আয়নামহল – ২

দুই

কী হল পৃথাদি, দৌড়োচ্ছ কেন? মুখেচোখে একটু জলও তো ছেটালে না!

সময় নেই রে। আমার ময়নারানি আজ ডুব মেরেছেন। টুকুসের স্কুল বাস চলে এলে কেলেঙ্কারি হবে।

ক’টায় আসে বাস?

সাড়ে চারটে… চারটে পঁয়ত্রিশ…। কবজিতে চোখ ফেলে পৃথা ফের ছটফট করে উঠল, লাস্ট বেলটা যে কেন আজ দেরিতে পড়ল!

বলতে বলতে পৃথা ঝড়ের গতিতে স্টাফরুমের বাইরে। প্রায় লাফাতে লাফাতে রাস্তায়। উফ্, শুক্রবারের সেভেনথ পিরিয়ডটা যেন এক বিভীষিকা। টিফিনের আগে পরপর তিনটে ক্লাস, টিফিনের পর আবার তিনটে, শেষ পিরিয়ডে আর শরীর চলে? তাও বাংলা-ইংরেজি- ইতিহাস-ভূগোল হলে একটা কথা ছিল। চেয়ারে বসে খানিক বকবক করে চল্লিশটা মিনিট তবু কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু অঙ্ক বড় কঠিন ঠাঁই। সেই চক হাতে উঠে দাঁড়াতেই হবে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করতেই হবে, সঙ্গে গলার অনন্ত ব্যায়াম। নতুন হেডমিস্ট্রেসের আক্কেলেরও বলিহারি, পৃথার এই শেষ ক্লাসটা এবার বেছে বেছে কিনা ইলেভেনকেই দিতে হল? ধাড়ি ধাড়ি মেয়েগুলো পর্যন্ত এই শেষবেলায় ক্লান্তিতে ঢুলতে থাকে, গজাল মেরে মেরে তাদের মাথায় এখন বাইনোমিয়াল থিয়োরেম ঢোকানো যে কী পরিশ্রমের কাজ! নাহ্, অমিতাদির প্র্যাকটিকাল সেন্স একেবারে জিরো।

সরু গলি পেরিয়ে, স্টেট ব্যাঙ্কটা টপকে, পৃথা হাঁপাতে হাঁপাতে বাস স্টপে এল। কপাল ভাল, দাঁড়াতে না-দাঁড়াতেই আজ সন্তোষপুর মিনি। যথারীতি বসার জায়গা নেই, দাঁড়িয়েছে ড্রাইভারের পিছনটায়। ঘড়ি দেখে এবার স্বস্তি পেল একটু। চারটে চোদ্দো। যাদবপুর মোড়ে জ্যামে না-আটকালে মনে হয় ঠিকঠাক পৌঁছে যাবে।

ব্যাগ খুলে একটা পাঁচ টাকার নোট বার করল পৃথা। রুমালটাও। কনডাক্টরকে টাকাটা এগিয়ে দিয়ে রুমালে মুখ মুছছে। ফাল্গুনের গোড়াতেই বেশ গরম পড়ে গেল, বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ ঝলসাবে নির্ঘাত। কণাদ বলছিল, এবার শোওয়ার ঘরে একটা এ.সি লাগাবে। কিনে ফেলতে পারলে মন্দ হয় না। জীবনে অনেক সুখই তো পেল পৃথা, এখন নয় একটু আরাম করুক!

মিনিবাস থেমে থেমে এগোচ্ছে। যাদবপুর থানা পেরোল। চারটে বাইশ। পৃথার টেনশনটা ফিরছিল আবার। টুকুসদের স্কুল বাস দু’-চার মিনিট দেরিও তো করতে পারে। করেও তো। পরশুই তো প্রায় পৌনে পাঁচটায় এল। আজ যদি তাড়াতাড়ি নামিয়েও দিয়ে যায়… একদিন কি আর টুকুস একা একা ফিরতে পারবে না? গেছেও তো দু’-চারবার। ময়নার কামাই তো আর নতুন কিছু নয়। তবু… ভয় লাগে পৃথার। যা রিকশা চলে রাস্তায়, আর টুকুসটাও যা ভেবলুর মতো হাঁ করে হাঁটে! কিছু একটা দেখল, তো ওমনি দাঁড়িয়ে গেল! গাড়ি রিকশা কিছুই তো বাবু খেয়াল করে না।… মেন রোডের ওপর ফ্ল্যাট কিনলে কি ভাল হত? স্কুল বাস নামিয়ে দিত দরজায়!… ধ্যাত, বড় রাস্তা মানে তো আরও বেশি বিপন্নতা। হুট করে বাইরে বেরিয়ে গেলেই সামনে বাস লরি ট্যাক্সি অটো…! তার চেয়ে বাবা এটাই ঠিক আছে। মিনিট পাঁচ-সাত হাঁটতে হয় বটে, কিন্তু হট্টগোল নেই, ঝামেলা নেই, পাড়াটাও বেশ নিরিবিলি …

ব্যাগে কি মোবাইল বাজছে? পৃথা সচকিত হল। হ্যাঁ, তারই তো সুরঝংকার। স্কুল থেকে বেরোনোর সময়ে কি অন করেছিল ফোনটা? নাকি টিফিনে কণাদের সঙ্গে কথা বলার পর আর অফ করা হয়নি?

ব্যাগ খুলে খুদে দূরভাষ যন্ত্রটিকে হাতে নিল পৃথা। ঝলক দেখল নাম্বারটা। ল্যান্ডলাইন। অচেনা। কে?

পৃথা কানে ফোন চাপল, হ্যালো?

ওপারে এক মহিলাকণ্ঠ। কিন্তু শোনা যাচ্ছে না স্পষ্ট। শব্দগুলো কেটে কেটে যাচ্ছে। বার কয়েক হ্যালো হ্যালো করে পৃথা হাল ছেড়ে দিল। সামান্য গলা উঠিয়ে বলল, আমি বাসে আছি। খুব ডিসটার্বেন্স হচ্ছে, আপনি আধ ঘণ্টা পরে করুন।

মোবাইল ব্যাগে রাখার আগে আর একবার নম্বরটা পড়ল পৃথা। উঁহু, চেনা নয়। ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ডের মেয়েগুলো নয় তো? সারাক্ষণ যারা লোন গছানোর জন্য মুখিয়ে থাকে? নাকি রং নাম্বার?

সুকান্ত সেতুতে উঠে বাস গতি বাড়িয়েছে। পৃথা সামনের রডটাকে চেপে ধরল শক্ত করে। দুপুর থেকেই কোমরের ব্যাথাটা শুরু হয়েছিল, এখন বাড়ছে ক্রমশ। ঝনঝন করছে। কোমরের আর দোষ কী, সারাদিন খাড়া দাঁড়িয়ে ক্লাস নেওয়া…! বয়সও তো হচ্ছে! নয় নয় করেও চুয়াল্লিশে পৌঁছোল। এইসব ব্যথাট্যাথা উপসর্গগুলো এখন ভোগাতেই থাকবে। স্কুলে শিপ্রাদি সেদিন ক্যালসিয়াম খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিল। হাড়গোড়গুলো নাকি মজবুত থাকে। তার আগে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিলে হয়। কিন্তু সময় কোথায়? সময় কোথায়? এই তো, দিনভর স্কুল, সংসার, বর, ছেলে… যাকে বলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত দশা।

ছেলের কথা মাথায় ফিরতেই আবার উদবেগ। টুকুস যদি ফ্ল্যাটে পৌঁছেও যায়, ঢুকতে তো পারবে না! বুদ্ধি করে দোতলায় শীলাদের ফ্ল্যাটে চলে যেতে পারে। শীলাকে বলাও আছে। কিন্তু টুকুস কি যাবে? আগের দিন তো সিঁড়িতেই ঘাড় ঝুলিয়ে চুপটি করে বসে ছিল টুকুস। কলিংবেলে হাত যায় না, দরজা ধাক্কা দিয়েছিল, শীলারা নাকি শুনতে পায়নি! বেচারা। কবে যে লম্বা হবে!

বাস থেকে নেমে অবশ্য ভাবনা উৎকণ্ঠার ত্বরিত অবসান। পৃথা মোড় থেকেই দেখতে পেল টুকুস আগে আগে হাঁটছে। হেলেদুলে। এবং মোটেই রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে নয়, মোটামুটি ধার ঘেঁষে।

বড় বড় পা ফেলে পৃথা ধরল ছেলেকে, কী রে, এই নামলি বুঝি? মাকে দেখে খুশি হল কি টুকুস? বোঝা গেল না। সাড়ে আট বছরের ছেলে বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভঙ্গিতে বলল, নাহ্। অনেকক্ষণ।

অনেকক্ষণ মানে কতক্ষণ?

হবে ফাইভ মিনিটস।

পাঁচ মিনিটে মাত্র এইটুকু এলি?

তুমি তো বলো, রাস্তা দিয়ে ধীরেসুস্থে হাঁটবি!

ছেলের বাচনভঙ্গিতে এবার হেসে ফেলল পৃথা। তারপর শুরু হয়েছে তার একের পর এক জেরা। টুকুস আজ স্কুলে কী করল, টিফিন ঠিকঠাক খেয়েছে কিনা, কারও সঙ্গে মারপিট করেনি তো, কী কী হোমওয়ার্ক আছে…। টুকুসের এইসব রোজকার খুঁটিনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খ না জানলে পৃথার যেন তৃপ্তি হয় না। ছেলে ছেলে করাটা তার প্রায় বাতিকে দাঁড়িয়ে গেছে। একটু বেশি বয়সের সন্তান বলে কি? হবেও বা

কথায় কথায় বাড়ি এসে গেছে। তিনতলায় উঠে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল পৃথা। ছেলেকে ইউনিফর্ম ছাড়াল, ঘষামাজা করল, নিজেও মুখ হাত ধুয়ে তরতাজা হয়ে নিল খানিকটা। তারপর ঢুকেছে রান্নাঘরে। নুডলস সেদ্ধ বসিয়ে ফ্রিজ খুলে দুধ বার করছে। এই এক ঝঞ্ঝাট, টুকুসকে দুধ খাওয়াতে এখন প্রাণ বেরোবে। ভাবতে ভাবতে রাতের রান্নাটাও ছকে ফেলল মনে মনে। ডিমের ডালনা তো করাই আছে, সঙ্গে ডাল আর একটা ভাজা করে নিলেই যথেষ্ট। কণাদের খাওয়ার কোনও প্যাখনা নেই, যা থাকে তাই সোনামুখ করে খেয়ে নেয়।

আবার মোবাইলে ঝংকার। ড্রয়িং-ডাইনিং স্পেসে। গ্যাসের আঁচ কমিয়ে পৃথা এগোচ্ছিল, তার আগেই টুকুস তুলে নিয়ে টিপেছে বোতাম। একটা দুটো কথা বলে পৃথাকে দিয়ে গেল ফোন, একটা দিদা।

কে দিদা? কোন দিদা?

জানি না। নাম বলেনি।

গ্লাসে টুকুসের দুধ ঢালতে ঢালতে বাক্যালাপ শুরু করেছিল পৃথা, ওপারের মহিলাটির পরিচয় জানামাত্র প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে গেছে।

দিব্যর মা!

গলা কাঁপছে দিব্যর মা’র, তোমাকে আমি খানিক আগেও একবার ফোন করেছিলাম।

কী করে যে স্বর স্বাভাবিক রাখল, পৃথা নিজেও জানে না। রাগ বিস্ময় বিরক্তি, কিছুই না-ফুটিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি তখন স্কুল থেকে ফিরছিলাম।… কেমন আছেন?

ওই একরকম। এই বয়সে আর থাকা না-থাকা। তুমি কেমন আছ?

ভাল। বলেই পৃথার মুহূর্তের জন্য মনে হল, দিব্যর মা’র কুশলপ্রশ্নটা একেবারেই অর্থহীন। নিশ্চয়ই উনি আশা করেননি, তাঁর প্রাক্তন পুত্রবধূ বলবে সে এখন ভাল নেই? গলা শান্ত রেখেই জিজ্ঞেস করল, আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোত্থেকে?

তোমার মাকে আজ ফোন করেছিলাম।

ও।… হঠাৎ…?

তুমি হয়তো শুনেছ, দিব্য খুব অসুস্থ?

খবরটা পৃথার স্নায়ুতে কোনও আলোড়ন তুলল না। সহজভাবেই বলল, না, জানতাম না। কী হয়েছে?

সেরিব্রাল অ্যাটাক। হেমারেজ হয়নি, তবে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে ব্রেনের অনেকগুলো সেল ড্যামেজ হয়েছে। অবস্থা এখনও খুব ভাল নয়। দিব্যর মা একটুক্ষণ থেমে রইলেন, যেন অপেক্ষা করলেন পৃথার প্রতিক্রিয়ার। পৃথা নিশ্চুপ দেখে ফের তাঁর কণ্ঠ ফুটেছে, কাল বেষ্পতিবারের আগের বেষ্পতিবার দিব্য সোনামাটি গিয়েছিল। ওখানে যে আশ্রম খুলেছে, সেখানেই… সন্ধেবেলা হঠাৎই…। সঙ্গে দুই ছাত্র ছিল। আর কল্পনা, কল্পনার বর। তারা সবাই মিলে ধরাধরি করে আগে উলুবেড়িয়া হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, পরদিনই কলকাতায় এনে গ্রিন ভিউতে ভরতি করেছে। ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে সবে কাল বেডে দিল।

পৃথা অস্ফুটে বলল, ও।

ডান দিকটায় এখনও তেমন সাড় নেই। কথাও চলে গিয়েছিল, এখন বলছে একটু একটু। তাও জড়িয়ে জড়িয়ে।

পৃথা আবারও বলল, ও।

কাল তোমার খুব নাম করছিল। দিব্যর মা গলার ধরাধরা ভাবটাকে সামলালেন, হাত-মুখ নেড়ে জানতে চাইছিল তুমি খবরটা পেয়েছ কিনা।

এ সংবাদেও পৃথা তেমন উদ্‌বেলিত হল না। তবে শরীর শক্ত হয়ে গেছে সহসা। এসব সমাচার তাকে শোনানোর কী অর্থ? দিব্যজ্যোতির সম্পর্কে পৃথার কণামাত্র আগ্রহ নেই, থাকতে পারে না, থাকা সম্ভব নয়, থাকা উচিতও নয়। এগারো বছর আগে যার সঙ্গে সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলেছিল পৃথা, কিংবা বলা যায় ছিঁড়তে বাধ্য হয়েছিল, আজ সে বেঁচে রইল, না মরে গেল, তাতে পৃথার কী যায় আসে?

কিন্তু সত্যিই কি দিব্য তার নাম করছে? এও কি দিব্যর অভিনয়?… কিন্তু ওরকম অসুস্থ অবস্থায় কোনও পাষণ্ডও কি অভিনয় করতে পারে? অবশ্য পাষণ্ড বললেও দিব্যজ্যোতি সিংহকে যথেষ্ট সম্মান দেখানো হয়। দিব্যজ্যোতির মতো পাপাচারী পৃথা জীবনে আর একটাও দেখেনি।

পৃথার নীরবতায় দিব্যর মা কি কোনও আশ্বাস খুঁজে পেলেন? গলা উঠেছে সামান্য, তোমায় একটা অনুরোধ করব পৃথা। রাখবে?

বলুন?

তোমাকে বলার আমার মুখ নেই। অনুরোধ করা উচিতও নয়। তুমি বিয়ে-থা করে শান্তিতে ঘর-সংসার করছ। তবু… যদি একবার আসো… দিব্যর সামনে একবার দাঁড়াও.::

আমিই-ই! পৃথার গলা বিস্ময়ে চড়ে গেল। এতটাই উচ্চগ্রামে, যে টুকুস পর্যন্ত ছুটে এসেছে টিভি ছেড়ে। চোখ পিটপিট করে দেখছে মাকে। তাড়াতাড়ি তার হাতে দুধের গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে পৃথা স্বর নামাল, আমি গিয়ে কী করব?

তা নয়… আসলে দিব্য বোধহয় তোমায় একবার দেখতে চাইছে… এখনও তো জীবনসংশয়টা রয়ে গেছে… কী হবে কিছু বলা যাচ্ছে না…

দিব্যর মা এবার স্পষ্টতই ভেঙে পড়েছেন। নাক টানছেন জোরে জোরে। একেই বুঝি বলে পুত্রস্নেহ! দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গে গান্ধারীও কি ভেঙে পড়েনি!

পৃথা স্বর অচঞ্চল রাখল, দেখি।

মোবাইল অফ করে পৃথা ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। এ কী আজব আবদার রে বাবা? যদি-বা সত্যিই দিব্য এখন পৃথা পৃথা করে, তো পৃথার কী? মরণকালে তার হরিনামের সাধ জেগেছে বলে পৃথাকে গিয়ে খঞ্জনি বাজাতে হবে? নিশ্চয়ই দিব্যর চেলা-চামুণ্ডারা নার্সিংহোমে মজুত আছে, তাদের কাছে মশলাদার খোরাক হতে যাবে পৃথা! অসম্ভব। এক সময়ে অনেক নির্বুদ্ধিতা হয়েছে, এই বয়সে আর নতুন করে বোকা সাজার কোনও মানে হয় না।

দিব্যর মা’র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নুডলসের দফারফা। গলে প্রায় পাঁক। তাড়াতাড়ি ছানচা দিয়ে ছেঁকে তুলে নুডলগুলো স্টিলের ট্রে-তে ছড়ানোর চেষ্টা করল পৃথা। হচ্ছে না, জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। এই মণ্ড দিয়ে চাউমিন বানালে কে গিলবে? টুকুস না কণাদ?

চড়াং করে মাথা গরম হয়ে গেল পৃথার। রাগটা গিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে নিজের মা’র ওপর।

হ্যালো, মা? তোমার সেন্সটা কবে হবে বলো তো?

কেন রে? কী করলাম?

দুম করে দিব্যর মাকে আমার নাম্বার দিয়ে দিলে! একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলে না?

না, শোন খুকু… ব্যাপারটা হয়েছে কী….

আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। যদি বা দিলে… সঙ্গে সঙ্গে আমায় জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

তুই তখন স্কুলে, তাই তোকে বিরক্ত করিনি। রাত্তিরেই তোকে ফোন করতাম।… মীরাদি এমনভাবে বলছিলেন, মুখের ওপর না করে দেব? কী বলব? মেয়ের ফোন নাম্বার আমি জানি না?… তা ছাড়া তোর আর দিব্যর মধ্যে যাই হোক, আমার সঙ্গে মীরাদির তো কখনও অসম্ভাব হয়নি!

উফ্, তুমি এমন এক একটা অকোয়ার্ড সিচুয়েশনে ফেলো না মা! জানো, কেন ফোন নাম্বার চেয়েছিলেন?

না-জানার কী আছে! গৌরীর স্বরে খুব একটা তাপ-উত্তাপ নেই, তোকে একবার নার্সিংহোমে যেতে বলেছে, তাই তো?

ও, তুমি জানো। পৃথা থ, তার পরেও তুমি… হরিবল! তোমার কি বলে দেওয়া উচিত ছিল না, পৃথাকে আর এসবের মধ্যে টানাটানি করবেন না?

ব্যাপকতামি করিস না, খুকু। মীরাদি কী এমন অন্যায় কথা বলেছেন? একটা মরোমরো মানুষকে দু’মিনিটের জন্য দেখতে গেলে তোর গায়ে কী এমন ফোসকা পড়বে?

হুঁহ্, মানুষ না আরও কিছু

সে তুমি যা খুশি বলতে পারো। তবে একটা কথা তো অস্বীকার করতে পারবে না, সে এক সময়ে তোমার স্বামী ছিল। তার সঙ্গে নয় নয় করেও দশ বছর ঘর করেছ। তোমার সঙ্গে ডিভোর্সের পর সে আর বিয়েও করেনি। একটা একা মানুষ…। গৌরী যেন আরও কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিলেন, যাক গে, তোমার ইচ্ছে হলে যাবে, না হলে যাবে না। আমার ওপর মেজাজ দেখানোর তো কোনও কারণ দেখি না।

বলেই গৌরী ফোন রেখে দিয়েছেন। উপযুক্ত কোনও জবাব দেওয়ার সুযোগ না পেয়ে অসহায় ক্ষোভে ছটফট করতে থাকল পৃথা। মা-টা যে কী! কণাদের সঙ্গে তার বিয়েটা ভালভাবে মেনে নিয়েছে বটে, টুকুসের ওপরেও খুব টান, তবে দিব্যজ্যোতির প্রতি মায়া এখনও ঘুচল না। মেয়ের মুখ থেকে জামাইয়ের অনাচারের অনুপুঙ্খ কাহিনি শোনা সত্ত্বেও। দিব্যজ্যোতির সাফাইগুলোকেই এখনও মা বিশ্বাস করে বসে আছে। বিবাহবিচ্ছেদের পর কোনও পুরুষ আর বিয়ে না-করলে সে একেবারে নিষ্কলুষ! হয় তাকে দুঃখী মানুষ ভাবা হবে, নয়তো সাধুসন্ত গোছের কিছু একটা। কী যে সব প্রিমিটিভ ধারণা!

পৃথা পায়ে পায়ে সোফায় এসে বসল। মেঝেয় পা ছড়িয়ে কার্টুন চ্যানেল দেখছে টুকুস, টিভির একদম সামনেটায় গিয়ে। অত কাছ থেকে টিভি দেখার জন্য অন্য দিন ছেলেকে বকে পৃথা, এখন কিছুই বলল না। টুকুসের দুধের গ্লাস প্রায় ভরতিই পড়ে, সেদিকে নজরই গেল না যেন। গাঁক গাঁক করে টম অ্যান্ড জেরি চলছে পরদায়, ইঁদুর-বেড়াল খেলার উচ্চকিত ধ্বনিতে অন্য সময়ে কানে তালা লেগে যায়, আজ যেন শুনতেই পাচ্ছে না। বাক্ দৃষ্টি শ্রবণের ইন্দ্রিয়গুলো যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। অথবা অসাড়।

আপন মনে দু’দিকে মাথা নাড়ল পৃথা। কী মানুষ! ভাবমূর্তি নির্মাণের কী অসীম ক্ষমতা!

দিব্যজ্যোতির সঙ্গে তার সম্পর্কটা তখন শেষ পর্যায়ে। সে তখন মনস্থির করেই ফেলেছে, পচে যাওয়া সুতোটাকে এবার ছিঁড়েই ফেলবে, চলে এসেছে বাপের বাড়ি, মা’র কাছে উগরে দিয়েছে মাসতুতো বোনদের সঙ্গে দিব্যজ্যোতির অবৈধ কামকেলির উপাখ্যান…। দু’-চার দিন পর হঠাৎ এক সন্ধেবেলা দিব্যজ্যোতি এসে উপস্থিত।

বাবা সেদিন বাড়ি ছিল না। মা’র তো কোনও কালেই স্থানকালপাত্র জ্ঞান নেই, পৃথার সামনেই হাউমাউ করে উঠল, এসব কী শুনছি, দিব্য? তুমি নাকি রুনি ঝুনির সঙ্গে…?

দিব্যজ্যোতি পলকে পাংশু। একটুক্ষণ সময় নিয়ে বলল, দেখুন মা, আপনাকে কয়েকটা কথা বলি। পৃথা সত্যি বলছে, কি মিথ্যে বলছে, সে প্রসঙ্গে আমি যাবই না। তবে পরিস্থিতিটা তো বুঝতে পারছেন, আমার আর পৃথার সম্পর্কটা তলানিতে এসে ঠেকেছে। পৃথা আমায় আর সহ্যই করতে পারছে না। আমি দাবি করব না, আমি ধোওয়া তুলসীপাতা নিশ্চয়ই আমার অনেক দোষ আছে। খামতি আছে। নইলে এক সময়ে আমায় ভালবেসে বিয়ে করেও পৃথা আজ সরে যেতে চায় কেন?… তবে এই যে বদনামগুলো পৃথা ছড়াচ্ছে… আমি পুরুষমানুষ, তায় আঁকাজোকা করি… উচ্ছৃঙ্খল বলে আমাদের খানিকটা দুর্নামও আছে। সুতরাং আমার গায়ে কেউ কালি ছিটোলে কিছু যায় আসে না। ঝেড়ে ফেলব।… কিন্তু রুনি ঝুনির কথা ভাবুন। তারা তাদের মতো করে লাইফে সেটল্ করছে… এখন এইসব কলঙ্ক যদি রটে, তাদের কত ক্ষতি হতে পারে বলুন তো?

কী নিপুণ বাক্যজাল বিছিয়ে অর্ধসত্যের আবরণে নিজেকে আড়াল করে ফেলল দিব্যজ্যোতি। মা মোটেই বোকা হাবা নয়, তবু এমন ধরনের কথার ফাঁদে আচ্ছা ঘাঘু লোকও তো বেকুব বনে যায়। আমতা আমতা করে মা বলল, কিন্তু খুকু যে… নিজের চোখে…?

থাক না মা ওসব কথা। চোখ কতটুকু দেখে? দেখে তো মানুষের মন। আপনার মেয়ের মন যদি বলে আমি চরিত্রহীন, সে-ধারণা তো আমি বদলাতে পারব না। তার চেয়ে বরং কোনও সিন ক্রিয়েট না-করে আলাদা হয়ে যাওয়াই তো ভাল। বিশ্বাস করুন, আমি পৃথার শত্রু নই। আমি চাই, পৃথা পৃথার মতো করে সুখী হোক।

তারপরেই উঠে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রস্থান।

দৃশ্যটা মনে পড়লেই পৃথার গা যেন রি-রি করে ওঠে। প্রায় বারো বছর পরেও।

কেউ কি ভাবতে পারবে, কী কুৎসিত চেহারায় মানুষটাকে দেখেছে পৃথা? দিনের পর দিন? মাসের পর মাস? একটা দিনের স্মৃতি তো পচা ঘায়ের মতো দগদগ করছে।

তখন সবে চাকরিতে জয়েন করেছে পৃথা। সেদিন কী কারণে যেন ছুটি হয়ে গেল স্কুল, দুপুর দুপুর পৃথা বাড়ি ফিরে এসেছিল। দিব্যর মা অফিসে, দিব্য কলেজে, বাড়ি ফাঁকা থাকারই কথা। নিজের চাবিতে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে থমকে গেল পৃথা। দিব্যর স্টুডিয়োয় কার গলা শোনা যাচ্ছে না? নারীকণ্ঠ!

নিছকই কৌতূহলের বশে স্টুডিয়োর দরজায় গিয়ে পৃথার পা গেঁথে গেছে মাটিতে। চোখের পলক পড়ছে না। ডিভানে যে ত্রিমাত্রিক ছবিটা দেখছে, তা কি সত্যি?

রুনি ডিভানে শায়িত! দিব্যর ছোটমাসির বড় মেয়ে রুনি! গাইঘাটা থেকে কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে আসা রুনি! ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলনিবাসিনী রুনি।…. রুনির বুকের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে দিব্য! দু’জনের কারও অঙ্গে এক কণা সুতোও নেই!

রুনি চোখ বুজে কী যেন প্রলাপ বকে চলেছে একটানা। দিব্যর হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে রুনির নগ্ন দেহে। হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে উঠছে রুনি, পরক্ষণে হাসছে খিলখিল।

দৃশ্যটায় একটা তীব্র মাদকতা ছিল। আবার প্রচণ্ড উত্তাপও। পৃথার চোখ দুটো যেন ঝলসে গেল। প্রায় টলতে টলতে এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। স্টুডিয়ো থেকে ভেসে আসা হাসি আর উল্লাসধ্বনি, মাঝে মাঝে যৌনগন্ধী আওয়াজ, তার কানকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল।

চৈত্রের প্রখর দুপুরে, দরজা-জানালা বন্ধ আধো অন্ধকার ঘরে কতক্ষণ নিঃসাড়ে পড়ে ছিল পৃথা? পৃথা জানে না। শুয়ে শুয়েই টের পাচ্ছিল, রুনি বাথরুমে গেল, বেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে, চায়ের জল চড়াচ্ছে। দিব্য কি তখনই ঢুকেছিল শোওয়ার ঘরে? নাকি আর একটু পর? বিছানায় পৃথাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেছে, আরে, তুমি কখন এলে?

কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না পৃথার। তবু মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, অনেকক্ষণ।

হঠাৎ? দুপুরবেলায়?

এবার ঝাঁঝ এসে গেল গলায়, বোধহয় তোমাদের লীলাখেলা দেখাটা আমার কপালে ছিল, তাই।

আশ্চর্য, দিব্যর কোনও ভাবান্তর নেই। নাকি ছিল? অতিমানবিক ক্ষমতায় মনের ভাব গোপন রাখতে পেরেছিল দিব্য? ড্রয়ার থেকে নতুন সিগারেটের প্যাকেট বার করল একটা। সেলোফেনের মোড়ক ছাড়াতে ছাড়াতে পৃথার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সহজ স্বরে বলল, ইমোশনের মাথায় এরকম হয়েই যায়। এগুলোকে বেশি পাত্তা দিতে নেই। স্টুডিয়োর দরজাটা তোমার ভেজিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

দিব্যর সুললিত বাক্যরাজির মাঝে কখন বুঝি দরজায় রুনি। তাকে দেখে দিব্য বলে উঠল, কী রে, তুই অমন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?

আআআমি… যাই দিব্যদা।

তাড়া কীসের? বোস না। তোর বউদিকেও এক কাপ চা দিস।

এর পরেও আরও আট আটটা বছর এই মানুষটার সঙ্গে বাস করেছিল পৃথা! কী করে যে ছিল? কেন ছিল? এখন ভাবতে গেলে পৃথা কোনও উত্তরই খুঁজে পায় না। কণাদ টেনে বার না-করলে সে বুঝি অনন্তকাল থেকে যেত চেতলার ওই বাড়িটায়। কত কী যে নিঃশব্দে সহ্য করে গেছে। কত কিছু জেনেও প্রতিবাদ করেনি। রুনি, রুনির পরে ঝুনি … ছাত্রীটাত্রিদের সঙ্গেও কি আর ফস্টিনস্টি চলত না? পারমিতা বলে মেয়েটা, যে দিব্যকে দেখলে গলে গলে পড়ত, তাকেও কি দিব্য ছেড়ে কথা বলেছে? তবু পৃথা পড়ে ছিল কোন কুহক মায়ায়? কীসের আশায়? শরীরের টানও তো ছিল না। চৈত্রের সেই দুপুরের পর থেকে দিব্যজ্যোতি বিছানায় এলে কেমন যেন সিঁটিয়ে যেত পৃথা, আপনাআপনি কাঠ হয়ে যেত শরীর। তা হলে?

টিভিতে ইঁদুর-বেড়ালের কাহিনি শেষ। টুকুস এসে ঠেলছে পৃথাকে, মা? ও মা?

পৃথা সন্তোষপুরের ফ্ল্যাটে ফিরল, কী?

আমার সাম্‌সগুলো নিয়ে আসব?

তোমার দুধ শেষ হয়েছে?

কখন। গ্লাসটা দ্যাখো।

পৃথার ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি ফুটে উঠল। টুকুসটা ঠিক বুঝেছে মা’র একটা কিছু হয়েছে, মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছে মা’র। দু’হাত ছড়িয়ে পৃথা ডাকল, আয়, কাছে আয়।

টুকুস লজ্জা লজ্জা মুখে গা মোচড়াল, কেন?

আমার সোনা বাচ্চাটাকে একটু আদর করি।

ছেলেকে খানিক চটকে অঙ্কের খাতা-বই আনতে বলল পৃথা। ইস, টুকুসটার তো বিকেলে দুধ ছাড়া কিছু খাওয়া হল না, নিজেরও পেট চুঁইছুঁই করছে, সেই কখন দু’খানা রুটি খেয়েছিল, উঠে চিঁড়েটিড়ে কিছু ভাজবে নাকি? কিংবা টোস্ট ওমলেট? টুকুস ওমলেট দেখলে নাক সিঁটকোয়, ওকে পোচ করে দেওয়া যেতে পারে। দিব্যরও ডিমের পোচ ভীষণ প্রিয় ছিল। হঠাৎ দিব্যজ্যোতির সেরিব্রাল হল কেন? প্রেশারটেশারে ধরেছিল নাকি? মদের মাত্রা কি খুব বাড়িয়েছিল ইদানীং? সোনামাটি গিয়ে কি দেদার বেলেল্লাপনা করত? সোনামাটিতে দিব্যর কাজকর্ম নিয়ে বছর দুয়েক আগে বেশ একটা বড়সড় আর্টিকেল বেরিয়েছিল কাগজে। মেয়েদের জন্য স্বনির্ভর প্রকল্প গড়েছে দিব্য, ওইসব মেয়েদের নিয়ে কি সোনামাটিতে ফুর্তিফার্তা করত? দিব্যজ্যোতি সিংহর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। হয়তো শহরের মেয়েতে অরুচি ধরেছিল, মুখবদলের জন্য গ্রামে ছুটছিল তাই!

কিন্তু পৃথাকে দেখার সাধ জাগল কেন? কণাদকে ফোনে জানাবে খবরটা? কী প্রতিক্রিয়া হবে কণাদের? দিব্যর জেগে ওঠা নতুন বাসনাটায় নিশ্চয়ই খুব আহ্লাদিত হবে না?

তবু বলতে তো হবে। বলা উচিত।

পৃথা হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা তুলল সেন্টার টেবিল থেকে। কী ভেবে রেখেও দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *