আমি ও জনৈক ইমাম

আমি ও জনৈক ইমাম

এক

শীতের সকাল।

মামা বাড়ির পুবের খোলা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চা খাচ্ছি আর রোদের আদর নিচ্ছি। একটু আগেও খুব কুয়াশা ছিল। এখন কুয়াশা কেটে ঝলমলে রোদ উঠেছে। দিনের শুরুর উষ্ণ রোদ্রের পরশ গায়ে মাখতে খুব আরাম লাগছে।

গতকাল রাতে আমি মামা বাড়ি এসেছি। নিজের ইচ্ছেতে আসা নয়, বাধ্য হয়ে আসা। আমার মামা গ্রামে চেয়ারম্যান ইলেকশন করছেন। ইলেকশনে মামার পক্ষে প্রচারণার জন্য আমাকে আনা। মামার ধারণা-আমি ভার্সিটিতে পড়ুয়া আধুনিক ছেলে, আমার কথা গ্রামের লোকজন মনোযোগ দিয়ে শুনবে। গ্রামের লোকেরা শহরের শিক্ষিত আধুনিক লোকদের কথা একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে। শিক্ষিত আধুনিক লোকদের কথা তারা নাকি দৈববাণীর মত বিশ্বাস করে।

আমার মামা অত্যন্ত প্রতাপশালী লোক। আশপাশের অন্তত দশ গ্রামের লোক তাঁর নাম শুনলে ট্যারা হয়ে যায়। অবশ্য মামার নাম শুনলে লোকজন যে শুধু ভয়ে-শ্রদ্ধায় ট্যারা হয়ে যায় তা না-ও হতে পারে। আমিও মামার নাম শুনলে ট্যারা চোখে তাকাই, কারণ মামার প্রতাপ আর ক্ষমতার প্রভাব তাঁর নামের উপরও পড়েছে। মামার নাম-সৈয়দ হালিম চৌধুরী। নামের আগে পরে দুটো বড় বংশের নাম। সৈয়দ ও চৌধুরী। এই সৈয়দ ও চৌধুরী কোথা থেকে এসেছে কে জানে! আমার জানা মতে-আমার নানার বংশের নাম ছিল সর্দার। সর্দার টাইটেল পান আমার নানার দাদা। তিনি নাকি ডাকাত দলের সর্দার ছিলেন। প্রথম জীবনে স্রেফ সিঁদেল চোর। পরে প্রাচীন ঠগি সম্প্রদায়ের সাথে মিশে ডাকাতি শুরু করে এক পর্যায়ে ডাকাতের সর্দার হন। সেই থেকে বংশের নাম হয় সর্দার। মামা, বাপ-দাদাদের সেই সর্দার বংশ বাদ দিয়ে জাতে উঠবার জন্য নামের আগে-পিছে দুটো বড় বংশের সাইনবোর্ড টানিয়েছেন। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়য়া মামা বুঝতেও পারেন না নামের আগে-পিছে দুটো বংশের নাম রাখা কতটা হাস্যকর।

মামা তাঁর এক জীবনে অনেক ধন-সম্পদ করেছেন। এখন ক্ষমতা আর সম্মানের মোহ তাঁকে তাড়া করছে। গ্রামের চেয়ারম্যান হয়ে তাঁর মনের কাঙ্ক্ষিত বাসনার প্রথম ধাপ তিনি পেরুতে চান। ধীরে-ধীরে আরও অনেক দূর। কপালে থাকলে কী না হয়! হয়তো একদিন তিনি মেয়র ইলেকশন বা এম.পি. ইলেকশন করার নমিনেশনও পেয়ে যাবেন।

মামার প্রধান সহযোগী দবির বেপারী। মোটা-সোটা তাল গাছের মত লম্বা দশাসই চেহারার লোক। মামার প্রধান পরামর্শদাতা, বুদ্ধিদাতা সবই দবির বেপারী। মামার সমস্ত কাজ-কারবার চলাফেরা দবির বেপারীকে সঙ্গে নিয়ে। তরুণ বয়স থেকেই মামা আর দবির বেপারী খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দবির বেপারী আর মামা বলতে গেলে একে অপরের ছায়া। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে—মামার এত ধন-সম্পদ হয়েছে, সেই দিক দিয়ে দবির বেপারীর কিছুই হয়নি। এমনকী লোকটা বিয়েও করেনি। অথচ মামার স্ত্রী সংখ্যা চারজন। মামার সবচেয়ে ছোট স্ত্রীর বয়স মাত্র উনিশ। আমার চেয়েও ছোট মামী ছয় বছরের ছোট।

দবির বেপারীর মত বিশালদেহীর পাশে মামা যখন দাঁড়ান তখন মামাকে দেখে মনে হয় দাড়িওয়ালা একটা বামন। মামা উচ্চতায় বোধ হয় পাঁচ ফুটও হবেন না। অথচ মামীরা প্রত্যেকেই কী লম্বা লম্বা!

মামা ছয় কন্যা এবং এক পুত্রের জনক। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তারা যে যার শ্বশুর বাড়িতে। পরের চার মেয়ে পড়াশুনা করছে। দুইজন একই সাথে এইচ.এস.সি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আর বাকি দু’জনের একজন ক্লাস টেনে আর একজন ক্লাস নাইনে পড়ে। সবার ছোট ছেলে। ছেলের বয়স মাত্র চার মাস।

মামার উনিশ বছর বয়স্কা ছোট বউ অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর চার মাস আগে মামার সারা জীবনের আশা পূরণ করেন। মামা একটা পুত্ৰ সন্তানের আশায়ই একের পর এক বিয়ে করেন। প্রথম ঘরে পর পর তিন মেয়ে। দ্বিতীয় ঘরে দুই মেয়ে। তৃতীয় ঘরে এক মেয়ে। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ স্ত্রীর ঘরে ছেলের মুখ দেখলেন মামা।

মামার বাড়ির সংখ্যাও চারটি। প্রতিটি বাড়িই দেখার মত। বরিশাল সদরে ছাপান্ন শতাংশ জমির উপর একটি বাড়ি। ঢাকায় দুটো বাড়ি। দুটোর একটি মিরপুরে, দুই ইউনিটের ছয়তলা বিশাল বিল্ডিং। আর একটি বাড়ি আশুলিয়ায়। তুরাগ নদীর ওপারে রুস্তমপুরে। প্রায় আশি শতাংশ জায়গা জুড়ে বাড়িটা। সমস্ত বাড়ি জুড়ে কমলা, মালটা, আঙুর, আনার এ ধরনের দামি ফলের বাগান আর বাড়ির সামনের কিছু জায়গা জুড়ে জানা-অজানা বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফুলের বাগান। চারদিকে বাগান, মাঝখানে বাংলো টাইপের একতলা বিল্ডিং। বলতে গেলে সারা বছরই বাড়িটা খালি পড়ে থাকে। কালু নামে এক কেয়ারটেকার বাড়িটার রক্ষণা-বেক্ষণ করে। আশুলিয়ার সেই বাড়িতে মামা মাঝে-মধ্যে ঢাকাই সিনেমার নায়িকা বা মডেল সুন্দরীদের নিয়ে সময় কাটাতে যান।

গ্রামের এই বাড়িটার কথা আর কী বলব! এটা তো যেনতেন জমিদার বাড়িকেও হার মানাবে। অন্তত এক একর জায়গা জুড়ে বাড়িটা। বাড়ির পিছনে অনেক দিনের পুরানো বিভিন্ন বড় বড় গাছের বাগান। সামনে দিঘি আকৃতির বিশাল পুকুর। পুকুরের বাঁধানো চওড়া ঘাটলা। চারপাড়ে ফাঁকা- ফাঁকা করে লাগানো নারকেল গাছ। পূর্ণিমার রাতে পুকুরের মাঝে তাজমহলের মত হোয়াইট সিমেন্টে বানানো বাড়ির প্রতিবিম্ব দেখা যায়। সে এক অসাধারণ দৃশ্য।

মামার বাড়িতে এসে বলা যায় মোটামুটি রাজার হালে আছি। এ বাড়ির নিয়ম হচ্ছে প্রত্যেকটা লোকের জন্য- আলাদা আলাদা একজন কেয়ারটেকার। আমার তদারকির জন্য নিয়োগ করা হয়েছে বোকা-সোকা সহজ-সরল চান্দু মিয়া নামের এক লোককে। চান্দু মিয়া বোধ হয় আমারই বয়সী। বোধ হয় বলছি এই জন্যে, কারণ গ্রামের লোকদের বয়স চট করে ধরা যায় না। রোগা-পাতলা মাঝারি উচ্চতার চান্দু মিয়ার গায়ের রং তামাটে। চেহারায় কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মাথা ভর্তি অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা এলোমেলো উস্কখুস্ক লালচে চুল।

চান্দু মিয়ার দায়িত্ব তৎক্ষণাৎ আমার হুকুম তামিল করা। এই যেমন-আমি এখন বাড়ির দোতলার পুবের খোলা বারান্দায় বসে বড় এক মগ ভর্তি চা খাচ্ছি আর রোদ পোহাচ্ছি, চান্দু মিয়াও আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে আমার হুকুম শোনার জন্য আর শোনার পরে তামিল করার জন্য।

চান্দু মিয়ার পরনে ময়লা রঙের লুঙ্গি আর বিবর্ণ হাফ হাতা শার্ট। খালি পা। খুব সম্ভব কোনও এক সময় লুঙ্গির রং সাদা ছিল আর শার্টের রং লাল। এমন শীতের মাঝে চান্দু মিয়া স্রেফ একটা হাফহাতা শার্ট পরে কীভাবে ঠিক আছে সেটাই এক আশ্চর্য!

গ্রামের এই বাড়িতে এখন আমার দুই মামী আছেন। একেবারে বড় মামী আর উনিশ বছর বয়স্কা ছোট মামী। মামা যেখানেই যান ছোট মামীকে সঙ্গে নিয়ে যান। ছোট মামীকে ছেড়ে তিনি থাকতে পারেন না।

দুই

মামা আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। তিন দিনের হাত খরচ। মামার প্রচারণায় বেরিয়ে গ্রামের লোকজনদের নিয়ে চা-নাস্তা, পান-তামাক খেয়ে এই টাকা খরচ করতে হবে। তিন দিন পরে আবার হাত খরচ পাব। ভোটের এখনও দশ দিন বাকি। এই দশ দিন ধরে এভাবেই হাত খরচের টাকা পাব।

চান্দু মিয়াকে নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লাম। আমার প্রথম উদ্দেশ্য গ্রামের বাজারে গিয়ে বিভিন্ন চায়ের দোকানে বসে লোকজনকে চা-টা খাইয়ে খাতির জমানো।

মামার মিটিং, মিছিল, সমাবেশ এর কোনও কিছুর মধ্যেই তিনি আমাকে জড়াবেন না। আমার কর্মপদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মামার অভিমত-যারা মামার মিটিং, মিছিল, সমাবেশে যোগদান করে, তারা এমনিতেই মামার ভোটার। এর বাইরে যারা তাদের সাথে মত বিনিময় করে, তাদেরকে দলে ভিড়ানো আমার দায়িত্ব। অর্থাৎ লোকজন ধরে ধরে আমাকে টোপ ফেলতে হবে।

চান্দু মিয়াকে নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতেঁ গ্রামের একমাত্র জামে মসজিদের সামনে এসে পৌঁছালাম। রোদের প্রখরতা বেড়েছে। আমার গায়ে ফুলহাতা সোয়েটার। গা চিড়বিড় করছে। সোয়েটার খুলে ফেলতে হবে।

মসজিদ দেখে একটা পরিকল্পনা এসে মাথায় ভর করল। মসজিদ থেকে মামার প্রচারণা করলে কেমন হয়! মসজিদের ইমাম, মুসল্লিদের নিয়ে মিলাদ পড়ে মামার জন্য দোয়া করব। বোধ হয় খুব কাজে দেবে। বাংলাদেশের মানুষ এমনিতে নামাজ-রোজা যতটুকুই করুক না কেন, ধর্মের প্রতি দুর্বলতা কিন্তু প্রগাঢ়।

গা থেকে সোয়েটার খুলতে খুলতে চান্দু মিয়াকে বললাম, ‘মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে একটু কথা বলা দরকার।

চান্দু মিয়া গলায় অনেকখানি উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘চলেন, তারে মসজিদের ভেতরেই পাওন যাইব। নাইলে মসজিদের পেছনে তাঁর থাহনের ঘরে। খুবই পরহেজগার মানু। হারাক্ষণ ওজু অবস্থায় থাহেন। মসজিদের ভিতরে বইস্যা উনি হয় কোরানশরীব পড়েন নাইলে হাদীস-কেতাব পড়েন, নাইলে নফল নামাজ পড়েন। বেহুদা বইয়া থাহেন না…’

ইমাম সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করতেই চান্দু মিয়াকে এত উৎসাহিত দেখাচ্ছে কেন কে জানে? গড়গড় করে কথা বলেই যাচ্ছে। এমনিতে কিন্তু চান্দু মিয়া তেমন কথাবার্তা বলে না, হুঁ-হ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

আমরা মসজিদের দিকে এগোচ্ছি। চান্দু মিয়া ইমাম সাহেব সম্পর্কে বিভিন্ন গুণগান করেই যাচ্ছে, ‘…খুবই কামেল আদমি। ওনার বশে কয়ডা জিন আছে। ফজরের ওক্তে গেরামের কেউ মসজিদে নামাজে আয় না। উনি একলা-একলা নামাজ পড়েন। তহন জিনেরা ওনার পেছনে দাঁড়ায়ে জামাতে নামাজ আদায় করে…

এতক্ষণে বুঝতে পারলাম ইমাম সাহেবের সম্পর্কে চান্দু মিয়ার এত উৎসাহ কেন। যার বশে জিন থাকে সে অনেক ক্ষমতাবান। চান্দু মিয়ার মত মানুষ ক্ষমতাবানদের প্রশংসা করবে এটাই স্বাভাবিক। মনে মনে আমি হাসলাম, মানুষ মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে আর গ্রামের লোকেরা এখনও জিন-টিনের বিশ্বাস নিয়ে পড়ে আছে!!!

মসজিদের ভিতরে ইমাম সাহেবকে পাওয়া গেল না। মসজিদের পিছনে ইমাম সাহেবের থাকার ঘরের সামনে গিয়ে দেখা গেল ঘর ভিতর থেকে বন্ধ। বোঝা গেল ইমাম সাহেব ভিতরেই আছেন। চান্দু মিয়া দরজার কড়া নাড়তে নাড়তে উঁচু গলায়, ইমামসাব… ও ইমামসাব…’ বলে কয়েকবার ডাক দেয়ার পর ইমাম সাহেবের সাড়া পাওয়া গেল।

দরজা খুলে ইমাম সাহেব বের হলেন। পরনে লুঙ্গি আর খালি গায়ে গামছা প্যাচানো। ইমাম সাহেবের লম্বাটে মুখমণ্ডল ভর্তি বুক পর্যন্ত লম্বা কাঁচা দাড়ি। মাথা চকচকে ন্যাড়া। গোঁফও কামানো। ঝকঝকে চোখে ঘন কালো মণি। সহজ-সরল চোখের চাহনি। অত্যন্ত সুপুরুষ চেহারা। চেহারায় নূরানী – ছাপ।

ইমাম সাহেবকে দেখে বোঝা গেল তিনি এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলেন।

চান্দু মিয়া ইমাম সাহেবকে আমার পরিচয় দিল-বড় বাড়ির বড় মিয়ার ভাগ্নে। ঢাকা থেকে এসেছেন। গ্রামের লোকেরা আমার মামাকে বড় মিয়া বলে সম্বোধন করে। আর মামার বাড়িটা পরিচিত বড় বাড়ি নামে।

ইমাম সাহেব আমাকে সালাম দিলেন। আমি সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, ‘আপনার অনেক সুনাম শুনেছি। আপনি নাকি সব সময় ইবাদত- বন্দেগীতে মশগুল থাকেন। তা এতক্ষণ বুঝি ঘুমাচ্ছিলেন?’

আমার প্রশ্নে ইমাম সাহেব বোধ হয় খানিকটা লজ্জা পেলেন। তিনি অপ্রস্তুত গলায় বললেন, ‘ভাই, আমি রোজা রেখেছি। আর রোজা অবস্থায় ঘুমানোও ইবাদতের সমান।’

‘এখন তো রোজার মাস নয়। কীসের রোজা রেখেছেন?’

‘আমি প্রতি শুক্রবারই নফল রোজা রাখি।’

ভাবলাম কথা বাড়িয়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট না করে আমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইমাম সাহেবের কাছে এসেছি তা খুলে বলি। পকেট থেকে এক হাজার টাকা বের করে ইমাম সাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম, ‘আজ জুমার নামাজের শেষে মুসল্লিদের নিয়ে মিলাদ পড়ে, আমার মামার জন্য দোয়া করবেন। মামা যেন নির্বাচনে জয়ী হতে পারেন। আর এই টাকা দিয়ে মিষ্টান্ন আনিয়ে রাখবেন। দোয়া শেষে, মুসল্লিদের মধ্যে সেই মিষ্টান্ন বিতরণ করবেন।’

ইমাম সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ‘ভাই, মিষ্টান্নের জন্য এত টাকার প্রয়োজন নেই। মিষ্টান্ন মানে তো বাতাসা। মুসল্লি যা হবে তাতে দুই কেজির বেশি বাতাসা লাগবে না। দুই কেজি বাতাসা কিনতে দুইশ’ টাকার বেশি লাগে না।’

আমি বললাম, ‘শুধু বাতাসা দিবেন কেন? বাতাসার সাথে শুকনো মিষ্টি বা জিলাপি দিতে পারেন।

ইমাম সাহেব বললেন, ‘হাটের দিন ছাড়া এই গ্রামে মিষ্টি বা জিলাপি পাওয়া যায় না। মিষ্টি বা জিলাপি আনতে হলে রূপাকাঠী বন্দরে যেতে হবে। রূপাকাঠী বন্দরে যেতে-আসতে প্রায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লাগবে। জুম্মার নামাজ শুরু হওয়ার বাকি তো মাত্র তিন ঘণ্টা।’

আমি পাঁচশ’ টাকার দুটো নোট থেকে একটি রেখে অন্যটি ইমাম সাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম, ‘ঠিক আছে, তা হলে শুধু বাতাসার ব্যবস্থাই করুন।’

ইমাম সাহেব বললেন, ‘তাতে তো পাঁচশ’ টাকা লাগবে না, দুইশ’ টাকাই যথেষ্ট।’

‘বাকিটা আপনার হাদিয়া।’

ইমাম সাহেব লজ্জিত গলায় বললেন, ‘আমি হাদিয়া নেই না।’

আমি বললাম, ‘আমার কাছে পাঁচশ’ টাকার নোটের নীচে কোনও ভাঙতি টাকা নেই। বাকি টাকা পরে কোনও এক সময় নিয়ে যাব।’

এইবার ইমাম সাহেব টাকা নিলেন। স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমি এখনই সাইকেল নিয়ে বের হচ্ছি বাতাসা আনার জন্য।’

আমি দরাজ গলায় বললাম, ‘আজ সন্ধ্যায় আপনার ইফতারি আমি পাঠিয়ে দিব।’

ইমাম সাহেব খুশি হওয়া গলায় বললেন, ‘শুকরিয়া।’

আমরা চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম। ইমাম সাহেব লজ্জিত গলায় বললেন, ‘ভাই, বেয়াদবি নিবেন না-এতক্ষণ আপনাদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হলো। আসলে এখানে মসজিদের ভিতরে ছাড়া বসার ব্যবস্থা নেই। মসজিদের ভিতরে তো আবার অজু ছাড়া যাওয়া যায় না। ঘুম থেকে উঠলাম, অজু নেই।’

আমি ইমাম সাহেবের কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ অন্য একটা প্রসঙ্গ তুললাম, ‘ও, ভাল কথা, শুনলাম আপনার বশে নাকি কয়েকটা পোষা জিন আছে? আমাকে এক দিন জিন দেখাবেন।

ইমাম সাহেব কোনও জবাব দিলেন না। শুধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন।

তিন

সন্ধ্যা থেকে গ্রামের বাজারেই আমি।

চায়ের দোকানে বসে লোকজনদের চা-বিস্কিট খাইয়ে খাতির জমানোর চেষ্টা চালিয়েছি, কিন্তু লোকজন আমাকে তেমন পাত্তা দিল না। শহরের আধুনিক শিক্ষিত লোকদের কথা গ্রাম্য লোকজন মনোযোগ দিয়ে শোনে-মামার এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো। বরং গ্রামের লোকজন আমাকে ময়ূরের ঝাঁকে কাক ঢুকে পড়েছে সেই দৃষ্টিতে দেখছে।

এক বৃদ্ধ লোককে যখন আমার পরিচয় দিলাম সৈয়দ হালিম চৌধুরীর ভাগ্নে তখন লোকটা কেমন চোখ-মুখ শক্ত করে বললেন, ‘চেহারা-সুরত দেইখ্যা তো বোঝছেলাম শিঙ্কিত ঘরের ভালা পোলা, এহন দেহি হালিম মিয়ার ভাগ্নে!

বৃদ্ধের কথার মানে কী-সৈয়দ হালিম চৌধুরীর ভাগ্নে মানে খারাপ লোক। আজ এক দিনেই যা বুঝতে পারলাম তা হলো, গ্রামের লোকজন মামাকে তেমন ভাল চোখে দেখে না। মামাকে যারা সমর্থন করে, তাঁর মিটিং, মিছিল, সমাবেশে যোগ দেয় এর অধিকাংশই হচ্ছে উঠতি বয়সী গ্রাম্য বখাটে ছেলেছোকরা বা বদমায়েশ সুবিধাবাদী লোক।

বিভিন্ন চায়ের দোকানে ঘুরে-ঘুরে লোকজন পটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে, বাজারের ভিতরে মামার নির্বাচনী প্রচারণার অফিসে গিয়ে বসলাম।

মামার নির্বাচনী মার্কা হচ্ছে আনারস। অফিস ঘরের সমস্ত দেয়াল আনারস মার্কার পোস্টারে পোস্টারে সয়লাব। পোস্টারে বড়-সড় একটা আনারসের পাশে মামার পাঞ্জাবি-টুপি পরা হাসি হাসি মুখের ছবি।

অফিসের দায়িত্বে আছে চেংড়া ধরনের কয়েকটা ছেলে। ছেলেরা আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কীভাবে আমার খেদমত করবে। কেউ ছুটে যায় সিঙারা-পিঁয়াজু আনতে, কেউ যায় চা আনতে, কেউ আবার সিগারেট আনতে।

চেংড়াদের লিডারের নাম আবুল বাসার। আবুল বাসার শিক্ষিত ছেলে। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করে শুদ্ধ-অশুদ্ধ গুলিয়ে ফেলে। পর পর তিনবার এইচ.এস.সিতে ফেল করেছে। তার খুব ইচ্ছে পাশ করে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশুনা করা।

প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষে আবুল বাসার হাসি মুখে বলল, ‘ব্রাদার, ঢাকার বর্তমান হালচাল সম্পর্কে কিছু কন।’

আমি বললাম, ‘ঢাকা সম্পর্কে কী বলব? ঢাকা যেমন ছিল তেমনই আছে।’

‘না, শোনলাম ঢাকা নাকি আইজকাইল ফরেন হইয়া গেছে।’

‘কোন দিক দিয়ে?

‘না, শোনলাম…’ আমতা আমতা করে আবুল বাসার, ‘রাস্তাঘাটে মেয়েরা নাকি আইজকাইল ওড়না-টোড়না পরা বাদ দিছে। মিনি স্কার্ট, টাইড গেঞ্জি, সর্ড কামিজ পরে ওড়না-টোড়না ছাড়া বেহায়ার মত ঘুরে বেড়ায়। যারাও একটু-আরটু ওড়না পরে, তারা এক পাশ ঢাকে অন্য পাশ উদম করে রাখে। আর পার্কে পার্কে নাকি চলে খোলামেলা প্রেম।’

আমি হাই চেপে প্রসঙ্গ ঘুরাতে বললাম, ‘ঢাকায় কী হয় না হয় তা দিয়ে কোনও দরকার নেই। এখানকার পরিস্থিতি কী বলছে তাই বলুন? মামার সাপোর্টার কেমন? মামা কি ভোটে জিততে পারবেন?’

আবুল বাসার বিজয়ীর হাসি দিয়ে বলল, ‘ইনশাল্লাহ! ধইরা নেন আমরা হইয়া গেছি। আনারস মার্কা ছাড়া একটা ভোটও অন্য কিছুতে পড়বে না।’

ঠাণ্ডা মিয়ানো একটা পিঁয়াজু আর চা খেয়ে সিগারেট ধরালাম। বাজারের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাত মাত্র সাড়ে আটটা। আমার জ্যাকেটের পকেটে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। ঢাকা থেকে আমার বন্ধু আরিফ ফোন করেছে।

আরিফের সাথে কথা বলা শেষে মোবাইল ফোনটা পকেটের যথাস্থানে রাখতে গেলাম, তখন আবুল বাসার আমার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, ‘ব্রাদার, আপনার মোবাইলে কি কিছু নাই?’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কী থাকবে?’

আবুল বাসার ষড়ষন্ত্রকারীদের মত গলা নিচু করে বলল, ‘ব্রাদার, শুনেছি আইজকাইল সবার মোবাইলে নাকি নাটক-সিনেমার নায়িকাদের বিভিন্ন উল্টা-পাল্টা দৃশ্যের গোপন ভিডিও থাকে। তা আপনার মোবাইলে এই জাতীয় কিছু নাই?’

আমি বিরক্ত স্বরে বললাম, ‘না, নেই।’

আমার বিরক্তিভাব হয়তো আবুল বাসার বুঝতে পারল। এর পর কিছুক্ষণ সে চুপ মেরে রইল। আমিই আবার মুখ খুললাম, ‘দোকানপাট তো সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে, অফিস খুলে বসে থেকে আর লাভ কী?’

আবুল বাসার বলল, ‘তা, ব্রাদার, ঠিকই বলেছেন। বসে থেকে কোনও লাভ নাই। মেলা রাইত হইছে। আপনে আছেন বইলাই এতক্ষণ অফিস বন্ধ করি নাই। আপনের সাথে কথা কইয়া বহুত মজা পাইতেছি।’

অফিস বন্ধ করে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। আমার সাথে যথারীতি আমার সার্বক্ষণিক পাইকদার চান্দু মিয়া আর আবুল বাসার। আবুল বাসারের সাথের অন্যান্য ছেলেরা কিছুদূর আসার পর ভিন্ন রাস্তা ধরে চলে গেছে। তাদের বাড়ি গ্রামের অন্য পাশে। শুধু আবুল বাসারের বাড়িই মামার বাড়ির পাশে। কী আর করা, সারা পথের সফর সঙ্গী হলো দুষ্টমতি আবুল বাসার।

রাত মাত্র সাড়ে নয়টা। এরই মধ্যে সমস্ত গ্রামটা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ। শুধু গাছের পাতা থেকে পাতায় ঝরে পড়া শিশিরের টুপ-টুপ শব্দ আর মাঝে-মাঝে রাত জাগা পাখিদের ডানা ঝাপটানো এবং গা ছমছমানো বুলি।

আমরা তিনজন কথাবার্তা ছাড়াই নীরবে হেঁটে চলছি। খুব শীত পড়েছে। গায়ে দামি চামড়ার জ্যাকেট থাকতেও শীতের হিম যেন হাড় পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। আবুল বাসারের পরনে লুঙ্গি, গায়ে চাদর। মাথা, গলা, কান মাফলার দিয়ে ভালভাবে প্যাঁচানো। দুঃখ লাগল চান্দু মিয়ার কথা ভেবে। চান্দু মিয়ার পরনে শুধু সকালের পরা সেই বিবর্ণ পুরানো হাফহাতা শার্ট আর ময়লা লুঙ্গি। যথারীতি খালি-পা। তবে মাথা, গলা, কান একটা মাফলার দিয়ে প্যাঁচানো। চান্দু মিয়ার ভাবভঙ্গি নির্বিকার। সে যে শীতে কষ্ট পাচ্ছে তাকে দেখে তা মনে হচ্ছে না।

কিছু দূর যাওয়ার পর আবুল বাসার চাদরের নীচ থেকে একটা সস্তা সিগারেটের প্যাকেট বের করে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘ব্রাদার, গাঁজা ভরা কয়েকটা সিগারেট আছে, অভ্যাস থাকলে ধরান।’

আমি রাগান্বিত স্বরে বললাম, ‘না, ওসব হাবিজাবির অভ্যেস আমার নেই।’

আবুল বাসার একাই একটার পর একটা গাঁজা ভরা সিগারেট ধরিয়ে উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে, আয়েশি ভঙ্গিতে হেলেদুলে হাঁটতে থাকল।

চার

বাড়িতে পৌঁছাতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। মামা তখনও ফেরেননি। সন্ধ্যায় মামা গিয়েছেন উত্তর পাড়ায় সমাবেশ করতে।

বাড়িতে হুলস্থুল কাণ্ড। মামার চার মাস বয়সী ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনা এমন—ছোট মামী রাত পৌনে দশটার দিকে তাঁর শিশুপুত্রকে নিয়ে নিজের রুমে ঘুমাতে যান। মশারি খাটিয়ে, ঘুমন্ত ছেলেকে মশারির ভিতরে রেখে মামী রুমের সাথে লাগোয়া টয়লেটে যান। টয়লেট থেকে বের হওয়ার পর দেখতে পান বিছানায় তাঁর ছেলে নেই। রুমের দরজাও খোলা। মামীর স্পষ্টই মনে আছে, তিনি রুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

মামীর কথা যদি সত্যি হয়, অর্থাৎ তিনি যদি রুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করেই থাকেন, তা হলে ধরে নিতে হবে কেউ আগে থেকেই মামীর রুমের ভিতরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল। হয়তো খাটের নীচে বা আলমারির পিছনে। মামী যখন টয়লেটে ঢোকেন তখন সুযোগ বুঝে তাঁর ছেলেকে নিয়ে সটকে পড়ে। কিন্তু বাড়ি ভর্তি লোকজন, এর মধ্যে কেউ বাচ্চা চুরি করে পালিয়ে যাবে তা কারও চোখে পড়বে না এটা কেমন কথা!!!

মামা বাড়িতে ফেরার পর কিছুক্ষণ হম্বিতম্বি আর গলা ফাটিয়ে গর্জন করে কাজের লোকদের গালাগালি করে এক সময় মিয়ানো মুড়ির মত মিইয়ে যান। ধরা গলায় বলতে থাকেন, ‘আমাকে নির্বাচন থেকে সরানোর জন্য এটা কালা জাকিরের একটা চাল… ‘

কালা জাকির হচ্ছে মামার নিকটতম প্রতিপক্ষ। নিকটতম প্রতিপক্ষ বলছি এই জন্যে, মামার ধারণা, মামা যদি নির্বাচনে বিজয়ী হতে না পারেন, তা হলে কালা জাকির হবে।

ছেলে চুরি যাওয়ার পর থেকে ছোট মামী তীক্ষ্ণ স্বরে কাঁদতে-কাঁদতে একটু পর পর মূর্ছা যাচ্ছেন। মামার চোখও বারবার ভিজে উঠছে। আমি মামাকে সান্ত্বনা দিচ্ছি। মামার মত একজন ক্ষমতাবান দাপটশালী লোকের চোখে পানি দেখতে কেমন অন্য রকম লাগছে। কী আশ্চর্য ব্যাপার, সৃষ্টিকর্তা ধনী, গরিব, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান…সবার রক্তের রঙ যেমন লাল বানিয়েছেন তেমন সবার চোখের পানির রঙও একই করেছেন।

মামার ছেলের খোঁজে চারদিকে লোক বেরিয়ে পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে-বাচ্চা যে চুরি করেছে সে এখন পর্যন্ত গ্রামের সীমানার বাইরে যেতে পারেনি। ট্রলার ঘাটে, খেয়া ঘাটে লোক রাখা হয়েছে। যাতে ট্রলারযোগে বা নৌকাযোগে কেউ গ্রামের বাইরে না যেতে পারে।

মামা এক লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। যে তাঁর ছেলের খোঁজ এনে দিতে পারবে সে টাকাটা পাবে!

মামার নির্বাচনী অফিসের কর্তা লোক গাঁজাখোর আবুল বাসারকেও দেখলাম একটা কানা টর্চলাইট নিয়ে মামার ছেলেকে খুঁজতে বেরিয়েছে। টর্চলাইটটাকে কানা বলছি এই জন্যে-সেই টর্চলাইট দিয়ে যে আলো বেরুচ্ছে তাতে দৃষ্টিভ্রম হয়ে পথে হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আবুল বাসারের চোখ দুটো টকটকে লাল। কথাবার্তা জড়ানো। জড়ানো গলায় সে বলে গিয়েছে, ‘ব্রাদার, ইনশাল্লাহ বড় মিয়ার ছেলেকে আমিই খুঁজে পামু।’

রাত বেড়েছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। সরগরম পরিবেশ। বৈঠকখানায় মামা তাঁর ঘনিষ্ঠজন বন্ধুসম লোকজন নিয়ে বসে আছেন। মামার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তাঁর ডান হাত দবির বেপারীও উপস্থিত। মামা ছেলে হারানোর শোকে হা-হুতাশ করে যাচ্ছে। সবাই তাকে ভরসা দিচ্ছে। দবির বেপারী, ঘন ঘন মোবাইল ফোনে কাকে যেন নির্দেশ দিচ্ছে, কালা জাকিরের কান ধরে এখানে নিয়ে আসতে। স্বেচ্ছায় না আসতে চাইলে জোর করে নিয়ে আসতে।

দবির বেপারীসহ মামার সমস্ত ঘনিষ্ঠজনদের বদ্ধমূল ধারণা মামার ছেলে চুরি যাওয়ার পিছনে কালা জাকিরেরই হাত আছে। কালা জাকিরকে ধরে ঠিকমত প্যাদানি দিতে পারলে সব রহস্য বের হয়ে আসবে।

বিভিন্ন উড়ো খবর আসছে। দক্ষিণ পাড়ায় সন্দেহজনক এক লোক ধরা পড়েছে। খেয়াঘাটে অপরিচিতা সুন্দরী এক মহিলাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর আসে ট্রলারঘাট থেকে। বোরখা পরা এক মহিলাকে রাত সাড়ে দশটার দিকে ট্রলারযোগে বন্দরের দিকে যেতে দেখা গিয়েছে। মহিলার বোরখার নীচে কিছু বোধহয় লুকানোও ছিল। তৎক্ষণাৎ বন্দরের উদ্দেশে লোক পাঠানো হয়েছে সেই মহিলার খোঁজে।

বৈঠকখানার এক কোনায় বসে দবির বেপারী আর মামার ঘনিষ্ঠজনদের মামার ছেলে খুঁজে বের করার বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখা ছাড়া আমার আর কোনও কিছু করার নেই। আমি এখানকার অতিথি, পথঘাট ভাল করে চিনিও না। কোথাও খুঁজতে বের হব সেটা সম্ভব নয়। অবশ্য আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী চান্দু মিয়া আমার পাশেই আছে। তাকে নিয়ে কোথাও যাওয়া যায়। কোথাও যেতে আমার ইচ্ছে করছে না। শরীর কেমন বিবশ লাগছে। আজ সারাদিন অনেক হেঁটেছি। আমি শহুরে ছেলে, জীবদ্দশায় এমন ম্যারাথন হাঁটাহাঁটি আর হয়নি। প্রচণ্ড খিদেও পেয়েছে। বাড়ির এমন পরিস্থিতিতে খেতে বসা যায় না। কী আশ্চর্য ব্যাপার, সব পরিস্থিতিতেই মানুষের ক্ষুধা- তৃষ্ণা লাগে! খুব নিকটজন কেউ মারা গেলেও আমরা কিছুক্ষণ কেঁদেকেটে খেতে বসি। ক্ষুধা তখন আরও বেশি পায়। কাঁদলে চোখের জলের সাথে শরীর থেকে প্রচুর প্রোটিন বেরিয়ে যায়। তাই শরীর ঘাটতি প্রোটিন পূরণের জন্য তখন খাবার চায়।

বৈঠকখানা থেকে বাইরে বের হলাম সিগারেট ধরানোর জন্য। আমার পিছনে পিছনে চান্দু মিয়াও বের হলো। আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকার যে দায়িত্ব চান্দু মিয়াকে দেয়া হয়েছে তা সে নিষ্ঠার সাথে পালন করছে।

টানা বারান্দার একেবারে দক্ষিণ মাথায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সিগারেট ধরিয়ে দু-তিনটা টান দিয়ে দেখি কেমন গা গুলাচ্ছে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে সিগারেট খেতে চাইলে সাধারণত এমনই হয়।

আমার ছায়াসঙ্গী চান্দু মিয়া বলল, ‘ভাইজান, চলেন ইমামসাবের কাছে যাই।’

আমি সিগারেট ফেলে দিয়ে গলায় বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘এত রাতে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে কী হবে?’

‘ইমাম সাব জিনেরে দিয়া বড় মিয়ার পোলার খোঁজ কইতে পারবে।

চান্দু মিয়ার প্রস্তাবটা খারাপ লাগল না। এটা স্বীকার করতেই হবে সত্যিই ইমাম সাহেব লোকটার চেহারার মাঝে কেমন আধ্যাত্মিক নূরানী ছাপ আছে। এমন চেহারার লোক দেখলে যে কোনও মানুষেরই মনে হতে পারে, লোকটার মাঝে কোনও অলৌকিক ক্ষমতা থাকলেও থাকতে পারে। আমার মনের গভীরেও খানিকটা কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। কৌতূহল মেটানোর এটা একটা মোক্ষম সময়।

পাঁচ

মসজিদে পৌঁছে অবাক হলাম।

ইমাম সাহেব খিচুড়ি রান্না করে, পিঁয়াজ-কাঁচা মরিচ কুচানো দিয়ে ডিম ফেটে রেখে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা আসার পর ডিম ভেজে আমাদের নিয়ে খেতে বসবেন। ইমাম সাহেব কী করে বুঝলেন এত রাতে আমি আর চান্দু মিয়া ক্ষুধা পেটে তাঁর কাছে আসব?! তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু কোনও সদুত্তর পেলাম না।

তিনি স্টোভে ডিম ভাজতে ভাজতে কোমল গলায় বললেন, ‘আল্লাহপাক আজ রাতে আপনাদের দু’জনার রিজিক আমার সাথে লিখেছেন। তাই আমি আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করেছি আর আপনারাও এসেছেন।’

মসজিদের ভিতরেই আমরা গোল হয়ে খেতে বসেছি। ঝাল-ঝাল খিচুড়ি, গরম ডিম ভাজা দিয়ে খেতে খুবই ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে যেন স্বর্গীয় খাবার খাচ্ছি। এমন সুস্বাদু খাবার বোধহয় আমি আর জীবনেও খাইনি। অথচ খুবই সাধারণ দ্রব্য দিয়ে খিচুড়ি রান্না করা হয়েছে। খুব সম্ভব মুগ, মসুর, দুই-তিন প্রকারের ডালের সাথে ছোট-ছোট টুকরো করে কাটা আলু আর যা যা প্রয়োজন—চাল, পিয়াজ, রসুন, হলুদ, লবণ, গরম মসল্লা…এসব দিয়েই খুব সাধারণ ভাবে রান্না খিচুড়ি। অতিরিক্ত শুধু বোম্বাই মরিচ। বোম্বাই মরিচের ঝাঁজ-ঝাঁজ ঘ্রাণ আর ঝাল পাওয়া যাচ্ছে। বোম্বাই মরিচের ঝাল শীতের রাতে শরীর গরম করে দিচ্ছে।

খিচুড়ি খাওয়া শেষ হতেই ইমাম সাহেব ছুটে বাইরে গেলেন। একটু পর ফজলি আমের মত বড় সাইজের একটা পাকা আম হাতে ভিতরে ঢুকলেন। আমটার রঙ সিঁদুরে লাল।

আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই অসময়ে আম পেলেন কোথায়? এখন তো আমের সিজন না।

ইমাম সাহেব কোনও উত্তর না দিয়ে রহস্যময় স্নিগ্ধ হাসি দিলেন। তারপর বটি দিয়ে আমটা কাটতে লাগলেন।

আমার বিস্ময় আকাশ ছুঁয়ে গেল, যখন দেখলাম আমের খোসা ছেলার পর আমের ভিতরটা টুকটুকে লাল। সাধারণত পাকা আমের রঙ হয় হলুদ। এমন লাল রঙের আম আমি জীবনেও দেখিনি। আগে আমি এমন আম দেখেছি যে আমের খোসা সিঁদুরে লাল, কিন্তু ভিতরে ঠিকই হলুদ। আমের ভিতরটা অমন টুকটুকে লাল জীবনে এই প্রথম দেখলাম।

ইমাম সাহেব আমের একটা বড় টুকরো আমাকে দিলেন, টুকটুকে লাল রঙের আম হাতে নিয়ে প্রথমে কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে আমের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এরপরে মুখে দিয়ে দেখি মধুর মত মিষ্টি। স্বাদ যেমন, মিষ্টি ও তেমন, মন মাতানো মিষ্টি গন্ধ। নরম মাখনের মত মুখের ভিতরে যেন গলে- গলে যাচ্ছে।.

ইমাম সাহেব চান্দু মিয়াকেও আমের টুকরো দিলেন। নিজেও একটা টুকরো মুখে নিলেন। এবং খাওয়া শেষে গলায় অনেকখানি তৃপ্তি নিয়ে বললেন, ‘শুকুর আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে আমটা খুবই মিষ্টি।’

আম কাটার এক পর্যায়ে আরও আশ্চর্য হলাম। আমের কোনও বিচি নেই!!! চান্দু মিয়াকে দেখলাম-সে নির্বিকার। সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই আম খাচ্ছে। চান্দু মিয়ার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, ইমাম সাহেবের আমের রঙ তো এমনই লাল হবে! বিচি ছাড়া হবে! এটাই স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!

খাওয়া শেষ হতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে যেতে চাইল। চান্দু মিয়ারও দেখি একই অবস্থা। সে মসজিদের ডান পাশে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। তাই দেখে ইমাম সাহেব বললেন, ‘মসজিদের ডান দিকে শোয়া উচিত নয়, বাম দিকে শুতে হয়।’

ইমাম সাহেব বালিশ আর কাঁথা এনে দিলেন। চান্দু মিয়া, ইমাম সাহেবের নির্দেশ মত মসজিদের বাম দিকে গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়ল। ভারী শ্বাস নিতে লাগল।

মসজিদের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ, বাইরের ঠাণ্ডা ভিতরে ঢুকতে পারছে না। মেঝেতে সস্তা দরের পাটের কার্পেট বিছানো। সব মিলিয়ে এই শীতের রাতে মসজিদের ভিতরটা ঘুমানোর জন্য যথেষ্টই আরামপ্রদ।

আমি ঘুম জড়ানো গলায় হাই চাপতে চাপতে ইমাম সাহেবকে বললাম, ‘আপনার কাছে মূলত যে জন্যে এসেছিলাম, সেই প্রসঙ্গ তো তোলাই হলো না।’

ইমাম সাহেব আমার চোখে চোখ রেখে থমথমে গলায় বললেন, ‘আপনার মামার ছেলের খোঁজ জানতে তো?’ কিছুক্ষণ চুপচাপ পলকহীন থেকে, ‘আর সত্যিই আমার কোনও ক্ষমতা আছে কিনা সেটা দেখতে তো?’ আমার চোখ থেকে চোখ নামিয়ে, ‘অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ন। আল্লাহতায়ালা রাত দিয়েছেন ঘুমানোর জন্য।’ একটু থেমে গলায় কেমন রহস্যময় গাম্ভীর্য এনে, ‘হয়তো ঘুমের মধ্যেই আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।’

কথা শেষ করেই ইমাম সাহেব কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমিও ইমাম সাহেবের কাছ থেকে কিছুটা দূরে শুয়ে পড়লাম। সম্ভবত শোবার সাথে সাথেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম এবং সেই সাথে দেখতে শুরু করলাম একটা জীবন্ত স্বপ্ন।

স্বপ্নে ছোট মামীকে দেখছি। ছোট মামীর চিন্তা চেতনাগুলো আমি যেন সব স্পষ্ট বুঝতে পারছি। ছোট মামী সারাক্ষণ শুধু কাঁদেন, তাঁর কোলের দুধের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে কাঁদেন। বাচ্চাটাকে তিনি প্রচণ্ড ঘৃণা করেন। তাঁর মনের ভিতরে প্রতিহিংসার জন্ম দিয়েছে ওই বাচ্চা। কারণ এই বাচ্চা তাঁর ভালবাসার ফসল নয়, তাঁর ঘৃণার ফসল।

ছোট মামীর মনে অনেক দুঃখ। বিয়ের আগে তিনি রূপবান এক যুবকের সাথে প্রেম করতেন। মনের ভিতরে তখন কত রঙিন স্বপ্ন। একদিন তারা দুজনে মিলে ঘর বাঁধবে, ভালবাসার রঙিন স্বপ্নগুলো বাস্তবে ধরা দেবে, তাদের ফুটফুটে একটা বাচ্চা হবে…দু’জনার অভিভাবকদেরও সেই বিয়েতে সম্মতি ছিল। হঠাৎ একদিন প্রতাপশালী বয়স্ক হালিম মিয়া লোকজন দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে বিয়ে করেন। রঙিন স্বপ্নগুলো ভেঙেচুরে পথের ধুলোয় মিশে যায়।

হালিম মিয়ার আরও তিন স্ত্রী আছে। তাঁর কোনও ছেলে সন্তান নেই। তিনি একটি ছেলের জন্য মরিয়া হয়ে আছেন। সময়ের স্রোতে এক সময় ছোট মামী একটা ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। হালিম মিয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়।

হালিম মিয়া তো ছেলে পেয়ে খুশিতে আটখানা। আর ছোট মামীর মনে মাথা চাড়া দেয়-এই তো প্রতিশোধ নেয়ার যোগ্য জিনিস। ছোট মামী ভাবেন, হালিম মিয়া তাঁর জীবনের সমস্ত সুখ-আনন্দ কেড়ে নিয়েছে, তাকেও তিনি সুখে থাকতে দেবেন না। বুড়ো হাবড়াটা কম বয়সী স্ত্রী আর ছেলে নিয়ে সুখে জীবন কাটাবে তা হতে পারে না। প্রতিশোধ নিতে হবে-প্রতিশোধ। সারাক্ষণ মাথার ভিতরে ভন-ভন করে প্রতিশোধ।

ছোট মামী সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। এক সময় তাঁর সুযোগ এসে যায়। হালিম মিয়া দিন-রাত ব্যস্ত থাকেন নির্বাচনের প্রচারণায়। এই তো অঘটন ঘটানোর সঠিক সময়।

হালিম মিয়ার জগতের সবচেয়ে প্রিয়জন তাঁর চার মাসের শিশুপুত্রকে ছোট মামী রাতের আঁধারে সবার অগোচরে, বাড়ির সামনের বড় পুকুরটায় ফেলে আসেন। তিনিই কিন্তু শিশুটির মা! কিন্তু তাতে তাঁর হাত একটুও কাঁপেনি। তিনি স্বীকার করেন না এই শিশুটির মা তিনি। শিশুটি শুধুই হালিম মিয়ার। হালিম মিয়া তাঁকে শিশুটির মা হতে বাধ্য করেছিলেন। তাঁর জীবনের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন ওই পাষণ্ড হালিম মিয়া। আজ তিনি প্রতিশোধ নিতে পেরেছেন। হালিম মিয়ার সবচেয়ে প্রিয়জনকে আজ তিনি মেরে ফেলেছেন। সামান্য হলেও মনে শান্তি লাগছে। তাঁর নিজেরও বেঁচে থাকার কোনও ইচ্ছে নেই। বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে গেছে সেই কবে। শুধু আজকের এই দিনটার জন্যই এত দিন ধরে অপেক্ষা। প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে, এখন করবেন আত্মহত্যা!

স্বপ্নের এর পরের অংশ আমি যা বাস্তবেই দেখেছিলাম তাই। নিজের রুম থেকে ছেলে চুরি যাওয়ার ছোট মামীর মিথ্যে নাটক। ছোট মামীর কান্নাকাটি আর মূর্ছা যাওয়ার অভিনয়। মামার রাগারাগি, হম্বিতম্বি, হা- হুতাশ। মামার এক লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা। চুরি যাওয়া ছেলেকে খুঁজতে দলে-দলে লোকজন বের হওয়া। খেয়াঘাটে-ট্রলারঘাটে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। কালা জাকিরকে সন্দেহ…

পরিশিষ্ট

মামার শত আদরের ধন তাঁর শিশুপুত্রের ভাসমান লাশ পাওয়া যায় বাড়ির সামনের বড় পুকুরের মাঝে। পুত্রের মৃত্যু শোকে মামা একেবারে ভেঙে পড়েন। সেই শোক সামলাতে না সামলাতে তিন দিনের মাথায় ছোট মামী ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। সবাই মনে করে ছোট মামী আত্মহত্যা করেছেন পুত্রের শোকে। নির্বাচনেও মামার ভরাডুবি হয়। বিপুল ব্যবধানে মামা হেরে যান। গ্রামের একটা সাধারণ লোকও মামাকে ভোট দেয় না। কালা জাকিরও নির্বাচনে জয়ী হতে পারে না। নির্বাচনে জয়ী হন মকবুল মাস্টার নামে এক লোক। অত্যন্ত সাদাসিধা ভাল মানুষ তিনি। তাঁর চেয়েও বড় কথা, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আর আমার মামা হচ্ছেন একাত্তরের রাজাকার।

আমার খুব ভাল লাগছে এই ভেবে-মামাদের গ্রামের অশিক্ষিত সহজ- সরল লোকরাও আজ একাত্তরের রাজাকারকে প্রত্যাখ্যান করে একজন মুক্তিযোদ্ধার যোগ্য সম্মান দিতে শিখেছে। এমন এক দিন আসবে এই গ্রামের মত, যেদিন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হবে।

যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায়ও মামার নাম উঠেছে। আমার আপন মামা-এর পরেও আমি মনে-প্রাণে চাই, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মামার যেন উপযুক্ত শাস্তি হয়। ভেবে অবাক লাগে, আমাদের দেশের বড়-বড় রাজনৈতিক দল কীভাবে তাদের ছত্রছায়ায় একাত্তরের ঘাতক রাজাকার আলবদর, আলশামসদের মত যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয় দেয়! যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির জন্য তারা মিটিং-মিছিল-হরতাল ডাকে। সেই সব রাজনীতিবিদদের কি দেশের জন্য কোনও দায়িত্ববোধ, সম্মানবোধ, ভালবাসা নেই??? দেশকে যারা ভালবাসে না, তাদের রাজনীতি করার কোনও অধিকার নেই। ষোলো কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার কোনও যোগ্যতাই তাদের নেই। ওই সব মুখোশধারী রাজনীতিবিদদের অবশ্যই একদিন এ-দেশের জনগণ টেনে- হিচড়ে তাদের অবস্থান থেকে হটিয়ে দেবে।

সেই রাতে ইমাম সাহেবের খাওয়ানো বিচিবিহীন টুকটুকে লাল রঙের আমের কথা অনেককেই বলেছি। সবাই-ই শুনে প্রচণ্ড অবাক হয়েছে। আমি আর চান্দু মিয়া ছাড়া চেনাজানা আর কাউকেই এখন পর্যন্ত পেলাম না, যার ভাগ্যে অমন আম খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে।

আমাদের ভার্সিটির বোটানি বিভাগের চেয়ারম্যান স্যরকেও সেই আম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। স্যর রাগান্বিত স্বরে বলেছেন, ‘আমার সাথে এ ধরনের সস্তা রসিকতা আর কখনও করবে না। আমি তোমার বন্ধু বা ইয়ারমেট নই। বিচিবিহীন, টুকটুকে লাল রঙের আবার আম হয় নাকি!’

আমার পরিচিত এক বড় ভাই মুহম্মদ পারভেজ মুন্না। সংক্ষেপে মুন্না ভাই। অসংখ্য বই পড়ার জ্ঞান যাঁর রয়েছে। তাঁকেও আমটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। সব শুনে তিনি বললেন, ‘ইমাম সাহেব সেই রাতে তোমাকে এবং চান্দু মিয়াকে হিপনোটাইজ করেছিলেন। হিপনোটাইজড অবস্থায় হিপনোটিস্ট যে ধরনের হিপনোটিক সাজেশন দেয় তাই সত্যি মনে হয়। হিপনোটিস্ট যদি এক মুঠ কাদা মাটিও হাতে দিয়ে হিপনোটিক সাজেশন দেয়-এটা আমের মত দেখাচ্ছে, এটার রঙ টুকটুকে লাল, এটা খেতে খুব মিষ্টি, তখন সেটাই মনে হবে।

আমি মুন্না ভাইয়ের যুক্তিটা মন থেকে মানতে পারলাম না। এর পরেও যুক্তি খণ্ডনের দিকে না গিয়ে বললাম, ‘তা হলে স্বপ্নের ব্যাপারটা! স্বপ্নে আমি কীভাবে আসল তথ্য জানলাম?’

মুন্না ভাই মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, ‘ইমাম সাহেব বোধহয় উচ্চ ক্ষমতার টেলিপ্যাথির মাধ্যমে তাঁর জানা তথ্য তোমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *