট করার দরকার নেই। গলাটা বড্ড শুকিয়ে যাচ্ছে, আবার একটু জল খাওয়াও।

জল শেষ করে দাওয়া থেকে নেমেছে দিব্যজ্যোতি, আচমকাই পৃথিবীটা কেমন দুলে গেল। নাকি মাথাটা? দু’-চার সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে সামলাল নিজেকে। তারপর মকবুলের উঠোন পেরিয়ে পায়ে পায়ে রাস্তায়। ক্রমশ গতি বাড়াল। ঠান্ডাটা এবার কমে গেছে হঠাৎ, তবু কেমন যেন শিরশিরানি জাগছে দেহে। যেন বিদ্যুতের হালকা তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে শিরা বেয়ে। হলটা কী? দুপুরে ফুলকপি দিয়ে কইমাছ রেঁধেছিল কল্পনা। মাঘের কপি হজম করা কঠিন, অবেলায় খেয়ে গ্যাসট্যাস হল না তো? কিন্তু এতক্ষণ তো কোনও উপসর্গ ছিল না?

কবে এলেন, মাস্টারমশাই?

চিন্তায় ছেদ পড়ল। সামনে শ্যামল গুছাইত। পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য। সোনামাটিরই বাসিন্দা। হাতে চার সেলের একখানা গাবদা টর্চ বাগিয়ে কোথায় যাচ্ছিল কে জানে, দিব্যজ্যোতিকে দেখে দাঁড়িয়ে গেছে। অগত্যা দিব্যজ্যোতিকেও থামতে হয়।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে দিব্যজ্যোতি বলল, এই তো, আজ সকালবেলা।

থাকছেন নাকি কয়েক দিন?

ইচ্ছে তো আছে। বলেই একটা দরকারি কথা মনে পড়ে গেছে। জিজ্ঞেস করল, সুবর্ণলতার টিউবওয়েলের ব্যাপারটা কদ্দূর এগোল ভাই?

স্যাংশন তো হয়ে গেছে। দু’-এক মাসের মধ্যেই বসে যাবে।… আপনি চেয়েছেন, সরকার দেবে না, এ কি হয়?

সূক্ষ্ম শ্লেষটা দিব্যজ্যোতির কান এড়াল না। শ্যামল গুছাইতের এখনও তার ওপর কিঞ্চিৎ ক্ষোভ আছে, সে জানে। সুবর্ণলতা শুরু করার সময়ে শ্যামল যথেষ্ট বাগড়া দিয়েছিল। বাস রাস্তার ধারে কী করে এক লপ্তে পাঁচ একর জমি পেয়ে গেল একটা বাইরের লোক, তা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করেছিল বিস্তর। পরে অবশ্য পার্টির ওপরতলা থেকে ধমকটমক খেয়ে সে প্রশমিত হয়। এখন টুকটাক টিপ্পনী কেটেই বেচারার সুখ।

দিব্যজ্যোতি শব্দ করে হেসে উঠল, আরে দুর, আপনারা চেয়েছেন বলেই সুবর্ণলতা হয়েছে। চলছেও আপনাদেরই অনুগ্রহে। আসলে সুবর্ণলতা তো আপনাদেরই। আমি নিমিত্ত মাত্ৰ।

হ্যাঁ। সে তো বটেই।

আমার কিন্তু আর একটা আবদার আছে ভাই। টিউবওয়েলটা যেন বাইশ পাইপের হয়। মেয়েগুলো অত দূর দূর থেকে আসে, ওদের জলটুকু যদি হাইজেনিক না হয়… লোকাল লোকেরও তো পানীয় জলের ভাল একটা সোর্স হবে।

কিন্তু… আঠারো পাইপের বেশি তো এখন কোথাও দেওয়া হচ্ছে না। শ্যামলের কণ্ঠে ফের শ্লেষ, আপনারও তো ভাল ফান্ড আছে, সেখান থেকে কিছু ঢালুন না। বাইশ কেন, তা হলে চল্লিশ পাইপও হয়ে যায়।

এবারও চটল না দিব্যজ্যোতি। হেসেই বলল, সে তো দেওয়াই যায়। তবে ওই টাকা ক’টা হাতে থাকলে আপনাদের সুবর্ণলতায় আরও কতগুলো মেয়েকে প্রোভাইড করা যায়, সেটাও ভাবুন। প্লাস, ডাইভারসিফিকেশনের কাজটা তো প্রায় থেমেই আছে। বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য বজায় রেখে সুবর্ণলতা সফট্ টয় বানাবে, মুখোশ তৈরি করবে…. জুট নিয়েও একটা প্ল্যান ভাবা হচ্ছিল…

ভাল তো। এগিয়ে যান। শ্যামল কবজিতে ঢাউস টর্চ মেরে সময় দেখল, আমরা তো আছিই। আপনার পাশে পাশেই আছি।

ঘাড়ের ওপরেই আছি! বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল দিব্যজ্যোতি। হাসতে হাসতেই বলল, আমার কমেন্ট কিন্তু সিরিয়াসলি ধরবেন না ভাই। পাগল-ছাগল মানুষ, উলটোপালটা বলে ফেলি…। আসুন না কাল- পরশুর মধ্যে একদিন। আমার দুই ছাত্র এসেছে… খুব প্রমিসিং স্কাল্পটার। এখানকার কুমোরপাড়ার শিল্পীদের নিয়ে দিন তিনেকের একটা ওয়ার্কশপ করাব ভাবছি। এলে ছেলে দুটোর সঙ্গে আপনার আলাপ হয়ে যাবে।

দেখি। পারলে যাব।

শ্যামলকে পেরিয়ে কয়েক পা যেতে না-যেতেই ফের মাথায় একটা ছোট্ট চক্কর! মুহূর্তের জন্য দিব্যজ্যোতির মনে হল পা দুটোও যেন টলে গেল। কী হচ্ছেটা কী? প্রেশার টেশারে ধরল নাকি? বছর পনেরো আগে স্পন্ডিলোসিস হয়েছিল, ভুগিয়েছিল বেশ কিছুদিন, ব্যায়াম ট্যায়াম করে চাপা দিয়েছিল তখনকার মতো। ইদানীং শরীরচর্চা হয় না নিয়মিত, রোগটা কি আবার ফিরে এল! নাহ্, কাল থেকে ঘাড় গলা মাথার কসরতটা চালু করতে হবে।

ধীর লয়ে মন্দিরপাড়ার পাঁচ-ছ’খানা পাকাবাড়িকে পিছনে ফেলে, বাস রাস্তার ওপারে, সুবর্ণলতায় এসে পৌঁছোল দিব্যজ্যোতি। স্বর্ণলতায় ছাওয়া কাঠের সুদৃশ্য ফটক ঠেলে পা রাখল প্রাঙ্গণে। দরজাটা ধরে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল স্থাণুবৎ। হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প।

সুবর্ণলতার রূপটি ভারী স্নিগ্ধ। ঢোকার মুখেই মাথা ঝুঁকিয়ে দুই দ্বাররক্ষিণী। রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া। বিশাল কম্পাউন্ডকে ঘিরে থাকা উঁচু পাঁচিলের ভেতরপানে সার সার সবুজ পাহারাদার। কদম শিমুল পলাশ বকুল ছাতিম কাঁঠালিচাঁপার পাশে নিম আম জাম শ্যাওড়া শিরীষ হিজলের দল। আছে মহুয়া। আছে জারুল। আছে মুচকুন্দ, আছে নাগকেশর। ফটকের একদম সামনেটাতে ঘাসের নরম গালিচা, তাকে বেড় দিয়ে ফুলের বাগান। মরশুমি ফুল, বারোমেসে ফুল, কিছুই সেখানে অচ্ছুৎ নয়। বেল জুঁই কামিনী গন্ধরাজের সৌরভে ম-ম করে গ্রীষ্ম বর্ষা, শীত হেমন্তে ডালিয়া গাঁদা চন্দ্রমল্লিকার শোভায় চোখ জুড়িয়ে যায়। সযত্ন নির্মিত রাঙা মাটির পথ সদর থেকে চলে গেছে অন্দরে, ঘুরে এসে ফের ফটকেই মিশেছে। পথের ধারে খানবারো কুঁড়েঘর, অর্ধচন্দ্রাকারে সাজানো। ঘরগুলো অবশ্য নিখাদ মাটির নয়। ভিত খোঁড়া, ইটের গাঁথনি, সিমেন্টের প্রলেপ, ছাদ ঢালাই, সবই হয়েছিল। দৃশ্যমান চালটুকুই শুধু খড়ের। দেওয়ালের রংও মাটি বলেই ভ্রম হয়। মধ্যিখানে অফিস, বাঁ দিকের ঘরগুলোতে কাজ করে মেয়েরা, ডান দিকে থাকার জায়গা। অতিথিদের। দিব্যজ্যোতির। আর কল্পনা-সুখেনের। পিছনে চওড়া চাতাল, কুয়োতলা, মালি চৌকিদারদের আস্তানা, হাঁস-মুরগির মিনি খামার, সবজিখেত। পুকুরটির বাহার আছে। গোল নয়, চৌকো নয়, কাটা হয়েছে নদীর ছাঁদে। আঁকাবাঁকাভাবে। নীল হলুদ লাল কমলা শাপলা ফোটে জলে। ওপারের সবজিখেতে যেতে একখানা বাঁশের সাঁকো পেরোতে হয়। সব মিলিয়ে সুবর্ণলতা সত্যিই যেন তুলির টানে আঁকা ছবি। দিব্যজ্যোতির নিজের হাতে ফুটিয়ে তোলা একমাত্র ল্যান্ডস্কেপ।

লাল মাটির পথ ধরে দাওয়ারূপী বারান্দায় উঠে দিব্যজ্যোতি দেখল, গেস্টরুমে অনুপল আর সাগ্নিক দাবায় মগ্ন। রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁকছোঁক শব্দ আসছে, সম্ভবত রাতে কোনও নতুন পদ বানাচ্ছে কল্পনা।

নিজের খাটে গিয়ে শুলেই বুঝি দিব্যজ্যোতির ভাল লাগত একটু। তবু অনুপলদের ঘরেই ঢুকল সে। যৌবনের সান্নিধ্য তার ক্লান্তি হরণ করে নেয়।

হালকা গলায় দিব্যজ্যোতি বলল, ভরসন্ধেবেলা তোরা বুড়োদের মতো দাবা নিয়ে বসেছিস! ছ্যা ছ্যা।

খেলা থেমেছে। সাগ্নিক একগাল হাসল, না দিব্যদা, জাস্ট টাইম পাস্। আপনি আমাদের ফেলে হাওয়া হয়ে গেলেন…

কপচাস না। দিব্যজ্যোতি বেতের চেয়ার টেনে বসল, যা একখানা ভাতঘুম দিচ্ছিলি, বাপস্। পাল্লা দিয়ে দু’জনের নাক ডাকছিল।

অনুপল দাবার গুটিগুলো গুছিয়ে রাখছে বাক্সয়। ঘাড় দুলিয়ে বলল, হুম, দুপুরের খাওয়াটা খুব বেশি হয়ে গিয়েছিল।

কাল সুবর্ণলতার পুকুরের মাছ খাওয়াব। সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বসে যাব ছিপ নিয়ে।

যদি মাছ না ওঠে?

উঠবে, উঠবে। সুখেন দারুণ চার বানায়। দিব্যজ্যোতি বেঁটে টেবিলটায় পা তুলে দিল, তারপর বল… ঘুম থেকে উঠে করলিটা কী?

আপনার বাগানেই চরে বেড়াচ্ছিলাম।

জঙ্গল বল। সাগ্নিক অনুপলকে শুধরে দিল, গাছে গাছে খুদে অরণ্য।

দিব্যজ্যোতি চোখ তেরচা করল, বড় গাছ ক’টা আছে গুনেছিস?

টোটাল এরিয়ায়? গুনে শেষ করা যাবে?

এমন কিছু তো বেশি নয়। সামনে পেছনে মিলিয়ে সিক্সটি নাইন।

কাউন্ট করে লাগিয়েছেন?

ইয়েস মাই বয়েজ। আমার পহেলা গার্লফ্রেন্ড ঊনসত্তর বছর বয়সে মারা গিয়েছিল। তার স্মৃতিটা ধরে রেখেছি।

অনুপল আর সাগ্নিক চোখ চাওয়াচাওয়ি করছে। দিব্যজ্যোতি হো হো হেসে উঠল, ওরে গাড়ল, ছেলেদের পয়লা গার্লফ্রেন্ড কে হয়? ঠাকুমা, অর দিদিমা। ঠাকুমা তো আমার জন্মের আগেই ফুটুস। সো… ইট ওয়াজ মাই দিদিমা। সুবর্ণলতা গুহরায়। বুড়ি আম খেতে খুব ভালবাসত, তাই আমগাছই আছে চোদ্দোখানা। অল ডিফারেন্ট ভ্যারাইটি। হিমসাগর, ক্ষীরসাপাতি, বেগমফুলি, ল্যাংড়া, ফজলি, মধুকুলকুলি….

কথার মাঝেই আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে এসেছে কল্পনা। শ্যামলা রং, আঁটোসাঁটো চেহারা, মুখচোখ সুশ্রী হলেও কেমন যেন রসকষহীন। উদ্ধত যৌবনে এক ধরনের রুক্ষতা আছে। চাঁছাছোলা গলায় দিব্যজ্যোতিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন চা খাবে, মামা?

এদের দিয়েছিস?

তিনবার। আলুপকোড়া ভেজেছিলাম। ফিনিশ। তুমি এত দেরি করলে?

মকবুলের ওখানে গিয়েছিলাম।

আমার কথা মিলেছে? সরস্বতীর কেস?

হুম। তাই তো দেখছি। দিব্যজ্যোতি মাথা নাড়ল, তবে কাজটা তুলে দিয়ে যাবে।

দিলেই ভাল।… চা বসাব?

থাক। তুই বরং আমাদের গ্লাস বোতল দিয়ে যা।… আমার ঘরে গিয়ে ব্যাগটা খোল, দুটো হুইস্কি আছে…

এক্ষুনি টানতে বসে যাবে?

বেশি গার্জেনি ফলাস না তো। যা। সঙ্গে পেঁয়াজ শশা কুচিয়ে দিবি। সুখেন দুপুরে ক’টা কুচো মাছ তুলেছিল না?

রাতের জন্য ভেজেছি।

দিয়ে দে এখন।… রাতে কী মেনু?

তোমার জামাই একটা মোরগা কেটেছে। ভাত আর মোরগার ঝোল। আর স্যালাড।

ফাইন।… ও-ঘর থেকে আমার সিগারেট দেশলাইটাও নিয়ে আসিস।

কল্পনা কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেল।

তার গমন ভঙ্গিটি দেখে অনুপল ফিকফিক হাসছে, আপনার সুবর্ণলতার কর্ত্রীটি কিন্তু বেশ জাঁদরেল। মিলিটারি টাইপ।

সেইজন্যই তো ওকে এখানে আনা। এইসব প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে কড়া ধাতের লোক দরকার। আর জানিসই তো, কড়া হওয়া আমার নেচারে নেই…। দিব্যজ্যোতি চেয়ারের কাঁধে হাত ছড়িয়ে দিল, কল্পনা আমাদের বাড়িতে কাজ করত। খুব ছোটবেলা থেকে মা’র সঙ্গে আসত কাজে। ইন ফ্যাক্ট, ওর মা-ই ছিল আমাদের হাউসমেড। মেয়েটাকে স্কুলে ভরতিও করে দিয়েছিলাম, ক্লাস সিক্সের বেশি এগোতে পারেনি। তারপর বড় হল… বিয়েটিয়ে দিয়ে দিলাম। বরটা বোকার বেহদ্দ। দুটোকেই যতে দিয়েছি এখানে। কল্পনাই সুখেনকেও খাটায়।

অনুপল চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, এখানকার হিসেবপত্র, হ্যানাত্যানা, সব ও সামলাতে পারে?

আরে না। আমিই দেখি। হিসেবপত্রর জন্য একটা আলাদা লোকও আছে। সপ্তাহে দু’দিন করে এসে খাতা বিল ভাউচার লিখেটিখে যায়। কল্পনা দেবী আছেন তর্জন-গর্জনের জন্য। বলতে পারিস, আমার ডাকসাইটে সুপারভাইজার। ওর ভয়ে লোকাল বাচ্চাকাচ্চারাও ফল চুরি করতে সাহস পায় না। আমি গাঁয়ে এসে আম-জামটা বিলোই বলে মহারানির কী রাগ!

সাগ্নিক খাট থেকে নেমে জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখছে বাইরেটা। ঘরের আলো জানলা পেরিয়ে খানিক গিয়েই দীপ্তি হারিয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সাগ্নিক বলল, আপনার কম্পাউন্ডটা কিন্তু বড্ড অন্ধকার। ভেতরে সার্চ লাইট গোছের কিছু লাগাতে পারেন।

মাথাটা একটু যেন ঝিমঝিম করছে আবার। উপেক্ষা করে দিব্যজ্যোতি হাসল, এফেক্টটা ভাল হবে না। আমার কনসেপ্টটাই মার খেয়ে যাবে। তোদের মনে আছে, ক্লাসে আমি একটা কথা বারবার বলতাম? ডার্কনেস হ্যাজ ইটস ওউন বিউটি। সেই সৌন্দর্যটা আলোর সৌন্দর্যের চেয়ে কিছু কম নয়। …সত্যি বলতে কী, আলোর চেয়ে অন্ধকারই মানুষের কল্পনাকে বেশি স্টিমিউলেট করে। রাত্তিরবেলা বাইরে বেরিয়ে দেখিস… বাতাসের শব্দ, পাতা পড়ার আওয়াজ, রাতচরা পাখির ডাক, নেভি-ব্লু স্কাই উইথ লাখ লাখ তারা এবং চারপাশটাকে ভাল করে দেখতে না-পাওয়া… সব ক’টার কম্বিনেশনে কেমন এক পিকিউলিয়ার অনুভূতি তৈরি হয়। মাঝখানে একটা ধ্যাবড়া আলো দিলে সব যাবে ভোগে। এখানে ইলেকট্রিসিটি আনারই আমার ইচ্ছে ছিল না। নেহাত মেয়েগুলো কাজকর্ম করে, আলো পাখা থাকলে ওদের একটু সুবিধে হয়….

কল্পনা ট্রেতে মাছ ভাজা, শসা, পেঁয়াজ নিয়ে ঢুকল। পিছন পিছন সুখেন, হাতে পানীয়র সরঞ্জাম। হুইস্কির বোতল, গ্লাস, জলের জগ নামাল টেবিলে। বিনীত স্বরে জিজ্ঞেস করল, আমি ঢেলে ঢেলে দেব, মামাবাবু?

কল্পনা ভারিক্কি গলায় বলল, আমি এদিকটা দেখছি। তুমি যাও, ভাতটা ফুটে গেছে, নামিয়ে ফেলো।

পাজামা শার্ট পরা খয়াটে চেহারার লোকটা চলে যাচ্ছিল, ঘুরে এল আবার। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই বার করে দিব্যজ্যোতির হাতে দিয়ে বলল, মাত্র পাঁচটা আছে। এনে দেব আর?

দু’-এক সেকেন্ড চোখ কুঁচকে ভাবল দিব্যজ্যোতি। তারপর বলল, নাহ্। রাতে আর তোকে বেরোতে হবে না। চালিয়ে নেব

কল্পনা নিপুণ হাতে বোতলের ছিপি খুলে ফেলেছে, মেপে মেপে ঢালছে গ্লাসে। আবার মুখ বন্ধ করতে করতে বলল, তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল, মামা।

দিব্যজ্যোতি ঠোঁটে সিগারেট চাপল, কী?

সুবর্ণলতায় এবার একটা ফোন নিলে হত না?

কী হবে ফোন দিয়ে? কলকাতায় কার সঙ্গে তুই গপপো করবি?

আমার দরকার নেই। তোমার জন্যই বলছি। খবরাখবর নিতে পারবে।

দুর পাগল, খবর নিতে তো আমি নিজেই চলে আসছি।

না, বাইরেও তো যাও। এই তো, পুজোর পর দিল্লি গেছিলে…

দু’-চার সপ্তাহ আমি খোঁজ না-নিলে সুবর্ণলতা মরে যাবে না রে ভাই!

তবু… কত কিছু বলার থাকে….

কিচ্ছু বলার নেই। ভাগ তো। জানিস না, আমি ফোন-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। নেহাত বাড়িতে একটা রাখতে হয় তাই… আমি মোবাইল পর্যন্ত নিইনি। হবে না ফোন। ফোট।

হ্যাট হ্যাট করছ কেন? কল্পনা চোখ পিটপিট করল, এবার কিন্তু যাওয়ার সময়ে মাল বেশি পাবে না, আগে থাকতে বলে রাখলাম। তোমার দু’খানা নকশি কাঁথার এখনও অর্ধেক দশা… পটও পাবে তুমি বড়জোর…

দুপুরে তো একবার কথা হল, না কী? এক কথা বারবার না বললে সুখ হয় না?

দিব্যজ্যোতির গলা হঠাৎই চড়ে গেছে। আহত মুখে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল কল্পনা, তারপর বেরিয়ে গেল গাল ফুলিয়ে।

অনুপল বলে উঠল, হঠাৎ রেগে গেলেন কেন, দিব্যদা?

ধুত, কানের কাছে ট্যাকট্যাক ট্যাকট্যাক… ভাল্লাগে না। দিব্যজ্যোতি সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলল। নিজের মনে বলল, শরীরেও আজ ঠিক জুত নেই…

কী হল?

কীরকম একটা অস্বস্তি… বোধহয় গ্যাসট্যাস… মাথাটাও কেমন করছে…

তা হলে আবার সিগারেট ধরালেন কেন?… মাঝে তো নেশাটা বেশ ছেড়ে দিয়েছিলেন।

রাখ তো, আমি ঠিক আছি। দিব্যজ্যোতি সোজা হয়ে বসল,— নে, গ্লাস তোল। লেটস সেলিব্রেট দা ইভনিং।

একসঙ্গে তিনটে পানপাত্র উঠল শূন্যে, উল্লাস!

সাগ্নিক গ্লাসে ছোট্ট চুমুক দিল, কাল তা হলে আমাদের কী কী প্রোগ্রাম?

সকালে মাছ ধরা। দুপুরে কুমোরপাড়া। দিব্যজ্যোতি বেশ খানিকটা হুইস্কি ঢালল গলায়। —তোমরা ওদের হাতের কাজ ভাল করে দেখে নেবে। আমি জানি, দে আর গুড, যথেষ্ট সূক্ষ্মতাবোধ আছে। স্টিল, তোমরাই যখন ওয়ার্কশপটা চালাবে, তখন সামনাসামনি ওদের সঙ্গে আলোচনা খুব জরুরি।… বাই দা বাই, বলে রাখছি, ওয়ার্কশপটা হবে তিন দিনের। এবং এর জন্য তোমরা যৎকিঞ্চিৎ সম্মানদক্ষিণা পাবে!

টাকাপয়সা আবার আনছেন কেন দিব্যদা? আপনার একটা ভাল কাজে জয়েন করতে পারছি… প্লাস, তিন দিন চুটিয়ে হইহই করব…

বাকতাল্লা ছাড়ো। তারপর তো কলকাতায় গিয়ে খিস্তি মারবে, দিব্যদা ছাত্রদের মাথায় হাত বুলিয়ে খাটিয়ে নিল! দিব্যজ্যোতি হা হা হেসে উঠল। চোখ টিপে বলল, ফোকটে করলে আন্তরিকতা থাকে না রে, আমি জানি।

অনুপল আর সাগ্নিকও হেসে ফেলেছে। অনুপল গ্লাসে আর একটু জল মেশাতে মেশাতে বলল, একটা ব্যাপার আমাদের কিন্তু খুব স্ট্রেঞ্জ লাগে, দিব্যদা। আপনি এখানে… এত জায়গা থাকতে এই সোনামাটিতে এসে প্রতিষ্ঠান খুললেন কেন?

মাথার ঝিমঝিম ভাবটা বাড়ছে কি? দিব্যজ্যোতি ঘাড় ঝাঁকিয়ে নিজেকে খানিকটা স্থিত করার চেষ্টা করল। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, বলতে পারিস এটা একটা চান্স ফ্যাক্টর। সুবর্ণলতার প্রোজেক্টটা নিয়ে অনেক দিন ধরেই গভর্নমেন্টের দরজায় হত্যে দিয়ে পড়ে ছিলাম। এখানে ঘুরছি, সেখানে ঘুরছি, একে ধরছি, তাকে ধরছি… সরকারি লোকজন তো, কেউ গা-ই করে না। হঠাৎই উড়ো খবর পেলাম, হাওড়া ডিস্ট্রিক্টে নাকি একটা এন জি ও-র জন্য খানিকটা জমি অ্যালট করা আছে, কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত নেয়নি। ব্যস, আমার কপাল খুলে গেল।… প্রথমে এত ইন্টিরিয়ারে দেখে একটু মন খুঁতখুঁত ছিল। তারপর ভেবে দেখলাম, কলকাতা থেকে কী আর এমন দূর? বাগনান তো ট্রেনেই আসা যায়, সেখান থেকে বাসে মিনিট চল্লিশ। আর আমি তো যাতায়াত করব গাড়িতে, ম্যাক্সিমাম দু’ঘণ্টা। তা ছাড়া সত্যিকারের কাজ করতে হলে তো এরকম…

দিব্যজ্যোতি থেমে গেল আচমকা। তার কি কথা জড়িয়ে যাচ্ছে? জিভটা আলগা আলগা লাগে কেন? নেশা হয়ে গেল? প্ৰথম পেগ ফুরোনোর আগেই?

অসম্ভব। হতেই পারে না। ঢক করে গ্লাসের তরলটুকু গলায় ঢেলে দিল দিব্যজ্যোতি। চেয়ারে মাথা রেখে জোর করে কথা আনল গলায়, তোরা হয়তো বলবি, হঠাৎ মাথায় সুবর্ণলতার ভূত চাপলই বা কেন?… বহুকাল ধরেই একটা সংকটে ভুগছিলাম রে। ইনার ক্রাইসিস। মেন্টাল ক্রাইসিস। আত্মিক সংকট। খালি মনে হত, কী করছি? কী-ই করছি? এই যে জীবনটা পেয়েছি, এর মানে কী? উদ্দেশ্য কী? শুধু ছবি এঁকে আর কলেজে ক’টা ক্লাস নিয়ে লাইফটা কাটিয়ে দেওয়া? পয়সা আসছে এসব করে, কিন্তু মনের খিদেটা মিটছে কোথায়! ভেতরের সমস্ত এক্সপ্রেশনগুলো কোথায় যাচ্ছে? কারা কিনছে? দিব্যজ্যোতি সিংহ কি আস্তে আস্তে গোটা কতক মাথামোটা বড়লোকের বাড়ির দেওয়ালে শো পিস হয়ে যাচ্ছে না? আমি কি এটাই চেয়েছিলাম? টাকা কামাব, খাবদাব, বেড়াব, ফুর্তি করব…? বুকে একটা সাইরেন বাজত সারাক্ষণ। বিলিভ মি। কে যেন বলত, আর নয়, আর নয়, শুধু নিজের জন্য বাঁচা এবার থামাও দিব্যজ্যোতি। মানুষের জন্য বাঁচো। মানুষের জন্য করো কিছু। আমিও ভেবে দেখলাম…

নাহ্, জিভটা কিছুতেই আর বাগে থাকছে না, উলটেপালটে যাচ্ছে। আবার শিরায় সেই বিদ্যুৎত্তরঙ্গ বয়ে যাওয়ার অনুভূতি।

দিব্যজ্যোতি একটা হেঁচকি তুলল, অ্যাই, আমায় শসার প্লেটটা বাড়িয়ে দে তো।

সাগ্নিক সঙ্গে সঙ্গে ডিশ বাড়িয়ে ধরেছে। দিব্যজ্যোতি হাত রাখল প্লেটে। কিন্তু শসা তুলল না। তুলতে পারল না। খামচাচ্ছে শসাগুলোকে, আমার কীসের পিছুটান, বল? বউ ভেগে গেছে। নো ছেলেপুলে। আছে শুধু মা, সেও থাকে নিজের মেজাজে। আমি আর কেন টাকার পেছনে ছুটব? তখনই দিদিমার কথা মনে পড়ল। দিদিমা খুব বলত, আমাদের দেশের মেয়েরা বড় অসহায় রে, পারলে তাদের জন্য কিছু করিস। ওখান থেকেই সুবর্ণলতার আইডিয়াটা মাথায় এল। ভাবলাম, যদি কিছু করার স্বপ্ন দেখতেই হয়, বড় মাপের স্বপ্নই দেখি। শুধু মেয়েরা কেন, গাঁয়ের আর পাঁচটা গরিব মানুষদের নিয়ে… কামার, কুমোর, তাঁতি…. সব্বাইকে নিয়ে এখানে একটা শিল্পগ্রাম…

দিব্যজ্যোতির ঘাড় ঝুপ করে হেলে গেল। জিভ আর নড়াচড়া করছে না। পেচ্ছাপ পাচ্ছে হঠাৎ, অথচ ওঠার ক্ষমতা নেই। যাহ্, বেরিয়েই গেল।

প্রাণপণ চেষ্টায় চোখের পাতা দুটো ঈষৎ ফাঁক করতে পারল দিব্যজ্যোতি। অনুপল আর সাগ্নিককে খুঁজছে। মুখ দুটো একদম সামনে এগিয়ে এসেছে যেন। কিন্তু অসম্ভব ঝাপসা। কেউ কি হাত রাখল গায়ে? ডাকছে কি কেউ?

অস্পষ্ট মুখ দুটো মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ফুটে উঠল এক অসীম ক্যানভাস। তুলির টান পড়ছে ক্যানভাসে। ভারমিলিয়ান রেড, গ্যাম্পোজ ইয়েলো, ক্যাডমিয়াম অরেঞ্জ, ক্রিমসন, স্কারলেট, পার্পল, মভ, আলট্রামেরিন ইন্ডিগো…!

বর্ণময় ক্যানভাসে সূর্যাস্ত হচ্ছে আবার। ধীরে ধীরে অন্ধকার। সব অন্ধকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *